বাড়ির সামনে কনকচাঁপা ও গোলঞ্চ, গেটের দুই পাশে কামিনী এবং পুকুরঘাটে জোড়বকুলের গোড়ায় মাটি খুঁচিয়ে, মাটির সঙ্গে নানারকমের সার মিশিয়ে প্রতিদিন দুই বেলা পানি ঢেলে ফাল্গুনের মাঝামাঝি বিশ পঁচিশ বছরের গাছগুলোকে রঙবেরঙের ফুলে সাজিয়ে তোলায় তমিজ এখন ইসমাইল হোসেনের বাড়িতে খাতির পায়। ম্যাগনোলিয়ার দুটো কলম নিয়ে আসা হয়েছিলো কলকাতা থেকে, চার বছরে সেটার বাড় বুঝতে ইয়াকুব বাড়ি এসে প্রত্যেক দিন স্কেল দিয়ে মাপতো। তমিজকে পেয়ে ইয়াকুব সেটার পেছনে এমনভাবে লেগেছে যে বর্ষার শুরুতে ফুল না ফুটিয়ে গাছ দুটোর আর রক্ষা নাই। শীতের মরশুমি ফুল ভালো করে ঝরে পড়ার আগেই ইয়াকুব সেগুলোকে ঝোপজঙ্গল আখ্যা দিয়ে সাফ করে ফেললো। এখন সেখানে গোল, চারকোণা ও তিনকোণা কেয়ারি কাটা শুরু হয়েছে। মাটি আচ্ছাসে কুপিয়ে গোবরের সঙ্গে মেশাবার জন্যে ইয়াকুব যে কতো কিসিমের সারই নিয়ে আসে তমিজ একশো এক বার শুনেও সেসবের সায়েবি নাম মনে রাখতে পারে না।
মনে রাখার চেষ্টাও করে কি-না সন্দেহ। এই খাটনিটা ধানজমির পেছনে খাটলে গিরিরডাঙা আর নিজগিরিরডাঙার চাষাদের চোখ জুড়িয়ে যেতো ফসলের ফলন দেখে। টাউনের ভদ্দরলোকদের মাথায় কী পোকা যে আছে তমিজ তার হদিস করতে পারে না। ধান, নয়, পাট নয়, পেঁয়াজ রসুন নয়, আলু নয়, আনাজ তরকারি নয়, খালি ফুলের পেছনে এতো টাকা নষ্ট করার কোনো মানে হয়? মাটিতে সার মেশাতে মেশাতে তমিজের হাত আলগা হয়ে আসে : এবার হুরমতুল্লার ভিটার পেছনে পেঁয়াজ রসুন তোলার পর সে আউশ বোনার হাউশ করেছিলো। এখন ওই জমি তৈরির সময় চলে যাচ্ছে। জীবনে পেঁয়াজ রসুন ছাড়া হুরমতুল্লা ওই জমিতে আর কিছু আবাদ করে নি। চাষার ঘরের মানুষ বলে তাদের এতো ােেয়াব, কিন্তু জমির রঙ দেখে এই তমিজই প্রথম বোঝে, ওখানে আউশের খন্দ ভালো হবে। বিয়ের রাতেই ফুলজানকে ওই জমিতে লাঙল দেওয়ার কথা সে বলেছিলো। ফুলজানের মনে থাকলেও কাজ হয়।
বিকালবেলা ইয়াকুব হোসেন বোঝায়, তোমার ঐ চাষাড়ে হাত দুটো একটু নরম করে। এই সার মেশাতে হয় মিহি করে। তার হাতে চাষার লক্ষণ দেখায় তমিজ ইয়াকুবের দিকে তাকায় গদগদ হয়ে; কিন্তু তার সব ক্ষমতা কি ফুরিয়ে যাবে এই ফুল গাছের তোয়াজ করে করে?
ঘড়ি লাগানো কবজির নিচে লম্বা লম্বা ফর্সা আঙুল-জোড়ানো লালচে হাতে মিহি করে সার মেশাবার কৌশল শেখায় ইয়াকুব। বলে, নিবারণকে একদিন খবর দিলেই ও এসে তোমাকে দেখিয়ে দেবে।
ভাইজান, আরে আপনে মাটিত হাত দেন? তমিজ করে কী? এই অনুযোগ শুনে ইয়াকুব পেছনে তাকালে দেখতে পায় আবদুল কাদেরকে। কিন্তু তার মনোযোগ অব্যাহত থাকে কেবল তমিজের দিকেই। তাকে নতুন কাটা কেয়ারির অসমান রেখা দেখিয়ে বলে, কোদাল কোপাবার আগে খুরপি দিয়ে লাইন কেটে নিতে বললাম না?
আবদুর কাদের বলে, তমিজ, ইয়াকুব ভাই মিলিটারির অফিসার আছিলো রে, তার কামোত ফাকি দিবার পারবু না। এটি কয়দিন থাকলে কাম শিখবার পারবু, তখন গাঁওত যায়া আর নাঙল ঠেলা লাগবি না।
ইয়াকুব আবদুল কাদেরের দিকে তাকিয়ে একটু হেসেই ঠোঁটজোড়া গুটিয়ে ফেলে। এদের সে বেশি পাত্তা দেয় না। বড়দার কাছে এসব লোক যখন তখন আসে বলেই বাড়ির বাগানটার হাল এই হয়েছে। তবে বড়দা তো ঢাকায় ইয়াকুবের হাসি মুখে এই ঠাণ্ডা খবরে কাদেরের খুব একটা এসে যায় না। সে আজ দেখা করতে এসেছে এদের। বাপের সঙ্গে, হেঁ হেঁ, জ্যাঠো, মানে আপনার পিতার সাথে একটু দেখা করার দরকার ছিলো। মানে—
ও। বলে ইয়াকুব ধীরেসুস্থে হেঁটে বারান্দায় উঠে বাড়ির ভেতরে চলে গেলে কাদের আরাম পায় : ইসমাইল ভায়ের এই ভাইটা এমনিতে ভালো, ব্যবহার বেশ ভাললাই, কিন্তু গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বেশিক্ষণ মিশতে পারে না। এখনি হৃষিকেশ মৈত্রের ছেলে অনিল কি আজিজ ডাক্তার আসুক, তাদের সঙ্গে ইয়াকুবের গলার হো হো হাসি শোনা যাবে একেবারে টাউনের মাঝখান থেকে। সে বাপু যাই হোক, এম টি হোসেনের সঙ্গে কথা না বলে কাদের আজ এখান থেকে নড়ছে না।
ফুলজানের বাপের সাথে কথাবার্তা ছিলেন ভাইজান? জমি দেওয়ার ওয়াদা করিছিলো। তমিজ ব্যাকুল হয়ে হুরমতুল্লার জমি সম্বন্ধে জানতে চাইলে কাদের এই কয়েক মিনিটের মধ্যে তাকে দ্বিতীয়বার ধমক দেয়, আরো রাখ। যদ্দিন পারিস এটি থাক। এস পি সায়েবেক অনেক ধরাধরি কর্যা পুলিসেক আটকা রাখা হছে। এটি থ্যাকা বারালেই তোক থানার মধ্যে তুলবি। ও দিকে কালাম মাঝি আটো হছে, মাঝিপাড়ার মানুষ তাক আর দেখবারই পায় না। মুকুন্দ সাহার দোকান দখল করার তালে আছে, তার লিজের মানুষই তার সাথে কেউ নাই।
এসব কথা তমিজের কানে ঢোকে কি-না সন্দেহ। সে বলে, আর কয়টা দিন গেলে আউশের জমিত নাঙল দেওয়ার সময় পার হয়া যাবি না? তমিজের কথায় কাদের বিরক্ত হয়, আবার ছোঁড়াটার ওপর মায়াও হয়। ইসমাইল হোসেন এই ছেলেটা সম্বন্ধে একটু দুর্বল।-ভোটের আগে তমিজ জেলে না থাকলে তার মুক্তির জন্যে ওয়াদা করা যেতো কীভাবে? মাঝিপাড়ার ভোট সব তার বাকসে পড়েছে এই ছোঁড়াটার জন্যে। এবার তার পেছনে লেগেছে কালাম মাঝি। কালাম মাঝিটা যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তাতে ইসমাইল হোসেনের আর কী এসে যায়, কিন্তু কাদেরকে একটু হুঁশিয়ার তো থাকতেই হয়। সামনে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইলেকশন, সেখানে কালাম মাঝি ছাড়া কাদেরের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে আর কে? তমিজটাকে কাদের হাতে রাখলে কালাম মাঝি গ্রামে দূরের কথা নিজের আত্মীয় স্বজনের ভোট পর্যন্ত পাবে না। ইসমাইল ভায়ের হাতে পায়ে ধরে, এটা ওটা বুঝ দিয়ে কাদেরই তমিজকে নিয়ে এসেছে এখানে। এখন দেখা যাচ্ছে এই বাড়িতে তার খাতির বেশ ভালোই। ইয়াকুবের সঙ্গে সঙ্গে বাগান করে। বাড়িতে মূলতানি গাই আছে দুটো, তাদের যত্ন নেওয়ার ভারও পেয়েছে তমিজ। গোবু দুটোর জন্যে ইসমাইল হোসেনের মায়ের বড়ো দুরদ। সেই দরদের সামান্য হিস্যা যদি তমিজের কপালে জোটে তো এই বাড়িতে তার কায়েমি আসন টলায় কে? অথচ দেখো, তমিজের বাপের বোকা বেটাটা মরার জন্যে বাড়ি যেতে পাগল হয়ে উঠেছে। কাদেরের রাগই হয়, বাড়িত গেলেই তোক জমি দিবি কেটা? তুই হুরমতুল্লার বেটিক বিয়া করলু, বাপজান সামনের খন্দ হুরমতুল্লাক করবার দেয় কি-না কওয়া যায় না। তখন হুরমতুল্লাক নিজের জমি আবাদ করা লাগবি না?
কিন্তু তমিজটা একেবারে নাছোড়বান্দা, আপনেরা না কছিলেন জমির উপরে বর্গাদারের হক কায়েম করার আইন জারি হবি? ফুলজানের বাপেক আপনের বাপজান জমি থ্যাকা উঠায় ক্যাংকা করা?
আবদুর কাদের রাগ করলেও হেসে ফেলে, তোর বাপু এতো কথাও মনে থাকে? তোক এম এল এ করা লাগে। কাদের হো হো করেই হাসে। হাসিটা তার এখনো ইসমাইল বা ইয়াকুব বা এদের বাপের মতো অতোটা উচ্চকণ্ঠ না হলেও বেশ দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সেই খানদানি হাসির অনুশীলন করতে করতেই জানায়, দুই বছর আগে এ্যাসম্বলিতে জমিদারি উচ্ছেদের বিল উঠলে বর্গাদারদের সম্বন্ধে ঐ ধরণের একটা কথা ছিলো। ঐ বিল তো আবার উঠিছে, এই তো কয়দিন আগেই উঠলো। এবার বর্গদারের বথা বাদ দিছে।
বাদ দিছে? তমিজের হাত থেকে মিহি করে সার মেশানো মাটি পড়ে যায় ঘাসের ওপর। এক আইন আবার দুইবার দুই রকম হয় কি করে? হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না,-ভদ্দরলোকদের এই বচন কি ভদ্দরলোকরাই খারিজ করে দিচ্ছে?
কাদের তাকে তাড়া দেয়, দেখ তো বাপু, বুড়া সায়েবকে খবর দে একটু।
কথাটি তমিজের কানে ঢোকে না, সে জানতে চায়, তেভাগা হলেও কাম হয়। তেভাগা তো হচ্ছেই, না?
এ কথা সে কথা, দে বুড়ি আলাপাতা। কাদের তমিজের একটি ব্যাপারেই লেগে থাকা নিয়ে হাসে, তোর খালি এক কথা। উগলান তো সব শ্যাষ হয় গেছে বাপু। নাচোলের দিকে এখানো মাথা গরম কিছু চ্যাংড়া।
লাটোর? জায়গাটার নাম জানা থাকলেও এর অবস্থান সম্পর্কে তমিজের ধারণা অস্পষ্ট, কিন্তু সেটা সে স্বীকার করবে কেন? লবাবগঞ্জ তো? চিনি না? জয়পুরেত যখন ধান কাটিচ্ছিলাম তখনি তো ওটি জোতদাররা সব দৌড়াচ্ছিলো পাছার কাপড় তুল্যা।
উগলান দিন শ্যাষ। এখন বাপু বাড়ির মধ্যে খবরটা দে। হামি বারান্দাত বসি।
খিড়কির দরজা দিয়ে তমিজ বাড়ির ভেতরে গেলে কাদের বারান্দার চেয়ারে বসে বাড়ির লনটা দেখে। চোখ জুড়িয়ে যায়। খোলা গেটের ওপারে চওড়া কাঁচা রাস্তা। ঐ রাস্তা ধরে মিনিট দশেক হাঁটলেই নদী, খেয়া নৌকায় নদী পার হলেই জমজমাট টাউন। এদিকে একটা জমি কিনে বাড়ি করতে পারলে হতো। আবদুল আজিজ বাড়ি কিনলো। টাউনের আরেক প্রান্তে ঘিঞ্জি এলাকায়। চারদিকে হিন্দু বাড়ি। পার্টিশনের আগে ওখানে তো মোসলমানকে বাড়ি ভাড়াও দেওয়া হতো না, এখন দুই একটা মোসলমান বাড়ি কিনে কিংবা দখল করে ঢুকতে শুরু করেছে। তবে শরাফত মণ্ডল ঠিকই বলে, হিন্দু প্রতিবেশী থাকা ভালো। উঁচু জাতের শিক্ষিত হিন্দু পাড়ায় থাকলে বাড়ির ছেলেমেয়েরা বয়ে যায় না। আর পাকিস্তানে হিন্দুরা তো একটু ছোটো হয়েই থাকবে, ওদের দাপটটা সহ্য করতে হবে না। নতুন যারা আসবে, তাদের বেশির ভাগই লুটপাটের পাট্টি, পাড়াটা নষ্ট করে দেবে।
এই শহরতলী এলাকায় এম টি হোসেন বেশ মাথা উচু করেই আছে। এ দিকেও সব বামুন কায়েত আর বৈদ্যের বসবাস; কিন্তু পাড়ার ক্লাবঘরটা এই বাড়িতেই। ক্লাবে আসে তো উচু জাতের হিন্দুই বেশি। কী সুন্দর হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে ইয়াকুব হোসেনের খাতির!
আপনাক ঘরত বসবার কলো, তমিজের কথায় আবদুল কাদের হলঘরে ঢোকে। ইসমাইল হোসেন ঢাকায়, সুতরাং বাড়ির হলঘর খালি। এই ঘর কাদের কখনো এরকম খালি দেখে নি। দেওয়ালের শেলফ ভরা সারি সারি বই, ইংরেজি বাংলা বইতে শেলফগুলো ঠাসা। পাল্লা খোলা পেয়ে, একটা শেলফের সামনে দাঁদিয়ে কাদের বই নাড়াচাড়া করে। চামড়ায় বাঁধানো ইংরেজি ম্যাগাজিন, পাশে ইংরেজিতে এম টি হোসেনের নাম খোদাই সোনালি অক্ষরে। কাদেরও টাউনে বাড়ি করলে এরকম সাজানো বইয়ের আলমারি করবে।
আরে কাদের নাকি? বসো বসো। এম টি হোসেন ঢুকে প্রথমেই তার খোেলা শেলফের পাল্লা বন্ধ করে, তালাচাবিও লাগায়। কাদের একটু ধাক্কা খেলেও বাঁধানো বই সাজানোটা ভালো করে দেখে নেয়।
এম টি হোসেন কাদেরের কাছে তাদের গ্রামের খবর জানতে চায়। তবে গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙা, গোলাবাড়ি এলাকার খবর তার মোটামুটি সবই জানা। আবদুর কাদেরের বাবা মুকুন্দ সাহার বাড়ি কিনেছে পানির দামে, কালাম মাঝি আছে। তার দোকানটা দখল করার তালে, বুড়ার অজানা নাই কিছুই। তার আক্ষেপ, ইসমাইল হোসেন টাউনে কি ঢাকায় একটা বাড়িঘর কিছুই করলো না। বড়ো বড়ো বাড়ি ফেলে রেখে হিন্দুরা চলে যাচ্ছ। এই সময়, ঠিক আছে ন্যায্য দামেই, কিছু সম্পত্তি কেনো। টাকা কম পড়লে এম টি হোসেনই না হয় কিছু দেবে। পরে এই সুযোগ কি আর পাওয়া যাবে?-না, এসবের মধ্যে সে নাই। এতাই যদি সাধু হও তো চেলাচামুণ্ডারা যে লুটপাট করে তাদের তো বাধা দিতে পারো না। তা হলে এই সততার মানে কী?
ইসমাইল হোসেনের চেলাদের মধ্যে কাদের প্রথম চার পাঁচ জনের মধ্যেই পড়ে। বুড়া আবার তার বাপের দৃষ্টান্ত না দেখায় তাই তার আক্ষেপে কাদের পুরো সায় দেয়, ভাইজানের তো লিজের দিকে নজর নই। শামসুদ্দিন ডাক্তার, সাদেক উকিল, সামাদ। খান, মফিজুল হক,-এরা তো সম্পত্তি করিচ্ছে দুই হাতে। তা ধরেন,–।
এর মধ্যে পরোটা ও গোরুর গোশতের ভুনা এসে পড়লে কাদের বলতে গেলে একাই প্রায় সবটা সাবাড় করে। খাওয়ার তৃপ্তিতে ও নিজের আরজি পেশ করার প্রস্ততিতে কাদের দুটো ঢেকুর তোলে। কী ব্যাপার? কাদের জানায়, শিমুলতলার তালুকদার বাড়ি থেকে কাদেরের একটা সম্বন্ধ এসেছে। আজ পয়গাম নিয়ে যাবে তার বাবা শরাফত মণ্ডল। মেয়ে দেখা হবে, পাকা কথাও হবে। সঙ্গে লোকজন যাবে খুব কম। শরাফত মণ্ডল তো যাবেই। কাদেরের মা তো আবার দুইজন, বলে লজ্জায় মাথাটা নিচু করে একটু হেসে লজ্জাটা ফেরে কাটিয়ে উঠে সে জানায়, দুই মা যাবে, আবদুল আজিজ যাবে, আজিজের শালা সম্বন্ধী যাবে জনা চারেক, আজিজের শাশুড়িকেও নিতে হবে। আজিজের বড়ো সম্বন্ধীর বৌ যেতে পারে। কন্যা দর্শনার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা শোনা থামিয়ে ইসমাইলের বাবা বলে, শিমুলতলার তালুকদারদের কার মেয়ে?
জি, ইসমাইল ভায়ের শ্বশুরের বংশই। মেয়ের বাপকে আপনে চেনেন। আজহার তালুকদার। পুরানা ঘর।
আর পুরানা ঘর! এখন টাকা হলে পুরানা ঘর বংশ সব কেনা যায়।
মনটা একটু ছোটো হয়ে গেলেও কাদের হাত জোড় করে আরজি করে, এম টি হোসেন সাহেব তকলিফ করে তাদের সঙ্গে মেয়ের বাড়িতে যদি একটু তশরিফ নেয় তো কাদের একজন খানদানি, বিচক্ষণ ও বিবেচক মুরুব্বি পায়। তার বাবা শরাফত মণ্ডল নিজে এসে তাকে নিয়ে যাবে। সব মিলিয়ে ঘণ্টাখানেকের ব্যাপার।
এম টি হোসেন এক কথায় রাজি হলে আবদুল কাদের তাদের মজহাবের। রেওয়াজের বাইরে উঠে দাঁড়িয়ে তাকে কদমবুসি করে এবং তার স্বভাবের বাইরে তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চোখের সঙ্গে সঙ্গে কানেও পানি জমে থাকতে পারে, কারণ এর পর ঐ সৌম্যদর্শন বৃদ্ধের কোনো কথাই সে শুনতে পায় নি।
বাড়ির গেটে কামিনী গাছের গোড়ায় তমিজকে বসে থাকতে দেখেও কাদেরের আবেগ উথলে ওঠে, তমিজ, এটি আছিস, ভালো করা থাক। ইসমাইল ভাইয়ের বাপ তো ফেরশতার লাকান মানুষ রে। এংকা মানুষ হয় না। হুশিয়ার হয়া থাকিস। দেখি। তোর নামে মামলাটা খারিজ করার চেষ্টা তো করিচ্ছি। ইসমাইল ভাই ঢাকা থ্যাকা আসুক। আর শোন। এটা রাখ। পকেট থেকে আস্ত একটা আধুলি তমিজের হাতে দিতে গিয়েও ফিরিয়ে নেয়, না। এটা আমার কাছে থাক। পাকিস্তানের নয়া আধুলি। হুকুমতে পাকিস্তান কিছুদিন আগে নতুন টাকা ছেড়েছে, আস্তে আস্তে পুরোনো টাকা তুলে নেওয়া হবে।
মুগ্ধ চোখে চকচকে আধুলিটা দেখে পকেট রেখে কাদের তমিজের হাতে তুলে দেয় দুটো সিকি, কি ভেবে ফের একটা দুআনিও খুঁজে দিলো।।
লুঙির কোচড় থেকে তমিজ বার করে পাঁচ টাকার একটা আস্ত নোট; সেই নোট আর রেজকি গুনে কাদেরকে দিতে দিতে বলে, আগে আপনার কাছে রাখিছিলাম তিন আনা কম সাত টাকা, আবার এখন আপনে দিলেন দশ আনা, আবার হামি এখন দিচ্ছি আট টাকা ছয় আনা,কতো হলো? সাতে আটে পনেরো আর ওদিকে।
হিসাবটা কাদের তাড়াতাড়ি করতে চায, পনেরো টাকা এগারো আনা।
ক্যাংকা কর্যা? তমিজ ফের প্রথম থেকে যোগ করে এবং যোগফল কাদেরের হিসাবের সঙ্গে মিলে গেলে নিশ্চিন্ত হয়, হুঁ, পনেরো ট্যাকা এগারো আনা। আপনে আর পাঁচ আনা পয়সা দিলে ষোলো ট্যাকা সই সই হয় ভাইজান!
কাদের সঙ্গে সঙ্গে তাকে পাঁচ আনা দিলে সেটাও কাদেরের কাছে রেখে তমিজ বলে, আর বেশি লাগবি না। কিছু জমলেই বাড়ির ভিটাটা কালাম মাঝির কাছ থ্যাকা খালাস করবার পারি। ফুলজানের বাপ জবান যখন দিছে, জমি তো তার দেওয়াই লাগবি। ঐ জমিত দুইটা খন্দ করবার পারি তো ভিটার পিছনের জমিটা আপনাগোরে কাছ থ্যাকা লিবার পারি, না? আপনে কলেই ওটা পাওয়া যাবি ভাইজান। হামার ঐ জমিত আমন হবি খুব ভালো, উঁচু জমি। কয়টা খন্দ করলেই–।
যাই রে। তুই থাক।। কাদের যাবার জন্যে পা বাড়ালে তমিজ ফের বলে, ঐ ট্যাকা থ্যাকা আপনে দুইটা ট্যাকা ফুলজানের হাতোত দিয়েন। আর টাউনের বাজার থ্যাকা হামার বেটির একটা পিরান লিবেন দশ আনার মধ্যে। তাহলে আর কতো থাকে?
তোর বেটি হছে নাকি? এতো বড়ো একটা খবর কাদের জানতো না বলে তমিজ এতোটাই অবাক হয় যে, তার পেটের মধ্যে বুদবুদ-ােলা বেটিটাক চোখের দেখাও দেখবার পারলাম না। কী খায়, কী পরে-কথাগুলো পেটের আরো ভেতরে ড়ুবে যায়, গলা পর্যন্ত আর আসে না। এর বদল বেরিয়ে আসে, বেটির পিরান দশ আনা আর ফুলজানের হাতোত দিলেন দুই ট্যাকা, না আবোরা আট আনা দেওয়া ভালো। কতো হলো?-–
কিন্তু কাদেরের বড়ো তাড়া। বাপ বোধহয় তার এসেই পড়েছে আজিজের বাড়িতে। তাকে নিয়ে দুপুরের পর পরই ফের আসতে হবে এখানে। তারপর মেয়ে দেখতে নামাজগড় যাওয়া। রূপমহল থেকে শরাফত আংটি একটা কিনেছ। মিষ্টি নিতে হবে ভালো দেখে, পরিমাণেও বেশি হওয়া চাই—শিমুলতলার তালুকদারদের বাড়ি। মেয়ের গায়ের রঙ শ্যামলা শুনে কাদেরের মন উঠছিলো না, শ্যামলা বলা মানে কালোই। কিন্তু শরাফত মণ্ডল একেবারে পাগল হয়ে উঠলো; ঐ বাড়ির কালো কেন, খোড়া কানা মেয়েও ঘরে নিয়ে এলে জেলার পুব এলাকার সবখানে তার ইজ্জত বাড়ে। আজহার মিয়া একটু দূরের হলেও তালুকদার বংশেরই তো। বিয়েতে, আকিকায়, ঈদে, বকরিদে, জানাজায় দাফনে সবাই মিলিত হয়। তালুকদারদের সাজানো গোছানো গোরস্তানেও এদের সমান হিসা্য। তা কাদের দেখলো, বাপকে আর এই নিয়ে চটিয়ে। লাভ কী? নামাজগড়ে আজহার মিয়ার মাটির দোতলা বাড়িটা এই মেয়েই পাবে শুনে আপত্তি করার আর কোনো কারণই থাকলো না। আবার বিয়েটা হলে ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে লতায় পাতায় একটা কুটুম্বিতাও হয়।
বাপজান বোধহয় টাউনে এসেই পড়লো। তমিজের হিসাবনিকাশ কাদেরের কানে ঢোকে না। তবে এম টি হোসেনের প্রতি টইটম্বুর ভক্তির খানিকটা সে খালাস করে তমিজের জন্যে উদ্বেগ জানিয়ে, তমিজ, একটা কথা কই। আজ বাপজান এই বাড়িত আসবি, আসরের নামাজ পড়বি এটি অ্যাসা। ইসমাইল ভায়ের বাপ দাওয়াত করলো, না আসলে বুড়া মানুষটা মন খারাপ করবি। বাপজান আসলে তুই আড়ালে থাকিস। তোক এটি দেখলে আমার সাথে সাটাসাটি করবি। বাপজানেক তো চিনিস।
তমিজ তার হিসাব করেই চলে, ধরেন বেটির পিরান না হয় বারো আনা দিয়াই কিনলেন আর ফুলজানকে ট্যাকা দিলে আপনের কাছে জমা থাকে কতো? আর কয়টা ট্যাকা হলে ভিটার জমিটা খালাস করি। আর আপনে ভালো করা বুঝায়া কন তো আপনার বাপজান। হিসাব নিকাশের নিষ্পত্তি না করেই কাদের রওয়ানা হয় আজিজের বাড়ির দিকে।