রাক্ষুসে ক্ষুধা

রাক্ষুসে ক্ষুধা

দুটো চকচকে বাদামী ক্যাপসুল গিলে নিল মনরো। তাকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে। হাসল। আজকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাসতে পছন্দ করে মনরো। তার দাঁতগুলো এখন ধবধবে সাদা। দশ বছর বয়স থেকে প্রতি বছর তিন মাস দাঁতের ডাক্তারের চেম্বারে যাতায়াত তার নিত্য রুটিনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এখন তার দাঁতে কোনও সমস্যা নেই। সমান, মসৃণ, চৌকোনা দাঁতগুলো হিরের মত ঝকঝক করছে।

এক কদম পিছিয়ে এল মনরো, কনুই ঘষা খেল বাথরুমের বিদ্যুৎ- বাতির সুইচে। মাথার ওপরের বাতিটি নিভে গেল। তবে মনরো আঁধারেও দিব্যি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সবকিছু। ওর জীবনে এটা আরেকটা চমকপ্রদ ঘটনা; ওর আশ্চর্য নৈশ-দৃষ্টি। ক্যাপসুলগুলো খাওয়ার পর থেকে মনরোর জীবনে অভূতপূর্ব সব পরিবর্তন ঘটে চলেছে। সবচেয়ে পরিবর্তন এসেছে খাদ্যাভ্যাসে। যে মনরোর এক সময় খাবার দেখলেই গা গোলাত এখন তার খিদে বেড়ে গেছে বহুগুণ।

বোর্ডিং হাউজের ডাইনিং রুমে ঢুকল মনরো। তার টেবিলটা যথারীতি খানি অথচ মাসখানেক আগেও টেবিলটা খালি পেত না সে। আজকাল মনরো নিঃশব্দে খাওয়া সারে, তার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে থাকা অন্য ভাড়াটেদের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করেই, তারপর বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। ওর একটু এক্সারসাইজ করা দরকার। হ্যাটখানা মাথায় চাপিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল মনরো!

রাস্তায় নেমে বুক ভরে দম নিল ও। ঠাণ্ডা বাতাস ঝাপটা দিল পিঠে। হাঁটা ধরন মনরো। শহরের শেষ প্রান্তে আসার পরে শুরু করুণ দৌড়। বিরামহীন তিন ঘণ্টা দৌড়াল সে। সামান্য ক্লান্ত বোধ করছে। এবার বাড়ির ফিরতি পথ ধরল মনরো। রাস্তার পাশে একটি লাঞ্চবার-এ আটকে গেল নজর। কাউন্টারের সামনে রাখা একটি টুলে বসে পড়ল সে। আরেকটা টুলে পড়ে থাকা খবরের কাগজটা তুলে নিল। পড়তে লাগল। মনোযোগে ছেদ পড়ল কাউন্টারম্যানের কন্ঠে:

‘শুনুন, মিস্টার, আমি জানি না আপনি কে রা কী, তবে আপনি যে-ই হোন, এখান থেকে উঠে পড়ন। পনেরো মিনিট আগে শর্টসার্কিট হয়ে বিদ্যুৎ চলে গেছে। অথচ অন্ধকারে বসে আপনি কিনা পেপার পড়ছেন! ফোটেন তো, মিয়া!’

কাঁধ ঝাঁকাল মনরো, চলে এল ওখান থেকে। আবার হাঁটতে লাগল রাতের বেলা এই হাঁটাহাঁটি নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগে, যখন ও ছিল নিতান্তই রোগা-পটকা, বেঁটে, খুদে একটা মানুষ—তখনও সান্ধ্যভ্রমণ করত মনরো। হাঁটত যাতে ক্লান্ত হয়ে ঘুম আসে।

আর হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েই লোকটার সঙ্গে ওর পরিচয়।

.

বসন্তের শেষের দিকের এক রাতের ঘটনা ছিল ওটা। মনরো হাঁটতে হাঁটতে অচেনা একটি রাস্তায় চলে এসেছে, এমন সময় ধোঁয়া চোখে পড়ল ওর। একটি বাড়ির সামান্য খোলা একটি দরজা দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। ফায়ার ড্রিলের ট্রেনিং নেয়া মনরোর• চোখ প্রথমেই রাস্তায় ফায়ার অ্যালার্ম বক্স খুঁজল। তারপর পুলিশের সন্ধান করল। এরপর পথচারীর খোঁজ করল। কিন্তু কিছু বা কাউকে চোখে পড়ল না। বুক ভরে শ্বাস নিল মনরো, দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল ঘরে। বাড়িতে একটিই মাত্র ঘর। আর ধোঁয়ার পাতলা একটি রেখা উঠছে এই ঘর থেকেই। ঘরের মাঝখানে তিন ঠেঙা টেবিলের ওপর রাখা পিতলের একটি পাত্র থেকে ধোঁয়ার উৎপত্তি। ধোঁয়ার সামনে, মনরোর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুদ্রকায়, বাঁকা পায়ের একটি মানুষ। তার পরনের আলখেল্লার নীচের অংশ মাটিতে লুটোচ্ছে। বেঁটে লোকটি মনরোর দিকে ফিরে তাকালও না, ইশারায় দেয়ালে ঠেস দেয়া কাউচে বসতে বলল।

কাউচের কিনারায় বসল মনরো। পিতলের পাত্র থেকে লকলকে অগ্নিশিখা জ্বলে উঠে মাঝে মাঝে আলোকিত করে তুলছে ঘর। ক্ষুদ্রকায় মানুষটির আলখেল্লার সোনার কাজ করা কারুকাজ ঝলমল করে উঠছে আলখেল্লায় চাঁদ, ছাগলসহ অচেনা ছোট ছোট কিছু জন্তুর ছবি। বেঁটে মানুষটি ঘুরল :

‘তুমি এসেছ বলে আমি খুশি হয়েছি। খুবই খুশি। ভেবেছিলাম কেউই বুঝি আসবে না।’

মনরো হাঁ করে তাকিয়ে থাকল লোকটির দিকে।

লোকটি হাত ঝাড়া দিতেই তার হাতে যেন ভোজবাজির মত উদয় হলো একটি ছোট প্যাডের কাগজ এবং পেন্সিল। সে পেন্সিলে কী যেন লিখল। তারপর বলল, ‘ভিটামিন বি। নার্ভের জন্য খুবই চমৎকার। তোমার কী কী সমস্যা আমাকে বলো।’

মনরো একটু ভেবে নিল। সে তার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে ভালবাসে।

‘আমার খিদে বলে কিছু নেই,’ বলল সে। রাতে আমার ঘুম আসে না। আমার দাঁতের অবস্থা জঘন্য। ছেলেবেলায় একবার রিকেট হয়েছিল আমার। তারপর থেকে শরীরের হাড়গোড় তুলোর মত নরম-’

‘বেশ,’ হাতে ‘হাত ঘষল ক্ষুদ্রকায় মানুষটি। ‘তোমার লাগবে পুরো ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, সেই সঙ্গে অন্যান্য ভিটামিনেরও প্রয়োজন হবে। শুধুই ভিটামিন। কোনও তন্ত্রমন্ত্রের দরকার নেই। এখন ওং বং চং মন্ত্রের যুগ ফুরিয়েছে। ভিটামিন ক্যাপসুল খেলেই সমস্ত রোগ সেরে যাবে। আর সবগুলোই খেতে হবে। ভাগ্যিস, নিয়তি আমার কাছে তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে!’

ছোট্ট হাতটি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল প্যাড, সেখানে উদয় হলো গাঢ় বাদামী রঙের একটি বোতল। বোতলটি মনরোর দিকে এগিয়ে দিল সে। মনরোকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল।

‘এটা নাও,’ হাসছে ক্ষুদ্র মানুষ। ‘ওষুধের দোকানে কোটি টাকা দিলেও এ জিনিস মিলবে না। অত্যন্ত উঁচুমানের ওষুধ এগুলো। মাইগড, তুমি কল্পনাও করতে পারবে না কী দারুণ একটা ওষুধ তোমাকে দিচ্ছি। নাও। পয়সা দিতে হবে না। আমার তরফ থেকে তোমার জন্য এটা উপহার। তবে তোমাকে একেবারে শুধু শুধু দিচ্ছি না। একটা বিষয় প্রমাণ করা দরকার আমার। তোমাকে দিয়ে সে বিষয়টি প্রমাণ করতে চাই। ক্যাপসুল ফুরিয়ে গেলে আবার এসো। মাগনা দিয়ে দেব।’

.

মনরোর হাতে বাদামী বোতল। তাকে হতবুদ্ধি লাগছে। রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে ও। অথচ একটু আগেও একটি ঘরে ছিল মনরো। ধোঁয়া উড়তে দেখেছে। কিন্তু সত্যি কি ধোঁয়া দেখেছে ও? কুয়াশা পাক খাচ্ছে রাস্তায়। কুয়াশাকে ধোঁয়া ভাবেনি তো? আর বাড়িটাই বা গেল কোথায়? পুরোটাই যদি ওর অনুর্বর মস্তিষ্কের কল্পনা হয়ে থাকে তা হলে হাতে ক্যাপসুলের এ বোতল এল কোত্থেকে? শ্রাগ করল মনরো, ঘুরল, বোতল নিয়ে ফিরে এল বোর্ডিং হাউজে।

নিজের ঘরে ঢুকল মনরো, মুঠোয় শক্ত করে ধরা বাদামী বোতল। সাবধানে আটকে দিল দরজা। কাপড় খুলতে লাগল। শার্ট খুলতেই শীতল বাতাস ঝাপটা দিয়ে গেল ওকে। নাকের ভেতরটা সুড়সুড় করে উঠল। হ্যাঁ- আ আ চ্চো! হাঁচি দিল মনরো। হাঁচির সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মাথা ব্যথা। বোতলের দিকে তাকাল মনরো। বোতলের গায়ে একটি লেবেল লাগানো। লেবেলে লেখা: এখুনি দুটো ক্যাপসুল খেয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ো।

বোতলের ক্যাপ খুলল মনরো, তালুতে ফেলল দুটো চকচকে ছোট ক্যাপসুল। এক ঢোক পানি দিয়ে পেটে চালান করে দিল ক্যাপসুল জোড়া, তারপর শুয়ে পড়ল বিছানায়। শুয়ে শুয়ে কল্পনা করল পৃথিবীর সমস্ত ক্ষমতা তার হাতে চলে এসেছে এবং সে ইচ্ছে করলেই যে কাউকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মেরে ফেলতে পারছে এবং মেরিলিন মনরোর সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে। গত রাতটাও যার প্রায় বিনিদ্র কেটেছে, সেই মনরো আজ বালিশে মাথা ঠেকানোর ‘এক মিনিটের মধ্যে তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

পরদিন সকাল আটটায় ঘুম ভাঙল মনরোর। সাধারণত ঘুম ভাঙার পরই তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায় সর্দিতে বোজা নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে না বলে। তবে আজ কী আশ্চর্য! নিঃশ্বাস নিতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না তার। নাকে একটুও সর্দি নেই! মাথাটাও ঝিমঝিম করছে না। ড্রেসারের ওপরে রাখা বোতলে চোখ চলে গেল মনরোর। লেবেলটা আছে এখনও। তবে নতুন লেখা ফুটে আছে ওতে: দেখলে তো? আরও ক্যাপসুল প্রয়োজন হবার আগ পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

বোতলটি উল্টেপাল্টে দেখল মনরো। বোতলের গায়ে কোথাও নির্মাতা বা প্রতিষ্ঠান কিংবা এতে কী ধরনের ওষুধ আছে তা সম্পর্কে কিছুই লেখা নেই।

গোসল সেরে নিল মনরো। কাপড় পরে নেমে এল নীচে, ডাইনিংরুমে নাস্তা খেতে। নাস্তায় সে শুধু দুটো শুকনো আলু বোখারা খায়। আর কিছু না। আলু বোখারা দুটো দ্রুত সাবাড় করে ফেলল মনরো। এমন সময় প্লেটে গরম বিস্কিট নিয়ে হাজির হলেন বাড়িউলি মিসেস হেঞ্চ। একটু ইতস্তত করে বাড়িউলির কাছে বিস্কিট খেতে চাইল মনরো।

‘কেন, মি. ফিদারস্টোনহাগ,’ বললেন মিসেস হেঞ্চ, বিস্কিট আপনার পেটে যে সহ্য হবে না তা তো জানেনই। জেনেশুনে বিষ পান করতে চাইছেন যে!’

‘মিসেস হেঞ্চ,’ গলায় গাম্ভীর্য ফোটাল মনরো, ‘সারা দিন যে মানুষটিকে কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় তার শুধু দুটো শুকনো আলুবোখারা খেলে চলে না।’ সে পরপর দুটো বিস্কিট খেল। তারপর একে একে পেটে চালান করল আপেল, কলা এবং এক জোড়া বেকন।

দিনটি কেটে যেতে লাগল দ্রুত। বেশ চমৎকার একটি দিন। জর্ডান অপটিকাল কোম্পানির প্রেসিডেন্ট মি. জর্ডান মনরোর কাজের গতির বেশ প্রশংসা করলেন। সে অত্যন্ত দ্রুত তৈরি করে ফেলল বুক কীপিং শিট মনরো লক্ষ করল মি. জর্ডানের সেক্রেটারি গ্লোরিয়া রিংগল, যে কিনা মনরোর দিকে ভুলেও তাকায় না, আজ বেশ কয়েকবার তাকে ফিরে দেখল।

ওই রাতে ঘুমাবার আগে বোতলের লেবেল পড়ল মনরো। লেবেলে লেখা: তুমি কি ক্লান্ত এবং তোমার কর্মক্ষমতা কি হ্রাস পেয়েছে? অন্যরা যখন সেরা চাকরি এবং সুন্দরী মেয়েগুলোকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে তুমি কি তখনও বোকার মত মাটিতে পায়ের নখ খুঁড়ছ? তোমাকে আর হতাশ হতে হবে না, মনরো। যাও। এখুনি দুটো ক্যাপসুল খেয়ে ফেলো।

মনরো দুটো ক্যাপসুল গিলল।

সকাল। রোদ চমকাচ্ছে সূর্য। মনরো লাফ মেরে নামল বিছানা থেকে। হাত পা টান টান করে ভরাট গলায় গান ধরল। শেভ করার সময় লক্ষ করল তার দাড়ি আগের চেয়ে ঘন হয়ে উঠেছে। ত্বকের রঙে সোনালি ছাপ। আর তার চোখ-আহ্! কী অন্তর্ভেদী চাউনি চোখে। সে কোথায় যেন পড়েছে ড্রাইভাররা কাঁচা গাজর খায় যাতে রাতের অন্ধকারে গাড়ি চালাতে সমস্যা না হয়। কাল রাতে মনরো লক্ষ করেছে সে অন্ধকারেও খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনের বড় বড় লেখাগুলো পড়তে পারছে। সত্যি, দিন দিন দারুণ উন্নতি হচ্ছে মনরো ফিদারস্টোনহাগের।

সে নাস্তা সারল পাঁচটি বিস্কিট এবং তিনটি ডিম দিয়ে। লক্ষ করল কৌতূহল নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন মিসেস হেঞ্চ।

অফিসে মনরো অ্যাকাউন্টিং চার্টের কাজ সারল অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। সাড়ে দশটা নাগাদ আবার খিদে পেয়ে গেল ওর। লাঞ্চ কাউন্টারে গিয়ে বসল এক গ্লাস দুধ খেতে। পাশের টুলটা দখল করল গ্লোরিয়া রিংগল। মিস রিংগলকে মনে মনে ভালবাসে মনরো। যদিও সাহস করে কথাটা প্রকাশ করা হয়নি।

মনরো মিস রিংগলের দিকে হাসি মুখে ফিরল। ‘গ্লোরিয়া, প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলল সে, ‘আজ রাতে আমার সঙ্গে ডিনার করবে?’

‘কেন নয়, মি. ফিদারস্টোনহাগ,’ হাসি ফিরিয়ে দিল সুন্দরী গ্লোরিয়া। আপনার সঙ্গে ডিনার আমি উপভোগ করব। বলুন কোথায় যাবেন?’

মনরো তিনটার সময় বেরুল অফিস থেকে। বাড়ি গিয়ে দেখবে বোতলের লেবেলে কী নির্দেশ আছে। মনরো দেখল ওতে লেখা: ওহ্, বয়, গ্লোরিয়ার সঙ্গে ডেট। তিনটে ক্যাপসুল খাও।

সন্ধেটা কাটল চমৎকার। মনরো এবং গ্লোরিয়ার যেন জন্মই হয়েছে একে অন্যের জন্য। ওদের রুচিবোধে কী অপূর্ব মিল! ওরা একই বিষয় নিয়ে হেসে কুটিপাটি হলো, অফিসের লোকজন সম্পর্কে দু’জনের ধারণায় কোনও ব্যবধান নেই, দু’জনেরই অপারেশন করে ফেলে দেয়া হয়েছে টনসিল | গ্লোরিয়া ক্ষুধার্ত মানুষ পছন্দ করে: আর মনরো তার খিদে মেটানোর জন্য সর্বোত্তম পুরুষ।

.

কিন্তু আজ রাতে উদ্বেগ বোধ করছে মনরো। লাঞ্চ ওয়াগনের লোকটার ঝাড়িতে মেজাজ বিগড়ে যায়নি ওর, বরং ভয় লাগছে। সবাই জানে ভিটামিন A চোখের দৃষ্টি বৃদ্ধি করে। কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে। মনরো অন্ধকারে হাঁটছে। রাস্তার নুড়ি পাথরে লাথি কষাচ্ছে। নুড়ি পাথর, কাগজের টুকরো ছোটখাট এ সব জিনিস আঁধারেও আশ্চর্য পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। হঠাৎ ওর চোখের সামনে ধোঁয়া উড়তে লাগল। তারপর হাজির হয়ে গেল হুড়কোবিহীন একটি দরজা। খুলে গেল কপাট। ক্ষুদ্রকায় একটি মানুষের পরিচিত শারীরিক কাঠামো ফুটে উঠল। পিতলের একটি পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। পাত্রের নীচে ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে।

সরাসরি কাজের কথায় চলে এল মনরো। ‘দেখুন মি. …আ… আমি চাই না আপনি আমাকে অকৃতজ্ঞ ভাবুন। আমি জানি আপনি আপনার ইয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত আছেন…তবে হলো কী…’

‘আমি মোটেই ব্যস্ত নই,’ স্ফূর্তির গলায় বলল বেঁটে লোকটি। ‘তোমাকে সানন্দে সাহায্য করব। দেখতেই পাচ্ছ এটা একটা অসাধারণ নতুন প্রজেক্ট। জাদুবিদ্যায় রীতিমত বিপ্লব ঘটাতে চলেছি আমরা। গত পঞ্চাশ মিলিয়ন বছরেও ওরা কিছুই শিখতে পারেনি। এখনও থোড়-বড়ি-খাড়া এবং খাড়া- বড়ি থোড় টাইপের ম্যাজিকের জগতে পড়ে আছে। নাহ্, আমাদের সংস্কার- সাধন করতেই হবে। আর ভিটামিন দিয়ে আমি আমার গবেষণা শুরু করেছি। A. ভিটামিন দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধির জন্য, B ভিটামিন নার্ভের শক্তি বাড়ায়, সি ভিটামিন ব্যবহারে সেরে যায় দাঁতের সমস্ত ক্ষত, D ভিটামিন মজবুত করে তোলে শরীরের হাড়-আর বাকিগুলোর কথা তো তুমি জানই। তুমি ভিটামিন নিতে এসেছ, নিয়ে যাও। একদিন বিশ্বের প্রতিটি স্কুল ছাত্র তোমাকে ভিটামিনের জাদুর অগ্রদূত হিসেবে জানবে।’

‘কিন্তু দেখুন,’ মরিয়া গলায় বলল মনরো, ‘আমি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি দেখতে পাচ্ছি। যে কারণে লোকজনের চোখে পড়ে যাচ্ছি। অন্ধকারেও সবকিছু দেখার খায়েশ আমার নেই। জাদুকর হওয়ার কোনও ইচ্ছেও আমার নেই। ভিটামিন A-টা আমার ওষুধের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায় না?’

মনরোর মনে হলো লোকটা যেন রাগে তার খুদে মুঠো পাকিয়েছে ‘সেক্ষেত্রে,’ বলল বামন জাদুকর, ‘আমি ভিটামিন A বাদ দিয়ে অন্য ভিটামিনগুলোর ডোজ বাড়িয়ে দিচ্ছি। তবে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। নতুন প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ খাও’- আবার শূন্য থেকে উদয় হলো বোতল, ‘—এবং সুখি মানুষ হও।

আবার রাস্তায় একা মনরো। ডানে-বামে তাকাল। খুদে মানুষ কিংবা বাড়ি কিছুই চোখে পড়ল না। ঘন হয়ে উঠছে কুয়াশা। মনরো দ্রুত পা চালাল। নিজের আস্তানায় ফিরে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল ওপরে, ঢুকল ঘরে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। তবে তার আগে দুটো ক্যাপসুল খেয়ে নিতে ভুলল না।

ওই হপ্তার শেষের দিকে, ভিটামিন পিলের নিয়মিত ডায়েট চালিয়ে যাওয়ার পরে, মনরো সিদ্ধান্ত নিল গ্লোরিয়ার সঙ্গে তার এনগেজমেন্ট দ্রুত সেরে ফেলা দরকার। গ্লোরিয়া লোকজনকে বলে বেড়াতে লাগল প্রথম প্রথম মনরোকে সে পাত্তা না দিলেও আজকাল সে মনরো ছাড়া কিছুই বোঝে না। মনরোর সবকিছুই তার ভাল লাগে। তার আচার আচরণ, খিদে…সবকিছু।

শুক্রবারটা শুরু হলো বাজে ভাবে। মিসেস হেঞ্চ মনরোকে পরিষ্কার বলে দিলেন মনরো তাঁকে যে ভাড়া দেয় তা দিয়ে তার রাক্ষুসে ক্ষুধা মেটানো সম্ভব নয়। মনরোর জন্য খাবার কিনতে কিনতে তিনি নাকি ফতুর হয়ে যাচ্ছেন। হয় মনরোকে ভাড়া বাড়িয়ে দিতে হবে নতুবা ছাড়তে হবে ঘর।

মনরো আশ্বাস দিল ব্যাপারটি ভেবে দেখবে।

সেদিন রিকেলে প্রচণ্ড খিদে পেতে লাগল মনরোর। সে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর লাঞ্চ কাউন্টারে গেল। গ্লোরিয়া তার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আছে দেখেও না দেখার ভান করল। এমন খিদে জীবনেও লাগেনি তার

সন্ধ্যাবেলা একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকল মনরো পেটে খিদের আগুন নিয়ে। রেস্টুরেন্টের প্রায় সমস্ত খাবার সে একাই সাবাড় করল। গ্লোরিয়ার অন্ধকার মুখে আরও আঁধার ঘনাল। সে মনরোকে নিয়ে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল। তবে পথে প্রেমিকের সঙ্গে একটি কথাও বলল না। ঘরে ঢুকেই কিচেনে ছুটল মনরো। চোখের পলকে এক বাক্স বিস্কিট শেষ করল সে, গিলল এক বোতল কেচাপ-কিন্তু এখনও অতৃপ্ত মনরো ফিরে এল লিভিংরুমে।

অপূর্ব সুন্দর একটি নীল পোশাক পরে আধশোয়া অবস্থায় কাউচে বসে আছে গ্লোরিয়া। খুবই সুন্দর লাগছে ওকে। এত সুন্দর, যে কেউ ওকে দেখলে খিদের কথা ভুলে যাবে। গ্লোরিয়ার দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল মনরো।

‘ডার্লিং,’ বলল সে, ‘তোমার ঠোঁট যেন পাকা টসটসে লাল বেরী তোমার গায়ের ত্বক পীচ ফলের মত জ্বলজ্বল করছে। তোমার দুধ সাদা ঘাড় আমাকে মাখনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে-‘

আর বলতে পারল না মনরো।

.

‘খুবই দুঃখজনক ঘটনা,’ এ নিয়ে কমপক্ষে একশোবার কথাটা পুনরাবৃত্তি করলেন মিসেস হেঞ্চ। ‘ছেলেটা দিলে বড় চোট পেয়েছে। মেয়েটা চলে যাওয়ার পর থেকে ছেলেটা বেদনায় শুকিয়ে যাচ্ছে। এরকম অবস্থা কখনও ছিল না ওর। সবকিছুর প্রতিই সে যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এমনকী এখন ওষুধও খাচ্ছে না। যদিও ওষুধ খেয়ে ওর উপকারই হচ্ছিল। মনরো সমস্ত ওষুধ ফেলে দিয়েছে জানালা দিয়ে। আবার আগের মত না খাওয়া রোগে ধরেছে ওকে।’

‘ওরা মেয়েটার কোনই খোঁজ পায়নি? মেয়েটা কি কারও সঙ্গে ভেগে গেল, নাকি এমনি এমনি অদৃশ্য হয়ে গেল?’

‘কেউ ওর খোঁজ পায়নি,’ বললেন মিসেস হেঞ্চ, জিভ বের করে ঠোঁট চাটলেন, চেহারা করুণ করে ডানে-বামে মাথা নাড়লেন। ‘সে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *