মাঝির বেটা হলে কী হয়, তমিজ কিন্তু হুরমতুল্লার ভিটার পেছনের জমির স্বভাবটা ঠিকই ধরেছিলো; প্রথমবার সেখানে আউশের আবাদ মারা পড়লো বটে, কিন্তু পরের বছর ফুলজানের জেদেই ফের আউশ বোনা হলো। আর খন্দও হলো, আল্লা রে আল্লা, রোপা আমনের জমিতেও মানুষ এতো ধান দেখে না। কিন্তু সেখান থেকে আদ্দেক জমি তো হুরমতুল্লাহ রাখতে পারলো না, বেচে বিয়ে দিলো তার পেয়ারের বেটি নবিতনকে। বুড়ার কথা : সব দোষ ফুলজানের। মাঝির বেটাকে নিকা করায় ভালো বংশের কোনো মানুষ কি তার বাপের সঙ্গে সম্বন্ধ করতে চাইবে? তাও হুরমতুল্লার শালা বলে ভাগ্নীটাকে বেটার বৌ করে ঘরে তুললো; শর্ত ছিলো একটাই : সোনামুখী হাটে তার মনিহারি দোকানটা সাজিয়ে দিতে হবে। জমি বেচা টাকাতে দোকান বড়ো করা যায় না। শালা তার মানুষ ভালো বলেই শুধু ওই জমি বেচার টাকা নিয়েই বেটার বৌ ঘরে তুললো, এখন চাপ দিচ্ছে বাকি টাকার জন্যে।
দেখা যাক, এবারের বর্গা করা আমন থেকে কিছু শোধ করা যায় কি-না। আজকাল এমন কি অঘ্রানের রোদেও হুরমতুল্লা অল্পেই কাবু হয়ে পড়ে; তার ঘন ঘন পিপাসা পায়, বদনা বদনা পানি খেয়েও বার বার পেচ্ছাব করা ছাড়া আর কোনো ফল হয় না। তাই রোদ পড়লে শরীরে যতোক্ষণ কুলায় হুরমতুল্লা পড়ে থাকে জমিতেই। ফুলজান থাকে। কাছাকাছিই। পাঁচুন দিয়ে নিড়াবার ফাঁকে ফাঁকে একটু দম নিতে তাই হুরমতুল্লার বাধে বাধো ঠেকে। নিজের বেটি হলে কী হয়, নিড়ানির সময় বাপকে একটু জিরাতে দেখলেই ফুলজান ক্যাটক্যাট করে, মাঝির বেটা কয়া তাক হেলা করো, মাঝির বেটা তো একদণ্ড বস্যা থাকে নাই। তার হাত চলিছে বাতাসের আগে।।
মাঝির বেটার সাথে লিকা বস্যা জাত ধর্ম খালু, সেই সোয়াগের মরদ আজ কয়টা বছর হয়া গেলো একটা খবর লেয় না। চার আনা পয়সাও তো পাঠায় না। হুরমতুল্লার এই আক্ষেপে এক হাত তুফাতের ধানগাছে কাঁপন লাগে, তাতেই তেজ ফিরে পেয়ে সে আরো হাত তিনেক জায়গা নিড়াতে পারে।
তমিজের পাত্তা নাই, সে কি আজকের কথা গো? কেষ্ট পালের মুখে কী না কী শুনে। ফুলজান বাপকে কয়েকদিন খুব ধরলো, মণ্ডলবাড়ি গিয়ে সে তমিজের খবরটা ঠিকঠিক। জেনে আসুক। হুরমতুল্লা বুড়ে হয়েছে বলে তো আর পাগল হয়ে যায়নি; শরাফত মণ্ডলের সামনে মাঝির বেটার খবর নিতে গিয়ে মানুষটাকে খামাখা খেপিয়ে দেবে নাকি? ফুলজানের আবদার রাখতে কি সে মণ্ডলের যেটুকু জমি বর্গা করছে তাও হারাবে নাকি? তার সংসার আছে না? তার আরো বেটি আছে না? বুড়া বাপের শরীরের দিকে ফুলজান ভুলেও কি একবার তাকায়? তার খাওয়া পরা জিরানের কথা কি ভাবে? এই বাড়িতে তাকে দরদ যদি কেউ করে তো সে এক নবিতন। মেয়েটার বিয়ে দিলাম জষ্টি মাসে, ছয় মাসের ওপর হয়ে গেলো, বেটিটাকে একবার বাড়িতে আনতে পারলাম না। হুরমতুল্লা নিজের দুই বিঘা জমি বেচে শালার হাতে তুলে দিলো বেটিকে, মেয়ে তার সুখেই থাকবে। শালাও তো তার বোন বোনাই ভাগ্নীদের জন্যে অস্থির; পোড়াদহ মেলা। লাগার তিন চার দিন আগে বোনকে নাইওর নিতে গোরুর গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে প্রতি বছর। আর এখন? বেয়াই হওয়ার পর তার চেহারাই পাল্টে গেলো। জমি বেচার টাকা। তো নিলোই, তাতেও নাকি সোনামুখী হাটে তার বেটার দোকানের সাজগোছ সম্পূর্ণ হয় না। তা হুরমতুল্লার পয়সার অভাব? কেন? জমিটা বেচে দিলেই তো হয়। তার বেটা আছে নাকি? জমি কি সে রেখে দেবে ওই মাঝির বেটার ভোগের জন্যে? দোকান সাজাবার হাউস না মেটা পর্যন্ত জামাই তার শ্বশুরবাড়ি আসবে না, বৌকেও পাঠাবে না।
দোকানদার জামাই পেয়ে হুরমতুল্লা এখনো খুশিই। চাষাভুষা কামলাপাট নবিতনটার পছন্দ নয়। মেয়েটার ছিলো সেলাইয়ের সখ, চাষার ঘরের মেয়ের হাতের কাজ যে এত চিকন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। শ্বশুর বাড়িতে সে কি সেলাইফেঁাড়াই। করার সুযোগ পায়? মেয়েটার মনটাও বড়ো কোমল গো। ফুলজানের মতো মাঠে মাঠে, জমিতে জমিতে ঘুরে সে একটা মদ্দামানুষ হয়ে ওঠে নি।—মেয়েমানুষ, তার মেয়েমানুষের মতো থাকাই ভালো, মেয়েমানুষ জমিতে কামলা খাটলে বুক পাষাণ হয়ে যায়।
আর নবিতন?—দুপুরে বাপ ঘরে ফিরলে সে তাকে আর জমিতে ফেরত পাঠাতে চায় নি, ক্যা বাজান, এই শরীল লিয়া তুমি এই গনগনা ওদের মধ্যে ফির গতর খাটাবার যাবা কিসক গো?—সেই মেয়েকে হুরমতুল্লা আজ একবার চোখের দেখাটাও দেখতে পারে না। একেকবার ইচ্ছা হয়, দুত্তোরি, ভিটার পেছনের জমিটা না হয় বেচেই দিই। কিন্তু ঘরে তার মদ্দা কিসিমের খাণ্ডারনি বেটি আছে না একটা? সেটা তার ঘরের শনি, বংশের ইজ্জত মারা ঘেগি মাগী। ঘ্যাগভরা তার খালি হিংসা আর হিংসা।
হুরমতুল্লা আড়চোখে তাকায় দিঘির পুবের দিকে। দিঘির ঢালে, নিচে এক মনে নিড়ানি দিয়ে চলেছে ফুলজান। ফুলজানের বেটি পায়ে পায়ে উঠে গেছে দিঘির ঢালে, কাঠালগাছের নিচে। এমনিতে গাছের আন্ধার, তার ওপর ঘুড়িটা হয়েছে কালো কুচকুচে। বাপ দাদার গায়ের পাকা রঙ। ছুঁড়ির বাড়ও বড়ো বেশি, কে বলবে এখনো তিন বছরে পড়ে নি? হবে না কেন? ফুলজান তো সুযোগ পেলেই বেটির মুখে ভাত ঠাসে, কেউ খাক কি না খাক, বেটিকে তার ঠিকই গেলানো চাই। সাধে কি ঘুড়িটার এরকম বাড়? যেভাবে বাড়ছে, এর বিয়ে দেওয়ার ভারও পড়বে হুরমতুল্লার ঘাড়েই। মাঝির পয়দা বেটিকে বিয়ে করবে কে? আবার রাতে বিছানা থেকে উঠে ঘুমের মধ্যেই দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে চায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মাচার তলে ঢুকে খুটখাট করে, গুড়গুড় করে হাঁটে। দাদার ব্যারামটা পেয়েছে, বড়ো হতে হতে ব্যারাম আরো বাড়বে না? তখন?-নাতনির বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বের গুরুভারে কিংবা নবিতনের শ্বশুরকে টাকা দেওয়ার ভাবনায় কিংবা দিনরাত পিপাসা পাওয়ার ব্যারামেও হতে পারে, হুরমতুল্লার মাথা নুয়ে নুয়ে পড়ে।
দিঘির পুবে পাঁচুন হাতে নিড়াতে নিড়াতে ফুলজান হুরমতুল্লাকে প্রায় সেজদা দেওয়ার মতো উপুড় হওয়া দেখে আঁচ করে, আবছা আলোয় বাপের চোখে সবই। ঝাপসা ঠেকছে। বুড়া এখন ধানগাছ উপড়ে না ফেলে। কিন্তু বাপের সঙ্গে কথা বলতে মন চায় না তার। নবিতনের জন্যে তার সোয়াগ উথলাতে দেখে ফুলজানের একেকবার ইচ্ছা করে, বাড়িতে আগুন দিয়ে, জমির গোছা গোছা ধানগাছ সব উপড়ে ফেলে বেটিকে কোলে নিয়ে সে বেরিয়ে যায় যেদিকে দুই চোখ চায়। দোকানদার জামাইকে টাকা দেওয়ার জন্যে বুড়ার গোয়া চুলকায়। আর বড়ো জামাইটা যে তার কতোদিন থেকে ঘরছাড়া, কৈ, বুড়া তো তার তত্ত্বতালাস কিছুই করে না। পালপাড়ার কেষ্ট পাল। একদিন এদিক দিয়ে কোথায় যাচ্ছিলো, হুরমতুল্লার দুয়ারে হাঁক দিয়ে জানিয়ে গেলো, কোথায়, ঠাকুরগাঁও না নাচোল না কোথায় চাষারা উৎপাত করেছিলো জোতদারদের সঙ্গে, পুলিস গিয়ে মেলা মানুষকে গুলি করে সাফ করে দিয়েছে, জেলের মধ্যেও কিছু ভরেছে। তো তাদের মধ্যে নাকি এই এলাকার চাষাও আছে। কেষ্ট পাল এর বেশি কিছু বলতে পারে না। ফুলজান তাই বাপকে একটু যেতে বললো মণ্ডলবাড়িতে। বাপজান, ওই বাড়িত গেলে ব্যামাক খবরই পাওয়া যাবি। ফুলজান বুড়াকে এমন কি তার বেটির জন্যে সরিয়ে রাখা চিড়া খাইয়ে দিলো এক পেট। বুড়া গেলোই না। তা গেলেই বা কী হতো? মণ্ডলবাড়ির পোষা গোলাম সে, গিয়ে মণ্ডলের হাগা গোয়াখান জিভ দিয়ে সাফ করে আসতো। তমিজের কথা সেখানে ভোলার মতো মুরোদ কি এই বুড়ার হতো?
আবছা আলোয় আর আবছা আন্ধারে এখান থেকে হুরমতুল্লাকে দেখায় মোষের দিঘির দক্ষিণ পাড়ের শিমুলগাছ থেকে ছিটকে পড়া ব্যারামে বুড়া শকুনের মতো। দেখে ফুলজানের হাতও ভারি হয়ে আসে। তার হাতে পাঁচুন একটি আগাছায় শিকড়ে বারবার খোঁচায়, খোঁচানোর গতি বড়ো ধীর। মাটি ও আগাছার সঙ্গে ওই পাঁচুনের ঘষাঘষিতে শোনা যায় মণ্ডলবাড়ির কাদেরের কথা, উগলান খবর কি পুলিস সব কয়? কতো মানুষ মারে, জেলেত ভরে, উগলান হিসাব কি সব রাখা যায়?
তমিজের খবর নিতে হুরমতুল্লা শরাফতের বাড়িতে না গেলে ফুলজান কী আর করে, নিজেই একদিন চলে গিয়েছিলো গিরিরডাঙায় মণ্ডলবাড়ি। কোলে তার বেটি আর কাপড়ের কোঁচড়ে লুকানো নবিতনের সেলাই-করা কথা।-পালাপাড়ার কোন বৌ পুরনো কাপড় দিয়েছিলো, পরে আর নিতে আসে নি। মনে হয় ইনডিয়া চলে গেছে। আর যদি আসেও তো ফুলজান তাকে পাঠিয়ে দেবে নবিতনের শ্বশুরবাড়ি। দোকানদার ভাতার তার নতুন কাপড় কিনে দেবে, কথা না হয় নবিতন আরেকটা সেলাই করবে।
কাদেরের বৌ কাঁথা পেয়ে মহা খুশি। তাদের শিমুলতলার কাঁথার এতো নাম, চটের ওপর উলের কাজ করা তার দাদীর মসজিদ আর চাঁদ তারা আঁকা জায়নামাজ এতোই সুন্দর যে, দেখলেই তার ওপর দুই রাকাত নামাজ পড়ে নিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু এই চাষার মেয়ে নানা রঙের সুতায় এমন করে সব পাখি, মাছ, হাতপাখা আর ফুল বুনে রেখেছে যে, একবার দেখলে আর চোখ ফেরানো যায় না।
আবদুল কাদের কিন্ত অতো খুশি নয়। কেষ্ট পালের কথা শুনে সে বলে, চাষাদের উৎপাত বন্ধ করতে পুলিসকে একটু গা ঝাড়া তো দিতেই হয়। উত্তরে আর পশ্চিমে কিছু মানুষ তো মারতেই হয়েছে, কিন্তু তাদের সবার নাম ধাম কি আর জানানো সম্ভব? তা এই নিয়ে এতো হৈ চৈ করার কী আছে? এখানে পুলিস একটা পাদ দিলেও ইনডিয়ায়। মহা শোরগোল ওঠে। আমাদের শিশুরাষ্ট্রটিকে গলা টিপে মারার জন্যে ইনডিয়া কী না করছে! পালপাড়ায় তো আবার ইনডিয়ার কাগজ ছাড়া আর কিছু ঢোকে না। কেষ্ট পাল বুঝি এইসব কথা খুব রাষ্ট্র করে বেড়াচ্ছে?
না ভাইজান। কোনো শিশুকে গলা টিপে দম বন্ধ করে মারার সঙ্গে কেষ্ট পালকে জড়াবার সম্ভাবনায় ফুলজান ভয় পায়। খুনের দায় থেকে তাকে বাঁচাতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে ফুলজান, না ভাইজান, তাই খালি কয়া গেলো কোনটে বলে পুলিসের গুলিত মানুষ মরিছে। তার মধ্যে হামাগোরে এটিকার–
হবার পারে। আবদুল কাদের আরো গম্ভীর হয়, ছোঁড়াটা এমনি খুব কামের আছিলো, কতো সুবিধা করা দিছিলাম। কোটে যায় কী করলো, আল্লাই জানে। আবদুল কাদের এবার তাকে বিদায় দেওয়ার শোভন আয়োজন করে, বৌয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, কাঁথা পছন্দ হয়েছে।
কাদেরের বৌ ফুলজানের বেটির হাতে একটা কাঁচা টাকা ধরিয়ে দেয়। কাদের দশ টাকার একটা নোট তার দিকে এগিয়ে ধরে, আগে না তোক কিছু দিছিলাম। তমিজের টাকা। কী ভেবে পাঁচ টাকার একটি নোট ফের এগিয়ে দেয়, রাখ।
এতো টাকা পেয়ে ফুলজানের বুক কাঁপে। তমিজের খবর দিতে পারে না, কাদের তাকে এতো খাতির করে কেন?
ফুলজান ফিরেই আসছিলো। তাকে ইশারায় উঠানে ডেকে নেয় মণ্ডলের ছোটোবিবি। ফুলজানের বেটিকে একটা শবরিকলা দিলে টাকাটা পড়ে যায় তার মুঠ এ থেকে। ফুলজান সঙ্গে সঙ্গে সেটা তুলে আঁচলে বাঁধে। বারান্দা ঘেঁষে উঠানের এক পাশে মোড়ায় বসে ছোটোবিবি ফুলজানকে পিড়িতে বসার ইশারা করে। ক্যা রে ফুলজান, তোর শাউড়ির খুনের মামলার কী হলো রে? তোর আগের সোয়ামি ওই বাউদাটার সাথে তোর শাউড়ির বলে কী কী আছিলো? ছিক্কা ছিক্কো! তোর শ্বশুর বলে দলদলার মধ্যে খালি দাপায়। হামাগোরে ইটের ভাটাই রাখা গেলো না, ওই জায়গাত নাকি এখন খালি আগুন জ্বলে? মনে হয়, তমিজের বাপই ওটি ইগলান করে। তুই জানিস কিছু?
ফুলজানকে এতো প্রশ্নের জবাব দিতে হয় না। তার আগেই তোমার খালি বেদাত কথা। বারান্দায় জলচৌকিতে অজু করার বদনা হাতে নিয়ে বলে ওঠে শরাফত, কবরের মধ্যে আজাব হলে মরা মানুষ দাপাবি। এর মধ্যে আবার আগুন পাও কোটে? ইটের ভাটা তুল্যা দিছি কি ভূতের ভয়ে? উগলান কথা কও, তোমার নামাজ কবুল হবি?
তুমি বাপু মেয়ামানুষের কথার মধ্যে আসসা কিসক? ছছাটোবিবির এক ধমকেই শরাফত সবটা মনোযোগ নিয়োগ করে আসরের নামাজের অজু করায়। মাস কয়েক আগে বড়োবিবি মরার পর ছোটোবিবির তিড়িংবিড়িং লাফানো বন্ধ হয়েছে, তার তেজ এখন সংহত। দুই বিবির ঠাণ্ডা ও গরম লড়াই থেকে রেহাই পাবার স্বস্তিতে শরাফত এখন ছোটোবিবির এসব বকাঝকা অকাতরে হজম করে, বরং বহুকাল বাদে এক স্ত্রী সংসারের সুখ সে ভোগ করে তারিয়ে তারিয়ে।
শরাফত ঘরের ভেতরে আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর জোরে জোরে বলে নামাজ শুরু করলে ছোটোবিবি প্রাণ খুলে কুলসুমের হত্যাকাণ্ড, কেরামতের সঙ্গে তার সম্পর্ক, পাকুড়তলা থেকে পাকুড়গাছের উধাও হওয়া, চোরাবালির ভৈতরে শুয়ে কুলসুমের কেলেঙ্কারিতে ক্ষুব্ধ তমিজের বাপের দাপাদাপি, সন্ধ্যা হলেই সেখানে আগুন জ্বলে ওঠা এবং এসবের ফলে তাদের ইটখোলা উঠে যাওয়া প্রভৃতি বিষয়ে নানাকরম প্রশ্ন করে এবং প্রত্যেকটি প্রশ্নের জবাব দেয় সে নিজেই। ফুলজান উঠে দাঁড়ালে তার হাতে সের তিনেক চিড়ার একটা পুটলি দেয়, তোক দিয়া চিড়া কোটালাম। তোর চিড়া খুব ভালো হছিলো রে। তোর বেটিক খিলাস। বলতে বলতে তার বাৎসল্য উথলে ওঠে, তমিজের নামে মিলাদ পড়াস রে। যা শুনি, ওদিককার খবর ভালো লয়।
নতুন ধান উঠলে গত পৌষে চিড়া কোটার জন্যে মণখানেক পানিশাল ধান পাঠিয়ে দিয়েছিলো ছোটোবিবি। টাকাও দিয়েছিলো আগাম। মণ্ডলের টেকি তো সব ব্যস্ত থাকে। চাল কোটায়। আর এখানে ধান ভানে সব মাঝিপাড়ার বৌঝিরা, চিড়া কোটার তারা জানে কী? চেঁকির পিছাড়িতে তাদের এলোমেলো পায়ের চাপে কেঁকির মুগুরটা গড়ের মধ্যে পড়ে ধাপ দুপ করে, ধানটা ভাজাও তাদের ঠিক হয় না। তাদের চিড়া হয় ফেটে যায়, না হয় চিটকা চিটকা হয়। মণ্ডল বাড়ির চিড়া তাই কোটা হয় সব হুরমতুল্লার বাড়িতে। তা ফুলজান নিজেই সের চারেক চিড়া সরিয়ে রেখেছিলো, ছোটোবিবি তো আর মেপে দেখে নি। বেটির জন্যে রাখা চিড়া খাইয়ে দিলো বাপকে। বাকিটা রেখে দিয়েছে তার মাচার নিচে হাঁড়ির ভেতর; গোখরা সাপ বেরুবার পর তার বাপ সেই মাচায় আর শোয় না, সেখানে থাকে এখন ফুলজান। একদিক থেকে ভালোই। ওর তলায় হাত দেওয়ার সাহস কারো নাই। এখন এই পুটলিটা যে কত্তো দিন ওখানে লুকিয়ে রাখতে হয় কে জানে? এই সের তিনেক চিড়া তমিজের চার বেলার নাশতা। আর খেতলালের গুড় হলে তিন বেলাতেই সাপটে দেবে। মাঝির বেটা মানুষটা এতোও খেতে পারে গো!—তমিজের নামে। এরা মিলাদ পড়াতে বলে কেন?-এই মানুষ পুলিসের গুলিতে মরবে? অতোই সোজা? মণ্ডলবাড়ির সব মানুষ চাইলেই, কালাম মাঝি চাইলে, আমতলির দারোগা চাইলেই কি আর তমিজ মরে?-ফুলজানের গালে ঘ্যাগে গলায় বুকে তমিজের গরম নিশ্বাস এসে লাগে কতোদূর থেকে। একেকবার মনে হয়, কতো বা বচ্ছর পার হলো! আবার কখনো চমকে ওঠে, সারা গা তার গনগন করে তমিজের নিশ্বাসের শিখায়। শিখাতেই হয়তো ফুলজান চমকে উঠে তাকায় একটু দূরে। হুরমতুল্লা সেখানে বসে বসে ঝিমাচ্ছে।
মগরেবের ওকতো গেলো। বস্যা টোপ পাড়া?
ফুলজানের শুকনা গলা শুনে আকাশের দিকে মুখ তুলে হুরমতুল্লা ফের সচল হয়ে ওঠে। আজ বুঝি পূর্ণিমা। তামাম ধানখেতের ওপর যেন চালের পিটুলি দিয়ে লেপে দেওয়া হয়েছে। আর চাঁদ থেকে দুধ পড়ছে, তাই সারাটা ধানখেত জুড়ে দুধের হালকা সুবাস। ফুলজানের বেটিটা এতোক্ষণ না খেয়ে আছে। দুধের গন্ধে তার নিশ্চয় খিদে পাচ্ছে। দুধ দিতে না পারুক, কাউনের চালের ভাত তো দুটি মুখে দিক। নিড়ানি দিতে দিতেই সে বলে, ঘরত যা। তোর বিটির খিদা নাগিছে না?
