সারদার ট্রেনিং থেকে বেশ ভালোভাবে পাশ করে কলকাতায় ফিরে এসেছি। সে এক অদ্ভুত বিচিত্র অভিজ্ঞতা। কূলহারা পদ্মার উত্তর দিকে প্রায় হাজার বিঘে জমির উপর সারদা পুলিস ট্রেনিং সেন্টার। আগেই বলেছি, আমরা ছিলাম বেঙ্গল পুলিসের অধীনে। এ. এস. পি. থেকে শুরু করে সাধারণ কনস্টেবল পর্যন্ত সবাইকে এখানে ট্রেনিং নিতে হতো। প্রকাণ্ড একটা হলের মতো ঘরে আমরা প্রায় ষাট জন (এ. এস. আই.) থাকতাম। ভোর পাঁচটায় বিউগিল বাজলেই তাড়াহুড়ো করে বিছানা ছেড়ে উঠে প্রাতঃকৃত্য ইত্যাদি শেষ করে ঠিক ছ’টার সময় পোশাক পরে রাইফেল নিয়ে পদ্মার পাড়ে প্যারেড গ্রাউন্ডে গিয়ে ঈাড়াতে হতো। তারপর প্রায় দেড় ঘণ্টা একনাগাড়ে দৌড়-ঝাঁপ ও ড্রিল করে যখন প্রায় আধমরা হয়ে যেতাম তখন আধ ঘণ্টার ছুটি মিলতে। তারই মধ্যে কিছু খেয়ে নিয়ে ড্রিলের পোশাক বদলে খালি পায়ে খাকি হাফপ্যান্ট ও হাফসার্ট পরে আবার গিয়ে দাঁড়াতে হতো। তারপর শুরু হতো খেলা ও নানারকমের ব্যায়াম। যেমন, বারো তেরো হাত উঁচু সিমেন্ট-করা পাঁচিল টপকানো, প্যারালালবারের নানারকম কসরৎ, হাইজাম্প, লঙজাম্প ইত্যাদি। ঘণ্টা দেড়েক পরে আবার আধ ঘণ্টার ছুটি। তার মধ্যে পোশাক বদলে আবার ল’ ক্লাশে যেতে হতো। সেখানে প্রায় দু ঘণ্টা ‘পি. আর. বি.” (পুলিস রেগুলেশন বুক) থেকে নিরস কতকগুলো আইনকানুন পড়ানো হতো। বারোটা থেকে একটা ছিলো স্নান করা ও খাওয়ার ছুটি। আবার একটা থেকে তিনটা পর্যন্ত ল’ ক্লাশ, খেলাধুলো; তারপর আবার ড্রিল। ছুটি হতো ছটায়। আবার সন্ধ্যে সাতটা থেকে চলতে ল’ ক্লাশ। এ সময়টায় কেউ পড়াতো না, নিজেদেরই বসে পড়তে হতো। একজন ইনস্টাক্টর শুধু বসে পাহারা দিতেন। রাত্রি আটটায় আবার বিউগিল বাজলেই ব্যারাকের উঠোনে লাইন দিয়ে দাঁড়াতাম, শুরু হতো নাম ডাকা। তারপর খাওয়ার ছুটি। রান্নাঘর ছিলো আমাদের ব্যারাক থেকে খানিকটা দূরে। সুতরাং নাম ডাকার পর প্রায় একরকম ছুটে গিয়ে ঢুকতাম মেসে। উড়েঠাকুর যা রান্না করতো তাই অমৃতের মতো লাগতো। আবার রাত্রি ঠিক ন’টায় বিউগিল বাজতে, সঙ্গে সঙ্গে ঘরের আলো নিবিয়ে যে-যার বিছানায়। প্রথম প্রথম কান্না পেতো। ভাবতাম কেন মরতে এলাম। কিন্তু দিনকতক বাদে আর তেমন কষ্ট হতো না। বৃহস্পতিবার ছিলো আমাদের ছুটির দিন, সেদিন থোপা আসতো। সকাল থেকে কোনো কাজ নেই, শুধু গল্প, সময় আর কাটতে চায় না। মনে হতো, এর চেয়ে দৈনন্দিন প্যারেডই যেন ছিলো ভালো।
ট্রেনিং-এ গিয়ে আমার আর একটি বিশেষ উপকার হয়েছিলো। ছেলেবেলা থেকেই আমি ভীষণ রোগা ছিলাম, কারো সামনে খালি গায়ে বেরোতে লজ্জা হতো। কারণ জামা খুললেই মনে হতে যেন বুকের হাড় পাঁজরাগুলো দাঁত বার করে হাসছে। পুলিশ ট্রেনিং-এ নিয়মিত ধরাবাঁধার মধ্যে থেকে স্বাস্থ্য আমার একেবারে বদলে গেল। আগেকার জামা আর গায়ে দিতে পারতাম না। এসব ছাড়াও বন্দুক ছোঁড়া, দৈনিক প্রায় দশ বারো মাইল মার্চ করা, লাফঝাঁপ ইত্যাদি আমার পরবর্তী জীবনে বিশেষ কাজে লেগেছিলো।
রোজ একবার করে আপিসে যাই, খানিক গল্পগুজব করে চলে আসি। শুনলাম, আমার নাম সব ডিস্ট্রিক্ট-এ পাঠানো হয়েছে। যেখানে ভেকেন্সি থাকবে সেখানে বদলি করে দেবে। বাবা-মার বিশেষ ইচ্ছা চব্বিশ পরগণার কোনও, থানায় দিলে কাছাকাছি থাকতে পারবো। আমারও কলকাতা ছেড়ে দূরে কোথাও যাবার ইচ্ছা ছিলো না। রতিলালবাবুকে বাবা সেই কথাই বলেছিলেন। একদিন আপিসে গিয়ে শুনি, আমাকে চট্টগ্রাম বদলি করেছে। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। রতিলালবাবু জানালেন যে, অন্য কোথাও ভেকেন্সি নেই, কাজেই ওখানে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাবা-মাও বেশ দমে গেলেন। একে অজানা জায়গা, তার উপর অনেক দূর। কি করবো না করবো ভাবছি। রতিলালবাবু একদিন এসে বললেন–এখন চলে যাও, যখনি চব্বিশ পরগণায় ভেকেন্সি হবে তখনি এখানে আনবার ব্যবস্থা করা যাবে। অগত্যা। তাই ঠিক হলো। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, খাকি পোশাক ইত্যাদি কিনে নিয়ে শুভদিন দেখে একদিন চিটাগং মেলে রওনা হলাম।
***
চট্টগ্রাম। স্টেশনের কাছেই পুলিস ক্লাব। সেখানেই আস্তানা নিলাম। রাস্তায় বেরতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা এতো ছোট্ট অথচ এতো সুন্দর শহর আর বাংলাদেশে আছে কিনা আমার জানা নেই। থানায় যাবো, অচেনা পথ। পুলিস ক্লাব থেকেই একজন সঙ্গী জুটিয়ে নিলাম। লাল সুরকির আঁকাবাঁকা পথ, অজগর সাপের মতো নিচু থেকে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। সেখানেই থানা ও পুলিশ কোতোয়ালি। থানার পাশ দিয়ে লালপথ নামতে শুরু করেছে ঘড়ির প্রি-এর মতো ঘুরে ঘুরে। সমতলে নেমে সে-রাস্তা আবার অন্যধার দিয়ে একে-বেঁকে উপরে উঠেছে। সমস্ত শহরের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হলো টাইগার হিল। শহরের উত্তরে পাহাড়তলীর পথ। সেখান থেকে Bay of Bengal দেখা যায়। পুলিস কোর্ট ফেয়ারি হিলের ওপর। ওখান থেকে বাঁয়ে প্রশস্ত কর্নফুলি ও ডাইনে প্রশস্ততর তার মোহনা দেখা যায়। কোর্ট-এর নিচে সদর ঘাট, ভবল মুরিংস জেটি, পরে মহেশখালি–তারপর বে অব বেঙ্গল–শহর থেকে অন্ততঃ ১৫/২০ মাইল দূরে।
খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোতোয়ালি থানার সব অফিসারের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল। অফিসার-ইন-চার্জ ছিলেন চাঁদ মিঞা। অতি অমায়িক ভদ্রলোক। ফার্স্ট অফিসার একজন হিন্দু, হেম গুপ্ত। সেকেণ্ড অফিসার মুসলমান। আগে থানার নাম শুনলেই ভয় হতো, ভাবতাম না জানি কি ভয়ানক জায়গা। এদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর সে ভুল ভেঙে গেল। এ যেন একান্নবর্তী একটি সংসার, কয়েকটি ভাই মিলে-মিশে সে সংসার চালাচ্ছে।
এখানে একটি কথা বলে রাখা বিশেষ দরকার যে, চট্টগ্রাম জেলা ছিলো সব দিক দিয়ে ‘ব্যাকওয়ার্ড’, বিশেষ করে পুলিস ডিপার্টমেন্ট। বড় বড় অফিসার–যেমন ধরুন-ইনস্পেক্টর, ডি. এস. পি, প্রভৃতির সঙ্গে আলাপ করে বুঝলুম লেখাপড়া বিশেষ কিছুই করেননি। অধিকাংশই ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন পেয়ে বড় হয়েছেন। আমি ক্যালকাটা আই. বি. থেকে আসছি শুনে এদের মধ্যে অনেকেই নিজে থেকে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। যদিও পদমর্যাদায় ও বয়সে এরা আমার চেয়ে অনেক বড়। স্থানীয় ক্লাবগুলোতেও দেখলাম বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই একটা না একটা ক্লাব থেকে নিমন্ত্রণ আসতো। উদ্দেশ্য হলো তাদের নাট্যাভিনয়ে কিছু সাহায্য করা। প্রথম প্রথম দু-এক জায়গায় গিয়েও ছিলাম। সেই পচা মান্ধাতার আমলের নাটক, নাকী সুরে টেনে টেনে যাত্রার ধরনে অভিনয়, কি আর দেখাবো। তবু ওরই মধ্যে দু’-একটা পার্ট দেখিয়ে দিতাম। পরে আর যেতাম না। নানা অজুহাতে এড়িয়ে চলতাম। সব চাইতে মজার ব্যাপারটাই বলি। সেদিন কি একটা উপলক্ষ্যে স্কুল, কলেজ, কোর্ট সব বন্ধ। বিকেল বেলায় পুলিস ক্লাবে বসে চা খাচ্ছি। রাখালদা (ইনি পুলিস কোর্টের কেরানী, বয়েস প্রায় পঞ্চায়। বেশ রসিক লোক) কোথা থেকে একটা হারমোনিয়ম এনে হাজির করলেন, উদ্দেশ্য আমাকে গান গাইতে হবে। আমি তো অবাক। রাখালদা হেসে বললেন আমরা সব শুনেছি ভায়া, তুমি সব বিষয়েই ওস্তাদ। আর হবেই বা না কেন? আই. বি’র লোক, চৌকশ না হলে চলবে কেন?
অনেক রকম ওজর আপত্তি করেও দেখলাম ফল হবে না। অগত্যা গাইলাম কাজীদার সেই বিখ্যাত গান যা কলকাতার অলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এমন কি বিড়িওয়ালারাও বিড়ি বাঁধতে বাঁধতে বিড় বিড় করে যে গান গায়। ভয়ে ভয়ে গাইলাম–
কে বিদেশী, মন উদাসী
বাঁশের বাঁশি বাজাও বনে।
গান শেষ করে দেখি সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। চোখে মুখে প্রশংসা উপচে পড়ছে। বাইরে চেয়ে দেখি অগুন্তি লোক রাস্তায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে। রাখালদা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন–এতো ভালো গাইতে পারে অথচ এতোক্ষণ ধরে ন্যাকামী করছিলে। নাও আরেকখানা গাও।
জীবনে এই প্রথম শুনলাম আমি ভালো গাইতে পারি। . চট্টগ্রামের জনসাধারণের উপর শ্রদ্ধা বেড়ে গেল, গাইলাম–
তোমর পাশে বসতে পেলে
কইবো না আর কথা
নীরবতায় ডুবিয়ে দেবো
বুক ভরা মোর ব্যথা।
আরো দু’তিনখানা গেয়েছিলাম কিন্তু কি গান আজ আর তা ঠিক মনে নেই। তবে সবগুলোই পচা পুরোনো গান যার প্রথম লাইন গাইলেই কলকাতার আসর থেকে লোক উঠে যেতো। পুলিস ক্লাবে গান গেয়ে নিজের সর্বনাশ নিজে ডেকে আনলাম। সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লো আমি নাকি ভালো গান গাইতে পারি। ফলে রোজ নেমন্ত আসতে শুরু হলো। আজ ডি. এস. পি’র বাড়ি থেকে, কাল কোতোয়ালি কোয়াটার্স থেকে, পরশু স্টুডেন্টস্ ক্লাব থেকে। সব জায়গাতেই সেই মান্ধাতা আমলের গান ‘কে বিদেশী’। দিনে রাতে অন্তত পঁচিশ ত্রিশবার এই একটি গানই আমাকে গাইতে হতো। তাতেও নিস্তার নেই, ডি. এস. পি. সদানন্দবাবুর মেয়ে নমিতা খাতা পেন্সিল নিয়ে বসলো গানটা তাকে শিখিয়ে দিতে হবে।
রোজ রিজার্ভ আপিসে গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। তখনো আমার পোস্টিং হয়নি কারণ কোথাও ভেকেলি নেই। দিনগুলো বেশ আনন্দেই কাটতে লাগলো। এখানে এসে আরেকটা জিনিস খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করলাম–পুলিসের কি অসীম ক্ষমতা। কলকাতায় বসে ধারণাও করা যায় না। একটু উদাহরণ দিই। ধরুন কোতোয়ালিতে বসে গল্প করছেন। সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছে। বলে দিন ক’ প্যাকেট কি সিগারেট দরকার, নিমেষে এসে যাবে। পয়সা দেবার কথা চিন্তাও করবেন না। কোথাও যাবেন, ট্যাক্সি দরকার। কনেস্টবলকে শুধু বলে দিন, তারপর ট্যাক্সি এলে সারা শহর তাতে ঘুরে বেড়ান। ভাড়া? কি সর্বনাশ! ভাড়া অফার করে আপনি কি ট্যাক্সিওয়ালাকে অপমান করতে চান? সিনেমায় যাবেন? কোতোয়ালিতে বারো মাসের পাশ পড়ে আছে, শুধু গিয়ে সিনেমা হলের মালিককে ধন্য করে আসুন। এই রকম কতো আর বলবো।
প্রথম প্রথম এদের ভাষা বুঝতে প্রাণ বেরিয়ে যেতে। চট্টগ্রামের ভাষা যেমন জলদ তেমনি জড়ানো। পাঁচ ছ’টা কথা একসঙ্গে জড়িয়ে তালগোল পাকিয়ে বলাই হলো এদের রীতি। যেমন ধরুন-হারামজাদাবেডাএডেকিল্লাইয়াছু! বুঝলেন কিছু। কথাটা ভাঙলে দাঁড়ায়–হ্যারামজাদা ব্যাটা এখানে কিসের জন্যে এসেছিস? প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হলেও পরে বেশ বুঝতে পারতাম, কিন্তু বলতে পারতাম না। আমার অবস্থা তখন সেইরকম দোয়াতের মতো যাতে কালি ঢোকানো যায়, বের করা যায় না। যাক যা বলছিলাম। এইভাবে কোতোয়ালিতে আড্ডা দিয়ে ক্লাবে গান গেয়ে সিনেমা দেখে প্রায় দু’ সপ্তাহের উপর কাটিয়ে দিলাম। মাঝে শরীরটা খারাপ ছিলো বলে দু দিন কোতোয়ালিতে যেতে পারিনি। সেদিন গিয়ে দেখি থানার আপিস ঘরের পাশে একটা ছোট ঘরে হেমদ বসে রয়েছে, পাশে টেবিলটার কাছে ঘোমটা দিয়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে, পরনে একটা বিশ্রী ময়লা শাড়ি। তার পাশে আধবয়সী আরেকটি মেয়ে। আমি একটু উঁকি দিয়ে চলে আসবে কিনা ভাবছি, হেমা ডাকলে-এসে ধীরাজ।
অগত্যা গিয়ে সামনের চেয়ারটায় বসলাম।
হেমদ চট্টগ্রামের ভাষায় জড়িয়ে জড়িয়ে মেয়েটিকে উদ্দেশ করে বললে–এখনও বল, তোর স্বামীকে নয়তো তোর বাপকে খবর পাঠাই। উত্তরে মেয়েটি শুধু আপত্তি জানিয়ে মাথা নাড়লে। হেমা ভীষণ রেগে উঠে এমন কতকগুলো ভাষা প্রয়োগ করলে যা শুনে আমার কান লাল হয়ে উঠলো, আমি লজ্জায় মাথা নিচু করলাম। বোধ হয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই হেমদা বললেন– জানো ধীরাজ, মেয়েটি একটি মুসলমান চাষীর স্ত্রী। ওর বাপও একজন অবস্থাপন্ন চাষী। স্বামী মারধর করে বলেই উনি আর তার ঘর করবেন না। বললাম, বেশ, তোর বাপকে খবর দিই, তা সেখানেও যাবে না। এই মতির-মা, ঘোমটা খুলে দাও তো। পাশের আধবয়সী মেয়েটিকে হুকুম করলে হেমা।
মুচকি হেসে মতির-মা মেয়েটির ঘোমটা খুলে দিলে। বজ্রাহতের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। অপরূপ সুন্দরী মেয়ে, বড় টানাটানা চোখ, নাক মুখ যেন তুলি দিয়ে আঁকা। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ, অযত্নে কিছু মলিন দেখালেও সে যে সুন্দরী তা বুঝতে এতোটুকু কষ্ট হয় না। বয়েস সতেরো-আঠারো। নিটোল সুন্দর দেহ। অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছি। চমক ভাঙলো হেমার কথায়,–কি হে, তোমার সিনেমার হিরোয়িন করে নেবে নাকি?
বলা বাহুল্য, পুলিসের চাকরি নেবার আগে আমি যে সিনেমায় নেমেছিলাম, এ খবর এখানকার সবাই জানে। আর সে ছবি এখানেও দেখানো হয়েছে। লজ্জা পেয়ে কি জবাব দেবো ভাবছি। হেমদা বললে–জানো ধীরাজ, আজ দুপুর থেকে মেয়েটাকে কতো করে বোঝাচ্ছি। বাড়ি ফিরে যাও, এ পথ ভালো না। এমন কি এও বলেছি যে, তোর স্বামীকে কোতোয়ালিতে ডেকে এনে বেশ করে শাসিয়ে দিচ্ছি, যাতে আর ও তোর গায়ে হাত না দেয়, তা কিছুতেই শুনবে না! কে যে ওর মাথার মধ্যে ঢুকিয়েছে, খাতায় নাম লেখালে টাকাকড়ি গয়নাগাঁটি কিছুরই অভাব হবে না; রাণীর হালে থাকবে। রাণীর হালে থাকবে সত্যি, তবে যতদিন যৌবন থাকবে। তারপর একটা শক্ত অসুখে পড়লে–তখন? দেখো মতির-মা, এখনও সময় থাকতে মেয়েটাকে বোঝাও।
এবার মতির-মা বললে–বাবু, আমি কি কম বুঝিয়েছি? কিন্তু ও কিছুতেই গো ছাড়বে না।
একটু চুপ করে থেকে হেমা বললেন–সবই বুঝতে পারছি, মতির-মা। তুমিই যে ফুসলে ওকে বার করে এনেছে তাও জানি। শুধু ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে অন্য লোক দিয়ে এসব করাচ্ছে বলেই কিছু করতে পারলাম না। কিন্তু যেদিন হাতে-নাতে ধরবো, সেদিন বুঝতে পারবে।
মতির-মার পরিচয় যা পেলাম তাতে বুঝলাম এসব কাজে ও সিদ্ধহস্ত। স্থানীয় পতিতালয়ে (যার নাম রেয়াজুদ্দিন গলি, অন্য নাম ১৪নং গলি) ও বাড়িওয়ালি। হাতে বেশ পয়সাকড়ি আছে। বহু মেয়েকে লোক দিয়ে ফুসলে বার করে এনে ওর ভাড়াটে করে রেখেছে। অভিনয়েও মতির-মার পটুত্ব লক্ষ্য করলাম। হেমদার কথা শুনে হঠাৎ হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে হেমার পা দুটো জড়িয়ে রাজ্যের দিব্যি গিলে সে জানাতে চাইলে, সত্যিই সে এর মধ্যে নেই। এ ব্যাপারটায় আমিও খানিকটা অভিভূত হয়ে গেলাম। হেমদা রূঢ়ভাবে পা দুটো সরিয়ে নিয়ে ততোধিক রূঢ় কণ্ঠে বললেন–ওসব অভিনয় আমার সামনে করে না মতির-মা। যাও, ওকে নিয়ে যাও, চারদিন বাদে কোর্টে হাজির করে, নাম রেজেস্ট্রি হবে।
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম–চারদিন বাদে কেন হেমা?
বিষাক্ত হাসি হেসে হেমদ জবাব দিলে–দু’দিন হায়ার অফিসারদের মধ্যে কেউ কেউ মতির-মার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়ে মেয়েটিকে বোঝাবেন, তারপর হেড কনস্টেবল, কনস্টেবল, আর্দালি এরা সবাই বোকবে, তাতেও যদি না থোক তাহলে চতুর্থদিনে কোর্টে নাম লিখিয়ে একেবারে পাকা করে দেবে।
নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো হেমা।
শুনে কাঠ হয়ে গেলাম। এ ধরনের কথাবার্তা বা অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। চুপ করে আছি দেখে হেমা বললেন কি হে, তুমিই আগে একবার বুঝিয়ে দেখবে নাকি? বলো তো ব্যবস্থা করে দিই। আবার সেই গা জ্বালানো হাসি। আমার তখন বাকরোধ হয়ে গিয়েছে। একটু চুপ করে থেকে হেমা বললে–ধীরাজ, বাইরে থেকে লোকে শুধু আমাদের দোষত্রুটিগুলোই দেখতে পায়। কিন্তু ভাই, আমরাও মা বোন স্ত্রী কন্যা নিয়ে ঘর করি। তুমি জানো না ভাই, আজ দু’দিন ধরে মেয়েটাকে কতো বুঝিয়েছি। কখনো ভয় দেখিয়েছি, কখনো মিষ্টি কথা বলেছি। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। যাকগে, ওর নিয়তি ওকে টেনেছে কে রাখবে। বলতে বলতে হহমদার গলা ধরে এল। তাড়াতাড়ি একটা কেসফাইল টেনে নিয়ে কি লিখতে শুরু করলেন।
মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কোতোয়ালি থেকে পুলিস ক্লাবে ফিরে এলাম। সে রাত্রে অনেকক্ষণ অবধি ঘুমোতে পারলাম না। সুন্দরী ঐ কৃষক বধূটির জন্যেই কি? হবেও বা!
***
শরীরটা খারাপ ছিলো, মনটাও ভালো ছিলো না। পরদিন কোথাও বেরনো হলো না। আজ কোতোয়ালিতে যেতেই দেখি, হৈ হৈ ব্যাপার। জিলার বড় সাহেব ( এস. পি. ) মিঃ মরিস বদলি হয়ে যাচ্ছেন। তাঁর জায়গায় আসছেন জি, আর, পি’র পুলিস সুপারিন্টেডেন্ট মিঃ মুলাণ্ড। সামনের শনিবার মিঃ মরিসের বিদায় সম্বর্ধনা আর সে সম্বর্ধনার একমাত্র চিত্তবিনোদকারী হচ্ছি আমি। কিছু বলবার আগেই হেমদা বললেন–আমরা সবাই জানি, তুমি খুব ভালো ক্যারিকেচার করতে পারো, গান গাইতে পারো, আর আমাদের অনেকের চাইতে ভালো ইংরেজী কথাবার্তা কইতে পারো। কাজেই কোনো আপত্তি শুনবে না।
মনে মনে খুশি হইনি বললে মিথ্যা বলা হবে, কিন্তু মুখে বললাম–হেমা, আমি একজন সামান্য–এ, এস, আই। অতো বড় বড় সাহেবের সামনে…
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হেমদা হেসে বললেন–ওরা স্মার্টনেস খুব পছন্দ করে, এতে তোমার ভবিষ্যতে ভালোই হবে।
শনিবার বেলা তিনটা থেকেই কোতোয়ালিতে লোক আসতে শুরু হয়েছে। সাহেব-মেমের সংখ্যাই বেশি। তাছাড়া ছোটো-বড় সব পুলিসের অফিসাররাও একে একে এসে পড়লো। বেলা চারটা নাগাদ প্রকাণ্ড হলঘরে আর তিল ধারণের স্থান রইলো না; হলঘরের মাঝখানে একটা গোল টেবিল, তার উপর একটা বক্স হারমোনিয়ম। যথারীতি বিদায় সম্ভাষণের পালা শেষ হলো। তারপর আমার পালা। অফিসার-ইন-চার্জ সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আদেশ বা অনুরোধ হলো, একখানা গানের। দুরু দুরু বক্ষে হারমোনিয়মের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর শুরু করলাম অগতির গতি কাজীদার ঐ গান–কে বিদেশী।
বোধ হয়, গানটা সেদিন ভালোই গেয়েছিলাম। দেখলাম, সাহেব-মেম সব উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দিচ্ছে। শুধু মাত্র একটি লোক গম্ভীর মুখে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসে আছে। তার নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি শুধু আমারই উপর। হেমাকে জিজ্ঞেস করে জানলাম, উনিই হলেন জি. আর. পি’র নবাগত পুলিস সুপার মিঃ মুলা। আমাদের হবু হর্তাকর্তা বিধাতা।
তারপর ইংরেজী, বাংলা, হিন্দিতে অনেকগুলো কমিক স্কেচু গান আবৃত্তি করলাম। শ্রোতারা সবাই উচ্ছ্বসিত। শুধু আমাদের হর্তাকর্তা বিধাতার মুখে হাসি ফোঁটাতে পারলাম না। তাঁর মুখ ক্রমেই গম্ভীর হয়ে উঠতে লাগলো। মাঝে মাঝে পাশের দু’-একটি অফিসারকে কি যেন জিজ্ঞেস করে নিলে, তারপর আবার সেই হাঁড়ি মুখ।
পার্টি শেষ হলো। সবারই মুখে ধন্য ধন্য। আমি কিন্তু মোটই শান্তি পেলাম না। সব প্রশংসা কোলাহলের মাঝে ঐ নীল চোখ যেন আমাকে নজরবন্দী করে রেখে দিলে। হেমা এক পাশে ঠেলে নিয়ে ফিসফিস করে বললে–ধীরাজ, তোমার গান ও ক্যারিকেচার মিসেস মুলাণ্ডের খুব ভালো লেগেছে। তিনি তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান, এসো। মিসেস মুলাও অসামান্যা সুন্দরী। বয়েস কুড়ি-বাইশ বলেই মনে হয়। কাছে যেতে হাত বাড়িয়ে আমার করমর্দন করলেন। তারপর হেসে বললেন–I never expected such a brilliant talent in the Police force.
ধন্য হয়ে গেলাম। হেসে মেমসাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়ে দেখি হাঁড়িমুখো মুলাণ্ড কোঠরে ঢোকা নীল চোখ দুটো দিয়ে আমাকে যেন গিলতে চাইছে।
.
দু’দিন পরের কথা। সিনেমা দেখে ফিরছি; পথে কোনো ট্যাক্সি পেলাম না। অগত্যা হেঁটেই কোতোয়ালিতে যাবো ঠিক করলাম। উঁচু নিচু লাল সুরকির পথ, ঘুরে ঘুরে নামছি, বেশ লাগছিলো। হঠাৎ একেবারে পিছনে শুনলাম মোটর গাড়ির হর্ন। চমকে পাশে সরে গিয়েই দেখি স্টিয়ারিং-এ বসে আছেন মিসেস মুলাণ্ড। সিগারেটটা ঠোঁটে চেপেই মৃদুমধুর হেসে নিজেই দরজা খুলে দিয়ে বললেন–গেট ইন।
উঠে পাশে বসলাম। এবার আমার বিস্ময়কে চরমে পৌঁছে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন–কোথায় যাবেন? কোতোয়ালিতে? চলুন আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি, আমি ওদিক দিয়েই যাবে।
আমি নির্বাক। ভাবছি এখনো কি সিনেমা দেখছি না সত্যিই সুন্দরী মিসেস মুলাণ্ডের পাশে বসে আছি। পথ অল্প, কোতোয়ালিতে পৌঁছে গেলাম। গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়ে মিসেস মুলাণ্ড সিটের পাশ থেকে সিগারেট কেসটা বার করে নিজে একটা ধরিয়ে কেসটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি তো অবাক। আমার হতভম্ব ভাব দেখে মিসেস মুলাণ্ড তে হেসেই খুন। তারপর বললেন––Don’t you smoke?
আর আপত্তি চলে না। কেসটা হাতে নিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম তারপর ভাবলাম–কি বলি, একটা কিছু বলা তো দরকার, একটু ইতস্তত করে বললাম–It’s a nice case.
মেমসাহেব খিল খিল করে হেসে উঠলো, তারপর হাসতে হাসতে বললে–Keep it, every time you light a cigarette you will think of me. Yes?
আবার সেই দুষ্টুমিভরা হাসি। মনে মনে ভাবলাম, তোমায় আমি জীবনে ভুলবো না মেমসাহেব। মুখে শুধু বললাম–Thanks। তারপর নিজেই দরজা খুলে নেমে পড়লাম। কোতোয়ালিতে ঢুকে দেখলাম বারান্দার থামের আশে-পাশে বিস্ফারিত চোখে হেমা এবং আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ্য করছে। আমি যেন আজ উপকথার রাজপুত্রের মতো। হঠাৎ ঘুমন্ত রাজকন্যার রাজ্যে উপস্থিত হয়েছি। মনে মনে যে বেশ একটা গর্ব অনুভব করছিলাম, এটা অস্বীকার করতে পারবো না।
একসঙ্গে অজস্র প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে উঠলাম-কোথায় দেখা হলো? কি বললে মেমসাহেব? এতোক্ষণ গাড়িতে বসে কি কথা হচ্ছিলো? ইত্যাদি, ইত্যাদি। যত বলি সিনেমা থেকে ফেরবার পথে দেখা। মেমসাহেব দয়া করে আমাকে লিফট দিয়ে গেলেন। কেউ বিশ্বাস করে না, তবে একটা কথা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিলো যে, আমি অসাধারণ ভাগ্যবান এবং অতি শীঘ্রই প্রমোশন পাবো তাতে আর ভুল নেই। শুধু হোমদা সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। আমাকে একপাশে টেনে এনে বললেন–ব্যাপারটায় খুব উৎফুল্ল হবার কিছু নেই। মুলাণ্ড সাহেব অত্যন্ত বদরাগী লোক, তার ঐ সুন্দরী স্ত্রীকে নিয়ে অনেক রকম স্ক্যাণ্ডাল ও কানাঘুষো শোনা গিয়েছে। কাজেই এখন থেকে একটু সাবধান থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
এ যেন আমার হরিষে বিষাদ হলো। আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে রাত্রি প্রায় এগারোটার সময় পুলিস ক্লাবে ফিরে এলাম। এখানেও নিস্তার নেই। অত রাতেও সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে জেগে। রাখালদা একগাল হেসে বললেন–কবে খাওয়াচ্ছে ভায়া?
অবাক হবার ভান করে বললাম–মানে?
এবার যতীন বলে একটি ছেলে এগিয়ে এসে বললে–এই নিজের চোখে দেখা বুঝলে ভাই–এ আর শোনা কথা নয়। জানো রাখালদা, হঠাৎ কোতোয়ালির সামনে সাহেবের গাড়ি দেখে ভাবলাম–ব্যাপার কি? একটু দূরে থেকে উঁকি মেরে দেখি–ও বাবা, মেমসাহেব ধীরাজের গলা জড়িয়ে ধরে এক গাল হেসে কি সব বলে যাচ্ছে, কথা আর শেষই হয় না।’
কি জবাব দেব। অবাক হয়ে শুধু ভাবলাম, কোতোয়ালি থেকে এই সামান্য পথটুকু আসতেই গলা জড়িয়ে ধরেছি, এর পর আরও দূরে ঐ বদরাগী মুলাণ্ড-এর কানে যখন এই সংবাদ পৌঁছবে –তখন? ভাবতে সর্বাঙ্গ শিউরে উঠলো। খাওয়াদাওয়া শেষ করে শুতে বেশ একটু রাত হয়ে গেল। সে-রাত্রে ভালো করে ঘুমোত পারলাম না। যদিও শেষের দিকে একটু পাতলা ঘুম এল, তাও বিশ্রী স্বপ্নে ভরা। দেখলাম আমি যেন কি একটা কাজে মিঃ মুলাও-এর বাংলোয় গিয়েছি। আমার কথা শোনবার আগেই সাহেব ড্রয়ার খুলে রিভলবার বার করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি প্রাণপণে ছুটছি, আঁকাবাঁকা লাল সুরকির পথ বেয়ে ঘুরে ঘুরে নামছি, এ পথের যেন আর শেষ নেই। দু তিনবার পড়েও গেলাম। হাঁটু ছড়ে রক্ত পড়ছে, দৃকপাত নেই। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, দেখি ঘামে সমস্ত বিছানা ভিজে গিয়েছে। শুনলাম বারান্দায় হুঁকোয় তামাক খেতে খেতে রাখালদা ঠাকুরকে বলছেন–আজ ছুটির দিন, দুপুরে মুরগী রাঁধো হে ঠাকুর, আজকের ফিস্টের সব খরচ ধীরাজ ভায়ার।
***
তিন দিন পরের কথা বলছি। কোতোয়ালি থেকে সেদিন রাত্রে একটু সকাল সকাল পুলিস ক্লাবে ফিরলাম। শরীরটা ভালো লাগছিলো না। ভাবলাম, কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়বে। রাত প্রায় দশটায় রাখালদা মেসে ফিরে এসেই আমার ঘরে ঢুকে বললেন–ভায়া, কাল সকাল ঠিক আটটায় রিজার্ভ আপিসে যেও, বড় সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন।
কি এক অজানা ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। রাখালদা হেসে বললেন–না হে, ভয় পাবার মতো কিছু নয়, তোমায় পোস্টিং করবে। চেষ্টা করে, যাতে কোতোয়ালিতে থাকতে পারে অথবা কোর্টে। বাইরের কোনো থানায় দিলে তোমার বড্ড অসুবিধা হবে। শহুরে লোক, শহরে থাকবার চেষ্টাই করো।
–সেটা কি আমার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে রাখালদা।
–অনেকটা তাই। তুমিই সাহেবকে বুঝিয়ে বলতে পারবে ভোমার সুবিধা-অসুবিধার কথা। অন্য সবাই তো কথাই বলতে পারে না সাহস করে। আর বেশি কথা না বাড়িয়ে রাখালদা একটু গম্ভীরমুখেই আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরদিন সকাল আটটার আগেই হাজির হলাম রিজার্ভ আপিসে। রিজার্ভ অফিসার হরকুমারবাবু অমায়িক লেক, বয়েস প্রায় পঞ্চাশ। মাথার চুল সাদা, গোঁফ সাদা, মোটা-সোঠা বেঁটে মানুষটি, মুখে সব সময় একটি মোলায়েম হাসি লেগেই আছে। দেখলে হঠাৎ বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না যে, পুলিসে কাজ করেন। পরিচয় ছিলো না। ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়াতেই হরকুমারবাবু প্রসন্ন হাসিতে যেন আমায় আশীর্বাদ করে বললেন–আরে এসো, এসো, ধীরাজ, তোমার সম্বন্ধে আমার কৌতূহলের অন্ত নেই।
তারপর হঠাৎ একটু থেমে বললেন–তুমি বলে সম্বোধন করলাম, রাগ করোনি তত ভাই? বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট; আর তো ছ’মাস বাদেই রিটায়ার করছি।
বাধা দিয়ে বললাম–না দাদা, আপনি তুমিই বলবেন।
হরকুমারবাবু খুশি হলেন, বললেন–লোকের মুখে মুখে শুধু তোমার নাম শুনছি। গল্পে, গানে, চেহারায় তুমি নাকি একমেবাদ্বিতীয়।
স্থান কাল ভুলে হরকুমারবাবু হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলেন।
অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন সরল সদাশিব মানুষ এতদিন ধরে পুলিসের চাকরি করছেন কী করে। চমক ভাঙলো কুকুরের ডাকে। চেয়ে দেখি, সামনের ফুল বাগানের মধ্যেকার লাল সুরকির পথ বেয়ে দু’পাশে দুটো ভয়ঙ্কর এ্যালসেশিয়ান কুকুর নিয়ে, খাকি হাফপ্যান্টপরা নীলাক্ষ মুলাণ্ড কুকুর দুটোর চেন টেনে ধরে হন্ হন্ করে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছেন। মুলাণ্ডকে হাঁটতে হচ্ছে না, ঐ প্রকাণ্ড ভয়াল কুকুর দুটোই তাকে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। মনে হলো রাশ ছেড়ে দিলেই ওরা নিমেষে আমার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলবে। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম।
উঠে এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালাম। চেয়ে দেখি হরকুমারবাবুও পাংশু মুখে উঠে দাঁড়িয়েছেন। বুঝলাম সাহেব-ভীতি এদের অস্থিমজ্জাগত।
কুকুর দুটো ঘরে ঢুকেই আমাকে নতুন লোক দেখে বিকট চিৎকার করে দু’পায়ে খাড়া হয়ে উঠলো। মুলাণ্ড সাহেব অতি কষ্টে বেত উঁচিয়ে ওদের সংযত করলেন।
ঐ এ্যাটেনশন অবস্থায় দাঁড়িয়েই বললাম–Morning sir.
কালা নেটিভকে প্রতিনমস্কার করাটাও বোধ হয় মুলাণ্ডের মতো সাহেবের আভিজাত্যে বাধলো। শুধু ক্রুদ্ধ চোখে আমার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে হরকুমারবাবুকে বললেন–R. O., has he been posted anywhere?
ভয়ে ভয়ে হরকুমারবাবু জবাব দিলেন–No sir!
Let me see the file,–সাহেবের গলা গর্জন করে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বার করে একটা ধরালেন, তারপর অগ্নিবর্ষী দৃষ্টি দিয়ে আমার আপাদমস্তক আবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–Your name Dhiraj Bhattacharjee?
–Yes sir.
–You are coming from Calcutta I. B?–Yes sir.
–You were a film actor before you joined I. B! Isn’t it?
–Yes sir.
দাঁতে দাঁত চেপে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে হঠাৎ বিদ্রূপের স্বরে সাহেব বললেন–Why did you change your mind?
কি জবাব দেবো! দিলেও ঐ মুলাণ্ডের কাছে শুধু অরণ্যে রোদন ছাড়া আর কিছুই হবে না, এটা বেশ বুঝলাম। অগত্যা চুপ করেই রইলাম।
এই সময় সাহেবের আর্দালি ছুটতে ছুটতে এসে সাহেবের কুকুর দুটোকে সামনের বাগানে নিয়ে গেল। খানিকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
হরকুমারবাবু একটা মোটা ফাইল সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলেন। সাহেব পাতার পর পাতা উল্টে যাচ্ছেন আর মাঝে মাঝে হরকুমারবাবুকে কি জিজ্ঞাসা করছেন বুঝতে পারলাম না।
এইভাবে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল। ঠায় এ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমি যেন কঁসির আসামী, বিচার হয়ে গিয়েছে, শুধু জজসাহেবের হুকুমটা শুনিয়ে দেওয়ার অপেক্ষা। ফাইল ওল্টাতে ওল্টাতে শুনলাম সাহেব নিজের মনেই যেন বলছেন– Very smart I. B. man I see!
আরো মিনিট পনেরো এইভাবে কাটবার পর সাহেব বিরক্ত হয়ে সশব্দে ফাইলটা বন্ধ করে হরকুমারবাবুকে কি যেন মৃদুস্বরে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো। একটু পরে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–ব্যাপার কি দাদা?
হরকুমারবাবুর মুখে হাসি নেই। গম্ভীরভাবে ফাইলগুলো সাজাতে সাজাতে বললেন–কী জানি, সাহেবকে এরকম চটতে বড় একটা দেখিনি! তোমার উপর ওর আক্রোশই বা কেন?
উত্তরটা এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–যাবার সময় কী বলে গেলেন সাহেব?
–ফাইল টাইলগুলো কেটে নিয়ে যাবার জন্য বলে গেল– তোমায় কোথায় পোস্টিং করবে এখনও ঠিক করতে পারেনি।
উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললাম–তাহলে চলি দাদা।
কোনো জবাব না দিয়ে অর্থহীন দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন হরকুমারবাবু!
রিজার্ভ আপিস থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে পথে এসে দাঁড়ালাম।
.
সেই দিনই বিকেলে, বেলা আন্দাজ চারটে হবে, পুলিস ক্লাবে বসে চা খাচ্ছি; হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন রাখালদা। এর আগে এতে বেলাবেলি কোর্ট থেকে আসতে দেখিনি রাখালদাকে। জিজ্ঞাসা করলাম–শরীরটা ভালো নেই বুঝি রাখালদা?
কোনও উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে পাশের ঘরে চলে গেলেন রাখালদা।
কৌতূহল হলো, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাখালদার ঘরে ঢুকে পড়লাম। তখনো রাখালদা কোর্টের জামা-কাপড় ছাড়েননি। খাটের উপর বসে সামনের জানলা দিয়ে দূরের স্টেশনের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে বসে আছেন। দু তিনদিন আগে দেশ থেকে চিঠি এসেছিল রাখালদার ছেলেটির অসুখ। আশঙ্কায় মনটা দুলে উঠলো। ভাবলাম তবে কি–আস্তে আস্তে রাখালদার পাশে বসলাম। একটু ইতস্তত করে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–খবর কি খুবই খারাপ দাদা?
আমার দিকে মুখ ফেরাতেই দেখি রাখালদার চোখে জল। আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে ধরা-গলায় রাখালদা বললো ভাই, খুব খারাপ খবর। এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
কি সান্ত্বনা দেবো ভাবছি, এমন সময় ঘরে ঢুকলো যতীন, রমেশ ও ব্যানার্জি। এরা সবাই পুলিস ক্লাবের মেম্বার। দেখলাম সবারই মুখ বিষণ্ণ। খবরটা তাহলে এরাও জানে!
রমেশ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে–হায় হায়, এমন মানুষটার ভাগ্যে শেষে কিনা এই হলো?
এই অবস্থায় একটা কিছু আমার বলা দরকার। রাখালদার একখানা হাত ধরে আস্তে আস্তে সান্ত্বনার সুরে বললাম–ভেবে আর কি করবে রাখালদা! যা হয়েছে তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই, ভগবান যা–
যতীন গর্জন করে উঠলো–ভগবান? সব তাতে ঐ ছাই ফেলতে ভাঙা কুলে ভগবানকে টেনে আনবেন না ধীরাজবাবু! মানুষ অন্যায় করে দেবে দণ্ড আর সেই দণ্ড বিনা প্রতিবাদে মাথা পেতে নিয়ে শুধু আকাশের দিকে চেয়ে বলবেন–ভগবান যা করেন ভালোর জন্যই! ছিঃ
ব্যানার্জি এতোক্ষণ চুপচাপ একপাশে বসেছিলো। আমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলে–ব্যাপারটা সব শুনেছেন ধীরাজবাবু?
–না শুনিনি, তবে অনুমানে বুঝতে পেরেছি।
–কি বলুন তো?
একটু ইতস্তত করে বললাম–দেশ থেকে রাখালদার একটা খারাপ খবর–কথাটা শেষ করবার আগেই অন্তত দুঃখের মধ্যেও সবাই হো হো করে হেসে উঠলো, লজ্জায় আমি এতোটুকু হয়ে গেলাম।
রাখালদা ম্লান হেসে বললেন–হা অদৃষ্ট! সেইজন্যেই বুঝি ভগবানের দোহাই দিয়ে আমায় সান্ত্বনা দেওয়া হচ্ছিলো!
কলকাতার আই. বি-র চৌকশ ছেলে আমি আজ এদের কাছে একেবারে বেকুব বনে গেলাম। এবার সোজা জিজ্ঞাসা করলাম–ব্যাপার কি?
উত্তরটা সবাই একসঙ্গে দিতে যাচ্ছিলো। রাখালদা হাত দিয়ে থামিয়ে বললেন–মুলা তোমায় টেকনাফ থানায় বদলি করেছে।
আমি তো অবাক! আমায় সাহেব টেকনাফ থানায় বদলি করায় এদের হা-হুঁতাশ করার কি কারণ থাকতে পারে বুঝলাম না।
বুঝলাম একটু পরে। রাখালদা বললেন–জানো ধীরাজ, টেকনাফ চট্টগ্রাম থেকে স্টীমারে আড়াই দিনের পথ। ছোট্ট একটা দ্বীপ। যার পর আর বাংলাদেশ নেই। বে অব বেঙ্গলের অপর পাড়ে ওয়াল্টেয়ার আর বাংলা দেশের সীমানা ঐ দ্বীপেই শেষ হয়ে গেল। কোনোও পুলিস অফিসার ভীষণ অপরাধ না করলে ওখানে বদলি করা হয় না। ঐ সব দ্বীপেই রাজবন্দীদের অন্তরীণ করে রাখা হয়। ও দ্বীপের বাসিন্দারা হলো মগ। তাদের ভাষা বুঝতেই তো তোমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাবে।
আক্কেল আমার অমনিতেই গুম হয়ে গিয়েছিলো। এতোক্ষণে বুঝলাম রিজার্ভ আপিসে মুলাণ্ডের অদ্ভুত আচরণের অর্থ। এইবার হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলাম–The penalty of being too smart.
সেই রাত্রেই কর্তব্য ঠিক করে ফেললাম।
***
ঠিক করলাম চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে এই চট্টগ্রাম থেকেই কলকাতায় ফিরে যাবো। সকাল বেলায় কোতোয়ালিতে গিয়ে হাজির হলাম। সবার মুখ বিষণ্ণ গম্ভীর। হেমঙ্গা আমার হাত দুটো ধরে অনুতাপের সুরে বললেন,–ধীরাজ এর জন্য দায়ী আমি। কিন্তু বিশ্বাস করো ভাই, আমি তোমার ভালো করতেই চেয়েছিলাম।
বিক্ষোভটা মনের ভিতর চেপে রেখে সান্ত্বনার সুর মিশিয়ে বললাম–তোমরা কেন মিছিমিছি অনুতাপ করছছ দাদা। এ ভালোই হলো। এখানে রাখলে চাকরি আমি ছাড়তাম না এটা ঠিক। কিন্তু ঐ মগের মুলুকে? কখনোই না।
ডি. এস. পি. সদানন্দবাবু কি একটা কাজে এই সময় কোতোয়ালিতে এলেন। আমায় দেখেই বললেন–সব শুনেছি ধীরাজ। ভারি দুঃখের কথা।
হেমদা আমার রেজিগনেশন লেটারটা সদানন্দবাবুকে দেখালেন। চিঠিটা পড়ে খানিকক্ষণ গুম হয়ে থাকলেন সদানন্দবাবু। তারপর হেমাকে ডেকে নিয়ে একটু দূরে বারান্দার পশ্চিম দিকে চলে গেলেন। খানিক বাদে যখন দু’জনে ফিরে এলেন, দেখলাম দু’জনেই বেশ একটু উৎফুল্ল। হেমা বললেন,–ধীরাজ, সদানন্দবাবু বলছেন একবার আমরা শেষ চেষ্টা করে দেখি। আমি আর উনি এখনই একবার যাচ্ছি মুলা সাহেবের বাংলোয়। দেখি কি করা যায়। তুমি ততোক্ষণ কোতোয়ালিতে অপেক্ষা করে।
প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বাদে ওঁরা ফিরলেন, সঙ্গে ও. সি. চাঁদ মিঞাও আছেন। হেমদ. কোতয়ালির সিঁড়িগুলো একরকম লাফিয়ে ঘরে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর হাত থেকে রেজিগনেশন চিঠিটা নিয়ে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে ফেললেন। বুঝলাম ব্যাপার কি হয়েছে। কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। ভাবলাম সত্যিই আমি ভাগ্যবান, নইলে সামান্য একজন এ. এস. আই-এর জন্য এতো বড় বড় অফিসারদের মাথা ঘামানোর কি দরকার ছিলো।
সদানন্দবাবু বললেন–সাহেব কিছুতেই রাজী হতে চায় না। বলে এখানে থাকলে কাজ কর্ম কিছুই করবে না–খালি আড়া দিয়ে বেড়াবে–আরও কতো কি।
সদানন্দবাবুর মুখের কথা একরকম কেড়ে নিয়ে হেমা বললেন–তাতেও কিছু হতো না স্যার, যদি না ঐ সময় মেম সাহেব এলে পড়তো। আর যাই বলুন, মেম সাহেব আমাদের অসাধারণ বুদ্ধিমতী একথা বলতেই হবে। কেমন কায়দা করে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলে বলুন তো?
জিজ্ঞাসা করলাম–মেম সাহেব কি বললে হেমা?
হেমা বললে–আমরা একরকম আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। এমন সময় ঘরে ঢুকলো মেম সাহেব। নমস্কার প্রতিনমস্কারের পালা শেষ হলে জানতে চাইলে আমরা কেন এসেছি। ব্যাপারটা সব খুলে বললাম। সব শুনে বিস্ময়ে চোখ দুটো কপালে তুলে মুলাণ্ডের দিকে চেয়ে বললে–Is it a fact Johny? সাহেব কোনও জবাব না দিয়ে চুপ করে আছে দেখে মেম সাহেব বললে বরাবরই দেখেছি তুমি স্মার্ট ও বুদ্ধিমান লোকগুলোকে দু চোখে দেখতে পারো না–খোশামুদে ডাল হেডেড লোক নিয়ে কাজ করাই তোমার অভ্যাস। যারা পোপাষা কুকুরের মতো মাথা নিচু করে সব সময় হুজুর হুজুর করবে তারাই তোমার pet. কেন? আমি ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করে দেখেছি–He is very smart and intelligent. তাকে তুমি posting করেছে। টেকনাফে? অল রাইট! It is your affair Johny, do, whatever you think best. হাত ঘড়িটা দেখে মেম সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে বললে– চলি, আমার রাইডিং-এর সময় হয়ে গিয়েছে–বাই বাই! দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে দাঁড়ালো মেম সাহেব, তারপর সাহেবকে বললে–এতোগুলো অফিসার এসেছেন তোমায় request করতে, আমি হলে এদের কখনই নিরাশ করতাম না। নাটকীয় ভঙ্গিতে মেম সাহেব প্রস্থান করলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ। কেউ আর কথা বলে না। তারপর সদানন্দবাবু বললেন–এক কাজ করুন স্যার, অন্তত মাস তিনেকের জন্য ওকে টাউনের কোথাও posting করে দিন, আপনারও চোখের উপর থাকবে, আমরাও নজর রাখবো-কাজ কর্ম ভালোভাবে করে ভালোই, নইলে যেখানে খুশি বদলি করে দিলেই হবে।
মুলাণ্ড উঠে দাঁড়িয়ে বললে–অল রাইট! তোমরা যখন সবাই বলছে তখন তাই হবে। আগের order cancel করে কাল সকালেই আমি নতুন অর্ডার দিয়ে দেবো।
বেলা অনেক হয়ে গিয়েছিলো, সদানন্দবাবু বললেন–চলো। ধীরাজ, তোমাকে পুলিস ক্লাবে নামিয়ে দিয়ে যাই। আসবার সময় হেমদা ইশারা করে কাছে ডেকে চুপি চুপি বললে–এই তিনটে মাস একটু সাবধানে থাকিস ভাই-মেম সাহেবের সঙ্গে প্রেম ট্রেম…। কথা শেষ করতে দিলাম না–মান হেসে তাড়াতাড়ি সদানন্দবাবুর গাড়িতে উঠে বসলাম।
পুলিস ক্লাবে এসে দেখি সবাই আপিসে চলে গিয়েছে। সুখবরটা রাখালদাদের জানাতে না পেরে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগলো। খাওয়া দাওয়া করে শুলাম। ঘুমোতে পারলাম না, উঠে পড়লাম। বেলটা চারটে আন্দাজ বেরিয়ে পড়লাম। কোথায় যাই–ভাবলাম স্টেশনের দিকে যাই–সাড়ে চারটের সময় চাঁদপুরের গাড়ি আসে, হয় তো চেনা লোক দু-একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। আজ একা থাকতে ভালো লাগছিলো না। উদ্দেশ্যহীনভাবে platform-এ পায়চারি করতে শুরু করে দিলাম। চাঁদপুরের গাড়ি এল, অগুন্তি লোক নামলো, চেনা একটিও না। মিনিট পনেরো বাদে দেখলাম platform প্রায় খালি হয়ে গিয়েছে। এক পা দু পা করে খালি platform-এর পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করে দিলাম। অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হুশ হলো। দেখি, European Quarters-এর কাছে এসে পড়েছি। সামনে ছোট্ট একটা পার্ক, কিছু দূরে দূরে লোহার বেঞ্চি পাতা তারই একটিতে বসে পড়লাম। দূরে পড়ন্ত রোদের লাল আভা কৃষ্ণচূড়ার লাল মাথা আরও রাঙিয়ে দিয়েছে–মুগ্ধ তন্ময় হয়ে তাই দেখছি। কতোক্ষণ এইভাবে ছিলাম মনে নেই, হঠাৎ চমকে উঠলাম। দেখি, আপাদমস্তক কালো লোমে ঢাকা ছোট্ট একটা জাপানি ল্যাপ ডগ এরই মধ্যে কখন বুকের ওপর উঠে বসে দুটো পা দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে লোমের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট কুকুতে চোখ দুটো দিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আছে। আতঙ্কে ও উৎকণ্ঠায় উঠে দাঁড়িয়েছিলাম–পিছনে চোখ পড়তেই দেখি, অপরূপ সজ্জায় হাত দুই দূরে দাঁড়িয়ে আমার এই অসহায় অবস্থাটা পরম কৌতুকের সঙ্গে উপভোগ করছে মোহময়ী মিসেস মুলা! মনে মনে প্রমাণ গুণলাম। বাংলার প্রসিদ্ধ প্রবাদ বাক্যটি মনে পড়লো–যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। কুকুরটাকে টেনে ছুঁড়ে ফেলে দেবব কিনা ভাবছি–বিদ্রোহী মন তখনই চোখ রাঙিয়ে উঠলো বুঝলাম সেটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না–আমার চেয়ে ঐ pet কুকুরটার মূল্য যে অনেক বেশি সেটা বুঝতেও দেরি হলো না! অগত্যা জোর করে মুখে হাসি এনে ঐ লোমের জঙ্গলে হাত বুলিয়ে কুকুরটাকে আদর করতে শুরু করে দিলাম। দেখি মেম সাহেব একেবারে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসিমুখে ডান হাতখানা আমার দিকে বাড়িয়ে মেম সাহেব বললে–গ্ল্যাড?
হকচকিয়ে গেলাম। ভাবলাম-কুকুরটাকে বুকের ওপর আদর করতে পেয়ে গ্ল্যাড না মেম সাহেবের সুপারিশে টেকনাফ যাওয়া বন্ধ হয়েছে বলে গ্ল্যাড–কোনটা? আস্তে আস্তে কুকুরটাকে সবুজ ঘাসে ভর লনটার উপর নামিয়ে দিতেই সে ছুটে দূরের বেঞ্চিটার ওপর লাফিয়ে উঠে বসলো। দুরু দুরু বক্ষে হাসিমুখে মেম সাহেবের প্রসারিত হাতখানা দু’হাতে চেপে ধরে বললাম–তোমার ঋণ আমি জীবনে শোধ করতে পারবো না মিসেস মুলা।
কপট তিরস্কারের ভঙ্গিতে মেম সাহেব বললে–সিলি। তোমাদের–মানে ইণ্ডিয়ানদের দেখেছি একটুতেই sentimental হয়ে পড়ে। সিট ডাউন।
দু’জনে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে পড়লাম। দেখি, আমার হাতখানা তখনও মেম সাহেব ধরে আছে–ছাড়িয়ে নিতে সাহস হলো না।
একটু চুপ করে থেকে–দূরে দৃষ্টি মেলে মেম সাহেব যেন নিজের মনেই বলে চললো–বরাবরই ‘জনি’ হেড স্টং ও জেলাস–ইদানীং আরো বেড়ে গিয়েছে। সুন্দর ও স্মার্ট কোনও ছেলের সঙ্গে আমায় কথা বলতে দেখলেই ও রাগে একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড করে বসে তুমি জানো না ভটচাষ কি করে সব দিক মানিয়ে আমায় চলতে 5! You can’t imagine how unhappy I am. perts শেষে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো।
অবাক হয়ে শুধু ভাবলাম–এ সব ঘরোয়া কথা মেম সাহেব আমাকে শোনাচ্ছে কেন? কি জবাব দেবো, চুপ করে বসে আঁমতে লাগলাম।
একটু পরে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে মেম সাহেব বললে ভটচাষ, ডু ইউ বিলিভ ইন লভ? ভালোবাসার অস্তিত্বে তোমার বিশ্বাস আছে?
এ কী প্রশ্ন! ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গেলাম। দেখি, উত্তরের আশায় মেম সাহেব মুখের দিকে চেয়ে আছে। কি বলি? আমতা আমতা করে বললাম–সিওর!
হঠাৎ হাসিতে ফেটে পড়লো মেম সাহেব–যেন উন্মাদের হাসি–থামতেই চায় না। লজ্জায় লাল হয়ে ভাবলাম–কী এমন হাসির কথা বলেছি! যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিলো তেমনি হঠাৎ থেমে গেল হাসি। গম্ভীর হয়ে মেম সাহেব বললে–তুমি বিশ্বাস করতে পারে। দু’বছর আগে ঐ মুলাণ্ডের জন্য আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম–এক ঘণ্টা না দেখতে পেলে পৃথিবী অন্ধকার মনে হতো? ভাবতাম, এই হলো সত্যিকার লভ। ভুল, ভুল, মন্ত ভুল। ভালোবাসা বলে কিছু নেই। মুলাণ্ডের আগে আরো চার জনের প্রেমে পড়েছিলাম-প্রত্যেকবারই মনে হতো এই সত্যি, এইটেই খাঁটি ভালোবাসা–!
মেম সাহেবের হাতের মুঠোর মধ্যে হাতখানা ঘেমে উঠেছে–নিরুপায়, চুপ করে বসে রইলাম। মেম সাহেব বলে চললো–আক্ত ওদের দেখলে হাসি পায়–একদিন ওদের জন্য পাগল হয়ে ছিলাম মনে হলে নিজের ওপর রাগ হয়। আর Johny! You don’t know young man, how I hate him! How I hate him!
মিসেস মুলাণ্ডের চরিত্রের এ দিকটা একেবারে অজানা ছিলো–বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে চুপ করে রইলাম।
একটু পরে হাসিমুখে আমার দিকে চেয়ে মেম সাহেব বললে– Do you know Bhattacharjee, I like you? gfa orica থাকলে আমি খুশিই হবে। But love! oh never, never. ভালোবাসাটা মিথ্যে কথা–ভালোলাগাটাই সত্যি! হঠাৎ চেঁচিয়ে মেম সাহেব ডাকলো–গ্রেটা!
স্বপ্ন ভেঙে গেল–দেখি, সন্ধ্যার অন্ধকারে মিশে গিয়ে কুকুরটা লাফিয়ে উঠেছে মেম সাহেবের কোলে-আদরে চুমুতে আচ্ছন্ন করে ছেড়ে দিতেই সে লাফিয়ে আমার কোলে এসে বসলো তারপর আস্তে আস্তে আমার ডান পাশে সরে গিয়ে সামনের পা দুটো তুলে মুখটা আমার কোলে রেখে দিব্যি আরামে শুয়ে পড়লো। হঠাৎ আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত বাড়িয়ে কুকুরটাকে আদর করতে শুরু করলো মেম সাহেব–ইউ নটি গ্রেটা, হাউ ডু ইউ নো আই লাইক হিম? মুখে মদের গন্ধ পেলাম। মেম সাহেবের এত উচ্ছ্বাসের কারণ খানিকটা বুঝতে পারলাম।
আদর আর শেষ হয় না। আমি যে রক্তমাংস দিয়ে গড়া একটা মানুষ–মনে হলো সে কথা একদম ভুলে গিয়েছে মেম সাহেব। আমি যেন জড়পিণ্ড, নয় তো ঐ লোহার বেঞ্চের একটা অংশ। কতোক্ষণ এইভাবে বসেছিলাম জ্ঞান নেই-হঠাৎ দু’জনে চমকে উঠলাম–দেখি একেবারে কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুলাণ্ড। তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে বুকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো মেম সাহেব। চাপা গম্ভীর statu aro 1969-It is past eight o’clock Milly! Everybody is waiting for you.
Oh, sorry dear,–বলে কোনোদিকে না চেয়েই চলে গেল মেম সাহেব। শুধু মুলাণ্ড যাবার আগে একটা দৃষ্টি দিয়ে আমার আপাদমস্তক দেখে চলে গেল। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও সে দৃষ্টির অর্থ বুঝতে কষ্ট হলো না।
এতো দুঃখেও হাসি পেলে আমার। ভাবলাম, ভাগ্য ছাড়া পথ নেই। বিধাতা অলক্ষ্যে দাবার ছকে যে ঘুটি সাজিয়ে রেখেছেন– তার বাইরে চাল দেবার সাধ্য কারও নেই।
পুলিস ক্লাবে যখন ফিরলাম–তখন রাত দশটা বেজে গিয়েছে। রাখালদা বললেন–কোথায় ছিলে ধীরাজ! কোতোয়ালি থেকে হেমবাবু তোমায় দু’বার ডাকতে পাঠিয়েছেন–বলেছেন যতো রাত্রি হোক একবার তার সঙ্গে দেখা করতে। কোনও কথা না বলে কোতোয়ালিতে চলে এলাম। দেখি, অতো রাতেও সদানন্দবাবু, চাঁদ মিঞা, হেদা আরও দু’ তিনজন অজানা অফিসার বসে আছেন। কেমন একটা গম্ভীর নিস্তব্ধ ভাব। চুপ করে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সদানন্দবাবু বললেন–বসো ধীরাজ। কাঠের পুতুলের মতো একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
ও. সি. চাঁদ মিঞা বললেন–হঠাৎ ঘণ্টা দেড়েক আগে আর্দালি দিয়ে বড় সাহেব লিখে জানিয়েছেন–তোমাকে টেকনাফেই বদলি করা হলো। এখানে রাখা হবে না। হঠাৎ কেন যে সাহেবের মত পরিবর্তন হলো বুঝতে পারলাম না।
আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম–মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আজকের সন্ধ্যার ঘটনা কাউকে বলব না। চুপ করে রইলাম।
হঠাৎ হেমা টেবিলে একটা প্রকাণ্ড চাপড় মেরে বলে উঠলেন–চাষা, হাল চাষা। ব্যাটা বিলেতে নির্ঘাৎ লাঙ্গল চষত। সুপারিশের জোরে বড় সাহেব হয়ে এখানে এসেছে।
সদানন্দবাবু সায় দিয়ে বললেন–সামান্য ভদ্রতাটুকু জানে না! আমাদের কথা দিয়ে তা রাখলো না?
বাধা দিয়ে হেমা বললেন,–হ্যাঁ, রাখবে! মিসেস মুলাও পর্যন্ত কত অনুরোধ করলে তাই বড় রাখলে। আমার কি মনে হয় জানেন স্যার? ব্যাটা নিশ্চয় নপুংসক। তাই ওর দ্বিতীয় রিপুটা এতো প্রবল।
চাঁদ মিঞা এতোক্ষণ একটা কথাও বলেননি। হাত তুলে হেমদাকে বাধা দিয়ে বললেন–ভুলে যেও না হেম, এটা কোতোয়ালি থানা আর ঐ মুলা হচ্ছে আমাদের ওপরওয়ালা। এসব আলোচনা আপিসের বাইরে বসে করাই নিরাপদ।
সদানন্দবাবু সায় দিয়ে বললেন–হেম একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। যাক, আসল কথায় আসা যাক, কি করবে ধীরাজ?
মৃদুকণ্ঠে বললাম–আমার জন্যে কেন আপনারা এতো অপমান সহ্য করছেন স্যার? আমি তো আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম চাকরি করবো না।
কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথাই বললেন না।
সদানন্দবাবু আমাকে কাছে ডেকে এনে বসালেন। তারপর শান্ত স্বরে বললেন,-ধীরাজ, তুমি ছেলেমানুষ তাই একটুতেই মাথা গরম হয়ে ওঠে। আমি তোমার বাপের বয়সী। আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোনন। কক্সবাজারের নাম শুনেছে?
ঘাড় নেড়ে জানালাম শুনেছি।
–কক্সবাজার খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা। অনেক দূর দেশ থেকে লোকে ওখানে হাওয়া বদলাতে আসে। কিন্তু টেকনাফ তার চেয়েও স্বাস্থ্যকর জায়গা।
বিস্মিত হয়ে সদানন্দবাবুর মুখের দিকে চাইলাম। সদানন্দবাব হেসে বললেন–হ্যাঁ, আমি নিজে গিয়েছি সেখানে। চমৎকার জায়গা। জিনিসপত্রের জলের দামে পাওয়া যায়। তোমার একমাত্র অসুবিধে হবে সঙ্গীর। তা তুমি যে রকম আলাপী তাতে বেশিদিন সে অভাবও থাকবে না। আর মগের ভাষা? কিছুদিনের মধ্যেই শিখে নিতে পারবে।
চুপ করে রইলাম।
হেমদা বললেন–স্যার ঠিক কথাই বলেছেন। তুমি চলে যাও টেকনাফে। কাজকর্ম কিছু নেই, খালি মজা করে খাও ঘুমোও আর চোখভরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখো।
সদানন্দবাবু বললেন,-চিটাগাং শহর দেখে যদি তোমার ভালো লেগে থাকে, টেকনাফ দেখলে মনে হবে সেটা স্বয়ং বিশ্বকর্মার হাতের তৈরি আর এটা মানুষের গড়া।
চাকরিতে ইস্তফা দেবার ইচ্ছাটা পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মনে মনে তাহারই আলোচনা করছি এমন সময় শুনলাম সদানন্দবাবু বলছেন–ধীরাজ, একটা সরকারি চাকরি যোগাড় করতে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। কিন্তু ছাড়তে লাগে এক মিনিট। যদি সেখানে তোমার ভালো না লাগে, ছেড়ে দিও। তবু সরকারের পয়সায় অমন একটা জায়গা ঘুরে আসা, সেটাও কি কম লাভ?
মন স্থির করে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম–আমি যাবো স্যার।
আর কেউ কিছু বলবার আগেই কোতোয়ালি থেকে বেরিয়ে সটান পুলিশ ক্লাবে চলে এলাম।
.
সেদিন আর কোথাও বার হইনি, কারও সঙ্গে কথাবার্তাও বললাম না। হাতে মাত্র আর একটি দিন সময় পরশুদিন বেলা ন’টার স্টীমারে আমায় টেকনাফ রওনা হতে হবে, মুলাণ্ডের আদেশ। সে আদেশের নড়চড় হবার জো নেই। রাজ্যের অভিমান জড়ো হলো বাবা আর মায়ের উপর। বেশ ছিলাম কলকাতায়; এতোদিন ছবিতে আমার নাম, প্রতিপত্তি, পয়সা কোনোটারই অভাব থাকতো না। তা নয় দিলে জোর করে পুলিসে ঢুকিয়ে। বেদের মতো আজ এ-দেশ কাল ও-দেশ করে হয়রান হয়ে মরছি। চিঠির কাগজ টেনে নিয়ে বাবাকে চিঠি লিখতে বসলাম, লিখলাম–
শ্রীচরণকমলেষু–
এখানে আসিয়া আপনাকে পত্ৰ দিয়াছিলাম। তাহাতে লিখিয়াছিলাম চট্টগ্রাম আমার খুব ভালো লাগিয়াছে। বোধহয় কোতোয়ালিতেই আমাকে বহাল করিবে, কিন্তু ভাগ্যদোষে সব উলটপালট হইয়া গিয়াছে। আগেকার এস. পি. এখান হইতে বদলি হইয়া গেলেন। তাঁহার স্থলে অন্য একজন আসিলেন। এই উপলক্ষ্যে সেদিন কোতোয়ালি থানায় একটি বিদায়-সভার আয়োজন করা হয়। সবাই মিলিয়া আমাকে সেই সভায় গান ও আবৃত্তি করিতে অনুরোধ করেন। সাহেবদের সুনজরে পড়ার এমন সুযোগ ছাড়া বুদ্ধিমানের কাজ হইবে না মনে করিয়া আমি সানন্দে রাজী হইয়াছিলাম; কিন্তু ফল হইল অন্যরূপ। নূতন সাহেব আমাকে কিছুতেই শহরে রাখিতে রাজী হইল না। এখানকার বহু বিজ্ঞ অফিসার আমাকে এখানে রাখিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিলেন, কিন্তু সাহেব কিছুতেই রাজী হইল না। তাহার এক কথা–এখানে থাকিলে আমি কাজকর্ম কিছুই করিব না, শুধু আমোদ আহ্লাদ করিয়া বেড়াইব। এই যুক্তি দেখাইয়া সাহেব আমাকে সুদূর টেকনাফে বদলি করিয়াছে। পরশু এখান হইতে রওনা হইব।
এখানকার লোকমুখে যাহা শুনিলাম, তাহাতে বুঝিলাম টেকনাফ অতি ভয়ঙ্কর জায়গা। এখান হইতে স্টীমারে মাইতে আড়াই দিনের বেশি লাগে। বঙ্গোপসাগরের পারে ছোট্ট একটি দ্বীপ, তাহার বাসিন্দারা সব মগ, তাহাদের ভাষা বোঝা যায় না। কলিকাতা হইতে চিঠি যাইতে চৌদ্দ পনর দিন লাগে। টেলিগ্রাম যায় সাত দিনে। বছরের সাত মাস এই দ্বীপটার সঙ্গে বাইরের জগতের কোন সংশ্রব থাকে না। শুধু শীতকালে যখন সমুদ্র একটু শান্ত থাকে, তখন চট্টগ্রাম হইতে সপ্তাহে একদিন স্টীমার যায় ও আসে। ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের ঐ দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়। ওখান হইতে অধিকাংশই আর ফিরিয়া আসে না। এখানকার অনেকেই আমাকে নিষেধ করিতেছেন। প্রথমে ভাবিয়াছিলাম যাইব না, কিন্তু অনেক ভাবিয়া শেষ পর্যন্ত যাওয়াই স্থির করিলাম। চাকরিতে ইস্তফা দিয়া কলিকাতায় গেলে আপনারা ভাববেন, ফিল্ম-এ অভিনয় করিবার জন্য একটা মিথ্যা ছল করিয়া আমি চাকরি ছাড়িয়াছি।
আশা করি এইবার আপনারা নিশ্চিন্ত ও আনন্দিত হইবেন, কারণ ওখান হইতে ফিরিবার সম্ভাবনা আমার খুব কম আর ইচ্ছাও নাই। জীবনে আমার বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছে। আর অধিক লিখিয়া আপনাদের ধৈর্য নষ্ট করিব না। অজ্ঞাতে শ্রীচরণে যদি কোনও অপরাধ করিয়া থাকি মার্জনা করিবেন। আপনি ও মা আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম জানিবেন, ছোটভাই বোনকে আমার আশীর্বাদ দিবেন। ইতি–প্রণত সেবকাধম ধীরু।
নিজের হাতে চিঠিটা স্টেশনের ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে এসে মন অনেকটা হাল্কা হলো।
***