আকাশ পাতাল – ৪

শেয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা

শৃগাল অতি ধূর্ত প্রাণী। দেখতেও নেহাত খারাপ নয়। সরু ছুঁচলো মুখ। চামচের মতো ন্যাজ। অনেক বিলিতি কুকুরের চেয়ে ভালো। পুষতে ইচ্ছে করলেও পোষ মানে না। নিজের চরিত্রের গুণে আদিকাল থেকেই সাহিত্যে নিজের স্থান করে নিয়েছে। কবে একবার দ্রাক্ষাফল খাবার লোভ হয়েছিল, নাগালে এল না দেখে সেই যে বলেছিল, দ্রাক্ষাফল টক, আজও সেই উক্তি মানুষের মুখে মুখে। গাছের ডালে ঠোঁটে মাংসপিণ্ড নিয়ে কাক বসেছিল। আহা! তোমার ডাকটি কি মিষ্টি বলে, বলে, তাকে ডাকিয়ে মাংসখণ্ডটি ছিনিয়ে নিয়ে প্রমাণ করেছিল, দ্রাক্ষাফল টক বলে যতটা বৈদান্তিক হতে চেয়েছিল, ততটা বৈদান্তিক সে নয়। খাঁটি মানুষের মতো তার ভেতর বেদান্ত আছে, বিষয়বুদ্ধি আছে, সুযোগ—সন্ধানী, ধূর্ত, লোভী আবার পণ্ডিতও। পাঠশালা খুলে কুমির মাতার সব কটি সন্তানকে ভোগে লাগিয়েছিল। মানুষের মতোই শৃগালের কাণ্ডকারখানার শেষ নেই। শৈশবে ইংরেজি শিখতে গিয়ে সাত সকালেই তাকে খামারের পাশে মুরগির সঙ্গে মোলাকাত করতে দেখেছিলাম। মুরগি তার বড় প্রিয় খাদ্য। মুরগি বড় মানুষেরও ভীষণ প্রিয়। মুরগির মধ্যে মুরগি ভরে সেই মুরগির দোলমা বানিয়ে না খেলে রাষ্ট্রনায়ক দেশের চিন্তায় তেমন জুত পেতেন না।

মুরগির পালক ছাড়ানো শরীরে কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে চারটি ডিমের কুসুম ফেটিয়ে ঢেলে দিয়ে, তাইতে অলিভ, টোম্যাটো ইত্যাদি বহুপ্রকার মালমশলা ঢেলে, রাইস স্যালাড সহযোগে উদরসাৎ করে এক নেত্রী শক্ত মুঠোয় দেশের হাল ধরেন। শৃগালের সঙ্গে মুরগির দেখা হয়েছিল খামারের পাশে, তার সঙ্গে আমাদের নিত্য দেখা ভোজের টেবিলে। মুরগির ঠ্যাং ধরে সভ্য মানুষের অসভ্য টানাটানি।

মানুষের আশেপাশেই শৃগালের সংসার। শহরের বুকে প্রহরে প্রহরে তার রাত জাগা ডাক আমরা আর শুনতে পাই না ঠিকই। তবে আমাদের বুকের শ্মশানে অহরহ তার ডাকাডাকি। এক প্রশ্ন—ক্যা হুয়া, হুককা হুয়া। সবই ধোঁয়া। হুয়া হুয়া। যা হবার তা হয়েছে। চলছে চলবে, হচ্ছে হবে। জন্ম হবে, মৃত্যু হবে। মানুষের একটা অংশ এগোবে, আর একটা অংশ পেছবে। মা কালীর হাতে কাটা মুণ্ড ঝুলছে, তলায় হাঁ করে আছে লোলুপ শৃগাল। মানুষের লোভ, মানুষেরই রক্তপান করছে ফোঁটা ফোঁটা। জয় শিবা।

শেয়াল পণ্ডিতের পাঠশালাই আমাদের পাঠশালা। তুমি ধূর্ত হও, তুমি শঠ হও, প্রবঞ্চক হও, কর্তাভজা হও। বাঘের পেছনে পেছনে ঘোরো। প্রমাণ করো বাঘের শৌর্য নয়, শৃগালের ধূর্ততারই জয়জয়কার সর্বযুগে। বীরের জন্যে কফিন, একটি শ্বেতপাথরের ফলক, ইতিহাসে একটি প্যারা। ধূর্তের জন্যে সিংহাসন। সেতুর ওপর শিকার মুখে বাঘ। শৃগাল বলবে ওই দেখো জলে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী। বীর ব্যাঘ্র যেই হুংকার ছাড়বে শিকার অমনি শৃগালের খপ্পরে। এই তো রাজনীতি। এই তো বেঁচে থাকার নীতি। সমানে—সমানে পাঞ্জাব লড়াই অতীতের বিষয়। বর্তমান চলছে—’শঠে শাঠ্যং সমাচরেত’—এর নীতিতে। ধর্মের জয় কাব্যে। পাণ্ডবদের জন্যে মহাপ্রস্থান। কৌরবদের জন্যে রাজ্যপাট। সীতার জন্যে পাতালপ্রবেশ। আদর্শের পথে, ধর্মের পথে জাগতিক সুখের আশা দুরাশা। গাড়ি, বাড়ি, রাজ্যপাট, সিংহাসন শৃগালের পাঠশালে না পড়লে কব্জা করা শক্ত। জগৎকে চালাতে হলে চালু হতে হবে। অচলকে সচল করতে হবে। যে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে চায় তাকেও ফ্যাঁস ফোঁস করতে হবে।

গর্তের মধ্যে ছিল সাপ। মাঝে মধ্যেই কামড়—টামড় মারত। এক সাধু যাচ্ছিলেন সেই পথে। গর্তের সাপকে বললেন, বাপু বয়েস হচ্ছে। এখন হিংসে ভুলে অহিংস হও। সাপের মনে সাধুর উপদেশটি ধরল। সে আর ফ্যাঁস—ফোঁস করে না, কামড়ায় না। যে পারে সেই এসে খুঁচিয়ে যায়। ঢিল মারে। অনেক দিন পরে সাধুর খেয়াল হল, সেই সাপটার কী হল একবার গিয়ে দেখে আসি। সাপের অবস্থা দেখে তাঁর ভীষণ করুণা হল। নির্জীব, ক্ষতবিক্ষত, দীর্ঘকাল আহার জোটেনি। তোমার এ কী অবস্থা বাপু? সাপ বললে, আপনি আমায় অহিংস হতে বলেছিলেন। সাধু বললেন, তা তো বলেছিলুম; কিন্তু তোমাকে তো ফ্যাঁস—ফোঁস করতে বারণ করিনি। তোমার ফোঁসটি রাখবে, তা না হলে মরবে। তার মানে ফোঁস—ধার্মিক হতে হবে। তা না হলে শয়তান মেরে পাট করে দেবে। সিংহ, বাঘ, পৃথিবীর তাবৎ খানদানি প্রাণী সংখ্যায় ধীরে ধীরে কমে আসছে। সংরক্ষণের কড়া আইনে তাদের অবলুপ্তি ঠেকাতে হচ্ছে। শৃগালের সে ভয় নেই। শৃগাল—স্বভাবের জোরে সৃষ্টির আদি থেকে অন্ত তার হুক্কা—হুয়া শোনা যাবে।

শেয়ালের মতই শেয়ালকাঁটা। বড় মজার গাছ। যেখানে কিছু নেই, সেখানে শেয়ালকাঁটার শোভা! চাষের প্রয়োজন নেই। অনুর্বর, রুক্ষ জমিতেই বাড়—বাড়ন্ত। ফুলেরও কী শোভা! মানুষের ধরা—ছোঁয়ার বাইরে। কাঁটা খোঁচা হয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোরু ছোঁবে না, ছাগলে চিবোবে না। কে যে নাম রেখেছিলেন শেয়ালকাঁটা! ফুল দেখলে চোখ জুড়োয়। পাতা দেখলে আতঙ্ক হয়। ভয়াবহ সুন্দরী। সহজে উপড়ে ফেলা যায় না। সর্বাঙ্গে কাঁটা। পশু না চিনুক, শৃগালের পাঠশালে পড়া মানুষ এই উদ্ভিদটিকে ঠিক চিনেছে। সেই মানুষ, যাদের কাছে পৃথিবীটা শুধু টাকার। সুদর্শন চক্রের মতো সাদা টাকা, কালো টাকা ঘুরছে। যক্ষের মতো চেহারা। মেদে ঢাকা কুতকুতে মুখ। চোখে শৃগাল দৃষ্টি। তাদের পৃথিবীতে সাহিত্য নেই, বিজ্ঞান নেই, সংস্কৃতি নেই, আছে রাজার ছাপ মারা রাশি রাশি টাকা। যদি বলা হয়, ডক্টর খোরানা আজ বক্তৃতা দেবেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন হবে, কেতনা ভাও? ভাও? এ তোমার তেল নয়, চর্বি নয়, চা, চিনি, পাট নয়। লেকচার, লেকচার। তুমি কীসের কলাকৌশলে এমন একটি তুমি হলে সেই কাহিনি শুনতে পাবে। ঠোঁট উলটে যাবে, রাখো ইয়ার। উসমে কেয়া হোগা! মানুষ চাঁদে গিয়ে কী পেয়েছে? ওখানে পাঁচতারা হোটেল খুলে ক্যাবারে নাচানো যাবে? শেয়ালকাঁটার তেলের সঙ্গে লংকার গুঁড়ো আর সরষের তেলের গন্ধ মিশিয়ে জোড়া মহেশ মার্কা খাঁটি কড়ুয়ার তেলের কারবার খোলা যাবে ইয়ার? নেহি। তব? চাঁদ কি কেয়া ভাও হায়? চাঁদের চেয়ে চাঁদি বড়। আসলের চেয়ে নকল ভালো। চায়ের জন্যে চা—বাগানের কি প্রয়োজন বুদ্ধু! আমড়াতলার গলি আছে। ঘি আর মাখনের জন্যে গোরু চাই! গোরু তো তুম হো। ভাগাড়ে চর্বি আছে, পাশে কেমিস্ট আছে। সোজা ফর্মুলা। কেজি চর্বি, পাঁচ কেজি জল, হলদে রং পরিমাণ মতো, আর একটু সুবাস। ফেটাও। ফেটানেসে কেয়া হোগা? মখখন বনেগা জী। ইনভেস্টমেন্ট পাঁচ রুপিয়া, কামাই পচাশ রুপিয়া। হুককা হুয়া। কেয়া হুয়া? কামাই হুয়া। কামাইকা বাত ছাড়া, পৃথিবীতে আর কোনো বাত নেই।

জনৈক শিল্পপতি তাঁর প্রধান রাসায়নিককে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, এই রং বানাতে কী কী জিনিস লাগবে? কেমিস্ট ভদ্রলোক মোট ষোলোটি উপাদানের একটি তালিকা পেশ করলেন। শিল্পপতি হেসেই অস্থির, আরে বুদ্ধু, ষোলোটা মাল দিয়ে এ মাল তো সবাই বানাতে পারবে। তোমাকে তাহলে এত টাকা মাইনে দিয়ে রেখেছি কেন? পাঁচ আইটেমসে এই আইটেম বানাও। কেমিস্ট বললেন, তাতে যে স্ট্যান্ডার্ড থাকবে না। আরে ইয়ার স্ট্যান্ডার্ডকা বাত ছোড়ো, কামাইকা বাত বোলো।

বেবিফুডে ভেজাল ভরে পেটি পেটি বাজারে ছাড়া হয়ে গেছে। যিনি ছেড়েছেন সেই কড়োরপতি রোজ সকালে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে কাগজের পাতা ওলটান। কটা শিশু মরল রে বাবা! একদিন গেল, দুদিন গেল, মৃত্যুর কোনো খবর নেই। এক মাস পার হয়ে গেল, জয় রামজীকি জয়! বাল লোক সব হজম কর লিয়া।

