• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

যখন পুলিস ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

লাইব্রেরি » ধীরাজ ভট্টাচার্য » যখন পুলিস ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য
যখন পুলিস ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

যখন পুলিস ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য
প্রথম প্রকাশ–আষাঢ়, ১৩৬১

.

দু’চার কথা

মামুলী ভূমিকা এ নয়। কাহিনী পড়বার আগে আমার কয়েকটি কথা সুধী পাঠকদের জানিয়ে রাখতে চাই। দেশ পত্রিকায় প্রকাশের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বহু কৌতূহলী পাঠকের চিঠি আমি পেয়েছি ও পাচ্ছি। সবার ঐ একই জিজ্ঞাসা–এত দীর্ঘদিন বাদে এ কাহিনী আমি কেন লিখতে গেলাম। আমি বলতে চাই–এর আগে ইচ্ছা বা অবসর থাকলেও পুলিস সম্বন্ধে ভেতরের ও বাইরের এত কথা আমি অকপটে ও এত সহজে লিখতে পারতাম না। কোনো পরাধীন দেশের লেখকের পক্ষে তা সম্ভবও নয়। আর একটা কথা এখানে বলা দরকার–পুলিসকে সাধারণের চোখে হেয় বা অপদার্থ প্রতিপন্ন করবার উদ্দেশ্য নিয়েও এ কাহিনী আমি লিখিনি। কর্মক্ষেত্রে সর্ব স্তরেই ভালো-মন্দ লোক আছে-ই–সেই ভালো-মন্দের মাঝে আমি যে কতবড় অযোগ্য অপদার্থ–এক কথায় মিস ফিট–এইটেই হলো আমার কাহিনীর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা–এটা নিছক গল্প না সত্যি? সবার অবগতির জন্য তাই জানাই ‘যখন পুলিস ছিলাম’ আমার জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ কাহিনী। হয় তো অজান্তে কল্পনার রঙ একটু আধটু লেগেছে–তাতে কাহিনীর আকর্ষণ বেড়েছে না কমেছে সে বিচারের ভার সুধী পাঠকের ওপর।

রাতারাতি সাহিত্যিক খ্যাতি লাভের দুরাশা নিয়েও এ কাহিনী আমি লিখিনি। এটি লেখবার একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। বন্ধুবর সাহিত্যিক শ্রীপ্রেমেন্দ্র মিত্রের বাড়িতে ছুটির দিনে প্রায়ই আড্ডা জমতো এবং এখনও জমে। বহু নামকরা সাহিত্যিক ও রসিক জদ-সমাগমে সরগরম সেই আড্ডায় বেমানান হলেও শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাকে উপস্থিত থাকতে হতো– এবং রস পরিবেষণের খানিকটা অংশও নিতে হতো। সেই আসরে আমার পুলিসি অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কয়েকটা গল্প বলতাম। সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন প্রশংসায় ও আমাকে লেখবার জন্য বারবার অনুরোধ করতেন। সাহস বা অবসরের অভাবে ইচ্ছা থাকলেও এতদিন হয়ে ওঠেনি। আজ সাহস না থাকলেও প্রচুর অবসর–তাই ভয়ে ভয়ে তিন চারটে পরিচ্ছেদ লিখে ফেললাম এবং একদিন দেশ পত্রিকার প্রাণ পরম স্নেহাস্পদ শ্ৰীসাগরময় ঘোষকে চুপি চুপি বাড়িতে ডেকে এনে শুনিয়ে দিলাম। পড়া শেষ করে কোনো কথা না বলে লেখাটি পকেটে পুরে তিনি বললেন–আপনি বাকিটা লিখতে শুরু করুন–আমি ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপবো।

এত বড় একটা জটিল সমস্যা এত সহজেই সমাধান হয়ে গেল–প্রথমটা বিশ্বাস করতেই পারিনি–তারপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। ভগবান সাগরকে দীর্ঘজীবী করুন।

আজ আমার জীবনের একটা স্মরণীয় দিন, তাই আমার হিতৈষী বন্ধুবান্ধব, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাইকে জানাই আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা। আর একজনের কথা এখানে উল্লেখ না করলে আমার বক্তব্য অসমাপ্ত থেকে যাবে। সে হচ্ছে আমার অকৃত্রিম হিতৈষী উদীয়মান সাংবাদিক শ্রীমান সরোজ চক্রবর্তী। তার উৎসাহ ও পরিশ্রম বাদ দিলে এত শী আমার বই প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। মুখের শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে ঋণ শোধ করবার চেষ্টা না করে ওর কাছে তাই আমি ইচ্ছে করেই ঋণী হয়ে রইলাম।

ধীরাজ ভট্টাচার্য
তাং ১লা আষাঢ়,
–ললিত স্মৃতি–
৭২ হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রীট,
কলিকাতা-২৫

.

উৎসর্গ

আমার পরমারাধ্য পিতৃদেব–
ললিত মোহন ভট্টাচার্যের
পুণ্য শ্রীপাদপদ্মে

বাবা–
ভাগ্যিস আমায় জোর করে পুলিসে ঢুকিয়ে ছিলেন–
আপনার ভাগ্যবান ছেলে
“ধীউ বাবা”

.

রাত জেগে স্কুলের পড়া পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পরিষ্কার স্বপ্ন দেখলাম, লণ্ডনে বেকার স্ত্রীটে রবার্ট ব্লেকের ড্রয়িং রুমে বসে স্মিথের বোকামির জন্য তিরস্কার করছি। পাশের দরজার ফাঁক দিয়ে মিসেস বাডেল একটু উঁকি দিয়ে বোধহয় জানিয়ে দিয়ে গেল যে, সে সবই শুনছে। পায়ের কাছে বিরাটকায় টাইগার চোখ বুজে শুয়ে আছে; সে যে ঘুমোয়নি, মাঝে মাঝে ল্যাজ নেড়ে তা জানিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধ রাত্রির বুক চিরে বাইরের কলিং বেলটা আর্তনাদ করে উঠলো। নিমেষে টাইগার লাফিয়ে উঠে কান খাড়া করে দাঁড়ালো, স্মিথের ভ্যাবাচাকা খাওয়া মুখখানা কঠিন হয়ে উঠলো। আর আমি নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে রিভলবারটা হাতে তুলে নিলাম। বেচারি বার্ভেল ভয়ে ভয়ে সবে মাত্র দরজা খুলে দিয়েছে এমনি পরম মুহূর্তে ঘুম ভেঙে গেল, ইস!

চোখ মেলে দেখি মা কাছে দাঁড়িয়ে বকেই চলেছেন। ছোট ভাইবোনগুলো ঘুম-ফুলে চোখে পরম আনন্দে তা উপভোগ করছে। শুধু বাবা নির্লিপ্তভাবে বাইরের রকে পায়চারি করছেন। মায়ের বকুনি কোনোদিন আমাকে বিশেষ দমাতে পারেনি; একটু ভালো করে চেয়ে দেখি মা’র হাতে রয়েছে পাঠ্যপুস্তকের নিচে লুকিয়ে রাখা দীনেন্দ্র রায়ের রহস্যলহরী সিরিজের বুদ্ধির যুদ্ধ, এবার সত্যিই লজ্জা পেলাম আর দমেও গেলাম। পরীক্ষার পড়ার ছুতোয় ছোট ভাইবোনদের এমনকি মাকেও কম যন্ত্রণা দিইনি। পড়ার সময় কাউকে ঘরেই ঢুকতে দিতাম না। তাছাড়া দোকান বাজার ফাই ফরমাশ সব খেটেছে ছোট ভাইবোনেরা। রাত জেগে পড়ার জন্য উঠতে দেরি হবেই-কাজেই সকাল থেকে আমার ঘরের আশেপাশে কারু জোরে কথাটি পর্যন্ত বলবার উপায় নেই। আজ বোধহয় সুদ সুদ্ধ পেয়ে গেলাম। মা বলে চলেছেন, আর কাজ নেই লেখাপড়া শিখে, অনর্থক পয়সা নষ্ট। পরীক্ষার তিনদিনও নেই আর রাত জেগে হতভাগা পড়ছে বটতলার ডিটেকটিভ উপন্যাস?

রহস্যলহরী যে বটতলার চেয়ে অনেক উঁচুদরের উপন্যাস এ প্রতিবাদ তখন করতে সাহস পাইনি।

এরই ফাঁকে ছোট বোনটা বলে উঠলো, জানো মা, কাল রাতে ইংরেজি পড়াটার একটু মনে করে দিতে যেই দাদাকে বলেছি, কি বকুনিটাই…। সে আরো হয়তো বলতো, মা এক ধমকে থামিয়ে দিলেন–যা যা, হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসগে যা, একজন তো লেখাপড়া শিখে আমাদের রাজা করলো, এখন তোমরা বাকি।

তারপর মায়ের যত আক্রোশ পড়লে গিয়ে নিরীহ বাবার উপর–কতদিন বলেছি, একটু শাসন করো, অতো আস্কারা দিও না। তা তো হবে না, এখন ভোগো।

বেলা বেড়ে উঠতে লাগলো, আমার দিক থেকে কোনও প্রতিবাদ না পেয়ে মা গজ গজ করতে করতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ছোটভাই বাজারের থলি ও কয়েকটা টাকা খাটের উপর রেখে নামতার মতো কি কি আনতে হবে না-হবে বলে গেল। প্রতিবাদ করে কোনও ফল নেই। আমি জানি পরীক্ষার ফল না বেরুনো পর্যন্ত এ নির্যাতন আমাকে সইতেই হবে। শুধু এতেই শেষ হলো না। রাত জেগে পড়তে বসলেই মা প্রবলভাবে বাধা দিয়ে বলতেন, মিছিমিছি আর তেল পুড়িয়ে কাজ নেই–শুয়ে পড়ো।

তবু সব হজম করে রাত জেগেই পড়তাম। অন্য সময় আমার পড়া হতো না। এরই মধ্যে একদিন বাবা সন্ধ্যেবেলায় কাছে এসে বসলেন, বুঝলাম নিশ্চয়ই কিছু বলতে এসেছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বাবা বললেন, ধীউবাবা, (আমাকে বাড়িতে সবাই ধীরু বলে ডাকতো, শুধু বাবা ডাকতেন, ধীউবাবা বলে) বাইরের নাটক নভেল পড়তে আমি বারণ করিনে, ওতে জ্ঞান বাড়ে, কিন্তু পরীক্ষার সময় এগুলো নাই বা পড়লে। এরপরে অঢেল সময় পারে।

সেইদিন শুধু বলেছিলাম, রোজ আমি পড়ি না বাবা, ঐ বইটা তারপরদিন ফেরত দিতে হবে বলে… আর বলতে পারলাম না। এতদিনের জমে ওঠা অভিমান ভিড় করে গলার কাছে এসে আমার বাকরোধ করে দিলে। সস্নেহে আমার গায়ে কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বাবা বলেছিলেন, জানি, নইলে প্রতি পরীক্ষায় তুমি প্রথম বা দ্বিতীয় ছাড়া হওনি। একি শুধু বাইরের উপন্যাস পড়ে হয়? মায়ের কথা মনে করতে নেই।

সেদিনকার কথা আমি জীবনে ভুলতে পারবো না।

.

এর পরের দু’ তিন বছরের ঘটনা যেমনি সংক্ষিপ্ত তেমনি বৈচিত্র্যহীন। মধ্যবিত্ত সংসারের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার একঘেয়ে ইতিহাস; তার সঙ্গে আমার বক্তব্যের বিশেষ যোগ নেই বলে এড়িয়ে গেলাম।

ভালোভাবে ম্যাটিক পাশ করে আশুতোষ কলেজে আই.এস-সি. ক্লাশে ভর্তি হলাম। মা-বাবার আন্তরিক ইচ্ছা হয় ডাক্তার নয় ইঞ্জিনীয়ার হবে। বলা বাহুল্য রহস্যলহরীর এখন আমি নিয়মিত গ্রাহক। আর লুকিয়ে পড়বার দরকার হয় না।

এই সময় এমন একটা ঘটনা ঘটলে, যা আমার ভবিষ্যতের আশা আকাঙ্ক্ষা সব কিছু লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেল। আমার বড়দা দৌলতপুর কলেজে বি-এ. ( ফোর্থ ইয়ারে) পড়ছিলেন। পরীক্ষার বিশেষ দেরি নেই, আমারও সেকেণ্ড ইয়ারের টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষার ফিজ পর্যন্ত জমা দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ বড়দা বাড়ি চলে এলেন। বললেন, আজ আট দশ দিন যাবৎ জ্বর, মোটেই রেমিশন হয় না। যথারীতি এখানকার ডাক্তার দেখানো হলো, কিন্তু সে জ্বর আর রেমিশন হলো না। ঠিক পঁচিশ দিনের দিন বড়দা মারা গেলেন। আমার জীবনে সব কিছুর আদর্শ ছিলেন আমার বড়দা, তার বিষয়ে বিশদ লেখার স্থান এ নয়, আমিই এগিয়ে যাই।

মা শোকে শয্যা নিলেন। আমরাই জোর করে তাঁকে খাওয়াই, শুধু বাবার বাহ্যিক কোনো পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। বড়দা মারা যান ভোরে, সব কিছু ব্যবস্থা করে আমরা যখন শব নিয়ে শ্মাশানে গেলাম তখন বেলা সাড়ে দশটা বেড়ে গিয়েছে। ফিরে এসে শুনি বাবা নিয়মিত এগারোটায় স্কুলে গিয়ে ছেলেদের পড়িয়েছেন ঠিক নিয়মিত হাসিগল্পের মধ্য দিয়ে। বেলা একটার সময় হেডমাস্টার মহাশয় খবরটা কার কাছ থেকে শুনে হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখেন বাবা ক্লাশে পড়াচ্ছেন। খানিক অবাক হয়ে থেকে তিনি বললেন, ললিতবাবু, আপনি আজও স্কুলে এলেন?

হেসে বাবা জবাব দিয়েছিলেন, হ্যাঁ, যার জিনিস তিনি নিয়েছেন, এতে দুঃখ করবার কী আছে। তাছাড়া বাড়ি বসে হা হুতাশ না করে ছেলেদের নিয়ে বেশ ভুলে আছি। এতে অবাক হবার কি আছে?

বাবা ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের বাংলা সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন।

এর পরে বাড়ি আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো। রাতদিন মায়ের কান্না, ছোট ভাইবোনদের বিষণ্ণ মুখ, বাবার মৌন স্তব্ধতা সব মিলে আমাকে কেমন করে দিলো। বড়দার জন্যে এক ফোঁটা চোখের জল ফেলবার ফুরসৎ আমি পেলাম না। কলেজ বন্ধ, সময় কাটানো দুষ্কর হয়ে উঠলো। ঠিক করলাম, আর পড়বো না। ভোরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াই। রাত্রে ফিরে যাহোক কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ি। ঘুমোতে পারি না, কি অসহ্য অবস্থা।

এরই মধ্যে একদিন এক বন্ধু বায়োস্কোপ দেখাতে নিয়ে গেল এম্প্ৰেস্ থিয়েটারে (বর্তমান রূপালী সিনেমা)। ম্যাডান কোম্পানির ভোলা নির্বাক ছবি ‘Tara the dancer’। যেমন জঘন্য গল্প তেমনি বিচিত্র তার চিত্ররূপ এবং ফটোগ্রাফি। আমার জেদ চেপে গেল ছবিতে অভিনয় করবার। শুনে সঙ্গের বন্ধুটি তো হেসেই খুন। একে তখন বিশ্রী রোগা চেহারা তার উপর ছবির অভিনয় সম্বন্ধে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। কাজেই তাকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। সে গিয়ে আরো জানা অজানা সবার কাছে খবরটা রাষ্ট্র করে দিলো। ফলে ব্যাপারটা খুব জটিল হয়ে পড়লো। আমি যেন সবার কাছে একটা হাস্যকৌতুকের উৎস হয়ে উঠলাম। জেদ আরো বেড়ে গেল। কি করি, বাড়িতে তো কিছুতেই মত দেবে না। আর তখনকার দিনে সতেরো আঠারো বছরের ছেলে বায়োস্কোপ করে শুনলে লোকে আঁতকে উঠতে। তারপর ঘৃণা ও অবজ্ঞার এমন একটা চাউনি দিতো যা সহ্য করে সমাজে বাস করার চেয়ে জেল খাটা শ্রেয় মনে হতো।

স্কুলে পড়বার সময়ে খাবারের পয়সা জমিয়ে ভাবের অভিব্যক্তি তুলি। অনেক চেষ্টা ও পরিশ্রমের পর সেগুলো তখনকার সবচেয়ে জনপ্রিয় সাপ্তাহিক “সচিত্র শিশির”-এ ছাপা হয়। সেই হলো একমাত্র ছাড়পত্র বা প্রশংসাপত্র। ম্যাডান কোম্পানিতে তখন পরিচালক জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বাংলা ছবি তুলছেন–সতীলক্ষ্মী। খবরটা অতিকষ্টে সংগ্রহ করে একদিন ঐ একমাত্র প্রশংসাপত্র “সচিত্র শিশির” সঙ্গে করে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। কি জানি কেন ছবিগুলো দেখে তিনি তাঁর ছবিতে একটা বদমাশ চরিত্র বিনোদের ভূমিকা আমাকে দিলেন।

চরিত্রটি যা বুঝিয়ে দিলেন তা হচ্ছে–বিনোদ অতি নীচ ও জঘন্য স্বভাবের যুবক। বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে সে সতীলক্ষ্মী বন্ধু-স্ত্রীর উপর কদর্য দৃষ্টি দেয় ও কিসে তার সতী নাম ঘুচিয়ে পাপের পঙ্কিল পথে টেনে আনবে, তারই চিন্তায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে। বিনোদের সারা জীবনটাই এই ধরনের কার্যকলাপে পূর্ণ। শেষ পরিণতি দেখা যায়–একটা নিষ্পাপ সরলা বালিকা, যাকে যৌবনে বিনোদ প্রলোভনের ফাঁদ পেতে সর্বনাশের পথে টেনে এনেছিল, যার ফলে শেষ পর্যন্ত সে পাগল হয়ে যায়। সেই বালিকাই হঠাৎ একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে ফিরে এসে দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গার ধারে বিনোদকে একা পেয়ে তার চুল টেনে ধরে মাটিতে ফেলে তার বুকের উপর বসে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলে পা ধরে টানতে টানতে গঙ্গার জলে ফেলে দেয়।

ভীষণ দমে গেলাম। প্রথম নেমেই এমন একটা চরিত্র। বাবা মা দূরের কথা, চেনাশোনা কেউ যদি এ চরিত্রে আমাকে পর্দায় দেখে, তাহলে…। আর ভাববার সময় পেলাম না। জ্যোতিষবাবু বললেন, এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে। কাল থেকে সুটিং। আপত্তি থাকে তো এখনই বলুন, স্টেজের অনেক অভিনেতা এ ভূমিকাটির ওপর লুব্ধ দৃষ্টি দিয়ে বসে আছে।

যা থাকে কপালে, রাজী হয়ে গেলাম।

.

রোজ সকালে বেরিয়ে যাই আর বাড়ি ফিরি সন্ধ্যে সাতটা আটটায়। এইভাবে প্রায় দশ বারো দিন শুটিং হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ একদিন মা জিজ্ঞেস করে বসলেন, রোজ সকালে উঠে কোথায় যাস?

আমতা আমতা করে আসল কথাটা এড়িয়ে সেদিনকার ফাঁড়া কাটালাম, পরদিন রাত্রে বাবাও জিজ্ঞাসা করে বসলেন। বিপদ হলো সেখানেই, বাবার কাছে আমি মিথ্যা বলতে পারতাম না। একটু ইতস্তত করে সবই খুলে বললাম। সব শুনে বাবা গম্ভীর হয়ে গেলেন। কিছু বললেন না। পরদিন থেকে মা হাঙ্গার স্টাইক করে বসলেন। বড়দার শোক এ ক’দিনে যা একটু কমে এসেছিল, আমার সিনেমায় ঢোকায় তা আবার দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। রাত্রে শুনি মা বাবাকে বলছেন, তুমি কী? তুমি কি মানুষ? এক ফোঁটা ছেলে, ঐসব বাজারের মেয়েদের সঙ্গে রঙ মেখে নেচে কুঁদে বেড়াবে আর তুমি অম্লান বদনে তাতে মত দিলে? বেঁচে থেকে আমি এসব দেখতে পারবো না। আর কটা দিন সবুর করো আমি মরি, তারপর তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করো। উত্তরে বাবা কী যে বলেছিলেন শুনতে পাইনি।

সকালে বাবা ডেকে পাঠালেন। বললেন, যা হবার হয়েছে, আর তুমি সুটিং করতে যেও না।

ভয়ে ভয়ে বললাম, এতখানি কাজ এগিয়ে গিয়েছে যে, এখন সুটিং বন্ধ করলে ওরা মহা বিপদে পড়বে। আর তা ছাড়া ক্ষতিপূরণের দাবি দিয়ে মামলাও করতে পারে। অনেক চিন্তার পর ঠিক হলো, এই ছবিটার পর আর আমি কোনো ছবিতে অভিনয় করবো না, একথা মায়ের পা ছুঁয়ে বলতে হবে। তাই হলো।

অগত্যা মা অন্নজল গ্রহণ করলেন, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

‘সতীলক্ষ্মী’ ছবি বেরুলো। বাবা একদিন লুকিয়ে দেখে এসে তিন চারদিন গম্ভীর হয়ে রইলেন। কারো সঙ্গে ভালো করে কথা কইলেন না। বহু আত্মীয়স্বজন অযাচিতভাবে এসে মাকে ও বাবাকে তিরস্কার করে গেলেন, যথা–জেনে শুনে ছেলেটাকে পড়া বন্ধ করিয়ে উচ্ছন্নের পথে ঠেলে দিলে। এর পর সমাজে তোমাদের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো কষ্টকর হবে সেটা ভেবে দেখেছে? যেন মরমে মরে গেলাম। সবচাইতে দুঃখ, বাবা তিরস্কারের উত্তরে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না। নিজের বাড়িতেই যেন আমি একঘরে হয়ে গেলাম।

.

ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের (আই. বি.) একজন বড় সি. আই. ডি. অফিসারের বালবিধবা মেয়েকে বাবা গীতা এবং আরও কি সব ধর্মগ্রন্থ পড়াতেন। একদিন পড়িয়ে বাড়ি ফিরলেন একটু সকাল সকাল। অনেকদিন পরে প্রথম সেদিন বাবাকে একটু প্রফুল্ল দেখলাম। রাত্রে বাবার ঘরে ডাক পড়লো। গিয়ে দেখি মাও সেখানে বসে আছেন। বাবা কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললেন, ধীউবাবা, তোমাকে পুলিসে ঢোকাবার সব ব্যবস্থা করে এলাম।

হঠাৎ কথাটা শুনে কেমন হকচকিয়ে গেলাম। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে মা একেবারে জ্বলে উঠলেন, ভেবেছে বায়োস্কাপ করে বেড়াবে? তা হবে না। নয়তো ফের তোমাকে কলেজে ভর্তি হতে হবে।

বাবা স্নিগ্ধ হাস্যে মাকে চুপ করতে বললেন। তারপর আমাকে সস্নেহে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, তাই করো তুমি। আর এ বয়সে এত খাটতে আমি পারি না। তুমি যদি কিছু সাহায্য করতে পারো তাহলে আমার মস্ত লাভ।

দ্বিধা আমার তখনও রয়েছে, সিনেমা থেকে পুলিস? বাবা বললেন, আর পুলিশ লাইনটাকে অতো খারাপ ভাবছে কেন? পুলিসে কি ভালো লোক নেই?

সম্মতি দিলাম। আর না দিয়েও কোনো উপায় ছিলো না আমার। কোনো কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকা আর সহ্য হয় না!

***

Book Content

১. পুরোপুরি পুলিস
২. সারদার ট্রেনিং
৩. চট্টগ্রাম থেকে মগের মুল্লুক
৪. মাথিন
৫. চৈত্র-সংক্রান্তি
৬. ট্রেন ছাড়ল
৭. কাওয়ার্ড
লেখক: ধীরাজ ভট্টাচার্যবইয়ের ধরন: আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা
যখন নায়ক ছিলাম

যখন নায়ক ছিলাম – ধীরাজ ভট্টাচার্য

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.