পঞ্চম পর্ব
আমি নিরপরাধ, কিন্তু আমার নিজের কথাই আমাকে অপরাধী করে তোলে।
–ইয়োব ৯:২০
৫.১
অ্যালিসিয়া বেরেনসনের ডায়েরি
ফেব্রুয়ারি ২৩
মাত্র চলে গেল খিও। এখন একা আমি। যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু লিখে ফেলতে হবে আমাকে। খুব বেশি সময় নেই হাতে। কতক্ষন শরীরে কুলাবে, জানি না।
আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে আমার মাথায় সমস্যা আছে। সত্যটা মেনে নেয়ার চাইতে এরকম ভাবাটাই সহজ ছিল। কিন্তু আসলে আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
প্রথমবার যখন তাকে থেরাপি রুমে দেখি, কিছু একটা পরিচিত মনে হয়। কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝতে পারি চোখদুটো আগেও দেখেছি। তাছাড়া সিগারেট আর আফটারশেভের গন্ধটাও পরিচিত। কথা বলার ছন্দ, কথার মাঝে বিরতি–এসবও মিলে যায়, শুধু কণ্ঠস্বরটা কোন এক কারণে অন্যরকম ঠেকেছিল। কিন্তু পরের বার দেখা হওয়ার সময় নিজেকে আর লুকোতে পারেনি। আমার বাসায় ঢুকে যে কথাটা বলেছিল, ঠিক সেই একই কথা আবারো আমাকে এখানে বলে সে। কথাগুলো কখনোই ভোলা সম্ভব নয় আমার পক্ষে:
“আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি। বিশ্বাস করুন কথাটা। সত্যিটা হচ্ছে, আমি চাই আপনি যাতে ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারেন।”
এই কথাগুলো শোনা মাত্র সব পরিস্কার হয়ে যায় আমার কাছে। ধাঁধার সূত্রগুলো একদম খাপে খাপে বসে গেছে।
এই লোকটাই সেই আততায়ী।
হঠাৎই কি যেন একটা হয়ে যায় আমার। ঝাঁপিয়ে পড়ি তার ওপরে। ওখানেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম তাকে। মারবো নাহয় মরবো। গলা চেপে ধরি, চোখ ওপড়ানোর চেষ্টা করি, বারবার মেঝেতে মাথা ঠুকে ঘি বের করে ফেলার চেষ্টা করি কিন্তু লাভ হয় না। মারতে পারিনি তাকে। আমাকে আটকে ফেলে কয়েকজন মিলে। ঘুম পাড়িয়ে বন্দী করে রাখে। এরপর আবারো সাহস হারিয়ে ফেলি। সংশয়ে ভুগতে থাকি যে আমার বোধহয় ভুল হচ্ছে। পুরোটাই কল্পনা বৈ কিছু নয়।
থিও আর সেই লোকটা একই ব্যক্তি হয় কি করে? গ্রোভে এসে আমাকে এভাবে উসকে দেয়ার পেছনে তার কি উদ্দেশ্যে থাকতে পারে? তখনই সত্যটা বুঝতে পারি। আমাকে সাহায্য করার বিষয়টা একদমই গাঁজাখুরি। আসলে এসব থেকে বিকৃত এক ধরণের তৃপ্তি পাচ্ছে সে। সেজন্যেই ফিরে এসেছে নিজেকে জাহির করার জন্যে।
“আপনাকে সাহায্য করতে চাই আমি। বিশ্বাস করুন কথাটা। সত্যিটা হচ্ছে, আমি চাই আপনি যাতে ঠিকঠাক চিন্তা করতে পারেন।”
হ্যাঁ, এখন ঠিকঠাকই চিন্তা করতে পারছি। আমি যে সত্যটা জানি সে বিষয়ে কোন রাখঢাকও করিনি। সেজন্যে ইচ্ছে করে গ্যাব্রিয়েলের মৃত্যুর ব্যাপারে মিথ্যে গল্প ফেঁদেছি। থিও’র চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে সে বুঝতে পারছে আমি মিথ্যে বলছি। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ একে অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকি আমরা। আমি তাকে চিনে ফেলেছি, এটা টের পায় সে। তার চোখে এমন একটা অনুভূতি দেখতে পাই, যেটা আগে কখনো দেখিনি। ভয়। আমাকে ভয় পাচ্ছিল সে। কাকে কী বলে ফেলি সেটা নিয়ে আতঙ্কে ছিল নিশ্চয়ই। আমার কণ্ঠস্বর ওর ভেতরের সুপ্ত ভয়টা আবারো জাগিয়ে তোলে।
সেজন্যেই কয়েক মিনিট আগে ফিরে এসেছিল। তবে এবারে আর কিছু বলেনি। সোজা এগিয়ে এসে আমার কব্জিতে একটা সুই বিধিয়ে দেয়। আমি তাকে আটকানোর চেষ্টা করিনি, কোন প্রকার ধস্তাধস্তিও করিনি। এই শাস্তিটা আমার প্রাপ্য। হ্যাঁ, আমি আসলেও অপরাধী। কিন্তু থিও’র ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। সেজন্যেই ডায়েরিতে সব লিখে রাখছি, যাতে এবারে আর পার না পায় সে। শাস্তি পেতেই হবে তাকে।
তাড়াতাড়ি লিখতে হবে। আমার শরীরে কি ইনজেক্ট করেছে জানি না, কিন্তু সেটার প্রভাব টের পাচ্ছি। চোখ ভেঙে ঘুম আসছে। বালিশটা হাতছানি দিয়ে ডাকছে অনেকক্ষণ ধরেই। ঘুমাবো আমি…না, এখন ঘুমোলে চলবে না। জেগে থাকতেই হবে। আগে পুরো গল্পটা শেষ করতে হবে। আর এবারে, একদম সত্যটাই বলবো।
সেই রাতে বাসায় ঢুকে লিভিংরুমে একটা চেয়ারের সাথে আমাকে বেঁধে ফেলে থিও। এরপর গ্যাব্রিয়েল বাড়ি ফিরলে তাকেও বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করে। প্রথমে ভেবেছিলাম মেরেই ফেলেছে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর টের পাই যে গ্যাব্রিয়েল শ্বাস নিচ্ছে। তাকেও একটা চেয়ারে বসিয়ে বাধে থিও। আমাদের চেয়ার দুটো এমন অবস্থানে রাখে যাতে একে অপরের চেহারা দেখতে না পারি।
“প্লিজ,” আকুতি জানাই আমি। “প্লিজ, ওকে কষ্ট দেবেন না। আপনি যা চান, তা-ই করবো আমি।”
আমার কথা শুনে হেসে ওঠে থিও। শুকনো এই হাসিটাকে যে কতটা ঘৃণা করি আমি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। “কষ্ট দেব?” বলে মাথা ঝকায় সে। “ওকে খুন করবো আমি।”
বুঝতে পারি, ফাঁকা বুলি আউড়াচ্ছে না থিও। আর সামলাতে পারি না নিজেকে, দু’চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে শুরু করে। আপনি যা চান, সেটাই করবো আমি। ওকে ছেড়ে দিন, প্লিজ। ওর মত মানুষ হয় না। ওকে ভালোবাসি আমি। অনেক বেশি-”
“একটা কথা বলুন, অ্যালিসিয়া। আপনার কি মনে হয়? সে ভালোবাসে আপনাকে?”
“হ্যাঁ, সবার চাইতে অনেক বেশি ভালোবাসে।”
ঘড়ির কাটার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। অনন্তকাল পর কথা বলল থিও। “সেটা দেখা যাবে।”শীতল দৃষ্টিটার দিকে খুব বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। থিওর মধ্যে মনুষ্যত্ব বলে কিছু ছিল না সেই মুহূর্তে। যেন নরক থেকে সাক্ষাৎ শয়তান উঠে এসেছে।
আমার চেয়ারের সামনে থেকে সরে গ্যাব্রিয়েলের উল্টোদিকে গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না, দেখতে পাচ্ছি না কিছু। এরপরেই ভোতা একটা শব্দ কানে আসে। গ্যাব্রিয়েলকে সর্বশক্তিকে থাপ্পড় দিয়েছে সে। যতক্ষণ অবধি জ্ঞান না ফেরে ততক্ষণ মারতেই থাকলো থিও। কিছুক্ষণ পর মুখে বুলি ফোটে গ্যাব্রিয়েলের।
“কি-কি-”
“হ্যালো, গ্যাব্রিয়েল।”
“কে-কে আপনি?”
“খুবই সাধারণ একজন মানুষ। বিবাহিত। তাই জানি ভালোবাসার মূল্য কি। আর এটাও জানি যে ভালোবাসার মানুষটা বিশ্বাসঘাতকতা করলে কেমন লাগে।”
“কি আবোল তাবোল বলছেন।”
“কাপুরুষেরাই তাদের ভালোবাসার মানুষকে ধোঁকা দেয়। তুই কি কাপুরুষ, গ্যাব্রিয়েল?।”
“জাহান্নামে যা।”
“তোকে মেরেই ফেলতাম। কিন্তু অ্যালিসিয়া তোর প্রাণ ভিক্ষা চাইছে। তাই তোকে এখন একটা সুযোগ দিব। হয় তুই মরবি, নাহলে তোর জায়গায় অ্যালিসিয়া মরবে। সিদ্ধান্ত তোর।”
একদম ঠাণ্ডা স্বরে কথাগুলো বলে থিও। শুনে মনে হবে যেন এই কথাগুলো নিজের সাথেই হাজারবার বলেছে। কোন অনুভূতি নেই কণ্ঠে। একদম শান্ত। কয়েক মুহূর্ত কিছুই বলল না গ্যাব্রিয়েল। হাঁপানোর শব্দ শুনে মনে হচ্ছে তার পেটে সজোরে ঘুষি বসিয়েছে কেউ।
“না”
“হ্যাঁ। হয় অ্যালিসিয়া মরবে, নাহলে তুই মরবি। সিদ্ধান্ত তোর, গ্যাব্রিয়েল। দেখা যাক কত ভালোবাসিস ওকে। ওর জন্যে নিজের জান দিতে পারবি? দশ সেকেন্ড সময় দিচ্ছি তোকে। দশ…নয়-”
“ওর কথা বিশ্বাস কোরো না,” বলি আমি। “আমাদের দু’জনকেই মেরে ফেলবে। আই লাভ ইউ”
-আট, সাত-”
“আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো, গ্যাব্রিয়েল-”
“-ছয়…পাঁচ-”
“আমাকে ভালোবাসো তুমি-”
“-চার…তিন-”
“গ্যাব্রিয়েল, একবার বলো যে আমাকে ভালোবাসো তুমি-”
“দুই”
আর তখনই কথা বলে ওঠে গ্যাব্রিয়েল। প্রথমে ওর কণ্ঠস্বর চিনতেই পারিনি। মনে হচ্ছিল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। বাচ্চারা কোন অপরাধ করলে এই সুরে কথা বলে। কিন্তু আমাদের জীবন-মরণ নির্ভর করছিল গ্যাব্রিয়েলের কথাগুলোর ওপরে।
“মরতে চাই না আমি,” বলে সে।
এরপর সব থেমে যায়। অসহ্য একটা নীরবতা নেমে আসে চারপাশে { মনে হচ্ছিলো আমার শরীরের প্রতিটা কোষ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে; জুই গাছ থেকে যেভাবে ফুলগুলো ঝরে পড়ে, ঠিক সেভাবে মৃত কোষগুলো ঝরে পড়ছে। জুঁইয়ের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম? হ্যাঁ, মিষ্টি একটা ঘ্রাণ…
গ্যাব্রিয়েলের কাছ থেকে সরে এসে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে থিও। তবে তার কথা ঠিকমতো আমার কানে ঢুকছিল না। “শুনলেন তো, অ্যালিসিয়া? আমি জানতাম গ্যাব্রিয়েল একটা আস্ত কাপুরুষ। নাহলে নিজের স্ত্রীকে রেখে আমার স্ত্রীর সাথে শোয় কি করে? আমার জীবনের একমাত্র সুখটা কেড়ে নিয়েছে। সামনে এগিয়ে আসে থিও, আমার কানের কাছে মুখ এনে বলে, “কাজটা করতে খারাপ লাগছে আমার। কিন্তু সত্যটা জানার পর আপনারও নিশ্চয়ই বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা চলে গেছে?”
আমার মাথা বরাবর বন্দুক তাক করলো সে। চোখ বন্ধ করে ফেলি। গ্যাব্রিয়েলের চিৎকার কানে আসছে-”গুলি করবেন না! গুলি করবেন না!”
একটা ক্লিক শব্দ। এরপর কানফাটানো গুলির আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে সব নীরব হয়ে যায়। ভেবেছিলাম মরেই গেছি বুঝি।
কিন্তু আমার ভাগ্য কখনোই অতটা ভালো ছিল না।
চোখ খুলে দেখি সিলিংয়ের দিকে বন্দুক তাক করে আছে থিও। মুখে হাসি। ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে আমাকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয় সে।
“অ্যালিসিয়া?” গ্যাব্রিয়েল ডাকে আমার নাম ধরে। “অ্যালিসিয়া?”
টের পাচ্ছি যে গ্যাব্রিয়েল ওর চেয়ারে বসেই মোচড়া-মুচড়ি করছে। ঘরে দেখার চেষ্টা করছে কি হয়েছে।
“কি করেছিস তুই? বেজন্মা কোথাকার! ঈশ্বর-”
আমার হাতের বাঁধন খুলে দেয় থিও। এরপর বন্দুকটা মেঝেতে নামিয়ে রাখে। আলতো করে আমার গালে একবার চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়। সামনের দরজা দিয়ে।
গ্যাব্রিয়েল আর আমি বাড়িতে তখন একা। শব্দ করে কাঁদছিল ও, কোন কথাই বলতে পারছিল না। শুধু চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকে। “অ্যালিসিয়া, অ্যালিসিয়া-”
আমি নীরবই থাকি। কেন যেন অ্যালসেস্টিসের কথা মনে হচ্ছিল বারবার। কিন্তু তার স্বামী তো তাকে একটু হলেও ভালোবাসে।
“অ্যালিসিয়া…কি হলো-”
মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোয় না আমার। কি করে কথা বলতাম? ও তো নিজের মুখেই আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
আর মৃত মানষ কথা বলে না।
পায়ের বাঁধন খুলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। নিচু হয়ে মেঝেতে হাত দিতেই বন্দুকটা হাতে ঠেকে। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি গরম মনে হচ্ছিল জিনিসটা। হেঁটে গিয়ে গ্যাব্রিয়েলের মুখোমুখি হই। ওর চোখ বড় বড় হয়ে যায় আমাকে দেখে।
“অ্যালিসিয়া? তুমি বেঁচে আছো! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তুমি-”
যদি বলতে পারতাম, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার, পরাজিত সব মানুষের পক্ষ থেকে গ্যাব্রিয়েলের ওপরে প্রতিশোধ নিয়েছিলাম কিংবা গ্যাব্রিয়েলের মধ্যে আমার বাবার ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম সেদিন-তাহলে কিছুটা হলেও শান্তি লাগতো। কিন্তু এখানে মিথ্যে কিছু লিখবো না। সত্যটা হচ্ছে, আমার আর গ্যাব্রিয়েলের চোখের দৃষ্টি হঠাই একে অপরের সাথে পাল্টে যায়। নিজেকে ওর জায়গায় আবিষ্কার করি আমি।
এখন পরিস্কার বুঝতে পারছি সবকিছু। শান্তি বলে জীবনে কখনো কিছু বরাদ্দ ছিল না আমার জন্যে। কেউ ভালোবাসতো না। আমার সব স্বপ্ন, আশা আকাঙ্ক্ষা ভেঙে হয়ে গিয়েছিল। মা মারা যাবার পরদিন বাবা আসলে ঠিক কথাটাই বলে-মায়ের জায়গায় আমি মরলেই ভালো হতো। বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই আমার। আমার জীবনের কোন মূল্য নেই। শেষ হয়ে গেছে সবকিছু। আর গ্যাব্রিয়েলই করেছে কাজটা।
এটাই সত্য।
আমি গ্যাব্রিয়েলকে হত্যা করিনি।
বরং ও আমাকে খুন করেছে।
আমি শুধু বন্দুকের ট্রিগারটা টেনেছিলাম।
.
৫.২
“এই দৃশ্যটা দেখলে সবসময়ই খুব খারাপ লাগে আমার,” ইন্দিরা বলল। “কার্ডবোর্ডের বাক্সে বন্দী করে ফেলা হচ্ছে একজনের জীবনের সবকিছু।”
মাথা নেড়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চারপাশে তাকালাম।
‘কিন্তু একটা বিষয় অবাক করেছে আমাকে,” আজকে কথা বলার রোগে পেয়েছে ইন্দিরাকে। “অ্যালিসিয়ার জিনিসপত্র অনেক কম। অন্য রোগিদের তো হাবিজাবি কত কিছু থাকে। কিন্তু এখানে কয়েকটা বই, কিছু ছবি আর ওর কাপড়-চোপড় ছাড়া কিছুই নেই।”
স্টেফানির কথামতো অ্যালিসিয়ার ঘর খালি করতে এসেছি আমি আর ইন্দিরা। “সে আর কখনো জেগে উঠবে বলে মনে হয় না, স্টেফানি বলেছিল আমাদের উদ্দেশ্যে। তাছাড়া একটা ঘর ফেলে রাখা সম্ভব নয় আমাদের পক্ষে।”
চুপচাপ কাজ করে গেলাম আমরা। কোন জিনিসগুলো সংরক্ষণ করা হবে আর কোনগুলো ফেলে দেয়া হবে এগুলো নিয়ে কয়েকবার কথা বললাম শুধু। মনোযোগ দিয়ে অ্যালিসিয়ার সব জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি। তবে আমাকে বিপদে ফেলার মত কিছু নেই বলে মনে হছে।
অ্যালিসিয়া ডায়েরিটা এতদিন কিভাবে লুকিয়ে রেখেছে সেটাই ভাবছিলাম। ভর্তির সময় সঙ্গে করে সব রোগি অল্প কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসে। অ্যালিসিয়া এনেছিল খামভৰ্তি স্কেচ। ওগুলোরই কোন একটায় ডায়েরিটা ছিল নিশ্চয়ই। খামগুলো খুলে ভেতরে উঁকি দিলাম। বেশিরভাগই অসমাপ্ত স্কেচ আর খসড়া। এখানে সেখানে কয়েকটা সুন্দর ছবিও আছে, অ্যালিসিয়ার প্রতিভার ব্যাপারে কোন সন্দেহ পোষণ করা চলবে না।
একটা স্কেচ ইন্দিরাকে দেখিয়ে বললাম, “এটা আপনি।”
“কি? নাহ।”
“হা, দেখুন খেয়াল করে।”
“আসলেই?” বলে খুশিমনে স্কেচটা হাতে নিল ইন্দিরা। “আসলেই এটা আমি? কবে আঁকলো! আমি তো কিছু জানিই না। সুন্দর না?”
“হ্যাঁ। আপনি রেখে দিন এটা।”
মুখ বাঁকিয়ে স্কেচটা আমাকে ফিরিয়ে দিল ইন্দিরা। “সেটা তো সম্ভব না।”
“অবশ্যই সম্ভব। অ্যালিসিয়া নিশ্চয়ই কিছু মনে করতো না আপনি ছবিটা নিলে,” হেসে বললাম। “তাছাড়া কেউ কিছু জানবেও না।”
“বলা যায় না।” দেয়ালে ঠেস দেয়া বড় পেইন্টিংটার দিয়ে চোখ গেল তার। আমাকে আর অ্যালিসিয়াকে দেখা যাচ্ছে সেখানে। এলিফ এই ছবিটাই নষ্ট করেছিল।
“এটা কি তুমি নিয়ে যাবে?” ইন্দিরা জিজ্ঞেস করলো।
“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম। “জিন-ফিলিক্সকে ফোন দিয়েছি। সে-ই এসবের একটা বন্দোবস্ত করবে।”
“তুমি রাখতে পারলেই ভালো হতো,” মাথা নাড়লো ইন্দিরা।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম পেইন্টিংটার দিকে। আসলে এটা খুব একটা পছন্দ নয় আমার। কিন্তু অ্যালিসিয়ার অন্য ছবিগুলো ঠিকই ভালো লাগে। একটু অদ্ভুতই ব্যাপারটা, কারণ ছবিটাতে আমি নিজেও আছি।
একটা কথা পরিস্কার করে বলে দিতে চাই-আমি কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সন্দেহ করিনি যে অ্যালিসিয়া সেদিন গ্যাব্রিয়েলকে গুলি করবে। আর আমারো কাউকে খুন করার কোন ইচ্ছে ছিল না। আমি শুধু অ্যালিসিয়া সত্যিটা জানাতে চেয়েছিলাম। যেমন আমি আমার স্ত্রী সম্পর্কে জেনেছি। বোঝাতে চাইছিলাম, গ্যাব্রিয়েল তাকে ভালোবাসেনা। ভুলের স্বর্গে বাস করছে সে। তাদের বিয়ে একটা নাটক বৈ কিছু নয়। কেবলমাত্র এসব জানলেই জীবনকে নতুন করে সাজাতে পারবে সে। মিথ্যে নয়, সত্যের ভিতে গড়া একটা জীবন।
অ্যালিসিয়ার মানসিক সমস্যার ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই জানা ছিল না আমার। যদি জানতাম তাহলে ওরকমটা কখনোই করতাম না।
মিডিয়ায় যখন খুনের ঘটনাটা নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো, মনে মনে একটা দায়বদ্ধতা অনুভব করি আমি। বারবার মনে হচ্ছিল প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে সবাইকে বোঝাই যে এসবের জন্যে আমি কোনভাবেই দায়ি নই। সেজন্যেই গ্রোভের চাকরিটার জন্যে আবেদন করেছিলাম।
অ্যালিসিয়াকে খুনের পরবর্তী জীবনের সাথে মানিয়ে নেয়াটাই উদ্দেশ্যে ছিল আমার। তাকে যদি ঠিকভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করতে পারি, তাহলে সত্যটা বুঝবে সে-এমনটাই আশা করেছিলাম।
হ্যাঁ, অনেকে বলতে পারে, সব সূত্র চিরতরে গোপন করার জন্যে অ্যালিসিয়ার জীবনে ফিরে এসেছি। কিন্তু এটা সত্য নয়। এই কাজটা যে আমার জন্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ তা শুরু থেকেই জানা ছিল আমার। ধরা পড়ে যেতে পারি, গোটা পরিকল্পনা যে কোন সময় ভেস্তে যেতে পারে-এতসব ঝুঁকি সত্ত্বেও কাজটা করি কারণ…কি বলবো? আমি এমনই।
ভুলবেন না, আমি একজন সাইকোথেরাপিস্ট। অ্যালিসিয়ার সাহায্যের দরকার ছিল, আর একমাত্র আমিই জানতাম, কী করে তাকে সাহায্য করতে হবে।
প্রথমদিকে এই ভেবে কিছুটা শঙ্কিত ছিলাম, সে চিনে ফেলবে আমাকে। যদিও সেদিন মাস্ক পরে গিয়েছিলাম তার বাসায়, তবুও বাড়তি সতর্কতা হিসেবে কণ্ঠস্বর ইচ্ছে করে পাল্টে ফেলি। কিন্তু অ্যালিসিয়া চিনতে পারে না আমাকে, তাই তার জীবনের নতুন একটা ভূমিকা পালনের সুযোগ পাই। এরপর পলের সাথে তাদের ক্যামব্রিজের বাসার ছাদে কথা বলার বুঝতে পারি আসলে ঐ দিনটাতে কি করেছিলাম আমি।
অ্যালিসিয়ার বাবার মত গ্যাব্রিয়েলও অ্যালিসিয়াকে হত্যা করেছিল সেদিন, কথার মাধ্যমে। সেজন্যেই প্রতিশোধের নেশা চেপে বসে তার মধ্যে। কিন্তু ভার্নন রোজ নয়, তার প্রতিশোধের অনলে ছাই হয় গ্যাব্রিয়েল বেরেনসন। যেরকমটা আমি সন্দেহ করেছিলাম, খুনের ঘটনাটা আসলে অ্যালিসিয়ার বহুদিনের চেপে রাখা ক্ষোভ আর হতাশার বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
কিন্তু অ্যালিসিয়া যখন সেদিন থেরাপি রুমে গ্যাব্রিয়েলের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মিথ্যে বলল, বুঝে যাই যে আমাকে চিনে ফেলেছে সে। আর তাই বাধ্য হয়েই সারাজীবনের জন্যে তার মুখটা বন্ধ করে দিতে হলো।
সব দোষ ক্রিস্টিয়ানের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছি-একেই বোধহয় বলে পোয়েটিক জাস্টিস। তবে ওকে ফাঁসানোর জন্যে কোন প্রকার অনুশোচনাবোধ নেই আমার। অ্যালিসিয়ার যখন তাকে সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল, সেই মুহূর্তে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। শাস্তি তার প্রাপ্য।
অ্যালিসিয়ার মুখ বন্ধ করা অতটা সহজ ছিল না। ওর শরীরে মাত্রাতিরিক্ত মরফিন ইনজেক্ট করা আমার জীবনে সবচেয়ে কঠিনতম কাজ। সে যে মারা যায়নি, এতে ভালোই হয়েছে। এখন ইচ্ছে করলে প্রতিদিন তার পাশে গিয়ে হাত ধরে বসে থাকতে পারবে। তাকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলিনি অন্তত।
“আমাদের কাজ তো শেষ?” ইন্দিরার কথায় চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে গেল আমার।
“হ্যাঁ।”
“বেশ। আমার যেতে হবে, বারোটার সময় একজন রোগির সাথে দেখা করার কথা।”
“আপনি চলে যান বরং,” বললাম।
“লাঞ্চে দেখা হচ্ছে তাহলে?”
“হ্যাঁ।”
আমার হাতে আলতো করে একবার চাপ দিয়ে বেরিয়ে গেল ইন্দিরা।
ঘড়ির দিকে তাকালাম। আজকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার ইচ্ছা আমার। বড় বেশি ক্লান্ত লাগছে। বাতি নিভিয়ে রুমটা থেকে বের হতে যাবো, এ সময় হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় আসলো আমার। ওখানেই জমে গেলাম।
ডায়েরিটা কোথায়?
ঘরের চারদিকে তাকালাম। সবকিছু খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছি আমি। অ্যালিসিয়ার ব্যক্তিগত সব জিনিস হাতিয়ে দেখেছি।
কিন্তু ডায়েরিটা কোথাও নেই।
এতটা বেখেয়ালী হলাম কী করে? ইন্দিরার প্যাচালের কারণে আসলে বারবার মনোযোগ ছুটে গেছে।
কোথায় ওটা? নিশ্চয়ই এখানেই কোথাও আছে। ডায়েরি ছাড়া ক্রিস্টিয়ানের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ উপস্থাপন করা যাবে না। ওটা লাগবেই আমার।
আবারো তল্লাশি চালালাম ঘরটায়, সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। দুশ্চিন্তা। সবগুলো কার্ডবোর্ডের বাক্স উল্টেপাল্টে দেখলাম। সব খাম ছিঁড়ে ফেলে স্কেচগুলো মাটিতে ফেলে দিলাম। ওগুলোর মধ্যে লুকোনো নেই জিনিসটা। আবারো সবগুলো ড্রয়ার একটা একটা করে দেখলাম ধৈৰ্য্য সহকারে।
কিন্তু কোথাও পেলাম না ডায়েরিটা।
.
৫.৩
রিসিপশনে ট্রাস্টের জুলিয়ান ম্যাকমেহন অপেক্ষা করছিল আমার জন্যে। হৃষ্টপুষ্ট শরীরের বিশালদেহী একজন মানুষ, লালচে কোঁকড়ানো চুল। কথোপকথনের সময় আপনার আমার মধ্যে থাক ব্যাপারটা, ‘সব কথার শেষ কথা বা বুঝতেই তো পারছেন এই জাতীয় কথা বলে অভ্যস্ত। ট্রাস্টের খুব অল্প সংখ্যক সদস্যই গ্রোভের প্রতি সদয়, জুলিয়ান তাদের মধ্যে একজন। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে সে।
“প্রফেসর ডায়োমেডেসের সাথে কেবলই কথা হলো। একটা বিষয় আপনার জানা উচিৎ-তিনি কাজ থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন।”
“ওহ আচ্ছা।”।
“আসলে ওনার চাকরির আরো কয়েক বছর বাকি ছিল। কিন্তু অনুসন্ধান কমিটিকে এড়াতে নিজে থেকেই সরে গেলেন। আপনার আর আমার মধ্যেই থাক কথাটা, কাঁধ নাচালো জুলিয়ান। “বেচারার জন্যে খারাপই লাগছে। এত সুন্দর একটা ক্যারিয়ারের এরকম সমাপ্তি। তবে মিডিয়ার হৈ-হট্টগোলের মধ্যে জড়াতে হবে না। যাইহোক, আপনার কথা বলছিলেন প্রফেসর।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ। নিজের পদটা আপনাকে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন,” বলে একবার চোখ টিপলো জুলিয়ান। “আপনি নাকি কাজটার জন্যে একদম আদর্শ ব্যক্তি।”
হাসলাম আমি। “সবসময়ই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন প্রফেসর।”
“দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক দিনের ঘটনার কারণে ট্রাস্টের পক্ষে আর গ্রোভ চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে ক্রিস্টিয়ানের গ্রেফতার এই সিদ্ধান্ত নিতে একপ্রকার বাধ্যই করেছে আমাদের। চিরদিনের জন্যে গ্রোভ বন্ধ করে দিচ্ছি আমরা।”
“খুব বেশি অবাক হলাম না শুনে। অর্থাৎ আমার কোন চাকরি নেই আপাতত?”
“আসলে, সব কথার শেষ কথা-কয়েক মাসের মধ্যে আমরা নতুন। সাইকিয়াট্রিক সার্ভিস চালু করার কথা ভাবছি। যেখানে ট্রাস্টের খরচ আগের তুলনায় অনেক কম হবে। আর আপনি যদি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে যোগ দেন, তাহলে আমরা খুশি হবো, থিও।”
উত্তেজনা চেপে রাখা কষ্টকর হলো আমার জন্যে। হাসিমুখেই হ্যাঁ বলে দিলাম। “আপনার আর আমার মধ্যেই একটা কথা বলি,” তার মত করেই বললাম, “এরকম সুযোগের স্বপ্নই দেখে এসেছি এতদিন।”
বানিয়ে বলিনি কথাটা। আমি যদি কোন সাইকিয়াট্রিক পরিচালনার সুযোগ পাই, তাহলে সত্যিকার অর্থেই অনেকে লাভবান হবে সেখান থেকে। যেমনটা রুথের কাছ থেকে আমি লাভবান হয়েছি। অ্যালিসিয়াকে যেভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।
আমার জন্যে এখানে আসার সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল না, এটা স্বীকার করতেই হবে।
যা চেয়েছিলাম তার সবটুকুই পেয়েছি। প্রায় সবটুকু।
***
গত বছর সেন্ট্রাল লন্ডন থেকে সারেতে চলে যাই আমি আর ক্যাথি, যেখানটায় বড় হয়েছি আমি। বাবা মারা যাবার সময় বাড়িটা আমার নামে দিয়ে যান। তবে মা যতদিন বেঁচে আছেন, মালিকানা তারই থাকবে। কিন্তু মা অত জটিলতার মধ্যে যেতে চাননি। আমাকে আর ক্যাথিকেই বাড়িটা পুরোপুরি লিখে দিয়ে তিনি একটা বৃদ্ধাশ্রমে উঠে পড়েন।
জায়গাটা লন্ডন থেকে একটু দূরে, এটা ঠিক। কিন্তু ওখানে এরকম খোলামেলা বড় বাসা কখনো পেতাম না। আমরা ঠিক করেছিলাম, সারেতে আসার পরপরই সবকিছু একদম নতুন করে সাজাবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর করা হয়ে ওঠেনি। বাড়ি সাজানোর জন্যে পোর্তোবেল্লো মার্কেট থেকে কেনা জিনিসগুলো এখনও আগের মতনই প্যাকেট করে রাখা আছে। তাই বাড়িটার চেহারা খুব একটা বদলায়নি। বরং ছেলেবেলায় যেমনটা দেখেছি, এখনও সেরকমই আছে।
বাড়িতে পৌঁছে নিজেই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলাম। যত দ্রুত সম্ভব কোট খুলে ফেললাম, ভেতরটা গ্রিনহাউজের মতন গরম। হলওয়েতে থার্মোস্ট্যাটের তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে দিলাম। ক্যাথির এরকম গরমে থাকতে ভালো লাগলেও আমার তুলনামূলক ঠাণ্ডাই পছন্দ। এটা নিয়ে প্রায়ই খুনসুটি হয় আমাদের। টিভির আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি হলওয়ে থেকে। ইদানীং টিভি দেখার পরিমাণ বেড়ে গেছে ক্যাথির। সবসময় চালুই থাকে চারকোনা জিনিসটা।
লিভিংরুমে উঁকি দিয়ে দেখি সোফায় পা তুলে বসে আছে সে। হাতে বড় একটা চিপসের প্যাকেট। সবসময় এসব হাবিজাবি খেতেই থাকে; এ কারণেই গত কয়েক বছরে ওজন এ রকম বেড়ে গিয়েছে। এখন আর আগের মতন ব্যায়ামের ধার ধারে না। অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে আগের তুলনায়, অবসাদগ্রস্তও বলা যায়। ওর ডাক্তার অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট খাওয়ার কথা বললেও, আমি মানা করে দিয়েছি। বরং একজন থেরাপিস্টের কাছে মনের সব কথা বলে হালকা হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাথি খব সম্ভবত কারো সাথেই কথা বলতে চায় না।
প্রায়ই খেয়াল করি যে আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে। তখন ওর মাথায় কি চলে কে জানে। হয়তো গ্যাব্রিয়েলের ব্যাপারে আমাকে বলবে কি না সেসব নিয়ে ভাবে। কিন্তু শেষমেষ কিছুই বলে না। চুপচাপ বসে থাকে, অনেকটা অ্যালিসিয়ার মতন। ওকে সাহায্য করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু সেটা সম্ভব হচ্ছে না কিছুতেই।
মাঝে মাঝে সবকিছু অর্থহীন মনে হয় আমার কাছে। এত কিছু তো ক্যাথিকে কাছে রাখার জন্যেই করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওকেও হারাতে হলো।
সোফার হাতলে বসে ওকে কিছুক্ষণ দেখলাম। “আমার এক রোগি প্রায় মরতে বসেছিল ওভারডোজের কারণে। এখন কোমায়।”ক্যাথি নির্বিকার। “খুব সম্ভবত আমার এক সহকর্মীই ইচ্ছেকৃতভাবে কাজটা ঘটিয়েছে। এবারেও কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আমার কথা শুনতে পাচ্ছো তুমি?”
কাঁধ ঝাঁকালো ক্যাথি। “হ্যাঁ, কিন্তু বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।”
“সমবেদনা জানিয়েও কিছু একটা বলতে পারতে।”
“কার জন্যে সমবেদনা? তোমার জন্যে?”
“না, আমার রোগির জন্যে। লম্বা একটা সময় ধরেই তার থেরাপিস্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিলাম। অ্যালিসিয়া বেরেসন।” নামটা বলার সময় মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলাম ক্যাথিকে।
মনে হলো যেন আমার কথা কানেই যায়নি তার। এক মুহূর্তের জন্যেও অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না।
“বেশ বিখ্যাত কিন্তু সে, কুখ্যাতও বলতে পারো। কয়েক বছর আসে স্বামীকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে, মনে আছে তোমার?”
“নাহ,” আবারো কাধ ঝাঁকিয়ে চ্যানেল বদলায় ক্যাথি।
হ্যাঁ, আমাদের মধ্যে নাটকটা এখনও চালু আছে।
আমার অভিনয়ের মাত্রাও আগের তুলনায় আরো বেড়েছে। অনেকের সাথেই এরকম নাটক করতে হয় এখন। এমনকি নিজের সাথেও অভিনয় করি। সেজন্যেই এসব লিখে রাখছি বোধহয়। আত্মহংকারের জন্যে সত্যটা মেনে নিতে কষ্ট হলেও, এখানে বাস্তবতাটুকু জমা থাক।
একটা ড্রিঙ্ক দরকার আমার এখন। রান্নাঘরে গিয়ে ফিজার থেকে ভদকার বোতল বের করলাম। গ্লাসে একটু ঢেলে নিয়ে একবারে গিলে ফেললাম পুরোটা। আরেক শট ঢালোম।
রুথের সাথে যদি এখন আবারো দেখা করি, তাহলে কি বলবে সে? ছয় বছর আগে তার কাছেই তো খুলে বলেছিলাম সবকিছু। কিন্তু সেটা যে সম্ভব নয়, তা ভালো করেই জানি। আমি আর আগের থিও নেই। আমার ভেতরের সতোর লেশমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না। রুথের মত বয়স্ক একজনের মানুষের সামনে বসে কি করে অকপটে মিথ্যে বলবো? আমার জীবনে তার অবদান অন্য যে কারো চাইতে বেশি। কি করে তাকে বলবো যে তিনটা জীবন পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছি? আর সেজন্যে বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই আমার ভেতরে। শিষ্টাচার, দয়া, সতোর জায়গা দখল করে নিয়েছে শঠতা, হিংসা আর বিকৃত মানসিকতা। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে ভাবি না আমি।
রুথের মনে আমার জন্যে বিতৃষ্ণা জন্মাবে, এই ভাবনাটার চাইতে আমার জন্যে কষ্ট পাবে সে-এই ভাবনাটাই বেশি পোড়ায়। তার হয়তো মনে হতে পারে যে আমাকে সাহায্য করতে অক্ষম হয়েছে সে। একদম অল্প বয়সি একটা ছেলে, যে তার কাছে সাহায্যের আশায় গিয়েছিল-সযোগ পেয়েও তার সমস্যা দূর করতে পারেনি সে। তার আত্মাটাকে বাঁচাতে পারেনি। ঘন্টার পর ঘন্টা সাইকোথেরাপির কোন মূল্য থাকবে না। কিন্তু ধারণাটা ভুল, কারণ সব দোষ আমার।
কলিংবেল বেজে উঠলো এসময়। কল্পনা থেকে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। সন্ধ্যা বেলায় আমাদের বাসায় কেউ আসে না। বিশেষ করে লন্ডন থেকে সারেতে চলে আসার পর কেউ এসময় বেল বাজায়নি। আর শেষ কবে আমাদের বাসায় কাউকে দাওয়াত দিয়েছিলাম, সেটাও ভুলতে বসেছি।
“কারো আসার কথা নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু ক্যাথি জবাব দিল না। টেলিভিশনের শব্দ ছাপিয়ে বোধহয় আমার কথা শুনতেই পায়নি।
আমিই উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালেন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। একটু অবাকই হলাম তাকে দেখে। অতিরিক্ত ঠাণ্ডার কারণে গাল দুটো একদম লাল হয়ে আছে বেচারার। গলায় মাফলার জড়ানো।
“শুভ সন্ধ্যা, মি. ফেবার।”
“ইন্সপেক্টর অ্যালেন? আপনি এখানে?”
“এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম, তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। তাছাড়া কেসের ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য জানতে পেরেছি। এখন কথা বলতে পারবেন?”
ইতস্তত করতে লাগলাম আমি। “আসলে এখন তো রান্না করবো ভাবছিলাম, তাই
“খুব বেশি সময় লাগবে না।”
হাসল অ্যালেন। না করলেও যে শুনবে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে, অগত্যা একপাশে সরে তাকে ভেতরে আসার সুযোগ করে দিলাম আমি। ভেতরে ঢুকে হাসি আরো চওড়া হলো তার। হাতমোজা আর কোট খুলে ফেলল। “এত ঠাণ্ডা পড়েছে। কিছুক্ষণ পর তুষার ঝরতে শুরু করবে নিশ্চয়ই।” তাপমাত্রার পরিবর্তনের কারণে চশমার কাঁচ ঘোলা হয়ে গেলে রুমাল দিয়ে সেগুলো পরিস্কার করে নিল।
“আমাদের বাসায় একটু বেশিই গরম।”
“আরে নাহ, আমার তো এরকম গরমই পছন্দ।”
“আমার স্ত্রী-ও আপনার মতনই।”
ঠিক এই সময় ক্যাথি হলওয়েতে বেরিয়ে এসে আমার আর ইন্সপেক্টর অ্যালেনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। “কি হয়েছে?”
“ক্যাথি, ইনি চিফ ইন্সপেক্টর অ্যালেন। একটু আগে আমার যে রোগির ব্যাপারে কথা বলছিলাম, তার কেসটা তিনিই দেখছেন।”
“শুভ সন্ধ্যা, মিসেস ফেবার।”
“কিছু ব্যাপারে আলাপ আছে আমাদের। খুব বেশিক্ষণ লাগবে না। তুমি গিয়ে গোসল সেরে ফেল। আমি খাবার রেডি করে তোমাকে ডাক দেব,” বলে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে ইঙ্গিত করলাম। “চলুন তাহলে।”
ক্যাথির দিকে একবার তাকিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলো ইন্সপেক্টর অ্যালেন। তার পেছন পেছন গেলাম আমি। ক্যাথি তখনও হলওয়েতেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিছুক্ষণ পর তার পদশব্দ ওপর তলায় মিলিয়ে গেল।
“কিছু খাবেন?”
“ধন্যবাদ। এক কাপ চা পেলে বর্তে যেতাম।” ভদকার বোতলটার দিকে তাকিয়ে বলল ইন্সপেক্টর।
হাসলাম আমি। “নাকি আরো শক্ত কিছু?”
“নাহ, আপাতত চা-ই দিন।”
“কিরকম চা পছন্দ করেন আপনি?”
“একটু কড়া। খুব বেশি দুধ না দিলেও চলবে। চিনি ছাড়া। চেষ্টা করছি মিষ্টি সবকিছু এড়িয়ে চলার।”
কেতলিতে পানি চাপিয়ে তার মুখোমুখি বসলাম।
“কী যেন বলবেন বলেছিলেন?”
“আসলে মি. মার্টিনের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
“জিন-ফিলিক্স?” বিস্মিত কণ্ঠে বললাম। “তার ব্যাপারে আবার কি কথা?”
“তিনি গ্রোভে এসেছিলেন অ্যালিসিয়ার আঁকা ছবি আর অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে যেতে। তখন বেশ কিছুক্ষণ তার সাথে আলাপ হয়। চমৎকার একজন মানুষ। অ্যালিসিয়ার ছবিগুলো নিয়ে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করার কথা ভাবছেন। তার মতে এখনই মোক্ষম সময়, যেহেতু মিডিয়াতেও অ্যালিসিয়াকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, আমার দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকালো অ্যালেন। “আপনি কিন্তু তাকে নিয়ে একটা বই লিখতে পারেন।”
“আসলে এ বিষয়ে এখনও কিছু ভাবিনি। মাফ করবেন, জিন ফিলিক্সের সাথে আমার সম্পর্কটা এখনও বুঝতে পারছি না, ইন্সপেক্টর।”
“নতুন ছবিটা নিয়ে খুবই উৎসাহী ছিলেন মি. মার্টিন। এলিফ যে ছবিটায় দাগ দিয়েছে, এটা নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই তার। বরং এতে নাকি ছবিটার শিল্পমূল্য বেড়ে গেছে। আমি নিজে আসলে এসব শিল্প-টিল্প নিয়ে অত বেশি বুঝি না, মি. ফেবার। আপনি বোঝেন?”
“নাহ্।” মূল কথায় আসতে তার কতক্ষণ লাগবে কে জানে। কেমন যেন অস্বস্তিবোধ হচ্ছে আমার।
“যাইহোক, ছবিটার অনেক প্রশংসা করছিলেন মি. মার্টিন। এক পর্যায়ে ভালো করে দেখার জন্যে হাতে তুলে নেন। আর সেখানেই ছিল জিনিসটা।”
“কোন জিনিসটা?”
“এটা।”
জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চারকোণা জিনিস বের করলো প্রফেসর। দেখামাত্র সেটা চিনতে পারলাম আমি।
অ্যালিসিয়ার ডায়েরি।
এসময় কেতলিটা পানি গরম হয়ে যাওয়ার সংকেত দিলে সেখান থেকে ফুটন্ত পানি নিয়ে একটা মগে ঢালোম আমি। চামচ দিয়ে দুধ মেশানোর সময় খেয়াল করলাম যে হাত কিছুটা কাঁপছে।
“ওহ। আমিও ভাবছিলাম যে কোথায় ডায়েরিটা।”
“ফ্রেমের উল্টোদিকে বামপাশে আটকে ছিল। ওখানে গেল কী করে কে জানে।”
এ কারণেই তাহলে চোখে পড়েনি। ছবিটা এতই অপছন্দ আমার যে একবার উল্টিয়েও দেখিনি। দেখলে…
কালো ডায়েরিটার ওপরে এখন হাত বুলাচ্ছে ইন্সপেক্টর। “ভেতরের লেখাগুলো কিন্তু ধাঁধার মতন। তীর চিহ্ন দিয়ে যোগ করা হয়েছে অনেক কিছু। বিভ্রান্তিকর।”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। “অসুস্থ মনের প্রতিচ্ছবি বলতে পারেন।”
ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে একদম শেষদিকে চলে গেল ইন্সপেক্টর। এরপর ওখান থেকে জোরে জোরে পড়া শুরু করলেন
“…সেজন্যেই কয়েক মিনিট আগে ফিরে এসেছিল। তবে এবারে আর কিছু বলেনি। সোজা এগিয়ে এসে আমার কব্জিতে একটা সুঁই বিধিয়ে দেয়।”
হঠাই আতঙ্ক ভর করলো আমার চিত্তে। আমি যখন ডায়েরিটা পড়ি তখন এই কথাগুলো ছিল না। এরকম প্রমাণের ভয়েই ছিলাম। কিন্তু এখন ডায়েরিটা ভুল একজনের হাতে চলে গেছে। ইচ্ছে করছে তার হাত থেকে ডায়েরিটা ছিনিয়ে নিয়ে পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। ফাঁদে পড়ে গেছি। তোতলাতে শুরু করলাম
“আ-আমার মনে হয় যদি-”
আমি যে ঘাবড়ে গেছি এটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছে ইন্সপেক্টর। “জি?”
“না, কিছু না।”
তাকে থামানোর আর চেষ্টা করলাম না। এখন আমি যা-ই করি না কেন তাতে আমাকে আরো বেশি অপরাধী মনে হবে। এই প্যাঁচ থেকে বেরুবার আর কোন উপায় নেই। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, আগের তুলনায় অনেক বেশি স্বস্তিবোধ হচ্ছে এখন।
“আমার মনে হয় না আপনি অন্য কোন কাজে এই এলাকায় এসেছিলেন, ইন্সপেক্টর,” তার হাতে চা তুলে দিয়ে বললাম।
“ঠিক ধরেছেন। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়েই এখানে আসার উদ্দেশ্যটা বলে ফেলতে মন সায় দেয়নি। সত্যিটা হচ্ছে, এই ডায়েরির লেখাগুলো কিন্তু পুরো বিষয়টার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।”
“ওখানে কি লেখা সেটা আমিও জানতে চাই,” নিজেকে বলতে শুনলাম। “দয়া করে একটু জোরে পড়বেন?”
“বেশ, এত করে যখন বলছেন…”
মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা প্রশান্তি নিয়ে জানালার পাশের চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম।
একবার গলা খাকারি দিয়ে পড়তে শুরু করলো ইন্সপেক্টর অ্যালেন।
“মাত্র চলে গেল থিও। এখন একা আমি। যত দ্রুত সম্ভব সবকিছু লিখে ফেলতে হবে আমাকে। খুব বেশি সময় নেই হাতে…”।
কথাগুলো শুনতে শুনতে আকাশে সাদা মেঘের আনাগোণা দেখতে লাগলাম। অবশেষে তাদের মন গলেছে। ভেতরে বন্দি থাকা তুষারগুলোর আজ ছুটি। জানালা খুলে হাত সামনে বাড়ালাম। একটা তুষারকণা ভাসতে ভাসতে আমার হাতে এসে পড়লো। কিছুক্ষণ পর আবার মিলিয়েও গেল। অজান্তেই মুখে একটা হাসি ফুটলো আমার।
আরেকটা তুষারকণা ধরার জন্যে হাত সামনে বাড়িয়ে দিলাম।
৫ নং অধ্যায়ের পরবর্তী অংশটা কোথায়?
আর নেই। এখানেই শেষ।
আসাধারন একটি উপন্যাস পড়তে ভালো লাগেছে।
বইটা পড়তে পড়তে নিজেকেই কেমন জানি মানসিক রোগী মনে হচ্ছিল। এতো বড় একটা বই দুই দিনে পড়ে শেষ করব ভাবিনি!
অসাধরন
অসাধারণ একটা বই,,,প্রথমে বুঝতেই পারিনি শেষ টা এরকম হবে..অসাধারণ