যন্ত্ৰণা

যন্ত্রণা

মি. বদরুল হাসান চল্লিশ পেরিয়েছেন আরও বছর পাঁচেক আগে। উচ্চতা মাঝারী, ওজন তিন মণের কাছাকাছি। মুখখানা থলথলে, মাংসের চাপে চোখ দু’টো ভেতরে ঢুকে আছে। এই মুহূর্তে তিনি চোখ কুঁচকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বসার ঘরের এক কোণে রাখা একুশ ইঞ্চি সনি কালার টিভির দিকে। ওদিকে খানিকক্ষণ অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে কটমট করে চোখ ফেরালেন আবদুস সামাদের দিকে। আবদুস সামাদ হাড়গিলে চেহারার, তবে চোখের তারায় শিশুসুলভ একটা সরল ভাব আছে। সে মি. বদরুল হাসানের ত্রিশ হাজার টাকা দামের দামী কার্পেটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসেছে, সামনে একটা টুল বক্স, হরেক রকম যন্ত্রপাতি, গুনগুন করে ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’ গাইছে আর টুল বক্স নিয়ে কী যেন খুটুর খাটুর করছে।

রাগে বদরুল হাসান সাহেবের গা জ্বলে যাচ্ছে। আবদুস সামাদের মত নিম্ন শ্রেণীর একটি লোক তাঁর ঘরের মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসেছে, ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছেন না তিনি। কিন্তু নিজের স্বার্থেই নিম্ন শ্রেণীর এই লোকটিকে তাঁর কিছুক্ষণের জন্য সহ্য করতেই হবে।

আবদুস সামাদ নোংরা একটা ত্যানা দিয়ে হাত মুছল, তারপর আড়মোড়া ভেঙে তাকাল বদরুল হাসান সাহেবের দিকে।

‘সার, আজ কেমন আছেন?’

বদরুল সাহেবের বাম দিকের ভ্রুটা টকাশ করে লাফ দিল। আমি কেমন আছি তা তোমার পরে জানলেও চলবে। আগে বলো হারামজাদা টিভিটা আমাকে আর কত ভোগাবে। ওটার পেছনে আজ আবার কত খনাতে হবে?’

আবদুস সামাদ টিভি সেটের দিকে দ্রুত একবার নজর বোলাল, তারপর চোখ ফেরাল বদরুল হাসানের দিকে। ‘ওটার টিউব জোড়া গেছে। অসিলেটারের অবস্থাও খারাপ। নতুন ফিল্টারও লাগাতে হয়েছে।

চেহারা থমথমে হয়ে গেল মি. বদরুল হাসানের, নীচের পাতলা ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলেন তিনি।

‘হারামজাদা টিভিটার পেছনে রিপেয়ারের জন্য এ পর্যন্ত যত টাকা আমি ঢেলেছি,’ বললেন তিনি, তাতে নতুন আরেকটা সেট কেনা যেত।’

হাসল আবদুস সামাদ। নরম গলায় বলল, ‘তা হয়তো যেত। কিন্তু সার. গতবার আপনি আমার সামনেই এমন লাথি মারলেন স্ক্রিনে যে….’

ঘুরে দাঁড়ালেন বদরুল হাসান, হোল্ডারে একটা সিগারেট ঢোকালেন। ‘মনে আছে আমার,’ তাঁর কণ্ঠ তেতো শোনাল। ‘কিন্তু ফাজিলটা ঠিক মত কাজ করছিল না।’ শ্রাগ করলেন তিনি। ‘ভেবেছিলাম লাথি গুঁতা খেয়ে যদি ঠিক হয়।’

‘কিন্তু লাথি খেয়ে ওটার আবার বারোটা বেজেছে,’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ল আবদুস সামাদ হতাশ ভঙ্গিতে। ‘এভাবে করলে তো, সার, একটা জিনিসও টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।’

‘আমাকে উপদেশ দিতে এসো না, আবদুস সামাদ,’ গমগমে গলায় বললেন বদরুল হাসান। টিভির সমস্যাটি কী সেটা বলো।

টুল বক্স বন্ধ করল আবদুস সামাদ। উঠে দাঁড়াল। উপদেশ দিচ্ছি না, সার। একটু সাবধানে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে বলছিলাম। ইলেকট্রনিক্স জিনিসের মা-বাপ নেই, সার। গ্যারান্টিও কম। আপনার টিভিতে এবার বেশ বড় রকমের সমস্যা হয়েছে। তারটার সব ছিঁড়ে গেছে। আরও কী ক্ষতি হয়েছে খোদা মালুম। গত মাসে আপনার রেডিওর একই রকম অবস্থা হয়েছিল। আপনি ওটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।’

‘রেডিওটাও ঠিকমত কাজ করছিল না,’ বদরুল সাহেবের কণ্ঠ বরফশীতল।

‘কিন্তু কেন কাজ করছিল না, সার? বেয়াদবী মাফ করবেন-আমার ধারণা আপনি রেডিও-টিভি কোনটারই ঠিকমত যত্ন নেন না।’

ঠোঁটে ঝোলানো হোল্ডারের সিগারেটে ধীরে সুস্থে আগুন জ্বালালেন মি. বদরুল হাসান। এক মুখ ধোঁয়া ছাড়লেন, তারপর বিজ্ঞানী যেভাবে মাইক্রোস্কোপে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট দেখেন, ঠিক সেরকম দৃষ্টিতে তাকালেন আবদুস সামাদের দিকে।

‘এই ব্যাখ্যার জন্য তোমাকে নিশ্চয়ই আমাকে আলাদা চার্জ দিতে হবে না?’

এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রিপেয়ারম্যান। ‘আসল ব্যাপারটা কী বলুন তো, সার? বার বার এরকম হচ্ছে কেন?’

‘জানি না,’ কর্কশ গলায় বললেন হাসান সাহেব। ‘বললামই তো টিভিটা ঠিকমত কাজ করছিল না। আর তোমার এত ভ্যাজর ভ্যাজর করার কী দরকার? সেট ঠিক হয়েছে কিনা তাই বলো।’

আবদুস সামাদ কোনও কথা না বলে টিভি অন করল। পর্দায় ভেসে উঠল আবদুল বয়াতীর মুখ। গলা ফাটিয়ে জারী গাইছে। এক দৃষ্টিতে বয়াতীর মুখখানা দেখল কিছুক্ষণ আবদুস সামাদ, ভল্যুম কমাল। আবার বাড়াল। তারপর সন্তুষ্টচিত্তে অফ করল টিভি। ঘুরে দাঁড়াল বদরুল হাসান সাহেবের দিকে।

হাসান সাহেব বিচিত্র মুখ ভঙ্গি করে ঘর থেকে বেরুলেন, পেছনে এল আবদুস সামাদ।

‘আপনার বিলটা পাঠিয়ে দেব, সার,’ বলল আবদুস সামাদ বদরুল হাসান সাহেবের পাশে হাঁটতে হাঁটতে।

‘হুম্‌ম’ জবাব দিলেন বদরুল হাসান।

সদর দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আবার বদরুল হাসানের দিকে তাকাল আবদুস সামাদ। কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে।

লিভিং রুমে এসে ঢুকলেন বদরুল হাসান। ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা ঘড়িটা গম্ভীর শব্দে বেজে উঠল।

গলার স্বর নিচু করে বদরুল সাহেব বললেন, ‘আবার শুরু করেছ? অনেক হয়েছে তো! আমার কথা কানে যায় না?’

কিন্তু ঘণ্টাটি একভাবে বেজে যেতে লাগল। ম্যান্টলপিসের দিকে হেঁটে গেলেন বদরুল হাসান। গলার স্বর সপ্তমে তুললেন, ‘বললাম তো অনেক হয়েছে। তারপরও যন্ত্রণা দাও। এত সাহস!’

দু’হাতে ঘড়িটাকে মুঠো করে ধরলেন তিনি, টান দিলেন জোরে। প্লাগসুদ্ধ ঘড়িটা ছিটকে এল দেয়াল থেকে। তারপর ওটাকে ধরে মস্ত আছাড় দিলেন বদরুল হাসান। ভেঙে টুকরো হয়ে গেল ঘড়ি। তাতেও রাগ কমল না। এবার পা দিয়ে পিষতে শুরু করলেন যন্ত্রটাকে। কিন্তু ভাঙা ঘড়ি থেকে ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এল অনবরত, যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনও পশু। বেশ সময় লাগল ঘণ্টার শব্দ থামতে। ভাঙা কাঁচ আর ছেঁড়া স্প্রিং-এর ওপর ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। ঘামে মুখ ভিজে সপসপে, থর থর করে কাঁপছে শরীর। শান্ত হলেন তিনি ধীরে ধীরে। শরীরের কাঁপুনি থামলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে, নিজের বেডরুমে গিয়ে ঢুকলেন।

দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন বদরুল হাসান। নিজেকে ভঙ্গুর, ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত লাগছে। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তবে মাঝে মাঝেই দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠলেন ঘুমের ঘোরে।

.

মি. বদরুল হাসান ব্যাচেলর মানুষ। উত্তরায় প্রাসাদোপম একটি বাড়িতে থাকেন। পৈতৃক সূত্রে অগাধ সম্পত্তির মালিক। ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে নিজেও বোধহয় জানেন না। কাজেই পেটের ধান্ধা তাঁকে করতে হয় না। অবসরে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে পাঠান। কোনওটি ছাপা হয়, কোনওটি হয় না।

জীবন এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই বদরুল হাসানের। প্রতিবেশীদের খবর রাখার কোনও প্রয়োজন বোধ করেন না। তাঁর বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা এ কারণে হাতে গোনা। অবশ্য এতে কোনও অসুবিধে নেই বদরুল সাহেবের। পত্রিকায় লেখালেখি আর বাড়িতে ইলেকট্রিক বিভিন্ন গ্যাজেট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাঁর সময় চলে যায়। অবশ্য বেশিরভাগ যন্ত্রই তিনি ভেঙে ফেলেন খুলতে গিয়ে। আর কাজটা যে একেবারে অজ্ঞতা থেকে করেন ঠিক তাও নয়। মনে হয় যান্ত্রিক কাঠামোগুলো ভেঙে তিনি এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করেন।

এ মুহূর্তে মি. বদরুল হাসান তাঁর বিশাল বেডরুমের দরজা খুলে নেমে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। পরনে স্মোকিং জ্যাকেট, এগোলেন খুদে স্টাডি রুমের দিকে। ওখান থেকে টাইপ রাইটারের খটাখট শব্দ ভেসে আসছে। তাঁর সেক্রেটারী, শেহনাজ পারভীন বদরুল সাহেবের নোটগুলো টাইপ করছে। বদরুল হাসান এগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাবেন। তিনিও টাইপ জানেন তবে টাইপ রাইটার মেশিনটিকে আরও অনেক যন্ত্রের মতই পছন্দ করেন না। কম্পিউটারের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আরও বেশি। এ কারণে জিনিসটি কেনেননি তিনি।

শেহনাজ পারভীনের বয়স তেইশ। সে সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরী সায়েন্সে এম. এ করছে। মি. বদরুল হাসানের কাছে পার্ট টাইমের কাজ করে। যা বেতন পায় তা দিয়ে হোস্টেল খরচা তো চলে যায়ই, দেশের বাড়িতে ছোট ভাইটাকেও মাসে মাসে পাঠাতে পারে কিছু।

শেহনাজ পারভীন বদরুল হাসানের তেরো নম্বর সেক্রেটারী। শোনা যায়, কোনও মেয়েই নাকি বদরুল সাহেবের সাথে এক মাসের বেশি কাজ করতে পারেনি তাঁর তিরিক্ষি মেজাজের · কারণে। শেহনাজের ধৈর্য প্রশংসনীয়। মাস তিন হলো সে সেক্রেটারীর কাজটি করে যাচ্ছে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়াই।

টাইপ করতে করতে মাথা তুলে চাইল শেহনাজ। তাঁর বস ভেতরে ঢুকেছেন। হোল্ডারসহ সিগারেট ঝুলছে মুখ থেকে। উদাসীন ভঙ্গিতে তিনি একবার পেছনে ফিরে দেখলেন, তারপর শেহনাজের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। উঁকি দিলেন টাইপ রাইটারে আটকানো কাগজটার দিকে। তারপর ডেস্ক থেকে কতগুলো কাগজ হাতে নিলেন।

‘সারা বিকেল বসে তুমি এই করেছ?’ জানতে চাইলেন তিনি ঠাণ্ডা গলায়।

চোখে চোখ রাখল শেহনাজ। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘জ্বী। সাড়ে তিন ঘণ্টায় চল্লিশ পৃষ্ঠা টাইপ করেছি, সার। আমার সাধ্যে এই কুলাল।’

টাইপ রাইটারের দিকে আঙুল নাচালেন বদরুল হাসান। ‘ইডিয়েট গ্যাজেটটা দিয়ে মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠা টাইপ! আরে, টমাস জেফারসন মাত্র আধাদিনে পালকের কলম দিয়ে আমেরিকার সংবিধান লিখেছিলেন, তা জানো?’

রিভলভিং চেয়ারটা ঘোরাল শেহনাজ। শীতল শোনাল কণ্ঠ, ‘তা হলে মি. জেফারসনকে ভাড়া করছেন না কেন, সার?’

বদরুল হাসানের বাম ভ্রু লাফিয়ে উঠল। ‘তোমাকে আমি বলিনি যে মুখে মুখে তর্ক একদম পছন্দ নয় আমার?’

টাইপ রাইটারের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, শেহনাজ, ‘অসংখ্যবার এবং অসংখ্যবার বলেছেন।’ আবার সোজা হয়ে বসল। ‘একটা কথা বলব, সার।’ ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল। ‘আরেকটা নতুন মেয়ের খোঁজ করুন, এমন কেউ যার তিনটে হাত এবং গায়ে গণ্ডারের চামড়া তা হলে তার সঙ্গে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন। আমার পক্ষে…’ সশব্দে নিজের পকেট বুক বন্ধ করল শেহনাজ। আপনার সাথে কাজ করা সম্ভব নয়।

‘চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাইছ?’ জিজ্ঞেস করলেন বদরুল সাহেব।

‘জ্বী। ছাড়তাম আরও আগেই। কারণ আপনার মত এত খুঁতখুঁতে, খামখেয়ালী স্বভাবের লোকের সঙ্গে কাজ করার মত ঝক্কি আর নেই। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি আমি। আগামী মাসে ইউরোপে চলে যাচ্ছি।’ ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল শেহনাজ।

বিমূঢ় দেখাল বদরুল হাসানকে, কিছু বলার জন্য মুখ খুললেন একবার, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন, তারপর স্বভাব বিরুদ্ধ অত্যন্ত নরম গলায় ডাক দিলেন পেছন থেকে। ‘শেহনাজ…দয়া করে যেয়ো না।

থমকে দাঁড়াল শেহনাজ পারভীন। ঘুরল। বদরুল সাহেবের চেহারায় ভয়ার্ত একটা ছাপ ফুটে উঠেছে যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না ওর।

‘কিছু বললেন?’ কোমল স্বরে বলল শেহনাজ।

মুখ ঘোরালেন বদরুল হাসান, অস্বস্তিতে ভুগছেন যেন। ইয়ে মানে…আরেকটু সময় যদি আমার সাথে থাকতে। না, কোনও কাজের জন্য নয়। ইয়ে…আজ এক সাথে ডিনারটা না হয় করলাম…’ আশা নিয়ে চেয়ে থাকলেন তিনি শেহনাজের দিকে।

‘আমার খিদে পায়নি তেমন,’ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল শেহনাজ। ‘তা ছাড়া ডিনারের সময় এখনও হয়নি। হতাশা ফুটে উঠতে দেখল সে বস-এর মুখে। ‘হয়েছে কী আপনার, সার?’ সহানুভূতির সুর নেই, এমনি প্রশ্ন।

হাসতে চেষ্টা করলেন বদরুল হাসান। কেমন বিকৃত দেখাল মুখ। ‘না, হবে আবার কী? তাড়া না থাকলে চলো ঘুরে আসি কোথাও থেকে।’

ঝাড়া দু’মিনিট বদরুল হাসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল শেহনাজ। তারপর থমথমে গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ সার। আজ আমার সত্যি তাড়া আছে আর তাড়া না থাকলেও আপনার সঙ্গে কোথাও যেতাম না আমি। কেন, সে ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আপনাকে দিতে বাধ্য নই আমি। গুড নাইট, মি. বদরুল হাসান।’

বদরুল হাসান সাহেবের মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। একটু টলে উঠলেন তিনি। লোকটার আবার প্রেশার উঠে যাচ্ছে না তো? শঙ্কিত হয়ে ভাবল শেহনাজ। সে কিছু বলার আগেই বদরুল হাসান বলে উঠলেন, ঠিক আছে, শেহনাজ। ঠিক আছে। কোথাও যেতে হবে না। এক কাপ কফি খেতে খেতে একটু গল্প করার সময়ও কি হবে না তোমার? আমার আসলে এই মুহূর্তে একা থাকার কথা ভাবলে খারাপ লাগছে।’

আবার লিভিং রুমে ফিরে এল শেহনাজ, দাঁড়াল বদরুল হাসানের পাশে। ‘আপনি অসুস্থ নাকি, সার?’ জিজ্ঞেস করল সে।

এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন বদরুল সাহেব।

‘তা হলে কোনও দুঃসংবাদ?’

‘না।’

এক মুহূর্ত নীরবতা। আবার জানতে চাইল শেহনাজ।

‘তা হলে সমস্যাটা কী আপনার?’

হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন বদরুল হাসান। আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাকালেন শেহনাজের দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত দৃষ্টি।

‘আমি খুব ক্লান্ত,’ ভাঙা গলায় বললেন তিনি। ‘গত চার রাত এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। আর এখন একা থাকার কথা ভাবলেই…’ ব্যক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলছেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ভাবনাটা নিজের ওপর বিরক্তি এনে দিল তাঁর। তবু বলে চললেন, ‘এ সত্যি অসহ্য, শেহনাজ। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে আমার চারপাশে। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো।

‘বলে যান।

টিভি সেটের দিকে আঙুল তুললেন বদরুল সাহেব, ‘ওই…ওই যে জিনিসটা ওখানে। ওটা গভীর রাতে আপনা আপনি চালু হয়ে যায়, জাগিয়ে রাখে আমাকে সারারাত।’ তাঁর চোখ ঘর ঘুরে স্থির হলো হল রুমের দিকে ‘আর ওই পোর্টেবল রেডিওটা দেখ। ওটাকেও আমি বেডরুমে রাখি। ঘুমাতে গেলেই রেডিওটা নিজ থেকে অফ-অন হতে থাকে।’

কথা বলতে বলতে মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন বদরুল সাহেব, যখন মুখ তুললেন, শেহনাজ লক্ষ করল চোখের তারায় অদ্ভুত একটা পাগলামির ভাব ফুটে উঠেছে। ‘আমার বিরুদ্ধে এই বাড়িতে ষড়যন্ত্র চলছে; শেহনাজ। টিভি সেট, রেডিও, লাইটার, ইলেকট্রিক ঘড়ি, আর…আর ওই বদমাশ গাড়িটাও যেটাকে আমি চালাই।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বদরুল হাসান, মুখ সাদা হয়ে গেছে, উত্তেজিত। ‘গত রাতে গাড়িটা আমি গ্যারেজে ঢোকাচ্ছিলাম খুব ধীরে আর সাবধানে।’ শেহনাজের দিকে এক পা এগিয়ে এলেন তিনি, হাতের মুঠো বার বার খুলছেন আর বন্ধ করছেন। হঠাৎ হুইলটা আমার হাতের মধ্যে ঘুরতে শুরু করল। শুনলে? আপনা থেকেই হুইলটা ঘুরছিল। স্রেফ সেধে গিয়ে ধাক্কা খেল গ্যারেজের এক ধারে। ভাঙল একটা হেড লাইট-ওই যে ম্যান্টেলপিসের ওপর।’

শেহনাজ ম্যান্টেলপিসের দিকে তাকাল। ওখানে কিছু নেই। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি শেহনাজের।

‘আমি…আমি ওটা ফেলে দিয়েছি,’ ভীরু গলায় বললেন বদরুল হাসান। তারপর জোর করে গলায় স্বর ফোটালেন, ‘এরকম অবস্থা অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে, শেহনাজ, কোনওদিনই আমি যন্ত্রপাতি ঠিক মত ব্যবহার করতে পারিনি।’ হাহাকারের মত শেষ বাক্যটা যেন বেরিয়ে এল বদরুল সাহেবের গলা চিরে।

শেহনাজ স্থির চোখে তাকাল তাঁর দিকে, মায়া হলো আত্মম্ভরী লোকটার জন্য।

‘হাসান সাহেব,’ খুব নরম গলায় বলল সে, ‘আমার মনে হয় আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত।’

বদরুল হাসানের চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে উঠল, কর্কশ শোনাল কণ্ঠ। ‘ডাক্তার!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘বিংশ শতাব্দীর সর্বরোগ হরণকারী বলে দাবী করা ইডিয়েটগুলো! যদি বিষণ্নতায় ভোগো ডাক্তার দেখাও। যদি সুখে থাকো তা হলেও ডাক্তার এনে এর কারণ খোঁজো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলেও ডাক্তারের কাছে যাও। তুমি,’ গলা ফাটালেন তিনি শেহনাজকে লক্ষ করে, ‘নিজে গিয়ে ডাক্তার দেখাও না।’ রাগে কাঁপছে গলা। ‘আমি একজন যুক্তিবাদী, র‍্যাশনাল, বুদ্ধিমান মানুষ। আমি জানি আমি কী দেখছি। আমি জানি কী শুনছি। গত তিন মাস ধরে যান্ত্রিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনগুলো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, আমাকে শেষ করার পাঁয়তারা কষছে। বুঝলে, মিস শেহনাজ পারভীন?’

শেহনাজ কয়েক সেকেন্ড উত্তেজিত লোকটাকে যেন জরীপ করল। তারপর বলল, ‘বুঝলাম, সার। আপনি সত্যি খুব অসুস্থ। আসলেই আপনার চিকিৎসার দরকার। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে আপনার নার্ভের বোধ হয় ক্ষতি হয়েছে। তাই আবোল তাবোল সব দেখছেন এবং শুনছেন।’

মেঝের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল শেহনাজ, তারপর ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়াল।

‘যাচ্ছ কোথায় তুমি?’ চেঁচিয়ে উঠলেন বদরুল।

‘আপনার কারও সঙ্গ প্রয়োজন নেই, সার।’ বলল শেহনাজ হলঘর থেকে। ‘আপনার দরকার ডাক্তার দেখানো।’

‘দেন গেট আউট অভ হিয়ার,’ আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। ‘এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। আর কোনও দিন যেন তোমার মুখ না দেখি।’

‘জীবনেও দেখবেন না,’ বলল শেহনাজ। ‘আপনার মত পাগলের সাথে কাজ করে কোন্ বোকা?’ দুপদাপ পা ফেলে সে দরজার দিকে এগোল।

‘সাবধান,’ চেঁচিয়ে বললেন বদরুল হাসান। ‘আর কোনওদিন যেন তোমাকে এখানে না দেখি। তোমার চেক আমি পাঠিয়ে দেব। আর শুনে রাখো, তোমার মত বেয়াদব সেক্রেটারীর কখনও প্রয়োজনও হবে না আমার।’

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল শেহনাজ। বুক ভরে বাতাস নিল, তারপর আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, ‘মি. বদরুল হাসান, যন্ত্র নিয়ে যে যন্ত্রণায় আপনি আছেন, প্রার্থনা করি, তা থেকে খুব সহজে যেন নিষ্কৃতি না পান।

বেরিয়ে গেল শেহনাজ, পেছনে দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা। মূর্তির মত নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। উপযুক্ত শব্দ হাতড়াচ্ছিলেন সেক্রেটারীকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে। কিন্তু শেহনাজ চলে গেছে বুঝতে পেরে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। এমন সময় শুনলেন ইলেকট্রিক টাইপ রাইটারটা খট খট শব্দ করছে।

বুকের রক্ত জল হয়ে গেল তাঁর শব্দ শুনে। কিছুক্ষণ পরে থেমে গেল টাইপ রাইটার। পড়ার ঘরে ঢুকলেন বদরুল হাসান। টাইপ রাইটারে কাগজ পরানো। বদরুল সাহেব রোলারটা ঘোরালেন কাগজের লেখা পড়ার জন্য। তিন লাইনে লেখা একই কথা, ‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।’

নিজেই এই কথাগুলো লিখেছে টাইপ রাইটারটা। টুকরোটা ছিঁড়ে আনলেন তিনি যন্ত্র থেকে, দলা মোচড়া করে ফেলে দিলেন মেঝের ওপর।

‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল,’ গলার স্বর সপ্তমে তুলে বললেন তিনি। ‘গোল্লায় যা তুই। আমাকে বেরিয়ে যেতে বলার কে তুই?’ জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখলেন বদরুল সাহেব, ঘামে ভেজা মুখে হাত ছোঁয়ালেন। ‘এটা একটা যন্ত্র…একটা টাইপ রাইটার। ফালতু একটা জিনিস…’

স্থির হয়ে গেলেন তিনি লিভিং রুমের টিভি থেকে ভেসে আসা একটা কণ্ঠ শুনে।

‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।’ বলছে কণ্ঠটা।

বুকের ভেতর ব্যাঙের মত লাফাতে শুরু করল হৃৎপিণ্ড, ঘুরেই ছুটলেন বদরুল লিভিং রুমের দিকে। হাতে গিটার নিয়ে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে নাচছে টিভি পর্দায়। নাচের সময় হাইহিলে শব্দ তুলছে, সোজা তাকাচ্ছে বদরুল সাহেবের দিকে। মিউজিকের তালে মেয়েটা নাচতেই থাকল। তা হলে গলার স্বরটা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন, ভাবলেন বদরুল হাসান। সেক্রেটারী মেয়েটা ঠিকই বলেছে। নিদ্রাহীনতার কারণে আবোল তাবোল দেখছেন আর শুনছেন তিনি।

টিভির মিউজিক থেমে গেল। মেয়েটি গিটার হাতে ক্যামেরার সামনে ‘বো’ করল, মুখ তুলে আবার সরাসরি তাকাল বদরুল সাহেবের চোখের দিকে।

মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।

রাগের চোটে বিকট চিৎকার করে উঠলেন বদরুল হাসান। হাতের কাছে ফ্লাওয়ার ভাসটা নিয়ে গায়ের শক্তিতে ছুঁড়ে মারলেন টিভিটার দিকে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো টিভি, গ্লাস ভেঙে শত টুকরো হলো, ধোঁয়া উঠতে লাগল গল গল করে। তারপরও, কী ভয়ানক ব্যাপার, ধোঁয়ার মাঝ থেকে মেয়েটার রিনরিনে কণ্ঠ ভেসে আসতে লাগল।

‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল,’ বলে চলল কণ্ঠটি। আহত জন্তুর মত চিৎকার দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন বদরুল, হলঘর পেরিয়ে উঠে গেলেন সিঁড়িতে।

টপ ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালেন তিনি, গলার রগ ফুলে গেল চিৎকার করার সময়। ঠিক আছে। ঠিক আছে নির্বোধ যন্ত্রের দল। তোরা আমাকে ভয় দেখাতে পারবি না। শুনতে পাচ্ছিস? আমি জীবনেও তোদেরকে ভয় পাব না।’

ঠিক তখন পড়ার ঘর থেকে গভীর, স্পষ্ট এবং ছন্দায়িত ভঙ্গিতে ভেসে এল টাইপ রাইটারের শব্দ। বদরুল বুঝতে পারলেন হারামজাদাটা কী টাইপ করছে। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল তাঁর। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে ঢুকলেন বেড রুমে, দরজা বন্ধ করলেন। তারপর বালিশে মুখ চেপে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বন্ধ দরজা ভেদ করেও টাইপ রাইটারের টাইপ করার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। তারপর এক সময় আপনাআপনি থেমে গেল। নীরব হয়ে গেল বাড়ি।

দুই

সে রাতেও যথারীতি ঘুম হলো না বদরুল হাসান সাহেবের। একাধিকবার দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন তিনি। সারা শরীর ঘেমে চুপচুপে। ঘুমের আশা বাদ দিয়ে সিলিং-এর হালকা নীলাভ আলোর দিকে চেয়ে থাকলেন চুপচাপ। হঠাৎ ঢং ঢং শব্দে বাজতে শুরু করল দামী সুইস দেয়াল ঘড়িটা। গুণতে থাকলেন বদরুল হাসান। বারো…এক…দুই…তিন। থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। তাঁকে আতঙ্কিত করে দিয়ে ভেসে এল ধাতব, খনখনে কতগুলো শব্দ, ‘এখনও সময় আছে। ভেগে পড়ো, বদরুল।’ চোখ বড় বড় করে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল সাহেব। ওখান থেকেই কথাগুলো আসছে। ভাঙা রেকর্ডের মত একভাবে বেজে যেতে লাগল পেণ্ডুলাম। আর সহ্য হলো না বদরুল সাহেবের। বেড সাইড টেবিলের ওপর মার্বেল পাথরের সাদা একটা কুকুরের মূর্তি ছিল, ওটাকে ঝট করে হাতে তুলে নিলেন তিনি। ‘শুয়োরের বাচ্চা।’ বলে ছুঁড়লেন দেয়াল ঘড়ি লক্ষ্য করে। কাঁচ ভাঙার তীক্ষ্ণ শব্দ হলো। ফেটে চৌচির হয়ে গেল শৌখিন জিনিসটা। কিন্তু পেণ্ডুলামটা দুলতেই থাকল আগের মত। আর সেই অসহ্য কথাগুলো! উঃ!

কানে আঙুল চাপা দিয়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরুলেন বদরুল হাসান। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘড়ির শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। তবু ভেতরে যেতে সাহস পেলেন না তিনি। ঝুল বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় বসে থাকলেন চুপচাপ। অন্ধকার আকাশে তাঁর দৃষ্টি। দরদর ধারায় জল পড়ছে চোখ বেয়ে। অঝোরে কাঁদছেন বদরুল হাসান।

.

ভোরের নরম রোদ গায়ে মেখে জেগে উঠলেন বদরুল হাসান। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে নেই। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কয়েকজন কৌতূহলী মর্নিং ওয়াকার পথ চলতে তাঁর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। ব্রিত বোধ করলেন বদরুল সাহেব। প্রতিবেশীদের সাথে তাঁর সদ্ভাব নেই। তাঁর কাছে প্রতিবেশী মানেই পরনিন্দা, পরচর্চাকারী। এজন্য কোনও দিন কারও সাথে সেধে আলাপ করার প্রবৃত্তি হয়নি বদরুল সাহেবের। আর তারাই তাঁকে সাত সকালে ব্যালকনিতে হাঁ করে ঘুমাতে দেখে নিশ্চয়ই মুখরোচক গল্পের সন্ধান পেয়ে গেছে। অবশ্য কে কী বলল তার থোড়াই কেয়ার করেন তিনি। লোকগুলোর দিকে মুখ বাঁকিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ঘরে। তারপর ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকলেন।

প্রতিদিন শেভ করার অভ্যাস বদরুল সাহেবের। কিন্তু আজ ক’দিন গালে ব্লেড ছোঁয়াননি ইচ্ছে করেই। ঘুম হয় না বলে অবসাদ তাঁকে গ্রাস করে থাকে সর্বক্ষণ। আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলেন বদরুল হাসান। একী দশা! চোখের নীচে কয়েক পোচ কালি, খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো সব সাদা। গালের হনু দুটো জেগে উঠেছে প্রকটভাবে। চোখের সাদাটে জমির পাশে ছানির মত কী যেন। চাউনিটা উদ্ভ্রান্ত, অসহায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইলেকট্রিক রেজরটা হাতে নিলেন বদরুল হাসান। প্লাগ লাগানোই ছিল, সুইচ টিপতেই চালু হয়ে গেল যন্ত্র। গালে ছোঁয়ালেন তিনি ধারাল রেজার। আহ, কী ঠাণ্ডা! ইলেকট্রিক নিড়ানির মত দাড়ির জঙ্গল সাফ হতে লাগল মৃদু ঘস ঘস শব্দে। হঠাৎ উঃ! করে উঠলেন বদরুল সাহেব। ‘হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন গাল থেকে। বিস্ফারিত চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর কালচে চামড়ায় প্রথমে সাদা একটা কাটা দাগ ফুটে উঠল, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ফাঁকটা পূরণ হয়ে গেল টকটকে লাল রক্তে। অসাবধানতার জন্য মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলেন বদরুল সাহেব। গালে আবার রেজর ছোঁয়াতে যাবেন, আয়নায় তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। রেজরটাকে অবিকল গোখরো সাপের ফণা মনে হলো, ছোবল মারতে উদ্যত। সরাসরি রেজরের দিকে চাইলেন বদরুল হাসান। হার্ট বিট মিস করল একটা। রেজরটা যেন ক্রূর চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। হঠাৎ রেজর ধরা হাতটা নড়তে শুরু করল। টেনে নিয়ে যাচ্ছে গালের দিকে। হাতটাকে থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন বদরুল। পারলেন না। ছোবল দিল ওটা তাঁকে। তীব্র জ্বালা অনুভব করলেন জুলফির নীচে। ‘মাগো!’ বলে খালি হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলেন, আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়াতে শুরু করল রক্ত। রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে, হাতে ধরা ইলেকট্রিক রেজর, বদরুল হাসানের ভয়ার্ত মুখ—সব মিলে আয়নায় যেন সিনেমার এক ফ্রিজ শট।

একটা গাল দিয়ে রেজরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বদরুল। ওটা বাথরুমের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে এক কোণে পড়ে থাকল। দ্রুত আয়োডিন লাগালেন তিনি কাটা জায়গায়। জ্বলে উঠল ভীষণ। দাঁতে দাঁত চেপে ড্রেসিং- এর কাজটা সারলেন বদরুল হাসান। তারপর রেজরটাকে চোখের আগুনে পোড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে আবার তুলে রাখলেন যথাস্থানে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাস্তা সারলেন বদরুল হাসান। তাঁর একটা ঠিকে ঝি আছে। ভোরবেলায় এসে বাসন-কোসন ধুয়ে, নাস্তা বানিয়ে, দুপুর আর রাতের খাবার রান্না করে চলে যায়।

নাস্তা সেরে সেদিনের ইত্তেফাকটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন বদরুল সাহেব। সেই একই গৎবাঁধা খবর। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়ন, অমুক জায়গায় ডাকাতি, তমুক জায়গায় ছিনতাই ইত্যাদি ইত্যাদি। হেডিংগুলোয় চোখ বুলিয়ে বিরক্ত বদরুল কাগজটা ফেলে দিলেন টেবিল থেকে। টেনে নিলেন কফির কাপ। ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিচ্ছেন, এই সময় বেজে উঠল ফোন। ঝন ঝন শব্দটা কানে মধু বর্ষণ করল। আসলে এই মুহূর্তে কারও সঙ্গ চাইছিলেন বদরুল সাহেব। হোক না সে অদৃশ্য সঙ্গী। সাগ্রহে রিসিভার কানে ঠেকালেন বদরুল হাসান।

‘ইটস বি হাসান স্পীকিং,’ গমগমে গলায় বললেন তিনি।

‘আচ্ছা, এটা কি তারকালোক?’ ভেসে এল একটা কচি কণ্ঠ।

‘না তো! তুমি কত নম্বর চাইছ?’

‘আমি একটু জাহিদ হাসানের নাম্বারটা চাইছি। ভীষণ দরকার। দিতে পারবেন?’

অপর প্রান্তে অনুনয়।

বেশ মজা পেলেন বদরুল হাসান। বোঝাই যাচ্ছে নয়-দশ বছরের বাচ্চা। তিনি বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন।

‘জাহিদ হাসানের নাম্বার দিয়ে কী করবে তুমি?’ কৌতুকের সুরে জানতে চাইলেন তিনি।

‘উনি না আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। আপনি বিটিভিতে সবুজ সাথী দেখেন? ওই যে মফিজ পাগলা…’

শেষ কবে বিটিভি দেখেছেন মনে করতে পারলেন না বদরুল হাসান। স্যাটেলাইটের অনুষ্ঠানগুলোই তাঁর কাছে ট্র্যাশ মনে হয়, বিটিভি দূরে থাক। তবু বাচ্চাটার সাথে কথা চালিয়ে যাবার লোভে তিনি বললেন, ‘হুম। দেখেছি তো।

‘তা হলে তো কথাই নেই। জানেন, সেদিন না…’ সোৎসাহে কী যেন বলতে গিয়েছিল বাচ্চা, হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল।

ভয়ংকর দৃষ্টিতে রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। যেন লাইন কেটে যাবার জন্য ফোনটারই দোষ।

প্রচণ্ড জোরে তিনি রিসিভারটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখলেন। গায়ের ঝাল কমল যেন কিছুটা। তারপরও ওটার দিকে কটমট করে চেয়ে রইলেন। এমন সময় আবার ‘ক্রিং ক্রিং’ আওয়াজ। বাচ্চাটাই আবার ফোন করেছে ভেবে তাড়াতাড়ি রিসিভার কানে ঠেকালেন বদরুল হাসান।

‘এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’ ভরাট গলায় কেউ বলে উঠল ওধার থেকে।

‘কী!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন বদরুল হাসান।

‘বলছি এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’ কথাটা পুনরাবৃত্তি করল অদৃশ্য কণ্ঠ।

আর সহ্য করতে পারলেন না বদরুল হাসান। ‘ইউ ব্লাডি ফুল!’ বলে গায়ের জোরে রিসিভারটা ছুঁড়ে মারলেন। তারে টান খেয়ে ক্রেডলসুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল ফোন। টপ সেন্টার টেবিলের এক কোণে ফোনের তার বেধে গেল যেন কীভাবে। শূন্যে ঝুলতে লাগল রিসিভার। মাউথ পিস দিয়ে একভাবে, একঘেয়ে কথাগুলো ভেসে আসতে লাগল বার বার-’এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’

ছুটে গেলেন বদরুল। এক টানে ছিঁড়ে ফেললেন তার। তারপর পাগলের মত রিসিভারটা কার্পেটে ঢাকা মার্বেল পাথরের মেঝেতে ঠুকতে লাগলেন। ভেঙে টুকরো হয়ে গেল ওটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ভাঙা ফোনের পাশে বসে হাঁফাতে লাগলেন তিনি।

কিছুক্ষণ পর সুস্থির হয়ে ভাবতে বসলেন বদরুল হাসান। এরকম কেন ঘটছে? তাঁর মাথা টাথা সত্যি খারাপ হয়ে যায়নি তো? তিনি কি স্রেফ হ্যালুসিনেশনের শিকার নাকি যা ঘটছে সব বাস্তব? শেহনাজ ঠিকই বলেছে তাঁর আসলে ডাক্তার দেখানো দরকার। নাকি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন? ধুর তিনি কি পাগল নাকি যে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাবেন? তারচে’ কোনও মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে যাওয়াই ভাল। ঘুম না হওয়াটাই তাঁর রোগ। কীভাবে ঘুম হবে এটা জানতে হলেও একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।

মেডিসিনের জাঁদরেল ডাক্তার প্রফেসর বাতেনকে দেখাবেন, সিদ্ধান্ত নিলেন বদরুল সাহেব। কিন্তু ডা. বাতেনের সাথে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। অভ্যাস বশে ফোর্নের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও নিজেকে সংযত করলেন। তাঁর সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে ভাঙা রিসিভার। এ এলাকায় কাছে পিঠে কার্ড ফোন সেন্টার নেই। এক কিলোমিটার দূরে পুলিশ বক্সের সাথে আছে একটা। এখন আর ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। মোবাইল ফোনটাও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। একবার ভোরের কাগজ-এ ফোন করার চেষ্টা করছিলেন জরুরী প্রয়োজনে। বার বার এনগেজড টোন পাওয়ায় মাথায় রক্ত চড়ে যায় বদরুল সাহেবের। সব দোষ মোবাইলের ওপর চাপিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেন তিনি ওটাকে। সন্ধ্যা বেলায় নিজেই যাবেন ডাক্তারের কাছে, সিদ্ধান্ত নিলেন বদরুল সাহেব। প্রফেসরের অ্যাসিস্ট্যান্টকে একখানা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলে আজকেই সে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবে।

তিন

খিঁচানো মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরলেন বদরুল হাসান। প্রফেসর বাতেনকে পাননি তিনি। চেম্বার বন্ধ। শুক্রবার তাই। আরে, শুক্রবার বলে কি অসুখ- বিসুখগুলোও ছুটি নেয় নাকি? নাকি বন্ধের দিন বলে স্পেশাল তোয়াজ করে? যত্তসব কাণ্ডজ্ঞানহীন ডাক্তারের বাস এ দেশে।

রাগে গজ গজ করতে করতে বদরুল সাহেব বার ক্যাবিনেট থেকে একটা ‘ভ্যাট সিক্সটি নাইন’-এর বোতল বের করলেন। মদ্যপানের অভ্যাস তাঁর তেমন নেই। কোনও কারণে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লে তরল পদার্থটা টনিকের কাজ দেয়। কিন্তু আজ কাজ করল উল্টো। দপদপিয়ে ব্যথা শুরু হলো মাথায়। যেন ফেটে যাবে। ব্যালকনিতে এসে বসলেন। এক ফোঁটা বাতাস নেই। খিঁচানো মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল আরও। ঢুকলেন শোবার ঘরে। ফুল স্পীডে এসি ছেড়ে দিলেন। ধুত্তুরি, ঘর ঠাণ্ডা হচ্ছে কই? নাকি এই ব্যাটাও জাত ভাইদের মত বিট্রে শুরু করে দিল? খানিকক্ষণ এয়ার কুলারের নবগুলো নিয়ে খোঁচাখুঁচি করলেন তিনি। মুখ প্রায় ঠেসে ধরলেন যন্ত্রটার গায়ে। উঁহুঁ, কেমন একটা গরম বাতাস আসছে না?’

‘আমার সাথে বিটলামি, না? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা’ বলে বাথরুমে ঢুকলেন বদরুল হাসান। পানি দিয়ে চোবাবেন এয়ার কুলার। জবর শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন যাতে এমন ফাজলামি আর না করে।

বাথরুমের দরজায় পা রাখতেই বদরুলের চোখ কপালে উঠে গেল। শেভিং কেবিনেটে রাখা ইলেকট্রিক রেজরটা নিজে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখ কচলালেন বদরুল। ভুল দেখছেন না তো? নাহ, ওই তো ওটা নড়ে উঠল। তারপরই বদরুল সাহেবকে লক্ষ্য করে লাফ দিল।

‘বাপরে।’ বলে মাথা সরিয়ে নিলেন বদরুল সাহেব। ভীষণভাবে মাথাটা ঠুকে গেল দরজার কোণে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিনে পয়সায় তারার ফুলঝুরি দেখলেন তিনি। তারপর প্যান্ট বেয়ে সরসর করে কী একটা উঠে আসছে টের পেয়ে সেদিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন। রেজরটা!

আহত জন্তুর মত গোঙানি বেরিয়ে এল বদরুল হাসানের গলা থেকে। হাতের এক ঝটকায় রেজরটাকে ফেলে দিয়ে দৌড়ালেন বেডরুমে। দরজা বন্ধ করার আগে এক পলক দেখলেন এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে রেজর, ঠিক গোখরো সাপের মত ফণা তুলে।

দরজায় খিল দিয়ে কিছুক্ষণ হাপরের মত হাঁফালেন বদরুল। হঠাৎ টের পেলেন খুব শীত করছে তাঁর। চালু হয়ে গেছে এসি পুরো দমে। ঠকাঠক কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। এয়ার কুলার বন্ধ করার জন্য এগোলেন তিনি কিন্তু দু’পা এগোনোই সার। যন্ত্রটাতে যেন সাইক্লোন বইতে শুরু করেছে। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। কিছুতেই এসির সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে ঘরের তাপ মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে নেমে এল। বদরুল সাহেব বুঝলেন আর কয়েক মিনিট এ ঘরে থাকলে তিনি ঠাণ্ডায় জমেই মারা যাবেন। এয়ার কুলার বন্ধের আশা ত্যাগ করে দরজা খুললেন তিনি। এবং সাথে সাথে আক্রান্ত হলেন।

শয়তান রেজরটা যে দরজার কাছেই ওঁৎ পেতে ছিল, কে জানত? সোজা বদরুল সাহেবের টুটি লক্ষ্য করে ওটা লাফ দিল। একটুর জন্যে লক্ষ্য ভ্ৰষ্ট হলো আক্রমণ। সাঁৎ করে মাথা সরিয়ে নিয়েছেন বদরুল। রেজর গিয়ে ধাক্কা খেল দরজার চৌকাঠে

পড়িমরি করে দৌড় দিলেন বদরুল হাসান। এক সাথে তিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে লাগলেন ওজনদার শরীর নিয়েও। নীচ তলায় নেমে পেছন ফিরে চাইতেই আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রক্তের নেশায় উন্মাদ রেজরটা লাফাতে লাফাতে নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।

দৌড় দিতে গেলেন বদরুল হাসান। সকালে ছিঁড়ে রাখা টেলিফোনের তারে পা বেধে দড়াম করে খেলেন এক আছাড়। দুনিয়া দুলে উঠল চোখের সামনে। ঠিক তখন সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করল।

স্টাডি রুমে আপনা থেকে জ্যান্ত হয়ে উঠল টাইপ রাইটার। খট খট শব্দে ওটা কী টাইপ শুরু করে দিয়েছে বদরুল সাহেব বুঝতে পারলেন খুব ভাল ভাবে। তাঁর বেডরুমের ভাঙা দেয়াল ঘড়িটা বাজতে শুরু করল ঢং ঢং শব্দে। ভাঙা টিভির শূন্য গহ্বর থেকে ভেসে এল খল খল হাসি। আর একই সঙ্গে ভাঙা ফোন বেজে উঠল। ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দটা বিস্ফোরণের মত বাজল কানে। বদরুল সাহেব শুনতে পেলেন দেয়াল ঘড়ি, টিভি আর ফোন এক সাথে বলতে শুরু করেছে, ‘তোমার আর রক্ষা নেই, বদরুল। আর রক্ষা নেই।

গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করতে মন চাইল বদরুল সাহেবের। চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করলেন তিনি যা শুনছেন সব মিথ্যা, যা দেখছেন তা দুঃস্বপ্ন বৈ অন্য কিছু নয়।

কিন্তু পায়ে সাপের দংশনের মত তীব্র জ্বালা টের পেতেই লাফিয়ে উঠলেন বদরুল। সেই রেজরটা। ধারাল খুরের আঘাতে গোড়ালির কাছ থেকে কেটে নিয়েছে প্যান্ট। গল গল ধারায় বেরুনো তাজা রক্ত সাথে সাথে শুষে নিয়ে আরও রক্তাক্ত রঙ ধারণ করল লালচে কার্পেট।

এক লাথিতে রেজরটাকে পা থেকে ফেলে দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাড়ি-বারান্দার দিকে ছুটলেন বদরুল হাসান। অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে ছিল শক্তিশালী, কালো মার্সিডিজ বেঞ্জটা। তিনি কাঁপা হাতে চাবি বের করলেন পকেট থেকে, তালা খুলতে গিয়ে ঝনাৎ করে পড়ে গেল রিংসুদ্ধ চাবি। নিজেকে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে উবু হলেন বদরুল। হঠাৎ তাঁর পিলে চমকে দিয়ে মেঘ গর্জনের শব্দে চালু হয়ে গেল মার্সিডিজের ইঞ্জিন। সার্চ লাইটের মত একটা হেড লাইট জ্বলে উঠল অন্ধকারের বুক চিরে। তারপর ব্যাক গিয়ার মেরে গাড়িটা নিজেই পিছু হঠল। চাবি খুঁজবেন কী, এমন ভৌতিক কাণ্ড দেখে সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল হাসান গাড়ির দিকে। সম্বিত ফিরল যখন মার্সিডিজ সগর্জনে তাঁর দিকে ছুটে এল, তখন।

হেড লাইটের তীব্র আলো অন্ধ করে দিল বদরুল হাসানকে। গাড়িটা তাঁর গায়ের ওপর এসে পড়ছে বুঝতে পেরে ব্যাঙের মত লাফ দিলেন তিনি এক ধারে। আহত পা-টা বেকায়দায় পড়ল এক টুকরো দশ ইঞ্চি ইটের ওপর। দুনিয়া ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। পরক্ষণে চিৎকারটাকে গপ করে গিলে ফেলতে হলো মূর্তিমান আজরাইলকে আবার তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এবার দিক্‌বিদিক্ শূন্য হয়ে ছুটলেন মি. বদরুল হাসান।

মৃত্যু ভয় কাকে বলে টের পেলেন তিনি। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করলেন কিন্তু কেউ শুনল না তাঁর কথা। তুরাগ নদীর ধারে, উত্তরার একেবারে শেষ প্রান্তে নিজের বাড়িটি করেছেন বদরুল সাহেব। এদিকে সকালে আর বিকেলে স্বাস্থ্যসেবীরা আসে তাজা বাতাস ভক্ষণ করতে। সন্ধ্যার পরে কেউ ভুলেও পথ মাড়ায় না। কারণ এখানকার বাসিন্দাদের সন্ধ্যার পর সময় কাটে ক্লাবে বা পার্টিতে। আর বদরুল সাহেবের মরণ আর্তনাদ কেউ শুনতে পাচ্ছে না কারণ তাঁর নিকটতম প্রতিবেশীর বাড়িও এখান থেকে অন্তত পাঁচশো গজ দূরে। সে বাড়িতে এ মুহূর্তে আলো জ্বলছে না। হয়তো বাসিন্দারা বেরিয়ে পড়েছে নৈশ অভিসারে। তাই কেউ দেখল না একটি অসহায় মানুষ উন্মত্ত যন্ত্র দানবের হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ করতে চলেছেন।

খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলে বেলার কথা মনে পড়ছে বদরুল হাসানের। ছোট বেলা থেকেই সব ধরনের যান্ত্রিক অনুষঙ্গের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা। বাড়ির টিভি, রেডিও ইত্যাদি নিজ হাতে খুলে, নব টব মুচড়ে দিয়ে বিকৃত মজা পেতেন তিনি। বড় হয়েও যায়নি বদভ্যাসটা। ইলেকট্রিক গ্যাজেটগুলো অনভ্যস্ত হাতে নাড়াচাড়ার কারণে বহুবার ওগুলো বিগড়ে গেছে আর সেই সাথে জিনিসগুলোর প্রতি ঘৃণা বেড়েছে বদরুল সাহেবের। মনে হয়েছে তাঁকে মানসিক অশান্তিতে রাখার জন্যই যন্ত্রগুলো ইচ্ছে করে নষ্ট হয়। আর তাঁকে মেরামতের জন্য বার বার পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা দিতে হয়।

কিন্তু এখন কৃতকর্মের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে বদরুল হাসানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিগুলোর ওপর এতকাল অবিচার করার ফল এখন পাচ্ছেন হাতে হাতে। জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হচ্ছে।

বিশাল বপু নিয়ে গোঙাতে গোঙাতে ছুটছেন বদরুল হাসান। পেছনে অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর মত শখ করে কেনা মার্সিডিজ বেঞ্জ। আজ বিকেলেও ওটার দরজা ঠিক মত খুলছিল না বলে পেল্লায় এক লাথি বসিয়ে দিয়েছিলেন বদরুল। হয়তো সেই লাথির প্রতিশোধ নিতেই ছুটে আসছে মূর্তিমান আতঙ্ক।

ছুটতে ছুটতে তুরাগের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন বদরুল সাহেব। দূরে কোথাও পাড় ভাঙার অস্পষ্ট শব্দ বুকে কাঁপ ধরাল। নীচে তাকাতেই হিম হয়ে গেল শরীর। অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু খলবলে জল রাশির শব্দ। পেছনে তাকালেন তিনি। হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে যমদূত।

‘মাফ করো!’ দু’হাত জড় করে কেঁদে উঠলেন তিনি। ‘আমি সাঁতার জানি না। আমাকে এভাবে মেরো না, প্লীজ

জবাবে গর্জে উঠল ইঞ্জিন। আবার এগোতে শুরু করল মৃত্যু। এক পা করে পিছু হঠতে শুরু করলেন বদরুল হাসান। এগিয়ে আসছে মার্সিডিজ। একটা হেড লাইটে গাড়িটাকে এক চোখো দানবের মত লাগছে। চোখটা মৃত্যু খিদেয় অস্থির।

পিছু হঠতে হঠতে একেবারে পাড়ের কিনারে এসে গেলেন বদরুল হাসান। এখানে মাটি খুব নরম। তাঁর ভারী শরীরের ওজন সইতে পারল না নরম মাটি। হঠাৎই টের পেলেন বদরুল সাহেব পায়ের নীচ থেকে সরে যাচ্ছে আশ্রয়, পিছলে পড়ে যাচ্ছেন তিনি উঁচু পাড় থেকে। ছিটকে পড়ার আগ মুহূর্তে বদরুল সাহেবের মনে হলো মার্সিডিজের চোখটা যেন হাসছে। প্রতিশোধ নিতে পারার পরিতৃপ্তির হাসি!

চার

বদরুল হাসানের ফুলে ফেঁপে ওঠা পচা লাশ তুরাগের দক্ষিণে আবিষ্কার হলো দিন দুই পরে। মাছ ধরতে গিয়ে স্থানীয় জেলেরা লাশটাকে পেল। তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দিল মৃত দেহ।

যথারীতি পোস্টমর্টেম হলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ডাক্তার বললেন, প্রচুর মদ্য পানের আলামত পাওয়া গেছে তাঁর দেহে। রুটিন মাফিক তদন্তে পুলিশ বদরুল সাহেবের প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারল, বদরুল সাহেবকে নাকি অনেকেই দেখেছে একা, উদ্ভ্রান্তের মত কথা বলতে। দু’একজন প্রতিবেশী এটাও জানাল মাঝে মাঝেই তাঁর বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় গোঙানি আর চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে। সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে গিয়েছিল তারা। অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাদেরকে। এরপর থেকে বদরুল হাসানের ব্যাপারে তারা আর মাথা ঘামায়নি।

তদন্ত শেষে পুলিশ তাদের রিপোর্টে লিখল মি. বদরুল হাসানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী। একা থাকতেন তিনি, কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। শেষ দিকে তাঁর মধ্যে এক ধরনের মস্তিষ্ক বিকৃতি লক্ষ করা যায়। ঘটনার দিন প্রচুর মদ খেয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি গাড়ি নিয়ে। (গাড়ির হুইলে তাঁর হাতের ছাপ এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়)। সম্ভবত তুরাগ নদীর ধারে এসে হাওয়া খেতে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। মাতাল অবস্থায় পাড় ভেঙে ছিটকে পড়েন নদীতে। এবং সলিল সমাধি লাভ করেন।

.

এই ঘটনার মাস ছয় পরে বনানী গোরস্তানে এসেছে তমিজ আলী কবরের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘাস, আগাছা ইত্যাদি ছাঁটতে। ঘাস ছাঁটার যন্ত্র দিয়ে কাজটা এক মনে চালিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ একটা কবরের পাশে এসে যন্ত্রটা যেন পাগল হয়ে উঠল। বার বার তমিজ আলীর হাত থেকে ছিটকে যেতে চাইল, কবরটার গায়ে আঘাত করতে লাগল। যেন তীব্র ঘৃণা ভরে লাথি মারছে। তমিজ ভাবল তার যন্ত্রে বুঝি গোলমাল। সে ঘাস কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখল। কোনও সমস্যা নেই। অন্য কবরের পাশের আগাছা ঠিকই সাফ করছে যন্ত্র, কিন্তু নতুন, দামী পাথরের এই কবরটার কাছে এলেই যেন খেপাটে আচরণ শুরু করে দিচ্ছে। কৌতূহল হলো তমিজ আলীর। কবরটার দিকে তাকাল সে ভাল করে। অল্প স্বল্প লেখাপড়া জানে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে। পড়ল

মি. বদরুল হাসান (১৯৫২-১৯৯৭)

এই কবরে নিশ্চয়ই জিনের আসর আছে, ভ্রূ কুঁচকে ভাবল তমিজ আলী। নইলে ঘাস কাটার যন্ত্র এমন করে কেন?

জিনের কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল ওর। এদিক ওদিক তাকাল। ধারে কাছে কেউ নেই। আয়াতুল কুরসী পড়ে বার তিনেক ফুঁ দিল বুকে। তারপর যন্ত্রটা শক্ত মুঠোয় চেপে কবরটার দিকে সভয়ে আরেক বার তাকিয়ে গোরস্তানের গেটের দিকে হন হন করে হাঁটা দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *