আপাই
ওঁ ভগবতেঃ বাসুদেবায় নমঃ
যেহেতু এই ভয়ংকর ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে, সেহেতু আমি আমাদের দলের সবার নিজস্ব নাম পদবীই লিখলুম। শুধু পুরুলিয়া সদর দপ্তরের বড়কর্তার অনুরােধে ওই গ্রামের আক্রান্ত মানুষগুলাের নাম আর পদবী পরিবর্তিত করে দিয়েছি। তাদের সত্যকারের নাম ধাম জেনে তােমাদের তেমন কোন কাজ নেই, কিন্তু এই যাত্রায় আমার যা হাড়ে কাঁপুনি ধরানাে অভিজ্ঞতা হয়েছিলাে, তেমনটি আর কারুর কোনােদিনও হবে না। আজ এই অতি বৃদ্ধ বয়সেও সে ঘটনা স্মরণ করলে আমার গায়ে কাঁটা দেয়। তােমরা সেই রায়দীঘড়ার ডাকসাইটে কালীগুণীনের কথা তাে অনেক শুনেছো। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ কিন্তু এই ঘটনাতেই। এই গল্প হল কালীপদ মুখুজ্জেরও যিনি গুরুদেব, সেই পিশাচসিদ্ধ শ্রী হংসী তান্ত্রিককে নিয়ে। এই গল্পে তাঁর উল্লেখ বা উপস্থিতি খুব কমই রয়েছে, কিন্তু তাঁর ভূমিকাটি কিন্তু কম নয়। একজন মহা শক্তিমান তন্ত্রসাধক কেমন ভাবে দেশের দশের প্রাণ রক্ষার্থে হাসতে হাসতে নিজের প্রাণ দিয়েছিলেন সেই কথা আজ তােমাদের বলতে চলেছি। মন দিয়ে শােননা। যে ঘটনার কথা আজকে বলতে চলেছি, সেটি দেওয়াল ক্যালেন্ডারের নিরিখে খুব প্রাচীনকালের কথা না হলেও, তখন আমি সদ্য যুবক। তখনকার কলিকাতার সাথে বর্তমান কলিকাতা শহরের জীবনযাত্রার পার্থক্য সামান্যই, কিন্তু তৎকালীন গ্রামবাংলার সঙ্গে এখনকার পল্লী অঞ্চলের তফাৎ ছিল আকাশ আর পাতালের। ঘটনাটা বলার আগে তখনকার গ্রামবাংলার জীবনযাপনের একটা ছােটো বর্ণনা দিয়ে রাখছি। তােমরা বিরক্ত হবে জানি, কিন্তু সে সময়ের ঘুটঘুটে অন্ধকারে গ্রামের ছমছমে আর চাপা আতঙ্কের পরিবেশের মধ্যে না ঢুকলে তােমরা এই ভয়টুকুর সাথে একাত্ম হতে পারবে না। এখন তােমরা তেমন আঁধার মাখা গ্রামগঞ্জ চোখেই দেখ না, তাে বুঝবে কি। তখন গ্রামাঞ্চলের ঘরে ঘরে এখনকার মতাে বিজলীবাতি পৌছায়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাস্তাঘাট বলতে ছিল পায়ে হাঁটা কাঁচা মেঠো পথ, তাও আবার বড় বড় ঝুপসী গাছের ছাউনিতে ঢাকা। একেকটা বাড়িঘর থাকত অনেকখানি জমি জায়গা দখল করে। ফলে সেগুলির মধ্যে দূরত্ব হত অনেকখানি। পল্লীবাসীরা রাত্তিরে যাতায়াত করতাে টিনের কেরােসিন কুপি বা নিদেনপক্ষে হাত-লণ্ঠন নিয়ে। হ্যারিকেন বা টর্চ বাতি থাকতাে কেবলমাত্র সেইসব বাড়িগুলিতে যাদের আর্থিক উপার্জন মাস গেলে অন্ততঃ দুশােটি টাকা। পূর্ণিমার রাত্তিরে যখন রাস্তাঘাট, বাড়ির দাওয়া ধুয়ে যেত চাঁদের রােশনাইতে, তখন লােকের মনে থাকতাে খুব আহ্লাদ। তাঁরা দল বেঁধে পথেঘাটে হেঁটে হেঁটে সুখ দুঃখের গল্প করতাে, তাস পাশা খেলত, গুড় মেশানাে চা খেতাে আর উঠানের ওপর পরিবারের সক্কলে বসে মাদুর পেতে আড্ডা দিতে। কিন্তু…
অমাবস্যার রাত্তিরে সেই গ্রামেরই চেহারা যেত পাল্টে। সেই অপয়া মিশকালাে আঁধারে বড়াে সহজে কেউ ঘর থেকে বের হতাে না। যদিও বা হতাে, সঙ্গে থাকতাে আগুনের আলাে। বাইরে থেকে কেউ কারুকে ডাকতে এলে, নিদেনপক্ষে তিন চারবার নাম ধরে না ডাকলে কেউ সাড়া দিতাে না। আজকের যুগে এই নিশির ডাকের কথা তােমাদের হয়তাে বিশ্বাস করবার কথা নয়, কিন্তু বাড়ির বয়স্ক মানুষদের জিজ্ঞেস করে দেখাে, তারা এসব ফাঁদ ভালােভাবেই জানেন এবং বােঝেন। তােমরা তাে আর নিশিভুলাের ডাকের আতঙ্ক ঠিক কতখানি হতে পারে তা নিজের চোখে দেখনি, তাই বুঝবেও না, কিন্তু আমি রাতের পর রাত নিজের চোখে ভুলাের শয়তানি আর ভুলিয়ে ভালিয়ে শিকার ধরা প্রত্যক্ষ করেছি। সে কথা তােমাদের আরেকদিন বলবাে’খন। সে আরেক ভয়ানক ব্যাপার। শুনলে তােমাদের গা শিউরে উঠবে। তবে এইবেলা একটা কথা কয়ে রাখা ভালাে, তােমরা শহরে থাকো বলে খুব বেশি আশ্বাস পাবার তেমন কোনও কারণ কিন্তু নেই। একটা জিনিস জেনে রেখাে, নিশি কিন্তু শহরেও ডাকে। শুধু নিশুত রাতেই নয়, নিঝুম দুপুরেও। শহর যখন ঘুমিয়ে পড়ে, পথঘাট যখন নিরালা হয়, তখন তারা জাগে। ওৎ পেতে থাকে তােমার অন্যমনস্ক হবার সুযােগের অপেক্ষায়। যখন হয়তাে তুমি নিশ্চিন্দি চিত্তে গল্পের বই পড়চ, সেই অসতর্ক মুহূর্তে তােমার বাড়ির দুয়ার, তােমার জানালার কার্নিশে তারা অপেক্ষা করে মনের মতাে শিকারের।
আসলে এদের নিয়ে ভয়টাও ঠিক অমূলক নয়, কারণ এই ধরনের দুর্ঘটনার ভুরি ভুরি উদাহরণ বহু লােক নিজের চোখেই দেখেচে। তখন পঁচিশ ত্রিশ ঘর পরিবার নিয়ে বাড়ির কাছাকাছি তৈরি হতাে শ্মশান। সেখানেই কাছাকাছি দাহকার্য আর পুস্করা বিধি সম্পন্ন হত ঐ পরিবারগুলির। পুস্করা কাকে বলে জানাে? কোনও কোনও তিথিতে মানুষ মারা গেলে তার মৃতদেহটা দোষ পায়। ফলে তার আত্মার মুক্তি তাে হয়ই না, বরং তাঁরা রাতবিরেতে নানান ক্ষতি করে বেড়ায়। সেই দোষ কাটাবার একটা ভয়ঙ্কর উপায়ের নাম হল পুস্করা। সে সময়ে গ্রামবাসীদের মনে থাকত ভূত প্রেত, আর দানাের সম্বন্ধে অগাধ বিশ্বাস। অবশ্য তার ঢের কারণও ছিল।
সে কথা যাক, যে সময়ের কথা আমি বলচি সে সময়ে আমরা সদ্য যুবক। সেবারে আমার বন্ধু শরতের একগুঁয়েমি জেদ আর দুঃসাহসের জন্যে আমরা যে কঁাচাখেগাে অশরীরী দানাের খপ্পরে গিয়ে পড়েছিলাম, তার সঙ্গে আমি একমাত্র সাদৃশ্য পেয়েছি গল্পের বইতে পড়া কুমায়ুনের এক কুখ্যাত চিতাবাঘের। একখানা জীয়ন্ত প্রাণীর সাথে একটা মৃত অশরীরীর এই উদাহরণের যথেষ্ট কারণও আছে বৈকি। কুমায়ুনের গল্পের সেই কুখ্যাত চিতা নাকি নিঃশব্দে এসে মানুষকে তুলে নিয়ে যেত, পাশের লোক টেরও পেত না। তার চলাফেরা ছিল নিঃসাড় এবং আকস্মিক। সেই পাহাড়ের বেশিরভাগ বাসিন্দাই তাকে চিতা বলে মনে করত না। ভাবত কোন মৃত দুষ্ট আত্মা। বহু বচ্ছর ধরে দশ বিশখানা গাঁ মিলিয়ে সে তার তাণ্ডব চালিয়ে গিয়েছিলাে। অবশেষে বিখ্যাত পশুপ্রেমী ও শিকারি স্যার জিম করবেট সেবারে সেই ‘নকল প্রেতাত্মাকে’ বন্দুকের গুলিতে নিধন করে গ্রামবাসী ও তীর্থযাত্রীদের নিষ্কৃতি দিয়েছিলেন, এ কথা প্রায় সব্বাই জানেন।
আমরা এই নরখাদক ‘আসল প্রেতাত্মার’ কি করলাম, সেই কথাই আজ তােমাদের বলব।
যে দিনের কথা দিয়ে শুরু করচি, সেই রাত্তিরে কুষ্টিয়া মুর্মূ আর ওর বউ বাড়ির পিছনের ঘরটায় ঘুমুচ্চিতলা। আর ওদের দুই মেয়ে আর ছেলেটা ঘুমুচ্চিলাে পূবের ঘরে। ঐ ঘরের জানলার পাশেই সেই কঁচা বেড়ার গােয়ালঘরটা, যেখানে প্রথম উৎপাতটা শুরু হয়।
কিছু না হােক, চার চারটে দুধেল গাই আর গােটা তিনেক ছাগল রয়েছে ওদের। চোর ছাচোর এ গ্রামে তেমন একটা নেই বটে, কিন্তু শিয়াল আর বুনাে কুকুর রয়েছে বড্ড বেশি। তাই কুষ্টিয়া শহর থেকে কুকুর এনে পুষেচে। বেজায় তেজী কুকুর। নাম ‘বুধি’। সেটা আবার গােয়ালঘরের আগলের মধ্যেই রাত্তিরে ছাড়া থাকে আর মাঝেমাঝে ভুক-ভুক আওয়াজ করে নিজের অস্তিত্ব জানান দেয়।
তিন ভাইবােনের মধ্যে বড় মেয়ে ললিতাই ব্যাপারটা প্রথম টের পেলাে আর ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাে। ঠিক কিসের জন্যে ঘুমটা ভাঙলাে তা ধরা গেল না বটে, কিন্তু কিছু একটার আওয়াজ নিশ্চয়ই হয়েছে এবং হয়েছে যথেষ্ট জোরে, নাহলে তার গাঢ় ঘুম এ ভাবে কক্ষনাে ভাঙতােই না। এখনও কানের মধ্যে সেই আওয়াজটার অনুভূতি হয়ে চলেছে। সেই সঙ্গে গােয়ালের পশুগুলাের পা দাপানাের ধুপধাপ, আর ভয় পাওয়া গলার চাপা কোলাহল। ঠিক যেমনটি ওরা সাপ টাপ দেখলে করে থাকে আর কি। কেরােসিনের কুপির দিকে তাকিয়ে ললিতা দেখল সেটা তেলের অভাবে খাবি খাচ্চে। তার মানে আন্দাজ প্রায় মাঝরাত্তির।
এ কথা সে কথা ভাবতে ভাবতে আবার শুতে যাচ্ছিলাে, এমন সময় আরেকটা ব্যাপার কানে আসায় তার আর শােয়া হলােনা। এমনিতেই সেই বিকাল থেকে একনাগাড়ে তুমুল বৃষ্টি পড়ে চলেছে। এটা অকালবর্ষণ, কারণ এ সময়টা বৃষ্টিবাদল হবার কথা নয়। টিনের চালের ওপর একঘেয়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার ঝমঝম আর সঙ্গে বয়ে চলা ঝােড়াে হাওয়ার সাঁই সাঁই শব্দগুলাে যদিও ঘুমে ব্যাঘাত করা তাে দূর, উল্টে ঘুমপাড়ানি গানেরই কাজ করে, কিন্তু সেই অবিশ্রান্ত ধারাপাতকে ছাপিয়ে কানে এল পুরােপুরি অন্যরকম একটা আওয়াজ। অস্পষ্ট, কিন্তু ঘ্যাঁসঘ্যাঁসে ধরনের। বঁটিতে সবজি কাটার সময় যেমন শব্দ হয়, অনেকটা সেইরকম।
ললিতার শরীর শক্ত হয়ে উঠলাে। তবে কি কোনাে পশু গােয়ালঘরের বেড়া আঁচড়াচ্চে? নিশ্চয়ই শিয়াল বা বুনাে কুত্তাই হবে। তাহলে বুধি গেল কোথা? ঘুমাবার বা লুকিয়ে থাকার কুকুর সে আদপেই নয়। পা টিপে টিপে উঠে, কেরােসিনের কুপি আর চালের ডিবের উপর থেকে লম্বা হাঁসুয়াটা তুলে নিয়ে, খুব আস্তে দরজা খুলে বাইরে পা রেখেই, প্রথম অস্বস্তির অনুভূতিটা টের পেলাে ললিতা।
এই অনুভূতি ঠিক লেখার অক্ষরে বােঝানাে যায় না। কোথাও যেন কিছু একটা অস্বাভাবিক হচ্চে, যেটা হবার কথা নয়। কোনও একটা খুব ভয়ের ব্যাপার যেন কাছেপিঠেই কোথাও ওৎ পেতে লুকিয়ে রয়েচে, লক্ষ্য করচে। সেই সঙ্গে বাতাসে একটা পােড়া পােড়া মতাে বিশ্রী উগ্র গন্ধ। কিন্তু ললিতা শহরের মেয়ে নয়। গ্রামের কঠোর আর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা মেয়েদের একজন। হাঁসুয়াটা বাগিয়ে ধরে, গােয়ালের দরজার সামনে এগােতে গিয়েই বুধির নরম শরীরে তার পা’টা ঠোক্কর খেল। অবাক হয়ে সে দেখলে, স্থির, ভয় মাখা চোখে গােয়ালের দিকে তাকিয়ে কুকুর মরে রয়েছে। অমন তেজী কুকুরখানাকে কে বা কারা যেন তীব্র আক্রোশে গলা টিপে মেরেচে। গলার কণ্ঠনালির কাছটা খাবলানাে, আর পিছনের পা জোড়া টেনে ছিড়ে ফেলা হয়েছে। এ তাে কোনােভাবেই একটা পশুর কাজ হতে পারে না। তবে কি চোর পড়লাে? তাহলে এই অসহায় জীবটার শেষ মরণ আর্তনাদেই তার ঘুমটা ভেঙেচিলাে। ললিতার আঙুলগুলাে হাঁসুয়ার বাঁটে কামড়ে বসলাে। আঁচলটা কোমরে ঘুরিয়ে বেঁধে, মাথার চুল কে ঘাড়খোঁপা করে নিয়ে, ঝড়ের বেগে দৌড়ে গােয়ালের ভিতরে ঢুকে পড়ল সে, আর ঢুকেই যা চোখে পড়লাে, তাতে সে হতবুদ্ধির মতাে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাে। শিথিল হয়ে যাওয়া হাত থেকে হাঁসুয়া আর কুপিটা পড়ে গেল।
তেলের বাতির নিভু নিভু দপদপ করা শেষ আলােতে দেখা গেল, গরু বাছুরগুলাে আতঙ্ক মাখা চোখে গােয়ালের উত্তর কোণায় তাকিয়ে রয়েছে। তার ঠিক সামনে তাদের নতুন বাচ্চা ছাগলটার অর্ধেক ধড় পড়ে আছে। মাথার দিকটা। আর বাকি অর্ধেকটাকে লােমশ হাতে আঁকড়ে ধরে সশব্দে ডেলা ডেলা মাংস ছিড়ে খাচ্চে, সাদা ধোঁয়াটে আকৃতির এক বিশাল জন্তু। মেয়ে মানুষের মতাে আকৃতি, কিন্তু ধোঁয়া ধোঁয়া। সারা দেহের হাড় মাংস সব ঝলসানাে। চোখদুটো কয়লার ভাটির মতাে জ্বলচে। ঝকঝকে দাঁতের পাটি কামড়ে বসেচে ছাগলটার দাবনা’তে। গােটা ঘরটা পােড়া গন্ধে ভর্তি। হাতের থেকে হাঁসুয়াটা পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়ে, ঘাড় তুলে তাকালাে প্রেতমূর্তিটা। চোয়াল থেকে বেরিয়ে আসা চারটে কুকুর-দাঁত ঝিকিয়ে উঠল।
ছাগলের বাকি আধখাওয়া দেহটা তুলে ললিতার গায়ে সজোরে ছুঁড়ে মেরে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে ‘হাআআআআআআ করে চিৎকার করে উঠলাে, আর সেই অমানুষিক, অপার্থিব আর্তনাদ হাহাকারের মতাে ঘুমন্ত গ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গেল। ললিতা নিঃসাড়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
সকালে যখন জ্ঞান ফিরলাে তখন গােটা গ্রামের লােক এক হয়েছে। নলিতার গােটা শরীরে ধারালাে নখরের ফালাফালা আঁচড়ের দাগ। গােয়ালের মধ্যে ছাগলের মাংস, হাড়, শিং ছত্রখান হয়ে রয়েছে। আর বৃষ্টি ভেজা নরম মাটিতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য এলােমেলাে প্রায় মানুষের মতােই পায়ের ছাপ। তবে আকৃতিতে অনেক বড় আর তাতে চারটে করে আঙুল।
চিৎকারটা কিসের, তা পরিস্কার না বুঝলেও অনেকেরই ঘুম ভেঙে গিয়েছিলাে কাল রাত্তিরে। সকাল হতেই গ্রাম কে গ্রাম তােলপাড় হয়ে উঠলাে। এ কোন অজানা অপদেবতার আবির্ভাব হল পরগণাতে? বটতলার সবেধন চায়ের দোকানে, ইস্কুল বাড়ির মাঠে, সব জায়গায় একই আলােচনা চলতে থাকলাে। পল্লী অঞ্চলে একবার কোনাে আলােচনা শুরু হলে তা স্তিমিত হতে বিলম্ব হয়, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এই আলােচনাও বন্ধ হয়ে আসলাে, কারণ তার মধ্যে নতুন করে আর কিছুই ঘটলাে না। শুধু কুষ্টিয়ার মেয়েটা কিছুতেই আর পুরােপুরি সুস্থ হলাে না। মােটামুটি স্বাভাবিকভাবেই কাজকর্ম আর কথাবার্তা চালালেও, মাঝে মাঝেই চমকে উঠে কেঁদে ফেলে আর বিড়বিড় করে ভুল বকে। একা একা বসে থাকলেই গােয়ালঘরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে, আর আঙুল তুলে কাঁপা কাঁপা হাতে উত্তর কোণে কি যেন দেখায়।
এ গাঁয়ের মােড়লের নাম বিশ্বনাথ। তাকে গাঁয়ের মােড়লগিরি ছাড়াও শহরে কিছু কন্ট্রাক্টারির চালানের কাজও করতে হতাে। বাঁশ, কেরােসিন, কাঠ, এইসব আর কি। তা সেদিন বিশ্বনাথ তাে সদরে গিয়ে কাজেকর্মে আটকে গেল। তখন তাে আর এত ঘরে ঘরে টেলিফোন যন্ত্র বা যােগাযােগের উপায় ছিলাে না। তাই সে বাড়িতে জানাতেও পারলাে না। অবশ্য তার বউ কোনদিনই এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করতাে না। কাজের সুত্রে তার পতিদেবতাটিকে মাঝে মধ্যেই সদরে থাকতে হতাে।
মিঠু ধানবাদের মেয়ে। বছর দুয়েক আগে বিশ্বনাথকে বিয়ে করে এই গ্রামে এসেচে। মিষ্টি ব্যবহার আর পুজোআচ্চার নিখুঁত জোগাড়যন্ত্রের জন্যে গ্রামের সবাই ওকে ভীষণ ভালােবাসতাে। মােড়লের বউদের মতাে বাড়তি অহঙ্কার তার কোনদিনই ছিলাে না। প্রায় নতুন বিবাহিত এই দম্পতির মধ্যে ভালােবাসা আর বন্ধুত্ব ছিলাে খুব গভীর। তাই মাঝে মাঝে স্বামী বাড়ি না ফিরলেও কখনােই রাগ বা অভিমান করে বসে থাকতাে না। সে তার এক বছরের ছেলেকে খাইয়ে দাইয়ে, নিজে খেয়ে, কাঁসার জামবাটিতে স্বামীর জন্যে চাট্টি পান্তা ভিজিয়ে রেখে, দরজায় আগল দিলাে।
কত সময় পার হয়েছে ঠিক খেয়াল নেই, হঠাৎ মিঠুর নাকে একটা বুনাে গন্ধ এল। সেই সঙ্গে বাইরে বাড়ির ওপাশের নারকেল গাছটার ওপর থেকে একটা দুড়দাড় হুড়মুড় আওয়াজ। যেন হঠাৎ ওঠা ঝড় ঝঞায় পাতাগুলাে ভয়ানক জোরে দোল খাচ্চে। মাথার জানলায় লাগানাে চটের বস্তাটা তুলে সে দেখলাে পিছনের বাগানের কোনাে গাছেই ঝড়ের চিহ্নমাত্রও নেই। একটু পরেই নারকেল গাছের নড়াচড়া থেমে গিয়ে দাওয়ার কাছে একটা শব্দ শুরু হল। যেন ঘরের বাইরে কোনাে ভারী শক্তিমান জন্তু পায়চারী করছে, আর তাতে গােটা ঘরটা তিরতির করে কাঁপছে। দরজার ওপরে কাচের পরকলায় বাঁধানাে মিঠুর স্বৰ্গত শ্বশুর শাশুড়ির ফোটোগ্রাফ টাঙানাে ছিল। সেগুলির কাঁচ মৃদু ঝনঝন করতে শুরু করল। একটা ভীষণ ভয়ের অনুভূতি মিঠুকে পেয়ে বসলাে। তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস খুব দ্রুত হয়ে এল। তারও বাইরে গরু বাঁধারয়েছে বটে, কিন্তু মুর্মূ বাড়ির ঘটনাটাও তার মাথায় ছিলাে। সে ঠিক করে নিল, যা হয় তােক, কিন্তু ঘরের দরজা সে মরে গেলেও খুলবে না। কিন্তু সেই প্রাণীটিকে চোখের দেখাটুকু দেখার আকর্ষণ সে সামলাতে পারলাে না। আওয়াজটা আসচে দাওয়ার সামনে থেকে। দরজা না খুলেও, রান্নার উনুনের পাশের জানলাটা দিয়ে উঁকি মেরেও দাওয়াটা পরিস্কার দেখা যায়। হ্যারিকেন বাতির চাকা ঘুরিয়ে আগুনটাকে উসকে দিয়ে, খুব ধীর পায়ে মিঠু এসে দাঁড়ালাে উনুনের পাশে। বাইরে থেকে একটানা ঝিঝির তান ভেসে আসছে। মিঠু অবাক হল। যদি সত্যিই কোনাে প্রাণী বাইরে চলাফেরা করে থাকে, তবে ঝিঝিপােকার তাে ডাকার কথা নয়। বরং চুপ মেরে যাবার কথা। হঠাৎ মনে হল কেউ যেন টালির চালের উপর দিয়ে দৌড়ে গেল। মিঠুর কানে একটা ফোস ফোস আওয়াজ এল। কোন বড় সড় জন্তু যে তাসে নাক তুলে কিছুর আঘ্রাণ নিচ্চে। সে সাহসে ভর করে জানলার এক কোণায় চোখ রাখল।
বাইরে নিশুতি আঁধার। কিন্তু গ্রামের লােকের চোখে আঁধারমাণিক জ্বলে। সে প্রথমেই নারকেল গাছটার দিকে চোখ ফেরালাে। সাজানাে পাতাগুলাে যেন কোনাে এক তাগড়াই হাতে নাড়া খেয়ে এলােমেলাে, অগােছালাে হয়ে পড়েছে। আকাশে মিটমিট করে অনেকগুলি নক্ষত্র ফুটে রয়েছে। তাদের সামান্য আলােতেও ধানের গােলা, পুকুরপাড়, বাবলাতলা সবই মােটামুটি পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তেমন অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়লাে না। শুধু উঠোনের মধ্যে, ইঁদুরে মাটি তুললে যেমনটি হয় তেমনি বেশ কিছু ছিদ্র নজরে এল। কিসের কে জানে। তেমন কিছু নেই বুঝে, হ্যারিকেনটা হাতে তুলে নিয়ে, ভিতর ঘরে যাবার জন্যে যেই সে পিছন ঘুরে দু পা এগিয়েচে, সঙ্গে সঙ্গে সে টের পেলাে যে, সমস্ত ঝিঝিপােকার পাল একসঙ্গে তাদের ডাক থামালাে। সেই সঙ্গে বাতাসে উড়ে এল তীব্র পােড়া একটা গন্ধ। বােঝা গেল, ঝিঝিপােকারা এমন কোনও জন্তুকে দেখতে পেয়েছে, যার আবির্ভাব এ সময়ে অবাঞ্ছিত।
মিঠু আতঙ্কে একটা নিঃশাস টেনে দম বন্ধ করে ফেললাে। জৈবিক তাড়না আর অদম্য কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে দু পা এগিয়ে, নিচু হয়ে চোখ রাখলাে জানালায়, আর সঙ্গে সঙ্গে তার গােটা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠলাে। বাইরের আলাে আঁধারির মধ্যে খুব আবছা, ধোঁয়াটে একটা নারীমূর্তি পিছন ফিরে বসে আছে। বিশাল বিশাল জটা কুণ্ডলী পাকানাে চুল তার মাথা থেকে কোমরে এসে পড়েছে। পিছন ঘুরে মূর্তিটা কি যেন চিবােচ্ছে। তার শক্তপােক্ত চোয়ালের থেকে হাড় ভাঙ্গার কটমট আওয়াজ কানে আসছে।
মিঠু নিজের মুখে নিজের দুটো হাত প্রাণপণে চেপে ধরে রইলাে, যাতে একচিলতে শব্দও না বেরােয় মুখ থেকে। ওর পা দুটো আর ঘাড়টা কেউ যেন স্থির করে দিয়েছে। ওই পিশাচিনীর থেকে চোখ ঘােরাবার ক্ষমতা তার আর নেই।
বেশ কিছুক্ষণ খাবার পরে, যেন বিরক্ত হয়েই সেই প্রেতিনী বাকি ভুক্তাবশেষ টুকু ছুঁড়ে দিলাে দাওয়ার দিকে, আর সেদিকে তাকিয়ে মিঠুর এত সময়ের আতঙ্কটা তীব্র গলাফাটা কান্না হয়ে বেরিয়ে এল। সেই চিৎকারে মানুষখেকো রাক্ষসীটা এক লাফে দাওয়ার উপরে উঠে এসে থাবা পেতে বসলাে। তার মুখের কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়চে তাজা রক্ত আর গলা থেকে চাপা গরগর শব্দ শােনা যাচ্চে। মিঠু আচ্ছন্নের মতাে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে শােবার ঘরে ঢুকে, তাকিয়ে রইলাে খাটের দিকে, যেখানে এই একটু আগেও তার এক বছরের ছেলেটা শুয়ে ছিলাে। মাথার ওপর টালির চাল অনেকটা ফাঁক হয়ে আছে, যেখান দিয়ে তার কোলের সন্তানকে তুলে নিয়ে গেছে ঐ মানুষখাকী। ঘােলাটে, শুকনাে চোখে মিঠু কিছুক্ষণ চেয়ে রইলাে সেদিকে। তারপর কাঁপা কাঁপা পায়ে ফিরে এসে দরজা খুলে ফেললাে। মায়ের প্রাণ হার মানালাে অশরীরীর আতঙ্ককে।
গ্রামের পাড়াপড়শীরা রাত্রে যে মিঠুর চিৎকার শােনেনি তা নয়, কিন্তু সকালে বিশ্বনাথ ফেরার পরে সেটা কেউই আর স্বীকার করলাে না। দাওয়ার সামনে ওদের ছেলেটার ছিন্নভিন্ন আধখাওয়া ছােট্ট দেহটা পড়ে আছে, আর মিঠুর ঘাড়ভাঙা, খুবলানাে শরীরটা পড়ে রয়েছে ইদারার মধ্যে। ধরাধরি করে মৃতদেহ তােলা হল পাতকুয়াে থেকে এবং গাঁয়ের ডােমপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লােকগুলাে অবধি তা দেখে শিউরে উঠলাে। মরার আগে যেন কারাে সাথে খণ্ডযুদ্ধ করেছিলাে সে। অপ্রতিরােধ্য সেই শত্ৰু মিঠুর নাক মুখ খুবলে, কান ছিড়ে, হাতের কবজি অবধি কেটে ফেলেছিলাে। উঠোনের ধ্বস্তাধস্তির চিহ্নগুলাে সাক্ষ্য দিচ্ছে এমন এক সাহসী মায়ের, যে তার সন্তানের শত্রুকে হাজারগুণ শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও রেয়াৎ করেনি, এবং সেই কারণেই তার ঘাড় ভেঙে, কুয়াের মধ্যে ফেলে, তবে নিশ্চিন্ত হয়েছিলাে রাতের ওই নরখাদক দাননা। সেই সঙ্গে গােটা আঙ্গিনাময় এক অজানা কিছুর ধারালাে নখের গর্ত আর ছাপ। তাতে চারটে করে আঙুল। বিশ্বনাথ অচৈতন্যের মতাে উঠোনে আছাড় খেয়ে পড়ল, আর পাগলের মতাে সেই আততায়ীয়ের পায়ের ছাপের উপরে দু হাত তুলে আঘাত করতে লাগল আর বাচ্চা ছেলের মতাে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলাে।
পরের দিন ইস্কুলবাড়ির চাতালে গাঁয়ের মাতব্বরেরা এক সভা ডাকল, আর বিকেল নাগাদ বিশ্বনাথ আর দু তিনজন লোেক গাে-যানে রওয়ানা হল চর-বাঁকীপুরের বামা গুণীনের খোঁজে। এই প্রেতাত্মার নাশ চাই। এই সর্বনাশের উপযুক্ত বদলা চাই। তা এই বামা গুণীন কিন্তু বড়াে যেমন তেমন ওঝা নন। বহু দূর দূর থেকেও লােকে তার নামে কপালে হাত ঠেকায়।
বিশ্বনাথেরা প্রথমে গাঁয়ের এক তান্ত্রিক ভুবনকে ধরেছিলাে, কিন্তু সে রাজী হয়নি। বলেছিলাে, এই শক্তির মােকাবিলা করার উপযুক্ত শক্তি আমার গুরু আমাকে দিয়ে যেতে পারেননি, তাই আমার দ্বারা কিছু হবার নয়। এর প্রতিকার করতে পারতাে যদি আমার গুরু অথবা আমার এক গুরুভাই এখানে থাকতাে। কিন্তু গুরু আমার দেহ রেখেছেন বহু দিন আগে, তা আপনারা জানেন, আর আমার সেই গুরুভাই এখন রয়েছেন শিবালিক পর্বতে কঠিন শব সাধনায়। এই বিপদের আভাস পাবার পর পরই আমি তাকে বার্তা পাঠিয়েছি। তার সাধনা সমাপ্ত হলেই যে কোনও দিন তিনি আসবেন। তাই আপাতত আপনারা অন্যত্র সন্ধান করুন।
চর-বাঁকীপুরের বামা গুণীন তাে প্রথমে কিছুতেই রাজী হয় না। বলে- যা যা দূর হ। আমাকে কি নিম্নমানের তন্ত্রসাধক ঠাউরেচিস নাকি যে ভূত প্রেত আর শাঁকিনী হাঁকিনীকে তাড়াতে দৌড়বাে? দূর হয়ে যা।
অবশেষে দু’দিন ধরে ধর্না দিয়ে, গালাগাল হজম করেও তাঁরা বামা ওঝাকে বােঝাতে সক্ষম হলাে তাদের বিপদের কথা। দু’দিন পরের দ্বিপ্রহরে বামা তাদের সাথে রওনা দিলাে সেই অভিশপ্ত গ্রামে। শর্ত রইলাে যে গুণীনকে কেউ হাত দেখা, কোষ্ঠী বিচার বা দীক্ষার জন্যে পেড়াপেড়ী করবে না। কেউ সিকি পয়সাও প্রণামী বা দক্ষিণা দেবে না। কোনও দান বা উপহার দেওয়া চলবে না। নাহলে ওঝা তখনই ফেরত চলে যাবে। শুধু এক থান শুদ্ধ কালাে মিশমিশে কাপড় তাকে দিতে হবে।
সবাই রাজী হলাে। গ্রামে পা দিয়ে তাঁরা শুনলে যে এই দুদিনেও রােজ একটা করে নরহত্যা হয়েছে। ওঝা গরুর গাড়ি থেকে সরাসরি মাটিতে পা দিলে না। এক টুকরাে কাপড় বিছিয়ে তার ওপর নেমে বিড়বিড় করে কি যেন মন্ত্র পড়তে থাকল। চারদিক চেয়ে সে বললে, বড়াে সব্বনাশা ব্যাপার হে মােড়ল। খুব বিপদ। এ গাঁয়ে আপাই ঢুকেচে। এলাকায় খুব ভয়ানক কোনও অপঘাত ঘটলে সে তল্লাটে আপাই বাসা বাঁধে। সাধারণ পেত্নি বা শাঁকচুন্নির থেকেও একশােগুণ সব্বনাশা। আমি এমনটি আগে কক্ষনাে দেখিনি। তবে তােমরা ভয় করাে না। এই যে আমার ঝুলিতে এই নীল বীজের মালা দেখচ, এর সুমুখে কোনও অশুভ শক্তির সাধ্যি নেই দাঁড়িয়ে থাকে।
এবার শােন, আমার তােদের গাঁয়ের মধ্যে থেকে একটা বিবাহিতা সধবা মেয়েমানুষ দরকার ওই রাক্ষসীর টোপ হিসেবে। এ এক তন্ত্র প্রক্রিয়া। তােরা বুঝবি নে। কোনও ভয় নেই। আমি থাকতে তার কোনও ক্ষতি কেউ করতে পারবে না, শুধু সাহস দরকার। ওই রাকুসীকে কালকের মধ্যেই বন্দী করে ফেলবাে আমি। আছে কেউ?
অতবড় তান্ত্রিকের অতখানি আশ্বাস সত্বেও কেউই কিন্তু রাজী হল না টোপ হতে। অমন অলক্ষুণে কথা শােনার পরেই মেয়েমানুষেরা আস্তে আস্তে ঘরের পানে সরে পড়েচিলাে, এমনকি বিশ্বনাথ ঘরে ঘরে গিয়ে বুঝিয়েও লাভ হল না। বামা গুণীন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললে, বেশ। তাতে আমার কোনও ক্ষতি নেই। দিনকয়েক একটু সময় লাগবে এই যা, কিন্তু ওই রাক্কুসী আমার হাত থেকে নিস্তার পাবে না। আমাকে কিছু যজ্ঞের জিনিসপত্তর আর বুনাে ঘােড়ার তীব্র গন্ধওয়ালা পাতা জোগাড় করে দিতে হবে। সে পাতা বেশ চিনিস তাে তােরা? এবার দূর হ। আমাকে একটু একা থাকতে দে। দূর হ চোখের সামনে থেকে।
গুণীন রাত্রে ডেরা ফেললাে গাঁয়ের শেষ প্রান্তে কাকপোঁতার শ্মশানে। শ্মশানে একটি ক্ষুদ্র মন্দির রয়েছে। দেবীর নাম ভূতচন্ডী। এই দেবী বড়াে ভয়ানক এবং এই পরগণার রক্ষাকারীও বটে। বিশেষ কোনও বিপদ বালাই মহামারীতে পড়লে কেবলমাত্র কালীপুজার রাত্রে এই দেবীর মূর্তি গড়ে পুজা করতে হয় এবং ভােরের আলাে ফোটার পূর্বেই প্রতিমা বিসর্জন দিতে হয়। দেবী পুজায় সন্তুষ্ট হলে সেই নিশ্চিৎ বিপদের প্রকোপ থেকে রক্ষা করে থাকেন, কিন্তু কালীপুজা আসার অপেক্ষায় থাকলে গাঁয়ে শুধু শিয়াল কুকুর ছাড়া কিছু থাকবে না। গ্রাম শ্মশান হয়ে যাবে। তাই সকলে মিলে শলা করে আনা হলাে বামা ওঝাকে।
ওঝা রােজ তিনবেলা করে যজ্ঞ করে, হােম করে, এর গােটা গাঁ। ঘুরে ঘুরে একটা কংকালের মুণ্ডু থেকে জল ছিটিয়ে বেড়ায়। ওঝা গ্রামে পা রাখার পর থেকে দুদিন কেটে গেছে। এই দুদিনে একটাও নরহত্যা তাে দুরস্ত, একটা গরু বাছুর অবধি মরেনি। গ্রামবাসীদের মনে এবার একটু একটু করে সাহস ফিরতে শুরু করেছে। সেই শয়তানী প্রেতাত্মা এবারে ঠিক লােকের হাতে পড়েছে। এবারে সবাই নিশ্চিন্তে রাত্রে ঘুমুতে পারবে।
কিন্তু গ্রামবাসীদের হিসেবে মস্ত বড়াে ভুল ছিল। তাঁরা নিশ্চিন্তে ঘুমুলেও সেই মানুষখাকী কিন্তু ঘুমায়নি। দূর থেকে, আড়াল থেকে সে নজর রেখেচিলাে সবার ওপরে। পরপর দুদিন সে তান্ত্রিকের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে গ্রামে ঢুকতে না পারলেও তৃতীয় দিন ঘটে গেল অঘটনটা।
এখন ব্যাপারটা হয়েছে কি, বিশ্বনাথ মােড়লরা হলাে দুই ভাই। বিশ্বনাথ বড়াে, আর তার ছােটো ভায়ের নামটা হচ্চে শ্রীপতি না শ্রীনাথ কি যেন।
গাঁয়ের সবাই ডাকে ছেনু বলে। তা সেই ছেনু ছিল বড় বদমেজাজি আর রাগ ছিল চণ্ডালের মতাে। আগে নাকি ফুলবেড়ে ইস্টিশানে কোন এক ভাতের হােটেলে রাঁধত, কিন্তু তার সখ হল নিজের হােটেল খােলার। পরপর তিন চারবার ব্যাবসায় ধাক্কা খেয়ে, পয়সাকড়ি নিঃশেষ করে এখন তার ভিক্ষুকের মতাে দশা হয়েছে। লােকের থেকে চেয়ে চিন্তে সংসার চলে।
ছেনুর বউয়ের নাম কান্তা। অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের মেয়ে। বয়স উনিশ কি কুড়ি। স্বামী দু চার পয়সা যা জোগাড় করে আনতে তা তেল আর লবণ কিনতেই ফুরিয়ে যেতাে। তাই সে রােজ দুপুরবেলা চুপিচুপি বেরিয়ে বিশ্বনাথের বউ মিঠুর থেকে চাট্টি চাল ডাল চেয়ে আনতাে আর তারপর উনুন ধরিয়ে রান্না চাপাতাে। ছেনু এসব কিছুই জানতাে না বা জানতেও চাইতাে না। কিন্তু মিঠু মারা যাবার পর সে পথ বন্ধ হলাে। ঘরে যা খুদকুঁড়াে ছিল তাই দিয়ে দিন দুই তিন চলে গেল, কিন্তু কান্তা এ অবস্থায় নতুন করে লজ্জায় আর ভাসুরের কাছে চাল চাইতে পারলে না।
যেদিনের কথা বলচি, সেদিন ছােটো তরফের উনুনে সকাল থেকে হাঁড়ি চাপেনি। অনেক চেষ্টা করে কান্তা দুপুরের দিকে ছেনুর জন্যে সামান্য কটা আতপচাল জোগাড় করেছিলাে। এখন এই নরখাদকের আতঙ্কের জন্যে কেউই কাজে বা চাষবাসে যেতে পারছে না। এ অবস্থায় কে কাকে দেখে? কান্তা স্বামীর জন্যে সেই সামান্য কটা চালের ভাত রাঁধলাে আর নিজে এক ঘটি জল খেয়ে সবে মাত্র কুটিরের দাওয়াতে বেরিয়েছে, এমন সময় ছেনু উসকোখুসকো চুলে, হনহন করে বাড়িতে ঢুকেই হুকুম করলাে, ভাত দে। কান্তা সেই যৎসামান্য ভাত মাটির সরাতে করে স্বামীর সুমুখে রাখলাে।
সারাদিন এর বাড়ি ওর বাড়ি ভিক্ষে করে বেরিয়ে, এক পেট ক্ষুধা নিয়ে বাড়িতে এসে, এই মূষিক পরিমাণ আহার্য দেখে তার মাথায় চণ্ডাল ভর করলাে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক লাথি মেরে ভাতের সরা ফেলে দিয়ে বউয়ের চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালে ঠুকে দিলে। কান্তার কপাল ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে থাকলাে। আরও বেশ কিছুক্ষণ ধরে অমানুষের মতাে এলােপাথাড়ি মারধাের করে ছেনু তার বউকে বললে, দূর হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে। তাের মুখদর্শন আর করতে চাইনে আমি। কান্তা ধীরে ধীরে মাটি থেকে উঠে গলায় আঁচল দিয়ে ঠাকুরকে গড় করলাে, তারপর স্বামীর মুখের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে, একখানা মেটে কলসি আর একগাছা ঝিকের দড়ি নিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।
সন্ধ্যার মুখে কুটিরের সামনে বামা গুণীন বসেছিলাে গ্রামবন্ধন মন্তর পড়তে। চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। সামনে যজ্ঞের কাঠে আগুন জ্বলচে আর তা থেকে পটপট করে ফুলকি ওঠার আওয়াজ আসচে। নীলবীজের মালা, ঘি সিন্দুর শাঁখা মধু আর এক স্তুপ- অশ্বগন্ধার পাতা ডাঁই করে রাখা। ঘরের ভিতরে বলি দেবার জন্যে রাখা রয়েচে দুটো কালাে মােরগ। এই গ্রামবন্ধনের মন্তর রােজ সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ে পড়তে হয়, নাহলে বাঁধন কেটে যায়। বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে তান্ত্রিক সবে মাত্র আগুনে ঘিয়ের আহুতি দিতে যাবে, এমন সময়ে কুটিরের পিছন থেকে অনেকগুলাে কুকুরের কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। যাকে কিনা বলে ‘মড়া কান্না’।
বামা বিরক্ত হয়ে উঠলাে। অসন্তুষ্ট মুখে আবার যজ্ঞ শুরু করতে যাবে, এমন সময়ে মনে হল শুধু কুকুর নয়, তার সঙ্গে একজন মানুষের কান্নাও আসচে। বামা বেশ অবাক হলাে। এই রাত্তিরে এই নিঝুম শ্মশানপুরীতে কে কাঁদে? গুনীন উঠে পড়ে ধীরে ধীরে গিয়ে দাঁড়ালো কুটিরের পেছনের জমিতে। দেখলো, গোটা ছয় সাত নেড়ি কুকুর শ্মশানের দিকে তাকিয়ে উঁ উঁ করে কাঁদচে, তার চোখে ভালো ঠাহর না হলেও মাঝ শ্মশানে কে একজন মেয়েমানুষ যেন বসে রয়েছে।
কার্তিকের হিমে ভেজা পাতা, বুনাে কাশবন আর পটপটি গাছের ঝােপ ভেদ করে তান্ত্রিক ঢুকে পড়লে শ্মশানের প্রায় মাঝখানে। মেয়েটি এই হিম জলের রাত্তিরে ভেজা পােষাক, ভেজা চুলে বসে বসে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কাঁদছে। মেয়েটির থেকে হাত দশেকের দুরত্ব রেখে বামা গম্ভীর ভরাট গলায় জিজ্ঞেস করলে, “কে তুই? এত রাত্তিরে শ্মশান জাগাতে এসেছিস? কি নাম তাের?”
মেয়েটি সম্ভবতঃ তান্ত্রিকের দিকে আগে খেয়াল করেনি। হঠাৎ গম্ভীর গলার শব্দ পেয়ে আঁতকে উঠলাে।
-“কী হলাে, বললি নে? কে তুই?”
আমি এই গাঁয়েই থাকি বাবা। আমার নাম কান্তা। আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিওনি। তােমার দুটি পায়ে পড়ি।”
-“গাঁয়ে থাকিস তাে এই রাত্তিরে শ্মশানের মধ্যে মরতে এসেছিস কেন?”
“আমি আর কোনােদিনও বাড়িতে ফিরবাে না বাবা। আমার স্বামী আজ আমাকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে।”
-“মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে? কেন? কোন বাড়ির বউ তুই?”
– “আপনার গ্রাম থেকে আপনাকে যে মােড়ল মশায় আনতে গিয়েছিলেন, উনি আমার ভাসুর ঠাকুর।”
– “অঃ। বিশ্বনাথের ভায়ের পরিবার তুই।”
কান্তা চুপ করে রইলাে।
তান্ত্রিক কিছুক্ষণ ছােটো চোখে চেয়ে রইলেন কান্তার দিকে। একটু বাদে বললেন, “তাের স্বামী তােকে বড্ড অত্যাচার করে, তাই না? আমি কিন্তু ওষুধ করে দিতে পারি যাতে তাের স্বামী ভালােমানুষ হয়ে যায়, সুখে ঘর করতে পারে। কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে।”
কান্তা আবার হু হু করে কেঁদে উঠলাে।
– “আপনি যদি আপনার মেয়ের এই উপকার করতে পারেন, তবে সত্যি বলচি, আপনার জন্যে জীবন অবধি দিতে পারি।”
তান্ত্রিক হাসলাে।
বললে, “জীবন দেবার প্রয়ােজন হবে না বাছা, কেবল কাল রাত্তিরের জন্যে সেই মানুষখাকীর টোপ হতে হবে তােকে। আমার একজন সধবা, সাহসী লােক দরকার। আমি থাকতে কোনও চিন্তা নেই।”
-“চিন্তা আমি করিনে বাবা। মরতেই তাে চলেছিলাম কিন্তু আপনি জীবন দিলেন। কোথায় যেতে হবে, কী করতে হবে আমাকে বলুন?”
