শরাফত মণ্ডল ছাতা বন্ধ করতে করতে কাদেরের দোকানে ঢুকতেই ফুল ইউনিফর্মে মোড়ানো তহসেনউদ্দিন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং একটু উপুড় হয়ে মণ্ডলকে কদমবুসি করে। মণ্ডল হাসি হাসি মুখ করে বলে, থাক, থাক। বেঁচে থাকো। কদমবুসি করলেও আমতলির দারোগাও গ্লামালেকুম বলে পাছাটা চেয়ার থেকে ইঞ্চি দুয়েক উঠিয়ে ফের ঠিকমতো বসে। হাটে এই সাতসকালে পুলিসের জিপগাড়ি দেখে মুগুল খানিকটা আঁচ করেছিলো। কিন্তু তমিজকে খুঁজতে টাউনের পুলিস আসে কোন আইনে?
গফুর মিষ্টির আয়োজন করেছিলো আগেই। খেতে খেতে ছানায় ভেজাল ও মিষ্টির মান নিয়ে নিয়মমাফিক আলোচনায় যোগ দিয়ে শরাফত সরাসরি জিগ্যেস করে, তোমরা তমিজের কোনো হদিস করাবার পারলা না?
আমতলির দারোগার চোখেমুখে একটু অসন্তোষ, ধরা তো যায়ই। কিন্তু বড় মানুষরা যদি আসামিকে শেলটার দেয় তো–।
আরে, বলেন কী? আপনার কাজ আপনি করেন তো, আপনাকে বাধা দেবে কে? কাদের প্রতিবাদ করে এবং আশ্বাসও দেয়, আমি তো আপনাদের এস পি সায়েবকে সেদিন মুখের ওপর বললাম। এইসব চোরডাকাত ছাড়া থাকলে নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ শান্তিতে থাকে কী করে?
গ্রিন সিগন্যাল থানাওয়ালারা পেয়েছে সপ্তাহ তিনেক আগে। এর মধ্যে একবার বাড়ি এসে তহসেন তমিজের ঘর ভালো করে দেখেও এসেছে। তবে সে গিয়েছিলো প্লেন ড্রেসে। আমতলির দারোগাকে খোলাখুলি বলেও দিয়েছে, আসামী তো তাদের জাতিগুষ্টির মধ্যেই পড়ে, আবার মণ্ডলরা তাদের পেছনে লেগেই রয়েছে; অফিসিয়ালি তমিজের বাড়ি সার্চ করতে যাওয়াটা তার জন্যে নিরাপদ নয়। আমতলির দারোগা এখন যাচ্ছে নিজগিরিরডাঙায় তমিজের শ্বশুরবাড়ি সার্চ করতে। এলাকার সবচেয়ে বড়ো মুরুব্বির সঙ্গে একটু পরামর্শ করবে। তহসেন এসেছে পরিচয় করিয়ে দিতে। তাকে আবার এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।
তহসেন বলে, হুরমতুল্লা তো আপনার পুরোনো বর্গাদার। আপনি বললে তাকে ধরবে, আপনি না করলে এমনি গিয়ে খুঁজে আসুক।
হুরমতুল্লা মানুষ ভালো। সোজা মানুষ আর কী। তমিজের সাথে বেটিক নিকা দিয়া এখন মুসিবতে পড়িছে। আমি অনেক মানা করিছিলাম। মাঝির বেটার সাথে কুটুম্বিতা–। তহসেনের সামনে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যেতে সর্তক হয়ে মণ্ডল বলে, জেল-খাটা কয়েদির সাথে আত্মীয়তা করা এখন নিজেই ভুগিচ্ছে। জমি তো মেলা দিছিলাম, বর্গা করিচ্ছিলো। এই বিয়াটা দেওয়ার পরে খালি মোষের দিঘির আশেপাশে কিছু জমি ছাড়া আর সব ফেরত লিছি। ভাবছিলাম সবই ক্যাড়া লেই। পরে দেখলাম, বুড়া মানুষ। আর তোমরা তমিজেক বান্দলে হুরমতুল্লা বেটিক ফির লিকা দিবি অন্য জায়গাত।
তহসেন উৎসাহ পায়। তমিজকে ধরার জেদ তার দিনদিন আরো জোরে সোরে চেপে বসছে। সে নিশ্চিত, ওই ডাকাতটাই মাঝিপাড়ার মানুষদের খেপাচ্ছে। আর ওর সঙ্গে কুলসুমটার একটা যোগাযোগ আছেই। মেয়েটার এমন চমঙ্কার ফিগার, কালো মুখে অস্পষ্ট আলোর আভা, সারা জীবন কাটালো বোকাসোকা অথর্ব বুড়োর সঙ্গে। এখন সতীনের গোয়ার টাইপের কুচ্ছিত ছেলের গায়ের গরম খায়। তহসেন ক্রিমিনাল তো কম চরালো না। ব্রিটিশ আমলের আনডিভাইডেড বেঙ্গল থেকে শুরু করে কয়েকটা ডিস্ট্রিক্টে কতোগুলো থানায় চোরডাকাত ঠেঙিয়ে আসছে সে আজ আট বছরের ওপর। কুলসুমের দিকে তাকিয়েই বোঝা যায়, ওই তাগড়া বডিতে মাগী পারে না হেন কাজ নাই। বডির চেয়েও ডেনজারাস হলো তার নিশ্বাস। এ পর্যন্ত দুইবার সে তার কাছাকাছি গেলো। কুলসুম একবার গন্ধ নিতে শুরু করলে তহসেনের গা শিরশির করে : মাগী বুঝি তহসেনের ব্রেন, হার্ট, ইনটেস্টাইনের ভেতরের সব কিছু কারেক্টলি আইডেনটিফাই করে ফেললো।
একটা প্রবলেম তার বাপকে নিয়ে। কালাম মাঝির বুদ্ধিশুদ্ধি তো কম নাই। এরকম একটা মানুষ,-কুলসুমের জন্যে তার এতো টান কিসের? তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাননা যায় না যে, মাঝিপাড়াকে তমিজ খেপাচ্ছে কুলসুমকে দিয়েই। না। কুলসুমের কোনো দোষ মানুষটা দেখতেই চায় না। কেন? এটা কি কাৎলাহার বিলের সেই জিন না ভূতের সঙ্গে তমিজের বাপের কানেকশনের ভয়ে? কুলসুমের দাদা চেরাগ আলি সেই জিনের খাস বান্দা ছিলো বলেই কি বাপ তার কুলসুমকে ঘটাতে এতে ভয় পায়?
বুদ্ধি পরামর্শ বরং দিতে পারে শরাফত মণ্ডল। হাজার হলেও জমিজমা নিয়েই থাকে, জমির মতোই ধীরস্থির। মাঝিদের মতো মাছের ছটফটানি এদের থাকে না। বড়ো গেরস্থ মানুষ, বুদ্ধি একেবারে পাকা।।
হরমতুল্লার বেটির কথা কবার পারি না। শরাফত বলে, কিন্তু হুরমতুল্লা তমিজেক ঘরত থাকবার দিবি, বিশ্বাস করা কঠিন। তবে তোমার দেখার কথা তো ভালো করাই দেখো।
না। দেখবেন তো ইনি। তহসেন আমতলির দারোগাকে দেখিয়ে দেয়, এলাকাটা তো আমার জুরিসডিকশনে নয়। আমি এখন ফিরে যাচ্ছি টাউনে। তেভাগার কিছু নেতা ধরা পড়েছে, আজ কোর্টে ওঠানো হবে। তো, ইনি হাজার হলেও নতুন মানুষ, আবার বাড়িও এদিকে নয়, পাবনার মানুষ। তা সার্চের সময় এলাকার একজন গণ্যমান্য লোক থাকা দরকার।
সেই গণ্যমান্য লোকটি হওয়ার ভয়ে শরাফত মণ্ডল কাতর হলে তহসেন তাকে বাঁচায়, আমার বাবাকে বলেছি। তো বাবা বোধহয় একবারে হুরমতুল্লার বাড়িতেই চলে যাবেন।
জিপ নিয়ে তহসেন টাউনে চলে যাবার পরপরই আমতলির দারোগা দুইজন কনস্টেবল নিয়ে রওয়ানা হলো নিজগিরিরডাঙার দিকে।
ভাদ্রের ভ্যাপসা গরমে নিজগিরিরডাঙার রাস্তা, কাটা পাট ও পাকা আউশের জমি, এমন কি গাছপালা থেকেও আগুনের ভিজে ভিজে হলকা আসছে। জমিতে মানুষ আউশ কাটছিলো, কোনো কোনো জমি থেকে কাটা পাট নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো খালের দিকে, গরমে কেউ কেউ দম নিচ্ছিলো আমগাছের তলায়। পুলিস দেখে খুরপি, কাস্তে নিয়ে সব ছুটতে শুরু করে। এলোমেলোভাবে দৌড়াতে গিয়ে কেউ কেউ পড়ে যায় পুলিসের একেবারে সামনে।
হুরমতুল্লাহ বসেছিলো তার পুরোনো বর্গী করা জমির আলে কুলগাছের তলায়। পাটের ফলন এবার ভালো নয়, আষাঢ়ে বর্ষণ এবার একেবারেই কম। আল্লার গজব না পড়লে এরকম কখনো হয়? আর ঝড়! জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ—এই তিন মাসে যতোবার বৃষ্টি, ততোবার ঝড়। আজ ভাদ্রের প্রায় শেষ, বৃষ্টি কোথায়? একে গরম, তাতে খন্দের এই হল দেখে হুরমতুল্লার মাথা ঘোরে, কিছুক্ষণ পাট কাটলেই বমি বমি লাগে। সেদিন ছাইহাটার করিম ডাক্তার সাইকেলে এদিক দিয়ে যাবার সময় এক দণ্ড দাঁড়িয়েছিলো, বলে গেলো লেবু আর চিনি দিয়ে সরবত খাবে দিনে অন্তত দুইবার। দুপুরবেলাটায় তার খুব খিদে পায়, তা পান্তার সানকিতে পানিই বেশি, ভাতের দানা মনে হয় গোণা যায়। তার তখন ইচ্ছা করে, খুব ঝাল পুঁটকির ভর্তা দিয়ে দুই সানকি ভাত খায় খুব তারিয়ে তারিয়ে। এখন সুপথ্য চিনি লেবুর সরবত বা কুপথ্য ঝাল পুঁটকির ভর্তা মাখা ভাত কিছুই না জোটায় এবং আবাদ ভালো না হওয়ায় সে বেশ মনমরা। নবিতন ছুটতে ছুটতে এসে হাঁপায় আর বলে, বাপজান পুলিস। বাড়িত পুলিস লাগিছে। মনমরা হুরমতুল্লা নতুন বাছুরের মতো তিড়িং করে উঠে দাঁড়ায় এবং সোজা তাকায় দক্ষিণপূর্বে, সেদিক মণ্ডলবাড়ি। ওই বাড়িটিকেই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা বিবেচনা করে ওদিকে পালাবার জন্যে সে পা বাড়ায়। নবিতন বলে, বাপজান, ঘরত চলো। ঘরত পুলিস।
বাড়ির বাইরে বেঞ্চে বসে রয়েছে আমতলির দারোগা। ঘামে ভিজে গামছায় তাকে হাওয়া করত গেলে হুরমতুল্লা দারোগার ধমক খায়, রাখো তোমার জামাইকে বার করে দাও।
একটু তফাতে কালাম মাঝিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হুরমতুল্লার চোখ মুখ কুঁচকে আসে। এতে তার পুলিসের ভয়টা একটু চাপা পড়ে। এখন তার কুটুম্বিতাকেই যদি কাজে লাগানো যায় এই ভরসায় সে কালাম মাঝিকে তোয়াজ করে, আপনাগোরে বৌ ভালোই আছে। কালাম মাঝি বৈবাহিক সূত্রের আত্মীয়তাকে কিছুমাত্র আমল না দিয়ে বলে, ভালো তো থাকারই কথা। তোমার জামাই তোমার বেটিক তো টাকাপয়সা, কাপড়চোপড় সবই দিয়া যায়। ক্যাংকা কর্যা দেয়?
দারোগার ইশারায় একজন কনস্টেবল ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদারকে নিয়ে চলে। যায় বাড়ির পেছনের ভিটায়। ফুলজানের জেদেই এবার সেখানে প্রথম আউশের আবাদ করা হয়েছে। ধানগাছগুলো গরমে ঘামে এবং ধানখেতের তাপে কনেস্টবলের গায়ে ফোস্কা পড়ার জো হলে সে বুট পায়ে খচমচ করে তার মধ্যে হাঁটে।
নবিতন নিজেই এসে কালাম মাঝিকে কদমবুসি করে এবং বলে, আপনে বাড়ির মধ্যে চলেন। কালাম মাঝি তার আরজি কবুল করে এবং দারোগার দিকে তাকালে সেও তাকে ভেতরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করে। পেছনে যায় একজন কনস্টেবল।
পুলিসদের খেতে দেওয়ার মতো ঘরে কিছুই নাই। কনস্টেবল বাড়ির ভেতরে এদিক ওদিক আসামী খোজে আর নবিতন ও ফুলজান তাদের আপ্যায়নের জন্যে কী দেওয়া যায় তারই খোঁজে এখানে ওখানে হাতড়ায়। বাপের ঘরের মাচার নিচে হাঁড়িপাতিলে চিড়া মুড়ি খৈ কিছু খাকতে পারে মনে হলে ফুলজান হামাগুড়ি দিয়ে ঢেকে মাচার। তলায়। মাটির একটা হাড়ি ধরে টানতেই ফুলজান চিৎকার করে ওঠে। চিকন কালো একটা সাপ মাথা তুলে তার দিকে ফণা নাচায়। ঘরে লোকজন আসতে না আসতেই দুধভাত না পেয়েও কোনো উৎপাত না করেই সাপ চলে যায় উঠানের দিকে। কালাম মাঝি লাফ দিয়ে ওঠে উঠানের ভেতর এবং কনস্টেবল বলে, আরে এ যে গোখরা সাপ। দারোগা চলে আসে উঠানে, সাপটা তখন রান্না ঘরের পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে বাড়ির পেছনের ভিটায়। দারোগা তার ল্যাজ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় নি। তবে পদাধিকারবলে সে রায় দেয়, এই সাপের জোড়া আছে। সাপ তোমরা পোযষা নাকি? সাপের ভয় কাটাতে রাগ করে হুরমতুল্লার ওপর।
এরপর ওই ঘরে দূরের কথা, উঠানেও কেউ যায় না। বাইরে গাবতলায় বেঞ্চে বসে দারোগা বাড়ির লোকজনকে ডেকে জিগ্যাসাবাদ সারে। ফুলজানের মা কোনো জবাবই দিতে পারে না। মাঝখান থেকে মুখের ওপর ঘোমটা বেশি করে টানতে গিয়ে তার শাড়ি পাছার ওপর অনেকটা ফেঁসে যায়।
ফুলজানকে জিগ্যাসা করার সময় যেচে কথা বলে কালাম মাঝি। কালাম মাঝি বলে, তমিজ তোমার কাছে টাকাপয়সা দিয়া যায় কখন? তখন মাঝিপাড়ার মানুষ কেটা কেটা থাকে?
মাঝিপাড়ার মানুষেক এই বাড়িত আসবার দিবি কেটা?
রাগে ব্রহ্মাণ্ড জ্বলে গেলেও কালাম মাঝি সামান্য একটু ঝাঁঝ মিশিয়ে জিগ্যেস করে, ট্যাকা আর কাপড় দেয় কেটা?।
ফুলজান ফের ফুঁসে উঠতে মুখ তুলছিলো, তার আগেই হুরমতুল্লা তাকে আটকায়, কাদের মিয়া দুইবার ট্যাকা দিছিলো, পুরানা পিরানও দিছে। ধরেন শরাফত মণ্ডল তো হামাগোরে একই বংশের মানুষ। হামার বিটির বিপদ দেখ্যা—
বুড়া, তোমার মরণের আর বাকি কতো? কালাম মাঝি হুরমতুল্লার বয়সের দিকে ইঙ্গিত করে, মিছাকথাগুলা কও কোন মুখে? তোমার আখেরাতের ভয় নাই? কাদের মিয়া ট্যাকা দিলো কুটি থ্যাকা?
কালাম মাঝি ফেরারি তমিজের সঙ্গে মণ্ডলদের যোগাযোগের কথাটা দারোগার কাছে স্পষ্ট করতে চায়। তমিজকে দিয়ে মাঝিপাড়ায় ঝামেলা করতে চাইছে এই শালার মণ্ডলের গুষ্টি। কিন্তু দারোগা কাদেরের ব্যাপারে কোনো উৎসাহই দেখায় না। কাদেরের অনুমোদন ছাড়া এই বাড়িতে আজ তার আসাই সম্ভব হতো না। দারোগা ফুলজানকে দেখায় অন্যরকম ভয়, তমিজকে না পেলে তোমাদের এই বাড়ি ক্রোক করা হবে, তা জানো?
ফুলজানের ঘ্যাগের ভেতর থেকে ফোস করে ওঠে একটু আগে দেখা গোখরো সাপ, এই বাড়ি কী অর বাপের?
ঠিক কথা। দারোগা একমত হয়েও অন্য যুক্তি দেখায়, তোমার বাপের বাড়ি। কিন্তু তোমার বাপের বাড়ি তো পাবে তোমরা কয় বোন। তোমরা হিস্যা আছে না। এখানে? তোমার সম্পত্তিতে তোমার স্বামীর হিস্যা থাকবে না?
নিজের বিষয় সম্পত্তির মালিকানার বেদখল ঠেকাতে অস্থির হয়ে ওঠে হুরমতুল্লা, মাঝির বেটাক জামাই করা হামার সব্বোনাশ হলো গো দারোগা সাহেব।
ছেলের জুনিয়র সহকর্মীর সামনে কালাম মাঝি উসখুস করে। তাকে উদ্ধার করে। ফুলজান, অর আবার বাড়ির হিস্যা কী? হামি অর ভাত খাই? হামার বিটি হছে, একটা খবর লিছে? উই হামার কিসের সোয়ামি। অর ভাত হামি খামো না।
তালাক দেবে? দারোগার প্রশ্নের জবাব দেয় হুরমতুল্লা, হুঁ। আপনারা তমিজেক ধরেন চাই নাই ধরেন, উই জেলেত থাকুক চাই ঘাটাত ঘাটাত ঘুরুক, হামি হামার বিটির তালাক লিমুই। শরাফত মিয়ার সাথেও হামার কথা হছে, তাইও এই কথাই কছে।
শরাফত মণ্ডলের এরকম প্রতিপত্তি কালামের জন্যে সুখের নয়। বিরক্ত হয়ে সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। দারোগা উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এখানে লাভ হবে না। চলেন,–তমিজের বাড়িতেই চলেন। তহসেন সাহেব প্রথমে তাই যেতে বলেছিলেন।
কালাম মাঝি রাজি হয় না, আরে এখন ওখানে যায়া লাভ নাই। হামার বাড়ির সাথে অর ঘর, হামি জানি না? দারোগা তবু যাবো যাবো করতে থাকলে কালাম বলে, তমিজ আসলেও অনেক রাতে আসবার পারে। যদি যান তো একদিন আঁতকা যাওয়া লাগবি অনেক রাত হলে।
দুপুরবেলার প্রচণ্ড গরমে দারোগার কাছে কালামের প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়। তবে যাবার তারিখ এখনি সে বলতে পারে না।
ফুলজানের একেকবার মনে হয়, তমিজের ভাত সে খাবে না। যে ভাতার মাসের পর মাস পালিয়েই থাকে, তার জন্যে আবার অন্সে আহ্লাদ কিসের? ভাত না খেলে তার কী হয়? আজই তালাক পায় তো বাপজান কালই তার নিকা দিতে পারে। হুরমতুল্লা : বলে, এবার খাঁটি চাষীর ঘরের ছেলেই জোগাড় করবে।
পুলিস চলে যাবার আগেই আরো ভ্যাপসা হতে লাগলো, গরম একেবারে অসহ্য হয়ে উঠলো। তারপর হঠাৎ করে মেঘ করে বৃষ্টি নামলো ঝমঝম করে। বেশিক্ষণ নয়, সন্ধ্যার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি থেমে গেলো। আকাশে লেগে রইলো টুকরা টুকরা মেঘ। কাদার মধ্যে বেটিকে কোলে করে ফুলজান বেরোলো ভিটার পেছনে আউশের জমিটা দেখতে। বৃষ্টিতে ভিজে ধানগাছগুলো যেন অনেকদিনের ব্যারাম থেকে সেরে উঠেছে। কিন্তু নষ্ট ফসল কি আর ভালো হয়? ধানের শীষে শীষে রুগ্ন ক্লান্তি, তবু পানির ফোঁটা মাথায় করে তারা যেন গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। আহা! এখনো যদি আউশের খন্দটা ভালো হয়। এই জমিতে প্রথম আউশের আবাদ মার খাওয়ায় হরমতুল্লা রাতদিন তমিজকে বাপমা তুলে গালাগালি করে। ফুলজানের জেদেই আউশ করা হলো, ফুলজানকে তো তমিজই প্রথম বলে, ওই জমিটা আউশের জন্যে ভালো। তা কে জানে, তমিজ থাকলে ওখানে ধান ভালোই হতো হয়তো। মাঝির ঘরের মানুষ হলে কী হয়, তার লাঙল জমিকে ঠিকই বশ করে ফেলতো। অনেকদিন আগে, সে কতো বছর তমিজও জানে না, এই গিরিরডাঙায় নাকি জঙ্গল কেটে জমি তৈরি করেছিলো তমিজেরই পরদাদার পরদাদা, না-কি তারও দাদা। মুনসি তা হলে তমিজের কী?
তাদের ভিটার পেছনে আউশের জমিরও পেছনে আলের ওপরে পায়ের আঙুলে ভর করে দাঁড়ালে বাঙালি নদীর রোগা স্রোতের ওপারে পাকুড়তলায় কিসের আলো দেখা যায়। ওখানে এখন বড়ো কোনো গাছ নাই, ছোেটা ছোটো ঝোপের ওপর সারি সারি আলো জ্বলে আর নেভে। মানুষ ওগুলোকে মুনসির ফেলে-যাওয়া আলো বলে ভয় পায়, আবার খুশিও হয়। ফুলজান এ নিয়ে কখনো কিছু ভাবেও না। অতো রঙ্গ করার সময় কোথায় তার? তবে এখানে দাঁড়ালে খুব গরমের মধ্যেও গা জুড়িয়ে যায়। পাকুড়তলা থেকে কি হাওয়া আসে নাকি? কিন্তু পাকুড়গাছ কোথায়? তার বেটিও ওইদিকেই তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। আকাশে ফের মেঘ জমতে থাকলে ওপারটা আন্ধারে লেপে যায়। গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলে ফুলজান তাড়াতাড়ি ঘরে ফেরে বেটিকে বুকের মধ্যে সাপটে ধরে।