অবিশ্বাস্য সত্য

অবিশ্বাস্য সত্য

পরের কয়েকদিন আমি নিজেকে ঠিক পথে রাখলাম। খাবার কেনা বাদে অন্য কোনো কারণে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের হইনি। ছোট্ট ঘরটায় থেকে স্টেশনারি থেকে কিনে আনা ওরিগামি পেপার দিয়ে কাগজের সারস বানাচ্ছিলাম।

মিয়াগি আমার ডেস্কের ওপর সারি সারি কাগজের সারস দেখে প্রশ্ন করল, “একহাজারটা বানাতে চাও?” (জাপানিজ মিথলজি অনুযায়ী, কেউ যদি কাগজ দিয়ে একহাজারটা সারস বানাতে পারে, তবে দেবতারা তার একটা ইচ্ছে পূরণ করে দেন)

“হ্যাঁ। যা ভাবছ, ঠিক সেটাই করছি আমি।”

ইতোমধ্যে বানিয়ে রাখা ডজন খানেক সারস থেকে নীল রঙের একটা তুলে নিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল মিয়াগি।

“হাজারটা বানিয়ে রাখতে চাও কেন?”

“মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেটুকু সময় আমার রয়েছে, তা যেন সুখে কাটে—এই ইচ্ছেটা যাতে পূরণ হয়,” ঘোষণা করলাম।

অর্থহীন কাজে ডুবে যেতে খুব ভালো লাগে আমার। খুব শীঘ্রই গোটা ঘরটা নানান রঙের কাগজের সারসে ভরে গেল-গোলাপি, কমলা, হলুদ, হালকা সবুজ, কালচে সবুজ, হালকা নীল, গাঢ় নীল, বেগুনি সারস।

ঘরের ঘূর্ণায়মান স্ট্যান্ডিং ফ্যানের হালকা বাতাসে সারসগুলো উড়ে যাচ্ছিল ঘরের একেক কোণে। বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন এই টাটামির ঘরটাও রাঙিয়ে দিচ্ছিল তারা।

নিজের হাতের বানানো সারসগুলো দেখে বেশ চমৎকৃতই হলাম। প্রার্থনা করার জন্য এর থেকে সুন্দর কিন্তু অর্থহীন-এমন কোনো কাজ আর আছে?

কাগজ ভাঁজ করতে করতে মাঝেমধ্যে মিয়াগির সাথে কথা বলতে মন চাইছিল, কিন্তু নিজেকে থামালাম। আমি তাকে আমার শান্তির উৎস বানাতে চাইনি। তাকে ব্যবহার করে নিজের মানসিক অবস্থা ঠিক করাটা কেমন জানি অন্যায় মনে হলো আমার কাছে।

অবশ্য মিয়াগির হাবভাবে মনে হচ্ছে সে ধীরে ধীরে আমার প্রতি কোমল আচরণ করা শুরু করেছে। আমাদের চোখাচোখি হলে সে চোখ সরিয়ে নিচ্ছে আজকাল, যেখানে আগে সে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে একদম গর্ত করে ফেলত। আজকাল আমাকে সে মানুষ হিসেবেই দেখা শুরু করেছে, আগের মতো কোনো জড়বস্তু হিসেবে আর দেখছে না।

বোধহয় স্টেশনে আমার কাছে সবকিছু খুলে বলার পর সে ধীরে ধীরে আমার সাথে সহজ হতে শুরু করেছে। কে জানে। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে। হয়তো সব পর্যবেক্ষককেই সময়ের সাথে সাথে কোমল আচরণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কথাটা মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো, সে এখানে তার চাকরি করতেই এসেছে। আমি যদি এই সত্যটা ভুলে যেয়ে হাওয়ায় উড়তে শুরু করি, তবে ভবিষ্যতে বেশ পস্তাতে হবে আমাকে।

পাঁচদিন লেগে গেল কাজটা শেষ হতে। নিশ্চিত হতে সবগুলো গুনে দেখলাম। আবিষ্কার করলাম, কয়েকটা সারস আমার হাতে বানানো নয়। এত সুন্দর কারুকার্য আমার হাত দিয়ে বের হয়নি। আমি ঘুমিয়ে থাকার সময় নিশ্চয়ই কেউ ভালো মন থেকে এসব বানিয়েছে।

হাজারটা সারসের সবগুলোকে আমি একটা সুতোয় বেঁধে ছাদ থেকে ঝুলিয়ে দিলাম।

চিঠিতে ফিরে আসি।

যে রাতে সারসগুলো বানানো শেষ করলাম, সে রাতে পরনের জিনসের পকেট পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা ভাঁজ করা কাগজ মিলল।

