• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

শ্রেষ্ঠ গল্প – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় 

লাইব্রেরি » বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় » শ্রেষ্ঠ গল্প – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় 
শ্রেষ্ঠ গল্প - বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় 

শ্রেষ্ঠ গল্প – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় 

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প 

অধ্যাপক জগদীশ ভট্টাচার্য সম্পাদিত 

প্রথম প্রকাশ : আষাঢ় ১৩৫৫ 

গল্পগুলির নির্বাচনে 
বন্ধুবর শ্রীযুক্ত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অনেকখানি হাত আছে, 
সেই কথা স্মরণ করে বইখানি তাঁকেই দিলাম। 

ব. ভ: ম. 

.

ভূমিকা 

সাহিত্যক্ষেত্রে শ্রীবিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯১৫-১৬ সালে। পৃথিবী জুড়ে তখন প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বাজছে। বাংলা সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রাদিত্যের এক পার্শ্বে ‘বীরবল’ আরেক পার্শ্বে শরৎচন্দ্র নিজ-নিজ দীপ্তিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। বঙ্গভারতীর সেই পরম ঐশ্বর্যের দিনে প্রথম প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই তরুণ বিভূতিভূষণ সারস্বত সমাজের মাল্যচন্দন লাভে ধন্য হয়েছিলেন। তূর্যধ্বনিতে দিগদিগন্ত মুখরিত করে তিনি আবির্ভূত হননি; স্নিগ্ধ সরসতায় পরিচিত পরিবেশকে সুমধুর করে তাঁর প্রতিভা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখনী যেমন মধুক্ষরা, তাঁর সৃষ্টিও তেমনি অফুরন্ত। কিন্তু, ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে, প্রথম প্রকাশের পর সুদীর্ঘ একুশ-বাইশ বৎসর অতিক্রান্ত না হবার পূর্বে তিনি গ্রন্থাকারে কোনও রচনা প্রকাশ করেননি। 

বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প-সংকলন ‘রাণুর প্রথম ভাগ’ প্রকাশিত হয় ১৩৪৪ সালে। দীর্ঘবিলম্বিত প্রস্তুতি-পর্ব সমাপ্ত করে তিনি সেদিন থেকেই সাহিত্যরচনায় পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করলেন। সত্যি কথা বলতে গেলে, রাণুর গল্পমালাতেই তাঁর স্বকীয় প্রতিভার পরিচয় সুপরিস্ফুট হয়ে উঠল। ‘রাণুর প্রথম ভাগে’র মুখবন্ধে তিনি বলেছেন, “মাটি আর মন লইয়াই দেশ। বাংলাদেশের মাটি বড় ভিজা এবং মন বড় অশ্রুসিক্ত। আশার কথা মাটি আর বেশি দিন ভিজা থাকিবে না; নদী, খাল, বিল সব জাহান্নমে চলিয়াছে। মনের দিকটা!—যদি একদণ্ড অশ্রুর ধারা বন্ধ করা যায়, সেই জন্যই এই আয়োজনটুকু।” এই সংক্ষিপ্ত বক্রোক্তির মধ্যেই বিভূতিভূষণের শিল্পীমন নিজেকে প্রকাশ করেছে। ‘রাণুর দ্বিতীয় ভাগে’র মুখবন্ধে বক্তব্যকে আরেকটু বিশদ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘দেশের সমস্যামন্থর হাওয়াটাকে একটু হালকা করা’ই তাঁর লেখার ‘মিশন’। বস্তুত এখানেই বিভূতিভূষণের বৈশিষ্ট্য। অসংখ্য সমস্যাভরে জর্জরিত জীবনের জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে এর চিরন্তন রসপ্রবাহের উৎসসন্ধানই তাঁর শিল্পীমানসের মুখ্য ধর্ম। যুগের দাবিতে জীবন-সমুদ্র যেখানে বিক্ষুব্ধ সেখানে তাঁর স্থান নয়। মর্তের চিরপ্রবহমান জীবন-নির্ঝরিণীর তটপ্রান্তে বসে তিনি রসামৃতের সাধনায় তন্ময়। ‘ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা ছোট ছোট দুঃখকথা’র মধ্য দিয়ে জীবনের যেসব অশ্রু-হাসির কাহিনি নিতান্তই সহজ সরল হয়ে প্রকাশিত হচ্ছে, তার মধ্যেই তিনি অফুরন্ত রসের ভাণ্ডার নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। আমাদের অতি-পরিচিত ঘরোয়া পরিবেশে শাশুড়ি-বউ, ননদ-ভাজ, কর্তা-গিন্নি, নাতি-ঠাকুমার পরিহাস-রসিকতার মধ্যে যে অন্তঃপুরচারী রস অবগুণ্ঠিত, পারিবারিক শাসন-শৃঙ্খলা ও বিধিনিষেধের মধ্যেও যে চিরন্তন কিশোর-কিশোরীর পূর্বরাগ-অনুরাগ, অভিসার মিলন-লীলা অব্যাহত, তাসের মজলিসি আড্ডায় বন্ধুদের গালগল্পের মধ্যে সম্ভব—অসম্ভবের সীমানা পেরিয়েও যে জীবনরস উচ্ছ্বলিত, বিভূতিভূষণের সাহিত্যে প্রধানত সেই রসেরই পরিবেশন। অবশ্য ‘রাণুর প্রথম ভাগ’ প্রকাশের পরও বহু বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে বিভূতিভূষণের জীবনপরিক্রমা বৃহত্তর ক্ষেত্রে প্রসারলাভ করেছে। ‘দৈনন্দিন’ ঘরোয়া কথা শেষ করে ‘বর্ষায়’, ‘বসন্তে’ তিনি চিরপুরাতন বিরহ-মিলনের কাহিনি রচনা করেছেন, শারদীয়া-হৈমন্ত-চৈতালির বিচিত্র সুরের সঙ্গে সংগত করে জীবনের বীণায় কড়ি ও কোমনে নানান সুরের আলাপ করেছেন; চিরকেলে সুখদুঃখ যেমন এসেছে, তেমনি আবার চলতি কালের সমস্যাকেও একেবারে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি; ‘কলিকাতা-নোয়াখালি-বিহারে’র কথাও তাঁকে বলতে হয়েছে। কাজেই কেবল সহজ সুরে সহজ কথাই নয়, গভীর সুরে গভীর কথাও আমরা তাঁর কাছে শুনেছি। জীবন সম্পর্কে রসিকচিত্তের চিরন্তন ‘প্রশ্ন’কেও যেমন তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি, তেমনি বিহারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিধ্বস্ত জীবনের পটভূমিকায় এযুগের ভারতবর্ষের সবচেয়ে জটিল হিংসা-অহিংসার সমস্যাও তাঁর রচনাকে আলোড়িত করে তুলেছে। 

শুধু বহুবিচিত্র ছোটগল্পেই নয়, উপন্যাসের বৃহত্তর পরিধিতে জীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপের প্রতিফলনেও তাঁর সৃজনীশক্তির নব-নব পরিচয় রসগ্রাহী পাঠকসমাজকে পরিতৃপ্ত করছে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নীলাঙ্গুরীয়’ প্রকাশিত হয় ১৯৪২ সালে। আমাদের প্রেমোপাখ্যান-প্লাবিত কথা-সাহিত্যে তরুণ-তরুণীর হৃদয়-বিনিময়ের বিষণ্ণ—মধুর রহস্য-গভীরতায় বিভূতিভূষণেরও যে নতুন কথা বলার আছে তারই উজ্জ্বল স্বীকৃতি ‘নীলাঙ্গুরীয়’। তারপর ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’, ‘নব-সন্ন্যাস’ ও ‘তোমরাই ভরসা’ প্রভৃতি উপন্যাসে লেখকের বৃহত্তর জীবন-পরিক্রমা বিচিত্র রূপে ও রসে বাংলা কথাশিল্পকে সমৃদ্ধতর করে তুলেছে। কিন্তু ‘স্বর্গাদপি গরীয়সী’ জননীদের কথাতেই হোক, আর জন্মভূমির উদ্ধারব্রতে ‘নব-সন্ন্যাস’-ধর্মে দীক্ষিত বীর সন্তানদের কাহিনিতেই হোক, ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ মুখ্যত হৃদয়-বেদনারই শিল্পী। স্বভাবতই উপন্যাসের বিপুল আয়তনে সংঘাতমুখর জীবন প্রবাহের তরঙ্গশীর্ষে চিরপ্রবহমান নরনারীর জটিল কাহিনিবিন্যাসে কথাশিল্পীর নব-নবায়মান শক্তিমত্তার পরিচয় স্ফুরিত হয়েছে; কিন্তু বিভূতিভূষণের ছোটগল্প আর বিভূতিভূষণের উপন্যাস পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক হয়েই তাঁর শিল্পীমানস ও সৃজনীশক্তির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় উন্মীলিত করছে। 

তবে বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণের প্রাথমিক প্রতিষ্ঠা মুখ্যত হাস্যরসিক হিসেবেই। এবং সেখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠ পরিচয়। হাস্যরসিক কথাটি অবশ্য বড় ব্যাপক এবং ব্যাপক বলেই অস্পষ্ট। আমাদের সাহিত্যে স্থূল এবং অশ্লীল ভাঁড়ামো থেকে অতি-সূক্ষ্ম রসিকতাও হাস্যরসের এলাকাভুক্ত। বিভূতিভূষণের হাস্যরসাত্মক গল্পেরও প্রকারভেদ আছে। তামাশা, কৌতুক ও রঙ্গরস থেকে অতি উচ্চাঙ্গের রসিকতা পৰ্যন্ত বিভিন্ন স্তর ও পর্যায়ের হাসি তিনি দু-হাতে ছড়িয়ে চলেছেন। কিন্তু হাস্যরসিক হিসেবে তাঁর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তাঁর হাসি যেমন সংযত ও সুন্দর, তেমনি তা নির্দোষ ও নির্মল। তা কখনওই ব্যক্তিগত অসূয়া বা বিদ্বেষপ্রসূত নয়, এবং সেজন্যই তাতে কুটিল শ্লেষ বা তীব্র ব্যঙ্গের কশাঘাত থাকে না। পক্ষান্তরে সে হাসি কোনও বিশেষ চপল মুহূর্ত বা কৌতুককর ঘটনা-সংস্থানের ওপরও সর্বদা নির্ভর করে না। জীবন ও জগৎ সম্বন্ধে গভীর অন্তর্দৃষ্টির ফলেই সে হাসির উদ্ভব। গভীরতর বেদনাবোধের মধ্যেই তার সৃষ্টি, সুতরাং চেতনার মর্মমূলেই তার প্রতিষ্ঠা। নীলকণ্ঠের স্ফুরিত ওষ্ঠাধরের স্মিতহাসির সঙ্গেই বুঝি তার তুলনা দেওয়া চলে। 

বক্তব্য বিশদতর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে। বিভূতিভূষণের ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণ করলে তাতে তিনটি মহল খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষ বিভূতিভূষণ, দার্শনিক বিভূতিভূষণ ও শিল্পী বিভূতিভূষণ। মানুষ বিভূতিভূষণ সূক্ষ্ম-অনুভূতিশীল রসিকচিত্তের অধিকারী। জীবনে গভীর রহস্য প্রধানত বেদনার মধ্য দিয়েই তাঁর কাছে ধরা পড়েছে। মর্মবিদারী সে বেদনার অশ্রুতে তাঁর হৃদয় কানায় কানায় পূর্ণ। ব্যক্তিগত জীবনে এই ট্রাজিক পরিণামে আশাহত বিভ্রান্ত মানুষের কণ্ঠে আর্তনাদই শুধু শুনতে পাওয়া যায়—

Life’s but a walking shadow; a poor player
That struts and frets his hour upon the stage, 
And then is heard no more; it is a tale 
Told by an idiot full of sound and fury, 
Signifying nothing. 

জীবনের রঙ্গমঞ্চে কিছুক্ষণের জন্যে বৃথা আস্ফালন নির্বোধের অর্থহীন কাহিনি তো বটেই, কিন্তু যে স্বয়ং সেই অর্থহীন কাহিনির একজন অসহায় অভিনেতা, সে যখন তার নিজের জীবনের চরম সর্বনাশের মুখে এই নিষ্ঠুর সত্য উপলব্ধি করে তখন তার পক্ষে সেটা মর্মান্তিক হাহাকারেই পর্যবসিত হয়। কিন্তু যে একটু দূরে দাঁড়িয়ে, তটস্থ হয়ে, নির্লিপ্ত মন নিয়ে এই জীবলীলা প্রত্যক্ষ করতে পারে, সে বলে—

মাটির ঢেলা, মাটির ঢেলা, 
রঙ দিল কে তোর গায়ে? 
গড়লে তোরে কোন্ আদলের ছাঁচে? 
ভুখ দিলে যে বুক দিলে যে 
মুখ দিতে সে ভুলল না, 
মৃত্যু দিলে লেলিয়ে পাছে পাছে। 
কোন্ মেলাতে সাজিয়ে দিলে 
বিকিয়ে দিলে কার হাতে? 
কোন্ খেয়ালির খেলেনা তুই হায় রে! 
কোলের পরে দুলিস্ কভু 
মাটির পরে যাস্ প’ড়ে— 
মলিন ধূলা লাগে সকল গায় রে! 

এই তো দার্শনিকের দৃষ্টি! এই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে গেলে মানুষের সুখদুঃখ, হাসিকান্নার লীলা তো কোন খেয়ালির পুতুল নিয়ে খেলারই সমকক্ষ। আর শেষ পর্যন্ত যা পুতুল খেলার অধিক কিছুই নয়, তা নিয়ে মানুষের এত আসক্তি, এত অশ্রুপাত, এত উল্লাস;—দুনিয়ায় এর চেয়ে বড় হাসির জিনিস আর কী আছে? বিভূতিভূষণের আছে এই দৃষ্টি, এই দার্শনিক মন। সেজন্যেই তাঁর মানবসত্তা জীবনের গভীরে তলিয়ে গিয়ে যে আনন্দ-বেদনার কাহিনিগুলো সংগ্রহ করে আনে তাঁর দার্শনিক-সত্তা সে-সব কাহিনির কুশীলবদের structting ও fretting দেখে না হেসে পারে না। তাদের জীবনের সুখদুঃখ তাদের কাছে সত্য তো বটেই, গভীরভাবেই সত্য; কিন্তু হতভাগ্যরা জানে না, তারা খেলাঘরের পুতুল বই তো নয়! মানবজীবনের গভীরে এই মায়ার খেলা দেখেই সম্যকদ্রষ্টা দার্শনিকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। সে হাসি বিদ্রুপের হাসি নয়। মায়াগ্রস্ত মানুষের প্রতি সমবেদনার অশ্রু মাখানো আছে সে হাসিতে। এই অশ্রুসিক্ত হাসিই বিভূতিভূষণের সাহিত্যের স্থায়ী ভাব। সখা, বাৎসল্য, মধুর—যে রসই তিনি পরিবেশন করুন না কেন, হাস্যরসই তাঁর অঙ্গীরস। তাই জীবনের গভীর দুঃখও তাঁর হাতে উৎকৃষ্ট হিউমার বা হাস্যরসে রূপান্তরিত হয়। প্রসঙ্গত আরেকটি কথা এখানে বলে নেওয়া প্রয়োজন। বিভূতিভূষণ মানুষকে শুধু স্রষ্টার হাতে যথেচ্ছচালিত ক্রীড়নকমাত্রই মনে করেন না। তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের সুখদুঃখের মূলে আছে তার নিজেরই অনেকখানি হাত। চরিত্রের মধ্যেই যেমন ট্রাজেডির বীজ নিহিত থাকে, তেমনি মানুষেরই কোনো মূঢ় আচার-আচরণ বা কামনা-বাসনা ও ভক্তিবিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত থাকে হাসির উপাদান; বাহ্যিক পরিবেশ বা ঘটনাসংস্থান কিংবা জীবন—রঙ্গমঞ্চের অদৃশ্য পরিচালকের খেয়ালখুশিতে তা অনিবার্য হয়ে ওঠে বটে, কিন্তু তার মূল উপাদান থাকে চরিত্রের মধ্যেই লুক্কায়িত। 

বিভূতিভূষণের ব্যক্তিত্বের তৃতীয় মহলে আছেন শিল্পী বিভূতিভূষণ। এই শিল্পী একাধারে কবি ও পরিহাসরসিক। তাই তাঁর সাহিত্যের যেমন একদিকে আছে সুকুমার সৌন্দর্যবোধ ও উচ্চাঙ্গের পরিকল্পনা, তেমনি অন্যদিকে আছে কৌতুক-কুতূহলী পরিহাসরসিক চিত্তের সরসতা। এই উভয় গুণের সম্মিলনে তাঁর শিল্পকর্ম রসমধুর কাব্যসুষমায় মণ্ডিত হয়েছে। 

.

২

ওপরে বিভূতিভূষণের ব্যক্তিত্বের যে তিন মহলের কথা বলা হল, তাঁর সমস্ত সাহিত্যসৃষ্টির মধ্যেই যে এই তিনেরই সম্যক প্রকাশ হয়েছে এমন নয়। কোথাও হয়তো তাঁর মানবসত্তারই প্রকাশ হয়েছে সার্থক। সেখানে মানুষের গভীরতম সুখদুঃখ, সুখদুঃখের রূপেই ফুটে উঠেছে। সেখানে হাস্যরসিক হয় প্রচ্ছন্ন, নয় একেবারেই অনুপস্থিত রয়েছেন। কোথাও দার্শনিকসত্তাই প্রধান হয়ে উঠেছে, সেখানে রসিকতা প্রধানত তত্ত্বাশ্রয়ী, মানবসত্তার অনুপস্থিতিতে বাস্তব জীবনের সুখদুঃখ যথাযোগ্য মর্যাদা পায়নি। আবার কোথাও কেবল শিল্পীসত্তারই প্রকাশ। সেসব ক্ষেত্রে শিল্প যেমন জীবনের গভীরে প্রবেশাধিকার পায়নি, তেমনি বিভূতিভূষণের দার্শনিক-দৃষ্টিসঞ্জাত উৎকৃষ্ট হাস্যরসেরও অভাব ঘটেছে। যেখানে কবিদৃষ্টি বড়, সেখানে শুধু উচ্চাঙ্গের কাব্যকলারই সৃষ্টি, আর যেখানে শিল্পীচেতনার পরিহাসরসিক দিকটাই মুখ্য সেখানে এক ধরনের মধুর রঙ্গরসে পরিবেশ মুখরিত। উভয় ক্ষেত্রে শিল্পকর্মই প্রধান এবং পরিবেশনের চমৎকারিত্বের ওপরই রসের উৎকর্ষ নির্ভরশীল। কিন্তু যেখানে বিভূতিভূষণের তিনটি সত্তারই যুগপৎ অখণ্ড বিকাশ সম্ভব হয়েছে সেখানেই তাঁর সাহিত্যের চরমোৎকর্ষ সেখানেই তাঁর শিল্পসৃষ্টি নিজস্ব মহিমায় গৌরবান্বিত। 

উদাহরণস্বরূপ ‘রাণুর প্রথম ভাগ’ গল্পটির উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে বিভূতিভূষণের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ প্রকাশ। আট বছরের মেয়ে রাণুর অকালপক্ক গৃহিণীপনাই গল্পটির উপজীব্য। ঠাকুরমার মতো প্রবীণা গৃহিণী সেজে সংসারের অসংখ্য দুর্ভাবনায় তার দিন কাটে, তাই প্রথম ভাগের পড়াটুকু তার কিছুতেই শেষ করে ওঠার সময় হয় না। শিশুরা বয়স্কদের অনুকরণে তাদের পুতুলের খেলাঘরে নিজেদের সংসার রচনা করে, এখানে রাণু বয়স্কদের সংসারকেই তার পুতুলের খেলাঘর করে তুলেছে। শিশুর এই প্রবীণাসুলভ কথাবার্তাও আচার-আচরণই গল্পের হাস্যরসের উৎসস্থল। কিন্তু এখানেই এর রস-পরিবেশন সমাপ্ত হয়ে যায়নি। জগজ্জননীকে ঘরের মেয়ে করে বাঙালিরা আগমনি-বিজয়ার হাসিকান্নার মধ্য দিয়ে যে লীলারস আস্বাদন করে, বর্তমান গল্পটিও শেষ পর্যন্ত সেই লীলার ক্ষেত্রেই উপনীত হয়েছে। গৌরীদানের পুণ্যলোভাতুর পিতার আগ্রহাতিশয্যে রাণু আট বছর বয়সেই তার পুতুলের সংসার ছেড়ে বধূ সেজে শ্বশুরঘর করতে রওনা হয়েছে। আর সংসারের প্রবেশপথে দাঁড়াতেই ওর অসময়ের গৃহিণীপনাটা সরে গিয়ে ওর মধ্যেকার শিশুটি বিস্ময়ে, কৌতূহলে অভিভূত হয়ে পড়েছে। বিদায়-মুহূর্তে প্রমাণিত হয়েছে যে ওর সব হাসির অন্তরালে এত দিন গোপনে শুধু অশ্রুই জমা হয়ে উঠছিল। এ অশ্রুসিক্ত হাসিটুকুকে হালকা সুরে হেসে উড়িয়ে দেবার উপায় নেই, কারণ এ যে আমাদের নিত্যকার জীবনরসেরই রসায়ন, আর এ রসায়ন প্রস্তুত হয়েছে মানুষে-দার্শনিকে-শিল্পীতে মিলে যে একটি বিশিষ্ট সৃজনীপ্রতিভা তারই নির্মাণশালায়। তাই স্বাদে-গন্ধে তা হয়ে উঠেছে অমন অপূর্ব। শুধু ‘রাণুর প্রথম ভাগে’ই নয়, আমাদের ঘরোয়া পরিবেশে শিশুমহলের মধ্যে যে একটি অফুরন্ত রসের ভাণ্ডার আছে, বিভূতিভূষণ তার দ্বারটি আমাদের কাছে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। শিশুকণ্ঠের কাকলিতে যে অমৃত, শিশুচরিত্রের বিশ্লেষণে যে হাস্যোদ্দীপক সরসতা আছে, তাকে অবলম্বন করে তিনি সখ্য-বাৎসল্যের সঙ্গে হাস্যরস মিশিয়ে এক নতুন মিশ্ররস পরিবেশন করেছেন। বস্তুত তাঁর হাতে গড়া বাংলা ছোটগল্পের যশোদা-মূর্তিটি বড়ই চমৎকার! বর্তমান সংকলনে এ পর্যায়ের গল্পগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে আছে ননীচোরা, পীতু আর মাসি। ‘ননীচোরা’ গল্পে অবশ্য শিশুচরিত্রটি উপলক্ষ মাত্র। বালগোপালের সেবায় আত্মনিবেদিত একটি বৈষ্ণব পরিবারের ভক্তিমতী শাশুড়ি-বধূর বিশ্বাসপরায়ণতা এর রসসৃষ্টির উপাদান হয়েছে। ভগবান শিশুর রূপে আমাদের ঘরে জন্মগ্রহণ করে ভক্তের সেবা ও পরিচর্যা গ্ৰহণ করেন, এই বিশ্বাসই শিশুর আচার-আচরণকে শাশুড়িবধূর কাছে রহস্যময় করে তুলেছে। এমনকি গোপালের সেবায় নিবেদিত নৈবেদ্যের থাকা থেকে ক্ষীরের নাড়ু অপহৃত হতে দেখে শাশুড়ির মনে গোপালের প্রত্যক্ষ আবির্ভাব-সম্ভাবনাই গভীরতর হয়ে উঠেছে। গল্পটিতে যথাযথ নিষ্ঠা, বিশ্বাস ও মমতার সঙ্গে বাৎসল্যরসের পরিবেশন অতি উপাদেয়। সঙ্গে সঙ্গে শিশুর স্বভাবসুলভ মিষ্টান্ন প্রীতি ও চৌর্যবৃত্তিই যে শাশুড়ির ভক্তিবিহ্বলতার মূল কারণ, একথা বলে লেখক এ হাস্যলঘুতার দিকটি আমাদের কাছে উদ্ঘাটিত করতে কুণ্ঠিত হননি। আর এখানেই তাঁর পরিহাসরসিক বিত্তের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 

জীবনের অনেক গভীর ভাবাবেগ ও ভক্তিবিশ্বাসের মূল যে কত মিথ্যা মোহ ও অবাস্তব মায়ার ছলনাজালে জড়িত, এবং সে কারণেই মানুষের গভীরতম সুখদুঃখ ক্ষেত্রবিশেষে যে কত হাস্যোদ্দীপক, এই দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কালিকা, বৈরিগীর ভিটেয়, হৈমন্তী ও বর্ষায় প্রভৃতি গল্পে। ‘কালিকা’ গল্প একটি ডানপিটে গেছো মেয়ের কাহিনি। তারই চক্রান্তে তার শ্বশুর পরিবারে ডাকাতি করতে গিয়ে কী করে ভৈরব ডাকাত মন্দির প্রাঙ্গণের ঈষত্তরলিত অন্ধকারে কালিকা-মূর্তি প্রত্যক্ষ করে ভীত, বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে ডাকাতির কথা ভুলে গেল এবং পরিবারটি রক্ষা পেল তারই চমকপ্রদ কাহিনি। এখানে ভৈরব ডাকাতের কালিকা-দর্শন তার নিজের কাছে সমস্ত সন্দেহ-সংশয়ের অতীত প্রত্যক্ষ সত্য অথচ তার পেছনে আছে ওই প্রত্যুৎপন্নমতি গেছো মেয়েটির চাতুরি। ‘বৈরিগীর ভিটেয়’ রোমাঞ্চকর ভৌতিক পরিবেশে ভূতের ভয়ও বাস্তব সত্য হয়ে উঠেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণিত হল যে, যাকে ভৌতিক প্রক্রিয়ার ফল বলে গ্রহণ করা হয়েছে, আসলে তার মূলে আছে সিদ্ধি—সেবন-সঞ্জাত নেশার প্রভাব। এমনি করে ডাকাতের কালীভক্ত এবং জনসাধারণের ভূতের ভয় শেষ পর্যন্ত নিতান্তই হাস্যকর বলে প্রতিভাত হয়েছে। 

‘বর্ষায়’ ও ‘হৈমন্তী’ গল্প দুটি ব্যর্থ প্রেমের করুণরসে অভিসঞ্চিতা। রাজপুত অরূপকুমার আর রাজকুমারী কঙ্কাবতীর প্রবালদ্বীপের প্রেমের স্বপ্নজড়িত রূপকথার রাজ্য পেরোতে না-পেরোতেই আট বছর বয়স্ক শৈলেন ভালোবেসেছিল তার সেজবউদির সই নব-পরিণীতা পঞ্চদশী নয়নতারাকে। সেই বাল্যমোহ নয়নতারার স্বামীর প্রতি তীব্র ঈর্ষায় রূপান্তরিত হয়ে কী করে এক ভৌতিক পরিণতিতে দুঃসহ বিচ্ছেদের সৃষ্টি করলে, বন্ধুদের আড্ডায় বসে পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক শৈলেন তারই রসোগার শেষ করে বলছে,—”আমি জীবনে আর কাউকেই চাইনি, আমার জীবনের চিত্রপটে নয়নতারাকে অবলুপ্ত করে আর কারুর ছবিই ফুটতে পায়নি। পনেরো বছরের অটুট যৌবনশ্রীতে প্রতিষ্ঠিত করে তারই ওপর নিবদ্ধদৃষ্টি আমি তাকে অতিক্রম করে আমার পঁয়ত্রিশ বছরে এসে পড়েছি—সূর্য যেমন যৌবনশ্যামলা পৃথিবীকে অতিক্রম করে অপরাহ্ণে হেলে পড়ে।” নয়নতারার প্রতি শৈলেনের বিরহ যে নিবিড়ভাবেই সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু পঞ্চদশর্ষীয়া বিবাহিতা তরুণীর প্রতি আট বছর বয়স্ক শিশুর বাল্যমোহকে সারা জীবন প্রেমের মর্যাদা দিয়ে অন্তরে লালন করার যে মাত্রাহীন অসংগতি, তাই এ কাহিনির বর্ষা-বিরহকে অন্তরে অন্তরে ব্যঙ্গ করে চলেছে। ‘হৈমন্তী’ গল্পটির ব্যর্থ প্রেমের সুগভীর বেদনায় করুণ। হেমন্ত-গোধূলিতে মাথায় ফসলের বোঝা, কোলে শিশু, একটি সুখী সাঁওতাল দম্পতিকে দেখে প্রৌঢ় ইঞ্জিনিয়ার সুরেশ্বরের নিজের বঞ্চিত ও নিঃসঙ্গ জীবনের দিকে চোখ ফিরল। মনে পড়ল প্রথম যৌবনের একটি উপেক্ষিত প্রেমের কাহিনি। তারপর বোল্ট-নাট-জয়েস্ট-অ্যাঙ্গল—শিটের তলায় তলিয়ে গেল হৃদয়ের সেই কোমল অনুভূতিটি। জীবনে সম্মান, প্রতিপত্তি সবই জুটেছে কিন্তু তবু হৃদয়ের সে ফাঁক আর ভরাট হল না। অতিক্রান্ত-যৌবনে প্রথম যৌবনের অবহেলিত প্রেমকে স্মরণ করে এই যে দীর্ঘশ্বাস, এর যথাযোগ্য মর্যাদা গল্পটিতে পেয়েছে। বিশেষত যে নারী বধূবেশে বাসরঘরে এসে প্রেমিকের জীবন ধন্য করতে পারত সে যখন স্টেনোটাইপিস্টের পদপ্রার্থিণী হয়ে চরিত্রবান ইঞ্জিনিয়ারের কাছে প্রত্যাখ্যাতা হয়ে ফিরে গেল, তখন ভাগ্যের এই নিষ্ঠুর পরিহাস হতভাগ্য সুরেশ্বরের অতনুবিলাপকে অধিকতর করুণ করে তুলেছে। কিন্তু যখন দেখতে পাওয়া যায় যে, একটি ফোটোর দোকানে নিজের ফোটোর পাশে একটি সুন্দরী তরুণীর ফোটো দেখতে পেয়ে তারই প্রতি প্রণয়াবেশের সৃষ্টি হয়েছে এবং সুরেশ্বর সেই স্বপ্নসর্বস্ব রোমান্সকেই অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করে সারা জীবন দুঃখের পসরা বয়ে চলেছে, তখন মানুষের ভাবাবেগের এই যুক্তিহীন মুঢ়তার মধ্যে যে হাস্যকরতা আছে তারই কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আলোচ্য দুটি গল্পে অবশ্য হাস্যরস প্রচ্ছন্ন, বিশেষত শেষোক্ত গল্পটিতে করুণ-বিপ্রলম্ভের বিষণ্ণ বেদনাই মুখ্য। 

ভাবাবেগের আত্যন্তিকতা মানুষের আচার-আচরণে অসংগতি সৃষ্টি করে কীভাবে উপহাস্য হয়ে ওঠে তার উদাহরণ ‘শ্যামলরানি’, ‘ধর্মতলা-টু-কলেজ-স্কোয়ার’ ও ‘সম্পত্তি’ গল্প। ‘শ্যামলরানি’ গল্পে শ্যামলী গাভির প্রতি সুধার আসক্তি এবং বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শ্যামলীবিহীন দিনগুলোর দুঃখপ্রদ চিন্তা সুধাকে ভাবী বরের নিকট উদ্ভদ পত্রালাপে প্রেরণা জুগিয়েছে। শ্যামলীর প্রতি আসক্তি গভীর বলেই হাস্যোদ্দীপক লিপিলিখন এখানে উপাদেয় হয়ে উঠেছে। মানুষের সংকোচ, লজ্জা ও দুর্বলতার ফলে জীবনের কত দুর্লভ মুহূর্তও যে হাতের মুঠোয় এসে অপচিত হয়ে যায় তারই উদাহরণ ‘ধর্মতলা-টু-কলেজ-স্কোয়ার’ গল্পটি। একটি নবদম্পতি নির্জনতায় পরস্পরের সঙ্গলাভের জন্য সংসারের ভাণ্ডার থেকে অতিকষ্টে কয়েকটি ঘণ্টা অপহরণ করে পথে বেরিয়েও কীভাবে তা নষ্ট করতে বসেছে ট্রামের ভিড়ের মধ্যে তাদের ক্ষণরচিত অন্তঃপুরে প্রবেশ করে লেখক সে কাহিনি উদ্ঘাটিত করেছেন। এখানে দুঃসাহসিকা নববধূর বৈসাদৃশ্যে ব্রীড়াবনত তরুণের অসহায় দুর্বলতা কৌতুকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। আত্মাভিমান যে মানুষের আচরণকে কতটা অন্যায়ের পথে নিয়ে যেতে পারে ‘সম্পত্তি’ গল্প তারই উদাহরণ। বাতাসপুরের ছ-আনি দশ-আনির মালিক উমেশ পাল ও ভৈরব পালের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা একটি চোরের শাস্তিবিধান ব্যাপারে উৎকট হয়ে উঠল। চোরকে কোন পক্ষ শাস্তি দেবে—এই নিয়ে উভয় পক্ষের দারোয়ানদের মধ্যে ঝগড়াতে অবশেষে ছ-আনিরই হল জয়, কারণ চোরাই মাল তাদের, সুতরাং চোরও তাদের সম্পত্তি, অতএব তাকে শাস্তি দেবার অধিকারী একমাত্র তারাই। এই আত্মাভিমানের ফলে ছ-আনির জমিদার চোরকে হাতির ওপর চড়িয়ে জয়বাদ্য বাজিয়ে দশ-আনিদের নাকের ওপর দিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে এক বিরাট ভূসম্পত্তি দান করে এল। চোর শাস্তি পেল কিনা সে কথা বড় নয়, বড় হল প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপমান ও জব্দ করে দম্ভ ও আত্মাভিমান চরিতার্থ হল কিনা, তাই। 

পশুচরিত্র নিয়ে ‘আদরিণী’, ‘মহেশ’ বা ‘কালাপাহাড়ে’র মতো সার্থক গল্প বাংলা সাহিত্যে অল্পই রচিত হয়েছে। এদিক দিয়ে ‘কুইন অ্যান’ গল্পটিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এ গল্পে অশ্বিনী কুইনঅ্যান রসসৃষ্টির উপলক্ষ মাত্র। আসলে রায়সাহেব ননীগোপাল চক্রবর্তী জমিদার অ্যান্ড অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটই এর লক্ষ্য। ইংরেজ আমলে শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের কৃপা ও করুণাপ্রার্থী ‘প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর’ যে একদল জীবের সৃষ্টি হয়েছিল রায়সাহেব ননীগোপাল তাদেরই একজন। কৌতুকমিশ্র সরস ব্যঙ্গের গুটপাকে এ গল্পের রস কাহিনির কুহরে কুহরে প্রবেশ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত যন্ত্রযুগের প্রাদুর্ভাবে মধ্যযুগীয় শিভ্যরির দিন গত হয়েছে, এ যুগে ঘোড়দৌড়ের মাঠ ছাড়া অশ্ব-অশ্বিনীদের আর তেমন কদর নেই। সম্প্রতি রায়সাহেবদেরও ইজ্জত নষ্ট হয়েছে। কিন্তু মধ্যযুগের অশ্বারোহী বারেন্দ্রবৃন্দের বিংশশতকীয় প্রহসন-সংস্করণ রায়সাহেব চক্রবর্তীর উচ্চারোহণ-আকাঙ্ক্ষায় ‘কুইন-অ্যান’-এর অন্তিম পরিহাস বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠায় অক্ষয় হয়ে রইল। 

বর্তমান সংকলনের বাকি তিনটি গল্প শিল্পী বিভূতিভূষণের অনবদ্য শিল্পনৈপুণ্যের সার্থক উদাহরণ। ‘চৈতালি’ গল্পে অবশ্য তাঁর কবিসত্তাই বড় হয়ে উঠেছে। পশুপতিনাথ দর্শনে বেরিয়ে হিমালয়ের বিভিন্ন স্তরের প্রাকৃতিক বর্ণনা, মঠধারী রহস্যময় পুরুষের আবির্ভাব ও তিরোভাব, ধ্যানমগ্ন মহাদেবের বিরাট মূর্তি-দর্শন ও সর্বশেষে হিমালয়ের বুক জুড়ে তাঁর প্রলয়তাণ্ডবের চমকপ্রদ কাহিনি এ গল্পটিকে উৎকৃষ্ট কাব্যের মর্যাদা দিয়েছে। ‘দ্রব্যগুণ’ ও ‘বরযাত্রী’ গল্প দুটি পরিহাসরসিক বিভূতিভূষণের কৌতুক—প্রিয়তার অতুলনীয় নিদর্শন। দুটি বোতল—তাও একটি খালি শরবতের এবং অন্যটি ফিনাইলের—তাকে অবলম্বন করেই ‘দ্রব্যগুণের’ উৎপত্তি। বড়দিনের বাজার থেকে শৈলেনকে দুটি বোতল বগলে করে ফিরতে দেখে তাকে মদ্যাসক্ত ভেবে সুরাপায়ী বাল্যবন্ধুর রসিকতা ও সদুপদেশ, পরদিন প্রতিবেশী, সুহৃৎ ও শুভানুধ্যায়ী মহলে ভর্ৎসনা এবং সর্বশেষে তার চরিত্রদোষ সংশোধনের জন্যে তার গৃহে কংগ্রেসি স্বেচ্ছাসেবক দলের পিকেটিং পর্যন্ত ঘটনাবলির উপাদেয় বর্ণনা বিভূতিভূষণের লিপিকুশলতার চূড়ান্ত স্বাক্ষর বহন করে এনেছে। মানুষের জ্ঞানবিশ্বাস ও বিচার—পদ্ধতির আপাত গুরুগাম্ভীর্যের মূলও যে, কত অকিঞ্চিকর হতে পারে তাই এই গল্পের প্রতিপাদ্য, কিন্তু পরিবেশনগুণে লেখক যে কত তুচ্ছ ঘটনাকে অবলম্বন করে কত উৎকৃষ্ট শিল্প সৃষ্টি করতে পারেন, এটি তারও শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ‘বরযাত্রী’ গল্পে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ও বিচিত্র পরিবেশের মধ্যে বরযাত্রী দলের দুর্গতি ও লাঞ্ছনার কাহিনি অট্টহাসির সৃষ্টি করে। শিবপুরের গনশা ও ত্রিলোচন, ঘোঁৎনা ও রাজেন, গোরাচাঁদ ও কে. গুপ্ত—এদের প্রত্যেকেরই চরিত্রগত কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, এবং সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকেও হাস্যরস উৎসারিত হয়েছে, কিন্তু সমগ্রভাবে বরযাত্রী দলটিকে আশ্রয় করে যে হাস্যরস সৃষ্টি হয়েছে তা প্রধানত ঘটনাসংস্থানজনিত; অবশ্য তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের আতসবাজি ও কৌতুকাবহ বর্ণনার ফুলঝুরি। পূর্বেই বলা হয়েছে, শেষোক্ত গল্পগুলোতে পরিবেশনের রসই মুখ্য। শিল্পায়ন-সৌকুমার্যের গুণেই সেগুলোর চমৎকারিত্ব। জীবনশিল্পী হিসেবে যেমন বিভূতিভূষণের সংযমসুন্দর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি জীবনের অশ্রুসিক্ত বেদনাকেও হাস্যমধুর করে তুলেছে, তেমনি কাব্যশিল্পী হিসেবে শুচিশুভ্র পরিহাসরসিকতা তাঁর রচনাকে করেছে সরস ও প্রসাদগুণান্বিত। 

জগদীশ ভট্টাচার্য 
বঙ্গবাসী কলেজ 
আষাঢ় ১৩৫৫ 

Book Content

রাণুর প্রথম ভাগ
বরযাত্রী
ননীচোরা
চৈতালি
শ্যামল-রানি
হৈমন্তী
কুইন অ্যান
বর্ষায়
সাঁতু
বৈরিগীর ভিটেয়
ধর্মতলা-টু-কলেজ-স্কোয়ার
দ্রব্যগুণ
সম্পত্তি
কালিকা
মাসি
সার্টিফিকেট
লেখক: বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়বইয়ের ধরন: গল্পগ্রন্থ / গল্পের বই
বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ২ - দ্বিতীয় খণ্ড

বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় রচনাবলী ২ (দ্বিতীয় খণ্ড)

রাণুর কথামালা

রাণুর কথামালা – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর দ্বিতীয় ভাগ

রাণুর দ্বিতীয় ভাগ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

রাণুর তৃতীয় ভাগ

রাণুর তৃতীয় ভাগ – বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়

Reader Interactions

Comments

  1. মোঃ আলি হাসান

    May 12, 2024 at 8:39 am

    এই সংকলনে “ধর্মতলা টু কলেজ স্কোয়ার” গল্পটি বাদ গেছে। আপলোড করবেন প্লিজ।

    Reply
    • বাংলা লাইব্রেরি

      May 12, 2024 at 12:35 pm

      ভুলে বাদ পড়ে গিয়েছিল। যোগ করা হয়েছে। ধন্যবাদ।

      Reply
  2. S

    May 13, 2024 at 12:22 pm

    Himadri kishore dasgupta er lekha adventure samagra 3,4 dewa jabe plz.

    Reply

Leave a Reply to মোঃ আলি হাসান Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.