২.৩১
পরদিন সকাল সকাল পৌঁছে যাই গ্রোভে। ঠিক করেছি বার্বির বলা কথাগুলো নিয়ে আলাপ করবো অ্যালিসিয়ার সাথে (মানে আমিই যা বলার বলবো, সে শুনবে)। কিন্তু রিসিপশনে ঢোকা মাত্র একটা বিকট চিৎকার শুনতে পেলাম। গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছে কেউ। পুরো করিডোরে ভেসে বেড়াচ্ছে সেই আর্তনাদ।
“কি হয়েছে?”
আমার প্রশ্ন আমলে না নিয়ে দ্রুত ওয়ার্ডের দিকে ছুটে গেল নিরাপত্তা কর্মী। আমিও গেলাম তার পিছু পিছু। যতই সামনে এগোচ্ছি, চিৎকারের মাত্রা বাড়ছে। আশা করি অ্যালিসিয়া ঠিক আছে, এসবের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু কেন যেন মনে কু ডাকছে।
ডান দিকের করিডোরে পা রাখলাম। নার্স স্টেশনের বাইরে ভিড় জমিয়েছে সবাই। ডায়োমেডেস ফোনে প্যারামেডিকদের সাথে কথা বলছেন। তার শার্ট ভিজে গেছে রক্তে, তবে রক্তগুলো তার নয়। দুজন নার্স হাঁটু গেড়ে বসে আছে মেঝেতে চিৎকাররত মহিলার পাশে। কিন্তু অ্যালিসিয়া নয় সেটা।
এলিফ।
প্রচণ্ড যন্ত্রনায় ডাঙায় ভোলা মাছের মত তড়পাচ্ছে এলিফ, চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে তার। কিছু একটা গেঁথে আছে ডান চোখে। প্রথম দেখায় কাঠি মনে হলেও ভালো করে তাকাতে বুঝে গেলাম জিনিসটা কি। একটা তুলি।
অ্যালিসিয়া দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের পাশে। ইউরি এবং আরেকজন নার্স শক্ত করে ধরে রেখেছে তাকে। তবে ধরে না রাখলেও কোন অসুবিধে ছিল না। একদম শান্ত সে। তার ভাবলেশহীন চেহারা অ্যালসেস্টিস ছবিটার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। এই মুহূর্তে তার দৃষ্টি আমার দিকে।
অস্বীকার করবো না, প্রথমবারের মত কিছুটা ভয় পেলাম।
.
২.৩২
“এলিফ কেমন আছে?” ইউরিকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড থেকে ফিরতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম। নার্স স্টেশনে বসে আছি এখন।
“কিছুটা ভালো,” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল সে। “পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়াবে না আশা করি।”
“ওর সাথে দেখা করতে চাই আমি।”
“এলিফ, নাকি অ্যালিসিয়া?”
“আগে এলিফের সাথে।”
মাথা নাড়লো ইউরি। আজকের রাতটা ওকে বিশ্রাম নিতে হবে। কালকে সকালে তোমাকে নিয়ে যাবো ওর কাছে।”
“কি হয়েছিল? তুমি ছিলে ঘটনার সময়? নিশ্চয়ই অ্যালিসিয়াকে উস্কে দিয়েছিল?”
আবার লম্বা শ্বাস ছেড়ে কাঁধ ঝাঁকালো ইউরি। “আমি আসলে জানি না। অ্যালিসিয়ার স্টুডিওর বাইরে ঘুরঘুর করছিল এলিফ। কিছু একটা তো বলেছেই। কি নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায়, কে জানে।”
“তোমার কাছে চাবি আছে না? চলো ঘরটা দেখে আসি। কোন সূত্র পাওয়া যেতে পারে।”
নার্স স্টেশন থেকে বেরিয়ে অ্যালিসিয়ার স্টুডিওতে চলে আসলাম আমরা। ইউরি দরজা খুলে ভেতরে আলো জ্বালো।
কাংখিত জবাবটা পেতে খুব একটা সময় লাগে না আমাদের। ইজেলের দিকে তাকাতেই বুঝে যাই কি ঘটেছিল।
অ্যালিসিয়ার নতুন পেইন্টিংটা নষ্ট করে দিয়েছে কেউ। লাল রঙ দিয়ে মোটা হরফে ‘মাগি লেখা সেখানে।
মাথা নাড়লাম। “তাহলে এই ব্যাপার।”
“তোমার কি মনে হয়, এলিফ করেছে কাজটা?”
“আর কে করবে?”
***
এলিফের সাথে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা করলাম। স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। এক চোখের ওপরে পুরু ব্যান্ডেজ। দেখে বোঝাই যাচ্ছে, প্রচণ্ড উত্তেজিত, সাথে ব্যথা তো আছেই।
“ভাগ এখান থেকে,” আমাকে দেখেই খেঁকিয়ে উঠলো সে।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার পাশে বসলাম। “আমি দুঃখিত, এলিফ। আসলেই দুঃখিত। খুব খারাপ হয়েছে তোমার সাথে, কণ্ঠে সহানুভূতি ঢেলে শান্তস্বরে বললাম।
“আর ভং ধরতে হবে না, যাও এখান থেকে,” আগের চেয়ে কিছুটা নরম হয়েছে তার কণ্ঠ।
“কী ঘটেছিল, আমাকে খুলে বলল।”
“শূয়োরের বাচ্চা আমার চোখ তুলে নিতে চেয়েছিল। দেখছে না তুমি!” মুখ খারাপ করা থামালো না এলিফ।
“হঠাৎ এরকম কেন করলো অ্যালিসিয়া? ঝগড়া হয়েছিল তোমাদের?”
“তুমি কি বলতে চাচ্ছো সব দোষ আমার? কিছুই করিনি আমি!”
“না, আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। শুধু বুঝতে চাইছি, এরকম একটা কাজ কেন করলো সে।”
“কারণ ওর মাথার কয়েকটা স্ক্রু ঢিলা।”
“ছবিটার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই? আমি দেখেছি ক্যানভাসে কি লিখেছো তুমি।”
অক্ষত চোখটা বন্ধ করে ফেললো এলিফ।
“কাজটা কিন্তু মোটেও ভালো করোনি, এলিফ। তবে অ্যালিসিয়া যা করেছে সেটাও একদমই উচিৎ হয়নি, তবুও-”
“আসলে ঐ কারণে আমাকে আক্রমন করেনি ও,” চোখ খুলে বলল এলিফ, দৃষ্টিতে ঘৃণা।
“তাই?” দ্বিধান্বিত স্বরে বললাম। “তাহলে কেন বলেছে?”
একটা বিকৃত হাসি ফুটলো এলিফের ঠোঁটে। কিছু বলল না সে। চুপচাপ ওভাবেই কিছুক্ষণ বসে থাকলাম আমরা। হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়বো, এমন সময় কথা বলতে শুরু করলো সে।
“ওকে শুধু সত্যটা বলেছিলাম।”
“কোন সত্যের কথা বলছো?”
“এটাই যে তুমি ওর প্রেমে পড়েছে।”
অবাক না হয়ে পারলাম না।
“তুমি ওর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো, আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আবারো কথা বলে উঠলো এলিফ। “এটাই বলেছিলাম। ও তোমাকে ভালোবাসে। থিও আর অ্যালিসিয়া চিপায় গিয়ে…” মুখ দিয়ে বিকৃত শব্দ করলো সে কিছুক্ষণ, এরপরেই উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। কি ঘটেছিল তা বুঝতে এখন আর সমস্যা হচ্ছে না। রাগ সামলাতে না পেরে হাতের তুলিটা এলিফের চোখে গেঁথে দেয় অ্যালিসিয়া।
“ওর মাথায় সমস্যা আছে,” হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে এসেছে এলিফের। “শালী একটা সাইকো।”
এলিফের ব্যান্ডেজ করা চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তার কথায় কিছুটা হলেও সত্যতা আছে।
.
২.৩৩
মিটিংটা ডায়োমেডেসের অফিসে হলেও শুরু থেকেই স্টেফানি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। এবারের মিটিংয়ের আলোচনার মূল বিষয় যেহেতু ‘সার্বিক নিরাপত্তা, সুতরাং তার আদেশই শিরোধার্য। এটা খুব ভালো করেই জানে সে। ডায়োমেডেসের গম্ভীর চেহারা দেখা মনে হচ্ছে তিনিও বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা।
বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে স্টেফানি; চোখমুখে স্পষ্ট উত্তেজনা। তার কথা মানতে যে আমরা সবাই বাধ্য, এটা ভেবে মজা পাচ্ছে নিশ্চয়ই। কিছুদিন আগেই এখানকার সকলে জোট বেঁধে তার মতের বিরোধীতা করেছিল, এখন সেটারই প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ পেয়েছে সে।
“গতকাল সকালে যা ঘটেছে তা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়,” বলল স্টেফানি। “আমি মানা করেছিলাম তার হাতে ছবি আঁকার সরঞ্জাম তুলে দিতে, কিন্তু আমার কথা শোনেননি আপনারা। তাকে আলাদা সুবিধা দেয়ার কারণে অন্যেরা তো অসন্তুষ্ট হবেই। জানতাম এ রকম কিছু ঘটবে। এখন থেকে নিরাপত্তার বিষয়েই সবচেয়ে বেশি জোর দেব আমরা।”
“অ্যালিসিয়াকে আলাদা করে রাখা হয়েছে কেন?” জিজ্ঞেস করলাম। “নিরাপত্তের খাতিরে?”
“নিজের এবং অন্যদের নিরাপত্তার জন্যে হুমকি সে। এলিফকে যেভাবে আঘাত করেছে-খুব সহজে মেরেও ফেলতে পারতো।”
“ওকে উসকে দেয়া হয়েছিল।”
ক্লান্তভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ডায়োমেডেস। “উসকে দিলেও এরকম কিছু করা একদমই ঠিক হয়নি তার। কোনভাবেই এর সপক্ষে যুক্তি দেখানো চলবে না।”
“সেটাই বলতে চাচ্ছি আমি,” স্টেফানি মাথা নাড়ে।
“এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা,” বললাম। “অ্যালিসিয়াকে এভাবে একঘরে করে রাখাটা কিন্তু বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে, আমরা মধ্যযুগে বাস করছি নাকি?” ব্রডমুরে আইসোলেশন রুমে অনেক রোগিকে থাকতে দেখেছি আমি। রুমগুলোয় কোন জানালা থাকে না, কোনমতে একটা বিছানা ঢোকানো হয় কেবল। কয়েক দিন কি, কয়েক ঘন্টা ওখানে থাকলেই সুস্থ কারো মাথা বিগড়ে যাবে। সেখানে অ্যালিসিয়া আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
কাঁধ ঝাঁকালো স্টেফানি। “এই ক্লিনিকের ম্যানেজার হিসেবে নিরাপত্তার স্বার্থে যে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে। তাছাড়া ক্রিস্টিয়ানের সাথে কথা বলেছিলাম বিষয়টা নিয়ে, সে-ও সম্মতি জানিয়েছে।”
“তা তো দেবেই।”
মুখে ক্রুর একটা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকালো ক্রিস্টিয়ান। ডায়োমেডেসের দৃষ্টিও যে আমার দিকে, তা টের পাচ্ছি। জানি তাদের মাথায় কি ঘুরছে-আমি ব্যাপারটার সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে জড়িয়ে গেছি; সেজন্যেই এরকম আচরণ করছি এখন। যা ইচ্ছে ভাবুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।
“তাকে এভাবে বন্দি করে রাখলে তো কোন সমস্যার সমাধান হবে না। আমাদের উচিৎ তার সাথে কথা বলা, তাকে বোঝার চেষ্টা করা।”
“সবকিছু ঠিকঠাকই বুঝেছি আমি,” ক্রিস্টিয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে কোন অবুঝ শিশুর সাথে কথা বলছে। “সমস্যাটা তোমাকে নিয়ে, খিও।”
“আমাকে নিয়ে?”
“নতুবা কি? তুমি আসার পর থেকেই তো গোলমালের শুরু।”
“কী রকম গোলমাল?”
“সত্যটা শুনতে খারাপ লাগছে? তুমিই ওর ওষুধের ডোজ কমানোর ব্যাপারে ঘোট পাকিয়েছে-”
হেসে ফেললাম। “ঘেট পাকিয়েছি? ওকে যে পরিমাণ ওষুধ দেয়া হতো তাতে একটা ঘোড়াও কাবু হয়ে পড়বে।”
“ফালতু কথা।”
ডায়োমেডেসের দিকে ফিরলাম। “আপনিও কি একই কথা ভাবছেন?”
মাথা ঝাঁকালো ডায়োমেডেস। “প্রশ্নই আসেনা,” বলে চোখ নামিয়ে নিলেন। “তবে এটা ঠিক যে ওষুধের ডোজের তারতম্যের কারণে সমস্যা হয়েছে।”
“আমি এটা মানতে নারাজ।”
“তুমি বোধহয় গোটা ব্যাপারটার সাথে একটু বেশিই জড়িয়ে ফেলেছে নিজেকে,” দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ডায়োমেডেস। “আর এ মুহূর্তে কোন ভুলের সুযোগ নেই আমাদের-এটা খুব ভালো করেই জানো। ক্লিনিকের ভবিষ্যৎ একটা সুতোয় দুলছে এখন। আমাদের প্রতিটা ভুল ট্রাস্টকে ইন্ধন যোগাবে ক্লিনিকটা বন্ধ করে দিতে।”
প্রফেসরকে এভাবে হাল ছেড়ে দিতে দেখে বিরক্ত লাগছে। তাই বলে তো অ্যালিসিয়াকে কড়া ডোজের ওষুধ দিয়ে একঘরে করে রাখতে পারি না আমরা! তাহলে জেলখানার সাথে পার্থক্যটা কি থাকলো?”
“তোমার কথার সাথে একমত আমি, থিও,” ইন্দিরা বলে উঠলো এ সময়। “সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের ঝুঁকি নেয়ার কোন ইচ্ছেই নেই। তাই একজন রোগিকে ইচ্ছেমতন ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখাই যৌক্তিকভাবে অনেকে। কিন্তু সাইকোলজিস্ট বা সাইকোথেরাপিস্ট হিসেবে আমাদের আরো সাহসী হতে হবে। রোগিদের সাময়িক উন্মাদনাটুকু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাই সবচেয়ে ভালো সমাধান, এভাবে আটকে রাখাটা পাশবিক।”
চোখ বাঁকালো ক্রিস্টিয়ান। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতে যাবে এ সময় হাত উঁচিয়ে তাকে থামালেন ডায়োমেডেস। “সেজন্যে বড় দেরি হয়ে গেছে। আসলে দোষটা আমারই। সাইকোথেরাপি অ্যালিসিয়ার জন্যে নয়। শুরুতেই মানা করে দেয়া উচিৎ ছিল।”
ডায়োমেডেস মুখে বলছেন, পুরো দোষ তার, কিন্তু মনে মনে আসলে আমাকেই দোষি ভাবছে সবাই। সবার চোখ এখন আমার দিকে। ডায়োমেডেসের দৃষ্টিতে হতাশা, ক্রিস্টিয়ানের দৃষ্টিতে বিদ্রূপ আর ইন্দিরার দৃষ্টিতে খেলা করছে দুশ্চিন্তা।
“অ্যালিসিয়ার ছবি আঁকা থামিয়ে দিতে পারেন আপনারা। কিন্তু তার থেরাপি বন্ধ করবেন না-তাহলে আর তার স্বাভাবিক জীবন যাপনের কোন আশাই থাকবে না,” চেষ্টা করলাম যাতে কণ্ঠে মিনতির ভাব না ফোটে।
“আমার তো এখন মনে হচ্ছে অ্যালিসিয়া আর কখনোই স্বাভাবিক হবে না,” প্রফেসর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন।
“আমাকে আর কয়েকটা দিন সময়-”
“না,” ডায়োমেডেসের কণ্ঠের দৃঢ়তা শুনেই বুঝতে পারলাম, এ বিষয়ে আলোচনা করা বৃথা।
আমার সুযোগ শেষ।
.
২.৩৪
প্রফেসর ডায়োমেডেসের কিন্তু সেদিন ভুল আন্দাজ করেছিলেন। তুষারপাত হয়নি। বরং প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় বিকেলের দিকে। মুহুর্মুহ বজ্রপাতে একটু পরপর কেঁপে উঠছিল চারপাশ।
অ্যালিসিয়ার জন্যে থেরাপি রুমে অপেক্ষা করছি। আজকেও বৃষ্টি ঝরছে বাইরে। ভেতরে ভেতরে খুবই ক্লান্ত আর বিষণ্ণ আমি। অ্যালিসিয়াকে সাহায্য করার আগেই সুযোগটা হারালাম; এখন আর কিছু করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।
দরজায় কেউ কড়া নাড়লো এসময়, তাকিয়ে দেখি অ্যালিসিয়াকে নিয়ে এসেছে ইউরি। যতটা ভেবেছিলাম তার চাইতেও খারাপ অবস্থা তার। চেহারা একদম ফ্যাকাসে, যেন জীবন্ত লাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ঠিকঠাক হাঁটতেও পারছে না, ডান পাটা অনবরত কাঁপছে। ক্রিস্টিয়ানকে মনেমনে গালি দিলাম আবারো, ওর প্রেসক্রাইব করা ওষুধ খেয়েই অ্যালিসিয়ার এই অবস্থা।
ইউরি চলে যাবার পর লম্বা একটা সময় চুপচাপ ঘরটায় বসে থাকি দু’জনে। অ্যালিসিয়া চোখ নামিয়ে রেখেছে। এক পর্যায়ে মুখ খুলতেই হলো আমাকে। এমনভাবে কথাগুলো বললাম যেন স্পষ্ট শুনতে পায় সে।
“অ্যালিসিয়া, আপনাকে যে আইসোলেশন রুমে আটকে রাখা হয়েছে, সেজন্যে আমি দুঃখিত। আসলেও দুঃখিত।”
কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
“এলিফের সাথে যা করেছেন,” দ্বিধান্বিত স্বরে বললাম, “সেটার জন্যে আমাদের বোধহয় আর থেরাপি চালিয়ে যাবার সুযোগটা নেই। তবে সিদ্ধান্তটা আমার ছিল না, আমি বরং এর প্রতিবাদ করেছি। আপনি চাইলে আমাকে জানাতে পারেন, এলিফ এবং আপনার মাঝে ঠিক কী হয়েছিল? নিশ্চয়ই ভেতরে ভেতর অপরাধবোধ হচ্ছে আপনার? সে ব্যাপারেও আলোচনা করতে পারি আমরা।”
অ্যালিসিয়া কিছু বলল না। এই ঘোরের মধ্যে আমার কথা তার মাথায় আদৌ ঢুকছে কি না, সে ব্যাপারে সন্দিহান আমি।
“আচ্ছা আমার কেমন লাগছে আগে সেটা বলি নাহয়। এই মুহূর্তে আসলে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে আমার। কারণ আমরা একসাথে ঠিকমতো কাজ শুরু করার আগেই সুযোগটা হারাতে হচ্ছে। আপনার ওপরেও রাগ হচ্ছে কারণ আপনি আরেকটু চেষ্টা করলেই আজ এই দিন দেখতে হতো না।”
এবার মাথা তুলে আমার দিকে তাকালো অ্যালিসিয়া।
“জানি আপনি ভয় পাচ্ছেন। আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। আমি, কিন্তু সুযোগটা দেননি। আর এখন পুরো পরিস্থিতিই বিগড়ে গেছে।”
চুপ হয়ে গেলাম। পরাজিত মনে হচ্ছে নিজেকে।
ঠিক এই সময় অ্যালিসিয়া এমন একটা কাজ করলো যা আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারবো না।
কাঁপা কাঁপা হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় সে। কিছু একটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সেখানে-একটা চামড়া দিয়ে বাঁধানো নোটবুক।
“এটা কি?”।
বরাবরের মতনই কোন উত্তর নেই। হাতটা এখনও সামনে বাড়িয়েই রেখেছে।
“আমাকে দিচ্ছেন এটা?” কৌতূহলী কণ্ঠে বললাম।
এবারেও জবাব না পাওয়ায় অগত্যা তার হাত থেকে সাবধানে নোটবুকটা নিলাম। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টেই বুঝে গেলাম জিনিসটা কি।
অ্যালিসিয়ার ডায়েরি।
ভেতরের লেখাগুলো দেখে মনে হচ্ছে লেখার সময় মন খুব অস্থির ছিল তার। তীর চিহ্নের মাধ্যমে একটা প্যারার সাথে আরেক প্যারা জুড়ে দিয়েছে। শেষদিকের লেখাগুলো তো প্রায় বোঝাই যাচ্ছে না। লেখার ফাঁকে ফাঁকে নানারকম ছবি আঁকা। ফুল, লতাপাতা, পাখি। আবার কয়েকটা পাতায় লাইনের পর লাইন লিখে কেটে দেয়া হয়েছে হিজিবিজি করে।
“আমি এটা দিয়ে কি করবো?” অ্যালিসিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
প্রশ্নটা অবশ্য না করলেও হতো। সে কেন আমাকে এটা দিয়েছে তা একদম পরিস্কার।
অ্যালিসিয়া চাইছে আমি যেন তার ডায়েরিটা পড়ি।