কৃষ্ণ
০১.
কৃষ্ণ-নামের মহিমা যে কতখানি সে অনুভূতি আমার না থাকলেও পরিষ্কার জানি এই প্রাচীন নামটি যুগ-যুগান্তরের মানুষকে কত বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করেছে। ‘কৃষ্ণ’ এই শব্দটি যে ধাতু থেকে নিষ্পন্ন সেই ‘কৃষ্’ ধাতুর মানেও নাকি আকর্ষণ করা। মানুষটির চরিত্রও বিচিত্র। প্রথম জনে যদি বলেন কৃষ্ণ সেই পুরাণ পুরুষোত্তম, তবে দ্বিতীয় জন বলবেন–তিনি কপটের চূড়ামণি। তৃতীয় মানুষের দৃষ্টিতে ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সুত্রধার বোধহয় কৃষ্ণ। চাণক্যের আগে এমন ধুরন্ধর রাজনৈতিক নেতা আর দ্বিতীয় নেই। আবার চতুর্থ ব্যক্তি যখন কৃষ্ণের বৃন্দাবনী লাম্পট্যে বিচলিত, তখন কবি বলবেন কৃষ্ণের সেই বিশ্বমোহন লাম্পট্য তোমাকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুক–ইত্যুক্তে ধৃতবল্লবী কুচযুগস্ত্বং পাতু পীতাম্বরঃ। কেমন করে এমনটি হয় আমার জানা নেই। পরস্পর বিরোধী গুণের এমন সমবায় আর কোন দেবতা বা মানুষের মধ্যে দেখা যায়নি বলেই বোধহয় কৃষ্ণের আকর্ষণ এই দু হাজার বছরেও অম্লান।
সেকালের দিনে বহুরূপী সাজত, তার জন্য সাজ দরকার হত। পোশাক পাল্টাতে হত। কৃষ্ণ, যাঁকে আমরা অনেকেই ভগবান বলে জানি এবং মানি–তাঁর যে কত রূপ এবং তিনি যে কত বড় বহুরূপী–তা তাঁর রূপ বদলের সহস্র রকমফেরেই প্রমাণিত। কৃষ্ণকথার সর্বোত্তম গ্রন্থ ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণের এই বহুরূপিত্ব সম্বন্ধে একটি শ্লোক আছে। কৃষ্ণ তখন দাদা বলরামের সঙ্গে কংসের দরবারে ঢুকতে যাবেন। কংসহত্যার বিধ্বংসী ক্রিয়াকলাপ তখনও বাকি আছে। ভাগবতকার বলছেন, কৃষ্ণের আগমনে-সেই সময় কংস-সভার মল্লদের কাছে যেন অশনিসঙ্কেত ভেসে এল। সাধারণ মনুষেরা মনে করল যেন সর্বকালের সেরা মানুষটি ঢুকেছে কংসের সভায়। যুবতীরা ভাবলেন বুঝি অঙ্গ ধরেই এসেছেন সাক্ষাৎ ভালবাসার দেবতা। মল্লনামশনি দৃণাং নরবরঃ খ্রীণাং স্মরো মূর্তিমান। এরই মধ্যে গোপবালকেরা কিন্তু নির্বিকার। তাদের মনে ব্যত্যয় হয়নি একটুও, তারা ভাবল তাদের সেই চিরকালের বাঁশিওয়ালাটি বুঝি এসেছেন–শুধু জায়গাটা বৃন্দাবন নয়, মথুরা। ঠিক একই ভাব ছিল দেবকী এবং বসুদেবের। বহুদিন আগে দেখা কংস কারাগারের সেই উজ্জ্বল শিশুটিও যেন নতুন করে তাঁদের বাৎসল্য জাগ্রত করে তুলল। তবে কংসের সভায় যে সব অসৎ সামন্তরাজারা ছিলেন তাঁরা কিন্তু বুঝলেন যে তাঁদের শায়েস্তা করার মানুষটি এসে গেছেন। স্বয়ং ভোজপতি কংস, কৃষ্ণের মধ্যে দেখতে পেলেন মৃত্যুকে। কৃষ্ণকে দেখে যোগী-মুনিদের পরমতত্ত্ব লাভের অনুভুতি হল। বৃষ্ণিবংশীয়রা তাঁকে জানলেন রাজা বলে, দেবতা বলে। আর অজ্ঞ লোকেদের বড় মানুষ দেখলে যা হয়, তাই হল। তারা বুঝলে-এ মানুষ তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে, বড় মানুষের ব্যাপার–নাক গলিয়ে লাভ নেই–
মৃত্যুর্ভোজপতের্বি রাডবিদুষাং তত্ত্বং পরং যোগিনাং
বৃষ্ণীণাং পরদেবতেতি বিদিতো রঙ্গং গতঃ সাগ্রজঃ।
এই শ্লোকটিতে ঈশ্বরী মায়ার কোন চিহ্ন নেই। কিংবা নেই কোন বিভূতি-প্রদর্শনের চেষ্টা। একটি মাত্র মানুষ এখানে বহুরূপীর মত। পোশাক-আশাক পাল্টানোরও কোন ব্যাপারই নেই। তবুও কেমন বহুরূপী। এর পরে অবতারতত্ত্বের আমদানি হলে, সবিশেষ ব্রহ্মের আকৃতি প্রতিষ্ঠা হলে–অর্থাৎ কিনা সত্যি সত্যি বহুরূপীর মত সাজ পাল্টালে-এ কৃষ্ণকে যে কত শত রূপে দেখা যাবে তাই এখন বিচার্য।
যাঁরা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম পড়েছেন, তাঁরা মনে রাখবেন কৃষ্ণের প্রত্যেকটি নামের পেছনেই একটা ইতিহাস আছে। অবশ্য ইতিহাস না বলে, এগুলিকে গল্প বলাই ভাল। তবে হ্যাঁ, পণ্ডিত মানুষ যাঁরা, তাঁরা কৃষ্ণের এই অষ্টোত্তর শতনাম নিয়ে গবেষণা না করলেও কৃষ্ণ এই মানুষটি একজনই কিনা সে সম্বন্ধে যথেষ্ট চিন্তিত। অর্থাৎ যিনি পাণ্ডবের সখা কৃষ্ণ বিদুরের প্রভু’, তিনিই ‘গোপীকুল বস্ত্রহারী শ্রীরাসবিহারী কিনা সে সম্বন্ধে সন্দেহ তো রয়েই গেছে, উপরন্তু অষ্টোত্তর না হলেও মহাভারতের কৃষ্ণ, বাসুদেব কৃষ্ণ, গোপাল কৃষ্ণ–এই রকম অন্তত পাঁচ-ছ রকমের কৃষ্ণের আমদানি হয়েছে পণ্ডিতদের মানস-লোকে; তাতে যন্ত্রণা আরও বেড়েছে। পণ্ডিতদের যন্ত্রণা উপশমের দায় যেহেতু আমার নয়, আমি তাই সরাসরি কৃষ্ণের সামগ্রিক চিত্রে আসি।
একজন জলজ্যান্ত মানুষ হিসেবে কৃষ্ণের নামটি প্রথম পাওয়া যায়, ছান্দোগ্য উপনিষদে। পণ্ডিতেরা অনেকেই এই মত পোষণ করেন যে, ছান্দোগ্য উপনিষদের কৃষ্ণ হলেন ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য। কিন্তু মনে রাখা দরকার এ ধারণাটি চালু হয়েছে শঙ্কারাচার্যের ভাষ্যব্যাখ্যা থেকে। তিনিই বলেছেন “কৃষ্ণায় দেবকীপুত্ৰায় শিষ্যায়”। মূল উপনিষদে কিন্তু কৃষ্ণ যে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য, তার কোন উল্লেখমাত্র নেই। সেখানে সোমযাগের রূপকে মানুষের জীবনচক্রের বর্ণনা চলছিল। এই যজ্ঞদর্শনটিই ঘোর আঙ্গিরস নামক ঋষি উপদেশ করেন কৃষ্ণকে। ছান্দোগ্য উপনিষদের মূল পঙক্তিটি এই রকম–তদ্ধৈত ঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্ৰায় উক্ত্বা উবাচ অপিপাস এব স বভুব। সোন্ত বেলায়া এতৎ এয়ং প্রতিপদ্যেত– অক্ষতম অসি, অচ্যুত অসি, প্রাণ সংশিততমসীতি।(১) অঙ্গিরা গোত্ৰীয় ঘোর নামক ঋষি দেবকীনন্দন কৃষ্ণকে এই যজ্ঞদর্শন উপদেশ দিয়ে (পরবর্তী তিনটি মন্ত্রও] উপদেশ করেছিলেন। সেই দেবকীপুত্র কৃষ্ণ [উক্ত বিদ্যার উপদেশ শুনে অন্য বিদ্যা বিষয়ে নিঃস্পৃহ হয়েছিলেন। ঐ বিদ্যাভিজ্ঞ ব্যক্তি মৃত্যুকালে এই তিনটি মন্ত্র জপ করবেন–অক্ষত আছ, আপন প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হওনি অর্থাৎ অচ্যুত আছ, প্রাণের প্রতি সুক্ষ্ম অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
এই পঙক্তির মধ্যে দেবকীপুত্র কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য বানানো শঙ্করের পক্ষে একটু অন্যায় হয়েছে। অন্তত শ্রদ্ধেয় বিমানবিহারী মজুমদারের মতে তাই, তবে তিনিও বোধহয় একটু অন্যায় করেছেন–যখন ছান্দোগ্য উপনিষদের পরবর্তী পঙক্তিটির অর্থ ধরে বলেছেন যে, ওখানে ‘অচ্যুতমসি’-এই ‘অচ্যুত’ শব্দে ঘোর আঙ্গিরস কৃষ্ণকেই সোধন করেছেন–ঠিক যেমনটি গীতার মধ্যে অর্জুন তিন তিনবার ‘অচ্যুত’ বলে সম্বোধন করেছেন কৃষ্ণকে।(২) আসলে কিন্তু মূল ছান্দোগোর পঙক্তিতে কৃষ্ণ সম্বন্ধী কোন সম্বোধনের ব্যাপারই নেই, ঠিক যেমনটি নেই শঙ্করের বলা কোন শিষ্যত্বের ব্যাপারও। বস্তুত পুরাণে ইতিহাসে যেমনটি পাই তাতে কৃষ্ণ ছিলেন সান্দীপনি মুনির শিষ্য, আর তাঁর পারিবারিক পুরোহিত ছিলেন গর্গ। কিন্তু শঙ্করের বক্তব্যেও আমি কোন অন্যায় দেখতে পাই না, কেননা সে যুগে যে কেউ ব্ৰহ্মবিদ্যার মত গম্ভীর তত্ত্ব কিংবা শাস্ত্রীয় কোন শাসন উপদেশ করতেন তাঁকেই গুরু বলে মেনে নেওয়া হত এবং যিনি অনুশাসনযোগ্য তিনিই তো শিষ্য। স্বয়ং কৃষ্ণও তো তাঁর বিচিত্র জীবনকালে কত বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে উপদেশ গ্রহণ করেছেন। শঙ্কর হয়তো এই রকম একটা বিশদ অর্থেই কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য বলে প্রতিপন্ন করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ছান্দোগ্য উপনিষদ রচনার সময়েই, অন্য কোন কৃষ্ণ নয় ‘দেবকীর ছেলে কৃষ্ণ এইটাই কি তাঁর সত্তা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়? ছান্দোগ্যের প্রায় সমকালীন কিংবা পূর্বেই তো তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বাসুদেব’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে নারায়ণ এবং বিষ্ণুর সমান কক্ষায়। বাসুদেব মানে বসুদেবের ছেলে।
ব্যাস, আবার বিপদ বেধে গেল। পণ্ডিতেরা বড় আজীব জীব। জামান পণ্ডিত জ্যাকবি, অপেক্ষাকৃত পুরাতন তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সূত্র ধরে মন্তব্য করে বসলেন–বৈদিক যুগ যখন প্রায় শেষ হয়ে এল তখন বসুদেবের ছেলে কৃষ্ণ অবশ্যই নারায়ণ এবং বিষ্ণুর সমকক্ষায় পুজিত হতেন; কিন্তু দেবকীর ছেলে কৃষ্ণ যেহেতু ছান্দোগ্য উপনিষদে একজন তত্ত্বজিজ্ঞাসু পণ্ডিত হিসেবেই পরিচিত, তাই তিনি পূজা পেতে শুরু করেন কিছুদিন পর থেকে। অর্থাৎ কিনা দেবকীর ছেলে কৃষ্ণের বিষ্ণুখট্টায় আরোহণ ঘটতে বসুদেবের ছেলের থেকে সময় লেগেছে বেশি।(৩) পিতা বসুদেব এবং জননী দেবকীর মধ্যে এই শতাব্দীর ব্যবধান কৃষ্ণকে দেখে যেতে হয়নি ভাগ্যিস।
পাঠককুল সবিস্ময়ে লক্ষ করুন, তৈত্তিরীয় আরণ্যকে এবং ছান্দোগ্য উপনিষদে এক একবার মাত্র কৃষ্ণনাম সংকীর্তনেই পণ্ডিতদের ধারণা হয়েছে-পিতা বসুদেবের নামে পরিচিত কৃষ্ণ ছেলেটি, মাতা দেবকীর নামে পরিচিত ছেলেটির থেকে আলাদা এবং নিশ্চয়ই ভিন্ন শতাব্দীর। তাঁরা আবার Syncretism নামে এক সর্বব্যাধি বিনাশক শব্দ আমদানি করেছেন, যাতে প্রমাণ হয়ে যাবে যে মনুষ্যলোকের সমীকরণের বুদ্ধিতে দুই কৃষ্ণ এক হয়ে গেছেন। আধুনিক যুগের একজন প্রগতিশীল গবেষকের কাছে syncretism শব্দটা যে যথেষ্ট প্রয়োজনীয় তা আমিও জানি, কিন্তু এই শব্দের কিছু অপব্যবহারও লক্ষ করার মত। পাঠক মহাশয়। ধরুন আমি কবাবু। আমি হয়তো প্রথম যৌবনে কিঞ্চিৎ অসংবদ্ধ খ্রীসঙ্গ করেছি কিন্তু বিবাহোত্তর জীবনে আমি একেবারে একপত্নীত হয়ে গেলাম। পাঠক মহাশয়! আপনি যদি গবেষক হন তাহলে একশ বছর পরেই বলতে পারবেন-যৌবনোন্ধত কবাবু লোকটি আলাদা, আর একপত্নীত কবাবুটি আসলে খবাবু; কেবলমাত্র মনুষ্যলোকের সমীকরণের বুদ্ধিতে দুজনেই পরে কবাবু বলে পরিচিত হয়েছেন, মূলে তারা আলাদা মানুষ।
ঠিক এই রকমই এক সমীকরণের পদ্ধতিতে যে সাহিত্যে যে কৃষ্ণকে পাওয়া যাবে তাঁকে প্রথমে আলাদা করে ফেলা হবে অপর সাহিত্যে বর্ণিত কৃষ্ণটি থেকে। তারপর বলা হবে যে, এরা সবাই ছিলেন ভিন্ন ব্যক্তিত্ব, কিন্তু মনুষ্যলোকের সমীকরণের বুদ্ধিতে তাঁরা সবাই এক হয়ে গেছেন।
সত্যি কথা বলতে কি আরণ্যক কিংবা উপনিষদের সঠিক কাল নির্ণয় করা খুবই কঠিন। সাধারণ নিয়মে বেদে সংহিতার পরেই আসে ব্রাহ্মণ গ্রন্থগুলি, তারপর আরণ্যক, তারপর উপনিষদ। কিন্তু এক্ষেত্রে সামবেদের কোন আরণ্যক নেই এবং ছান্দোগ্য উপনিষদটি সামবেদের ধারায় ব্রাহ্মণগ্রস্থের পরেই লিখিত। কিন্তু যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় উপনিষদের আগে আছে তৈত্তিরীয় আরণ্যক। কাজেই তৈত্তিরীয় আরণ্যক যখন লেখা হচ্ছিল, তখন হয়তো ছান্দোগ্য উপনিষদ লেখা হয়ে গেছে। বিশেষত তৈত্তিরীয় আরণ্যকের ভাষা এবং ছন্দ অনেক ক্ষেত্রেই ছান্দোগ্য উপনিষদের চেয়ে পুরানো বলে মানা যায় না, বরঞ্চ অবাচীন। অপিচ এই আরণ্যক গ্রন্থে কৃষ্ণ বাসুদেবের নাম বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই এই সিদ্ধান্তের কথা মনে আসে যে, ছান্দোগ্য উপনিষদের মানুষ কৃষ্ণ, তৈত্তিরীয় আরণ্যকের সময়ে ভগবান হয়ে গেছেন এবং সেই দিক দিয়ে তৈত্তিরীয় আরণ্যক অবশ্যই ছান্দোগ্যের চেয়ে নবীনই বটে। কিন্তু তাই বলে কোন অবস্থাতেই পিতা বসুদেবের সঙ্গে জননী দেবকীর আরণ্যক ব্যবধান তৈরী করা ঠিক নয়।
ভারত সমাজের আর এক নামকরা পণ্ডিত আর জি ভাণ্ডারকার আবার বললেন–এ বাসুদেব, সে বাসুদেব নয়। অর্থাৎ কিনা তৈত্তিরীয় আরণ্যকের বাসুদেব মোটেই আমাদের কৃষ্ণ বাসুদেব নয়। বাসুদেব হলেন সাত্ত্বত-বৃষ্ণিকুলের কুলাধিদেবতা, ইনি কৃষ্ণ নন। তাঁর মতে, সেই দেবতা বাসুদেবের সঙ্গে আঙ্গিস শিষ্য কৃষ্ণের সমীকরণ হয়েছে অনেক পরে।(৪) দুঃখের বিষয়, এই ভারতীয় পণ্ডিতকে বিরাট এক তর্কের জালে ফেলে দিলেন ইউরোপীয় কিথ সাহেব। তিনি বললেন–The seperation of Vasudeva and Krisna as two entities, it is impossible to justify.(৫) পুরাণে ইতিহাসে যে কৃষ্ণকে আমরা সহজে চিনি, তাঁকে পুরাণকতারা প্রায় সব সময়েই “ভগবান সাত্ত্বতাং পতিঃ কিংবা বৃষ্ণীণাং পরদেবতা অর্থাৎ সাত্ত্বত-বৃষ্ণিকুলের দেবতা বলেই সহস্রবার চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, পুরাণকারদের সময়ে কৃষ্ণ সম্পূর্ণ ভগবত্তায় প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু বংশ, প্রতিবংশের অনুক্রম বর্ণনা যেখানে পুরাণকারদের প্রধান উদ্দেশ্য, সেইসব জায়গায় তাঁরা নিপুণভাবে দেখিয়েছেন সত্ত্বান বা বৃষ্টি থেকে কত পুরুষ পরে নিছক মানুষের মতই কৃষ্ণের জন্ম হয়েছে। একটি বংশে অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন পুরুষ জন্মালে পরবর্তীকালে তিনি সেই বংশের মহাপুরুষ কিংবা দেবতাও হয়ে যান, এ তো আমরা লৌকিক জগতেও দেখি। তা ছাড়া বসুদেবের ছেলে বাসুদেব নন এ কথা তো কোথাও বলা হয়নি, না মহাভারতে, না পুরাণে। এসব জায়গায় বাসুদেব নামে সাত-বৃষ্ণিকুলের পৃথক কোন কুলদেবতারও তো উল্লেখ নেই, যা ভাণ্ডারকার বলতে চেয়েছেন। ভগবান বাসুদেবের পৃথক কোন বৈশিষ্ট্য যদি পুরাণকারেরা কোথাও বলেও থাকেন, তা আমাদের কৃষ্ণকেই উদ্দেশ্য করে, এবং কোন অবস্থায়ই তাঁকে অতিক্রম করে নয়।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে কৃষ্ণের উৎস নিয়ে ভান্ডারকার আর কিথের উতোর-চাপান খুব জমেছিল। ভাণ্ডারকার নন্দগোপের প্রত্নে বেড়ে ওঠা গোপালক কৃষ্ণের কোন প্রাচীনত্বই স্বীকার করেন না। তাঁর ধারণা, আভীর জাতির লোকেরা ভারতবর্ষে এসেছিল সিরিয়া কিংবা এশিয়া মাইনর থেকে। তারা তাদের সঙ্গে বয়ে এনেছিল যীশুখ্রীষ্টের গল্প। সেইগুলিই নাকি রূপান্তরিত হয়ে কৃষ্ণকথার সূচনা হয়েছে ভারতবর্ষে। খ্রীষ্টের নামই কোমল সুরে কৃষ্ণনামের ধনি বয়ে এনেছে।(৬)
তাও ভাল, এই মহাত্মা পি. জর্জির মত জুডা থেকে যাদব কিংবা জন থেকে অর্জুনের নাম টিপে টিপে বার করেননি। উইলিয়ম জোন্স, হেবার সাহেব, ফ্লকার-এরা সবাই যে কত রকম করে ভারতবর্ষের চিরপরিচিত কৃষ্ণকে খ্রীষ্টের ছাঁচে ফেলবার চেষ্টা করেছেন, তা আর বলবার নয়। এসব প্রসঙ্গে তাঁদের পাণ্ডিত্য যতখানি গভীর তার চেয়েও বেশি উদ্ভট এবং কষ্টকর।
পণ্ডিতদের মধ্যে আরেক দল আছেন, যাঁরা ঐতিহাসিকতাকেই অবতারবাদের মৌল উপাদান বলে মনে করেন। জে এন ফারকুহার এই কথাটি স্বীকার করে নিয়েও বলেছেন যে ভারতবর্ষের রাম আর কৃষ্ণের কথা যতখানি ঐতিহাসিক তার থেকে অনেক বেশি পৌরাণিক, more mythical than hsitorical। ফারকুহার অবশ্য যীশুখ্রীষ্টকেই একমাত্র ঐতিহাসিক পুরুষ বলে মনে করেন।(৭) কিন্তু তাঁর এই উক্তি স্ববিরোধী। কেন না, তাঁর নিজেরই লেখা অন্য একখানি গ্রন্থে তিনি বলেছেন–খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেই রাম আর কৃষ্ণ দুজনেই যুদ্ধবীর হিসেবে খ্যাতি লাভ করে গেছেন। ফারকুহার বিশ্বাস করেন মেগাস্থিনিসের সময়েই রাম আর কৃষ্ণের নামের প্রথমে ভগবানের উপাধি যোগ হয়েছে এবং খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর গোড়া থেকেই তাঁরা বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে দেখা দেন।(৮)
আগে মানুষ, তারপর প্রবাদপুরুষ যুদ্ধবীর, তারপর ভগবান-অবতারবাদের এই তত ক্রমিক বিবর্তন। কিন্তু এসব কথা মূলত স্বীকার করে নিলেও ঠিক রুডলফ অটো সাহেবের মত ফারকুহারেরও ধারণা যে, ভগবদ্গীতার কবির মনোলোকে যীশুখ্রীষ্টের ছবি ছিল। ভগবদগীতার অনুশাসনে কর্তব্য-নিষ্ঠার যে চরম প্রকর্ষ দেখানো হয়েছে সে নাকি যীশুখ্রীষ্টের কল্পনা ছাড়া সম্ভবই নয়। একথা ঠিকই যে, যীশুখ্রীষ্ট তাঁর আপন কোটিতে যথেষ্ট মহনীয়। কিন্তু পরম মহত্ত্বের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই যে অন্য কোন ধর্মে, অন্য কোন বিশ্বাসেও থাকতে পারে সেটাও তো বোঝা দরকার। প্রথমত গীতার মধ্যে এত ভিন্নজাতীয় উপদেশ, এমন প্রকীর্ণ তত্ত্বজ্ঞান একই ব্ৰহ্মসুত্রে গাঁথা আছে যে গীতার শ্রোতা অর্জুনই স্বয়ং বার বার বিভ্রান্ত হয়ে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেছেন-তাহলে কোনটা শ্রেয়ঃ কোনটা ‘জ্যায়সী’, আমি কোন পথে যাব? সেখানে একটিমাত্র বিশেষ মানুষের ছাঁচে ভগবদ্গীতা লিখিত হয়েছে, এ কথাটা বড় বেশি সহজ বা সহজীকরণ। দ্বিতীয়ত যদি স্বকর্মনিষ্ঠা স্বধর্মপরায়ণতা কিংবা চরম কোন কর্তব্যবোধই ভগবদগীতার প্রথম পাঠ হয় এবং সেই ধর্মকর্ম করার জন্য যে কষ্ট, যে আত্মত্যাগ অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়, তাহলে তাঁর একটা জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ খুঁজতে যীশুখ্রীষ্ট পর্যন্ত দৌড়তে হবে কেন, তাঁর অনেক আগেই তো আমরা রামচন্দ্রকে পাচ্ছি। তাঁর একটা বংশ পরিচয়ও তো পুরাণে ইতিহাসে আছে। জি-পারিন্দার অবতারবাদের ব্যাপার-স্যাপার যথাযথ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে ঐতিহাসিক চরিত্র হিসেবে কৃষ্ণ বড়ই সমস্যাসঙ্কুল বটে, কিন্তু রামের ঐতিহাসিকতা নিয়ে কোন সন্দেহই নেই-Rama seems clearly historical.”(৯) এমন কি শুধু ঐতিহাসিকতাও নয়, অবতারের স্বভাববিধিতে যাঁরা বাইবেলীয় নৈতিকতাই (Biblical sense of morality) বড় বলে মনে করেন তাঁদের উদ্দেশ্যে পরিষ্কার বলা যায় যে রামের মত নীতিবোধ, মায়া-মমতা, বন্ধুত্ব এবং তার জন্য কষ্টস্বীকার–এসব কিছুই বাইবেলীয় নীতিবোধের চেয়ে কোন অংশে কিছু কম নয়–Rama affords more patterns of conduct in nobility, affection and long suffering.(১০)
অবতারের কথা যখন উঠল তখন একটা কথা বলতেই হবে। ঐতিহাসিকতা যদি অবতারবাদের মৌল উপাদান হয় তাহলে আমাদের দশখানি অবতারের পাঁচ/ছ’খানাই বাদ যাবে। তা যাক। পশুস্বভাব অবতারগুলির মধ্যে ভূভার হরণ ব্যাপারটাই বড় কথা ছিল–পুরাণজ্ঞ পণ্ডিতেরা যাকে বলেছেন reordering of the cosmos. কিন্তু যেদিন থেকে পশুর সঙ্গে আধেক মানুষ এসে জুটল (পাঠক বুঝতেই পারছেন আমরা নরসিংহ অবতারের কথা বলছি) সেদিন থেকেই অবতারবাদের সঙ্গে মিশে গেছে ভক্তিবাদ, যার পরিবর্তে ঈশ্বরের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি করুণা। আবার দেখুন তিনপেয়ে বেটে বামন অবতার। তিনি দৈত্যরাজ বলিকে আপন ছলনায় নিগৃহীত করে দেবতাদের ইজ্জৎ রক্ষা করেছেন। আবার তিনিই দৈত্যরাজের থাকার সুবন্দোবস্ত করেছেন পাতালে, নিজেও ছিলেন তাঁর দ্বাররক্ষী হয়ে। পরিত্রাণ, রক্ষা–এ যদি ঈশ্বরীয় স্বভাব হয়, তবে করুণাও ঈশ্বরের স্বভাব। কিন্তু তবু যেন এই বেঁটে বামনের মধ্যে একটু মানব-চরিত্রের দূষণ লাগল–সেটি হল তাঁর ছলনা, কুটিলতা–যে গুণে তিনি বলিকে প্রতিহত করেছেন এবং যা নিজমুখে স্বীকারও করেছেন। বামন অবতারের দুই-পঙক্তি বর্ণনার মধ্যেও জয়দেবকে তাই প্রথমেই লিখতে হয়েছে ছয়সি বিক্রমণে বলি অদ্ভুতবামন’।
বামন অবতারের পরেই আছেন তিনখানি রাম এবং বুদ্ধ। বুদ্ধ অবশ্যই মানুষ এবং অবশ্যই ঐতিহাসিক। ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বৌদ্ধধর্মের ঘোর বিরোধী, তবু তিনি ব্রাহ্মণদেরই করা অবতারের লিষ্টিতে স্থান পেয়েছেন। এর ওপরে আরও যন্ত্রণা হল–বৌদ্ধদের আপন দর্শনেই অবতারবাদ মূলত স্বীকৃত নয়। তবু যে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মে অবতার বলে স্বীকৃত, তার একটা কারণ তিনি অতি বড় মাপের মানুষ–যদিও নিন্দুকেরা বলে যে বুদ্ধকে অবতার হিসেবে স্থান দিয়ে ব্রাহ্মণেরা কৌশলে বৌদ্ধধর্মের বিস্তার বন্ধ করেছিলেন। তিনখানি রামের মধ্যে পরশুরাম দাশরথি রামের মহিমায় ঢাকা পড়ে গেছেন-তেজোভি গতবীৰ্য্যত্বা জামদগ্ন্যা জড়ীকৃতঃ (রামায়ণ ১.৭৬.১২) এবং ঠিক একই অবস্থা হয়েছে বলরামের। ভারতবিখ্যাত ছোটভাই কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ থাকার জন্যই তিনি অবতার হয়ে গেছেন, নচেৎ বলরামকে খুব একটা কেউ পুছত না। কিন্তু আমাদের আসল রাম হলেন দাশরথি রাম এবং লক্ষ্য করার বিষয় হল তাঁর মধ্যে দেবতা আছেন যতখানি, মানুষ আছেন তার চেয়ে অনেক বেশি। বাস্তবিক পক্ষে বাল্মীকি রামায়ণের প্রতিজ্ঞাও ছিল তাই। একটি আদর্শ মানুষকে খুঁজে খুঁজেই বাল্মীকির শ্লোক শেষ পর্যন্ত উত্তরকাণ্ড গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলল ভগবানকে। রামায়ণের বালকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড অত্যন্ত প্রামাণিকভাবেই প্রক্ষিপ্ত বলে পরিচিত এবং এর মধ্যেই যত বিষ্ণু নারায়ণের-তত্ত্ব রামের ঘাড়ে এসে পড়েছে। নইলে অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত যে রামচন্দ্রকে পাই সে একটা সম্পূর্ণ মানুষ। ভূ-ভার হরণের মত অতিলৌকিক কাজ যার সূত্র ধরে বানরদের সঙ্গে বন্ধুত্ব, সেতুবন্ধন এবং রাবণবধ সম্পন্ন হয়েছে, সে সবই তো অবতারবাদের কল্প অনুসারে-অধর্মের অভ্যুত্থান, ধর্মের স্থাপন, পরিত্রাণায় চ সাধূনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রাম অবতারের যেটা বাড়তি পাওনা সেটা হল দোষে গুণে মিলিয়ে তার মানুষ মানুষ ভাব, যে ভাবটি শুধু দৈত্যরাক্ষসদের পক্ষশাতন করেই নিরস্ত হয় না, শুধুই পৃথিবীকে দুষ্টমুক্ত করেই তিরোহিত হয় না, আরও কিছু থেকে যায়, যা একান্তই মানুষিক। এই মানুষিকতার মধ্যেই ঐতিহাসিকতা লুকিয়ে থাকে, যেটা রাম অবতারের ব্যাপারে পারিন্দার সাহেবের মনে হয়েছে পরিষ্কার, আর কৃষ্ণের ব্যাপারে মনে হয়েছে জটিল, ‘complex। পারজিটার, আর, সি, হাজরা কিংবা হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর মত পণ্ডিতেরা এই জটিলতার জাল খুলতে চেষ্টা করেছেন। প্রাচীন বংশাবলী এবং ভারতবর্ষের ইতিহাস নতুন করে সাজিয়ে তাঁরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, আমাদের কৃষ্ণ নিতান্তই ঐতিহাসিক পুরুষ এবং একান্তই মানুষ। কৃষ্ণকে বাদ দিয়ে প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস হয়ে যাবে অসম্পূর্ণ। আর ধর্ম এবং দর্শন হয়ে যাবে নিরাশ্রয়। সাধারণের কাছে আমাদেরও তাই দায় আছে কৃষ্ণকে ইতিহাসের দৃষ্টি থেকে যতটা সম্ভব পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করার।
এ ব্যাপারে প্রথম কথা হল ছান্দোগ্য উপনিষদে ঘোর আঙ্গিরসের শিষ্য যে দেবকীপুত্র কৃষ্ণ তার সঙ্গে আমাদের কৃষ্ণের চরিত্র বেশ মেলে। ভগবদগীতার মধ্যে যে উপদেশগুলি ভগবান কৃষ্ণের জবানীতে দেওয়া আছে এবং ছান্দোগ্য উপনিষদে যে উপদেশগুলি কৃষ্ণ লাভ করেছেন তার একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন হেমচন্দ্র রায়চৗধুরী। শ্লোক ধরে ধরে বিচার করে তিনি দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, এই দুই কৃষ্ণ একই।(১১) তবে হ্যাঁ, সময়ের অনুক্রমে এককালের আঙ্গিরস শিষ্য যেমন মাস্টার হয়ে উঠেছেন, তেমনি মানুষটা হয়ে গেছে ভগবান।
উল্লেখ্য, খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতেই মহাবৈয়াকরণ পাণিনি, বাসুদেব কৃষ্ণ এবং অর্জুনের নাম একসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। পাণিনির এই সূত্রটির গঠনই এমন যে, তাতে কৃষ্ণের পূজ্যত্ব সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকে না।(১২) মহাভারতে কৃষ্ণের পার্থসারথি রূপ তখনকার মানুষের মনে, এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল যে রাজারা যুদ্ধে গেলে সৈন্যবাহিনীর সামনে কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি বয়ে নিয়ে যেতেন। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর ঐতিহাসিক কাটিয়াস জানিয়েছেন যে, ভারতের সেই স্মরণীয় সমরনায়ক পুরু যখন আলেকজাণ্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন, তখন তাঁর প্রাগ্রসর সেনাবাহিনীর সামনে ছিল কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি।(১৩) পুরুর মনে ছিল ভগবদ্গীতার অভয় বাণী-যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণঃ যত্র পাথে ধনুর্ধরঃ। তত্র শ্রীবিজয়ো ভূতি ধ্রুবাণীতি মতি মম ॥ পুরু যুদ্ধে হেরেছিলেন, কিন্তু ভারতবাসী তবু ভোলেনি যে কৃষ্ণ যেখানে জয়ও সেখানে।
সময়ের অনুক্রমে আলেকজাণ্ডারের পরেই আসে মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির কথা। খ্রীষ্টপূর্ব একশ পঞ্চাশ শতাব্দীতেই তিনি লিখছেন যে তাঁর সময়ে কৃষ্ণজীবনের নানা ঘটনা নিয়ে রীতিমতো নাটক বাঁধা হয়ে গেছিল। বিশেষ করে কৃষ্ণের কংসবধ তখন এতই জনপ্রিয় যে পতঞ্জলি উল্লেখ করেছেন–অভিনেতারা সব দুই ভাগে ভাগ হয়ে যেত। কংসপক্ষে যারা থাকত তারা হল, ‘কালামুখ’ আর কৃষ্ণপক্ষে যারা অভিনয় করত তাঁরা হল ‘রক্তমুখ। শুধু অভিনয় নয়, কৃষ্ণের কংস হত্যার কাল সম্বন্ধে পতঞ্জলি এমন একটি ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন, যাতে বোঝা যায় তাঁর সময়েই এই ঘটনা ছিল সুদূর অতীতের–জঘান কংসং কিল বাসুদেবঃ। পতঞ্জলির ধারণা কৃষ্ণ শুধু ক্ষত্রিয়মাত্র নন, বাসুদেব নামটিই হল ভগবানের সংজ্ঞা-সংজ্ঞৈষা তত্রভবতঃ। আর বাসুদেবের ভক্তদের নাম ছিল বাসুদেবক।(১৪)
ইতিহাসের দৃষ্টিতে মেগাস্থিনিস পতঞ্জলির আগের মানুষ। তিনিও কৃষ্ণের কথা জানতেন এবং আরও জানতেন যে মথুরা এবং কৃষ্ণপুর, সেই যেখান দিয়ে যমুনা বয়ে গেছে সেই কৃষ্ণপুর, সেখানকার সমভূমির লোকেরা, বিশেষত শৌরসেনীরা কৃষ্ণের পূজা করত।(১৫)
সমস্ত প্রমাণ থেকেই পাণিনি, পতঞ্জলি কি মেগাস্থিনিস কার্টিয়াস সবার প্রমাণেই, এমন একটা সিদ্ধান্ত করা যায় যে, খ্রীস্টজন্মের পূর্বেই বাসুদেব কৃষ্ণ পরম ঈশ্বরে পরিণত। কাজেই তিনি যখন মহাভারতের ইতিহাস রঙ্গমঞ্চে উপস্থিত ছিলেন, সে নিশ্চয়ই আরও আগের ঘটনা। ভারত-যুদ্ধের কাল নির্ণয় করা অবশ্যই খুব কঠিন। তবু বেশি কচকচির মধ্যে না গিয়ে বেশির ভাগ গবেষকের মত একত্র সংগৃহীত করে সময়ের একটা বৃহৎ পরিসর বেছে নিলে দেখব–মহাভারতের যুদ্ধ হয়েছিল পনেরোেশ’ খ্রীস্টপূর্বাব্দ থেকে আরম্ভ করে আটশ পঞ্চাশ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে।
যদি পুরাণগুলির মত স্বীকার করে নিই তাহলে মহাপদ্মনন্দের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে পরীক্ষিতের জন্ম পর্যন্ত সময়টি ধরা হয় ১০৫০ বছর। এই ধারণা অনুযায়ী ভারতযুদ্ধ গিয়ে পড়বে সেই ১৪০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের এদিক-ওদিক। পুরাণের হিসেবগুলিকে আজকের পণ্ডিতেরা প্রায়ই গল্পগাথা বলেই উড়িয়ে দেন। আরেক দল আছেন যাঁরা পুরাণকারদের কথাবার্তা সাহেবদের অনুদৃষ্টিতে মিলিয়ে নেন। আমরা বলি, পুরাণগুলির মধ্যে ঐতিহাসিক তথ্য আছে প্রচুর এবং সেগুলি সমসাময়িক জৈন বৌদ্ধ (পালি এবং সংস্কৃত) এবং অন্যান্য ধারার সঙ্গে মিলিয়ে নিলে পুরাতত্ত্বের অনেক খবরই আমাদের নিজস্ব দৃষ্টিতেই মীমাংসিত হতে পারে, যাকে যোসেফ কিটাগাওয়া বলেছেন internal consistency।(১৬) এই সমস্ত ধারার একটা সুষ্ঠু সামঞ্জস্য করে পণ্ডিতেরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে খ্রীস্টজন্মের অন্তত হাজার বছর আগে কোনও সময় কৃষ্ণ স্বদেহে বর্তমান ছিলেন। কাজেই কৃষ্ণের মধ্যে খ্রীস্টের এবং কংসের মধ্যে রাজা হেরডের ছায়া দেখে যাঁরা পুলকিত হন তাঁদের জানাই–তৈত্তিরীয় আরণ্যক কিংবা হান্দোগ্য উপনিষদের সময়েই মহাভারতের মূল ঘটনাটি তখনকার কথক ঠাকুর সূত মাগধদের কল্যাণে, পৌরাণিক তথা ব্যাসেদের মাধ্যমে যথেষ্ট প্রচারিত হয়েছিল। মনে রাখবেন–খোদ ছান্দোগ্য উপনিষদ, যা কিনা খুব সঠিক না হলেও অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব ৭০০/৮০০ বছর আগে লেখা, তাতে ইতিহাস পুরাণ অর্থাৎ কিনা মহাভারত পুরাণকে পঞ্চম বেদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে–ঋগ্বেদং ভগবাধ্যমি যজুর্বেদং সামবেদমাথৰ্বণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদম।(১৭) কাজেই ছান্দোগ্য উপনিষদে দেবকীপুত্র কৃষ্ণের নাম শুনে কিংবা তৈত্তিরীয় আরণ্যকে বাসুদেব কৃষ্ণকে বিষ্ণুকায় প্রতিষ্ঠিত দেখে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পরবর্তীকালে পঞ্চম থেকে দ্বিতীয় খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত অঞ্জস্রবার কৃষ্ণের নামোল্লেখ পাওয়া যাবে; তবে দুঃখ এই সর্বত্রই তিনি ভগবান হয়ে গেছেন। একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি হিসেবে, এক সময়ের অতিমান্য পুরুষ, অথচ মানুষ হিসেবে তাঁকে যেন পাওয়াই যায় না। রাজা-রাজড়াদের প্রতিষ্ঠিত শিলালিপিগুলিও এই দেবায়নী ধারা থেকে বিচ্যুত হয়নি। শিলালিপিতে শতবার কৃষ্ণের নামোল্লেখ দেখিয়ে এই রচনাকে ভারাক্রান্ত করতে চাই না; কেন না কৃষ্ণসম্বন্ধে প্রথম যে শিলালিপিটি আমরা পাই তাতেই তিনি উল্লিখিত হয়েছেন ‘দেবদেব’ মানে দেবতাদেরও দেবতা বলে। আরও মজা, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় এই শিলালিপিগুলিরমধ্যে এখনও প্রথম বলে পরিগণিত এই লিপিটি কিন্তু কোন ভারতীয় রাজার কৃতি নয়। গ্রীসদেশের যবন রাজা আণ্ডিয়ালকিডাস হেলিওড়োরাসকে, রাজা কাশীপুত্র ভগভদ্রের কাছে দূত করে পাঠিয়েছিলেন। সেই হেলিওড়োরাস ভারতবর্ষে এসে ভাগবত ধর্মের প্রেমে পড়ে গেলেন, প্রেমে পড়লেন বাসুদের কৃষ্ণেরও। যবন রাজার কাছে তিনি হলেন ‘দেবদেব’।(১৮)
বাসুদেব কৃষ্ণের প্রাচীনত্বে এবং ঈশ্বরত্বে আরেকটি বড় প্রমাণ হল পঞ্চরাত্র গ্রন্থগুলি। জয়াখ্য সংহিতা, অহিবুধ্য সংহিতা-এইসব অতি পুরাতন পঞ্চরাত্র গ্রন্থগুলিতে যে ব্যহবাদের সূচনা হয় তারও মূলে আছেন এই বাসুদেব কৃষ্ণ। বৃহবাদের প্রধান কথা হল, বাসুদেব কৃষ্ণই সব, তাঁর থেকেই অন্যান্য দেবতাদের শক্তিবৈচিত্র্য। পরবর্তীকালের আবেশ অবতার, বিভব অবতার, সাক্ষাৎ অবতার এবং আরও শতেক অবতারবাদের অন্যতম উৎসভূমি এই পঞ্চরাত্র গ্রন্থগুলি এবং তারও মূল এই বাসুদেব কৃষ্ণ।(১৯) কৃষ্ণের প্রতাপ দিনে দিনে এমনই বেড়ে চলছিল যে মহাভারতের নারায়ণীয়পাধ্যায়ে যে নর, নারায়ণ, হরি এবং কৃষ্ণের চতুমূর্তি দেখতে পাই (১২.৩৩৪৮-৯) সেগুলি একাত্ম হয়ে গেছে বাসুদেব সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন এবং অনিরুদ্ধের সঙ্গে অর্থাৎ কিনা কৃষ্ণ, কৃষ্ণের বড় ভাই বলরাম, কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যুম্ন এবং তাঁরই নাতি অনিরুদ্ধের সঙ্গে।(২০) সত্যি কথা বলতে কি খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই কৃষ্ণের জ্ঞাতি-গুষ্টি, আত্মীয়-স্বজন, ছেলে-পুলে সবাই জনমনের পূজ্য আসনে বসে গেছেন। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর একটি শিলালিপিতে সঙ্কর্ষণ আর বাসুদেবের নাম তো সম মাহাত্মে উচ্চারিত।(২১) আর খ্রীষ্টজন্মের প্রথম বছরেই অন্য একটি শিলালিপিতে তোষা নামের এক অভিজাত মহিলা শৈলদেবগৃহে পূজা-অর্চনার উদ্দেশ্যে অতিমান্য পাঁচজন বৃষ্ণিবীরদের-ভগবতাং পঞ্চবীরাণাং–অপূর্ব পাঁচটি মূর্তি স্থাপনের কথা ঘোষণা করেন। লুডার্স সাহেব জৈন গ্রন্থের সূত্র ধরে বৃষ্ণিবংশের এই পাঁচ বীর পুরুষের নামকরণ করেছেন-বলদেব, অঙ্কুর, অনাবৃষ্টি, সারণ এবং বিদুরথ অর্থাৎ কৃষ্ণ নয়, কৃষ্ণের গুষ্টি। এদের মধ্যে অক্রূর ছাড়া আর সবাই কৃষ্ণের পূর্বজ, যদিও পুরাণের বংশাবলীতে তাঁদের সবারই নাম পাওয়া যায় এবং বিরথ তত বেশ বিখ্যাত। অধ্যাপক জে এন ব্যানার্জি কিন্তু বায়ু পুরাণের প্রমাণ উল্লেখ করে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, লুডার্সের অঙ্কে ভুল আছে। বায়ু পুরাণের মতে এই পাঁচ বৃষ্ণিবীর হলেন যথাক্রমে বলরাম, কৃষ্ণ, শাম্ব, প্রদ্যুম্ন এবং অনিরুদ্ধ। এই প্রমাণই পণ্ডিতমহলে এখন গৃহীত।(২২) তার মানে খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর মধ্যেই শুধু কষ্ণ নয়, কৃষ্ণের ছেলে-পুলে মায় নাতি অনিরুদ্ধ পর্যন্ত পূজ্য পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
বঙ্কিম লিখেছেন–”রুক্মিণী ভিন্ন আর কোনও কৃষ্ণমহিষীর পুত্র পৌত্র কাহাকেও কোন কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না। রুক্সিণীবংশই রাজা হইল–আর কাহারও বংশের কেহ কোথাও রহিল না।
এই সকল কারণে আমার খুব সন্দেহ যে, কৃষ্ণের একাধিক মহিষী ছিল না।” (২৩)
বঙ্কিমের দৃষ্টি বড়ই একপেশে। মহাভারত ছাড়া অন্য কিছু তিনি মানতেই চান না। কৃষ্ণকে আদর্শ নেতা তথা একপত্নীব্ৰত সাজানোর জন্য তাঁর যুক্তিজালের অন্ত নেই। কিন্তু রুক্মিণীর বংশই রাজা হল অতএব রুক্মিণীই কৃষ্ণের একমাত্র পত্নী–এ কিরকম যুক্তি? আমরা যদি বলি সুভদ্রার বংশই শেষ পর্যন্ত রাজা হল, অতএব দ্রৌপদী অর্জুনের স্ত্রী ছিলেন না, চিত্রাঙ্গদা উলুপীও মিথ্যা কল্পনা, তা হলে তো বড়ই বিপদ। স্মরণীয়, বৈষ্ণবাচার্য রামানুজের গুরু যামুনাচার্য শঙ্করের ‘একমেবাদ্বিতীয় ব্রহ্মতত্ত্বের প্রস্তাবে একটি শ্লোক লিখেছিলেন। শঙ্করের বিরুদ্ধাচরণ করে তিনি বলেছিলেন–”যদি বলি, এই যে চোল দেশের রাজা, ইনিই হলেন পৃথিবীর অদ্বিতীয় সম্রাট–তাহলে বুঝতে হবে তাঁর মত রাজা আর দুটি নেই জগতে। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে তাঁর পুত্র-পরিবার, চাকরবাকর কেউ ছিল না তু তৎপুত্র-তভৃত্যকলত্রাদি নিবারণম্।”
আমরাও তাই বলি। আমরা বলি, কৃষ্ণ রুক্মিণীর স্বামী ছিলেন নিশ্চয়ই, তাই বলে কি সত্যভামা, জাম্ববতী ছিলেন না, কিংবা প্রথম যৌবনে রাধা-চন্দ্রাবলী? রাধার কথা উঠলে তো বঙ্কিমের কৃষ্ণাদর্শ ভেঙে চৌচির হয়ে যাবে, রাগে রাঙা হয়ে তিনি বলে উঠবেন–আর প্রশ্ন করিও না গার্গী, তোমার মুণ্ড খসিয়া পড়িবে। বঙ্কিমের বক্তব্য :
মনুষ্য কতটা নিজরক্ষা ও বৃত্তি সকলের বশীভূত হইয়া স্বতঃই কর্মে প্রবৃত্ত হয়। কিন্তু যে কর্মের দ্বারা সকল বৃত্তির সর্বাঙ্গীন স্ফূৰ্ত্তি ও পরিণতি, সামঞ্জস্য ও চরিতার্থতা ঘটে তাহা দুরূহ। যাহা দুরূহ, তাহার শিক্ষা কেবল উপদেশে হয় না–আদর্শ চাই। সম্পূর্ণ ধর্মের সম্পূর্ণ আদর্শ ঈশ্বর ভিন্ন আর কেহ নাই।…
অতএব যদি ঈশ্বর স্বয়ং সান্ত ও শরীরী হইয়া লোকালয়ে দর্শন দেন, তবে সেই আদর্শের আলোচনায় যথার্থ ধর্মের উন্নতি হইতে পারে। এই জন্যই ঈশ্বরাবরের প্রয়োজন। মনুষ্য কর্ম জানে না; কর্ম কিরূপে করিলে ধর্মে পরিণত হয় তাহা জানে না; ঈশ্বর স্বয়ং অবতার হইলে সে শিক্ষা হইবার বেশী সম্ভাবনা, এমত স্থলে ঈশ্বর জীবের প্রতি করুণা করিয়া শরীর ধারণ করিবেন, ইহার অসম্ভাবনা কি?(২৪)
অবতারমাত্রেই জনসমক্ষে একটা বড় আদর্শ স্থাপন করবেন–এই জিনিসটা বঙ্কিমের মাথায় বড় বেশি ক্রিয়া করেছিল। অবতার হয়ে দু-চারটে রাবণ-কুম্ভকর্ণ কি কংস-শিশুপাল বধ করা তাঁর মতে ‘অতি অশ্রদ্ধেয় কথা’। ঈশ্বরের অবতারের কাজ হল আদর্শ স্থাপন। আমরা বলি কি তাঁর কথাটা রামচন্দ্র সম্বন্ধে ভালই খাটে, কিন্তু কৃষ্ণের চরিত্র বড়ই জটিল। বিশেষত বঙ্কিমের কৃষ্ণ যত আদর্শবাদী নেতা কিংবা মহাভারতের ‘বিসমার্ক’ হন না কেন, তবু তিনিই সম্পূর্ণ কৃষ্ণ নন। এর ওপরে আছেন দার্শনিকেরা, যাদের সঙ্গে বঙ্কিমের বিবাদ হতে বাধ্য এবং সেই বিবাদে বঙ্কিমের হার এতটাই অবশ্যম্ভাবী যে তিনি জেনে বুঝে সে দিকটার ধারও মাড়াননি। দার্শনিক বলবেন–মনুষ্য অবতারের কাজ শুধু দু-চারটে রাবণ-কংস বধ হবে কেন, এমন কি তার উদ্দেশ্য জনসমক্ষে একটা বিরাট আদর্শ স্থাপনও নয়। মানুষ হয়ে জন্মাবার পেছনে ঈশ্বরের নিজেরই উদ্দেশ্য আছে, আছে স্বার্থ। এর সঙ্গে আছেন মহাকবি, তিনি ধুয়া ধরবেন–তিনি মুক্ত, তাই তাঁর লীলা বন্ধনে; আমরা বদ্ধ, সেইজন্য আমাদের আনন্দ মুক্তিতে।(২৫) ঠিক এই কারণে তিনি রাজার রাজা হয়েও আপনিই আসেন ধরা দিতে; সে যতখানি আমাদের জন্য ঠিক ততখানি তাঁর নিজের জন্যেও। ভারতবর্ষের সমস্ত ধর্ম যেখানে একান্তভাবেই দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত সেখানে দার্শনিকদের মূল কথাটি ছেড়ে দিলে চলে না। দার্শনিকেরা বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রাচীন পংক্তিটির দিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে বলেন-উপনিষদের সেই ‘একমেবাদ্বিতীয় পুরুষ নাকি একা একা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন, তাঁর মনে ছিল না এতটুকু আনন্দ–স বৈ নৈব রেমে, যম্মাদ একাকী নরমতে–কেননা একা একা আনন্দ পাওয়া যায় না। তাই তিনি জায়া হলেন, নিজেকে এই রকম করে দ্বিধা বিভক্ত করলেন। শুধু অসুর রাক্ষস বধ নয়, শুধু আদর্শ স্থাপন নয়, আরও কিছু। জন্ম-মরণের আবর্ত তাঁকে স্পর্শ না করলেও–অজোপি সন্ অব্যয়াত্মা–তিনি জন্ম নিলেন। সমস্ত ভূতবর্গের অধীশ্বর হয়েও–ভূতানামীশ্বরোপি সন্”তিনি বাঁধা পড়লেন মানব জীবনের সুখ-দুঃখের মায়ায়। তাতে মানুষেরই মত কখনও তার কপালে জুটল সুখ, কখনও দুঃখ কখনও বা যন্ত্রণা। রসিক দার্শনিকেরা এই ব্যাপারগুলোকে বলেছিল ‘লীলা। শব্দটি সাধারণ নয়, কেননা এই শব্দের সাহায্যেই ঈশ্বরের মনুষ্যোচিত ক্রিয়াকলাপের ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, অন্য কোন শব্দের দ্বারা নয়। ব্ৰহ্মসূত্র লিখেছে–আমাদের জগৎটিই সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের লীলাবশে—লোকবত্তু লীলাকৈবল্যম্। কাজেই সেই লীলাবশেই যদি তিনি তাঁর আপন সৃষ্ট খেলাঘরে কিছুদিন মনুষ্য ব্যবহার করে আনন্দ পান, তাতে দার্শনিক খুশি হন। কিন্তু খুশি হন না ঐতিহাসিক, তাঁরা এসব লীলা-টীলার ধার ধারেন না। আমরা বলি, তাতে ক্ষতি কিছু নেই। উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ মহাভারতে মনুষ্য থেকে যাঁর দেবায়ন ঘটেছে, ঐতিহাসিক যে তাঁকে মনুষ্য বলবেন তাতে আশ্চর্য কি! যেমন ধরুন, যেসব পণ্ডিতেরা বাল্মীকির রামায়ণকে মূলত পাঁচ কাণ্ড বলে মনে করেন, তাঁরা রামচন্দ্রের মনুষ্যত্বেই বিশ্বাসী। ইতিহাসের দৃষ্টিতে রামায়ণ আরম্ভ হয়েছে অযোধ্যার রাজবাড়ির অন্তঃকলহ এবং সিংহাসনের অধিকার নিয়ে, শেষ হয়েছে লঙ্কাকাণ্ড রাবণ-বিজয়ের সূত্র ধরে। কিন্তু রামচন্দ্রের যৌবনকাল, বিবাহ, আত্মত্যাগ, বনবাসের হাজারো কষ্ট এবং শেষে রাক্ষস-বিজয়–এই সব কিছুর মাধ্যমে ঐতিহাসিক যেখানে পৌঁছোতে চান তা হল রামের মনুষ্যত্ব, পারিন্দার যাকে বলেছেন-all make up a human being. আবার দার্শনিকও স্বরূপত রামচন্দ্রের বিষ্ণুত্ব স্বীকার করে নিয়ে যে জায়গাটায় পৌঁছতে চান, তাও কিন্তু রামের মনুষ্যত্বই। দুজনের মধ্যে মূল পার্থক্য হল–প্রথম জন প্রথম থেকেই রামকে মানুষ বলেই জানেন এবং তাঁর ধারণা–ভারতবর্ষীয় মানুষের ব্যক্তিপূজার সুযোগে বিষ্ণুর সঙ্গে রামের সমীকরণ ঘটেছে। আবার অন্যজন, মানে দার্শনিক, তাঁকে প্রথম থেকেই বিষ্ণু বলে জানেন এবং তাঁর ধারণা ঈশ্বরীয় লীলাবশে তিনি মানুষের রূপ ধারণ করেছেন মাত্র। তিনি যে মানুষের মত সমস্ত ব্যবহার-কর্ম, ধর্ম এমনকি অপকর্ম করছেন, সেও লীলাবশেই।
ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক-দুই তরফেই যখন ঈশ্বরের মনুষ্যত্ব প্রতিপাদনই কাম্য, সেখানে রামচন্দ্রের পথ ধরেই আমরা কৃষ্ণে পৌঁছতে পারি, যদিও ঐতিহাসিকতা এবং দার্শনিকতা–দুটিই ভীষণভাবে জটিল হয়ে গেছে কৃষ্ণ-জীবন এবং সামগ্রিক কৃষ্ণচরিত্র প্রসঙ্গে। প্রথম, কৃষ্ণের জীবন কথায় ব্যাসদেবের মহাভারতই একমাত্র উপাদান নয়,আরও শতেক পুরাণ কাহিনী আছে যা তাঁকে মহাভারতের একান্ত লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছে। দ্বিতীয়, অবতারবাদের মূল উদ্দেশ্য যাকে পুরাণজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেছেন ভূ-ভার হরণ, দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন-এই উদ্দেশ্য কৃষ্ণের ব্যাপারে একেবারেই গৌণ হয়ে গেছে। এমনকি বঙ্কিমের কথামত জীবজগতের সামনে একটা বিরাট আদর্শ স্থাপনও যদি কৃষ্ণ অবতারের মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলেও নিতান্ত ঐতিহাসিক কারণেই দেখা যাবে যে, কৃষ্ণ একেবারেই বেদের বার।
পুরাণ এবং মহাভারতের প্রক্ষিপ্ত শ্লোকপঙ্ক থেকে কৃষ্ণকে উদ্ধার করার একটা গুরু দায়িত্ব বঙ্কিম নিয়েছিলেন বটে; কিন্তু তাঁর, একান্তভাবে তাঁরই আদর্শ কৃষ্ণের পক্ষে বিপজ্জনক শ্লোকগুলিকে সোজাসুজি প্রক্ষেপবাদের আওতায় আনার অধিকার বঙ্কিমেরও নেই, কোনও সাহেবেরও নেই। বিশেষত সেইসব শ্লোকের প্রাচীনত্বও কম নয় এবং সেগুলি কালে কালে ভারতীয় ধর্ম এবং দর্শনকেও প্রভাবিত করেছে। কাজেই সেগুলিকে সুবিধে বুঝে বাদ দিয়ে চললে সামগ্রিক কৃষ্ণচরিত্র বোঝা যেমন কঠিন হয়ে পড়বে, তেমনি অসুবিধে হবে ভারতবর্ষের দার্শনিকতার চরিত্র বুঝতে, সমাজ-ইতিহাস তো দূরের কথা। যেমন ধরুন বাল্মীকি রামায়ণের বাল এবং উত্তরকাণ্ড প্রক্ষিপ্ত বলে পরিচিত হলেও এই কাণ্ড দুটির বিভিন্ন অংশ অবলম্বন করে চতুর্থ/পঞ্চম খ্রীষ্টাব্দেই কালিদাস তাঁর রঘুবংশের অনেকখানি লিখে ফেলেছেন। আবার তারও আগে দ্বিতীয়/তৃতীয় খ্রীস্টাব্দে ভাস তাঁর অভিষেক নাটক, প্রতিমা নাটক লিখেছেন রামায়ণের প্রক্ষিপ্ত অংশ অবলম্বন করেই। বলতে পারেন এঁরা সব কবি। উগ্র, মধুর বিকৃত এমনকি অবগুণ্ড কবির মনোলোকে রসের পরিণতি লাভ করে, কাজেই প্রক্ষিপ্তবাদের নিরসনে কল্পনামুখর কবি সহায় হবেন কি করে। আমরা বলব, বঙ্কিমও ঔপন্যাসিক, তাঁর মনোলোকের সমস্তটাই জুড়ে বসে আছেন এমন এক আদর্শ কৃষ্ণ, যিনি আমাদের দৃষ্টিতে এক বৃহৎ চরিত্রের একাংশ মাত্র। যদি বলেন কৃষ্ণচরিত্রের লেখক আপাতত গবেষকের ব্যাসাসনে উপবিষ্ট, তাহলে বলব–পৃথিবীর কোন্ গবেষক আপন লক্ষ্যস্থাপনে অন্যত্র অন্ধ না হন? গবেষকের সুবিধে, তিনি পণ্ডিত, তাই অন্যের সেই যুক্তিগুলিই তিনি গ্রহণ করেন, যেগুলি তাঁর লক্ষ্যপূরণ করে। আবার আরও গভীরে যান-সেখানে দেখবেন একই বেদান্তদর্শন এবং একই উপনিষদ গ্রন্থ অবলম্বন করে শংকরাচার্য অদ্বৈতবাদী এবং রামানুজ তাঁর উল্টো বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী। আবার নিম্বার্ক, মঘাচার্য, বল্লভাচার্য, চৈতন্যদেব-এরাও একে আরেক জনের থেকে আলাদা। যুক্তি কারও কম নয়, কিন্তু এরা প্রত্যেকে ব্রহ্মসূত্র, উপনিষদ এবং পুরাণ গ্রন্থের সেই অংশগুলিই সদ্ব্যবহার করেছেন, যেগুলি তাঁদের বিশেষ লক্ষ্য পূরণে সাহায্য করে। আমরা বলি-বঙ্কিমও তাই করেছেন, তার ওপরে তাঁর সুবিধে ছিল আরেক কাঠি। তিনি যখন ১৮৯২ সালে কৃষ্ণচরিত্রের একটা যুৎসই বর্ণনা দিলেন, তখন ভারতবর্ষে সাহেবদের প্রাচ্যবিদ্যাচচা আরম্ভ হয়ে গেছে। মুখে একটা আপাত ইংরেজ-ভাব বিরোধী সুর জিইয়ে রেখেও তিনি যা যা লিখেছেন, তা সাহেবদের লেখা হলেই মানাত ভাল। বুদ্ধ, রাম, কৃষ্ণ-এই সব প্রাচ্যচরিত্রের উৎস সন্ধানে সাহেবসুবোরা মাঝে মাঝে এমন মূলোচ্ছেদী পাণ্ডিত্য প্রকাশ করেছেন যে তাতে প্রাচ্যদেশের পণ্ডিতেরাও অনেকেই বিমুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। আমাদের ভয় হয় এইসব অসাধু প্রকোপ, এইসব মুগ্ধতা বঙ্কিমের হৃদয়েও কাজ করেনি তো? নিন্দুক গবেষকরা আজকাল বলছেন যে রেভারেণ্ড হেষ্টি, যিনি কৃষ্ণের বৃন্দাবনী লাম্পট্য নিয়ে নানা অকথাকুকথা বলতেন, তাঁর সমুচিত জবাব দিতে গিয়েই বঙ্কিম তাঁর আদর্শ কৃষ্ণচরিত্র সমাজের সামনে উপস্থাপন করেন।(২৬) কাজেই যদি এমন একটা ভাবনা কাজ করে থাকে যে, দেখ সাহেবদের মত করে লিখলেও আদর্শ কৃষ্ণকে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে বলব, তার জন্য বঙ্কিমকে বড় বেশি মূল্য দিতে হয়েছে। অর্ধেক কৃষ্ণকে তিনি প্রক্ষিপ্তবাদের ছাই দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন।
বঙ্কিমের সমকালীন সমাজেই বঙ্কিমের এই একদেশদর্শিতার প্রতিবাদ হয়েছিল। শোনা যায় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ অত্যন্ত অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও জ্যেষ্ঠপুত্র মহাপণ্ডিত দ্বিজেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন-”দ্যাখো, বঙ্কিম যে রকম করে কৃষ্ণচরিত্র আলোচনা করছে, তার একটা প্রতিবাদ হওয়া আবশ্যক।”(২৭) জিজেনাথ প্রতিবাদ করেছিলেন অত্যন্ত কড়া ভাষায় :
বঙ্কিমচন্দ্র শেষাশেষি যতই গীতাভক্ত হউন না কেন তিনি অনেকদিন ধরিয়া পাকা পজিটিভিস্ট ছিলেন। পজিটিভ ফিলসফি যাহাই হউক না কেন, শুধু মানুষকে লইয়া একটা পজিটিভ রিলিজন দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিলে চলিবে কেন? রিলিজন কি অমনি গড়িয়া তুলিলেই হয়? পজিটিভিস্ট চাহিল একজন গ্রান্ড ম্যান, মহাপুরুষ। বঙ্কিমবাবু ভাবিলেন, এই তো আমার হাতের কাছে একজন গ্রান্ড ম্যান রহিয়াছেন; যেমন বিষয়বুদ্ধি, তেমনি পরমার্থ জ্ঞান, এইরকম চৌকস মানুষ দরকার। অতএব আমাদের দেশে পজিটিভিস্ট রিলিজন দাঁড় করাইতে হইলে শ্রীকৃষ্ণকে গ্রান্ড ম্যান করিলেই সর্বাঙ্গ সুন্দর হইবে। তবে বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণকে আর মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে এক করিলে চলিবে না। ফলে দাঁড়াইল বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র।(২৮)
আমরা এই কথাটা একভাবে বলেছি। বলেছি, যে বিশ্বাস বহুকাল ধরে ভারতবর্ষের ধর্ম এবং দর্শন পরিচালনা করে এসেছে তাকে প্রক্ষিপ্তবাদের ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেই চলে না। সন্ন্যাসী পণ্ডিত বিবেকানন্দ ম্যাড্রাসের এক জনসভায় বঙ্কিমকে কটাক্ষ করে বললেন :
গোপীপ্রেম দ্বারাই সগুণ ও নিষ্ঠুণ ঈশ্বরের সম্বন্ধে বিরোধের একমাত্র মীমাংসা হইয়াছে। কৃষ্ণ অবতারের মুখ্য উদ্দেশ্য এই গোপীপ্রেম শিক্ষা দেওয়া। এমন কি দর্শনশাস্ত্র শিরোমণি গীতা পর্যন্ত সেই অপূর্ব প্রেমোন্মত্ততার সহিত তুলনায় দাঁড়াইতে পারে না। আমাদেরই স্বজাতি এমন অনেক অশুদ্ধচিত্ত নিবোধ আছে যাহারা গোপীপ্রেমের নাম শুনিলেই উহা অতি অপবিত্র ব্যাপার ভাবিয়া ভয়ে দশ হাত পিছাইয়া যায়।•••ভারতে এখন অনেকের মধ্যে একটা চেষ্টা দেখা যায়–সেটা যেন ঘোড়ার আগে গাড়ি জোতার মত। আমাদের মধ্যে অনেকের ধারণা-কৃষ্ণ গোপীদের সহিত প্রেম করিয়াছেন, এটা সাহেবরা পছন্দ করেন না। তবে আর কি, গোপীদের যমুনার জলে ভাসাইয়া দাও। সাহেবদের অনুমোদিত না হইলে কৃষ্ণ টেকেন কি করিয়া? কখনই টিকিতে পারেন না!…মহাভারতের দু-একটা স্কুল ছাড়া–সেগুলির বড় উল্লেখযোগ্য স্থল নহে–গোপীদের প্রসঙ্গই নাই। দ্রৌপদীর স্তবের মধ্যে এবং শিশুপালের বক্তৃতায় বৃন্দাবনের কথা আছে মাত্র। এগুলি সব প্রক্ষিপ্ত। সাহেবরা যা চায় না সব উড়াইয়া দিতে হইবে। গোপীদের কথা, এমনকি কৃষ্ণের কথা পর্যন্ত প্রক্ষিপ্ত!”(২৯)
এই যথেষ্ট। এ বিষয়ে আমাদের আর কোন বক্তব্য নেই। আমরা শুধু ছোট্ট করে বলি সম্পূর্ণ কৃষ্ণকে যথাসম্ভব বর্ণনা করতে হলে তাঁর বাল্য বয়স, যৌবনটাও চাই।
.
০২.
কৃষ্ণের সমস্ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের নিরিখে যে লিপিটিকে আমার সবচেয়ে সম্পূর্ণ বলে মনে হয় সেটি হল দ্বাদশ শতাব্দীর ভোজবমার বেলাভ তাম্রশাসন ভোজবমা কৃষ্ণের সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘সো’পীহ গোপীশতকেলিকারঃ কৃষ্ণো মহাভারতসূত্রধারঃ।(১) শ্লোকটি বড় মধুর। দুই দিকে দুটি জব্বর বিশেষণ, মধ্যখানের শব্দটি কৃষ্ণ। কৃষ্ণচরিত্রের এই দুটিই দিক। একদিকে তিনি শত গোপীর ভালবাসার ধন–অন্যদিকে মহাভারতের মত বিশাল জীবন-নাটকের সূত্রধার হলেন তিনি। কিন্তু এই দুটি বিশেষণই পণ্ডিতদের মধ্যে বিবাদ ডেকে এনেছে। তাঁরা বলবেন শতগোপীর নায়ক যিনি, তিনি এক কৃষ্ণ। আর মহাভারতের সূত্ৰধার যিনি, তিনি আরেক কৃষ্ণ। তাঁদের মতে কৃষ্ণকৃত গোপীরঙ্গ–সে যে একেবারেই হাল আমলের ব্যাপার। বরঞ্চ মহাভারত গ্রন্থটার ঐতিহাসিকত্ব যেহেতু একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তাই ওই কৃষ্ণকে তবু খানিকটা মেনে নেওয়া যায়।
অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে মহাভারতের কিছু শ্লোক পরবর্তী কালে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে। একথাও স্বীকার করি, পুরাণগুলির মধ্যেও অনেক পুরাণই বেশ অবাচীন। কিন্তু সঙ্গে এও জিজ্ঞাসা করি-মহাভারতের মধ্যে যে শ্লোকগুলি প্রক্ষিপ্ত হয়েছে, সেগুলির প্রাচীনতা নির্ধারণ করার ক্ষমতা কে রাখেন? পণ্ডিতদের এক কলমের আঁচড়ে ভগবদ্গীতাও তত প্রক্ষিপ্ত বলে প্রমাণিত, কিন্তু সেই গীতার প্রাচীনতাও তো কম নয়। অন্যদিকে সমস্ত পুরাণগুলির প্রাচীনতা সংশয়াতীত না হলেও, এমন পুরাণও তো আছে, যা যথেষ্ট প্রাচীন। তার মধ্যেও যদি বা প্রক্ষেপ ঘটে থাকে তার প্রাচীনতা নির্ধারণ করবেন কে? স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্ৰই অনেক পুরাণের প্রামাণিকতা দু-চার কথায় উড়িয়ে দিয়েছেন। আবার যেগুলিকে প্রাচীন বলে তিনি মনে করেন, তার মধ্যেও যদি বা কোথাও আহিরিণী যুবতীর পাশে রাখাল রাজার পদধ্বনি শোনা গেছে, সঙ্গে সঙ্গে বঙ্কিম তাঁর বঙ্কিম দৃষ্টি দিয়ে সেই পুরাণকারকে শাসন করেছেন।বঙ্কিমের উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণকে রুক্মিণীর একান্ত নায়ক করে ভোলা। মহাভারতের কতগুলি স্তরবিভাগ করে একেবারে মূলস্তরের কৃষ্ণকে জনসমক্ষে নিয়ে আসা–এও ছিল বঙ্কিমের অভীষ্ট। সন্দেহ নেই, যুক্তিতর্কের উপন্যাসে বঙ্কিম তাঁর মত করে বেশ খানিকটা সফলও হয়েছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই কথাটাও বলব যে, ‘গোপীশতকেলিকার’ কৃষ্ণকে তিনি যেভাবে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। প্রথমত তিনি বোধ হয় খেয়াল করেননি যে মহাভারতের মত বিশাল গ্রন্থে-ভীম, অর্জুন, দুর্যোধন–সবারই বালক বয়সের একটা জুৎসই বর্ণনা আছে, কিন্তু কৃষ্ণের বালকোচিত লীলাখেলার আভাসমাত্র নেই; এমনকি তাঁর জন্মকথাও মহাভারতে অবহেলিত। এই গ্রন্থে কৃষ্ণকে যেন প্রথম থেকেই পাই কূটবুদ্ধি এক নেতা হিসেবে, যে নেতার কোনকালে যে একটা বালক বয়স ছিল, তা অন্তত মহাভারত পড়ে মনে হয় না। কৃষ্ণের বাল্যকাল সম্বন্ধে মহাভারতের মত গ্রন্থের এই নীরবতা পুরাণগুলির এবং অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থের প্রামাণিকতা স্বভাবতই বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষত আমরা যদি প্রক্ষিপ্তবাদ আর পরদেশী প্রভাবের কথা পদে পদে তুলে ধরি, তাহলে কম্বলের নোম বাছতে বাহুতে শেষ পর্যন্ত মহাভারতের মত চিরোষ্ণ কম্বলখানিই বরবাদ হয়ে যাবে; পুরাণের কথা তো বাদই দিলাম। কাজেই কৃষ্ণের সবাঙ্গীণ জীবনকথায় মহাভারত, পুরাণ, শিলালিপি এবং অন্যান্য সহায়ক গ্রন্থগুলিও দরকারমত প্রতিপূরণ করবে।
কৃষ্ণের অলৌকিক জন্মরহস্য নিয়ে কোন বাদানুবাদ করতে চাই না, কেননা পৃথিবীতে সৌর বংশলতায় যত দেবতা বা বীর (solar Gods and heroes) আছেন, তাঁদের অনেকেই অযযানিসম্ভব-খ্রীস্ট থেকে বুদ্ধ, অ্যাপোলো থেকে রামচন্দ্র কিংবা আর্মেনীয় কাব্যগাথার সনাসর–সবাই।(২) এমনকি এই সেদিন, চৈতন্যদেবের জন্মও দেখি জগন্নাথ মিশ্রের হৃদয় থেকে শচীর হৃদয়ে। পৃথিবীর সৌর বংশতালিকায় আরও এক আশ্চর্য মিল হল–এই সৌর বীরেরা জন্মের পরেই এমন সব বিপদ-আপদের মধ্যে দিয়ে মানুষ হন, যা তাঁদের পরবর্তী শৌর্য বীর্যকে প্রতি তুলনায় আরও উজ্জ্বল করে তোলে। কংসের ভয়ে যেমন কৃষ্ণের জীবন বিপন্ন। হেরডের ভয়ে তেমনি খ্রীস্টের, ফারাওদের ভয়ে তেমনি মোজেসের। আবার জন্মের পরেই কৃষ্ণ যেমন গোপপল্লীতে নিবাসিত, ভীষ্ম তেমনি পরিত্যক্ত হয়েছেন গঙ্গার কূলে, সূর্যপুত্র কর্ণ নদীতে আর মোজেস পরিত্যক্ত হয়েছেন নলখাগড়ার বনে।(৩)
জন্ম-মুহূর্তেই এই পুত্র বিসর্জন নাকি সৌর দেবতার জীবনে অত্যন্ত জরুরী, কেননা এতে জন কিংবা ভক্তমানসে যুগপৎ করুণা, ভয় এবং শেষ পর্যন্ত বিস্ময়ের সঞ্চার হয়। কাজেই সৌরশক্তিসম্পন্ন দেবতা বীরদের অলৌকিক জন্ম নিয়ে আমরা বেশি সময় নষ্ট করব না। কৃষ্ণ কংসের কারাগারে জন্মেছেন। অত্যাচারী কংসের ভয়ে পিতা বসুদেব তাঁকে রেখে এসেছেন ঘোষপল্লীতে, বন্ধু নন্দগোপের কাছে। সৌর দেবতার ছাঁচে ঢালা শুধু এইরকমই একটা জীবন যদি হত কৃষ্ণের, তাহলে এই প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজন পড়ত না। মুস্কিল হয়েছে বর্তমান লেখক কৃষ্ণকে ঐতিহাসিক পুরুষ বলেই মনে করে। কাজেই তাঁর বাল্যজীবন এবং যৌবনে অলৌকিকতার ভাগ যদি অনেকখানি থাকেও, তবু তাঁর বাল্য, কৈশোর কিংবা যৌবনটাও মিথ্যে নয়। বিশেষত তাঁর জীবনকালের এই অংশটুকু আভিধানিক অর্থেই বড় সফল, কাজেই আমাদের পূর্ব প্রতিজ্ঞামত কৃষ্ণচরিত্রের এই অংশটাও বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। এই মুহূর্তে অত্যাচারী কংসের কথা আমরা আলোচনা করব না, কেননা তার সময় আসবে কৃষ্ণের প্রথম যৌবনের শেষাশেষি। কৃষ্ণকে যারা শুধু রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই চেনেন, তাঁরা জানেন, রাজনীতির ক্ষেত্রে কৃষ্ণ একা ছিলেন না। সেখানেও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গ ছিল, বিরোধী পক্ষ ছিল, আর ছিল স্তুতি-নিন্দার জ্বর এবং তার জন্যে সুখ-অসুখ দুইই। এমন বড় মাপের একটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন এবং যৌবনও যে খুব একটা তরঙ্গহীন সাধারণ পর্যায়ের হবে, তা আমি মনে করি না। এমনকি তাঁর বাল্যকালটিও মোটেই ভাবলেশহীন নয়। ভগবত্তার জয়কার এখানে যতটুকু আছে, তার থেকে অনেক বেশি আছে মানব শিশুর দৌরাত্মি।
না না, আমরা এখানে পালাগান করতে বসিনি কিংবা বসিনি ভাগবতপাঠের আসরে যে, নানা সুরে হরি বলে সেই লীলা গাইব। তবে যেটা না বললে নয়, তা হল যশোদা-মায়ের মমতা-মাখা গল্পগুলিও যথেষ্ট পুরানোঅন্তত ততখানিই পুরানো যতখানি বিষ্ণুপুরাণ কিংবা হরিবংশ। পণ্ডিতদের ধারণা যে কৃষ্ণ ব্রজে ‘নবনীত-চৌর’ বলে প্রসিদ্ধ কিংবা যাঁর দুষ্টুমি ছিল নিতান্তই অভিনব, তাঁর সমস্ত গল্পগুলিই পুরাণ রচনার বহুকাল আগে থেকেই লোকমুখে প্রচলিত ছিল, ইংরেজিতে যাকে বলে oral tradition তাই।(৪) বাস্তবিকপক্ষে একথা অবিশ্বাস করারও কোনও কারণ নেই। নইলে দেখুন, প্রায় একই সময়ে হরিবংশ-পুরাণ, ভাসের বালচরিত নাটক, এবং প্রাকৃত ভাষার কবি সাতবাহন হালের গাহাসত্তসঈ–এগুলি সবই একযোগে অন্য মাতৃস্থানীয় ব্রজগোপীদের মুখে দুষ্টু-কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। এই দুষ্টুমি স্থান পেয়েছে প্রাচীন শিলালিপিগুলিতেও এবং তাও খ্রীষ্টীয় কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই। এখনকার ভেলোরে রাখা একটি শিলালিপিতে তো কৃষ্ণ পুরো কান ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, যদিও এই শিলালিপিটি আরও পরের। শিলালিপি কোন ব্যক্তিচরিত্রের ঐতিহাসিকতার প্রমাণ কি না জানি না, কিন্তু লোকপ্রিয়তার প্রমাণ তো বটেই। আবার যে মানুষটি এত লোকপ্রিয় তিনি কি একেবারেই কল্পলোকের আকাশ থেকে উড়ে এসে শতাব্দীর মায়ের কোল জুড়ে বসলেন? বস্তুত যশোদা যদি মিথ্যে হয়, তবে রাধাও মিথ্যে, আহিরিণী যুবতীরাও সব মিথ্যে।
সাহিত্যের মধ্যে প্রাকৃত ভাষায় লেখা সাতবাহন রাজা হালের গাহাসত্তসঙ্গ বোধহয় প্রথম, যার মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যকাল এবং যৌবনের তিনটি ঘটনার উল্লেখ আছে, যা প্রক্ষিপ্তবাদের আওতায় পড়ে না। খ্রীস্টপূর্ব ২৩৫ শতাব্দ থেকে আরম্ভ করে ২২৫ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময়ে হালের সময় নির্ধারিত। হালের সংগৃহীত একটি শ্লোকে দেখি-যশোদা মাতৃস্নেহে উদ্বেলিত হয়ে বলছেন-কৃষ্ণ আমার এখনও দুগ্ধপোষ্য শিশু-অজ্জ বি বালো দামোঅরত্তি–এই কথা শুনে কৃষ্ণের মুখের দিকে তেরচা করে তাকিয়ে ব্রজবধূরা সব মুখ লুকিয়ে হাসিছল।(৫)
সম্পূর্ণ শ্লোকটির মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে ব্রজবধূদের রহস্যজনক সম্বন্ধটি যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি যশোদার বাৎসল্য–যা অন্য সব পুরাণগুলিতে সবিস্তারে বর্ণিত। কৃষ্ণ-গোপী সম্বন্ধে এ শ্লোকটি যদি সাধারণ উল্লেখমাত্র হয়, তাহলে একেবারে স্পষ্ট করে রাধার উল্লেখও পাব হালেরই গাথায়। কবি বলেছেন–কৃষ্ণ! তুমি যখন ফুঁ দিয়ে রাধার চোখে-পড়া ধূলিকণাটি উড়িয়ে দিচ্ছিলে, তখনই অন্য ব্রজবধূদের গর্ব ধুলোয় মিশে গিয়েছিল।(৬)
পণ্ডিত আর সি হাজরা মশায় ভাগবত পুরাণকে ষষ্ঠ সপ্তম খ্রীস্টাব্দের পরে স্থান দিয়েছেন, কিন্তু হালের এই কবিতার মর্ম উপলব্ধি করতে পারবেন তিনিই, যিনি ভাগবত পুরাণের রাসপঞ্চাধ্যায়ীতে একবারটি নজর দেবেন। রাসনৃত্যের মাঝখানে সমস্ত গোপীদের মধ্যে থেকে এক ধন্যা তরুণীকে কৃষ্ণ প্রায় কোলে করেই উঠিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে গেছেন। ভাগবতকার এই তরুণীর নাম বলেননি, কিন্তু সেই গোপীর ভাগ্যলিপিতে রাধার নামই শুধু আবছা করে পড়া যায়। পুরাণ বলেছে–কৃষ্ণ এক কাজে দুই কাজ করেছেন–প্রশমায় প্রসাদায়, রাধাকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে তিনি অন্য গোপীদের কৃষ্ণসম্বন্ধীয় গর্ব খর্ব করেছেন আর রাধাকে দেখিয়েছেন-”আমি তোমাকেই সব থেকে বেশি ভালবাসি। হালের ভাষায় যার চোখে এককণা ধুলো পড়লেও কৃষ্ণ স্থির থাকতে পারেন না, ভাগবতকার তাকেই নিয়ে এসেছেন বিজন বনে; কৃষ্ণ তাকে উঁচু করে ধরেছেন–সে ফুল তুলবে বলে। তাকে আপন হৃদয়ের গোপন কথাটি বলে দিয়েছেন পথ চলতে চলতে। শেষে সে বলল–আর পারছিনে গো হাঁটতে। এই কাতর অনুবন্ধে প্রেমিক কৃষ্ণ আর স্থির থাকতে পারেননি, তিনি বলেছেন-হাঁটতে হবে না তোমাকে, তুমি আমার কাঁধে উঠে পড়–এবমুক্তঃ প্রিয়ামাহ স্কন্ধ আরুহ্যতামিতি।(৭)
কৃষ্ণপ্রিয়া এই সৌভাগ্যবতী রমণীটি বেশ কয়েকবার ভাগবত পুরাণের মধুরতম শ্লোকগুলি অধিকার করেছে আর অন্য শ্লোকে ধরা পড়েছে শতগোপীর ঈর্ষা, বেদনা। ঠিক এইখানেই হালের শ্লোকটির সঙ্গে ভাগবতের শ্লোকরাজির মূল সুরে তফাত কোথায়?
পণ্ডিতেরা যতই বলুন-মহাভারতের কৃষ্ণ আলাদা, আর রাধাহৃদয়ের অবুঝ অধিবাসীটি আলাদা–আমি বিশ্বাস করি না বা করতে চাই না। বরঞ্চ চৈতন্যদেবকে আমি অনেক বড় ঐতিহাসিক বলে মানি। তাঁর মতে মহাভারতের বাসুদেব কৃষ্ণ হলেন ঐশ্বর্যের কৃষ্ণ, আর ব্রজগোপীদের কৃষ্ণ হলেন মাধুর্যের কৃষ্ণ–দুজনে একই। তবে চৈতন্যদেব কৃষ্ণের সেই কৈশোরগন্ধী যুবক বয়সটাকে ভালবাসেন, মথুরা-দ্বারকার রাজবেশী পরিণত পুরুষটিকে তিনি শুধু মাথায় রাখেন।(৮) যাঁরা বড় বড় রাজনৈতিক নেতা বলে আজকেও পরিচিত, তাঁদের জীবনেও কি যৌবনোচ্ছল কোন অধ্যায় থাকতে নেই; থাকতেই পারে। তাতে নিন্দাপর্ক একেবারে ঘুলিয়ে উঠতে পারে বটে, কিন্তু তা অসত্য নাও হতে পারে। মহাভারতে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হচ্ছিল, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণ গোপীজনপ্রিয়’ বলে খুব কেঁদেছিলেন, সে ডাক কৃষ্ণের কানে পৌঁছলেও, পুনা থেকে যাঁরা মহাভারতের পরিশুদ্ধ সংস্করণ বার করেছেন, তাঁদের কানে পৌঁছোয়নি, বঙ্কিমের কানেও তা বাঁকা শুনিয়েছে। শুধু : মজা হল, মহাভারতের সংস্কারকেরা বাল্যবয়সে কৃষ্ণের পূতনাবধ, কেশিবধ মেনে নিয়েছেন, গোবর্ধন-ধারণের মত অলৌকিক ঘটনাকেও প্রক্ষেপ বলেননি, কিন্তু বাদ সাধল শুধু কৃষ্ণের গোপীজনপ্রিয়তা।
পুরাণবেত্তা মানে মিথলজিস্টরা কিন্তু বলেন, পৃথিবীতে যাঁরা সৌরকক্ষের দেবতা বলে পরিচিত, তাঁরা বীরের ধর্মে যতখানি বড়, ভালবাসার ব্যাপারেও ততখানি দৃঢ়। গ্রীকদেবতা অ্যাপোেলোর কথা ভাবুন, একে তিনি সৌরকোটির দেবতা, তাতে কৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর বড় মিল। স্বীকৃত এবং বিবাহিত প্রেমে কৃষ্ণের যেমন রুক্মিণী, গ্রীক-সূর্যের তেমনি কোথ, কৃষ্ণ যেমন অষ্টমহিষীর নায়ক, অ্যাপোলোর তেমনি ড্যাফেন, কীরেনি, বিওবিস কি করোনিস। আর রাসলীলা! মিউজদের সঙ্গে অ্যাপোলোর নাচা-গানা খেয়াল করুন। ভাগবতে শুকদেবের রাসস্তুতির মত হেসিয়ডের স্তুতিটিও মাথায় রাখুন–”There the long-robed Ionians gather in your honour with their…shy wives’; “the girls of Delos, hand-maidens of the Far-shooter’, ‘Shall I sing of yoụ as wooer in the fields of love, how you went wooing the daughters of Azan. (Hesiod, Theogony)(৯)
একথাটা পরিষ্কার মনে রাখা দরকার যে পৃথিবীর সৌর দেবকুলের বেশিরভাগ দেবতার প্রেম এবং বীরত্ব দুইই বড় বেশি। ঋগবৈদিক দেবকল্পে যিনি সৌর দেবতা হিসেবে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন, সেই ইন্দ্রের বীরত্বগাথায় যেমন ঋগবেদ ছেয়ে গেছে, তেমনই প্রেমিক হিসেবে তাঁর গুণপনাও কম নয়; এমনকি পরকীয়া প্রেমেও তাঁর চরিত্র যথেষ্ট কলঙ্কিত। তার প্রমাণ আছে বেদ, ব্রাহ্মণ, রামায়ণ, মহাভারত এবং সমস্ত পুরাণগুলিতেও। আমাদের ৪০ ধারণা–ঋগবৈদিক বিষ্ণুর পরিত্রাতার ভূমিকা যেমন কৃষ্ণজীবনের পরবর্তী অধ্যায়ে মিশে গিয়েছিল, অপর সৌর দেবতা ইন্দ্রের অসামাজিক অপপ্রেমগুলিও তেমন স্থান করে নিয়েছে কৃষ্ণের পূর্বজীবনের রঙ্গরসে। পণ্ডিতেরা জানিয়েছেন যে, ইন্দ্রপূজার সঙ্গে কৃষ্ণপূজার একধরনের বিরোধ ছিল।(১০) এই বিরোধে কৃষ্ণ শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রের ওপর জয়ী হলেও, দিন যত যাচ্ছিল, ইন্দ্রের বীরত্বসূচক গুণগুলি কৃষ্ণের শৌর্যবীর্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল।(১১) আবার ইন্দ্রের প্রেমিক স্বভাবটিও একাত্ম হয়ে যাচ্ছিল কৃষ্ণের সঙ্গে। ঝগবৈদিক ইন্দ্রের পরবর্তী সময়ে, কারও যদি বিভিন্ন রকমের, বিভিন্ন আকৃতির অসুর-দৈত্য বধের কৃতিত্ব থাকে, সে কৃষ্ণের। কেউ যদি ধর্ম এবং দর্শনের বড় প্রবক্তা বলে গণ্য হন তো সে কৃষ্ণ। ইন্দ্র বৃত্র বধ করেছিলেন, কৃষ্ণ বধ করেছেন শম্বরাসুরকে, যে বৃত্রেরই প্রতিমূর্তি বলে গণ্য। ইন্দ্র বিরাট সাপটিকে মেরে সপ্তসিন্ধুর গতি মুক্ত করলেন, কৃষ্ণও কালিয় দমন করে যমুনার জলকে করলেন পরিস্রুত, মুক্ত।(১২) কাজেই কৃষ্ণের প্রেমিক স্বভাবটিও যে উত্তরাধিকারসূত্রে এই স্বর্গস্বভাব থেকেই আসবে, এতে আশ্চর্যের কি আছে!
আশ্চর্যের বিষয় হল, বীরত্বে আর প্রেমে গ্রীকদেবতা দুই ভাগ হয়ে যান না। কিন্তু প্রেমিক রসিক কৃষ্ণের সঙ্গে বীরকৃষ্ণকে মেলানো যায় না–এটাই আমাদের পাণ্ডিত্য। কৃষ্ণ যদি শুধু কংসের জ্যাঠতুতো বোনের ছেলে হিসেবে পরিচিত হতেন তা হলে দোষ হত না। গোয়ালাদের ঘরে মানুষ হলেও সারাজীবন তাঁর ওঠাবসা ছিল আর্য নরপতিদের সঙ্গে; বরঞ্চ অনার্য বলে পরিচিত যাঁরা তাঁদেরই তিনি যম হয়ে উঠলেন, কিন্তু অল্পবয়সের হৃদয়ে প্রেম জন্মালে তারও তো একটা পথ চাই। বধের আগে শিশুপাল চিৎকার করে বলেছিলেন–জরাসন্ধ কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করে সম্মান খোয়াতে চাননি, কেননা কৃষ্ণ দাস জাতির ছেলে–যো’নেন যুদ্ধং নেয়েষ দাসোয়মিতি, সংযুগে। শিশুপাল মহামতি ভীষ্মের মুখের ওপর বলেছিলেন–উচ্চকুলে জন্ম নিয়ে গয়লার ছেলের প্রশংসা করতে তোমার লজ্জা করে না। তুমি কি জান-জরাসন্ধ যখন ব্রাহ্মণ বলে কৃষ্ণকে পাদ্য-অর্ঘ্য জুগিয়েছিলেন, তখন শুধু নীচকুলতার জন্যই সেই পাদ্য-অর্ঘ্য কৃষ্ণ গ্রহণ করতে সাহস পায়নি।(১৩) শিশুপালের এই সব কথা শুধু গালাগালিও হতে পারে, আবার সত্যও হতে পারে এবং সত্যি কথা বলতে কি সত্যই বটে। আমাদের কথা হল, মহাভারতের মধ্যেই তাহলে গোপকৃষ্ণের সত্তা স্বীকার করা হচ্ছে, কিন্তু পণ্ডিতেরা তবু গোপীদের অস্তিত্বে সন্দিহান। আমরা বলি গোপেরা থাকলে, গোপীরাও থাকবে এবং তাদের প্রেমও যে থাকবে, তাতেই বা আশ্চর্য কি?
আমার ধারণা, শুধু কৃষ্ণ কেন, কৃষ্ণের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে এই গোপ-গোপীদের সম্পর্ক বহুদিনের। কৃষ্ণের পূর্বপুরুষদের সম্বন্ধে দু-চার কথা পরে বলতেই হবে, তবে একটা কথা এখনই বলা প্রয়োজন। গোপালক ব্রজবাসীরা মহারাজ কংসের রাজ্যভুক্ত ছিলেন, সে কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কৃষ্ণের পালক পিতা নন্দ, যিনি অবশ্যই রাজা বলেই পরিচিত, যদিও সামন্ত নৃপতি, কংসের করদ, তবুও তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি গোপালক। কিন্তু তাঁর সঙ্গে অভিজাত যদুবংশীয় পুরুষ বসুদেবের এত ভাব কেন? এতই ভাব যে তিনি তাঁর কয়েকটি স্ত্রীকেই রেখে দিয়েছেন নন্দগোপের ঘরে, ছেলেরাও সেখানেই জন্মাচ্ছে। আরও একটা কথা আছে হরিবংশে, ব্রহ্মপুরাণে, যেখানে বসুদেবের অন্যান্য পুত্ৰ-পরিবারের কথা সবিস্তারে বলা হচ্ছে, সেখানে হঠাৎ করে অত্যন্ত অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই দুই পুরাণই গর্গবংশীয় এক পুরুষের কথা উল্লেখ করেন। বলার ভঙ্গিটা ঠিক এইরকম–”বসুদেবের ঔরসে বৃদেবী (বসুদেবের চৌদ্দ বউ-এর এক বৌ) মহাত্মা অনাবহকে জন্ম দিলেন। ত্রিগর্তরাজার এক মেয়ে ছিল, তার স্বামী ছিল গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণ।”(১৪) তারপর এদের পুত্রজন্মের ইতিহাস।
মজা হল, বসুদেবের সঙ্গে এই গর্গগোত্রীয় শৈশিরায়ণের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই বলে আপাতভাবে মনে হয়। কিন্তু গর্গ ছিলেন বসুদেবদের কুলপুরোহিত। হরিবংশ একবার এই শৈশিরায়ণের কথা বলেছে বটে কিন্তু অন্য দুই জায়গায় সোজাসুজি তার নাম বলেছে গাৰ্গ বা গর্গ এবং বলেছে তিনি ছিলেন যাদবদের কুলপুরোহিত। তিন জায়গাতেই ছেলের নামটি কিন্তু একই আছে। কাজেই আমি আমার বক্তব্যটি এবারে পরিষ্কার করতে পারি। আমার ধারণা এই গর্গ যদুবংশেরই লোক ছিলেন। তার কারণ হরিবংশ এবং পুরাণগুলিতে যেখানে যেখানে বংশবর্ণনা আছে, সেখানে সেখানেই দেখা যাবে, এক ক্ষত্রিয় বংশের চার ছেলের মধ্যে একজন ব্রাহ্মণ হয়ে গেল, পাঁচজনের মধ্যে দুজন ব্রাহ্মণ হয়ে গেল। ক্ষত্রিয় রাজা বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণ হওয়ার ঘটনা অনুসরণ করেই হোক, বা এমনি-এমনিই, ক্ষত্রিয় বংশ থেকে হঠাৎ ব্রাহ্মণ হয়ে যাওয়াটা অসম্ভব ছিল না। মৎস্যপুরাণ এদের বলেছে–ক্ষত্রোপেতা দ্বিজাতয়ঃ আর পারজিটার বলেছেন Ksatrian Brahmans. প্রমাণ উদ্ধৃত করে পাজিটার স্পষ্ট জানিয়েছেন-Even the brahmanical Bhagavata says plainly that Gargya (Gargas) from a ksatriya became a brahman.(১৫) যাই হোক আমার ধারণা গর্গ ছিলেন এই ধরনের ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ, নইলে বসুদেবের পুত্র-পরিবার বর্ণনার সময় তাঁর কথা আসবেই বা কেন? এইবার আসল কথাটা বলি। এই গর্গ বা গার্গ বা শৈশিরায়ণের আপন স্ত্রী বা শ্যালকের ধারণা ছিল যে গর্গ ছিলেন তোজাহীন পুরুষ। ব্রহ্মপুরাণ মতে তাঁর স্ত্রী তাঁকে সন্দেহ করতেন যে গর্গের বীর্যস্খলন হত না–জিজ্ঞাসাং পৌরুষে চক্রে ন চন্দে চ পৌরুষ। ব্যাপারটা কোনও কারণে তাঁর ভাইয়ের কানে যায়। তখন সেই ভাই মানে গর্গের শ্যালক প্রকাশ্য রাজসভায় সবার সামনে এমনভাবেই বলেন যাতে মনে হবে তিনি নপুংসক-অপুমানিতি রাজনি। গর্গই বা কম কিসে, ব্রাহ্মণ হয়ে গেছেন বলে কি তাঁর কোনও ক্ষমতাই নেই। রাগে তাঁর শরীর হয়ে গেল কালো, লোহার মত। আর ক্রোধের প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি হঠাৎ এক গোপকন্যা, তার নামও আবার গোপালী, তাকে ধরে মৈথুন আরম্ভ করলেন–গোপকন্যামুপাদায় মৈথুনায় উপচক্রমে।(১৬) সেই গোপালীই গর্গের ঔরসে জন্ম দিলেন কালযবনকে। কালযবনের কথা পরে আসবে। আমার শুধু জিজ্ঞাসা, এই গর্গ বা গার্গ-তিনি যদুবংশীয়ই হোন কিংবা তাঁদের আচার্য গুরু-তিনি কি আর কোন মেয়েছেলে খুঁজে পেলেন না, হাতের সামনে একটি গোপকন্যাই খুঁজে পেলেন? পুরাণকারেরা বলেছেন এই গোপকন্যাটি, নাকি স্বর্গের অপ্সরা, আমি বলি–কৃষ্ণের ভালবাসার গোপীদেরও অনেকেই বলেছে স্বর্গের অপ্সরা, কিংবা স্বর্বেশ্যা(১৭), আসলে গোপকন্যা গয়লার ঘরেরই মেয়ে।
এই ঘটনা থেকে আমার বোঝানোর জিনিস এইটুকুই যে, গোপালক আভীরজাতির সঙ্গে যদুবংশীয়দের দহরম-মহরম ছিল অনেক আগে থেকেই, কাজেই কৃষ্ণকে রাখাল রাজা নন্দের ঘরে পালিত হতে দেখে আমাদের আশ্চর্য লাগে না। অনেক পণ্ডিতই খুব করে অঙ্ক কষে দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে আভীরেরা ভারতবর্ষে ছিলেন বৈদেশিক। কিন্তু তার প্রতিবাদ করেছেন অনেকেই, এবং মহাভাষ্যকার পতঞ্জলির প্রমাণে বলা যায় যে, অভীরেরা খ্রীস্টপূর্ব দেড়শ শতাব্দীতেই শূদ্রবর্ণের শাখা হিসেবে গণ্য ছিল।(১৮) এই সময়েই যারা জাতি-বর্ণের ব্যবস্থায় স্থান পেয়ে গেছেন, তারা যে ভারতবর্ষে নবাগত, তা বলা যায় না। আভীর জাতির পুরুষেরা যে পরবর্তী ভারতবর্ষের ইতিহাসেও যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন, সে প্রমাণও আছে।(১৯) অন্য দিকে কুষাণ যুগের প্রথম পর্বেই মথুরার স্থাপত্যে দেখতে পাই বসুদেবের হাত থেকে কৃষ্ণ চলে গেছেন নন্দগোপের হাতে। শেষ নাগের ছত্রছায়ায় বসুদেব পার হচ্ছেন যমুনা। মথুরার এই স্থাপত্য শিল্পের সঙ্গে তো ভাগবত পুরাণের বর্ণনার কোন তফাতই নেই। তাহলে কৃষ্ণের এইসব গল্পগাথাকে একেবারে অবচিীন প্রশস্তি বলে উড়িয়ে দিই কি করে? আরও একটা কথা আছে। বৌদ্ধ গ্রন্থ ঘট জাতকে দেখা যাচ্ছে বাসুদেব এবং তাঁর ভাইয়েরা সব কংসের বোন দেবগভূভার ছেলে। তাদের পালনের ভার পড়ল যাঁদের হাতে, তাঁদের একজন নাকি দেবগভূভার (মানে অবশ্যই দেবকীর) পরিচারিকা। তার নাম নন্দগোপা এবং আরেকজন তাঁর স্বামী অন্ধকবে।(২০) ঘট জাতকের সব সংবাদই চিরন্তন ব্রাহ্মণ্য গাথাগুলির সঙ্গে মেলেনি বলে পণ্ডিতেরা অনেকেই এগুলিকে উল্টোপাল্টা বলেছেন কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা, নন্দগোপা না হয় যশোদা, না হয় স্বামীর নামেই তিনি মিসেস নন্দ হলেন–কিন্তু এই ‘অন্ধকবেটি কে? কৃষ্ণ তো অন্ধকবৃষ্ণি কুলেরই বংশধর, এবং ‘অন্ধকবে অবশ্যই অন্ধকবৃষ্ণি শব্দেরই অমার্জিত রূপ। অন্ধক এবং বৃষ্ণি এরা দুজনেই যদুবংশেরই অধস্তন পুরুষ বলে পরিচিত। আমরা আগেই বলেছি–যদুবংশীয় পুরুষদের সঙ্গে গোপালকদের গভীর সম্বন্ধ ছিল। তাই ঘটজাতকের সংবাদ শুনে আমাদের মনে হয়, এ সম্বন্ধ ছিল এতটাই যে, অন্ধকবৃষ্ণিকুলের পুরুষেরা গোপালক নন্দকে অন্ধকবৃষ্ণিদেরই একজন বলে ভাবতেন, যার জন্য তাঁর নামই হয়ে গেছে অন্ধকবৃষ্ণি বা অন্ধকবেহ্নু।
বসুদেব তাঁর জ্যেষ্ঠা পত্নী রোহিণীর গর্ভসম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই নন্দগোপের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রোহিণীর গর্ভে জন্মেছিলেন বলরাম। আর কৃষ্ণকে নন্দগোপের হাতে শুধু পালন করতে দিয়ে তিনি আর নিজের ঋণ বাড়াতে চাননি। তিনি বললেন–”রৌহিণেয় বলরাম আমার বড় ছেলে, আর কৃষ্ণ তোমার ছোট ছেলেস চ পুত্রো মম জ্যায়ান কনীয়াংশ্চ বাপায়। তুমি এদের দুজনকেই রক্ষা কোর।”(২১) একজনের মা গর্ভবতী অবস্থায় ব্রজে এল, অন্য ছেলেটি জ্বলজ্যান্তই এল চুপিসাড়ে, এদের সম্বন্ধে কি ব্ৰজে কোন কথাবাতাই হোত না? নিশ্চয়ই হোত এবং জনগণের চোখে এই ছেলে দুটির আলাদা একটা মূল্যও ছিল। যেদিন গোবর্ধন পাহাড়কে হাতে তুলে ধরে বৃষ্টি বন্যার হাত থেকে সমস্ত মানুষকে কৃষ্ণ রক্ষা করলেন, সেদিন বৃদ্ধ গোপেরা এবং তাদের জাতি-গুষ্ঠি কৃষ্ণকে বলল–এত অল্প বয়সেই তোমার এই শক্তি! তুমি মানুষ নও, দেবতা; আজকে তোমায় বলতেই হবে কি করে বসুদেব তোমার পিতা হলেন–কিমর্থঞ্চ বসুদেবঃ পিতা তব।(২২)
বিচক্ষণেরা বলেছেন–ব্রজের লোকেরা তখনও কেউ কৃষ্ণকে বসুদেবের ছেলে বলে চিনত না। অতএব এখানে বসুদেব মানে গোপরাজ নন্দকেই বুঝতে হবে। আমাদের জিজ্ঞাসা, কৃষ্ণ নন্দের ঘরেই বড় হচ্ছিলেন। সেখানে নন্দ কেমন করে তোমার বাবা হলেন–এ প্রশ্ন বাতুলের। যদি এ প্রশ্ন তারা করেও থাকে, তবে তাদের মনে সন্দেহ আছে যে, কৃষ্ণ হয়তো নন্দের ছেলে নয়। বিশেষত জনগণ খবর রাখে বেশি। আবার বসুদেব অর্থ যদি বসুদেবই ধরি তাহলেও বুঝতে হবে সাধারণের মনে সঙ্গত প্রশ্ন আছে–তুমি পালিত হচ্ছ এখানে, অথচ তোমার বাবা আসলে বসুদেব। হয়তো পুত্র বদলের ব্যাপারটা তারা ঘোলাটে হলেও জানতেন। তাই তাদের প্রশ্ন–তোমার কাজকর্ম অলৌকিক, অথচ গয়লাদের মত ছোট ঘরে তোমার জন্মবলঞ্চ বাল্যে ক্রীড়া চ জন্ম চাম্মাসু গহিতম।(২৩) জনসাধারণ আজকে সত্য কথাটা বার করে নিতে চায়; তারা বলে–কি দরকার বাপু তোমার, কেন গোপবালকের ছদ্মবেশে আমাদের মত ছোট জাতের ঘরে আনন্দ করে বেড়াচ্ছ–কিমর্থং গোপবেশেন রমসে’ স্মাসু গহিতম। লক্ষণীয়, কৃষ্ণ এই সময় নিজেকে চাপা দিতে পারলে বাঁচেন। তিনি বললেন–আপনারা আমাকে তেমন বিরাট কিছু ভেবে দূরে সরিয়ে রাখবেন না, আমি আপনাদেরই একজন–তথাহং নাবমন্তব্যঃ স্বজাতীয়ো’স্মি বান্ধবঃ। সবচেয়ে বড় কথা যদি আপনারা আমাকে নিতান্তই বন্ধু বলে মনে করনে, তবে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করবেন না-পরিজ্ঞানেন কিং কাৰ্য্যম। এ ব্যাপারে যত চুপ করে থাকবেন ততই আমার ওপর অনুগ্রহ করা হবে। আর যদি নিতান্তই আমার কথা সবিশেষ জানতে হয়, তাহলে অপেক্ষা করুন-কালঃ সংপ্রতিপাল্যতা-সময়ে সব জানতে পারবেন। এই কথা শুনে গোপজনেরা একেবারে মুখটি চেপে মানে মানে যে যেদিকে পারেন চলে গেলেন বদ্ধমৌনা দিশঃ সর্বে ভেজিরে পিহিতাননাঃ।(২৪)
আমি আগে বলেছি, অন্ধক বৃষ্ণিরা যেহেতু গোপরাজ নন্দকে তাঁদেরই একজন বলে ভাবার চেষ্টা করতেন তেমনি কৃষ্ণবলরামেরও সারাজীবন আকুল চেষ্টা ছিল নিজেকে গোপজনের একজন বলে দেখাবার-স্বজাতীয়ো’স্মি বান্ধবঃ। বৃদ্ধগোপেদের মনে নানা প্রশ্ন জাগছিল, তাদের মেয়েরাও আর বাগ মানছিল না, কেননা হরিবংশে এই গোপেরা মুখ চেপে চলে যাবার পরেই রাসনৃত্যের সময় এসেছে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা-গোপ-গোপীরা একেবারে পুরোপুরিই কবি-কল্পনা নয়। ইতিহাসের চোখ কচলে দেখা যাবে, গোপ-গোপীরা আকাশ দিয়ে উড়ে এসে কবির মনোভূমি জুড়ে বসেননি। কবিকল্পনা–তা সে যতই লাগামছাড়া হোক না কেন, তারও একটা সামাজিক ঐতিহাসিক পটভূমিকা থাকবে, যার জন্যে কাব্যে নাটকে, শিলালিপিতে যেখানেই গোপীদয়িত কৃষ্ণকে পাই তার চরিত্র তো বদলায়নি কোথাও। এমনকি তাঁর রাজনৈতিক ছল-চাতুরির সঙ্গেও তাঁর পূর্বজীবনের প্রেম-চাতুরির মিল আছে। পণ্ডিতেরা কোমর বেঁধে বলবেন, খ্রীস্টপূর্ব সময়ের কোন শিলালিপি যেহেতু বৃন্দাবনের রাখালরাজার কথা বলেনি, অতএব ওসব অনেক পরের কথা-কবিদের কল্পনাবিলাসে তৈরি। আমার বাতুল মনে জিজ্ঞাসা জাগে-ভারতবর্ষের পুরাতাত্ত্বিকদের কাছে খ্রীস্টের জন্ম সময়টি, কৃষ্ণ-জন্মের কাল থেকে অনেক বেশি জরুরী। কেননা যা কিছুই পুরানো, তার খবর যদি খ্রীস্টজন্মের আগে না হয়, তাহলে সেটির পৌরাণিকতা নিয়ে নানান বিবাদ হবে। বিশেষত ধরুন কোন মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যদি বেশ কিছু সূত্র না থাকে এবং কোন পুরাতন সাহিত্যে যদি তাঁর উল্লেখ না পাওয়া যায়, তবে পণ্ডিতেরা বলবেন, সে মানুষের ঐতিহাসিকতাও নেই, পৌরাণিকতাও নেই। অর্থাৎ কিনা ডি এল রায় যদি ঊনবিংশ শতাব্দীতে শাজাহান কিংবা চন্দ্রগুপ্ত নাটক লেখেন তাহলে বুঝতে হবে শাজাহান তাঁর পঞ্চাশ বছর আগে জন্মেছিলেন আর চন্দ্রগুপ্তের কথা ছেড়েই দিলাম। আমি আগেও বলেছি–কোন ঐতিহাসিক পুরুষ যদি বিখ্যাত হন, তবে তাঁর কথা তাঁর সমকালে যতখানি শোনা যেতে পারে, তার থেকেও বেশি শোনা যেতে পারে পরে। সাহিত্যের বিষয়বস্তু হতে সময় লাগে আরও বেশি। তবে পাঁচ রকমের সাহিত্যে সেই মানুষটির আকার-প্রকার-স্বভাব যদি একই রকমের হয়, তবে তাঁর ঐতিহাসিকতায় সন্দেহই বা করি কি করে? রাখালিয়া কৃষ্ণের সম্বন্ধে পাথুরে কোন প্রমাণ যেহেতু খ্রীস্টপূর্বাব্দে পাই না (খ্রীস্ট জন্মের কিছু দিনের মধ্যে অবশ্য পাই), তাই সাহিত্যগুলিই হবে গোপকৃষ্ণের ঐতিহাসিক আশ্রয়।
আর একটি কথা। আমাদের প্রাচীন পুরাণকারেরা একেবারে গর্দভ ছিলেন না; গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে একটা নিয়ম-বিধি তাঁদের মত করেই তাঁরা তৈরি করেছিলেন। যে সব ঘটনা একবার সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে, সেই ঘটনাগুলিরই বিস্তৃত পুনরাবৃত্তি যে গ্রন্থরচনারীতির পরিপন্থী-এটা তাঁরা কথঞ্চিৎ নিশ্চয়ই জানতেন। আবার যে সব ঘটনা খুবই বিখ্যাত, সেগুলির দ্বিরাবৃত্তি করাও তাঁরা সঠিক মনে করতেন। পাঠক খেয়াল করবেন, হরিবংশের কথকঠাকুরকে গ্রন্থারম্ভেই নতুন কথা বলতে অনুরোধ করা হয়েছে। শৌনক বললেন–সৌতি মুনি। আপনি আমাদের মহাভারতের অমৃতকথা সবিস্তারে জানিয়েছেন, জানিয়েছেন কি করে কুরুবংশের প্রতিষ্ঠা হল (পাণ্ডবেরাও এই কুরুবংশের মধ্যেই পড়েন, কেননা কুরু তাঁদেরও বহুপূর্ব পুরুষ)। কিন্তু আপনি বলেননি সেই বৃষ্ণি এবং অন্ধকদের কথা, যা অন্তত দয়া করে এখন বলতে পারেন ন তু বৃষ্ণন্ধকানাঞ্চ তন্ ভন্ বক্তৃমহসি।
সত্যি কথাই তো, সারা মহাভারত জুড়ে তো শুধু পাণ্ডব আর কৌরবদের ক্রমিক প্রতিষ্ঠার কথা। কিন্তু দুরে থেকে যিনি দক্ষ বাজিকরের মত তাঁর কুহক-সুতোয় পাণ্ডব-পুত্তলিকাদের নাচাচ্ছিলেন, তাঁর নিজের মাতৃ-পিতৃবংশ অন্ধক বৃষ্ণিদের কথা কেউ তো বলেনি। প্রতিষ্ঠিত রাজা কংস-জরাসন্ধের নিগ্রহের ব্যাপারে পাণ্ডবদের থেকে, বৃষ্ণি-অন্ধকদের অবদান অনেক বেশি। এই তো পুরাণগুলির কাজ-বংশো মন্বন্তরাণি চ–কোন পুরাণ যদি বিশেষ একটি বংশের কীর্তিকলাপ সংকীর্তন করে তো আরেক পুরাণ অন্য বংশের। মহাভারত যদি কৃষ্ণের পরিণত বয়সের ইতিহাস হয়, তো হরিবংশ হল তাঁর যৌবনোচ্ছ দিনগুলির রঙিন ইস্তাহার। ঠিক যেমন এই সেদিনও, বৃন্দাবন দাস চৈতন্যজীবনের পূর্ব ইতিহাসটুকু ধরেছেন চৈতন্যভাগবতে আর কৃষ্ণদাস কবিরাজ বিস্তার করেছেন তাঁর উত্তর জীবনকথা। হরিবংশও তেমনি মহাভারত কথার প্রতিপূরণ করেছে, কারণ প্রতিপূরণ করাই ইতিহাস পুরাণের কাজ। হতে পারে, কথকঠাকুরদের কল্পনার রঙে কৃষ্ণজীবনের অনেক কাহিনীই নতুন মাত্রা লাভ করেছে, তাই বলে কি মূল কাঠামোটাই মিথ্যে হয়ে যাবে! তা হতে পারে না এইজন্যে যে, আমরা অন্যান্য সাহিত্যকেও এ ব্যাপারে সাক্ষী মানব।
যে তথ্যটা ভীষণভাবে লক্ষ্য করার মত, সেটা হল–যে সময়ে উত্তর-পশ্চিম ভারতে গোপালক কৃষ্ণের জীবন কাহিনীগুলি কবির লেখনীমুখে নিঃসৃত হয়েছে, প্রায় সেই সময়েই দক্ষিণ ভারতের কবিরাও কৃষ্ণজীবনের এই কাহিনীগুলি উল্লেখ করেছেন একই সুরে। আধুনিক এক গবেষক বহু পরিশ্রমে দক্ষিণ ভারতের মায়োনের সঙ্গে কৃষ্ণের একাত্মতার প্রমাণ করে অতি প্রাচীন চঞ্চম সাহিত্যে কৃষ্ণের অনুপ্রবেশটি সুন্দর করে দেখিয়েছেন।(২৫) খ্রীস্টীয় দু-এক শতাব্দীর মধ্যে লিখিত ‘শিলঞ্চড়িকার নামে তামিল গ্রন্থটিতে দেখা যাচ্ছে মায়োন (মায়বন) এবং তাঁর স্ত্রী নপ্পিনাই–এঁরা অবশ্যই কৃষ্ণ রাধা)-পূজিত হতেন গোপ-গোপীদের দ্বারাই।
মিল কবি লিখেছেন–কেমন করে মাদুরাইয়ের রমণীরা বালিয়োন, (বলরাম) মায়োন আর নপ্পিনাই-এর অনুকরণে রাসনৃত্য করতেন। নাচের সময়ে তারা গান করে বলে, কেমন করে মায়োন কিশোরী নপ্পিনাইয়ের কাপড় আর গয়না চুরি করেছিল। কেমন করে এই ঘটনায় নগ্না নপ্পিনাইয়ের মুখটি লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে।(২৬)
আমরা বুঝি, এসব সেই বস্ত্র হরণের কথা। বৃন্দাবনের মেয়েদের সঙ্গে কৃষ্ণের এই সব ব্যাপার-স্যাপার পণ্ডিতেরা বিশ্বাস করতে চান না। কিন্তু উত্তর ভারতে বৃন্দাবনের নাম-খ্যাতি বহুদিনের। স্ত্রী-পুরুষের একই রকম বেচাল দেখলে আমরাও তো বলি-বৃন্দাবন বানিয়ে ফেলেছে। ঠিক একই রকম করে চতুর্থ শতাব্দীতেই উজ্জয়িনীর কবি জানতেন বৃন্দাবন মানেই মেয়েদের নিয়ে মজা করার জায়গা। কৃষ্ণের ভগবত্তা সম্পূর্ণ মাথায় রেখেও কালিদাস তাঁর স্বয়ংবরা নায়িকাকে উপদেশ দিয়েছেন–এই শূরদেশের রাজা সুষেণকেই তুমি বেছে নাও, তারপর ঠিক কুবেরের বাগানের মত সুন্দর সেই বৃন্দাবনের বনে প্রবেশ করে আপন যৌবন সফল কর বৃন্দাবনে চৈত্ররথাদনে নির্বিশ্যতাং সুন্দরি যৌবনশ্রীঃ।(২৭)
আর বৃন্দাবনে গোপ-গোপীদের নাচ দেখে সেটিকে অবাস্তব কবিকল্পনা ভাবার কোন কারণ নেই। গোপ-গোপীদের খানিকটা অবলীলায় নাচার-অভ্যেস ছিল। যার জন্যে তামিল কবিতায় নাচের প্রসঙ্গে বলরামের নাম এসেছে। সাধারণে জানেন শুধু কৃষ্ণই রাধা আর হাজারো গোপীদের সঙ্গে রাসের নাচটি নেচেছিলেন কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন বলরামেরও রাস আছে কোন কোন পুরাণে।(২৮) আবার একটা জিনিস দেখুন, এই নাচগুলি হয়েছে এমন অবলীলায় যে তার আগে পরে দু-একটা রাক্ষস কিংবা অসুরবধও হয়ে যাচ্ছে। জয়বল্লভের বজ্জালগ্নে দেখা যাচ্ছে রাধা খুব গর্বিত, কেননা কৃষ্ণের যে হাতখানি রাধার বক্ষবন্ধনী রাঙিয়ে দিয়েছে, সে হাতে লেগে ছিল কেশী দানবের রক্ত। বজ্জালগ্নের কথা রেখে দিন, হরিবংশে কি বিষ্ণুপুরাণে যে রাত্রে বিখ্যাত সেই রাসনৃত্য হচ্ছিল সেই নাচা-গানার মাঝখানেই এসে পড়েছে অরিষ্টার বা বৃষভাসুর। কিন্তু সেই অসুরটিকে মেরে কৃষ্ণ কিন্তু আবার ফিরে এসেছেন তাঁর অবশিষ্ট নাচটি নাচবার জন্য।(২৯) এ নাচটা গোপ-গোপীর সমাজে ছিল এতটাই সহজ, এতটাই স্বাভাবিক।
হালের আর একটি শ্লোকে তো কৃষ্ণের রাসনৃত্যেরই কথাই প্রায় উল্লিখিত। কোন নিপুণা গোপী কৃষ্ণের নৃত্যপ্রশংসার ছলা করে অন্য গোপীর স্বেদচিকন কপোলে প্রতিবিম্বিত কৃষ্ণকে চুম্বন করছিলেন।(৩০)
এই নৃত্যকে রাস বলে অভিহিত করুন বা অন্য কোন নামে গোপীসঙ্গে কৃষ্ণের নৃত্যবিলাস কিছু না কিছু যে হয়েই ছিল তার প্রমাণ আছে ভাসের নাটকেও, যে নাটকটি কোনক্রমেই দ্বিতীয়/তৃতীয় খ্রীস্টাব্দের পরে যাবে না। ভাসের এই বালচরিত নাটকের মধ্যে কৃষ্ণের বাল্যজীবনের অনেক ঘটনাই বিধৃত, এবং অনেকেই মনে করেন যে, এই নাটক রচিত হয়েছে হরিবংশের পটভূমিকায়। তা হতেই পারে, ভারতীয় সাহেবরা কিছু নাই বলুন, ইঙ্গলস্ সাহেব কিন্তু বলেছেন–হরিবংশে আমরা যেন এক নতুন জগতে প্রবেশ করি, কৃষ্ণকাহিনীর এই রূপ যেন সাধারণে প্রচলিত লোকগাথার অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে; এ যেন সেই চিরন্তনী বাধা-শুদ্ধতা থেকে অনেক মুক্ত, পরবর্তী পুরাণগুলির ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামি যেন হরিবংশের কৃষ্ণকাহিনীকে একটুও লাঞ্ছিত করেনি। এখানে আমরা প্রবেশ করি রাখালিয়ার বাঁশির ছন্দে বাঁধা এমন এক জগতে, যেখানে কেউ শহুরে ভদ্রতা পছন্দ করে না। এমনকি এদের স্বর্গলোকও কোন অভিজাতের ক্রীড়াভূমি নয়, সেখানে আছে শুধু গরু আর রাখালবালকেরা।(৩১) এমন একটা অনাবিল ধূসর জগতের অধিবাসী যারা, তাদের ন্যায়নীতিবোধের সঙ্গে চিরন্তন ব্রাহ্মণ্য নীতিবোধ যে মিলবে না তাতে আর আশ্চর্য কি? কাজেই কোন শারদ রাত্রিতে শত অভিসারিকারা এসে যদি নেচে থাকে রাখালবধুর সঙ্গে তাতে দোষ দেখি না কোনও। নাট্যকার হিসবে ভাস তো আরও বিশ্বাসযোগ্য চিত্র এঁকেছেন। সেখানে এক গয়লাবুডোর তত্ত্বাবধানে কৃষ্ণের নাচা-গানার আরম্ভ এবং আধুনিক পল্লীবাসী বুড়ো মুখিয়ার সঙ্গে সে গয়লাবুডোর কোন তফাত নেই। ভাসের নাটকে দামক নামে এক রাখাল ছেলে বৃদ্ধ-গোপালকের কাছে জানাচ্ছে–
ও খুড়ো, আজ যে আমাদের দামোদর কৃষ্ণ আসছেন এই বৃন্দাবনে; সে হল্পীসক নাচবে সব গোপবালিকাদের সঙ্গে।
বুড়ো বললে–তা বেশ তো! তাহলে আমরা সবাই মিলে সেই হল্লীসক দেখব।
নাচের নামে গয়লাবুড়ো ভাঙা গলায় এক গানই আরম্ভ করে দিল, আর গলা ছেড়ে ডাকতে লাগল বাছা বাছা সুন্দরী সব গোপরমণীদেরও ঘোষসুন্দরী, ও বনমালা, চন্দ্ররেখা, মৃগাক্ষি তাড়াতাড়ি এস সব। বাদ্যি-বাজনা নিয়ে এস সব–আন মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা।
একটু পরেই গয়লা বুড়ো জানাচ্ছে–শোন হে ছুকরিরা সব! সিংহ যেমন বেরিয়ে আসে পাহাড়ের গর্ত থেকে, তেমনি ধেয়ে আসছেন আমাদের দামোদর, তাঁর সঙ্গে আছেন সঙ্কর্ষণ বলরাম। দামক ছেলেটির বয়স বুঝি কম; সে কৃষ্ণের অবর্তমানে কিংবা হয়তো নাট্যশৈলীর অনুরোধ বনফুলের শোভায় সুবেশা ঘোষরমণীদের একটা দশাসই রূপবর্ণনা দিয়ে দিল। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে বলরামও জানালেন যে, গোপবালকেরাও সব তাদের বেসুক আর ডিণ্ডিমের বাদ্যি নিয়ে এসে গেছে। গোপবৃদ্ধের কাছে তাঁর আকুল জি-স্রাসা-মেয়েগুলা সব এসেছে তো! সবাই এসে গেছে, স্বয়ং দামোদরও এসে গেছেন। এবারে তিনিই ঘোষপল্লীর সেরা মেয়েটিকে বললেন-ঘোষসুন্দরী। রাখালিয়াদের পক্ষে যোগ্য নাচ হল এই হলীসক। বলরাম বললেন–ওরে বাজা বাজা, ওরে দামক, ওরে মেঘনাদ, বাদ্যি বাজা, বাদ্যি বাজা। নাচ আরম্ভ হল।
বুড়ো গয়লা আর থাকতে পারল না, সে বললে–আপনারা সব নাচছেন, আমি বুড়ো আমি কি করি? দামোদর কৃষ্ণ বললেন–কেন, তুমি নাচ দেখ। শেষ পর্যন্ত সেও আর লোভ সম্বরণ করতে পারল না, সেও নাচতে শুরু করে দিল বিকট তালে ধুলো উড়িয়ে।(৩২)
এই তো স্বাভাবিক, পাড়ার যত ছেলেমেয়ে এবং বুড়ো সবাই জ্যোৎস্নারাতের নেশায় নাচতে এসেছে। পরের যুগের পুরাণকতারা রাসক্ষেত্রে কৃষ্ণ ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের প্রবেশ অনুমোেদন করেননি। বিরাট এক মুক্ত উপভোগের রাজ্যে শত শত সুন্দরী যুবতীদের সঙ্গে কৃষ্ণকে একেবারে একা ছেড়ে দিয়েছেন পুরাণকতারা। দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে হরিবংশের ‘ বর্ণনা যতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, ব্ৰহ্ম কিংবা বিষ্ণুপুরাণই ততটা নয়, কেননা আতিশয্য এসে গেছে বর্ণনায়। আর ভাগবত পুরাণকার কৃষ্ণলীলার প্রত্যেক ঘটনার সঙ্গে এমন মধুর কবিত্ব মিশিয়েছেন যা রাস-পঞ্চাধ্যায়ে এসে একেবারে চরমে উঠেছে–সে কবিত্ব সাধারণ মানুষ, সচ্চরিত্র এবং দুশ্চরিত্র সকলকেই এমন এক রসলোকে পৌঁছে দেয়, যেখানে ঘটনা কিংবা তথ্য সম্বন্ধে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসে না।
পুনরুক্তি করছি। হরিবংশে যেখানে ইন্দ্ৰযজ্ঞ স্তম্ভিত হল এবং ইন্দ্র এসে প্রতিবাদ আরম্ভ করলেন, তখন গোপেরা সব কৃষ্ণকে বলল-আপনি মানুষ নন, দেবতা। কৃষ্ণ বললেন–আপনারা আমাকে বিরাট পরাক্রমী পুরুষটি মনে করে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। আসলে আমি আপনাদের একজন, আপনাদের বন্ধু-মন্যন্তে মাং যথা সর্বে ভবন্তো ভীমবিক্রম। তথাহং নাবমন্তব্যঃ স্বজাতীয়োস্মি বান্ধবঃ। কৃষ্ণের এই সহজ ভাবটা হরিবংশে সত্যিই তবু খানিকটা আছে, যা অন্য পুরাণে নেই। হরিবংশে দেখি, যে শারদ পূর্ণিমা নিশিতে ব্রজগোপীদের সঙ্গে কৃষ্ণের রাসক্রীড়া হয়েছিল, সে রাত্রিতেও ব্রজের পথঘাটের অঙ্গরাগ ছিল করীষ, মানে গোবরের ছড়া। বিষ্ণুপুরাণে কিংবা ভাগবতে বৃন্দাবনের রাস্তাঘাট কিন্তু ঝকঝক করছে। পরিবেশটা যেমন পরিচ্ছন্ন, তেমনি একটু কৃত্রিমও বটে, এবং এর বেশির ভাগটাই কবিদের পরিসর।
আর একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না। সেটা হল, যে যতই বলুন না কেন যে, ভাসের বালচরিত নাটকখানি হরিবংশের পটভূমিকায় রচিত, নাটকটি আদ্যন্ত নিপুণভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে এ নাটকের উপাদান সংগ্রহ করা হয়েছে লোকস্তরে প্রচলিত কথা পরম্পরা থেকে, যাকে আমরা ইংরেজিতে oral tradition বলি। নাটকের প্রায় প্রথম থেকেই একটা প্রধান চরিত্র সেই বুড়ো গয়লা। কৃষ্ণজীবনের অনেক কাহিনীই এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে সেই বুড়ো গয়লার মুখে এবং প্রায় সব কাহিনীই সে এমনভাবে রিপোর্ট করছে যেন সে, এসব কাহিনী লোকমুখে বারবার শুনেছে। নাট্যরীতি অনুযায়ী, যে নাট্যরীতি অন্তত কালিদাসের থেকেও ভাসের ভাল জানা ছিল, একটি চরিত্রের মুখে একঘণ্টা ধরে বকবকানি বক্তৃতা রুচিসম্মত হয় না। অথচ সেই সূক্ষ্ম নাট্যবোধের বিরুদ্ধ কাজটিই ভাস করেছেন–এই বৃদ্ধ গয়লার মুখে অনেকক্ষণ ধরে একের পর উক্তি বসিয়ে। সেই উক্তিগুলি কিরকম-না, এক মাস বয়সেই নন্দগোপের ছেলে এই করেছেন, দশ মাস বয়সেই আবার এই করেছে, এইরকম করে শকটভঞ্জন, পুতনাবধ থেকে আরম্ভ করে গোপাল কৃষ্ণের সমস্ত বীরত্ব গাথাই সংবাদের মত পরিবেশিত হয়েছে এই বুড়ো গয়লার জবানিতে। গয়লা বুড়ো আরেকটা দামী কথা বলেছে, যখন সে দুষ্টু কৃষ্ণের বালচাপল্যের প্রসঙ্গে দামবন্ধনের কথা বলেছে। সমস্ত গোপমাতারা উত্যক্ত হয়ে যশোদার কাছে যখন কৃষ্ণের নামে নালিশ জানাল, তখন মা তাঁকে দড়ি দিয়ে উনূখলে বেঁধে রেখে শাস্তি দিলেন। কৃষ্ণ উলুখল সামেত গিয়ে পড়লেন জোড়া-অর্জুন গাছের ওপর। এরা দুজনেই ছিল দানো, কৃষ্ণের চাপে দুজনেই মারা গেল।
ব্ৰহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ কিংবা ভাগবতপুরাণ–সবাই সমস্বরে বলেছে–এই যমলাজুন আসলে হল কুবেরের দুই ছেলে নলকূবর আর মণিগ্রীব। কামমোহিত এই দুই কুবেরপুত্র নারদের শাপে বৃক্ষত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল। ভাসের, বালচরিতে গয়লা-বুডোর সংবাদে আমরা এসব পূর্বজন্মের কথা কিছুই জানতে পারি না, এবং তাতে বুঝি যমলাৰ্জুন-ভঙ্গ নিয়ে সবচেয়ে পুরানো ধারণাটিই–যেমন যেমন লোকমুখে চলেছে, তেমনটিই বসানো আছে বুড়ো গয়লার মুখে। এই শাপ-টাপের কথা হরিবংশেও কিছু নেই, বরঞ্চ সে আর একটি গূঢ় কথা বলেছে, যেটা আজকের মিথলজিস্টদের কাছে খুবই প্রয়োজনীয়। যখন দুটি বৃক্ষই ভূপাতিত হল, তখন অন্য গোপরমণীরা সব চিৎকার করে যশোদাকে ডেকে বললেন–শিগগির এস গো মা যশোদা, যে গাছ দুটোকে আমরা পুজো করতাম, যাদের কাছে মানসিক করতাম-যৌ তাবৰ্জুনৌ বৃক্ষৌ তু ব্রজে সতত্যাপযাচনৌসেই গাছদুটো ভেঙে পড়ে গেছে, তবে তোমার ছেলেটি বেঁচে গেছে। এর পরেও দেখি গোপবৃদ্ধেরা বলাবলি করছে যে, গাছ দুটি ছিল দেবতার মন্দিরের মত-ঘোষস্যায়তনোপমৌ।(৩৩) আধুনিক পুরাণবেত্তারা বলেন প্রাচীন এবং আদিম বৃক্ষপূজা হঠিয়ে দিয়ে এইভাবেই কৃষ্ণপূজা চালু হয়েছিল, যেমনটি হয়েছিল ইন্দ্রপুজার পরিবর্তে, কিংবা কালিয় নাগকে সমুদ্রে পাঠিয়ে নাগপূজার পরিবর্তে।
ভাস যে তাঁর নাটকের উপকরণ সংগ্রহ করেছিলেন একেবারে লোকর থেকেই সেটা আরও বুঝি এইজন্যে যে,এই অর্জুন বৃক্ষ দুটির দিকে তাঁর একটুও নজর ছিল না। তাঁর বেশি চিন্তা ছিল–এই দুর্ঘটনার মাধ্যমে কৃষ্ণের দামোদর নামটি কি করে চালু হয়ে গেল, সেইটি। দাম মানে রঞ্জু। উদরে দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছিল বলেই তিনি দামোদর। বুড়ো গয়লা ভারী নাটকীয় কায়দায় বলেছে–যারা নাকি কৃষ্ণের নামে নালিশ করেছিল, তারাই এখন আদর করে ডাকতে আরম্ভ করল দামোদর বলে।(৩৪) কৃষ্ণের দামোদর নামটি ভারী পুরানো এবং ভাসের নাটকের সমস্তটা জুড়েই এই দামোদরের ক্রিয়াকলাপ। এমনকি তৃতীয় অঙ্কে যখন তিনি গোপীসঙ্গে হল্লীসক নেচে বেড়াচ্ছেন তখনও তিনি ‘ভত্ত্ব দামোদর। হরিবংশেও কৃষ্ণ যখন গোপরমণীদের জ্যোৎস্নাভিসারে বনে নিয়ে গেলেন, তখনও তারা অব্যক্ত মধুর স্বরে যে নামে ধীরে ধীরে ডেকেছিল, তা হল দামোদরনাম দামোদরেত্যেবং গোপন্যাস্তদাব্রুবন্। মজা হল পরবর্তী পুরাণগুলোর মধ্যে অতি অল্প সময়ের মধ্যে এক অতি পরিশীলিত নাগরিক বোধ কাজ করল। যে নামের মধ্যে যশোদার রঙ্গুবন্ধনের দাগ রয়েছে, সেই নামটিকে পরবর্তী পুরাণকতারা আর প্রেমিক কৃষ্ণের সঙ্গে মেলাতে পারলেন না। পেটুক দামুর কথা তাঁরা জানতেন কিনা জানি না, তবে রাসরসিক কৃষ্ণকে দামোদর নামে ডাকতে তাঁদের কুণ্ঠা হয়েছে; অথচ হরিবংশে এই দামোদর নামক লোকটির সঙ্গেই ব্ৰজরমণীরা সব কি সুখেই কাল কাটিয়েছেন-ব্ৰজং গতাঃ সুখং চেরুদামোদর-পরায়ণাঃ। এই দামোদরের সঙ্গে নাচতে গেলে গোপীদের প্রসাধন লাগে শুধু গোবরের গুড়ো, কিন্তু বিষ্ণু পুরাণে কিংবা ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণের নামে যেমন মধুকরী কল্পনার ছোঁয়া, গোপীদের প্রসাধনেও তেমনি কুমকুম, চন্দনের ছড়াছড়ি–যতখানি আহিরিণী, তার থেকেও বেশি নাগরিকা।
প্রিনজ আর হেলার সাহেব বালচরিতের ওপর ভাল কিছু কাজ করেছেন। তাঁদের ধারণা ভাসের বালচরিতে বুড়ো গয়লার মুখে যে প্রাকৃতভাষা বসানো আছে তা হল আভীরীদের ভাষা, যাকে তাঁরা মাতৃভাষায় বলেছেন : Hirten dialekt (herdsmen’s dialect)। ভাস এই ভাষা আবারও ব্যবহার করেছেন তাঁর পঞ্চরাত্র নাটকে এবং তাও গয়লাদের মুখেই।(৩৫) গবেষকেরা সন্দেহ করেন–ভাসের লেখা এই আভীরী ভাষা ভরতের নাট্যশাস্ত্রে উল্লিখিত আভীরী ভাষার সমগোত্রীয় নয় তো? আমরা এত কিছু বুঝি না, যা বুঝি, তা হল আভীরীদের মধ্যে ছেলে এবং মেয়েরা একসঙ্গে নাচাগানা করত মাঝে মাঝেই, এবং তাদের মধ্যে বিবাহিতা রমণীরাও থাকতেন। কৃষ্ণের বাল্যকালটা যেহেতু আভীর আর আহিরিণীদের সঙ্গেই কেটেছে তাই নিঃসন্দহে বলতে পারি, একটা ঐতিহাসিক নাচের সাক্ষী তিনি অবশ্যই ছিলেন এবং তাতে পরবধূরাও অংশ নিয়েছিল, যদিও ভাস স্পষ্টত স্বকণ্ঠে তা বলেননি। মনে রাখবেন, ভাসের নাটকে এই নাচের নাম হল্লীসক, যাকে একটা গ্রুপ-ডান্স অবশ্যই বলা যেতে পারে : কিন্তু হরিবংশকার এই নাম ব্যবহার করেননি এবং তিনি কিন্তু রাস শব্দটিও ব্যবহার করেননি। রাস কথাটি প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ব্ৰহ্ম পুরাণে, বিষ্ণু পুরাণে এবং অন্যান্য পরবর্তী পুরাণগুলিতে তো বটেই। গবেষকেরা সন্দেহ করেন যে, পুরাণকারেরা তাঁদের সমসাময়িক সমাজ থেকে ‘রাস’ শব্দটি আহরণ করেছেন, যে রাস বলতে বিশেষ সুর, তাল, গান, কাব্য এবং নাচ–সবই একসঙ্গে বোঝায়।
হল্লীসক কিংবা রাস-এ সবের কূট-কাঁচালি থাক। কৃষ্ণ নেচেছিলেন–সে কথা সত্যি। কিন্তু নাট্যকার ভাস যে কথাটা স্বপ্নেও ভাবেননি এবং যে কথাটা পরবর্তী সমস্ত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াল, হল–কৃষ্ণের পরবধূবিলাস। আজ থেকে আড়াই/তিন হাজার বছর আগে কোন আভীরী সমাজে বিশেষ একটি আভীর যুবকের মোহন বাঁশির সুরে যদি আকুল হয়ে উঠে থাকে পরবধূরা–জগৌ কলং বামদৃশং মনোহরম্-তাতে দোষ কিছু দেখি না। যৌথনৃত্যেই বা দোষ কি? হরিবংশকার বলেছেন-স্বামী, ভাই কিংবা বাবা-মা বাধা দেওয়া সত্ত্বেও গোপাঙ্গনারা রাত্রিতে কৃষ্ণের আসঙ্গ লোভে তাঁকেই খুঁজতে লাগলেন। হরিবংশে পরবধূর গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে এই একটিই শ্লোক, বিষ্ণু পুরাণেও তাই; কিন্তু ভাগবত পুরাণে এসে কৃষ্ণকে প্রথমেই একেবারে দার্শনিক ভিত্তিতে স্থাপন করা হল, তারপরে পরবধূর লাম্পট্য দেখিয়ে, সে লাম্পট্যও প্রতিষ্ঠিত হল দার্শনিক ভিত্তিতে। তবু কিন্তু সব কিছুর ওপরেও বলব, এই ভাগবত পুরাণ না থাকলে আমরা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কতকগুলি কবিতা থেকে বঞ্চিত হতাম।
মহাভারতের রাজনৈতিক নেতা কৃষ্ণকে বেশ সহজেই যুক্তি-তথ্য দিয়ে প্রমাণ করা যায়, কিন্তু পুরাণকর্তাদের ইতিহাসাশ্রয়ী কল্পনালোকে তৈরি ভাবুক রসিক কৃষ্ণকে দেখতে হবে নতুন আলোকে। একটা কথা মনে রাখা দরকার, হালের গাথাতে যে প্রেমিক কৃষ্ণটিকে আমরা পাই নাট্যকার ভাসের সময়েই তিনি ঈশ্বরে পরিণত। এমনকি গুপ্তযুগের কবি কালিদাসও গোপবেশ বেণুকর, নবকিশোর নটবর যে কৃষ্ণকে চিনতেন, তাঁকেও তিনি এক করে দিয়েছেন বিষ্ণুর সঙ্গে বহেণের স্ফুরিতরুচিনা গোপবেশস্য বিষ্ণোঃ।(৩৬) বলা বাহুল্য তিনি বৃন্দাবনের খবরও রাখতেন। মহাভারতকার নন্দ-যশোদার প্রাণারাম কৃষ্ণের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই বলেননি, কিন্তু রাখাল কৃষ্ণ কিংবা তাঁর আভীর মা-বাবা মথুরার পাথরে খোদাই হয়ে গেছেন খ্রীস্টোত্তর প্রথম কি দ্বিতীয় বছরেই। কাজেই মহাভারতের কৃষ্ণের পাশাপাশি আভীর কৃষ্ণের ঐতিহ্যও প্রচলিত ছিল খ্রস্টপূর্বাব্দ থেকেই। আর ঈশ্বরত্ব যে কেমন করে আস্তে আস্তে মনুষ্যত্বকে গ্রাস করে তার প্রমাণ অন্তত ভারতবর্ষে দেবার প্রয়োজন নেই। পুরাণকর্তাদের সপ্রণাম অভিবাদ-স্তুতিতে, কবিদের মাঙ্গলিকে শ্রুতকীর্তি পুরুষ ঈশ্বর হয়ে যান। একটি প্রাচীন শ্লোকে দেখি যশোদা কৃষ্ণকে বলছেন-দেখ বাছা, রাত্রি অনেক হল, এবার ঘুমিয়ে পড়। কৃষ্ণ বললেন–আমার ঘুম আসছে না। যশোদা বললেন–তাহলে গপ্পো শোন, ঘুম আসবে। যশোদা গপ্পো বলতে আরম্ভ করলেন-পুরাকালে রঘুবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ রাম নামে এক রাজা ছিলেন। একথা শুনেই কৃষ্ণের মুখে এক অনির্বচনীয় হাসি ফুটে উঠল। কবি বলতে চাইলেন, কৃষ্ণের মনে তাঁর পূর্বেকার রাম অবতারের স্মৃতি জেগে উঠল বলেই তাঁর হাসিটি।(৩৭) এইরকম করেই ভগবত্তার প্রতিষ্ঠা হয়।
মহাভারতের বাসুদেব কৃষ্ণ যদি খ্রীস্টপূর্বাব্দেই ভগবান হয়ে গিয়ে থাকেন, তো গোপকিশোর কৃষ্ণও ভগবান হয়ে গেছেন খ্রীস্টপূর্বাব্দেই। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে আধুনিকমনা একজন ঐতিহাসিকের চোখ চৈতন্যদেবের হিল। কেননা আজকাল যে syncretism–এর কথা বলা হয়, তার সম্পূর্ণ বোধ সেই ষোড়শ শতাব্দীতেই চৈতন্যদেবের ছিল। তাঁর মুন্সিয়ানা হল, মহাভারত কিম্বা ইতিহাসের সেই ঐশ্বাত্মক কৃষ্ণকে মাথার মধ্যে রেখেও তিনি মহিমাম্বিত করেছেন গোপালক কৃষ্ণকে। তাঁর দৃষ্টিতে এই গোপবেশ কৃষ্ণই পরম তত্ত্ব, পরম ঈশ্বর। কিন্তু কৃষ্ণের ভগবৎ স্বরূপটি থাকতে হবে ভক্তের বুদ্ধিতে, মনে নয়। অর্থাৎ কিনা বৈষ্ণব ভক্ত তাঁর তত্ত্বগত বুদ্ধিতে তাঁকে পরম ঈশ্বর বলে মানবেন, কিন্তু ভক্তের মনে থাকবে তাঁর মানুষ স্বরূপ, যেখানে তিনি বাঁধা পড়বেন ভক্তপ্রাণের টানে, যেখানে তিনি যাজ্ঞবল্ক্য কিংবা শেতকেতুর জ্ঞানময় পরিনিষ্পন্ন বুদ্ধিতে শুধুমাত্র জ্যোতিঃস্বরূপ হয়ে ধরা দেন না, যাঁর কথা পাসক্যাল বলেছিলেন এইভাবে-God of Abraham, Isac and Jacob, not of the philosophers and scholars।(৩৮)
ভগবান হিসেবে কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা হয়েছে দুভাবে–এক, মিথলজিস্টদের দৃষ্টিতে ঋশ্বৈদিক বিষ্ণুর মাধ্যমে আর দার্শনিকের দৃষ্টিতে জ্যোতিঃস্বরূপ ব্রহ্মের মাধ্যমে। বিষ্ণুর মধ্যে যে ত্রাতার ভূমিকা ছিল, কৃষ্ণের অসুরবিনাশী সত্তার সঙ্গে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে; বস্তুত বিষ্ণুব্যতিরিক্ত একেবারে শুদ্ধ এবং পৃথক কৃষ্ণ-পূজা পদ্ধতি যেমন খুঁজে বার করা কঠিন, ঠিক তেমনই কঠিন কৃষ্ণব্যতিরিক্ত কোন বিষ্ণুপূজা পদ্ধতি খুঁজে বার করা। বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ–একে অপরের ক্ষেত্রে এমন নির্বিরোধে ঢুকে পড়েছেন যে, তাঁদের একান্ত আপন জমিটিই মধুর পারস্পরিকতায় বেদখল হয়ে গেছে। কালিদাসকে তাই বলতে হয়েছে গোপ-বেশস্য বিষ্ণোঃ। বার্থ সাহেব আবার আরেক কাঠি ওপরে, তাঁর ধারণা ঋগবৈদিক বিষ্ণুর যে এত নাম-যশ, তা সম্ভব হয়েছে এই কৃষ্ণের জন্য।(৩৯) কৃষ্ণের সঙ্গে একাত্মতার আগে বেদের যুগে বিষ্ণুকে কে অত পুছত। হবেও বা। আমরা যেটুকু বুঝি মহাভারতের যুগের অনেক আগেই বাসুদেব কৃষ্ণের সঙ্গে বৈদিক বিষ্ণু এক হয়ে গেছেন। তাতে একটা বড় লাভ হয়েছে এই যে, বিষ্ণুর সংস্পর্শে এসে কৃষ্ণের যেমন দেবায়ন সম্ভব হয়েছে, তেমনি কৃষ্ণের সংস্পর্শে বিষ্ণুর মনুষ্যায়নও সহজ হয়ে গেছে। এই দেবায়ন আর মনুষ্যায়নের আন্তর প্রতিক্রিয়ায় কৃষ্ণ হয়ে উঠেছেন অবতারবাদের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি শুধু অবতার নন, অবতারী। জয়দেবের দশাবতার স্তোত্রের মধ্যে তাই অবতার হিসেবে কৃষ্ণের নাম পাওয়া যায় না, কেননা “কেশব ধৃত দশবিধরূপ”, কৃষ্ণই দশটি অবতাররূপে আবির্ভূত, তিনিই তাঁদের কতা-জয়দেবের ভাষায়–দশাকৃতিকৃতে কৃষ্ণায় তস্মৈ নমঃ।।
একটা কথা অবশ্য ঠিক, কৃষ্ণকে আজকে যে চেহারায় আমরা পাই, সে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে পুরাণকারদের অবদান এবং সেই কৃষ্ণকেই নতুন করে চিনিয়ে দিয়েছেন চৈতন্যদেব। সকলেই জানেন বৈদিক যুগে দেবতা অনেক। যখন একের স্তব করা হচ্ছে, তখন মনে হবে তিনিই যেন সব, রবীন্দ্রনাথের অতিবাদী ভঙ্গিতে বলা যায়–
থাকো হৃদয় পদ্মটিতে
এক দেবতা আমার চিতে
চাইনে তোমায় খবর দিতে
আরো আছেন তিরিশ কোটি।
কিন্তু তিরিশ-কোটি দেবতার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে কদিন চলে! ঋষিদের মনেও কেমন যেন এক নৈরাশ্যবোধ কাজ করতে থাকল, তাঁরা ভাবলেন–কার পূজা। করব, এত তেল-ঘি পুড়িয়ে কি ফল–কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেমঃ? এইরকম এক নৈর্ব্যক্তিক অনুভূতি থেকেই বৈদিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব কমে গেল। হবিধুম, মেঘমন্দ্র মন্ত্রোচ্চারণ, শত-সহস্র যজ্ঞ-প্রক্রিয়ার আড়ম্বর আস্তে আস্তে জায়গা করে দিল উপনিষদের; উদয় হলেন ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিরা জ্ঞান, যোগ আর ধ্যানের সূক্ষ্ম পথে। কিন্তু জ্ঞান আর ধ্যানের সূক্ষ্মতা, নিষ্কাম কর্ম আর চিত্তশুদ্ধি–এসব সাধারণ্যে চলে না। ঋষি যখন বলবেন, অন্তমিতে আদিত্যে, চন্দ্রমসি অস্তমিতে, যিনি থাকেন তিনি সেই জ্যোতিষ্মন পুরুষ, সাধারণে তখন বলবেন–সেই পুরুষটির চেহারা বল, জ্যোতিঃস্বরূপকে আমরা বুঝতে পারি না। ঠিক এই সুযোগটিই সদ্ব্যবহার করেছেন পুরাণকতারা। কৃষ্ণ লীলাপুরুষোত্তম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন, পর ব্রহ্ম, পুরাণ পুরুষ–সব তিনিই।
তবু এরই মধ্যে চৈতন্যের মর্মকথাটিই বলা হল না–সেটি হল পরবধূলম্পট হিসেবেই কৃষ্ণের তাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠা। চৈতন্য পরিকর রাধাভাবে বলেছেন-কোন এক সুচতুর শঠচূড়ামণি, গোপবধূর লম্পট আমাদের জোর করে তাঁর ভৃত্যে পরিণত করেছেন–কেনাপি শঠেন বয়ং হঠেন দাসীকৃতা গোপবধূবিটেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তত্ত্বদৃষ্টিতে এই পরবধুনায়কই সমস্ত লীলারসের আধার। তিনি যেহেতু রস আস্বাদনের জন্যই ভূমিতে অবতীর্ণ, তাই পৃথিবীর যা চরম রস-পরবধূবিলাস, সেটিই তিনি করে দেখিয়েছেন। যদিও বৈষ্ণব সুজনের মতে এই ব্ৰজরমণীরা কিন্তু কেউই আসলে পরবধু নন, এরা গোলোক বৈকুণ্ঠে সবাই কৃষ্ণের স্বকীয়া কান্তা, শুধু কৃষ্ণকে লীলারস আস্বাদন করানোর জনাই পরকীয়ার মত ব্যবহার করছেন মাত্র–জীব গোস্বামীর ভাষায়-পরমস্বীয়া অপি পরকীয়ায়মানা ব্রজদেব্যঃ।(৪০)
এসব তত্ত্বকথার মধ্যে আর একটুও যাব না, আমরা জানি পরকীয়া রসের মাদকতা যাই থাকুক এবং তার তত্ত্বগত প্রতিষ্ঠাও যাই হোক না কেন, কৃষ্ণ যে রসিকপুরুষ এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। সারা জীবন ধরেই তাঁর এই রসিকতা পরিব্যাপ্ত। জে এল ম্যাসন সাহেবের মাথায় আবার ফ্রয়েডের পোকা থাকার দরুন তিনি কৃষ্ণের যৌনচরিত্রের এক নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি একটি প্রাচীন শ্লোক খুঁজে বার করেছেন তাতে লেখা আছে-কৃষ্ণ যখন একেবারেই শিশু তখন মায়ের বয়সী কোন ব্ৰজযুবতী শিশু কৃষ্ণের ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুমো খাচ্ছিলেন, তাঁর কণ্ঠ লেগে ছিল কৃষ্ণের কণ্ঠে অধরমধরে কণ্ঠে কণ্ঠং–আর চটুল দৃষ্টিতে তিনি তাকাচ্ছিলেন চপল শিশুর চোখের দিকে। শিশু কৃষ্ণ যখন কান্না জুড়ে দিলেন, তখন তিনি তাঁকে লুকোলেন বুকের মধ্যে। এতে কৃষ্ণের মনে জেগে উঠল অমৃত পুলক, বুঝি তার অধরে হাসির ঝিলিক খেলে গেল একটু, কেননা তিনি যেন তখন ভালবাসার রসে অবশ-নিভৃতপুলকঃ স্মেরঃ পায়াৎ স্মরালসবিগ্রহঃ। ম্যাসন বলেছেন–শিশু অবস্থা থেকেই এই ব্রজরমণীদের অতিরিক্ত আদর ভালবাসায় কৃষ্ণের এক ধরনের যৌন বিকার ঘটেছে যা পরবর্তীকালে পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর অতি সম্ভোগে এবং রমণীবিলাসে।(৪১) এত সব যৌন-বিকারের কথা হয়তো আমরা ম্যাসন সাহেবের মত করে বুঝি না, তবে এটা বুঝি কৃষ্ণকে অনেক মেয়েরাই ভালবাসত, সে যেমন ব্ৰজেও, সে তেমনি দ্বারকাতেও। ভাগবত পুরাণে ‘ভ্রমরগীত’ বলে একটা অধ্যায় আছে। তখন কৃষ্ণ মথুরায়, আর উদ্ধবকে তিনি দূত করে পাঠিয়েছেন গোপীদের সংবাদ নিয়ে আসার জন্য। গোপীরা উদ্ধবদূতকে দেখেই তাকে ফুলে-ফুলে-মধু-খাওয়া কৃষ্ণ-মধুকরের বন্ধু মনে করে যথেষ্ট গালাগালি দিল। কিন্তু তাঁদের আসল শঙ্কা যেটা, সেটা কিন্তু ধরা পড়েছে একেবারের ভ্রমরগীতের ‘শেষে। তাঁদের ধারণা বৃন্দাবনের সহজ সরল আহিরিণীর প্রেম কৃষ্ণকে যথেষ্ট সুখ দিতে পারেনি। কিন্তু মথুরা যে শহর, সেখানকার নাগরিকদের বৈদগ্ধ্য-বিলাস নিশ্চয়ই তাঁকে একেবারে নেশায় বুঁদ করে ফেলেছে। এমন অবস্থায় সেই অধশায়িত কৃষ্ণ তাঁর অগুরুগন্ধি হাতখানি মাথার তলায় ঠেকা দিয়ে একবারও কি এই ব্ৰজের দাসীদের কথা মনে করেন–কচিদপিস কথা নঃ কিঙ্করীণাং গৃণীতে/ভুজমগুরুসুগন্ধং মৃধাস্যৎ কদা নু।(৪২)
সত্যিই কৃষ্ণ মনে রাখেননি। মথুরার নাগরিকারা তো আছেনই, দ্বারকায় আছেন সেইসব বিদগ্ধা মহিলারা, যাদের একটার পর একটা কৃষ্ণ বিয়ে করে এনেছেন। কৃষ্ণ যখন তাঁর ছোটবেলার আভীরপল্লী ছেড়ে মথুরায় এসেছিলেন কিংবা দ্বারকায় প্রায় রাজা হয়েই বসেছিলেন, সেদিন তিনি ধরতে পারেননি নগরবাসিনী নাগরিকার স্বভাব কি? কংসের আদেশে অত্রুর যেদিন কৃষ্ণকে নিতে এসেছিল, সেদিন বিরহ-নক্ষত্রের মিটমিটে আলোতেই গোপাল বালিকারা কৃষ্ণের ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন। কৃষ্ণ বোধহয় মিথ্যে কোন আশ্বস দিয়েছিলেন ব্রজগোপীদের; কিন্তু তাঁরা ঠিক ধরেছিলেন। তাঁরা পরস্পরে নিজেরা নিজেরাই বললেন–মথুরায় একবার গেলে পরে আর কি কৃষ্ণের পক্ষে ফিরে আসা সম্ভব! মথুরা-নাগরীদের কথার মধু এমনই যে সেই বিলাসরসের ছলায় কৃষ্ণ নিশ্চয়ই ভুলে যাবেন আমাদের মত গ্রাম্যগোপীদের–নাগরস্ত্রীকলালাপমধু শ্রোত্রেণ পাস্যতি। চিত্তমস্য কথং ভুয়ো গ্রাম্যগোপীষু যাস্যতি।(৪৩) তার মধ্যে নাগরীদের হাব, ভাব, কটাক্ষ–এই সবের শৃঙ্খলে একবার বাঁধা পড়লে কোন যুক্তিতে তিনি আবার ব্রজে ফিরে আসবেন-কয়া যুক্ত্যা সমেষ্যতি। সত্যিই তো যুক্তি ছিল না, আপাতদৃষ্টিতে সত্যিই যুক্তি ছিল না। কিন্তু নাগরীদের রসালাপ ভাবস্মিত কটাক্ষের সঙ্গে যে অবিশ্বসিনী স্বৈরিণীর বিশ্বাস মেশানো ছিল তা কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তাঁর জীবৎকালেই বুঝতে পেরেছিলেন। সেদিন অবশ্যই তাঁর পুরানো আভীরপল্লীর সরলা গোপকিশোরীদের কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল–এক রমণী অন্য এক গোপরমণীকে বলেছিল-সখি, তোমার বুদ্ধি অতি সরল, কেননা কঠিন হৃদয় সেই পুরুষটিকেই তুমি মনপ্রাণ সঁপে বসে আছ। কৃষ্ণের আবার মনে পড়ছিল-সৎ পরামর্শ দেওয়া সেই হিতৈষিণীর মুখের ওপর ঝামড়ে চিৎকার করে উঠেছিল সেই কুলবালিকা গোপনারী। সে বলেছিল-বোল না সখী অমন করে বোল না। শ্যামসুন্দর আমার স্বেচ্ছাচারী পুরুষ। তিনি যদি হাজার বছরের ঔদাসীন্য নিয়ে আমাকে অবহেলাও করেন-কামং শ্যামলসুন্দরো ময়ি সখি স্বৈরী সহ সমাঃ, তবু কোনদিন ভুল করেও যেন আমার মন সেই প্রাণের প্রাণ প্রাণারাম কৃষ্ণের সপ্রণয় দাস্য পরিত্যাগ না করে–চেতত জন্মনি জন্মনি প্রণয়িতা দাস্যং ন মে হাস্যতি।
কৃষ্ণ রসিক পুরুষ, মনে মনে তিনি জানতেন মথুরানাগরীদের চেয়ে ব্রজের আহিরিণীরা শতগুণে ভাল। মথুরায় কিছুদিন থাকার পরেই তাই উদ্ধবকে তিনি বলেছিলেন–একবার ব্রজে যাও–গচ্ছেদ্ধব ব্রজং সৌম্য। সেখানে গিয়ে তুমি দেখবে এখনো আমার ফেরার পথ চেয়ে বসে আছে ব্ৰজের গোপিনীরা। ফেরার আশা–সেই আশাই শুধু তাদের প্রাণধারণ করতে শিখিয়েছে-আশাবন্ধৈঃ সখি নবনবৈঃ কুর্বতী প্রাণবন্ধ। ব্রজগোপীদের কাছ থেকে অনেক দূরে বসে কৃষ্ণ একবারের জন্যও অন্তত বুঝেছিলেন–ব্রজগোপীরাই তাঁর জীবনের চরম প্রাপ্তি–তাঁরাই তাঁর প্রাণ বল্লবব্যা মে মদাত্মিকাঃ।(৪৪)
.
০৩.
কৃষ্ণজীবনের এই অধ্যায়টাকে এখন আমাদের ছেড়ে দিতে হবে, কেননা সময় এসেছে আরও গভীর ঐতিহাসিকতায় মন দেবার। কৃষ্ণ যখন এই ধরাধামে এসেছিলেন তখন তাঁর কালের সমস্ত রীতিনীতি, লোক ব্যবহার এমনকি ধর্মেরও মাথায় চেপে বসেছিলেন। পুরানো অনেক কিছুই তাঁর আমলে উঠে গেছে, যা কিছুই আবার ঘটেছে বা হয়েছে নতুন করে–তা তাঁর মত করেই ঘটেছে বা হয়েছে। মিথলজিস্টরা যেমন বলবেন, কৃষ্ণপূজা চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন সমাজের অনেক অন্ধপূজাই উৎখাত হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে বৃক্ষপূজা যেমন একটি, কালিয়দমনের পরে নাগপূজাও তেমনি একটি। যেটা বলা হয়নি এবং যেটা অত্যন্ত জরুরী সেটা হল ইন্দ্রপূজা বন্ধের বৃত্তান্ত। ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের সংঘর্ষের মূলটা জানতে হলে আমাদের আরও একটু পেছন ফিরে তাকাতে হবে।
প্রথমেই আমবা প্রবেশ করব ঋগবেদের কালে। সেখানে দেখব দশ হাজার সৈন্য নিয়ে কোন একজন কৃষ্ণ অংশুমতী নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দারুণ শব্দ করছেন–অংশুমতী অতিষ্ঠদিয়ানঃ কৃষ্ণো দশভিঃ সহশ্রৈঃ। অনেক পণ্ডিতই অংশুমতী নদীকে যমুনা বলে মনে করেন। কৃষ্ণ বোধহয় শব্দ করে যুদ্ধের আহ্বানই জানাচ্ছিলেন কাউকে। কেননা ঋগবেদে দেখি–এই শব্দ শুনেই ইন্দ্র এসে কৃষ্ণপক্ষের সৈন্যগুলিকে বধ করেন। ইন্দ্র নিজের মুখেই বলেছেন–দ্রুতগামী কৃষ্ণকে দেখতে পেলাম, সে অংশুমতী নদীর গূঢ়স্থানে বিস্তৃত প্রদেশে বিচরণ করছে এবং তার অবস্থিতি ঠিক সূর্যের মত–অপশ্যং বিষুণে চরন্তমুপহুরে নবদ্যা অংশুমত্যাঃ। নভো ন কৃষ্ণমবতস্থিবাসে।(১)
যদি প্রক্ষিপ্তবাদই মেনে নিই, তাহলে এই ঋটি প্রক্ষিপ্ত হয়ে থাকলেই আমাদের সুবিধা। কেননা ঋগবেদের মূলস্তরে কৃষ্ণের নামোল্লেখ অসম্ভব এবং এই ঋটি যদি পরবর্তীকালের সংযোজন হয়, তাহলে আমাদেরই অভীষ্টপূরণ হয়। ঋগবেদ খবর দিয়ে বলেছে, ইন্দ্র নাকি বৃহস্পতির সহায়তায় কৃষ্ণের আগুয়ান সৈন্যবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন। তবে সেই সৈন্যবাহিনী ছিল দেবহীন, মানে নিশ্চয়ই কৃষ্ণহীন–বিশশা অদেবীরভ্যা চরন্তী বৃহস্পতিনা খুঁজেন্দ্রঃ সসাহে।
যুদ্ধের এই রীতি কৃষ্ণের সঙ্গে মেলে। কৃষ্ণের চরিত্র যেমন, তাতে বিপদ বুঝলেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খাবার মানুষ তিনি নন। এখানে আরও লক্ষ করার বিষয় হল-কৃষ্ণের সঙ্গে সূর্যের তুলনা। মিথলজিস্টদের কাছে কৃষ্ণ সৌর দেবতা হিসেবেই পরিগণিত। বিশ্বের সমস্ত ধর্মেই সৌর দেবতাকুলের বিশেষ এক মর্যাদা আছে, কেননা সূর্য থেকেই বেশির ভাগ দেবতার উৎপত্তি। সেই দিক থেকে সৌর মণ্ডলের মধ্যে কৃষ্ণের অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মিথলজিস্টদের ধারণা বৈদিক দেবতা বিষ্ণুর সঙ্গে কৃষ্ণের একাত্মতাই শেষ পর্যন্ত কৃকে সৌর দেবতাকুলের (Solar Gods) সভ্য করে তুলেছে। কিন্তু মজা হল, অনেকেই ওপরের ঋটিকে উল্লেখ করেছেন–আর্য জাতির প্রতিভূ ইস্ত্রের সঙ্গে অনার্য কৃষ্ণের সংঘর্ষ সূচনা করার জন্য। যে ঋন্ত্র উল্লেখ করে পণ্ডিতেরা বলেছেন ইন্দ্র কৃষ্ণকে মেরে ফেলেছিলেন, সেই ঋকমন্ত্রে ইন্দ্র কর্তৃক কৃষ্ণবধের কোন উল্লেখ নেই।(২) ১.১৩০.৮ সংখ্যা কমন্ত্রে দেখা যায়-আর্যজাতির রক্ষার জন্য, ব্ৰতরহিত আচারহীন ব্যক্তিদের শাসন করার জন্য ইন্দ্র আর্যেতর জাতির কৃষ্ণ ভস্মীভূত করেছেন; ভাবটা এই–তাঁদের ছাল ছাড়িয়ে দিয়েছেন–ত্বচং কৃষ্ণা অরন্ধয়ৎ। এই ছাল ছাড়ানোর মানে তো মনে হয় তাদের অনার্য সত্তা নষ্ট করে আর্য করে তুলেছেন। কিন্তু এই ঋক্মন্ত্র থেকে ছাল ছাড়ানোর ব্যাপারটা মাথায় রেখে, ৮৯৬.১৩-১৫ মন্ত্রের ব্যাখ্যায় যদি বলি-ইন্দ্র কৃষ্ণ নামক এক অনার্য যোদ্ধাকে মেরে ফেলেছিলেন–তাহলে, বড়ই বিপদ হয়। হ্যাঁ, ইন্দ্র এবং কৃষ্ণের সংঘর্ষের কথাটা সত্যি বটে, তবে তার থেকেও বেশি লক্ষণীয় এই ঋকে কৃষ্ণের সঙ্গে সূর্যের তুলনা। অন্যত্র দেখেছি, যখনই কোন দেবতা সূর্যের মত বলে কুত্রাপি বেদে ব্রাহ্মণে উল্লিখিত হয়েছেন, তখনই তাঁকে যথাযোগ্য পাদ্যঅর্ঘ্য দিয়ে সৌর দেবতার পংক্তিতে একটি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বয়ং ইন্দ্রের মুখেই যার উপমা শোনা যাচ্ছে, সূর্যের মত কিংবা সৌর দেবকুলের শিরোমণি ইন্দ্রই যাঁকে বর্ণনা করছেন জ্যোতিষ্মন্ শরীর বলে–অধারয়ৎ তৰং তিত্বিষাণঃ, সেই সূর্যবর্ণের কোন উল্লেখই তো গবেষকেরা করলেন না। শুধু এইটেই তাঁদের মনে হল যে, এ হচ্ছে আর্যীকরণের যুগসন্ধিতে আর্যের সঙ্গে অনার্যের সংঘর্ষ। আমাদের জিজ্ঞাসা-আর্যীকরণের যুগে আর্যদের সঙ্গে কি আর্যদেরও সংঘর্ষ বাধেনি, বেধেছে-কুরু-পাণ্ডবের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই তার একটা বড় প্রমাণ। বৈদিক দেবতাদের মধ্যেও কি এক দেবতার সঙ্গে আরেক দেবতার সুসম্পর্ক ছিল! আমাদের ধারণা কৃষ্ণকে সৌর-জাতে তুলবার জন্য বিষ্ণু পর্যন্ত যেতে হবে না, সূর্যবরণ কৃষ্ণ নিজেই তার প্রমাণ অথবা অনার্য হলেও কৃষ্ণের প্রভাব ছিল সূর্যের মতই।
মিথলজিস্টদের ধারণা, ঋগবেদের যুগে ইন্দ্রপূজার সঙ্গে কৃষ্ণপূজার একধরনের সংঘর্ষ ছিল এবং সে সংঘর্ষে প্রাথমিকভাবে ইন্দ্র জয়ী হলেও পরবর্তীকালে সেই অপমানের শোধ নিয়েছিলেন কৃষ্ণ। তিনি ইন্দ্রপূজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ঋগবেদের হিসেব মত দশ হাজার সৈনিক তখনও কৃষ্ণের পেছনে ছিল কিনা জানি না, কিন্তু অনেক মানুষই যে তাঁর পেছনে ছিল তার প্রমাণ আছে হরিবংশে। ব্রজের গোয়ালারা সব বর্ষারম্ভে ইন্দ্ৰযজ্ঞ করার আয়োজন করেছিলেন। তখন কৃষ্ণ বললেন–এই উৎসবের প্রয়োজন কি? পকেশ এক গোপবৃদ্ধ এর উত্তরে বৃষ্টি আর কৃষির কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন কৃষ্ণকে। তিনি বললেন ইন্দ্রই আমাদের সনাতন রক্ষক (পাঠক খেয়াল করবেন ঋগবেদের ধারণাও তাই)।(৪) এর পরে গোপবৃদ্ধ ছোট্টখাট্ট যে বক্তৃতাটি দিলেন, এক কথায় তাকে ঋগবৈদিক ইন্দ্ৰস্তুতির পৌরাণিক সংস্করণ বলা চলে। হরিবংশ জানাচ্ছে ‘ইন্দ্রের সমস্ত প্রভাব জেনেও প্রভাবজ্ঞোহপি শস্য-কৃষ্ণ বললেন–যারা কৃষিজীবী, যাদের শস্য ফলানোর প্রয়োজন আছে, তারা ইন্দ্ৰযজ্ঞ করুক। আমরা হলুম গিয়ে গোয়ালা, গরুই আমাদের জীবন। যার কাছে অভীষ্ট ফল পাই, তাকে বাদ দিয়ে অন্যজনের পূজা করা তঞ্চকতা মাত্র। তার ওপরে যে পর্যন্ত কৃষি-জমি আছে সেই পর্যন্তই ব্ৰজের সীমা, সেই সীমার পরে বন, বনের পরে পাহাড়; সেই পাহাড়ই আমাদের অবিচল আশ্রয়বনাস্তা গিরয়ঃ সর্বে সা চাস্মাকং গতিধ্রুবা। অতএব ব্রাহ্মণেরা মন্ত্রযজ্ঞ করুন, হলষজ্ঞ করুন কৃষকেরা, আর গোয়ালারা করুক গিরিযজ্ঞ-গিরিযজ্ঞাস্তথা গোপা গিরিযজ্ঞঃ প্রবক্তৃতাম্। কৃষ্ণ আরও বললেন–যার ঝুঁত গোধন আছে সব নিয়ে সুখস্থানে পাহাড়ের কাছে গাছের তলায় ধুমধাম করে গিরিষজ্ঞ হোক। পূজা হল এবং গিরিযজ্ঞের মাধ্যমে কৃষ্ণই সে পূজা গ্রহণ করলেন। ব্রজবাসীরাও পাহাড়ের চূড়ায় কৃষ্ণকেই অধিষ্ঠিত দেখে প্রধানত তাঁরই শরণাগত হলেন।(৫) ঠিক এইভাবেই ইন্দ্রপূজা লুপ্ত হয়ে গেল, ঠিক যেমনটি লুপ্ত হয়ে গেল নাগ-পূজাও। সে আরেক কাহিনী। ইন্দ্রের মত পূজা না পেলেও কালিয়নাগের অধিকার অস্বীকার করার মত মানুষ তখন ব্ৰজে কেউ ছিল না। কৃষ্ণ কালিয়-নাগের মাথায় চড়ে নাচতে শুরু করে দিলেন। শেষে কিন্তু কালিয়ের সঙ্গে কেমন যেন একটা রফা হয়ে গেল। কৃষ্ণের কথায় কালিয় কিংবা নাগ-পূজকেরা ব্ৰজ ত্যাগ করেছে এবং কৃষ্ণও কালিয়কে অভয় দিয়েছেন যে তাঁর লোকেরা কালিয়কে বিরক্ত করবে না।(৬) ঠিক একই রকমের ঘটনা ঘটেছিল কৃষ্ণ আর ইন্দ্রের বেলাতেও।
কৃষ্ণের গিরিযজ্ঞ জলে ভাসিয়ে দেবার জন্য অনেক বৃষ্টি বর্ষণ করে, ব্রজবাসীদের শতেক পীড়া দিয়েও ইন্দ্র দেখলেন-কৃষ্ণ গোবর্ধন পাহাড়টি হাতে তুলে ধরে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সুরক্ষিত রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত আঁস্ব থেকে ইন্দ্র নেমে এলেন ডুয়ে–ভাবলেন এর দ্বারা দেবকার্য সাধিত হবে বুঝি। ঠিক এর পরেই ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের কেমনুরা একটা রফা হয়ে গেল। ইন্দ্র যা বললেন, তার ভাবটা ঠিক এইরকম-বাপু হে! ঠিক আছে, ঠিক আছে। এতকাল ধরে শ্রাবণ-ভাদ্র আর আশ্বিন-কার্তিক–এই চার মাস আমার পূজা আরাধনার সময় নির্দিষ্ট ছিল। এখন থেকে দুমাস আমার, আর দুমাস তোমার; অর্থাৎ কিনা বর্ষাকালটা আমার থাকল, শরৎকালটা পুরোই তোমার-এষামধং প্রযচ্ছামি শরঙ্কালং তু পশ্চিমম্। তোমাকে লোকে ডাকবে গোবিন্দ বলে, যেহেতু তুমি হলে গিয়ে গরুদের ইন্দ্র, আর আমাকে তো সবাই মহেন্দ্র বলেই ডাকে–অহং কিলো দেবানাং ত্বং গম ইন্দ্ৰংগতঃ। তাছাড়া আজকে বলে নয়, তোমার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার ব্যাপারও আছে। সেই যে সেই বলি রাজার রাজত্বের সময়, যখন সে খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল তখন তুমি বামনরূপে আমার ছোট ভাই হয়ে জন্মেছিলে, তোমার নাম হয়েছিল উপেন্দ্র। তাহলে, তুমি হলে গিয়ে উপেন্দ্র আর আমি হলুম গিয়ে মহেন্দ্র-মহেন্দ্ৰং চাপুপেন্দ্রঞ্চ মহয়ন্তি মহীতলে।(৭)
প্রাচীন এবং নবীনের এই সন্ধির সময়, প্রাচীন ইন্দ্ৰ আরেকটা কথা মনে করে কৃষ্ণকে বললেন। সেটা হল-বংশ-সম্বন্ধে তোমার পিসি কুন্তীর একটি ছেলে আছে। তার নাম অর্জুন, আমারই অংশে তার জন্ম। সেই অর্জুনকে তুমি একটু দেখে শুনে রেখ। শুধু তাকে রক্ষা করা নয় তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিও–স তে রক্ষ্যশ্চ মান্য সখ্যে চ বিনিযুজ্যতাম্।(৮)
ইন্দ্রের বিপুল বাগ্মিতার এই হল সার কথা। নিজে দেবেন্দ্ৰত্ব মহেন্দ্রত্ব কিছুই বিসর্জন দিতে চান না, অন্যদিকে উপেন্দ্রত্ব আর গরুদের ইন্দ্ৰত্ব লাভ করে কৃষ্ণ কতখানি খুশি হতে পারেন–তাও তিনি চিন্তা করলেন না। কৃষ্ণ মনে মনে হাসছিলেন কিমা, হরিবংশ তা জানায়নি। আপাতত ইন্দ্রকে না চটালেও তিনি কিন্তু বেশ মুরুব্বিয়ানার সুরে বললেন–জানি মশাই জানি, অর্জুনের জন্ম-কর্ম সব আমার জানা আছে। তার দুই দাদা যুধিষ্টির ভীমের কথাও আমার ভালমত জানা আছে। তার ছোট দুই ভাই নকুল সহদেব এমন কি কুন্তীর কানীন পুত্র সূর্যসম্ভব কর্ণের কথাও আমার জানা আছে। যুদ্ধকামী কৌরবদের সম্বন্ধেও আমার কাছে খবর আছে। আপনি এখন স্বর্গবাসীদের সুখের জন্য মানে মানে প্রস্থান করুন–তগচ্ছ ত্রিদিবং শক্র সুখায় ত্রিদিবৌকসাম্। আমি থাকতে অর্জুনকে কেউ কিছু করতে পারবে না-নাৰ্জুনস্য রিপুঃ কশ্চিন্ মমাগ্নে প্রভবিষ্যতি।(৯)
ইন্দ্ৰ-কৃষ্ণের সংঘর্ষে আর্যজাতির প্রতিভূ ইন্দ্রের ওপর কৃষ্ণের প্রতিষ্ঠা কি করে হল–সেটা দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। বরঞ্চ একজন ঐতিহাসিক পুরুষ হিসেবে কৃষ্ণ কি করে ক্রমে ক্রমে ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে একক প্রতিষ্ঠা পেলেন–সেটা দেখানোই আমার উদ্দেশ্য এবং সেই জন্যেই অর্জুনের প্রসঙ্গ অনিবার্য। পাঠক মনে রাখবেন, এ ব্যাপারে মহাভারত আমাদের যতখানি সুবিধে দেবে হরিবংশও ঠিক ততখানি।
প্রথম কথা, ইন্দ্র যখন কৃষ্ণের সঙ্গে মোটামুটি একটা সমঝোতায় এলেন তখনও কিন্তু কংসবধ হয়নি, কারণ কংসকে বধ করার জন্য ইন্দ্র সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন কৃষ্ণকে। আমরা বলব ইন্দ্রপজা রোধ কর কালিয়-নাগকে দমন করে কৃষ্ণ আগে নিজের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত এবং শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছেন। কংসের চর বলে প্রচারিত পূতনা, ধেনুকাসুর, লম্বাসুর ইত্যাদি অসুর নামধারী, বিরোধী শক্তিগুলি উৎখাত হবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ-বলরামের যুদ্ধবীর্যও দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে পাণ্ডব কৌরবদের মনোমালিন্যের খবরও ভারতের রাজনৈতিক মহলে বহুল প্রচারিত হয়ে গেছিল। কেননা ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণের বাক্যালাপের সূত্র থেকে বুঝি, কৃষ্ণ বৃন্দাবনে বসেই এই মনোমালিন্যের খবর রাখেন। ভারতের রাজনৈতিক পটভূমিকায় কৃষ্ণকে দেখতে হলে এখান থেকেই আমাদের আরম্ভ করতে হবে।
কৃষ্ণ-জীবনের তথ্য সরবরাহের ব্যাপারে ভাসের বালচরিত নাটকটিকে যদি সবচেয়ে প্রাচীন ইস্তাহার বলে মনে করি, তাহলে খেয়াল করতে হবে যে, সেখানে কোন পুরাণের দৈববাণী হয়নি বসুদেবের কাছে। বসুদেব জানতেনও না যে শিশু কৃষ্ণকে নিয়ে তিনি কোথায় যাবেন। তিনি শুধু এইটুকু জানতেন যে বাচ্চাটিকে অত্যাচারী কংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দেবকী জিজ্ঞেস করছেন-বাচ্চাটিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, আর্যপুত্র? বসুদেব বললেন–সত্যি কথা বলতে কি আমিও জানি না..সত্যং ব্ৰবিষি, অহমপি ন জানে।(১০) যাকগে, কপাল যেখানে নিয়ে যায় সেখানেই যাব। বসুদেব বেরোলেন, যমুনা পার হয়ে ৫৮ নন্দগ্রামের সীমায় এসে পৌঁছোলেন। তাঁর বন্ধু নন্দগোপ যেহেতু এখানেই থাকে, তিনি চাইলেন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে, পাছে অনর্থক কোন ঝামেলা হয়। একটি বটগাছের তলায় বসে কেবলই তাঁর মনে হতে থাকল বাচ্চাটা যদি লোকহিতের জন্য, কংসবধের জন্যই বৃষ্ণিকুলে জন্ম নিয়ে থাকে, তবে এই ঘোষপল্লী থেকে কেউ নিশ্চয়ই আসবে। এলও, নন্দগোপ এসে বৃষ্ণিকুলের পরিত্রাতাকে জন্মের মত আশ্রয় দিলেন।(১১)
এইরকম করে বাচ্চা বাঁচানোর গপ্পো তো আমরা সেদিনের রাজকাহিনীতেও শুনেছি এবং তার মধ্যে তো সত্যতাও কিছু আছে। কাজেই বসুদেব বার বার নন্দকে বলে দিলেন বাচ্চাটিকে মানুষ করার ব্যাপারে যেন কোন ত্রুটি না হয়, কেননা বাচ্চাটিকে বাঁচানো মানে কংসের হাত থেকে সমস্ত যাদবকুলকে বাঁচানো। এই যে যাদববৃষ্ণিকুল বাঁচানোর দায়, এই দায় থেকেই উত্তর পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কৃষ্ণের অভ্যুদয় এবং প্রতিষ্ঠা। মহাভাষ্যকার পতঞ্জলি সংবাদপত্রের শিরোনামের মত একটি খবর দিয়ে বলেছেন–অসাধু মতুলে কৃষ্ণঃ–অর্থাৎ কৃষ্ণ তাঁর মামার সঙ্গে অত্যন্ত দুর্ব্যবহার করেছেন, যার শেষ হয়েছে মৃত্যুতে। স্বীকার করতেই হবে যে শুধু কৃষ্ণ নয়, তাঁর শত্রু-মিত্র অনেকেই তখনকার রাজনৈতিক পটে ঐতিহাসিক চরিত্র।
কৃষ্ণের জন্মের সময়েই কংস অত্যাচারী রাজা বলে চারিদিকে সমস্বরে স্বীকৃতভোজবংশের কুলাঙ্গার-ভোজানাং কুলপাংসনঃ। নিজের বাবা উগ্রসেনকে তিনি বন্দী করে রেখেছেন কারাগারে। জনসাধারণকে তিনি বলে বেড়ান যে, উগ্রসেন নাকি তাঁর বাবাই নয়। তাঁর বাবা হলেন দানবরাজ ঢুমিল, যিনি উগ্রসেনের পত্নীর গর্ভে কংসের জন্ম দিয়েছেন।(১২) অন্যায়ভাবে বলপ্রয়োগেই যার জন্ম, সেই বলই হল কংসের আদর্শ, সুপ্রসিদ্ধ ভোজবংশে সে আদর্শ চলে না। সেকালের সুবিধে ছিল, অন্যের ঔরসে পুত্র জন্মালেও, পালক পিতারা সেই পুত্রকে স্বীকার করে নিতেন–সে আপন বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্যেই হোক কিংবা মুখর জগতের মুখ বন্ধ করার জন্য। যেমন ধর্ম, বায়ু অথবা ইন্দ্রের পুত্র হলেও যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন পাণ্ডুরই পুত্র। কিন্তু এইরকম একটা সুযোগেই কংস ভোজবংশের মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তবে তিনি যে প্রবল পরাক্রান্ত নরপতি হিসেবে পশ্চিম ভারতের রাজনীতিতে পাকা আসন করে নিয়েছিলেন, সে কিন্তু তাঁর নিজের ক্ষমতায়।
কৃষ্ণ এবং কংস দুজনের কথাই যখন উঠল, তখন এদের পূর্বকথা এবং বংশ-পরিচয়ও একটু সেরে নিতে হবে। কেননা পরবর্তী সময়ে দেখা যাবে, তখনকার ভারতবর্ষীয় রাজনীতির খেলায় যাঁরা কৃষ্ণের হাতেই হতাহত, তাঁরা অনেকেই কৃষ্ণের রক্তের সম্বন্ধে আপনজন, আত্মীয়। পাঠকের জানা আছে ভগবদগীতার প্রথম অধ্যায়ে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে ভেউ ভেউ করে কেঁদেছেন। তিনি কেমন করে আপন ভাই-বেরাদর, আত্মীয় স্বজনকে মারবেন–এই চিন্তায় তিনি আকুলিত–স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব। কৃষ্ণ তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন ধর্মযুদ্ধ করতেই হবে। এর পরে তো কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, রাজবিদ্যা রাজগুহ্যযোগ আরও কত যোগ উপদেশ করে অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেছেন–যুদ্ধ তোমাকে করতেই হবে–তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভকারণ তাতেই ধর্ম, তাতেই যশ। ভগবদগীতার অসংখ্য দার্শনিক উপদেশ স্মরণে রেখেও পাঠককে জনান্তিকে জানাতে পারি যে, যিনি এত জোরের সঙ্গে অর্জুনকে আত্মীয়-স্বজন বধে উৎসাহ দিয়েছিলেন, সেই স্বজন বধে তাঁর নিজেরই হাত ছিল পাকা। কাজেই কৃষ্ণের আপন আত্মীয়-স্বজনের বংশ পরিচয় একটু দিতেই হবে।
একটু বেশি আগের কথা বললে অসুবিধে হবে কিনা জানি না, তবে মহারাজ যযাতির কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। সেই যযাতি, যাকে কচের সঙ্গে কাটাকাটি হবার পর বিয়ে করেছিলেন দেবযানী; সেই যযাতি, যিনি দেবযানীর অজান্তে তাঁরই দাসী শর্মিষ্ঠার গর্ভে পুত্রোৎপাদন করেছিলেন। এই যযাতির বড় ছেলে হলেন যদু, যাঁর নামে যদুবংশ।যযাতির দ্বিতীয় ছেলে ক্রোষ্ট্র এবং ক্রোঙ্কুর নাতি হলেন বৃষ্ণি, অন্ধক এবং দেবমীঢুষ। যদুর সূত্রে কৃষ্ণ যেমন যাদব, তেমনি বৃষ্ণির সূত্রে তিনি বৃষ্টি। বৃষ্ণির দুই ছেলে শফল্ক এবং চিত্রক। শফষ্কের ছেলে অক্রূর কৃষ্ণের সমসাময়িক এবং তিনি কংসের সভায় গণ্যমান্য ব্যক্তি, সম্পর্কে কৃষ্ণের ভাইও বটে। কেননা বৃষ্ণি-অন্ধকের বৈমাত্রেয় ভাই দেবমীঢুষের ছেলে হলেন শূর এবং স্বয়ং বসুদেব এই শূরেরই ছেলে। কৃষ্ণ বসুদেবের ছেলে হলেও শুরের নামে শৌরি বলেও পরিচিত। বসুদেবের আপন বোন হলেন পৃথা, যাঁর সঙ্গে পাওর বিয়ে হয়েছিল। কাজেই পাণ্ডবেরা হলেন কৃষ্ণের আপন পিসতুতো ভাই। অন্য দিকে বসুদেবের আরেক আপন বোনের সূত্রে চেদিরাজ শিশুপালও কৃষ্ণের আপন পিসতুতো ভাই, পাণ্ডবদের দিকে তিনি অবশ্য মাসতুতো ভাই। বৃষ্ণি এবং দেবমীচুষের কথা বলেছি, অন্ধকের পুত্র-পরিবারের কথা বলিনি। এই অন্ধকের চার ছেলের মধ্যে একজনের নাম কুকুর। তিনি এতই বিখ্যাত যে, তাঁর বংশ কুকুরবংশ বলেও পরিচিত। এই অন্ধককুকুর বংশেরই অধস্তন পুরুষ হলেন আহুক, যাঁর ছেলে কংস-পিতা উগ্রসেন। কংসের ঊর্ধ্বতন এক পুরুষ ভোজ কিংবা মহাভোজ নামেও পরিচিত, যাঁর জন্য-কংস ভোজ বংশীয় বলেও পরিচিত। আহুকের অবশ্য দুই ছেলে-দেবক এবং উগ্রসেন। দেবকের ছিল সাত মেয়ে এবং তাঁদের সবারই একসঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বসুদেবের সঙ্গে। সেই সাতজনের একজন দেবকীর ছেলে হলেন কৃষ্ণ। বংশ-পরিচয় যতটুকু দিয়েছি, তা যথেষ্ট। আর একটা কথা না বললে নয়। তা হল, যযাতির যে ছেলেটি পিতার জরা গ্রহণ করেছিল তিনি হলেন পুরু। সেই পুরুবংশের অধস্তন এক পুরুষ হলেন বিখ্যাত কুরু। মহাভারতের ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা কুরুর নামেই বংশ পরিচয় দিতে গর্বিত বোধ করতেন এবং সেই জন্যেই তাঁরা কৌরব। এই অর্থে পাণ্ডবেরাও কৌরব। মূল ধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে পাণ্ডুপুত্রেরা যে পাণ্ডব নামে পরিচিত হতে চাইছিলেন তাতে বুঝি পাণ্ডুর সময় থেকেই তাঁদের ভ্রাতৃবিরোধ দানা বেধে উঠছিল। কৌরবেরা সব মারা গেলে পাণ্ডবেরা কিন্তু আবার কৌরব নামেই তাঁদের বংশ পরিচয় দিতে আরম্ভ করেন।
এবারে আবার কৃষ্ণ কথায় ফিরে আসি। কংস যে এত পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন, তার অন্যতম কারণ ছিলেন মগধরাজ জরাসন্ধ। জরাসন্ধ তাঁর নিজের দুই মেয়েকে কংসের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম ভারতে তাঁর আপন প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন। প্রধানত এই জরাসন্ধের বলে বলীয়ান হয়েই কংস যা ইচ্ছে তাই করে যাচ্ছিলেন।
হরিবংশের বর্ণনাতে স্পষ্ট বোঝা যায়-কংসের দৌরাত্ম্য এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তাঁর বন্ধুবান্ধবেরা পর্যন্ত তাঁকে আর সইতে পারছিল না। কৃষ্ণের হাতে যখন কংস-চরেরা অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে তখন স্ববিনাশের ভয়ে কংস নিজেই সভাস্থলে সবাইকে ডেকে এনে বলছেন–আমার কোন সুযোগ্য মন্ত্রী নেই, ভাল গুপ্তচরের অভাবে আমি চোখ থাকতেও অন্ধ-অনমাত্যস্য শূন্যস্য চারান্ধস্য মমৈব তু। আমি যে এখনো সিংহাসনে বসে আছি, সে শুধু আমার নিজের ক্ষমতার জোরে। মাতা-পিতা তো আমাকে ত্যাগই করেছেন, এমন কি আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব–তারাও আমাকে দ্বেষ করে–মাতাপিতৃভ্যাং সত্ত্যক্তঃ স্থাপিতঃ যেন তেজসা। উভাভ্যামপি বিদ্বিষ্টো বান্ধবৈশ্য বিশেষতঃ ॥(১৩)
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বৃষ্ণিদের ব্যাপারে বৃষ্ণিসংঘের কথাটি উল্লেখ করেছেন অর্থাৎ বৃষ্ণিবংশীয়েরা একটি সংঘ বা ইংরেজীতে যাকে corporation বলি তারই মাধ্যমে তাদের রাজত্ব চালাত।(১৪) কংস অবশ্যই সংঘমুখ্য ছিলেন। কৌটিল্যের এই তথ্যের নিরিখে আমার ধারণা হয়, যদু-ক্রোর বংশ যেহেতু অত্যন্ত বড় হয়ে গেছিল তাই অন্ধক-কুকুর, ভোজ, বৃষ্ণি এদের সবারই পৃথক পৃথক সংঘ ছিল। কিন্তু কংসের আমলে এরা সবাই কংসের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েই আপন আপন সংঘের কাজ চালাতেন। আমি একথা বললাম এইজন্য যে, বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কৃষ্ণের সমসাময়িক বংশজেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে লাগতে কসুর করতেন না এবং লক্ষ্য করলে দেখা যাবে তাদের একজন হয়তো বৃষ্ণি বংশের, অন্যজন অন্ধক বংশের কিংবা অন্যজন হয়তো সাত বংশের মানুষ। এদের মধ্যে পারস্পরিক বিবাদ সময়ে অসময়ে প্রকট হলেও, কারও পক্ষেই কংসকে অতিক্রম করা সহজ ছিল না। কিন্তু অত্যাচারের একটা সীমা থাকে, যে সীমা অতিক্রম করলে পারস্পরিক বিবাদ ভুলে সবাই এক হয়ে যায় এবং সেই বিশেষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। কংসের ব্যাপারেও বোধ হয় তাই হয়েছিল।
কংস যেদিন প্রকাশ্য রাজসভায় বসুদেবকে অপমান করলেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন–যদুবংশের লোকেদের মধ্যে তুমি হলে মুখ্য আর তোমার এই চরিত্র–যদূনাং যূথমুখ্যস্য যস্য তে বৃত্তমীদৃশম্? কংসের কথায় বোঝা যায় কৃষ্ণপিতা বসুদেব যদুদের সংঘমুখ্য ছিলেন এবং অনেকেই তাঁর অনুগামী ছিল। তাঁরা বসুদেবকে যথেষ্ট সম্মান করতেন, কারণ কংসের মতে বসুদেবকে নাকি তাঁরা গুরুর মত দেখেন-যদূনাং প্রথমে গুরুঃ। গুর্থং পূজতঃ সত্তি মহপ্তিধর্মবুদ্ধিভিঃ। বসুদেব এমন কিছু করেছেন যাতে সমস্ত যাদবদের ওপরেই কংসের ঘেন্না ধরে গেছে বাচ্যাশ্চ যাদবঃ কৃতাঃ। আমাদের জিজ্ঞাসা হয় বসুদেব কি করেছিলেন? ধর্মের পরম্পরায় আমাদের কাছে কৃষ্ণকাহিনী যেভাবে পৌঁছেছে তাতে তো আমরা বসুদেবকে নির্দোষ এক অত্যাচারিত পিতা বলেই জানি। কিন্তু হরিবংশে দেখি কংস বসুদেবকে বলছেন–তুমি এমন বৃথা আশা করো না বসুদেব, তুমি ভেব না–আমি মরলে তোমার ছেলে এই মথুরায় রাজা হবে। কংস মরলে কংসের ছেলেই রাজা হবে মথুরায় হতে কংসে মম সুতো মথুরাং পালয়িষ্যতি। এসব কথা থেকে সন্দেহ হয় মথুরায় সিংহাসনের অধিকার নিয়ে বসুদেবেরও কিছু পরিকল্পনা ছিল হয়তো। আরও একটা জিনিসও লক্ষ্য করার মত। কংস বার বার বসুদেবকে বললেন–তুমি হচ্ছ কাকের মত। একজনের মাথায় বসে কাক যেমন তারই চোখ খুবলে নেবার চেষ্টা করে, তেমনি তুমি আমারই খাচ্ছ, আমারই পরছ আর আমারই মুলোচ্ছেদ করছ-ছিনত্তি মম মূলানি ভুক্তে চ মম পার্শ্বতঃ। অবশ্য এ ব্যাপারে কংসপিতা উগ্রসেনেরও কিছু দায়িত্ব আছে। তিনি তাঁর ভাইয়ের সাত মেয়ের এক জামাই বসুদেবকে হয়তো কিছু প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকবেন। কংস বললেন–এখানেই তুমি জন্মেছ, এখানেই বড় হয়েছ এবং আমার বাবাই তোমাকে বড় করেছেন–ইহ ত্বং জাতসংবৃদ্ধা মম পিত্রা বিবর্ধিতঃ(১৫)। কিন্তু কংস যতই সাময়িক পিতৃগর্ব দেখান না কেন, নানা বিষয়েই তিনি পিতাকে ব্যথিত করেছিলেন এবং পিতার অন্তরে কংস ছিলেন গভীর ক্ষতেরই মত। উগ্রসেনের পক্ষে ভোলা সম্ভব ছিল না যে কংস আসলে দানবরাজ মিলের ছেলে। উগ্রসেনেরই রূপধরা মিলের বলাৎকারে কংসের জন্মদাত্রী মাতাও কংসকে সহজ মনে মেনে নিতে পারেননি, তার প্রমাণ আছে কংসেরই আহত বক্তব্যে। পিতামাতার দ্বারা বিদ্বিষ্ট কংসেরও অভিমান বেড়ে উঠছিল দিনে দিনে, তিনি তখন প্রকাশ্যে দুমিলের পরিচয়েই গর্বিত হতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া হল আরেক ধরনের।
হরিবংশে দেখি–যে সভায় কংস বসুদেবকে নিন্দা করলেন এবং যে নিন্দায় আমরা শুধু কংসপক্ষের বক্তব্য শুনেছি, সেই নিন্দার প্রকাশ্য প্রতিবাদ হল কংসের রাজসভার মধ্যেই, এবং বসুদেব নিন্দার প্রথম প্রতিক্রিয়াতেই অন্ধকবংশের প্রধান বললেন–তুমি যদি যাদবদের কেউ না হও–অযাদবো যদি ভবান, তাহলে তোমাকে কেউ জোর করে যাদব করতে পারবে না। তুমি ভোজবংশীয় হও কিংবা যাদব, তুমি কংসই হও, বা অন্য যে কেউ–তোমার মাথাটি তোমার সঙ্গেই আছে। আমাদের রাগটা তোমার থেকেও বেশি হয় তোমার বাবার ওপর, যে নিজের থেকে বিলক্ষণ, দুজাতীয় তোমার মত এক পুত্রের জন্ম দিয়েছে। তুমি যাদের শাসক সেই বৃষ্ণিবংশীয়েরা আর প্রশংসার যোগ্য নয়–অশ্লাঘ্যা বৃষ্ণয়ঃ পুত্র যেষাং ত্বম্ অনুশাসিতা।(১৬)
পাঠক খেয়াল করুন যিনি কংসের কথার প্রতিবাদ করছেন তিনি অন্ধকবংশীয়, যাঁর পক্ষ হয়ে প্রতিবাদ করছেন সেই বসুদেব যদুমুখ্য বলে পরিচিত। কংসকে এখন কেউ ভোজবংশীয় বলেও মনে করতে পারছে না, যাদব বলেও নয় এবং কংস যাদের শাসনকতা সেই বৃষ্ণিবংশীয় পুরুষেরা কংসের জন্যই দুনমগ্ৰস্ত। বৃদ্ধ অন্ধক কৃষ্ণ বলরামের জাতির কথা উল্লেখ করে বললেন কৃষ্ণও যাদব, বলরামও যাদব, অথচ তাদের সঙ্গে তুমিই শত্রুতা আরম্ভ করেছ প্রথম-জাত্যা হি যাদবঃ কৃষ্ণঃ স চ সঙ্কর্ষণো যুবা। ত্বং চাপি বিধৃতস্তাভ্যাং জাতবৈরেণ চেতসা। এসব কথায় বেশ বোঝা যাচ্ছে কংসের জ্ঞাতিকুলের মধ্যে অনেক সংঘমুখ্যই কংসকে পছন্দ করছিল না, প্রধানত যাদের বলে কংস বলীয়ান, সেই বৃষ্ণি-ভোজেরাও তার অত্যাচারে ছিল জর্জরিত এবং তাতে করে কংসের পিতৃকুল সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠছিল।
বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ–এই সব জাতির শক্তিমান পুরুষেরা ছিলেন কংসের স্বজন এবং প্রজা কিন্তু কংসের স্বচ্ছন্দচারিতায় এদের মধ্যে অনেকেই কৃষ্ণপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন–শেষাশ্চ মে পরিত্যক্তা যাদবাঃ কৃষ্ণপক্ষিণঃ।(১৭) মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ নিজেই যুধিষ্ঠিরকে বলছেন যে, ভোজজাতির বৃদ্ধপুরুষদের অনুরোধেই তিনি কংসকে বধ করেছেন। কংসের দ্বারা পীড়িত হয়ে ভোজকুলের ছোট ঘোট সামন্ত রাজারা এবং অভিজ্ঞ পুরুষেরাও জ্ঞাতি বন্ধুদের বাঁচাবার জন্যই কৃষ্ণকে কংসের বিরুদ্ধে যেতে বলেন–ভোজরাজন্যবৃদ্ধে পীড্যমানৈ দুরাত্মনা। জ্ঞাতিত্রাণমভীপ্তিরস্মসম্ভাবনা কৃতা ॥(১৮) হরিবংশে আগেই দেখেছি, কংস যখন উন্মুক্ত সভাস্থলে কৃষ্ণপিতা বসুদেবের নিন্দা করছিলেন তখন অন্ধক-গোষ্ঠীর এক জাঁদরেল পুরুষ (শ্রেষ্ঠঃ সমাজে) সেই মুক্তসভাতেই কংসকে অতি কঠিন ভাষায় তিরস্কার করেন এবং এই নিন্দার প্রতিবাদ করেন। সন্দেহ করি, বসুদেব যে কংসের কারাগার থেকে এক রাত্তিরের মধ্যেই কৃষ্ণকে বৃন্দাবনে পাচার করে দিতে পেরেছিলেন তার পেছনে অন্য সাধারণ মানুষেরও মদত ছিল। বসুদেব নিজেও যে তলায় তলায় কংসের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন না, তাও জোর করে বলা যায় না। কেননা, কংস যখন অরকে ব্ৰজে পাঠালেন ধনুর্যজ্ঞের ছলে কৃষ্ণকে মথুরায় দিয়ে আসতে, তখন তিনি অক্রূরকে বলছেন-দেখ বাপু, তুমি যদি বসুদেবের কাছ থেকে কোন কান-ভাঙানি না খেয়ে থাক, তবে তুমি আমার এই প্রিয়কার্য সাধন কর–যদি বা নোপজপ্তোহসি বসুদেবেন সুব্রত। অক্রূর কুরু মে প্রীতিমেতাং পরমদুর্লভাম ॥(১৯) স্বয়ং কংসের পিতা উগ্রসেন, যিনি প্রকাশ্যেই কংসের বিরোধী ছিলেন, তিনিও হয়তো কিছু মদত পেয়ে থাকবেন অন্যান্য ভোজরাজন্য বৃদ্ধদের কাছে। কংস মারা যাবার পর বৃদ্ধ বয়সে উগ্রসেনের পুনরায় রাজপদে অভিষেক আমাদের মনে সন্দেহজনক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। উগ্রসেনকে রাজা করার ব্যাপারে কৃষ্ণ স্বয়ংই ছিলেন অতিরিক্ত আগ্রহী। এবং এই রাজ্যাভিষেকের পূর্বে দু-একটি ঘটনা এই সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে। কংস মারা যাবার পর কংসের দুঃখিনী মাতা অত্যন্ত বিলাপ সহকারে লঙ্কেশ্বর রাবণের একটি উক্তি স্মরণ করেছিলেন। রাবণ নাকি বলেছিলেন–যে আমি দেবতাদেরও মেরে ফেলতে পারি, তারও আপন বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে ভয় অনিবার্য। কংসের রাজপদের ক্ষেত্রেও তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টিরাই ছিল লুব্ধ, তাই জ্ঞাতিগুষ্টিদের হাতেই তাকে মরতে হল-তথৈব জ্ঞাতিলুব্ধস্য মম পুত্রস্য ধীমতঃ। জ্ঞাতিভভ্যা ভয়মুৎপন্নং শরীরান্তকরং মহৎ ॥(২০)
দ্বিতীয়তঃ কংসের মা যখন কাঁদতে কাঁদতে উগ্রসেনকে সমদুঃখিত করার চেষ্টা করলেন তখন উগ্রসেনও যেন একেবারে গলেই গেলেন। তাঁর এমন শ্মশান-বৈরাগ্য উপস্থিত হল যে তিনি কংসের চিতাগ্নি স্থাপনের পর সপরিবারে বনেই চলে যেতে চাইলেন-সমুযোহহং সভাৰ্যশ্চ চরিষ্যামি মৃগৈঃ সহ। শত্রুপক্ষ হলেও কৃষ্ণ যেন কংসের অন্তিম সংস্কারের ব্যবস্থা করেন এই ছিল উগ্রসেনের কামনা। হরিবংশ কিন্তু জানাচ্ছে উগ্রসেনের এই বৈরাগ্য এবং কংসপ্রীতি দেখে কৃষ্ণ অত্যন্ত বিস্মিত হলেন–এতচ্ছুত্ব বচস্তস্য কৃষ্ণঃ পরমবিস্মিতঃ।(২১) অর্থাৎ উগ্রসেনের পূর্বকথার সঙ্গে পরের ব্যবহারটি যেন মেলে না। এর পর কংসের প্রেতকার্য হয়ে গেলেই উগ্রসেন রাজা হন।
উল্লিখিত দুটি ঘটনাই প্রমাণ করে যে পিতা হলেও উগ্রসেন একেবারে নিষ্কাম ঘৃতশুদ্ধ ছিলেন না। ভোজরাজন্যবৃদ্ধদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরও কিছু অভিসন্ধি ছিল। আবার, যে অক্রূরকে কংস পাঠালেন কৃষ্ণ-বলরামকে মথুরায় নিয়ে আসবার জন্য, সেই অরকেও কৃষ্ণ স্বপক্ষে জিতে নিলেন এক অদ্ভুত উপায়ে। লক্ষণীয় এই যে, অত্রুর কংস সভার এক বিশ্বস্ত মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণের অনুরক্ত ছিলেন এবং এটিও একটি সন্দেহজনক কথা। ভাগবত পুরাণে দেওয়া ধারণা অনুযায়ী অক্রূর যখন কৃষ্ণকে মথুরায় নিতে এলেন, কৃষ্ণ তখন বার বছরের কিশোর। তবে তিনি যে সেই সময় একেবারে নটবরটি ছিলেন, তা আমরা মনে করি না। সেই সংকটময় মুহূর্তে যে বুদ্ধির পরিচয় তিনি দিয়েছেন, তাতে বেশ বোঝা যায় তখনকার রাজনীতি তিনি কতটা বুঝতেন। মনে রাখতে হবে কংসের আহ্বানে-উঠল বাই তো কটক যাই–এই নীতিতে কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গেই কংসের দরবারে হোটেননি। অক্রূরের মধ্যে অল্প হলেও যে বিভীষণবৃত্তি ছিল, তার সম্পূর্ণ সুযোগ কৃষ্ণ গ্রহণ করেছেন। অধিকন্তু অক্রূরের দিক থেকে তাঁর প্রতি যে অনুরক্তিটুকু ছিল তা কৃষ্ণ আরও বাড়িয়ে তুললেন অক্রূরের সঙ্গে একটি মেয়ের বিয়ে দিয়ে। এমন একটি মেয়ের সঙ্গে তিনি অক্রূরের বিয়ে দিলেন, যাতে অর মনে মনে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলেন কৃষ্ণের কাছে।
মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন-কংস বড় বেড়ে উঠেছিল। ভোজরাজন্যবৃদ্ধেরা জ্ঞাতিত্রাণের ইচ্ছায় যখন বার বার আমাকে এই ব্যাপারে উত্ত্যক্ত কবতে লাগলেন তখন আমি অক্রূরের সঙ্গে আহুকের মেয়ে সুতনুর বিয়ে দিয়ে দিলাম এবং বলরামের সহায়তায় কংসকে হত্যা করলাম।(২২)
মজা হল, আহুক উগ্রসেনের বাবা, কংসের পিতামহ। আর কৃষ্ণমাতা দেবকীর সম্বন্ধে আহুক হলেন কৃষ্ণের প্রমাতামহ। কাজেই কৃষ্ণের পক্ষে মাতামহীর সমান কোন কন্যার সঙ্গে অক্রূরের বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারটা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। মহাভারতে যাকে আহুকের মেয়ে বলা হয়েছে সে আসলে আহুকের ঘরের মেয়ে, অত মহাভারতের আশয় তাই।(২৩) দেখা যাক হরিবংশ এ ব্যাপারে কি বলে?
হরিবংশ দু-জায়গায় জানিয়েছে অক্রূরের বিয়ে হয়েছিল উগ্রসেনের মেয়ের সঙ্গে। হরিবংশের বৃষ্ণিবংশ বর্ণনায় দেখি অক্রূর উগ্রসেনা সুগাত্রির গর্ভে প্রসেন ও উপদেব নামে দুটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন–অরেণোগ্রসেনায়াং সুগাত্রাং কুরুনন্দন। আবার স্যমন্তক মণি প্রসঙ্গে এই মেয়েটির নাম না করে হরিবংশ বলেছে অক্রূর উগ্রসেনীর গর্ভে প্রসেন এবং উপদেব নামে দুটি পুত্র উৎপাদন করেন–অরোেগ্রসেন্যাং তু সুতো দ্বেী কুরুনন্দন। হরিবংশের সুগাত্রি আর মহাভারতের সুতনু-এই • দুই নামের অর্থে কোন ভেদ নেই। শ্রীজীব ন্যায়তীর্থমশাই তাঁর হরিবংশের বঙ্গানুবাদে সুগাত্রি নামটির অর্থ করে ‘সুন্দরাঙ্গী করে দিয়েছেন; কিন্তু তিনি যদি তাঁর আপন হাতের বিষ্ণুপুরাণের সংস্করণটি খেয়াল করতেন তাহলে দেখতেন-সেখানে পরিষ্কার লেখা আছে–উগ্রসেনের কংস সুনামা ইত্যাদি নটি ছেলে আর তাঁর মেয়ে হল পাঁচটি-কংসা, কংসবতী, সুতনু, রাষ্ট্রপালী এবং কঙ্কী। এরাই হনে ‘উগ্রসেনতনুজাঃ।
যাকে হরিবংশ বলেছে উগ্রসেনা বা উগ্রসেনী সুগাত্রি, তাকেই বিষ্ণুপুরাণ বলেছে-সুতনু উগ্রসেনতনুজা; কাজেই মহাভারতের সুতনু আহুকের মেয়ে নয়, উগ্রসেনেরই মেয়ে। অর্থাৎ কংসের আপন বোন। কৃষ্ণমাতা দেবকী কিন্তু কংসের জ্যাঠতুতো বোন। দেবকীরা সাত বোন হলেন কংসের জ্যাঠা দেবকের মেয়ে। এদের সবাইকেই বিয়ে করেছিলেন কৃষ্ণপিতা বসুদেব। আগেই বলেছি, বসুদেব এবং উগ্রসেন–এই দুজনেরই হয়তো কংসের বিরুদ্ধে কোন দুরভিসন্ধি ছিল। তাই উগ্রসেনের মেয়ে, অর্থাৎ কংসের আপন বোনের সঙ্গে অজ্বরের বিয়ে হওয়ায় অরের মনে নিঃসন্দেহে এমন এক আভিজাত্যের বোধ তৈরি করেছিল, যা উল্টো দিক দিয়ে কংসের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছিল নিঃসন্দেহে। এদের সঙ্গে অন্ধক, ভোজ, যাদব এবং বৃষ্ণিদের প্রধান পুরুষেরা অনেকেই কংসের বিপক্ষে চলে যাওয়ায় বন্ধুহীন কংসকে শুধুমাত্র মুষ্টির আঘাতেই ধরাশায়ী করতে পেরেছিলেন কৃষ্ণ।
একদিকে কংসবধ যেমন কৃষ্ণকে তাঁর পশ্চিমী রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একক প্রতিষ্ঠা দিল তেমনি অন্যদিকে তিনি সশঙ্কিত হয়ে উঠলেন কংসের অন্য শুভানুধ্যায়ীদের সম্বন্ধে। যাঁরা রাজনৈতিক দিক থেকে কংসের পক্ষে ছিলেন, তাঁরাই তখন হয়ে উঠলেন কৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বী। ঠিক এই সময় থেকেই কৃষ্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে গভীরভাবে যোগাযোগ করবার চেষ্টা আরম্ভ করেন। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিয়ে হবার আগেই কৃষ্ণের সঙ্গে রুক্মিণী এবং সত্যভামার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। হরিবংশ জানিয়েছে, স্যমন্তক মণির স্বত্ব নিয়ে কৃষ্ণের নিজের ঘরে যে গণ্ডগোল সৃষ্টি হয়েছিল তার জেরেই সত্যভামার বাবা সত্রাজিৎ মারা যান। সত্ৰাজিৎ মারা যাবার সময় কৃষ্ণ দ্বারকায় ছিলেন না। তিনি পাণ্ডবদের জতুগৃহে দগ্ধ হবার সংবাদ পেয়ে ছুটে গেছিলেন বারণাবতে। পিতৃবিয়োগে শোকাকুলা সত্যভামা একাই বারণাবতে গিয়েছিলেন, কৃষ্ণকে পিতার মৃত্যুসংবাদ জানাতে।(২৪) কিন্তু এ প্রসঙ্গ অন্য। কৃষ্ণ যদিও মৃত বলে আখ্যাত পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধ তৰ্পণাদি করলেন, কিন্তু বাস্তবিক, তিনি এ খবর বিশ্বাস করেননি। তিনি সাত্যকিকে রেখে এলেন পাণ্ডবদের ভস্মীভূত দেহগুলি খুঁজে বার করবার জন্য, কেননা পাণ্ডবেরা সত্যিই মারা গেছেন না বেঁচে আছেন–এ খবর তাঁর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কেন তার কারণটা বলি।(২৫)
সমস্ত পুরাণগুলির প্রমাণে একথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে, কংসের মৃত্যুর পর গোটা ভারতবর্ষ রাজনৈতিক দিক দিয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। কংস ছিলেন মগধরাজ, জরাসন্ধের জামাই। মহাভারত খবর দিয়েছে, জরাসন্ধের দুইকন্যা অস্তি এবং প্রাপ্তি কংসের মৃত্যুর পর সোজা বাপের বাড়ি চলে আসেন এবং পিতা জরাসন্ধকে বলেন এই মৃত্যুর শোধ নিতে–পতিয়ং মে জহীতি। মহাভারতের তুলনায় হরিবংশের খবরটি রাজনৈতিক দিক থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ। হরিবংশ বলেছে, কংস কৃষ্ণের হাতে মারা পড়বার পর, শুধুমাত্র কৃষ্ণের জন্যই সমস্ত বৃষ্ণিকুলের সঙ্গে জরাসন্ধের শত্রুতা হয়ে গেল চিরকালের। জামাতা তৃভবত্তস্য কংসস্তম্মি হতে যুধি। কৃষ্ণার্থং বৈরমভব জরাসন্ধস্য বৃষ্ণিভিঃ। দ্বিধাবিভক্ত এই রাজকুলের একদিকে থাকলেন প্রবল পরাক্রমী জরাসন্ধ, অন্যদিকে ছিলেন কৃষ্ণ, যার প্রধান ভরসা ছিল যাদব, অন্ধক এবং ভোজবীরেরা।
পাঠক মনে রাখবেন, কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের পরে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি উত্তর ভারতের প্রধান্য ঘটে থাকে, তো এই যুদ্ধের পূর্বে সর্বত্রই ছিল প্রায় পূর্ব ভারতের প্রধান্য। মগধের রাজা জরাসন্ধ ছিলেন তখনকার ভারতের হাড়কাঁপানো রাজা। জামাই কংসের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তিনি কৃষ্ণ বলরামের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দুইপক্ষ মিলে যত অক্ষৌহিণী সেন্য যুদ্ধ করেছে, জরাসন্ধ তার থেকেও বেশি সৈন্য নিয়ে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। উত্তর ভারতের রাজনৈতিক আকাশে নতুন কৃষ্ণ-নক্ষত্রটিকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য যে মিত্রশক্তির অভ্যুদয় ঘটেছিল তার প্রথমে ছিলেন শিশুপাল যিনি মোটামুটি মধ্যপ্রদেশ অঞ্চলে রাজত্ব করতেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বেই ছিলেন করুষদেশের রাজা দন্তবক্র। ওদিকে ছিলেন কলিঙ্গের রাজা, প্রাগজ্যোতিষপুর, মানে আসামের রাজা, আর ছিলেন বাংলাদেশের রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেব। শেষোক্ত জনের বীরত্ব বা ক্ষমতা এমনই ছিল যে তিনি নিজেকে দ্বিতীয় বাসুদেব বলেই পরিচয় দিতেন। এছাড়া ছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণের ভাবী শশুর এবং শ্যালক-ভীষ্মক এবং রুক্মী। আর ছিলেন কৌরবেরা, যাঁরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখনও শিশু। হরিবংশে অতি অবহেলায়, সবার শেষে জরাসন্ধের দলের পুচ্ছভাগে কৌরবদের নাম করা হয়েছে। জরাসন্ধ তাঁর বাহিনী নিয়ে মথুরা অভিযানে চললেন, প্রচুর যুদ্ধও হল। শেষে সম্মুখ যুদ্ধে কৃষ্ণ-বলরামের হাতে জরাসন্ধকে মার খাইয়ে হরিবংশকার এক অদ্ভুত বিমলানন্দ লাভ করেছেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণের ভগবত্তায় সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখেও আমি হলফ করে বলতে পারি–যাঁর কূটনৈতিক চালে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তাবৎ মানুষ নিজের ছায়ার সঙ্গে পর্যন্ত লুকোচুরি খেলে, তিনি কিনা বোকার মত জরাসন্ধের এই বিপুল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন-এ আমি বিশ্বাসই করি না। তিনি সোজা পালিয়েছিলেন, সেই যে অংশুমতীর তীরে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় ঋগ্বেদের এক কৃষ্ণ যেমন পালিয়েছিল, সেই রকমই তিনি পালিয়েছিলেন। হরিবংশের এই খবর যে আমি বিশ্বাস করি না, তার কারণও আছে, জরাসন্ধের বাহিনীকে তিনি কিরকম ভয় পেতেন–সে কথা সেইখানেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।
পাঠক যদি একবার পাণ্ডবদের আহ্বানে স্বয়ং কৃষ্ণের সঙ্গেই মহাভারতের সভাপর্বে প্রবেশ করেন, তাহলে দেখবেন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের হঠাৎ চক্রবর্তী রাজা হওয়ার বাসনা জেগেছে। সরল মানুষ, তাতে প্রচুর মোসাহেব সামন্তের উৎসাহ-বাদে স্ফীত হয়ে তিনি ঠিক করলেন, রাজসূয়টা সেরে ফেলাই ভাল। ঠিক এই সময়ে কৃষ্ণ বাসুদেব এলেন পাণ্ডবদের সভায়। তিনি একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে বললেন–দেখুন দাদা যুধিষ্ঠির, আপনি রাজসূয় যজ্ঞ করবেন, এ অতি উত্তম কথা। কিন্তু তার আগে কতকগুলো ব্যাপার একটু খতিয়ে দেখা দরকার। সবার আগে ধরুন জরাসন্ধের কথা, যিনি তাঁর আপন বলবীর্যে সমস্ত রাজকুলকে দাবিয়ে রেখে তাঁদের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে আছেন–হিতো মূর্ধি নরেন্দ্ৰানাম ওজসাক্রম্য সর্বশঃ। আপনি জানবেন-সমস্ত রাজমণ্ডল তাঁরই পেছনে। হ্যাঁ, কিছুদিন হল আমরা কংসকে মেরে ফেলেছি বটে, তবে তার পরেই যখন জরাসন্ধ যুদ্ধোদ্যম শুরু করল, তখনই আমরা মন্ত্রীদের সঙ্গে বসে ঠিক করলাম যে, আমরা যদি আমাদের সমস্ত শাণিত অস্ত্র দিয়ে অবিশ্রান্তভাবে তিনশো বছর ধরেও জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করি, তবু আমরা তার সঙ্গে এঁটে উঠতে পারব না–অনারমন্তো নিষ্মন্তো মহাস্ত্রৈঃ শত্রুঘাতিভিঃ। ন হন্যামো বয়ং তস্য ত্রিভিশতৈ বল।(২৬)
পাঠক খেয়াল করবেন জরাসন্ধ যুদ্ধোদ্যত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু মথুরার মন্ত্রিসভায় এই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল–ভয়ে তু সমতিক্রান্তে–মানে কংসের ভয় চলে গেলে, জরাসন্ধে সমুদ্যতে–অর্থাৎ জরাসন্ধ যুদ্ধ্যোদ্যত হলে-মন্ত্রোহয়ং মন্ত্রিতো রাজন কুলৈরষ্টাদশাবরৈঃ-আমরা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। তার মানে হরিবংশের জবান এখানে ঠিক নয়। মহাভারতের সভাপর্বে কৃষ্ণ আরও বললেন-মহারাজ, শুধু কংস কেন, জরাসন্ধের ডান হাত-বাঁহাত হংস এবং ডিম্ভক নামে দুই শক্তিশালী রাজাকেও আমরা হত্যা করেছি। হংস-ডিম্ভকের মৃত্যুর পর যেটুকু সময় জরাসন্ধ বিমর্ষ হয়েছিল, সেই ফাঁকে জরাসন্ধের হানা থেকে বাঁচবার জন্য আমরা নিজেদের দেশস্থ ধন-সম্পত্তি ভাগাভাগি করে ছেলেপুলে নিয়ে আরও পশ্চিমে কুশস্থলীতে পালিয়ে গেছি–পৃথকত্বেন মহারাজ সংক্ষিপ্য মহতীং শ্রিয়। পলায়ামো ভয়াৎ তস্য স্বসুতজ্ঞাতিবান্ধবাঃ ॥(২৭)
এইটেই কথা–এইটুকু বুদ্ধি কৃষ্ণের ছিল। গোঁয়ার-গোবিন্দের মত সামনাসামনি যুদ্ধ করে বীরদর্পে আত্মাহুতি দেবার লোক তিনি নন। কাজেই আবারও বলি হরিবংশের বয়ানটি বিচারসহ নয়। হ্যাঁ, জরাসন্ধ মাঝে মাঝেই তাঁর রাজ্যে হানা দিতেন বটে, কিন্তু কৃষ্ণও তাঁর সঙ্গে খুব যুদ্ধ করতেন, একথা-ধোপে টেকে না। বরঞ্চ ভুয়োদশী ঝুনো রাজনৈতিক নেতার মত তিনি একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন। ধর্মীয় কারণে কিংবা কৃষ্ণের ঐশ্বরিক মাহাত্মবোধে হরিবংশকার জরাসন্ধকে কৃষ্ণের হাতে মার খাইয়ে হারিয়ে দিলেও সত্যকে একেবারে অস্বীকার করেননি। মনে রাখা দরকার কংসকে মারার জন্য কৃষ্ণকে বেশি বেগ পেতে হয়নি, কেননা যাদব, বৃষ্ণি, ভোজ–যাদের তিনি রাজা ছিলেন, তারা তলায় তলায় কৃষ্ণের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে রাজা হিসেবে তিনি মরেই ছিলেন। কিন্তু কংস মারা যাবার পরে জরাসন্ধ যেদিন তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে মথুরা আক্রমণ করলেন সেদিন বলরামকে বলেছেন–এই জরাসন্ধই হল আমাদের যুদ্ধ কৌশলের কষ্টিপাথর এবং আমাদের যোদ্ধা-জীবনের প্রথম অতিথিও এই জরাসন্ধ–আবয়ো যুদ্ধনিকষঃ প্রথমঃ সমরাতিথিঃ।(২৮) জরাসন্ধের কষ্টিপাথরে যাদববৃষ্ণির ক্ষমতা নঞর্থকভাবেই যাচাই হয়েছিল। তার প্রমাণ হল জরাসন্ধ একবার চলে যাওয়ার পর যখন আবার মথুরা অভিযানে ফিরে এলেন তখন জরাসন্ধের ভয়ে ভীত যাদবেরা এক জরুরী সভা ডাকলেন। বিকদ্রু বলে এক রাজনীতিকুশল ব্যক্তি যদুবংশের পূর্ব ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেষে বললেন–জরাসন্ধ সমস্ত রাজমগুলের মাথায় বসে আছেন, তার যে অসংখ্য সৈন্যবাহিনী এবং সমর-সম্ভার, সে অনুপাতে আমাদের সমর সম্ভার নগণ্য-অপ্রমেয়বলশ্চৈব বয়ঞ্চ কৃশসাধনাঃ। তার ওপরে এই মথুরাপুরীর যা অবস্থা তাতে শত্রুসৈন্যের একদিনের অবরোধও এর সহা করবার ক্ষমতা নেই। না আছে খাদ্য, না আছে আগুন জ্বালাবার ইন্ধন, না আছে দুর্গ। এই মথুরার চারদিকে যে জলপরিখা আছে তার সংস্কার হয়নি বহুদিন, নগরের দ্বাররক্ষার ব্যবস্থাও নেই, চারদিকে যে প্রাচীর তাও পাকা করা দরকার। মহারাজ কংস এসব দিকে নজরও দেয়নি, তার সৈন্যরা শুধু ভোগ করে গেছে। (২৯)
কথাগুলি খুব যুক্তিযুক্ত। কংস জরাসন্ধের ছত্রছায়ায় রাজত্ব করে যাচ্ছিলেন, তার ওপরে তিনি জরাসন্ধের জামাই। মথুরার চারদিকে কালযবন ইত্যাদি যেসব রাজারা ছিলেন তাঁরা সবাই ছিলেন জরাসন্ধের বশংবদ। কাজেই কংসকে পুরী রক্ষার জন্য আলাদা করে কিছু চিন্তা করতে হয়নি। বিকল্লু বললেন-কংস মারা গেছে, এ রাজ্যের এখন নবোদয়কাল, কাজেই শত্রুপক্ষের একদিনের অবরোধও এর সহ্য করবার ক্ষমতা নেই–পুরী প্রত্যগ্রনরোধে ন রোধং বিসহিষ্যতি। আমরা জানি জরাসন্ধ মথুরা অবরোধই করেছিলেন এবং বিকদুর সত্য বর্ণনার নিরিখে বেশ বুঝতে পারি সে অবরোধ সহ্য করবার ক্ষমতা মথুরাপুরীর ছিল না। ঠিক এই কারণে জরাসন্ধ যতবার যুদ্ধ করতে এসেছেন, কৃষ্ণ-বলরামের সৈন্যকে তার সামনা-সামনিই যুদ্ধ করতে হয়েছে, অন্য উপায় ছিল না। এর ফল যা হয়েছে সেটা রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট প্রণিধানযোগ্য। বিক বললেন–আমাদের সৈন্যেরা বহু যুদ্ধের সম্মুখীন হওয়ায় সমস্ত মনোবল হারিয়ে ফেলেছে-বলং সংমদভগ্নঞ্চ কৃষ্যমানং পরেণ হ। এ রাজ্যের সঙ্গে সমস্ত জনগণও মারা পড়বে। তার ফল হবে সাংঘাতিক। কংসপক্ষীয় যেসব যাদবদের বিরোধিতার মুখে এই রাজ্য আমরা জয় করেছিলাম, তারা এখন বিভেদ সৃষ্টি করবে অর্থাৎ তারা বলবে–আমরা তো কংসের রাজত্বেই ভাল ছিলাম, এ আবার কি নতুন উৎপাত আরম্ভ হল। অন্যান্য রাজারাও জরাসন্ধের ভয়ে আমাদের সঙ্গে বঞ্চনা করবে। কাজেই যদি আরও একবার মথুরাপুরী অবরুদ্ধ হয় তাহলে জনগণ বলবে কৃষ্ণপক্ষীয় যাদবদের বিরোধেই আমরা মরলাম–যাদবানাং বিরোধেন বিনষ্টাঃ স্মেতি কেশব।”(৩০)
এ সমস্তই রাজনীতির কথা, এবং কৃষ্ণ এর একটা কথাও অবহেলা করেননি। কৃষ্ণ বললেন–শত্রু যদি বলবান হয় তবে তার কাছাকাছি থাকা মোটেই উচিত নয়, অন্তত বুদ্ধিমান লোক তা থাকবে না বরঞ্চ পালিয়ে থাকাই বাঞ্ছনীয়–বলিনঃ সন্নিকৃষ্টে তু ন স্বেয়ং পণ্ডিতেন বৈ। অপক্রমেদ্ধি কালজ্ঞঃ। কাজেই আমি শক্তিমান হলেও অসমর্থ মানুষের মত আপাতত পালিয়েই যাব–এবং পালিয়ে যাব জীবন বাঁচানোর জন্যে–জীবিতাৰ্থং গমিষ্যামি শক্তিমানপাশক্তবৎ।(৩১)
আমরা আগেই বলেছি কৃষ্ণ পালিয়েছিলেন। হরিবংশ কৃষ্ণকে আগে একটু জিতিয়ে দিলেও পরে তাঁকে দক্ষিণ ভারতের দিকে লুকিয়ে থাকার জায়গা করে দিয়েছে। কৃষ্ণ বলেছিলেন–দরকার হলে পালাতে হবে বৈকি, কিন্তু সমর্থ হলেই যুদ্ধ করতে হবে-অপক্রমেদ্ধি কালজ্ঞঃ সমথে যুদ্ধমুদবহেৎ। কিন্তু এই সামর্থ্য কৃষ্ণের একদিনে আসেনি, তিনি একটু একটু করে এগোচ্ছিলেন আপন লক্ষ্যে।
সবাই জানেন দ্রুপদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের পর থেকেই পাণ্ডবদের শ্রীবৃদ্ধি ঘটছিল। কৃষ্ণও সেই সময় থেকে পাণ্ডবদের সঙ্গে উঠতে বসতে যোগাযোগ রেখে যাচ্ছিলেন, কেননা পাণ্ডব-কৌরবের ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব তখন বেশ জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং কুরুরাজ দুর্যোধন কিন্তু ছিলেন জরাসন্ধের পক্ষে। পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগাযোগটা কৃষ্ণ আরও বাড়িয়ে তুললেন আরও একটি ছোট্ট কাজ করে। তিনি অর্জুনের সঙ্গে নিজের বোন সুভদ্রার বিয়ে দিয়ে দিলেন। এই বিয়েটা তিনি দিয়েছিলেন সমস্ত যাদববৃষ্ণিদের মতের বিরুদ্ধে, এমনকি দাদা বলরাম পর্যন্ত এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয়ে অর্জুনকে ‘দুর্বুদ্ধিঃ কুলপাংসনঃ বলে গালাগালি দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরে কৃষ্ণ যখন সব বুঝিয়ে বললেন, তখন সবাই শান্ত হলেন। কৃষ্ণের রাজনৈতিক চাতুরি যে কতখানি তা বোঝ গেল, যখন এই বিয়ের ফলে যাদব, বৃষ্টি, অন্ধক, ভোজেদের সঙ্গে পাণ্ডবদের একটা সম্পূর্ণ যোগাযোগ প্রকট হয়ে উঠল। ঠিক এই বিয়ের পরে বৃষ্ণি-ভোজবংশীয়দের সমস্ত গুষ্টিকেই দেখি কৃষ্ণ-বলরামের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সভায় যেতে-বৃষ্ণান্ধকৈস্তথা ভোজৈঃ সমেতঃ পুরুষোত্তমঃ। সুভদ্রার বিয়েতে যে যৌতুকগুলি বৃষ্ণি-অন্ধকদের তরফ থেকে যুধিষ্ঠিরের খাণ্ডবপ্রস্থে পৌঁছেছিল, তাকে এখনকার ভাষায় রীতিমত ‘আর্মস-এইড’ বলা যেতে পারে। সমগ্র এক অধ্যায় জুড়ে বৃষ্ণি-অন্ধক, ভোজ-যাদবদের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের প্রীতি-প্রতিগ্ৰহ এতবার ধ্বনিত হয়েছে যে তাতে বেশ বোঝা যায়–এ ছিল এক যৌথচুক্তির আসর, সুভদ্রার বিবাহকালের ইমন-ভূপালী সেখানে ডুবে গেছে বৃষ্ণি-অন্ধক আর পাণ্ডবদের যৌথ-মিত্রতার আকুল শব্দে।(৩২)
যে দ্রুপদের মেয়ের সঙ্গে পাণ্ডবদের বিয়ে হল, কৃষ্ণ লক্ষ্য করে থাকবেন, সেই ধ্রুপদ একসময়ে জরাসন্ধের মথুরা অভিযানে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। হরিবংশ বলেছে-পাঞ্চালাধিপতিশ্চৈব দুপদশ্চ মহারথঃ। আবার এই দ্রুপদের সঙ্গে কৌরবদের একসময় মনোমালিন্য হয়েছিল, তাঁর রাজ্যেরও খানিকটা ক্ষতি হয়েছিল তাতে। যখন এ ঘটনা ঘটেছিল তখনও পাণ্ডবেরা স্বনামে ধন্য হননি। দ্রোণাচার্যের গুরুদক্ষিণা দেবার তাগিদে কৌরব-পাণ্ডবেরা একযোগে দ্রুপদের রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন এবং দ্রুপদ সে অপমান মনে রেখেছিলেন কৌরবদের নামেই। কাজেই পাণ্ডবদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত যখন তাঁর মেয়ের বিয়ে হল, কৃষ্ণের পক্ষে সেটা ছিল বড়ই স্বস্তিকর। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণের হৃদ্যতা ছিল আগে থেকেই, এবং দ্ৰৌপদীর সঙ্গে বিয়ের সুবাদে দ্রুপদ যে এবার জরাসন্ধ এবং কৌরব পক্ষের বিরোধী গোষ্ঠীতে থাকবেন এতে আর আশ্চর্য কি? সুভদ্রার সঙ্গে মুখ্য পাণ্ডব অর্জুনের বিয়ের পর কৃষ্ণ যথেষ্ট খেয়াল রেখেছিলেন যাতে দ্রৌপদী কোনমতেই চটে না যান। দ্রৌপদীর বিয়ের পর পরই সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পর সুভদ্রাকে সঙ্গে নিয়ে দ্রৌপদীর সামনে তাঁর দাঁড়াবার সাহস বা রুচি কোনটাই ছিল না। দ্রৌপদী প্রথম আঘাতে অভিমানভরে অর্জুনকে বলেছিলেন-তুমি চলে যাও সেইখানে, যেখানে আছেন সেই সাত্বত-বৃষ্ণিদের মেয়ে। অর্জুন অনেক বোঝালেন, অনেক সান্ত্বনা দিলেন, শেষে সুভদ্রাকে দ্রৌপদীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন একেবারে নববধূর আড়ম্বরহীন গোপবালিকার বেশে-পাৰ্থঃ প্ৰস্থাপয়ামাস কৃত্বা গোপালিকাবপুঃ। সুভদ্রা দ্রৌপদীর কাছে এসে বললে–আমি আপনার দাসীমাত্র। খুশী হলেন দ্রৌপদী। কিন্তু এ বুদ্ধি কার? আমরা খুব ভালভাবে জানি–এ বুদ্ধি কৃষ্ণের। শৈশব এবং প্রথম যৌবনের স্মৃতিজড়িত গোবালিকার বেশ যে কত সাদামাটা, সে যে পঞ্চস্বামী গর্বিত দ্রৌপদীর কাছে নম্রতার সম্পূর্ণ আভাস দেবে–এ জিনিস কৃষ্ণের জানা ছিল। তাই কৃষ্ণ যেমন সুভদ্রার বিয়ে দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক আখের গুছিয়ে ছিলেন, দ্রৌপদী তুষ্ট থাকায় দ্রুপদের দিকটাও তাঁকে একধরনের রাজনৈতিক সুবিধেই দিয়েছিল।
আর একটি কাজ করে কৃষ্ণ তাঁর আপন লক্ষ্যে আরও একটু এগোতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাতে যন্ত্রণা আরও বেড়েছে। এই কাজটি হল রুক্মিণীকে বিয়ে করা, যদিও এই ঘটনা ঘটেছে পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগাযোগের আগেই। রুক্মিণী ছিলেন বিদর্ভের রাজা ভীষ্মকের মেয়ে। শিশুপালের রাজ্য চেদির ঠিক দক্ষিণ দিকেই ভীষ্মকের রাজ্য। ভীষ্মকের ছেলে রুক্ষ্মী একটু গোঁয়ার গোছের মানুষ, একটু ক্রোধীও বটে। বাবা বেঁচে থাকা সত্ত্বেও যেমন দুর্যোধনের প্রতাপ বেড়ে গিয়েছিল, ভীষ্মক বেঁচে থাকতেই তেমনি রুক্ষ্মীর প্রভাব বেড়ে গিয়েছিল। রুক্মিণীর বিয়ে মানে, এক বিরাট রাজনৈতিক খেলা। কংসের মৃত্যুকে অবলম্বন করে সারা ভারতবর্ষের মধ্যে যে রাজনৈতিক বিভাগ এসেছিল, রুক্মিণীর বিবাহকে কেন্দ্র করে সেই বিভাগটি যেন পরীক্ষিত হল। কৃষ্ণের ওপর জরাসন্ধের সম্মিলিত বাহিনীর অভিযান আসলে কিন্তু উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওপর পূর্ব-মধ্য ভারতের রাজনৈতিক আধিপত্য পুনঃ স্থাপনের প্রয়াস।
আমি যে মাঝে মাঝে পূর্ব ভারত এবং উত্তর ভারতের দ্বন্দ্বের কথাটা তুলছি তার একটা সুনির্দিষ্ট কারণ আছে। একথা ত নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে। মহাভারতের কবির পূর্ব প্রতিজ্ঞা ছিল, তিনি আর্য ভূখণ্ডে দুই বিবদমান আর্যগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মাধ্যমে মহত্তর পক্ষের ক্রমিক প্রতিষ্ঠা দেখাবেন। কিন্তু তার জন্য তাঁর প্রধান প্রয়োজন ছিল অতিসমৃদ্ধ এবং পূর্ব-প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির অবক্ষয় দেখানো। মহাভারতের রাজসূয় পর্ব (যার ফলে যুধিষ্ঠির একবার কিছুদিনের জন্য রাজা হবার সুযোগ পেয়েছিলেন) এবং ভারত যুদ্ধ-এই দুটিই প্রধানত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ইতিহাস। কিন্তু মহাভারতে যেহেতু কৌরব-পাণ্ডবদের কথাই প্রধান, তাই যেকোন প্রসঙ্গেই তাঁদের কথা এসেছে। কিন্তু এরই মধ্যে পূর্বতন প্রতিষ্ঠিত রাজমণ্ডলের শক্তি এবং ক্ষমতাবৈচিত্র্য যে কতখানি সেদিকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করতে মহাভারতের কবি ভোলেননি। রাজসূয় পর্বে যুধিষ্ঠিরের সামনে কৃষ্ণের বক্তৃতাটি তো এ বিষয়ে প্রথম প্রকাশ্য অধিবেশন। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখবেন, তারও আগের দু-একটি পর্যায়ে মহাভারতের কবি সেইসব রাজশক্তির কথা উল্লেখ করেছেন অত্যন্ত নিপুণভাবে-যে সব রাজারা একান্তই জরাসন্ধের বন্ধু এবং দোসর। একথা ঠিক যে, উত্তর ভারতে কাশ্মীর থেকে আরম্ভ করে গান্ধার, কেকয়, মদ্র, কুরু, কাশী, কোশল–এ সমস্ত দেশের রাজারাই জরাসন্ধের কথায় উঠতেন বসতেন, কিন্তু এরা ছিলেন প্রধানত জরাসন্ধের ভয়ভীত৷ জরাসন্ধের আসল শক্তি ছিল পূর্ব এবং মধ্য ভারত, যেসব দেশের রাজারা ছিলেন জরাসন্ধের সুখদুঃখের সমমর্মী। সমমর্মিতার কথা পরে আসবে, রাজনৈতিক আখের গুছোনোর ব্যাপারে সমসাময়িক বিবাহগুলি নিয়ে আমরা আলোচনা করছিলাম। রুক্মিণীর বিবাহ-বিরেণ একান্তই হরিবংশনির্ভর। এই বিবাহ প্রসঙ্গে রুক্মিণীর স্বয়ংবরে যেসব রাজাদের আমরা জরাসন্ধ-পক্ষে মিলিত হতে দেখব, তাদের আরও কোন পুর্বসম্মেলনী মহাভারতে দেখা যায় কিনা তার একটা চেষ্টা আমাদের করতেই হবে।
পাঠক চলে আসুন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায়। লক্ষ্যবোধের ঠিক পূর্বে দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন সভায় সমাগত রাজবৃন্দের নামগুলি পড়ে পড়ে শোনাচ্ছিলেন। মহাভারতের কেন্দ্রবিন্দু এবং প্রধান প্রতিনায়ক যেহেতু দুর্যোধন, তাই তাঁর কথাই প্রথমে এল, এল তার সাঙ্গোপাঙ্গের কথাও। ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাট রাজার সপুত্র আগমন সংবাদ দিলেন এবং আরও কয়েকজন অবান্তর নৃপতির নামকরণের পরেই ধৃষ্টদ্যুম্ন যাঁদের নাম কীর্তন করলেন তাঁরা হলেন বঙ্গদেশের রাজা এবং যুবরাজ–সমুদ্রসেন পুত্র চন্দ্রসেনঃ প্রতাপবান্। তখনকার বঙ্গকে এখনকার বঙ্গের সঙ্গে মেলালে চলবে না। তখনকার বঙ্গ মানে অখণ্ড বাংলার নদ-নদী সঙ্কুল নীচের দিকটা, উত্তর-পূর্বে যার সীমা প্রায় ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত। ভীম যখন রাজসূয় যজ্ঞের কাজ সারতে পূর্ব দিক জয় করতে গেছিলেন, সেখানে মহাভারতকার লিখেছেন–বঙ্গরাজের রাজ্য আক্রমণ করে তিনি প্রথমে সমুদ্রসেনকে জয় করলেন তারপর চন্দ্রসেনকে আক্রমণ করলেন-সমুদ্রসেনং নির্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম। কাজেই ধৃষ্টদ্যুম্ন আপাতত কোন দেশের নাম না করলেও বেশ বুঝি এরা বঙ্গদেশের রাজা-মহারাজা। ধৃষ্টদ্যুম্নের লিস্টিতে তারপরেই নাম এল জলসন্ধ এবং তার পুত্র দণ্ড এবং বিদণ্ডের। (অন্যমতে দণ্ডধার)। এরা ‘মাগধ’ কিন্তু ঠিক জরাসন্ধের মগধজাত নয়, মনে হয় মগধের ঠিক আশপাশের লোক, তবে রাজা বটেই। এদের পরেই যাঁর নাম শোনাতে হল তিনি বিখ্যাত পৌণ্ড্রক বাসুদেবপুণ্ড্রবর্ধনের রাজা।
মহাভারতের আমলে বঙ্গ, সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত, অঙ্গ (যার খানিকটা আজও রাঢ়ভূমিতে সংলগ্ন) হরিকেল (সিলেট অঞ্চল) এবং পুণ্ড্রবর্ধন-এই সব দেশই ছিল আলাদা। এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিধর রাজা ছিলেন পৌণ্ড্রক বাসুদেব, যিনি কৃষ্ণের সমান ক্ষমতাশালী বলে নিজেকে মনে করতেন। তাঁর উপাধিও ছিল বাসুদেব। রাজসূয় যজ্ঞের আগে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে লম্বা-চওড়া যে বক্তৃতাটি দেন, তাতে পূর্ব ভারতীয় কতকগুলি রাজার নাম করে তাঁদের অসামান্য ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে সতর্ক করে দেন কৃষ্ণ। এই রাজাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পৌণ্ড্রক বাসুদেব, যিনি বঙ্গ-পু-কিরাতেষু রাজা বলসমন্বিতঃ। ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় এবার পৌণ্ড্রক বাসুদেবের নাম পেশ করলেন, উল্লেখ করলেন আসামের রাজা নরকাসুরের প্রতিনিধি এবং ছেলে ভগদত্তের কথাও। তারপর এক নিঃশ্বাসে ‘কলিঙ্গ স্তাম্রলিপ্তশ্চ পত্তনাধিপতি’র প্রসঙ্গ তুলেই বৃষ্ণিবীর এবং অন্যান্যদের কথায় এলেন। একেবারে সবার শেষে যাদের নাম দিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের ‘রাজনামকীর্তন’ শেষ হল তাঁরা হলেন শিশুপালস্ট বিক্রান্তে জরাসন্ধস্তথৈক চ।(৩৪)
ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে দ্রৌপদীর বিবাহসভায় যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের এক বৃহদংশে ছিলেন পূর্ব এবং মধ্যভারতের রাজারা। আবার যখন লক্ষ্যভেদ হচ্ছে সেখানেও দেখা যাবে, একটি বাক্যে যেমন কর্ণ, দুর্যোধন, শা, শল্য, অশ্বত্থামার নাম করা হচ্ছে, তেমনি কলিঙ্গ বঙ্গাধিপপাণ্ড্য পৌভ্রাবিদেহরাজো যবনাধিপশ্চ–এইসব অনার্য রাজাদেরও নাম-পরের মুহূর্তেই করতে হচ্ছে। লক্ষ্যবেধের অনুষ্ঠানে দ্রৌপদী কর্ণকে বরণ করার ব্যাপারে অনীহা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে যিনি আসন ছেড়ে ধনুঃস্পর্শ করলেন তিনি চেদিরাজ শিশুপাল, তারপরেই জরাসন্ধ। হ্যাঁ অৰ্জুনই শেষ পর্যন্ত ধনুর্বেধে সফল হলেন, কিন্তু মহাভারতকারকে সেইসব নরপতির নাম আগে করতে হয়েছে যাঁরা শুধু পূর্বতন নন, যারা তখনকার প্রতিষ্ঠিত রাজকুলের প্রধান। ধনুক তুলতে গিয়ে যখনই তাঁদের জানু বেকে পড়েছে মাটিতে, মহাভারতকার তখনই বুঝিয়েছেন এদের সময় হয়ে গেছে শেষ করবার। অন্য দিকে অর্জুনের সফলতায় পরিষ্কার হয়ে গেছে নবোদিত পাণ্ডবদের বৃদ্ধির আভাস। আগেই হরিবংশের বিকর বক্তৃতায় উল্লেখ করেছি কংসের মৃত্যুর পর নবোদিত মধুরার রাজশক্তি ‘যদুমুখ্যদের কথা। নবোদিত প্রধান হিসেবে কৃষ্ণের সঙ্গে আরেক নবোদিত শক্তি পাণ্ডবদের ‘আঁতাত’ লক্ষ্য করার মত। যাক সে কথা, কেননা আরও লক্ষণীয় বিষয় হল দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় পূর্বমধ্য ভারতের যে রাজশক্তিগুলিকে একত্রিত দেখেছি দ্রৌপদী-বিবাহের আরও অনেক আগে রুক্মিণী স্বয়ংবরে সেই রাজপুরুষদেরই দেখেছি একেবারে যোদ্ধার বেশে। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের সময়ে কৃষ্ণ যেহেতু আরও প্রতিষ্ঠিত তাই দেখছি ধনুর্বেধে ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জরাসন্ধ সভা ছেড়ে আপন রাজ্যে চলে গেছেন–তত উত্থায় রাজা স স্বরাষ্ট্রাণ্যভিজগ্নিবান। রুক্মিণীর বিয়ের সময় কিন্তু তা হয়নি।
কংসের মৃত্যুর পর জরাসন্ধ কৃষ্ণের বিরুদ্ধে অভিযান করেছিলেন, সেই অভিযানে যেসব বিক্ৰান্তনরপতির নাম হরিবংশকার করেছিলেন, সেই সমস্ত নরপতিকেই আবার দেখা যাবে রুক্মিণীর স্বয়ংবর অভিযানে সামিল হতে। হরিবংশের বয়ান মত রুক্মিণীর বিয়ের আগে জরাসন্ধ রীতিমত একটি সভা ডেকে রাজাদের একত্রিত করার চেষ্টা করলেন-নৃপা উদ্যোজয়ামাস। এই সভার প্রথম ‘অ্যাজেন্ডা ছিল–শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়ে। এই বিয়ের ঘটকালি করে তিনি নিজে ভীষ্মকের কাছে শিশুপালের জন্য প্রস্তাব দেন এবং এই প্রস্তাব সমর্থন করেন বাংলাদেশের রাজা মহাবলী পৌীক বাসুদেব-অনুজ্ঞাত পৌণে বাসুদেবেন ধীমতা। জরাসন্ধ সভার দ্বিতীয় ‘অ্যাজেন্ডা নিশ্চয়ই ছিল–যুদ্ধের স্ট্র্যাটিজি’ ঠিক করা, যা কার্যক্ষেত্রেই প্রমাণিত। কৃষ্ণ নিজে যেহেতু রুক্মিণীকে হরণ করার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন, তাই তাঁর দিক থেকে যুদ্ধের ভার পড়েছিল বলরাম এবং সাত্যকির ওপর, অন্যান্য বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজবীরেরা তো ছিলেনই।
মনে রাখতে হবে, বিয়ের আসরে এসে যুদ্ধ ভাল জমে না। হরিবংশকার তাঁর সাধ্যমত-ইনি একে পাঁচটা বাণ মারলেন, উনি ওঁকে আটটি নারাচের আঘাত করলেন–এইরকম করে একটা যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন বটে, কিন্তু মহাভারতে রাজসূয় পর্বাধ্যায়ে কৃষ্ণ বারবার করে যুধিষ্ঠিরকে শুধু জরাসন্ধের ভয়ই দেখিয়েছেন এবং সে ভয় স্বীকার করতে তাঁর একটুও লজ্জা হয়নি। পরিশেষে, কৃষ্ণ দুঃখ করে যে কথাটি বলেছেন তার ভাবটি এইরকম বড় আশা করে ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণীকে বিয়ে করেছিলুম দাদা! ভেবেছিলুম তাতে করে অন্তত জরাসন্ধপক্ষীয় একটি মহাশত্রু আমার পক্ষে আসবে, কিন্তু তা আর হল না, দাদা। কৃষ্ণ আরও বললেন–ভীষ্মক আমার আত্মীয়, আমরা সবসময় তাঁর প্রিয় সাধন করার চেষ্টা করি এবং বিনীতভাবে তার অনুগতও থাকি প্রিয়ান্যাচরতঃ প্রান সদা সম্বন্ধিনস্ততঃ। কিন্তু তবু তিনি মগধের রাজা জরাসন্ধেরই ভক্ত-স ভক্তঃ মাগধং রাজা ভীষ্মকঃ পরবীরহা। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা তাঁর ভজনা করলেও তিনি আমাদের ভজনা করেন না। বরঞ্চ আমরা যা চাই না, তাই তিনি করে বেড়ান-ভজতো ন ভজত্যম্মান অপ্রিয়েষু ব্যবস্থিতঃ। জরাসন্ধের কীর্তিকলাপে তিনি এতই মুগ্ধ যে তিনি নিজের কুল, বল, মান সব জলাঞ্জলি দিয়ে জরাসন্ধেরই শরণ নিয়েছেন-এ কুলং ন বলং রাজন্ অভ্যজানাৎ তথাত্মনঃ। পশ্যমানো যশো দীপ্তং জরাসন্ধমুপস্থিতঃ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, রুক্মিণীকে বিয়ে করার ফলে ভীষ্মক তো কৃষ্ণের হাতের মুঠোয় এলেনই না বরঞ্চ ভীষ্মকের বাগদত্তা রুক্মিণীকে বিয়ে না করতে পেরে শিশুপাল এবং তৎপক্ষীয় সমস্ত রাজারাই দ্বিগুণ ক্ষেপে রইলেন। এ দুঃখ মরবার আগে পর্যন্ত ভুলতে পারেননি শিশুপাল। মহাভারতের রাজসূয় যজ্ঞের সমাপ্তিতে শিশুপাল এমনভাবেই কৃষ্ণকে তিরস্কার করেছেন, যাতে পরিষ্কার মনে হবে রুক্মিণী ছিলেন তাঁরই জন্য নির্ধারিত বধূটি। একে এই অপমান, তার ওপরে কৃষ্ণেরই সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়ের মত নুনের ছিটে–এ সব কিছুই ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বাড়িয়েই তুলল, কমাল না।
পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের আগে কৃষ্ণের মুখে জরাসন্ধ সম্বন্ধে একাধিকবার যে ভীতি এবং উৎকণ্ঠা ধ্বনিত হয়েছে, তা যে একেবারেই অমূলক নয়–তার প্রমাণ পাণ্ডবদের রাজসূয় পর্যন্ত কৃষ্ণ যা কিছুই করেছেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল জরাসন্ধের শক্তি কমানো। পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগও মূলত জরাসন্ধের কারণেই। রাজসূয়ের আগে যুধিষ্ঠিরের কাছে যে বক্তৃতাটি কৃষ্ণ দেন, তাতে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, মধ্য-পূর্ব ভারতের যৌথ সমরসজ্জার বিরুদ্ধে যদি কোন ফল পেতে হয় তাহলে জরাসন্ধকে সরাতে হবে আগে। তাঁর অতিমিত সুসার বক্তৃতার মধ্যে কৃষ্ণ দেখিয়েছেন তাঁর মূল লক্ষ্যে পৌঁছোতে আর কতটুকু বাকি, কি কি কাজ তিনি এর মধ্যেই করেছেন এবং কোন কোন কাজে তিনি পাণ্ডবদের মদত চান। কৃষ্ণ জানিয়েছেন, হংস-ডিম্ভক নামে যে দুই বিখ্যাত নরপতি জরাসন্ধের মিত্রপক্ষে ছিলেন তাঁদের একজন মারা পড়েন বলরামের হাতে, অন্যজন তাঁরই শোকে ‘সুইসাইড করেন। এই দুজনের মৃত্যুর খবর শুনে জরাসন্ধ শূন্যমনে আপন পুরীতে প্রবেশ করেন–পুরং শূন্যেন মনসা প্রযৌ। কৃষ্ণ ভেবেছিলেন এইভাবে আর দু-চারটি শক্তিশালী নরপতিকে যদি জরাসন্ধের কক্ষচ্যুত করা যায় তাহলে জরাসন্ধ আরও শক্তিহীন হয়ে পড়বে এবং তাঁর মনোবলও ভেঙে যাবে। ঠিক এই জন্যেই তিনি প্রাগজ্যোতিষপুর মানে আসামে অভিযান চালান। প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা তখন ছিলেন নরক এবং এরই প্রত্যন্ত দেশের রাজা ছিলেন মুরু। মহাভারত এবং পুরাণে মুরু দৈত্য বলে পরিচিত, নরক ‘অসুর বলে। তাঁদের এই দৈত্য এবং ‘অসুর’ উপাধি হয়তো শুধুমাত্র অনার্য অধ্যষিত প্রত্যন্ত পূর্ব ভারতের রাজা বলেই এবং হয়তো বা শক্তিমত্তার উপাধিও বটে। নরক জরাসন্ধের মিত্রপক্ষে ছিলেন বহুকাল ধরেই এবং তিনি এত শক্তিশালী ছিলেন যে আর্যদের ধনসম্পত্তি লুঠতরাজ করতেন মাঝে মাঝেই, আর্যদের সুন্দরী সুন্দরী রমণীরাও এই লুঠের আওতা থেকে বাদ যেত না। হরিবংশে এবং বিষ্ণুপুরাণে দেখি শতাধিক ষোল হাজার রমণী নরকাসুরের অন্তঃপুরে মণিপর্বতের গুহায় লুকানো ছিল এবং এদের বেশির ভাগই ছিল দেবমণী। এ ছাড়াও বরুণদেবের বিখ্যাত ছাতাটি, খোদ দেবমাতা অদিতির মকর-মাক কানপাশা দুটি এ সবই নরকাসুরের লুণ্ঠিত সামগ্রীর কিছু কিছু। কৃষ্ণ যে নরকাসুর এবং মুরুকে মেরে ফেলেছিলেন, তাতে জরাসন্ধের শক্তিহীনতা ছাড়াও, তার উপরি পাওনা হয়েছিল নরকাসুরের লুষ্ঠিত সামগ্রীগুলি। পাঠক মনে রাখবেন–জরাসন্ধের ভয়ে ভীত কৃষ্ণ তখন সদ্য সদ্য দ্বারকাপুরী নির্মাণ করিয়েছেন। একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না, যদি বলি–শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকার অর্ধেক সাজ-সজ্জাই পূর্বভারতের দৌলতে, এমনকি তাঁর ষোল হাজার মহিষীর সবগুলিই প্রায় আমাদের পাড়ার। সেকালে অঙ্গবঙ্গ কলিঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন, সুক্ষ্ম, মগধ এবং কামরূপ এদের একটির সঙ্গে আরেকটি যেমন ঐতিহাসিক মিল ছিল তেমনি মিল ছিল সামাজিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনায়। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের রাজ্যসীমা ছিল উত্তরবঙ্গের প্রান্তে করতোয়া পর্যন্ত। ঠিক তার পাশেই কামরূপ রাজত্ব করতেন তাঁরই অভিন্নহৃদয় বন্ধু নরকাসুর (নরক রাজার অসুর উপাধিটি উত্তর ভারতীয়দের বরে)। আসামে আসবার পর কৃষ্ণের প্রথম কাজ যদি হয়ে থাকে নরকাসুরকে বধ করা, তাহলে তাঁর দ্বিতীয় কাজই ছিল নরকাসুরের সংগৃহীত সমস্ত বহুমূল্য সামগ্রী দ্বারকায় নিয়ে যাওয়া। পরাজিত রাজার সমস্ত ধন-সম্পদ বিজেতা রাজা লুণ্ঠন করেন, এই নিয়ম। কিন্তু লুণ্ঠনের এত সামগ্রী, এত বৈচিত্র্যের কথা বোধ হয় আর কোথাও নেই, যতখানি পাওয়া যায় আমাদের এই প্রতিবেশীর রাজ্য লুণ্ঠনে। হরিবংশের জবানীতে দেখি, নরকাসুরের কোষরক্ষকেরা সব কিছু, এমনকি অন্তঃপুরের রমণীদের পর্যন্ত হতশ্রী করে সমস্ত রত্ন কৃষ্ণের সামনে বিছিয়ে দিয়ে বলেছিল–যা আপনার অভিরুচি, তাবতীঃ পয়িষ্যামো বৃষ্ণন্ধকনিবেশনে-সব পাঠিয়ে দেব দ্বারকায়। প্রথমদিকে শ্রীকৃষ্ণ, অনেক জিনিসই যেন ‘ডুপ্লিকেট’ হয়ে যাচ্ছে, এমন একটি ভাব দেখিয়ে রত্নগুলি পরীক্ষা করতে লাগলেন–পরিগৃহ্য পরীক্ষা চ। পরিশেষে সর্বম আহরয়ামাস দানবৈ দ্বারকাং পুরী। দ্বারকাপুরী তখন কেবল তৈরি হয়েছে, কাজেই নরকাসুরের ধনরত্নে আপন রাজধানীর অন্তঃসজ্জার পরিকল্পনাটি মনে মনে ছকে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ঢুকলেন মণিপর্বতে। এই পর্বতেই নাকি নরকাসুর লুকিয়ে রেখেছিলেন মোল হাজার রমণী-মণি, যাদের তিনি ধরে এনেছিলেন দেবতা আর গন্ধর্বদের কাছ থেকে (উত্তরভারত থেকে নয়তো?) কৃষ্ণ তাঁদের বিয়ে করার জন্য সম্পূর্ণ পর্বতটি ধরে উঠিয়ে নিলেন গরুড়বাহনে। কৃষ্ণের সঙ্গে পরে বিয়ে হবে বলে হরিবংশকার এই রমণীদের–দেব-গন্ধর্ব কন্যা, ব্ৰত-উপবাসে তঙ্গী তথা কুমারী করে রেখেছেন এবং প্রতিবেশী রাজার চরিত্র রক্ষার্থে আমরাও তাই বিশ্বাস করতে ভালবাসি।
এইসব রমণী চরিত্রের কথা পরে আসবে। এমন কি দ্বারকার সাজসজ্জার কথাও থাক। নরকাসুরের পরে এবং রাজসূয় যজ্ঞের আগে কৃষ্ণ আর যাকে নিকেশ করলেন, তিনি হলেন কালযবন। আমরা এর কথা একবার আগে বলেছি। বলেছি যে, আমাদের সন্দেহ হয়–যদুকুলের ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ গর্গের (গার্গের) ঔরসে গোপালিকার গর্ভে জাত কালযবন কৃষ্ণের জ্ঞাতিগুষ্ঠিরই কেউ হবেন। জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গর্গ তাকে সঁপে দেন অপুত্রক এক যবন রাজার হাতে। কালযবন তাই যবনদেশেরই অধিপতি। ইনি কোন দেশের রাজা ছিলেন বলা কঠিন, তবে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম প্রত্যন্ত দেশগুলিতে যবনদের আধিপত্য ছিল, এ কথা ঐতিহাসিকেরাও স্বীকার করেন।(৩৬) সেই দৃষ্টিতে কালযবন ওইরকম কোন দেশের রাজা ছিলেন হয়তো। কিন্তু যে দেশেরই রাজা তিনি হোন না কেন, তিনি মহারাজ জরাসন্ধের বিক্রম-মুগ্ধ ছিলেন। হরিবংশ কিংবা বিষ্ণুপুরাণ থেকে বেশ বোঝা যায় জরাসন্ধের সঙ্গে কালযবনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল না, জরাসন্ধের সম্মিলিত বাহিনীতেও তাকে দেখা যায়নি।
যে সময়টা জরাসন্ধ বারবার মথুরা আক্রমণ করেও কৃষ্ণকে প্রতিহত করতে পারছিলেন না, সেই সময়েই যখন রুক্মিণী স্বয়ংবরের কথা উঠল তখন সমবেত বিবাহ-সভায় অনেকেই কৃষ্ণের শক্তিমত্তার কথা ভেবে যুদ্ধ-বিগ্রহের বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন। স্বয়ং জরাসন্ধও তার বশংবদ রাজমণ্ডলীকে পরীক্ষা করার জন্যই হোক কিংবা অন্য কোন কারণে বিবাহ-সভায় যুদ্ধের সম্ভাবনা তিনি পছন্দ করলেন না, উপরন্তু কৃষ্ণের সম্বন্ধে একটু ভয়ও দেখালেন। আসল কথা রুক্মিণী পিতা ভীষ্মক হয়তো কৃষ্ণের সঙ্গে আপোষে রাজি ছিলেন, কিন্তু তিনি তাঁর ছেলে রুক্মীকে কোনমতেই স্বমতে আনতে পারছিলেন না। প্রধানত এই রুক্ষ্মীর কৃষ্ণ-বিরোধিতার সুযোগেই সৌভপতি শা, জরাসন্ধের কাছে প্রস্তাব করে বসলেন যে, যবন রাজা কালযবনকে দিয়ে কৃষ্ণকে কিঞ্চিৎ শিক্ষা দেওয়া দরকার।(৩৭) শাল্ব ছিলেন দ্বারকার কাছাকাছি আনৰ্ত্তদেশের রাজা এবং জরাসন্ধের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু তিনি কালযবনের কথা তুললে পরে জরাসন্ধ যে খুব সন্তুষ্ট হলেন, তা মোটেই নয়। তিনি নিজে যে কৃষ্ণকে যথেষ্ট শিক্ষা দিতে পারেননিএ অপমান তো সবসময়ই তাঁকে দগ্ধ করছিল, তার ওপরে শাধের মুখে কালযবনের প্রতিভার কথা শুনে তিনি বড়ই বিমনা বোধ করলেন-বভূব বিমনা রাজন। হরিবংশকার পূর্বে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশবাণী ঘোষণা করেছিলেন যে, কৃষ্ণের হাতে জরাসন্ধের মৃত্যু হবে। শাম্বের কালযাবনিক প্রস্তাবের পর সেই আকাশবাণী স্মরণ করেই নাকি তিনি বিমনা হলেন–এটি হরিবংশের মত। কিন্তু এর পরেই জরাসন্ধের বক্তব্য শুনলে বেশ বোঝা যায় যে, তাঁকে কেউ করুণা করছে-এ তিনি সহ্যই করতে পারছেন না। তিনি বললেন–আগে কোন রাজা অন্য রাজার হাতে মার খেলে আমার শরণাপন্ন হত এবং আমার সাহায্যেই তারা আবার তাদের হৃত রাজ্য, বন্দী সেনাবাহিনী–সব ফিরে পেত–
মাং সমাশ্ৰিত্য পূর্বস্মিন নৃপা নৃপভয়ার্দিতাঃ।
প্রাপ্তবন্তি হৃতং রাজ্যং সভৃত্য বলবাহনম্ ॥
আর আজকে। আজকে সেই সব রাজারাই, যাদের এককালে আমি সাহায্য করেছি–সেই সব রাজারাই আমাকে অন্যের আশ্রয় নেবার জন্য পাঠাচ্ছে ছেনাল মেয়েছেলে যেমন নিজের স্বামীর ওপর রাগ করে অন্য পুরুষের ঘরে যায়, আপনারা তো তাই করছেন–কনন্যব স্বপতিদ্বেষাদন্যং রতিপরায়ণাঃ। আমি কি কৃষ্ণের ভয়ে আমার চেয়ে বেশি বলশালী রাজার আশ্রয় নিতে যাচ্ছি না? নিশ্চয়ই আমি একেবারে নিরুপায়, নইলে আমার মত লোককে অন্যের আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়নং যোগবিহীনোহং কারয়িষষ্য পরাশ্রয়–এর থেকে আমার মরা ভাল। আমি কিছুতেই আমার উদ্ধারের জন্য অন্য কাউকে সাধতে যাব নাম চান্যং সংশ্রয়ে নৃপাঃ। কৃষ্ণ হোক, বলরাম হোক কিংবা যে কেউ, আমার গায়ে যে হাত তুলবে তার সঙ্গে আমিই সামনাসামনি যুদ্ধ করব কৃষ্ণো বা বলদেবো বা যো বাসৌ বা নরাধিপঃ। হন্তারং প্রতিযোৎস্যামি….। (৩৮)
বেশ বুঝি, কালযবনের সঙ্গে জরাসন্ধের নিজস্ব যোগাযোগ ছিল না, কেননা প্রধানত পূর্বমধ্য ভারতের রাজারাই তাঁর হাত শক্ত করেছিলেন। উত্তর পশ্চিমের রাজারা তাঁর বিক্রম-মুগ্ধ ছিলেন, বশংবদও ছিলেন কিংবা ভীতও ছিলেন কিন্তু তাঁরা তার মনের কথা বুঝতেন না, যেমনটি বুঝতেন পৌড্রক বাসুদেব কিংবা শিশুপাল। কিন্তু তখনকার রাজনীতির ক্ষেত্রে যেহেতু কংস মারা গেছে এবং কৃষ্ণের অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেখানে তার পশ্চিমী বন্ধু শাধের কথা শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হল। রাজারা অনেক বিনয় করে জরাসন্ধকে বোঝালেন যে, শাই কালযবনের কাছে দূত হয়ে যাবেন এবং যা বলার তিনিই বলবেন, জরাসন্ধকে কিছুই ভাবতে হবে না।
আসলে শাল্বের সঙ্গেই কালযবনের বেশি যোগাযোগ ছিল, কিন্তু সে যুগে জরাসন্ধকে কেউ চিনত না বা ভয় পেত না–এটা ছিল অসম্ভব। কাজেই সেদিক দিয়ে শাম্বের সুবিধেই হয়ে গেল, কারণ তিনি পশ্চিমের মানুষ আর কালযবন উত্তর পশ্চিমের। জরাসন্ধও শেষ পর্যন্ত শান্বকে বললেন তিনি যেন এমন নীতি প্রয়োগ করেন যাতে যবনরাজ কৃষ্ণকে আক্রমণ করেন এবং কৃষ্ণকে জয় করেন–বনেন্দ্রঃ যথা যাতি যথা কৃষ্ণং বিজেষ্যতি। জরাসন্ধ যেহেতু শিশুপালকেই ভীষ্মককন্যা রুক্মিণীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাই তাঁরা চাইলেন রুক্মিণীর স্বয়ংবরের আগেই যাতে কৃষ্ণকে এই ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। সম্মুখ যুদ্ধের ইচ্ছে থাকলেও মথুরাবাসীদের সঙ্গে কালযবনের চিরন্তন শত্রুতা স্মরণ করে জরাসন্ধ আপাতত তাঁর পরাক্রমমুগ্ধ কালঘবনের সাহায্যই বেছে নিলেন। শান্ধ জরাসন্ধের বার্তা নিয়ে কালযবনের কাছে পৌঁছোলেন। যবন রাজা, যিনি সেকালের আর্যনৃপতির অনেক দুর্লভ গুণও অতিক্রম করেছিলেন বলে হরিবংশ বলেছে, তিনি শাম্বের সঙ্গে রীতিমত ‘্যান্ডসেক করে–স হস্তালিঙ্গনং কৃত্বা, সিংহাসনে বসিয়ে বললেন–ইন্দ্রকে আশ্রয় করে যেমন দেবতারা নিরুদ্বেগ, জরাসন্ধকে আশ্রয় করে আমরাও তেমনি। সেই মহারাজ জরাসন্ধের পক্ষে কোন্ কাজটি এমন অসাধ্য হল, যে তিনি আমার মত লোকের কাছে আপনাকে পাঠিয়েছেন–কিমসাধ্যং ভবেদস্য যেনাসি প্রেষিতো ময়ি। শান্ধ বললেন এবং কালযবনকে একেবারে মাথায় তুলে দিয়েই জরাসন্ধের বার্তা শোনালেন। কাজও হল। জরাসন্ধ তাঁর সাহায্য চাইছেন, এতেই কাল্যবন এত সম্মানিত বোধ করলেন যে তিনি সেই দিনই কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করলেন।
কালযবন ছিলেন যবন রাজা এবং স্বভাবতই আর্যদের সঙ্গে তাঁর ভাল বনত না। কৃষ্ণ তাঁকে মেরে ফেলেন এক অভিনব কৌশলে। মজা হল, কালযবন কিংবা জরাসন্ধ এদের কারও বিরুদ্ধে কৃষ্ণ সম্মুখ যুদ্ধে সেনাবাহিনী নিয়ে লড়বার সাহস করেননি। হরিবংশের বয়ান অনুযায়ী কৃষ্ণ একসময় কালযবনকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। একটি ভয়ঙ্কর কেউটে সাপ কলসীর মধ্যে পুরে দুতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন কালযবনের কাছে। তাঁর ইঙ্গিত ছিল–কেউটে সাপের সমান বাসুদেব কৃষ্ণের পেছনে লাগবার চেষ্টা কর নাকালসর্পসমঃ কৃষ্ণ ইত্যুকৃত্বা ভরতষভ। কালযবন সব বুঝলেন এবং এও বুঝলেন–এই ফিকিরে যাদবরা তাঁকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে-যাদবৈঃ ত্ৰাসনং কৃতম। উত্তরে তিনি করলেন কি-শতসহস্র বন্য পিঁপড়ে সেই কলসীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন। সেই পিঁপড়েগুলি যখন জ্যান্ত কালসাপটিকে একটু একটু করে খেয়ে কতগুলি গুড়োর মত বস্তু অবশিষ্ট রাখল–ভক্ষ্যমানঃ কিলাঙ্গেযু-তখন সেই কলসীর মুখ আবার বন্ধ করে কাল্যবন কৃষ্ণের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন–তাঁর বিশাল সৈন্যবাহিনীর জোরে কৃষ্ণের মত কেউটে সাপ গুঁড়ো হয়ে যাবে।(৩৯)
কৃষ্ণের মনে আবার ভয় ধরল, তিনি বুঝলেন তাঁর কৌশল ব্যর্থ হয়েছে-যোগং বিহতম। মহাভারতে দেখি, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলছেন যে, তিনি জরাসন্ধের ভয়ে কুশস্থলীতে পালিয়েছিলেন। দু-চার কথার পরে তিনি আবার বলছেন–এখন আমি দ্বারকায় পালিয়ে গেছি জরাসন্ধের ভয়ে-বয়ঞ্চৈব মহারাজ জরাসন্ধভয়াত্ তদা। মথুরাং সম্পরিত্যজ্য গতা দ্বারাবতীং পুরী। হরিবংশে কিন্তু দেখছি–যখন কৃষ্ণের কেউটে সাপের চাল ব্যর্থ হল এবং যখন তিনি বুঝলেন যে কালযবন পিঁপড়ে দিয়ে সাপ খাইয়ে তাঁর অশেষ সৈন্যবাহিনীর ইঙ্গিত করেছেন, তখনই কৃষ্ণ মথুরা ত্যাগ করে দ্বারকায় পালালেন–উৎসৃজ্য মথুরামাশু দ্বারকামভিজগিবান্। দ্বারুকায় সমস্ত যাদবদের রেখে এসে তিনি একা ফিরে এলেন মথুরায় এবং কৌশলে কালযবনকে বধ করলেন। হতে পারে মুখ্যত জরাসন্ধের ভয়েই তিনি দ্বারকায় পালিয়েছিলেন কিন্তু কালযবনের সৈন্যবাহিনীর ভয় তাঁর এই পলায়ন ত্বরান্বিত করেছিল।
তাহলে হংস-ডিম্ভক গেল, মুরু-নরক গেল, কালযবনও গেল। এদের সবাইকে শেষ করে জরাসন্ধ বধের জন্য, তিনি পাণ্ডবদের মদত চাইতে এসেছেন। কেননা এইটেই জরাসন্ধ বধের প্রকৃষ্ট সময়-পতিতৌ হংস ডিকৌ কংসশ্চ সগো হতঃ। জরাসন্ধস্য নিধনে কালোহয়ং সমুপাগতঃ। আমার ধারণা হংস-ডিম্ভক কিংবা মুরু-নরক-এরা যতখানি জরাসন্ধের বন্ধু ছিলেন, তার থেকেও বেশি কংসের বন্ধু ছিলেন। কাজেই এদের বধ করে তিনি কংসবন্ধুদের জরাসন্ধের দল ভারী করার সুযোগ নষ্ট করছিলেন। কালযবনের সঙ্গে যুদ্ধে যাবার আগে কৃষ্ণ যাদবদের বলেছিলেন-জরাসন্ধ আমাদের কোনদিন ক্ষমা করেননি এবং তিনি সদলবলে বৃষ্ণি রাজমণ্ডলের কষ্ট বাড়িয়ে তুলেছেন। কংসবধের ফলে অনেকেই আমাদের দল ত্যাগ করে জরাসন্ধকে আশ্রয় করেছে–কেচিৎ কংসবধাচ্চাপি বিরক্তাগতা নৃপাঃ।(৪০) অতএব জরাসন্ধই এখন প্রধান লক্ষ্য। মহাভারতে কৃষ্ণের বক্তৃতাটির ওপর টীকা করতে গিয়ে নীলকণ্ঠ বলেছেন–সব রাজাকে জয় করেই তবে না রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন হয়। আর সব রাজাই যেহেতু এদিক-ওদিক করে জরাসন্ধকেই আশ্রয় করে আছে, অতএব পালের গোদাটিকে, মানে জরাসন্ধকে মারলেই সব রাজাকে জয় করা হবে-রাজজয়শ্চ প্রধান-মল্ল-নির্বহন-ন্যায়েন জরাসন্ধবধেনৈব জীয়তে। হলও তাই। কিন্তু একটি রণভেরীর শব্দও শোনা গেল না, শোনা গেল না শত-সৈন্যের পায়ে চলা কিল-কিলা শব্দ। সন্ধ্যার আলো-আঁধারে স্নাতক-বেশী তিনটি ব্রাহ্মণ সোজাপথে নগরদ্বার দিয়ে না ঢুকে চৈত্যক পর্বতের শৃঙ্গ ভেঙে সেখান দিয়ে ঢুকলেন জরাসন্ধের বাড়ির মধ্যে। তারপরের কাহিনী সবারই জানা। রাজা হিসেবে জরাসন্ধের সেই মর্যাদাবোধ এবং সমতাবোধ ছিল, যার জন্য দ্বন্দ্বযুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তিনি কৃষ্ণ কিংবা অর্জুনের মত একটি লোককে বেছে নেননি এবং জরাসন্ধের এই মূল্যবোধ কৃষ্ণের আগে থেকেই জানা ছিল। জরাসন্ধ ভীমের হাতে প্রায় অন্যায়ভাবেই মারা পড়লেন এবং পূর্ব এবং মধ্য ভারতের মিত্রশক্তির যৌথ পতন ঘটল, মগধের রাজবাড়িতে ইন্দ্রপতনের সঙ্গে সঙ্গেই। রাজসূয় যজ্ঞ বিনা বাধায় সম্পন্ন হল। কৃষ্ণ শুধু বুদ্ধির জোরেই জিতে গেলেন এবং এ রাজসূয় যজ্ঞে পাণ্ডবদের নয়, কৃষ্ণেরই জিত হল।
রাজনীতির মধ্যেও সাধারণের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হয় এবং সে মনস্তত্ত্ব কৃষ্ণের বুদ্ধিতে পাণ্ডবেরাও যে বুঝতে পেরেছিলেন তার পরিচয় আছে রাজসূয় যজ্ঞের দিগবিজয় অভিযানের ‘স্ট্র্যাটিজি’তে। উল্লেখ্য, রাজসূয় দিগবিজয়ে পূর্ব দিকটি জয় করতে পাঠানো হয়েছিল সেই ভীমকেই, যে ভীম জরাসন্ধ বধের জন্য সারা ভারতবর্ষে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া পূর্বদিকের রাজারা, যাঁদের মধ্যে শিশুপাল, পৌণ্ড্রক বাসুদেবের মত সাংঘাতিক সাংঘাতিক যুদ্ধবীরেরা ছিলেন, তাঁরা যে ভীমকে ভালবেসে চুমো খেয়ে পূজোপহার বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা নয়, আপাতত তাঁদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল, জরাসন্ধ মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলে।
রাজসূয় যজ্ঞের সময় থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত সময় হল চোদ্দ বছর-বার বছর পাণ্ডবদের বনবাস, এক বছর অজ্ঞাতবাস এবং এক বছর সন্ধিপ্রস্তাবের উতোরচাপান। কংস, হংস-ডিম্ভক, মুরু-নরক এবং অবশেষে জরাসন্ধ–এরা মারা যাবার ফলে যেমন রাজসূয় যজ্ঞে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা বেড়ে গিয়েছিল, তেমনি উত্তর রাজসূয়পর্বে একজন উত্তর ভারতীয় রাজা হিসেবে কুরুরাজ দুর্যোধনের সম্ভাবনাও বেড়ে গিয়েছিল। এর সবচেয়ে বড় কারণ জরাসন্ধ তখন নেই এবং চেদিরাজ শিশুপালও মারা গেলেন রাজয়ের সমাপ্তি অনুষ্ঠানেই। চেদিরাজ শিশুপাল জরাসন্ধের পোষ্য-পুত্রের মত ছিলেন–জরাসন্ধস্তু সুতব দদর্শৈনং জুগোপ চ।(৪১) জরাসন্ধের মৃত্যু তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারলেন না। যার জন্য রাজসূয় যজ্ঞের সভাস্থলেই তিনি কৃষ্ণকে এলোপাথাড়ি গালাগালি দিতে থাকলেন, মা বাপ-বৌ তোলাও বাদ গেল না। সদ্য দিগবিজয়ী পাণ্ডবেরা তখনও সভাতেই আছেন এবং কৃষ্ণের ব্যাপারে কোন নিন্দাও তাঁরা সহ্য করছিলেন না, তাই কৃষ্ণ নিজেই আক্রমণ করলেন শিশুপালকে এবং শিশুপাল বেঘোরে প্রাণ দিলেন। কিন্তু তাতে লাভ কি হল? পাণ্ডবরা আর কদিন? পাশাখেলা-টেলার দৃষ্টান্ত ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে বোঝানো সম্ভব নয়, তবে এটা জানি-যিনি পাণ্ডবদের যশ অতি সহজে ম্লান করে দিলেন, সেই দুর্যোধন কিন্তু এককালে জরাসন্ধেরই অনুগামী ছিলেন এবং একথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। কাজেই জরাসন্ধ মরিয়াও প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই, যদিও এতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পূর্ব ভারতের নেতৃত্বটি হাত বদল হয়ে চলে গেল উত্তর ভারতের হাতে। জরাসন্ধ, শিশুপালের অকাল অন্তর্ধানে একেবারে যাকে বলে, মাটি খুঁড়ে গজিয়ে উঠলেন দুর্যোধন। কৃষ্ণপক্ষীয় পাণ্ডবেরা একবারমাত্র রাজসূয় যজ্ঞে ঝলসে উঠতেই তাদের বনবাস দিতে দেরি হয়নি দুর্যোধনের, এবং তার কারণ একটাই–ততদিনে জরাসন্ধের মিত্রপক্ষকে সম্পূর্ণ হাতে পেয়ে গেছেন দুর্যোধন। খেয়াল করে দেখবেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্রবর্ধন, প্রাগজ্যোতিষপুর–এই সব দেশের রাজারাই কিন্তু যোগ দিয়েছিলেন দুর্যোধনের পক্ষে। কিন্তু মজা হল, এসব দেশেও যাঁরা প্রবল পরাক্রমী দুর্দম রাজা ছিলেন–যেমন ধরুন পৌণ্ড্রক বাসুদেব, তাঁকে কিন্তু কৃষ্ণই হত্যা করেছেন এবং তা অবশ্যই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে। না হলে তিনি যে ধরনের এবং যে মর্যাদার মানুষ, তাতে ভারতযুদ্ধে তাঁর নাম অন্তত একবারের তরেও শোনা যেত।
আগেই বলেছি, জরাসন্ধের জামাই কংস যখন কৃষ্ণের হাতে মারা যান তখন জরাসন্ধের বাহিনী মথুরা আক্রমণ করলে বঙ্গ-পুণ্ড্রবর্ধনের রাজারা বন্ধুত্বের খাতিরে জরাসন্ধের অ্যালায়েড় আর্মিতে যোগদান করেছিলেন। অনেক বিশেষণহীন রাজার মধ্যে হরিবংশ পৌণ্ড্র বাসুদেবকে বড় সম্মান দিয়ে উল্লেখ করেছে–পৌকো বলিনাং বরঃ-বলবানদের মধ্যে তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ। মনে রাখা দরকার তখনকার দিনের হস্তিনাপুর এখনকার দিল্লির মত; কিন্তু তখনকার মগধ এখনকার মগধের মত হস্তিনাপুরের ধামাধরা ছিল না। বরঞ্চ আর্য সমাজের প্রধান প্রতিভূ কুরুবীর দুর্যোধনও জরাসন্ধের সম্মিলিত বাহিনীতে যোগ দিয়ে সম্মানিত বোধ করেছিলেন। হরিবংশের লিস্টিতে হাজারো রাজনামের গড্ডলিকাপ্রবাহে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের ক্ষীণধারাটি যেমন করে মিশেছে, তাতে স্পষ্ট বুঝি, দুর্যোধনের আহা মরি কোন মর্যাদা ছিল না এবং পাণ্ডবদের কোন নামই তখন শোনা যায় না! জরাসন্ধের পৌনঃপুনিক আক্রমণে মথুরাপুরী যখন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে এবং কৃষ্ণ যখন দ্বারকার আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন ঠিক তখুনি জরাসন্ধ শিশুপালের সঙ্গে বিদর্ভরাজ, ভীষ্মকের মেয়ে রুক্মিণীর বিয়ে ঠিক করে তিনি নিজেই বরকতার মত সবাইকে সংবাদ পাঠালেন। জরাসন্ধ যখন বর নিয়ে বিদর্ভের বিবাহবাসরে পৌঁছেছেন তখনও বোধহয় তাঁর সংশয় ছিল-কাজটা ঠিক হল তো? ঠিক এই সময়ে জরাসন্ধের দোলাচল মনের স্থিরতা নিয়ে আসলেন সেই বাঙালী রাজা পৌণ্ড্র বাসুদেব। হরিবংশ চলছে–অনুজ্ঞাতশ্চ পৌণে বাসুদেবেন–ধীমতা–পুন্ড্রবর্ধনের রাজা বুদ্ধিমান বাসুদেব জরাসন্ধের এই কাজ সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন। সমর্থনের ব্যাপারে অন্য কোন রাজার নাম যেহেতু এখানে আসেনি তাতে বুঝি বাংলার এই রাজা কত শক্তিশালী ছিলেন এবং একমাত্র তাঁরই অনুমোদন কত জরুরী ছিল জরাসন্ধের পক্ষে। হরিবংশ অবশ্য মহাভারতের মত না মেনে, বলেছেন তখনকার বঙ্গ ছিল জরাসন্ধেরই অধিকারে-অঙ্গবঙ্গকলিঙ্গানাম্ ঈশ্বরঃ স মহাবলঃ। মহাভারত কিন্তু বলেছে পৌণ্ড্রক ছিলেন বঙ্গ, পুণ্ড্র এবং কিরাত দেশের রাজা-বঙ্গপুণ্ডকিরাতেষু রাজা বলসমম্বিতঃ। পৌকো বাসুদেবেতি যো’সৌ লোকে’ভিবিতঃ ॥ অবশ্য বঙ্গের রাজা জরাসন্ধই হোন আর পৌণ্ড্রক বাসুদেবই হোন, সমগ্র উত্তর তথা পশ্চিম ভারত এদের দুজনকেই যমের মত ভয় পেত। এগারো অধ্যায় জুড়ে হরিবংশের বর্ণনা পড়ে বারবার মনে হয়েছে বাসুদেব নামটি ছিল সেকালের এক অতি সম্মানীয় উপাধি। বহুযুদ্ধ এবং বহুদ্ধির নায়ক কৃষ্ণ যেমন এই উপাধি গ্রহণ করেছিলেন, তেমনি তিনি বেঁচে থাকতে নগণ্য বাংলার পুভরাজা এই বাসুদেব’ উপাধিতেই ভূষিত হবেন, এ তাঁর সহ্য হয়নি। অন্যদিকে দ্বারকার সেই মদমত্তগোপাল বাসুদেব’ নাম ধারণ করায় কৃষ্ণের সমতুল্য শঙ্খ-চক্র ধনুগদা সবই পৌড়ক তৈরি করেছিলেন।
দুই শক্তিশালী প্রতিবেশী-মগধের জরাসন্ধ এবং প্রাগ জ্যোতিষপুরের নরকাসুর মারা যাওয়ায় সাময়িকভাবে বাংলার রাজা পৌণ্ড্রক বাসুদেবের পক্ষে যুদ্ধ করার কোন মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। কিন্তু বন্ধুহানির প্রতিশোধ নিতে তিনি নিজেই এক সময় লাখো সৈন্য নিয়ে ছুটলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণ জানতেন পৌকের পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব নয় এবং তিনি এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। বৃষ্ণি-যাদবদের আপন দুর্গে গিয়ে দুর-প্রবাসী এই বাঙালী রাজার পক্ষে যুদ্ধ জয় করা হয়তো সম্ভব হয়নি কিন্তু জরাসন্ধ নরকাসুরের মত দুর্দম প্রতিবেশীকে পাশে না পেয়েও যে ক্ষমতা তিনি দেখিয়েছেন, তার প্রশংসা আমার থেকেও স্বয়ং কৃষ্ণই করেছেন বেশি। প্রতিশোধ স্পৃহায় রাতের অন্ধকারে যখন তিনি দ্বারকা আক্রমণ করলেন কৃষ্ণ তখন সেখানে ছিলেন না। দিশেহারা দ্বারকাবাসীদের সঙ্গে যদুকুল চূড়ামণি সাত্যকি যখন প্রায় মরতে বসেছেন, তখন কৃষ্ণ এসে পৌঁছোললন পেছন থেকে। হরিবংশ যতই বলুন কৃষ্ণ গরুড় বাহনে ‘এয়ার-ড্রপ হয়েছিলেন, আমরা জানি আক্রমণ হয়েছিল সাঁড়াশির মত। হরিবংশে কৃষ্ণই যেহেতু শেষ কথা, অতএব পৌণ্ড্রক বধ। কিন্তু এই পৌণ্ড্রক বাসুদেবই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি, যাঁকে কৃষ্ণ মনে মনে পূজা করেছেন-মনসা সম্পূজ্য যদুনন্দনঃ। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁকে কৃষ্ণ সামনাসামনি প্রশংসা করে বলেছেন-’অহো বীর্য অহহা ধৈর্যমস্য পৌস্য দুঃসহম। পৌড্রের মৃত্যুর পর পৃথিবীতে বাসুদেব থাকলেন একজনই–তিনি উত্তর ভারতের সেই কৃষ্ণ বাসুদেব। মনে রাখা দরকার পৌণ্ড্রক বাসুদেবকে হত্যা করতে হয়েছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই এবং তা অবশ্যই পাণ্ডবদের জয়ের পথ সুগম করতে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে বাংলা, উড়িষ্যা এবং আসাম–এরা সবাই কিন্তু দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করেছে এবং তা করেছে কৃষ্ণপক্ষে পাণ্ডব চন্দ্রের উদয় সহ্য করতে না পেরে। দুর্যোধন যেহেতু পূর্বভারতীয় সম্মিলিত বাহিনীর এককালের অংশীদার, তাই পূর্বভারতীয় রাজারা তাদের পুরানো এক আর্যবন্ধুকে সমর্থন করেছে ক্রম প্রতিষ্ঠীয়মান অন্যতর আর্যনৃপতির ধ্বংসের জন্য। অবশ্য কৃষ্ণের সঙ্গে বদ্ধ-শত্রুতাও দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ।
পাঠকমশাই! এসব কথা আমার স্বকপোলের কল্পনা নয়। কৃষ্ণের রাজনৈতিক জীবনের পূর্বাপর বিচার করে কেউ দেখেন না; দেখলেও হরিবংশ-পুরাণগুলিকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যে গণনা করেন না। কিন্তু ‘হরিবংশ ঠাকুর অথবা পুরাণকর্তাদের বিবরণ যদি খোদ মহাভারতের সঙ্গে মিলে যায় তবে তার সত্যতা অস্বীকার করবেন কি করে? মহাভারতের দ্রোণপর্বটি একবার সত্যান্বেষীর দৃষ্টিতে বুঝতে হবে। দ্রোণপর্বে যখন ভীমের ছেলে ঘটোৎকচ কর্ণের হাতে মারা গেলেন, তখন পাণ্ডবেরা, বিশেষত ভীম এবং অর্জুন অত্যন্ত শোকাহত হলেন। সেই সোকাচ্ছন্ন রণভূমিতে কৃষ্ণ কিন্তু নির্বিকার। অবশ্য বিকার একধরনের ছিল সেটি আনন্দের বিকার। ঘটোৎকচের মৃত্যুতে তিনি ধেই ধেই করে নাচতে লাগলেন; ঝড়ের তোড়ে গাছ যেমন আকাশে-ঊয়ে লুটোপুটি খায়, কৃষ্ণ তেমন করেই নাচতে লাগলেন-সনৰ্ত্ত হর্ষসংবীতে বাতোস্কৃত ইব দুমঃ। এ রকম বেহায়া নৃত্য দেখে অর্জুন পর্যন্ত তাঁকে অস্থানে আনন্দ করার হেতু জিজ্ঞাসা করে বসলেন। উত্তর পাওয়া গেল। কৃষ্ণ অবশ্য যুক্তি দেখিয়েই বললেন যে, কর্ণের কবচ কুণ্ডল ইন্দ্র হরণ করেছেন ঠিকই কিন্তু তাতে পশ্চাত্তপ্ত ইন্দ্র তাঁকে একখানি সর্বনাশা বাণ দিয়েছেন। একাঘী বাণ, যা দিয়ে পাণ্ডবদের একজনের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। কর্ণের নজর যেহেতু সব সময়ই অর্জুনের ওপর, তাই অর্জুনের রক্ষা বিষয়ে তৎপর পার্থসারথি বড় চিন্তায় ছিলেন। ঘটোৎকচের ভয়ংকর আক্রমণ রোধ করবার জন্য কর্ণ অর্জুনের জন্য নির্দিষ্ট বাসবদত্ত একাগ্নী বাণটি ছাড়লেন এবং ঘটোৎকচকে মেরে ফেললেন। কৃষ্ণ তখন পুলকিত হয়ে অর্জুনকে বললেন-যাক বাঁচা গেল, ইন্দ্রের দেওয়া অমোঘ বাণখানি থেকে তুমি বাঁচলে। তারপর যে কথাটি কৃষ্ণ স্বীকার করলেন, তা থেকেই হরিবংশ এবং পুরাণ বিবরণের সত্যতা যাচাই হয়ে যাবে। কৃষ্ণ বললেন-এরকম অনেক কাজই আমি করেছি অর্জুন–এই যে জরাসন্ধ শিশুপাল, নিষাদরাজ একলব্য (ইনি পর্বতবাসী নিষাদদের রাজা, দ্রোণের সেই আঙুলকাটা শিষ্য। ইনি পৌণ্ড্রক বাসুদেবের সঙ্গে দ্বারকা পর্যন্ত আসেন কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে! বলরামের সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে একলব্য দ্বীপে আশ্রয় নেন। তাঁর মত যুদ্ধবীরের পক্ষে এই ছিল মৃত্যু) এদের সবাইকে একজন একজন করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগেই আমি বুদ্ধি করে মেরেছি কিন্তু কেন? মেরেছি তোমার ভালোর জন্যে-জরাসন্ধশ্চেদিরাজো মহাত্মা মহাবাহুশ্চৈকলবব্যা নিষাদঃ। একৈকশো নিহতঃ সর্ব এতে যোগৈস্তৈস্তৈ শুদ্ধিতার্থং ময়ৈব ॥
এই একেকজনের (একৈকশঃ) মধ্যে শুধু জরাসন্ধ, শিশুপাল নন, নরকাসুর, পৌণ্ড্রক বাসুদেব সবাই আছেন। অর্জুন বললেন-এর মধ্যে আবার তোমার কি বুদ্ধি কাজ করছে, আমার ভালোই বা কি? কৃষ্ণ বললেন-বাপুহে জরাসন্ধ শিশুপালেরা যদি আগেই মারা না পড়ত, তাহলে এখন তার পরিণাম দাঁড়াত ভয়ংকর–যদি ন সহঃ পূর্বমিদানীং সুর্ভয়ংকরাঃ। দুর্যোধন অবশ্যই এই সব রথী মহারথীদের যুদ্ধে বরণ করতেন এবং জরাসন্ধ শিশুপালেরা যেহেতু চিরকালই আমাদের ওপর খ্যাপা, তাই তাঁরাও কৌরবদেরই পক্ষ নিতেন–দুর্যোধনস্তান অবশ্যং বৃণুয়াদ্ৰথসত্তমা। তে’আসু নিত্যবিদ্বিষ্টাঃ সংশ্রয়েয়ুশ্চ কৌরবান্ ॥ আর এরা সবাই এক জায়গায় হলে তার ফল কি জান? সমস্ত পৃথিবীটাকেই এঁরা জয় করে নিতে পারতেন এবং কৌরবদের রক্ষা করতেন ঠিক দেবতাদের মত। ঠিক এইখানেই আমি বুদ্ধি খাঁটিয়েছি, কারণ বুদ্ধি ছাড়া এদের কাউকেই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়–অজয্যা হি বিনা যোগৈঃ।
জরাসন্ধের মিত্ররাজাদের মধ্যে শা, দন্তবক্র, দ্বিবিদ (যিনি নরকাসুরের বন্ধু বলে পরিচিত)-এঁরা সবাই কৃষ্ণের হাতে কিংবা বলরামের হাতে মারা পড়েছেন এবং তা অবশ্যই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে। কৃষ্ণের স্ট্র্যাটিজি’টা তাই লক্ষ করার মত। পাণ্ডবদের রাজসূয় যজ্ঞের পূর্ব পর্যন্ত কৃষ্ণের ‘ব্ল্যাকলিস্টে যদি জরাসন্ধ পর্যন্ত রাজারা স্থান পেয়ে থাকেন, তাহলে তাঁর অন্য অনুগত বন্ধুরাও নিহত হয়েছেন ভারত-যুদ্ধের আগে এবং তাতে পাণ্ডবদেরই আখেরে লাভ হয়েছে। এমনকি ভারতযুদ্ধের মূল দায়িত্বও কৃষ্ণের ওপরেই চেপে গেছে। মহাভারতের যানসন্ধি পর্বে দেখা যাবে পাণ্ডবদের সমরসজ্জায় মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। এই সময় দুর্যোধন এসে তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন ভেতব্যং মহারাজ-ভয় পাবেন না, জয় আমাদের হবেই। দুর্যোধন আরও বললেন–মহারাজ! আমি যখন শুনলাম, পররাষ্ট্রের ভয়-ধরানো সৈনাবাহিনী নিয়ে স্বয়ং কৃষ্ণ, কেকয় ধৃষ্টকেতু, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি রাজারা ইন্দ্রপ্রস্থের কাছেই বনবাসী পাণ্ডবদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন, তখনই আমি জ্ঞাতি-নিধনের ভয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ–এঁদের কাছে গিয়ে বললাম–যখন বাসুদেব কৃষ্ণ আমাদের উচ্ছেদে উৎসুক হয়েছেন, তাতে বুঝি পাণ্ডবরাও তাহলে যুদ্ধের ব্যাপারে নিশ্চয় করেছেন–ততঃ স্থাশ্যন্তি সময়ে পাণ্ডবা ইতি মে মতিঃ।সমুচ্ছেদং হি নঃ কৃৎস্নং বাসুদেবশ্চিকীর্ষতি। কাজেই দেখুন ভারতযুদ্ধে কৃষ্ণ যতই অস্ত্র-শস্ত্র ধারণ না করার কায়দা দেখান না কেন, দুর্যোধন ঠিক বুঝেছিলেন যে, যুধিষ্ঠির নয়, ভীম নয়, এমনকি অর্জুনও নয়, সব কিছুরই মূলে আছেন কৃষ্ণ-সমুচ্ছেদং হি নঃ কৃৎক্সং বাসুদেবশ্চিকীর্ষতি। দুর্যোধন বুঝেছিলেন–যেসব রাজারা একত্রিত হয়েছিলেন বাকলপরা যুধিষ্ঠিরের পক্ষে, তাঁদের মধ্যেও প্রধান হলেন কৃষ্ণ, ঠিক যেমনটি আগে ছিলেন জরাসন্ধতে যুধিষ্ঠিরমাসীন অজিনৈঃ প্রতিবাসিত। কৃষ্ণপ্রধানাঃ সংহত্য পৰ্যপাসন্ত ভারত।
কংসের মৃত্যু থেকে আরম্ভ করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যে বিরাট রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে তার প্রাণকেন্দ্রে যে মানুষটি ছিলেন, তাঁকে যদি ‘মহাভারত সূত্রধার’ বলে থাকেন ভোজবমা, তো আর এক প্রাচীন কবি ভারী শ্লেষের সঙ্গে বলেছেনকানীন পিতামহঃ সমভবৎ– পিত্রাদয়ো গোলকাঃ–যাদের পিতামহ (ব্যাসদেব) ছিলেন কুমারী মেয়ের গর্ভজাত পুত্র, আর বাপ-জ্যাঠারা ছিলেন বিধবার ছেলে (কারণ ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর বাবা বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গেছিলেন, তাই ব্যাসের ঔরসেই ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর জন্ম); আবার তাদেরও ছেলে যুধিষ্ঠির-ভীমেরা সব হল গিয়ে অন্য পুরুষের ব্যভিচারের ফল-তৎপুত্রাশ্চ যুধিষ্ঠির-প্রভৃতয়ঃ কুণ্ডা হ্যমী পাণ্ডবাঃ; যাদের পাঁচ ভাইয়ের একটামাত্র বৌ, যাদের আত্মীয়-স্বজন সব মরেছে যুদ্ধে-পঞ্চানাং দুপদাত্মজা সহচরী যুদ্ধে হতা বান্ধবাঃ; এইরকম ব্যভিচারের কালিমাখা বংশকেও যিনি জগতের বন্দনার পাত্র করে তুলেছেন, তিনি হলেন কৃষ্ণ-শ্রীকৃষ্ণেন কুলংকলঙ্কনিচিতং নীতং জগদ্বন্দিত। কাজেই সেই মহাভারতের সূত্রধরের জয় হোক। ভারতযুদ্ধের ফলাফল নিয়ে আমাদের কোন দুশ্চিন্তা নেই ঠিকই, তবে দু-একটা মোটা কথা তো থেকেই যায়। যেমন এই যুদ্ধের ফলে কৌরবদের বৃদ্ধি একেবারেই রুদ্ধ হয়ে গেল। জনমনে পূর্বাহ্নেই প্রতিষ্ঠিত পাণ্ডবেরা রাজনৈতিক দিক থেকে চরম প্রতিপত্তি লাভ করলেও ভারতযুদ্ধে তাঁরাই ছিলেন শিখণ্ডী। যুদ্ধের মূলনায়ক হলেন কৃষ্ণ-মহাভারতসূত্রধার। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরা-অভিমন্যুর বিবাহসভাই যুদ্ধের মন্ত্রণাসভায় পরিণত হয়েছে। কৃষ্ণ যুদ্ধেরই প্রস্তাব দিয়েছেন এবং সে মত বলরাম ছাড়া আর সবাই সমর্থন করেছে। সমর্থকদের মধ্যে একটা ভরসা ছিল বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজবীরেরা। দ্রুপদের পুরোহিতকে দুর্যোধনের কাছে পাঠান হল যাতে তিনি অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডবদের দান করেন। কিন্তু এ শুধু দূত পাঠানোই, যুদ্ধের দামামা তখন বেজে উঠেছে, দু-পক্ষই সৈন্যসংগ্রহে ব্যস্ত। স্বয়ং দুর্যোধন এবং অর্জুন এসে জুটেছেন কৃষ্ণের কাছে, দুজনেই কৃষ্ণের সাহায্যপ্রার্থী। সৈন্য সংগ্রহের প্রথম কল্পেই কৃষ্ণকে নিয়ে যে টানাটানি আরম্ভ হল, তাতে বেশ বোঝা যায় কৃষ্ণ তখন রাজনীতির ক্ষেত্রে কত প্রতিষ্ঠিত এবং বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজবীরেরা তখন কতখানি মান্যগণ্য। বিশেষত ‘বেলিজারেন্ট’ নিরস্ত্র কৃষ্ণকে স্বপক্ষে পাওয়ার চেয়ে বৃষ্ণি-অন্ধক-দুবীরদের নারায়ণী সেনা দুর্যোধনের কাছে অনেক বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। পরবর্তীকালে কৃষ্ণের মুখেই শোনা গেছে বৃষ্ণি-অন্ধকেরা যে রাজার পক্ষে থাকবেন সেই রাজাই এই পৃথিবীতে থাকবেন, যার পক্ষে বৃষ্ণি-অন্ধকেরা নেই সে রাজা থাকবে না–যস্য ন সু ন বৈ স স্যা যস্য সঃ কৃৎস্নমেব তৎ। কথাটা ভয়ংকর রকমের সত্যি, কিন্তু তৎ সত্ত্বেও যে দুর্যোধনের জয় হল না তার কারণ বৃষ্ণি-অন্ধকদের মহাগুরু কৃষ্ণ ছিলেন বিরোধী পক্ষে, এবং বলরাম যুদ্ধেই যোগ দেননি। অভিমনুর বিবাহ শেষে বলরাম প্রস্তাব করেছিলেন দুর্যোধনকে যেন শান্তপথে প্রণিপাত করে তুষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। এ কথা কৃষ্ণের তো পছন্দ হয়ইনি, উপরন্তু প্রধান বৃষ্ণিবীরদের মধ্যে অন্যতম সাত্যকি বলরামকে উল্টো বকাঝকা করলেন। ভারতযুদ্ধের ব্যাপারে কৃষ্ণের যথেষ্ট উস্কানি ছিল, যদিও যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে শেষ সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে যিনি কৌরবসভায় গেলেন, তিনি কৃষ্ণ। দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা যাকে দেখতেই পারে না, তাদের দু চক্ষের বিষস্বরূপ সেই কৃষ্ণকে কেন পাঠান হল দূত করে? কুদ্ধ ব্যক্তির কাছে অসহ্য ব্যক্তির শোপদেশ শত্রুতা আরও বাড়ায়, কমায় না। সম্ভবত কৃষ্ণ এ কাজ অন্য কাউকে দিয়ে করাতেও চাননি, পাছে সন্ধি হয়েই যায়। কৃষ্ণই যুদ্ধ চেয়েছিলেন এবং সেই যুদ্ধই হয়েছে। কৃষ্ণ যখন কুরুসভায় যাচ্ছেন তখন মধ্যম পাণ্ডব সদা-কৌরববিদ্বেষী–চিরকালের ক্ষমাহীন–নিত্যমনরমর্ষণঃ–ভীম পর্যন্ত কৃষ্ণকে বলেছিলেন–যেভাবে শান্তি আসে তাই কর কৃষ্ণ, সেই ভাবেই কথা বল যাতে যুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছি, এমন মনে না হয়–যথা যথৈব শান্তিঃ স্যাৎ কুরূণাং মধুসূদন। তথা তথৈব ভাষেথা মা স্ম যুদ্ধেন ভীষয়েঃ।(৪২)
কৃষ্ণের যেন একটু হাসিই পেল। এসব কথা যুধিষ্ঠিরকে মানায়, ভীমও কি সেই যুধিষ্ঠিরের মত ঠাণ্ডা মেরে গেল–শীতত্বমিব পাবকে। কৃষ্ণ দৌত্যকর্ম নিয়ে সেইভাবেই চলে যেতে পারতেন। কিন্তু না, যাবার আগে তিনি ভীমকে উত্তেজিত করতে থাকলেন; পূর্বকথা, পুর্বের ক্রোধ সব স্মরণ করালেন, তারপর বললেন–হ্যায়, যুদ্ধের সময় কিরকম উল্টোপাল্টা ব্যাপার ঘটছে; ভীমের মত লোকের মনেও ভয় ধরেছে–চেতাংসি বিপ্রতীপানি যত্ত্বাং ভীভীম বিন্দতি। এর ফল যা হবার তাই হল। ভীম ক্ষেপে উঠলেন, তাঁর বাহুবল কিরকম তার বহুরকম ফিরিস্তি দিলেন। শেষে বললেন–সারা দুনিয়া ক্ষেপে গেলেও আমি ভয় পাই না, কিন্তু তবু এটাই সহৃদয়তা; সব কষ্ট যে সহ্য করেছি তার কারণ এই, যাতে ভরতবংশীয়রা একেবারে চিরবিলুপ্ত না হয়ে যায়–সবাংস্তিতিক্ষে সংক্লেশান মা চ নো ভরতা নশন। (৪৩)
কৃষ্ণ দেখলেন এবং বুঝলেন লোহা গরমই আছে। তিনি এইটুকুই চেয়েছিলেন–এরা যেন এই মুহূর্তে ঠাণ্ডা মেরে না যায় গিয়েরিব লঘুত্বং তৎ শীতত্বমিব পাবকে। তিনি বললেন-না রে ভাই, মজা করছিলাম–প্রণয়াদিদমবুব। তিনি কৌরবসভায় গেলেন পাঁচখানি গ্রাম চাইতে, সন্ধির প্রস্তাব নিয়েও। কিন্তু চিরকালের পাণ্ডবপক্ষপাতী কৃষ্ণ, এই সময়ে নিরপেক্ষ দৃত সাজলে চলে? তাঁর আগমন সংবাদেই কৌরবপক্ষে সাজসাজ রব উঠল, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধও আরম্ভ হল। সারা ভগবদ্গীতা জুড়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন ক্ষত্রিয়ের ধর্মযুদ্ধ করতেই হবে। অর্জুন যুদ্ধ করলেন, সবাই যুদ্ধ করলেন। কৃষ্ণ সমস্ত জগতের সামনে প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁরই ঈপ্সিতপক্ষ জয়ী হয়েছে।
ভারতযুদ্ধের ফল কি হয়েছে ধর্মমতে তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। ভারতীয় দার্শনিক পন্থাতেও সে ফল মেলানো অসম্ভব নয় কিন্তু মানবিকতার বৃহত্তর দৃষ্টিতে ভারতযুদ্ধের ফল শূন্য। ভীম যা আশঙ্কা করেছিলেন–একে একে সবাই চলে গেল। ভরতবংশের বাতি দেওয়ার জন্য যিনি থাকলেন, সেই পরীক্ষিৎ অর্জুনের নাতি বটে, তবে তিনি কৃষ্ণ-ভগিনী সুভদ্রারও নাতি, আরও পরিষ্কার করে বললে কৃষ্ণ-বাসুদেবের ভাগিনেয় বংশ। আমি বলছি না কৃষ্ণের কোন বুদ্ধি এখানে কাজ করেছে, কিন্তু ফলতঃ এই ঘটেছে। যুদ্ধ থেমে গেলে হস্তিনাপুরের শ্মশান-নৈঃশব্দ্যের মধ্যে যুধিষ্ঠির রাজ্য করতে চাননি, দুঃখে মনের ব্যথায় তিনি চেঁচিয়ে উঠেছেন–চল ভায়েরা সব, এই পুরুষহীন জ্ঞাতিহীন রাজ্যে দুর্গতি লাভ করে আর কি হবে, তার চেয়ে বৃষ্ণি-অন্ধকদের বাসস্থানে ভিক্ষে করাও ভাল–যদ ভৈক্ষ্যমাচরিষ্যাম বৃষ্ণন্ধকনিবেশনে।
বিলাপ চলছে, বিলাপ হোক। ভিক্ষা করার অভিমান থাকলে হস্তিনাপুরেই করা যায়, সেখানে বৃষ্ণি-অন্ধকদের বাড়িতে গিয়ে তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ভিক্ষা করার কি মানে? তাহলে কি যুধিষ্ঠিরের মনের কোণেও কোনও ক্ষোভ ছিল যে এই সুবৃহৎ ভারতযুদ্ধের পেছনে কৃষ্ণের চাপা মদত আছে? এই একটা কথা থেকে এত বড় সিদ্ধান্ত ঠিক নয়, তবে যুদ্ধ ব্যাপারটা কৃষ্ণ চাননি, মহাভারত পড়ে তাও বোঝা যায় না। যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধই তাঁকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং সেখানে কাজ করেছে তাঁর আশ্চর্য রাজনৈতিক বুদ্ধি, যাকে তিনি, বারবার বলেছেন ‘যোগ’-যোগৈরপি হতাঃ যৈশুৈ তন্মে শৃণু ধনঞ্জয়। এমন কি গীতা, যাতে দার্শনিক তত্ত্বের শেষ নেই কোথাও, সেখানেও একেবারে অন্তিম শ্লোকে-যেখানে ধর্ম, সেখানে কৃষ্ণ–এমন কথা আসৈনি, বরঞ্চ বেশ ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়েছে–জয় সেখানে হবেই, যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণঃ যত্র পাথে ধনুর্ধাঃ। কাজেই বুদ্ধিযোগের ঈশ্বরের সঙ্গে পার্থের মত ধনুধরের যোগাযোগ শুধুই ধর্মের জন্যে এ কথা বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই ‘যোগের ফলেই সেকালের ধর্মরাজ্যে কিংবা বৃষ্ণি-অন্ধক-যদুবীরদের রাজ্যে, হস্তিনাপুরে অথবা তাঁর ভাগিনেয় বংশ পরীক্ষিতের রাজ্যে কৃষ্ণই একমাত্র প্রতিষ্ঠিত পুরুষ, অন্তত ভারতযুদ্ধের ফল তাই। পূর্বভারতীয় মহারাজ চক্রবর্তী সম্রাট জরাসন্ধের মৃত্যুতে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষমতা যদি কৌরবদের হাতে চলে গিয়ে থাকে, তবে কৌরবদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে রাজনৈতিক ক্ষমতা পাণ্ডবদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়নি, সে ক্ষমতা চলে গিয়েছিল বৃষ্ণি-অন্ধক-যদুমুখ্যদের হাতে, যাদের কথা কৃষ্ণ নিজেই গর্ব করে বলেছেন–যে পক্ষে বৃষ্ণিবীরেরা আছেন সেই পক্ষই যুদ্ধ জিতবে, আর যে দলে তারা থাকবে না তারা মুছে যাবে–যস্য ন সু ন বৈ স স্যা যস্য স্যুঃ কৃৎসমেব তৎ। এই যে প্রতিষ্ঠা, তাতে যদুমুখ্যতম ব্যক্তিটি, বৃষ্ণিদের অধিকর্তা ব্যক্তিটি কি পেয়েছিলেন? বহির্জগতে প্রতিষ্ঠায় তাঁকে নয় সবাই ভগবান বলে মেনে নিয়েছে, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে? সেখানে ঘর সামলাতে সামলাতেই তাঁর জীবন বীত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার অন্তরালে সংসার-বিধ্বস্ত কৃষ্ণকেও তাই একটু চিনে নেওয়া দরকার।
.
০৪.
পাঠককে কয়েক মুহূর্তের জন্য মহাভারতের বনপর্বে নিয়ে যাব। পাণ্ডবেরা কাম্যকবনে পৌঁছেছেন, কৃষ্ণও তাঁর প্রিয়তমা মহিষী সত্যভামাকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে এসেছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে। পাণ্ডবেরা কৃষ্ণের সঙ্গে কথা বলতে থাকলেন আর সত্যভামা বসলেন দ্রৌপদীর সঙ্গে। ঈষৎ আলাপচারিতার পরেই সত্যভামা মোক্ষম একটি প্রশ্ন করলেন দ্রৌপদীকে সত্যভামা বললেন-কি, যাদু জান গো তুমি দ্রৌপদী! একটি নয়, দুটি নয় পাঁচ-পাঁচটি মহা শক্তিশালী বর। এদের তুমি সামাল দাও কি করে কেন বৃত্তেন দ্রৌপদি পাণ্ডবান অধিতিষ্ঠসি? পাঁচজন তো বেশ তোমার বশে আছে, তোমার ওপর কোন ভাল-মন্দ মেজাজও দেখান না।. কথং চ বশগা স্তুভ্যং ন কুপ্যন্তি চ তে শুভে। এমনকি পাঁচজনেই যেন সব ব্যাপারেই তোমার মুখের দিকেই চেয়ে আছে, মেনিমুখো বললেই বা আপত্তি কি-মুখপ্রেক্ষাশ্চ তে সর্বে। বল না গো দিদি–ব্রত, স্নান, জপ, হোম নাকি ওষুধ করেছ দিদি। এই সৌভাগ্যের মূল কারণটা বল না পাঞ্চালী, যাতে কৃষ্ণও আমার বশে থাকে, কথা শোনে–যেন কৃষ্ণে ভবেন্নিত্যং মম কৃষ্ণো বশানুগঃ।(১)
সত্যভামার কথা শুনে দ্রৌপদী অনেক সদাচারের উপদেশ দিলেন। বললেন-যজ্ঞ, দান, জপতপ নয় স্বামীদের বিভিন্ন উপায়ে তুষ্ট রাখাই তাঁর সৌভাগ্যের চাবিকাঠি। আমাদের জিজ্ঞাসা, সেকালের এক নারী হিসেবে সত্যভামা পতিসেবার মাহাত্ম জানতেন না! সব জানতেন, কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে জানতেন যে কৃষ্ণ কিঞ্চিৎ চপলমতি। মহাভারতের বনপর্বের সময়ে কৃষ্ণ মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত পুরুষ। জরাসন্ধ, শিশুপাল, নরকাসুর–এই সব সাংঘাতিক রাজারা কৃষ্ণের হাতে পূর্বাহ্নেই মৃত। কিন্তু ব্যক্তিজীবনে স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাঁর দুর্বলতার কথা অবিদিত ছিল না; বোধ করি সত্যভামাও সেসব কথা জানতেন। হাজার বশে থাকলেও, হাজার কথা শুনলেও তাঁর স্বভাবে বোধহয় সেই পিচ্ছিল ভাবটি ছিল, যাতে সত্যভামার মত প্রিয়তমা পত্নীরও বারবার মনে হয়েছে যে, কৃষ্ণ যেন সম্পূর্ণ করে তাঁরই নন। বৃন্দাবনের কেলিকলা এবং অন্যান্য রমণী বিষয়ে কৃষ্ণের লঘুভাবটিই বুঝি সত্যভামার সন্দেহের কারণ। সন্দেহ আরও এই জন্যে যে একমাত্র সত্যভামাই পাতিব্ৰত্য এবং কর্তব্যর সীমা লঙ্ঘন করে কৃষ্ণকে যথার্থ ভালবাসতেন, যে কথাটা দ্রৌপদী বোঝেননি এবং বোঝেননি বলেই অত সদাচারের উপদেশ করেছেন।
প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণের ব্যক্তিগত জীবনের কথা বলতে হলে আমাদের আরও একবার পেছন ফিরে তাকাতে হবে। সেই যেদিন কংসের ধনুর্যজ্ঞের আমন্ত্রণ পেয়ে অক্রূরের রথে উঠলেন কৃষ্ণ, সেদিনটার কথা আমাদের স্মরণ করতেই হবে। সেদিনটা ছিল মথুরা যাবার দিন। পণ্ডিতেরাগো-পালক কৃষ্ণকে অকূরের রথে চড়িয়ে মথুরায় পাঠাতে একদম নারাজ, কিন্তু কবিরা এই পর্বটিকে অবলম্বন করেই মথুরা বিরহের অসংখ্য গীতি রচনা করেছেন, শিল্পীরা এঁকেছেন অমরচিত্র। আমি এসব বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে যাব না, তবে ‘গোপীশতকেলিকার কৃষ্ণ আর ‘মহাভারত সূত্রধার’ কৃষ্ণ–এই দুয়ের মধ্যে যোগসূত্র যে অক্রূর সে কথা অস্বীকারও করব না। অন্তত এই ‘ট্র্যাডিশন’ প্রথম, দ্বিতীয় শতাব্দীতেই যথেষ্ট প্রচলিত ছিল যে, গোপালক কৃষ্ণকে কংসের দূত এসে নিয়ে গেছে মথুরায়। ভাসের বালচরিত নাটকে দেখি, যেদিন কালিয়নাগকে দমন করে গোপিনীবালিকাদের মধ্যে কেবলই একটু রঙ্গ এস আরম্ভ করেছেন কৃষ্ণ, ঠিক তখনই খবর এল– অক্রূর এসেছেন কৃষ্ণকে নিতে। কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গেই সে আমন্ত্রণ স্বীকার করেছেন, এবং দৃশ্যপট পরিবর্তিত হয়েছে মথুরায়।(২) অন্যান্য নাটক কিংবা পুরাণকারেরা এখানে গোপীবিরহ(৩), যেতে নাহি দিব–এমনিধারা অনেক রস, করুণরসের মাধুর্য সৃষ্টি করেছেন। আমরা পণ্ডিতদের স্বার্থে এই সমস্ত কবিত্ব বিসর্জন দিতে পারি, কিন্তু এটুকু না বললে চলবে না যে, অক্রূরের রথে ওঠবার আগে কৃষ্ণকে তাঁর চুড়া-বশী দুটি রাধার কাছে জমা দিয়ে যেতে হয়েছিল, যশোদাকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল কটিতটের পীতধটিখানি। চূড়া বাঁশী আর পীতধটির স্মৃতিচিহ্ন ফেলে দিয়ে মথুরায় এসে কৃষ্ণ-বলরাম কংসের বাস রাঙানি ধোপাকে মেরে রাজবেশ তুলে নিলেন দেহে, ব্যাস্ বৃন্দাবনের সমাধি হল সেইদিনই।
তাতে কৃষ্ণের পক্ষে ক্ষতি হয়নি কিছু। দু-একটি অতি ভাগ্যবান পুরুষ এমনই আছেন, ভালবাসা পেতে যাঁদের অসুবিধে হয় না। যত অন্যায় করুন, কথা দিয়ে একটি কথাও না রাখুন, তবুও তাঁদের সৌভাগ্যরেখা এমন যে অখিল রমণীকুল তাঁদেরই ভালবাসে অথবা তাঁদেরই প্রেমে মোহগ্রস্ত। সমস্ত যৌবনকালটা যার–শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী, কারে রাখি কারেই ফেলি-বলে কেটেছে, মথুরার প্রশস্ত রাজপথ দিয়ে যাবার সময়েই তাঁর ভাগ্যপথে আবিভাব হল এক রমণীর। রমণী সাধারণী। তবে মুখখানি বেশ সুন্দর, খুঁত আছে শুধু দেহে। পিঠের ওপরে একখানি কুঁজ থাকার ফলেই তার সমস্ত সৌন্দর্য মাটি হয়ে গেছে। রাজপথে রমণী দেখে কৃষ্ণ একটু সকাম ভাবেই তার সঙ্গে কথা কইতে থাকলেন। হরিবংশ থেকে আরম্ভ করে ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ–সবাই কৃষ্ণের দিক থেকে এই কামনার অভিব্যক্তিটুকু লক্ষ্য করেছে। যা কিছুই কৃষ্ণ এই বিদেশিনীকে বলেছেন, তা সকামভাবেই বলেছেন–সকামেনৈব সা প্রাক্তা। আগেই বলেছি রমণী এমনিতে সুন্দরী, তার ওপরে সে রাজার ঘরে গন্ধ আর হরেক কিসিমের অঙ্গরাগের বেশাতি করে। কিছু চপলাও বটে, হরিবংশ তার হাঁটার ভঙ্গিটি বলেছে-”
বিকুটিলগামিনী। কৃষ্ণ বললেন-হ্যাঁগো মেয়ে, এত গন্ধ, এত অনুলেপন নিয়ে কোন দিকে চলেছ? মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে কুজা বলল–অত কথার কি দরকার বাপু, তোমার গন্ধ ভাল লাগে গন্ধ নাও, অঙ্গরাগ পছন্দ হয়, কত আছে সেজে নাও–যমিচ্ছসি মে বীর তৃগৃহাণানুলেপন। তোমাকে দেখেই আমি মুগ্ধ। তোমরা সেজে নাও। আমি দাঁড়িয়ে আছি। দুই ভাই সেজে নিলেন তারপর কৃষ্ণ ধীরে ধীরে কুজার কুঁজের ওপর আপন আঙুল দুখানি দিয়ে চাপ দিলেন। কুজা সোজা হয়ে গেল। হরিবংশ তাই বলেছে। আর বিষ্ণু এবং ব্রহ্মপুরাণ বলেছে দেহের বক্রতা সোজা করার ব্যাপারটা জানতেন কৃষ্ণ–উল্লাপনবিধানবিৎ’। কাজেই চিবুক ধরে পায়ের ওপর চাপ দিয়ে কি এক ‘ফিজিওথেরাপি করলেন কৃষ্ণ, যাতে কুজা সোজা হয়ে গেল। হরিবংশের মতে তার ফল হল এই যে, তার স্তনপ্রান্ত হয়ে উঠল উঁচু, দেহষ্টি হল লতার মত, খিলখিলিয়ে হেসে উঠল রমণী–জহাসোচ্চৈঃ স্তনটী ঋজুষ্টি লতা যথা। কৃষ্ণের বসনপ্রান্ত ধরে সে বলল যাচ্ছ কোথায় তুমি, তুমি ধরা পড়েছ আমার কাছে যাস্যসি ময়া রুদ্ধঃ কান্ত তিষ্ঠ গৃহাণ মাম–তুমি আমার কাছেই থাক, আমাকে নাও। এসব কথা শুনে দুই ভাই নাকি পরস্পর চাওয়া-চায়ি করে হাততালি দিয়ে উঠলেন। বলরামের সামনে কৃষ্ণের এইটেই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ আর ব্ৰহ্মপুরাণ বলেছে-কুজা যেই সুন্দরী হয়ে গেল–যোষিতাম্ অভবৎ বরা (ভাগবত পুরাণ মতে-বৃহস্ট্রোণিপয়োধরা) তখনই সে কৃষ্ণের কাপড় টেনে ধরে বলল–আমার ঘরে চল তুমিবস্ত্রে প্রগৃহ্য গোবিন্দং ব্রজ গেহং মমেতি বৈ। কৃষ্ণ বললেন–আজ নয়, পরে আসব।(৪)
হরিবংশ আর অন্য পুরাণ কর্তাদের আশয় বুঝেই ভাগবতপুরাণ বলেছে-বড় ভাই বলরামের সামনেই রমণীর প্রশ্রয়মাখা অকুল আহ্বান শুনে কৃষ্ণ একটু লজ্জাই পেলেন যেন–এবং স্ক্রিয়া যাচ্যমানঃ কৃষ্ণো রামস্য পশ্যতঃবললেন, যাব, পরে যাব।
হরিবংশ এবং অন্যান্য পুরাণকতারা কুজার নাম জানাননি। কেউ বলেছেন অনেক বক্রা, কেউ ত্রিবক্ৰা কেউ বা সোজাসুজি কুজাই। কুজার দেহের খুঁত তাঁদের প্রথম চোখে পড়েছে, মুখশ্রীর দিকে নজর পড়েছে পরে। তারপর কৃষ্ণের উল্লাপনবিধির চিকিৎসায় তার বৃহৎ শ্রেণী-পয়োধরও তাঁদের নজর এড়ায়নি। এরই মধ্যে কবি-নাট্যকার ভাস কুজার নাম দিয়েছেন মনিকা, কিন্তু তার মনের দিকে কেউ তাকাননি–ভাসও না, অন্যান্য পুরাণকারেরাও না। প্রশস্ত রাজপথে কৃষ্ণ যে কথা দিয়েছিলেন মনিকার বাড়ি যাবেন বলে, সে কথার কোন মূল্য দেননি অন্য পুরাণকর্তারা। একমাত্র ব্যতিক্রম ভাগবত পুরাণ। এখানে কংসবধের পর পরই কৃষ্ণ কুজার ঘরে গেছেন। ভাগবতকার কুজার বিশেষণ দিয়েছেন কামতপ্তা, কৃষ্ণ তার প্রতিদানও দিয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণ যেহেতু ঈশ্বরীয় গুণে অলংকৃত, তাই কৃষ্ণের কামনার কথা ভাগবতপুরাণ বলেনি। বরঞ্চ সেই গীতার বাক্যমত “আমাকে যে যেভাবে ভজনা করে আমি তাকে সেইভাবেই ভজনা করি–যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্”-এই নিয়মে কামতা কুজার অভীষ্টপূরণ তপ্তভাবেই করেছেন।(৫)
আমরা জানি কৃষ্ণও সমান কামুক একথা বলতে ভাগবতপুরাণের বাধোবাধো লাগবে। গবেষক সন-তারিখ মিলিয়ে কৃষ্ণের কুজামণ সম্বন্ধে বলেছেন-”ভাগবত পুরাণ তো হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ কিংবা বিষ্ণুপুরাণের পরে লেখা হয়েছে, তাই হরিবংশে যেসব কথা কৃষ্ণের ভগবত্তা বা নৈতিকতার পক্ষে বিপজ্জনক, সেগুলি না বলে উল্টো দিক দিয়ে তার ভগবত্তা কিংবা মাহাত্ম্য রক্ষা করে গেছে। (৬)
আমরা বলি–ভাগবত পুরাণের তো এ দোষ আছেই, কিন্তু অল্প হোক বেশি হোক, এ দোষ কি হরিবংশেরও নেই? সনাতন গোস্বামী তাঁর বৈষ্ণবতোষণী টাকায় কুজা প্রসঙ্গে হরিবংশের কতকগুলি শ্লোক উদ্ধার করেছেন। সনাতন বলেছেন সেটা মাথুর হরিবংশ। আমাদের ধারণা এটি মূল হরিবংশেরই অংশ যদিও সেটা এখনকার হরিবংশে দেখি না। যাই হোক এই শ্লোকগুলির মধ্যে কুজার পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত দেওয়া আছে, এবং তা এমন ভাবেই দেওয়া আছে যাতে বেশ বোঝা যায় কৃষ্ণের ভগবত্তা এবং নৈতিকতা রক্ষাকল্পেই শ্লোকগুলি বিরচিত।(৭)
আমরা এত বুঝি না। আমরা বুঝি গোপীশতকেলিকার শত গোপীকে বৃন্দাবনে ফেলে এসে নিজেকে ভাল করে বেঁধে রাখতে পারেননি। আকৃষ্ট হয়েছেন এমন এক মহিলার প্রতি, যিনি পুরাণে সৈরিষ্ক্রী বলে পরিচিত। রসশাস্তুকারেরা বলেছেন কুজার ভালবাসা নাকি ‘সাধারণী রতি। সাধারণী নারী মানে তো বেশ্যা। কুজার ভালবাসাও নাকি বেশ্যার মতই। সাধারণী রতির লক্ষণ হল, নায়ককে দেখা মাত্রই নায়িকার যৌন লালসা জাগে, এবং নায়কের অনুপস্থিতিতে সে লালসাও স্তিমিত হয়।(৮) প্রশস্ত রাজপথেই কুজার ভাব অত্যন্ত সকাম-বৃন্দাবনের গোপীকুলের কামগন্ধহীন নিকষিত ভালবাসাও তার নেই, কৃষ্ণ মহিষীদের নিষ্ঠাও তার নেই। সে রতি লালসা করেছে। স্বগৃহে সে লালসা তৃপ্ত হতেই সে নিবৃত্ত হয়েছে। কিন্তু মজা হল–রসশাস্ত্রকারেরা কুজার দিক থেকেই সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন, কৃষ্ণের দিক থেকে নয়। এই পর্বে কুজা যে ব্যবহার করেছে কৃষ্ণও তত সেই ব্যবহারই করেছেন। তিনি সাধারণী নায়িকার কামেচ্ছাপূরণ করেছেন, না, আপন ইচ্ছা পূরণ করেছেন সে তর্ক আসবেই। যদিও সে তর্ক ব্যাখ্যার জন্য সহস্র গীতা বাণী এবং ভাগবতের শ্লোক মুখিয়েই আছে, তবু সে শুধু ব্যাখ্যাই। কৃষ্ণচরিত্রের মসী তাতে সাময়িক ধুয়ে যায় বটে, প্রশ্ন তবু থেকেই যায়।
হ্যাঁ, কুব্জার নিষ্ঠা নেই, নিষ্কাম প্রেম নেই, কেবলই লালসা। তাহলে নিষ্ঠাবতীদের কথা বলি। নিষ্ঠার জন্যে, পাতিব্ৰত্যের জন্যে মহিষীরাই তো বিখ্যাত, গোপীরা নয়। সাধারণ নিষ্ঠা, প্রেম, একনিষ্ঠতা-এ সব কিছুর ওপরে তাঁরা, কাজেই মহিষীপ্রেমের কথা আলাদা করে বলতে হবে। আগেই বলেছি, রুক্মিণীর বিয়ের মধ্যে রাজনীতি ছিল। তাঁর দাদা রুক্মী তাঁকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির স্বার্থে, আর কৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আপন স্বার্থে। কিন্তু এর কোনটির মধ্যে রুক্মিণীর আত্মকথাটি নেই। রুক্মিণী তার কালের সেরা সুন্দরী, শিশুপাল শাল্ব–সবারই তিনি মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। মহাভারতে রুক্মিণীর প্রসঙ্গে শিশুপাল বারবার বলেছে ‘মৎপূর্বা’ অর্থাৎ রুক্মিণী তারই। এ প্রসঙ্গে কথাবার্তাও মনে হয় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল এবং রুক্মিণীও বোধহয় তা জানতেন। হরিবংশে দেখি, রুক্মিণীর স্বয়ংবর সংবাদে সমস্ত রাজারা যখন বিদর্ভরাজ্যে সমবেত হয়েছিলেন, তখন কৃষ্ণ সেই সভায় নিমন্ত্রিত ছিলেন না। তার সবচেয়ে বড় কারণ তিনি মথুরার রাজা ছিলেন না। জরাসন্ধের মতে কোন সিংহাসনেই কৃষ্ণ বসার যোগ্য নয়, তাঁর কোনও রাজধানীও নেই, নগরও নেই-সিংহাসন অনধ্যাস্যং পুরং চাস্য ন বিদ্যতে। কাজেই রাজারা যেখানে স্বয়ংবর সভায় সিংহাসনের ওপর রুক্মিণীর জন্য অপেক্ষা করবেন, সেই রাজসমাজে কৃষ্ণ বসবেন কোথায়? তিনি কি মাটিতে বসে থাকবেন? এই অপমান বরণ করার জন্য তিনি স্বয়ংবর সভায় আসবেনই না।(৯) কৃষ্ণ তবু এলেন, এবং এসে উঠলেন বিদর্ভ নগরেরই প্রাচীন পুরুষ ক্ৰথ ও কৈশিকের বাড়িতে। এঁরা দুই ভাই, এবং কৈশিক ভীষ্মকের বাবা অর্থাৎ রুল্পী-রুক্মিণীর পিতামহ।
এ অভ্যাস কৃষ্ণের ছিল। যেখানে পাশের ঘরেই ঝামেলা আছে, সেখানে তারই পাশের ঘরে গিয়ে বিপদ এবং ঝামেলার একটা আঁচ নেওয়া কৃষ্ণের অভ্যাস। কৌরবসভায় পাণ্ডবের দৌত্যপর্বেও তিনি সরাসরি দুর্যোধনের কাছে যাননি। একবার কুন্তীর ঘরে গেছেন, একবার বিদুরের ঘরেও গেছেন। এই কৈশিকের বাড়ি যাওয়াটা অনেকটা বিদুরের ঘরে যাবার মত। যাই হোক, কৃষ্ণ আসার সংবাদে সমস্ত রাজকুলের মধ্যে সোরগোল পড়ে গেল। স্বয়ংবর সভা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় ভীষ্মক সাময়িকভাবে স্বয়ংবর বন্ধ করে দিলেন। ঠিক এই সময়েই শাম্বের বক্তৃতা এবং তারই উদ্দীপনায় কালযবনের সাহায্য নেওয়া হল, যাতে স্বয়ংবরের আগেই কৃষ্ণকে শেষ করে দেওয়া যায়। যাই হোক স্বয়ংবর সভা স্থগিত হওয়ার সংবাদে বিভিন্ন নরপতির যাই প্রতিক্রিয়া, হোক না কেন, রুক্মিণী সখীদের কাছে গিয়ে লজ্জায় অধোমুখী হয়ে বললেন-”আমি কৃষ্ণ ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করব না- চান্যেষাং নরেন্দ্রানাং পত্নী ভবিতুমুৎসহে।(১০)
মহামতি বঙ্কিমচন্দ্র রুক্মিণী হরণে বিশ্বাস করেন না। মহাভারতের যে কোন জায়গায় রুক্মিণী হরণের প্রসঙ্গ আছে, সেগুলিকে তিনি প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। আর হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ অথবা ভাগবতপুরাণ তাঁর কাছে গল্প উপন্যাস ছাড়া কিছুই নয়। পুরাণ-ইতিহাসের যে ধারা ভরতবর্ষে প্রচলিত তার যে একটা ধারাবাহিকতা আছে, যাকে আজকের দিনের গবেষণার পরিভাষায় continuity বলি, সেই ধারাবাহিকতার ধারণা সম্বন্ধে বঙ্কিম আমলের সাহেবরা অপরিচিত ছিলেন, কাজেই আদর্শ কৃষ্ণের পক্ষে অসুবিধেজনক সব কিছুই হয় তিনি প্রক্ষেপ পঙ্কে নিক্ষেপ করেছেন, নয়তো বা গল্প-উপন্যাস বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। পুরাণকারেরা কিন্তু এই ধারণাই পোষণ করেন যে কৃষ্ণ রাক্ষস বিধি অনুসারে কন্যাহরণ করেই রুক্মিণীকে বিবাহ করেন। হরিবংশের লজ্জানত অধধমুখী রুক্মিণীর অস্ফুট একখানি বাক্য থেকেই ব্রহ্মপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ সিদ্ধান্ত করেছে যে, রুক্মিণী এবং কৃষ্ণ–দুজনেই দুজনের প্রতি পরস্পর আসক্ত ছিলেন। ভাগবত পুরাণ যেহেতু আরও পরের লেখা তাই সেই পুরাণ-কবি রুক্মিণীকে দিয়ে রীতিমত একখানা প্রেমপত্র লিখিয়ে এক ব্রাহ্মণের হাতে পাঠিয়ে দিয়েছেন কৃষ্ণের কাছে। প্রেমপত্রের ভাষাটিও অপূর্ব। রুক্মিণী লিখেছেন
তিন ভুবনের সেরা মানুষটি আমার!
তোমার গুণের কথা যেমন শুনেছি রূপের কথাও তেমনি এবং সেইজন্যেই আমার মনটিও একেবারে লজ্জাহীন হয়ে তোমাতেই আবিষ্ট হচ্ছে–তৃয্যমুতাবিশতি চিত্তম অপত্ৰপং মে। তোমার বিদ্যা, বয়েস, সম্পত্তি, কুল-শীল–এসবই তোমারই মত, কিন্তু তাই বলে কোন্ কুলবতী কন্যা তোমাকে বরণ না করে থাকবে প্রিয়! আজ থেকে তোমাকেই আমি পতিত্বে বরণ করেছি। দেখো, তোমার মত বীরের প্রাপ্য যে জিনিসটিরমণীর হৃদয়-তা যেন শিশুপাল ছিনিয়ে না নেয়, সিংহের ভাগ যেন শেয়ালে না চুরি করে
মা বীরভাগ অভিমর্শতু চৈদ্য আরা–
গোমায়ুবখ্যাগপতে বালম্ অম্বুজাক্ষ।
জানবে কালকেই আমার বিয়ে, তুমি শিশুপাল জরাসন্ধকে পরাস্ত করে আপন শক্তি শুল্কে রাক্ষসদের মত জোর করে আমায় নিয়ে যাও।(১১)
ভাগবত পুরাণের এই চিঠির মধ্যে কেমন করে, কোন সময়ে রুক্মিণীকে হরণ করতে হবে, তাও তিনি স্বয়ংই কৃষ্ণকে জানিয়েছিলেন। সেইমত কাজও হয়েছিল। কিন্তু এত কায়দাকানুন করে, একের চোখে ধুলো দিয়ে আরেক জনকে পিটিয়ে যে রুক্মিণীকে বিয়ে করা হল, সেই রুক্মিণীর বিবাহিত জীবনের ধারাটি হয়ে গেল বড়ই সাদামাটা, বড়ই তরঙ্গহীন। আসলে রুক্মিণীর রূপ ছিল, কিন্তু বুদ্ধি ছিল না। ছিল না সেই বিদগ্ধতা, সেই অধরা ভাবটি যাতে স্বামীর কাছে তিনি চিরনতুন থাকেন। নবীনা নায়িকা বড় অল্পকালেই প্রবীণ সাধিকা বনে গেলেন। তিনি কেবলই স্বামীর অনুগতা। বৈদগ্ধ্য, হাব-ভাব কিংবা বিলাসিনী যুবতীর আড়াল ঘনিয়ে নেওয়া নিজের চারদিকে–এ সব তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি একটুও। স্বামীর প্রতি আনুগত্যে সাধারণ পরিহাস পর্যন্ত রুক্মিণী বুঝতেন না। ভাগবত পুরাণে আছে, কৃষ্ণ একবার রুক্মিণীকে বলেছিলেন রাজকন্যে, আমি বোধহয় তোমার যোগ্যই নই। জরাসন্ধের ভয়ে আমি সমুদ্রের মধ্যে বাস করি, আর আমাকে ভগবান বলে ডাকে শুধু ভিখারীগুলো। তাছাড়া শিশুপাল জরাসন্ধ–এরা সব হলেন রাজা, আমি রাজা পর্যন্ত নই। আমি বলি কি, তার চেয়ে বরং নিজের ইচ্ছেমত এবং মনোমত আবার একটা বিয়ে কর-আত্মনো নুরূপং বৈ ভজস্ব ক্ষত্রিয়ষভম্।(১২)
রুক্মিণীর হৃদয় অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। চোখে জল, রুদ্ধবাক, শেষে মূর্ছা গেলেন রুক্মিণী। তাঁর এই অবস্থা দেখে আমৃত্যু সংসার বিরাগী এক বৈষ্ণব বাবাজি পর্যন্ত হেসে বলেছেন-কৃষ্ণ যদি রুক্মিণীকে কৈল পরিহাস। কৃষ্ণ ছাড়িবেন বলি রুক্মিণীর হৈল ত্রাস ॥ চৈতন্যচরিতামৃতের মরমী কবি তাঁর কথার সূত্রে যে তত্ত্বটি প্রকাশ করেছেন, বিবাহিত জীবনে সে কথাটি ঔষধের মত। তাঁর মতে বিবাহিত প্রেমিককে যিনি কেবলই প্রভু বলে মনে করেন, প্রেমিকের ওপর ঈশ্বর বুদ্ধিতে যিনি কেবলই আনুগত্য নিয়ে চলবেন, প্রেমের বিচিত্র ক্ষেত্রে তিনি একেবারেই হতভাগিনী, ঠিক যেমনটি রুক্মিণী।(১৩) অথচ কৃষ্ণেরই অন্য এক পরিণীতা বধু সত্যভামাকে দেখুন। তিনি সারাজীবনই মধুর দাম্পত্য রস এমনভাবেই ভাগাভাগি করে নিয়েছেন কৃষ্ণের সঙ্গে যে, সত্যভামার সামান্য ভ্রূকুটি রচনাতেই কৃষ্ণের মনে হত এই বুঝি সত্যা রেগে গেলেন। তাঁর সামান্য মৌনতাই কৃষ্ণের কাছে চরম নিগ্রহের রূপ নিয়ে ধরা দিত। কিন্তু কেন এমনটি হল? এর কারণ লুকিয়ে আছে কৃষ্ণ-সত্যভামার বিবাহ-পূর্ব জীবন থেকে আরম্ভ করে সম্পূর্ণ বিবাহিত জীবন জুড়েই।
আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র সত্যভামার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্বন্ধ স্বীকার করেন না, জাম্ববতীর সঙ্গেও নয়। সত্যভামার সঙ্গে জড়িত স্যমন্তক মণির বিবরণ তাঁর মতে উপন্যাস আর ভল্লুক কন্যা জাম্ববতীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিবাহ নাকি অসম্ভব। এ প্রসঙ্গে দু-একটি কথা নিবেদন করতেই হবে। প্রথম কথা স্যমন্তক মণির কাহিনীটি অত্যন্ত পুরানো, এবং বেশির ভাগ পুরাণেই এ কাহিনীটি ধারাবাহিক কৃষ্ণ-জীবনের অনুক্রমে বর্ণিত নয়। একেবারে আলাদাভাবে যেখানে ভোজ বৃষ্ণি এবং অন্ধকদের বংশ-প্রতিবংশের নামকরণ হচ্ছে, সেইখানে এই সম্যক মণির বিবরণ এবং সত্যভামা-জাম্ববতীর বিবাহ প্রসঙ্গ এসেছে। তাতে বুঝি এ কাহিনীর পৌরাণিকতা কৃষ্ণজীবনের অন্যান্য কাহিনীর থেকে অনেক বেশি। তাছাড়া বিষ্ণুপুরাণের মধ্যে স্যমন্তক মণির কাহিনীটি পুরাতন বংশাবলীর সঙ্গে প্রাচীন গদ্যে লেখা হয়েছে। অনেকেই মনে করেন হাজারো শ্লোকেগাঁথা ছন্দোবদ্ধ পুরাণকাহিনীর মধ্যে গদ্যে লেখা অংশগুলি বিশেষ পুরানো। সেদিক দিয়েও তাই সত্যভামা জাম্ববতাঁকে উড়িয়ে দেওয়া খুবই কঠিন।
সত্যি কথা বলতে কি, স্যমন্তক মণির বিবরণ সম্পর্কে বঙ্কিমের ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। সত্যভামা এবং জাম্ববতীর বিয়ে স্যমন্তক মণির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, এবং একথা বলা অন্যায় হবে না যে পৌরাণিকেরা তাঁদের কল্পনোক থেকে এই কাহিনীর বিবরণ লেখেননি। পুরাণকর্তাদের বহু আগে থেকেই এই কাহিনী লোকসমাজে ঐতিহাসিকভাবে প্রচলিত ছিল। তার একটা বড় প্রমাণ উল্লেখ করছি, তবে একটু ধৈর্য ধরে তা বুঝতে হবে।
নিরুক্তকার যাস্ক; যিনি বেদের প্রথম সফল বৈয়াকরণ বলে বিখ্যাত, এবং যিনি পুরাণকারদের অনেক পূর্ববর্তী, তিনি একটি বাক্য লিখেছেন ‘দণ্ড্যঃপুরুষঃ। এই বাক্যের দণ্ড্যঃ এই পদটি বোঝাতে গিয়ে যাস্ক লিখেছেন দণ্ড’ শব্দটির মূল ধাতু নাকি ‘দা ধাতু। আমরা জানি ‘দগু’ শব্দটি ‘দ’ ধাতু থেকেই আসছে এবং ‘দা ধাতু মানে, দান করা। কিন্তু যাস্ক বললেন দা ধাতুর রূপ হল ‘দতে এবং তার মানে নাকি ধারণ করা কিংবা ধারণ করানো-ধারয়তি। ‘দদতে’ ক্রিয়ার এই অর্থ পুরাণের যুগে চলেনি অর্থাৎ ‘সেমাণ্টিক’ দিক দিয়ে এটি অতি প্রাচীন ব্যবহার। যাই হোক এই ‘দদতে’ ক্রিয়ার ‘ধারণ অর্থ বোঝাতে গিয়ে যাস্ক একটি উদাহরণ দিলেন। তিনি বললেন–
‘অক্রূরো দদতে মণিম্ ইতি অভিভাষন্তে। যাঙ্কের এই পংক্তিটিই বঙ্কিমের উপন্যাসকল্পে সবচেয়ে বড় আঘাত। এই পংক্তির মধ্যে অক্রূর কিংবা তার সঙ্গে মণির কি সম্পর্ক সে কথা পরে বলব, কিন্তু দুটি শব্দ এখানে সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয়। এক, ‘দদতে’ শব্দটির ‘ধারণ’ অর্থে ব্যবহার পুরাণকারেরা জানতেন না। তাঁরা এই শব্দটিকে ‘আদান’ অর্থাৎ গ্রহণ অর্থে ব্যবহার করে লিখেছেন জগ্রাহ (বিষ্ণুপুরাণ ৪. ১৩• ৪২ পৃঃ ২৯৮)। একমাত্র হরিবংশ লিখেছে ‘ধারয়ামাস’ (১. ৩৯. ১) যাতে ধারণ অর্থ খানিকটা আসে এবং তাতে বুঝি হরিবংশকার প্রাচীন বিবরণ অক্ষুণ্ণ রাখতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় কথা হল-যাস্ক লিখেছেন ‘ইতি অভিভাষন্তে অর্থাৎ অক্রূর সেই মণিরত্নটি ধারণ করেছিলেন ‘এইরকম বলা হয়। অভিভাষন্তে মানে আরও পরিস্কার করে বলা যায়– ‘লোকে বলে’। অর্থাৎ সামন্তক মণির কাহিনী লোকমুখেই প্রচলিত ছিল, এবং সেই লোকপ্রবাদ বা oral traditions থেকেই পৌরাণিকেরা সেই কাহিনী ছন্দোবন্ধে ছড়িয়ে দিয়েছেন। গবেষক সিদ্ধান্ত করেছেন যে, যাঙ্কের উদ্ধৃত পংক্তিটি–’অরো দদতে মমি অবশ্যই আরও পুরানো কোন শ্লোকের একাংশ। এই শ্লোকগুলিকে বলা হয় ‘গাথা, যেগুলি ভীষণ পুরানো বলে গবেষকেরা মানেন। পংক্তিটি শুনলে, অবশ্যই এটিকে একটি ছন্দোবদ্ধ শ্লোকের একাংশ বলেই মনে হয় এবং গবেষকের ধারণা, স্যমন্তক মণির কাহিনীটি যেহেতু বৃষ্ণিবংশীয় সত্রাজিতের প্রসঙ্গেই সবসময় উচ্চারিত তাই এই গাথাটি “might have formed a part of family ballad or the gatha of the Vrsnis which used to be sung on ceremonial occasions.”(১8)
এত কথা আমি এখানে বলতাম না, কিন্তু বঙ্কিম যেমন গুরু গম্ভীরভাবে স্যমন্তক মণি এবং সত্যভামাকেও একেবারে নস্যাৎ করে দিয়েছেন, তাতে সমান গুরুগম্ভীরভাবেই এই প্রসঙ্গ প্রতিষ্ঠা করার দরকার ছিল। যাই হোক আমরা কৃষ্ণ-সত্যভামার প্রসঙ্গে আসি, যদিও এই প্রসঙ্গ শুরু করতে হবে শেষ থেকে। বঙ্কিমচন্দ্র, বিমানবিহারী মজুমদার–সবাই শেষ থেকেই শুরু করেছেন, আমরাও তাই করব। মহাভারতের শান্তিপর্ব খুললে দেখা যাবে- মহাভারতের সূত্রধার নারদের কাছে তাঁর জীবনের দুঃখ-কষ্টগুলি নিবেদন করছেন। তিনি বললেন–এই যে দেখছ আমার জ্ঞাতি-গুষ্টি–এরা সব আমাকে খুব ক্ষমতাশালী বলে মানে, এমনকি মুখে বলে আমি একেবারে ঈশ্বর, কিন্তু আসলে এই জ্ঞাতিদের চাকরের মতই থাকতে হয় আমাকে দাস্যম ঐশ্বর্যবাদেন জ্ঞাতীনাং নু করোম্যহম। ধন-সম্পত্তির যা আদায়-উপায় করি, তার অর্ধেক ভোগ করি আমি, আর সব যায় এই জ্ঞাতিগুষ্ঠির ভোগে এবং আমার লাভ এই যে, তার দরুণ যত গালাগালি আর নালিশ-সব সহ্য করতে হয় আমাকে। অক্রূর বলবে-কৃষ্ণ আহুকের পক্ষ নিয়েছে, আর সেই জন্যে আমাকে দেখতে পারে না। আবার আহুক বলবে-কৃষ্ণ অরের পক্ষ নিয়েছে এবং সেইজন্যেই আমায় দেখতে পারে না। এদের দুবাক্য সব সময় আমার মনের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলছে। লোকে যেমন কাঠের ওপর দিকটা ধরে নীচের দিকটা আগুনে ঢুকিয়ে আগুন জ্বালায়, তেমনি দুবাক্যের কাঠটি আমার হৃদয় দহন করছে। এই যে দাদা বলরাম, তিনি নিজের শক্তিমত্তায় সব সময়েই মেজাজে রয়েছেন, ছোটভাই গদ, (এই ছোটভায়ের জন্যই কৃষ্ণের এক নাম গদাগ্ৰজ) সে সব সময়েই নিজের সুকুমার দেহ নিয়ে ব্যস্ত; আর ছেলে প্রশ্ন- সে নিজের মোহন রূপে নিজেই মত্ত। এ অবস্থায় আমি যে কত অসহায় সে কেউ বুঝবে না। বৃষ্ণি-অন্ধকদের মধ্যে অনেকেই এখন বড় মানুষ, শক্তিমান এবং তাঁরা যে রাজার দলে থাকবে তাদের জয় সুনিশ্চিত আর যাদের দলে নেই তাদের জয় অনিশ্চিত। কিন্তু এদের সাহায্যও আমি কিছু পাই না। আর সবার ওপরে আছে সেই আহুক আর অক্রূরের চিরকালের ঝগড়া, তাদের যে কোন একজনের পক্ষ অবলম্বন করা আমার পক্ষে অসম্ভব, অথচ এই দুজনের মত আত্মীয় যার আছে তার জীবন যে কিরকম দুর্বিষহ, তা তোমায় কি করে বোঝাব নারদ! দুই জুয়াড়ীর এক মায়ের মত আমি একজনের জয় আকাঙ্ক্ষা করি আর অন্যজন যাতে হেরে না যায় তাও চিন্তা করি-সোহং কিতবমাতেব দ্বয়োরপি মহামতে। একস্য জয়মাশংসে দ্বিতীয়স্যাপরাজয়ম।(১৫)
প্রায় বৃদ্ধ বয়সে সম্পূর্ণ সুপ্রতিষ্ঠিত অবস্থায় এই হল কৃষ্ণের মানসিক বিপ্লব। ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই মানসিক অবস্থার জন্য অনেকখানিই দায়ী হল স্যমন্তক মণি এবং সত্যভামা। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বলি। যযাতিপুত্র ক্রোফ্টর গান্ধারী আর মাদ্রী নামে দুই বউ। গান্ধারীর গর্ভে অনমিত্র, আর মাদ্রীর গর্ভে যুধাজিৎ আর দেবমীচুষ। মাদ্রীর ধারায় যুধাজিতের ছেলে বৃষ্ণি এবং তাঁরই নাতি হলেন অর এবং একই ধারায় দেবমীঢুষের ছেলে শূর এবং তাঁর নাতি হলেন কৃষ্ণ। অন্যদিকে গান্ধারীর ধারায় অনমিত্রের ছেলে হলেন নিম্ন এবং তাঁরই নাতনী হলেন সত্যভামা। তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়–
ছবি। পেজ ৯৩
সম্পর্কে সত্যভামা তাহলে কৃষ্ণের সগোত্ৰীয়া বোন এবং তাঁরা একে অপরকে বহু আগে থেকেই চিনতেন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে সত্যভামার যা সম্পর্ক, অরের সঙ্গেও সেই সম্পর্ক। এবারে মূল কথায় আসি।
সত্যভামার বাবা সত্রাজিৎ ছিলেন সূর্যের উপাসক এবং হরিবংশ বলেছে সূর্য নাকি তাঁর সখা প্রাণসমো’ ভবৎ’। একদিন সমুদ্রের তীরে সত্রাজিতের সামনে সূর্যদেব আবির্ভূত হলেন এবং বর চাইতে বললেন। সত্রাজিৎ কিছু চাইলেন না, শুধু সূর্যের গলার মালাখানি চেয়ে বসলেন। সেই মালার মধ্যমণি ছিল স্যমন্তক। সূর্যের কাছে মণিলাভ করে সত্রাজিৎ যখন দ্বারকায় ঢুকলেন তখন সবাই ভাবল আকাশের সূর্যই বুঝি হেঁটে চলেছে ডুয়ে-সূযোয়ং গচ্ছতীতি হ।(১৬) এই উজ্জ্বল স্যমন্তক মণি সত্রাজিৎ যেখান থেকেই পান, এই মণিরত্নের প্রভাব ছিল অলৌকিক। প্রতিদিন এই মণি আট ভার সোনা প্রসব করত, এবং রাজ্যে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, রোগ কিছুই ছিল না এই মণির প্রভাবে। হরিবংশ বলেছে সত্রাজিৎ মণিখানি নিয়ে ভালবেসে নিজের ভাই প্রসেনকে দিলেন কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ তার প্রাচীন গদ্যের ভাষায় জানিয়েছে যে, পাছে কৃষ্ণ এই মণি তাঁর কাছে চেয়ে বসেন, সেই ভয়েই তিনি ভাই প্রসেনের কাছে রেখে দেন। অবশ্য হরিবংশ এবং বিষ্ণুপুরাণ দুটিতেই স্বীকার করেছে যে, এই স্যমন্তক মণির ওপর কৃষ্ণের লোভ ছিল। কৃষ্ণকে মহান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিষ্ণুপুরাণ বলেছে যে, কৃষ্ণ নাকি মহারাজ উগ্রসেনের জন্য এই মণিটির প্রতি সম্পৃহ হয়েছিলেন। কারণ উগ্রসেন যেহেতু রাজা, অতএব মণিটি দেশের রাজারই যোগ্য। হরিবংশে দেখা যাচ্ছে প্রসেনের মণিটি একবার চেয়েও ফেলেছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু যাই হোক তিনি সেটি পাননি, এবং সামর্থ্য থাকলেও তিনি জোরও খাটাননি কেননা তাতে আত্মীয়াবিরোধ হতে পারে–গোত্ৰভেদভয়াচ্চ শক্তো’পি ন জহার।(১৭)
এইটুকুতেই বেশ বোঝা যাচ্ছে যে স্যমন্তক মণির অধিকার নিয়ে গোলমাল রীতিমত পেকে উঠেছিল। এরই মধ্যে প্রসেন করলেন কি মণিটি গলায় দুলিয়ে মৃগয়ায় চলে গেলেন। হরিবংশ এবং পুরাণগুলি তাই বলেছে বটে, তবে আমার দৃঢ়মূল ধারনা যে প্রসেন মণিটি কোথাও রেখে আসবার জন্যেই মৃগয়ার ছল করে কোথাও যাচ্ছিলেন কারণ তিনি ধারণা করেছিলেন যে কৃষ্ণ মণিটি ছিনিয়ে নিতে পারেন। এদিকে বনমধ্যে এক সিংহ প্রসনকে মেরে ফেলে। বৃষ্ণি এবং অন্ধকেরা অর্থাৎ কৃষ্ণের জ্ঞাতিগুষ্ঠি সবাই প্রসেনের মৃত্যুর খবর পেয়ে এই ধারণা করলেন যে, কৃষ্ণ একসময়ে প্রসেনের কাছে মণিটি চেয়েছিলেন, অতএব সুযোগ বুঝে এখন তিনিই প্রসেনকে বনের মধ্যে গুপ্তহত্যা করেছেন–ততো বৃষ্ণন্ধকাঃ কৃষ্ণঃ প্রসেন বধকারণাৎ। প্রার্থনাং তাং মণে বুধ্বা সর্ব এব শশঙ্কিরে। বিষ্ণুপুরাণ বলেছে সমস্ত যদুকুল প্রসেনবধের ব্যাপারে কৃষ্ণকে দায়ী করে কানাকানি করতে থাকল–যদুলোকঃ পরস্পরং কণাকর্ণি অকথয়ৎ।(১৮)
যথাসময়ে সব কৃষ্ণের কানে উঠল। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার তাগিদে তিনি সাড়ম্বরে ঘোষণা করলেন যে ঘটনাস্থল থেকে মণিটি তিনি অবশ্যই উদ্ধার করে আনবেন। এইবারে কৃষ্ণকে আমরা দেখব রীতিমত গোয়েন্দার ভূমিকায়। প্রথমেই তিনি প্রসেন হত্যার অকুস্থলে পৌঁছোতে চাইলেন। যারা পায়ের ছাপ, হাতের ছাপ, সব বোঝে সেই সব লোকেদের সাহায্যে–পুরুষেরাপ্তকারিভিঃ–তিনি প্রথমে প্রসেনের পায়ের চিহ্ন জোগাড় করলেন। চিহ্ন ধরে এগোতে এগোতে শ্রান্ত ক্লান্ত কৃষ্ণ এক পাহাড়ের কাছে এসে দেখেন প্রসেন মরে পড়ে আছে। যদু কুলের জনগণ এবার ভাবল সিংহই প্রসেনকে মেরেছে, কিন্তু মণির কোন হদিশ পাওয়া গেল না। কিছুদূর গিয়ে কৃষ্ণ দেখলেন সিংহটিও মরে পড়ে আছে এবং বিভিন্ন পদচিহ্ন পরীক্ষা করে দেখলেন যে এক ভালুক তাকে মেরেছে। এবার ভালুকের পদচিহ্ন ধরে এগোতে এগোতে ৯৪ একটি গুহার কাছে গিয়ে দেখলেন পদচিহ্ন সেই গুহার মুখে এসেই মিলিয়ে গেছে। বৃষ্ণি-অন্ধকদের সবাইকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে কৃষ্ণ গুহার মধ্যে ঢুকলেন। অর্ধেক ঢুকেই তিনি একটি নারীকণ্ঠের সান্ত্বনাবাণী শুনতে পেলেন। রমণী বলছে–সিংহ প্রসেনকে মেরেছে আবার জাম্ববান সেই সিংহকে মেরে মণি নিয়ে এসেছে এ মণি এখন তোমারই-তব হোষ স্যমন্তকঃ।(১৯)
অল্প সময়ের জন্যে হলেও পাঠক খেয়াল করবেন–হরিবংশ, ব্ৰহ্মপুরাণ এবং বিষ্ণুপুরাণ-এই তিনটি পুরাণেই রমণীমুখের এই সানাবাণীটি অনুষ্ঠুভ ছন্দে লেখা এমনকি বিষ্ণুপুরাণে গদ্যে লেখা কাহিনীটির মধ্যেও এই শ্লোকটি অবিকৃত।(২০) আমরা সন্দেহ করি, এটি সেই প্রাচীন গাথারই কোন অংশ যা লোক-মুখে চলত এবং যা পুরাণকারেরাও বিকৃত করতে সাহস পাননি। যাই হোক এমন স্পষ্ট কথা শুনে কৃষ্ণ গুহার মধ্যে ঢুকলেন এবং জাবানেরসঙ্গে তাঁর যুদ্ধ চলল একুশ দিন। বলরাম এবং অন্যান্য যাদববীরেরা সাত-আটদিন অপেক্ষা করে সপ্তাষ্টদিনানি তস্তু-ফিরে এলেনদ্বারকায়। আপন লোকেরা কৃষ্ণের শ্রাদ্ধশাস্তিও করে ফেলল। এদিকে কৃষ্ণ জাম্ববানকে হারিয়ে মণিরত্ন উদ্ধার করলেন এবং বীরত্বের উপহারস্বরূপ পেলেন জাম্ববানের কন্যা জাম্ববতাঁকে।
পাঠকের ব্যাঘাত হলেও মনে রাখতে হবে কৃষ্ণের মহিষীকুলে জাম্ববতীর স্থান রুক্মিণীর পরেই। বঙ্কিম জাম্ববতাঁকে বিশ্বাস করেন না এবং বিশ্বাস করেন না যে, কৃষ্ণ কোন ভালুকের মেয়েকে বিয়ে করতে পারেন। আমরা বুঝি, জাম্ববান কোন ভালুক নয়, এরা এমন একটি জাতি যারা ভালুকের ‘টোটেম ব্যবহার করত। নইলে রামচন্দ্রের আমলের জাম্ববান কৃষ্ণের আমলে টিকে থাকতেন না। বিশেষতঃ জাম্ববানের গুহাটি বিন্ধ্যপর্বতের পাশে ঋক্ষবান্ পর্বতে। বিন্ধ্যপর্বতের ওপারে ঋক্ষবান পর্বতের নাম শুনেই বুঝি এই লোকগুলির স্থায়ী বসতি ছিল এইখানে, এবং তারা ঋক্ষ অর্থাৎ ভালুকের ‘টোটেম’ ব্যবহার করত। জাম্ববান্ নামটি শুধু তাদের লিডারে’র মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য। এরা অবশ্যই অনাৰ্য্য এবং বিবাহের ব্যাপারে অনাৰ্য্যকন্যা আর্যদের কাছে কোনকালেই নিরানন্দের কারণ ছিল না–তার উদাহরণ দিতে পারি ভূরি ভূরি। জাম্ববতীর কথায় আবার পরে আসব, আপাততঃ আমাদের মূল গোয়েন্দা কাহিনীতে ফিরে আসি।
জাম্ববতীর সঙ্গে স্যমন্তকমণি হাতে কৃষ্ণ দ্বারকায় ফিরলেন। নিজের অপবাদ মোচন করার জন্য মণিটি সবার সামনে সত্রাজিতের হাতে দিলেন, কারণ তিনিই তো মূল অধিকারী দদৌ সত্রাজিতে তং বৈ সর্বসাত্ত্বসংসদি। মণি ফিরে পেয়ে সত্রাজিতের মনে দ্বিগুণ লজ্জা হল। এই মণির জন্য তিনি কৃষ্ণকে লোভী, চোর সবই সাজিয়েছেন। একটু ভয়ও হল। তিনি কৃষ্ণকে খুশি করার জন্য নিজের সুন্দরী মেয়েটিকে কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। সত্রাজিতের মেয়ের নাম সত্যভামা। সত্যভামার বাসররাত্রি থেকেই কৃষ্ণ জীবনে দ্বিতীয় নাটকের শুরু। যে কৃষ্ণ ঘরে-বাইরে প্রায় সুপ্রতিষ্ঠিত, যে কৃষ্ণ তাঁর জ্ঞাতিগুষ্ঠির জন্য এতকাল শুধু করেই গেছেন, তাদেরই হাতে তাঁকে কেমন নাকাল হতে হল, সে নাটক আরম্ভ হয়েছে সত্যভামার সঙ্গে তাঁর বিয়ে থেকেই।
সত্যভামাকে যে কৃষ্ণ বৌ হিসেবে পাবেন, এ তিনি ভাবতেই পারেননি। আত্মীয়তার সূত্রে এই বিদগ্ধা মহিলাটিকে তিনি নিশ্চয়ই আগে থেকেই জানতেন, কিন্তু তালে-গালে ঘটনার চক্রে সে যে কোনদিন তাঁরই গৃহের বধূটি হয়ে আসবে, এ ছিল তাঁর ভাবনার বাইরে। বিশেষতঃ এই “অনিন্দিতা সত্যভামার ওপরে চোখ ছিল অনেকের এবং তাঁরা সবাই কৃষ্ণের আপন ঘরের লোক। সত্যভামার হস্তকামীদের মধ্যে প্রধান ছিলেন অক্রূর।(২১) সত্যভামার ওপরে অক্রূরের যেমন সবসময় চোখ ছিল, তেমনি লোভ ছিল মণিরত্ন সামন্তকের ওপরেও। এই মণি কত সুবর্ণপ্রসব করত সে আলোচনায় লাভ নেই, তবে মণিটির বিক্রয়মূল্য নিশ্চয়ই ছিল সাংঘাতিক, যার জন্য সবারই লোভ ছিল মণিটির প্রতি। সত্যভামার ওপরে অক্রূরের লালসাদৃষ্টির কথা হরিবংশ জানিয়েছে, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণ বলেছে-কৃষ্ণের বহু আগে থেকেই শুধু অর নয়, কৃতবর্মা, শতধম্বা–এইসব যাদব বীরেরাও সত্যভামার হৃদয়-লিন্দু ছিলেন-তাঞ্চ অক্রূর কৃতবর্মশতধন্থ প্রমুখ-দবাঃ পূর্বং বরয়ামাসুঃ। কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার অনেক আগে থেকেই যেহেতু এরা সত্যভামার পিছনে ঘুরঘুর করছিলেন, তাই কৃষ্ণকে অযাচিত কন্যাদানের ফলে এরা সবাই সত্রাজিতের ওপরে ভীষণ ক্ষেপে গেলেন এবং তাঁর সঙ্গে প্রচণ্ড শত্রুতা আরম্ভ করলেন।
অক্রূরের পরিচয় আগেই বলেছি। কৃতবর্মা আর শতধা, দুই ভাই, অন্ধকবৃষ্ণিদের মতই আরেক ধারা ভজমানের বংশে জন্মেছেন। কৃষ্ণ কিংবা অক্রূরের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ। সত্যভামার বিয়ের পর অক্রূর আর কৃতবম ছোটভাই শতধন্বাকে বললেন–এই সত্রাজিৎ হল পাকা বদমাশ–’অতি দুরাত্মা’। আমরা, এমনকি তুমিও ওর মেয়েটিকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে। ও আমাদের তো মেয়ে দিলই না এমনকি তোমাকেও যদি দিত, তাহলেও হত। তোমাকেও দিল না, দিল কৃষ্ণকে–অস্মন্ ভবন্তং চ অবিগণয্য কৃষ্ণায় দত্তবান্। এ অবস্থায় সত্রাজিতের বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই। তাছাড়া নিতান্তই মেয়েটাকে যখন পেলে না, তখন ও ব্যাটাকে মেরে মণিটা নিতে দোষ কি? তুমি বরং সেই চেষ্টা কর–ঘাতয়িত্বনং তন্মহারত্নং ত্বয়া কিং ন গৃহাতে? কৃষ্ণ যদি এ ব্যাপারে বাগড়া দেয়, তাহলে আমরা তোমাকেই সাহায্য করব। শতধম্বা, যিনি হয়তো অক্রূর এবং কৃতবর্মার থেকেও সত্যভামার প্রতি বেশি অনুরক্ত ছিলেন, হয়তো বা এদের থেকে বয়সও তার কম ছিল, তিনি বললেন- ঠিক আছে, তাই
সুযোগও এসে গেল। ঘটনার পটভূমিকাটা এইরকম– দুর্যোধন পাণ্ডবদের বারণাবতে পাঠিয়েছেন জতুগৃহে বদ্ধ করে দন্ধ করার জন্য। জতুগৃহদাহ হয়ে, গেছে এবং আচমকা পাণ্ডবদের মৃত্যুসংবাদ রটে গেলে কৃষ্ণ বারণাবতে পৌঁছোলেন ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য। কৃষ্ণের মাথায় কিঞ্চিৎ গগায়েন্দা বুদ্ধি থাকার ফলে তিনি বুঝতে পারলেন যে পাণ্ডবরা জতুগৃহে দগ্ধ হননি। কিন্তু এদিকে আরেক বিপদ হল। কৃষ্ণের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে শতধা নিদ্রিত অবস্থায় সত্রাজিতকে বধ করে সামন্তক মণি ছিনিয়ে নিলেন। পিতৃহীন, মণিহীন সত্যভামা একাই রথে করে বারণাবতে উপস্থিত হলেন : এই আচরণ সত্যভামাকেই শোভা পায়, রুক্মিণী কিংবা জাম্ববতীর মত কুলবতীরা কৃষ্ণের কাছে কোনদিন এত প্রশ্রয় পাননি যে একা একা রথে করে দ্বারকা থেকে হস্তিনাপুর যাবেন। যাই হোক কেঁদেকেটে সত্যভামা কৃষ্ণকে পিতার মৃত্যুসংবাদ জানালেন এবং জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে তাঁর এই অপমান যে অসহ্য, সে কথাও কৃষ্ণকে বোঝাতে ভুললেন না। এত ঝামেলার মধ্যে স্যমন্তক মণির মূল অধিকারী শ্বশুর সত্রাজিতের মৃত্যুতে কৃষ্ণ মনে মনে খুশিই হলেন কিন্তু মুখে খুব রাগ দেখিয়ে বললেন–এই অপমানের বিহিত আমি করব।(২২)
পাণ্ডবদের মৃত্যুতে অবিশ্বাসী কৃষ্ণ একটি লোকদেখানি শ্রাদ্ধক্রিয়া করলেন বটে কিন্তু সাত্যকিকে বললেন পাণ্ডবদের দগ্ধ মৃতদেহগুলি খুঁজে বার করতে কারণ তাঁর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল পাণ্ডবেরা মরেনি। সাত্যকিকে কর্তব্যকর্মের ভার দিয়ে ব্যস্ত রাজনীতিবিদ দ্বারকায় ফিরেই প্রথমে জপানোর চেষ্টা করলেন বলরামকে। কৃষ্ণ তাঁকে বললেন–সত্রাজিতের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে স্যমন্তক মণি এখন আমাদেরই–স্যমন্তকো মহাবাহো হ্যম্মাকং স ভবিষ্যতি। বাস্তবিক এই কারণেই সত্রাজিতের মৃত্যুসংবাদ শুনেও কৃষ্ণের অন্তরে আনন্দ হয়েছিল এমনকি এখন যে তিনি বলরামকে স্বপক্ষে আনার জন্যেওই মণি এখন আমাদের’-এই বলে গৌরবে বহুবচন ব্যবহার করলেন, তাও তাঁর মনের কথা কিনা কে জানে, কারণ এই নিয়ে পরে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।(২৩)
যাই হোক কৃষ্ণ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে শতধকে মারার চেষ্টা নিলেন। খবরটা ফাঁস হয়ে যেতেই শতধম্বা দাদা কৃতবর্মার শরণ নিলেন। পূর্ব প্রতিজ্ঞা ভুলে কৃতবর্মা কৃষ্ণ এবং বলরামের মত শক্তিধরের বিরুদ্ধে যাবার অসামর্থ্য জানালেন। সময় বুঝে অক্রূরও শতধম্বাকে উল্টো কথা বললেন। আসলে সত্রাজিৎ মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে এদের সত্যভামার ব্যাপারে খানিকটা ক্রোধশান্তি হয়েছিল। তারপরে সত্যভামার একাকী হস্তিনাপুর চলে যাওয়া এবং কৃষ্ণের ক্রুদ্ধ হয়ে দ্বারকায় ফিরে আসা থেকেই কৃতবর্মা আর অরের প্রত্যক্ষ ভীতি সঞ্চার হয়। হরিবংশ অবশ্য বলেছে যে কৃষ্ণের সঙ্গে টক্কর দেবার ক্ষমতা অরের ছিল কিন্তু শঠতা করেই তিনি হৃদিকপুত্র শতধকে সাহায্য করেননি–শক্তোপি শাঠ্যা হার্দিক্যময়ো নাভ্যপদ্যত। শতধন্থা বুঝলেন তাকে বাঁচাতে পারে এমন কোন শক্তি নেই এবং তার মূল ওই মণিটি, যেটা পূর্বে ছিল তিনজনেরই লক্ষ্য। শতধা বললেন ঠিক আছে, তবে মণিটি আপনি রাখুন। অক্রূর মণি নিতে স্বীকার করলেন এই শর্তে যে, প্রাণ গেলেও মণিটি কোথায় আছে তা তিনি কৃষ্ণকে বলবেন না। তাই হল। মণি দিয়ে শতধম্বা ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে চললেন। একই বেগে রথে চড়ে কৃষ্ণ-বলরাম শতধার পিছু নিলেন। এক জায়গায় শতধম্বার ঘোড়া মারা গেল এবং তিনি পায়ে হেঁটেই পালাতে লাগলেন। পথের মাঝে ঘোড়ার মৃতদেহ দেখে কৃষ্ণ-বলরামের রথের ঘোড়াগুলিও বুঝি বা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, তাই কৃষ্ণ তাঁর দাদাকে রথে অপেক্ষা করতে বলে শতধম্বাকে ধাওয়া করলেন পায়ে হেঁটেই, কারণ এতেই সময় বাঁচার কথা। এক সময়ে শতধম্বাকে ধরেও ফেললেন কৃষ্ণ এবং কোন কথা জিজ্ঞেস করার আগেই তাঁকে মেরে ফেললেন। কিন্তু তাঁর শরীর এবং কাপড়-চোপড় আতিপাঁতি করে খুঁজেও তিনি মণিটি পেলেন না। বিফল মনোরথ ফিরে এসে সে কথা যখন বলরামকে জানালেন তখন আরেক বিপদ হল।
বলরাম বললেন–ধি কৃষ্ণ, শত ধিক্ তোমাকে, তুমি এত অর্থপিশাচ। তুমি আজ বেঁচে গেলে শুধু আমার ভাই বলে ধিক্ ত্বাং যমর্থলিঃ। এতচ্চ তে ভ্রাতৃত্বান্ মর্ষয়ে। এই সেই পথ, তুমি মানে মানে চলে যাও, তোমাকে বা তোমার জ্ঞাতি-বন্ধু বৃষ্ণি-অন্ধকদেরও আমার কোন প্রয়োজন নেই। আমি চললাম। ভীষণ ক্রুদ্ধ বলরাম বিদেহ নগরীতে চলে গেলেন। এবং আতিথ্য নিলেন বিদেহদেশের রাজার।(২৪)
পাঠক বোধহয় এতক্ষণে খানিকটা বুঝতে পারছেন যে, মহাভারতে কৃষ্ণ যে দুঃখ করেছেন তার খানিকটা কারণ নিশ্চয়ই আছে। অর, কৃতবর্মা, বলরাম–এইসব যদুবীরদের সঙ্গে কৃষ্ণের যা সম্পর্ক দাঁড়াল তা মোটেই স্বস্তিকর নয়। বিদেহ অর্থাৎ মিথিলাদেশে বলরাম বেশ কিছুদিন ছিলেন এবং সমস্ত পুরাণগুলি একযোগে খবর দিয়ে বলেছে যে ওই সময়েই কুরুরাজ দুর্যোধন বলরামের কাছে গদাশিক্ষার উন্নততর কৌশলগুলি শিখে নেন। এই খবরটি অবিশ্বাস করার কোন কারণ নেই, কেননা একেবারে অন্যরকম একটি গল্পাংশের মধ্যেও এই টুকরো খবরটি সর্বত্র অবিকৃত, এবং এটিও স্বীকৃত সত্য যে দুযযাধন বলরামের কাছে এক সময়ে গদা শিক্ষা করেন। গদার ব্যাপারে বলরামের শিক্ষা দুর্যোধনের কাজে লেগেছে তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, এবং বলরামের শিষ্য বলেই তিনি পরিচিত। যাই হোক, বলরাম থাকলেন মিথিলায়, এদিকে তিন বছরের মধ্যেও যখন এমন কোন লক্ষণ বোঝা গেল না যে, কৃষ্ণই মণিটি নিয়েছেন, তখন উগ্রসেন এবং অন্যান্য বড় বড় যদুবীরেরা বলরামকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ফের দ্বারকায় নিয়ে এলেন।
দ্বারকায় আরও একটি উল্লেখ্য ঘটনা ঘটল। অক্রূর, যাঁর কাছে মণিটি ছিল এবং যা কেউ জানত না, সেই অক্রূর হঠাৎ বড়লোক হয়ে উঠলেন এবং তিনি বিভিন্ন যজ্ঞক্রিয়া আরম্ভ করলেন। তাঁর আকস্মিক এই ভক্তিভাবের মধ্যেও একটা রাজনীতি ছিল, সেটি পরিষ্কার করে দিয়েছে বিষ্ণুপুরাণ। ক্ষত্রিয় যদি যজ্ঞে দীক্ষিত হন তবে তাঁকে মারলৈ ব্ৰহ্মহত্যার পাপ হয়। অতএব যজ্ঞে দীক্ষিত অবস্থায় কৃষ্ণ তাঁকে কোনমতেই প্রাণে বধ করে মণিটি ছিনিয়ে নিতে পারবেন না, এই বিশ্বাসেই অক্রূর একটি যজ্ঞ শেষ করেই আরেকটি আরম্ভ করতে লাগলেন অর্থাৎ এইভাবে যজ্ঞকর্মের ছলে তিনি প্রায় বাষট্টি বছর কাটিয়ে দিলেন–সবনগতৌ হি ক্ষত্রিয়বৈশ্যা নিয়ন ব্রহ্মহা ভবতীতি দীক্ষাকবচং প্রবিষ্ট এব তন্থেী দ্বিষষ্টিবষাণি।(২৫)
বিষ্ণুপুরাণ বলেছে-এরপর অক্রপক্ষের ভোজেরা সাত্ত্বতকুলের একজনকে মেরে ফেলার ফলে অক্রূর ভয়ে দ্বারকা ছেড়ে কিছু আত্মীয়স্বজনকে সঙ্গে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে গেলেন। বিষ্ণুপুরাণ এখানে আরেকটা হত্যাকাহিনীর উল্লেখ করলেও আমাদের ধারণা, হরিবংশের বয়ানমত, শতধম্বার দ্বারা সত্রাজিৎকে গুপ্তহত্যা করবার সঙ্গে সঙ্গেই অক্রূর তাঁর জ্ঞাতি-গুষ্টি কিছু অন্ধকদের সঙ্গে নিয়ে দ্বারকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। কারণ সত্রাজিৎ বধের পরিকল্পনার মধ্যে যে অক্রূর ভালভাবে জড়িত ছিলেন সে কথা অন্তত কৃষ্ণের কাছে লুক্কায়িত ছিল না, এবং তিনি যে তখনই অরকে কিছু বলেননি তার একমাত্র কারণ তাতে জ্ঞাতি-ভেদ সৃষ্টি হত।(২৬) শতধম্বাকে মেরে কৃষ্ণ সত্রাজিৎ-হাকে সোজাসুজি শাস্তি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সমুচিত প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও অক্রূরের গায়ে হাত তুললে যে জ্ঞাতিগুষ্টির মধ্যে গণ্ডগোল বাড়বে, সে কথা কৃষ্ণ ভালই বুঝতে পেরেছিলেন। তাছাড়া, রাজনীতিক হিসেবে অক্রূরও কম প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না, শতধর মৃত্যুর পরেই তাঁকে ঘাঁটানো সমীচীন মনে করেননি কৃষ্ণ। কিন্তু অরকে বাগে পাবার জন্য নানারকম প্যাঁচ তিনি কষেই যাচ্ছিলেন।
হরিবংশ এবং পুরাণগুলি বলেছে যে, অক্রূর দ্বারকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে অনাবৃষ্টি, মড়ক এবং আরও নানা উপসর্গ দেখা দিল। এগুলি নাকি সেই স্যমন্তক মণির প্রভাব। মণিটি যতদিন দ্বারকায় ছিল, ততদিন দ্বারকায় কোন আধিভৌতিক, আধিদৈবিক বিপদ ছিল না, কিন্তু অর মণি নিয়ে চলে যেতেই দ্বারকায় বিপৎপাত শুরু হল। কৃষ্ণ মনে মনে যাই আন্দাজ করে থাকুন, তিনি বৃষ্ণি, অন্ধক এবং ভোজবৃদ্ধদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। এক অন্ধকবৃদ্ধ বললেন–অক্রূরের বাবা শফল্ক যেখানে থাকতেন, সেখানে কোন আধিদৈবিক বিপৎপাত ঘটত না। উত্তরাধিকারসূত্রে অরেরও নাকি এই গুণ আছে। অতএব সবাই মত প্রকাশ করলেন অঙ্কুরকে রাজ্যে ফিরিয়ে আনা হোক এবং তাও একেবারে বিনা প্রশ্নে, বিনা শর্তে-তদয়মানীয়তামিতি, অলমতিগুণবতি অপরাধান্বেষণেন ইতি।(২৭)
পারিবারিক রাজনীতির খেলাতেও কৃষ্ণ যে কত ধুরন্ধর তা বোঝা যাবে এই সময়ে। বৃষ্ণি-অন্ধকদের কথা মেনে নিয়ে তিনি নিজে, উগ্রসেন, বলরাম সহ অক্রূরের কাছে গিয়ে তাঁকে সমস্ত অভয় দিয়ে ফিরিয়ে আনলেন দ্বারকায়। অর যখন দ্বারকা ছেড়ে পালালেন, কৃষ্ণ তখনই বুঝেছেন যে মণিটি অক্রূরের সঙ্গে চলে গেছে। কৃষ্ণ জানতেন, একটার পর একটা যজ্ঞ করা সাধারণভাবে অকূরের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কেননা তাঁর রেস্ত অত ছিল না–অপ্পোপদানঞ্চাস্য। অক্রূর দ্বারকায় ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারকার সমস্ত বিঘ্ন শান্ত হয়ে গেল। কৃষ্ণ এবার নিশ্চিতভাবে বুঝলেন যে স্যমন্তক মণি অকূরের কাছেই আছে। ঠিক এই সময়ে কৃষ্ণ নিজের বাড়িতে যাদবদের এক সভা ডাকলেন। নির্ধারিত সময়ে কৃষ্ণ যাদবদের কাছে তাঁর সভা ডাকার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে বলে দিলেন। এরপর অঙ্কুর এসে পৌঁছেলে কৃষ্ণ তাঁর সঙ্গে খানিক হাস্য পরিহাস করেই আসল কথা পাতলেন। তিনি বললেন-আমি জানি শতধা পালানোর আগে স্যমন্তক মণিটি দিয়ে গেছে আপনার কাছেই। না, না, আপনার সঙ্কুচিত হওয়ার কোন কারণ নেই, মণিটি আপনার কাছেই থাকুক। মণির যে সুফল তা তো আমরা সবাই পাচ্ছি। আমার বক্তব্য শুধু একটাই–আমার দাদা বলরাম সন্দেহ করেন যে মণিটি আমি লুকিয়ে রেখেছি। আমাকে শুধু এই সন্দেহ এবং অপবাদ থেকে মুক্ত করার জন্য মণিটি একবার তাঁকেই দেখান–কিন্তু এষ বলভদ্রো’স্মান আশঙ্কিতবান। তদম্মপ্রীতয়ে দর্শয়… (২৮) দয়া করে আপনি অভদ্র ব্যবহার করবেন না। আজকে প্রায় ষাট বচ্ছর হয়ে গেল, আমি মণিটির জন্য ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। পূর্বেকার সেই রাগ হয়তো এখন চলে গেছে, কিন্তু তবু সেই রাগ মনের মধ্যে এখনও ধিকিধিকি জ্বলছে বৃষ্টিবর্ষে গতে কালে যদুরোমো’ভূন মমানঘ। স সংরূঢ়ো’সকৃৎ প্রাপ্তস্ততঃ কালাত্যয়ো মহান ॥(২৯)
উপায়ান্তর না দেখে অক্রূর মণিহরণের কথা স্বীকার করলেন এবং মণিটি দেখালেনও বটে। নানা ওজর তুলে তিনি বললেন–শতধর মৃত্যুর পর আমি ভেবেছিলাম মণিটি আপনি চেয়ে নেবেন। আপনি আজ নেন কি কাল নেন এই ভেবে আমিই মণিটি এতকাল ধারণ করেছিলাম–এতাবন্তং কালম্ অধারয় (পাঠক যাঙ্কের উদ্ধৃতিটি খেয়াল করবেন, সেখানে ‘ধারয়তি’ অর্থে ‘দদতে’ প্রয়োগ আছে-অক্রাে দুদতে মণিম্। আমি নিজেও এর জন্য বহু যন্ত্রণা সহ্য করেছি, নিশ্চিন্তে কোন সুখভোগও করতে পারিনি। এখন আপনি নিজে এই মণি গ্রহণ করে আমায় মুক্তি দিন। ইচ্ছে হলে অন্য কাউকে দিন-তদিদং স্যমন্তকরত্নং গৃহ্যােম্, ইচ্ছয়া যস্যাভিমতং তস্য সমপ্যতাম্। এই বলে মণিটি বার করে সবার সামনে রাখলেন।
হরিবংশ বলেছেকৃষ্ণ নিজে অপবাদমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তুষ্ট হলেন এবং মণিটি অক্রূরকে আবার ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বিষ্ণুপুরাণ ভেতরের কথাগুলি ফাঁস করে দিয়েছে। বিষ্ণুপুরাণ বলেছে–অর মণিটি কৃষ্ণের হাতে দিতেই বলরাম ভাবলেন–শুধু কৃষ্ণ কেন আমিও এই মণির সমান অংশীদার–মমায় অচতেনৈব সামান্যঃ সমন্বীতিঃ –অতএব তিনি মণির ব্যাপারে কিঞ্চিৎ লালায়িত হলেন। কৃষ্ণমহিষী সত্যভামা ভাবলেন–এ আমার বাপের ঘরের জিনিস, বাপের সম্পত্তি মেয়েই পাবে-মমৈবেদং পিতৃধনমিতি, অতএব তিনিও মণিটি পেতে ইচ্ছা করলেন। এই অবস্থায় কৃষ্ণ একবার বলরামের মুখে চান, আরেকবার সত্যভামার মুখে, শেষে নিজের ঘরেই বিবাদ ডেকে আনার চেয়ে মণিটি তিনি অরকেই রাখতে দিলেন, কারণ তাতেই রাজ্যের উপকার, সবার উপকার।(৩০) দীর্ঘ ষাট বছর ধরে স্যমন্তকমণির অধিকার নিয়ে যে বিবাদ চলেছিল, কৃষ্ণের প্রায় বৃদ্ধবয়েসে সেই বিবাদ সম্মানজনক ভাবে মিটল। মহাভারতের মধ্যে কৃষ্ণ যে আক্ষেপ করেছিলেন, তার সমাধান হল এতদিনে। তবে একটা কথা এখানে বলতে হবে। মহাভারতের মধ্যে আহুক আর অক্রূরের যে ঝগড়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তার বোধহয় কোন সূত্র এখানে পাওয়া গেল না। যে আহুক কংসপিতা উগ্রসেনেরও পিতা, তাঁর সঙ্গে অক্রূরের বিবাদ–এটা হতে পারে না। আবার বিমানবিহারী মজুমদার মশায় আরেক আহুকের কথা বলেছেন, যার একশত বলবান পুত্র ছিল এবং যার সম্বন্ধে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে ভরসা দিয়েছিলেন যে, দুর্যোধনের সঙ্গে বিবাদে এই আহুক যুধিষ্ঠিরের পক্ষে লড়বেন। কিন্তু জিজ্ঞাসা হল এই আহুকের সঙ্গে অক্রূরের কোন বিবাদের কথা তো মহাভারত হরিবংশ কিংবা পুরাণে কোথাও নেই। কাজেই এ ব্যাপারটি একটু অন্যভাবে ভাবতে হবে। সকলেই লক্ষ্য করেছেন–কৃষ্ণ, বলরাম, অক্রূর, কৃতবর্মা–এইসব মানুষদের অনেকেই তাঁদের পূর্বতন বংশকার, ঊর্ধ্বতন পুরুষদের নামে পরিচিত ছিলেন–যেমন বৃষ্ণি, অন্ধক ইত্যাদি। রামায়ণের রামচন্দ্রকে অনেকেই ডেকেছেন রঘু বলে। আবার দেখেছি অনেকে যেমন বহু পূর্বতন পুরুষের নামে নিজের পরিচয় দিতেন, তেমনি অল্প পূর্ববর্তী বংশকারের নামেও পরিচয় দিতেন, যেমন একই নোক কখনও অন্ধক বলে, কখনও বা কুকুর বলে; এমনকি অব্যবহতি পূর্বপুরুষের নামেও পরিচয় চলত যেমন, শূরের ছেলে বসুদেব অনেক সময়ই শূর বলেও পরিচিত। আমার বক্তব্য হল স্যমন্তক মণিটি কৃষ্ণ মূলত চেয়েছিলেন দেশের রাজা উগ্রসেনের জন্য এবং উগ্রসেনের পিতা হলেন আহুক। আহুক নিজে যথেষ্ট বিখ্যাত ছিলেন এবং আহুক বলতে এখানে উগ্রসেনকেই বোঝানো হচ্ছে।
আমি যে ঠিক বলছি কিংবা আহুক বলতে উগ্রসেনকে ইঙ্গিত করার একটা ধারা যে দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত টিকে ছিল তার প্রমাণ দেবেন ভাগবত পুরাণের সবচেয়ে পুরানো টীকাকার শ্রীধরস্বামী। যদুবংশ ধ্বংসের নিমিত্তমাত্র যে মুষলটি কৃষ্ণপুত্র সাম্ব প্রসব করেছিলেন সেই মুষলটি ভেঙে ফেলেছিলেন আহুক যাকে শ্রীধরস্বামী বলেছেন “আহুক উগ্রসেনঃ” (শ্রীমদ্ভাগবতম ১১. ১. ১৯ শ্রীধরস্বামীর টীকা)। অক্রূর কংসের রাজসভায় মন্ত্রী ছিলেন এবং অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতাও বটে। কংসের মৃত্যুতে মথুরার নেতৃত্ব উগ্রসেনের হাতে চলে যায় এবং অরের প্রভাবও কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয় নিশ্চয়ই। কৃষ্ণ সবসময়ই উগ্রসেনের স্বার্থরক্ষা করে চলেছেন ঠিকই, কিন্তু অক্রূরকেও তিনি অবহেলা করেননি। এমনকি উগ্রসেনকন্যার সঙ্গে অরের বিবাহব্যবস্থাও কৃষ্ণই করেন। কিন্তু কংসের মৃত্যুর পর হতপ্রভাব অক্রূরের সঙ্গে শ্বশুর উগ্রসেনের একটা ক্ষমতার ঠাণ্ডা লড়াই চলছিলই। এই লড়াইতে কৃষ্ণ আর কি করবেন, মহাভারতের বয়ান মত, তিনি চেয়েছেন-উগ্রসেনেরই যেন জয় হয় আবার অক্রূরও যেন একেবারে পরাজিত না হন। এরই মধ্যে স্যমন্তক মণির ঘটনা। ঘটনারম্ভের ষাট বছর পরে স্যমন্তকমণিটি অরের কাছেই ফিরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ বলেছেন–আপনার কাছে যদি মণিটি থাকে তবে এই মথুরারাজ্যেরই উপকারত্বস্থঞ্চাস্য রাষ্ট্রস্যোপকারকং–আপনার কাছেই মণিটি থাকবে। এইভাবেই বৃহত্তর স্বার্থে রাজ্যোপকারের অছিলায় কৃষ্ণ হয়তো আহুক উগ্রসেন আর অক্রূরের ঠাণ্ডা লড়াই বৃদ্ধ বয়েসে হলেও খানিকটা মেটানোর চেষ্টা করেছিলেন। অঙ্কুর মণিরত্ন পূর্ববৎ ধারণ করলেন, আর বিষ্ণুপুরাণ বলল-তথেতি উক্ত জুগ্রাহ তন্মহামণিরত্ন, যাকে অতিপ্রাচীন ভাষায় যাস্ক বলেছিলেন অঙ্কুরো দদতে মণিম্। শেষের এই সুদিনের কথা পুরাণকারেরা যতই বর্ণনা করুন না কেন, এই স্যমন্তক-মণিটি যে প্রথম অক্রূর শঠতার মাধ্যমেই নিজের কাছে রেখেছিলেন, সে কথাটা বেশ চালু হয়ে গেছিল। তৃতীয়-চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই একটি বিখ্যাত নাটক কিংবা কাব্য লেখা হয়ে গিয়েছিল, যার নাম ছিল মণিহরণ’। এই গ্রন্থটি আজ হারিয়ে গেছে। কিন্তু আশ্চর্য হল, এই কাব্যনাটক গ্রন্থটি সনাতন ঐতিহ্যবাহী গ্রন্থপঞ্জী থেকে বাদ গেলেও একেবারে বিপরীতধর্মী বৌদ্ধ আচার্যরা কিন্তু অত্যন্ত সম্মান করে তার উল্লেখ করেছেন। বৌদ্ধ আচার্য স্থিরমতি, যিনি অসঙ্গ অথবা বসুবন্ধুর শিষ্য, তিনি ‘মহাযান’ নামে একটি গ্রন্থের নাম এবং গ্রন্থােপনিবদ্ধ বিষয়ের তাৎপর্য বোঝনোর জন্য দুটি সনাতনপন্থী বিখ্যাত গ্রন্থের উদাহরণ দেন এবং সেই দুটিই কৃষ্ণের জীবন সংক্রান্ত। একখানি তো কংসবধ’, যার উল্লেখ মহর্ষি পতঞ্জলি পর্যন্ত করেছেন, আরেকটি হল এই মণিহরণ’ যা অবশ্যই এই স্যমন্তক মণি বিষয়ক কাব্য কিংবা নাটক।(৩১)
অক্রূরের কৃতকর্মের বিচার থেকে আমরা একে মণিধারণই বলি আর মণিহরণই বলি, আমরা কিন্তু লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষকে বড় করে ফেলেছি অর্থাৎ সত্যভামার থেকে স্যমন্তককে বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। বাস্তবিকপক্ষে কৃষ্ণ-সত্যভামার বিবাহিত জীবনের ষাট বছর যদি চলে না যেত তাহলে যে সভায় স্যমন্তক মণি সর্বসমক্ষে কৃষ্ণের হাতে দেওয়া হল এবং যে মণির প্রতি সত্যভামার সম্পূহ কটাক্ষ নিক্ষিপ্ত হয়েছে, এই কটাক্ষকে অবহেলা করে কৃষ্ণের পক্ষে আর মণি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হত না। এই স্ফুরিতাধরা রমণীটিকে কৃষ্ণ যে কি পরিমাণ সমঝে চলতেন তা বলে বোঝাবার নয়। সত্যভামার অজস্র রূপ-গুণ মুগ্ধ ভক্তদের ফাঁকি দিয়ে কৃষ্ণ সত্যভামাকে পেয়েছিলেন জীবনে।
কৃষ্ণ এ সৌভাগ্য জীবনেও ভুলতে পারেননি। এমনকি চৈতন্যযুগের আলঙ্কারিকরা পর্যন্ত বলেছেন-রুক্মিণী কৃষ্ণের বিনীতা প্রেয়সী বটে কিন্তু সত্যভামার সৌভাগ্যই বেশি–সত্যভামোত্তমা স্ত্রীণাং সৌভাগ্যে চাধিকাভবৎ। আমরা বলি সৌভাগ্য কৃষ্ণেরই, সারাজীবন ধরে সত্যভামার অজস্র আবদার তামিল করেছেন কৃষ্ণ। একমাত্র তিনিই পেরেছেন অন্তঃপুর ছেড়ে একা একা কৃষ্ণের সঙ্গে সেই বারণাবতে দেখা করতে যেতে। নরকাসুরকে বধ করবার সময় তিনি কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত গেছেন। গরুড়বাহনে দুজনের ভাল করে জায়গা হয় না, তো কি, কৃষ্ণ তাঁকে প্রায় কোলে করেই নিয়ে গেছেন–অঙ্কে নিধায় দয়িতামিহ সত্যভামা।(৩২) তাঁর জন্য স্বর্গের ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। স্বর্গের নন্দনকাননের বুক থেকে ফুটন্তু পারিজাত ছিঁড়ে এনে লাগাতে হয়েছে সত্যভামার চুলে। কেন? সত্যভামা স্পষ্ট কথায় জানিয়ে দিয়েছেন–সতীনদের মনে ঈর্ষার জ্বালা ধরবে, তাদের মধ্যে এই ফুল মাথায় খুঁজে আমি সগর্বে ঘুরে বেড়াব–বিভ্রতী পারিজাতস্য কেশপক্ষেণ মঞ্জরী। সপত্নীলাম্ অহং মধ্যে শশাভেয়মিতি কাময়ে। আর সত্যভামার এই সব আবদার যদি না শোনা যায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঠোঁট দুটি যাবে ফুলে, অনুযোগ করে তিনি বলবেন-মিথ্যে কথা, সব মিথ্যে, তুমি না বলেছ কৃষ্ণ, রুক্মিণী, জাম্ববতী কেউ আমার তত প্রিয় নয়, যেমনটি তুমি–ন মে জাম্ববতী তাদৃগ অভীষ্টা ন চ রুক্মিণী।(৩৩) সত্যভামা এখানেই থামলেন না। বললেন—
এ কথা যদি নিছক চাটুবাক্য না হয় তাহলে এই পারিজাত বৃক্ষ তুলে নিয়ে যেতেই হবে দ্বারকায়, আর সেই ফুল খোঁপায় খুঁজে আমি সতীনদের মনে জ্বালা ধরিয়ে দেব। শেষ পর্যন্ত সত্যভামার কথা ফেলতে না পেরে দেবরাজের সঙ্গে এক বিরাট যুদ্ধ লাগিয়ে দিলেন কৃষ্ণ। অন্যদিকে ইন্দ্রেরও বলিহারি যাই। তিনিও শচীর কথায় ওঠ-বোস করে, ক্রোধান্বিত হয়ে চলে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। অলঙ্ঘ্য নিয়মে যুদ্ধের ফল কৃষ্ণের স্বপক্ষে গেল। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে রসরাজ কৃষ্ণের যখন বোঝাপড়া হয়ে গেল তখন কিন্তু বিগলিত হয়ে আসল কথাটি স্বমুখেই ফাঁস করেছেন কৃষ্ণ, বলেছেন এত সব যুদ্ধ-বিগ্রহ-তার কারণ স্ত্রীর বচন–সত্যা বচন-কারণাৎ। সত্যভামার আদরের নাম–সত্যা।(৩৪)
সতীনকাঁটা বলতে যা বোঝায়, সত্যভামার কাছে তাঁরা দুজন হলেন জাম্ববতী, আরেকজন রুক্মিণী। কৃষ্ণের আর যেসব স্ত্রী ছিল, তাদেরকে সত্যভামা বোধহয় পাত্তাই দিতেন না, ভাবে বুঝি কৃষ্ণও তাঁদের খুব একটা পাত্তা দিতেন না, না হলে সদা মানিনী সত্যভামার মুখে তাদের নাম বাদ পড়ার কথা নয়। আরেক কথা, রুক্মিণী এবং জাম্ববতীর বিয়ে যেহেতু সত্যভামার আগেই হয়েছিল, তাই সত্যভামার ঈষা ছিল প্রধানত এই দুজনের ওপরেই। সত্যভামার সঙ্গে বিয়ে হবার পরেও কৃষ্ণের অন্য স্ত্রীদের প্রভাব কৃষ্ণের ওপরে থাকবে এটা সত্যভামা বিশ্বাস করতেন না। সত্যি কথা বলতে কি, বিশ্বাস না করার কারণও আছে। রুক্মিণী এবং সত্যভামা বাদে আর যিনি কৃষ্ণের মনে প্রেমের মন্ত্র গুঞ্জরণ করতেন, তিনি বোধহয় জাম্ববতী। জাম্ববতী হয়তো ছিলেন কোন অনার্যজাতির মেয়ে, যারা ‘টোটেম হিসেবে ব্যবহার করত একটি ভল্লুককে। হরিবংশ জাম্ববতীর বাবাকে চিনিয়েছে ভল্লুকদের রাজা বলে কিন্তু মহাভারত জাম্ববতাঁকে বলেছে ‘কপীন্দ্রপুত্রী বলে, তার মানে বানর রাজার মেয়ে। ভালুক কিংবা বানরের গবেষণা না করেও বোঝা যায় যে, জাম্ববতী ছিলেন অনার্যপ্রসূতা,–আর্যদের অপ্সরী-কিন্নরী বিয়ে করা মিষ্টি-মুখে হয়তো এই অনার্যরমণীরাই তেতুলের কাজ করতেন। তাই জাম্ববতীও কৃষ্ণের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন। শিলালিপিগুলির মধ্যে প্রথম যেটিতে কৃষ্ণমহিষীদের কথা পাই সেটি হল চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের তুসমের প্রস্তরলিপি। পাটরানী রুক্মিণী নয়, মানিনী সত্যভামা নয়, কৃষ্ণ এখানে বর্ণিত হয়েছেন জাম্ববতী নামে যে কমলিনী তার মধুকর হিসেবে।(৩৫) এই একটিবার মাত্র জাম্ববতীর সৌভাগ্য উদয় হয়েই যেন অস্তাচলের শেষরেখাঁটির মত তুসম পাহাড়ের ফলক-খানি রাঙিয়ে দিল। কৃষ্ণ যে মধুকর, উদ্ধবের কাছে গোপীরাও তাই বলেছে, পাহাড়ে খোদাই করা লিপিও তাই বলে। আসলে রুক্মিণী আর সত্যভামাকে বিয়ে করে কৃষ্ণ যে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চেয়েছিলেন, সেটি সফল হয়নি। রুক্মিণীর জন্য শিশুপাল, জরাসন্ধের ঝামেলা যেমন বেড়েই চলল, তেমনি সত্যভামা আর তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি স্যমন্তক মণি নিয়ে সমগ্র যাদবকুলের মধ্যে গোলমাল বেধেই রইল। বিয়ে করে যেখানে সুবিধে হওয়ার কথা, সেখানে ঘরে-বাইরে নানা অসন্তোষ বেড়েই চলল। তবু কৃষ্ণ আরও কিছু বিয়ে করে ফেললেন, যদিও সেই বিবাহিতা রমণীদের নাম সম্বন্ধে হরিবংশ দু-জায়গায় দুরকম লিস্টি দিয়েছে, বিষ্ণু পুরাণের সঙ্গেও সে লিস্টির পুরোপুরি মিল হয় না। বেশ বোঝা যায় এই সব স্ত্রীরা কৃষ্ণের অন্তঃপুরের শোভামাত্র, এরা কোনদিনই কৃষ্ণের হৃদয় অধিকার করতে পারেননি। আর ছিল সেই ষোল হাজার একশ মহিলা, যাঁদের মধ্যে অপ্সরী, দেবী, মানুষী সবাই ছিলেন।
হরিবংশ, বিষ্ণুপুরাণ এবং অন্য সমস্ত পুরাণগুলো একবাক্যে স্বীকার করেছে যে এই ষোল হাজার একশ মহিলাকে আসামের রাজা নরকাসুর বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে এনেছিলেন। ভাবীকালে কৃষ্ণের সঙ্গে বিয়ে হবে বলে পুরাণকারেরাও এই যুবতীদের একেবারে একবেণীধরা সতী বলে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণ যখন বিজিত এবং মৃত নরকাসুরের ধনসম্পত্তি দ্বারকায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছায় আসামের মণি পর্বতে ঢুকলেন, তখন হরিবংশকার যেভাবে বর্ণনা দিয়েছেন তা বড়ই অদ্ভুত। কৃষ্ণ ঢুকেই দেখতে পেলেন সেখানে রক্ষিত আছে সেই সব মেয়েরা, যারা গন্ধর্ব এবং অসুরমুখ্যদের বড়ই প্রিয়–গন্ধবাসুর-মুখ্যানাং প্রিয়া দুহিতরস্তথা। গন্ধর্ব এবং অসুরদের ব্যক্তিগত ন্যায়নীতি বোধ সম্বন্ধে অন্যত্র পুরাণকারদের মতামত মোটেই অনকূল নয়, কিন্তু তাদের মেয়েদের নাকি নরকাসুর একটুও বিরক্ত করেননি এবং তাঁরা নাকি সব কাম-টামের ব্যাপার একেবারে বর্জন করে দেবীর মত সুখে বাস করছিলেন–সুখিনঃকামবর্জিতাঃ। নরকাসুর লোকটা খুব ভালো বলতে হবে, যিনি শুধু ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ সুন্দরী সুন্দরী মহিলাদের দূর দূরান্ত থেকে চয়ন করে আনতেন। কিন্তু কৃষ্ণের ব্যবহারটি দেখুন এতগুলো সুন্দরী মেয়ে দেখে তাঁর অন্য কোন প্রত্যঙ্গ সৌন্দর্য নজরে পড়ল না, তিনি দেখলেন–দদর্শ পৃথুলশ্রোণী সংরুদ্ধা গিরিকরে। এতগুলি স্কুলনিতম্ববতী মেয়ে এক সঙ্গে দেখে কৃষ্ণ নিশ্চয়ই বোকার মত দাঁড়িয়ে ছিলেন না; বরঞ্চ অভিজ্ঞ পুরুষটি যখন দেখলেন সব মেয়েগুলিই এক সঙ্গে তাঁকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিল, সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বর এবং অভয় দুটিই তাঁদের দান করলেন।
হরিবংশ কিংবা পুরাণগুলি নরকাসুরের আনা এই কন্যাগুলির কুলশীলের কোন পরিচয় দেয়নি, তবে এদের চরিত্র যে একেবারে ঘূতশুদ্ধ ছিল না, তা নানা কারণেই মনে হয়। এ বিষয়ে বরাহ পুরাণ এবং সাম্ব পুরাণ–এ দুটিই আমাদের সাক্ষী দেবে। আমি আগেই বলেছি রুক্মিণী জাম্ববতী এবং সত্যভামা–এই তিনজনের ভালবাসাতেই আঁধার-আলোয়, ভাল-মন্দে কৃষ্ণের দিনগুলি কেটে গেছে। অন্যদিকে এই তিনজনই কৃষ্ণের শত মধুকরবৃত্তি ক্ষমা করেও স্বামীর অনুরক্তা। কিন্তু আর যাঁরা–সে মিত্ৰবিন্দাই হোক কি নাগজিতী, সে ভদ্রা, কালিন্দীই হোক কি রোহিণীরা কেউই কৃষ্ণের প্রতি সুনিষ্ঠ ছিলেন বলে মনে হয় না, নরকাসুর সঞ্চিতা পৃথুলশ্রোণীদের কথা তো বাদই দিলাম। মহাভারতকার বলেছেন যখন বৃষ্ণি অন্ধক বংশ ধ্বংস হয়ে গেল, কৃষ্ণবলবাম লোকান্তরিত হয়েছেন, তখন অর্জুন দ্বারকায় গেছিলেন বৃষ্ণি-স্ত্রীদের রক্ষা করতে। আমার ধারণা বৃষ্টি নয়, তাঁরা কৃষ্ণেরই স্ত্রী এবং সংখ্যায় তাঁরা ছিলেন সহস্র। যখন পুরোদমে লুঠতরাজ চলছে তখন অর্জুন দস্যুদের পেছনে একটা নিষ্ফল ধাওয়া করলেন। মহাভারত জানাচ্ছে সেই হাজারো স্ত্রীলোকের মধ্যে অনেককেই দস্যুরা টেনে নিয়ে গেল অর্জুনের সামনেই আর অনেকে ইচ্ছে করেই কামবশত দস্যুদের সঙ্গে চলে গেল–সমস্ততোবকৃষ্যন্ত কামাচ্চান্যাঃ প্রবজুঃ।(৩৬) এরা নাকি পঞ্চনদী অঞ্চলের দস্যু আভীর জাতের মানুষ–আভীরৈরপমৃত্যাজৌ হৃঃ পাঞ্চনদালয়ৈঃ। (৩৭)
এই যে সহস্র-স্ত্রীলোকেরা ইচ্ছে করে দস্যদের সঙ্গে পালিয়ে গেল, হিসেব কষলে তাদের বয়স তখন কম হবে না, কিন্তু সেই বয়সেও যে তাদের ভোগবাসনার বীজ লুপ্ত হয়নি, তা তো প্রমাণ হয়েই গেল। আমাদের ধারণা এই সব কটি স্ত্রীলোকই সেই নরকাসুরের ঘর থেকে আনা, যাদের দিকে চোখ পড়লে হরিবংশকার পর্যন্ত আর কিছুই দেখতে পান না, শুধু খেয়ালে আসে ‘পৃথুলশ্রেণীঃ। খুব সম্ভব এরাই পালিয়ে ছিলেন নিজের ইচ্ছেয়, আর এরা যে সব কৃষ্ণেরই স্ত্রী ছিলেন তার প্রমাণ দেবে সাম্ব পুরাণ। তবে তার আগে বরাহ পুরাণের কথাটা বলি, সাম্বের প্রসঙ্গ সেখানেও আসবে।
সাম্ব হলেন জাম্ববতীর ছেলে, তাঁর মত সর্বাঙ্গসুন্দর পুরুষ তাঁর যুগে দ্বিতীয়টি ছিল না। হরিবংশ বলেছে, যে বছরে রুক্মিণীর ছেলে প্রদুম্নকে সম্বরাসুর ধরে নিয়ে গেল সেই বছরেই সাম্বের জন্ম। জন্মের পর থেকেই সাম্ব যে জন্য বিখ্যাত, সে হল তার রূপ। বরাহ পুরাণের মতে নারদ কৃষ্ণকে জানালেন যে তাঁর মোল হাজার স্ত্রীই সাম্বের রূপে মত্ত। সাম্ব এবং এই স্ত্রীদের অবৈধ আচার-আচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে নারদ সেই কুৎসা ব্ৰহ্মলোকে থেকেও শুনতে পেয়েছেন। নিজেরই ঔরসজাত পুত্র, কি করেই বা পরীক্ষা করা যায়? শেষ পর্যন্ত নারদের কথার সত্যতা যাচাই করতে কৃষ্ণ সাম্বকে উপস্থিত হতে বললেন তাঁর আপন খ্রীমণ্ডলীর মধ্যে। কৃষ্ণ সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন যে সাম্ব এলেন, দেখলেন এবং তাঁর আপন স্ত্রীদের জয় করলেন।(৩৮)
সাম্ব পুরাণে, নারদ যে কৃষ্ণের কান ভাঙাচ্ছেন তার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল। সাম্ব নাকি নিজের রূপ-যৌবনে মত্ত হয়ে সর্বদাই ক্রীড়া করে বেড়াতেন এবং নারদকে যথেষ্ট ছেদ্ধা-ভক্তি করতেন না। এতে নারদ রুষ্ট হয়ে ভাবলেন সাম্বকে উচিত শিক্ষা দেবেন-করিয্যে বিনয়ং ভূশম্। নারদ কৃষ্ণকে বললেন–আপনার ষোল হাজার বৌ তো বটেই এমনকি আপনার পত্নীরাও মানে রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী ছাড়া, আর সবারই মন পড়ে আছে সান্তের কাছে–সবার্সং চ মনাংসি আসাং সাম্বেন কিল কেশব।(৩৯)
নারদ কৃষ্ণকে বললেন–এই কথাটা বলা আমার ভুল হল, কিন্তু বলা উচিত বলে বললাম। ব্যাপারটা চলছিলই, কৃষ্ণের অগোচরে। গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী কৃষ্ণকে এতদিন কেউ বলার সাহস পাননি। কিন্তু সংসারের এই অপবাদ ব্ৰহ্মলোকে না হোক লোকমুখে চলছিলই। নারদ সে কথাটা কৃষ্ণকে জানিয়েছেন মাত্র। সত্যান্বেষীর মত কৃষ্ণ এখানে নারদকে বিশ্বাস করেননি প্রথমে। তারপর যখন সস্ত্রীক ক্রীড়া করবার সময় সাস্থ সেখানে উপস্থিত হলেন, তখন কৃষ্ণ দেখলেন তাঁর স্ত্রীদের অবস্থা খুবই খারাপ। এমনকি সাম্বকে দেখে–যোষিতাম্ অল্পসত্বানাং যোন্যঃ শীঘ্রং প্রসুবুঃ। সাম্ব পুরাণ অবশ্য বলেছে কৃষ্ণস্ত্রীরা সে সময় প্রচুর মদও খেয়েছিল এবং তাতে কৃষ্ণের রাগটা আরও বেড়ে গিয়েছিল। একটি শাপে সাম্বকে কৃষ্ণ-পরিণত করলেন এক কুষ্ঠরোগীতে। আর পত্নীদের তিনি বললেন–স্বামী থাকা সত্ত্বেও তোমাদের মন যখন অন্য জায়গায় পর পুরুষে ধরেছে- যম্মাদ ধৃতানি চেংসি মাং মুক্তান্যত্র বঃ খ্রিয়ঃ–তখন আমার লোকান্তরের পর তোমরা পতিলোক প্রাপ্ত হবে না এবং অরক্ষিত অবস্থায় দুস্যহস্তে পতিত হবে।(৪০)
সাম্ব পুরাণে বসিষ্ঠ’ এই গল্প বলে নিজে মন্তব্য করলেন হরির এই শাপেই তাঁর স্ত্রীরা অর্জুনের সামনেই পঞ্চনদীয় দস্যুদের দ্বারা অপহৃত হয়েছিলেন। তাহলে মহাভারতের সেই সহস্র সকামা রমণীদের সম্বন্ধে আমাদের যে অনুমান ছিল বসিষ্ঠ সেই মতের পরিপোষণা করলেন। কৃষ্ণের শাপের আওতা থেকে বাদ পড়েছিলেন তিনটি মাত্র রমণীরুক্মিণী, জাম্ববতী এবং সত্যভামা– মুক্লা তিঃ পতিব্রতাঃ। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, কৃষ্ণের অন্য পাঁচ প্রধানা মহিষীও বাসনার দূষণমুক্ত ছিলেন না অথবা কৃষ্ণও তাঁদের স্ববশে রাখতে পারছিলেন না।
কৃষ্ণ বশে রাখতে পারেননি কিংবা তাঁরা বশগত হননি অথবা তারা বশ্যা ছিলেন না-এ সব কিছুর ফলশ্রুতি একই, মহামতি কৃষ্ণের ব্যক্তিঞ্জীবনের পক্ষে সে ফল করুণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
তাহলে কি দাঁড়াল? বহির্বিশ্বে যে মানুষটি একটু একটু করে ক্ষমতার চূড়োয় উঠেছিলেন, সেই কৃষ্ণের চোখের সামনেই কুরুবংশ নিষ্প্রদীপ হল, পাণ্ডবদের শিবরাত্রির সলতে পরীক্ষিৎ অতি অল্প সময়ের মধ্যেই জনমেজয়ে পরিণত হলেন আর সে মানুষটির জীবন কেটে গেল–কবে ঘি খেয়েছিলেন, সেই পিতামহ কাহিনীর গল্প শুনতে শুনতেই। অপিচ কৃষ্ণের নিজের জ্ঞাতি-গুষ্টি ভোজবৃষ্ণি-অন্ধকেরা নিজেদের মধ্যে কাটাকাটি, হানাহানি করে মরল। রাজনীতি কি বিচিত্র বস্তু। আসলে কৃষ্ণ কংসবধ করেছিলেন বটে, কিন্তু কংসের বলদর্পিতার আগুনটি তিনি নিজে আত্মস্থ করেছিলেন। সেই আগুন জরাসন্ধকে পুড়িয়েছে, কৌরবদের পুড়িয়েছে, শেষে সেই আগুন তাঁর নিজের ঘরেও এসে লাগল–তিনি শেষরক্ষা করতে পারলেন না। ক্রমিক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটা এমনভাবেই তাঁর মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গিয়েছিল যে, এই প্রতিষ্ঠা, আরও প্রতিষ্ঠা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কৃষ্ণের পেছন পেছন ঘুরেছে। এতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সুখ নির্ভর করেছে শুধুমাত্র স্ত্রীদের সতীত্বের ওপর আর তাঁর জ্ঞাতি-গুষ্টিরা একে অন্যের থেকে শুধু বলবান হয়ে উঠেছিল। তার ফলে আহুক উগ্রসেন আর অক্রূরে বনিবনা হয় না, বলরাম শুধু সুরাপানের মাত্রা চড়িয়ে কারণে অকারণে বলদর্পী হন। কৃষ্ণের ওপরেও তাঁর যে আস্থা নেই এবং বলরামের ওপরেও যে কৃষ্ণপক্ষীয়দের আস্থা ছিল না তা বহুভাবে প্রমাণিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের উদ্যোগ-আলোচনায় বলরামকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন যুযুধান সাত্যকি, যিনি কৃষ্ণের আপন ঘরের লোক, ভাই। অথচ সাত্যকির সঙ্গে আরেক নাম করা বৃষ্ণিবীর কৃতবর্মার বনিবনা হয় না, যে কৃতবর্মা সাত্যকি কৃষ্ণের বিপক্ষে কৌরবপক্ষে যোগ দেন। এরকম একটা কথা বেশ চালু হয়েছে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে কৃষ্ণ অর্জুনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন-হয় নারায়ণী সেনা নাও, নয় নিরস্ত্র আমাকে নাও। অর্জুন নিরস্ত্র কৃষ্ণকে বরণ করলেন আর দুর্যোধন (সে নাকি বোকা) নিলেন নারায়ণী সেনা।
এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার নারায়ণী সেনা কৃষ্ণেরই প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এক বিশেষ শক্তিমান সেনাবাহিনী যা কেবলই গোপালকদের দ্বারা তৈরী এবং যারা যুদ্ধে কৃষ্ণকেও হার মানাতে পারে–মৎসংহননতুল্যানাং গোপানাম্ অবুদং মহৎ। নারায়ণা ইতি খ্যাতাঃ…।(৪১) আমি আগেই বলেছি গোপেদের সঙ্গে অন্ধকবৃষ্ণিদের বিশেষ সম্বন্ধ ছিল। কৃষ্ণ গোপেদের দিয়ে এই বাহিনী তৈরী করে তার নাম দিয়েছিলেন নারায়ণী সেনা, এখনকার ভাষায় যাকে বলা যায় ‘নারায়ণ রেজিমেন্ট’। কংসের সম্মুখীন হবার সময় এই বাহিনীর সহায়তা কৃষ্ণ গ্রহণ করেছিলেন কিনা সে খবর ইতিহাস দেয়নি, কিন্তু একেবারে মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কংস আদেশ দিয়েছিলেন–সমস্ত গোপেদের বার করে দাও আমার রাজ্য থেকে-গোপানামপি মে রাজ্যে ন কশ্চিৎ স্থাতুমর্হতি।(৪২) শুধুমাত্র কৃষ্ণ বলরামের ওপর আক্রোশেই যদি কৃষ্ণাশ্রিত গোপেদের ওপর কংসের রাগ হয়ে থাকে সে কথা আলাদা, কিন্তু মহাভারতের নারায়ণী সেনা গোপেদের সেনা। আমার বক্তব্য কিন্তু এখানে নয়, মহাভারতে কৃষ্ণ আর নারায়ণী সেনার বিকল্প শুধুমাত্র কৃষ্ণনির্ভর ছিল, কিন্তু সাতকুলের যুযুধান সাত্যকি, যিনি কৃষ্ণের ভাই এবং নিশ্চয়ই কোন সংঘমুখ্য, তিনি চতুরঙ্গ সেনা সঙ্গে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন যুযুধানস্ততে বীরঃ সাত্বতানাং মহারথঃ। মহতা চতুরঙ্গেন বলেনাগাদ যুধিষ্ঠিরম্ ॥ অপরদিকে কৃতবর্মা যিনি আরেক সংঘমুখ্য হবেন এবং যিনি কৃষ্ণের সঙ্গে যথেষ্ট সম্পর্কিত, তিনি ভোজ, অন্ধক এবং কুকুরবংশের ব্যক্তিগত অক্ষৌহিণী সেনা নিয়ে যোগ দিলেন দুর্যোধনের পক্ষে কৃতবর্মা চ হার্দিকো ভোজান্ধকুকুরৈঃ সহ। অক্ষৌহিণ্যব সেনায়া দুযযাধনমুপাগমৎ ॥(৪৩) লক্ষণীয় বিষয় হল, এখানে মহাভারতকার উদ্যোগপর্বের উচ্ছ্বাসে অথবা অভ্যাসে বলেছেন যে, সাত্যকি চতুরঙ্গবাহিনী নিয়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেন। কিন্তু তা ঠিক নয়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে ভীম আর দুর্যোধন যখন গদাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত তখন বলরাম সেখানে উপস্থিত হলেন। ঠিক সেই সময়ে বৃষ্ণি-ভোজদের কথা আবার উঠল। বলরাম কৃষ্ণকে বলেছিলেন–তুমি দুযোধনদেরও সাহায্য কর। তাতে কৃষ্ণ ক্ষেপে গেলেন এবং বলরাম চলে গেলেন তীর্থযাত্রায়। কিন্তু এই দুই ভায়ের মতবিরোধের সুযোগ নিয়ে অনুরাধা নক্ষত্রের শুভযোগে কৃতবর্মা সমস্ত যাদবদের নিয়ে যোগ দিলেন কৌরবপক্ষে–মৈত্রনক্ষত্রযোগেণ সহিতঃ সৰ্বাদবৈঃ। আশ্রয়ামাস ভোজন্তু দুর্যোধম অরিন্দম ॥ সাত্যকি কিন্তু একাই কৃষ্ণের সঙ্গে যোগ দিলেন পাণ্ডব পক্ষে যুযুধানেন সহিতঃ বাসুদেবস্তু পাণ্ডবান্।(৪৪) সাত্যকি অর্জুনের শিষ্য, তাই বোধহয় এই কৃতজ্ঞতা।
আগেই বলেছি সত্যভামা এবং স্যমন্তকের অধিকার নিয়ে কৃতবর্মা কিভাবে কৃষ্ণের বিরুদ্ধে চলে যান। কৃষ্ণের সঙ্গে তার শত্রুতা কোন্ পর্যায়ে পৌঁছেছিল তা বোঝা যাবে কৃষ্ণের ভাগ্নে এবং অর্জুনের পুত্র অভিমবধে। সপ্তরথীর যে চক্রব্যহ অভিমন্যু ভেদ করেছিলেন, তার অন্যতম প্রধান রথী ছিলেন কৃতবর্মা। অভিমন্য হলেন সেই মানুষটি যাঁর মধ্যে তাঁর মাতুল কৃষ্ণের অসাধারণ গুণগুলি এবং পাণ্ডবদের উত্তরাধিকার–দুইই আছে–যে চ কৃষ্ণে গুণাঃ স্ফীতাঃ পাণ্ডবে চ যে গুণাঃ। অভিমন্যৌ কিলৈকস্থা দৃশ্যন্তে গুণসঞ্চয়াঃ ॥ বৃষ্ণিকুলের পরমপ্রিয় এই ভাগিনেয় অভিমনু এবং পাণ্ডবদের আদরের দুলাল–তাঁকে বধ করার অন্যতম অংশীদার বৃষ্ণিকুলেরই কৃতবর্ম। কৃতবর্মা শুধু অভিমনুর গায়ে প্রখর শরাঘাত করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি শুধু পাণ্ডবদের বিপক্ষে প্রবল পরাক্রম দেখিয়েই ক্ষান্ত হননি-এই কৃতবর্মা ছিলেন সেই সাংঘাতিক পাপকর্মের জন্য দায়ী, যে পাপ তাঁর স্বপক্ষীয় দুর্যোধন পর্যন্ত ক্ষমা করেননি। যে তমসাবৃত রাত্রিতে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের পাঁচটি পুত্রকে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে রেখে এলেন, সেদিনও দ্বাররক্ষীর কাজটি করেছিলেন এই কৃতবর্মা।
এতগুলি অপকর্ম করেও কৃতবর্মা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত পার পেয়ে গেছিলেন। রথী-মহারথীদের যুদ্ধে পতন ঘটলেও কৃতবর্মা অক্ষত ছিলেন এবং যুদ্ধশেষে তিনি ফিরে এসেছিলেন দ্বারকায়। কৃষ্ণ ফিরে এসে বসুদেবকে যথারীতি যুদ্ধের খবর দিয়েছেন কিন্তু অভিমনুর ব্যাপারে কৃতবর্মার অন্যায় আচরণের কথা কৃষ্ণ বলেননি–সে কি জ্ঞাতিভেদের ভয়ে, না শুধুই ভয়ে। কৃতবর্মাকে তিনি কখনই ঠেকাতে পারেননি। শেষে কৃষ্ণপুত্র সাম্বের দুর্মতিতে যদুবংশের মধ্যে যে মুষল-যুদ্ধ আরম্ভ হল সেইদিন কৃতবর্মাকে বাগে পেলেন সাত্যকি। সমস্ত মহাভারতখানি কুরু-পাণ্ডবের আত্মকথা হলেও মহাভারতের মৌষলপর্বখানি কিন্তু বৃষ্ণি-অন্ধক-ভোজ-যাদবদের ইতিহাস, যদিও তা ধ্বংসের ইতিহাস। এই ধ্বংসের আরম্ভটা ছিল সাংঘাতিক। মদ, মাংস মেয়েমানুষ কোনটারই অভাব ছিল না। স্বয়ং বলরাম কৃষ্ণের সামনেই কৃতবার সঙ্গে মদ্যপান আরম্ভ করলেন রামঃ সহিতঃ কৃতবর্মনা। অন্যদিকে সাত্যকি, গদ এবং বন্ধু একসঙ্গে মদ্যপান আরম্ভ করলেন। কৃষ্ণ কাউকে বারণ করলেন না। মদের ঝোঁকে সাত্যকির মুখ দিয়ে এবার সত্যি কথা বেরোতে আরম্ভ করল। তিনি বললেন–কিরে ব্যাটা কৃতবর্মা, মৃতের মত ঘুমন্ত পাঁচটি বাচ্চা ছেলেকে তুই মেরে এলি, তোর এই অধর্ম যাদবরা কখনও ক্ষমা করবে না। সাত্যকির এই অবজ্ঞা, অবহাস সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন। কৃতবর্মাকে বাঁহাতের আঙুল নাচিয়ে উত্তর দিতে দেখে নিশিন্নিব সাবজ্ঞং তদা সব্যেন পাণিনা-সাত্যকি এবার কৃষ্ণের সামনেই সেই সত্যভামা আর স্যমন্তকের পুরানো কাসুন্দি ঘেঁটে তুললেন। কাহিনী শুনে সত্যভামা পুরানো পিতৃমণির শোকে কৃষ্ণের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। নিজেও তিনি যেমন রেগে উঠলেন, কৃষ্ণকেও তেমনি খেপিয়ে তুললেন। তবু কৃষ্ণ কাউকে কিছু বললেন না। এবারে সাত্যকি খঙ্গ নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন কৃতবর্মার মাথায়। কৃতবর্মার মাথা কাটা গেল–এতদিনের পুরানো হিস্যা এই মিটল। কিন্তু তাতে কি? সাত্যকিও মারা পড়লেন কৃতবর্মাপক্ষীয়দের হাতেই। এগিয়ে এলেন প্রদ্যুম্ন, এবারে চুলোচুলি লড়াই আরম্ভ হল–তাতে পিতার হাতে পুত্র মারা পড়ল, পুত্রের হাতে পিতা-যদুবংশ ধ্বংস হল।(৪৬) তিলে তিলে যে গৌরব, যে ক্ষমতা বৃষ্ণি-অন্ধকদের জন্য পুঞ্জীভূত করেছিলেন কৃষ্ণ, ক্ষমতালিপু সংঘমুখ্যদের কারণেই সেই গৌরব চুরমার হয়ে গেল।
যাদববৃষ্ণি বীরেরা একের সঙ্গে অপরে লড়াই করে যখন সবাই শেষ হয়ে গেল, তখন সারথি দারুককে দিয়ে কৃষ্ণ খবর পাঠালেন অর্জুনকে। সেই সময়ে দ্বারকার স্ত্রীদের রক্ষার কথা তাঁর মনে পড়ল–স্ক্রিয়ো ভবান রক্ষিতুং যাতু শীঘ্রং। বলরামকে বললেন, একটু অপেক্ষা করুন আর্য-যাবৎ খ্রিয়ো জ্ঞাতিবশাঃ করোমি। বসুদেবকে কৃষ্ণ বললেন–কিছুক্ষণের জন্য আপনি স্ত্রীদের রক্ষা করুন, যতক্ষণ অর্জুন না এসে পৌঁছোয়–স্ত্রিয়ো ভবান্ রক্ষতু নঃ সমগ্রা ধনঞ্জয়স্যাগমনং প্রতীক্ষন।
কৃষ্ণ বুঝেছিলেন-ঘরে পুরুষমানুষ না থাকলে স্ত্রীরা খারাপ হয়ে যাবে। হাসি পায়, যে মানুষটি জনে জনে স্ত্রীরক্ষার কথা বলে আপন দায়িত্ব পালন করছিলেন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে সেই কৃষ্ণকে দুই সেনাবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে অর্জুন বলেছিলেন যুদ্ধ করব না কৃষ্ণ, যুদ্ধে কুলক্ষয় হলে যে অধর্ম হবে, সে অধর্মে নষ্ট হয়ে যাবে পাণ্ডব-কৌরবের সকল কুলকামিনীরা–অধমভিভবাৎ কৃষ্ণ প্ৰদুষ্যন্তি কুলখ্রিয়ঃ কুলস্ত্রীরা দুষ্ট হলে উপযুক্ত পুরুষের অভাবে বর্ণসংকর তৈরী হবে, পূর্বপুরুষেরা পিণ্ড পাবেন না। কিন্তু এত আর্তি, এত ভবিষ্যদ দৃষ্টি কৃষ্ণের চোখে তখন পড়েনি। তিনি বলেছিলেন–এসব হৃদয়ের দুর্বলতা, এগুলি ত্যাগ করতে হবে, যুদ্ধ করতেই হবে–ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্বক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ। আজকে যখন নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে যদুবৃষ্ণি পুঙ্গবেরা সবাই মরল, তখন কি কৃষ্ণের অর্জুনের সেই কথাগুলি মনে পড়ল–অধমভিভবাৎ কৃষ্ণ প্ৰদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ। কিন্তু তখন বড় দেরী হয়ে গেছে। অর্জুন এসেও তাঁদের রক্ষা করতে পারলেন না। ষোড়শস্ত্রীসহস্রানি বাসুদেবপরিগ্রহঃ–তাদের কতজনকে দস্যুরা ছিনিয়ে নিল, আর কতক নিজেই পালালেন-কৃষ্ণের বহুকাল অনুপস্থিতিতে তাঁরা বুঝি বা দুষ্ট হয়েই ছিলেন। রুক্মিণী জাম্ববতী আগুনের শরণ নিলেন সত্যভামা তপস্যার জন্য গেলেন বনে। ধর্ম, ধর্মযুদ্ধের এই কি পরিণতি, বাইরেও কৃষ্ণের শান্তি মিলল না, ঘরেও নয়। বৃন্দাবনবিলাসী একনায়ক, মথুরা-দ্বারকার রাজাদেরও রাজা, কুরু-পাণ্ডবের ধর্মযুদ্ধের পুরোহিত–তাঁর এই কি বিদায়!
.
.
প্রথম অধ্যায়ের গ্রন্থপঞ্জী
১. ছান্দোগ্য উপনিষদ, দুগাচরণ সাংখ্য বেদান্ততীর্থ সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৩৩৩ সাল, ৩, ১৭, ৬, পৃ. ৩৫২।
২. বিমানবিহারী মজুমদার, কৃষ্ণ ইন্ হিস্ট্রি এন্ড লিজেন্ড, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৯, পৃ. ৪।
৩. হারম্যান জ্যাকবি, কৃষ্ণসম্বন্ধীয় প্রস্তাব, হেস্টিংস সম্পাদিত এনসাইক্লোপেডিয়া অব রিলিজয়া এন্ড এথি। ৭ম খণ্ড, নিউ ইয়র্ক, ১৯৬৪, পৃ. ১৯৫।
৪. আর. জি. ভাণ্ডারকার, বৈষ্ণবিজ শৈবিজম্ এন্ড মাইনর রিলিজিয়াস সিস্টেমস, বারাণসী : ইন্দলজিক্যাল বুক হাইস, ১৯৬৫, পৃ. ৮-১২; ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারি, ১৯১২, পৃ. ১৩।
৫. এ. বি. কিথ, জানাল অব দ্য রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯১৫, পৃ. ৮৪০।
৬. আর. জি. ভাণ্ডারকার, বৈষ্ণবিজ শৈবিজ, পৃ. ৩৫-৩৮।
৭. জে. এন. ফারকুহার, পামানেন্ট লেসনস অব দ্য গীতা, অকসফোর্ড, ১৯১২, পৃ ৩১।
৮. জে. এন. ফারকুহার, আ প্রাইমার অব হিন্দুইজম, দিল্লী, ১৯৭৫ (পুনর্মুদ্রিত), পৃ. ৭৪।
৯. জি. পারিন্দার, অবতার এন্ড ইনকারনেশন, ফেবার এন্ড ফেবার, ১৯৭০, পৃ. ১২২।
১০. ঐ পৃ. ১২৩।
১১. হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, মেটিরিয়ালস ফর দ্য স্টাডি অব আর্লি হিস্ট্রি অব দ্য বৈষ্ণব সেক্ট, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯২০, পৃ. ৪৮-৫০।
১২. পাণিনি সূত্র করেছেন বাসুদেবার্জুনাভ্যাং বুঞ’ (৪. ৩, ৯৮) পাণিনির নিজেরই করা দ্বন্দ্বসমাসের নিয়ম অনুসারে সূত্রটির গঠন হওয়া উচিত ছিল ‘অর্জুনবাসুদেবাভ্যাং বুঞ। পণ্ডিতেরা বলেন পাণিনির এই ভুলটি নাকি ইচ্ছাকৃত এবং এই ভুলের পেছনে নাকি পাণিনির একটি উদ্দেশ্য আছে। উদ্দেশ্য এই যে, বহু অক্ষর বিশিষ্ট ‘বাসুদেব’ পদটি আগে বসিয়ে পাণিনি বাসুদেবের পূজ্যত্ব প্রতিপাদন করেছেন। পাণিনির পরবর্তী মহাবৈয়াকরণ কাত্যায়ন শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিপূরক সূত্রই বানিয়ে দিয়েছেন– ‘অভ্যহিতং পূর্বং’। এতে বেশি সম্মাননীয় ব্যক্তির নাম দ্বন্দ্বসমাসে আগে বসবে।
১৩. কার্টিয়াস লিখেছেন- An image of Hercules was borne in front of the line of infantry, and this acted as the strongest of all incentives to make the soldiers fight well. To desert the bearers of this image was reckoned a disgraceful military offence… আর. সি. মজুমদার, দ্য ক্লাসিক্যাল অ্যাকাউন্টস অব ইন্ডিয়া, ফার্মা কে, এল. এম; কলিকাতা, ১৯৪১, পৃ. ১১৯-১২০।
১৪. পতঞ্জলি, মহাভাষ্য, মতিলাল বনার্সিদাস : দিল্লী, ১৯৬৭, ৩. ২. ১১১, পৃ. ১৭৬।
১৫. জে. ম্যাক্রিশুল, এনসেন্ট ইন্ডিয়া অ্যাজ ডিসক্রাইবড় বাই মেগাস্থিনিস এন্ড আরিয়ান, কলিকাতা, ১৯২৬, পৃ. ৬৪।
১৬. জোজেফ এম. কিটাগাওয়া। দ্য হিস্ট্রি অব রিলিজনস (চিকাগো) ১৯৭৩, পৃ: ২৬।
১৭, ছান্দোগ্য উপনিষদ, ঐ, ৭. ২.।
১৮. আর. পি. চন্দ, মেমোয়েরস অব দ্য আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, নং ৫, পৃ. ১৫৭।
১৯. এস. এন. দাসগুপ্ত, হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ান ফিলজফি, ৩য় খণ্ড, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৬১, পৃ. ৩৪-৪১।
২০. জে. এ. বি ভ্যান ব্যুটেনন, “দ্য নেম্ পঞ্চরাত্র”– দ্য হিস্ট্রি অব রিলিজিয়ান ১: ২ (১৯৬২) পৃ. ২৯৩।
২১. ডি. আর. ভাণ্ডারকর, দ্য আরকিওলজিক্যাল বিমেইনস এন্ড এসকেভেসস অ্যাট নাগরী, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ১৯২০, মেমোয়ের নং ৪।
২২. জে. এন. ব্যানার্জি, ডিভালপমেন্ট অব হিন্দু আইকোনোগ্রাফি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬, পৃ. ৯৩, ৩৮৬
২৩. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণচরিত্র, বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড, সাহিত্যসংসদ ১৩৮০ সাল (৫ম মুদ্রণ), পৃ. ৪৯২।
২৪. ঐ, পৃ. ৪৩৩।
২৫. রবীন্দ্র রচনাবলী, ১৯৬৫ দ্র. চতুরঙ্গ, পৃ. ৪৮৬
২৬. শঙ্করীপ্রসাদ বসু, বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচচা” দ্র. দেশ, সাহিত্য সংখ্যা, ১৩৯৫, পৃ. ১৩০-১৪২।
২৭. বিপিনবিহারী গুপ্ত, পুরাতন প্রসঙ্গ, বিশু মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত, বিদ্যাভারতী সংস্করণ, পৃ. ২৮৯-২৯০।
২৮. ঐ, পৃ. ২৯০-২৯২।
২৯. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয় : কলিকাতা, ১৩৬৯ সাল, ৫ম খণ্ড, পৃ. ১৫০-৫৪।
.
২য় অধ্যায়ের গ্রন্থপঞ্জী
১. দ্র. ভোজবমার বেলাভ তাম্রশাসন, এপিগ্রাফিকা ইস্তিকা,১২শ সংখ্যা, পৃ. ৩৭-৪৩। পণ্ডিত নলিনীকান্ত ভট্টশালী ঢাকা রিভিউতে (জুলাই ১৯১২) পুরো শ্লোকটি উদ্ধার করেছিলেন। ড: রাধাগোবিন্দ বসাক এবং জে, এন, ব্যানার্জি সেই শ্লোকটির একটি শব্দ নিয়ে বিচার-বিবেচনা করা সত্ত্বেও ভট্টশালীর পাঠটিই সাধারণ্যে গৃহীত। যদিও “সোপীহ গোপীশতকেলিকারঃ কৃষ্ণো মহাভারতসূত্রধারঃ” এই পংক্তি নিয়ে কোথাও কোন বিবাদ নেই।
২. সুকুমারী ভট্টাচার্য, ইন্ডিয়ান থিওগনি, ফার্ম কে, এল, এম; কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৩০১।
৩. সুকুমারী ভট্টাচার্য, “দ্য সানগড় এন্ড সোটেরিওলজি”, অষীক্ষা (সংস্কৃত বিভাগের পত্রিকা) যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৯৭২, পৃ. ২৬।
৪. জন স্ট্রাট হলি, কৃষ্ণ, দ্য বাটার-থি, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮৩, পৃ. ২৫।
৫. গাথাসপ্তশতী, মাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত, এশিয়াটিক সোসাইটি, ১৯৭১, ২. ১২ পৃ. ২৬।
৬. ঐ. ১. ৮৯ পৃ. ২১।
৭. ভাগবত পুরাণ, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৩০৯ সাল, ১০. ৩০, ৩৭-৩৮।
৮, রাধাগোবিন্দ নাথ, শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতের ভূমিকা, ভক্তিগ্রন্থ প্রচার ভাণ্ডার : কলিকাতা, বঙ্গাব্দ ১৩৫৫, পৃ. ৮৩, ৯৬-৯৯, ১৮৫-১৮৭, ২০৪-২৩৮।
৯. হেসিয়ড, থিওগনি, লোয়েব সংস্করণ, পৃ. ৩৩৩-৩৩৬। দ্রঃ সুকুমারী ভট্টাচার্য ইন্ডিয়ান থিওগনি, (পূর্বে উল্লিখিত) পৃ. ৩০৪।
১০. ইয়ান্ খণ্ডা, আসপেকটস অব আর্লি বিষ্ণুইজম, মতিলাল বনার্সিদাস : দিল্লী, ১৯৬৯ (২য় সংস্করণ), পৃ. ১৫৫-১৫৭।
১১. সুবীরা জয়সোয়াল, দ্য অরিজিন এন্ড ডিভালপমেন্ট অব বৈষ্ণবিজম, মুন্সীরাম মনোহরলাল : দিল্লী, ১৯৬৭, পৃ. ৫০-৫১; দ্রঃ ইয়া খণ্ডা (পূর্বে উল্লিখিত) পৃ. ২৪-৩১, ১২২।
১২. ইয়াং খণ্ডা (পূর্বে উল্লিখিত) পৃ. ১৫৬।
১৩. মহাভারত, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, কলিকাতা (বঙ্গবাসী সংস্করণ) ২. ৪২.১; ২. ৪১. ৬; ২, ৪২, ৪।
১৪. হরিবংশ আর্যশাস্ত্র : শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ এবং নিত্যানন্দ স্মৃতিতীর্থ সম্পাদিত কলিকাতা, ১৩৮৪ সাল, ১. ৩৫, ৯-১২। ব্রহ্মপুরাণ, আর্যশাস্ত্র, শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ এবং নিত্যানন্দ স্মৃতিতীর্থ সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৩৯২ সাল, ১৪. ৪৬।
১৫. এফ. ই. পারজিটার, এনন্সে ইন্ডিয়ান্ হিস্টোরিক্যাল ট্র্যাডিশন, লন্ডন, ১৯২২, পৃ. ২৪৩-২৪৮।
১৬. হরিবংশ, ঐ, ১, ৩৫. ১২-১৪।
১৭. কথাটা এমনি করে অবশ্য কোন পুরাণ কিংবা শাস্ত্রকারেরা বলেননি।
গোপীদের প্রসঙ্গে ‘অপ্সরা’ কথাটার প্রথম প্রয়োগ করেন বৈষ্ণবাচার্য মধ্ব–”জারত্নে অপ্সরীণাং’, ‘কামভক্ত্যা অপ্সরীণাং’। এই কথাগুলি তিনি বলেছেন ভাগবত পুরাণে যেই গোপীদের কথা আরম্ভ হল, তখনই। শরত্নাবলী ‘অঙ্গরা’ শব্দের মানে করেছে ‘সুবেশ্যা’। কাজেই কোন গোপবালিকাকে অপ্সরা বলে চিহ্নিত করলেই তাকে অপ্সরা বলে মানতে হবে এমন কথা নেই। খণ্ডা সাহেব আবার বিষ্ণুপুরাণের ভিত্তিতে যে কথাটা বলতে চাইলেন, সেটা আমাদের মনমত হল বটে, কিন্তু ভুল বললেন। তিনি লিখেছেন And what is to give another instance the element of ‘historical truth’ in the tradition preserved in the Visnupurana (5, 9. 38) that the gopis, the wives of Krsna were the apsarases who had been cursed by the ascetic Astavakra?” (Aspects of early Visnuism.p. 125) বিষ্ণুপুরাণের যে জায়গাটুকু খণ্ডা উদ্ধার করেছেন, সেখানে কৃষ্ণস্ত্রীদের পূর্বজন্মে অপ্সরা বলা হয়েছে এবং তাঁরাই অষ্টাবক্র মুনির শাপ লাভ করেছিলেন। ফলে তাঁরা কৃষ্ণের স্ত্রী হয়েও পরে দস্যুদের দ্বারা হৃত হয়েছিলেন। এখানে গোপীদের কথাটাও জুড়ে দিয়ে খণ্ডা সাহেব অন্যায় করেছেন বলে মনে করি।
১৮, পতঞ্জলি, ব্যাকরণ-মহাভাষ্য, এফ. কিলহৰ্ণ সম্পাদিত, বম্বে, ১৮৯২, ১ম খণ্ড, পৃ. ২৫২।
১৯. এপিগ্রাফিকা ইন্ডিকা, ১৬শ খণ্ড, নং ১৭; দ্রঃ ডি. আর. ভাণ্ডারকর, অ্যানুয়াল রিপোর্ট, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ১৯১৩-১৯১৪, পৃ. ২৩০-২৩১ এবং দীনেশচন্দ্র সরকার, দ্য এজ অব ইমপেরিয়াল ইউনিটি, ভারতীয় বিদ্যাভবন : বম্বে, ১৯৬০ (তৃতীয় সংস্করণ), পৃ. ২২২।
২০. জাতক, ই. বি. কাউয়েল সম্পাদিত, কেমব্রিজ, ১৮৯৫-১৯১৩, ঘটজাতক, ৪র্থ খণ্ড, পৃ. ৫১-৫২।
২১. হরিবংশ, ঐ, ১. ৫. ৪-৮।
২২. হরিবংশ, ঐ, ১, ২০. ৪-৫।
২৩. হরিবংশ, ঐ, ১. ২০, ৬।
২৪. হরিবংশ, ঐ, ১, ২০, ১১-১৪।
২৫. এফ. হার্ডি, বিরহভক্তিঃ দ্য আর্লি হিস্ট্রি অব কৃষ্ণ ডিভোস ইন সাউথ ইন্ডিয়া, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস : দিল্লী, ১৯৮৩, পৃ. ১১৯-২৩৭।
২৬, ভি, আর রামচন্দ্র দিক্ষিতর, শিলগড়িকার : ইংরেজী অনুবাদ, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস : লন্ডন, ১৯৩৯, ১৭। এম. রাঘবায়েঙ্গার, আরায়চিত্তোকুতি, পরিনিলয়মঃ ম্যাড্রাস, ১৯৬৪, পৃ. ৬২।
২৭. কালিদাস, রঘুবংশ, হরগোবিন্দ মিশ্র, চৌখাম্বা সংস্কৃত সিরিজ : বারাণসী, ১৯৬১, ৬, ৪৫-৫০।
২৮. বলরামের রাগের কথা আছে ভাগবত পুরাণে।
২৯. ওদেশে ডেভিশ কিংসলে সাহেব কৃষ্ণের এই সব নাচের একটা মিষ্টি ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যা এদেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের মধ্যে বেশ চলে। দ্রঃ ডি. কিংসলে, “উইদাউট কৃষ্ণ দেয়ার ইজ নো সং”, হিস্ট্রি অব রিলিজিয়নস্ পত্রিকা ১২ খণ্ড, নং ২ (১৯৭২), পৃঃ ১৬০-১৬১। এই ‘কানু বিনে গীত নাই’ শীর্ষক প্রবন্ধ ছাড়াও এ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা পাওয়া যাবে, কিংসলেরই লেখা দুখানি গ্রন্থে : দ্য ডিভাইন প্লেয়ার : আ স্টাডি অব কৃষ্ণলীলা, দিল্লী, ১৯৭৯ এবং দ্য সোর্ড এন্ড দ্য ফুট : কালী এন্ড কৃষ্ণ, বার্কলে, ১৯৭৫।
৩০. গাথাসপ্তশতী (পূর্বে উল্লিখিত) ২. ১৪. পৃ. ২৬।
৩১. ডি. ইনগল, “দ্য হরিবংশ অ্যাজ আ মহাকাব্য”, লুই রেণু স্মারক গ্রন্থ (Melanges d’indianisme a la memoire de Louis Renou) প্যারিস, ই. ডি. বোকার্ড, ১৯৬৮, পৃ. ৩৮৪-৩৮৭।
৩২. ভাস, বালচরিত, সি আর দেওধর, ওরিয়েন্টাল বুক এজেন্সি : পুনা, ১৯৫১, পৃ. ৫২৪-২৯।
৩৩. হরিবংশ, ১. ৮, ২৪-২৮!
৩৪. ভাস, বালচরিত (পূর্বে উল্লিখিত)
৩৫. প্রিনজ (Printz) সাহেব প্রথমে লক্ষ্য করেন যে বালচরিতের ৩য় অংশের প্রথমার্ধে এবং পঞ্চরাত্রের ২য় অংকের প্রবেশকে এক ধরনের বিশেষ প্রাকৃত ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। পরে হেলার সাহেব এই ভাষাটি বিশ্লেষণ করে দেখান যে এটি আভীরীদের ভাষা– Hirtendialekt. (এইচ. হেলার, বালচরিত, লাইপজিগ, ১৯২২ ২য় খণ্ড, ভূমিকা পৃ. ৩ (এফ)। দ্রষ্টব্য : এইচ হার্ডি, বিরহভক্তি (পূর্বে উল্লিখিত) পৃ. ৭৮, পাদটীকা ১০০।
৩৬. কালিদাস, মেঘদূত, পার্বতীচরণ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৩৭৬ সাল, পূর্বমেঘ. ১৫।
৩৭, সুভাষিতরত্নকোষ, ডি. ডি. কোশাম্বি এবং ভি, ভি, গোখলে সম্পাদিত, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৫৭, হরিব্রজ্যা, ২০, পৃ. ২৪।
৩৮. হিউগো রাহুনির, “দ্য ক্রিশ্চান মিস্ট্রিজ এন্ড পেগান মিস্ট্রিজ। দ্রঃ মিষ্ট্রিজ, এরানোজ ইয়ার বুক, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৭১, পৃ. ৩৫৯।
৩৯. বার্থ সাহেবের বক্তব্য সুশীল কুমার দে উদ্ধার করেছেন। দ্রঃ এস, কে, দে, আসপেক্টস্ অব স্যানসক্রিট লিটারেচার, কলিকাতা, ১৯৫৯, পৃ. ৯১-৯২ পাদটীকা নং ২।
৪০, জীব গোস্বামীর জ্যাঠামশাই সনাতন গোস্বামী ভাগবত পুরাণের ওপর বৈষ্ণবতোষণী টীকায় বলেছেন আরও ভাল। তাঁর মতে, চিরকালের ১১৪ পরমাত্মীয় পরমাত্মস্বরূপ কৃষ্ণের কাছে পর’ বলেই কেউ নেই, সেখানে ‘পরদারা’-নাস্তি অস্য পরো নাম কশ্চিৎ, কে বা পরদারাঃ। দ্রঃ ভাগবত পুরাণ, রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন, মুর্শিদাবাদ, ১২৯৪ সাল, ১০ম স্কন্ধ, পৃ. ৬৩৪।
৪১. জে. এল. ম্যাসন, “দ্য চাইল্ডহুড় অব কৃষ্ণঃ সাম্ সাইকো-অ্যানালিটিক অবসার্ভেসন”। দ্রঃ জার্নাল অব দ্য আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি, খণ্ড ৯৪ : নং ৪।
৪২. শ্ৰীমদভাগবতম, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১০. ৪৭, ২১.
৪৩. বিষ্ণুপুরাণ, কালীপদ তকাঁচার্য এবং শ্রীজীব ন্যায়তীর্থ সম্পাদিত, আর্যশাস্ত্র, কলিকাতা, ১৩৭২ সাল, ৫. ১৮. ১৪, ১৫।
৪৪. শ্রীমদ্ভাগবত, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১০. ৪৬. ৬।
.
তৃতীয় অধ্যায়ের গ্রন্থপঞ্জী
১. ঋগ্বেদসংহিতা, রমেশচন্দ্র দত্তকৃত বঙ্গানুবাদ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, জ্ঞানভারতী : কলিকাতা, ১৯৬৩, ৮, ৯৬, ১৩-১৫।
২. এস. রাধাকৃষ্ণান, ইন্ডিয়ান্ ফিলসফি, লন্ডন, ১৯৪৮, প্রথম খণ্ড, পৃ. ৮৭। ইয়ান খণ্ডা, আসপেক্টস অব আর্লি বিষ্ণুইজ (পূর্বে উল্লিখিত), পৃ. ১৫৭। সুকুমারী ভট্টাচার্য, ইন্ডিয়ান থিওগনি (পূর্বে উল্লিখিত), পৃ. ৩০৫ (সুকুমারী ভট্টাচার্য অবশ্য অনবধানতাবশতঃ ঋসংখ্যাটি ভুল নির্দেশ করেছেন (৮, ৮৫, ১৩-১৫)
৩, ইয়ান খণ্ডা, পূর্বে উল্লিখিত, পৃ. ১৫৭।
৪. হরিবংশ, পূর্বে উল্লিখিত, বিষ্ণুপ, ১৫. ৪-৫, ৮-১৯।
৫. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ১৬. ১-১১; ১৭, ২১-২৪।
৬. বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ ছাড়াও কালিয়াদমনের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের জন্য দ্রষ্টব্য : হাইনরিখ জিমার, মিথস্ এন্ড সিমবলস্ ইন ইন্ডিয়ান্ আর্ট এন্ড সিভিলাইজেসন, বলিজেন্ ফাউন্ডেস : ওয়াশিংটন, ১৯৪৬, পৃ. ৭৭-৯০। মিচা এলিয়াদে, কসমস্ এন্ড হিস্ট্রি : দ্য মিথ অব দ্য ইন্টারন্যাল রিটার্ন, অনুবাদ : ডাবলু. আর. ট্রাস্ক, নিউ ইয়র্ক, ১৯৫৯, পৃ. ১২-১৫, ৫৫-৬০; এলিয়াদে, প্যাটার্নস ইন কমপারেটিভ রিলিজিয়ন, অনুবাদ : রোজমেরী শীড, ক্লিভল্যান্ড, ১৯৬৩, পৃ. ৮৯, ৯৯-১০১, ৩৭৪-৩৭৯। জন স্ট্রাটন হলি, “কৃষ্ণস্ কসমিক ভিট্রিস।” দ্রঃ • জানাল অব দ্য আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব রিলিজিয়ন, খণ্ড ৪৭ : নং ২ (১৯৮০) পৃ. ২০৪।
৭, হরিবংশ, পূর্বে উল্লিখিত, বিষ্ণুপর্ব, ১৯, ৪৫, ৪৭, ৫৯।
৮. ঐ, ১৯. ৭৩-৮৮।
৯. ঐ, ১৯. ৯৪-৯৯।
১০. ভাস, বালচরিত, সি. আর. দেওধর সম্পাদিত, ২য় সংস্করণ, ওরিয়েন্টাল বুক এজেন্সি, পুনা, ১৯৫১, পৃ. ৫১৪।
১১. যদ্যয়ং বালো লোকহিতার্থং কংসবধার্থং বৃষ্ণিকুলে প্রসূতশ্চেৎ ঘোষাত্ কশ্চিদ্ ইহাগচ্ছতু। বালচরিত, পূর্বে উল্লিখিত, পৃ. ৫১৬।
প্রসঙ্গতঃ ফরাসী গবেষক আঁদ্রে কোর্তুরের একটি মন্তব্য আমরা এখানে উল্লেখ করব, কারণ তাঁর মন্তব্যটি আমার বক্তব্যের পরিপোষক। কোতুরে মনে করেন মথুরার কাণ্ডকারখানায় কৃষ্ণের হস্তক্ষেপের ব্যাপারটি অনেক বেশি জটিল; অন্ততঃ অনেক বেশি জটিল, যতখানি ভাণ্ডারকর তাঁর মহাভারতের কৃষ্ণ আর গোপাল কৃষ্ণের ভেদতত্ত্বে প্রতিপাদন করেছেন। কোর্তুরে মনে করেন কৃষ্ণ এসেছিলেন যাদবদের বংশ রক্ষা করতে এবং কালনেমির অবতার কংসকে পর্যুদস্ত করতে। এইভাবেই তিনি জগতের হিত সাধন করতে চেয়েছেন। কোর্তুরের মূল মন্তব্যটি নীচে দেওয়া হল :
Les motifs invoques pour l’intervention de Krsna in Mathura sont donc plus complexes que ne l’avait apercu Bhandarkar dans son desir de distinguer un Krsna epique et un dieu des bouviers. Krsna vient redresser la lignee des Yadava, Vaincre une reincarnation de Kalanemi et a travers cela, il se propose d’oeuvrer au bien-etre du monde. আঁদ্রে কোর্তুরে, “জিনিয়লজি এ রিইনকারনেস দা লা মিথ ডেনফাঁস দ্য কৃষ্ণ (Genealogie et reincarnation dans le mythe denfance de Krsna) দ্রঃ স্টাডিজ ইন রিলিজিয়ন, সায়েন্সেস রিলিজিয়সে, খণ্ড ২ : নং ২ (১৯৮২), পৃ. ১৪৫।
১২. হরিবংশ, পূর্বে উল্লিখিত, বিষ্ণুপর্ব, ২৮, ৫৪-১১৫।
১৩, ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ২৮, ১১৬।
১৪. কৌটিল্যীয়ম অর্থশাস্ত্রম, রাধাগোবিন্দ বসাক সম্পাদিত, কলিকাতা, ১৯৬৪, ১ম খণ্ড, ১ম অধিকরণ, প্রকরণ-ইন্দ্রিয় জয়ঃ, পৃ. ৪
১৫. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ২২ অধ্যায়টি সম্পূর্ণ দেখুন।
১৬. . বিষ্ণুপর্ব, ২৩, ১-৭।
১৭. ঐ, বিষ্ণুপর্ব ২৮. ৩৭।
১৮. মহাভারত, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, কলিকাতা, শকাব্দ ১৮৩০, ২. ১৪. ৩৩।
১৯. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ২২, ৯৮।
২০, ঐ বিষ্ণুপর্ব, ৩১, ৪৬।
২১. ঐ বিষ্ণুপর্ব, ৩২. ৩১।
২২. মহাভারত, পূর্বে উল্লিখিত, ২. ১৪, ৩৩-৩৪।
২৩. বিমানবিহারী মজুমদার, কৃষ্ণ ইন হিস্ট্রি এন্ড লিজেন্ডু, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৯, পৃ. ৮২-৮৩।
২৪. হরিবংশ, হরিবংশপর্ব, ৩৯, ৬-প্রযযৌ রথমারুহ্য নগরং বারণাবতম। বিষ্ণুপুরাণ, পূর্বে উল্লিখিত, ৪. ১৩. ৩৭ পৃ. ২৯৬। ১১৬
২৫. বিষ্ণুপুরাণ বলেছে- জতুগৃহদাহের পর কৃষ্ণ পাণ্ডবদের আসল বৃত্তান্ত জেনেও দুর্যোধন যাতে পাণ্ডবদের আরও গভীরতর কোন ফাঁদে না ফেলেন সেইজন্যই কুলোচিত সৌজন্য রক্ষার্থে বারণাবতে গেছিলেন জতুগৃহদগ্ধানাঞ্চ পাণ্ডুনন্দনানাং বিদিতপরমাথোপি ভগবান দুর্যোধন-প্রযত্নশৈথিল্যার্থং কুলাকরণায় বারণাবতং গতঃ (৪. ১৩. ৩৬)
২৬, মহাভারত, ২. ১৪. ৮-১১, ৩৬।
২৭. ঐ, ২, ১৪, ৪৯।
২৮. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ৩৫, ৬।
২৯, ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৩৮, ৫৬-৬০
৩০. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৩৮, ৬০-৬৪।
৩১. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৩৯, ৮-৯।
৩২. মহাভারত, আদিপর্ব, অধ্যায় ২২১। এই অধ্যায়টির নাম শুধু সুভদ্রাহরণপর্ব নয়, এ পর্বের নাম হরণাহরণপর্ব।
৩৩. ঐ, ১, ২২১. ১৯।
৩৪. ঐ, আদিপর্ব অধ্যায় ১৮৬।
৩৫. ঐ, আদিপর্ব, ১৮৭. ১৫-১৬, ২৪-২৭।
৩৬: হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী, পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব আনসেন্ট ইন্ডিয়া, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৭২, পৃ. ৩৮১-৩৯৪।
৩৭. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ৫২, ২৫-৩২।
৩৮. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৫২, ৩৩-৩৭।
৩৯. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৫৭, ৩১-৩৮।
৪০. ঐ, বিষ্ণুপ, ৫৭. ২৯-৩০।
৪১, হরিবংশ লিখেছে জরাসন্ধ শিশুপালের সমানবংশ এবং জ্ঞাতি। শিশুপালের বাবা শিশুপালকে জরাসন্ধের হাতেই মানুষ করার জন্য দিয়েছিলেন এবং জরাসন্ধও তাঁকে ছেলের মত দেখতেন। দ্রঃ হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ৫৯, ২১-২৪।
৪২. মহাভারত, ৫. ৭৪, ১-২৩।
৪৩. ঐ ৫. ৭৬. ১-১৮
.
৪র্থ অধ্যায়ের গ্রন্থপঞ্জী
১. মহাভারত, ৩, ২৩২. ৪-৮।
২. ভাস, বালচরিত, পূর্বে উল্লিখিত, পৃ. ৫৪৯
৩, বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ সবিস্তারে অক্রযাত্রা এবং বিরহপর্বের ছবি এঁকেছে। রূপ গোস্বামীর ললিতমাধব নাটকের তৃতীয় অঙ্কও এ ব্যাপারে তাৎপর্যপূর্ণ। আরও দ্রষ্টব্য : ডন ম্যারি উলফ, “আ স্যানক্রিট পোর্ট্রেট; রাধা ইন দ্য প্লেজ অব রূপ গোস্বামী।” দ্রঃ ডিভাইন কনসর্ট, জে, এস. হলি এবং উনা ম্যারি উলফ সম্পাদিত, বার্কলে রিলিজিয়াস স্টাডিজ সেরিজ, ১৯৮৯, পৃ. ৩০।
৪. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ২৭. ২৬-৩৯। বিষ্ণুপুরাণ, ৫. ২০. ১-১২। ভাগবতপুরাণ, ১০, ৪২. ১-১২।
৫. ভাগবত পুরাণ, ১০, ৪৮, ১-৯।
৬, নোয়েল শেট, “দ্য জাস্টিফিকেশন ফর কৃষ্ণজ অ্যাফেয়ার উইদ দ্য হাঞ্চব্যাকড় উওম্যান”। দ্রঃ পুরাণ (বারাণসী) খণ্ড ২৫ : নং ২১ (জুলাই ১৯৮৩) পৃ. ২৩৩।
৭, শ্ৰীমদ ভাগবতম, রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন সম্পাদিত, মুর্শিদাবাদ, ১৮৯৪ সন, ১০. ৪৮. ৪ শ্লোকের ওপর সনাতন গোস্বামী কৃত বৈষ্ণবতোষণী টীকা। অধিকন্তু রাধাগোবিন্দ নাথ, গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শন, চতুর্থ খণ্ড, প্রাচ্যবাণী : কলিকাতা ১৯৫৯, পৃ. ২৬৫৫।
৮. রূপ গোস্বামী, উজ্জ্বল নীলমণি, হরিদাস দাস (সং), হরিবোল কুটীর : নবদ্বীপ, গৌরাঙ্গ ৪৬৯, স্থায়িভাব প্রকরণ, ৪৫, পৃ. ২৫৩।
৯, হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ৫০, ১৫-১৬।
১০. ঐ, বিষ্ণুপর্ব, ৫২, ৩, ৫১।
১১. শ্ৰীমন্ ভাগবতম, পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত, ১০. ৫২. ৩৭-৪৪।
১২. শ্রীমদ্ভাগবতম, ১০, ৬০. ১০-১৭।
১৩. রূপ গোস্বামী, উজ্জ্বলনীলমণি, পূর্বে উল্লিখিত, হরিপ্রিয়া প্রকরণ, শ্লোক নং ১১।
রূপ গোস্বামী তাঁর ললিমাধব নাটকে রাধা, চন্দ্রাবলী এবং আরও ছয় মুখ্য সখীকে নিয়ে অভিনয় জমিয়েছিলেন। কিন্তু এক সময়ে কৃষ্ণের মথুরাযাত্রার কষ্টে তাঁরা সবাই আত্মবিসর্জন দিলেন। পরবর্তী অঙ্কগুলিতে রূপ গোস্বামী রাধা, চন্দ্রাবলী সবাইকেই কৃষ্ণমহিষীরূপে পুনরুজ্জীবিত করেন। কৃষ্ণমহিষীদের মধ্যে রুক্মিণীই পাটরানী বলে ইতিহাস-পুরাণে বিখ্যাত। কিন্তু পুনরুজ্জীবনের সময়ে রূপ গোস্বামী রাধাকে করলেন সত্যভামা, কারণ তিনি বামা, মানিনী নায়িকা আর চন্দ্রাবলীকে করলেন রুক্মিণী, কারণ তিনি দক্ষিণা আনুগত্যময়ী নায়িকা।
১৪.. যোগেন্দ্রনাথ বসু, “সোর্সে অব দ্য টু কৃষ্ণ লিজেন্ডস্।” দ্রঃ ইন্ডিয়ান কালচার খণ্ড ৬নং ১-৪ (জুলাই ১৯৩৯-এপ্রিল ১৯৪০) পৃ. ৪৬৪-৪৬৭।
১৫. মহাভারত, শান্তিপর্ব, ৮১. ৫-১২।
১৬, হরিবংশ, হরিবংশপর্ব, ৩৮, ১৩-২৩।
১৭, বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩. ১৬।
১৮; ঐ, ৪. ১৩. ১৯।
১৯. হরিবংশ, হরিবংশপর্ব, ৩৮, ৩০-৩৬। বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩. ২০-২২। ব্রহ্মপুরাণ, ১৬. ২৯-৩৬।
২০. শ্লোকটি সম্পূর্ণ দেওয়া হল :
সিংহঃ প্রসেনমবধীৎ সিংহহা জাম্ববতা হতঃ।
সুকুমারক! মা রোদীস্তব হোষ স্যমন্তকঃ ॥ হরিবংশ, ১. ৩৮, ৩৬; বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩, ২২; ব্ৰহ্মপুরাণ, ১৬.
২১. ব্ৰহ্মপুরাণ ১৭, ২, হরিবংশ, ১, ৩৯, ২, বিষ্ণুপুরাণই একমাত্র বলেছে যে সত্যভামার প্রণয়প্রার্থী ছিলেন অর, কৃতবম শতধ–এরা তিনজনেই- তাঞ্চারকৃতবর্ম- শতধ-প্রমুখযাদবাঃ পূর্বং বরযামাসুঃ (৪. ১৩. ৩৫)।
২২. ‘তয়া চৈবমুক্তঃ পরিতুষ্টান্তঃকরণোপি কৃষ্ণ-সত্যভামার কথা শুনে কৃষ্ণ মনে মনে খুশি হয়েছিলেন এইজন্যে যে তাঁর ঈঙ্গিত মণিটি এবার সত্যভামার মাধ্যমে তাঁরই অধিকারে আসবে (বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩. ৩৮)।
২৩. হরিবংশে দেখি, বলরামকে বলার সময় কৃষ্ণ প্রথমে মুখ ফসকে বলেছিলেন–এ মণি এখন আমারই হবে- স্যমন্তকঃ সমগামী। কিন্তু বলরামের সাহায্যপ্রাথী কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে ভুল সংশোধন করে বলেছেন, মণিটি এখন আমাদের হবে। দ্রঃ হরিবংশ ১. ৩৯, ১০-১১।
২৪. বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩, ৪৬।
২৫, ঐ. ৪. ১৩, ৪৮-৫০।
২৬. “জ্ঞাতিভেদভয়াৎ কৃষ্ণস্তমুপেক্ষিতবানথ”, হরিবংশ, ১. ৩৯. ৩০-৩১।
২৭, বিষ্ণুপুরাণ, ৪, ১৩, ৫৬-৫৭।
২৮, ঐ, ৪. ১৩. ৬০।
২৯. হরিবংশ, ১, ৩৯, ৩৬-৩৭।
৩০. বিষ্ণুপুরাণ, ৪. ১৩, ৬৫-৬৮।
৩১. স্থিরমতি, মধ্যাস্তবিভাগভাষ্যটীকা, আর. সি. পায়ে সম্পাদিত, মতিলাল বনার্সিদাস, ১৯৭১, পৃ. ১৫০। স্থিরমতি লিখেছেন : অস্য চ মহাযানস্যাভিধায়িকা যা সূত্ৰাদিদেশনা সাপি মহাযানং ভবতি…যথা কংসবধো মণিহরণঞ্চ।
৩২. ধর্মসূরি, নরকাসুরবিজয়ব্যায়োগ, আন্দ্ৰেশর্মা সম্পাদিত, ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটি, হায়দ্রাবাদ, ১৯৬১, পৃ. ৭।
৩৩, বিষ্ণুপুরাণ, ৫. ৩০. ৩৩-৩৭।
৩৪. ঐ, ৫. ৩১.৩।
পুরাণকারেরা সত্যভামার আদরের নাম সত্য বললেও, শুষ্ক রুক্ষ বৈয়াকরণ পতঞ্জলি তাঁর আদরের নাম বলেছেন ভামা। পতঞ্জলি বলেছেন- এই জগতেই দেখা যায় সম্পূর্ণ বাক্য প্রয়োগ করতে গিয়ে লোকে বাক্যের খানিকটা বলে কিংবা সম্পূর্ণ পদ বোঝাতে গিয়ে পদের একটুখানি প্রয়োগ করে পদেষু পদৈকদেশা, যেমন ‘দেবদত্ত’ বলতে ‘দত্ত কিংবা ‘সত্যভামা না বলে শুধু ‘ভামা–সত্যভামা ভামেতি (ব্যাকরণমহাভাষা, মতিলাল বনার্সিদাস, দিল্লী প্রকাশিত, ১৯৬৭, ১. ১. ৪৫)। হায়! খ্রীস্টপূর্ব দেড়শ শতাব্দীতে লোক প্রযুক্ত ‘দৃশ্যন্তে হি..প্রযুঞ্জানা’–এইরকম পদ ব্যবহার দেখেও বঙ্কিমচন্দ্র সত্যভামার চরিত্রে বিশ্বাস করেন না।
৩৫. “জিতমভীরুমেব জাম্ববতী বদনারবিন্দোজ্জিতালীন”
ফ্লিট, করপাস্ ইনক্রিপসনাম্ ইন্ডিকেরাম, ৩য় খণ্ড, পৃ. ২৬৯, ২৭০।
অধিকন্তু পি. ব্যানার্জি, কৃষ্ণ ইন ইন্ডিয়ান্ আর্ট, ন্যাশনাল মিউজিয়াম, নিউ দিল্লী, ১৯৭৮, পৃ. ১৬৩।
৩৬. মহাভারত, মৌষলপর্ব, ৭, ৫৯।
৩৭, ঐ, মৌষলপর্ব, ৮, ১৭
যারা কৃষ্ণস্ত্রীদের হরণ করেছিল তাদেরকে কখনও বা ম্লেচ্ছও বলা হয়েছে মহাভারতে :
প্রেক্ষতবে পার্থস্য বৃষ্ণন্ধকবরক্সিয়ঃ।
জগুরাদায় তে মেচ্ছাঃ সমন্তাজ জনমেজয় ॥
মৌষলপর্ব, ৭. ৬৩।
৩৮. বরাহপুরাণ, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল সংস্করণ, কলিকাতা, ১৮৮৮, অধ্যায় ১৭৭, ৪-২৯ শ্লোক।
৩৯. সাম্বপুরাণ, বিজনবিহারী গোস্বামী সম্পাদিত, নবভারত পাবলিশার্স : কলিকাতা, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ, তৃতীয় অধ্যায়, ১৬-৫০ মোক।
৪০. ঐ, তৃতীয় অধ্যায়, ৪৬ শ্লোক।
৪১. মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ৭. ১৮।
৪২. হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ৩০. ৬৬।
কংসের সঙ্গে যুদ্ধে গোপেদের সোজাসুজি কৃষ্ণের সঙ্গে দেখা যায়নি বটে, তবে কংসের ধনুঃশালায় ঢুকে প্রথমে যখন কৃষ্ণ ধনুকখানি ভেঙে বেরিয়ে আসলেন, তখন কিন্তু কৃষ্ণ গোপেদের সঙ্গেই মিলিত হয়েছিলেন নির্গম্য বায়ুধাগারাজ জগতু গোপসন্নিধৌ (হরিবংশ, বিষ্ণুপর্ব, ২৭, ৫০)। এ ঘটনা গোপবাহিনীর ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত বহন করে কি?
৪৩. মহাভারত, উদ্যোগপর্ব, ১৯, ১ এবং ১৯, ১৭।
৪৪. ঐ, শল্যপর্ব, ৩৫, ১৪।
৪৫. ঐ, মৌষলপর্ব, ৩. ১৮।
৪৬. ঐ, মৌষলপর্ব, তৃতীয় অধ্যায়।
৪৭. ঐ, মোষলপর্ব, ৪, ৪, ৭, ৮।