– “আমার পিছনে পিছনে আয়”, এই বলে বামা গুণীন এগুতে থাকলাে কুটিরের দিকে।
কুটিরের সুমুখে তখনও আগুন জ্বলচে। সেখানে দাঁড়িয়ে গুণীন বললে,
– “শােন, আমি এতক্ষণ গ্রামবন্ধের যজ্ঞে বসেছিলাম, কিন্তু তােকে পাবার পর ঠিক করলাম গ্রামকে আর বাঁধবাে না। ওই ডাইনীটাকে আসতে দিতে হবে গাঁয়ের ভিতর। তুই লণ্ঠনটা জ্বেলে নিয়ে চুপ করে কুটিরের ভিতর বসে থাক। আমি ওকে আনার জন্যে বাণ মারতে বসছি।”
কান্তা জীর্ণ কুটিরের মধ্যে লুকিয়ে পড়লাে, আর বামা বসলাে যজ্ঞাসনে।
আমরা ছােটবেলায় পড়েচি, এক এ চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ, পাঁচে পঞ্চবাণ…
তন্ত্র মতে মােট পাঁচটি বাণ। দ্বারণ, মারণ, স্তম্ভণ, মােহন আর উচাটন। দ্বারণ বাণ হলাে কারাে দেহ বা কোনও জায়গাকে মন্ত্রের দ্বারা বেঁধে দেওয়া। মারণ হলাে কোনও শরীরধারী প্রাণীকে মন্ত্রের দ্বারা দূর থেকে হত্যা করা। স্তম্ভণ হচ্চে কাউকে কোনও কাজ করা থেকে বিরত করা বা আটকে দেওয়া। মােহন বাণের সাহায্যে কোনও শরীরী বা অশরীরী আত্মা বা প্রাণীকে নিজের দিকে টেনে আনা যায়। আর শেষের এই উচাটন বাণ বর্তমানে ত্রিভুবন থেকে লােপ পেয়েছে। এর দ্বারা মৃত প্রাণীকে পুনর্জীবিত করা সম্ভব।
তা, বামা গুণীন সেই নরখাদক আত্মাকে আবাহন করার জন্যে মােহন বাণ মারতে বসলাে। কিছুক্ষণ মন্ত্র পড়ার পর তান্ত্রিক উঠে পড়লাে। উৎসর্গের মােরগ দুটোকে আনার জন্যে কুটিরের দরজায় এসে দাঁড়ালাে এবং এক নারকীয় দৃশ্য তার চোখে পড়লাে।
ঘরের ভিতরে মেঝের চারিদিকে মুরগীর পালক ছড়ানাে আর তার মাঝে বসে সেই বউটি জ্যান্ত পাখিগুলাের শাসনালী চেপে তাদের ছিড়ে ছিড়ে খাচ্চে। তার হাত পা গুলাে বিশাল লম্বা লম্বা এবং শরীরও সেই অনুপাতেই বিরাট। গােটা ঘরে পােড়া ধোঁয়ার গন্ধ। ঘরে লণ্ঠন জ্বলচে, কিন্তু কান্তার কোনও ছায়া পড়ছে না। বউটি তান্ত্রিকের দিকে পিছন ফেরা, কিন্তু আগন্তুকের উপস্থিতি টের পেয়ে দেহটা না ঘুরিয়েই শুধু মুণ্ডুটা এদিকে ঘুরে এল আর বামাকে দেখে খিলখিল করে হেসে উঠলাে।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে গুণীন চিৎকার করে উঠলে, “হতভাগী সর্বনাশী, তুইই তবে সেই আপাই। গাঁয়ের লােকগুলােকে খেয়েচিস, এই বউটাকে খেয়েচিস, আর তার শরীরে বাসা বেঁধে আজ তুই তাের যমের ঘরে পা রেখেচিস। কিন্তু আমাকে তুই চিনিস নে।”
বামা পিছন ফিরে এক দৌড়ে যজ্ঞবেদীর কাছে চলে এসে নীচু হয়ে হাত ঢােকালাে নীলবীজের মালার থলিতে। সে অনুভব করলে মালাটা থলির ভিতরে পাগলের মতাে ছটফট করছে আর ঘােড়ার গন্ধওয়ালা অশ্বগন্ধা পাতার স্তুপে কি করে যেন আগুন লেগে গিয়েছে। এক টানে মালাটা বের করে পিছন ফিরতেই সে দেখলাে, রাক্ষসী একদম তার মুখের সামনে এসে দাঁড়িয়েচে। মুখে ভয়াল কুটিল হাসি। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস ফোঁস ফোস করে পড়চে।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই রক্তমাখা চারটে ধারালাে দাঁত কামড়ে বসলাে তান্ত্রিকের কণ্ঠনালীতে। শুরু হলাে ধ্বস্তাধস্তি। গায়ের জোরে কেউ কারুর থেকে কম যায় না। বামা গুণীন বেশ কয়বার চেষ্টা করলাে শরীরবন্ধ মন্তর পড়তে, কিন্তু গলার মধ্যে থেকে ঘড়ঘড়ে গােঙানি ছাড়া কোনও আওয়াজ বেরুলাে না। সে চেষ্টা করলে বউটির কপালে নিজের তর্জনী ঠেকাতে, কিন্তু গলা কামড়ে রাখায় তার হাত শারীরিক নিয়মেই বেশি দূর উঠলাে না। অবশেষে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে সে এলিয়ে পড়লাে আগুনের পাশে। রাক্ষসী মুখের রক্ত মুছে পৈশাচিক আনন্দে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠলাে।
গাঁয়ের লােকেরা এই দুদিনে একটু সাহস হওয়ায় রাস্তা ঘাটে ইতি উতি ঘুরছিলাে। তারা পুনরায় এই পরিচিত অপয়া হাসির শব্দ কানে আসতেই একেবারে আঁতকে উঠলাে আর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ােদৌড়ি করে যে যার ঘরে ঢুকে আগল দিলাে।
একটু বেলা বাড়লে, দশ বারােজন মিলে ইতস্ততঃ ভাবে বামার কুটিরের কাছে গিয়ে দেখলে, তান্ত্রিকের দশাসই দেহটা পড়ে রয়েচে বেড়ার সামনে। শ্মশানের থেকে কয়েকটা পাতিশেয়াল এসে তার আশেপাশে ঘুরঘুর করছিলাে, মানুষ দেখে তারা পালিয়ে গেল। তান্ত্রিকের হাত, পা, মাথা সব তীব্র আক্রোশে টেনে টেনে ছেড়া হয়েছে, আর কাকপোঁতার শ্মশানের পুকুরে ভাসচে ফুলে ঢােল হওয়া ছেনুর বউয়ের মৃতদেহ। বাসী মড়া। তার গলায় বাঁধা দড়ি কলসি। সম্ভবতঃ সে বাড়ি থেকে বেরিয়েই সােজা এই পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিলাে।
এই দুদিনে পল্লীবাসীদের মনের আশা ভরসা যেটুকু বা ফিরেছিলাে, সব এই ঘটনায় ধূলিসাৎ হয়ে গেল। বামার মতাে ডাকসাইটে একজন তান্ত্রিককে যে অপদেবতা হেলায় ফেলায় হত্যা করতে পারে, তার সাথে এঁটে ওঠা কোনও মানুষের সাধ্য নয়।
পরপর এই দু তিনটে ঘটনায় পল্লীবাসীদের মনে যত না বেদনা হল, তার থেকে বেশি জুড়ে বসলাে ভয়ানক এক আতঙ্ক। অদেখা অশরীরীর হাতে নিজের অস্তিত্ব বিনাশের ভয়। এবার কার পালা? এই সন্দেহ যে একেবারে অমূলক ছিলাে না, তার প্রমাণ হিসেবেই যেন সেই সর্বনাশী রাক্ষসী রােজ রাত্তিরে এমনই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড একটা দুটো করে ঘটাতে লাগল, এবং তার পর থেকে গােটা গাঁ আর তার আশেপাশের এলাকার মানুষজন সূর্য ডােবার পর ঘর থেকে বেরনােই বন্ধ করে দিলাে। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও কেউ বড়াে একটা দরজার বাইরে পা রাখতাে না। যাদের রান্নাঘর বাড়ির বাইরে ছিলাে, তারা সপরিবার আলাে, আগুন নিয়ে বাড়ির বাইরে একসাথে বসে থাকতাে, আর রান্না হয়ে গেলেই খাবারদাবার, বাসনকোসন নিয়ে সেই যে ঘরে ঢুকে আগল তুলে দিতাে, তা আর সূর্য ওঠার আগে খুলতাে না। গােটা তল্লাটের উপর এক সর্বনাশা অভিশাপ যেন তার বুভুক্ষু থাবা মেলে ওৎ পেতে বসে রইলাে শিকারের অপেক্ষায়।
অথচ এই মাস দুয়েক আগে অবধিও এসবের কোনাে নামগন্ধও ছিলাে না। কত রাত অবধি বটতলায়, ইস্কুল বাড়ির পাশে, মনসার থানে গাঁয়ের বয়স্ক লােকেরা বসে গল্পগুজব করতাে। গরমকালে খােলা মাঠে পুরুষ মানুষরা সারারাত শুয়েও থাকতাে। কিন্তু দুই মাস আগে পরিত্যক্ত রেললাইনের মাপজোক করতে জনা আষ্টেক কুলি মজুর তাবু ফেলেছিলাে এই গ্রামে। লাইনের ও পাশটাতে। সঙ্গে ছিল তাদের এক ঠিকেদার। অত্যাধিক লােভী আর বদমেজাজি এই মানুষটা যখন খবর পেলেন যে, রেললাইনের পাশের রেলবাংলােটা প্রায় তিরিশ বচ্ছর ইস্তক বেওয়ারিশ অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তখন তিন চার জন কুলি কে সঙ্গে করে চৌহদ্দির ভিতর ঢুকে পড়ে, দামি দামি গাছগুলােকে কাটবার জোগাড়যন্ত্র করতে থাকল। কিছু দেহাতি লােক। নিষেধ করবে বলে জড়াে হয়েছিলাে। ঠিকেদার ধমক দেওয়াতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে এদের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগল।
কিছুক্ষণ মাটি কোপাবার পরেই একজন কুলি কি একটা পেয়ে উত্তেজিত হয়ে হইহই করে ওঠায়, ঠিকেদার নিজে ছুটে এসে, হাতে হাত লাগিয়ে মাটির তলা থেকে টেনে তুললাে এক বিশাল বড়ড়া গজাল। সম্ভবত সােনা বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে তৈরি। ইস্কুপ যেমন প্যাঁচওয়ালা আকৃতির হয়, তেমনি। ভদ্রলােক যখন গজালটাকে চোখের সামনে ধরে লােভাতুর চোখে তার বাজারদর বােঝার চেষ্টা চালাচ্চে, এবং তার গায়ে লেখা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হিজিবিজি লেখাগুলি উদ্ধার করার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই এল ঝড়টা। সাধারণ ঝড় নয়। কালবােশেখের বিকেলে যে ঘূর্ণিঝড় দেখাে, তাও নয়। কোন এক সর্বনাশা দানবী যেন প্রেতলােকের গহন রাজ্য থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষের সংহারের খেলায় নেমেছে। প্রকৃতি যেন হিংস্র, ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রোশে ফেটে পড়চে। চতুর্দিক ধুলােয় কালাে, অন্ধ হয়ে গেল। রেলবাংলাের পিছনদিকের সাতখানা শিমূলগাছ যেন ঝড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আছাড় খেতে লাগল।
যেসব গ্রাম্য লােকগুলাে দূরে দাঁড়িয়ে এদের কীর্তিকলাপ লক্ষ্য করছিলাে, তারা প্রত্যেকেই সভয়ে দেখলে যে, এই প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণি, এই সৃষ্টি স্থিতি বিনাশ করা অন্ধকার, কেবলমাত্র রেলবাংলাের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তার বাইরে সব স্বাভাবিক, সব উজ্জ্বল। শুধুমাত্র ঐ বাংলােকে আর শিমূলগাছগুলােকে যেন উপড়ে ফেলে, চরাচর থেকে মুছে ফেলতে চেষ্টা করুচে কোনাে ভুইফোঁড় দানব।
যাই হােক, আস্তে আস্তে ঝড়ের প্রকোপ আর তেজ কমে এল। অন্ধকার কেটে গিয়ে বাংলাের ধূসর রঙের দেওয়াল, গাছের সারি আর সবকিছু চোখে পড়তে লাগল। শুধু আর কোনদিনই দেখা গেল না ঐ ঠিকেদার আর তার সঙ্গের কুলিদের। ঐ ক্ষণিকের প্রলয় যেন তাদেরকে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। মােড়ল হিসেবে বিশ্বনাথ কয়দিন খোঁজ তল্লাশি করেছিলাে বটে, কিন্তু তাতে কোনই সন্ধান পাওয়া গেল না।
এই দুর্ঘটনার ঠিক পরের দিনই ঘটে মুর্মূ বাড়ির ঘটনাটা, যা কিনা ঐ পরগণার প্রথম উপদ্রব। গ্রামের বয়স্ক লােকেরা ঐ বাংলাে বাড়ির মর্মান্তিক ইতিহাস ভালাে ভাবেই জানত। তারা ঠিক বুঝে নিল যে ঐ বাড়ির বাঁধন থেকে কে মুক্তি পেয়েছে। তারা দলবদ্ধ গৃহবন্দি হয়ে থেকে, নিজেদের প্রাণ হয়তাে বাঁচাতে সক্ষম হচ্চিললা, কিন্তু প্রায় রােজই কারাে না কারাে গােয়ালে হানা দিতে ঐ মূর্তিমান যম। কখনাে গরু, কখনাে মহিষ, কখনাে বা ছাগল মেরে খেয়ে যেতাে। আর না খাওয়া বাকি হাড়, মাংস ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতাে গৃহস্থবাড়ির চালে, দাওয়ায়, পথের মাঝে।
নিঃশব্দে মাটির দেওয়াল খুঁড়ে তুলে নিয়ে যেত ছােট্ট নরম শিশুদের, কখনাে কখনাে বড় মানুষদেরও। কখনাে বা মাঝরাতে কানে আসত বাড়ির বাইরের দেওয়াল ঘেঁসে কে যেন কিছু খুঁকে চলেচে। তখন বাকি রাতটা পরিবারের সবাই মিলে না ঘুমিয়ে একসাথে আতঙ্কে কাটিয়ে দিত। রাত ভিতে কান পাতলেই শােনা যেতাে মেয়েলি কণ্ঠের অট্টহাসি আর হাহাকার, আর সেই হাড় হিম করা ‘হাআআআআ” চিৎকার শােনামাত্রই সবাই বুঝতে পারতাে যে মানুষখাকী তার শিকার ধরেচে।
আস্তে আস্তে গােটা পরগণার মানুষ এই দু তিনটে গ্রামে পা রাখা তাে দুরস্ত, এমনকি নাম উচ্চারণ করাও বন্ধ করে দিলাে। এই গাঁগুলির লােকেরা গ্রামান্তরে গেলেও, রাত্রি হবার আগেই তাদের বিদায় করে দেওয়া হতাে। কে জানে, হয়তাে এই হতভাগ্যই আজ ঐ অপদেবতার নজরে আছে। তাই একে খুঁজতে এসে হয়তাে এই তল্লাটেও ডেরা বাঁধবে ঐ ডাইনী। কিছুদিনের মধ্যে বাড়ি ঘর খালি হওয়া শুরু হল। যাদের অন্যত্র সংস্থান ছিলাে, তারা গাঁ ছেড়ে উঠে গেল। আর যারা জমিজিরাত ফেলে কোনােভাবেই যেতে পারল না, তারা এভাবেই ভয়ে আধমরা হয়ে দিন কাটাতে থাকল।
গােটা পল্লীর যখন এই অবস্থা, যখন প্রতি হপ্তায় হপ্তায়ই প্রায় গােটা দু তিনেক করে পরিবার হয় পালিয়ে যাচ্চে, না হয় আপাই-এর হাতে অপঘাতে মারা পড়ছে, ঠিক সেই সময়টাতেই আমার নিয়তি আমাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নিয়েছিলাে এই বধ্যভূমিতে। শারদীয়া দুর্গাপূজার হপ্তাদুয়েক পরে। আসানসােলের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পুরুলিয়ার বিভিন্ন গ্রামে, মুলুকে বিনি পয়সায় চিকিৎসা করাতাে দুঃস্থ, গরীব মানুষদের। সেই সংস্থার বাঁধাধরা ডাক্তার ছিলাম আমরা চারজন। রামদয়াল মুখুজ্জে ছিল অর্থোপেডিক, অর্থাৎ হাড়ের ডাক্তার আর তার বসতবাটী ছিল শ্যামবাজার ইয়ংবেঙ্গলের স্বদেশী কাপড়ের দোকান পেরিয়ে ট্রামগাড়িতে করে একটু দূরে বেলগেছে নামের জায়গায়। সাধন মুখুজ্জে ছিল এই রামদয়ালের খুড়তুতাে না জেঠতুতাে ভাই। সে ছিল দন্ত বিশেষজ্ঞ। আর আমার খুব কাছের বন্ধু শ্ৰী শরতকুমার চক্রবর্তী (তখন তার বাড়ি ছিল বঁড়শে বেহালাতে) আর আমি মেডিসিন বিভাগ এর। শরত আর আমি একই পাড়ায়, তখন সদ্য তৈরি হওয়া শেয়ালদা উড়ালপুলের কাছে নেবুলাতে বাড়ি কিনেচি, কিন্তু বাকি দুজনের সঙ্গে এখন আর তেমন কোন যােগাযােগ নেই। এ সবই আজ থেকে বহু বহু বৎসর আগেকার কথা। এতদিনে সে গ্রামটার নাম ঠিক মনে পড়ছে না, তবে, খুব মিষ্টি কি একটা নাম যেন ছিল।
যাই হােক, সেই সংস্থা আমাদের চারজনের পাঁচদিনের খাওয়ার জন্যে বরাদ্দ করলাে মােট তিনশাে টাকা। আজকে বসে এই টাকার অঙ্কটা শুনে হাসি পাবারই কথা, কিন্তু অত বচ্ছর আগে সত্যি সত্যিই এই টাকাতে জনা চারেক লােক হেসে খেলে সাত-আটদিন কাটিয়ে দিতে পারতাে। আমাদের বলা হলাে, ঐ টাকা গ্রামের মােড়ল বিশ্বনাথকে মাসখানেক আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। আমরা গেলে উনিই আমাদের আহারের আয়ােজন করবেন। আর থাকার জন্যে বরাদ্দ হল ঐ গ্রামের রেলবাংলাে। যদিও বাংলােটা ঠিক রেলের সম্পত্তি ছিল না। নিলামের মাধ্যমে তা কলকাতা শহরের কোনাে বিত্তবান ব্যাবসায়ীকে বিক্রয় করে দেওয়া হয়েছিলাে, কিন্তু তবুও প্রায় বছর তিরিশেক যাবত পরিত্যক্ত পড়ে থাকার কারণে, জেলাশাসক নিজের দায়িত্বে ঐ বাড়িতে আমাদের থাকার মৌখিক অনুমতি দেন। সঙ্গে দেন কিছু কার্বলিক আর বড়াে তিনটি হ্যারিকেন লণ্ঠন। শেষের দ্রব্য তিনটি সরকারের সম্পত্তি। আর বলে দেন যে দরকার মতাে মিট্টি কা তেল (কেরােসিন) যেন আমরা মােড়লের কাছে থেকে চেয়ে নিই, কারণ তিনি সদরের সরকারী কেরােসিনের সাপ্লায়ার। আমরা রওয়ানা হবার আগে একটা সস্তার ভাতের হােটেল থেকে পেট ভরে খেয়ে নিলাম। খাবার সামান্যই, বিউলির ডাল, ঝিঙ্গে পােস্ত, মাছের ডিমের বড়া, আর মৌরলা-তেঁতুলের টক, কিন্তু আবার কখন খাওয়া জুটবে তার কোনও ঠিক আছে?
আসানসােল থেকে চার কামরার (বর্তমানে লুপ্ত) ধোঁয়া ওঠা রেলগাড়িতে চেপে, মুরাদি স্টেশনকে বাঁয়ে ফেলে, যে জায়গাতে বাঁক নিয়ে লাইনটা ঝাড়খণ্ডের দিকে ঢুকে গেছে, ঠিক সেই বাঁকের সংযােগস্থলে এই গ্রামটা। ঝাড়খণ্ড (তখন বিহার) ঢােকার আগেই একটা বিশেষ বাণিজ্যিক লাইন ভাগ হয়ে, ডানদিক ঘুরে সােজা চলে যেত জঙ্গল অধ্যুষিত গ্রামগুলাের বুক চিরে। এখন তােমরা গ্রামের মধ্যে রেলের গাড়িতে চেপে যেতে যেতে দেখতে পাও পাকা নয়তাে টালির বাড়ি।
আমরা দেখেছিলাম ভেজা খড়ের কুঁড়ে ঘর, ছবির মতাে সাজানাে। মাইলের পর মাইল জমি জুড়ে শুকুতে দেওয়া পাট আর খড়ের গাদা। রেলের লাইনের গা ঘেঁষে বনকলমী, গােলঞ্চ, বুনাে গাঁদা, জবা আর রামতুলসীর ঝাড় আর তার বেগনি রঙের ফুল। আমরা যখন গিয়েছিলাম, সেই তখনই সেই লাইন দিয়ে রেলগাড়ি চলতাে না। এখনাে চলে না। এটা শুধুমাত্র তৈরি হয়েছিলাে জঙ্গল থেকে কাঠ, গুড়ি কেটে, তা মালগাড়ি মারফৎ সদরে চেরাইকলে পাঠাবার জন্যে। কিন্তু কোনাে কারণে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়, আর রেললাইন ঢাকা পড়ে যায় বিছুটি, কুঁদরি আর লজ্জাবতীর ঝােপে।
রেলের এই বাংলােটাও হয়তাে ওইসব সাহেব-সুবােদের জন্যই জন্মলাভ করেছিলাে, কিন্ত মশা ম্যালেরিয়ার জন্যই হােক, আর কাজকর্ম না থাকার জন্যই হােক, বাংলােটা রয়ে যায় জনশূন্য। গাঁয়ের পাঁচটা আজেবাজে লােক ঐ বাড়িটায় জ্বালানী কাঠকুটো আর খড়ের গাদা ডাঁই করে রাখতাে। আড্ডা দিতাে। পরে রেলের বড়ােসায়েব নিলাম ডেকে বাংলাে বেচে দেন শহরের কোনাে এক ধনী ব্যাবসায়ীকে। এ সবই এখানে এসে শােনা। আমাদের সদর থেকে বলা হয়েছিলাে, গাঁয়ের মােড়লের সঙ্গে দেখা করে, খাবারদাবার চেয়ে নিতে। তা আমরা গ্রামে ঢুকেই শুনলাম যে, মাত্র হপ্তাদুয়েক আগে, অর্থাৎ কোজাগরীর দিন নাকি ওনার বাড়িতে এক নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে গেছে। উনি নিজেও গুরুতর অসুস্থ। গাঁয়ের লােকেরা আরও কিছু বলতে নিয়েছিলাে, কিন্তু আমরা তার আগেই ওখান থেকে চলে এলাম।
আমরা পড়লাম মহা আতান্তরে। তাকে না পেলে খাবাে কী এই কয়দিন? অগত্যা আমরাই গুটি গুটি রওনা দিলাম ওনার বাড়ির দিকে। একে ওকে জিজ্ঞেস করে করে খুঁজে বের করলাম বাড়িটা। বেশ দু পয়সার মালিক বলেই মনে হল বাড়িটা দেখে। বাড়ির পাশ বরাবর বেশ কয়টা নারকেল গাছ। পিছনে অনেকখানি আমবাগান, ধানের গােলা, গােয়াল, সবই সম্পন্ন গৃহস্থের লক্ষণ।
একটা বাচ্চা ছেলে বিরাট উঠোনটায় ঘুরঘুর করছিলাে। আমরা মােড়লকে খুঁজচি জেনে বাচ্চাটা আমাকে আর শরতকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলাে। বেশ বড় পরিসর ভিতরে, কিন্তু একটু যেন অগােছালাে হয়ে রয়েছে। ঢুকেই ডানদিকে মাটি নিকোনাে রান্নার জায়গা। একজন বছর চল্লিশের ভদ্রলােক আর এক মহিলা ভাত চড়াচ্ছেন। আমাদের দেখে উৎসুক হয়ে চেয়ে রইলেন। সােজা এগিয়ে গিয়ে ডানপাশে শােবার ঘর।
ঘরে ঢােকার মুখে বাইরের দিকে এক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধার ফোটোগ্রাফ। ছেলেটির দিকে তাকাতেই সে বলে উঠলাে আমার দাদাই আর দিদি। এতক্ষণে বুঝলাম যে, যে দম্পতিটি বসে রান্না করছেন, তারা হলেন বিশ্বনাথের বোন আর বােনাই। এই বাচ্চাটি তাদেরই ছেলে। ঘরে ঢুকে সামান্য চমকালাম। অনেকসময় বাবা আর ছেলের মধ্যে মুখের অনেকটা আদল থাকে বটে, কিন্তু এতখানি সাদৃশ্য এই আমার প্রথম দেখা। ছবিতে দেখা বিশ্বনাথের বাবা আর বিশ্বনাথ কে শুধু বয়সের পার্থক্যতেই আলাদা করা যেতে পারে। বিশ্বনাথের চুল উসকোখুসকো, পরনে শাদা মিলের ধুতি, গা আদূড়। আমাদের পরিচয় জেনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি বাচ্চাটাকে দিয়ে কাদের যেন ডাকতে পাঠালেন। আমাদের হাতজোড় করে বললেন, “আমি কয়দিন যাবৎ অত্যন্ত অসুস্থ। নাহলে আমি নিজেই গিয়ে দেখা করতাম। আপনারা কিছুমাত্র চিন্তা করবেন না। আমার লােক গিয়ে আপনাদের চাল, ডাল, সবজী, মাছ, জ্বালানী, সব পৌঁছে দেবে। তবে ডাক্তারবাবু, একটা কথা আমার শুনবেন? আপনারা আমার বাড়িতে থাকুন। গাঁ গঞ্জের সব জায়গা ঠিক ভালাে নয়। এটা সাবধানবাণী নাকি ভয় দেখানাে সেটা আন্দাজ করতে পারলুম না।
আমি আশ্বস্ত করে বললাম যে আমাদের বাংলােয় থাকতে কোনাে সমস্যাই হবে না। শুধু শুধু আপনাকে বিরক্ত করার কোনাে মানেই হয় না। তিনি কী একটা বলবাে বলবাে করেও আর বললেন না। আমি বাংলােয় ফেরার পথে শুধু এটাই ভাবছিলাম যে, মােড়ল হওয়া বাস্তবিকই বড়াে সহজ কাজ নয়। নিজের মানসিক বেদনাকে চেপে রেখে, তিনি যে ভাবে নিজের কর্তব্যপরায়ণতার পরিচয় দিলেন, তাতে আমি এই অর্ধশিক্ষিত, গ্রাম্য মানুষটির প্রশংসা না করে পারলাম না।
ট্যাঁকঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সকাল ন’টার সময় আমরা এসে দাঁড়ালাম বাংলাের সুমুখে। দোতলা বাড়ি। সামনে বেশ অনেকটা বাগান করার মতাে জায়গা। পিছনেও ঠিক ততােটাই। সামনের জমিতে গাদাখানেক শুকনাে কাঁটাগাছের ঝােপ। হয়তাে বাড়ির মালিক কখনাে গােলাপ বাগান করেছিলেন। আর পিছনে বেশ কিছু দেবদারু, দুটো আম, কয়টা নিমগাছ, আর মাথা উঁচু করে একপেয়ে দানবের মতাে দাঁড়িয়ে রয়েছে সাত সাতটা আদিমকালের শিমূলগাছ। বাড়িটার রঙ ফ্যাকাসে কালচে মতাে। এমনকি ভিতরের দেওয়ালগুলাে অবধি। কিন্তু এটাও যে আর দশটা রেলবাংলাের মতােই উজ্জ্বল লাল রঙের ছিলাে, তা ঐ কালচে রঙের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি মারা ঝাপসা লাল রঙ দেখেই মালুম হয়। ফটকের বাইরে পাথরে খােদাই করে বাড়ির নামটাও লেখা আছে। নব ভূবন’। আগে কী ছিল তা তাে আমি জানিনে, কিন্তু এখনকার হতশ্রী অবস্থার সঙ্গে বাড়ির নামটি একেবারেই বেখাপ্পা ও হাস্যকর।
সে কথা থাক, আমরা মােটামুটি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই নিজেদের লটবহর একরকম গুছিয়ে, ঠিক দশটায় বাড়ির চৌহদ্দির বাইরের রাস্তায় তাঁবু ফেলে বসেছি। এর মধ্যেই মুখে মুখে খবর ছড়িয়ে পড়েছে, আর বেশ কিছু লােকজনও আসতে শুরু করেছে। এখানে আসা থেকে ক্যাম্প ফেলা অবধি এই দু তিন ঘণ্টায় অনেকগুলি ললাকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় করেচি, আর প্রায় প্রতিবারই আড়ালে-আবডালে অনেক উড়াে গুজব কানে এসে পোঁচেছে। সব গল্পই এই বাংলােকে ঘিরে। আমরা যে পেশায় আছি, তাতে আমাদের বহুদিন যাবৎ অনেক আগানে-বাগানে, অনেক আঘাটা জায়গায় রাত কাটাতে হয়েছে, হরেক কিসিমের লােকের সাথে মেলামেশা করতেও হয়েছে, তাই এইসব গল্পগুলােকে শুনেও তত বেশি বিচলিত আমরা হইনি, কিন্তু এবারে গ্রামের মানুষজন যা শুরু করলাে, তাতে আমি অন্তত সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। তাদের ভাঙা ভাঙা টুকরাে টুকরাে কথাগুলাে আজ এতদিন পরে আমার পক্ষে গুছিয়ে লেখা সম্ভব নয়, কিন্তু তাদের সবার কথাতেই একটাই আর্তি, আমরা যেন তাদের মধ্যে কারাে বাড়িতে গিয়ে রাত্রিবাস করি। নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবার ওই আকুলি বিকুলির ঠিক উল্টো অর্থ এই হয় যে, আমরা যেন বাংলােবাড়িতে না থাকি। তারা যেন ধরেই নিয়েছে যে কাল সকাল হলেই আমাদের আর পাওয়া যাবে না, আর বিনিপয়সায় চিকিৎসাও করানাে হবে না কারুর। কিন্তু আমরা তত অধিক চিন্তিত হলাম না, কারণ এই পেশার সুবাদে আমাদের বহু অদ্ভুত আর বিপজ্জনক স্থানে রাত কাটাতে হয়েছে। বাড়ির লােক প্রথম প্রথম খুব উদ্বেগ প্রকাশ করত, এমনকি আমার মা একদিন কালীঘাটের মন্দির থেকে একখানা ইস্টি-কবচ এনে গলায় পরিয়ে দিয়েচিলাে। বলেছিলাে মা রক্ষেকালীর এই কবচখানা গলায় থাকলে কোনও বিপদ বালাই নাকি স্পর্শ করতে পারে না।
যাই হােক, মেডিসিন বিভাগে যেহেতু আমরা দুজন ডাক্তার ছিলাম, তাই শরতকে আমার রিলিভার রেখে আমি চলে এলাম বাংলােয়, দুপুরের খাবার খেতে। আমি ফিরলে তারপর বাকিরাও আসবে একে একে। আজ রান্নাবান্না করতে পারব না জেনে মােড়লমশাই কোন এক ব্রাহ্মণকে দিয়ে টুকিটাকি রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কালাে তেঁতুল দিয়ে ঝকঝকে করে মাজা কাসার থালাগুলি তুলে তুলে দেখলাম খাবার বড় মন্দ নয়। ভাজা ঘন সােনামুগের ডাল, ডাঁটি সমেত বেগুন ভাজা, লম্বা লম্বা পটোল ভাজা, ছানা বড়ার ডালনা, একটা মাছের মাথা দেওয়া পাঁচমিশেলি ছাড়া আর পুকুরের রুই-এর ঝােল। অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে এসে, খাবারগুলি থালায় বেড়ে, আমার সঙ্গে আনা সদ্য বাজারে আসা ছয় ব্যাটারির রেডিওগ্রাম যন্ত্রটার চাবি ঘুরিয়ে চালু করে দিলাম। এই জরাজীর্ণ বাড়িটার সাথে যে আদৌ আকাশবানীর কোনাে সংযােগ থাকবে সেটা আমি আশা করিনি, কিন্তু বেতার কেন্দ্র জানান দিলেন যে তিনি পুরােদমে আছেন।
রেডিও রিসিভার যন্ত্র কথা বলে উঠলাে। কোন এক অখ্যাত তরুণী হিন্দিভাষায় উচ্চাঙ্গে রাগরাগিণীর আলাপ শুরু করেছেন। তা করুক। নির্জন এই অট্টালিকাতে নেই মামার চেয়ে, এই মামাই ভালাে।
খেতে খেতে একটা ঝটাপট শব্দ শুনে জানলার দিকে চেয়ে দেখলাম কতকগুলি পেল্লায় আকৃতির গােলা পায়রা কার্নিশে বসে ডানা ঝাপটাচ্চে আর মােড়লের রাখা চালের বস্তাটার দিকে লােলুপ চোখে দেখচে। একটা জিনিস খেয়ালে আসায় সামান্য অবাক হলাম। এত্ত বড় একটা বাড়ি এতদিন ধরে পরিত্যক্ত পড়ে আছে, কিন্তু একটা পায়রা, ঘুঘু বা কোনাে পাখিই বাসা বাঁধেনি। এটা একটু অস্বাভাবিক বৈকি। এইসব যখন চিন্তা করচি, আচমকা একটা বিকট কর্কশ আওয়াজে চমকে উঠলাম। রেডিওর ফিতে সম্ভবত এদিক ওদিক হয়ে গিয়ে, কিছুক্ষণ শাঁই শাঁই শব্দ করে, আবছা আবছা কথা কানে আসতে থাকল। সম্ভবত কোনাে শ্রুতি নাটক শুরু হল। যেন ঝড় আর বজ্রপাত শুরু হয়েছে, আর তার মধ্যে দিয়ে শােনা যাচ্চে এক গ্রাম্য বালার করুণ আর্তনাদ। সে তার কোনাে এক মনিবের কাছে দুটি ভাত ভিক্ষা চাইচে। বড় হৃদয়স্পর্শী সে কান্না। সেই সঙ্গে ভারী ভারী দরজা জানলা হাওয়ায় ধাক্কা খাবার দুমদাম শব্দ, আর তা ছাপিয়ে সেই মেয়েটির হাউ হাউ কান্না। “বাবুউউউউ… শুধু দু মুঠো ভাত দেবেন বাবু। আপনার পায়ে পড়ি, আপনাকে ভগবানের দোহাই… শুধু দু মুঠো ভাত।”
রেডিওতে এতটাই তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম যে, স্থান, কাল স্মরণ ছিল না। মনে পড়ায়, ধড়মড়িয়ে উঠে রেডিও বন্ধ করে, বাড়ির বাইরে হাত মুখ ধুয়ে ক্যাম্পে এলাম।
গ্রামের লােকগুলােও আমাদের টোপ দিতে পিছপা হলনা। যে দিনের কথা বলচি, সে দিনটা ছিলাে হৈমন্তী কালীপূজা। তা দেহাতি লােকেরা আমাদের ভরপেট খাওয়া, আর কচি পাঁঠার মাংসের লােভ দেখাতেও পিছপা হয়নি। কিন্তু শরত একটু অন্য ধাতের ছেলে। ছােট থেকে আজ অবধি যতগুলি ভূতের উপন্যাস পড়েচি, তার প্রত্যেকটাতেই মােটামুটি শরতের মতাে একটা করে বেপরােয়া চরিত্র থাকে, যারা অতিরিক্ত বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে শেষে বিপদকে আমন্ত্রণ জানায়। ভূতের গল্প পড়তে গিয়ে এই চরিত্রগুলির উপরে আমার ভয়ানক রাগ হতাে, কিন্তু এবার আমি বাস্তবেই এরকমই একটা চরিত্রের পাল্লায় পড়ে গেলাম।
এমনিতে খুবই বুদ্ধিমান আর ঠান্ডা মাথার ছেলে, কিন্তু বড্ড বেশি সাহস আর জেদ। সে এসব কথায় বিন্দুমাত্র কান না দিয়ে বরং হাে হাে করে হেসেই উড়িয়ে দিলাে। বললাে, “বুঝলে না ভায়া? এ হল গ্রামের নিজস্ব রাজনীতি। আমরা ডাক্তারেরা যদি কারাে বাড়িতে আতিথ্য স্বীকার করি, তবে এদের দেশওয়ালি বেরাদরের কাছে কদর বাড়ে। মান্যিগণ্যি বােঝায়। আর সেই সঙ্গে কালীপূজোর চার চারটে বামুন ভােজনের পুণ্যিটা ফাউ, কিন্তু ওরা তাে আর ছোটো মুখুজ্জের খাওয়ার বহর জানে না ভায়া। দশ দিনের আলাে-চাল একদিনেই সাবড়ে দেবে।” বলেই হা হা করে হাসতে থাকলাে। সত্যি বলতে ওর ঐ প্রাণখােলা হাসি আর দৃঢ়তার জন্যই আমরা বাকিরা ঐ ঘরে রাত কাটাতে সাহস পেয়েছিলাম।
যাই হােক, রুগী বড় কম ছিল না গাঁয়ে। ছােট মুখুজ্জের দাঁতের রুগীর দেখা না মিললেও, বাকিদের রুগী মিলিয়ে কিছু না হলেও জনা তিরিশেক তাে হবেই। তার মধ্যে একেকজন আবার অনেকগুলি করে রােগ বাঁধিয়ে বসে আছেন। মােটামুটি কুড়ি-বাইশ জনকে দেখতে দেখতেই অমনি বিকেল সাড়ে পাঁচটা বাজলাে।
বাইরে তখনও প্রায় দশ বারােজন দাঁড়িয়ে। আমরা আড়চোখে বার বার খেয়াল করছিলাম, বাইরের লােকগুলাে একটু অস্থিরভাবে পশ্চিম দিকে কি যেন একটা লক্ষ্য করে চলেছে। তাদের মধ্যে আরও দু তিনজন ভিতরে এলে পর আমরা সবে তাদের নাড়ী পরীক্ষা করতে নিয়েচি, অমনি লাইনে দাঁড়ানাে সবার মধ্যে হঠাৎ বিষম ঠেলাঠেলি হুড়ােহুড়ি পড়ে গেল। যাদের চিকিৎসা চলছিল তারাও “কাল আসবাে ডাক্তারবাবু” বলে দল বেঁধে হাঁটা লাগালাে। বার বার অনুরােধ করা সত্ত্বেও একটা মানুষও দাঁড়ালাে না।
আমি বাইরে বেরিয়ে দেখলাম পশ্চিমের জঙ্গলের মাথায় সূর্য এসে ঠেকেচে। কোন দূর থেকে যেন আবছা আবছা একটা হাসির মতাে ‘হাহাহাআআ আওয়াজ পেলাম আমরা। অমনি লােকগুলাে হাঁটা ছেড়ে দৌড় শুরু করলাে আর মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ক্যাম্প ফাঁকা হয়ে গেল।
এসব গাঁয়ে এমনিতেই ডাক্তারের আকাল। আসানসােলে দাওয়াখানা আছে বটে, কিন্তু সে খরচা দেওয়া এদের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তাই মুফতে চিকিৎসা, ওষুধ পেয়েও না দেখিয়ে চলে যাওয়াতে, আমার মনের মধ্যে কীট প্রবেশ করলাে। আবার সেই গল্পগুজব, কানাকানিগুলাে মনে পড়লাে।
এসবের পাট মিটিয়ে, তাঁবু গুটিয়ে, আমরা গিয়ে ঢুকলাম বরাদ্দ করা সেই বাংলােতে। দোতলায়। এতক্ষণে পুরাে বাড়িটা ভালাে করে দেখা হলাে। সিঁড়িতে দোতলায় উঠে সামনেই লম্বা টানা বারান্দা, আর উত্তরে একটা ঘরে গিয়ে সেই বারান্দা শেষ হয়েছে। সেটা বন্ধ। বাকি ঘরগুলাে সব ঐ বারান্দার বাম দিকে। আদ্যিকালের আমলের বিশাল বিশাল একেকটা ঘর, আর ততটাই উঁচু তার ছাদ। চুন সুরকির সাহায্যে আর্চ বানিয়ে গড়া। এককালে সম্ভবত বিদ্যুতের সংযােগও ছিল, কারণ দেওয়ালে ‘জি সি ওয়েলস’ কোম্পানির চীনামাটির বিদ্যুৎ বোের্ড চোখে পড়ল। আমরা পশ্চিমের সবকটা জানালা খুলে দিলাম। শিমূল গাছগুলাের পিছনে সূর্য তখন তার অস্তিত্ব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার ওধারে খানকতক নিম আর প্রচুর মেহগিনি গাছ। এই মেহগিনি গাছের প্রাচুর্য কিন্তু ইংরেজ আমল থেকেই বাংলায় প্রবল। বারােভূঁইয়ার অন্যতম ভুইয়া প্রতাপাদিত্য যখন তার মায়ের আদেশে যশাের রােড তৈরি করেন, তখনও ইংরেজ স্থপতিরা ঐ সীমাহীন সড়ককে ছাউনি দিয়ে দেন মেহগিনি গাছ দিয়ে।
কিন্তু একটা ব্যাপার দেখে আমার কেমন যেন কিন্তু কিন্তু লাগল। বাড়ির সবকটা দেওয়াল, মায় মেঝেগুলাে অবধি যেন কালাে কালাে কিসের পাতলা আস্তরণে ঢাকা। যেন পরতে পরতে অনেক কালের কালাে ধূলাের গুঁড়াে এসে জমা হয়েছে। এমনকি এই একদিনেই আমার সাধের রেডিওটার সামনের সাদা কাপড়ের অংশটা অবধি কালচে হয়ে গেছে। সবচেয়ে বাঁয়ের প্রকাণ্ড ঘরটায় আমরা নিজেরাই কোনােরকমে তিনটে অংশ সাফসুতরাে করে নিলাম। জানালার দিকের ভাগটা শােবার জন্য, মাঝেরটা মালপত্তর ও ওষুধের পেটি রাখার জন্য, আর দরজার সামনের অংশটা রান্নাবান্নার জন্য। জানালা দিয়ে বেশ ফুরফুর করে বাতাস আসছিলাে। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। শরত ওষুধের জমাখরচ লিখচিলাে, আর মুখুজ্জে দু ভাই সম্ভবত রান্না বা সবজি কাটা ধরনের কিছু একটায় ব্যস্ত ছিল। এমন সময় ‘জয় ত্তারা’ গােছের একটা পিলে চমকানাে হুঙ্কারে আমি ভীষণভাবে আঁতকে উঠলাম। শরত আর বাকি দুজন চাবুকের মতাে একযােগে সটান উঠে দাঁড়ালাে।
দরজার প্রায় পুরােটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে একজন লাল টকটকে কাপড় পরা কাপালিক। জটা আর গোঁফদাড়িতে শুধু চোখদুটো বাদে মুখের পুরােটাই অদৃশ্য হয়েছে। কপালে বেশ মােটা লালচন্দনের টীকা। হাতে একটা তামার চিমটে, আর দু পায়ে রুপাের মােটা দু গাছি রুলি পরা। এমন অস্বাভাবিক রকমের বুক কাঁপানাে নিনাদ কেবলমাত্র ওইরকম একটা দৈত্যাকার শরীর থেকেই বেরনাে সম্ভব।
-“কী রাঁধা হচ্চে?”
প্রশ্নটা একজন কাপালিকের মুখ থেকে এতটাই অপ্রত্যাশিত যে আমরা চট করে কোন জবাবই দিতে পারলাম না। শরত চোখ ছােট করে প্রশ্ন করলাে,
– “কে আপনি?”
জবাব এল না।
– “গাঁয়ের লোক কিছু বলেনি তােমাদের? নিশ্চয়ই বলেচে। তবে থাকলে কেন এ বাড়িতে?”
শরত তাচ্ছিল্য ভরে জবাব দিলাে, “হুম, বলচিলাে বটে কেউ কেউ, তবে গেঁয়াে ভূতেদের গ্রাম্য প্রলাপ শােনার বা মানার প্রয়ােজন মনে করিনি। তাই থাকচি। সােজা ব্যাপার।”
– “বাবু, তােমার ঘরদোরের অলিগলি যেমন তুমিই ভালাে বােঝাে, তেমনি পাড়াগাঁয়ের হালচাল এই গেঁয়াে ভূতগুলােই বেশি জানে। তাদের কথাটা শুনলেই ভালাে করতে। তােমাদের ধারণা যে গ্রামের লােক মানেই ভূত প্রেত দত্যি দাননায় বিশ্বাসী, তাই না? কিন্তু আদৌ তা বাস্তব কথা নয়। এরা খেটে খাওয়া, মজদুরি করা বাস্তববাদী লােক। ভূতপ্রেতের বিলাসিতার সময় এদের কোথা? যতক্ষণ না জীবনের সুতােয় টান পড়ছে, ততক্ষণ এরা এমনকি বাঘ সিংহের অস্তিত্বও অবধি স্বীকার করতে চায় না। এদের অবজ্ঞা করে নিজেকে ঠকিয়াে না।”
শরত এবার চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করলাে, “আমি নিজের চোখে দেখে, কেবলমাত্র কানে শুনে, নিজের বাপ ঠাকুরদার কথাও বিশ্বাস করিনে। বােঝা গেল?”
কাপালিকের কোনাে ভাবান্তর দেখা গেল না। তেমনি মৃদু হাসিমুখেই প্রশ্ন
‘
করল, “আর ঠাকুরদার বাপ কে? তাকে বিশ্বাস করে তাকে তাে তুমি চোখেই দেখােনি, শুধু বাপ ঠাকুরদার মুখে গল্প শুনেছো মাত্র। তাও তুমি বিশ্বাস করাে যে তিনি ছিলেন। তুমি চুলদাড়ি কাটাতে যে নাপিতের কাছে যাও, তাকে তুমি চেন? চেন না। তার হাতে ধারালাে অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তুমি নিশ্চিন্ত মনে তার হাতিয়ারের সামনে চোখ বুজে, গলা পেতে দাও। এটাকেই তাে বিশ্বাস বলে ডাক্তারবাবু। এই বিশ্বাসেই পৃথিবী চলে। অপদেবতায় তােমার বিশ্বাস থাক আর না থাক, তাই বলে তােমাকে বাগে পেলে অনিষ্ট করতে তার কিছুমাত্র আটকাবে না। তারা তােমার বিশ্বাস অবিশ্বাসের তােয়াক্কা করে না। রাত্তিরটা গাঁয়ের কারাে বাড়িতে থাকবে চলাে।”
এই প্রথম আমার মনে হল যে, এই কথাগুলাে তাে ঠিক চিরাচরিত তান্ত্রিকের যােগ্য হলনা। বরং দর্শন আর সমাজতত্বের ছোঁয়া আছে তাতে।
-“সে সবই তাে বুঝলাম, শুধু এই রাত্তিরে আপনার আসার কারণটা ছাড়া”, শরত বলল।
-“বলছি। আপাই কাকে বলে জানা আছে?”
-“আপাই’ মানে?” আমি অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করলাম।
-“আপাই হল একটা দশা। একটা অভিশাপ। শোনাে ডাক্তারবাবুরা, বাড়ির বড়ড়া বুড়ােদের জিজ্ঞেস করে দেখাে, যখন কেউ মনের মধ্যে কোনও অপূর্ণ আশা, কোনও ইচ্ছা নিয়ে অপঘাতে বেঘােরে প্রাণ হারায়, তখন তার ভেতরের আত্মাটা একটা দোষ পায়। সেই দশাটাকে বলে আপাই। ধূর্ত কুটিল, ভয়ানক হিংস্র এক দশা, যার মােকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব। এ গাঁয়ে সেই আপাই নেমেছে।”
তারপর তার মুখেই টুকরাে টুকরাে ভাবে এ গ্রামে চলতে থাকা নারকীয় নরমেধ যজ্ঞের ঘটনাগুলি শুনলাম। এমনকি আজই সন্ধে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ, অর্থাৎ যখন কিনা আমরা ক্যাম্প গুটাচ্ছি, সে সময়ে এখান থেকে মাইল দেড়েক দূরে মীনাপাগলীর জঙ্গলে রাক্ষসী তার শিকার ধরেছে।
গাঁয়ের দফাদার সুকিয়া হেমব্রমের বিঘে দুয়েক ধানি জমি আছে মীনাপাগলীর জঙ্গলের ওপারে। কাল থেকে তার জমিতে লােক খাটবে। তার আগে মেয়েকে নিয়ে বাধ্য হয়েই বীজতলা তদারক করতে গেছিলাে সে। সন্ধ্যা নামার আগেই তড়িঘড়ি বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাে তারা, কিন্তু জঙ্গলের অর্ধেক পেরােতে না পেরােতেই কেমন করে জানি আঁধার নেমে যায় ঝুপ করে। হনহন করে চলতে চলতে যখন বড়াে বিলটার পাশ অবধি পৌঁছেছে, ঠিক তখনই একটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়ালাে দুজনে।
চৌকো কাচের শিশ পড়া লণ্ঠনটা তুলে দেখলাে, বিলের উলটো দিকের ঝােপের থেকে দু তিনটে সরু বাঁশ নুইয়ে নেমে আসছে। সুকিয়া ওর বারাে বছরের মেয়েটার হাত শক্ত করে ধরে রইলাে। একটু সময় পরেই বাঁশ জঙ্গলের মধ্যে তুমুল হুটোপাটি শুরু হয়ে গেল, আর হঠাৎ ওঠা দমকা হাওয়া যেন ফুঁ দিয়ে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিলাে। সুকিয়া তাড়াতাড়ি মাটিতে বাতিটা রেখে যখন দেশলাই ঠুকচে, একবার মনে হল একটা গােঙানি আর দাঁত কিড়মিড় করার মতাে শব্দ কানে এল মুহূর্তের জন্যে। মরিয়া হয়ে ঝটপট বাতিটা জ্বালিয়ে পিছন ঘুরতেই দেখা গেল, তার মেয়েটা বিলের দিকে তাকিয়ে শান্ত মুখে কি যেন দেখচে। সুকিয়া আর কথা না বাড়িয়ে, মেয়ের হাত ধরে সবেমাত্র এগােতে যাবে, এমন সময় কানে এল বিলের জলে বুড়বুড়ি ওঠার শব্দ। লণ্ঠনটা একটু উঁচিয়ে ধরতেই তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলাে। জলের উপরে একটা কিশােরীর কাঁচের চুড়ি পরা হাত উঠে আছে। পাড়ের কাছেই। সুকিয়া মারাত্মক ভয় পেলেও দফাদার হিসেবে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারলাে না। বাঁ হাতে নিজের মেয়ের হাত চেপে ধরে, ঢালু কাদা মাখা পাড় বেয়ে একটুখানি নেমে ডান হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলাে সেই উঁচিয়ে থাকা হাতটা, আর বলিষ্ঠ হাতে এক হেঁচকা টান মেরে শরীরটাকে তুলে আনলাে পাড়ে। বাতিটাকে মাটি থেকে তুলে এগিয়ে আনলাে মৃতদেহের উপরে। কোমরের নীচ থেকে আধখাওয়া দেহটার মুখের দিকে তাকিয়ে একেবারে পাথর হয়ে রইলাে সুকিয়া।
সামনে পড়ে রয়েছে তার নিজের মেয়েটার আধখাওয়া দেহ। সুকিয়া আস্তে আস্তে মুঠো করা হাতটা ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে, ছদ্মবেশী মানুষখাকীর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাঙা কান্না ভেজা গলায় চিৎকার করে উঠল- “কে তুই রাক্ষসী? কে তুই? আমার মেয়ে সেজে তুই আমার এতবড় সব্বোনাশ করলি ডাইনী? আমার মেয়েটা তাের কি ক্ষতি করেছিল? হা ঈশ্বর…
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। ঘণ্টাখানেক বাদে পাগলের মতাে চিৎকার করতে করতে জঙ্গল থেকে ছুটে বেরলাে সুকিয়া। দুই চোখ ভয়ে ঠেলে বেরুচ্চে। গােটা দেহে, মুখে ফালা ফালা আঁচড়ের দাগ।
একনাগাড়ে কথা বলে কাপালিক থামলাে। আমরা তিনজন তাে বাংলাে ছেড়ে যেতে একপায়ে রাজী, কিন্তু শরত সে ধাতের ছেলেই নয়। হতভাগা ভূত প্রেত ভগবান কিছুই মানে না। আমরা জানতাম যে সে ছিল চূড়ান্ত নাস্তিক। একথা সেকথার পর, সে কাপালিককে সােজাসুজি বেরিয়ে যেতে বললাে, আর তাতে এই প্রথম কাপালিকের মুখে হাসির বদলে বিষণ্ণতা লক্ষ্য করলাম।
-“কোনাে কথাই যখন শুনলে না বাবুরা, তখন আমার আর কিছু করার নাই। আমি হংসি তান্ত্রিকের শিষ্য। গুরু আমার দেহ রেখেচেন আটাশ বছর আগে মাঘ মাসে। তখন আমি বছর কুড়ির জোয়ান। ছেলে বেলাতে গুরুদেব আমাকে পথের থেকে কুড়িয়ে এনে মানুষ করেন। সেই থেকে। আশ্রমই আমার ডেরা। যে কাউকে ভুবন তান্ত্রিকের ডেরা বললেই দেখিয়ে দেবে। চলি ডাক্তারবাবুরা।”
তান্ত্রিক চলে গেল। শরত তাকে নীচে নামিয়ে, কপাট এঁটে দিয়ে উপরে এল। যতই হালকা করার চেষ্টা সে করুক, আমার মনের খচখচানিটা কিন্তু নির্মূল হল না। রাত্রে ঘুমুতে যাবার আগে রান্নার জায়গাটায় একটা হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছিলাম। বাকি দুটি ছিল নেভানাে। এটা ওটা ভাবতে ভাবতে, সারাদিনের খাটাখাটুনিতে কখন যে চোখ জুড়িয়ে এসেচে বুঝতেও পারিনি।
ঘুম ভাঙলাে খুব অস্পষ্ট একটা আওয়াজে। অনেক দূর দিয়ে নারকেল বা তালপাতা টেনে নিয়ে গেলে যেমন খসখস হয়, অনেকটা সেই ধরনের। শরীরটা শিউরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলাম যে, আমাদের শিয়রের কাছে যে লম্বা মেঝের অংশটা আছে, সেখান দিয়ে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। এ মুড়াে থেকে ও মুড়াে। মাঝে স্কুপ করা ওষুধের পেটি, বস্তা আর তাঁবুটা ঢিপি করে রাখা আছে, কিন্তু তাতে তার হাঁটা কোনােভাবেই বাধা পাচ্ছে না। আমি ভীষণ আতঙ্কে তাকাবার বা পাশ ঘােরার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেললাম। স্নায়ু বিকল হয়ে আসতে শুরু করল। বাকি তিনজনেরই পালা করে নাক ডাকার গর্জন আসছে। অর্থাৎ আমি একাই জেগে। একটা হিমেল স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। আমি সবেমাত্র পাশ ঘুরে শরতকে ডাকতে যাবাে, এমন সময় কে যেন বরফ শীতল হাতে আমার মুখ চেপে ধরল। আমি বােবার মতাে গোঁ গোঁ করতে থাকলাম কিন্তু একফোঁটা শব্দও বেরুল না আমার গলা থেকে। পর মুহূর্তেই আমাকে একটা হঁচকা টান দিয়ে কে যেন টেনে নিয়ে চলল বাইরের দিকে।
আমি আতঙ্কে মরিয়া হয়ে চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সেই শীতল নখওয়ালা হাত আমার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে রাখল। সেই অদেখা অশরীরী আমাকে হিচড়ে হিচড়ে নিয়ে চলল বাইরের দিকে। তার ক্ষুরধার নখে আমার পিঠ ফালাফালা হয়ে যাচ্চে। মাটিতে পা আছাড়ি পিছাড়ি খেতে খেতে সভয়ে দেখলাম আমি এসে পড়েচি বাইরের পথের ধারের জঙ্গলের সামনে। কানে আসচে মেয়েলী কণ্ঠের চাপা হিংস্র গরগর আওয়াজ। আচমকা আমার পা জোড়াকে একটিমাত্র হাতের মুঠিতে ধরে সেই অমিত শক্তিধর প্রেতিনী উল্টো করে তুলে ধরল আর সবেগে ঝাঁকাতে শুরু করলাে। এতখানি রাস্তা পার হয়েও এখনও যখন সে আমাকে প্রাণে মারেনি, তখন আমার মনে একটু হলেও সাহস ফিরে আসছিলাে, যদিও এর কারণটা ছিল আমার অজানা, কিন্তু এই উল্টো করে ঝুলিয়ে যেই মুহূর্তে ঝাঁকুনি দিতে লাগল সে, সেই মুহূর্তেই তার কুটিল অভিসন্ধি আমার মাথায় বিদ্যুতের মতাে খেলে গেল, আর আমি আতঙ্কে কাঠ হয়ে গেলাম!
ইস্টিকবচ!
এই শয়তানী রাক্ষসী আমার গলার কবচ খুলে পড়ার অপেক্ষা করচে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে উল্টো হয়ে থাকা গলার ফাঁক দিয়ে কবচটা পড়ে না যায়, কিন্তু অসহায় ভাবে দেখলাম আমার অসাড় হয়ে আসা শরীরটা থেকে সেই কবচখানা ঠিক ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সেই মানুষখাকী আমাকে সজোরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাে পাশের ঝােপের মধ্যে।
কাঁপা কাঁপা হাতে ঝােপের পাতাগুলি সরিয়ে যা চোখে পড়লাে, তাতে আমার প্রাণ উড়ে গেল।
হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এক ধোঁয়াটে মেয়েমানুষের মতাে বিশাল মূর্তি। তার হাতের আগায় লম্বা লম্বা ধারালাে সাদা নখ। ছুঁচালাে দাঁতগুলি মুখ ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। আমি প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যেও প্রাণের তাগিদে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়াবার চেষ্টা করতে যেতেই কান ফাটানাে গর্জন করে আমাকে লক্ষ্য করে লাফ দিলাে সেই মূর্তিমান যম।
আমি চোখ মুদ্রিত করে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম এক ভয়ঙ্কর নৃশংস মৃত্যুর, কিন্তু তার মধ্যেও অনুভব করলাম যে সেই রাক্ষসী কোনােভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। আমাকে সে এখনও ধরতে পারেনি। চোখ খােলার মতাে শক্তিও আমার আর অবশিষ্ট ছিল না, কিন্তু অতি ক্লেশে আমি চোখ মেলে চাইলাম, এবং ভীষণ ভয়ে পুনর্বার আমার হৃদযন্ত্র স্তব্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হল।
সেই ভয়াল দর্শন মূর্তি আমার মাটিতে পড়ে থাকা শরীরটা থেকে মাত্র হাত চারেক উপরেই শূন্যে ঝুলচে। সে চাইছে হাত বাড়িয়ে আমার উপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়তে, কিন্তু কোনও অজানা কারণে তার সেই চেষ্টা বিফল হয়ে চলেচে। হঠাৎ একটা ভীষণ বজ্রপাতের নিনাদের মতাে “হুমমমমম” শব্দ কানে প্রবেশ করলাে, আর সেই শব্দেরই অভিঘাতে যেন সেই বিকটাকার নরখাকী ছিটকে পড়লাে অনেকটা দূরে এবং একটা বিফল আক্রোশে গর্জন করে উঠেই বাতাসে মিলিয়ে গেল।
সাক্ষাৎ ভয়াবহ মরণের থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়ে আমি হাউহাউ করে কেঁদে উঠলাম, আর তখনই আমার নজরে এল সামনের মাটির পথের উপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে একখানা ধোঁয়া ধোঁয়া ছায়ার মতাে দীর্ঘকায় মূর্তি। আমি ভয়ার্ত স্বরে রুদ্ধ কণ্ঠে কইলাম, “কে? কে ওখানে?”
জলদমন্দ্র কণ্ঠে উত্তর এল, “ব্রাহ্মণ। নাম কালীপদ মুখুজ্জে, নিবাস রায়দীঘড়া গাঁ।”
মানুষের কণ্ঠ শুনে আমি টলােমলাে পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আর এতক্ষণে তাঁকে বেশ উত্তম রূপে লক্ষ্য করলাম। পুরুষদের মধ্যে এমন চেহারা দুর্লভ। পরণে শ্বেতশুভ্র ধুতি আর কামিজ। দীর্ঘায় আন্দাজ ছয় হাতের উপরেই। মেদহীন মুখে বজ্রের তুল্য কাঠিন্য, কিন্তু চোখ দুটিতে শিশুর ন্যায় সরলতা আর নিরহঙ্কার দ্যুতি মাখানাে। একবার তাকিয়ে দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে। একবার তাঁকে দেখলে মন জানিয়ে দেয় যে এবার মুক্তি। আর কোনও বিপদ নাই।
আমি উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “কালীপদ মুখুজ্জে? নামটা বড়াে চেনা ঠেকছে। কোথায় শুনেচি বলুন তাে।”
কালীপদ এবারে প্রাণখােলা হাসি হেসে উঠলাে। বললে, “শােনাে পাগলের কথা। আমি কি তেমন তেমন কেউ নাকি যে চিনতে পারবে? বহুকাল আগে এই গাঁয়ে আমি গুরুর কাছে সাধনা করতুম। এখন নানান পাকে পড়ে সব বিদ্যাই যেতে বসেছে। তাই দুই একটা খুদকুঁড়াে যা রয়েছে, সেইগুলি ঝালিয়ে নিতে গিয়েছিলাম উত্তরের এক পাহাড়ে। তা সেইখেনে আমার গুরুভাইয়ের বার্তা পেলাম, এই পরগনায় নাকি মহা সর্বনাশ উপস্থিত হয়েছে। আমি আর রইতে পারলাম না। এই গাঁ আমার গুরুর গাঁ। এই পরগনায় আমার বিদ্যালাভ। সাধনা সম্পন্ন হবার পরে গুরুদেব আমাকে কয়েছিলেন এই গাঁয়ে যেন কখনও না আসি। আমার ধারণা আমি তেমন কিছুই শিখে উঠতে পারিনি, কিন্তু একদিন গুরুদেব কইলেন, ‘কালী… তুই তন্ত্রবিজ্ঞানে সিদ্ধি লাভ করেছিস। এইবারে তােকে এই গাঁ ছেড়ে যেতে হবে। তন্ত্রের নিয়ম হল দুইজন সিদ্ধাই এক সাধন ক্ষেত্রে রইতে পারে না। তাতে ক্ষতি হয়।
আমি সেই গাঁ ছেড়ে চলে গিয়েছি, তারপরে একসময় সংবাদ পেয়েছি গুরুদেব দেহ রেখেচেন যদিও তার কারণখানা আমাকে জানানাে হয়নি, কিন্তু সুদীর্ঘ কাল আমি এদিকপানে আসিনি। আজ এসেছি। এসেছি, কারণ আমি আমার গুরুদেবের মৃত্যুর হেতু আর হােতা দুজনের কথাই জানতে পেরেচি। গুরুদক্ষিণা শােধ করার সময় এসেচে।”
আমি কালিগুণীনের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলুম। কিয়দক্ষণ পূর্বেই দেখা সেই মায়াবী দৃষ্টিতে এখন বিদ্যুতের চাবুক ঝলসাচ্চে।
কালী আমার হাত ধরে অবিচলিত কণ্ঠে কইলাে, “আমি বাঙ্গালী। তুমিও তাই। আমি আজ চলেছি এই গাঁয়ের মানুষগুলাের দুঃখের সমাধান খুঁজতে। তুমি ডাক্তার। মানুষকে বাঁচানো তােমার পেশা। তুমি কি একজন বাঙ্গালী হয়ে আমার সঙ্গে এগুবে? নাকি কাল এই গাঁ ছেড়ে পালিয়ে যাবে? যা তােমার ইচ্ছা।”
কালীগুণীন যদি এর চাইতে আমাকে সরাসরি তাঁর সঙ্গে যেতে কইতাে তাহলে বরং আমি পিছিয়ে যেতে পারতুম, কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে যে কি উন্মাদনা, কি আবেগ ছিল, আমি এক কথায় সম্মত হয়ে গেলুম।
তান্ত্রিক আমার দক্ষিণহস্ত নিজের হস্তে ধারণ করে নিয়ে চলল সেই আমাদের রেল বাংলাের দিকেই। টেনে নিয়ে চলল বললেই যথার্থ হয়, কারণ আমি যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু তত অধিক সাহসও আমার বুকে নাই। একটু পরে আমরা দোতলায় উঠে এলাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে বাইরের দিকের ঘরটায় এসে দাঁড়িয়ে চার সেলের টর্চটার বােতাম টিপলাম। হালকা লালচে আলােতে দেখলাম অতবড়াে বিশাল ঘরটা খাঁ খাঁ করছে। তারপর ধীর পায়ে এগােলাম সিঁড়িতে ওঠার মুখের টানা ঝুল বারান্দাটায়। আমার শরীর রীতিমতাে ভারী হয়ে আছে বুঝতে পারছি। প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে, কে বা কারা যেন ঘরের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে ঝাঁপিয়ে পরার সুযােগের অপেক্ষায়। কোণায় কোণায় কাদের যেন চাপা ফিসফাস।
বারান্দায় বেরনাে মাত্র একঝলক ঠান্ডা কনকনে হাওয়া মুখে চোখে আছড়ে পড়লাে। বাইরের গাছপালা চাঁদের আলাের বন্যায় ভেসে যাচ্চে, আর তারই সামান্য দাক্ষিণ্যে বারান্দাটুকুও আবছা আলােয় ভাসচে। সঙ্গে একটানা ঝিঝি পােকার ঝিল্লী রব। কালী আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল বারান্দার শেষের সেই উত্তুরে ঘরটার দিকে। দরজার সামনে পৌছে টর্চ বাতির আলাে ফেললাম তালার উপরে।
ঘাের অন্ধকারের মধ্যে টর্চের আলাে জ্বাললে, বাকি চারপাশ যেন আরও ঘুটঘুটে মনে হয়। বাকি কিছু দেখা যায় না। কিন্তু আর কোনােদিকে দেখবার প্রয়ােজনও ছিল না। ক্ষয়টে আলােতে দেখতে পেলাম, দরজার তালা খােলা। কিন্তু এমনভাবে ঝােলানাে যে দূর থেকে দেখলে বন্ধই মনে হয়।
পেতলের সিংহমার্কা হাতলে সামান্য চাপ দিতেই ক্যাঁয়্যয়্যয়্যয়্যচ শব্দে পাল্লা খুলে গেল। আমরা ভিতরে পা দিলাম আর সাথে সাথেই মনে হল যে ঘরটা থেকে যেন কয়েক পরত আলাে কমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, বারান্দা অন্ধকার। কিছুমাত্র জ্যোৎস্না নেই। তবে হয়তাে মেঘে চাঁদ ঢাকা পড়েছে। এমন সময় বাতাসে ভেসে এল ক্ষীণ ঢাকের আওয়াজ, এবং তা শুনে এবার আমার নিঃশ্বাস অবধি স্তব্ধ হয়ে এল। আজ যে কালীপূজো। ঘাের অমাবস্যা। অথচ এই এক্ষুনি আমরা চাঁদের আলােতে বারান্দা পেরিয়ে এসেছি, এ কথা তাে মিথ্যা নয়। স্পষ্ট মনে আছে। আমি কালীর মুখের দিকে অসহায় শুকনাে মুখে তাকালাম। সে আমার হাতে আলতাে চাপ দিয়ে বলল, “বােকা, বাইরের জগতের নিয়ম, বিধি, বিজ্ঞান, কিছুই এখানে কাজ করে না। এ হল প্রেতলােকের রাজ্য। ওসব নিয়ে চিন্তা করাে না, আর হ্যা, একদম ভয় পাবে না কিন্তু। উপরে তাকাও।”
ওঁর হাতের আলােটা দেওয়ালের একজায়গাতে গিয়ে স্থির হয়েছিলাে। আমি সেদিকে তাকানাে মাত্রই আঁতকে উঠলাম। জানালার উপরে কুলুঙ্গির খােপটা থেকে উঁকি দিচ্চে একটা কাটা ছাগলের মাথা। ধবধবে সাদা লােম। তার সবুজ সবুজ চোখ দুটো টর্চের জ্যোতিতে ঝিকিয়ে উঠছে। একটা শিং ভাঙা, আর কাটা গলা থেকে অবিরাম রক্তের ধারা দেওয়াল বেয়ে নেমে, নীচের মেঝেতে জমা সাতপুরু ধুলাের উপর চাপ বেঁধে আছে। দোকানে বাজারে ছাগলের মাথা ঝুলতে আগেও অনেক দেখেছি, কিন্তু এই অপদেবতার নরককুণ্ডে দাঁড়িয়ে, সেই একই জিনিসকে দেখে আমার হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি শুরু হল। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম, কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম কোথাও কিচ্ছুটি নেই। কুলুঙ্গি চাপা পড়েছে মাকড়সার ফাঁদে।
এতক্ষণ আমরা দরজার দিকের দেওয়ালটাকে লক্ষ্যই করিনি। এবার ফিরতে গিয়ে আলাে গিয়ে পড়লাে তার ওপর। সংস্কৃতে হিজিবিজি কি সব যেন লেখা আছে তাতে। ভালাে করে নজর বােলাবার পরে দেখলাম সংস্কৃত নয় বাংলাতেই লেখা, কিন্তু লেখার ছাঁদ অনেক পুরনাে আমলের মতাে। একটা ছড়া লেখা। অতি মামুলি মানের ছড়া। আপাতঃ দৃষ্টিতে তার কোনাে মানেই খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু একটুও বাড়িয়ে বলছি না, আজ এতগুলাে বৎসর পরেও আমি সেটা মুখস্থ বলতে পারি। চুন সুরকির প্লাস্টারে ধারালাে কিছুর আঁচড়ে খােদাই করে লেখা আছে এক পাঁচ লাইনের ছড়া। আমরা পড়তে শুরু করলাম।
নবভুবন
কটকটে লাল বেত // কোনারক চকচক,
খসখস বন শাখা // মরু-জল তকতক,
কতক নদি, শাড়ি ও // ওড়িশা দিন কতক,
কত কত লজ-রুম // খাশা নব সখ সখ,
কচকচ কর নাকো // তবে ললাটে কটক।
– হংসিনী সিংহ
–
সেই অতি মামুলী ছড়াখানার নীচে আরও ক্ষুদ্র হরফে লেখা রয়েছে, “আমার নামে যে গুণ আছে, ছত্রে ছত্রে সে গুণ আছে”।
পড়ে কিছুই বুঝলাম না। এতক্ষণে আমার ভয় কিছুটা দূর হয়েছে। বললাম, “নবভুবন তাে এই বাড়িটারই নাম, সেটা মনে আছে, কারণ আমরা এই নামটা নিয়ে হেসেছিলাম। কিন্তু লেখকের নামটা কখনােই শুনিনি।”
কালী সামান্য হেসে বলল, “শুনেচো ভায়া শুনেছো। মনে হয় আজ সন্ধেবেলাতেই শুনেছো।”
এবার মনে পড়লাে। ঐ ভুবন কাপালিক নিজেকে কোনও এক হংসি তান্ত্রিকের শিষ্য বলে পরিচয় দিয়েছিলাে। এটা তাহলে সেই গুরুরই লেখা। কাপালিক হংসিনী। ভুবন আর কালী তান্ত্রিকের মন্ত্র দাতা দীক্ষাগুরু।
লেখাটা নিয়ে এতটাই তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম যে, কতক্ষণ সময় কেটে গেছে সত্যই খেয়াল করিনি। পশ্চিমের বন্ধ জানালাটার ওপাশে চৌহদ্দির বাইরে থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে একটা দুটো কাক ডেকে উঠলাে। কালীর দিকে তাকিয়ে দেখি তার দুচোখ ভেসে যাচ্চে জলে। মৃত গুরুদেবের জীবনের অন্তিম প্রহেলিকার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সে কাঁদছে। অবশেষে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যখন বারান্দায় এলাম তখন পূবের আকাশে ফিকে সাদা আভা দেখা দিয়েছে।
আমরা আর ডানদিকে ঢুকলাম না। এখনাে বাকি তিন সঙ্গীর নাকডাকার আওয়াজ আসছে। একতলার দরজার খিল খুলে বেরিয়ে এলাম। দুপাশের শুকনাে গােলাপ কাঁটার ঝােপ পার করে রাস্তায় নামলাম। একটা দুটো করে পাখি জাগতে শুরু করেছে। সকালের ভেজা ভেজা পাতাগুলাের উপরে কাঁচপােকাগুলি লাফিয়ে বেড়াচ্চে। কালী রেল বাংলাের পিছনের সেই আদিম, ঝােপ ঢাকা রেললাইন ধরে এগােতে শুরু করলাে। আমি প্রথম থেকে সেই যে তাঁর হাত ধরে ছিলাম, তা আর ছাড়িনি। এমনকি সােয়া-ঘণ্টা হেঁটে যখন বটতলায় পৌঁছালাম, তখনও সেই হাত ধরা।
বটতলার সবেধন চায়ের দোকানে তখন আঁচ পড়চে। মাটির দেওয়াল আর তালপাতার বাতা দেওয়া দোকানে জনা পাঁচ-ছয়েক লােক চা খাবার জন্যে বসে আছে। আমাদের দেখে তাদের প্রত্যেকেই খুব ব্যস্ত হয়ে এগিয়ে এল। সাত তাড়াতাড়ি গামছা-টামছা দিয়ে কাঁঠালগাছের গুড়িটা ঝেড়ে ঝুড়ে দিয়ে একজন হাঁক দিলাে, “হে মহিম, ডাক্তারবাবুরা এয়েছেন হাে। চা পানি দেও তাত্তারি।”
গরুর দুধের চা আর নারকেল কোরা দিয়ে মাখা মুড়ি পেলাম। দোকানদার অত্যন্ত প্রবীণ মানুষ। যিনি হাঁক দিলেন, তিনিও তাই। আমরা বাদে বাকিরা সবাইই প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরের ঘরে। কিন্তু কারুর শরীরেই কোনাে দুর্বলতার চিহ্ন নেই। এরা সারারাত্তির দলবেঁধে কালীপূজো দেখে, এখন দলবেঁধেই বাড়ি ফিরচিলাে। দোকানদার কিন্তু চা দিয়ে চলে গেল না। কালীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কালী বার তিনেক তার মুখের দিকে তাকিয়েও ইতস্ততঃ চোখ ফিরিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগল। কিন্তু মহিম দোকানী চোখ সরাল না। কালী বার দুয়েক বুড়ােআঙুল খুঁটে, সােজাসুজি দোকার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাে, “আপনি পুরােটা জানেন? বিলক্ষণ জানেন। আমাকে বলবেন?”
মহিম সামান্য ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলাে, “ডাক্তারবাবুদের আমি কালকেই দেখেছি, কিন্তু তার মাঝে আপনি ছিলেন না। আপনার পরিচয়?”
-“ব্রাহ্মণ। নাম কালীপদ মুখুজ্জে। নিবাস সোঁরবনের রায়দীঘড়া গাঁ। আপনারা আমার গুরুদেব অঘােরী হংসী তান্ত্রিককে তাে বেশ চিনতেন।”
মহিমের চোখে তান্ত্রিকের নাম শােনামাত্র যুগপৎ সম্রম আর বিস্ময় ফুটে উঠলাে। সে দোকানে বসে থাকা নাতির দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, “হাে,
চুলা ডি উসকাই কি দুধ চড়াই দিবাে।”
এরপরের কথাগুলাে যদিও পুরােটাই দেহাতি ভাষায় হয়েছিলাে, কিন্তু আমি সেগুলাে বাঙলাতেই লিখব। দোকানী উল্টোদিকের পেয়ারা ডালের বেঞ্চিটাতে বসল। একটু কি ভেবে নিয়ে, শান্ত গলাতে বলতে শুরু করল, “আমরা গাঁ গঞ্জের মানুষ বাবু। কত কষ্ট, কত যাতনা সয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হয়, তা তােমরা চিন্তাও করতে পারবে না। সহজে আমরা কষ্ট দুঃখ পাইনে, কিন্তু কষ্ট কখন হয় জানাে বাবু? যখন ভালাে মানুষে। খারাপ ব্যভার করে। যখন খুব বিশ্বাসের, খুব ভরসার মানুষটা দানাে হয়ে গিয়ে গাঁ কে গাঁ উজার করে দেয়।”
– “দানাে”? আমি অস্ফুট স্বরে বলে ফেললাম, আর সঙ্গে সঙ্গে ডান উরুতে কালীর একটা মােক্ষম চিমটি টের পেলাম। চুপ করে গেলাম।
দোকানী আবার বলতে শুরু করলাে, “এখানে যে রেল বাংলােয় আপনারা উঠেচেন, সেখানা আজ থেকে বছর তিরিশেক আগে অবধি ছিল রেলের সম্পত্তি। ঐ জঙ্গলের কাঠকুটো কেটে রেলের গাড়িতে করে শহরে নিয়ে যেতাে সায়েবরা। তাদের থাকবার জন্যিই তৈরি হয় ও বাড়িখানা। ততদিন আগেও গােটা গাঁয়ে একমাত্র ঐ বাড়িতেই বিজলীবাতি ছিল। সায়েবরা শেষ অবধি মশা, সাপ আর বিছা নিয়ে থাকতে রাজী হল না।
ও বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকত। তার কিছুদিন পর কলকাতার এক মস্ত বড়ােমানুষ রাখহরি মুখুজ্জে এ বাংলােখানা ডাক-বিক্রীতে কিনে নিলেন সেই যাকে বলে আট হাজার টাকায়। তিনি আর গিন্নীমা এ বাড়িতে এসেছিলেন বটে, কিন্তু প্রথম প্রথম কয়বার মাত্র। তারপর থেকে দুজন চাকর, একজন খাস চাকর, আর এক রান্নার ঠাকুর মাত্র থাকত। চাকরগুলা মােটে ভালাে লােক ছিল না বাবু। বড়ােকত্তার থেকে পয়সা চেয়ে নিতে বলে, হদ্দ হামেশা আমাদের এর বাড়ি ওর বাড়ি থেকে জোর করে ছাগল, মুরগি নিয়ে চলে যেত। কখনাে পয়সা দিতাে না। মাঝে মাঝে ছাগল, ভেড়া চুরিও করতাে তারা। মােটে ভালাে লােক ছিল না। আমি তখন বছর চল্লিশের জোয়ান মদ্দ। ও বাড়িতে মালীর কাজ পেলাম।
নিজের মুখে বলতে নাই বাবু, এই হরেন মাস্টার সাক্ষী, আমার হাতে মরা গাছ প্রাণ পায়। বাড়ির সুমুখের বাগানে গােলাপ বাগান করলাম। গােটা লাল টুকটুকে বাড়িখানা গােলাপের খােশবাইতে ম ম করত গাে। বাবু তাে বাগান দেখে খুব খুশি হয়ে আমার মজুরি আট আনা বাড়িয়ে দেছলেন। এই বড় কত্তামশাইয়ের এক ছেলে ছিল। নাম বিজয় মুখুজ্জে। ভারি মিষ্টি দেখতে তাকে। পটের নারানঠাকুরটির মতাে একমাথা চুল, টানা চোখ আর সাদা সায়েবদের মতাে ছিপছিপে চেহারা। এই ছােট কত্তামশাইই এই বাড়িতে বেশি আসতেন। এ পরগণায় তেনাদের কাচ আর তিসির তেলের কারবার ছিল, আর ছিল পুরীর মন্দিরের কাছে গােটা তিনেক বিশাল বিশাল লজ-বাড়ি।
এখানে আগে একটা কথা বলার দরকার ডাক্তারবাবু, ছােটকত্তার বয়স যখন দশ বারাে বচ্ছর, তখন একটা ঘটনা ঘটেছিলাে। রাখহরি মুখুজ্জে সপরিবারে পুরীতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। লজগুলিও তদবির-আদায় করা হবে এই ফাঁকে। পুরী থেকে কোনারকের সূর্যঠাকুরের মন্দির দর্শনের সময়ে দশ বছরের বিজয়কে সাপে কাটে। চোখ উল্টে, অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার পরে সবাই যখন আশা ছেড়েই দিয়েছে, গিন্নীমা কেঁদে মাটিতে লুটোচ্চেন, ঠিক সেই সময়ে খবর শুনে হাজির হলেন ঐ তল্লাটের এক দোকানদার। তার নামটা কত্তামশাই বলতেন বটে, তবে এখন আর মনে পড়ছে না। তিনি ছিলেন কত্তাবাবারই সমবয়সী। জাতিতে উৎকল ব্রাহ্মণ সেই লােকটি নানান ওষুধ বিষুধ জানত। হাত পায়ের নানা জায়গার চামড়া চিরে, ওষুধ ঠেসে দিয়ে, এখানে ওখানে গিটটি পট্টি বেঁধে, আর গােটা শরীরে ধুলােবালি মাখিয়ে দেবার কিছু পর থেকেই শিশুর শীতল শরীরে উত্তাপ ফিরতে লাগল।
ঘণ্টা দুয়েক বাদে ভয় কেটে গেল। বিজয় উঠে বসল, আর সেই সঙ্গে ঐ দোকানীর সাথে রাখহরিবাবুর গড়ে উঠল প্রাণের বন্ধুত্ব। ঐ ভদ্রলােক ছােট ব্যবসায়ী ছিলেন। বাড়ি কটকে। পুরীর বিখ্যাত লাল রঙ করা বেতের লাঠি, আর সম্বলপুরী শাড়ির কারবার ছিল তার। এই ঘটনার পরে রাখহরিবাবু বহুবার পুরীতে নিজের লজে গেছেন, আর প্রতিবারই দেখা করেছেন তার উপকারী বন্ধু আর তার পরিবারের সাথে, কিন্তু বিজয়ের বয়স যখন তের চোদ্দ, তখন একবার তিনি একাই পুরী গেলেন বটে, কিন্তু ফিরে এলেন বিষন্ন মুখে, একটি বছর আষ্টেকের খোঁড়া মেয়েকে সঙ্গে করে। জানা গেল বন্ধু আর তার পরিবার বাড়ির মাটির দেওয়াল ধ্বসে প্রাণ হারিয়েছে, কিন্তু বেঁচে গেছে শুধু এই মেয়েটি, আর সেই অনাথা অভাগীকে মায়ের স্নেহে বুকে টেনে নিলেন গিন্নীমা।
মেয়েটির নাম মালা। বড্ড লক্ষ্মী মেয়ে। উকল ব্রাহ্মণ বলে মাছ মাংস ছোঁয় না। নিরিমিষ খায়। কাজে কর্মে, কথাবার্তায় বড় মিষ্টি, শুধু দোষের মধ্যে বেচারির বাঁ পা’টা সামান্য খােড়া, এবং সেটিতে মাত্র চারটে আঙুল।
গিন্নীমার ভীষণ সাধ ছিল যে, মালা বড় হলে ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে দেবেন, কিন্তু ছােট কত্তাবাবা সে মেয়েকে দু চক্ষে সহ্য করতে পারতেন না। বড়ােমানুষের ছেলেরা যেমন হয় আর কি। সে চিরকালই মালাকে একজন অভাগা, একজন কাজের লােক বলেই ভেবে এসেছে। বাড়ির চাকর-বাকরের থেকে তাকে আলাদা করে দেখার কোনাে তাগিদও অনুভব করেনি কখনাে। তাই এই প্রস্তাব ওঠার পরে, মালা বিনা দোষে বিজয়ের চোখের কাঁটা হয়ে রইলাে।
এই বাংলােটা কেনার দু বছরের মাথায়ই গিন্নীমা পরলােকগত হন, আর তার এক বছরের মধ্যেই বড়াে কত্তাবাবাও। ফলে বাড়ি ,ব্যবসা, লজের সব দায়িত্ব এসে পড়ে বিজয়ের ঘাড়ে এবং সে মালাকে পাঠিয়ে দেয় এই অজ গ্রামে। বাকি চাকর বাকরদের সাথে। গাঁয়ে কিন্তু আমরা সবাইই জানতুম যে মালা দিদিমনির সাথেই ছােট কত্তার বে হবে, কারণ গিন্নীমাই আমাদের খুব আনন্দ করে সে কথা বলেছিলেন, ফলে আমরা মনিবের চোখেই দেখতুম দিদিমনিকে।
তা, এক মাঘ মাসের শীতের রাত্তিরে বিজয়বাবু এসে পৌঁছালেন গাঁয়ে। পরদিন সকালে তার সদরে (আসানসােলে) ব্যবসার কি যেন কাজ ছিল। তাই রাতটা নিজের বাড়িতেই কাটাবে বলে আসা। সন্ধ্যার মুখে ছােটকত্তা যখন এসেছিলেন তখন আমরা কেউই তাকে নজর করিনি, কারণ শীতের সন্ধ্যায় পথে বড় বেশি লােক থাকে না। বিজয় এসে দরজায় ঘা দিলাে। মালা দরজা খুলল, আর বিজয়কে দেখে ভুত দেখার মতাে চমকে উঠলাে। মালাকে একপাশে সরিয়ে বিজয় ঘরে ঢুকে এল। মালা আমতা আমতা করে অস্ফুট স্বরে তাকে কি যেন একটা বলতে যাবে, এমন সময়ে রান্নার ঠাকুর এসে দাঁড়ালাে। মালাকে দেখে বলল, “কি রে ? হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস যে বড়? যা উপরে যা।
দিদিমনি বামুন ঠাকুরকে দেখে সিঁটিয়ে গেল, আর বাধ্য মেয়ের মতাে উপরে চলে গেল। বিজয় একটু অবাক হয়ে খেয়াল করলাে যে শুধু রান্নার ঠাকুরই নয়, বরং সবকটা চাকরকেই যমের মতাে ভয় পায় মেয়েটা। তাদের কথায় ওঠে বসে। বিজয় মনে মনে একটু প্রসন্ন হল। পুরনাে কাজের লােকদের সামনে মালা তার কর্তৃত্ব খাটাতে পারেনি। বরং তাকেই এদের কথা শুনে চলতে হয়। এখানে সে গিন্নীগিরি ফলাতে পারে না। শাবাশ। এই তাে চাই।
ভিতরবাড়ির কলতলায় হাত মুখ ধুয়ে, রান্না চাপাতে বলে সে চলে গেল। উপরতলার উত্তরের ঘরটায়। কিছুক্ষণ পরে মালা অকারণেই এটা ওটা পরিস্কার করবার অছিলা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকল। দরজার দিকে উঁকি মেরে নিয়ে চাপা স্বরে বিজয়কে বলল, আমার পােড়া অদৃষ্ট যে আজ নিজের মুখে আপনাকে এসব কথা বলতে হচ্চে দাদাবাবু, কিন্তু আপনি আচমকা এ বাড়িতে এসে পড়ে ভালাে কাজ করেননি। এদের হাতে আপনি কিচ্ছুটি খাবেন না বাবু। আমি কপাল দোষে এই দেউড়িতে বাঁধা পড়ে গিয়েচি বাবু, কিন্তু আপনি এখুনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যান। নাহলে…
মালা থেমে গেল। বিজয় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, দরজায় তার খাস চাকর সেনাপতি দাঁড়িয়ে। সেনাপতি চোখ পাকিয়ে মালার দিকে ফিরে বলল, “কী জন্য ঢুকেছিলি দাদাবাবুর ঘরে? আঁ? কথার জবাব না দিয়ে মালা মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
বিজয়ও মালার এই অসংলগ্ন আর অপ্রত্যাশিত কথায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাে। সেনাপতি বলল, খাবার বেড়েচি দা’বু। খাবেন চলুন।
-‘আজ কী বেঁধেচে বামুনঠাকুব?’
-‘আজ্ঞা, কচি পাঁঠার ঝােল আর টুকিটাকি।’
বিজয় নিচে নেমে খেতে বসলাে। মাথার ওপর দুখানি নিভু নিভু বিজলি বাতি জ্বলচে। সব খাবার বিশাল জলচৌকিতে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাকর, বামুন সব আশেপাশে দাঁড়িয়ে খাবার তদারকি করচে, আর মালা পিছনে দাঁড়িয়ে পাখার বাতাস করচে। বিজয় আসনপিঁড়িতে বসে সবেমাত্র ভাতের গ্রোস মুখে তুলতে যাবে, এমন সময় বিজলি চলে গেল, আর মুখ তুলেই বিজয়ের বুক ধড়াস করে উঠল। যেখানে চাকরগুলাে থাকার কথা, সেখানে রয়েছে শুধু জোড়া জোড়া সবুজ মার্বেলের মত আলাে, যে আলাে শিয়াল কুকুরের চোখের জ্যোতিতে থাকে। একটু বাদেই আবার আলাে জ্বলে উঠল, আর আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেল। বিজয় ভাবলাে তার চোখের ভুল হয়েছে।
মাছের মুড়াের ডাল আর ভাজাভুজি শেষ করে বিজয় যেই মাংসের বাটির দিকে হাত বাড়িয়েছে, সেই সময় মালা অসাবধানে হাতপাখার ধাক্কায় বাটিটা ছিটকে মাটিতে ফেলে দিলাে। ব্রাহ্মণ মানুষ দ্বিতীয় বার খাবার চেয়েও খেতে পারেন না। অগত্যা বিরক্ত মুখে খাওয়া ছেড়ে উঠে, কলতলায় আঁচিয়ে, বিজয় সােজা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাে।
ঘাের শীতের রাত্তিরে বেশ ঘুম ঘুম এসেছিলাে, কিন্তু মাঝরাত্তিরে হঠাৎ কানে এল, বাইরে দাঁড়িয়ে কে যেন জানালায় ঠক ঠক করচে। ঘুমের মধ্যে তার আর উঠতে ইচ্ছে হল না, কিন্তু তা সামান্য সময়ের জন্যে মাত্র। তারপরেই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে পড়লাে বিজয়। এও কি সম্ভব? দোতলার জানলায় কেউ কড়া নাড়বে কেমন করে? তবে কি কোন গাছের ডাল জানলায় এসে ঘা দিচ্ছে? তাই বা কী করে হবে! বাড়ির সামনের দিকে তাে কোনাে বড় গাছই নেই, শুধুই গােলাপ বাগান!
বিজয় নিঃশব্দে জানালার খড়খড়ির পাশে এসে দাঁড়ালাে। শব্দটা হয়েই চলেচে। খট খট ঠক ঠক। ডান হাতটা বাড়িয়ে জানালার হুড়কো খুলে ফেলা মাত্র কপাটগুলি সপাটে খুলে গেল, আর ঠান্ডা কনকনে হাওয়া এসে হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিলাে। ইংরাজি স্থাপত্যে তৈরি এ বাড়িতে জানালায় কোন গরাদ নেই। বাঁ হাত বাড়িয়ে বিজয় বিদ্যুৎ বাতির চাবিটা ঠেলে তুলে দিলাে, আর ঘর মুহূর্তের মধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল।
নিজের শরীরকে যথা সম্ভব লুকিয়ে রেখে, সে জানলায় মাথা বাড়িয়ে বাঁ চোখ রাখল, আর সেই মুহূর্তে তার গােটা শরীর হিম হয়ে গেল। জানলার বাইরের দিকের এগােনাে চাতালে বসানাে আছে একটা ধপধপে সাদা ছাগলের কাটা মুণ্ডু। চোখ দুটি বোঁজা। গলা থেকে ফিনকি দিয়ে বয়ে চলেচে রক্তস্রোত। বিজয়কে দেখে সেই মুণ্ডু নিজের সবজে চোখের ঢাকনি খুলল, আর কাতর স্বরে ব্যা অ্যা অ্যা অ্যা অ্যা করে চাপা গলায় ডেকে উঠলাে।
চোখের ভুল নয়। একটা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন কাটা মাথা তার সামনে ডাকচে। বিজয় বােবার মতাে গোঁ গোঁ চিৎকার করে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। খাটের পায়া হাতড়ে উঠে দাঁড়িয়েই দৌড় দিলাে একতলার দিকে, কাজের লোকদের দেখা পাবার আশায়। সিঁড়ি থেকে নেমেই কানে এল, কলতলায় কোনাে কাজের লােক নলকূপ টিপে জল নিচ্ছে, আর সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজকে লক্ষ্য করে, ভরসায় বুক বেঁধে টলােমলাে পায়ে কোনােমতে এসে দাঁড়ালাে কলতলার কুয়াের মুখে। পলকহীন দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যাবার আগে বিজয় দেখল, নলকূপের হাতল টিপে কেউ জল নিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু কোনাে মানুষকেই দেখা যাচ্চে না, আর জলের বদলে লােহার মুখ দিয়ে বের হচ্চে টাটকা, তাজা রক্তের স্রোত।
ছােটকত্তা কতক্ষণ বেহুশ ছিলেন খেয়াল ছিল না, কিন্তু যখন ধুম জ্বর নিয়ে তার সম্বিত ফিরল, তখন ভােরের আলাে ফুটব ফুটব করচে। খালি গায়ে, ধুতি পরে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে, তিনি বেরিয়ে এলেন সদর দরজার বাইরে, আর প্রাণের তাগিদে ছুটতে ছুটতে আমার দোকানে এসে আপনাদের এই কাঁঠালগাছের বেঞ্চিটাতে বসে বেদম হয়ে হাঁপাতে লাগলেন। তখন দোকানের সামনে এই এইখানটায় রেলগাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। তখন এ লাইনে রেলগাড়ি চলতাে দিনে দুটো। একটা এই সময়ে, আরেকটা বিকেলে। তখন তার মুখেই আমি সব ঘটনা শুনি।
আমরা তাে কত্তাকে দেখে হাঁ হয়ে রয়েছি, কারণ তিনি কখন বা গাঁয়ে এলেন, কখন বা এসব হল, আমরা তার কিছুই জানিনে। জানলে তাকে ঐ বাড়িতে ঢুকতে দিই? আসলে তার হপ্তাখানেক আগে আমাদের মুলুকে বুনাে কুকুরের একটা গােটা দল এসে আস্তানা নিয়েছিলাে, আর সেই কারণে আমাদের রাত্তিরের ঘুম উড়ে গিয়েচিলাে, কারণ তারা একবার কোথাও আশ্রয় নিলে আর সহজে গা তােলে না বাবু। বড় ভয়ানক জন্তু। কোথাও ঘাপটি মেরে বসে থেকে, রাত হলেই গেরস্থবাড়ির গরু ছাগল মারে। গাঁয়ের হুলাপার্টির লােকেরা বাধ্য হয়ে একখানা সাদা ধপধপে ছাগল ধরে, তার গায়ে বেশ করে প্রাণমুগরাে গাছের কষ মাখিয়ে, ঐ রেলপাটির ওপারের ঝােপটায় বেঁধে দিয়ে আসলাে। বুননাকুত্তারা তাকে মুখ লাগালেই দল কে দল সাবাড় হয়ে যেতাে, কিন্তু কপাল খারাপ ডাক্তারবাবু, তারা সেদিন ঐ ধার মাড়ালই না, বরং তিন মাইল দুরের মুরাডিগঞ্জের মােড়লের বাড়ি বাছুর মারল, আর ভােররাত্রের দিকে ছাগলের ফুকার শুনে বাংলাের চাকরগুলাে বাইরে এসে, ভাঙা লাইন পেরিয়ে হাজির হল ঐ ঝােপের কাছে, আর না জেনেই সেখানাকে চুরি করে নিয়ে চলে গেল। যেমনটি ওরা আগেও বহুবার করেছিলাে। ছাগলটাকে কেটেকুটে খাওয়াও হয়েছিলাে।
আমরা সেসব জানতুম না। জানলাম দুপুরে। সে সময়ে আমাদের গাঁয়ের শেষ সীমায় এক সাধু থাকতেন। হংসি সাধু। তিনি বাড়ি ঢুকে মৃতদেহগুলাের নাড়ী টিপে বললেন, কেউ আর বেঁচে নেই। ঐ তীব্র বিষ মাখানাে মাংস যারা খেয়েছিলাে, তাদের বাঁচার কথাও নয়।
আমি ছােটকত্তাকে বললাম, আপনি আর ও বাড়িতে থাকবেন না বাবু। কলকেতা চলে যান। আপনার কাজের লােকগুলাে সব্বাই অপঘাতে মরেচে। ও বাড়ি অভিশাপ পেয়েছে। শুনেছেন নিশ্চয় সব কথা লােকের কাছে কত্তা?
‘শুনেচি মহিম। সব শুনেছি।
‘একটা কথা বলি ছােটবাবু? শুধু মালা মায়ের কথা আমাদের খুব মনে পড়বে কত্তাবাবা, খুব মনে পড়বে।”
এ অবধি বলে, মহিম ধুতির খুঁট দিয়ে চোখের কোণা মুছল। বসা গলাকে খাঁকারি দিয়ে ফের বলতে শুরু করল, “কিন্তু কত্তার ব্যবসায়ী মনের মধ্যে হয়তাে লাভ ক্ষতির হিসেব চলচিলাে। সে ভাবল, এত দামি বাড়িখানা হাতছাড়া না করে, যদি কোনােভাবে দোষ কাটিয়ে নেওয়া যায়, তবে ল্যাঠা চুকে গেল। এই উদ্দেশ্য নিয়ে সে দুপুরবেলায় একলা একলা গিয়ে পৌঁছালাে আপনার গুরুদেব, সেই তান্ত্রিক বাবার ডেরায়। বাবা সব শুনে তাকে চারখানা মন্তরপড়া গজাল দিলেন। তামার তৈরি, আর তার সারা গায়ে আঁকিবুকি কেটে ঘরবন্ধের মন্তর লেখা। ভারী অদ্ভুত জিনিসখানা।”
কালী ব্যস্তসমস্ত হয়ে কইল, “হাঁ হাঁ, সেখানাকে দেউরি বাঁধন বলে। তারপর?”
মহিম বলতে শুরু করলাে, “তারপর তান্ত্রিকবাবা বললেন, ‘বাছা, তুমি এ গজাল বাড়ির চার কোণে পুঁতে দেবে, কিন্তু খুব সাবধান। শেষ গজালটি পোঁতার সময়ে তােমরা কেউ কোনােভাবেই বাড়ির ভিতরে থাকবে না। কোনাে জীবিত মানুষ বা প্রাণী যেন ঐ চৌহদ্দির ভিতরে না থাকে।
সায় জানিয়ে বিজয় সেই মন্তর-গজাল নিয়ে ফিরে এলেন বাড়ির বাইরে। সন্ধ্যার ঠিক মুখে। বাড়িতে অন্ধকার। কেউ বাতি জ্বালায়নি। খুব নিঃশব্দে বিজয় বাইরের তিন দিকে তিনটি গজাল পুঁতে দিয়ে, এসে দাঁড়ালাে সদর দরজার সামনে, বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। নিচু হয়ে শেষ গজালটাকে মাটিতে ছোঁয়ানাে মাত্র, সেটা নিজে থেকেই মাটির ভিতরে সেঁধিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ যেন হাওয়া চলা বন্ধ হয়ে রইল। চাঁদ ভয়ে মেঘের আড়ালে মুখ লুকালাে। সদ্য বাসায় ফেরা পাখিগুলাে কোন এক অজানা আতঙ্ক টের পেয়ে পাখা ঝাপটিয়ে আকাশে ওড়াউড়ি শুরু করে দিল। ঠিক তখনই গােটা তল্লাটের চোখ ধাঁধিয়ে প্রকাণ্ড শব্দ করে বাজ পড়লাে বাংলাে বাড়ির ছাদে, আর গােটা বাড়িটা জুড়ে যেন আগুন আর আতসবাজির খেলা শুরু হয়ে গেল। বনজঙ্গলে আগুন লাগলে যে আকাশছোঁয়া শিখা ওঠে, এ আগুন সে আগুন নয়। গুড়ের মরশুমে আখ ছিবড়ের পাহাড়ে যে পর্বতপ্রমাণ আগুন লাগানাে হয়, সে আগুনও নয়। এ যেন আগুনই নয়। গােটা বাংলাে জুড়ে এক নীলচে রঙের মায়াবী আলাে যেন ঝিকিমিকি করে জ্বলে চলেছে, আর তার রােশনাইতে বাড়িটা একটু একটু করে পুড়তে লাগল। কালাে, ভুষোকালির রঙ হয়ে গেল প্রতিটা ঘর, প্রতিটা মেঝে। অথচ ঘরের একটা দরজা জানালা, গেরস্থালির কোন আসবাব ছাই হল না। আর তার সামান্য পরেই দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা। গােটা গায়ে আগুন মাখা চার চারটি পিশাচ দৌড়াদৌড়ি করে বেরিয়ে আসতে চাইছে, আর ভয়ানক গর্জন করচে। চাইছে বটে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারছে না। কোনাে এক অখ্যাত তান্ত্রিকের নাম না জানা মন্তর তাদের আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেচে ঘরের মধ্যে।
এবারে খুলে গেল উপরতলার জানালা। সে জানলায় দাঁড়িয়ে ছটফট করছে মালা। গােটা গায়ে আগুন। সে চিৎকার করে আকুলি বিকুলি করছে, ‘দাদাবাবুউউউ… তােমার পায়ে পড়ি, আমাকে ছেড়ে দাও দাদাবাবু… আমি এ বাড়ির চাকর হয়ে থাকব, শুধু দু মুঠো ভাত দিও, আর কিছু চাইনে আমি… ওহহ, বড় জ্বালা… আমি জন্ম অভাগী… দু মুঠো চাল ছাড়া আর কিছু চাইব না… উঃ মা গাে, জ্বলে মরলাম… দাদাবাবুউউউ’।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। প্রেতপুরীর ধ্বংসলীলা সমাপ্ত করে সেই সর্বনাশা ক্ষুধার্ত আগুন নির্বাপিত হল। শুধু বাড়িটার লাল রঙ মুছে গিয়ে কয়লা কালাে হয়ে গেল। রাত্তির তখন আটটা হবে। আমি তখন জন খাটিয়ে গােলাতে ধান ভরচি, সেই সময় কত্তা এসে উপস্থিত হল। বলল, ‘সব শেষ করে এলাম মহিম। আর কোনাে প্রেত, কোনাে পিশাচ ও বাড়িকে গ্রাস করতে পারবে না।
আমি ধানের কুনকে মাটিতে নামিয়ে রেখে বললাম, আপনার কত কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝি কত্তাবাবু। কিন্তু সবই ভগবানের ইচ্ছা। তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। ছােট মুখে একটা কথা বলি বাবু?
‘বল মহিম’ শান্ত মুখে বলল বিজয়।
‘এবারে বড় কত্তাবাবা আর সতীলক্ষ্মী গিন্নীমার শেষ ইচ্ছেটা রাখুন কত্তা। দিদিমনিরে বে করে কলকেতা চলে যান।
‘কোন দিদিমনি?’ বিজয় হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করল।
‘মালা দিদিমনি বাবু, এ গাঁয়ের মা লক্ষ্মী।
‘তুমি কি উন্মাদ হয়ে গেছ মহিম! কী বলছ এসব? এই কি তােমার উপহাস করার সময়? সেই রাক্ষসীকে আর চারটে পিশাচের সঙ্গে পুড়িয়ে মেরে এসেচি আমি। ওদের আর কোনাে অস্তিত্ব নেই মহিম। তারা মুক্তি পেয়েছে।
আমি ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে কিছুসময় চেয়ে থেকে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লাম।
‘এ কি সব্বনাশ করে এসেচো কত্তাবাবা? এ কি সব্বনেশে কথা শােনাচ্চো? জীয়ন্ত মানুষেরে পুড়িয়ে এসেচো কি গাে? সে যে রক্ত মাংসের মানুষ। সে যে মরেনি।
বিজয়ের মুখ সাদা হয়ে গেল।
কইলাে, তবে যে তােরা সবাই বললি, সব চাকর-বাকরেরা বিষাক্ত মাংস খেয়ে অপঘাতে মরেছে! আর কেউ বেঁচে নেই!
‘হক কথাই বলেচি কত্তা, কিন্তু দিদিমণি আপনার ঘরের চাকর কবে থেকে হল বাবু? আপনাকে চাকর বাকরের কথা বলেছিলাম। আমি যে তার কথা কস্মিনকালেও বলিনি। আপনার কাজের লােকগুলাে বিষ মাংস খেয়ে মরেছে, কিন্তু দিদিমণি উৎকল বামুনের মেয়ে, সে যে মাছ মাংস কিচ্ছুটি ছুঁতাে না, সে কি আপনি জানেন না? আপনি বড়মানুষ, আপনার কথায় হাজার লােক চাকর খাটতে রাজী, কিন্তু সবাইকে নিজের দাস ভেবে নেবার এ রােগ আপনার মধ্যে কেমন করে ঢুকল বাবু ? সে যে গিন্নীমা আর বড়কত্তার নিজের মেয়ে সমান ছিল গাে। আজ তাঁরা বেঁচে থাকলে হয়তাে সে সম্পর্কটাও বদলে যেত, কিন্তু অহঙ্কার আর ভুল ধারণায় আপনি তাদের সে ইচ্ছেটাকে পুড়িয়ে মেরে এলেন কত্তা?
তবে যে আপনি বললেন, আপনি নাকি সকালে সব-ই শুনেছেন? আপনি কিছুই জানতেন না? জানতেন না মালা মা বেঁচে আছে? হা ভগবান।
ছােটো মুখে বড়াে কথা মাপ করবেন কত্তা, কিন্তু তাঁর ওই রাক্ষসপুরী থেকে পালাবার ঢের পথ ছিল। তাঁর বাপ কতখানি তুকতাক জানতাে, সে আপনি ছােটবেলার ঘটনা থেকেই ভালােই জানেন। তারই কিছু ধারা মালাও পেয়েছিলাে। তাই শয়তানগুলাে তাঁকে মেরে ফেলতে পারেনি। কিন্তু তাঁর ভয় ছিল আপনি কোনও না কোনও দিন ঠিক এ বাড়িতে আসবেন আর ওরা আপনাকে মেরে ফেলবে। আপনাকে বাঁচাবার জন্যিই মালা মা আধমরা হয়েও না পালিয়ে ও বাড়িতে থেকে গিয়েছিলাে। একজন মানুষকে ঠিক কতখানি ভালােবাসলে প্রেতের সঙ্গে এক ঘরে বাস করা যায় আপনি বােঝেন কত্তাবাবা? আপনি পারতেন? কেউ পেরেছে? মা আমার এক রাশ স্নেহ আর ভালােবাসা নিয়ে পুড়ে মরল গাে। হা ভগবান। যারা এক বুক আশা ইচ্ছে নিয়ে নিজের ভালােবাসার মানুষটার হাতেই বেঘােরে প্রাণ হারায়, মরার পরে তাঁরা কি হয় বােঝেন কত্তা…?
বিজয় সবই বােঝে, আর বােঝে বলেই আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়ল। বােকার মতাে এদিক ওদিক তাকাতে থাকল। তারপরে যে দুই তিনদিন তিনি এ গাঁয়ে ছিলেন, রােজই শুধু উসকোখুসকো চুল আর ময়লা কাপড়ে বাংলােবাড়ির চারদিকে ঘুরঘুর করে বেড়াতেন, আর কাউকে দেখলেই শুধােতেন, “তােমরা মালা কে কেউ দেখেচ? আমার বউ মালা? সে যে ভাত খেতে চেয়েছিল। তাইত, বড় সমস্যা হল যে। না খেয়ে সে গেল কোথা?
সেই শেষ দেখা। এর পর সেই হতভাগ্য যে কোথায় গেল, আমরা আর কোনাে খবরই পেলাম না তার। সব কপাল ডাক্তারবাবু। সব ঈশ্বরের ইচ্ছে। তার ইচ্ছের সামনে ফকির রাজা হয় আর রাজা হয় ভিখিরি।”
বৃদ্ধ মহিম দু হাতের পাতা দিয়ে চোখের কোল মুছল। বৃদ্ধের এই কুঞ্চিত, ঝাপসা চোখজোড়া এক শতকের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী।
-“তারপর? ও বাড়িতে কি আর কেউই যায়নি?” কালী প্রশ্ন করল।
-“গেছিলাে বাবু। আপনার গুরুদেব হংসি তান্ত্রিক গেছিলাে। সে আমাদের সকলকে নিয়ে গিয়ে বাংলােবাড়ির সুমুখে দাঁড়ালাে। বিড়বিড় করে কি যেন বলতে লাগল। মাটি তুলে জিভে ঠেকাল। নাক তুলে হাওয়া শুকল। তারপর দোতলার খােলা জানলার দিকে তাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে কি যেন দেখতে লাগল। আমরা সেখানে কিছুই দেখতে পেলাম না, কিন্তু সাধুবাবা ঘরের কোণায় কোণায় যেন কিছু একটা দেখতে পাচ্চিলেন। তখন গ্রামের মােড়ল ছিল, আমাদের বিশ্বনাথ মােড়লের বাবা মাধব।
সাধুবাবা মাধবকে বললেন, “আমার তন্ত্রসাধনা আজ শেষ হবে মােড়ল। আমার শক্তি এক নির্দোষ, নিরপরাধকে বধ করেছে। আমার এ পাপ ক্ষমার অযােগ্য। শােন, আমি বাড়ির ভিতরে যাচ্ছি। যদি আমি ফিরে না আসি, তবে খবরদার কক্ষনাে এ বাড়ির ভিতরে কেউ ঢুকবিনে। জীয়ন্ত অবস্থায় পুড়ে মরেছে হতভাগী।
এই ভয়ানক অপঘাতের প্রতিশােধ নেবার জন্যে ও সুযােগের অপেক্ষায় থাকবে অনন্তকাল। কখনাে এখানকার মাটি খুঁড়বি নে। মন্তরের তেজে সে আটকে, ওত পেতে আছে আছে কুঠির মধ্যে। আমি তাকে দেকতে পাচ্ছি। আমার দেওয়া সেই ঘরবন্দীর বাঁধন একবারের তরে খুলে গেলে ও রাক্ষসী গাঁ উজাড় করে দেবে।
আপনার গুরুভাই ভুবন তান্ত্রিক তখন সেখেনেই ছিলাে। সাধু তার হাতে নিজের আংটি, মােটা মােটা মালা আর দুটো পেল্লাই আকৃতির মাদুলি খুলে দিয়ে গেলেন। হাতে রাখলেন শুধু একটা চিমটা। যাবার সময় ভুবনকে। বলে গেল, ‘যদি বাড়ি থেকে বেরুতে পারি, তবে গােড়ায় গিয়ে সমাধান করব এ ভুলের। এ মাদুলি দুটোকে খুব খুব যত্নে রাখবি। কোনােভাবেই যেন আগুন একে ছুঁতে না পারে। খুব সাবধান! এ হল কাল-কবচ।
হংসি তান্ত্রিক আর বাইরে আসেনি কোনদিনও। সেই তার শেষ যাত্রা।”
মহিমের নাতি এসে আরও এক গেলাস করে চা দিয়ে গেল, আর কালী সবার অলক্ষ্যে ধুতির খুঁট দিয়ে চোখের কোল মুছল। আমার মন বিষন্ন হয়ে উঠলাে।
-“অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভুবন তান্ত্রিকের আখড়াটা কি সেই পুরাতন আশ্রমেই রয়েছে?”
মহিম ক্লিষ্ট মুখে ঘাড় নেড়ে সায় জানালাে।
আমাকে টেনে তুলে কালী আবার বন্ধ হয়ে থাকা রেললাইনের উপর দিয়ে চলতে শুরু করল, বিছুটি আর ঝােপ জংলা ভরা পথ দিয়ে। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কালী আমাকে বলল, “কি ভায়া? কিছু বুঝলে নাকি?”
-“সবই বুঝলাম। না বােঝার আর কি আছে?” আমি বললাম।
-“বুঝবে বৈকি, তােমার বুদ্ধি অপার। নিশ্চয়ই বুঝবে। তাও কি বুঝলে যদি একটু বলতে তাহলে আমিও বুঝতাম।”
আমি বললাম, “প্রথমতঃ মালার বাবা শাড়ি আর পুরীর বিখ্যাত কটকটে লাল বেতের কারবার করত। বিজয়ের বাবার অনেকগুলি লজ-বাড়ি ছিল পুরীতে। তারপর কোনারকের ঐ ঘটনার উল্লেখ। সবই ঐ ছড়াটার সাথে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে। তাই রহস্যের কিনারা পেতে হলে ছড়া অনুযায়ী আমাদের দিনকতক কটকে যেতে হবে। এখানে বসে এই অভিশাপের সমাপ্তি করা যাবে না। কেমন? ঠিক বলেছি কিনা?”
কালী সামান্য হেসে বলল, “বাহ, শালুক চিনেছেন গােপালঠাকুর।”
আমি অধৈর্য হয়ে বললাম, “তুমি কি বললা? এর আর কী ব্যাখ্যা আছে?”
উত্তর এলনা। তার বদলে সে উত্তেজিত মুখে বলতে থাকল, “দুটো কথা ভেবে আমি যারপরনাই আশ্চর্য হচ্চি ভায়া। প্রথম কথা হল, যদি আমার ধারণা ঠিক হয়, তবে আমাদের কপালে এমন এক অদ্ভুত সুন্দর আর রহস্যময় ভ্রমণ অপেক্ষা করছে, যেমনটি আর কেউ কক্ষনাে প্রত্যক্ষ করেনি। করা সম্ভবও নয়। আর দুই, আমার গুরুদেব কেন যে লেখক হলেন না তা আমি জানিনে, কিন্তু উনি লেখক হলে, অনেক লেখকই মাৎ হয়ে যেত। কি অদ্ভুত সম্পদ যে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তা আমরা ছাড়া আর কেউ জানলই না। যদি কখনাে পারি, তবে এই কবিতা আমি বুক চিতিয়ে সবাইকে জানাব।”
আমি কিছুই বুঝলাম না। সামান্য পাঁচ লাইনের এক সামান্য ছড়া, তায় আবার খাপছাড়া ধরনের ভাব। তার এমন মাহাত্ম্য ?
জিজ্ঞাসা করতেই কালী আবার হেসে বললে, “কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী।”
আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করার উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। প্রায় আধ ঘণ্টাখানেক হেঁটে দেখা পেলাম ভুবন তান্ত্রিকের আশ্রমের। টিনের চালের ছাউনি দেওয়া বিরাট মাপের দুটো ঘর। কালী আমাকে বাইরে রেখে নিজে এগিয়ে গেল। আশ্রমের সামনের হাঁড়িকাঠের সামনে গিয়ে সে সাষ্টাঙ্গে শুয়ে প্রণাম করলাে আর তারপর ভিতরে প্রবেশ করলাে। আমি সেই ফাঁকে একটা খালি ঘরে উঁকি মারলাম, কিন্তু যা চোখে পড়ল তাতে হতবাক হয়ে গেলাম। সাধু ঋষিদের ঘরে কমণ্ডলু, চিমটা বা নরমুণ্ড অবধি থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু হংসি তান্ত্রিকের ঘরে শােভা পাচ্ছে নানান আকৃতির বকযন্ত্র, টেস্ট টিউব, তামার তৈরি স্টোভ, রাশি রাশি পুঁথি আর ফিটকিরির টুকরাে।
এটা কী আদৌ কোনাে আশ্রম নাকি গবেষণাগার তা বােঝা মুস্কিল। যাই হােক, প্রায় মিনিট কুড়ি পর যখন আমি প্রায় বিরক্ত হয়ে উঠেচি, তখন কালী হাসিমুখে ভুবনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল। দুজনেরই চোখে মুখে উত্তেজনা, আর হাতে দুটো পেল্লাই আকৃতির মাদুলি। সেই কাল-কবচ। কালীর হাতে একটা আগুনের ধুনি। ধুনিটা আশ্রমের মুখের বিশাল পিপুল গাছটার তলায় রাখা হল। কালী ভুবনকে প্রশ্ন করল, “আমার ঠিক স্মরণ হচ্চে না, তুমি মনে করে বলাে দেখি, যে জায়গাটায় আমরা পা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছি, সেই জায়গাটুকু আজ থেকে তিরিশ বছর আগে শক্ত জমিই ছিল তাে? কুয়াে টুয়াে জাতীয় কিছু ছিল না তাে?”
ভুবন হেসে দুদিকে মাথা নাড়ল।
আমরা ধুনির পাশে এসে দাঁড়ালাম। মাটিতে একটা গােল বৃত্তাকার দাগ কাটা হল। কালী ভালাে করে মাদুলি দুটোকে পরীক্ষা করে, একটাকে ধুতির কোঁচাতে শক্ত করে ভরে নিল। আরেকটাকে হাতে নিয়ে ভুবনের দিকে তাকাল। তান্ত্রিক হাত তুলে অভয়ের মুদ্রা করলেন। কালী হাতের তাবিজটাকে আগুনে ফেলে দিয়ে, আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। আগুন থেকে এক ভলক ঘন ধোঁয়া বেরিয়ে চারিদিকের বাতাসে মিশে গেল।
কিছু সময় কিছুই হল না। তার পরেই ভয়ঙ্কর শব্দে মেঘ গর্জন করে উঠলাে। একটা অদৃশ্য ঘূর্ণি যেন আমাদের চারপাশের সব অণু পরমাণুকে টেনে নিয়ে ওই ধুনিতে আহুতি দিচ্ছে। এই প্রথম খেয়াল করলাম কালীগুণীনের হাতখানা কাঁপছে, আর তাঁর মুখে তীব্র উত্তেজনা। তার পর ঠিক কি হল কিছুই বুঝতে পারলাম না। চোখের উপর একবার দমকা আলাে, আরেকবার নিচ্ছিদ্র অন্ধকার, আবার চোখ ধাঁধানাে আলাে, পর মুহূর্তেই আবার সব কালাে। শরীরটা গুলিয়ে উঠচিলাে, যেন কোনাে অনেক উঁচু জায়গা থেকে নীচে তলিয়ে যাচ্চি। চতুর্দিকে বইতে থাকা ঝড় ঝঞা আর এই সৃষ্টিছাড়া আলাে আঁধারির চমকের মধ্যেও আমি হাঁ করে লক্ষ্য করলাম, আশ্রমের দেউড়ির সংলগ্ন আমাদের সামনের ঐ দৈত্যকায় পিপুল গাছটা আস্তে আস্তে রূপ পাল্টাতে শুরু করলাে। একটা দুটো করে পাতা কমতে কমতে গাছটা ছােট হতে শুরু করলাে, আর ধীরে ধীরে একটা চারাগাছে পরিণত হল, এবং মিলিয়ে গেল।
এভাবে কতক্ষণ আলাে অন্ধকারের খেলা চলেছিল জানিনে, তবে ঘাের কাটল কালীর হাতের চাপে। তখন সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পরার আয়ােজন শুরু করেছে। চারিদিকের দৃশ্যে কোথায় যেন কি একটা বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। সামনের বেদীতে, যেখানে ভুবন বসে ছিল, সেখানে একটি সাত আট বছরের বাচ্চা ছেলে বসে বসে পেয়ারা খাচ্চে।
“পা চালাও জলদি…
বলে কালী আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল, যেদিক থেকে আমরা এসেছিলাম, সেদিকে। যখন প্রায় রেললাইনের কাছাকাছি চলে এসেছি, আমি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সামনে তারা’ চিহ্ন যুক্ত এক বিশাল লম্বা মালগাড়ি ধিকিধিকি ধোঁয়া ছেড়ে লাইন দিয়ে এগিয়ে চলেছে মন্থর গতিতে। মাঝখানের খােলা পাটাতনগুলাে বিশাল বিশাল গাছের গুড়িতে বােঝাই। আমি গাড়িটা চলে যাওয়া অবধি একভাবে দেখতে থাকলাম। তারপর প্রশ্ন করলাম, “মুখুজ্জেমশায়? আশ্রমের ঐ বাচ্চা ছেলেটা কে ছিল?
কালী উত্তর দিলাে, “জয় ত্তারা।”
আমরা যখন মহিমের চায়ের দোকানের কাছে এসে পৌঁছালাম, দেখতে পেলাম দোকানে মহিম বা তার নাতি নেই। বছর চল্লিশের এক ভদ্রলােক চা পরিবেশন করছেন, আর দোকানে কিছু সঙ্গী সাথীর সাথে বসে রয়েছে বিশ্বনাথ মােড়ল। আমি সােজা সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কালী হাঁ হাঁ করে বাধা দিতে যাচ্ছিলাে, কিন্তু আমি তার আগেই বিশ্বনাথের সামনে গিয়ে বললাম, “বেশ লােক তাে আপনি মশায়, আমরা এদিকে নানান ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছি, আর যার ভরসায় কোম্পানি আমাদের পাঠালাে, সে কিনা মনের সুখে চা খাচ্চে!”
মােড়ল আর তার সাথীরা অবাক চোখে আমাদের দিকে কিছু সময় চেয়ে থেকে বলল, “তােমরা কারা বটে?”
আমার খুব রাগ হয়ে গেল।“বটে? আমাদের চিনতে কষ্ট হচ্ছে বৈকি?”
কালী তাড়াতাড়ি এসে আমাকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “বেয়াদপি মাপ করবেন মােড়ল মশায়, আমার বন্ধু কিছু ভুল করচে। মাপ চাইছি।” – বলে আমাকে চোখ পাকিয়ে দোকান থেকে বের করে আনল।
-“গাধা… এতক্ষণেও কি কিস বােঝােনি তুমি?”
-“কি বুঝব! চেনা লােক না চেনার ভান করচে। এই বুঝব?”
– “ওরে বােকা, মােটেই চেনা নয়। ও লোেক বিশ্বনাথ নয়, মাধব মােড়ল। বিশ্বনাথের বাবা।”
খানিক্ষন আমার মুখ থেকে কোনাে বাক্য সরল না। কালী আবার বলল, “আমরা সেই আগের সময়ে আর নেই ভায়া। আমরা তিরিশ বছর সাঁতরে পিছিয়ে এসেছি, আমার গুরু হংসি তান্ত্রিকের কাল-কবচের জোরে। বালক ভুবনকে আর মার্টিনের ওই আদিমকালের রেলগাড়ি দেখেও তােমার বােধ হল না? আশ্চর্য”।
সত্যি বলতে বােধ বা বুদ্ধি কোনটাই আমার কাজ করছিলাে না। তবু আস্তে আস্তে প্রশ্ন করে ব্যাপারটা কতক কতক বুঝতে লাগলাম। আননে আমার চোখে জল এসে গেল। তিরিশ বচ্ছর পিছনে মানে, আমার মা, বাবা দুজনেই এখন জীবিত! না হােক দেখা, হােক কথা, তবুও অন্ততঃ এই মুহূর্তটায় আমি অনাথ নই।
আমরা যে কাঁটাঝােপ ঘেরা লাইন পথে এসেছিলাম, সেই পথেই ফিরতে লাগলাম। ঠিক সেই পথে বললে ভুল বলা হবে, কারণ রেললাইন এখন রীতিমত চালু এবং ঝাঁ চকচকে।
আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কেমন করে জানলে যে, ঐ কবচের মধ্যে অতীতে ফেরত যাবার শক্তি আছে? বর্তমান থেকে অতীত আর অতীত থেকে বর্তমানে যাবার এ সঙ্কেত তুমি পেলে কোথা?”
-“কবিতার মধ্যে”, কালী উত্তর দিল।
-“ওহহ, তুমি ধরতেই পারােনি ভায়া? কি অপূর্ব এই ছড়া। কিছু কিছু নাম আছে জানাে তাে, যেগুলােকে উলটো করে পড়লেও একই নাম দাঁড়ায়? যেমন, সুবল লাল বসু। এরকম টুকটাক নাম টাম বহুকাল আগে থেকেই লােকে আবিষ্কার করেছিলাে, কিন্তু এই ধাঁচের সবচেয়ে লম্বা লাইনটি লিখেছিলেন দাদাঠাকুর বিদূষক শরৎচন্দ্র। সে লাইনটি হল-“কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী”। আজ অবধি এটাই ছিল বাঙলার দীর্ঘতম লাইন, যা কিনা উলটোদিক থেকে পড়লেও একই দাঁড়ায়। কিন্তু ভায়া, গুরুদেব তাে সেই ইতিহাস তিরিশ বছর আগেই ভেঙে দিয়েছেন। তার লেখা পাঁচ পাঁচটা লাইন শেষ অক্ষর থেকে একবার উলটো করে পড়াে দেখি!
আমি মনে মনে হিসেব করে হতভম্ব হয়ে গেলাম। এ যে প্রায় অসম্ভব! কালীর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য। শেষের লাইন শেষ অক্ষর থেকে পড়তে থাকলে, প্রথম লাইনটা পাওয়া যায়। একদম শেষ অক্ষর থেকে পুরােটা একটানা পড়ে গেলে আয়নার মতাে উপরের লাইনগুলােই ফিরে আসে। শুধু তাইই নয়, কবিতার নামটা, এমনকি লেখকের নামটিও একই গুণসম্পন্ন। অর্থাৎ, শুরু থেকে শেষ আর শেষ থেকে শুরু? এবার আমার কাছে সব জলের মতাে সােজা হয়ে গেল। এইজন্যেই হংসীতান্ত্রিক ভুবনকে বলেছিলাে যে এই ভুলের গােড়ায় ফিরে গিয়ে সমাধান করব! কেউ সে ইঙ্গিত বােঝেনি, বুঝেছে কেবল তাঁর নিজের হাতের তৈয়ারি সবচেয়ে ধারালাে হাতিয়ার, তাঁর যােগ্য শিষ্য কালীপদ মুখুজ্জে।
কালী এবার সামান্য বিষাদের স্বরে কইল;
“বুঝলে ভায়া, আমি ভেবেছিলাম যে অজ্ঞাত আততায়ী আমার গুরুকে নিধন করেছে, তাকে আমি উপযুক্ত শায়েস্তা করব, কিন্তু তা বােধ হয় হবার নয়। গুরুদেবের হত্যা হয়নি। কারুর ক্ষমতা ছিল না তাঁকে মারবার। তিনি নিজের অনিচ্ছাকৃত মর্মান্তিক ভুলের জন্যে নিজেই দেহত্যাগ করেছিলেন। গুরুদেব নিজেও আততায়ীকে শাস্তি দিতে চাননি। চেয়েছিলেন অন্য এক আশ্চর্য সমাধান।”
সূর্যের আলাে যখন প্রায় নিভে এসেছে, সে মুহূর্তে বাংলােকে বাম দিকে রেখে, রেললাইন টপকে, আমরা এগিয়ে চললাম খানিক দূরের আশশ্যাওড়া আর বুনাে কচুর ঝােপের দিকে। সেখানে ঢােকা মাত্র আমি চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্চিলাম, তখনই কালী আমার মুখ চাপা দিলাে, আর বলল, “খবরদার হাত ছুঁয়াে না যেন। তীব্র বিষ মাখানাে আছে ওর গায়ে। এই ছাগলটাকে নিয়েই তাে যত গণ্ডগােলের শুরু হয়েছিলাে।”
আমার পায়ের কাছে একটা মােটাসােটা মানকচুর পুরুষ্টু গােড়াতে বাঁধা রয়েছে একটা দড়ি, আর দড়ির অপরপ্রান্তে বাঁধা রয়েছে একটা সাদা ধপধপে ছাগল। গাঁয়ের লােকেদের রেখে যাওয়া সেই বিষ মেশানাে ছাগল। তার একটা শিং ভাঙা। চোখের কোলে কালাে টানা দাগ। যে মুণ্ডু আমি পশ্চিমের ঘরের কুলুঙ্গিতে দেখেছিলাম, আর সম্ভবত বিজয় দেখেচিল জানালার চাতালে! আমরা অন্ধকারে ওত পেতে বসে রইলাম সারারাত্তির। বড় দীর্ঘ সে অপেক্ষা। শিকারি যেমন বাঘের জন্যে মাচায় খাপ পেতে থাকে, তেমনি আমরা সময়ের দূরত্বকে নস্যাৎ করে অতীতে পৌঁছে, আজ একটা মর্মান্তিক অপঘাতের, একটা ঐতিহাসিক ভুলের শিকার করতে এসেছি।
যখন সময় আন্দাজ রাত সাড়ে তিনটে হবে, বহু দূর থেকে একটা গরুর আর্ত আওয়াজ, আর অসংখ্য বুনাে কুকুরের চিৎকার কানে এল। সেই শব্দে ছাগলটা ব্যা ব্যা ব্যা করে একনাগাড়ে ডাকতে শুরু করলাে, আর তার একটু পরেই গাছের ফাঁক দিয়ে আবছা আলাে চোখে পড়ল। লাইনের ওপারের রেল বাংলাের দোতলার একটা জানলা খুলে দু চারটে মুখ উঁকি মারল। একটু বাদেই বাংলাের সামনের গাছগুলাের উপর একটা লম্বাটে আলাে এসে পড়লাে। চাকরগুলাে বাংলাের সদর দরজা খুলে প্রাণঘাতী বিষ মেশানাে ছাগলটাকে চুরি করতে বেরােচ্চে।
মিনিটখানেকের ব্যবধানে লাইনের গায়ে তিনজন লােককে দেখা গেল। চাপা গলায় হাসি ঠাট্টা করতে করতে তারা এদিকেই আসছে। যখন ছাগলের ডাক লক্ষ্য করে তারা প্রায় ঝােপের কাছেই এসে পড়েছে, এমন সময় কালিগুণীন ঝােপের থেকে মাথা তুলে সােজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাে তাদের সামনে। আমি কালীর পিছনদিকে বসেছিলাম। সামনেটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু চাকরগুলাে তাঁকে দেখে আচমকা ভয়ানক স্বরে আর্ত চিৎকার করে উঠলাে। নাহ, মানুষকে দেখে মানুষ যেমন চিৎকার করে, তেমন চিৎকার নয়, বরং একেবারে সামনাসামনি অতি ভয়ঙ্কর কোনও কিছু দেখতে পেয়েচে যেন তারা।
বাপরে…
খেয়ে ফেললে রে… গােছের ভয়ানক বুকফাটা হাহাকার করে উঠে প্রাণভয়ে তারা পড়ি মরি করে দৌড় লাগালাে বাংলাের দিকে, আর একটু বাদেই শােনা গেল দড়াম করে সদর বন্ধ করার আওয়াজ।
কালী কপালের ঘাম মুছতে মুছতে, ছাগলটার দড়ি খুলে দিয়ে, মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাে। তার মুখে বিজয়ীর হাসি। আমি তন্ময় ভাবে তিরিশ বছর আগেকার, সদ্য আলাে ফোটা আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার মুখেও হাসি। যখন কিছুটা আলাে হয়ে এল, আমরা ধীরে ধীরে ঝােপ থেকে বেরিয়ে এলাম বাংলাের দিকে। বাড়িটার সব কালাে, ময়লা রঙ মুছে গিয়ে, লাল টুকটুক করচে। বাড়ির সামনে দুপাশে অজস্র গােলাপ ফুল ফুটে আছে, এবং তার গন্ধে গােটা এলাকা বিভাের হয়ে আছে। গােলাপ ঝাড়ের পাশে গােলাপের চেয়েও মিষ্টি একটি মেয়ে, ডুরে পাড় শাড়ি পরে সদ্য স্নান করা খােলা চুলে, আঙ্গিনায় গােবরজলের ছড়া দিচ্চে। দরজার সামনে উনান রাখা। তাতে সবেমাত্র আঁচ পড়েচে।‘মালা!’, আমার মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল। সাত গাঁয়ের অতৃপ্ত বিভীষিকা, মানুষখাকী পিশাচীনি মালা আজ রক্তমাংসের জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে আমাদের সামনে ঘরকন্নার, গেরস্থালীর কাজ করছে! এ যে অবিশ্বাস্য! এই দেবী প্রতিমাকে কোনােভাবেই যে প্রতিহিংসা পরায়ণ, সর্বনাশী বলে কল্পনা করা চলে না! “এই হল সেই নরখাদক আপাই”, কালী ফিসফিস করে বললাে। “না বন্ধু ভুল, আমরা ওকে সেই সর্বনাশের থেকে বাঁচাতে পেরেচি। মালা এখন সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী”, আমি মুগ্ধ স্বরে বললাম। আমার আধুনিক বেশভূষা আর উপস্থিতিতে মালা বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছিলাে। কালী সদরের কাছে এগিয়ে গিয়ে নরম স্বরে বলল, “মা, আমরা রেল আপিসের কেরানী। জঙ্গলের কাঠ দাগাতে এসেছি। আমাদের একটু আগুন দেবে মা? বিশেষ দরকার।”
মালা আয়তচক্ষে একটু তাকিয়ে, সামান্য খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। দেখলাম তার ভিজে পায়ে মাটিতে ছাপ পড়েছে। তাতে চারটে করে আঙুল। সে উনানটা নিয়ে এসে বসিয়ে দিলাে আমাদের সামনে।
“এতে হবে বাবু?” – মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করল মালা। “হবে বৈকি, ঢের হবে। এক গেলাস জল দেবে মা?”, কালী হাসি মুখে বললেও, খেয়াল করলাম তার গলাটা ভারী হয়ে এল। মালা জল আনতে ঘরে ঢুকতেই কালী মেটে উনানের লােহার হাতলটা ধুতির খুঁট দিয়ে ধরে তুলে নিয়ে হাঁটা দিলাে রেল লাইন ধরে। গন্তব্য ভুবনের আশ্রম। সঙ্গে আমি। ফেরার পথে চায়ের দোকানে বসা লােকগুলাে আর মাধব মােড়ল আমাদের অমন জ্বলন্ত ধোঁয়া ওঠা উনান নিয়ে লাইনের পাটাতন দিয়ে হনহন করে হাঁটা দেখে হাঁ করে চেয়ে রয়েচে দেখলাম। কোনও এক মধ্যবিত্ত গৃহস্থ ঘর থেকে রেডিও যন্ত্রের কথা শােনা যাচ্চে। যুক্তরাষ্ট্র নাকি কিউবায় পণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে, আর তাই নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেহেরু সাহেব নিজের বক্তব্য রাখছেন। আমি অবাক হয়ে খবর শুনতে শুনতে এগােতে লাগলাম। কালীকে বললাম, এটা তাে ভাই আমার জন্মেরও বেশ কিছু আগের ঘটনা! কালী হেসে বললাে, “তা ভাই, তুমিও তাে তােমার জন্মসালের থেকে পাঁচ-ছয় বচ্ছর পিছিয়ে এসেচ। হিসেব মতাে এ সময়টায় তােমার পৃথিবীতে থাকবারই কোনও অধিকার নেই। তা তুমি এসেচই যখন, তখন ভালাে করে ক’দিন ঘুরে বেরিয়ে নাও, এদিককার মানুষদের ডাক্তারি টাক্তারি করাে গে। আমি চললুম গিয়ে ভবিষ্যতে”। আতঙ্কে আমি ওর কামিজের আস্তিন খামচে ধরলাম।
উনুনের হাতটা বদলে নিয়ে হাে হাে করে হেসে উঠলাে মুখুজ্জে মশায়।
আমরা কিছুক্ষণ হেঁটে পৌঁছালাম আশ্রমের সুমুখে। কালী কিন্তু আশ্রমে প্রবেশ করলাে না। পরে কারণটা জেনেছিলাম। সেই সময়ে, অর্থাৎ তিরিশ বছর পূর্বের ওই সময়টাতে তখন হিসেবমতাে হংসী তান্ত্রিক জীবিত। তাই আশ্রমে প্রবেশ করলে গুরু নিষেধ লঙ্ঘন করা হতাে। আমরা এসে দাঁড়ালাম সেই আগের জায়গাটায়, গােল বৃত্তটার মধ্যে। কালী আমার হাত শক্ত করে ধরে, জ্বলন্ত উনানের মধ্যে উঁাকে গোঁজা মাদুলিটা বের করে ফেলে দিল। মুহূর্তের মধ্যে আবার গর্জন করে উঠলাে আকাশ। আবার শুরু হল সেই আলাে আঁধারির খেলা। যখন সম্বিত ফিরল, তখন দেখি সামনে সেই বিশাল পিপুল গাছ, আর বেদীতে ভুবন তান্ত্রিক বসে মিটি মিটি হাসছে, যেন আমরা গেছি পাঁচ মিনিটও হয়নি। এর পরের ঘটনাগুলাে বলা আর না বলা সমান। তবে মজার ব্যাপার এই যে, বর্তমানে ফিরে দেখলাম, ইতিহাসকে বদলে দেবার কারণে আমাদের বাস্তবটাতেও সামান্য পরিবর্তন হয়েছে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। যেমন কোনও লােক অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের ঠাকুরদাকে বিয়ের আগে খুন করে ফেললে সে আর কোনােভাবেই বর্তমানে ফিরে আসতে পারবে না, কারণ বর্তমানে তাঁর আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। তেমনি আমরাও ভবিষ্যতে ফিরে দেখলুম যে আমাদের স্বেচ্ছাসেবী সেই সংস্থা নাকি আমাদের থাকার জন্যে রেল বাংলাে নয়, বরাদ্দ করেছিলাে বিশ্বনাথের বাইর-বাড়ির ছােট ঘরটা। আর আমরা নাকি গতকাল রাত্রে সেখানেই ছিলাম। বাংলােতে নয়। তাও তাে সত্য। সে বাংলাে তাে এখন আর পরিত্যক্ত বাড়ি নয়, রীতিমত বসতবাটী। এরপর আরও পাঁচদিন আমরা মােড়লের বাড়িতে থেকে, ক্যাম্প খাটিয়ে চিকিৎসা করলাম, আর তারপর চলে এলাম। বছরখানেক পরে একদিন আসানসােলের ঐ সংস্থার আপিস থেকে ফেরার পথে দেখা হয়ে গেল বিশ্বনাথের সঙ্গে। গাল গপ্পো করতে করতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করে তার মুখে জানতে পারলাম যে, বিজয়ের সঙ্গে নাকি মালার বিয়ে হয়ে গিয়েছে সেই তিরিশ বচ্ছর আগেই, আর সে মালাকে নিয়ে কালীঘাটের বাড়িতেই ফিরে গিয়ে সংসার পেতেচিলাে। তাদের বড় ছেলে এখন বাংলােতে থাকেন। মহিম ঐ বাংলাের মালীর পদে পাকাপাকিভাবে বহাল হয়ে রয়েছে এখনও, যদিও তাঁর বয়স এখন বিশ্রামের। গাঁয়ের ইস্কুল বাড়ির এক ছােকরা ইস্কুল মাস্টারের সঙ্গে কুষ্টিয়ার মেয়ে ললিতার বিয়ে ঠিক হয়েছে, এবং বিশ্বনাথের ছেলেটা টুকটাক কথা কইতে শিখেছে। তার বউ মিঠু, ছেনুর বউ কান্তা আর গাঁয়ের বাকি লােকেরা আমাদেরকে গ্রামের কালীপুজাতে যাবার নেমন্তন্ন জানিয়েছে। অর্থাৎ সব্বাই বেঁচে রয়েছে, আর এতদিন ঘটে আসা দুর্ঘটনাগুলাে বা হত্যাকাণ্ডগুলাে আদৌ ঘটেনি। ঘটবেই বা কেমন করে? মালা বা অন্যান্য চাকর-বাকরগুলাে তাে সেদিন অপঘাতে মরেইনি। আমরা সেদিন ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিলাম। কালীগুণীনকে কিন্তু আমি সঙ্গ ছাড়িনি আর। সে ফিরে গিয়েছিলাে সুন্দরবন আবাদে তাঁর জমিদারি রায়দীঘড়া না কোন একটা তালুকে। ভারী মনােরম জায়গা। লােকটা নিজের মুখে নিজের কথা কিছুই কইতে চায় না দেখে আমি সেইখেনে গিয়েই তাঁর সঙ্গে ভাব জমালাম আর তাঁর অতুলনীয় সব কীর্তির সাক্ষী হয়ে থাকলাম। তা সে নেকড়েমারির হারাণ বাগদীর নিষ্ঠুর প্রেতাত্মাই হােক, হাসপাতালের ভয়ঙ্কর উপদ্রবই হােক, শানিয়াড়ী গাঁয়ের ভয়াবহ পানিমুড়ার হত্যালীলাই হােক অথবা বােলতা তালুকের সেই হিংস্র বাঘামূড়ার আতঙ্কই হােক না কেন, আমি কিন্তু এই অমায়িক, নিরহঙ্কার অথচ কালভৈরবের ন্যায় শক্তির অধিকারী কালীপদ মুখুজ্জেকে কক্ষনাে চোখের আড়াল হতে দিইনি আর।
– সমাপ্ত –