রান্না খাদ্য পুষ্টি – সিদ্দিকা কবীর
প্রথম প্রকাশ – মার্চ, ১৯৭৮
.
উৎসর্গ
বাংলাদেশের পুষ্টিহীন শিশুদের উদ্দেশে
.
[রান্নায় রসনার তৃপ্তি। বাংলাদেশের পুরনো ঐতিহ্যের মধ্যে রান্নাও একটি। সময়ের বিবর্তনে পরিবর্তিত বর্তমান রান্নার ধারাকে সেই ঐতিহ্যের সাথে মেলবন্ধনে আবদ্ধ করেছেন বিশিষ্ট পুষ্টিবিদ ও রন্ধন-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা সিদ্দিকা কবীর। খাদ্য ও পুষ্টি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে দীর্ঘকালের অধ্যাপনায় তিনি খাদ্য ও পুষ্টি সম্বন্ধে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেই অভিজ্ঞতার ফসল রান্না খাদ্য পুষ্টি বইটি।
লেখকের চিন্তা-ভাবনা-অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশে রান্না খাদ্য পুষ্টি বই-এর মাধ্যমে রান্না একটি শিল্পের মর্যাদায় আসীন হয়েছে।
বইটি শুধু দেশে নয়, বহির্বিশ্বেও সমাদৃত হচ্ছে। অতি সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত ‘গুরমান্ড ওয়ার্ল্ড কুকবুক অ্যাওয়ার্ড-২০১১’ লাভ করেছে।
আশা করা যায়, আধুনিক রুচিসম্মত পাঠক-পাঠিকা চিরাচরিত খাবার-দাবারের পাশাপাশি আধুনিক খাবারের পরিচয়পর্ব, আনুষঙ্গিক ঘ্রাণ-রং ও নান্দনিক পরিবেশন রীতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারবেন।]
.
সিদ্দিকা কবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে গণিতশাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি ইডেন গার্লস কলেজে গণিতের প্রভাষিকা পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের স্কলারশিপ নিয়ে ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে খাদ্য ও পুষ্টি এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এম. এস. ডিগ্রি লাভের পর ঢাকায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি মহাবিদ্যালয়ে ১৯৬৩ সালে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্তি পান। ১৯৯৩ সালে তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের অধ্যক্ষার পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সমাজকে পুষ্টিমানসম্পন্ন রান্নায় সচেতন করার জন্য বিভিন্ন সম্মাননা পদক পেয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত ‘সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি একটি মশলা প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রান্না প্রতিযোগিতায় বিশেষজ্ঞ ও অন্যতম জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সাল থেকে দশ বছর নেসলে বাংলাদেশ-এর নিউট্রিশন এবং কালিনারি কনসালটেন্টের কাজ করেন। তিনি অনন্যা শীর্ষ দশ, শেলটেক পদক ও বুড়িগঙ্গা রোটারি ক্লাব পুরস্কার অর্জন করেন।
রান্না সম্পর্কিত লেখিকার অন্যান্য বই: খাবার-দাবারের কড়চা, Bangladesh Curry Book ও ঘরোয়া রান্না (সম্পাদিত)।
১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সৈয়দ আলী কবীর-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
.
প্রথম সংস্করণের ভূমিকা
রান্নার সঙ্গে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। কিন্তু ব্যবহারিক দিক দিয়ে এ সম্বন্ধে অনেকের জ্ঞান অত্যন্ত সীমিত। উপরন্তু যার যতখানি জানা আছে তা বংশগত ধারায় প্রাপ্ত! উপযুক্ত জ্ঞান, অনুশীলন ও অর্থের অভাবে আমাদের ঐতিহ্যপূর্ণ খাবারের বিলুপ্তি ঘটছে আর যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটুকু অল্পসংখ্যক পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অন্যদিকে বিভিন্ন বিদেশি মুখরোচক খাবারের প্রতি আমাদের আকর্ষণ দিন দিন বাড়ছে। যথা—চাইনিজ ছাড়া আরও অনেক বিদেশি রান্না আছে যা আমাদের জানবার সুযোগ হয় না।
এ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রান্না খাদ্য পুষ্টি বইটি লেখা হয়েছে। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ঐতিহ্যপূর্ণ রান্নার জ্ঞানকে বিজ্ঞানের বিশ্লেষণে কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ করা ও বিদেশি রান্নার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো। আমাদের খাদ্যাভ্যাসের উন্নতি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রান্নার কৌশল আয়ত্ত করাও আর একটি উদ্দেশ্য। খাদ্যের সঙ্গে পুষ্টির গভীর সংযোগ আছে, একথা মনে রেখে শেষ অধ্যায়ে খাদ্য ও পুষ্টি সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। রান্নার রেসিপিতে বিজ্ঞানসম্মত মাপ ও রান্নার পদ্ধতি ব্যবহার করে রেসিপিগুলো স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য রান্নার ক্লাসে ব্যবহারের উপযোগী করা হয়েছে।
এ বই লেখার জন্য আমি যেসব আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে প্রচুর উৎসাহ, প্রেরণা ও সাহায্য পেয়েছি তাঁদের সবাইকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এ ছাড়া এ বিষয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা লাভ করেছি সেসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সিদ্দিকা কবীর
মার্চ, ১৯৭৮
.
প্রস্তাবনা
পাঠক-পাঠিকাদের জন্য রান্নার ব্যাপারে কয়েকটি বিষয় আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করছি। রেসিপি দেখে রান্না করতে গিয়ে যেসব সমস্যার উদ্ভব হতে পারে তারই সমাধানের জন্য এই প্রস্তাবনার উপস্থাপন।
যদিও বইয়ে এমন সব রান্না দেওয়া হয়নি, যেসব উপকরণ বাংলাদেশে পাওয়া যায় না, তথাপি মালমসলা যোগাড় করে নতুন একটা রান্না করা অনেকেই ব্যয়সাপেক্ষ মনে করেন। হলুদ, মরিচ, লবণের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় মসলাপাতি সব রান্নাঘরে থাকে। কিন্তু জায়ফল, জয়ত্রি, সিরকা, বেকিং পাউডার, ভেনিলা এসব এক রকম শৌখিন দ্রব্যেরই অন্তর্ভুক্ত। অথচ মনের মতো করে ছেলেমেয়েদের জন্য বা অতিথির জন্য রান্না করতে হলে এসব শৌখিন মসলারও প্রয়োজন হয়। মসলা একবার কিনলে অনেকদিন সংরক্ষণ করা যায়। একবার সব রকম মসলা কেনা সম্ভব না হলে মাসে মাসে কয়েকটি করে কেনা যায়। মসলাজাতীয় উপকরণ একবার কিনলে দু মাস, বছর এমনকি দু বছরের জন্য নিশ্চিন্ত থাকা যায়। হয়তো বা কতক উপকরণ অনেকের কাছে নতুন, আবার কোথায় কিনতে পাওয়া যাবে তাও অজানা। বাংলাদেশের সর্বত্রই পসারীর দোকান আছে—যেখানে পাওয়া যায় সল্টপিটার, বিটলবণ, ফিটকারি ইত্যাদি। পারফিউমারি দোকানগুলোতে (এ প্রসঙ্গে ঢাকার বাবু বাজার এলাকার পারফিউমারি দোকানের উল্লেখ করা যায়।) সোডিয়াম বেনজোয়েট, এসেটিক এসিড, লিকুইড গ্লুকোজ, এসেন্স, ঈস্ট ইত্যাদি বিক্রি হয়। খাওয়ার সোডা, স্বাদলবণ, খাওয়ার রং আজকাল সাধারণ মুদির দোকানেও পাওয়া যায়।
শীতের শেষে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মরিচ, সরিষা, মেথি, ধনে, মৌরি ইত্যাদি রকমারি মসলার নতুন ফলন বাজারে ওঠে। এ সময়টাতে কিছু বেশি করে মসলা কিনে ফাল্গুন-চৈত্র মাসের চড়া রোদে শুকিয়ে সারা বছরের জন্য রাখা যায়। রান্নার এসব টুকিটাকি বিষয় আগ্রহী ও উৎসাহীজনকে কিছুটা সাহায্য করবে বলে আশা রাখি।
সিদ্দিকা কবীর
Leave a Reply