অনুপযুক্ত কাজসমূহ
সকালের ট্রেনটা আসার কয়েক ঘণ্টা আগে ঘুম ভাঙল আমার। ভেন্ডিং মেশিন থেকে একটা ‘পুষ্টিকর’ তকমা আটা ড্রিংক বের করে খেতে শুরু করলাম। পুরো শরীরটা ব্যথা করছিল আমার। আকাশটা এখনও ততটা আলোকিত হয়নি, তাতেই সিকাডা পোকা, কাক আর ঘুঘু পাখিরা সকালের ডাক দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
স্টেশনের ভেতরে মিয়াগি বসে থেকেই হাত পায়ের আড়মোড়া ভাঙছিল। তার ‘পর্যবেক্ষণ’ শুরুর পর এই প্রথম তাকে মানুষের মতো কোনো আচরণ করতে দেখলাম।
বোতল হাতে তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আগের দিন রাতটায় বেশ আর্দ্র আর্দ্র ভাব ছিল, তাই তার কার্ডিগানটা খুলে সেটা সে তার কোলের ওপর রেখেছিল। ফলাফলস্বরূপ : তার নমনীয়, নিষ্প্রাণ সাদা রঙের কাঁধটা আমার চোখে ধরা দিয়েছে।
বোধহয় তখন আমি কোনোধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ছিলাম। তিনমাসের মধ্যে আমি মারা যাচ্ছি, সবকিছুই হতাশা বাদে আর কিছু বয়ে আনছে না, ঘুমের অভাব কিংবা ক্লান্ত আর সর্বাঙ্গে ব্যথা-এগুলোর যেকোনো একটা বিভ্রান্তির পেছনের কারণ হতে পারে। হয়তো এমনও হতে পারে—স্বীকার যতটুকু করি আর না করি, তার থেকেও বেশি ভালো লেগে গিয়েছিল তাকে, মানে মিয়াগি’কে।
কোনো কিছুই আসে যায় না। একটা কথাই খালি মাথায় ঘুরছিল, আমি ওর খারাপ হবে এমন কিছু একটা করে ফেলতে চাই। আরও চাঁছাছোলা ভাবে বললে, আমি ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওর দেহটাকে পেতে চাই। এতসব বিভ্রান্তিকর অনুভূতির সাথে তাল মেলাতে আমার যে কষ্ট হচ্ছে, তার সবটুকুই ওর শরীরে ঢেলে দিয়ে মুক্ত হতে চাই।
আমার কল্পনা করা সবচেয়ে জঘন্যতম চিন্তা ছিল এটা। এটাও আমার জানা ছিল যে, আমি যদি ওটা সত্যিই করতে যাই তবে সাথে সাথে আমার মৃত্যু হবে। তাতে কী? এর মানে কয়েক মাস আগে আমার মৃত্যুটা হবে, এর বেশি তো কিছু হবে না। অন্তত কিছু একটা করে মরে যাওয়াটাই শ্রেয়তর মনে হচ্ছে আমার কাছে। আমার পরিকল্পনার তালিকায় তো একটা জিনিস লিখেছিলাম, ‘কোনো কিছু পেতে চাইলে নিজেকে আর থামিয়ো না’।
একটু আগ পর্যন্তও মিয়াগিকে সেই ‘চাওয়া’ এর বাইরে রেখেছিলাম । কিন্তু যখন এভাবে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করলাম, তখন আমার কাছে মনে হতে লাগল—এই কাজের জন্য মিয়াগির চেয়ে যোগ্য প্রার্থী আর কাউকে পাব না। কী কারণে জানি না, তার প্রভাবে প্রায়ই আমার স্যাডিস্টিক (নৃশংস ) দিকটা বেরিয়ে পড়ে। সারাটা সময় আত্মনিয়ন্ত্রণ আর ভদ্র মানুষের চেহারা করে থাকা এই মানুষটা যখন মাঝেমধ্যে তার দুর্বল দিকটা দেখিয়ে ফেলে, তখন আমার ইচ্ছে জাগে তার এই মুখোশ পরে থাকা চেহারাটা সবার সামনে ছিঁড়ে প্রকাশ করে দিই। “সবসময় নিজেকে এত কঠোর আর আত্মনির্ভরশীল দেখাও, অথচ বাস্তবে তুমি অনেক অনেক দুর্বল,” ইচ্ছে করছিল কথাটা তাকে বলি।
আমাকে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিয়াগি বোধহয় আসন্ন বিপদটাকে টের পেল। আত্মরক্ষার তাগিদে সতর্ক হতে বাধ্য হলো সে।
“আমার একটা প্রশ্ন আছে,” মুখ খুললাম আমি।
“কী প্রশ্ন?”
“পর্যবেক্ষক যখন তার পর্যবেক্ষণের মানুষটাকে কোনো অনৈতিক কাজ করতে দেখে, কতক্ষণ সময় লাগে ওর (পর্যবেক্ষণের মানুষটার) মৃত্যু ঘটার?”
মিয়াগির চোখগুলোতে এবার সত্যি সত্যিই সতর্কতা জায়গা করে নিল। “এই প্রশ্ন করার পেছনে কারণ?”
“আমি যদি এখন তোমাকে আক্রমণ করে বসি, তাহলে আমার হাতে কত সময় বাকি থাকবে সেটা জানতে মন চাইছিল।”
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তার চোখে আতঙ্কিত হবার কোনো চিহ্ন দেখলাম না। বরং সেখানে আরও শীতলতা টের পেলাম। ঘৃণা ভর্তি শীতলতা।
“প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ করতে এক মুহূর্ত লাগবে। তারপর সেখান থেকে বিশ মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা না। আর হ্যাঁ, এর থেকে পালানোর কোনো পথ নেই।”
“তার মানে আমি অন্তত দশমিনিট পাব, ঠিক না?” পালটা বলে বসলাম।
মিয়াগি মাথা ঘুরিয়ে বিড়বিড় করল, “তা কিন্তু আমি বলিনি-”
চারপাশ নীরব হয়ে গেল।
বেশ কৌতূহলের সাথে লক্ষ্য করলাম, মিয়াগি পালানোর কোনো চেষ্টা করল না। শুধু নিজের হাঁটুজোড়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
আমি তার দিকে হাত বাড়ালাম।
ভেবেছিলাম, সে রেগে গিয়ে চিৎকার করবে কিংবা আমাকে গালি দেবে। কিন্তু কোনোটাই সে করল না। তার উন্মুক্ত কাঁধটা স্পর্শ করতেই সে একদম বরফের মতো ওখানেই জমে গেল। তাকে হঠাৎ দুঃখী দুঃখী লাগতে শুরু করল।
ইচ্ছে করছিল তাকে ওখানের মাটিতে ফেলে দিয়ে ওপরে চড়ে বসি, তারপর পাশবিকভাবে নিজের প্রবৃত্তির প্রকাশ ঘটাই। হয়তো সে কোনোভাবে আহত হবে, হয়তো তার সফেদ হাঁটুর ওপর যে আঘাতটা ছিল সেরকম আরেকটা আঘাত নতুন করে যুক্ত হবে। হয়তো তার ক্লান্তিমাখা, ইতোমধ্যে কালি পড়ে যাওয়া চোখদুটোয় যে অল্প খানিকটা প্রাণের আলো ছিল, সেটাও নিভে যাবে। হয়তো সবকিছু শেষে সে আমার দিকে তাকিয়ে তার স্বভাবসুলভ মন্তব্য করবে, “সন্তুষ্ট?”
আমি কি সত্যিই সন্তুষ্ট হব?
আমি আসলে কী করতে চাইছি?
আচমকা ভেতরের পাশবিক চিন্তাভাবনাগুলো দূর হয়ে গেল।
শূন্যতার এক প্রবল স্রোত এসে জায়গা করে নিল সেখানে।
মিয়াগির হাল ছেড়ে দেয়া চেহারা দেখে আমি প্রচণ্ড বিষণ্নতায় আক্রান্ত হলাম। কাঁধের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে মিয়াগির দুই সিট পরে গিয়ে বসলাম আমি। আচমকা এরকম আচরণ করে বসার জন্য প্রচণ্ড লজ্জা লাগতে শুরু করেছে।
“কঠিন একটা চাকরি করতে হয় তোমাকে,” বললাম আমি। “আমার মতো সমাজের ‘আবর্জনা’দের সাথে সময় কাটানো অনেক কঠিন একটা কাজ।”
মিয়াগি আমার দিকে তাকাল না। “পরিস্থিতিটা বোঝার জন্য ধন্যবাদ, “ সে জবাব দিল।
আহ, এজন্যই তো আমার মূল্য মাত্র তিনশো হাজার ইয়েন, আমি ভাবলাম। জীবনের সবচেয়ে জঘন্যতম কাজটা আমি একটু আগে করতে যাচ্ছিলাম।
“কাজটা অনেক বিপদজনক। আমি নিশ্চিত, ইতোমধ্যে আমার কিসিমের আরও দু-তিনজন মানুষের পাল্লায় পড়েছ তুমি; যারা কিনা মৃত্যুচিন্তায় বোধশূন্য হয়ে তাদের পর্যবেক্ষককে আক্রমণ করে বসে।”
সে আস্তে মাথা নাড়ল। “আমি তো বলব আপনাকে বেশ সহজভাবেই পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। অনেক মানুষ পেয়েছি যারা আরও ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব কাজ করে বসেছিল,” সে আমার মনের লজ্জাবোধটাকে দূর করার চেষ্টা করছিল।
খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করি, হাঁটুর ওপরের আঘাতটা কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু করলাম না। আচমকা এরকম সহানুভূতি দেখানোটা বেমানান লাগবে।
বরং তাকে অন্য আরেকটা প্রশ্ন করলাম, “এই কাজ কেন করছ তুমি?”
“সংক্ষেপেই উত্তর দিই : কারণ আমার হাতে আর কোনো উপায় নেই।”
“বিশদ ভাবেই ব্যাখ্যা কর।”
মিয়াগিকে দেখে মনে হলো সে বেশ অবাক হয়েছে। “আমি ভেবেছিলাম, হিমেনো বাদে আর কারো প্রতি আগ্রহ নেই আপনার।”
“সেটা সত্য না। যদি তোমাকে আমার ভালো না লাগত, তাহলে হয়তো একটু আগের ঘটনাটা করার কথা ভাবতাম না।”
“আচ্ছা। ধন্যবাদ।”
“যদি এ বিষয়ে তোমার কথা বলার ইচ্ছে না হয়, তাহলে বলার দরকার নেই।”
“লুকোনোর কিছুই নেই-আচ্ছা, আপনার মনে আছে যে আপনি আয়ু বিক্রির পাশাপাশি স্বাস্থ্য আর সময়ও বিক্রি করতে পারবেন?”
মাথা নাড়লাম।
“আমি সময় বিক্রি করেছিলাম। প্রায় ত্রিশ বছর সময়।”
আহ, তার মানে এই। শুরু থেকেই ‘সময়’ বিক্রি করা নিয়ে আমার মনে প্রশ্ন খচখচ করছিল।
“আচ্ছা। তাহলে সময় বিক্রি করলে-”
“হ্যাঁ। আপনার মতো যেসব মানুষেরা আমাদের কাছে আসে আর ‘সময়’ বিক্রি করতে চায়, তাদের বেশিরভাগই আমার মতো পর্যবেক্ষকে পরিণত হয়। সময় বিক্রি করলে নিজের নিরাপত্তা আর বন্ধুত্বকেও বিকিয়ে দিতে হয়, এই আরকি।”
“আর ‘সময়’ বিক্রি করে দেবার পূর্বে তুমি সাধারণ একজন মানুষ ছিলে?”
“হ্যাঁ। একদম আপনার মতো।”
মনে মনে আবছাভাবে একটা কল্পনার মিয়াগি কল্পনা করেছিলাম আমি, যে কিনা জন্মগতভাবে চাঁছাছোলা ভাবে জবাব দেয়, ব্যঙ্গ করতে পারদর্শী আর শক্ত মনের মানুষ। কিন্তু তার কথা শুনে এখন মনে হচ্ছে এই আচরণগুলো তাকে আত্মরক্ষার তাগিদে শিখতে হয়েছে।
“তোমার বয়স তো বাড়বে, তাই না? মানে ত্রিশ বছর পর, অর্থাৎ চল্লিশোর্ধ বয়সে এই কাজ থেকে তুমি কি মুক্তি পাবে?”
“হ্যাঁ। যদি অতবছর বাঁচতে পারি আরকি,” মৃদু হেসে সে জবাব দিল। এর মানে তাকে আরও কয়েকযুগ এরকম ‘অদৃশ্য মানব’ এর মতো বেঁচে থাকতে হবে।
“টাকার জন্য এত কিছু করার দরকার পড়ল কেন তোমার?”
“আজ তো আপনার মুখ খুলে গিয়েছে দেখছি।”
“ইচ্ছে না করলে জবাব দিও না।”
“তেমন আহামরি কোনো কাহিনি না।”
“আমার জীবনকাহিনি থেকে অন্তত ভালো হবে।”
মিয়াগি আবার ট্রেনের শিডিউল নোটিশটার দিকে তাকাল। “ট্রেন আসতে দেরি আছে যেহেতু, সেহেতু বলাই যায়,” বলে সে তার কাহিনি বলতে শুরু করল।
“আমার মা কেন তার জীবনের অনেকখানি সময় বিক্রি করে দিয়ে আয়ু কিনেছিলেন, তা বলতে পারব না। আমার মনে আছে, তিনি সর্বদা জীবন নিয়ে অভিযোগ করতেন। জন্মের পূর্বেই আমার বাবা আমাদের একলা ফেলে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিলেন। মা সুযোগ পেলেই তাকে অভিশাপ দিতেন ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তাকে ফিরে পেতে চাইতেন। হয়তো অপেক্ষার কাল বাড়ানোর জন্যই তিনি আয়ু কেনা অব্যাহত রেখেছিলেন। অবশ্য তা করে তো আর বাবার আয়ু বাড়ানো যায়নি। আর মা পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করার পর থেকে সবার চোখেই তিনি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন। সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা আমাকে ভাবায়—যে মানুষটা তাকে এতটা ক্ষতবিক্ষত করে চলে গিয়েছিল, তার জন্য মা এত অপেক্ষা করতেন কেন? মাঝেমধ্যে আমার অবশ্য মনে হতো, বাবা নয়, যে কেউ একজন হলেই চলত তার। বাবা বাদে আর কেউ যে তাকে ভালোবাসেনি-এরকম কষ্টে মা’কে জীবন পার করতে দেখে প্রচণ্ড ঘৃণা হতো তার প্রতি। তিনি আমাকেও ঘৃণা করতেন। প্রায়ই বলতেন এই কথা, ‘তোকে জন্ম দিয়ে কী যে ভুল করেছি!’। এতবার বলতে বলতে সেটা তার মুখের বুলিতে পরিণত হয়েছিল। আমার যখন ছয় বছর বয়স, মা তখন পর্যবেক্ষক হয়ে সবার চোখে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এরপর বেশ কয়েকটা বছর আমাকে খালার বাসায় কাটাতে হয়েছিল। ওরাও কখনো আমাকে খুব একটা পছন্দ করেনি।”
এ পর্যায়ে এসে মিয়াগি চুপ করে কী যেন ভাবতে শুরু করল। না, অনুভূতির এরকম বাড়াবাড়ি রকমের বহিঃপ্রকাশ নিয়ে সে এতটা চিন্তিত না। আমি নিশ্চিত সে ভাবছে, ‘আমার কাহিনি শুনে সে যদি ভেবে বসে, আমি করুণা পাওয়ার জন্য এই গল্প ফেঁদে বসেছি?’
অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই সে আবার মুখ খুলল। এবার আগের থেকেও অনুভূতিশূন্যভাবে; মনে হচ্ছে সে নিজের জীবন না বরং অন্য কারো জীবনের গল্প আমাকে শোনাচ্ছে।
“আমার যখন দশ বছর বয়স, তখন মা মারা যান। কীভাবে মারা গিয়েছিলেন তা জানতে পারিনি-শুধু জেনেছিলাম তার পর্যবেক্ষণ করা মানুষটার হাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল। আয়ু বাড়ানো মানে এই না যে, সে আঘাত কিংবা অসুখ-বিসুখ থেকেও মুক্ত থাকবে। আমি যখন এই জিনিসটা জানতে পেরেছিলাম, আমার কাছে এই আয়ু বাড়ানোর সাথে জড়িত সবকিছুকেই বানোয়াট মনে হচ্ছিল। যে মানুষটা আমাকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানাতে এসেছিলেন, তিনি আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেছিলেন। ‘তোমার ঋণ রয়েছে,’ তিনি বলেছিলেন। ‘তোমার মা বিশাল বড় একটা ঋণ শোধ না করেই মারা গিয়েছেন। এখন এই ঋণ শোধ করার জন্য তোমার হাতে তিনটা পথ রয়েছে-আয়ু, সময় কিংবা স্বাস্থ্য বিক্রি করা।’ আমার মা নাকি তার জীবনের বেশিরভাগ ‘সময়’ বিক্রি করে দিয়ে আয়ু কিনেছিলেন। কিন্তু ঋণ পরিশোধ না করেই তিনি গত হয়েছেন। তার সবচেয়ে কাছের সম্পর্কের মানুষ আমি। কাজেই আমাকে সেই ঋণের বোঝা তুলে নিতে হবে। আর যদি আমি সাথে সাথে সেই ঋণ পরিশোধ না করতে পারি, তাহলে আমাকে ঐ তিনটার যেকোনো একটা বেছে নিতে হবে।”
“আর তখন তুমি ‘সময়’ বেছে নিলে,” আমি বললাম।
“ঠিক ধরেছেন। আমার জীবনের ত্রিশ বছর সময় বিক্রি করে ঋণটা পরিশোধ করতে পেরেছিলাম। আর তাই এখন আমি ‘পর্যবেক্ষক’ হিসেবে কাজ করে থাকি। অনেক বিপজ্জনক আর নিঃসঙ্গ কাজ এটা, কিন্তু কাজটা থেকে আমি জীবনের মূল্য আর মানুষের জীবন কাটানোর পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক গভীর সব তত্ত্ব জানতে পেরেছি। এই ঋণ পরিশোধ শেষ হলে আমি নিশ্চিত-অন্যান্য সবার চেয়ে আমি আরও ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারব। তাই কাজটা যে খুব একটা খারাপ না, সেটাও কিন্তু বলা যায়।”
“আমি এটাই বুঝতে পারছি না,” আমি বলতে শুরু করলাম। “আমি ঐ জীবনের পুরোটাই বোধহয় বিক্রি করে দিতাম। একটু আগেই তো বললে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে তুমি ততদিন বেঁচে থাকতে পারবে কিনা। ধরে নিলাম তুমি ততদিন বেঁচে থেকে অবশেষে ঋণ থেকে মুক্ত হলে। কিন্তু ততদিনে তোমার জীবনের সবচেয়ে অসাধারণ সময়গুলো পার করে ফেলবে। আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করছি না, কিন্তু তুমি তো নিজেই আমাকে বলেছ : এতকিছুর পর নিজেকে কেবল রেসের স্টার্টিং লাইনে আবিষ্কার করবে। এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পর অবশেষে চল্লিশ বছর পার হবার পর জীবন শুরু করা-এটা তো বিশাল একটা ট্র্যাজেডি। তাই আয়ু বিক্রি করে দেয়াই তোমার জন্য ভালো ছিল।”
“আমার জীবনের মূল্য যদি স্বাভাবিকের কাছাকাছি হতো, হয়তো তাই করতাম আমি।”
“কত ছিল?”
“একদম আপনার মতো,” মিয়াগি হাসতে হাসতে বলল। “প্রত্যেক বছরের মূল্য দশ হাজার ইয়েন। হয়তো এ কারণেই আপনার সাথে এতটা কঠোর আচরণ করি আমি। কারণ, নিজের জীবনের এত কম মূল্য হওয়াটা আমি মেনে নিতে পারিনি। আপনার মধ্যে হয়তো নিজেকেই দেখি। সবসময় এভাবে আপনার ওপর রাগ ঢেলে দেবার জন্য মাফ করবেন
“কথাটা এভাবে বলছি দেখে ক্ষমা করে দিও, কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়াটাই সঠিক মনে হয় আমার কাছে,” আমি বললাম। “এই পর্যায়ে এসে কী আশা নিয়ে বেঁচে আছ?”
“ভালো প্রশ্ন করেছেন। ঠিকই ধরেছেন। এই যে আমিও ‘সময়’ বিক্রি করে এই পেশায় চলে এসেছি-এ থেকে বোঝা যায় আমি ঠিকই আমার মায়ের মেয়ে। বিশাল অসহায় বুদ্ধু আমি। বেঁচে থেকে আমার কোনো লাভ নেই, কিন্তু সামনে না এগিয়েও পারছি না। হয়তো তার মতোই মৃত্যু হবে আমার। কিন্তু-আপনার তো জানাই আছে ব্যাপারটা। হুট করে হাল ছেড়ে দিতে পারছি না। কে জানে, হয়তো ‘ভালো কিছু’ ঘটবে আমার সাথে।”
“আমি কিন্তু একজনের জীবনের কথা জানি। পঞ্চাশ বছর হবার পরেও তার জীবনে ভালো কিছু ঘটেনি,” ঠাট্টার সুরে বললাম।
“আমিও চিনি তাকে,” হাসিমুখে মিয়াগি বলল।
কেন জানি না, নিজেও হাসলাম।
তারপর সিগারেট ধরাতেই মিয়াগি উঠে দাঁড়াল। আমার হাতের প্যাকেট থেকে সিগারেট তুলে নিয়ে সেটা মুখে নিল। আমি লাইটারটা তার মুখের কাছে নিয়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাইটারের তেল ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই অনেক বার চেষ্টা করার পরেও আগুন জ্বলল না।
তখন সে সিগারেটটা মুখে রেখেই আমার দিকে মুখটা এগিয়ে আনল। আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিজের মুখটাও এগিয়ে নিলাম।
দুজনের সিগারেট একে-অপরকে স্পর্শ করার পর একটু ঘষতেই মিয়াগির সিগারেটটাও জ্বলে উঠল।
এই প্রথমবারের মতো তাকে দেখলাম আমার সামনে একটু সুস্থির, স্বাভাবিক হতে পেরেছে।
হয়তো আমাকে এরকম একজন মানুষই হওয়া উচিত। এমন একটা মানুষ, যার আশপাশে থেকে সে সুখী হতে পারবে। তার স্মৃতিতে এভাবেই যেন থেকে যাই আমি।
রেললাইনের ওপর দিয়ে দিগন্তের দিকে তাকালাম। অবশেষে সূর্যের উদয় হতে শুরু করেছে।