দশ বছর আগে লেখা সেই চিঠিটা।

টাইম ক্যাপসুল খুঁড়ে বের করার পর সেটাকে পকেটেই রেখে দিয়েছিলাম। এরপর আর ওটা খুলে পড়ার কথা মনেই পড়েনি।

জিনসটা উল্টো করে ওয়াশিং মেশিনে ছুঁড়ে চিঠিটা নিয়ে বসলাম। এর আগের বার কেবল চোখ বুলিয়েছিলাম, পুরোটা ভালো করে পড়া হয়নি।

চিঠিতে এই লেখা ছিল-

দশ বছরের ভবিষ্যৎ ‘আমি’কে বলছি,

এমন একটা কাজ তোমাকে করতে হবে, যা অন্য কারো পক্ষে করা সম্ভব না।

দশ বছর পরেও তুমি যদি নিঃসঙ্গ থেকে যাও, তবে আমি চাই তুমি হিমেনোকে দেখতে যাও।

সে আমাকে ছাড়া পুরোপুরি অসহায়-

আর আমিও ওকে ছাড়া অসহায়।

সিদ্ধান্ত নিলাম, চিঠিটা মিয়াগি’কে দেখাব।

“দশ বছর আগে তুমি তো বেশ সৎ আর কোমল হৃদয়ের একটা ছোট্ট ছেলে ছিলে দেখা যাচ্ছে,” মিয়াগির কণ্ঠে সন্তুষ্টির সুর টের পেলাম। “এখন কী করতে চাও?”

“আমি হিমেনো’কে দেখতে যাব,” বললাম আমি। “আমি জানি কতটা বোগাস আর অর্থহীন শোনাচ্ছে আমার কথাবার্তা। আমি এটাও জানি, দশ বছর ধরে দেখি না এমন একটা সহপাঠীর প্রতি এতটা মনোযোগ দেয়া কতটা বোকার মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু সেই দশ বছর আগের ছোট্ট ‘আমি’র ইচ্ছে এটা। সে আমাকে এই কাজটা করার অনুরোধ করছে। হ্যাঁ, আমি এখন যে কষ্ট পাচ্ছি তার থেকেও বেশি কষ্ট হয়তো পাব। আরও হতাশায় ডুবে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু নিজের চোখে দেখা না পর্যন্ত হাল ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটা নিতে পারছি না-ওকে আরও একটিবার দেখতে চাই আমি। কথা বলতে চাই শেষবারের মতো। সে আমাকে একটা জীবন উপহার দিয়েছিল, তাই আমি তাকে আমার গোটা জীবনের মূল্যটুকু মানে তিনশো হাজার ইয়েনের সবটুকু দিয়ে হলেও সেটার ঋণ পরিশোধ করতে চাই। অবশ্য সে টাকার সবটুকু তো আর এখন নেই। তবে যেটুকু আছে সেটুকুই যথেষ্ট। হয়তো তুমি আমার এই চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু টাকাটা আমার। নিজের জীবন বিক্রি করে এ টাকাটা পেয়েছি আমি। তাই আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারব তা দিয়ে, ঠিক না?”

“আমি তোমাকে থামাব না,” মিয়াগি বলল। “এমন না যে, এরকম অনুভূতি আমার অজানা।”

বেশ অবাক হলাম। সে যে আমার কাজে সমর্থন জানাবে, তা ভাবিনি।

অবশ্য মিয়াগির কথাটার পেছনে যে গূঢ় অর্থ থাকতে পারে, তা ভেবে দেখিনি। তবে কদিন পরে যখন ভেবে দেখেছিলাম, কথাটার মানে স্পষ্ট হয়েছিল আমার কাছে।

আমি যেরকম অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তার সাথে মিয়াগি ভালোমতোই পরিচিত।

আমি কীরকম অনুভব করছি, তার স্পষ্ট জ্ঞান আছে মিয়াগি’র। সে আমার আরও আগে থেকেই ঐ অনুভূতির ভার বয়ে বেড়াচ্ছে।

“আগামীকাল সকালেই আমি হিমেনোর বাসায় যাওয়ার কথা ভাবছি। সে এখন তার বাবা-মায়ের সাথে থাকছে, তাই না?”

“ঠিক। স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর সে পুরোপুরি তার বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে,” কেমন একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল মিয়াগি। বোধহয় আমার সামনে হিমেনোর কথা বলে আমাকে রাগিয়ে দিতে চায় না আর।

স্বভাবসুলভ নয় এমন একটা কাজ করে বসলাম। “ধন্যবাদ,” বললাম আমি।

“তোমাকেও,” সে আশ্বস্ত হয়ে জবাব দিল।

.

হিমেনোর বাবা মায়ের বাসার ঠিকানাটা কীভাবে আমার জানা, সেটা বলার আগে আমার ঐ চিঠিটার কথা বলতে হবে। আমাদের দুজনেরই যখন সতেরো বছর বয়স, তখনকার গ্রীষ্মকালে সে চিঠিটা আমাকে পাঠিয়েছিল।

চিঠিটা পড়ার পর কেন জানি আমার কাছে ভয়ঙ্কর লাগতে শুরু করেছিল। কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।

এরকম চিঠি তো তার লেখার কথা না।

চিঠির বিষয়বস্তু ছিল খুবই গতানুগতিক। সে লিখেছিল, কলেজে এডমিশনের জন্য পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে যাবার ফলে সে আজকাল বই পড়ারই সময় পাচ্ছে না। কোন কলেজে সে পড়তে চায়, আর সামনের শীতের ছুটিতে সে যে আমার এখানে আসার চেষ্টা করবে—সেসবও লিখেছিল সে।

একটা সতেরো বছরের মেয়ের লেখা এরকমই হওয়ার কথা।

কিন্তু সেটাই অদ্ভুত লেগেছিল আমার কাছে। অন্য কোনো সতেরো বছরের মেয়ের লেখা চিঠির বিষয়বস্তু হলে অবাক লাগত না, লেগেছে কারণ মেয়েটা হিমেনো। সে তো অন্যান্য স্বাভাবিক সতেরো বছর বয়সী মেয়েদের মতো নয়; আমার মতোই সে একগুঁয়ে, বেয়াড়া আর প্যাঁচালো মানসিকতার অধিকারিণী।

তার স্বভাবসুলভ হাসিঠাট্টাটা কোথায়? আমাকে অপমান করার প্রচেষ্টাটা কোথায়? এই চিঠিটায় আমি হিমেনো’কে খুঁজে পাচ্ছি না যে কিনা প্রত্যেকটা জিনিসকে বাঁকা ভাবে উপস্থাপন করত। সতেরো বছর হতে হতে মানুষ এতটাই পাল্টাতে পারে? নাকি তার কথাবার্তা আর লেখালেখির ভাষা সম্পূর্ণ আলাদা? সে কি চিঠি লেখার সময় এভাবেই স্বাভাবিক ভাষায় চিঠি লিখতে অভ্যস্ত?

এই প্রশ্নগুলোর জবাব আমার দ্বারা বের করা সম্ভব হয়নি। দু’সপ্তাহ পর আমি একই ভাষায় উত্তর লিখে পাঠালাম। আমি ব্যস্ত থাকায় চিঠির উত্তর দিতে দেরি হয়েছে আমার, যে কলেজে আমি ঢুকতে চাচ্ছি সেটার ব্যাপারে আর সে এখানে ঘুরতে আসলে আমি কতটা খুশি হব-সেসব বিশদ আকারে লিখে পাঠালাম।

তার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম আমি।

সপ্তাহ গেল, মাস গেল।

সে বছর শীতের সময়ে হিমেনো এখানে বেড়াতে এল না।

আমি কি কোথাও ভুল করেছি? সেসময় চিঠিটা লেখার সময় ‘তাকে যে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে’ এই ভাবটা আমি বেশ অস্বস্তির সাথেই প্রকাশ করেছিলাম। সেটা কি ভুল হয়ে গিয়েছে?

প্রাথমিকভাবে ধরে নিয়েছিলাম, চিঠির উত্তরটা লেখার সময় কোনো একটা ভুল হয়ে গিয়েছে আমার। কিন্তু হয়তো তখনই হিমেনো আমার অচেনা একটা মানুষের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে গিয়েছিল-যে মানুষটাকে মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ে ও মাত্র উনিশ বছর বয়সেই যাকে ডিভোর্স দিতে বাধ্য হয়েছিল সে।

ভেবে দেখলাম, খুব একটা স্বস্তিদায়ক স্মৃতি নয় সেটা। তবে চিঠিটা আমার কাছে আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ সেটার মাধ্যমেই সে এখন কোথায় আছে তা বের করা সম্ভব হয়েছে।

.

কলেজে ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম না, কিন্তু তার বাসার ঠিকানা পুরোপুরি জানার জন্য আমাকে কলেজের কম্পিউটার ব্যবহার করতে হবে। বাইকে চাবি ঢুকিয়ে প্যাডালে পা রাখতেই মিয়াগির বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল।

“তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার থেকে একশো মিটার দূরে যাওয়া উচিত না আমার—ঠিক না?”

“ঠিক,” সে বলল। “দুঃখিত, কিন্তু তোমাকে একলা কোথাও যেতে দিতে পারব না আমি-বাইকটায় তো দুজন আটবে, তাই না?

“হুম, তা আটবে,” স্বীকার করলাম। কলেজে যাওয়ার জন্য একটা সেকেন্ডহ্যান্ড ‘কাব ১১০’ মডেলের বাইক কিনেছিলাম আমি। পেছনের অংশটা ফেলে দিয়ে একটা সিট বসানোর ব্যবস্থা করা ছিল তাতে। কিন্তু আমার কাছে দ্বিতীয় কোনো হেলমেট নেই। অবশ্য মিয়াগি’কে আর কেউ দেখতে পারবে না, তাই সে নিয়ে আমি কোনো সমস্যায় পড়ব না।

“তাহলে সেটা দিয়েই ওখানে যাওয়া যাবে-অবশ্য আমি যাওয়াতে তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে, তবেই।”

“সমস্যা নেই। চলো।”

ইঞ্জিন চালু করে কিকস্ট্যান্ড ফেলে দিলাম। মিয়াগি’কে ইঙ্গিত করলাম পেছনে বসতে। সে ধন্যবাদ জানিয়ে পেছনে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।

প্রতিদিন যে রাস্তা দিয়ে কলেজে যাই সেটা দিয়েই চললাম, তবে ধীরগতিতে। সকালবেলার পরিবেশটা বেশ অসাধারণ আর নস্টালজিক লাগছিল। লম্বা, ঢালু একটা পথ বেয়ে নামার সময় লক্ষ্য করলাম, আকাশে বিশাল বড় সাইজের কিউমুলনিম্বাস মেঘ ভেসে রয়েছে।

কলেজ ফাঁকি দেবার বেশিদিন হয়নি, তা সত্ত্বেও কেন জানি জায়গাটাকে অচেনা আর শীতল মনে হচ্ছিল। আশপাশে যেসব শিক্ষার্থীরা ঘোরাফেরা করছে, তাদের প্রত্যেকেই ছিল আমার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক জগতের বাসিন্দা। প্রত্যেককেই সুখী আর সৌভাগ্যবান লাগছিল আমার কাছে। মাঝেমধ্যে যেসব গোমড়ামুখোদের দেখা মিলল, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল ব্যাপারটা তারা উপভোগই করছে।

লাইব্রেরিতে এলাকার ম্যাপটা প্রিন্ট করেই ঝট করে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাফেটেরিয়া এখনও খুলেনি, তাই ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা সুইট-বিন ব্রেড আর এককাপ কফি নিয়ে ক্যাফেটেরিয়ার লাউঞ্জে ব্রেকফাস্টটা সারলাম। মিয়াগি ধীরেসুস্থে একটা ডোনাট চিবুচ্ছিল।

“মিয়াগি-প্রশ্নটার পেছনে তেমন কোনো অর্থ নেই, কিন্তু কৌতূহল সামলাতে পারলাম না বলেই করছি-আমার জায়গায় থাকলে তুমি কীভাবে জীবনের এই শেষ কয়েক মাস কাটাতে?” জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

“হুম-আসলে আমি ওরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত বলতে পারব না,” সে উত্তর দিল। তারপর আড়চোখে চারদিকে দেখে নিয়ে বলল, “ইয়ে, তোমাকে আগেও বলেছি, মানুষজনের সামনে আমার সাথে কথা না বলাই তোমার জন্য ভালো হবে। তারা এভাবে তোমাকে কথা বলতে দেখলে ভাববে তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ।”

“সমস্যা নেই। আমি পাগলই।”

আসলেই লাউঞ্জ এরিয়াতে মানুষজন আমাকে একলা একলা কথাবার্তা বলতে দেখে বেশ কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। কিন্তু আমার কোনো সমস্যা নেই তাতে। বরং আমাকে সন্দেহজনক বলেই ভাবুক তারা। যদি মৃত্যুর আগে এভাবে প্রত্যেকের স্মৃতিতে থাকতে পারি, তবে তাই সই।

খাবারের পাট চুকেবুকে যেতেই উঠে দাঁড়ালাম। মিয়াগি উঠে আমার পাশে এসে দাঁড়াল।

“আমি ভাবছিলাম,” সে বলল। “তোমার প্রশ্নটার কী উত্তর দেয়া যায়। আর- এখন যা বলতে যাচ্ছি তা কিন্তু খুবই ভেবেচিন্তে বলা। যদি আমার হাতে মাত্র তিনমাস আয়ু থাকে, তবে মৃত্যুর আগে তিনটা জিনিস করবই করব।”

“বাহ। বলে ফেল। শুনতে আগ্রহী আমি।”

“শুনে তোমার খুব একটা লাভ হবে না,” সে আমাকে সতর্ক করার চেষ্টা করল। “প্রথমটা হলো-একটা লেকে যেতে চাই আমি। দ্বিতীয়টা হলো, নিজের কবরটা নিজেই প্রস্তুত করতে চাই আমি। আর তৃতীয় কাজটা হলো, তোমার মতোই আমি আমার জীবনে একসময় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রাখা একজনকে দেখতে যেতে চাই। এ কয়টা জিনিসই বোধহয় আমি করার জন্য বেছে নিতাম।”

“উত্তরটা থেকে বেশি কিছু বোঝা গেল না। একটু ব্যাখ্যা করবে?”

“যে লেকটায় যেতে চাচ্ছি, তেমন কোনো আহামরি লেক না ওটা। ছোটবেলায় একবার রাতের বেলা ওখানের আকাশ আর আকাশে জ্বলজ্বল করা তারকারাজি দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। এই তুচ্ছ জীবনে আমার দেখা সবচাইতে চোখধাঁধানো দৃশ্য ছিল সেটা। আমি জানি এ দুনিয়ায় আরও অগণিত দৃশ্য রয়েছে যেগুলোর কাছে এটা কিছুই না, কিন্তু আমার জ্ঞান অনুযায়ী ওটাই আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ দৃশ্য।”

“বুঝতে পেরেছি। আর কবর প্রস্তুত করা বলতে-তুমি কি কবরস্থানের প্লট কিনতে চাও নাকি?”

“না। আসলে আমি কিছু একটা-ধরো একটা বিশাল সাইজের পাথর বেছে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চাই, ‘এটাই হবে আমার কবরস্থান’। আমার বেছে নেয়া স্থান যেন হয় সেটা, আর কয়েকযুগ হলেও যেন ওটা আমার কবর থাকে—এটুকুই নিশ্চিত হতে চাই আমি। আর যে মানুষটার প্রতি আমার অনুরক্ততা রয়েছে,” সে দৃষ্টি নামিয়ে বলল, “দুঃখিত, ওর ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাইছি না।”

“বুঝে নিয়েছি। একটা ছেলে, তাই না?”

“ওভাবেই ধরে নিন।”

বোঝা গেল সে এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াতে চায় না।

আমি কথাটা ভেবে দেখলাম। এমন একটা মানুষ যার প্রতি মিয়াগি অনুরক্ত ছিল। সে আমাকে জানিয়েছিল, দশ বছর বয়স থেকেই তাকে ‘পর্যবেক্ষক’ এর কাজে যোগ দিতে হয়েছে। আর যেহেতু ‘একসময়’ অনুরক্ত ছিল বলেছে, তার মানে পর্যবেক্ষক হওয়ার আগে থেকেই তার অন্তরঙ্গ ছিল সে।

“ব্যথা পেতে পারি কিংবা হতাশাতেও ডুবে যেতে পারি। তা সত্ত্বেও আমি তার কাছে যেতে চাইব। তাই হিমেনোর সাথে তোমার দেখা হওয়াটা আমি থামাতে চাই না।”

“কথাবার্তাগুলো মোটেই তোমার মনে হচ্ছে না। সাধারণত নিজের ব্যাপারে কথা বলতে গেলে তুমি গা বাঁচিয়ে কথা বলো।” হাসতে হাসতে বললাম আমি।

“কারণটা হলো-একমাত্র নিজের ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো কিছু জানা নেই আমার,” মিয়াগি জবাব দিল।

.

হিমেনোর বাসা খুঁজে বের করাটা অনেক সোজা একটা কাজ ছিল।

প্রথম প্রথম বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, তার পরিবার আসলেই ওখানে থাকে। এমনও তো হতে পারে একই পদবিধারী অন্য আরেকটা পরিবারে এখানে থাকে। কিন্তু অন্য কোনো সাইন প্লেটে হিমেনো নামটা চোখে পড়ল না। তাই মোটামুটি নিশ্চিত আমি, এখানেই হিমেনো থাকে।

তার পুরোনো বাসা, যেটা আমাদের বাসার পাশে ছিল, সেটা ছিল বেশ বড়সড় সাইজের, পুরোনো ধাঁচে বানানো। হিমেনো (REEF) নামটার অর্ধেক অংশ হলো হিমে (HE) যার অর্থ ‘রাজকন্যা”। ওরকম ধাঁচের বাসায় তাকে দেখে সত্যিই মনে হতো, ‘রাজকন্যা’ নামটা আসলেই মানিয়েছে তাকে।

যদি ম্যাপ আর নেমপ্লেটে নাম না লেখা থাকত, হয়তো আমি ঘুণাক্ষরেও এই নতুন বাসাটা চিনতে পারতাম না। খুবই স্বাভাবিক, নিষ্প্রাণ আর সস্তা গোছের ছিল এই বাসাটা।

কলিংবেল বাজাতে দ্বিধাবোধ করলাম না, কারণ মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম সে ওখানে নেই। তিন মিনিট ধরে তিনবার কলিংবেল বাজালাম, কিন্তু কেউ দরজা খুলল না।

বিকেলে নিশ্চয়ই আসবে কেউ। ততক্ষণ পর্যন্ত আশপাশের এলাকায় সময় নষ্ট করা যাক। কলেজ থেকে প্রিন্ট করে আনা ম্যাপটায় বোধহয় রাত পর্যন্ত সময় নষ্ট করা যায়, এমন কোনো জায়গার দেখা মিলবে। ম্যাপে চোখ বুলাতেই ‘সিটি লাইব্রেরি’ চোখে পড়ল আমার। আজকে কলেজের লাইব্রেরিতে যাবার পর বই পড়ার আগ্রহটা আবার মনে জেগে উঠেছে।

বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে বেশ সুন্দর, ছোটখাটো লাইব্রেরি এই ‘সিটি লাইব্রেরি’। কিন্তু ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে এর ভগ্নদশাটা প্রকটভাবে চোখে পড়ল। সোঁদা একটা গন্ধ ছিল ভেতরে; পরিত্যক্ত স্কুল বিল্ডিং এর মতো দশা ছিল সেটার। অবশ্য সেখানকার বইয়ের কালেকশন কিন্তু মন্দ ছিল না।

কদিন ধরেই ভাবছি মৃত্যুর আগে কী কী বই পড়তে চাই আমি। আরও ভালোভাবে বললে-এই সংক্ষিপ্ত সময়ে কোন কোন বইগুলো আমার কাজে দেবে?

শুধু ঐ ধরনের বইগুলোই আমি এখন পড়তে ইচ্ছুক। যদি আমার কাছে অর্থহীন এমন শব্দ পড়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করি, তাহলে এতদিন ধরে বই পড়ে সময় ব্যয় করাটা সম্পূর্ণই বৃথা মনে হবে আমার কাছে। আচ্ছা, এই বইগুলো পড়ে আমার আসলে কী লাভ হচ্ছে?

বোধহয় স্বাভাবিক কোনো সময় হলে অন্য ধরনের বই বেছে নিতাম। আজ বেছে নিলাম পল অস্টার, কেনজি মিয়াজাওয়া, ও’ হেনরী এবং হেমিংওয়ের লেখা। হুম, বাছাইটা তেমন একটা উদ্দীপনা জাগাচ্ছে না। তাদের লেখা যেসব বই বাছলাম সবগুলোই ছিল ছোটগল্প সংকলন। এরকম বেছে নেয়ার পেছনে মূলত কারণ ছিল একটাই—আমি দীর্ঘ কোনো বই পড়তে চাই না এখন। এখানে লেখক মুখ্য ছিল না। নির্দিষ্ট পৃষ্ঠাসংখ্যার থেকেও বেশি পৃষ্ঠার গল্পের বই পড়ার মানসিক শক্তি আমার নেই।

ও’ হেনরীর ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ পড়ার সময় মিয়াগি আমার পাশে বসে আমার হাতের বইটায় চোখ রাখল। আমি যে পৃষ্ঠাটা পড়ছি, সেটা পড়ার চেষ্টা করছে ও।

“তুমি আমাকে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি গল্পও পড়বে?” আস্তে করে প্রশ্ন করলাম।

“বলতে পার,” বলে আমার আরও কাছে ঘেষে এল সে। তার গায়ের সুঘ্রাণটা আজ কেন জানি প্রশান্তিদায়ক মনে হচ্ছিল।

লাইব্রেরিতে বসে প্রায় সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত বই পড়লাম। এর ফাঁকে ফাঁকে বাইরের স্মোকিং এরিয়ায় গিয়ে দু-য়েকটা সিগারেট পুড়িয়ে এসেছি।

অভিজ্ঞতাটা বেশ নতুন আমার জন্য। এই যে, আরেকজনের সাথে ভাগাভাগি করে বই পড়ার অভিজ্ঞতা। কোনো একটা অনুচ্ছেদ পড়ার পর সেটা আমার মনে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে, সেটার থেকে বরং মিয়াগির মনে ঐ অনুচ্ছেদটা কী অনুভব করেছে সেটা জানার আকাঙ্ক্ষা হচ্ছিল। বই পড়াটাকে আরও গভীর লাগছিল আজ।

লাইব্রেরিতে থেকে বের হয়ে সোজা হিমেনোর বাসায় চলে গেলাম। এবারো কেউ কলিংবেল শুনে দরজা খুলল না। তাই বাইরে গেটের পাশে প্রায় একঘণ্টার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রতিবেশীরা সন্দেহের চোখে আমাকে দেখতে পারে, এ চিন্তাটাও মাথায় ছিল আমার।

রাত নেমে এল। রাস্তার বাতিগুলো জ্বলে উঠল। আমার পায়ের কাছে সিগারেটের অবশিষ্টের স্তূপ জমা হচ্ছিল। মিয়াগিকে ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকাতে দেখে ব্যাগ থেকে একটা পোর্টেবল অ্যাশট্রে বের করে সেগুলোয় সিগারেটের অবশিষ্ট অংশগুলো জমা রাখতে লাগলাম।

আজকের দিনটা মাটি হলো।

হিমেনোর সাথে দেখা হয়নি দেখে আমার মনের ক্ষুদ্র একটা অংশ কিন্তু খুশিই হয়েছিল। ফেরার পথে ভুল করে একটা মোড় নিতেই সারি সারি করে ঝোলানো কাগজের প্রদীপভর্তি একটা শপিং এলাকায় উপস্থিত হলাম। বেশ কিছু সময় কেটে যাবার পর উপলব্ধি হলো, এই এলাকাটা আমার মা- বাবার বাসার খুব কাছাকাছি একটা এলাকা। আগে কখনো এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করিনি।

সামনের মন্দিরটায় একটা উৎসব চলছিল। খিদে পেয়েছে দেখে পার্কিং লটে বাইকটা পার্কিং করে উৎসব যেখানে উদযাপন করা হচ্ছে, সেখানে ঢুকে পড়লাম। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে সুগন্ধি সসের গন্ধ শুঁকতে শুরু করলাম। যে স্টলটা পছন্দ হবে সেখানেই পেটপূজা সেরে নেব।

প্রায় দশ বছর পর কোনো উৎসব আয়োজনের ভেতরে প্রবেশ করলাম। হিমেনো চলে যাবার পর আমি স্থানীয় উৎসব অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম। অবশ্য সেখানকার উৎসবের আয়োজনও খুব একটা বড় ছিল না। দশ কি পনেরোটা স্টল বসত সেখানে। তা সত্ত্বেও বেশ ভিড় হতো। যেসব স্থানে আনন্দ করার জায়গা কম থাকে, সেখানকার বাসিন্দারা এসব ছোট ছোট ব্যাপারে অনেক উৎসাহী হয়ে থাকে, আনন্দও বিপুল পরিমাণে করে।

শুরুতে একটা ওকোনোমিয়াকি আর ফ্র্যাংকফটার কেনার পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু এর পর নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রত্যেকটা স্ট্যান্ড থেকে একটা করে খাদ্যদ্রব্য কিনে ফিরলাম। আমার হাত ভর্তি ছিল তাকোইয়াকি, সিরাপ দেয়া বরফ চূর্ণ, গ্রিল কর্ণ, কাবাইয়াকি, ফ্রায়েড চিকেন, ক্যান্ডি আপেল, চকলেটে-ডোবানো কলা, ইয়াকিতোরি, ফ্রায়েড স্কুইড আর ট্রপিকাল জ্যুস দিয়ে। মিয়াগি পাথরের সিঁড়ির একদম ওপরে অপেক্ষা করছিল আমার জন্য।

“এতগুলো জিনিস দিয়ে কী করতে চাও?” মিয়াগি শ্বাস আটকে প্রশ্ন করল।

“ছোটবেলার স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই। সবগুলো হয়তো খেয়ে শেষ করতে পারব না, কাজেই হাত লাগাও,” বলেই বসে গেলাম। মিয়াগি দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে অবশেষে কাবাইয়াকি এর প্যাকেটটা ব্যাগ থেকে বের করল। “খাবারের জন্য ধন্যবাদ,” বলে প্যাকেটের ভেতরে থাকা ভাজা ইল মাছ মুখে চালান দিতে শুরু করল সে।

বারো নম্বর আইটেমে যেতেই আমি আর মিয়াগি দুজনেই খাবারের গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে পড়লাম। দুজনের কেউই বেশি খেতে অভ্যস্ত না, তাই এই কয়টা খাবার খেতেই আমাদের পেট ফুলে বাস্কেটবলের মতো গোল হয়ে গিয়েছে। এতটাই ভারি ভারি লাগছিল নিজেকে যে দাঁড়াতেও মন চাইছিল না। মিয়াগি গোমড়া মুখে তখন ক্যান্ডি আপেলটা চেটে যাচ্ছিল।

পাথরের সিঁড়ির একদম ওপর থেকে নিচে অনুষ্ঠিত উৎসবের সবকিছু একসাথে চোখে পড়ছিল। মন্দিরের দিকে চলে যাওয়া পথটার দু’পাশ স্টল আর স্ট্যান্ড দিয়ে সাজানো। পথের ওপর তার দিয়ে সাজানো কাগজের তৈরি আলোর প্রদীপ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। বিমানবন্দরের রানওয়েতে যেমন আলোর সাজসজ্জা করা হয়, এখানকার আলোকসজ্জাটা ঠিক তেমনটাই দেখাচ্ছিল। মন্দিরের আশপাশের এলাকাটা নিষ্প্রভ লাল আলোয় আলোকিত হয়ে গিয়েছে। উৎসবের ভেতর থাকা মানুষজন বেশ হাসিখুশি মন নিয়ে ঘোরাফেরা করছিল-ঠিক যেমনটা দশ বছর আগে দেখেছিলাম।

তখন আমার পাশে ছিল হিমেনো—এই পাথরের সিঁড়িতে বসে আমরা নিচে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মনে মনেই তখন ধরে নিয়েছিলাম, নিচে হাঁটতে থাকা মানুষজনের সাথে যোগ দেয়ার মতো যোগ্য মানুষ আমি নই। তখন আমি কিছু একটার অপেক্ষায় ছিলাম, যা আমাদের অস্তিত্বের, আমাদের বেঁচে থাকার পেছনের মূল উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার করে দেবে।

ঠিক তখন হিমেনো ঐ ভবিষ্যতবাণীটা করেছিল। দশবছর পর আমাদের সাথে অসাধারণ কিছু একটা ঘটবে আর তখন আমাদের মনে হবে, আমরা কতটা সৌভাগ্যবান যে বেঁচে রয়েছি! সেসময়ই সে বলেছিল, দশবছর পর আমাদের কেউই সঙ্গী খুঁজে না পেলে একে অপরের সঙ্গী হব।

দশ বছর কেটে গিয়েছে। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী আমি তো এসেছি। যে মেয়েটা প্রতিজ্ঞাটা করেছিল, সে অবশ্য এতদিনে একঘর সংসার করে ফেলেছে। আর আমি? নিজেকে সে সুযোগ না দিয়েই সবটুকু আয়ু বিক্রি করে ফেলেছি।

কিন্তু দিনশেষে এই মুহূর্তটাতে তো দুজনেই পৌঁছাতে পেরেছি। আমাদেরকে কেউ এখনও নিজের বলে দাবি করেনি।

আমরা আবার সেই আগের মতোই নিঃসঙ্গ।

হিমেনো এখন কোথায়? সে কী করছে?

সিকাডার মধুর গুঞ্জনে মন্দিরের চারদিক পরিপূর্ণ হয়ে গেল। আমি সেই মন্দিরে উপাস্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করলাম।

টের পেলাম, অনেকখানি সময় এখানে কেটে গিয়েছে। পাশ থেকে মিয়াগির নোটবুকে লেখার খচখচ শব্দ কানে এলো। ততক্ষণে নিচের উৎসব উদযাপনও শেষের পথে, লোকজনও কমে এসেছে। আশেপাশে খাবারের পরিত্যক্ত কাগজগুলো জড়ো করে উঠে দাঁড়ালাম।

একটা অবয়ব সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল।

অন্ধকারে অবয়বটার চোখমুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে গায়ের আকারটা স্পষ্ট হতেই বুকটা ছলাৎ করে উঠল

সময় থেমে গিয়েছে।

লোকে বলে না, “অবিশ্বাস্য হলেও সত্য?”

বাস্তবে কিন্তু এরকম অবিশ্বাস্য ঘটনা নানাভাবে প্রায়ই ঘটে থাকে, অবশ্য যাদের সাথে ঘটে তারা অনেকসময় সেটা টের পায় না।

দেহের প্রত্যেকটা কোষ আনন্দে লাফিয়ে উঠছিল।

প্রত্যেকটা সিঁড়ির ধাপ পার হওয়ার সাথে সাথে ওর সম্পর্কিত সবগুলো স্মৃতি একে একে মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। যেদিন আমাদের দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল, চার বছর বয়সের সেই গ্রীষ্মের দিনে তার চলে যাওয়া সবকিছু।

দশবছরে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু যতই পরিবর্তন আসুক না কেন আমি তাকে কখনো চিনতে ভুল করব না।

একে অপরের মুখ দেখার দূরত্বে আসতেই আমি কর্কশ স্বরে বললাম, “হিমেনো।”

মেয়েটা থেমে গেল। আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল সে।

ধীরে ধীরে শূন্যতাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বোকা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি জায়গা করে নিল চোখজোড়ায়।

“কুসুনোকি?” হিমেনো সেই দশবছর আগের কন্ঠস্বরে বলে উঠল, ঠিক যেমনটা দশবছর আগে বলেছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *