• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

লাইব্রেরি » নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী » মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
মহাভারতের ভারত যুদ্ধ এবং কৃষ্ণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

সূচিপত্র

  1. গ্রন্থকারের নিবেদন
  2. কথামুখ

মহাভারতের ভারত যুদ্ধ এবং কৃষ্ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী
প্রথম সংস্করণ : ২৫ বৈশাখ ১৩৯৮

[কৃষ্ণ কি স্বয়ং ভগবান? না কি বিরাট মাপের এক ব্যক্তিত্ব, সামান্য এক গোপপল্লী থেকে বিস্ময়কর একক কৃতিত্বে যিনি সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন? মহাভারতের যুদ্ধ কি শুধুই কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ, নাকি ভারতের পূর্ব-দক্ষিণ শক্তির উপর উত্তর-পশ্চিম ভারতীয় শক্তির আধিপত্য বিস্তারের জন্য সারা ভারতবর্ষ জুড়ে সেকালে যে রাজনৈতিক তথা কূটনৈতিক যুদ্ধ হয়েছিল, তারই ইতিবৃত্ত? নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর লেখার সঙ্গে যাঁদের পরিচয় রয়েছে তাঁরা সকলেই জানেন যে, সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর অধিকার কত গভীর ও সুবিস্তৃত। এবং এও তাঁরা লক্ষ করেছেন যে, নৃসিংহপ্রসাদের কোনও কথাই কল্পনাপ্রসূত নয়। তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে তিনি সবসময়ই তুলে আনেন মূল সংস্কৃত সাহিত্যের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি, যথাসম্ভব অবিকৃত অবস্থায় জুড়ে দেন তার বাংলা অনুবাদ কি ব্যাখ্যা। তা সত্ত্বেও প্রতিটি রচনাতেই তিনি যে হয়ে ওঠেন চমকপ্রদ কি তথ্যে, কি ভাষ্যে–তার কারণ, সম্ভবত, নৃসিংহপ্রসাদের অপূর্ব দৃষ্টিকোণ।

এমনই একটি সম্পূর্ণ অভিনব দৃষ্টিকোণ থেকে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এই অসামান্য গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন কৃষ্ণ-চরিত্রের রাজনৈতিক উপাদানগুলি এবং একইসঙ্গে এঁকেছেন সেকালের একটি পূর্ণাঙ্গ ভারতচিত্র। দেখিয়েছেন, আজকের দিনে পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির উপর কেন্দ্রের যে-বঞ্চনার কথা আমরা বিভিন্ন কথাপ্রসঙ্গে বারবার বলি, তার বীজ উপ্ত হয়েছিল মহাভারতের ভারতযুদ্ধের সময় থেকেই। নৃসিংহপ্রসাদের শক্তিশালী কলমে এ-গ্রন্থে বিধৃত কৃষ্ণের ক্রমিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার অনন্য চলচ্চিত্র, ভারতযুদ্ধের কূটনীতিসমূহের পরিচয় উদ্ঘাটন, এবং, সর্বোপরি, সেকালের সঙ্গে একালের মেলবন্ধন-সূত্র আবিষ্কারের তাৎপর্যমূলক প্রয়াস– এর কিছুই লেখকের স্বকপোলকল্পনার ফসল নয়। হরিবংশ, মহাভারত এবং বিবিধ পুরাণ থেকেই সংগৃহীত হয়েছে। প্রতিটি উপাদান। অননুকরণীয় পদ্ধতিতে ব্যাখ্যার কাজটি শুধু নৃসিংহপ্রসাদের নিজস্ব। তাঁর তথ্যের বিপুল সংগ্রহ সম্ভ্রম জাগায়, বিশ্লেষণ করে মুগ্ধ। বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ’-এর মতো এ-গ্রন্থটিও প্রতিটি বাঙালীর অবশ্যপাঠ্য।]

.

স্বৰ্গতপিতৃদেবের উদ্দেশ্যে

রাধাবল্লভরাগভক্তিরসনে ভৃঙ্গায়িতং যম্মানো
নিত্যং শ্রীধরনামি বিগ্রহবরে সেবার্পিতা যত্তনুঃ।
শাস্ত্ৰক্ষীরপয়োধিমন্থনবিধেী দেবায়িতং যেন সঃ
শ্রীরামেশ্বরনাম-মকুলপতি বিয়ং বিন্যাৎ পিতা ॥ ১ ॥
দৃষটা কোপপরীতনেত্ৰযুগলং তস্যাভবিষ্য ভৃশং
গ্রন্থং যমরসিংহকেন রচিতং কৃষ্ণাভিধং ভাষয়া।
সোবক্ষ্যমরতেশ্বরস্য ঘটিতং ধাষ্ট্যেণ সর্বং ত্বয়া
 তত্তস্মৈ জনকায় দত্তমমৃতং কৃষ্ণেতি বর্ণদ্বয়ী ॥ ২॥

রাধাবল্লভকৃষ্ণের রাগানুগ ভক্তিরসের আস্বাদনে যাঁর মন ছিল মধুকরের মত, যাঁর দেহটি সমর্পিত হয়েছিল কুলবিগ্রহ শ্রীধর মহারাজের নিত্যসেবায়, শাস্ত্ররূপ ক্ষীরসমুদ্র মন্থনের ব্যাপারে যিনি ছিলেন দেবতার মত, সেই রামেশ্বর নামে আমার আচার্য এবং পিতা আমার সমস্ত বিঘ্ন নিরসন করুন। ১।

‘কৃষ্ণ’-এই নামে বাংলা ভাষায় লেখা নৃসিংহের গ্রন্থখানি দেখে তাঁর নয়ন দুটি অবশ্যই ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত; তিনি রেগে বলতেন–তুমি ধৃষ্টতাবশত পরম ঈশ্বর কৃষ্ণকে একেবারে সাধারণ মানুষটি করে তুলেছ-অতএব গ্রন্থ নয়, এই গ্রন্থে ব্যবহৃত ‘কৃষ্ণ নাম রূপ অমৃত বর্ণ দুটি শুধু আমার পিতাকে নিবেদন করলাম। ২।

.

গ্রন্থকারের নিবেদন

১৩৯৫ সালের আনন্দবাজার বার্ষিক সংখ্যায় ‘কৃষ্ণ’ প্রবন্ধটি কিঞ্চিৎ সংক্ষিপ্ত আকারে বেরোয়। প্রধানত কৃষ্ণ-জীবনের মূল তথ্যগুলিহি এই প্রবন্ধের উপজীব্য ছিল। এই প্রবন্ধ বেরোনোর পর আমার মনে হতে থাকে যে, একটা ফাঁক রয়ে গেছে। কারণ কৃষ্ণের আত্যন্তিক প্রতিষ্ঠার পর যে মহাভারতের যুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে সেখানে কৃষ্ণের ভূমিকায় একটা সর্বাঙ্গীন প্রেক্ষাপট আছে। তিনি প্রত্যক্ষভাবে মহাভারতের যুদ্ধে অংশ না নিলেও, সেখানে তিনি রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত বড় শক্তি। কৃষ্ণ এবং মহাভারতের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এ কথাটা আমার বার বার মনে হয়েছে যে, মহাভারতের যুদ্ধটা মোটেই কুরু-পাণ্ডবের জ্ঞাতিযুদ্ধ নয়। এর মধ্যে জড়িয়ে আছে অনেক রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ, যা বংশানুক্রমে চলে আসছে এবং এই বংশানুক্রমিক ব্যাপারগুলিই ভারতবর্ষের সমস্ত বিশিষ্ট রাজন্যবর্গকে ভারতযুদ্ধে অংশ নিতে প্ররোচনা যুগিয়েছে। যাই হোক, এই বংশগত সমস্যাগুলি নিয়ে আমি আগে লেখার সুযোগ পাইনি, যদিও সে সুযোগ এল ১৩৯৭ সালে আনন্দবাজার পুজোসংখ্যায় লিখবার সময়। তবে এখানেও একটি সমস্যা ঘটেছে। ভারতযুদ্ধের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ বোঝাবার জন্য আমাকে কিছু পুরানো কথা বলতে হয়েছে, যা আমার পূর্ববর্তী কৃষ্ণ প্রবন্ধটিতে ছিল। আমি দুটি প্রবন্ধ এক জায়গায় মিলিয়ে-মিশিয়ে একত্রে গ্রন্থনা করে দিতে পারলাম না বলে সহৃদয় পাঠক আমাকে ক্ষমা করবেন।

নিবেদন শেষ করার আগে আরও কটি কথা বলা প্রয়োজন। আনন্দবাজার বার্ষিক সংখ্যায় (১৩৯৫) কৃষ্ণ প্রবন্ধটি বেরোনোর পর প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রীরমাপদ চৌধুরীমশাই, যিনি উক্ত বার্ষিক সংখ্যার সম্পাদকও বটে, আমাকে জানান যে, প্রবন্ধটি গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। আমি যথারীতি প্রকাশকের প্রশ্ন তুলি। রমাপদবাবু বললেন–প্রকাশনার ভার নেবে স্বয়ং আনন্দ প্রকাশন সংস্থা। আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠি, কারণ এর থেকে আনন্দজনক প্রস্তাব একজন লেখকের পক্ষে আর কিই বা হতে পারে? রমাপদবাবুর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করার কোন মানে হয় না। এই জন্যে যে, যা কিছু আমি আজ পর্যন্ত বাংলায় লিখেছি, তার মূলেই তিনি। প্রথম যখন আমি লিখতে আরম্ভ করি, তখন কোনদিন এই বিশিষ্ট মানুষটির কাছে আমার কোন লেখার প্রশংসা শুনিনি, কিন্তু আমার ব্যাপারে যে তাঁর প্রশ্রয় ছিল, সে আমি বেশ বুঝতে পারতাম। এতে লাভ হয়েছে এই যে, আরও ভাল করে লিখতে হবে–এই তাগিদটা আমার দিক থেকে বেড়েছে, যদিও তা পারছি কিনা তা পাঠকের বিচার্য বিষয়। কৃষ্ণ এবং ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ’-এই দুটি প্রবন্ধ বেরোনোর পর অনন্যরা যে প্রশংসা করেছেন, সেগুলি রমাপদবাবুর মুখ দিয়ে একযোগে শোনার সৌভাগ্য হয়। ধরে নিই, এই প্রশংসার সঙ্গে রমাপদবাবুরও অন্তরের সায় আছে। আমার লেখার জগতে অভিভাবকের মত এই মানুষটিকে শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ছোট করি কি করে?

আমার লেখার আরেক প্রণয়ী– কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান শ্ৰীপ্রবালকুমার সেন। পড়শুনোর ক্ষেত্রে তিনি আমার অধ্যাপক হলেও ব্যবহারে আমার বন্ধুতুল্য। তাঁর বহুজ্ঞতা বারে বারেই আমার লেখার মধ্যে অন্তঃসলিলা ফন্ধুর মত ঢুকে পড়েছে এবং এমনভাবেই তা ঢুকেছে যে, আমার ব্যবহৃত শব্দের বালি না সরালে সে ধারাস্রোত খুঁজে বার করা কঠিন। তাঁর কাছে আমি চিরঋণী।

শ্রদ্ধেয়া সুকুমারী ভট্টাচার্য আমার দিদির মত। তাঁর অধীনেই আমি ‘কৃষ্ণ’ বিষয়ে গবেষণা করি। গবেষণা কর্মে দৃষ্টি প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা যে আমার জীবনে কত বড়, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। তাঁর সঙ্গে সর্ব বিষয়ে আমার মত মেলে না, বিশেষত এই প্রবন্ধের ক্ষেত্রে তো মেলেই না; তবু আমি জানি নিশ্চয় জানি যে, তিনি তাবৎ অধ্যাপক-অধ্যাপিকা-কুলের সেই বিভাগে পড়েন না, যাঁরা মতে মত না মিলালেই ক্ষিপ্ত হন। এই প্রবন্ধ দুটির পরম্পরায় কোথাও যদি তাঁর প্রতি অবাধ্যতা থাকে, তবে সেটা তাঁর প্রশ্রয় এবং দৃষ্টিভঙ্গীর ঔদার্যের জন্যই হয়েছে, কারণ তিনি কোনদিন আমাকে ধুয়া ধরতে শেখাননি কিংবা পায়ের নূপুরের মত বাজতে বলেননি।

আজ এই গ্রন্থ-প্রকাশনার সময়ে স্বর্গত জনক-জননী এবং অগ্রজের কথা মনে পড়ছে। বেঁচে থাকলে আজকে তাঁরা বড় খুশি হতেন। গ্রন্থরচনার ক্ষেত্রে আমার প্রথম এবং প্রধান প্রেরণা হলেন আমার স্ত্রী সুষমা। অবশ্য গ্রন্থরচনার কথাটা ভুল বলা হল। সংস্কৃতের লোকমাত্রেই বাংলাভাষার প্রতি কিঞ্চিৎ উন্নাসিকতা থাকে, যদিও ইংরেজী ভাষার ক্ষেত্রে তা থাকে না। স্বনামধন্য আচার্যদের আশীর্বাদে আমারও প্রায় সেই অবস্থাই হয়েছিল। ঠিক এই রকম একটা অবস্থায় আমাকে যিনি হাতে ধরে বাংলা সাহিত্যের জগতে প্রবেশ করান, তিনি আমার স্ত্রী। এদিক দিয়ে আমি তাঁকে আমার গুরু বলেই স্বীকার করি। আধুনিক কালের তাবৎ সাহিত্যিকদের গ্রন্থগুলির সঙ্গে আমার পরিচয় আমার স্ত্রীর সূত্রেই এবং আমি যে প্রথম প্রবন্ধটি আনন্দবাজারের রবিবাসরীয়তে দিয়ে এসেছিলাম, তাও তাঁরই সঙ্গে বাদানুবাদের ফলে। এই আরেক মানুষ, যিনি এখনও পর্যন্ত আমার কোন লেখা ভাল বলেন না এবং খালি ভাল ভাল লেখাগুলি পড়ে শিক্ষা নিতে বলেন। এই বিধানে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শুধু পড়ে যাওয়ারই আশঙ্কা থাকায় দাম্পত্য কলহের সুযোগ নিই এবং লিখতে আরম্ভ করি। আশা করি এই প্রকাশনা তাঁর বিষাদে কিঞ্চিৎ হরিষ তৈরি করতে পারে। একেবারে সাংসারিক পাঁচালি হলেও আরও দুজনের কাছে আমার ঋণ স্বীকার করতেই হবে। একজন আমার অগ্রজ, অজিতকুমার ভাদুড়ী, যিনি সাংসারিক কাজে আমাকে নানাভাবে অব্যাহতি দিয়ে গ্রন্থরচনার পথ সুগম করেছেন। দ্বিতীয়জন সেই একাদশবর্ষীয় অকালপক্ক ধৈর্যশীল বালক, যে ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমার পুত্ররূপে পরিচিত। সে এই বয়সেই মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে এই তর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে যে, ছাপার অক্ষরে বাবার নাম বেরোন মানেই ‘বাবা’ মানুষ হয়েছে।

আনন্দ প্রকাশন সংস্থার তরফে শ্ৰীবাদল বসু মহাশয় এই গ্রন্থ প্রকাশনার সমস্ত দায়িত্ব বহন করছেন, তাঁকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

.

কথামুখ

যে কালে মানুষ হিসেবে কৃষ্ণকে সবাই এক ডাকে চিনত, সেই প্রাচীন কালেই তাঁকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বহুবার। তাঁর দিকে তর্জনী তুলে পূর্বপক্ষ বলেছে–তুমি তোমার মামাকে মেরেছ, তুমি সরলা গোপরমণীদের মনে প্রেমের লালসা জাগিয়ে শেষে নিজেই পালিয়েছ, পরস্ত্রী-রমণের মত গর্হিত কাজও তুমি অনায়াসে এবং নির্দ্বিধায় সম্পন্ন করেছ। ব্যক্তিগত চরিত্রের এইসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়াও কৃষ্ণের জীবৎকালে যে যুদ্ধবিগ্রহগুলি চলেছে, এবং যেগুলিতে তিনি প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন, সেগুলিতে তৎকালীন যুদ্ধরীতি এবং নীতি অনেক সময়েই মানা হয়নি। মানা হয়নি কৃষ্ণের জন্যই। তিনিই অনেক জায়গায় সহায়ক পক্ষকে এমন উপদেশ দিয়েছেন, যাতে সমালোচকেরা তাঁর দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে তাঁকেই দায়ী করতে পারেন।

কৃষ্ণের বিরুদ্ধে এই সব তিক্ত প্রশ্ন মহাভারতের মধ্যেই উঠেছে। প্রশ্ন তুলেছেন তাঁর সমসাময়িক মানুষেরা, যাঁরা তাঁর বিপক্ষে ছিলেন, যেমন শিশুপাল, জরাসন্ধ, দুযযাধন এবং আরও অনেকেই। সম্পূর্ণ ভারতযুদ্ধের দায়ও বর্তেছে তাঁরই ওপর এবং তার জন্য তাঁকে অভিশাপ গ্রহণ করতে হয়েছে গান্ধারীর কাছ থেকে। পৌরাণিকেরা আবার তাঁর ব্যক্তিজীবনের নারীঘটিত কলঙ্কগুলির সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন কারও মারফত এবং অবশ্যই তার সমাধান এসেছে কৃষ্ণের ভগবত্তার পথ ধরে। অর্থাৎ কিনা সর্ব শক্তিমান ভগবান যা করতে পারেন, অন্য সাধারণ মানুষ তা পারে না। সাধারণে যদি এমনটি করেও, তা হবে–শিব ছাড়া অন্য কারও পক্ষে সমুদ্রমথিত বিষ খাওয়ার শামিল। পৌরাণিকেরা তাই বলেছেন–বড় মানুষেরা যা বলেন তাই কর, যা করেন তাই করতে যেও না–তেষাং যৎ স্বচোযুক্তং বুদ্ধিমাংশুৎসমাচরেৎ। শুধু পৌরাণিক কেন, বৈদিক মীমাংসক কুমারিল ভট্ট পর্যন্ত তাঁর তন্ত্রবাৰ্ত্তিকে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের মদ্যপান নিয়ে ব্যতিবান্ত হয়েছেন। আকুল হয়েছেন এই প্রশ্নেও যে কৌলিক সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণ রুক্মিণীকে বিয়ে করেছেন এবং অর্জুন তাঁর মামাতো বোন সুভদ্রাকে বিয়ে করেছেন কি করে?

এ সব প্রশ্ন সমাধানের সময় কুমারিলকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হয়েছে যে ক্ষত্রিয় রাজপুরুষেরা যদি একটু গৌড়ী কিংবা মাধ্বীমাকা সুরা পান করেন তাতে দোষ কি, ওসব বারণ ব্রাহ্মণদের বেলায়। আবার অর্জুনের মামাতো বোন বিয়ে করার সময় কুমারিলের যুক্তি হল-সুভদ্রা যদিও কৃষ্ণের বোন বলেই প্রসিদ্ধ, তবু এদের সম্বন্ধ বিচার করলে দেখা যাবে তিনি সরাসরি কৃষ্ণের বোন নন। বোন হলে অর্জুনের দোষ হত ঠিকই, কিন্তু কৃষ্ণের সম্বন্ধটাই যেখানে দূরে সরে যাচ্ছে সেখানে অর্জুনের দিক থেকে কি অসুবিধে আছে

বাসুদেবাজায়া চ কৌন্তেয়স্য বিরুধ্যতে।
ন তু ব্যবেতসম্বন্ধমভবে তদ্বিরুদ্ধতা ॥

ঠিক এমনি করেই যোগ খুঁজলে রুক্মিণীর পিতা ভীষ্মকের সঙ্গেও কৃষ্ণের কৌলিক যোগ আছে, কিন্তু যেহেতু সে সম্বন্ধ দূরগত, অতএব কৃষ্ণের দোষ কি আছে? কুমারিল কিন্তু সর্বশেষে সেই ভগবত্তার পথই প্রায় ধরেছেন। তিনি কৃষ্ণের জবানীতে ভগবদ্গীতার শ্লোক উদ্ধার করেছেন প্রথমে। শ্লোকে বলা হয়েছে–অর্জুন, আমার নির্দিষ্ট পথ সাধারণ মানুষেরা সবাই অনুসরণ করবে, কেননা শ্রেষ্ঠ পুরুষেরা যা আচরণ করেন, সাধারণ মানুষের কাছে সেইটাই প্রমাণ বলে গণ্য হয়, তারা সেই পুরুষকে অনুসরণও করে। এই শ্লোক বলেই কুমারিল বললেন–যে কৃষ্ণ সমস্ত লোকের আদর্শস্বরূপ, তিনি সমাজবিরুদ্ধ আচরণ করবেন কি করে–স কথং সর্বলোকাদর্শভূতঃ সন্ বিরুদ্ধাচারং প্রবর্তিষ্যতি? অতএব রুক্মিণীকে বিয়ে করে তিনি কোনই অসামাজিক আচরণ করেননি।

ভাল কথা। কিন্তু এই মদ্যপান আর রুক্মিণীহরণ ছাড়াও কৃষ্ণজীবনে আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে যা তর্কের যুক্তিতে প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে এবং ভট্ট কুমারিল নিজে ক্ষুরধার তার্কিক হওয়া সত্ত্বেও সেসব তর্কের ধার মাড়াননি, কেননা সেটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বস্তুত আমরাও সে ধারে যাব না; তার কারণ এই নয় যে আমরাও কুমারিলের বুদ্ধিমত্তার অনুবর্তী; তার কারণ এই যে, কৃষ্ণ চরিত্রের নীতি-যুক্তি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আরম্ভ করে অশোেক রুদ্র, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল পর্যন্ত বহু পণ্ডিত-গবেষক এই বিষয়ে কলম ধরেছেন এবং আমরা বলব-নান্তং জগাম, এখনও তর্কের অবকাশ আছে।

আমার বক্তব্য খুব অল্প। ভগবত্তা দিয়ে কৃষ্ণের সামাজিক কলঙ্কমোচনের গুরুদায়িত্ব আমার নেই; এমনকি বিভিন্ন বিপন্ন মুহূর্তে তিনি ঠিক কাজ করেছেন না বেঠিক–তা নির্ণয় করাও আমার দায়িত্ব নয়। আমি শুধু বলতে চাই তিনি যা করেছেন, তার একটা পরম্পরা আছে। কৃষ্ণ যখন জন্মেছিলেন, সেই সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁর অনুকূল ছিল না। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রায় পুরোটাই ছিল পূর্ব-মধ্য ভারতীয়দের দখলে, যার প্রধান পুরুষেরা ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ, চেদিরাজ শিশুপাল এবং পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব। কৃষ্ণের মামা কংস ছিলেন জরাসন্ধের জামাই এবং তিনি মগধরাজ জরাসন্ধের প্রতিনিধিমাত্র ছিলেন মথুরায়। জরাসন্ধই ছিলেন শ্রেষ্ঠতম এবং সমগ্র রাজমণ্ডল তাঁর কথায় উঠত বসত।

এইরকম একটা বিরুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে রাজনীতির খেলাটা সম্পূর্ণ নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার সম্পূর্ণ কৃতিত্বটাই কৃষ্ণের। তিনি কাজ আরম্ভ করেন আঁর অত্যাচারী মাতুলকে মেরে এবং কাজ শেষ করেন ভারতযুদ্ধে উত্তরভারতের কর্তৃত্ব কায়েম করে। কাজটা সহজ ছিল না এবং যে অস্বাভাবিক দ্রুততায় তিনি এই কাজ সম্পন্ন করেছেন, তার জন্য ছলনা এবং কৌশলের আশ্রয় নেওয়া ছিল স্বাভাবিক। কোথাও তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবে এই ছলনা করেছেন, কোথাও অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন। কিন্তু যে দ্রুততায় তিনি তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধি ঘটিয়েছেন, তা প্রায় অলৌকিকতার পর্যায়ে পড়ে এবং সেই জন্যেই ভগবান হতে তাঁর দেরী লাগেনি হয়তো। মহাভারতের সভাপর্বে জরাসন্ধ বধের পর যুধিষ্ঠিরের যে রাজসূয় যজ্ঞ হল, তার একটা রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে। পূর্বতন প্রধানপুরুষ জরাসন্ধ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটল, তাতে প্রধান পুরুষ বলে কে গণ্য হবেন সেই বিতর্কই ছিল যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের বিষয়। তর্কটা অস্বাভাবিক; কেননা অন্য ক্ষেত্রে, অন্য সময়ে যিনি রাজসূয় যজ্ঞ করেন তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হন। কিন্তু এখানে রাজসূয় হবার পরেই যুধিষ্ঠির প্রকাশ্য রাজসভায় ঘোষণা করলেনকৃষ্ণ! তোমার জন্যেই এই পৃথিবী আজ আমার বশে এসেছে—ত্বৎকৃতে পৃথিবী সর্বা মদ্‌শে কৃষ্ণ বৰ্ত্ততে। তোমার জন্যেই আজকে আমার এত টাকা-পয়সা, এত উন্নতি-ধনঞ্চ বহু বায়ে ত্বপ্রসাদা উপার্জিত।

স্বয়ং রাজসূয়ের অধিকতর এই আত্মনিবেদন এমনি এমনি নয়। সমস্ত রাজমণ্ডল রাজসূয় যজ্ঞে দীক্ষিত নৃপতির সভায় উপস্থিত হন। তাদের সবার সামনে পালাবদলের নায়ককে যদি সর্বসম্মতভাবে উপস্থিত করা যায়, তার রাজনৈতিক মূল্য অন্যরকম। সভায় এসে যুধিষ্ঠির কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মকে কিছুই না জানার ভান করে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনি একটি মাত্র লোকের নাম বলুন, যাঁকে আমি রাজয়ের অর্ঘ্য দান করতে পারি। বহুদিনের বিরাট রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় ভীষ্ম অনুভব করেছিলেন যুধিষ্ঠিরের মনের বাসনা কি? দ্বিতীয়ত জরাসন্ধহস্তাকে তিনি নতুন দিনের নায়ক হিসেবে চিহ্নিত করতে কোন কুণ্ঠা বোধ করেননি। তিনি বললেন–সত্যিই তো কৃষ্ণের দ্বারাই এ সভার মুখ উজ্জ্বল হয়েছে, তাঁর জন্যেই এ সভা আজ আহ্লাদিত।

কিন্তু অভিজ্ঞ বৃদ্ধের এই সিদ্ধান্ত সভার অন্য রাজারা কেউই মেনে নিতে পারেননি। জরাসন্ধ মারা যাবার কয়েক মাসের মধ্যেই অল্পবয়সী নতুন নায়কের এই নির্বাচন প্রতিষ্ঠিত রাজারা মেনে নিতে পারেননি। প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠলেন জরাসন্ধের ভাবশিষ্য শিশুপাল। প্রতিবাদের কারণও ছিল। যাঁরা কৃষ্ণের শত্রুপক্ষ তাঁদেরকে নেমন্তন্ন করে সভায় ডেকে এনে তাঁদেরই সামনে তাঁদের চিরশত্রুকে যদি সম্মানের মালা দেওয়া হয়, তা তাঁদের সইবে কেন? শিশুপাল তাই বলেছেন–এ তত ডেকে এনে অপমান–কিং রাজভিঃ ইহানীতে রবমানায় ভারত। মনে রাখবেন, আমরা কেউ কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠিরের ভয়ে, কিংবা তাঁর কাছ থেকে কিছু পাবার লোভে অথবা সান্ত্বনার জন্য তাকে রাজকর দিতে আসিনি; ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধর্মসাধক রাজসূয় যজ্ঞ করছেন, তাই রাজকর দিতে এসেছি তাঁকে। কিন্তু তিনি আমাদের অপমান করছেন।

কথাগুলি রাজসূয় যজ্ঞে দীক্ষিত ব্যক্তির কাছে উপাদেয় নয়, কারণ চতুর্দিক জয় করেই না রাজসূয় যজ্ঞ। কিন্তু শিশুপাল তাঁর প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছেন–তাই নয় শুধু। কৃষ্ণকে বিশেষ সম্মান দেখানোর উপযুক্ত যোগ্যতা কৃষ্ণের আছে কিনা সেটা নির্ধারণ করাও শিশুপালের লক্ষ্য ছিল। শিশুপাল বললেন–যদি মনে করেন বৃদ্ধ স্থবিরকে সম্মান দেখানো উচিত, তাহলে কৃষ্ণ কেন, তার বাবা বসুদেবকে আপনি অর্ঘ্যদান করুন। যদি মনে করেন বাসুদেব কৃষ্ণ আপনার হিতৈষী এবং অনুবর্তী, তাহলে এই হিতৈষিতা কিংবা অনুবর্তিতার জন্য আপনি আপনার শ্বশুর দ্রুপদকে বেছে নিন, কৃষ্ণ কেন? যদি মনে করেন কৃষ্ণ আপনার কাছে আচার্যের মত, তাহলেই বা কৃষ্ণ কেন, আপনি দ্রোণাচার্যকে অর্ঘ্যদান করুন। যদি মনে করেন কৃষ্ণ একেবারে বেদজ্ঞ পুরুষ, ঋত্বিক–তাহলেই বা তিনি কেন, মহর্ষি দ্বৈপায়নের মত মহামতি পুরুষ আপনার সভাতেই উপস্থিত, আপনি তাঁকে নির্বাচন করুন। যদি এদেরও পছন্দ না হয়, তাহলে স্বয়ং ভীষ্ম আছেন, দুর্যোধন আছেন, অশ্বথামা আছেন, কৃপ আছেন, মহারাজ পাণ্ডুর সমকক্ষ সম্মানী পুরুষ ভীষ্মক আছেন, শল্য, কর্ণকে নেই? আপনি আর লোক পেলেন না, এদের ছেড়ে আপনি অর্ঘ্যদানের জন্য এমন একটা মানুষ বেছে নিলেন, যিনি ঋত্বিকও নন, আচার্যও নন, রাজাও নন-নৈব ঋত্বিক ন চাচাযো ন রাজা মধুসূদনঃ।

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ করে যখন কৃষ্ণের অভ্যুদয় হল, তখন শিশুপাল বা তাঁর মত প্রতিষ্ঠিত নৃপতিদের দিক থেকে আক্রমণের এই ভাষাগুলি মনে রাখতে হবে। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও যে কারণে কৃষ্ণকে রাজসূয় যজ্ঞের অর্ঘ্যদান করা হল, আমার মত ক্ষুদ্রবুদ্ধি লোকের কৃষ্ণ নিয়ে বই লেখার কারণও সেইটাই।

শিশুপালের কথা শোনার পর যুধিষ্ঠির মিনমিন করে বলেছিলেন–দেখ শিশুপাল! তোমার থেকেও বয়সে এবং অভিজ্ঞতায় বড় মানুষেরা আমার অর্ঘ্যদান প্রস্তাব মেনে নিয়েছেন, তুমিও মেনে নাও-মৃশ্যন্তি চাহণং কৃষ্ণে তদ্বৎ ত্বং ক্ষন্তুমহসি। কিন্তু মহামতি ভীষ্ম দেখলেন, তিনিও এই প্রস্তাবের সঙ্গে জড়িত, অতএব কুলবৃদ্ধ হিসেবে উত্তরটা তাঁরই দেওয়া উচিত। ভীষ্মের বক্তব্যে সার কথা যা ছিল, তা হল-যুদ্ধের সময় যে ক্ষত্রিয় অন্য ক্ষত্রিয়কে জিতে নেয়, তাকে নিজের বশীভূত করে ছেড়ে দেয়, সেই ক্ষত্রিয় বিজিত ক্ষত্রিয়ের গুরুর মত। ভীষ্ম বললেন, এই বিরাট রাজসভায় একটি রাজাও নেই, যে কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হয়নি। নিখিল ক্ষত্রিয়কুল তাঁর বাহুর শক্তি বুঝে নিয়েছে এবং সেই কারণেই সমস্ত পৃথিবী এখন কৃষ্ণেই প্রতিষ্ঠিত। ঠিক এই কারণেই হাজারো বৃদ্ধ মানুষ এই রাজসভায় থাকতেও কৃষ্ণকেই আমাদের সম্মান দেখানো উচিত। ভীষ্ম যেন এবার একটু রেগেই গেলেন–শিশুপালের বলা ‘ঋত্বিক’, ‘আচার্য এসব খোঁটা তাঁর মনে আছে। তিনি বললেন-”ওইসব জ্ঞানবৃদ্ধ-টুদ্ধ আমি অনেক দেখেছি জীবনে-জ্ঞানবৃদ্ধা ময়া রাজন্ বহবঃ পর্যপাসিতা, কিন্তু তাঁদের কাছেও তো আমি এই কৃষ্ণের জয়গানই শুনেছি। তাছাড়া যদি বলকৃষ্ণ এখনও বাচ্চা ছেলে, কিন্তু সেও তো অপরীক্ষিত নয়। শৌর্য, বীর্য, কীর্তি এবং সংগ্রামে তাঁর জয়ের লিষ্টি তো আমরা যাচাই করেছি, তারপরেই না তাঁকে সম্মান দেবার প্রশ্ন এসেছে-যশঃ শৌর্যং জয়ঞ্চাস্য বিজ্ঞায়াচ্চাং প্রযুজমহে। ন চ কশ্চিদিহাম্মাভিঃ সুবালো’ প্যপরীক্ষিতঃ। মহান বৃদ্ধদের অতিক্রম করেও যে অল্পবয়সী কৃষ্ণকে আজকের দিনের নায়ক সাজিয়েছি, তার কারণ এইটাই। একটি রাজনৈতিক সভায় শিশুপাল যে প্রশ্ন তুলেছেন, ভীষ্ম তার মোকাবিলা করেছেন রাজনৈতিকভাবে।

ভীষ্ম এবার সিদ্ধান্তে আসছেন। তিনি বললেন–ব্রাহ্মণদের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, ক্ষত্রিয়দের মধ্যে সবচেয়ে বলবান যিনি, বৈশ্যদের মধ্যে যাঁর বেশি টাকাপয়সা আছে, আর শূদ্রদের মধ্যে যিনি বয়োবৃদ্ধ–তিনিই সম্মানের যোগ্য। কিন্তু কৃষ্ণকে আমরা অর্ঘ্য বাড়িয়ে দিয়েছি দুটো কারণে–হেতু দ্বাপি সংস্থিতৌ। এক, তিনি বেদবেদাঙ্গ জানেন ব্রাহ্মণের মত। দ্বিতীয়, তিনি সর্বাধিক বলশালী। কাজেই এই দুই বিষয়েই কৃষ্ণর মত মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই বলেই আজকে তাঁকে পুজো করছিমৃণাং লোকে হি কো’ ন্যোস্তি বিশিষ্টঃ কেশবাদৃত।

ভীষ্মের এই বিশ্লেষণটি আমার কাছে খুবই মূল্যবান। এই ক্ষুদ্র-পরিসর গ্রন্থে আমি শুধু দেখাবার চেষ্টা করেছি কি করে আস্তে আস্তে কৃষ্ণ নামে এই বিস্ময় বালকটি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইতে একেবারে সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করেছেন। রাজসূয় যজ্ঞের শেষে খাতায় কলমে ক্ষমতা এসেছে যুধিষ্ঠিরের হাতে, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত ছিল কৃষ্ণের হাতেই। পরবর্তীকালে এই ক্ষমতা আরও বেড়েছে, যার পরিণতি কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ক্ষত্রিয়কুলের প্রধান অর্জুনের তিনি রাজনৈতিক সারথি। মনে রাখা দরকার তখনকার দিনে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব লাভ করতে গেলে শুধুমাত্র একটার পর একটা যুদ্ধ জয় করলেই হত না। ছলে হোক, আর বলে হোক যুদ্ধ জয় তো করতে হবেই, কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে হলে আরও একটি জিনিসের প্রয়োজন হত–সেটি হল ব্রাহ্মণদের স্যাংসন।

কৃষ্ণ যে এ ব্যাপারে যথেষ্ট উদ্যোগী ছিলেন, তা ভীষ্মের ভাষ্য-বিশ্লেষণেই প্রমাণিত। আমি নিজে এই গ্রন্থের মধ্যে এ দিকটায় খুব একটা নজর দিইনি। তবে দু-একটা কথা এখানে অবশ্যই বলা উচিত। বস্তুত ‘গোব্ৰাহ্মণের হিতৈষী বলে কৃষ্ণের যে উপাধি জুটেছে, তা বিনা কারণে নয়। প্রথম জীবনে সান্দীপনি মুনির আশ্রমে শিক্ষা নেওয়া ছাড়াও ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সব সময়েই তিনি যোগাযোগ রাখতেন, পারলে তাঁদের উপকারও করতেন। সেকালে কখনও কোন রাজা নানা কারণে অত্যাচারী বলে প্রমাণিত হতেন, এবং অহংকারবশে কখনও না কখনও ব্রাহ্মণদের অপমানও করে ফেলতেন। সেই অত্যাচারী রাজা যখন যুদ্ধে মারা পড়তেন, তখন ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই অনুকূল হয়ে পড়তেন বিজয়ী রাজার। কৃষ্ণের জীবনে এ ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কংস জরাসন্ধরা মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণেরা অনেকেই যে কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে স্বস্তিবাচন করেছেন, সে প্রমাণ তো আছেই-তত্রৈনং নাগরাঃ সর্বে সকারেণাভ্যন্তদা। ব্রাহ্মণপ্রমুখ রাজন্ বিধিদৃষ্টেন কমণা ॥

এ তো গেল ব্রাহ্মণের নিজস্ব প্রতিক্রিয়া। কিন্তু প্রয়োজন পড়লে কৃষ্ণ যে কত সুচারুভাবে ব্রাহ্মণদের তোষণ করতে পারতেন, তার সবচে বড় প্রমাণ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ। দায়িত্বপূর্ণ হাজারো কাজ থাকা সত্ত্বেও তিনি আমন্ত্রিত ব্রাহ্মণদের পা ধুইয়ে দেওয়ার কাজ নিলেন–চরণক্ষালনে কৃষ্ণো ব্রাহ্মণানাং স্বয়ং হ্যভৃৎ। কাজটা সহজ ছিল না, অতগুলি লোকের সামনে জরাসন্ধজেতা পুরুষটি যদি ব্রাহ্মণের পদসেবা করেন, ব্রাহ্মণদের কাছে তার আলাদা মূল্য আছে এবং সে মূল্য ব্রাহ্মণদের তুষ্টি।

প্রণিধান করে মহাভারত পড়লে দেখা যাবে কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবনে আরও একটা সুবিধে ছিলেন যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির নিজে ক্ষত্রিয় হওয়া সত্ত্বেও তাঁর আচার-ব্যবহার সবই ব্রাহ্মণের মত ছিল–এ কথা মহাভারতেই বহুবার বলা আছে। বিশেষত ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল নিবিড়। জীবনের বহু অমূল্য সময় তাঁকে বনে বনান্তর ঘুরতে হয়েছে বলে এই যোগাযোগ আরও বেড়েছিল। কৌরবেরা যখন পাণ্ডবদের কপট-পাশায় হারিয়ে বনে পাঠালেন, তখন পাণ্ডবদের, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের এই বিপদকে, নিকট স্বজনের বিপদ বলেই গণ্য করেছেন ব্রাহ্মণেরা। যুধিষ্ঠিরের প্রতি ব্রাহ্মণদের এই সহানুভূতি আখেরে কৃষ্ণেরই কাজে দিয়েছে।

মহাভারতের বনপর্বে পাণ্ডবেরা যখন দ্বৈতবনে প্রবেশ করেছেন, তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠির প্রায় সব সম্প্রদায়ী ব্রাহ্মণদের সহানুভূতি লাভ করেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, ভৃগু, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ, কশ্যপ, অগস্ত্য, অত্রি–এই সব নামী-দামী ব্রাহ্মণ-গোত্ৰীয়েরা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, যার ‘নিট’ ফল একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মত। এই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সম্মেলনে দালভ্য মুনি বক একটি সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করেন। তাতে বোঝ যাবে-সেকালের যে কোন রাজনৈতিক পালাবদলের সময়ে ব্রাহ্মণ্য সমর্থন কত জরুরী ছিল। বক দালভ্য যুধিষ্ঠিরকে বললেন

সমস্ত সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণেরা এখানে আপনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে-ব্রাহ্মণাঃ সঙ্গতাঃ ত্বয়া। আপনি মনে রাখবেন, হাওয়া পেলে আগুন যেমন সমস্ত বন পুড়িয়ে ছাড়ে, তেমনি ব্রাহ্মণদের তেজ যদি ক্ষত্রিয়ের শক্তির সঙ্গে মেলে, তাহলে সমস্ত শকুল ধ্বংস করে ছাড়ে। ব্রাহ্মণদের বাদ দিয়ে কোন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বর্তমান জগৎ বশে আনা সম্ভব নয়, পরলোকের কথা নাই বা বললাম। হাতাঁকে অঙ্কুশ মারলে যেমন তার শক্তি কমে যায়, তেমনি যুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণদের সমর্থনহীন ক্ষত্রিয়েরাও বলহীন হয়ে পড়ে। ব্রাহ্মণদের কৃপাদৃষ্টি আর ক্ষত্রিয়ের তেজ–এই দুটো এক জায়গায় মিললেই আপনি স্বচ্ছন্দে সব করতে পারেন। আমি আবার সেই হাওয়ার তুলনা দিচ্ছি মহারাজ! লেলিহান আগুন যেমন উপযুক্ত হাওয়া পেলে দাহ্য বস্তু অবশ্যই দগ্ধ করে, তেমনি ব্রাহ্মণদের সহায় পেলে শত্রু জয় করা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে কিছুই নয়-তথা দহতি রাজন্যো ব্রাহ্মণেন সমং রিপুম।

এই বক্তৃতা করে বক দালভ্য যুধিষ্ঠিরকে বললেন–আপনি মহারাজ, চিরকাল ব্রাহ্মণদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেছেন-ব্রাহ্মণেমূত্তমা বৃত্তিস্তব.নিত্যং যুধিষ্ঠির–অর্থাৎ কিনা আপনার কি চিন্তা আছে? এই কথার পরে সমবেত ঋষিরা, যাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই অত্যন্ত নামী, তাঁরা প্রত্যেকেই সম্পূর্ণ সমর্থন জানালেন যুধিষ্ঠিরকে। মহাভারতকার এদের নাম জানিয়েছেন এবং বলেছেন ব্রাহ্মণেরা এখানে সবাই যুধিষ্ঠিরকে স্তব করলেন রীতিমত–স্কৃয়মানে যুধিষ্ঠিরে, তাঁরা রীতিমত পূজা বন্দনা করলেন যুধিষ্ঠিরকে–অজাতশত্রুমানéঃ।

দ্বৈতবনের পত্রচ্ছায়ায় এই যে ব্রাহ্মণ্যবাজণ্যের সম্মেলন হয়ে গেল, তার রাজনৈতিক ফল সুদূরপ্রসারী এবং সে ফল কাজে লাগিয়েছেন কৃষ্ণ। তিনি যুধিষ্ঠিরকে সামনে রেখে রাজনীতির সমস্ত কল্প একে একে প্রয়োগ করেছেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত। বলা বাহুল্য কৃষ্ণের আপন ছেলে-পিলেরাই ব্রাহ্মণ্যশক্তি হাতে রাখার গুরুত্ব বুঝতে পারেনি, যার ফল মৌষল পর্ব, যদুবংশ ধ্বংস কারণে অকারণে কৃষ্ণ যে কতখানি ব্রাহ্মণদের হাতে রেখে চলতেন তার একটা বড় উদাহরণ পাওয়া যাবে ভীমের ছেলে ঘটোৎকচ মারা যাবার পর।

ভীমের ছেলে ঘটোৎকচ যখন কর্ণের একাঘী বাণের আঘাতে যুদ্ধক্ষেত্রে ধরাশায়ী হলেন, তখন পাণ্ডব শিবিরে শোকের ছায়া নেমে এল। সমস্ত পাণ্ডবেরা যখন শোকে অধীর, তখন দেখা গেল কৃষ্ণ উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন। তাঁর এই অকারণ এবং অন্যায় আনন্দ দেখে অর্জুন পর্যন্ত হকচকিয়ে গেলেন এবং তাঁর আনন্দের কারণও জিজ্ঞাসা করলেন। কৃষ্ণের মুখ থেকে প্রথম কারণ যা জানা গেল–তা হল, কবচ-কুণ্ডল হারিয়ে কর্ণ ইন্দ্রের কাছ থেকে পেয়েছিলেন একাঘী শক্তি, যা পঞ্চ পাণ্ডবের একজনকে মারবেই। আর মারবে যখন, সে তো আর নকুল, সহদেবকে মারবে না, মারবে অর্জুনকেই। কৃষ্ণই ঘটোৎকচকে অতিযুদ্ধে তাতিয়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য সযত সঞ্চিত একাগ্নী খরচ করতে হল কর্ণকে, ঘটোৎকচকে মারবার জন্য। এতে প্রিয়সখা অর্জুন বেঁচে গেলেন, তাই কৃষ্ণের নাকি আনন্দ।

বেশ। একথাটা বেশ বোঝা গেল। কিন্তু এরপর কৃষ্ণ একে একে প্রকাশ করতে থাকলেন তাঁর পূর্ব কৌশলগুলি, যার জোরে তিনি অর্জুনকে নানা বিপদে রক্ষা করেছেন। এ কথাগুলিও বোঝর অসুবিধে নেই। কিন্তু একেবারে শেষে কৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন-দেখ অর্জন, এই যে হিড়িম্ব, বক রাক্ষস, কিমীর-এরা সবাই প্রায় ত্রেতা যুগের রাবণের মত রাক্ষস। এরা ব্রাহ্মণদ্রোহী এবং যজ্ঞবিদ্বেষী। এদের সবাইকে মধ্যম পান্ডব ভীম সাবাড় করে দিয়েছেন। বাকী ছিল এক অলায়ুধ রাক্ষস, সে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছিল। রাক্ষস দিয়েই রাক্ষস মারিয়েছি, ঘটোক্কচ তাকে মেরেছে। এবার স্বয়ং ঘটোৎকচকে তাতিয়ে দিয়ে কর্ণের সামনে ফেলেছি, যাতে সেই তাকে বধ করে-হৈড়িম্ব স্টাপ্যপায়েন শক্ত্যা কর্ণেন ঘাতিতঃ। কেন জান অর্জুন? ঘটোৎকচ ছিল ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধাচারী এবং যজ্ঞদ্বেষী রাক্ষস–এষ হি ব্রাহ্মণদ্বেষী যজ্ঞদ্বেষী চ রাক্ষসঃ! সে পাপী ধর্মকর্মের লোপ ঘটাত, তাই কায়দা করে কর্ণের সামনে অতিযুদ্ধরত অবস্থায় ফেলে তাকে মারিয়েছি। বস্তুত কর্ণ যদি তার অমোঘ শক্তি দিয়ে এই ঘটোৎকচকে না মারত, তাহলে কোন না কোন সময়ে আমি এই রাক্ষসটাকে মারতাম, কারণ সে ছিল এতটাই ব্রাহ্মণদ্বেষী এবং যজ্ঞবিঘ্নকারী। এতদিন যে আমি তাকে মারিনি, সে শুধু তোমাদের প্রিয় সাধনের জন্য।

এই যুক্তি বড় মর্মান্তিক। কথাটা যুধিষ্ঠিরের পর্যন্ত ভালো লাগেনি। কৃষ্ণের কথার প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন–ধমাধর্মের সূক্ষ্ম গতি আমার ভালই জানা আছে (ভাবটা এই যে ও ব্যাপারটা আমি তোমার থেকে বেশি বুঝি)। কিন্তু তাতেও এটা বুঝতে পারছি না যে, ব্রাহ্মণদ্বেষিতা ব্যাপারটা ঘটোৎকচের ক্ষেত্রে কি করে খাটে-ব্ৰহ্মহত্যাফলং তস্য যৎ কৃতং নাবলুধ্যতে। এরপর কবে কোথায় ঘটোৎকচ কিভাবে পাণ্ডবদের সাহায্য করেছিলেন–সে সব কথা বলতে বলতে যুধিষ্ঠির কেবল চোখ মুছতে থাকলেন। আমাদের এ বিষয়ে প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন এইটুকুই যে শুধু রাক্ষস নামটি ব্রাহ্মণদ্বেষিতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেই কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে নিজেই মারতে চেয়েছিলেন। বাস্তবক্ষেত্রে ঘটোৎকচ ব্রাহ্মণদ্বেষী ছিলেন কিনা, যুধিষ্ঠিরের কথায় তার সায় মেলে না। ঘটোৎকচের মৃত্যুর পর কৃষ্ণের বক্তব্য থেকে যা বোঝা যায় তা হল, ব্রাহ্মণদের হাতে রাখবার জন্য তিনি আপন স্বজনকে যুদ্ধে লড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠিত হননি, কুণ্ঠিত হননি সে কথা জোর গলায় বলতেও। জীবনের আরম্ভ থেকে রাজনৈতিক জগতের মূর্ধণ্যভূমিতে আসবার জন্য কৃষ্ণ নিজে যেমন ক্ষাত্র শক্তি ব্যবহার করেছেন, তেমনি ব্যবহার করেছেন ব্রাহ্মণশক্তিকেও। পাণ্ডব ক্ষত্রিয়ের জ্যাঘোষে কৃষ্ণের যে লাভ হয়েছে, তাকেই অনুরক্ত সহায়তায় ধরে রেখেছে ব্ৰহ্মঘোষ, কেননা এই দুয়ে মিলেই তখনকার রাজশক্তি নিরঙ্কুশ হত। বক দালভ্য তাই বলেছিলেন–জ্যাঘোষশ্চৈব পার্থানাং ব্রহ্মঘোষশ ধীমতাম! সংসৃষ্টং ব্ৰহ্মণা ক্ষত্ৰং ভূয় এব ব্যরোচত ॥

ব্রাহ্মণ্য এবং রাজন–এই দুয়ের সুষম সদ্ব্যবহার ছাড়াও কৃষ্ণের যেটা বাড়তি সুবিধে ছিল, সেটি হল তাঁর বুদ্ধি এবং পুরুষকার। বিপদের সময় ভেঙে পড়া, উৎসাহ হারানো কিংবা অভীপ্সিত কাজ সম্পন্ন হলে উল্লম্ফন না করা–এসব গীতোক্ত গুণগুলি যে তাঁর ভিতরে ছিল, তারও কারণ এই পুরুষকার এবং বুদ্ধি। কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার, পৌরুষ, বুদ্ধি–এত সব গুণ দিয়ে কৃষ্ণের শেষ লাভ কি হল, তার একটা হিসেব কষা দরকার। দরকার এইজন্যে যে, কৃষ্ণ এক বিরাট ধর্মরাজ্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং মহাভারত তথা ভগবদগীতায় এই মর্মে বহুতর বিচিত্র বক্তৃতাও দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিতেও এই ধর্মরাজ্যের চেহারাটা কিরকম হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরে তার একটা রূপ পাওয়া গেছে বৈকি। রাজ্য জুড়ে হাহাকার, পুরুষসৈন্য প্রায় নিঃশেষ, কৌরবদের কেউ বেঁচে নেই, পাণ্ডবরা নিজেরা বেঁচে থাকলেও তাঁদের বংশে এক পরীক্ষিৎ ছাড়া আর কেউই বেঁচে নেই। আছে শুধু ধর্মরাজ্য, কেননা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জয় হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের অভিষেক বারিতে বিধবাদের অশু মিশে গেল, শঙ্খধ্বনি-জুলু ধ্বনির সঙ্গে মিশে গেল বিধবাদের ক্রন্দন। ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠা হল, কৃষ্ণের স্বপ্ন সার্থক হল।

কিন্তু এই সার্থকতার একটা হিসেব কষা দরকার বলেই মহামতি ব্যাস একটা হিসেব মহাভারতের মধ্যেই কষেছেন। যে ধর্মরাজ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতিষ্ঠা হল, তার রূপেই তো নিশ্চয় এই হিসেবের আরম্ভ, যা ঔপন্যাসিক শ্ৰীগজেন্দ্র কুমার মিত্র তাঁর পাঞ্চজন্য উপন্যাসে দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন শ্রীবিমল কৃষ্ণ মতিলাল তাঁর নাতিক্ষুদ্র প্রবন্ধ নীতি, যুক্তি ও ধর্মে। কিন্তু যিনি এই বিরাট ধর্মরাজ্যের প্রবক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা, সেই কৃষ্ণেরও একটা হিসেব আছে মহাভারতেই। হিসেবটা ধরা আছে এত সূক্ষ্মভাবে, এমন সূক্ষ্ম ব্যঞ্জনায় যে, পুরুষোত্তম কৃষ্ণের উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠার নিরিখে তা প্রায় ধরাই যায় না। কিন্তু ব্যাস যা বলার বলেছেন, এবং আমাদের যা ধরার তা থেকেই ধরতে হবে।

একটা কথা প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার যে, ধর্ম বলতে ব্যাস কোন অতিলৌকিক ব্যাপার বোঝেন না, বোঝেন না ফুল, বেলপাতা, নৈবেদ্য। ধর্ম বলতে তিনি জীবনের ধর্মই বোঝেন, গোটা মহাভারতে এই জীবন-ধর্মের কাহিনীই রসে, ব্যঞ্জনায় বিধৃত। ব্যাস জানেন জীবনের ধর্মে কতগুলি নিয়ম আছে, নীতি আছে। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে অন্ধ, তার ফল তাঁকে পেতে হয়েছে। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম কামার্ত পিতার বিবাহ সম্বন্ধ করলেন, নিজে বিয়ে করলেন না, রাজ্য হাতে নিলেন না, তার ফলও তাঁকে পেতে হয়েছে বংশ বংশ ধরে পুত্র-পৌত্রদের অন্যায়, অবিচার এবং বিনাশও তাঁকে দেখে যেতে হয়েছে। রেহাই পাননি দ্রোণাচার্য, কুন্তী, গান্ধারী কিংবা অন্য কেউ। আবার ব্যাসের ধারণায় যিনি উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন, তাঁকেও কতগুলি নীতি-নিয়ম মানতে হয়, না হলে শেষরক্ষা হয় না। এটা অবশ্যই ঠিক যে, যিনি চরম মেধাবী, তিনি আপন প্রতিষ্ঠার দিকে যেতে চাইলে সমস্ত বাধা বিঘ্নই তিনি অতিক্রম করবেন। কিন্তু ব্যাসের দৃষ্টিতে তার মধ্যেও এক ধরনের শৃঙ্খলা থাকার কথা, নইলে চলে না। এ ব্যাপারে স্বয়ং কৃষ্ণই তাঁর উদাহরণ। কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল, শাশ্ব একে একে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন জরাসন্ধ-শিশুপালের মিত্রশক্তি কৌরবদের পর্যন্ত করতে। তাঁর নিজের গোষ্ঠী অন্ধক, বৃষ্টি, যাদবদের প্রতিষ্ঠা দিনে দিনেই বেড়ে উঠছিল, তাঁর আপন প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠার সুযোগ নিয়ে তাঁর স্ববংশীয়রা বেড়ে উঠছিলেন বিকৃতভাবে। অন্তদ্বন্দ্ব তো ছিলই, সেই সঙ্গে জুটেছিল সুরাপান আর স্ত্রীলোকের ব্যসন। কৃষ্ণ তাঁদের সর্বাংশে শাসন করতে পারেননি কিংবা তাঁরা শাসন শোনেননি।

সে যুগে যা ধর্ম বলে প্রচলিত ছিল–বেদ-ব্রাহ্মণ্য ইত্যাদি, সেগুলির প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল থাকার ফলে আপাতত গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী এক বেদধর্মের প্রবক্তা হিসেবেই তাঁর সুনাম হয়েছিল। কিন্তু জীবনের ধর্মে তাঁর কঠিন বিরোধীদের তিনি যে পন্থায় স্বধামে পৌঁছে দিয়েছেন, ব্যাস তা লুকোননি। ব্যাস তাঁর অতি পরিশীলিত ব্যঞ্জনায় বুঝিয়ে দিয়েছেন, কিভাবে যুধিষ্ঠিরকে তিনি হাতের পুতুলে পরিণত করেছিলেন। গল্প শোনা যায়, এক সময়ে রাশিয়ার অভিভাবক স্টালিন নাকি হাতে কলমে দেখিয়েছিলেন যে প্রতিরোধ এলে কেমন ব্যবহার করতে হয়। তিনি একটি জ্যান্ত মুরগীকে সমস্ত পালক ছাড়িয়ে রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। গরম কিংবা ঠাণ্ডার হাত থেকে বাঁচবার জন্য মুরগীটি ক্রমাগত দেয়ালের কাছে সিটিয়ে যাচ্ছিল অথবা আশ্রয় নিতে চাইছিল দেয়ালের পাশে। যুধিষ্ঠিরের অবস্থাটা প্রায় ছিল এই মুরগীর মতন। যুধিষ্ঠির যদিও কৃষ্ণের বিরোধী ছিলেন না, কিন্তু কৃষ্ণের রাজনৈতিক ধুরন্ধরতায় যুধিষ্ঠির অথবা অন্য পাণ্ডবদের অবস্থা এমনই হয়েছিল যে, কোন ক্ষেত্রেই তাঁরা কৃষ্ণের মত বিরাট এক ব্যক্তিত্বের দেয়ালের পাশে না দাঁড়িয়ে পারছিলেন না। এ জিনিসটা ব্যাস আকারে প্রকারে, ব্যঞ্জনায় নানাভাবেই প্রকাশ করেছেন, ধৈর্যশীল মহাভারতের পাঠকের কাছে এর ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর একসময়ে ধৈর্যশীলা গান্ধারী পাণ্ডবদের অভিশাপ দিতে চান। কারণ, কৌরবপক্ষে বাতি দেবার জন্য একটি সন্তান-প্রদীপও তাঁরা অবশিষ্ট রাখেননি। কিন্তু মহামতি ব্যাস তাঁর পুত্রবধূকে এই শাপ দেওয়া থেকে নিরস্ত করেন। এর পরে সন্তানহারা জননীর ক্রোধ গিয়ে পড়ে কৃষ্ণের ওপর। অভিযোগ এই যে, কুরু-পাণ্ডবের এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম যদি কেউ বন্ধ করতে পারতেন তো তিনি কৃষ্ণ। তিনি এই চেষ্টা করেননি, অতএব গান্ধারীর অভিশাপ নেমে এল তাঁরই ওপর। শাপের বিষয়বস্তু ছিল যদুবংশের ধ্বংস। বিস্ময়ের ব্যাপার, ব্যাস কিংবা আর কেউ গান্ধারীকে এই শাপ দেওয়া থেকে নিরস্ত করেননি। মহাভারতকার হিসেবে ব্যাসের হয়তো ধারণা ছিল যে গান্ধারীর অভিশাপ ধারণের ক্ষমতা কৃষ্ণের ছিল এবং তা পাণ্ডবদের ছিল না। কিন্তু দুষ্টমনে এই প্রশ্নও জাগে-গান্ধারীর মত ব্যাসেরও এই ধারণা ছিল না তো, যে, কৃষ্ণ এই যুদ্ধ বন্ধ করলেও করতে পারতেন এবং যুদ্ধের জন্য কৃষ্ণই দায়ী, পাণ্ডবরা নন।

উদ্যোগপর্বে ব্যাস যেন আপাতত দেখিয়েছেন যে কৃষ্ণ সন্ধি-টন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন, তিনি যেন যুদ্ধ বন্ধ করতে চান। কিন্তু সেই উদ্যোগপর্বেই ব্যাস এটাও দেখিয়েছেন যে, আপাতত কৃষ্ণ যাই প্রস্তাব করুন না কেন, তিনি মনে প্রাণে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাননি। এই কথাটা বর্তমান প্রবন্ধে যথাসম্ভব প্রমাণ সহযোগে আমিও দেখাবার চেষ্টা করেছি এবং তা অবশ্যই ব্যাসের মনোভাব বুঝে, স্বকোলকল্পনায় নয়। ব্যাস দেখিয়েছেন কৃষ্ণ কৌরবদৌত্যে ব্যর্থ হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছেন, তখন তিনি একাকী যুদ্ধবীর কর্ণের কাছে গিয়ে তাঁকে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতে বলেন। কৃষ্ণই কর্ণকে প্রথম বলেন যে তিনি সূতপুত্র নন, কুন্তীর পুত্র। কর্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে মিলিত হলে কত সুফল ফলবে এবং ভাবী মহারাজ কর্ণকে পাণ্ডবেরা এবং স্বয়ং কৃষ্ণও যে কতভাবে বিনতি দেখাবেন, তার কাল্পনিক চিত্র এঁকে কৃষ্ণ বার বার কর্ণকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কর্ণ একটুও বিচলিত হননি। তিনি নিজের জন্মবৃত্তান্ত, যেভাবেই হোক আগেই জেনেছিলেন এবং সেই কারণেই হয়তো বিচলিত হননি। কিন্তু লক্ষ্য করার মত বিষয় হল, কৃষ্ণ কর্ণের কাছে কথাটা বললেন, কিন্তু কই যুধিষ্ঠিরের কাছে তিনি তো এই সত্য প্রকাশ করেননি। যদি যুদ্ধ বন্ধ করার ইচ্ছে থাকত, তাহলে কর্ণের জন্মবৃত্তান্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে ভোলা উচিত ছিল স্বয়ং কৃষ্ণের অথবা কুন্তীর। কুন্তী তো পরিষ্কার যুদ্ধ চেয়েইছেন এবং উদ্যোগ পরে কৃষ্ণের মাধ্যমে ছেলেদের রীতিমত উত্তেজিতও করবার চেষ্টা করেছেন। অবশ্য তাঁর উত্তেজনার কারণও আছে।

কানীন পুত্রের মাতৃত্ব স্বীকার করে নেওয়ার মত বুকের পাটা হয়তো কুন্তীর ছিল না, কিন্তু কৃষ্ণ সত্যটা জানতেন এবং তিনি কুন্তীরও আগে কর্ণের সঙ্গে দরবার করতে গিয়েছিলেন। সেই নিরিখে, বিশেষত কর্ণের সারা জীবনের অপমান, অভিমানের নিরিখে এই সত্যটা তো কৃষ্ণই প্রকাশ করতে পারতেন পাণ্ডবদের কাছে, যুধিষ্ঠিরের কাছে। এতে যে ফল হত তাতে আমি নিঃসন্দেহ, কেননা তার প্রমাণ আছে স্ত্রীপর্বের শেষ অধ্যায়ে এবং শান্তিপর্বের প্রথম কয়েকটি অধ্যায়ে। স্ত্রীপর্বের শেষ অধ্যায়ে গঙ্গার তীরভূমি আকীর্ণ হয়ে গেছে বীরপত্নী বিধবাদের দ্বারা। কারও মনে আনন্দ নেই, উৎসাহ নেই, প্রত্যেকেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে বীর নায়কদের তর্পণে ব্যস্ত। এরই মধ্যে ক্রন্দনরতা কুন্তী হাহাকার করে পাণ্ডবদের অনুচ্চস্বরে বললেন–ওরে তোরা তোদের বড় ভাইয়ের উদ্দেশ্যে একটু জল দে গঙ্গায়। যে মানুষটার মত বীর আর ছিল না, যাকে এতকাল তোরা সূতপুত্র, রাধার ছেলে বলে জেনে এসেছিস, যুদ্ধক্ষেত্রে যে বীরের সঙ্গতি লাভ করেছে, সূর্যের মত তেজী যে ছেলেটাকে অর্জুন মারল, সেই সত্যবদ্ধ বীর কর্ণ তোদের আপন ভাই, সবার বড় ভাই, তার জন্যে এক অঞ্জলি জল দে গঙ্গায়।

কুন্তীর কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মত যুদ্ধে স্থির থাকা মানুষও সাপের মত নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন ক্রোধে। মাকে অনেক কথা শোনানোর পর যুধিষ্ঠির বললেন অভিমন্য মারা যেতেও আমি যে শোক পাইনি, দ্রৌপদীর সমস্ত ছেলেগুলি মারা যেতেও আমি যে শোক পাইনি, তার চেয়েও শতগুণ দুঃখ আজ আমি পেলাম কর্ণের মৃত্যুতে। তুমি যদি একবারের তরেও আমাকে বলতে যে, কর্ণ আমাদের বড় ভাই, তাহলে স্বর্গে থাকা জিনিসও আমাদের অপ্রাপ্য থাকত না এবং সমগ্র কুলের অন্তকারী এই যুদ্ধের সূত্রপাত হত না-ন চ স্ম বৈশসং ঘোরং কৌরবান্তকরং ভবেৎ।

অগ্রজ কর্ণের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠিরের এই প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এক বিরাট সত্য সুকানো আছে। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের হাতে পুতুল হলেও কোথাও কোথাও ধর্মের নামে তিনি বেশ খানিকটা একবগ্না; ঘটোৎকচের মৃত্যুর পরেও কৃষ্ণের যুক্তি তিনি মেনে নেননি, বরঞ্চ প্রতিবাদ করেছেন। সেই যুধিষ্ঠির যদি জানতেন যে, কর্ণ তাঁর অগ্রজ সহোদর তাহলে হয়তো যুদ্ধ নাও লাগতে পারত। বয়স্কা জননী লজ্জায় আপন পুত্রকেই তাঁর কন্যাবস্থার কলঙ্ক জানাতে চাননি। কিন্তু কৃষ্ণের কী হয়েছিল, তিনি কেন যুধিষ্ঠিরকে অথবা তাঁর প্রিয়সখা অর্জুনকেই বা জানাননি যে, কর্ণ তাঁদের বড় ভাই, কুন্তীর ছেলে। বিশেষত কানীন পুত্র সে যুগে সমাজে অসম্মতি ছিল না। গান্ধারীর শাপটা তাই মিথ্যে নয়। কৃষ্ণ যুদ্ধ বন্ধ করতে চাননি, বরঞ্চ মনে মনে যুদ্ধ চেয়েছিলেন।

মহাভারতের কর্তা হিসেবে ব্যাস দেখিয়েছেন যে, কৃষ্ণ যতই মেধাবী, যতই কুটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হোন না কেন, অথবা হোন না তিনি ঈশ্বর–মনুষ্যশ্রদ্ধার চরম আসনে অধিষ্ঠিত, কিন্তু তিনি যখন নরলীলা মনুষ্যব্যবহারী, তখন জীবনের ধর্ম তাঁকে পালন করতেই হবে। সে ধর্মে যদি ফাঁকি থাকে তবে ঈশ্বরকেও তার ফলভোগ করতে হবে। এই নিরিখে গান্ধারী অভিশাপ একটি রূপকমাত্র। ব্যাস দেখিয়েছেন–একে একে সমস্ত প্রতিপক্ষ শাতন করে কৃষ্ণ যখন ক্ষমতার চূড়ায় উঠে বসেছেন, তখন সেই ধর্মরাজ্যে টিকে আছেন শুধুই ধর্মরাজ-সদানত, সর্বদা অনুগামী। ততদিনে তাঁর নিজের ঘরেই আগুন লেগে গেছে; দু-তিনটি স্ত্রী ছাড়া কৃষ্ণের অন্য স্ত্রীরা সবাই প্রায় বিপথগামিনী;তাঁর পুত্রেরা এবং অন্যান্য বংশজেরা কৃষ্ণের ক্ষমতাতেই এত মদোন্মত্ত যে, তাঁদের লঘু-গুরু জ্ঞান নেই। কৃষ্ণের সামনেই তাঁরা যথেচ্ছ সুরাপান করেন, ব্যবহার করেন প্রতিকূল। ব্যাস দেখিয়েছেন–ঈশ্বরত্ব কিংবা ঐশ্বর্য ব্যক্তিজীবনের পক্ষে কোন সমাধান নয়। ছোট ছোট অন্যায়, ছলনা এবং অনীতি সাময়িকভাবে কৃষ্ণকে সুবিধে দিয়েছে মাত্র, কিন্তু সেগুলি পরিণাম-রমণীয় হয়নি কখনও। সেজন্য সারাজীবন ধর্ম ধর্ম করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে অন্তত যে সম্মান নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল, স্বয়ং ঈশ্বরীভূত কৃষ্ণের পক্ষে সেই সম্মানে দেহত্যাগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ জীবনের ধর্মে কৃষ্ণের অন্যায় ছিল, ছলনা ছিল, এমনকি হীনতাও ছিল এবং মহাভারত মহাকাব্যের সর্বময় কর্তা হিসেবে ব্যাস সে অপরাধ ক্ষমা করেননি। কিন্তু মহাকবি কিংবা ইতিহাস প্রণেতা হিসেবে ব্যাস এতটাই নির্বিকার এবং এতটাই নির্মোহ যে, বুদ্ধি, বল এবং মেধাবিত্বের নিরিখে এই ছলনাময় পুরুষটিকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ভগবত্তায় প্রতিষ্ঠিত করতেও তাঁর কুণ্ঠা হয়নি। অন্য দিকে স্ত্রীলোকের মুখে শাপের প্রতাঁকে কিংবা নিজের অন্যায়ের নিরিখে তাঁকে এবং তাঁর বংশ ধ্বংস করতেও ব্যাসের বাধেনি। কৃষ্ণ তাই এখনও বিতর্কের বিষয়ই রয়ে গেলেন। তাঁর সমসাময়িকেরাও তাঁকে যখন যা ভেবেছেন, তার থেকে তিনি হয়তো অন্যরকম থেকে গেছেন, এখন আমরাও যা ভাবছি, তার থেকেও তিনি হয়তো অন্যরকম। কৃষ্ণের মধ্যে অর্জুন যে বিশ্বরূপ দর্শন করেছিলেন সেটা তাই কোন আকস্মিক ঘটনা নয়, কৃষ্ণের বিশ্বরূপিতার বীজ রয়েছে স্বয়ং ব্যাসের হৃদয়ের মধ্যেই।

Book Content

১. কৃষ্ণ
২. মহাভারতের ভারতযুদ্ধ
লেখক: নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীবইয়ের ধরন: প্রবন্ধ ও গবেষণা
কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

কৃষ্ণা কুন্তী এবং কৌন্তেয় – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

চৈতন্যদেব - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

চৈতন্যদেব – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মহাভারতের প্রতিনায়ক - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

মহাভারতের প্রতিনায়ক – নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.