অশুভ যাত্রা

অশুভ যাত্রা

ডাইভারের ভঙ্গিতে শরীর টানটান করে দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ড ক্লেটন। রূপোলি স্পেসশিপ ‘ফিউচার’ নিয়ে মহাশূন্যের অনন্ত যাত্রার উদ্দেশে ডাইভ দিতে যাচ্ছে সে। গভীর দম নিল রিচার্ড ক্লেটন, হাত বাড়াল সামনে। চোখ বুজে স্পর্শ করল ঠাণ্ডা ইস্পাতের লিভার। ইস্পাতের শীতল ছোঁয়ায় সামান্য কেঁপে উঠল শরীর। তারপর লিভারটা ধরে টান মারল নীচের দিকে।

এক সেকেন্ড কিছুই ঘটল না।

তারপরই হঠাৎ প্রবল একটা ঝাঁকুনি ওকে ছুঁড়ে ফেলল স্পেসশিপের মেঝেয়। নড়ে উঠেছে ফিউচার! সেই সাথে অদ্ভুত একটা শব্দে ভরে গেল ভেতরটা। যেন পাখি দ্রুত ডানা ঝাপটাচ্ছে কিংবা দেয়ালি পোকা একটানা গুঞ্জন তুলছে। শব্দটা একটানা বেজেই চলল। সেই সাথে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে কাঁপতে থাকল ফিউচার। পাগলের মত এপাশ-ওপাশ দুলছে। ইস্পাতের দেয়ালে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফিরছে গুঞ্জনটা। শব্দটা ক্রমে উঁচু হয়ে উঠল। হতবুদ্ধি হয়ে মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকল রিচার্ড ক্লেটন। তারপর কোনমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়াল সে। ফুলে ওঠা কপালে হাত বোলাতে বোলাতে ধপ্ করে বসল খুদে বাঙ্কে।

স্পেসশিপটা নড়ছে এখনও। ভয়ঙ্কর কাঁপুনিটা কমেনি একটুও। কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাতেই দুঃখ, বিস্ময় এবং হতাশায় চোয়াল ঝুলে পড়ল তার। ঈশ্বর! প্যানেলটা গেছে। অস্ফুটে বলল ক্লেটন। প্রচণ্ড ধাক্কায় কন্ট্রোল প্যানেলটার কোনও অস্তিত্বই নেই। ভেঙেচুরে শেষ। ভাঙা কাঁচ পড়ে আছে মেঝেতে। ডায়ালগুলো প্যানেলের নগ্নমুখে এদিক-ওদিক ঝুলছে।

ক্লেটন হতাশ হয়ে বসে রইল ওখানেই। এরচে’ করুণ অবস্থা আর কী হতে পারে? তার ত্রিশ বছরের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তারই সামনে। দশ বছর বয়স থেকেই সে স্বপ্ন দেখে এসেছে একটা স্পেসশিপ তৈরি করবে, উড়ে যাবে অনন্ত অম্বরে। সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছিল ক্লেটন। কোটিপতি বাপের একটা পয়সাও এদিক-সেদিক করেনি। স্পেসশিপ তৈরি করার স্বপ্ন সফল করার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করেছে, রাশানদের সাথে বন্ধুর মত মিশেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছে ওদের রকেটগুলো। প্রতিষ্ঠা করেছে ক্লেটন ফাউন্ডেশন। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ভাড়া করে এনেছে মেকানিক, অঙ্কশাস্ত্রবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী এবং শ্রমিক। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে তৈরি হয়েছে তার স্বপ্নযান ‘ফিউচার’। ছোট্ট, জানালাবিহীন ফিউচারে ভ্রমণের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই ছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই যানে ছিল অক্সিজেন ট্যাংক, প্রচুর ফুড ক্যাপসুল এবং স্বচ্ছন্দে হাঁটাহাঁটি করার মত ছ’কদম জায়গাও। আর এই ছোট কেবিনটিই হয়ে উঠেছিল তার সকল স্বপ্নসাধ মেটানোর একমাত্র অবলম্বন। ক্লেটন চেয়েছিল ফিউচারে করেই সে স্বপ্নভূমি মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমাবে। সে-ই হবে মঙ্গলগ্রহে পদার্পণকারী প্রথম মানুষ। হিসেব করেও দেখেছে মঙ্গলে যেতে আসতে তার বিশ বছর সময় লাগবে। ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে ছুটবে ওর ফিউচার। সেভাবেই সব ঠিকঠাক করা হয়েছিল। পুরো প্যানেল সিস্টেমটাই করা হয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য। কিন্তু শুরুতেই এ কী বিপত্তি!

‘এখন আমি কী করব?’ ক্লেটন ভাঙা কাঁচগুলোর দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। বাইরের পৃথিবীর সাথে তার সকল সম্পর্ক এখন বিচ্ছিন্ন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাঙা বোর্ডে সে না দেখতে পারবে সময় না দূরত্ব, না বুঝতে পারবে গতি। এই ছোট্ট, বদ্ধ কেবিন ছেড়ে বাইরে যাওয়ার কোনও উপায়ই নেই। এখানেই হয়তো ওকে বছরের পর বছর বসে থাকতে হবে। একা। নিঃসঙ্গ। নিজেকে সে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখবে তারও উপায় নেই। পড়ার মত বইপত্র কিংবা খবরের কাগজ নেই, নেই খেলাধুলার সরঞ্জাম। মহাশূন্যের বিশাল গহ্বরে এক কয়েদী যেন সে এখন

পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে রিচার্ড ক্লেটন। পৃথিবীটাকে এখন সবুজ আগুনের একটা গোলার মত লাগছে। দ্রুত তাকে পেছনে ফেলে সামনে এগোচ্ছে ফিউচার। এগিয়ে যাচ্ছে আরেক আগুনের গোলার দিকে—মঙ্গল যার নাম।

ক্লেটন মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখল মহাশূন্যে ওর উত্থানপর্বের দৃশ্যটি। দেখল কমলা রঙের আগুন জ্বেলে ফিউচার ঘন সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বুলেটের গতিতে শূন্যে চলেছে। অসংখ্য লোক হাঁ করে দেখছে তার মহাশূন্য যাত্রা। মৌমাছির ঝাঁকের মত ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ওর সহকারী জেরী চেজ। সবাই অবাক হয়ে দেখছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শূন্যে মিলিয়ে গেছে ফিউচার। লোকজন এখন নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঘরে ফিরছে। কিন্তু কিছুদিন পর ওর কথা তাদের আর মনেও থাকবে না। অথচ তাকে, রিচার্ড ক্লেটনকে, এই উড়োজাহাজেই থাকতে হবে বিশটা বছর।

হ্যাঁ, থাকতে হবে। কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু এই কাঁপুনি থামবে কখন? ভাবছে ক্লেটন। কাঁপুনি ইতোমধ্যেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ফিউচার যখন তৈরি করা হয় তখন এরকম কোনও ভাইব্রেশনের কথা তার কিংবা বিশেষজ্ঞদের কারও মাথাতেই আসেনি। তা হলে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হত। কিন্তু এই কাঁপুনি যদি আর না থামে? যদি কুড়িটা বছর ধরেই ফিউচার এভাবে কাঁপতে থাকে? ভাবতেই আতঙ্কে হিম হয়ে যায় ক্লেটন।

বাঙ্কে শুয়ে শুয়ে ভাবছে রিচার্ড ক্লেটন। শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটে -যাওয়া প্রতিটি ঘটনা বিশদভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠল সে। ভেবেছিল এভাবে অন্তত কিছুটা সময় পার করা যাবে। এই দীর্ঘ সময় কাটাবে কীভাবে ভাবতেই শিরশির করে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।

‘আমি অন্তত ব্যায়ামও তো করতে পারি’ চিৎকার করে বলল ক্লেটন। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। ছ’কদম সামনে, ছ’কদম পেছনে। কিন্তু শিগগিরই একঘেয়ে হয়ে উঠল এ হাঁটাহাঁটি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্লেটন। এগোল ফুড-স্টোর কেবিনেটের দিকে। একটা ফুড ক্যাপসুল বের করে মুখে দিয়ে গিলে ফেলল- সংক্ষিপ্ত খাবার। ‘এমনকী খাওয়ার জন্যেও আমাকে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে না। স্রেফ মুখে দিয়ে গিলে ফেললেই হলো।’ শঙ্কিত মনে ভাবল সে। ওর মুখ থেকে কখন উবে গেছে হাসি। ফিউচারের কাঁপুনি ওকে যেন পাগল করে ছাড়বে। অস্থির হয়ে সে শুয়ে পড়ল বাঙ্কে, ঘুমাবার চেষ্টা করল। ঘুম এলে হয়তো এই বিশ্রী, একঘেয়ে গুঞ্জন ও কাঁপুনির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। বাতি নিভিয়ে দিল ক্লেটন। চোখ বুজে নিজের বন্দীদশার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল।

ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই ক্লেটনের মনে প্রশ্ন জাগল, এখন দিন না রাত। কিন্তু স্পেসশিপের মধ্যে দিনরাত্রির তফাত বোঝার উপায় নেই। এখানে দিনও নেই, রাতও নেই। আছে শুধু স্নায়ুকে যন্ত্রণা দেয়া একঘেয়ে শব্দটা। মস্তিষ্ক কুরে কুরে খাওয়া দুঃসহ শব্দটা। বাঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ক্লেটন দেখল ওর পা কাঁপছে। টলতে টলতে এগুলো সে কেবিনেটের দিকে। ফুড ক্যাপসুল গিলল কয়েকটা।

আবার বাঙ্কে এসে বসল ক্লেটন। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগছে। পরিচিত অপরিচিত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন সে এখন। অথচ এখানে করার মত কিছুই নেই। জেলখানার নিঃসঙ্গ কয়েদীদের চেয়েও খারাপ অবস্থা তার। ওরা বরং ওর এই সেলের চেয়ে বড় জায়গায় থাকে, সূর্যের আলো উপভোগ করতে পারে; প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারে তাজা বাতাসে। আর দু’একজন হলেও মানুষের দেখাও পায় তারা। কিন্তু তার অবস্থা! সম্পূর্ণ বিশ্ব সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন এক গুহাবাসী যেন সে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা পেয়ে বসছে ওকে। জীবন্ত কাউকে, কোনও একটা কিছু দেখার তীব্র ব্যাকুলতা অনুভব করছে সে নিজের অন্তরে। সামান্য একটা জ্যান্ত পোকার দেখা পেলেও জীবনের সমস্ত সম্পদ তাকে দিতে পারে এখন ক্লেটন। শুধু একটু প্রাণের স্পন্দন দেখতে চায় ও।

এই লাগাতার একঘেয়ে শব্দ ও অসহ্য ঝাঁকুনি সয়ে যাওয়া, মেঝেতে গুনে গুনে পা ফেলা, ক্যাপসুল খাওয়া আর ঘুমানো ব্যস, এ ছাড়া আর কিছু করার নেই ক্লেটনের। ভাবনাগুলোও যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একসময় হঠাৎ হাতের নখ কাটার প্রবল ইচ্ছে পেয়ে বসল তাকে। প্রচুর সময় ব্যয় করে কাজটা সারল সে। কিন্তু নখ কেটে কি সময় পার করা যায়? আর কোনও কাজ না পেয়ে সে এবার তীক্ষ্ণ চোখে নিজের জামাকাপড়গুলো পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোট্ট আয়নাতে নিজের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখখানা দেখে গেল সে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কেবিনের প্রতিটি জিনিস দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিন্তু তারপরও ঘুম আসার মত ক্লান্তি অনুভব করল না।

.

মাথাটা দপদপ করতে লাগল ক্লেটনের। চিনচিনে একটা ব্যথা। মনে হচ্ছে এই জীবনে ব্যথাটা থেকে রেহাই মিলবে না। ঘুম আসছে না, তবুও বাঙ্কে গিয়ে শুলো সে। শুয়ে জোর করে চোখ বুজল। আস্তে আস্তে তন্দ্রার মত এল। কিন্তু ফিউচারের ঝাঁকুনিতে বারবার কেঁপে উঠল শরীর, তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল বারবার, একসময় পুরোপুরি জেগে গেল সে। বাঙ্ক ছেড়ে উঠে আলো জ্বালল ক্লেটন। এবং আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করল সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।

‘সময় হচ্ছে আপেক্ষিক’ বন্ধুরা সবসময় বলত ক্লেটনকে। এখন সে হাড়ে হাড়ে কথাটার সত্যতা টের পাচ্ছে। সময় জানবে, এমন কোনও কিছুই নেই ওর কাছে। না আছে ঘড়ি, না অন্যকিছু। এমনকী চাঁদ কিংবা সূর্যের চেহারা দেখারও কোনও উপায় নেই। কতসময় ধরে এই স্পেসশিপে আছে সে? প্রাণপণে চেষ্টা করল ক্লেটন মনে করতে। কিন্তু পারল না।

আচ্ছা সে কি প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর খাবার খেয়েছে নাকি দশ ঘণ্টা অন্তর? অথবা বিশ ঘণ্টা পরপর? প্রতিদিন কি সে একবার করে ঘুমিয়েছে নাকি তিন অথবা চারদিনে মাত্র একবার ঘুমিয়েছে? সে ক’বার হাঁটাহাঁটি করেছে মেঝেতে?

ব্যাপারটা খুব ভয়াবহ। সে যদি সত্যি সত্যি সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলে তা হলে তো মহাসর্বনাশ হবে। এই মহাশূন্যে, স্পেসশিপে যেখানে অজানার উদ্দেশে উড়ে চলেছে, সেখানে তো সে অচিরেই পাগল হয়ে উঠবে। একা, এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে তাকে কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হবে। আবার ভাবনটা ফিরে এল ওর মধ্যে।

এখন সময় কত?

কিন্তু এই পাগল করা চিন্তা নিয়ে আর ভাবতে চায় না ক্লেটন। সে এখন অন্যকিছু ভাবতে চায়,। অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। যে পৃথিবী ছেড়ে ও চলে এসেছে সেই দুনিয়া এখন সে ভুলে থাকতে চায়। নয়তো পেছনের স্মৃতি ওকে আরও চরমে পৌছে দেবে।

‘আমি ভয় পাচ্ছি,’ ফিসফিস করে বলল ক্লেটন। ‘মহাশূন্যের এই অন্ধকারে একা থাকতে ভয় লাগছে আমার। হয়তো আমি এতক্ষণে চাঁদকে পেছনে ফেলে এসেছি। হয়তো পৃথিবী থেকে এখন দশ লক্ষ মাইল দূরে চলে এসেছি।

ক্লেটন হঠাৎ বুঝতে পারল, নিজের সাথে একা একা কথা বলে চলেছে সে। পাগলামির লক্ষণ! তবুও কথা বলে যাবে সে। থামবে না। এভাবে কথা বলে অন্তত ওর চারপাশ ঘিরে থাকা ভয়ঙ্কর গুঞ্জনের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।

‘আমি ভয় পাচ্ছি’ ক্লেটনের ফিসফিসানি ছোট্ট ঘরটিতে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আচ্ছা, এখন কটা বাজে? একনাগাড়ে এভাবে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ক্লেটন। চোখ বুজে এল। আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙলে নিজেকে বেশ তাজা মনে হলো তার। ‘আমি আসলে হঠাৎ রোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম,’ আপন মনে বলল সে। আসলে স্পেসশিপের ক্রমাগত, একঘেয়ে শব্দটা ওর স্নায়ুগুলোকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে গেছে। ভেতরের অক্সিজেনের চাপে ওর মাথা ঝিমঝিম করছে, হতবুদ্ধি মনে হয়েছে নিজেকে। হয়তো ক্যাপসুলগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে শরীর আর দুর্বল ঠেকছে না তার। হাসি ফুটল ক্লেটনের মুখে। পায়চারী শুরু করল মেঝের ওপর। আর পায়চারী করতে করতে সেই ভাবনাটা আবার পেয়ে বসল তাকে। আজ কী বার? যাত্রা শুরুর পর ক’সপ্তাহ কেটেছে? হতে পারে এক মাস চলে গেছে; কিংবা একবছর অথবা দু’বছর? পৃথিবী থেকে অনেক দূরে নিশ্চয়ই এসে পড়েছে সে? কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু। ক্লেটনের মনে হলো ওর ফিউচার এখন মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি চলে এসেছে। পেছনের কথা বাদ দিয়ে সামনে কী ঘটতে পারে তাই নিয়ে ভাবতে লাগল ক্লেটন।

সময় যাবার সাথে সাথে সবকিছুর একটা রুটিনও স্থির হয়ে গেল। অভ্যাসমত পায়চারী করছে ক্লেটন। ক্লান্ত হয়ে পড়লে ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ে পড়ছে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ছে, ঘুম থেকে জেগে আবার পায়চারী করছে।

রিচার্ড ক্লেটন ধীরে ধীরে পরিবেশ এবং নিজের শরীর সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে যেতে লাগল। মাথার ভেতর একঘেয়ে শব্দটা যেন ওর শরীরেরই একটা অংশ হয়ে উঠল। আর এই শব্দটাই যেন ওকে জানান দিয়ে চলল সে একটা স্পেসশিপে ছুটে চলেছে মহাশূন্যের পথ ধরে। ক্লেটন এখন আর নিজের সাথে একা একা কথাও বলে না। নিজেকে সে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। ওর চোখে এখন একটাই স্বপ্ন—মঙ্গলগ্রহ। স্পেসশিপটা যেন তার প্রতিটি ঝাঁকুনির সাথে একভাবে বলে চলেছে মঙ্গল- মঙ্গল মঙ্গল।

হঠাৎ একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। রিচার্ড ক্লেটন বুঝতে পারল সে ল্যান্ড করতে চলেছে। ফিউচারের নাক নিচু হয়ে গেল, নীচের দিকে কাঁপতে কাঁপতে নামতে লাগল স্পেসশিপ। লালরঙের গ্রহটার সবুজ তৃণভূমির দিকে তার যন্ত্রযান এগিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে। ক্লেটন টের পাচ্ছে তার যানের গতি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে নামছে।

অবতরণ করল ফিউচার। স্পেসশিপের দরজা খুলে ক্লেটন বেরিয়ে এল বাইরে, বেগুনি লাল রঙের ঘাসে আলতো করে পা ফেলল। শরীর বেশ ঝরঝরে আর হালকা লাগল। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয়া সূর্যালোক পৃথিবীর চেয়ে প্রখর ও উজ্জ্বল লাগল।

কিছু দূরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বনভূমি। বড় বড় গাছে ঝুলে আছে লাল রঙের রসালো ফল। ক্লেটন জাহাজ ছেড়ে এগোল জঙ্গলের দিকে। কী চমৎকার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। ওর খুব ভাল লাগল। ওকে দেখেই যেন সারির প্রথম গাছটি মাটির দিকে ঝুঁকে থাকা ‘হাত’ দুটো তুলে সম্ভাষণ জানাল।

হাত—এখানে গাছেরও হাত আছে! দুটো সবুজ হাত এগিয়ে এল ক্লেটনের দিকে। সাপের মত লম্বা আর মসৃণ হাত দুটো দিয়ে গাছটা ওকে আঁকড়ে ধরল, তুলে ফেলল শূন্যে। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে হাতদুটো। গুঁড়ির সাথে গাছটা চেপে ধরল তাকে। অসম্ভব বিস্ময়ে ক্লেটন দেখল দূর থেকে যেগুলোকে লালরঙের ফল মনে করেছিল সেগুলো আসলে ওদের মাথা। এবং রংটাও পুরোপুরি লাল নয়। বেগুনি ভাব আছে একটা।

বেগুনি লাল রঙের ভয়ঙ্কর মাথাগুলো মরা ছত্রাকের মত চোখ তুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ক্লেটনের দিকে। প্রতিটি মুখে বাঁধাকপির মত ভাঁজ। থকথকে, নরম মাংসপিণ্ডের মত লাগছে দেখতে। বিশাল হাঁ করে আছে সব ক’টা। ক্ষুধার্ত ভঙ্গি। যেন ওকে চিবিয়ে খাবে। হঠাৎ সবুজ হাতগুলো ওকে জ্যান্ত, ঠাণ্ডা গুঁড়ির সাথে আরও শক্ত করে চেপে ধরল, ক্লেটন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল বেগুনি লাল রঙের একটা মুখ-মুখটা দেখতে অনেকটা মেয়েদের মত নড়ে উঠেছে। মুখটা বাড়িয়ে দিচ্ছে চুম্বনের ভঙ্গিতে, যেন আগ্রাসী চুমু খাবে।

ভ্যাম্পায়ারের চুম্বন! রক্তাক্ত, ফাঁক করা ঠোঁট দুটো দেখে ক্লেটনের তাই মনে হলো। মুখটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ক্লেটন পাগলের মত ধস্তাধস্তি শুরু করল। কিন্তু হাতগুলো ওকে চেপে ধরে রইল। নেমে এল মুখটা ওর মুখের ওপর। চুম্বন করল। প্রচণ্ড ছ্যাঁকা খেল ক্লেটন। মনে হলো কেউ বরফ ঠেসে ধরেছে মুখে। হিমশীতল স্পর্শে হঠাৎ ক্লেটনের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল।

এ অবস্থা থেকে একসময় জেগে উঠল রিচার্ড ক্লেটন। জেগে উঠেই বুঝতে পারল আসলে স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণ। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। মুখটা দেখার জন্য বাঙ্ক ছাড়ল। এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। তাকাল। ভয়ানক চমকে উঠল। একী দেখছে সে? কাকে দেখছে? নাকি এখনও স্বপ্নই দেখছে!

বৃদ্ধ একটা লোক তাকিয়ে আছে আয়নায়। সারামুখে বলিরেখা, দাড়ির জঙ্গলে প্রায় ঢেকে আছে। ফুলোফুলো গাল ভেতরের দিকে ডেবে গেছে। চোখ দু’টোর অবস্থা সবচে’ ভয়াবহ। চোখ দেখে ক্লেটনের বিশ্বাসই হতে চাইছে না ও দুটো তার নিজের চোখ! কোটরের মধ্য থেকে লাল টকটকে দুটো চোখ অসম্ভব ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হাত দিয়ে মুখটা স্পর্শ করল সে, আয়নার মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পেল হাতে নীল নীল শিরা জেগে উঠেছে। মাথার চুল ধূসর। ক্লান্তভাবে সে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিল।

রিচার্ড ক্লেটন বুড়ো হয়ে গেছে!

কতদিন! কে জানে কত বছর ধরে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। নিশ্চয়ই অনেক বছর হবে। নইলে শরীরের এত পরিবর্তন হয় কীভাবে? বর্তমানের এই অস্বাভাবিক জীবনই ওর বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্রুত। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দারুণ ব্যাকুলতা অনুভব করল ক্লেটন। আরও ভয়াবহ কোনও স্বপ্ন দেখার আগেই তাকে এই অশুভ যাত্রা’ শেষ করতে হবে। সময়ের অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমস্ত মানসিক এবং দৈহিক শক্তি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। টলতে টলতে বাঙ্কে ফিরে এল ক্লেটন। ভীষণভাবে কাঁপছে। নক্ষত্রলোকের অন্ধকার ভেদ করে ফিউচার তার নিজস্ব গতিতে ছুটে চলল।

হঠাৎ ক্লেটনের মনে হলো বিশাল হাতুড়ি দিয়ে কারা যেন দমাদম দরজায় আঘাত করছে। প্রচণ্ড শক্তিতে বাড়ি মেরেই চলেছে। হঠাৎ এক সময় ভেঙে পড়ল দরজাটা। ভীষণ চেহারার কয়েকটা মূর্তি ঢুকল ভেতরে। ধাতব মূর্তি। ওরা এসেই দু’দিক থেকে ক্লেটনকে বজ্রমুষ্ঠিতে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলল বাইরে। লোহার মেঝের ওপর দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দানবগুলো। ওদের ধাতব পায়ের আওয়াজ উঠছে লোহার মেঝেয়। ইস্পাতের তৈরি বিশাল এক যানের সামনে দানবগুলো নিয়ে এল ওকে। যানটা দেখতে মিনারের মত। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপরে। ওরা ক্লেটনকে নিয়ে সেই ধাতব সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।

কিন্তু এ ওঠার যেন কোন শেষ নেই। উঠছে তো উঠছেই। সেই সাথে ধাতব পায়ের একটানা আওয়াজ উঠছে-ঢং, ঢং, ঢং। ধাতব মুখ কখনও ঘামে না। ধাতব মানুষ কখনও ক্লান্ত হয় না কিন্তু ক্লেটন তো ধাতব নয়, রক্তমাংসের মানুষ। প্রচণ্ড হাঁফিয়ে গেছে সে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। তবু তাকে টেনে নিয়ে চলল দানবগুলো। দীর্ঘসময় পরে অবশেষে শেষ হলো উত্থানপর্ব। চুড়োয় উঠে টাওয়ার রুমের ভেতরে ওরা ছুড়ে ফেলল তাকে। তারপর তাদের ধাতব কণ্ঠ খনখন করে উঠল, গ্রামোফোনের ভাঙা রেকর্ডের মত।

‘হে-প্রভু-তাকে—আমরা একটা পাখির মধ্যে পেয়েছি।’

‘তার-শরীর-নরম-বস্ত্র-দিয়ে-তৈরি।’

‘সে কোনও-আশ্চর্য-উপায়ে-বেঁচে আছে।’

‘সে-একটা-প্রাণী।

তারপর একটা গুমগুম শব্দ উঠে এল টাওয়ার রুমের মাঝখান থেকে।

‘আমি ক্ষুধার্ত।’

মেঝে থেকে অকস্মাৎ উদয় হলো একটা লোহার সিংহাসন। এ হলো ধাতব দানবদের প্রভু। জিনিসটা বিরাট আকৃতির লোহার একটা চোরাগত। গর্তের চারদিকে ঘিরে আছে বেলচা আকৃতির ভয়ঙ্কর দু’টো চোয়াল। চোয়াল দুটো ক্লিক করে ফাঁক হয়ে গেল, ঝকমক করে উঠল ক্ষুরধার দাঁতের সারি। গর্তের গভীর থেকে গমগমে কণ্ঠটা ভেসে এল, ‘আমাকে খেতে দাও।’

ধাতব দানবরা ক্লেটনকে ধরে ছুঁড়ে মারল সেই হাঁ করা বিশাল গর্তের মধ্যে। বিশাল চোয়াল দুটো তৎক্ষণাৎ সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, তীক্ষ্ণধার দাঁতগুলো বসে গেল মাংসল দেহে…

.

প্রচণ্ড চিৎকার করে জেগে উঠল ক্লেটন। কাঁপা হাতে আলো জ্বালল, তাকাল আয়নায়। ওর বেশিরভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। আগের চেয়েও বুড়ো দেখাচ্ছে। ক্লেটন অবাক হয়ে ভাবল এভাবে একটার পর একটা দুঃস্বপ্নের ধাক্কা ওর মস্তিষ্ক আর কত সইতে পারবে।

ফুড ক্যাপসুল খাওয়া, কেবিনে হাঁটাহাঁটি, একঘেয়ে শব্দটা শোনা, আর বাঙ্কে শুয়ে পড়া-ব্যস, এ ছাড়া আর কিছু নেই রিচার্ড ক্লেটনের জীবনে, আর শুধু বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গোনা। এভাবে কতযুগ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে জানে না সে।

দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে-দিনের হিসেব রাখে না ক্রেটন। আর ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে যেতে লাগল। প্রতিটি দুঃস্বপ্নের পর জেগে উঠে আতঙ্কিত চোখে সে লক্ষ করে বয়স আরও বেড়ে গেছে তার। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে দ্রুত। কখনও কখনও সে ভীত হয়ে ভাবে যাত্রা শুরুর আগে যে হিসেব নিকেশ সে করেছিল তাতে নিশ্চয়ই মারাত্মক কোনও ভুল থেকে গিয়েছিল। হয়তো সে সৌরমণ্ডলের চারদিকেই ক্রমাগত ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো সে জীবনেও মঙ্গলে পৌঁছুতে পারবে না। পরক্ষণে মনে অশুভ চিন্তাটা খেলে যায়-যদি এমন হয়, সে মঙ্গলও পার হয়ে এসেছে, সৌরজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন মহাশূন্যের অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে বেড়াচ্ছে!

চিন্তা করতে করতে মাথা গুলিয়ে আসে ক্লেটনের। আর ভাবতে পারে না সে, ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ে পড়ে বাঙ্কে। মাঝে মাঝে পৃথিবীর কথা মনে পড়ে তার, শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পৃথিবী কি এখনও বেঁচে আছে? অস্তিত্ব লোপ পায়নি তো তার? এমনও হতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধে পুরো পৃথিবী এক বিরাট ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। অথবা বিরাট কোনও উল্কার আঘাতে শেষ হয়ে গেছে সাধের ধরিত্রী। কিংবা এমনও ঘটা বিচিত্র নয় নক্ষত্রলোক থেকে ছুটে আসা মৃত্যুরশ্মির আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে দুনিয়া। ভয়াবহ সব আশঙ্কা ঘিরে রাখে ক্লেটনকে। কখনও ভাবে গ্রহান্তরের প্রাণীরা পৃথিবী দখল করে নেয়নি তো? কিন্তু এসব তার ক্ষণিকের ভাবনা। সবসময় তার মন জুড়ে থাকে কীভাবে, কবে সে তার লক্ষ্যে পৌছুবে। স্বপ্নের মঙ্গলকে না দেখে মরেও তো শান্তি পাবে না সে। তাকে বেঁচে থাকতেই হবে।

এমনি করে কেটে যেতে লাগল সময়। ক্লেটনের প্রায়ই মনে হত স্পেসশিপের বাইরে থেকে কারও যেন কণ্ঠ ভেসে আসছে। মহাশূন্যের বিকট অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে ভৌতিক আর্তনাদ। দুঃস্বপ্নেরা ফিরে ফিরে এল তার কাছে। এরমধ্যে কতদিন, কতঘণ্টা পেরিয়ে গেছে জানে না ক্লেটন। কিন্তু যখনি আয়নার দিকে তাকায়, ক্লেটন দেখতে পায় তার বয়স আরও দ্রুত বেড়ে চলছে। চুল বরফের মত সাদা, মুখ ভরে গেছে বলিরেখায়। সুস্থভাবে কিছু চিন্তা করারও শক্তি পাচ্ছে না সে। স্পেসশিপের একঘেয়ে, যন্ত্রণাদায়ক কাঁপুনি ও শব্দের মধ্যে মড়ার মত পড়ে আছে সে। কিন্তু এখনও বেঁচে আছে।

.

ঘটনাটা যে কী ঘটল প্রথমে ভাল করে বুঝতে পারেনি ক্লেটন। চোখ বুজে নিশ্চল শুয়েছিল সে। হঠাৎ অনুভব করল অবিশ্রাম কাঁপুনিটা আর নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ক্লেটন ভাবল, এবারও সে নির্ঘাত স্বপ্নই দেখছে। চোখ ঘষতে ঘষতে কোনমতে বিছানায় উঠে বসল ক্লেটন। ভাল করে তাকিয়ে বুঝল না, ফিউচার নড়ছে না। নিশ্চয়ই সে ল্যান্ড করেছে।

ফিউচারের কম্পন থেমে গেলেও ক্লেটনের শরীরের কাঁপুনি থামেনি। বছরের পর বছর একাধারে কম্পনের ফল এটা। উঠে দাঁড়াতে ভয়ানক কষ্ট হলো ক্লেটনের। কিন্তু এখন যে তাকে উঠতেই হবে। সময় এসেছে। এ মুহূর্তটির জন্য সে এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছে। তার স্বপ্ন এখন সফল হয়েছে। তার ফিউচার ল্যান্ড করেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সে।

টলতে টলতে দরজার দিকে এগোল ক্লেটন। দরজার হাতলটা প্রবল উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ওপরের দিকে তুলল। খুলে গেছে দরজা। ঝকঝকে সূর্যের আলো এসে চোখে বাড়ি মারল। শরীর ছুঁয়ে গেল বাতাস। আলোতে চোখ যেন ঝলসে গেল ক্লেটনের। বুক ভরে শ্বাস টানল-পা বাড়াল বাইরে-

ক্লেটন সোজা গিয়ে বাধা পড়ল তার সহকারী জেরী চেজের আলিঙ্গনের মধ্যে। চেজ বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্লেটনের অসম্ভব রোগা, নিস্তেজ চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কে? মি. ক্লেটন কোথায়?’ তারপর ভাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে। ‘আ…হায়…মি. ক্লেটন…। কিন্তু আপনার একী দশা, সার? আপনি যখন যাত্রা শুরু করলেন তখনই বিস্ফোরণটা ঘটল। স্পেসশিপ এই জায়গা ছেড়ে নড়তেই পারেনি। কিন্তু ভয়ানক কাঁপছিল বলে আপনাকে উদ্ধার করতে যেতে পারছিলাম না আমরা। এই একটু আগে কাঁপুনি থেমেছে। কিন্তু আপনার কী হয়েছে, সার? এমন লাগছে কেন আপনাকে?’

ফ্যাকাসে নীল চোখ জোড়া খুলে গেল ক্লেটনের। কথা বলার সময় ঝাঁকি খেল শরীর, ফিসফিসিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আ-আমি সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলাম, কত-কতদিন আমি ফিউচারে ছিলাম?’

বৃদ্ধ লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে জেরী চেজের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। আস্তে করে বলল, ‘মাত্র এক সপ্তাহ; সার।’

আস্তে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে এল, সামান্য কেঁপে স্থির হয়ে গেল দেহটা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে রিচার্ড ক্লেটন তার অশুভ যাত্রার সমাপ্তি ঘটিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *