অমৃতে গরল ছিল (দ্বিতীয় পর্ব)

অমৃতে গরল ছিল

শহরের এই অঞ্চলটায় বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে একসময় ছিল শুধুই খোলার ঘরের বস্তি। কালের প্রভাবে হঠাৎ করে সেখানেই একদিন প্রোমোটারের থাবা পড়ে পর পর গজিয়ে উঠল আট—দশটি ওনারশিপ ফ্ল্যাট। কত নাম তাদের। আকাশদীপ, মঙ্গলদীপ প্রভৃতি।

এর মধ্যে মঙ্গলদীপই সবার নজর কেড়ে নিল। মঙ্গলদীপের ‘বি’ ব্লকে এলেন জয়প্রকাশ মিশ্র নামে এক স্বর্ণব্যবসায়ী। বয়স পঞ্চাশোর্ধ্বে। সঙ্গে তাঁর লাস্যময়ী যুবতী স্ত্রী। একেবারে ডাকের সুন্দরী বললে যা বোঝায় ঠিক তাই। পথে বেরোলে জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে থাকত তাঁর দিকে।

মঙ্গলদীপের অদূরে একটি গলির মুখে ছিল বসন্তকুমারের বৈদ্যুতিক সাজ—সরঞ্জামের দোকান। বসন্তকে সবাই বসন বলেই ডাকত। বয়স সাতাশ—আঠাশের বেশি নয়। গায়ের রং ফর্সা। শক্তসমর্থ পরিশ্রমী যুবক। কিছুকাল আগে বহু অর্থ ব্যয় করে বোনের বিয়ে দিয়েছে। বিয়ে—থা করেনি। একার সংসার ওর। সেই বসন্তের সাথেই একদিন চোখে চোখ পড়ল মিশ্রজায়ার। বসন্তর বুকের মধ্যে যেন হাহাকার করে উঠল। বলতে গেলে সেদিন থেকেই নিজের মধ্যে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে। তাই সব সময়ই উৎসুক হয়ে থাকত আরও একবার নয়নভরে তাকে দেখবার জন্য। জয়প্রকাশ মিশ্র ব্যবসায়ী লোক। সে কারণে প্রায়ই তাঁকে ব্যবসার প্রয়োজনে যেতে হত দূরে—দূরান্তরে। সেই সময়কালে সুন্দরী মিশ্রজায়া নিজেই আসতেন বাজার—দোকানে প্রয়োজনে কিছু কেনাকাটা করতে। বসন্তের দোকানের পাশ দিয়েই আসা—যাওয়া। তাই চোখে চোখ পড়তই। বসন্ত তাকিয়ে থাকলেও চোখ নামিয়ে নিত মিশ্রজায়া।

এইভাবেই দিন যায়।

হঠাৎই একদিন এক সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় রূপের মাধুরী নিয়ে মিশ্রজায়া বসন্তর দোকানে এসে ওর মুখোমুখি হল।

বসন্তর মনের আঙিনাও যেন উদ্ভাসিত হল তার সেই রূপের ছটায়। নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারল না। তবু আবেগের উচ্ছ্বাস চেপে মুখে হাসি এনে বলল, ‘কিছু কি বলবেন?’

হরিণনয়না মিশ্রজায়া মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল, ‘আপনাকে যে আমার বিশেষ প্রয়োজন।’

বিস্মিত বসন্ত বলল, ‘বলুন কী প্রয়োজন?’

‘আমার ফ্ল্যাটের আলো হঠাৎ করে নিবে গেছে। কী যে হল কিছু বুঝতে পারছি না। আমার হাজব্যান্ডের ফিরতে রাত হবে। এই দীর্ঘ সময়টা আমি কি অন্ধকারে থাকব?’

‘মোটেই না।’ বসন্ত সঙ্গে সঙ্গে ওর যন্ত্রপাতি নিয়ে যাবার জন্য তৈরি হল। বলল, ‘কানেকশনের কোনও গোলমাল হয়েছে বলে মনে হয়। ও আমি এখনই ঠিক করে দিচ্ছি। আমার দোকান রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে। কখনও কোনও অসুবিধা হলে খবর দেবেন।’

বসন্ত ওর দোকান বন্ধ না করে পাশের দোকানের একজনকে একটু নজর রাখতে বলে সেই বিদ্যুৎবর্ণার সঙ্গ নিয়ে মঙ্গলদীপে এল।

সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখল সব ফ্ল্যাটে আলো জ্বললেও শুধু এই ফ্ল্যাটের ঘরগুলোই নিষ্প্রদীপ। বুদ্ধি করে ও টর্চটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তাই কোনও অসুবিধা হল না।

মিশ্রজায়াও মোমবাতি ধরালে তারই আলোয় ও কিছুক্ষণের মধ্যেই অভ্যস্ত হাতে লাইন ঠিক করল। আলোয় ভরে উঠল গোটা ঘর। মিশ্রজায়া এবার খুশির জোয়ারে ভেসে বসন্তকে একটি আরামকেদারায় বসিয়ে বলল, ‘এবার বলুন চা না কফি?’

অভিভূত বসন্ত এতটা আশাও করেনি। মৃদু হেসে বলল, ‘কফি হলেই ভালো হয়।’

মিশ্রজায়া ওর দিকে একবার মোহিনী দৃষ্টিতে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে কফি করতে চলে গেল। একটু পরে দুজনের মতো কফি আর বিস্কুট নিয়ে এসে মুখোমুখি বসল।

বসন্ত কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, ‘আপনারা তাহলে দুজনেই। কোনও ছেলেমেয়ে?’

‘এখনও কোনও ইস্যু হয়নি।’

‘আপনার উনি তো শুনেছি বেশিরভাগ সময় বাইরে বাইরেই কাটান। আপনার বোর লাগে না?’

‘লাগলেই বা কী করব বলুন? একটা বাচ্চা মেয়েকে রেখেছি, ও টুকিটাকি কিছু কাজ করে দেয়। ওর মা এসে একবেলায় বাসন মেজে ঘর পরিষ্কার করে মেয়েকে নিয়ে চলে যায়। রান্না আমি নিজেই করি। সব সময়ের জন্য কাউকে রাখি না। দিনকাল তো ভালো নয়।’

বসন্ত বলল, ‘ঠিকই করেন।’

মিশ্রজায়া এবার মানিব্যাগ খুলে একটি পাঁচশো টাকার নোট বসন্তর হাতে দিয়ে বলল, ‘হবে তো?’

বসন্ত অবাক হয়ে বলল, ‘আমার কাছে তো চেঞ্জ নেই।’

‘কী আশ্চর্য! চেঞ্জ কে চাইছে আপনার কাছে? আমি শুধু জানতে চাইলাম কম দিলাম না তো?’

বসন্ত কপালে হাত রেখে বলল, ‘হায় ভগবান! এটা রেখে আপনি ত্রিশটা টাকা দিন।’

বসন্তর কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ল মিশ্রজায়া। বলল, ‘এত কম টাকায় কারবার করলে জীবনে দাঁড়াবেন কী করে? যাক, আপনার ফোন নাম্বারটা দিন তো?’

বসন্ত ফোন নাম্বার দিলে মিশ্রজায়া বলল, ‘আমারটাও নিয়ে রাখুন। আমি আরতি মিশ্র। ফোন নাম্বার…।’

নম্বর আদানপ্রদানের পর মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে মঙ্গলদীপ থেকে আবার দোকানে এল বসন্ত। এরপর প্রায়ই দুজনের চোখাচোখি এবং মিষ্টি হাসির বিনিময় চলতে লাগল। এক বিকেলে শপিং করে ফেরার সময় মিশ্রজায়া বসন্তকে বলল, ‘কফি, মিল্ক পাউডার সবই ফুরিয়ে গিয়েছিল। নিয়ে এলাম। সন্ধের পর আসুন না, জমিয়ে কফি খাওয়া যাবে।’

বসন্ত বলল, ‘আসব, নিশ্চয়ই আসব।’ মিশ্রজায়া চলে যাবার পর এক অনাস্বাদিত রোমান্সের প্রভাবে ছটফট করতে লাগল বসন্ত। একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল। যাকে দেখলে চোখ ফেরাতে পারত না, বুকের ভেতরটা কামনার দহন জ্বালায় জ্বলত সেই তার কাছ থেকেই যে অযাচিতভাবে এমন লোভনীয় আমন্ত্রণ কোনওদিন আসবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। তাই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগল কখন সন্ধ্যা নামে সেই আশায়।

অবশেষে সন্ধ্যা হল। সন্ধ্যা সমাগমে ওর চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। দোকানের পাশেই সাইকেলটা রাখা থাকে। ও দোকান বন্ধ করে সাইকেল নিয়ে চট করে ওর বাড়িতে গিয়ে ড্রেসটা একটু চেঞ্জ করে নিল। তারপর ধীর পায়ে এসে হাজির হল মঙ্গলদীপে। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। ফ্ল্যাটের ডোরবেলে চাপ দিতেই লাস্যময়ী মিশ্রজায়া দ্বার খুলে বলল, ‘আসুন বসন্তবাহার মহাশয়।’

ও ভেতর ঢুকে বলল, ‘আমি বসন্তবাহার নই। বসন্তকুমার।’

মিশ্রজায়া হেসে বলল, ‘যার কৌমার্য যায়নি তাকে অবশ্য কুমার বলাই যায়। তবে আমার চোখে আপনি বসন্তবাহার। এত সুন্দর দেখতে, অথচ কোনও মেয়ে এখনও যে কেন ফাঁসায়নি আপনাকে সেটাই শুধু ভেবে পাচ্ছি না।’

বসন্ত ভেতরে ঢুকলে মিশ্রজায়া বলল, ‘বেশিক্ষণ থাকলে অসুবিধা নেই তো আপনার?’

‘না। আমি দোকান বন্ধ করে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে তবেই এসেছি।’

‘বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন। বোনের বিয়ে দিয়ে হালকা হয়েছেন, বলা যেতে পারে দায়মুক্ত হয়েছেন। নিজেও বিয়ে করেননি। তাই পিছুটানও নেই। ঠিক বলছি কি না বলুন?’

‘ঠিকই বলছেন। কিন্তু আমার ব্যাপারে এতসব আপনি জানলেন কী করে?’

‘মেয়েরা যার দিকে নজর দেয় তার নাড়িনক্ষত্র তারা আগেভাগেই জেনে নেয়। আমার যে কাজের দিদি সে আপনাকে চেনে। বলে, বসনদাদার মতো ছেলে হয় না। বড় ভালো মানুষ।’

এরপর আরামকেদারায় বসে নানারকমের গল্প হল। বসন্ত জিগ্যেস করল, ‘আপনার হাজব্যান্ড কত রাতে ফিরবেন?’

‘উনি ভাইজাগ গেছেন, ফিরতে চার—পাঁচদিন কি আরও বেশি সময় লাগবে। একা থেকে হাঁপিয়ে উঠি। তাই আসতে বললাম আপনাকে। একটু বসুন। আপনার জন্য কফি নিয়ে আসি।’

মিশ্রজায়া উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে ডিশভর্তি রসগোল্লা ও সন্দেশ এনে এগিয়ে দিল বসন্তের দিকে, ‘ততক্ষণ এগুলো খান, একটু পরে কফি আনছি।’

বসন্ত বলল, ‘তা তো খাব। তাই বলে এত?’

‘ও কিছু না। আমার যা প্রিয় তাই আপনাকে খেতে দিলাম।’

বসন্তর খাওয়া শেষ হলে কফি আর বিস্কুট নিয়ে ঘরে এল মিশ্রজায়া। তারপর কফি খেতে খেতেই বলল, ‘আপনার বাড়ি এখান থেকে কতদূরে?’

‘তা মিনিট দশেকের পথ।’

‘কীসে যাতায়াত করেন?’

‘সাইকেলে।’

‘সাইকেল! কেন আপনার স্কুটার নেই?’

‘স্কুটার কেনার টাকা কোথায় পাব?’

‘আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন একটা স্কুটার কিনুন। টাকা আমি দেব। ষাট—সত্তর হাজারের মধ্যে হয়ে যাবে নিশ্চয়ই।’

বসন্ত হাঁ করে তাকিয়ে রইল মিশ্রজায়ার দিকে। অত টাকা উনি দেবেন!

মিশ্রজায়া বলল, ‘স্কুটার চালাতে পারেন তো?’

‘পারি। ড্রাইভিংও জানি।’

মিশ্রজায়া আর কিছু না বলে আলমারির ড্রয়ার খুলে একশো টাকার নোটের বান্ডিল খান সাতেক নিয়ে এসে বসন্তর হাতে দিয়ে বলল, ‘এতেই হয়ে যাবে আশা করি। সত্তর হাজার আছে। কিনবেন কিন্তু।’

বসন্তর বিস্ময় একবার মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। বলল, ‘এতগুলো টাকা আপনি আমাকে দিলেন। শোধ করব কী করে?’

মিশ্রজায়া হেসে বলল, ‘আমি তো আপনাকে ধার হিসেবে দিইনি। এটা আমার তরফ থেকে গিফট। প্রীতির নিদর্শন বলতে পারেন।’

বসন্ত টাকাগুলো ব্যাগে পুরে বলল, ‘আপনার এই সৌজন্য আমি চিরকালের জন্য মনে রাখব। আজ তাহলে আসি?’

‘আসুন।’

সে রাতে টাকাগুলো মাথার কাছে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল বসন্ত। অতগুলো মিষ্টি খাওয়ার পর কিছু আর খেতে ইচ্ছে করল না। ও শুধু ভেবে পেল না সামান্য দু—একদিনের পরিচয়ে মিশ্রজায়া এতগুলো টাকা ওর হাতে তুলে দিলেন কী করে? এঁরা তাহলে কত টাকার মালিক? যাই হোক, কালই সে ওর এক বন্ধুকে নিয়ে মনের মতো একটি স্কুটারের দরদাম করে আসবে। পারলে কিনেও নেবে।

পরদিন সকালটা নানান ব্যস্ততার মধ্যে কাটল বসন্তর, বন্ধুর দেখা না পাওয়ায় স্কুটারের দোকানে যাওয়া হয়নি। নিজের দোকানও খোলেনি ও। তবে বিকেলে একবার দোকানে গিয়ে বসবে।

দুপুরে খেতে বসেছে তখনই ফোন এল, ‘স্কুটার এসেছে?’

‘না। কাল—পরশুর মধ্যে কিনে নেব।’

‘এখন কোথায়?’

‘বাড়িতেই আছি। খেতে বসেছি।’

‘এত বেলায়?’

‘আমি এরকম সময়েই খাই।’

‘কালকের মতো আজও একবার আসবেন কিন্তু। আমার এখানে আজ আপনার নিমন্ত্রণ। আমি খুব যত্ন করে আপনার জন্য বিরিয়ানি তৈরি করছি। ভেবেছিলাম স্কুটার নিয়ে আসবেন, তা যাক। সন্ধের পরই চলে আসবেন।’

বসন্ত আবেগ জড়ানো গলায় বলল, ‘আসব। শুধু আজ বলে নয়, আপনি যেদিন যখন যে অবস্থায় ডাকবেন তখনই চলে আসব।’

ফোন রেখে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করল বসন্ত। তারপর একটুও বিশ্রাম না নিয়ে নিজেই দু—একটা সিটি মলে গিয়ে স্কুটার পছন্দ করল। পঁয়ষট্টি হাজারে একটির দরদাম করে আগামীকাল সেটিই নেবে সিদ্ধান্ত হল। তারপর সন্ধে হতেই চলে এল মঙ্গলদীপে। যেখানে ওর মনকে ভরিয়ে দেবার মতো কেউ একজন আছে।

সিঁড়ি দিয়ে সোজা ওপরে উঠে দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল দরজা। অপরূপা সাজে সজ্জিতা হয়ে ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল মিশ্রজায়া। বলল, ‘আসুন, আসতে আজ্ঞা হোক।’

বসন্ত হেসে বলল, ‘আজ্ঞা তো আপনি দেবেন।’

‘দিলাম। অনেকদিন বিরিয়ানি রাঁধিনি। আজ আপনার জন্যই রাঁধলাম। না হলে এসব আমি হোটেল—রেস্টোরেন্ট থেকেই আনিয়ে নিই।’

‘আজও তাই করতে পারতেন।’

‘বাঃ রে। তাহলে কি আমার হাতের রান্না খাওয়ানো হত আপনাকে?’ বলেই টিভিটা অন করে দিল, তারপর রিমোট হাতে এ চ্যানেল ও চ্যানেল ঘুরিয়ে নিউজে এল।

কিছুক্ষণ খবর দেখার পর বসন্তকে বসিয়ে রেখে শিঙাড়া আর কফি নিয়ে এসে ওর পাশেই বসে পড়ল মিশ্রজায়া। এরপর কফি খেতে খেতেই বসন্তর ব্যাপারে আরও অনেক খোঁজখবর নিতে লাগল। তারপর বলল, ‘এখানে এসে আপনাকে পেয়ে আমি যেন বর্তে গেলাম। চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে কি ভালো লাগে? একজন কেউ গল্প করার মতো না থাকলে বোর লাগে খুব।’

‘আপনি তো বিকেলের দিকে এদিক—ওদিক করে একটু ঘুরতেও পারেন?’

‘পারি। কিন্তু আমার এই রূপই যে অভিশাপ। বাইরে বেরোলেই সকলের জোড়া জোড়া চোখের দৃষ্টি আমাকে লেহন করতে থাকে।’

বসন্ত হেসে বলল, ‘ওটা একটু মানিয়ে নিলেই পারেন। যে আপনাকে দেখে দেখুক। আপনি তাকাবেন না কারও দিকে।’

নিউজ থেকে এবার হিন্দি সিনেমায় রিমোট ঘুরল। রাত নটার পর মিশ্রজায়া বলল, ‘আপনার দেরি করিয়ে দিচ্ছি না তো? এবার বরং খাওয়াদাওয়ার পাটটা চুকিয়ে নেওয়া যাক।’

বসন্ত বলল, ‘যা আপনার মর্জি।’

মিশ্রজায়া এবার পাশের ঘরের ডাইনিং টেবিলে খাবারের সরঞ্জাম রেডি করে ডাক দিল বসন্তকে। খাদ্যতালিকা দেখে মন ভরে গেল বসন্তর। চিকেন বিরিয়ানি, স্যালাড, কষা মাংস, সন্দেশ ও আইসক্রিম। দুজনে মুখোমুখি বসে বেশ তৃপ্তি করে খেল। উপাদেয় রান্নার প্রশংসা না করে পারল না বসন্ত।

মিশ্রজায়া বলল, ‘আমার হাজব্যান্ড বাইরে আছেন বলেই এটা সম্ভব হল। উনি থাকলে তো হত না। যাই হোক, আপনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব যখন নিবিড় হলই তখন মাঝে মাঝেই এইভাবে এনজয় করব কী বলুন?’

‘বলেছি তো আপনি যখনই ডাক দেবেন তখনই আসব।’

‘প্রমিস?’

‘প্রমিস।’

‘তাহলে শেষ কথা বলি, বন্ধুত্ব যখন এত দূর এগোল তখন আর আপনি নয় তুমিই বলবে আমাকে। আমি আরতি। আমায় রতি বলে ডাকলে খুব খুশি হব আমি।’

‘ডাকব। তুমিও আমাকে বসন বলে ডাকবে।’

‘আমি তোমাকে মদন বলে ডাকব।’

‘বেশ, যে নামে ডাকলে তুমি খুশি হও সে নামেই ডাকবে।’

মিশ্রজায়ার এইসব আলাপনে বসন্তর বুকের ভেতরটা যেন তোলপাড় করে উঠল। এ তো প্রেম! ও নিজে যেমন ব্যাকুল হয়ে ওর সঙ্গ পেতে চায়, সেও কি তাই? তবুও ওরা দুজনে প্রেম যমুনার এপার—ওপার। তার ওপর মিশ্রজায়া পরস্ত্রী। ওই ধনী দম্পতির বৈভবের কাছে ও এক হতদরিদ্র যুবক ছাড়া কিছু নয়।

বেসিনের কলে মুখ—হাত ধুয়ে বসন্ত বলল, ‘এবার তাহলে আসি?’

‘এসো।’

বসন্ত দরজার দিকে যেতেই আরতি বলল, ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ? শোবার ঘরে এসো।’

থমকে দাঁড়াল বসন্ত। ওর মুখটা লাল হয়ে উঠল। বলল, ‘তার মানে?’

‘তার মানে অন্য কিছু নয়। আমাদের এই বন্ধুত্বের একটা স্থায়ী সম্পর্ক আজ রাতেই হয়ে যাক, এটাই আমি চাই।’ বলেই ওর হাত ধরে কাছে টেনে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল ওকে। বলল, ‘আমি চাই আজকের এই রাত আমাদের মধুরাত হোক।’ তারপর বলল, ‘তবে তুমি বড় রহস্যময়। আমার জীবনে তুমি এমন এক পুরুষ যে কিনা সক্রিয় হতে জানে না। তোমাকে আমি এত সুযোগ দিলাম তাতেও তুমি সেভাবে এগিয়ে এলে না। আপনি থেকে তুমিতে নামার পর আমাকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমুও খেলে না তুমি?’

বসন্ত আর থাকতে পারল না, আরতিকে সেও এবার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘দেরি করছ কেন, শোবার ঘরে যাবে না?’

আরতি বলল, ‘যাব বৈকি। সেজন্যই তো কখন থেকে বাসর সাজিয়ে বসে আছি।’

সারারাত মনোহর পরিশ্রমের পর শ্রান্ত ক্লান্ত দুজনে যখন শয্যা ত্যাগ করল তখন সুখের সাগরে ভেসে ওরা যেন দিশাহারা হয়ে গেছে।

আরতি বসন্তর বুকে মাথা রেখে বলল, ‘তুমি যে এত সুখ দিতে পারো তা আমি কল্পনাও করিনি। আমার প্রৌঢ় স্বামী কোনও কাজেরই নয়। মাসের মধ্যে কুড়িদিন তো বাইরেই থাকে। শুধু টাকার লোভে ওঁকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। দুর্গাপুরের বেনাচিতির মেয়ে আমি। মামার বাড়িতে মানুষ। মা—বাবা কেউ নেই। মামিই এই সম্বন্ধটা করেছিলেন। সে যাক, তোমাকে যখন পেয়েছি তখন আমার সব আক্ষেপ দূর হয়ে গেছে। তবে একটা কথা, শুধু আজকের রাত নয়। রোজ রাতেই আমি তোমাকে এই বিছানায় পেতে চাই। শুধু যেদিন অসুবিধা হবে সেদিন আমি তোমাকে ফোনেই জানিয়ে দেব।’

এরপর ঘরের বাইরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল দুজনে। কফি পর্বও শেষ হল। বিদায়বেলায় একটা উষ্ণ চুম্বন দিয়ে আরতি বলল, ‘যা বললাম মনে থাকে যেন, সন্ধের পর আবার আসবে কিন্তু।’

বসন্ত বিদায় নিয়ে দোকানে না গিয়ে বাড়ির দিকেই চলল। ঘরে এসে প্রথমেই পোশাক পরিবর্তন করে দেহটা এলিয়ে দিল শয্যায়। তারপর বেশ কিছুটা সময় গতরাতের স্মৃতিমন্থন করে নিজেই একটু চা করে খেল। এরপর বন্ধুকে ফোনে বার্তা দিয়ে ঝাঁপ তুলল দোকানের।

পাশের দোকানের ক্যাবা বলল, ‘কাল তোর কী হয়েছিল বসন? দোকান বন্ধ রেখেছিলি কেন?’

‘দূরে একটা ওয়ারিং—এর ব্যাপার ছিল। আজও একটু পরেই দোকান বন্ধ করব।’

‘কাজ শেষ হয়নি?’

‘না তা নয়, একটা স্কুটার কিনব ভাবছি।’

ক্যাবা বলল, ‘এটা তো একটা মস্ত সুখবর। ভালোই হবে। এখনকার দিনে স্কুটার না হলে চলে?’

এরপর দোকানে বসে টুকটাক কেনাবেচা করতে করতেই বিশ্বনাথ নামে ওর এক বন্ধু এল। সে—ই সঙ্গে করে নিয়ে গেল ওকে স্কুটার চেনাতে। একটা স্কুটার তো পছন্দ করাই ছিল। বিশ্বনাথ ওকে আরও দু—একটা দোকান ঘুরিয়ে অবশেষে অন্য এক দোকান থেকে দারুণ সুন্দর একটা স্কুটার কিনল। দাম পড়ল পঁয়ষট্টি হাজার। সেই স্কুটার নিয়ে পাড়ার কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন বেলা প্রায় বারোটা।

যাই হোক, স্টোভে একটু ভাত—ডাল ও ডিমের ওমলেট বানিয়ে চট করে স্নানাহার সেরে নিল। এরপর বিশ্রাম। তারপর দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই সন্ধ্যার প্রতীক্ষা। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হলেই প্রেম—ভালোবাসার তুফান দরিয়ায় ডুবে যাওয়া। কী আনন্দ!

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হল।

বসন্ত ধীর পায়ে সবার অগোচরে মঙ্গলদীপে এসে ডোরবেলে হাত দিল।

ভেতর থেকে আরতির কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কে?’

বসন্ত আস্তে করে বলল, ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’ আরতি হেসে দরজা খুলে বলল, ‘এসো।’ বসন্ত ভেতরে ঢুকে আরতি কিছু বলার আগে নিজেই গিয়ে আরামকেদারায় দেহটা এলিয়ে দিল।

আরতি বলল, ‘মনে হচ্ছে খুব ক্লান্ত।’

‘মোটেই না। তবে তোমার দেওয়া উপহার ঘরে এনেছি আজ।’

‘তার মানে স্কুটার কিনেছ। এখানে নিয়ে আসোনি তো?’

‘তাই কখনও আনি? আমি এমনভাবে গা ঢাকা দিয়ে আসি যে কেউ টেরই পায় না।’

‘এমনই হওয়া উচিত। তবে বেশিদিন এভাবে আসতে হবে না। আমি একটা মতলব করেছি।’

‘কীরকম?’

‘আগে কফি খাও তারপরে বলছি। আমার পরিকল্পনাটা যদি সাকসেসফুল হয় তাহলে কিন্তু হাতের মুঠোয় পৃথিবী।’

‘বলো কী!’

আরতি এবার গেল কফি আনতে। আগে থেকেই সব রেডি ছিল। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দুটো করে গরম শিঙাড়া ও দু’কাপ কফি নিয়ে টি—টেবিলে রেখে বলল, ‘এবার আমি যা বলব তা মন দিয়ে শুনবে।’

শিঙাড়ায় কামড় দিয়ে কফির স্বাদ নিয়ে আরতি বলল, ‘আমি ঠিক করেছি তোমাকেই বিয়ে করব আমি। তুমি হবে আমার আইনসম্মত বৈধ স্বামী।’

‘সে কী! মিশ্রজি তোমার বৈধ স্বামী নন?’

‘হ্যাঁ। আমাদের বিয়ে তো রেজিস্ট্রি করেই হয়েছে।’

‘তার মানে তুমি ডিভোর্স নেবে?’

‘মোটেই না। তাহলে তো পরিকল্পনাটাই ভেস্তে যাবে। উনি একশো কোটি টাকার মালিক, ভারতের বিভিন্ন স্টেটে আমাদের একটা করে ফ্ল্যাট আছে। গোয়ায় অঞ্জুনা বীচের কাছে মনোরম পরিবেশে নিজেদের একটা বাড়িও আছে। সেখানে আমি তোমাকে নিয়ে সুখের স্বর্গ রচনা করব। সারা ভারতের প্রতিটি ব্যাংকের লকারে আছে আমাদের কোটি কোটি টাকার সোনা। এসবই আমার হাতের মুঠোয় পাওয়া চাই। তবে সেটা সম্ভব আফটার হিজ ডেথ।’

বসন্ত বলল, ‘সে তো অনেক দূরের কথা। সে দিন যে কবে আসবে তা কে জানে?’

‘সেই দিনটিকে কৌশলে ডাকিয়ে আনতে হবে।’

‘কীভাবে?’

‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় জানো তো? প্রি—প্ল্যানড মার্ডার করতে হবে লোকটাকে।’

শিউরে উঠল বসন্ত। বলল, ‘খবরদার এইরকম কোনও পরিকল্পনা কোরো না। একূল—ওকূল দু—কূলই যাবে তাহলে।’

‘হিসেব করে অঙ্ক কষলে অঙ্কে ভুল হয় না। যা করতে হবে তা কিন্তু চতুরতার সঙ্গে।’

‘এ হয় না। এইরকম জঘন্য কাজ কখনোই করা উচিত নয়। এ অমানবিক।’

‘তাই নাকি? তুমি যে সেই লোকটারই বিবাহিতা স্ত্রীকে রোজ রাতে তিনবার— চারবার করে লুটছ এটা বুঝি মানবিক? চোরের মতো পরস্ত্রীর দেহ ভোগ করার সময় নিজের মনুষ্যত্বটা লকারে চাবি দিয়ে আসো নাকি? ওই সব সেন্টিমেন্ট মনের মধ্যে পুষে রেখো না। আমি যেমনটি যা বলব তেমনটি তাই করবে। এখন এসো একটু ফুর্তি করে নেওয়া যাক। এই মধুরাতে কিছুক্ষণের জন্য অন্তত দুটি দেহ এক করে সুখের সাগরে ভেসে যাই এসো।’

আরতির সঙ্গে বেডরুমে এল বসন্ত। আরতি এখন মূর্তিমান রতি। আর এই চরম মুহূর্তে ও সেই মদন।

একটু বিশ্রাম নেওয়ার পর আরতি বলল, ‘এবার তাহলে কাজের কথাটা হয়ে যাক। তোমাকে কী করতে হবে তা মন দিয়ে শোনো।’

বসন্ত মৃদু হেসে আরতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনও উত্তর দিল না।

আরতি বলল, ‘তোমাকে যে স্কুটারটা আমি কিনে দিয়েছি সেটাকেই এবার কাজে লাগাতে হবে।’

‘কীভাবে কী কাজে লাগাব বলো?’

‘আর মাত্র পাঁচদিন। এই পাঁচরাত্রি তুমি আমার দেহের অধিকার পাবে। ইচ্ছেমতো। তারপরে আর নয়। কেননা আমার উনি এসে পড়বেন। তখন পথেঘাটে তোমার চোখে চোখ পড়লে আমি তোমাকে চিনবও না। কথাবার্তা যা হবে তা গোপনে ফোনের মাধ্যমে। সন্ধের পর আমরা দুজনে এদিকে—সেদিকে প্রায় বেড়াতে যাই। সেই তোমার সুযোগ। আমার পরিকল্পনা মতো তুমি বেপরোয়া স্কুটার চালিয়ে ভয়ানক একটা কাণ্ড ঘটাবে। তারপর উধাও হয়ে যাবে চোখের পলকে। আরেকটা কথা, হেলমেট কিনেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওটা পরে থাকবে, যাতে হঠাৎ করে দেখে ফেললেও কেউ যেন চিনতে না পারে। এই কাজটুকু করতে হবে খুবই সতর্কতার সঙ্গে। তবে এ ব্যাপারে আমি তোমাকে পুরোপুরি হেল্প করব। কেউ টেরও পাবে না দুর্ঘটনা কীভাবে হল। তারপরই আমাদের হাতের মুঠোয় স্বর্গ। গোয়ার সাম্রাজ্যে তুমিই হবে সম্রাট। আমি সম্রাজ্ঞী। কী মজা না? তোমার এই ছোট্ট ঘর পড়ে থাকবে। স্কুটার কাউকে দান করে দেবে। আমাদের ছেলেমেয়ে হবে। এখন তো আমি নিয়মিত পিল খাই। কাজেই সে সম্ভাবনা নেই। যাক, এসব পরের কথা। এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য তৈরি থেকো।’

বসন্তকে তখন যেন নেশায় পেয়েছে। বলল, ‘আমাদের জীবনের ধারাটাই তখন অন্যরকম হয়ে যাবে, কী বলো?’

‘ঠিক তাই। রতি আর মদন হয়ে জগতের যত সুখ ও অমৃত আমরা নিংড়ে নিয়ে উপভোগ করব।’

এরপর অনেক রাত পর্যন্ত খুনের পরিকল্পনা ও নানারকম চক্রান্ত করতে লাগল দুজনে।

একসময় আরতি বলল, ‘আর কেন, এবার ডিনারের পর্বটা মিটিয়ে নেওয়া যাক। আজ অবশ্য আমি নিজে কিছু করিনি। মোহন পুরিওয়ালার দোকান থেকে রাধাবল্লভি আর ওদিকের রেস্টোর‌্যান্ট থেকে মাটন চাপ নিয়ে এসেছি। আমাদের কাজের দিদিকে দিয়ে সকালের দিকে রাবড়িও আনিয়ে রেখেছি অনেকটা। এই খেয়ে আবার নতুন উদ্যমে লেগে পড়া যাক। কী বলো?’

রাত দশটা নাগাদ ওরা ডিনারের পাট চুকিয়ে দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে বেডরুমের দরজা বন্ধ করল। তারপর সারারাত ধরে…

এইভাবে অতিবাহিত হল পাঁচ—পাঁচটি রাত। আরতির কথামতো ছ’দিনের দিন থেকে মঙ্গলদীপের রাস্তা ভুলেই গেল বসন্ত। সন্ধে হলেই আনচান করতে লাগল ওর মন—প্রাণ। রক্ত—মাংসের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো হয়ে উঠল ও।

দেখতে দেখতে দশ—দশটি দিন কীভাবে যেন কেটে গেল। এগারো দিনের দিন ভরদুপুরে ফোন এল আরতির, ‘কেমন আছো ডার্লিং? এই ক’দিন উপবাসী থেকে খুবই কষ্টে আছি। আশা করি তুমিও ছটফট করছ আমার জন্য। আর চিন্তা নেই, আমাদের কষ্টের দিন শেষ। আজ সন্ধ্যায় আমরা নির্জন ফোরশোর রোড ধরে গঙ্গার ঘাটে বসে সময় কাটাব। আজকেই প্ল্যানমতো কাজটা সেরে ফেলতে হবে। অ্যাক্সিডেন্ট করেই বাড়ি ফিরে আসবে। কোথাও যাবে না কিন্তু। ডেডবডি রাস্তাতেই পড়ে থাকবে। আর সারারাত ধরে আমরা দুজনে মিলনের আনন্দ উপভোগ করব।’

আবেগে উত্তেজনায় অধীর হয়ে বসন্ত বলল, ‘এ নিয়ে তুমি একটুও চিন্তা কোরো না রতি। তোমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছু করতে পারি। তোমরা বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে আমাকে একটা মিসড কল দিও। তাতেই বুঝে নেব।’

এরপর সারাটা দিন যে কীভাবে কাটাল বসন্তর তা একমাত্র সে—ই জানে।

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই মোবাইলে সংকেত পেল। ফোরশোর রোডের মুখে এসে একটা চায়ের দোকানে চা খাবার সময় দূর থেকে দেখতে পেল আরতি ও মিশ্রজিকে। ওরা একটা রিকশায় আসছিল।

আরতি আড়চোখে বসন্তকে দেখেই রিকশা থেকে নামল মিশ্রজিকে নিয়ে। বসন্ত তখন অন্ধকারের আড়ালে। ওরা দুজনে সেই দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে ভাড়া মিটিয়ে বিদায় দিল রিকশাকে।

বসন্ত বেশ কিছুটা দূরে থেকে নজর রাখতে লাগল ওদের দিকে।

প্রায় মিনিট দশেক পরে চা—পর্ব শেষ করে ফোরশোর রোড পার হয়ে ওরা দুজনে যখন একটু ছাড়াছাড়ি হয়ে আধো অন্ধকারে গঙ্গার দিকে এগোতে লাগল তখনই বেপরোয়াভাবে স্কুটার নিয়ে পিছন দিক থেকে মিশ্রজির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল বসন্ত। সেই ধাক্কার বেগ সামলাতে না পেরে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লেন মিশ্রজি।

আহত মিশ্রজির ওপর তীব্র গতিতে স্কুটার নিয়ে চড়াও হল বসন্ত। বেশ কয়েকবার তাঁর শরীরের ওপর দিয়ে স্কুটারের চাকা চলে যাওয়ার পর মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে উল্কাবেগে উধাও হয়ে গেল বসন্ত। আরতি কাছে গিয়ে দেখল মিশ্রজির দেহটা একবার একটু কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল। এরপর অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে সে নিজেও উধাও হয়ে গেল চোখের পলকে। রাত দশটা নাগাদ ফোন এল, ‘হ্যালো ডার্লিং, আর যে থাকতে পারছি না। কখন আসবে?’

বসন্ত বলল, ‘ওদিককার খবর কী?’

‘একদম শেষ। ডেডবডি পড়ে আছে অন্ধকারে একটা ড্রেনের ধারে।’

‘ওম শান্তি। একটু ধৈর্য ধরো, আমি এখনই যাচ্ছি তোমার কাছে। আজই হবে আমাদের সত্যিকারের মধুযামিনী।’

বসন্ত আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে মঙ্গলদীপে এল। ওকে জড়িয়ে ধরে সে কী আদর আরতির। একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘খুবই টেনশনের মধ্যে ছিলাম। তাই বিশেষ কিছুর ব্যবস্থা করিনি। দুজনের জন্য দু’প্যাকেট বিরিয়ানি এনেছি। আজকের মতো এই খেয়েই শুয়ে পড়া যাক। কাল খুব ভোরেই বিদায় নিও এখান থেকে।’

বসন্ত বলল, ‘সে তো নিতেই হবে। ডেডবডি পুলিশের চোখে পড়লেই হইচই শুরু হবে সকাল থেকে।’

আহার পর্ব শেষ করে আরতি বলল, ‘এসো, এবার সারারাত মিলনের আনন্দ ভোগ করি দুজনে।’

বসন্ত বলল, ‘হ্যাঁ। আমিও আর থাকতে পারছি না। ক’দিন ধরেই ছটফট করছিলাম। আজ চুটিয়ে উপভোগ করব।’

আরতি বলল, ‘তোমার মোবাইলে সুইচ অফ করা আছে?’

‘আছে। কেন বলো তো?’

‘ওটা আমার কাছে দিয়ে রাখো।’

‘হঠাৎ?’

‘ইউ আর এ ফুল। এত বড় একটা হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ কোন সূত্র ধরে কীভাবে এগোবে তা কি টের পাব আমরা? তোমার আমার দুজনের মোবাইলই অকেজো করে দেব।’

বসন্ত বলল, ‘ঠিক বলেছ তো ডার্লিং। ভেঙে গুঁড়িয়ে দাও এ দুটিকে। পরে বরং নতুন কিনে নেব।’

বসন্ত মোবাইলটা দিলে আরতি সেটা নিয়ে একদম নীচে নেমে গেল। এই ফ্ল্যাটে কোনও কেয়ারটেকার নেই। তাই গেট খোলা থাকে সব সময়ের জন্য। ও সেটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে বাগানের এক জায়গায় মাটি চাপা দিয়ে এল। নিজেরটারও ওই একই অবস্থা করল সে।

এরপর আবার ফ্ল্যাটে এসে শুরু হল সেই আদিম খেলা।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ক্লান্ত আরতি যখন ঘরের মেঝেয় ছেড়ে রাখা শাড়িটা কোমরে জড়িয়ে নিচ্ছে বসন্ত তখন আবার ওর হাত ধরে টানল। বলল, ‘এখনই কী? সবে তো রাত বারোটা। আর একবার হয়ে যাক।’

আরতি তখন এক ঝটকায় বসন্তকে ফেলে দিয়ে বলল, ‘তোমার খেলা শেষ হয়ে গেছে বসন্তকুমার মহাশয়। তুমি আমার খেলার পুতুল। খেলা শেষ, তুমিও শেষ।’

হতচকিত বসন্ত বলল, ‘এসব তুমি কী বলছ রতি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘পারবেও না। আর একটা কথা, রতি বলে তুমি আমায় কখনও ডাকবে না। যদিও ডাকবার অবকাশও পাবে না আর। তুমি আমার স্বামীর হত্যাকারী। ভয় দেখিয়ে তুমি আমাকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছ। এখন তুমি জেলের ঘানি টানবে। আর আমি এই বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়ে গোয়ায় গিয়ে ফুর্তি করব। আমার প্রেমিক অঞ্জন রায় পানাজির একটা হোটেলে আমার জন্য দিন গুনছে।’

বসন্তের মুখ মড়ার মুখের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আরতি!’

আরতি ফোঁস করে উঠল, ‘চেঁচিয়ে নিজের বিপদ ডেকে এনো না। এই মঙ্গলদীপের বাসিন্দারা অনেকেই কিন্তু এখনও ঘুমোয়নি। আমার ঘরে ঢুকে আমায় ধর্ষণ করেছ এটা জানতে পারলে প্রাণসংশয় হবে তোমার। তাই বলি তুমি চুপ করে বসো। আমার কাজ আমাকে করতে দাও।’ বলেই ঘরের বাইরে গিয়ে দরজায় শিকলটা তুলে দিল। তারপর শাড়িটা কোনওরকমে শ্রীঅঙ্গে জড়িয়ে মঙ্গলদীপের বাইরে আসতেই দেখল ওদের এলাকার রিকশাওয়ালা গোপাল রিকশা নিয়ে ঘরে ফিরছে।

এত রাতে এমন বিশ্রস্ত বেশবাসে আরতিকে দেখে গোপাল বলল, ‘ম্যাডাম কী হয়েছে আপনার?’

আরতি বলল, ‘যা হয়েছে তা তোমাকে বলবার নয় ভাই। তুমি এখনই আমাকে নতুন পাড়ার থানায় নিয়ে চলো।’

থানা এখান থেকে বেশি দূরে নয়, থানায় পৌঁছেই ইনসপেক্টর অশোক রায়ের কাছে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল আরতি।

এত রাতে আরতির এই অবস্থা দেখে চমকে উঠলেন অশোক রায়। শায়া—ব্লাউজহীন সোনার অঙ্গে কোনওরকমে লজ্জা নিবারণের জন্য শাড়িটা যেভাবে জড়ানো তাতে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ধর্ষণ করেছে কেউ।

পুলিশের জিজ্ঞাসার উত্তরে আরতি বলল, ‘আমার স্বামী জয়প্রকাশ মিশ্র পেশায় ব্যবসায়ী। আমরা বেশ কিছুদিন হল মঙ্গলদীপের দোতলায় ওনারশিপ ফ্ল্যাটে আছি। আমার হাজব্যান্ড ব্যবসার প্রয়োজনে প্রায়ই বাইরে চলে যান। সেই সময় এক সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাটের আলো নিভে গেলে এলাকার বসন্ত ইলেকট্রনিক্সে যাই। ওই দোকানের মালিক বসন্তকুমার এসে কানেকশন ঠিক করে দেয়। আমি ওকে ওর চাহিদা মতো টাকাও দিই। ইয়ং ছেলে। ডাকলেই পাব, তাই চা—কফির ব্যবস্থা করি। এরপর থেকেই ছেলেটি আমাকে নানাভাবে বিরক্ত করে। মাঝে মাঝে টাকাও চায়। আমি ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওকে এড়িয়ে যেতে থাকি। পারে আর একবার সিলিং ফ্যানটা খারাপ হলে বাধ্য হয়ে ওকেই ডাকি। সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সে রাতে আমাকে ভয় দেখিয়ে পরপর চারবার ধর্ষণ করে। যাবার সময় বলে যায় একথা কোনওরকম ফাঁস হলে অ্যাসিড দিয়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে ও। সেই ভয়ে আমি তটস্থ হয়ে থাকি। এরপর আমার স্বামীর বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে আরও কয়েকবার ধর্ষণ করে আমাকে। তারই মধ্যে আমার ঘরের আলমারি থেকে সত্তর হাজার টাকা খোয়া যায়। এই টাকাটা একজনকে দেবার জন্য রাখা ছিল।

‘আমার বাড়িতে যে কাজের দিদি এসে দুপুরের দিকে কাজ করে সে খুব গরিব। কিন্তু ভালোমানুষ। এ কাজ সে কখনোই করবে না। তাই বসন্তকেই আমি সন্দেহ করলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম টাকাটা খোয়া যাবার পরই ও একটা দামি স্কুটার কিনেছে। এরপর আমার হাজব্যান্ড ভাইজাগ থেকে ফিরে এলেন। আজ সন্ধ্যায় আমরা দুজনে গঙ্গার ধারে হাওয়া খাবার জন্য যাই। ফোরশোর রোডের কাছে একটা দোকানে চা খাবার সময় হঠাৎই আমার নজর পড়ে বসন্ত বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের ফলো করছে। ওকে দেখামাত্রই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে আমার। কেননা আমি মাঝেমধ্যেই ফ্ল্যাটে চাবি দিতে ভুলে যাই। তাই আমার স্বামীকে সে কথা জানিয়ে দ্রুত একটা রিকশা নিয়ে ফ্ল্যাটে চলে আসি। ভাগ্যে এলাম। দেখলাম সত্যি সত্যিই চাবি দিতে ভুলে গেছি। এরপর যখন যাব কি যাব না ভাবছি তখন দরজায় টক টক শব্দ। ভাবলাম আমার উনিই ফিরে এসেছেন বুঝি। কিন্তু ভুল ভাঙল দরজা খুলতেই। দেখলাম মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে বসন্তই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। ও গায়ের জোরে আমাকে ভেতরে ঢুকিয়ে বলল, ‘আমার পাওনা নিতে এসেছি। ক’দিন তোমার কত্তা থাকায় সুযোগ পাইনি। আজ কিন্তু ছাড়ছি না। আজ সারারাত তোমাকে আমার চাই।’ আমি বারবার বললাম, ‘আমার উনি এখনই ফিরে আসবেন।’ ও আমার কোনও কথা শুনল না। বাধা মানল না। ওর শক্তির কাছে আমি হার মানলাম। স্বামীর জন্য আমার উৎকণ্ঠা দেখে ও বলল, ‘এখন থেকে তুমি আমার রোজের শিকার। তোমার স্বামী তোমার কাছে আর কোনওদিনই ফিরে আসবেন না। আমার স্কুটারের ধাক্কায় তাঁকে আমি বরাবরের জন্য শেষ করে দিয়েছি। এবার তোমার পালা। আমাকে বাধা দিলে এই সুন্দর মুখখানা আমি এমনভাবে অ্যাসিড দিয়ে ঝলসে দেব যে কেউ আর ফিরে তাকাবে না তোমার দিকে।’

এই পর্যন্ত বলে একটু হাঁফ ছেড়ে আরতি বলল, ‘আমি বাথরুম যাবার নাম করে বহু কষ্টে ওর কবল মুক্ত হয়ে ঘরের দরজায় শিকল দিয়ে এখানে এসেছি।’

ইনসপেক্টর বললেন, ‘ফ্ল্যাটের অন্য বাসিন্দারা কেউ জানে?’

‘না, আমি কাউকে কিছু না জানিয়েই থানায় এসেছি। কেননা এই ফ্ল্যাটের সবার ঘরেই কাজের সুবাদে ওর যাতায়াত আছে। ব্যাপারটা জানাজানি হলে তাদেরই কেউ হয়তো ওকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেবে।’

আর কোনও কথা নয়। আরতির বয়ানকে বিশ্বাস করে পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল মঙ্গলদীপে। ওই গাড়িতে আরতিও এল।

পুলিশের পদার্পণে ফ্ল্যাটের অনেক বাসিন্দাই এসে জড়ো হল তখন। ইনসপেক্টর অশোক রায় দরজা খুলেই দেখতে পেলেন বসন্তকে। সে তখন লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকেছে। তারপর ওই অবস্থাতেই বলল, ‘স্যার, এই মহিলা আমাকে ফাঁসিয়েছে।’

ইনসপেক্টর অশোক রায় বললেন, ‘উনি কী করেছেন সেটা আমাদের জানার দরকার নেই। এখন এই গভীর রাতে এই ঘরের ভেতর আপনি কীভাবে এলেন? ইনি আপনার বিরুদ্ধে খুন এবং ধর্ষণের অভিযোগ করেছেন। এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?’

বসন্ত অতিকষ্টে বলল, ‘আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি। তবে এ ব্যাপারে আমারও কিছু বলার আছে।’

‘সেটা এখানে নয়, থানায় গিয়েই শুনব।’ বলে আরতিকে বললেন, ‘আপনি ঘরে গিয়ে আপনার পোশাক ঠিক করে নিন। আমরা এই ক্রিমিন্যালটাকে নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের দিকেই যাচ্ছি।’

পুলিশ বিদায় নিলে আরতি ঘরের দরজা বন্ধ করে শাড়িটা গুছিয়ে পরে নিল। আগাগোড়া ওর প্ল্যানটা যে এমন চমৎকারভাবে সাকসেসফুল হবে তা ও ভাবতেও পারেনি।

এদিনের এই ঘটনার কথা ছড়িয়ে পড়তে সবাই খুব বিস্ময় প্রকাশ করল। বসন্তর মতো ভালো একটা ছেলে যে এ কাজ করতে পারে তা ধারণারও অতীত ছিল সকলের কাছে। যে বোনের বিয়ে দিতে বহু অর্থ ব্যয় করেছিল বসন্ত, সেই বোনও দাদার এই কুকীর্তির কথা শুনে গলায় দড়ি দিল।

এই জঘন্য হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের অভিযোগের জন্য বসন্তর ফাঁসির আদেশ হল আদালতের রায়ে। তবে মূল চক্রী আরতিও কিন্তু পার পেল না। পুলিশের জেরার মুখে সদুত্তর দিতে না পেরে জালে জড়িয়ে পড়ল সেও। বিচারক তাকেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিলেন।

এদিকে জেলের অন্ধকার কক্ষে বসে মৃত্যুর প্রহর গুনতে গুনতে কেমন যেন হয়ে গেল বসন্ত। সুন্দরী পরস্ত্রীর দেহভোগের লালসায় নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল সে। এখন বুঝল অমৃতেও গরল ছিল। যদিও ওকে প্ররোচিত করেছিল আরতিই। নাহলে সে কখনওই এমন দুঃসাহসিক কাজ করত না। ধর্ষণের জন্য আহ্বান তো আরতিই করেছিল তাকে। তবে কিনা ওর কথায় খুনের ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হয়নি একেবারেই।

এখন বসন্ত মনে মনে ভাবে একবার যদি সে মুক্তি পেত তাহলে আরতির মতো মেয়েদের এমন শিক্ষা দিত যা কিনা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত। কিন্তু ফাঁসির আসামীকে মুক্তি দেবে কে?

এই জেলেই একজন জেলরক্ষীর সুনজরে ছিল সে। তাকেই একদিন কাছে ডেকে ওর জীবনের সুখ—দুঃখের সব কথাই বলল। তারপর একটু চুপ করে সে কী যেন ভেবে আবার বলল, ‘আর কিছুদিন বাদেই তো আমার ফাঁসি হবে। তবে একটা ব্যাপারে খুবই অনুশোচনা হচ্ছে আমার।’

জেলরক্ষীর বয়স চল্লিশোর্ধ্ব। জোয়ান লোক। বলল, ‘কীসের অনুশোচনা?’

বসন্ত বলল, ‘আমি তো সব কথাই বলেছি তোমাকে। ওই সত্তর হাজার টাকা আরতিই দিয়েছিল। ওর ওই টাকাতেই আমি গাড়ি কিনেছি। আর সেই গাড়িতেই ধাক্কা দিয়ে হত্যা করেছি জয়প্রকাশজিকে। কিন্তু যে কথা কাউকে বলিনি সে কথাই বলছি তোমাকে। কথায় বলে লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। একথাটা যে কতদূর সত্য তা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। আমার মৃত্যুদণ্ড হলেও আরতিও এখন জেলের ঘানি টানছে এটাই আমার মৃত্যুর আগে একমাত্র সান্ত্বনা। যাক, যে কথা বলছিলাম। ওই দিন সত্তর হাজার টাকা পাওয়ার পরে লোভ আমার অনেক বেড়ে যায়। ওই ফ্ল্যাটটা ছিল মিশ্রজির কালো টাকার স্টোর রুম। আমি সময় পেলেই আরতির অজান্তে গোপনে ওই সব টাকার দু—একটা করে বান্ডিল সরিয়ে ফেলতাম। আরতিকে আমি অবিশ্বাস করতাম না। তবু ভাবতাম যদি কখনও ওই বিশাল সম্পত্তির অধিকারী আমরা না হতে পারি তখন ওটা আমার কাজে লাগবে। আরতি যদি সত্যিই আমাকে বিয়ে করে গোয়ায় নিয়ে যায় তখন এসব আমি আমার বোনকেই উপহার দেব। এখন আমার সেই বোনও তো নেই। আমারই কারণে আত্মঘাতী হয়েছে সে।’

রক্ষী বলল, ‘টাকার পরিমাণ কত?’

‘তা প্রায় আড়াই কোটির মতো। এ ছাড়া টুকরো সোনা, সোনার বিস্কুট, আরতির লক্ষাধিক টাকার গয়না, সবই আমি একটু একটু করে সরিয়েছি। তারও পরিমাণ কম নয়। সে সব আমি বাড়িতে রাখিনি। কেননা যদি কখনও ধরা পড়ি তখন বিপদে পড়ব। তাই আমার বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে ঘোষাল বাগানে একটা বহুদিনের পুরোনো বিগ্রহহীন ভাঙা মন্দিরের পিছনে কায়দা করে পুঁতে রেখেছি সব। সেই জন্যই আমার অনুশোচনা। এত কিছু কুকর্ম করে আমার লাভ কী হল বলো তো? সবই তো গেল, এখন ওই জায়গা আমি চিনিয়ে না দিলে কেউ তার হদিসও পাবে না। সব—সব গেল আমার।’

বসন্তর কথা শুনে চোখ কপালে উঠে গেল রক্ষীর। বলল, ‘এ তুমি কী বলছ ভাই? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। যদি তুমি ওই টাকা ও সোনার সন্ধান আমাকে দাও তাহলে আমি রাজা হয়ে যাব। আমি সমস্তিপুরের লোক। বউ—বাচ্চা নিয়ে টালি নালার কাছে একটা বস্তিতে থাকি। তোমার ওই বিপুল সম্পদ আমি হাতে পেলে জীবনের মোড় ঘুরে যাবে আমার। আমি তোমাকে গোপনে আজই রাতের অন্ধকারে এখান থেকে বার করে নিয়ে যাব।’

বসন্ত শিউরে উঠে বলল, ‘সর্বনাশ! তোমার তো চাকরি চলে যাবে তাহলে?’

‘বয়েই গেল। ওই সম্পদ হাতে পেলে এই চাকরি তো আমি এমনিই করব না। ওর অর্ধেক পেলেও বর্তে যাব আমি।’

বসন্ত বলল, ‘যদি তুমি সত্যিই জেল থেকে বার করতে পারো আমাকে তাহলে ওর সবটাই তুমি নেবে। কেননা ওই টাকায় আমার আর কী হবে? জেল পলাতক আসামী আমি। যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারি। তবে একটা অনুরোধ, আমি তো কপর্দকশূন্য। দু’এক হাজার টাকা তুমি আমাকে দিও। ওই টাকা নিয়ে আমি হিমালয়ে চলে যাব। সেখানে বনে—জঙ্গলে ঘুরে সাধু—সন্ন্যাসীদের দলে ভিড়ে কাটিয়ে দেব বাকি জীবনটা। প্রতিটি মানুষের জীবনে মৃত্যু অবধারিত, তবে এই বয়সে মরতে আমার একদম ইচ্ছে করছে না।’

রক্ষী বলল, ‘মরতে তোমাকে হবে না। মরতে তোমাকে দেবও না আমি। যে করেই হোক আমি তোমাকে মুক্তি দেব এখান থেকে।’

বসন্ত বলল, ‘তোমার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ রইলাম।’

রক্ষী বলল, ‘রাত দশটার পরে আমি তোমার কাছে আসব। তুমি ঘুমিয়ে পোড়ো না যেন।’

বসন্ত বলল, ‘মুক্তির আনন্দে কি ঘুম আসে?’

কথা হয়েছিল সন্ধের পর। দেখতে দেখতে রাত দশটা হয়ে গেল। অল্প অল্প শীতের আমেজ ছিল। তাই একটা চাদর নিয়ে এসে রক্ষী বলল, ‘চট করে এটা গায়ে জড়িয়ে নাও। নিয়ে আমাকে ফলো করো।’

রক্ষীর নির্দেশ মতো বসন্ত তাই করল। তারপর কিছু সময়ের মধ্যেই ভয়ানক একটা ঝুঁকি নিয়ে জেলের বাইরে এল বসন্ত।

রক্ষী ওকে নিয়ে একটু অন্ধকার মতো জায়গায় গিয়ে বলল, ‘তোমার জন্য ঘর থেকে একটা পাজামা—পাঞ্জাবি এনেছি। চট করে পরে নাও এটা। আর এই নাও টাকা। এক, দুই হাজার নয়, পাঁচ হাজার টাকা এনেছি। এটা পকেটে রাখো।’

বসন্ত তাই করল।

রক্ষী বলল, ‘সে জায়গায় কি হেঁটে যাওয়া যাবে?’

‘যাবে, তবে সময় লাগবে অনেক।’

‘তাহলে একটু চলো আমার এক পরিচিতের মোটরবাইকটা নিয়ে আসি। তাতেই যাব।’

বেশ খানিকটা পথ যাবার পর বসন্ত বলল, ‘একটা শাবল আর কোদালের যে একান্ত দরকার। না হলে মাটি খুঁড়ব কী করে?’

রক্ষী বলল, ‘ঠিক কথা। এ বুদ্ধিটা তো মাথায় আসেনি। যাই হোক, সে ব্যবস্থাও হয়ে যাবে।’ কিছুক্ষণ হেঁটে আসার পর রক্ষীর পরিচিতের বাড়িতে আসতেই সে কী আপ্যায়ন ওদের! রক্ষী বলল, ‘এখন এ সবের কোনও দরকার নেই। একটা শাবল অথবা কুড়ুল আপাতত দাও। তোমার মোটরবাইকটাও কিছুক্ষণের জন্য দরকার। খুবই এমার্জেন্সি।’

সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যবস্থাও হয়ে গেল।

এরপর আর দেরি নয়। দ্রুত মোটরবাইক নিয়ে পরিত্যক্ত বাগানে ঢুকে পড়ল ওরা। গাড়িটা এক জায়গায় রেখে আধো অন্ধকারে বাগানে ঢুকে একটি ভাঙা মন্দিরের কাছে এসে বসন্ত বলল, ‘শাবলটা তুমি আমার হাতে দাও। আর বাইরের দিকে কড়া নজর রাখো যাতে কেউ হঠাৎ করে এদিকে এসে না পড়ে।’

রক্ষী বলল, ‘এত রাতে কে আসবে এখানে মরতে?’

‘এতটা নিশ্চিন্ত হয়ো না বন্ধু। বিপদ যে কখন কোন মুহূর্তে কোথা দিয়ে আসে তা কেউ বলতে পারে না।’ শাবল হাতে নিয়ে বসন্ত এক জায়গায় মাটি খুঁড়তে শুরু করেই থেমে গেল।

রক্ষী বলল, ‘কী হল! থামলে যে?’

‘মনে হচ্ছে কেউ যেন আসছে। ওই দেখো।’

রক্ষী ঘুরে তাকাতেই বসন্ত গায়ের জোরে তার মাথায় শাবলের এমন এক ঘা দিল যে আর্তনাদ করবারও সময় পেল না সে, একবার শুধু ‘ওঁক’ করে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

মৃত্যু নিশ্চিত করতে পর পর আরও কয়েক ঘা তার মাথায় দিয়ে শাবলটা একটা ঝোপের মধ্যে ফেলে দিল বসন্ত। তারপর ওই মোটরবাইকে চেপেই বেশ কিছুটা পথ এসে গঙ্গার তীরবর্তী এক জায়গায় সেটাকে ফেলে রেখে ছায়ান্ধকারে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য এরকম কৌশল নেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না ওর। মিথ্যা ও প্রতারণারই জয় হল।

একসময় গঙ্গার বাঁধানো ঘাটের কাছে একটি চালাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল বসন্ত। কতকগুলো ভ্যাগাবন্ড ক্লাসের লোক ও ভিখিরি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল একপাশে। বসন্ত ভাবল রাতটা এখানেই কাটিয়ে দেওয়া যাক। নইলে নৈশ প্রহরী পুলিশের চোখে পড়লে আবার জেল। জেলে ঢুকলেই ফাঁসি, কেননা ওর বিরুদ্ধে তো মৃত্যুদণ্ডাদেশ। অতএব বাঁচার কোনও পথই নেই। ভবঘুরেদের পাশে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎই একটা চাপা কান্নার স্বর ওর কানে এল। এত রাতে কে কাঁদে? মেয়ে গলার স্বর। ও এদিক—সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেল ঘাটের সিঁড়িতে বসে শাড়ি পরা এক যুবতি দু—হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। তাই দেখে বসন্ত ধীরে ধীরে উঠে এসে তার পাশে বসল।

যুবতি সরে গেল একটু। বসন্ত জিগ্যেস করল, ‘কে তুমি? এত রাতে একা এখানে বসে কাঁদছো কেন?’

যুবতি মুখ থেকে হাত নামিয়ে চোখের জল মুছে বসন্তর দিকে তাকাল। বলল, ‘তুমি কে?’

‘আমায় তুমি চিনবে না।’

বসন্ত দেখল যুবতি বিবাহিতা। কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ স্পষ্ট। গায়ের রং ঘন কালো। দারুণ সুন্দর মুখখানি। ঘন কেশবতী।

বসন্ত বলল, ‘আমরা কেউ কাউকেই চিনব না। তবুও জানতে চাইছি এভাবে একা একা ঘাটে বসে কাঁদছ কেন তুমি? তোমায় কি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে?’

‘না। স্বেচ্ছায় এসেছি আমি। আত্মহত্যা করব বলে।’

‘সে কী!’

‘হ্যাঁ। তবে মরতে এসেও মায়ার টানে আমি মরতে পারছি না।’

‘কীসের টান তোমার?’

‘সন্তানের। তিন বছর আগে বাড়ির অমতে একটি ছেলেকে ভালোবেসে আমি মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে পালিয়ে আসি। এদিকেই একটি বস্তিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি আমরা। আমার স্বামী একটা কারখানায় কাজ করে। আমার একটা এক বছরের ছেলেও আছে। আজ এক মাস হতে চলল আমার স্বামী এখানকার পাট চুকিয়ে এই বস্তিরই অন্য এক মেয়েকে নিয়ে উধাও হয়েছে। এখন আমি কী করি; আমার এই বিপদের কথা শুনে গতকাল আমার মা এসে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেছে। আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি যাইনি। দু—একদিন পরে যাব বলে এড়িয়ে গেছি।’

‘কেন এড়িয়ে গেলে?’

‘আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছে নেই। যাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসে ঘর ছেড়ে বস্তিতে এলাম সে আমাকে ছেড়ে চলে গেল। উপরন্তু বলে গেল এই বাচ্চাটা নাকি তার নয়। সেই দুঃখেই আমি মরতে এসেছিলাম। কিন্তু মরতে গিয়েও আমার সন্তানের কচি মুখখানি মনে পড়ে যাওয়ায় মরতে পারলাম না। এখন আমি কী করি?’

‘কী আবার করবে? তোমার মায়ের কাছেই ফিরে যাও তুমি। আবার নতুন করে জীবন শুরু করো। তোমার এমন মিষ্টি চেহারা। ঢল ঢল যৌবন। তোমার জীবনে ছেলের অভাব হবে না। আবার নতুন করে জীবন শুরু করো।’

‘তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমার কিন্তু একটা বাচ্চা আছে।’

‘তাতে কী? যার সঙ্গে ঘর বাঁধবে তাকে সে কথা আগেই জানাবে।’

‘আমার কথা বাদ দাও। এখন বলো তো তুমি কে? এত সুন্দর দেখতে তোমাকে। এই রাতে এখানে কী করছ?’

‘আমিও তোমারই মতো এক অভাগা। মালদহে গৌড় অঞ্চলের এক ব্যবসায়ীর ছেলে আমি। বিশেষ কাজে কলকাতায় এসে এক দুষ্টচক্রের হাতে পড়ে যাই। ওরা আমাকে এক জায়গায় আটকে রেখে আমার বাবার কাছে বিশ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। আমি বহু কষ্টে তাদের খপ্পর থেকে পালিয়ে এসেছি। এত রাতে কোনও ট্রেন পাব না, তাই ভিড়ে গেছি এই ভিখিরি দলের সঙ্গে। রাতটুকু এখানে কাটিয়ে কাল ভোরেই বিদায় নেব। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো, মরার চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দাও। এত রাতে এখানে না থেকে ঘরে যাও। এখানে থাকলে যদি কোনও বদ লোকের পাল্লায় পড়ো তখন কিন্তু কেঁদে কূল পাবে না। অনেকেই জীবনে কিছু না কিছু ভুল করে। তুমিও করেছ। আমিও করেছি। আবার নতুন করে জীবন শুরু করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘কী করে করব? আমার অতীত জানলে কেউ কি আমাকে নেবে? কেউ নেবে না।’

‘যদি আমি নিই? তুমি রাজি থাকলে আমিই তোমাকে বিয়ে করতে পারি?’

‘ভেবে বলছ তো? তুমি রাজি থাকলে আমার দিক থেকে কোনও আপত্তি নেই।’

যুবতি এবার ওর জীবনে নতুন করে বাঁচার আলো দেখে মুগ্ধ চোখে তাকাল বসন্তের দিকে। বলল, ‘সত্যি বলছ তুমি আমাকে নেবে?’

‘শুধু তোমাকে নয়, তোমার ছেলের দায়িত্বও নেব। এখন বলো তুমি কি রাজি?’

‘রাজি।’

‘তাহলে একটা কাজ করো, এইভাবে সারারাত গঙ্গার ধারে বসে থেকে কোনও লাভ নেই। বিশেষ করে আমি পলাতক। যদি ওই দুষ্কৃতীর দল আমার খোঁজে এদিকে এসে পড়ে তাহলে আবার আমি বিপদে পড়ে যাব। এখন অগ্রহায়ণ মাস। অল্প অল্প শীতও আছে। আজ রাতটুকু আমাকে বরং তোমার ঘরে আশ্রয় দাও। কাল সকালে আমি তোমাকে তোমার মা ও ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়েই চলে যাব। তারপর একদিন এসে আদর করে তোমাকে নিয়ে যাব আমার ঘরে। আমার ঘরণী হয়ে ঘর আলো করবে তুমি।’

‘তোমার বাবা—মা আমাকে মেনে নেবেন?’

‘নিশ্চয়ই নেবেন। কেননা ওঁরা জানবেন নিজের জীবন বিপন্ন করে তুমিই আমাকে ওই শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত করেছ।’

যুবতি সেই অন্ধকারেই বসন্তর বুকে মাথা রেখে বলল, ‘তুমি মানুষ নও দেবতা। তোমার নামটা কিন্তু জানা হয়নি এখনও।’

‘আমি বাসব।’

‘আমি বাসনা, চিরকাল দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বড় হয়েছি। এখন আমার পঁচিশ বছর বয়স। যাকে ভালোবেসে ঘর ছাড়লাম সেও আমার সঙ্গে প্রতারণা করল। আমি মরতে এসেছিলাম, এমন সময় তুমি এলে। আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখালে। এসো, আমার ঘরে এসো। রাত অনেক হয়েছে। তোমার হাত ধরেই কাল সকালে আমি আমার মা—বাবার কাছে ফিরে যাব।’ বলে বসন্তর হাত ধরে টান দিল বাসনা।

সামান্য পথ হাঁটা। তারপরেই একটা খোলার ঘরের বস্তিতে এসে হাজির হল ওরা। এত রাতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে সবাই। দু—একটা কুকুর ওদের দেখে ঘেউ ঘেউ করে আবার চুপ করে গেল। ঘরে ঢুকে দাওয়ায় এসে চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হল দুজনেই।

বাসনা বলল, ‘আজ তোমার ভালো করে খাওয়া হয়নি নিশ্চয়ই? দুপুরে অনেকটা সুজি করেছিলাম। তারই খানিকটা আছে, খাবে?’

‘তাই দাও। তারপর কাল সকালে বাইরের কোনও দোকানে বসে যা হয় কিছু খাওয়া যাবে।’

বাসনা বলল, ‘এবার তো শুতে হবে। রাত এখন প্রায় একটা কি দেড়টা। আমার একটা শাড়ি দিচ্ছি। ওটা পরে শুয়ে পড়ো।’

বসন্ত তাই করল। ওর পায়জামা—পাঞ্জাবি ছেড়ে বাসনার শাড়ি পরে শুয়ে পড়ল তক্তাপোশের বিছানায়। কোনওরকমে আজকের রাতটা কাটাতে পারলে কালই এই অঞ্চল থেকে বিদায়। বাসনাকে ওর মায়ের কাছে, ছেলের কাছে পৌঁছে দিয়ে কোথায় যাবে, কীভাবে যাবে সেই নিয়ে চিন্তাভাবনা করবে।

বসন্তর একপাশে বাসনাও শয্যা নিল। বলল, ‘আলোটা নিভিয়ে দেব কী?’

‘দিতে পারো।’

বাসনা বলল, ‘না থাক। তখন থেকে তোমার মুখটাও দেখা হয়নি ভালো করে।’ বলে ওর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল বাসনা। বলল, ‘কী সুন্দর তুমি।’

বসন্ত বলল, ‘তুমিও। কালো রূপে এত আলো এর আগে আর কারও মধ্যে দেখিনি আমি।’

‘সত্যি বলছ?’ বলে ওর বুকের ওপর মাথা রাখল।

বসন্তও তখন আবার জেগে উঠল নতুন করে।

আলো নিভিয়ে বাসনা বসন্তের পাশে শুলে দুজনেই সক্রিয় হয়ে উঠল। দুটি দেহ এক করে সারাটি রাত কাটিয়ে দিল মধুর মিলনে।

খুব ভোরে বসন্তর যখন ঘুম ভাঙল, বাসনা তখনও নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। এই সময়কালে ওর যে কী করা উচিত সেটাই সে চিন্তা করল। নিজেকে বাঁচানোর জন্য, রাতে আশ্রয়লাভের জন্য বাসনাকে ও আগাগোড়া মিথ্যে কথা বলেছে। অযথা দরদ দেখিয়ে বিশ্বাসভাজন হয়ে সারারাত ওর দেহ ভোগ করেছে। যে রমণীর ফাঁদে পড়ে আজ ওর এই অবস্থা, যার কারণে ওর আদরের বোনকেও হারিয়েছে, তার প্রতিশোধ ও কখনও নিতে না পারলেও অন্যের প্রতি প্রতারণা করে ও সেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে। সহজ সরল পন্থায় সৎ হয়ে থেকে এই তো পরিণাম। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু—দুটো খুন ইতিমধ্যে করেই ফেলেছে ও। তাই সৎ হয়ে থাকার চেষ্টা আর কখনও করবে না। হাতের কাছে মেয়েমানুষ পেলেই লুটবে। পকেটে টান পড়লে চুরি অথবা ডাকাতি করবে। প্রয়োজনে আরও খুন করবে ও। তবে বাসনাকে ওর মা—বাবার কাছে, সন্তানের কাছে পৌঁছে না দিয়ে ও পালাবে না। ওর দেহের পরতে পরতে সুখের পরশ পেলেও ওকে নিয়ে সংসার করা ওর পক্ষে অসম্ভব। কেননা এখনকার মতো ও মুক্তি পেলেও ওর জীবন এখন পদ্মপাতায় জলের মতো। পুলিশ এবং সি. আই. ডি—র জালে যে কোনও মুহূর্তে ও ধরা পড়ে যেতে পারে।

ও যখন মনে মনে এইসব চিন্তা করছে তখনই একসময় চোখ মেলল বাসনা। বলল, ‘কী গো! কখন উঠেছ? ডাকোনি কেন?’

‘অনেক রাত অবধি জেগেছিলে কাল। তাই তোমার এই ঘুমটুকু কেড়ে নিতে আমার ইচ্ছা হল না।’

বাসনা এবার উঠে বসে মেঝে থেকে শাড়িটা কুড়িয়ে জড়িয়ে নিল সারা দেহে। তারপর বলল, ‘কখন যাবে?’

‘যখন তুমি যেতে বলবে।’

‘দেরি করে লাভ কী? এখনই চলো তাহলে। ছেলেটার জন্য বড্ড মন কেমন করছে। ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্য। তুমি আসার আগে যদি জলে ঝাঁপ দিতাম তাহলে ছেলেটাও মাতৃহারা হত। আমিও তোমাকে পেতাম না।’

এরপর প্রাতঃকৃত্য সেরে একটা সুটকেসে বাসনা ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘চা করব, চা খাবে?’

বসন্ত বলল, ‘ওটা ট্রেনে বসে খেয়ে নিলেই হবে।’

অতএব বেরিয়েই পড়া গেল। ঘরের দরজায় তালা দিয়ে বাইরে আসতেই একজন মহিলা জিগ্যেস করলেন, ‘ছেলেটি কে রে বাসনা? কখন এল?’

বাসনা বলল, ‘ও আমাদের গ্রামের ছেলে মাসি। কাল অনেক রাতে এসেছে ও। আমি মায়ের কাছেই যাচ্ছি। পরে একদিন এসে মালপত্তর নিয়ে যাব।’

‘তাই যা মা। এভাবে কি একা একা থাকা যায়?’

ওরা বাইরে বেরিয়ে একটা দোকানে বসে চা আর কেক খেয়ে নিল দুজনে। তারপর ট্রেনে নয়, খানিক আসার পর মেচেদাগামী একটা বাস পেয়ে তাতেই উঠে পড়ল। দ্রুতগামী সরকারি বাস দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরিয়ে এগিয়ে চলল ঝড়ের গতিতে।

গ্রামে পৌঁছতে অনেক বেলা হয়ে গেল যদিও তবুও বাসনার বাবা—মা দারুণ খুশি হলেন মেয়েকে ফিরে পেয়ে। বসন্তর পরিচয় পেয়ে আরও আনন্দ হল পরিবারের সকলের। বাসনাও সন্তানকে বুকে জড়িয়ে কী আদরটাই না করল।

সারাটা দিন আনন্দেই কাটল। বলতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে না হলেও জামাই—আদরই পেল বসন্ত।

বিকেলের দিকে সিদ্ধান্ত নিল আর এখানে থাকা নয়। এবার ওর মুখোশ খুলতেই হবে। পালাতেই হবে এখান থেকে। আপাতত কিছু কেনাকাটার দরকার। রক্ষীর দেওয়া সেই পাঁচ হাজার টাকা এখনও আছে ওর কাছে। তা থেকেই একটা চাদর আর ঝোলাব্যাগ ও কিনে নিল। তারপর সেটা ওর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে রেখে অনেকটা সময় কাটাল বাসনার সঙ্গে। তারপর সন্ধের অন্ধকার নেমে আসতেই সবার অলক্ষে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাসনাকে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না ওর। তবুও লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু কথাতেই আছে। তার ওপর ও বুঝেই গেছে অমৃতে গরল ছিল। অমৃতে গরল আছে। তাই আর নয়।

চাদর ও ঝোলাব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে প্রথমেই ও এল মেচেদায়। সেখান থেকে খড়্গপুর। এখানে একটা হোটেলে ঢুকে পেট ভরে খেয়ে নিল। এরপর স্টেশনে এসে ভাবতে লাগল এখন ও কী করবে, কোথায় যাবে? এই বাজারে পাঁচ হাজার টাকা শেষ হতে বেশি সময় লাগবে না। তবুও কোথাও না কোথাও যেতে তো হবেই। হঠাৎই ওর কানে এল রাঁচি—হাতিয়া এক্সপ্রেস খড়্গপুরে আসছে। ও আর ক্ষণবিলম্ব না করে রাঁচির একটি টিকিট কেটে স্টেশনে অপেক্ষা করতে লাগল। একটু পরে ট্রেন এলে জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই ঢুকে ঠেলে গুঁজে বসার মতো জায়গা করে নিল একটু।

ট্রেন ছাড়লে বাসনার জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। মেয়েটা ওকে বিশ্বাস করে অকপটে ওর দেহের পূর্ণ অধিকার দিয়েছিল কাল রাতে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস এমনই যে ওর মতো সরল প্রাণের মেয়ের সঙ্গেও প্রতারণা করতে হল ওকে।

এখন ওর ভবিতব্য যে কী তা ও ভালোই বুঝতে পেরেছে। সুযোগ পেলে এমন বহু মেয়ের সঙ্গে ওকে প্রতারণা করতে হবে। কারও অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে তার ধন হরণ করতে হবে। প্রয়োজনে খুন। অতএব সাহসে বুক বেঁধে এগিয়ে যেতেই হবে ওকে। ট্রেনে সারারাত বসে কাটানোর পর মুরি আসতেই ফাঁকা হয়ে গেল ট্রেন। তখন একটা বাঙ্ক দখল করে শুয়ে পড়ল লম্বা হয়ে। শুয়ে শুয়ে কত কী—ই না চিন্তা করতে লাগল। আরতির কথাই ভাবতে লাগল বেশি করে। বেশ তো চলছিল। হঠাৎ করে অমন একটা হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েই সব কিছু কেমন যেন ওলোটপালোট হয়ে গেল। ও নিজেও বাঁচল না। ওরও জীবনটাকে শেষ করে দিয়ে গেল।

এক সময় রাঁচিতে এসে থামল ট্রেন। গাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল। ট্রেন থেকে নেমে খুব চেষ্টা করল অল্প ভাড়ার দু’একদিনের জন্য কোথাও কোনও সস্তার ঠেক পেতে। কিন্তু না। সেখানে যা হোটেল আছে তা সবই চড়া রেটের।

অতএব ঘরের আশা ছেড়ে একটা দোকানে বসল চা—বিস্কুট খেতে। একদল যাত্রী তখন রাজরপ্পায় যাচ্ছে ছিন্নমস্তার মন্দিরে পুজো দিতে। ওর মন তখনই অন্যরকম হয়ে গেল। মন্দিরের খোঁজ নিয়ে ও এসে বসল রামগড়ের বাসে।

রামগড় পৌঁছে অন্য যাত্রীদের অনুসরণ করে শেয়ারের অটোয় চলে এল এক অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে রাজরপ্পায়। এখানে গ্র্যানাইট পাথরের বুকের ওপর দিয়ে দুরন্তগতিতে বয়ে চলেছে ভেরা নদী। কিছুদূরে প্রপাতের সৃষ্টি করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দামোদরের বুকে। এখানে এসে প্রথমেই নদীর জল মাথায় নিয়ে ও মন্দির দর্শন করল। তারপর একটা গামছা কিনে ভালোভাবে স্নান করে নিল ভেরা নদীর জলে। স্নানের পর ভৈরবী প্রপাতের ধারে বসে সঙ্গমের দৃশ্য দেখল অনেকক্ষণ ধরে। এই জায়গাটার নাম ভাণ্ডারদহ।

অনেক বেলা পর্যন্ত বসে থেকে বহু যাত্রীর সমাগম দেখে একসময় একটি সস্তার হোটেলে ঢুকে নিরামিষ খানা খেয়ে নিল পেট ভরে।

সবই তো হল কিন্তু আশ্রয় নেবে কোথায়? এখানে না আছে কোনও হোটেল, না কোনও ধর্মশালা। কিছুই নেই। হতাশ চিত্তে বসন্ত নিজের খেয়ালেই ঘুরে বেড়াতে লাগল এদিক—সেদিক। ভৈরবী বা ভেরা নদী গ্র্যানাইটের স্তর ভেদ করে যেদিক থেকে বয়ে আসছে সেদিকেরই এক বনময় উচ্চস্থানে বড় একটি পাথরের ওপর বসে প্রকৃতির দৃশ্য দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে বেলা গড়িয়ে এল।

চারদিক ফাঁকাও হয়ে এল ক্রমশ। এমন সময় ও দেখল চার—পাঁচজন এ দেশীয় মহিলা মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে আরও উচ্চস্থান থেকে জঙ্গল ভেদ করে এদিকে নেমে আসছে। এদের মধ্যে দুজন কিশোরী, বাকি তিনজন অল্পবয়সি বিবাহিতা তরুণী।

বসন্তকে একাকী নির্জনে বসে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়াল ওরা। বেঁটেখাটো গোলালো চেহারার এক রমণী ওর থেকে একটু দূরে কাঠের বোঝাটা নামিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজের চোখমুখ একটু মুছে নিল। তারপর ধপ করে এক জায়গায় বসে আড়চোখে একবার তাকাল বসন্তের দিকে। বাকিরা সবাই নেমে গেলে রমণী বলল, ‘এ জি! সাম চার বাজে কা বাদ ইধার রহনা ঠিক নেহি। জলদি নীচে উতারো। নেহি তো ভল্লু—শের আ যায়েগা।’

বসন্ত বলল, ‘এদিকে বাঘ—ভালুকের উপদ্রব আছে বুঝি?’

‘হাঁ, হ্যায় তো। ইধার পুরা হি জঙ্গল।’

বসন্ত বলল, ‘আসলে আমি কখনও পাহাড় নদী ঝরনা এসব দেখিনি তো। তাই দূরের সব পাহাড়গুলোকে দেখছি। নদী দেখছি।’

‘তুম বাঙ্গালি? কাঁহাসে আয়ো?’

‘কলকাত্তা সে। সুভে রাঁচি আয়া থা। উসকে বাদ রামগড়।’

‘ব্যস। তাহলে রামগড়, নেহি তো রাঁচিতেই চলে যাও তুমি।’

বসন্ত বুঝল এরা এখানকার হলেও বাংলা জানে। বাংলা বলতেও পারে। তাই বলল, ‘কেন, এখানে কোথাও কোনও জায়গা নেই?’

‘নেহি। ইধার কোই নহি রহতা। সাম হোনেসে সব চলা যায়েগা।’

‘কেন বাঘের ভয়ে?’

‘শুধু বাঘ নয় অনেকরকম জানোয়ার আছে এখানে।’

‘আমি যদি মন্দিরে থাকি?’

‘ও ভি নেহি হো সকতা, মন্দিরের পূজারীজিরাও আরতির পর সবাই চলে যান।’

‘কোথায় যান?’

এখান থেকে কিছুদূরে একটা পাহাড়ি গাঁও আছে সেখানে।’

‘তুমি কোথায় যাবে?’

‘আমিও সেখানেই যাব।’

বসন্ত হতাশামিশ্রিত গলায় বলল, ‘আমাকে তুমি নিয়ে যাবে তোমাদের গ্রামে? একটা রাত অন্তত থাকতে দেবে?’

বসন্তর অসহায় অবস্থা দেখে রমণী ওর অনেকটা কাছে এসে বসল। বলল, ‘কে তুমি? কীজন্য এসেছ এখানে?’

‘মনের দুঃখে। কেউ কোথাও নেই আমার। নাম একটা আছে। কিন্তু ঠিকানা নেই। ভবঘুরের মতো ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি এখানে। এখন দেবী মা ছিন্নমস্তা যদি কৃপা করেন তবেই আমি বাঁচব। এত সুন্দর জায়গা দেখে মন ভরে গেছে আমার। এখানে কোনও দোকানে বা অন্য কোথাও কেউ যদি কোনও কাজ দেয় তো করব। না হলে মন্দিরের দরজায় বসে গামছা পেতে ভিক্ষে করব।’

বসন্তর কথায় হেসে উঠল রমণী। বলল, ‘কেউ তোমাকে ভিক্ষে দেবে না।’

‘কেন? আমার অপরাধ?’

‘এমন সুন্দর চেহারা তোমার। ভদ্রঘরের ছেলে। যে তোমাকে দেখবে তারই মন ভরে যাবে। তোমার মতো লালটু চেহারার একজন কেউ ভিক্ষে করবে এ আমি ভাবতেও পারছি না।’

‘তাহলে তো আমার মনে হয় এখানেই বসে থাকা ভালো। নাহয় বাঘের পেটেই যাব।’

‘না না, তা হয় না। কেন তুমি ওইরকম মতলব করছ? আমি তোমাকে মরতে দেব না। আমাদের গ্রামেই নিয়ে যাব তোমাকে। আমাদের চার—পাঁচটা ঘর আছে। তারই একটাতে থাকবে তুমি। এখন বলো তো কেন তুমি এই বয়সে এমন বিবাগী হয়ে চলে এসেছ এত দূরে? কারও সঙ্গে প্যার করে দুঃখ পেয়েছ?’

বসন্ত এবার সরাসরি ওর মুখের দিকে তাকাল। যুবতির পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল মুখ। গায়ের রং ফর্সা। তাতেও যেন একটু তামাটে রং মেশানো। বলল, ‘তুমি কি অন্তর্যামী? সত্যিই একজনকে খুবই ভালোবেসেছিলাম আমি। কিন্তু সে আমাকে ত্যাগ করেছে। ছোটবেলা থেকেই আমি মাতৃহীন। বাবা আবার বিয়ে করলে সৎমার অনাদরে আমি বড় হই। কিছুকাল আগে আমার বাবাও মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর জানতে পারলাম বাবা আমাদের সমস্ত বিষয়—সম্পত্তি আমার সৎমার নামেই লিখে দিয়ে গেছেন। সেখানে আমার কোনও কিছুই প্রাপ্তি নেই। একথা জেনেই হয়তো আমার প্রেমিকা অন্যের দিকে নজর দিয়েছে। এখন আমি কপর্দকহীন। স্বজনহীন হয়ে তাই মনের দুঃখেই দেশান্তরী হয়েছি। এবার দেখব আমার ভাগ্য আমাকে কোথায় নিয়ে যায়।’

রমণী বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘এমন সুন্দর সুপুরুষ যুবককে যে প্রত্যাখ্যান করে সে কী ধরনের মেয়ে? আমি হলে সারাজীবন তোমাকে বুকে করে রাখতাম। যাই হোক, তোমার জন্য আমি আছি। তুমি আমাকে ছেড়ে এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার চিন্তা মনেও আনবে না কিন্তু।’

বসন্ত বলল, ‘কোথায়ই বা যাব বলো? তোমার মতো এত ভালোবেসে আপনজনের মতো কে—ই বা আমাকে কাছে টেনে নেবে? কিন্তু তুমি তো বিবাহিতা। তোমার স্বামী আছে। তার ওপর সুন্দরী যুবতি তুমি। তোমার স্বামী বা পরিবারের দিক থেকে কোনও বাধা আসবে না?’

‘যদি আসে সেটা আমি সামলে নিতে পারব। ও ব্যাপারটা আমার ওপরই ছেড়ে দাও। এখন এসো আমার সঙ্গে। আর দেরি করলে যে—কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটে যেতে পারে।’

বসন্ত এবার কাঠের বোঝাটা তুলে ওর মাথায় চাপিয়ে দিল। সেই বোঝা মাথায় নিয়ে নদী পার হয়ে উঁচু ডাঙায় উঠল দুজনে। তারপর মন্দির ডানদিকে রেখে ধীর গতিতে এগোতে লাগল ওদের গ্রামের দিকে।

পথে যেতে যেতে বসন্ত জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম?’

রমণী হেসে বলল, ‘এতক্ষণে নাম জানার কথা মনে হল তোমার? আমার নাম ঊর্মিলা। ঊর্মিলা সাহু।’

‘কী করে জানব বলো? আমি তো সারাক্ষণ আমার কথাই বলে গেলাম। তুমি ঊর্মিলা, আমি গৌতম। তোমার আশ্রয়ে থেকেই আমি আমার জীবনের বাকি দিনগুলো এখানেই কাটিয়ে দেব। দেবীর আরাধনা করব। আর মায়ের মন্দিরে বা কোনও দোকানে যদি কোনও কাজের ব্যবস্থা হয়—।’

ঊর্মিলা ধমক দিয়ে বলল, ‘আঃ। এখনই ওইসব চিন্তা কেন? তোমার ব্যবস্থা তো আমিই করব।’

বসন্ত আর কিছু বলল না। বেশ একটু উচ্চস্থানে ছোট্ট এক পাহাড়ি গ্রামে সন্ধের মুখে পৌঁছে গেল ওরা। এখান থেকে দেবীর মন্দির ও ভেরা—দামোদরের সঙ্গম বেশ ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি এখানে বড়ই উদার।

কাঠের বেড়া দেওয়া বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে ঊর্মিলার ঘরসংসার, পরপর দু—চারটি ঘর রয়েছে সেখানে। তারই মধ্য থেকে একটি ঘর ঊর্মিলা খুলে দিল ওকে। ঘরের ভেতর একটি তক্তাপোশও পাতা আছে।

ঊর্মিলা সে ঘরে আলো জ্বেলে বলল, ‘এখানেই তুমি থাকবে। আমি তোমার জন্য বালিশ—বিছানা সব কিছুরই ব্যবস্থা করছি। এখন মুখ—হাত ধুয়ে একটু বিশ্রাম নাও। এখন থেকে এই ঘর তোমারই।’

এমন ভাগ্যবিপর্যয়ের পর এরকম স্বর্গবাস, এ যেন কল্পনাও করতে পারা যায় না। এইরকম শ্বাপদসংকুল অরণ্যে ও বরাবরের জন্য রয়ে গেলে পুলিশ সি. আই. ডি ওর নাগালও পাবে না কখনও। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার এই, কী এমন আছে ওর মধ্যে যার জন্য সবাই ওর প্রতি আকৃষ্ট হয়? ওর এই সাতাশ বছরের জীবনে সত্যি সত্যিই কোনও মেয়ের সঙ্গে প্রেম—ভালোবাসার বন্ধন হয়নি। প্রথম ওকে আকৃষ্ট করে আরতি। স্বেচ্ছায় দেহদান করে ওকে মাতিয়ে তোলে। জেল ভেঙে বেরিয়ে আসার পর ওর জীবনে এল খোলার ঘরের বাসনা। ওর মিথ্যাচারে বিশ্বাস করে সারারাত ধরে কী আনন্দই না দিল ওকে। সেখান থেকেও কৌশলে পালিয়ে আসার পর এল ভৈরবী সঙ্গমে ঊর্মিলা। প্রথম দর্শনেই কেন এত মজে গেল সে ওর প্রতি? তবে যেমন যা—ই হোক না কেন, এই জায়গা ছেড়ে ও ভুলেও অন্য কোথাও যাবে না।

একটু পরেই ঊর্মিলা ঘরে এসে বলল, ‘এই যে লালটুবাবু, চা পিয়োগে না?’

বসন্ত বলল, ‘হলে তো ভালোই হয়।’

‘তাহলে এসো। আর একটা কথা বলি শোনো, রাতে ঘর থেকে একদম বেরোবে না। যদিও বেরোতে হয় এই ঘেরার বাইরে যাবে না।’

বসন্ত ‘আচ্ছা’ বলে ওর সঙ্গ নিল। এক জায়গায় একটি চালাঘরের মতো অংশে ওদের রান্নাঘর। সেখানে বারো—তেরো বছরের এক কিশোরী কাঠের জ্বালে চা বানাচ্ছিল। ঊর্মিলা গিয়ে তাকে বলল, ‘এবার সরে আয় তুই।’ তারপর বলল, ‘চায় পিনেকে বাদ বাবুজিকো বাথরুম দিখা দে।’

এখানে বেশ শীত আছে। তাই রান্নাচালার এই কাঠের আগুনের তাপ খুবই ভালো লাগল বসন্তর। একটা চাটাই পাতা ছিল একপাশে। বসন্ত তাতেই বসল।

ঊর্মিলা ওকে বেশ কয়েকটা নোনতা বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে গাঢ় দুধের চায়ের কাপ ধরিয়ে দিল ওর হাতে। ঊর্মিলা এবং সেই মেয়েটিও চায়ের কাপ হাতে নিল।

বিস্কুট খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বসন্ত বলল, ‘তোমার এখানটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তবে তোমাদের পরিবারের আর সব কই? তোমার স্বামীকে তো দেখছি না?’

ঊর্মিলা এবার মুখ টিপে হাসল একটু। তারপর বলল, ‘এই তো এলে। এই যে দেখছ পুণ্যিকে, এখানকারই এক গোয়ালা পরিবারের মেয়ে ও। তোমারই মতো বাবা—মা কেউ নেই ওর। তাই ওকে আমিই রেখেছি। ও বলতে গেলে আমার সব কাজই করে দেয়।’

চা খাওয়া শেষ হলে ঊর্মিলা বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে।’ বলে একটি ছোট্ট ঘরে নিয়ে গিয়ে আলো জ্বেলে বলল, ‘ওই দেখো, উনি আমার স্বামী। পক্ষাঘাত হয়েছে। ইদানীং কথাও বলতে পারেন না। এখন ওঁর শেষ অবস্থা। যে কোনওদিন চলে যেতে পারেন। আর আমার পরিবার? সেরকম কেউ নেই। আমি নানা কাজে ব্যস্ত থাকি তাই পুণ্যিই ওঁর দেখাশোনা করে।’

বসন্ত আর কোনও প্রশ্ন না করে বলল, ‘তোমার ওপর তাহলে দায়িত্ব অনেক।’

ঊর্মিলা বলল, ‘কিছুমাত্র না। একটু পরে খাওয়াদাওয়ার পাট শেষ হলে পুণ্যি পাল্লা বন্ধ করে এই চালাঘরেই শোবে। আমি শোব আমার ঘরে। রুগির ঘরে আমরা কেউ থাকি না।’ একটু দম নিয় ঊর্মিলা আবার বলল, ‘এবার যা বলি তা মন দিয়ে শোনো। মন্দির এলাকায় আমাদের একটা দোকান আছে। পূজাসামগ্রী ইত্যাদির দোকান। শনি—মঙ্গলবারে পূজার্থীদের ভিড় এখানে উপচে পড়ে। ওইদিন আমি দোকানে বসি। কেননা রোজ তো সময় দিতে পারি না। এ ছাড়াও আমি ভেড়া, বখরি, মোরগা পালন করি। দু’দিন জঙ্গলে যাই জ্বালানি কাঠ আনতে। তাই এবার থেকে তুমি আমার ওই দোকান সামলাবে। তুমি তো এমনই একটি কাজ চেয়েছিলে, তাই না? বাকি কাজ সব আমি করব। আগে দু’একটা দিন রেস্ট নাও। তারপর দোকানে বসবে। কাল সকালে আমি তোমার জন্যে জামাকাপড় কিনে আনব। কেননা তোমার সঙ্গে কিচ্ছু নেই।’

বসন্ত বলল, ‘না না। ও তোমাকে কিনতে হবে না। ওসব কেনার টাকা আমার আছে।’

‘জানি। তবু ও টাকা তুমি তোমার কাছে রেখে দাও। যদি কখনও আমাকে ভালো না লাগে, হঠাৎ করে যদি আর কারও মোহে পড়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাও, তখন কিন্তু ওই টাকাটা তোমার অনেক কাজে লাগবে।’

বসন্ত বলল, ‘আমি তোমাকে ছেড়ে, এখানকার এই পরিবেশ ছেড়ে চলে যাব একথা তুমি ভাবতে পারলে?’

‘আমি জানি তুমি যাবে না। তবু বললাম। কিছু মনে কোরো না। আজ রাতে রুটি আর মাংস খাও। মিষ্টি প্যাঁড়া আছে। দোকান থেকে কেনা, পুণ্যি খুব ভালেবাসে।’

এরপর এখানকার দেবীমাহাত্ম্য, পরিবেশ, এখানকার মানুষজন সম্বন্ধে অনেক কথা হল, তার মধ্যে এক ফাঁকে ঊর্মিলা গিয়ে ওর শোয়ার ব্যবস্থা ঠিক করে এল। তারপর রুটি—মাংস ও সুস্বাদু প্যাঁড়া খেয়ে দারুণ তৃপ্ত হল বসন্ত।

ঊর্মিলা বলল, ‘তোমার ঘরে একটা টর্চ আর জলের জায়গাও রেখে এসেছি। এবার গিয়ে শুয়ে পড়ো।’ পুণ্যিকে বলল, ‘যা বাবুজিকে ওঁর ঘরে দিয়ে আয়।’

বসন্ত পুণ্যির সঙ্গে সেই ঘরে এল। এসে দেখল বেশ পরিপাটি করে সব কিছুর ব্যবস্থা করে গেছে ঊর্মিলা।

ও হাসিমুখে পুণ্যিকে বিদায় দিয়ে আলো নিভিয়ে নিজের চাদরটা গায়ে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু এই অজানা—অচেনা পরিবেশে এমন শান্তির আশ্রয় পেয়ে সহজে কি ঘুম আসে? তাই শুধুই এপাশ—ওপাশ করতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল সত্যি সত্যিই এত সুখ কি ওর সইবে চিরকাল? তবে এটা ঠিক, কোনওরকম বিপাকে পড়ে ও যদি নিজেই কোথাও চলে যায় সে কথা আলাদা। না হলে ঊর্মিলা কখনও ওকে ত্যাগ করবে না। ওর আচরণ ও চোখের ভাষায় তা পরিষ্কার। এইসব চিন্তা করতে করতে যখন ও নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে ঠিক তখনই দরজায় টকটক শব্দ। বসন্ত উঠে গিয়ে আলো জ্বেলে দরজা খুলতেই দেখল ঊর্মিলা। ওর হাতে একটা কম্বল।

ঘরে ঢুকে ঊর্মিলা বলল, ‘ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?’

‘না। শুয়ে শুয়ে নিজের কথাই ভাবছিলাম।’

‘ওসব নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করবে না। পুরাতন কোনও কিছু ইয়াদ রাখবে না। তখন কম্বল দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। এটা গায়ে চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ো।’

বসন্ত বলল, ‘আমার একটা চাদর আছে। সেটাই চাপা দিয়ে শুয়েছিলাম। কম্বল কাল দিলেও পারতে।’

‘তবু দিলাম। কেননা মাঝরাতে এখানে শীত খুব বেশি হয়। পাহাড়ি জায়গা তো।’

বসন্ত অভিভূত হয়ে বলল, ‘সত্যি, তুমি আমার জন্য যা করছ। তোমার ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না।’

ঊর্মিলা বলল, ‘ঋণ! কীসের ঋণ? আমি তোমাকে যা দিচ্ছি তা ভালোবেসেই দিচ্ছি। তুমি জানো না, এতদিন আমি মনে মনে তোমারই মতো একজনকে খুঁজছিলাম। নাও, এখন অনেক রাত। চুপচাপ শুয়ে পড়ো। আমি ঠিক তোমার পাশের ঘরেই আছি। কোনও জন্তুজানোয়ারের ডাক শুনে ভয় পেলে আমাকে ডেকো।’

বসন্ত বলল, ‘এই বনপাহাড়ের দেশে তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার? তোমাকেই তো ডাকব আমি। তুমি আমাকে ভালোবাসা দিয়েছ। আশ্রয় দিয়েছ।’

ঊর্মিলা এবার ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘হ্যাঁ দিয়েছি। তবে সেই আশ্রয়টা শুধু এই ঘরে নয়। আমার হৃদয়ে। বুকের গভীরে।’ বলেই ওকে গাঢ় আলিঙ্গনে বদ্ধ করে ওর বুকে মাথা রেখে বলল, ‘আমায় তুমি ছেড়ে যেও না গো। তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার বেঁচে থাকার জন্য তোমাকেই প্রয়োজন।’

এই রাতে যুবতি রমণীর পরশে অস্থির হয়ে উঠল বসন্ত। এরপরে আর কি স্থির থাকা যায়? একটু পরে জঙ্গলের গভীর থেকে একদল হরিণের ডাক যখন কানে এল, দুজনের দুটি দেহ তখন এক হয়ে গেছে।

দেখতে দেখতে একটি বছর কোথা দিয়ে যেন পার হয়ে গেল। ঊর্মিলা বিধবা হয়েছে কয়েকমাস আগে। বসন্ত জাঁকিয়ে বসেছে দোকানের ব্যবসায়। এই এক বছরের মধ্যে ওর মধুর ব্যবহারে সকলেরই খুব প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছে ও। মাতৃমন্দিরে মালাবদল করে বসন্তের সঙ্গে ঊর্মিলার বিয়েও হয়েছে। ঊর্মিলা এখন সন্তান—সম্ভবা।

এমনই সুখের সময়ে ঊর্মিলা একদিন বসন্তকে বলল, ‘চলো তোমাকে আমাদের গ্রাম ঘুরিয়ে আনি।’

‘সে তো হাজারিবাগ না কোথায় যেন?’

‘হ্যাঁ, হাজারিবাগের কাছেই টাটিঝরিয়ায়। আমার মা—বাবা এখনও বেঁচে আছেন। বাবা চোখে ভালো দেখেন না। মা একেবারেই গ্রামের মানুষ। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে সেকথা ওঁরা লোকমুখে শুনেছেন। এখন তুমি গেলে তোমাকে দেখবেন ওঁরা। খুব খুশি হবেন।’

‘বেশ তো চলো। কবে যাব বলো?’

‘কালই যেতে পারি। রামগড় থেকে ঘন ঘন বাস আছে হাজারিবাগের। এখানে তুমি কী জঙ্গল দেখছ? সেখানে গেলেই বুঝবে জঙ্গল কী ভয়ানক। বাঘ—ভাল্লুকের ভয়ে সন্ধের পর ঘর থেকেও বেরোয় না কেউ।’

‘সে তো এখানেও।’

‘ও জায়গা আরও বিপজ্জনক।’ তারপর মৃদু হেসে বলল, ‘আমার এই সম্ভাবনার কথাটাও তাঁদের জানিয়ে আসি। প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করবেন ওঁরা।’

পরদিন সকালেই রওনা দিল ওরা। গ্রামে পৌঁছতে বেলা হল অনেক। অনেক দিনের পর মেয়েকে, সঙ্গে জামাইকে দেখে খুশি হল সকলেই।

সবচেয়ে খুশি হল বসন্ত। এখানকার বনভূমি ও ছোট—বড় পাহাড়ের শ্রেণি মন ভরিয়ে দিল ওর। তিনদিন গ্রামে থাকার পর শেষদিন বিকেলের দিকে ঊর্মিলা বসন্তকে বলল, ‘চলো তোমাকে ওই টিলার ওপর যে শিবমন্দিরটা দেখছ সেখান থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।’

বসন্ত বলল, ‘সন্ধে হয়ে যাবে না?’

‘বেশিক্ষণ বসব না তো। বিয়ের আগে শিবরাত্রির সময় ওই শিবের মাথায় কত জল ঢেলেছি আমি। আবার কবে আসব না আসব তার তো ঠিক নেই।’

বসন্ত বলল, ‘চলো তবে।’

নির্জন বনপথ ধরে ওরা ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাথায় উঠে শিবঠাকুরকে দর্শন করল। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে যেই না ফিরে আসার উপক্রম করছে অমনি এক বলিষ্ঠ চেহারার যুবকের আবির্ভাব হল সেখানে। সে এসেই ঊর্মিলার একটা হাত শক্ত করে ধরে বলল, ‘আরে ঊর্মি! তু কব আয়ি?’

ঊর্মিলার চোখে আগুন, ‘সুরয, তু আভিতক জিন্দা হ্যায়?’

সূরয বলল, ‘কিতনে নম্বর কা?’

ঊর্মিলা বলল, ‘তুই হাত ছাড়বি কি না বল?’

সূরয বলল, ‘বচন দেতা হুঁ। সির্ফ বিশ মিনিট মে মেরা কাম হো যায়েগা। উয়ো বাঙ্গালি বাচ্চচাকো বল বিশ মিনিট ইন্তেজার করনেকে লিয়ে।’

বসন্ত আর থাকতে পারল না। সূরযের চোয়াল লক্ষ করে জোরে একটা ঘুসি মারল। আচমকা মার খেয়ে মন্দিরের চাতালের ওপর ছিটকে পড়ল সূরয। পরক্ষণেই রিভলভার হাতে উঠে দাঁড়াল। রাগে ফেটে পড়ে বলল, ‘মেরে পর হাত উঠায়া তু! ইতনা হিম্মত ক্যায়সে হুয়া তেরে কো?’ বলেই রিভলভার তাগ করল বসন্তর দিকে। সূরয ট্রিগারে চাপ দেওয়ার আগেই ঊর্মিলা ঝাঁপিয়ে পড়ল সূরযের ওপর। টার্গেট রং হয়ে গেল। গুলি লাগল ঊর্মিলার পেটে। জোরে একটা আর্তনাদ করে সেখানেই লুটিয়ে পড়ল ঊর্মিলা। সূরয সেদিকে তাকালও না। এক লাথিতে বসন্তকে ধরাশায়ী করল। সেখানেই বড় একটি পাথরের ওপর ছিটকে পড়ল বসন্ত। প্রচণ্ড আঘাত লাগল মাথায় এবং সারা শরীরে। তারপর আবার রিভলভার তাগ করতেই জঙ্গলের ভেতর থেকে হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগল সূরযের বুকে। সূরয চাপা আর্তনাদ করে ঘুরে তাকাতেই পর পর গুলি এসে বিদ্ধ করল ওকে। সূরয ছিটকে পড়ল পাহাড়ের ঢালে। এবার দেখা গেল এক বিদ্যুৎবর্ণাকে, তার চোখে—মুখে ক্রোধের আগুন। সে এসে একবার ঊর্মিলাকে দেখল। তারপর লাথি মেরে সূরযের দেহটা ফেলে দিল পাহাড়ের ঢালের দিকে। ঊর্মিলার দেহটাও তখন ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে এসেছে প্রায়।

আর বসন্ত? তার অবস্থা এমনই যে সে সব দেখেও ঊর্মিলার কাছে যেতে পারছে না।

সেই বিদ্যুৎবর্ণা তখন পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে উঠিয়ে বসাল বসন্তকে। বলল, ‘খুব লেগেছে তোমার?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওই মেয়েটি কে?’

‘আমার স্ত্রী।’

‘নিজের জীবন দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে গেল মেয়েটা।’

বসন্ত অতিকষ্টে বলল, ‘আমাকে একবার ওর কাছে নিয়ে যাবে?’

‘কেন, যেতে পারবে না তুমি?’

‘না। মাথায় বড় কষ্ট। পায়ের হাড়ে লেগেছে খুব। হাতটাও বুঝি গেল।’

বিদ্যুৎবর্ণা তখন বসন্তর হাত ধরে টেনে তুলল। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল বসন্ত। তবু ওই অবস্থায় ঊর্মিলার কাছে গেলে ঊর্মিলা বলল, ‘এত ভালোবেসেও পেলাম না তোমাকে। তবু যে ক’দিন পেয়েছি তাতেই মন ভরে গেছে আমার। আমার যা কিছু সব তোমারই রইল। একটি সন্তানও উপহার দিতে পারলাম না তোমাকে। যে আসছিল সেও পৃথিবীর আলো চোখে দেখতে পেল না। তাকে নিয়েই বিদায় নিচ্ছি আমি। তুমি ভালো থেকো।’

বসন্ত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ওর কী হবে?’

‘এদের দুজনেরই সৎকার করবে বনের বাঘেরা।’

‘এখন তাহলে কোথায় যাব আমরা?’

‘আমার ঝোপড়িতে।’

‘কিন্তু আমার যে এখন হেঁটে যাবারও শক্তি নেই।’

‘আমি তোমাকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। বেশি দূরের পথ নয়। ভাগ্যে আমি সময়মতো এসে পড়েছিলাম। না হলে তুমিও অকালে প্রাণ হারাতে।’

বিদ্যুৎবর্ণা বসন্তর হাত ধরে তুলে দাঁড় করালে বসন্ত খুব শক্ত করে ধরল ওকে। তারপর ধীরে ধীরে এক পা দু’পা করে এগোতে লাগল।

ওর অবস্থা দেখে বিদ্যুৎবর্ণা বলল, ‘তুমি দেখছি একেবারেই চলতে পারছ না। তুমি এক কাজ করো, পিছনদিক থেকে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো। আমি তোমাকে আমার পিঠে করেই বয়ে নিয়ে যাব।’

‘আমার ভার তুমি বইতে পারবে?’

বিদ্যুৎবর্ণা হেসে বলল, ‘দেখোই না পারি কি না। আমি একজন বারবনিতা, দেহব্যবসা করি। বহু পুরুষকে আমার বুকে উঠিয়েছি। আজ না হয় তোমাকে পিঠে নিয়েই চলব।’

বসন্তর বিস্ময়ের আর অন্ত রইল না। বাকি পথটুকু বিদ্যুৎবর্ণা অনায়াসে ওকে বয়ে নিয়ে এল। তারপর ওর ঝোপড়ির ঘরে এনে একটি ক্যাম্পখাটে শুইয়ে দিল ওকে।

দেখতে দেখতে সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হল। রাতের গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল চারদিক। গভীর জঙ্গলে ভরা এই পাহাড়ের শিখরদেশে নানারকম কীটপতঙ্গ ও বন্য জন্তুদের ডাক ছাড়া অন্য কিছুই শোনা গেল না।

এখানে কোনও বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই। হ্যারিকেনের আলোই এখন সম্বল। এই নির্জন ভয়ঙ্কর প্রদেশে মেয়েটা একা কী করে বাস করে? বসন্তর কৌতূহলের আর অন্ত রইল না। পাশাপাশি ঊর্মিলার জন্য ওর মনের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। ওর ঘরসংসার সব গেল। মন্দিরের কাছে সেই দোকান, গ্রামের লোকেরা, সবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল। আর তো ও সেই সুন্দর স্বর্গীয় পরিবেশে ফিরে যেতে পারবে না। ঊর্মিলার মরদেহ বাঘের পেটে গেলে কী কৈফিয়ত দেবে ও গ্রামের মানুষের কাছে? কেউ তো ওকে বিশ্বাস করবে না।

বিদ্যুৎবর্ণা এবার বসন্তর কপালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘যা হয়েছে তা ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছে। যা হবে তা ভালোই হবে।’

‘আমি ঈশ্বর বিশ্বাস করি না।’

‘তুমি নিরীশ্বরবাদী? খুব ভালো কথা। তবে ভাগ্য, ভবিতব্য এগুলোকে মানো নিশ্চয়ই? তাহলে নিরীশ্বরবাদের যিনি প্রভু, আমরা তাঁরই চরণে আশ্রয় নেব এবার।’

‘তিনি কে?’

‘এখন বলব না। তোমার সেরে উঠতে কয়েকটা দিন সময় লাগবে। এখন আগে একটু চা—পাঁউরুটি খাও। তারপর ব্যথা মরার ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকো চুপচাপ। রাতে ডাল—রুটি খাবে।’

‘তোমার নাম?’

‘আমার এখনকার নাম আলেয়া। পূর্ব নাম সোমা নন্দী। এসব কথা থাক। পরে সব বলব তোমাকে। তুমিও বলবে। তুমি তো বাঙালি। ঊর্মিলা এখানকারই মেয়ে। রাজরপ্পার মন্দির এলাকায় তোমাদের দুজনকে দেখেছি আমি। তবে নাম জানতাম না। সূরযের মুখে ওই নাম শুনতে পেলাম। তোমার নাম?’

‘আমি বসন্ত।’

সোমা এরপর ঝোপড়ির এক কোণে বসে কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে চা তৈরি করে দু—পিস পাঁউরুটি ও চা এগিয়ে দিল বসন্তের দিকে। ওর মুখোমুখি বসে নিজেও খেল।

চা পর্ব শেষ হলে সোমা বলল, ‘এবার ওষুধ দেব, তা খেলে দু’দিনে গায়ের ব্যথা মরে যাবে।’

বসন্ত বলল, ‘এই বনে—পাহাড়ে ওষুধ তুমি পাবে কোথায়?’

‘জঙ্গলে থাকি, একা থাকি। তাই সবরকম ওষুধই কাছে রাখতে হয়।’

‘বুঝলাম। কিন্তু এই বিপজ্জনক জায়গায় থেকে তুমি দেহব্যবসা করো কী করে?’

‘রোজই একবার করে শহরে যাই। সেখান থেকে রূপের ছলাকলায় ভুলিয়ে খদ্দের ধরে আনি। ওরা জানে না অমৃতেও গরল আছে। তারা আমার দেহ ভোগ করে সুখ পায়। আমি আনন্দ পাই এই ভেবে যে তাদের প্রত্যেকের শরীরে আমার রোগের বিষ ছড়িয়ে দিতে পারছি বলে। এসব কথা থাক। আগে তুমি ওষুধ খাও। সমস্ত ব্যথা—বেদনা সেরে যাবে। তবে হাড়ের ব্যথা মরতে সময় লাগবে একটু।’ সোমা এবার ব্যথা মরার কড়া ওষুধ ভিটামিন সহ ওকে খেতে দিল। তারপর বলল, ‘আজ রাতে ডাল—রুটি খাও। কাল থেকে অন্য ব্যবস্থা।’

বসন্ত শুনেই গেল ওর কথা। আসন্ন মৃত্যুর মুখ থেকে এই মেয়ে ওকে বাঁচিয়েছে। ওর ঘরে আশ্রয় দিয়ে সেবা করছে। অনন্ত রূপ—যৌবনের ধারক এই মেয়ে দেহব্যবসা করে। আবার ওর মতো আর্তের সেবাও তো করছে।

এমন সময়ে বাইরে দাপাদাপির শব্দ ও গর্জন শোনা গেল হঠাৎ।

সোমা বলল, ‘ভয় পেয়ো না। ভালুকের দল এসেছে। তবে আমার এই ঝোপড়ি এলাকায় ঢুকতে পারবে না।’

বসন্ত বলল, ‘সবই তো বুঝলুম। কিন্তু এই পরিবেশে একা তুমি থাকো কী করে? ভয় করে না?’

‘ভয়! কীসের ভয়? লোকালয়ে অনেক জ্বালা। অনেক যন্ত্রণা। এখানে শুধুই শান্তি। কী সুখে যে আছি!’

‘তা তো আছ। কিন্তু আমি যদি এখানে থাকি তাহলে তোমার দেহব্যবসা চলবে কী করে?’

‘সে চিন্তা তোমার কেন? আমি যে চিরকালই দেহব্যবসা করব তার কি কোনও ঠিক আছে?’

‘তাহলে করবেটা কী শুনি?’

‘যিনি নিরীশ্বরবাদী তাঁর শরণ নেব। তোমাকেও নেওয়াব।’

বসন্ত আর কোনও কথা না বলে চুপ করে রইল।

সোমা বলল, ‘আমি বাইরে গিয়ে কাঠের জ্বালে চট করে একটু ডাল—রুটি তৈরি করে আনি। এ ঘরে স্টোভ ধরানো যায়, কাঠের জ্বালে রান্না করা যায় না।’

সোমা ডাল—রুটি বানাতে গেলে বসন্ত ভাবতে লাগল এই বারবনিতাও এখন মজেছে ওর আকর্ষণে। রূপে—গুণে মেয়েটি অতি সুন্দরী। কিন্তু ওর হাতে রিভলভার এল কোথা থেকে? কে এই লড়াকু মেয়ে! সূরয নামের ওই দুষ্কৃতীকে ও কেন গুলি করে মারল? সে নিশ্চয়ই ওর খদ্দের হয়ে এসেছিল এখানে? যাই হোক, এই বারবনিতার পর ওর জীবনে আবার নতুন করে কে আসবে কে জানে? ঊর্মিলাকে পেয়ে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার একটা স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তাও হঠাৎ করে বুদবুদের মতো মিলিয়ে গেল একটু আগে। এখন ওর জন্য কোন ভবিতব্য অপেক্ষা করছে কে জানে? এবার কি তাহলে ওকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হবে? বসন্ত আর কোনও কিছুই ভাবতে পারল না।

প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে সোমা ডাল—রুটি তৈরি করে ঘরে এল। একটিই ঘর। বসন্তকে খুব যত্ন করে ডাল—রুটি খাওয়াল। নিজেও খেল। তারপর বলল, ‘এবার নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাও। তুমি ক্যাম্পখাটেই শুয়ে থাকো। আমি নীচেই শোব। তুমি অসুস্থ। তাছাড়া আমি চাই না তোমার শরীরে আমার খারাপ অসুখটা ঢুকুক।’

‘কিন্তু আমি চাই ওই অসুখটা আমার শরীরে নিতে। কেননা আমি আর বাঁচতে চাই না।’

‘তুমি না চাইলে কী হবে, আমি তো তোমাকে মরতে দেব না। তোমার শরীরের ব্যথা—বেদনা দু—একদিনের মধ্যেই সেরে যাবে। তোমাকে সুস্থ করে তোলার দায়িত্ব আমার।’

‘কেন, আমি তোমার কে?’

‘সে তুমি বুঝবে না। কাল সকালেই আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাব এখান থেকে।’

‘কোথায় যাবে?’

‘যেদিকে দু’চোখ যায়। যিনি নিরীশ্বরবাদী এবারে আমরা তাঁরই শরণ নেব।’

‘বেশ, তা না হয় নেবে। কিন্তু যে লোকটাকে তুমি খুন করলে তার ডেডবডি যদি পুলিশের হাতে পড়ে?’

‘সে ভয় করি না। ওই লোকটার বা তোমার স্ত্রী দুজনেরই ডেডবডি লোপাট হয়ে যাবে। এখানকার বুনো চিতারাই অস্তিত্ব লোপ করে দেবে ওদের।’

বসন্ত একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘এত জায়গা থাকতে তুমি এই ভীষণ জঙ্গলে দেহব্যবসা করতে এলে কেন? শহরের যে কোনও নিষিদ্ধ পল্লিতে থাকতে পারতে।’

‘পারতাম। ওইভাবে দেহব্যবসা করলে আমি স্বাধীন থাকতাম না। দুষ্টচক্রের অধীন হয়ে যেতাম।’

‘এবার বলো সূরয নামের ওই যে লোকটাকে তুমি খুন করলে, ওর সঙ্গে কি তোমার আগের কোনও শত্রুতা ছিল?’

‘আমার সর্বনাশের মূলে ওই লোকটা। তা ছাড়া ওই খুনে লোকটাকে না মারলে আমি তোমাকে বাঁচাতে পারতাম না। যাক, ওর কথা থাক। এখন তোমার কথা বলো।’

বসন্ত বলল, ‘আমার কথা আর কী বলব বলো? দু—দুজনকে খুন করে জেল থেকে ফেরার হয়ে লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

‘মিথ্যে কথা। খুনির চেহারা তোমার নয়। তুমি কখনও খুন করতে পারো না।’

‘সত্যি বলছি। খুন আমিও করেছি। দু’দুটো খুন। জেল পালানো খুনের আসামী আমি।’

‘হতেই পারে না।’

‘শুনবে তুমি আমার কথা? কোনও কিছুই আমি গোপন করব না।’

‘শুনব। শুনে আমিও বলব আমার কথা। দুজনেই দুজনের কাছে পরিষ্কার হয়ে থাকব।’

বসন্ত বলল, ‘আজ রাতে আমার চোখে ঘুম আসবে না। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ঊর্মিলার কথা। আবার তোমার দিক থেকেও চোখ ফেরাতে পারছি না। আমাকে তুমি ধরে একটু বসিয়ে দেবে? তোমার মুখ না দেখলে আমি বলতে পারব না।’

সোমা এবার শুয়ে থাকা বসন্তকে প্রায় পাঁজাকোলা করে তুলে বসিয়ে দিল ক্যাম্পখাটে। বসন্ত মৃদু হেসে সোমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘কী দারুণ দেখতে তোমাকে। এমন অঙ্গ ভরা রূপ সচরাচর দেখা যায় না।’

সোমা বলল, ‘এসব বাজে কথা রেখে তোমার নিজের কথা বলো।’

বসন্ত তখন আগাগোড়া সবই খুলে বলল সোমাকে। সব শুনে একটু চুপ থেকে সোমা বলল, ‘এবার আমার কথা শোনো। এখানে আমি আলেয়া নামের বারবনিতা। কিন্তু এককালে আমি গৃহবধূই ছিলাম। আমার নাম সোমা নন্দী। স্বামীর নাম শিবেন নন্দী। আমি দুর্গাপুরের মেয়ে। স্বামীর সঙ্গে মধ্য কলকাতায় একটি ফ্ল্যাটে থাকতাম। এক দুপুরে একটি দুষ্টচক্রের দল আমাকে আমার ফ্ল্যাট থেকে কিডন্যাপ করে। ওরা আমাকে পুলিশের মিথ্যা পরিচয় দিয়ে স্বামীর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে বলে ঘর থেকে বার করে নিয়ে যায়। তারপর আমাকে বন্দি করে রাখে তাদের গোপন ঘাঁটিতে। ওদের কাজ ছিল যুবতি মেয়েদের ফুসলিয়ে এনে অথবা বলপূর্বক ধরে এনে ভিনদেশে পাচার করে দেওয়া। এই যে সূরয তেওয়ারি যাকে আমি খুন করলাম সে ছিল এদের দলেরই একজন কুখ্যাত দুষ্কৃতী। প্রতিটি মেয়েকে পাচারের আগে সে তার দেহ ভোগ করত। তেমনি অত্যাচার আমার ওপর করল সে। আমি অনেক বাধা দিয়েছিলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওর আসুরিক শক্তির কাছে হেরে গেলাম। তারপরে কী যে হল আমার, আমি নিজেই তা ভেবে পেলাম না। সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারার সূরযকে ভালো লেগে গেল খুব। এমন সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়েই ও আমাকে মুক্তি দিয়ে পালাতে গেল। তখন ওর প্রতি আমার প্রেম জেগে উঠেছে। বললাম, ‘তুমি একা কেন যাবে? আমাকেও নিয়ে চলো। আমার সুখের জন্য তোমার মতো পুরুষই আমার পছন্দ।’ আমার তখন ঘরের মায়া নেই। কেননা আমি জানি আমার মতো ধর্ষিতা নারীকে কেউ আর আগের চোখে দেখবে না।’

বসন্ত বলল, ‘অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তারপর?’

‘তারপর ও আমাকে নিয়ে এল জামালপুরের কালীপাহাড়িতে। সেখানে ও আমাকে কালী মন্দিরে মালাবদল করে বিয়ে করল। এরপর আমরা এলাম মুঙ্গেরে। ততদিনে ওর কাছে আমি পুরোনো হয়ে গেছি। মাঝে মাঝে কোনও বিত্তবান ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা টাকা নিয়ে আমাকে তার শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য করত। মুঙ্গের থেকে হাজিপুর। তারপর ধানবাদ, গিরিডি। আমি তখন পুরোপুরি নষ্ট মেয়ে। তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আমার দেহ দান করব আর ওই অসৎ লোকটা তার টাকা ভোগ করবে এমন তো হয় না। এবার আমি নিজেই একদিন ওর খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে কোডারমায় ঘাঁটি করলাম। সেখান থেকে ধানবাদ। তারপরে হাজারিবাগ। হাজার দশেক টাকা হাতে পেলেই আমি যে কোনও বিত্তবান পুরুষের বেডরুমে যাই। আর সাধারণের কাছ থেকে হাজার টাকা পেলেই তাদের নিয়ে আসি এখানে। কেউ কেউ দিনমানেও আসে, কেউ বা সন্ধের মুখে। তারা অবশ্য সারারাত এখানেই থেকে যায়। আমার সঞ্চয়ের পরিমাণ এখন এক কোটি এক লাখ।’

বিস্মিত বসন্ত বলল, ‘এত টাকার মালিক হয়েও তুমি এই ঝোপড়িতে?’

সোমা হেসে বলল, ‘আজই আমার ঝোপড়িবাসের শেষ রাত। ওই টাকাটা সঞ্চয় করব এটাই ছিল আমার টার্গেট। আমার তো কোনও খরচ নেই। বিশাল অঙ্কের ওই টাকাটা জমেছে তাই। আরও আগে জমত। রোগের জন্য খরচ হয়েছে কিছু। আমার লক্ষ্যপূরণ হওয়ামাত্রই তুমি এলে। যে আমাকে এ পথে আসতে বাধ্য করেছিল সেও হঠাৎ কীভাবে যেন কারও কাছ থেকে খবর পেয়ে এখানে এসেছিল। ঘরেও ঢুকতে দিইনি ওকে। ও আমাকে দেখে নেবে বলে বিদায় নিয়েছিল। মনে হয় নিয়তিই ডাকিয়ে এনেছিল ওকে, তোমাকে টার্গেট না করলেও মারতাম ওকে। আমি মারব বলেই রিভলভার হাতে ওর পিছু নিয়েছিলাম।’

বসন্ত বলল, ‘তুমি সময়মতো এসে না পড়লে ও আমাকে মারতই।’

সোমা বলল, ‘যাক। আপদের শান্তি হয়েছে, ভালো ওষুধের প্রভাবে আমিও এখন আরোগ্যের পথে। কাল সকালেই আমি তোমাকে নিয়ে বরাবরের জন্য চলে যাব এখান থেকে। সম্প্রতি আমি একটি ফ্ল্যাট কিনেছি। সেখানেই নিয়ে যাব তোমাকে।’

‘সেটা কোথায়?’

‘এখন বলব না। সেখানে থাকব শুধু তুমি আর আমি। আমরা দুজনেই বিদ্বেষ ভুলে তাঁর শরণ নেব এবার।’

‘তিনি কে?’

‘তিনি একজন নিরীশ্বরবাদী। তাঁকে দর্শন করলেই মাথা নত হয়ে আসবে। তাঁর চরণে আশ্রয় নিয়ে দুজনেই আমরা ধর্মপথের পথিক হব। হিংসা ত্যাগ করব। পারবে না?’

বসন্ত বলল, ‘শুধু একটা অনুরোধ। আজ রাতে আমাকে দূরে রেখো না। আমাকে তোমার কাছে টেনে নাও। তোমার বুকে আশ্রয় দাও।’

রাতের আঁধার কেটে ভোর হল একসময়। ভোরের আলো ফুটে উঠতেই শয্যা ত্যাগ করে চোখে—মুখে জল দিল দুজনেই। সোমা জিগ্যেস করল, ‘কেমন বোধ করছ এখন?’

‘ভালো।’

‘আমি তোমাকে কড়া ডোজের পেনকিলার দিয়েছিলাম। চা—বিস্কুট খাওয়ার পর আরও একটা খাবে। দিনে দু’বার—তিনবার খেলেই ফিট।’

এরপর চা পর্ব শেষ হল ওদের। রোদ উঠতেই সোমা বলল, ‘চলো।’

‘এখনই?’

‘হ্যাঁ। আমাদের নতুন জীবন শুরু করতে হবে না?’

একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে নামা শুরু করল দুজনে। সোমা অবশ্য শক্ত করেই ধরে রইল বসন্তকে। একসময় ওরা নির্জন বনপথ পার হয়ে নীচে নামল।

তারপর একট রিকশা নিয়ে সোজা সিংহানি মিশনের কাছে এক শিবমন্দিরে। সেখানে দর্শন প্রণাম সেরে অনেক ফুল—মালা ও লাড্ডু কিনে কাছেই কালীমন্দিরে এল।

মন্দিরে প্রবেশ করে দেবীপ্রতিমার সামনে জোড় হাতে দাঁড়াল দুজনে। একশো টাকা দক্ষিণা সহ সেই ফুল—মালা ও মিষ্টি পূজারীর হাতে দিতেই তিনি নাম—গোত্র জেনে পুজো করিয়ে দিলেন। তারপর প্রসাদী মালা পরিয়ে দিলেন দুজনের গলায়। সেই মালা সেখানেই বদল করে নিল ওরা। দেবীর প্রসাদী সিঁদুর বসন্তকে দিয়ে সোমা বলল, ‘এটা আমার সিঁথিতে পরিয়ে দাও।’

বসন্ত সোমার সিঁথিতে সিঁদুর দিলে পূজারী ওদের দুজনকেই আশীর্বাদ করলেন।

এরপর দেবীর প্রসাদ একটু করে মুখে দিয়ে মন্দিরের বাইরে এল ওরা। একটা বড় দোকানে বসে জলযোগ পর্বটা সেরে নিল। তারপর বসন্তকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে সোমা একটা গাড়ি নিয়ে এসে বলল, ‘ওঠো।’

বসন্ত গাড়িতে উঠলে সোমা ওর পাশে বসে একটা হাত মুঠোয় নিয়ে আপনমনেই গুনগুন করতে লাগল।

বসন্ত বলল, ‘এখন আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘নতুন জীবন শুরু করতে।’

‘সেটা কোথায়?’

‘গেলেই দেখতে পাবে।’

বসন্ত আর কিছু বলল না। গাড়ি দ্রুত এগিয়ে চলল ঘন জঙ্গল ও পাহাড়— পর্বতের পথ অতিক্রম করে।

প্রায় ঘণ্টা তিনেক পরে গাড়ি এসে থামল এক জনবহুল পাহাড়ি এলাকায়।

বসন্ত বলল, ‘আর কতদূর?’

‘এই তো এসে গেছি।’

একসময় সোমার নির্দেশে ঘিঞ্জি এলাকার বাইরে এক রমণীয় স্থানে বড় একটি ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামল ওরা। ড্রাইভারের হাতে টাকা দিতেই সে গাড়ি নিয়ে ফিরে গেল।

সোমা বসন্তের হাত ধরে দোতলায় উঠে ওর নিজস্ব ফ্ল্যাটের চাবি খুলল। তারপর ঘরে ঢুকে বসন্তকে বলল, ‘তিন মাস হল কিনেছি এই ফ্ল্যাটটা। এখানেই গড়ে উঠবে আমাদের সুখের সংসার। এখান থেকেই আমরা প্রভুর চরণে শরণ নিয়ে নতুন জীবন শুরু করব।’

এরপর ঘরের সব জানালা খুলে বারান্দায় আসতেই মুগ্ধ বসন্ত বলল, ‘কী সুন্দর! দূরে বহুদূরে কত পাহাড়। আর ওই যে দেখা যাচ্ছে নদীটা। কী নাম ওর?’

সোমা বলল, ‘নৈরঞ্জনা। ফল্গুও বলে কেউ কেউ।’

‘আজই আমি স্নান করব ওখানে।’

‘তুমি একা? আমি বুঝি করব না?’

‘নিশ্চয়ই করবে। আমরা দুজনেই স্নান করব ওই নদীতে।’

‘ঠিক আছে। এখন একটু একা থাকো তুমি। আমি মালতীকে বলছি ঘরটা একটু ঝেড়ে—মুছে পরিষ্কার করে দিতে।’

মালতীকে আর ডাকতে হল না। সে নিজেই এসে দেখা করল, ‘ম্যাডাম কখন এলেন আপনি?’

‘এই তো এলাম। আগে আমাদের জন্য একটু চায়ের ব্যবস্থা কর। ঘর পরিষ্কার করে দে। তারপর তোকে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে যাব।’

ঘরে দুজনের শোবার মতো একটি রট আয়রনের খাট ছিল। সোমা এখানেই আদর করে বসাল বসন্তকে। বলল, ‘আজ দু’বেলাই আমাদের হোটেলে খেতে হবে। কাল থেকে ঘরেই ব্যবস্থা করব সব।’

বসন্ত বলল, ‘তা না হয় হল। কিন্তু আমরা কোথায় এলাম? কোন স্বর্গ এটা?’

‘এখনও বুঝতে পারছ না?’

‘না।’

‘একটু পরেই পারবে।’

মালতী একটি বাচ্চা ছেলেকে সঙ্গে করে ওদের জন্য চা—বিস্কুট ও কেক নিয়ে এল। বলল, ‘এখন ক’দিন থাকবেন ম্যাডাম?’

‘বরাবর। আর যাব না হাজারিবাগে। আর শোন, এখন থেকে তুই আমাকে ম্যাডাম বলবি না। দিদি বলবি। আর ইনি কে বুঝতে পারছিস তো? এঁকে বলবি—।’

‘বাবুজি।’

চা পর্ব শেষ হলে সোমা বলল, ‘একটু বিশ্রাম করো তুমি। আমি মালতীকে নিয়ে চট করে কিছু কেনাকাটা করে আসি। তারপর দুজনে স্নানে যাব।’

সোমা চলে গেলে বসন্ত কিছুটা সময় বিশ্রাম নিয়ে বারান্দায় এসে নৈরঞ্জনা ও দূরের পাহাড়ের দৃশ্য দেখতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে সোমা এসে বলল, ‘চলো আমরা নদীতে গিয়ে স্নানটা সেরে আসি।’

দারুণ উৎফুল্ল হয়ে বসন্ত বলল, ‘চলো, স্নানের জন্য মন আমার ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।’

মালতীর হাতে ঘরের দায়িত্ব দিয়ে একটা ঝোলাব্যাগ নিয়ে সোমা বসন্তের হাত ধরে নীচে নামল। এতক্ষণে বেশ ভালো করে জায়গাটার চেহারা দু’চোখ ভরে দেখল বসন্ত। বলল, ‘এত গাড়ি, এত মানুষজন, এত বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, এ কোথায় আমাকে নিয়ে এলে সোমা? দুরে ওটা কীসের মন্দির?’

‘তুমি এখন বুদ্ধগয়ায় এসেছ। ওই মন্দির হল বুদ্ধ ভগবানের। আমরা তাঁরই চরণে আশ্রয় নেব।’

আনন্দে শিহরিত হল বসন্ত। ওরা পায়ে পায়ে নৈরঞ্জনায় নেমে এল। এই নদীতে বর্ষাকাল ছাড়া ডুবজল থাকে না। তাই অল্প জলে বসে কাক স্নান করার মতোই স্নান করল দুজনে।

সোমা নতুন বস্ত্র এনেছিল। স্নান সেরে নতুন জামাকাপড় পরে বলল, ‘এবার চলো আমাদের অতীত ভুলে ভগবান তথাগত বুদ্ধের চরণে শরণ নিতে যাই।’

বসন্ত বলল, ‘চলো।’

শুভ্র সুন্দর বেশে পবিত্র মন নিয়ে পায়ে পায়ে ওরা একসময় বুদ্ধ মন্দিরে এল। তারপর দর্শন শেষে এল সেই বোধিবৃক্ষমূলে। মানুষের অত্যাচারের ভয়ে চারদিক ঘেরা। সেই সুপ্রাচীন পবিত্র স্থানকে প্রদক্ষিণ করে ধন্য হল ওরা।

সোমা বলল, ‘এ যাবৎ জ্ঞানে—অজ্ঞানে পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে যে পাপ আমরা করেছি, তার থেকে মুক্ত হই এসো।’

‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’

‘এসোই না।’

সোমা বসন্তের হাত ধরে এবার এল এখানকার তিব্বতি মনাস্ট্রিতে। এই মনাস্ট্রির মধ্যে আছে দুই কুইন্টাল ওজনের একটি বিশাল ধর্মচক্র।

সোমা বলল, ‘সকলের বিশ্বাস এই ধর্মচক্রটিকে বাম থেকে ডাইনে তিনবার ঘোরালে সর্ব পাপ নাশ হয়। এসো আমরা দুজনে একইসঙ্গে এই ধর্মচক্র ঘুরিয়ে সর্বপাপ হতে মুক্ত হই।’

অভিভূত বসন্ত বলল, ‘এখন তুমি আমার সহধর্মিণী। যা করব একসঙ্গেই করব। ভগবান বুদ্ধের নাম নিয়ে এসো আমরা দুজনেই ধর্মচক্র ঘোরাই।’

ধর্মচক্র ঘোরানো শেষ হলে বসন্ত বলল, ‘আর আমাদের মনে কোনও দ্বিধা রইল না। দুজনেই আমরা সর্বপাপ থেকে মুক্ত হলাম, কী বলো?’

সোমা বলল, ‘ঠিক তাই। এখন থেকেই শুরু হল আমাদের নতুন জীবন। এখন চলো, আমাদের ফ্ল্যাটের সামনে যে হোটেলটা আছে সেখানে খাওয়াদাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিই। বিকেলে আবার আসব এই বোধিবৃক্ষ প্রাঙ্গণে।’ তারপর বলল, ‘জানো তো আজ পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমা রাতে এখানে যে বিশাল বুদ্ধমূর্তি আছে, আমরা সেই মূর্তির পাদদেশে বসে ধ্যান করব।’

বসন্ত বলল, ‘তুমি যা বলবে যেমনটি বলবে আমি তেমনটিই করব।’

কথা বলতে বলতে ওরা বাইরের হোটেলে দুপুরের লাঞ্চ সেরে ফ্ল্যাটে এল। এবার শান্তির বিশ্রাম।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতেই ওরা আবার এল বোধিদ্রুমমূলে। এখানে আরও একবার প্রদক্ষিণ করে একটু এগিয়ে এক সুবিশাল বুদ্ধমূর্তির সামনে এল ওরা।

সোমা বলল, ‘এখানেই দুজনে পাশাপাশি বসে প্রভুর শরণ নিই এসো।’

ওরা যখন শুদ্ধচিত্তে বুদ্ধমূর্তির সামনে বসে দু’চোখ বুজে ধ্যান সাধনা করতে লাগল তখনই কানে এল সমবেত কণ্ঠস্বরে ‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি।’

ওরা চোখ মেলে দেখল নেপাল দেশের একদল বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এই মূর্তিকে প্রদক্ষিণ করছেন।

ওঁদের দেখাদেখি ওরা দুজনেও বৌদ্ধদের সঙ্গ নিয়ে মূর্তি প্রদক্ষিণ করল। সন্ন্যাসীরা বিদায় নিলেও ওরা সেখান থেকে সরে এল না। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে রাত। পূর্ণিমার রাত। চাঁদের জ্যোৎস্নাধারায় ভগবান তথাগত বুদ্ধের মর্মর মূর্তি তখন উদ্ভাসিত। এই নির্জনে রম্যস্থানে অন্তরের আকুল আহ্বানে বসন্ত সোমাকে আলিঙ্গনে বদ্ধ করল। সোমা কোনওরকম দ্বিধা করল না। বোধিবৃক্ষের দিক থেকে একটি শীতল বাতাস ওদের গায়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেল তখন।

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *