আকাশ পাতাল – ১৩

১৩

জন্ম যার কোলে মৃত্যুও তারই কোলে

গম—এ হস্তী—কা, অসদ, কিস—সে হো জুজ মর্গ ইলাজ।
শমা হর রঙ্গ—মে জলতী হৈ সহর হোনে তক।।

গালিব।

ওঁ প্রজাপতয়ে নমঃ, মানে একটি সংসারের শুরু। সানাই বাজতেও পারে, নাও পারে। আলোর ঝালরে গৃহ সাজতেও পারে নাও পারে। সাড়ম্বরে অথবা অনাড়ম্বরে সংসারের সূত্রপাত এইভাবেই হয়ে আসছে। একটি রাতের খেলা। শ্রাবণের কোনো বর্ষণ রাত হতে পারে। বসন্তের কোনো উতলা রাত হতে পারে। শামিয়ানার তলায় ছায়া ছায়া আমন্ত্রিত কিছু মানুষ! আলোর বৃত্তে কিছু উড়ন্ত পোকা, সিগারেটের পাক খাওয়া ধোঁয়া। কলাপাতায় ফুলকো লুচি, টিকিঅলা ঝুল কালো বেগুন ভাজা। বালি কিচকিচে মরসুমি শাকভাজা, এক হাতা মুগের ডাল, সমাহিত মাছের মাথার ভগ্নাংশ, রোরুদ্যমান পাকা পোনার গোটা দুই খণ্ড, বিমর্ষ মাংসের টুকরো, স্বচ্ছ চাটনিতে পেঁপের ওড়না, চতুষ্কোণ সন্দেশ, বর্তুলাকার রসগোল্লার মলিন মুখচ্ছবি। ত্রিকোণ পান মুখে অভ্যাগতদের সউদ্গার বিদায়। মধ্যরাতে কুকুরের চিৎকার, এঁটো পাতা নিয়ে টানাটানি। সুচারু শয্যায়, রজনীগন্ধার বাস নিতে নিতে এক জোড়া মানবমানবীর তরণী ভাসানো। একবার সুখ এসে হাল ধরে তো, দুঃখ এসে সে হাত সরিয়ে দেয়। বন্ধন ক্রমশই দৃঢ় হতে থাকে। জীবনে জীবন মিলে যায়। নতুনের গন্ধ মুছে যায়। জড়তা কেটে আসে।

ডুরে শাড়ি মোড়া যৌবনে বার্ধক্যের ছায়া নামে। দুই ইতিমধ্যে তিন, তিন থেকে চার, চার থেকে পাঁচ হয়ে যায়। নীচের দিক যত ভরাট হতে থাকে ওপরদিক তত খালি হতে থাকে। শ্বশুরমহাশয়, ‘তোমরা সব সুখে থাক,’ বলে একদিন বিদায় নিলেন। বিদায় নিয়ে গেলেন শাশুড়ি। সেদিনের নব দম্পতি হয়ে গেলেন কত্তা, গিন্নি। চারপাশ মা, মা ডাকে সরব। বিদায়ী কর্তার আসনে নতুন কর্তা। বিয়ের রাতের সিল্কের পাঞ্জাবিটি পোকায় ফুটোফুটো করেছে। সোনার বোতাম স্থান নিয়েছে গয়নার বাক্সে। মনে মনে প্রস্তুতি চলছে মেয়ের বিয়ের। কত্তার যৌবনের লম্বা হাত খাটো হয়েছে। মুখের হাসির বহর কমেছে। যে চোখে চশমা ছিল না সে চোখে চশমা এসেছে। সামনের চুল পাতলা হয়েছে। চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে। সময়ের ট্র্যাক্টর জীবনের খেতটিকে কুদলে দিয়েছে। ফসল কী উঠেছে, তা আর ভেবে দেখার সময় নেই। প্রেমের কথা স্বপ্নের কথা সব ফুরিয়ে গেছে, এখন শুধু কাজের কথা, কর্তব্যের কথা। সব খেলাই এখন মধ্য মাঠে, আত্মরক্ষার খেলা।

মধ্যবিত্তের আশা, আকাঙ্ক্ষা খুবই সামান্য। আকাশছোঁয়া কিছু নেই। কেউ রেসের ঘোড়া কিনে ডার্বি জিততে চায় না। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গলে সিংহ শিকারের বাসনাও নেই। সাতমহলা ইন্দ্রপুরীর স্বপ্নও কেউ দেখে না। পোয়াভর পাত্রে জীবনের মাপামাপি। লটারিতে হঠাৎ ছিয়াত্তর লাখ টাকা পেয়ে গেলে অনেকে হয় তো মারাই যাবেন। ইচ্ছাপূরণের দেবতা হঠাৎ যদি সামনে এসে প্রশ্ন করেন, ‘বলো তুমি কী চাও? তোমার তিনটি বাসনা আমি পূর্ণ করব। মধ্যবিত্ত থতোমতো খেয়ে যাবেন। ভেবেই পাবেন না, ঠিক কী চাই। শেষে বলবেন, ‘হে দেবতা, বিকেলের দিকে আমার গৃহিণীর চোরা অম্বল আর আধকপালেটি চিরতরে দূর করে দাও। এই হল আমার এক নম্বর প্রার্থনা। দু’নম্বর, ছেলেটিকে একটা ভালো চাকরি পাইয়ে দাও। তিন নম্বর, মেয়েটির জন্যে একটি ভালো পাত্র জুটিয়ে দাও। চতুর্থ আর একটি ইচ্ছা আছে প্রভু, সেটি হল, না ভুগে, না ভুগিয়ে আমি যেন করোনারি থ্রম্বোসিসে দুম করে মরে যেতে পারি।’

যে যেখানে আছে, সে সেখানেই থাকতে চায়। সেইখানেই রেখে যেতে চায় উত্তরপুরুষকে। আগেকার দিনে নিয়ম ছিল, পিতা অবসর নেবার পর, পিতার সেরেস্তাতেই পুত্রের চাকরি মিলত কর্মচারীর সন্তান হিসেবে। এখনও হয়তো কোথাও কোথাও এই নিয়ম চালু আছে। কেরানির ছেলে কেরানি। কম্পাউন্ডারের ছেলে কম্পাউন্ডার। ঠেলে ওপরে ওঠার চেষ্টা করলেও উপায় নেই। স্বপ্ন দেখা যায়। জাগরণের বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করা সহজ নয়। খাঁচার পাখির মাপা আকাশ। বিশাল আকাশে উড়তে গেলেই ডানা বেঁধে যায়।

মাছউলীকে রাজা খাতির করে সুরভিত করে, সুন্দর পালঙ্কে শুতে দিলেন। প্রহরের পর প্রহর চলে যায়, ঘুম আর আসে না। শেষে মাছের চুবড়িটি জলে ভিজিয়ে এনে মাথার পাশে রাখল। সেই পরিচিত গন্ধ। ধীরে ধীরে ঘুম এসে গেল।

পাঁচতারা হোটেলে মধ্যবিত্তকে ছেড়ে দিলে তার অবস্থা হবে গরম টিনের চালে বেড়ালের মতো। কার্পেটে জুতোসুদ্ধ পা তোলার আগে বকের মতো থমকে দাঁড়াবে। তারপর একপাশ দিয়ে পা টিপে টিপে হাঁটবে চোরের মতো। যদি বলা হয় কার্পেটের দাম দশ হাজার টাকা, তা হলে পা দিয়ে নয়, হাঁটু দিয়ে হাঁটার চেষ্টা হবে। খাবার টেবিলে ভোজের আয়োজন দেখে হাত গুটিয়ে আসবে। কার পর কী খেতে হয় জানা নেই।

ধনীর বাথরুমে ঢুকে জনৈকের প্রাকৃতিক কর্ম মাথায় উঠে গিয়েছিল। তার নিজের শয়নকক্ষের দ্বিগুণ আয়তন। চতুর্দিকে ঝকঝকে পালিশ করা। রুপোর মতো ঝকঝকে বাথরুম ফিটিংস। হাত দেবার আগে নিজের হাত দেখতে হয়। হাতের ময়লায় পালিশ না নষ্ট হয়ে যায়। বিশাল বাথটবে গন্ডা কয়েক কলের মুখ, পাইপের কারিকুরি। বাথটাব যেন বিলাসী বৃদ্ধ। আয়েস করে শুয়ে আছে। মেঝেতে এক ফোঁটা জল ফেলতে সংকোচ হয়। দেয়ালের গায়ে ওয়াটার হিটার। কলের গায়ে লেখা ‘হট’ আর ‘কোল্ড’।

মধ্যবিত্তের গৃহিণী দেড় হাজার টাকা দামের শাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। সে শাড়ি একবার পরেই, খুলে তুলে রাখতে হল। কোথাও বসতে গেলেই ভয় হয়, এই বুঝি দাগ লেগে গেল। চলতে গেলে ভয় হয়, এই বুঝি খোঁচা লেগে গেল। সে শাড়ি তোলাই রইল, বছরের পর বছর। পরা আর হল না। তিনশো টাকা দামের বিলিতি সেন্ট প্রদর্শনীর বস্তু হয়ে আলমারির গর্ভকোষেই মজুত রয়ে গেল, ব্যবহার করার সাহস হল না। এক ফোঁটার দাম কত সে হিসেব আজও মেলেনি! বড় জটিল গণিত।

যার যে মাপের চলন, সে সেই মাপেই পা ফেলবে। সুখের সংজ্ঞা যেমন সীমিত, সমস্যার বেশির ভাগই ছ্যাঁচড়া সমস্যা। কল, জল, আলো, দুধ, তেল, তেলেভাজা, ইলেকট্রিক বিল, মশামাছি, তেলাপোকা, হাঁচি, কাশি, সর্দি, পালাজ্বর, চুল উঠে যাওয়া, চোখ বসে যাওয়া, বায়ু, পিত্ত, মাছের দাম, আলুর দাম, ধুলো, ধোঁওয়া, বাড়িঅলা, ভাড়াটে। জিশুখ্রিস্ট ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন। মধ্যবিত্ত জিশুরা আলপিনের খোঁচায় মরোমরো।

এরই মধ্যে সাধ, অন্নপ্রাশন, বিবাহ, শ্রাদ্ধ। শিশুর আগমন। হাম, হামা। যকৃৎ বিবৃদ্ধি, হাতেখড়ি, বিদ্যারম্ভ। কিল, চড়, কানমোলা, মৃদু ধোলাই, আড়ং ধোলাই। কান্না, হাসি, বায়না। কখনো সোনার চাঁদ, মানিক আমার, কখনো গেছো হনুমান। পূর্বপুরুষ যত পাকছে, উত্তর পুরুষ ততই ডাঁসছে। ঠোঁটের ওপর গোঁফের রেখা স্পষ্ট হচ্ছে। গলায় বয়সা ধরছে। মা বাবা ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছে। বাইরের পৃথিবী এগিয়ে আসছে। প্রথমে গোপনে ধূমপান। ক্রমে প্রকাশ্যে। দৃষ্টি তেরছা হচ্ছে। মেয়েদের দিকে তাকাবার ধরন পালটাচ্ছে। ‘প্রাপ্তে তু ষোড়শ বর্ষের’ নীতিতে সংসার সব মেনে নিচ্ছে।

অবশেষে ‘অল রোড লিডস টু রোম’। পিতা ছিলেন কালেক্টরির বড়োবাবু। ছেলে ব্যাংকের কেরানি। বছর না ঘুরতেই ওঁ প্রজাপতয়ে নমঃ। আবার সেই হলুদ নিমন্ত্রণ পত্র। নতুন সিল্কের পাঞ্জাবি। এক সেট সোনার বোতাম। এক জোড়া নিউকাট। যুগ পালটেছে। ভিয়েনের বদলে ক্যাটারার। বাঁধা মেনু। কড়া পরিবেশন। সামান্য অদলবদল; কিন্তু সেই এক রাত। নতুন খাটে নতুন বিছানা। মসৃণ চাদর। রজনীগন্ধা একদিন সুবাস ছড়িয়ে শুকিয়ে যাবে। নবাগতার রঙিন ডুরে শাড়ি ধীরে ধীরে রং হারাবে। মৃদু চলন, মৃদু ভাষণ ক্রমে উচ্চ থেকে উচ্চতর হবে। বধূর ঘোমটা খসে, মাতা। সংসারের প্রাচীন মাতাটি ক্রমে ক্রমে অন্তরালে অস্তমিত হতে থাকবেন। একটু একটু করে তাঁর সব অধিকার চলে যাবে অন্যহাতে। এরপরই ওঁ গঙ্গা। যে খোঁটার সঙ্গে জীবন—তরণী বেঁধেছিলেন, সেই খোঁটাটি কালের নদীতে ভেসে যাবে। শূন্য শয্যায় দীর্ঘ একটি পাশবালিশ। ক্ষয়ে যাওয়া এক জোড়া চপ্পল। পুরু লেন্সের চশমা। গোটা দুই ধর্মপুস্তক। কয়েকটি ওষুধের ফাইল নীরবে তাকিয়ে থাকবে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধার দিকে। কেউ বুঝবে না তাঁর বেদনা। সংসার কখনোই তেমন মরমী নয়। হাঁসের মতো। পালকে জল ধরে না। বেদনার খোঁচা সময়ের শানে পড়ে মোলায়েম হয়ে আসে। কোনো যাওয়াই দীর্ঘকাল মনে রাখা যায় না। আগমনের চাপে নির্গমনের বেদনা মুছে যায়। ঝুল ঝাড়তে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় এক সার ছবি। অন্নপ্রাশনের আসনে টোপর মাথায় শিশু ক্রমে প্যান্ট পরা কিশোর। কিশোর থেকে যুবক। স্বামী স্ত্রী। বৃদ্ধবৃদ্ধা। শেষে একজন আছেন আর একজন নেই। অবশেষে দুজনেই ওঁ গঙ্গা। গালিবের মতো বলতে ইচ্ছে করে।

হস্তী হৈ নহ কুছ অদম হৈ, গালিব!
আখির তো কেয়া হৈ, অয় নহী হৈ?

সব আছে, না কিছুই নেই, গালিব?
শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা কী? নাকি কোনো ব্যাপারই নেই?

(অনু : আবু সয়ীদ আইয়ুব)

জীবনের শেষটা সকলেরই ভারি নিঃসঙ্গ। পাশের খেলার মাঠে তাদের উল্লাস, যারা নতুন এসেছে। রেফারি বাঁশি বাজাচ্ছে দূরে গাছের পাতা বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। কৃষ্ণকলি ফুটেছে, রাত ভোর হবার আগেই ম্লান হবার জন্যে। পাশের ঘরে নাতিরা গোল হয়ে বসেছে ক্যারামবোর্ড ঘিরে। স্ট্রাইকারের শব্দ হচ্ছে খটাস খটাস। পুত্রবধূ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কপালে টিপ আঁকছে সুচারু করে। টিভির পর্দায় যিনি গান গাইছেন, তিনি বছর পাঁচেক আগে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ছায়া শরীর, ছায়াকণ্ঠ পড়ে আছে।

জীবনের সব কাজ শেষ হয়ে গেলে কেমন লাগে? সেই সব কাজ, যা আর নতুন করে শুরু করা যাবে না। শুধু অপেক্ষা। হয় ক্ষণ অপেক্ষা, নয় দীর্ঘ অপেক্ষা। অপেক্ষা বড় ক্লান্তিকর। গাছতলায় প্রেমিকের অপেক্ষা। রোগীর ডাক্তারের জন্যে অপেক্ষা। বিদেশ থেকে ছেলের চিঠি আসবে তার অপেক্ষা। দুর্যোগের রাতে প্রিয়জন ঘরে ফেরেনি তার অপেক্ষা। পদশব্দ শোনা গেছে, কখন কে আসে, বড় উৎকণ্ঠা। সময়কে তখন বড় দীর্ঘ মনে হয়। শেষবেলার ছায়ার মতো।

কাছের মানুষ তখন অনেক দূরের। শব্দে নৈঃশব্দ্য। জীবনেই মৃত্যু। হাতের মুঠো খুলে খুলে মুহূর্তের পাখিরা অনবরতই উড়ে চলেছে। কাউকেই আর ফেরানো যাবে না। যাহা যায়, তাহা যায়। শূন্য এ বুকে যতই ডাকো না কেন পাখি আর ফিরবে না। গালিব সাহেবের মতই বলতে ইচ্ছে করবে :

বাদহ আনে—কা বফা কীজীয়ে; য়েহ কেয়া অন্দাজ হৈ,
তুম—নে কিঁউ সঁওপী হৈ মেরে ঘর—কী দরমানী মুঝে।।

আসবে ব’লে কথা দিয়েছো, কথা রাখো;
এ কেমন রীতি তোমার,
আমাকে আমারই দরজায়
দরোয়ানির কাজ দিয়েছো কেন?

(অনু : আবু সয়ীদ আইয়ুব)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *