শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – জুবায়ের আলম
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
.
উৎসর্গ
মোঃ জাহাঙ্গীর আলম
জুবাইদা গুলশান আরা
যে দুইজন মানুষের কোন স্বপ্নই আমি পুরণ করতে পারিনি
জারিন তাসনিম এলিন; আমার সব গল্পের প্রথম শ্রোতা
টুনু; যে আমাদের পরিবারে সতেরো দিনের অতিথি হয়ে এসেছিল
আর আমাদের ছাদের কবুতরগুলোকে।
.
ভূমিকা
আপনি যখন বইটা খুলেই ফেলেছেন, তখন আপনার কানে কানে একটা কথা বলা যাক। আসলে, সত্যি কথা বলতে, কোন বইয়ের ভূমিকা পড়া যেমন কঠিন, বইয়ের জন্য ভূমিকা লেখাটা তার থেকেও কঠিন। আমার মত অলস আর দীর্ঘসূত্রিতার বরপুত্রের জন্য তো প্রায় অসম্ভব। কিন্তু, তারপরও কিছু কথা বলার জন্য মনে হল ভূমিকাটা লেখা উচিৎ। এখন, আপনি যদি ভূমিকাটা পড়েন, তাতে খুব একটা লাভবান হবেন কি না জানি না, আবার ভূমিকা টপকে মূল লেখাতে চলে গেলেও আমি আপনার নামে ৫৭ ধারায় মামলা করব, এমনটাও না।
প্রথমেই আমার জীবনের একটা ঘটনা বলি। তৌফিকুর রহমান চিন্ময়ের সাথে আমার পরিচয় কলেজ জীবন থেকে। দুজনেই কলেজ জীবনে অনেক লিখেছি। পার্থক্য হল এই যে, জাতীয় দৈনিকে আমার বেশ কয়েকটা লেখা ছাপা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু চিন্ময়ের হয়নি। মানে চিন্ময় কোথাও লেখা জমা দিত না আর কি। ও খারাপ লিখত-এমনটা না। কিন্তু দুজনেই লেখক তো, তা সে যত ছোটই হই। তাই আমি একদিন জিজ্ঞাসা করে বসলাম, কিরে তুই লিখিস কিন্তু কোথাও জমা টমা দিস না ব্যাপার কি? কত পত্র পত্রিকা বের হয় কলেজের বিভিন্ন সংগঠন থেকে। তারপর জাতীয় দৈনিক আছে, স্থানীয় কিছু দৈনিক আছে- সেগুলোতেও তো তুই দিতে পারিস। চিন্ময় পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে সে বাইজি না যে নিজের লেখা দিয়ে অন্যের মনরঞ্জন করবে। সে লেখে তার নিজের জন্য। কেউ সেটা পড়ে নাক সিঁটকাবে, কেউ গালাগালি করবে, কেউ বাহবা দেবে, কেউ বিভ্রান্ত হবে- এর মধ্যে সে নেই। তাহলে লিখিস কেন? ও বলল- বাস্তবিকতা থেকে পালানোর জন্য লিখি। আমার চারপাশটা ভালো লাগছে না, আমি আমার মত করে একটা রিয়েলিটি তৈরি করে নিতে চাই, তাই লিখি। তৌফিকুরের চারপাশ যে তার পছন্দ হত না তা সেটা তাকে দেখেই বুঝতাম। ক্লাসের পরে সে কোন আড্ডা দিত না। কোন সামাজিক কর্মকান্ডেও তার উপস্থিতি ছিল বিরল। খুব কাছের কোন বন্ধুবান্ধব ছিল বলেও কখনও শুনিনি কিংবা জানি না। সব সময় তার ভেতরে একটা ‘পালাব পালাব’ ভাব। প্রচলিত যা কিছু আছে তার কিছুই যেন তার ভালো লাগে না।
কলেজ জীবন পার করার পরে অনেকবার সূর্যের দক্ষিনায়ণ আর উত্তরায়ণ হয়ে গিয়েছে। তৌফিকুরের সাথে যোগাযোগের সুতো ছিঁড়ে গিয়েছে। কলম আর কি-বোর্ড থেকে আমিও ততদিনে সরে গিয়েছি অনেক দূরে। এক রাতে কাজলার মোড়ে চা খাচ্ছি। মার্কেটিং-এর নয়নের সাথে দেখা। ও আমাদের ব্যাচে কমার্সে পড়ত। নয়নই বলল যে শুনেছিস, চিন্ময় এক্সিডেন্ট করছে? আমি তো অবাক। কোথায়? কবে? নয়ন বলল, পোড়াদহের ওইদিকে। নসিমনে চড়ে আলমডাঙা না কোথায় জানি যাচ্ছিল, খালের মধ্যে নসিমন উল্টে পড়ে গিয়ে যে কজন আরোহী নিহত হয়েছিল, তাদের মধ্যে ও একজন।
মনের কোন এক অন্ধকার কোণে পড়ে থাকা চিন্ময়ের স্মৃতিগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটা ছেলে, যে নিজেকে তার চারপাশের বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছে না, মানে পরোক্ষভাবে সে পালাতে চাইছে, সে এমন দুম করে মরে গেল? তাহলে কি সৃষ্টিকর্তা তাকে পালাতে সাহায্য করলেন? সে লেখালাখি করত বলেই কি চারপাশের সাথে মানিয়ে নিতে পারত না, নাকি মানিয়ে নিতে পারত না বলে লেখালেখি করত- ব্যাপারটা অজানাই থেকে গিয়েছে। শুধু ভিসুভিয়াসের মত ফুঁসে উঠেছে অনেক অনেক প্রশ্ন।
এমন ‘পলাতক’ লেখক অনেকে আছেন। ‘পলাতক’ নন, কিন্তু ‘পলাতক প্রবণ’- এমন লেখকের সংখ্যায়ও কম না। জীবনের ওপরে অভিমান করে ‘রূপসী বাংলা’র কবি জীবনানন্দ দাশের অকালে পালিয়ে যাওয়াটা তো সর্বজনবিদীত। ‘দূরবীন’, ‘ঘুণপোকা’ আর ‘চক্র’ এর মত চমৎকার উপন্যাসের লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেভাবে পালিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু পালাতে চেয়েছেন বহুবার। জীবনের একেবারে কিনারে দাঁড়িয়ে যখন, তখন তিনি দেখা পান শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের। অনুকূল চন্দ্রের এক অতিপ্রাকৃত আলিঙ্গন তাকে নতুন করে বাঁচতে শেখায়, জীবনকে নতুন করে দেখতে শেখায়। মৃত্যু আকাঙ্খী যেকোন মানুষই বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজবে। তার দুর্বল মন যেকোন একটা কারণকেই তার বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ হিসেবে দেখবে- এটাই স্বাভাবিক। তার ক্ষেত্রেও হয়ত সেটাই হয়েছিল। দুজনেই বেকারত্ব আর দারিদ্রের বিষাক্ত স্বাদ আস্বাদন করেছেন।
কিন্তু ‘The Outsider’, The Plague, The Stranger খ্যাত আলবেয়ার কাম্যুর তো কোন দারিদ্র্য ছিল না। জীবনানন্দ দাশের মত নিজের স্বীয় রূপ বিষয়ক আক্ষেপও তাকে করতে হয়নি। রমনীকুলের নিকট তিনি ছিলেন অতি আকাঙ্খিত ব্যক্তিত্ব। তাহলে তিনি কেন চলে গেলেন? যদিও তার মৃত্যু হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়, তারপরও অনেকেই এটাকে আত্মহত্যা বলেই বিশ্বাস করেন। এমন বিশ্বাসের পেছনে কারণও রয়েছে। তিনি আত্মহত্যার মত কাপুরুষোচিত একটা ব্যাপারকে সমর্থন করেছেন। তার বহুল আলোচিত দার্শনিক মতবাদ Absurdism-ই তার প্রমাণ।
তাহলে কি এমন কারণ? যার জন্য লেখকেরা পালিয়ে যেতে চান? ব্যাপারটা কি বংশগত? আর্নেস্ট হেমিংওয়ে খুব অল্প বয়সেই বাবাকে হারান। মৃত্যুর কারণ- আত্মহত্যা। তার বোন উরুসুলাও একই রাস্তা বেছে নেন। যে আর্নেস্টকে এন্থ্রাক্স, আমাশয়, ম্যালেরিয়া, এনিমিয়া, ডায়াবেটিস আর দু-দুটো প্লেন ক্র্যাশ মারতে পারেনি, সেই বিড়ালপ্রেমী আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বাষট্টি বছর বয়সে নিজের দোনলা বন্ধুক দিয়ে নিজের খুলি উড়িয়ে দিলেন। আর রেখে গেলেন The Old man and the sea, A sun also rises, For Whom The Bell Tolls এর মত অনবদ্য সব উপন্যাস। যিনি নিজেই বলে গিয়েছেন- “Courage is grace under pressure” তিনি নিজে এমন কাপুরুষোচিত কাজ কেন করবেন?
হেমিংওয়ের দলে আরো অনেকেই আছেন। মালায়লাম কবি রাঘাবান পিল্লাই ছোট্ট একটা কবিতা ‘ঘণ্টাধ্বনি’ লিখে ঝুলে পড়েছিলেন গাছে। ভার্জিনিয়া উলফ পকেট ভর্তি পাথর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ওউস নদীতে। নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন জাপানি লেখক কিমিতি হিরাওকা, প্ৰথম নোবেল বিজয়ী জাপানি লেখক ইউনিসারি কাওয়াবাতার মত প্রথিতযশা লেখক। জার্মান লেখক ও দার্শনিক ফ্রেডরিখ নিৎসে এবং শোপেনহাওয়ারও বরণ করে নিয়েছেন একই পরিণতি। দুজনের ভেতরে ছিল গুরু-শিষ্য সম্পর্ক।
তাহলে এই যে অবেলায় নিজের জীবনের পাতা থেকে কলম তুলে নেওয়া, হাসতে হাসতে একদিন দুম করে সরে যাওয়া- এর কারণ কি তাহলে শুধুই হতাশা? হতাশ তো সবাই হয়। একজন লেখক যেমন হতাশ হন, ঠিক একজন রিক্সাওয়ালাও হতাশ হন। দুজনের হতাশার কারণ আলাদা হতে পারে, কিন্তু হতাশা তো এক। তাহলে লেখকেরা কেন নিজেকে শেষ করে দিতে চান? The Bell Jar আর Ladz Lezarus এর মত আত্মস্বীকৃতিমূলক উপন্যাসগুলোতেই দেখা যায়, লেখিকা সিলভিয়া প্লাথ কি ভয়াবহ হতাশা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে তিনি এক একটা দিন পার করেছেন। একই পথে চলে গিয়েছেন অভিমানী, নি:সঙ্গ আর হতাশায় হাবুডুবু খাওয়া ছোট গল্পের প্রবাদ পুরুষ এডগার এলান পো।
২০০১ সালে আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী জেমস সি. কফম্যানের গবেষণায় বেরিয়ে আসে এক মন খারাপ করে দেওয়ার মত তথ্য। তার গবেষণা মতে, বেশিরভাগ লেখকই ‘Szlvia Plath’ সিন্ড্রোমে ভোগেন; কেউ কম, কেউ বেশি। বিশেষ করে লেখকদের চাইতে লেখিকারা এতে বেশি ভোগেন। তার মতে, লেখিকাদের চাইতে মহিলা কবিরা অনেক বেশি ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’ আর হতাশায় ভোগেন। তাদের অনেককেই ‘ইটিং ডিসঅর্ডার’ বা অদ্ভুত খাদ্যাভাসের সমস্যা ভুগতে দেখা যায়। শুধু লেখক লেখিকাই না, সৃজনশীল কাজের সাথে সম্পৃক্ত সকলেই এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন।
এদের ভেতরে যে সবাই হতাশাবাদী ছিলেন তাও না। অনেকের লেখনীতেই ফুটে উঠেছে আশার বাণী। কিন্তু সেই লেখনীর পেছনের মানুষটা যে ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছেন- এটা পাঠককে তারা বুঝতে দেননি। The old man and the sea এর সেই বৃদ্ধের মুখ দিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে পাঠককে বলে গিয়েছেন- A man can be destroyed but not defeated. কিন্তু সেই হেমিংওয়েই আত্মহত্যার মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন, জীবনের কাছে মানুষকে শেষমেষ হার মানতে হয়।
অনেক লেখক আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। অনেকে করতে চাইলেও হয়ত লেখনীর ভেতরে সেটা আসেনি। তবে আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা লেখক জীবনের কোন না কোন সময়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছেন। সেটা সচেতন কিংবা অবচেতনভাবেই হোক- চেয়েছেন। কেউ সেটা প্রকাশ করেছেন লেখার মাধ্যমে, কেউ করেননি। তবে আত্মহত্যার প্রভাব অনেক লেখকের জীবনে গভীর ছাপ ফেলেছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন থেকে তার সব থেকে কাছের মানুষ, তার অন্যতম বৌঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যা রবীন্দ্রনাথের লেখনীতে স্পষ্ট। হয়ত এক অব্যক্ত প্রেম ছিল, হয়ত সমাজ সংজ্ঞায়িত সম্পর্কের থেকেও গভীর ছিল তাদের ভেতরের বোঝাপড়াটা। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু পরে তার লেখার ভেতরে ফুটে ওঠে মৃত্যু-দর্শন। তিনি গানের মাধ্যমে শ্রোতাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বারবার যেন নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দিয়ে গিয়েছেন- মৃত্যু সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে বিমুখ আপনার পানে চাই। শোকতপ্ত লেখককে সান্ত্বনা দেওয়া যে কি কঠিন!
থ্রিলার লেখক সিডনি শেলডনকে কে না চেনে। তার আত্মজীবনী The Other Side of Me এর শুরুটাই হয়েছে তার আত্মহত্যা করতে চাওয়ার এক প্রবল ইচ্ছা দিয়ে। ১৯২৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ তাদের অসচ্ছল পরিবারেও লেগেছিল। শুধু মাত্র দারিদ্র থেকে বাঁচতেই তিনি ফার্মেসী থেকে ঘুমের ওষুধ চুরি করেছিলেন আত্মহত্যা করবেন বলে।
হ্যাঁ, লেখকেরা স্বাভাবিকভাবেই আবেগী। কিছুটা যুক্তির ধার যে তারা একেবারেই ধারেন না তা না। কিন্তু আবেগ-যুক্তি যুদ্ধে লেখকের প্রশ্রয়ে আবেগ সব সময়ই জিতে যায়। কোন এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় লিখতে বসে বহু আগের পাওয়া কোন দুঃখ অনেক বড় করে ধরা দেয়। কোন এক বিকেলে বহু আগের কোন বিচ্ছেদ অনেক দিন পরে ধরা দেয় অনেক বড় হয়ে। লেখকের তখন আবেগ আর বাস্তবতা মেলে না। কোথায় যেন একটা শূন্যস্থান থেকে যায়। পাতার পর পাতা হয়ত সেই বিচ্ছেদ নিয়েই লিখে ফেলেন, কিন্তু হতাশা কমে না; বরং বাড়তে থাকে। বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার মধ্যেকার যে পার্থক্য- এটা লেখকেরা সহজে মেনে নিতে পারেন না। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নিজেই সেটা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন বাস্তবতা আর পরাবাস্তবতার মাঝখানে আটকে যাওয়া একজন মানুষ।
ব্যক্তিগত মতামত হল, এটা অন্যায়, এটা স্বার্থপরতা। লেখকের এই অসময়ে চলে যাওয়াটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতাও। আমি নিজে লেখক কম, পাঠক বেশি। আমার প্রিয় লেখকেরা কি জানেন যে কি পরম মমতায় আমি তাদের বইগুলো বালিশের পাশে নিয়ে শুতে যায়? পড়ি বা না পড়ি, তাদের বইগুলো কি পরম যত্নে আমি বয়ে বেড়াই আমার ব্যাগে? জীবনের কঠিন সময়গুলোতে একজন পাঠকের ভরসাস্থল হল একজন লেখক। লেখকেরা হারিয়ে গেলে পাঠকদের পাশে কে দাঁড়াবেন? কথাটা পাঠকের জায়গা থেকে হয়ত স্বার্থপরের মত শোনাতে পারে, লেখকও বলতে পারেন, পাঠক স্বার্থপর হলে আমি কেন হব না? আত্মহত্যায় কিন্তু সমস্যার সমাধান কিছুই হচ্ছে না। বাস্তবতা এবং পরাবাস্তবতার মাঝখানের যে পার্থক্য- এটাও কমছে না। এই পলায়নপরতার দর্শন সমাধান করতে শেখাচ্ছে না, শেখাচ্ছে এড়িয়ে যেতে। কিন্তু লেখকদের ধর্ম তো তা না। লেখকরা কোন কিছু এড়িয়ে যেতে পারেন না। এড়িয়ে গেলে তারা লেখক হতেন না। হতেন আমার মতই কোন সাধারণ মানুষ। লেখকের হাত দুটো টেনে তোলার হাত, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়ার হাত না।
তো যাই হোক, চিন্ময়ের মৃত্যুটা স্বেচ্ছা মৃত্যু ছিল না। কিন্তু তার স্বেচ্ছা মৃত্যুর ইচ্ছাটা আমার কাছে ছিল অনেক বড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন। এই সমাজ আর প্রচলিত ব্যবস্থা কি লেখক আর কবিদেরকে ধরে রাখতে পারছেন না, নাকি লেখক আর কবিরাই সেই সমাজের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছেন না? সমাজের ভুলে গেলে চলবে না- সমাজের প্রতি প্রতিটা লেখকের যেমন কম বেশি দায়বদ্ধতা আছে, তেমনই সমাজেরও কিন্তু লেখকের প্রতি কিছুটা দায়বদ্ধতা আছে। দুটোর গরমিলের ফলাফল কিন্তু প্রাণঘাতী।
আপনি এতদূর পড়েছেন! সর্বনাশ! আপনার তো দূর্ধর্ষ ধৈর্য! যাই হোক, মূলত লেখকদের মনের ভেতরে আরেক দ্বিধান্বিত লেখককে নিয়েই এই উপন্যাস। যদিও ভূমিকাটা এমন থ্রিলারের সাথে যায় কি না জানি না। যদি যায় তো ভালো, না গেলে আমি করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী। অনিচ্ছাকৃত এবং অজ্ঞানতাবশত কিছু ভুল থেকে যেতে পারে বইটাতে, জানাবেন আশা করি।
আমার আরেক বন্ধু, বড়ভাই এবং খুব কাছের মানুষ- আমানুল্লাহ আমান ২০১৬ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান। তিনি লেখক ছিলেন না, তবে সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলেন। এই উপন্যাসটা লিখতে গিয়ে বারবার তার কথা মনে পড়েছে। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আব্বু, আম্মু, ছোট বোন, নানা, নানু, ছোট মামা, ছোট মামি, নিশু আন্টি, আরশিল, নান্নান- এরা সবাই কোন না কোনভাবে এই বইটার সাথে সম্পর্কিত; তাদের অশেষ ধন্যবাদ। জেসমিন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে অনেক সাহায্য করেছে; রুটিন করে উৎসাহ দিয়েছে- তাকে ধন্যবাদ। রাশিক জামান যথারীতি চমৎকার সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছে। তাকেও অশেষ ধন্যবাদ। সব শেষে সেইসব লেখককে ধন্যবাদ, যারা নিজেদের একটু একটু করে ভেঙে পাঠকদের ভেতরে নিজেকে বিলিয়ে দিচ্ছেন।
জুবায়ের আলম
আম্রকানন ছাত্রাবাস, রাজশাহী।
.
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, সব চরিত্র কাল্পনিক
.
এই শহরে এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে লেখকরা একবার গেলে
আর কখনও ‘লেখক’ হয়ে ফিরে আসে না।
Leave a Reply