বুড়ার খেয়াল শুধু তার বেটির খিদার দিকে, কার্তিক মাসে দুটো কাউনের চালের ভাতই তো খায়, বুড়ার তাও সহ্য হয় না। বাপকে ভালোমতোন একটা খোঁচা দিতে তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, জবাব দেয়, কাম থুয়া উঠি ক্যাংকা করা? বেন থ্যাকা তো মেলা মানুষ যায় এবিন দিয়া। কাম আগায়া থুই। কাম তো হামার করাই লাগবি।
তার মেয়ের খিদের কথা বলে হুরমতুল্লা আসলে খোঁচা দিয়ে ফেলেছে ফুলজানের পেটেই। ফুলজানের নিজেরই বেজায় খিদে পেয়েছে বলতে গেলে দুপুরে ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই। কাউনের চালের খসখসে ভাত হজম হয়ে পেট তার সেঁধিয়ে গেছে পিঠ বরাবর। বাড়ি ঢুকে খেতে তো হবে সেই কাউনের ভাতই, তাও এই বেলার খোরাকি আধপেটার বেশি নয়। খেসারির ডাল থাকলে ভাতটা নরম হয়, ঘরে খেসারি। পর্যন্ত নাই। খেসারির ডাল ছাড়াই খসখসে কাউনের ভাতের ভাবনাতেও তার খিদে এতোটুকু কমে না। তখন সবটা মন দিতে হয় নিড়ানির দিকে। কিন্তু বেটির জুলুমে কামের দিকে মন দেওয়ার জো আছে তার? মেয়েটা তার কথা কয় কম, এই বয়সের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু স্বভাবটা বড়ো ছটফটে। কোথাও এক মুহূর্ত বসে থাকতে পারে না, সবসময় এদিক ওদিক করছেই। এই তো কিছুক্ষণ আগে বেশ খেলছিলো মায়ের পাশে বসে। আবার এখন মায়ের কাধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ও মা, খিদা নাগিছে, ভাত খামো।কথাটা একবার বলেই মায়ের মাথায় হাতের চাপ দিয়ে তাগাদা দিতে লাগলো। তবে এখন ওকে ভাত দেওয়া চলবে না। এখন খেলে রাত না। পোহাতেই বিছানায় শুয়েই বেটি ঠেলতে শুরু করবে ফুলজানকে। একবার মাত্র মা ভাত খামো বলে সে অবিরাম ঠেলা দিতেই থাকলে ফুলজান কিছুতেই কথা না বললে কিংবা তার ঘুম না ভাঙলে মাচা থেকে উঠে বেটি তার ঢুকে পড়ে মাচার নিচে। তমিজকে খুঁজতে পুলিস এলে ওখানে গোখরা বেরিয়েছিলো। মাটির নিচে নাকি আরো সাপ থাকতে পারে। ফুলজানের ভয় করে। না, এখন বেটিকে কিছুতেই ভাত দেওয়া চলবে না।
ফুলজান তাই মাথা থেকে ঝামটা দিয়ে সরিয়ে দেয় মেয়ের ছোটো ছোটো হাত দুটো। তাতে ঝামেলা বরং বাড়ে। বেটি তার সোজা হাঁটা দেয় দিঘির ঢালের দিকে। মোষের দিঘির উঁচুপাড়ে লম্বা তালগাছের নিচে পুরনো উইঢিবিতে ওঠার ঝোঁকটা তার একটু বেশি। উইটিবির সামনে হাত তিনেক জায়গা, হুরমতুল্লা মাঝে মাঝে মগরেবের নামাজ পড়ে ওখানে। নিচেই খাড়া পাড়, সেখান থেকে পা হড়কে গেলে গড়িয়ে পড়বে পুকুরের পানিতে। তখন? ফুলজান তাই নিড়ানি বন্ধ রেখে বেটিকে ধরতে ছোটে দিঘির ঢালের ওপর দিয়ে।