রোমাঞ্চকর ১৫ – সম্পাদনা সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা, জানুয়ারি ২০২০, মাঘ ১৪২৬
প্রচ্ছদ : সুদীপ্ত মণ্ডল
.
উৎসর্গ
মাননীয় শ্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রদ্ধাস্পদেষু
.
ভূমিকা
কয়েকটি কথা যা না বললেই নয়
রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্য মানুষের রুচি পাল্টায়, না কি মানুষের রুচি অনুযায়ী রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্য বদলে যায়? এই প্রশ্ন যেমন খুবই দুরূহ তেমনই উত্তরটাও ব্যক্তিভেদে, কালভেদে এবং রুচিভেদে আজও অনুচ্চারিত ও দুর্জ্ঞেয়। সমাজের সর্বস্তরের মানুষই রোমাঞ্চ কাহিনির পাঠক—পাঠিকা, কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি সাহিত্যের সর্বস্তরের সেবক এর লেখক নন। রহস্য—রোমাঞ্চ কাহিনির ধারা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই এর নিজস্ব একটি রীতি—প্রকরণ বা স্টাইল আছে। এবং সেই স্টাইলটি সাধারণ গল্প—উপন্যাসের থেকে সম্পূর্ণ অন্য ধাঁচের। এই স্বাতন্ত্র্যটুকু সব লেখকের চোখে বা মনে যেমন ধরা পড়ে না, তেমনই গভীর ও ব্যাপক অনুশীলন—চর্চা ব্যতিরেকে তা আয়ত্ত করাও কঠিন। তাই পাঠক—পাঠিকাদের অধিকাংশ সময়েই দুধের বদলে পিটুলিগোলা খেয়েই মন ভরাতে হয়। মনের চোরাগলিতে প্রতি মুহূর্তে আমাদের গোপন অভিসার, যে উৎকণ্ঠাপূর্ণ অভিযাত্রা, সার্থক রোমাঞ্চ কাহিনি প্রধানত এই ‘কি হয় কি হয় শিহরন ভাব’ নিয়েই। মানসিক চর্চা ও মনঃসমীক্ষার প্রেরণায় তাই রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া রোমাঞ্চ কাহিনি গড়ে ওঠে, আর তখনই সে পায় প্রকৃত শিল্পের মর্যাদা।
মূলধারার সাহিত্য যদি জীবনের চোখধাঁধানো অয়েলপেন্টিং তাহলে রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্য নিশ্চিতভাবেই আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব জীবনযাত্রার সাদা—কালো (হয়তো বা ধূসর ক্ষেত্রেরও) ফটোগ্রাফ। বাংলা রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্য এ বিষয়ে ‘রত্নাকর বিশেষ’; বহু দুষ্প্রাপ্য পত্র—পত্রিকায় বিস্মৃতির ধুলোর আড়ালে চলে যাওয়া কত অসাধারণ রোমহর্ষক রোমাঞ্চ কাহিনি যে ছড়িয়ে— ছিটিয়ে পাঠকের চোখের আড়ালে চলে গেছে তা ভাবলেই আফশোশ হয়। তবে আনন্দের বিষয়, এই ধরনের হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু রহস্য কাহিনি খুঁজে বের করার পর সেগুলি গ্রন্থিত করা হলে সর্বস্তরের পাঠকদেরই কাছে সমাদর লাভ করে। আর এই আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতি থেকেই, এই বৃহদায়তন পরিকল্পনাটির সূত্রপাত। বাংলাবাজারে রোমাঞ্চ কাহিনির সংকলন অপ্রতুল নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও জোর গলায় বলছি, এই সংকলন সবদিক থেকেই একেবারে অন্যরকম ও অভিনব। এই বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর অধিকাংশ রচনাই দুষ্প্রাপ্য শুধু নয়, বাংলা রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্যের সুলেখকদের সুনির্বাচিত রচনার হারিয়ে যাওয়া বহু পত্র—পত্রিকার পাতা থেকে সরাসরি তুলে সুবিন্যাসিত সঞ্চয়নও। উপরন্তু এই সংকলনে কোনও একটি নির্দিষ্ট পত্রিকা বা আঙ্গিকের উপর গুরুত্ব না দিয়ে বাংলা রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্যের বহু হারিয়ে যাওয়া অনালোকিত ও অনালোচিত তটভূমির উপর যথাসাধ্য অভিনিবেশ করা হয়েছে, যাতে পাঠক—পাঠিকারা বাংলা রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্যের ‘বৈচিত্র্যময় ব্যাপকতার’ স্বাদ আস্বাদন করতে পারেন।
বাংলা রহস্য—রোমাঞ্চ সাহিত্যের ঐতিহ্যময় ধারায় ‘মাসিক রোমাঞ্চ’, ‘মাসিক রহস্য’, ‘ক্রাইম’, ‘গোয়েন্দা’, ‘অপরাধ’ ইত্যাদি বর্তমানে অলভ্য পত্রিকাগুলির অবদান সর্বদাই অনস্বীকার্য। বহু নামি—দামি শুধু নন, খ্যাত—অখ্যাত সব ধরনের লেখকেরই অনবদ্য সব রচনা প্রকাশিত হয়েছে এইসব পত্রিকাগুলিতেই। এই সংকলনেরও অধিকাংশ রচনাই এইসব পত্রিকাগুলির ধূলি—মলিন কীটদষ্ট পাতা থেকে সরাসরি ‘উজ্জ্বল উদ্ধার’। বস্তুত এইসব হারিয়ে যাওয়া রুদ্ধশ্বাস সব লেখা পড়তে পড়তে সবসময়ই মনে হয়েছে, এই সময়ের পাঠক—পাঠিকাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁদের চোখের আড়ালে এইসব ‘হিরে—মানিক’ রয়ে গিয়েছে, আর তাঁরা বাধ্য হয়ে বাংলা রোমাঞ্চ কাহিনির আঙিনায় শিল্পীর চেয়ে অদক্ষ শিল্পীর মাতামাতিই বেশি দেখছেন। এই সংকলন শুরু হয়েছে আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম কথাশিল্পী প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘হানাবাড়ি’ দিয়ে যেটির চিত্ররূপও একসময় মানুষকে শিহরিত করে তুলেছিল। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘গোপনচারিণী’ রোমাঞ্চ কাহিনিটি পুরোপুরি অন্য স্টাইলে লেখা, যা তাঁকে একালের পাঠক—পাঠিকাদের কাছে নতুনভাবে যেমন চেনাবে, তেমনই সেই সময়ের পাঠক—পাঠিকাদের কাছে এ এক ‘হারিয়ে পাওয়া ধন’। নীহাররঞ্জন গুপ্তের রহস্য কাহিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের বই শেষ না করা অবধি নাওয়া—খাওয়া ভুলিয়ে রেখেছে এমনই তার টান। এখানে তাঁর ‘পরাশর শীল’ নামে একটু অপরিচিত একটি রহস্য কাহিনি সংকলিত হয়েছে। বিমল মিত্র খুবই কম রহস্য কাহিনি লিখেছেন, কিন্তু যে—কটি লিখেছেন প্রতিটিই ওঁর নিজস্ব স্টাইল ও মেজাজে নিজ স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। প্রণব রায়কে গীতিকার হিসেবে বহু মানুষ চিনলেও, তিনি যে অনবদ্য কিছু রহস্য কাহিনি নিয়মিতভাবে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় লিখে গেছেন, তার থেকেই একটি এই সংকলনে পেশ হল। যাঁকে ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের রাজকুমার’ অভিধা দেওয়া হয়, সেই সমরেশ বসু বেশ কয়েকটি অ্যাডাল্ট ক্রাইম স্টোরি লিখেছেন, যার মধ্যে থেকে একটি এখানে গ্রন্থিত হয়েছে। বিধায়ক ভট্টাচার্য, মণি বর্মা, কৃশানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোরঞ্জন দে, রাজকুমার মৈত্র, রবিরঞ্জন মুখোপাধ্যায়, প্রবীরগোপাল রায়, সুপ্রিয়কুমার বিশ্বাস—এঁরা সকলেই রহস্য কাহিনির লেখক হিসেবে খুবই নিয়মিত ও সুপরিচিত নাম ছিলেন এবং সেজন্যেই এঁদের বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় রোমাঞ্চ কাহিনি এখানে বিভিন্ন দুর্লভ পত্র—পত্রিকার পাতা থেকে সরাসরি গ্রন্থিত করা হয়েছে যাতে পাঠক—পাঠিকারা রোমাঞ্চ সাহিত্যের সব ধরনের ধারার আস্বাদ পান ও ‘নিছক চর্বিত চর্বণ’ পাঠ না করে নিজেদের বঞ্চিত বোধ না করেন। আর আগেও যে কথা বহুবার গর্বের সাথে লিখেছি তা হল, আমার সম্পাদনা শিক্ষার সবকিছুই শ্রী অনীশ দেব—এর সৌজন্যে প্রাপ্ত। তাঁর অভিভাবকসুলভ সস্নেহ উপদেশ ‘গোয়েন্দা রহস্য’ পত্রিকা সম্পাদনা ও বিভিন্ন বইগুলির ক্ষেত্রে সবসময়ই নির্মাণটিকে আরও শোভনসুন্দর করেছে। এবং মাননীয় শ্রী অনীশ দেব যে তাঁর এই রোমহর্ষক সুদীর্ঘ আখ্যানটি এই বইতে সংকলিত করতে আমাকে অনুমতি দিয়েছেন সেইজন্য তাঁর কাছে আমি সবসময়ের মতো এবারও কৃতজ্ঞ।
এই ভূমিকায় প্রত্যেকটি কাহিনির আখ্যানবস্তু বা লেখকদের রচনাশৈলী নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করে দীর্ঘায়িত করছি না। কারণ, আমি মনে করি, কোনও লেখকের রচনার অসাধারণত্ব প্রমাণের জন্য দীর্ঘ প্রবন্ধের অবতারণা না করে পাঠক—পাঠিকাদের সামনে সরাসরি সেই লেখা তুলে ধরাটাই শ্রেয় ও সমীচীন—কারণ পাঠক—পাঠিকারা পাঠ শেষে যা মনে মনে ভাববেন, কোনও লেখকের অসাধারণত্ব বিচারের সেটিই হচ্ছে মহাকালের আসল কষ্টিপাথর। আর যেখানে এই বইয়ের সূচিপত্রে বাংলা সাহিত্যের রথী—মহারথীদের হারিয়ে যাওয়া সুবিস্তৃত রোমাঞ্চ কাহিনির বিপুল সমাবেশ যেন পাঠক—পাঠিকাদের কাছে এক ‘মহাভোজের আমন্ত্রণ’; সেখানে নিছক সম্পাদকের অধিকারবলে কথার কচকচির ফুলঝুরি ফুটিয়ে কারও বিরক্তি উৎপাদন করা কখনোই কাম্য নয়।
এই বৃহদায়তন সংকলন—গ্রন্থটির প্রকাশে সবচেয়ে জরুরি ভূমিকা দেব সাহিত্য কুটীরের কর্ণধার শ্রীমতী রূপা মজুমদারের, যিনি সর্বদাই হাসিমুখে নিরলসভাবে প্রয়োজনীয় দায়িত্ব সামলেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর উদ্যোগেই এত বড় একটি বই এত অল্প সময়ের মধ্যে দিনের আলোর মুখ দেখছে। তাঁকে ও ঐতিহ্যশালী এই প্রতিষ্ঠান দেব সাহিত্য কুটীরের সবাইকেই এজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। প্রত্যেক লেখক ও তাঁদের পরিবারবর্গের কাছেও আমি ব্যক্তিগতভাবে ঋণী যা বাস্তবিকই অপরিশোধ্য, সকলের ঐকান্তিক সহযোগিতায় এই স্ফীতকায় বইটি শেষ অবধি প্রকাশিত হতে পারছে।
এই বই বহু ভাবনা—চিন্তা ও পরিশ্রমের ফসল। তবে আমার পছন্দ যদি সকলের ভালো লাগে তবেই বুঝব এত সব কিছু সার্থক। তাঁদের কথা ভেবেই এই বই। অলমিতি বিস্তারেণ।
সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়
২৮/৮/২০১৯
sumanta Majumder
Nice