দুষ্কর্মেও রামজি, সুকর্মেও রামজি। এরই নাম মানুষ। অন্যের গলায় চাকু চালিয়ে নিজের মৃত্যুর সময় কাতর চিৎকার, প্রভু রক্ষা করো। আরও কিছুকাল বাঁচতে দাও, প্রাণ খুলে মানুষের সর্বনাশ করি। নিজের স্ত্রীকে পর্দানসীনা রেখে অন্যের স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরি। নিজে যখন বিয়ে করব তখন সতী খুঁজব, এদিকে মনে মনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব নারীকে অসতী বানাবার মতলব। নিজের বেলায় আঁটিসুঁটি পরের বেলায় দাঁতকপাটি। এর নাম মানুষ!

ধর্মের কথা, আদর্শের কথা এ কান দিয়ে ঢুকে ও কান দিয়ে বেরোবে। হুমনে দশ মন ঘি চড়াব ঈশ্বরকে পাবার জন্যে নয়, কামাইয়ের জন্যে। ছপপড় ফুঁড়ে দে মালিক। জমি কিনব, বাড়ি কিনব, রেসের মাঠে যাব, গরম দেখাব। ভোগের জন্যেই মন্দিরে মাথা খোঁড়া। যাগ, যজ্ঞ। নিবৃত্তির জন্যে নয়। মানুষের স্বভাব হল, ধরলেই চিঁচিঁ, ছেড়ে দিলেই তুড়ি লাফ। বিপদে পড়লে এক চেহারা, বিপদ কেটে গেলেই অন্য চেহারা।

কোনো এক রুটে নিত্য আসা যাওয়ার পথে বাসে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হত। প্রায়ই তাঁকে হাত দুয়েক তফাতে রেখে আমাকে দাঁড়াতে হত। সকলের সঙ্গেই তাঁর ঠুসঠাস চলত সারাটা পথ। কোনো কোনো দিন আমার পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে অপরের সঙ্গে ঝগড়া করতেন, আমার পায়ে আপনার পা ঠেকল কেন? সোজা হয়ে দাঁড়ান। ট্যাক্সি করে যান। তারপর কোনো একটা সিট খালি হলে, সকলকে টপকে মারাত্মক এক জিমন্যাসটিক দেখিয়ে ধপাস করে বসে পড়তেন। অনেক সময় এমনও হত, নিজের কায়দার সামান্য ত্রুটির জন্যে আর একজন বসে পড়েছেন, তিনি তার কোলে গিয়ে বসে পড়লেন। সারাটা পথ কোলে বসে বসেই ঝগড়া চলল। একদিন এক আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে, তাঁর সামনেই একটি আসন খালি হল। তিনি কিন্তু বসলেন না। আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘বসুন।’ ‘সে কি আপনি বসুন, আপনি সামনে আছেন, আপনারই টার্ন।’ অমায়িক হেসে বললেন, ‘আরে বসুন, বসুন, আজ আপনি বসুন।’

বসে বসে ভাবছি, মানুষের স্বভাবের এই ভাবেই হঠাৎ পরিবর্তন হয়। রত্নাকর রাতারাতি বাল্মীকি। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন, হাজার বছরের অন্ধকার একটি বাতিতেই আলোকিত হয়ে যায়। মনে মনে বলছি, যাক অবশেষে আপনি তাহলে শোধরালেন! শুধরে মানুষ হলেন।

হঠাৎ ভদ্রলোক সামনে ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘বসব কি মশাই, পাছায় অ্যায়সা এক ফোড়া হয়েছে, ছটা মুখ।

আমার সব ভাবনা উলটে গেল। কুকুরের ন্যাজ কারুর পিতার ক্ষমতা নেই সোজা করে।

এক মাংসাশী হঠাৎ মাংসাহার ছেড়ে দিলেন। বললেন আমি অহিংস হলাম। ছাগল এসে মহাপুরুষটিকে বললে, ‘সাধু, সাধু! সব মানুষই যদি আপনার মতো মহানুভব হতেন!’

তিনি বললেন, ‘ভয় নেই, একদিন না একদিন সকলকে হতেই হবে। দাঁত গেলে হাড় চিবোবে কী করে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *