• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মহান বদরের যুদ্ধ – মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল

লাইব্রেরি » মহান বদরের যুদ্ধ – মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল
মহান বদরের যুদ্ধ

মহান বদরের যুদ্ধ – মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল

অনুবাদ : মোঃ জহুরুল ইসলাম
সম্পাদনা: প্রফেসর ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রথম প্রকাশ – রমযান, ১৪১৯ জানুয়ারী, ১৯৯৯
প্ৰকাশক – মোহাম্মদ শরীফ হোসেন
দারুস সালাম পাবলিকেশন্স

.

উৎসর্গ

আমার প্রাণপ্রিয় বিলকিস বেগম, ফাতেমা যাহরা, সাফিয়া রহমান ও সালমা ইয়াসেমিন প্রমুখের নামে উৎসর্গীকৃত। কারণ এরাই এর প্রাণ প্রবাহ। তাই অনাগত ভবিষ্যতে এরাই একে আরো সঞ্জীবিত, পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত, সুশোভিত ও পত্র-পল্লবিত করে তুলবে। আমীন। সুম্মা আমীন!!

শুভার্থী
মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান

.

প্রাসংগিক প্রাক কথন

সমগ্র বিশ্ব-জাহানের একমাত্র মালিক ও প্রতিপালক আল্লাহ পাকেরই যাবতীয় প্রশংসা এবং স্তবস্তুতি। মানবতার হিদায়েতের লক্ষ্যে প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব সর্বনন্দিত ও বিশ্ববরেণ্য রসূল মুহাম্মদ মোস্তফা (সঃ) তাঁর সাহাবা-ই-কিরাম, তাবিঈন এবং আল ও আওলাদের প্রতি অজস্র দরুদ ও সালাম।

ইসলামের ইতিহাসে বদর যুদ্ধ এক গুরুত্বপুর্ণ অবিস্মরণীয় ঘটনা। কুফরের দুর্জয় দুর্গে মুষ্টিমেয় মুসলমানের পক্ষ থেকে এক দুর্দমনীয় প্রচন্ড আঘাত। এ আঘাত প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কুরাইশদের দ্বারা সম্ভব হয়নি। কারণ আল্লাহর রসূল এ আঘাত হেনেছিলেন স্বয়ং আল্লাহরই হুকুমে। তাই কুফর-দুর্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ ও খণ্ড বিখন্ড হয়ে গেল। বড় বড় কুরাইশ দলপতির চিরতরে বিনাশ ঘটলো। তাদের মেরুদণ্ড এমন ভাবে ভাঙ্গলো যে শির উঁচু করে দাঁড়াবার আর ক্ষমতাই রইলনা।

এই মহান যুদ্ধে অংশ গ্রহণ কারীদের ইসলামের ইতিহাসে সব চাইতে বেশী গুরুত্ব ও প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে মুহাজিরদের তুলনায় আনসারদের ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। একান্ত নিরস্ত্র ও নিঃসম্বল হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি সাধন কল্পে তাঁরা অম্লান বদনে অকুতভয়ে সেই বিশাল বিরাট ‘তাগুতী, শক্তির সম্মুখীন হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ্ স্বয়ং এই গাযওয়ার মাধ্যমে ইসলামের সমুজ্জল সত্যকে সপ্রমাণ করে একে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’ বা পার্থক্যকারী যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত ও আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এর মাধ্যমে ঈমান ও কুফর, হকও বাতিল এবং সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যের সীমারেখা টেনে দেয়া হয়েছে আর এভাবেই ইসলাম তার সহজাত বৈশিষ্ট্য এবং স্বকীয় জৌলুসে ফুটে উঠে স্বমহিমায় ভাস্বর হয়েছিল।

পবিত্র কুরআনের সূরা ‘আনফালে’ বদর যুদ্ধের বিস্তারিত পটভূমিকা ও বিবরণ বিধৃত হয়েছে। এছাড়া উর্দ্ধ গগন থেকে অসংখ্য ফেরেশতা মন্ডলী শুভ্রোজ্জল পাগড়ী পরিহিত অবস্থায় এই রণ ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে এতে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। তাই এ ছিল প্রকৃত পক্ষে ইসলামের বিজয় ও মর্যাদা লাভের ভিত্তি প্রস্তর।

বদর, উহুদ, খন্দক প্রভৃতি জিহাদ (আল্লাহর পথে) সম্পর্কে তথ্য সমৃদ্ধ পুস্তক প্রণয়ন আমার বহুদিনের সুপ্ত বাসনা ও প্রচ্ছন্ন প্রত্যাশা। কিন্তু এ পর্যন্ত মনের এই লালিত বাসনা বাস্তবে রূপ দেয়ার তেমন কোন সম্ভাবনাময় সুযোগ সুবিধে আমি করে উঠতে পারিনি। তাই অন্তরের গুপ্ত কোণের এই সুপ্ত আকাংখা শুধুমাত্র মনের বেণুবনেই গুমড়ে মরেছে।

এই শতকের আশির দশকে শুনেছিলাম সউদী আরবের প্রখ্যাত পন্ডিত জনাব বসুমাইল সাহেব বদর ও উহুদ ইত্যাদি ধর্মযুদ্ধ গুলোকে কেন্দ্র করে বেশ গবেষণামূলক ও তত্ত্ববহুল গ্রন্থ রচনা করেছেন আরবী ভাষায়। আমি চেয়েছিলাম আরবী থেকে বাংলায় ভাষান্তর করতে। কিন্তু আমার গবেষণা সন্দর্ভের ব্যস্ততা ও কর্মতৎপরতাই এ পথে অন্তরায় ও প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করেছিল।

মনীষী বসুমাইল কৃত মহান বদরের যুদ্ধ শীর্ষক বইটি আরবী ভাষাভাষীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন ও সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়ে এর একাধিক সংস্করণ প্রকাশ পায়-এভাবে এর ক্রমবর্দ্ধমান গুরুত্ব অনুধাবন করে তিনি স্বয়ং একে ইংরেজীতে অনুবাদ করিয়ে লাহোর থেকে প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের খ্যাতিমান লেখক ও কুরআন বিশারদ মওলানা মওদূদী সাহেব ও এই ভাষান্তরের ক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করেন এবং গ্রন্থের শুরুতে একটা মূল্যবান ভূমিকাও লিখে দেন।

ইতিমধ্যে কোন এক সুসময়ে ভারতের প্রখ্যাত আলেম মওলানা আবদুল জলীল সামরোদী কৃত “শুহাদা-ই-উহুদ” নামক অনবদ্য উর্দূ বইটিও আমার হাতে আসে। অনুরূপভাবে ডঃ এম হামীদুল্লাহ এবং গুলজার আহমদ রচিত “রাসূলুল্লাহ্র রণক্ষেত্র” নামক গ্রন্থদ্বয়েরও আমি সন্ধান পাই। কিন্তু একই কারণে অর্থাৎ সময় সুযোগের উৎকট অভাব হেতু আমি এ বইগুলোর সৎকার ও সদ্ব্যবহার করতে পারিনি।

১৯৮৭ সালের আগষ্ট মাসে আমার লেখা “মদীনার আনসার” শীর্ষক ২২৮ পৃষ্ঠার বইটা যখন আত্মপ্রকাশ করে তখন এতে বদর যুদ্ধের ঘটনাবলী পুংখানুপুংখরূপে বিধৃত হয়। কারণ এতে সক্রিয় অংশ গ্রহণকারীদের মধ্যে আনসারদেরই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এ সত্ত্বেও আমি বিশেষ কারণে জনাব বসুমাইলের ‘জংগে বদর’ সম্পর্কিত আরবী বইটিকে বাংলায় তরজমা করার প্রবল আকাংখা আদৌ প্রশমিত করতে পারিনি।

এদিকে প্রায় দুই যুগেরও অধিক কাল ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শ্রেণী সমূহে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ক্লাশ নিয়েছি। এভাবে মুখের ভাষা তথা মায়ের ভাষা বাংলার প্রতি মনের কোণে যে প্রবণতা অনুভূত হয়েছে তার তুলনায় কুরআনের ভাষা তথা আল্লাহর ভাষা আরবীর প্রতি আমার প্রবণতার অনুভূতি আদৌ কম হয়নি। এ ভাষার কদর, আদর এবং অনুশীলনও আমি কম করিনি। আমার অধিকাংশ বই-পুস্তকের প্রনয়ণ এই আরবী ভাষাকে নিয়েই আর্বতিত

এই প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই একান্ত স্বভাবগত ও মজ্জাগতভাবেই আমি চেয়েছিলাম আরবী তাফসীর ইবনু কাসীর এবং অন্যান্য গ্রন্থমালার মতোই জনাব বসুমাইলের আরবী বইকেও বাংলায় রূপান্তরিত করবো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছে না হলে মানুষের অন্তস্থিত সাধ-অভিলাষ অক্ষরে অক্ষরে কখনোও পূরণ হতে পারে কি? না, তা, কস্মিনকালেও পারেনা। সুতরাং আমার বেলায়ও তাই ঘটলো।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা জীবনের সুদীর্ঘ সময়কালের মধ্যে এই আরবী বইটির হদিস আমি কোনক্রমেই খুঁজে পাইনি। কিন্তু ১৯৯৩ সালের প্রান্তভাগে দেশের ভৌগলিক গন্ডি পেরিয়ে যখন আমি যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা দেই তখন তার অব্যবহিত পরেই হঠাৎ করে দেখি নিউইয়র্কের ইলমহার্ষ্ট এলাকার এক বিরাট বড় মুসলিম পুস্তক বিপনীতে আলোচ্য বইয়ের ইংরেজী অনুবাদটি তার শোভাবর্ধন করছে। মূল আরবী গ্রন্থ না পেয়ে তখন শেষ পর্যন্ত আমি এই ইংরেজী থেকেই ভাষান্তরে পরিকল্পনা নেই।

এক্ষণে এই অনুদিত আলোচ্য বইটিকে সব দিক দিয়ে নির্ভুল, অভ্রান্ত এবং প্রমাদবিহীন ভাবে যে সহৃদয় পাঠকবর্গের হাতে অর্পণ করতে পারছি, এমন দাবি আমি করিনা। কারণ আমার ন্যায় একজন সদা ব্যস্ত দীন হীন আকিষ্ণনের পক্ষে এককভাবে অনুবাদের এই কাজটি নিখুঁতভাবে আঞ্জাম দেয়া আদৌ সম্ভবপর নয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মতো এই ব্যস্ততম প্রবাস জীবনে এ কাজটি আরো দুরূহ ও দূরাতিক্রম্য। তাই এ কাজে আমাকে অকুণ্ঠ ও সক্রিয় সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ইংরেজী বিভাগের স্বনামধন্য অধ্যাপক জনাব জহিরুল ইসলাম সাহেব। সুতরাং সবটুকু কৃতিত্ব তাঁরই এবং আমি তাঁর কাছে চিরঋণী। আজ এ পুস্তক প্রকাশনার শুভলগ্নে তাঁর ইহ-পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় আমি মহান আল্লাহর সমীপে জানাই অজস্র অসংখ্য আকুল মুনাজাত।

জনাব অধ্যাপক জহির সাহেবের এই সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতার যথাযোগ্য স্বীকৃতি স্বরূপ আমি চেয়েছিলাম এ গ্রন্থের পরিশিষ্টাংশে তাঁর মূল গ্রন্থের লেখক জনাব বাসুমাইল সাহেবেরও ‘পরিচিতি’ প্রদান করতে। কিন্তু নিতান্তই পরিতাপ যে এই সুদূর বিদেশ বিভুঁয়ে অবস্থান করে এবারের মতো কোনটাই সম্ভবপর হলোনা। মাল-মসলা ও উপাদান উপকরণ আহরণ করতে গিয়েও বারবার হোঁচট খেয়েছি এবং অপারগ হয়েছি তাই আমার প্রবল ইচ্ছা এবং দৃঢ় সংকল্পও এখানে কোন কাজে আসেনি।

কিন্তু এ সত্বেও আমি কখনোও নিরাশ ও হতাশাগ্রস্থ হয়ে একেবারে হাল ছেড়ে বা হাত গুটিয়ে নেইনি। তাই পরবর্তী সংস্করণের বেলায় এ সবগুলোকে একসাথে সংযোজন করে নিখুঁৎ ও অভ্রান্তরূপে পরিমার্জিত আকারে পাঠকবর্গের হাতে তুলে দেয়ার একান্তই ইচ্ছে রইলো। এই প্ৰচ্ছন্ন ও সুপ্ত আশা-ভরসা বুকে নিয়ে একমাত্র আল্লাহর সাহায্য-সহায়তার উপর · নির্ভর করে আমার এই অতৃপ্ত আকাংখা ও অভিলাষের বাস্তবায়ন কল্পে অনাগত ভবিষ্যতের পানেই নির্নিমেষ নয়নে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে রইলাম। “ওয়ামা যালিকা আলাল্লাহি বি আযীয। রাব্বানাওয়া তাকাব্বাল দু’য়া” ১৪:৪০)

আগেই বলেছি এই সুমহান বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে এক অপরিসীম গুরুত্ব এবং অন্তহীন মূল্য ও তাৎপর্যের ধারক। কিন্তু পরিতাপের কথা যে, এই বদর, উহুদ, খন্দক, খয়বর ইত্যাদি যুদ্ধ সম্পর্কে আরবী, ফারসী, উর্দু, ইংরেজী, ফরাসী প্রভৃতি ভাষায় লিখিত গ্রন্থমালার তুলনায় বাংলা বই পুস্তকের সংখ্যা একান্তই অপ্রতুল, অপর্যাপ্ত এবং নগণ্য। অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের অংশ বিশেষ নিয়ে এই ভাষাভাষী বিপুল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৫/২০ কোটির কম নয়। তাই এজাতীয় আলোচ্য প্রাসঙ্গিক বই পুস্তকের চাহিদা এবং প্রয়োজন যে অতি প্রকট ও অপরিহার্য তা’ সহজেই অনুমেয়।

বলাবাহুল্য, এই দুর্বার প্রচ্ছন্ন চাহিদা ও প্রয়োজনের পরিপূরণ এবং এই দিগন্তব্যাপী ও সুদূর অভাব বিদূরণ ও বিমোচনের অভিপ্রায় নিয়ে শুধু আল্লাহর সাহায্যের উপর নির্ভর করে এই দুর্গম, বন্ধুর ও কন্টকাকীর্ণ পথে পা বাড়িয়েছি, যদিও আমার ব্যক্তিগত সংকোচ, সীমাবদ্ধতা এবং সংকীর্ণতা সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ ওয়াকিফহাল। কারণ আমার হৃদয় চিত্বের অন্তর্নিহিত তাড়না, অদম্য স্পৃহা এবং প্রানের উৎসারিত ও উচ্ছ্বসিত ভাবাবেগকে আমি শুধুমাত্র আজ কেন, কোনদিনই সংবরণ করতে পারিনি।

সুতরাং আমার এই দুঃসাহসিক পদক্ষেপের ন্যায়সঙ্গত, চুলচেরা ও সূক্ষ্ণ মূল্যায়ন এবং বিচার বিশ্লেষণের দায়িত্বভার সুধী পাঠকবৃন্দের স্কন্ধেই ন্যস্ত রইলো। কারণ এর মানদন্ড ও কষ্ঠিপাথর তো তাঁদেরই হাতে। অতএব এই ভ্রান্তি প্রমাদ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে দয়া করে তাঁরা যদি আমাকে অবহিত করেন, তবে আগামী সংস্করণে সেগুলোর যথাযোগ্য সংশোধন ও সংযোজন করে পরিমার্জিত ও পরিবর্দ্ধিত কলেবরে পুণঃ প্রকাশের আপ্রাণ চেষ্টা বো। জাতির সকল প্রকার হিদায়েৎ ও কল্যাণের লক্ষ্যে প্রানান্তকর প্রচেষ্টা চালাতে আমি সদা প্রস্তুত এবং চির আগুয়ান ও চলমান। ওয়ামা তাওফীকি ইল্লা বিল্লাহি আলাইহি তাওয়াক্কালতু ওয়া ইলাইহি উনিব।

এ গ্রন্থটি পান্ডুলিপির গহ্বর ও অন্তরাল তথা আঁধার কুহেলিকা থেকে সজোরে দ্রুত গতিতে নির্গত হয়ে কখনোও দিনের মুক্ত ও সুস্পষ্ট আলো বাতাস দেখতে ও তার সাথে পরিচিত হতে পারতোনা যদি সউদী আরবের রিয়াদ প্রবাসী এবং ঢাকার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী আলহাজ্জ মোহাম্মদ শরীফ হোসেন সাহেব প্রকাশনার যাবতীয় দায়িত্বভার নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করে এদিকে এগিয়ে না আসেতেন। তাঁর এ আন্তরিকতা ও নায়নিষ্ঠা সার্বক্ষণিক ভাবে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত এবং চির অম্লান ও অক্ষুণ্ন হয়ে থাকবে। আল্লাহ পাক তাঁকে নায্য প্রতিদানসহ আরো তাওফীক প্রদান ও দীর্ঘায়ূ করুন। আমীন! তাঁর সাথে আমার কোনদিন দেখা সাক্ষাৎ ঘটেনি। আজ তাই এই অদৃশ্য ও অদেখা গুনী ব্যক্তির এবং তাঁর পরিবার পরিজনের সামগ্রিক কল্যাণ, মঙ্গল ও শুভ কামনা করতে গিয়ে বিশ্বপ্রভুর দরবারে জানাই স্বার্বক্ষণিক আকুল মুনাজাত ও মিনতি।

সুষ্ঠু ও ত্রুটি বিমুক্ত কম্পিউটার কম্পোজ ও অক্ষর বিন্যাসের গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জনাব সাজিদুর রহমান ও সাইফুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ যে আন্তরিকতা ও কর্তব্যবোধের পরিচয় দিয়েছেন তা কখনোও বিস্মৃত হবার নয়। বস্তুতঃ এঁদের সবারই দ্বিধাহীন ও নিরন্তর প্রেরণা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রকাশনার এই দুর্গম পথকে অনেকখানি সুগম করে পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। তাই সকলকে আন্তরিক সাধুবাদ জানিয়ে আল্লাহর সমীপে এদের ইহ-পরকালীন অনন্ত কল্যাণ কামনা করছি। আরো করি আমার ক্ষুদ প্রায়সকে তুমি সবার জন্য পারলৌকিক মুক্তির সম্বল ও নাজাতের অসীলা করে দাও। আমীন! সুম্মা আমীন!! রাব্বানা ওয়া তাকাব্বাল দোয়া।

বিনয়ানত
ডঃ মুহাম্মদ মুজীবুর রহমান
প্রাক্তন প্রফেসর ও চেয়ারমান
আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ

বর্তমানে :
পরিচালক, উচ্চতর ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র
ইষ্ট মিডো এ্যাভেনু, ই. এম.
নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা
রমযান ১৪১৯ হি
জানুয়ারী ১৯৯৯

.

১৯৩৬ সালে বাবলাবোনা নামক এক ছায়া ঢাকা নিভৃত গ্রামে ডঃ মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান এর জন্ম। পিতা অধ্যাপক মওঃ আবদুল গণীর কাছেই তার প্রথম হাতে খড়ি। প্রথমে রাজশাহী নবাবগঞ্জের পার্শ্ববর্তী গ্রাম এবং পরে ঢাকা সরকারী আলিয়া মাদ্রাসা থেকে কৃতিত্বের সাথে কামিল পাশ ডিগ্রী নিয়ে তিনি দাদনচকে প্রথম স্তরের ডিগ্রী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তার পিতা আবদুল গণী সাহেবও এককালে ওখানে অধ্যাপনা করতেন।

ডঃ মুহাম্মাদ মুজীবুর রহমান দাদনচক থেকে যখন নবাবগঞ্জ ডিগ্রী কলেজে গিয়ে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন তখন রাজশাহী বিশববিদ্যালয় থেকে এম. এ/. পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৬৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের প্রভাষক হন। পরবর্তীতে আরবী বিভাগের সভাপতি, সহযোগী অধ্যাপক এবং সর্বশেষে তিনি অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারেও তিনি কিছু দিন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হিসাবে কাজ করেছিলেন। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্ক শহরে এক ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের পরিচালক।

গতিশীল প্রবন্ধকার হিসেবে ঢাকার ছাত্র জীবন থেকেই তিনি বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। বিভিন্ন ভাষায় তার বিচিত্র-ধর্মী প্রবন্ধমালা দেশ-বিদেশের একাধিক পত্র পত্রিকায় ব্যাপক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে। বাংলাদেশ ছাড়াও দিল্লী, হায়দারাবাদ, লাহোর, করাচী এবং ইসলামাবাদের বিভিন্ন প্রথম শ্রেণীর উর্দু পত্রিকায় তার যে সব চিন্তাদীপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধমালা মুদ্রিত হয়, সেগুলি পরবর্তীতে নয়াদিল্লী, বেনারস ও ইসলামাবাদ থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও পশ্চিম বঙ্গের বহু সাময়িকী ও পত্র পত্রিকায় তার অসংখ্য তথ্য-সমৃদ্ধ ও উন্নত মানের প্রবন্ধ রাজি প্রকাশিত হয়েছে একাদিক্রমে। এগুলি একত্রিত করে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষ ও পরিপুষ্টি সাধিত হতো নিঃসন্দেহে। বর্তমানে সাগর পারের সুদূর প্রবাস থেকেও তিনি সেগুলি প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে এর সঠিক বাস্তবায়ন রয়েছে একমাত্র আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের হাতেই।

।১৯৫৩ সালের দিকে ঢাকার বাংলা বাজারস্থ “ঢাকা প্রকাশ” নামক পত্রিকায় তিনি একটি লেখা দিয়েছিলেন অন্তরের বহু সাধ ও আশা-আকাংখা পোষণ করে। লেখাটি মুদ্রণ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর নামে নয়; বরং অন্যের নামে। এরপর থেকে বুক ভরা দুঃখ এবং এই বঞ্চনা জনিত ক্ষোভে তিনি সাহিত্য-চর্চা এক রূপ ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু এ নেশা যাকে একবার পেয়ে বসে, সে তা কোনদিন পরিহার করতে পারে না। লোভী তার ভুলের মাশুল দিয়ে কম্বলকে ছাড়তে চাইলেও কম্বল তাকে ভুলেও কখনো ছাড়ে কি? ডঃ মুজীবুর রহমানের সাহিত্য কর্ম ও রচনা শৈলীর অধিকাংশই ইসলামী সাহিত্যকে নিয়ে অনুবর্তিত। এ নিয়েই তার নশ্বর জীবন হয়ে উঠেছে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সে যাই হোক, উক্ত সালের শেষ প্রান্তে জমঈয়তে আহলে হাদীস কর্তক প্রকাশিত “তরজুমানুল হাদীস” নামক উচ্চাঙ্গের এক মাসিক পত্রিকায় তার লেখা “ত্যাগের দৃষ্টান্ত ও আদর্শের প্রেরণা” শীর্ষক প্রবন্ধ ছাপে। তখন কিন্তু তাঁর ঢাকাস্থ ছাত্র জীবনের পাঠ চুকিয়ে সবেমাত্র পাঞ্জাবের লাহোর শিক্ষা জীবনের সূচনা ঘটেছে। এছাড়া দেশ-বিদ্যাপীঠের ম্যাগাজিনে বহু মৌলিক এবং ভাষান্তরিত প্রবন্ধাবলী, নাটিকা, ছোটগল্প ইত্যাদি প্রকাশ পায়। সব মিলিয়ে এগুলোর সংখ্যা প্রায় দেড় দু’শের কাছাকাছি। এগুলোকে একত্রে সাজিয়ে গুছিয়ে গ্রন্থাবদ্ধ অবস্থায় বিন্যস্ত করে কয়েকটি আলাদা আলাদা খণ্ডে সংকলিত করা যেতে পারে কিন্তু তা করা কি আর সহজ ব্যাপার! ছাপাবে কে? এমনিতেই তার একাধিক প্রবন্ধমালা ও গন্থাবলীর পান্ডলিপি হারিয়ে গেছে পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী ও প্রকাশকদের কাছ থেকে। বিগত রাষ্ট্রবিপ্লব ও গণ-আন্দোলন জনিত ধ্বংস যজ্ঞের শিকার হয়ে তার বেশ কিছু পান্ডুলিপি বিনষ্ট ও অবলুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে। আর যেগুলি আজো পান্ডলিপির আকারে আবদ্ধ থেকে গুমরে মরছে, সে সব কবে যে দিনের আলো দেখতে সক্ষম হবে তা একমাত্র অন্তর্যামীই জানেন।

একাধারে ৪-৫টি ভাষায় তিনি সমান পারদর্শী এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাষা সমূহের প্রায় সবটাতেই তার কিছু না কিছু বই পুস্তক ও প্রবন্ধাবলী প্রকাশিত হয়েছে অবলীলাক্রমে। অবসর মুহূর্তে তিনি শিশু সাহিত্যের চর্চা করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে তার লেখা ‘বটগাছের ভূত’, ‘মৃত্যুর ভয়’, ছোটদের ইবনে বতুতা’ প্রভৃতি লেখাগুলি বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। এভাবে সাহিত্যের অধিকাংশ শাখায় সমান ভাবে পদচারণা করতে গিয়ে তিনি প্রায় তিন যুগ ধরে বিভিন্ন ভাষায় নিরলস ভাবে কলম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার লেখায় কোন আবেগ প্রবণতা নেই, আছে মননশীলতার দীপ্তি। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সাধনাকে তিনি স্বীয় উপজীবিকার উৎস হিসাব গ্রহণ করেননি, বরং অবসর ক্ষণের চিত্ত বিনোদন হিসাবেই বেছে নিয়েছেন।

১৯৫৩-এর দিকে উচ্চ শিক্ষার্থে লাহোর গিয়ে তিনি দেখেন, সেই পরিবেশ সম্পূর্ণই নতুন এবং একবারেই আলাদা। সেখানকার ভাষা ও সাহিত্য বাংলা নয়, বরং উর্দু। তাই উর্দু সাহিত্যকে বাংলায় ভাষান্তরিত করে এদেশের জনগণের জন্য এদেশেরই পত্র পত্রিকায় পাঠাতেন। এগুলির সংখ্যাও নেহাত কম নয়।

বিভিন্ন ভাষায় লিখিত তার বইগুলির মধ্যে “মাযামীনে মুজীব” (নয়া দিল্লী থেকে প্রকাশ) ‘ইমাম বুখারী, ‘ইমাম মুসলিম’, ‘মুহাদ্দিস প্রসঙ্গ’, ‘হযরত ইব্রাহীম’, ‘মুসলমানদের সাহিত্য সাধনা’, ‘ইসলামী সাহিত্যে তসলিমুদ্দীন’, ‘মিসরের ছোট গল্প’, ‘কোর’আন কণিকা’, ‘তাফসীর ইবনে কাসীর’, ‘আরবী সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘মদীনার আনসার ও হযরত আবূ আইউব আনসারী’, ‘বাংলা ভাষার কোর’আন চর্চা’, ‘মওলানা মুহাম্মদ জুনাগড়ী (রহঃ)’ ‘নবীজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নামায’, ‘ইদ্রিস মিয়া’, ‘মুহাদ্দিস আযীমাবাদী’ প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখ্যের দাবীদার। উপরোক্ত বিষয় বস্তুই হচ্ছে তার রচনাশৈলী ও সাহিত্য চর্চার প্রধান উপজীব্য বিষয়।

ডঃ এম, মুজীবুর রহমান কৃত অধিকাংশ বই ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত। তার ‘আল্লামা জারুল্লাহ্’ শীর্ষক বইটি প্রথমে ইসলামাবাদ থেকে উর্দুতে প্রকাশ পায়। এর বাংলা সংস্করণটি প্রথমে ধারাবাহিক ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকায় এবং পরে উক্ত সংস্থা থেকে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। তার “কোরআনের চিরস্তন মুজিযা” শীর্ষক বইটিও প্রথমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে এবং পরবর্তীতে এর উর্দূ সংস্করণটি বেনারস থেকে প্রকাশিত। এর অপূর্ব জনপ্রিয়তার এটাই প্রকৃষ্ট প্রমাণ যে, স্বল্প দিনে উভয়েরই বেশ কয়েকটি সংস্করণ বেরিয়ে যায়। “মাযামীনে মুজীব” নামক বইটি একাধিক খন্ডে ভারতের নয়া দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ‘বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন চর্চার পটভূমি’ শীর্ষক বইটি গুলবাহার খাতুন কর্তৃক ২৪ পরগণার চিংড়িপোতা থেকে প্রকাশিত। এটি তার পি. এইচ.ডি. থিসিসেরই একাশং। এর শুরুতে বেশ মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ মুখবন্ধটি হচ্ছে পশ্চিম বংগের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও প্রবীণ গবেষক এম. আবদুর রহমানের লেখনী প্রসূত। এই আব্দুর রহমান সাহেব মিসর থেকে তাঁর কিছু কিছু বই ডঃ রহমানের নামে উৎসর্গও করেছেন। থিসিস করার সুযোগ পেয়েও ভাগ্যচক্রে পরবর্তীতে যেহেতু তাকে সেই সুযোগটি হারাতে হয়েছিল। তাই ১৯৮১ সালের শুরুতে উক্ত বিষয়বস্তু শীর্ষক থিসিসের ফলশ্রুতিতে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। দেশী-বিদেশী পরীক্ষক মন্ডলীগণ সম্মিলিত ভাবে মন্তব্য করেছিলেন যে, এই আলোচ্য সুলিখিত অভিসন্দর্ভটি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্ব পূর্ণ সংযোজন। এটিও ঢাকার ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত। এর সূচনাংশে বেশ তথ্য সমৃদ্ধ মুখবন্ধ লিখেছেন যথাক্রমে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ হাবীবুর রহমান চৌধুরী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন মহাপরিচালক জনাব আবদুস সোবহান সাহেব।

ডঃ মুহাম্মদ মুজীবর রহমান ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি’, ‘ইতিহাস পরিষদ’, ‘এশিয়েটিক সোসাইটি’ ও ‘বাংলা একাডেমীর’ আজীবন সদস্য। এছাড়া ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’, ঢাকা, বাংলাদেশ পরিষদ, রাজশাহী; শামাখদুম ইনস্টিটিউট, রাজশাহী; প্রভৃতি সংস্থা ও সংগঠনের সদস্য হিসাবে তিনি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। বেশ কিছুদিন পূর্বে কলকাতার ইন্দো-আরব কালচারাল এসোসিয়েশনও তাকে সদস্যপদ করেছে।

এদেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন মুখী জাতীয় সম্মেলন এবং বড় বড় সভা সমিতিতে তিনি সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন এবং ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী সাহিত্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বস্তু সম্পর্কে আলোকপাত করেন। অনুরূপ ভাবে একই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধন কল্পে তিনি বিদেশের বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান এবং চিন্তাদীপ্ত ও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধরাজির উপস্থাপনা করে দেশের প্রতিনিধিত্ব ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও তিনি ভাষণ দান করেন। এভাবে মক্কার উম্মুল কোরা ও মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, করাচী, মুলতান ও বাহাওয়ালপুর বিশ্ববিদ্যালয়, লাহোর ও ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসব শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উপস্থিত ভাষণ দান ও চিন্তাদীপ্ত প্রবন্ধ পাঠের মাধ্যমে তিনি বরাবর অংশ গ্রহণ করেন। অনুরূপ ভাবে লন্ডন, বার্মিংহাম, লেইসটার, ইস্তামবুল, রাজস্থান, আসামের রতনপুর, হাইলাকান্দী প্রভৃতি শহরে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারেও তিনি যোগদান করেন এবং মূল্যবান প্রবন্ধ পাঠ করেন।

মোট কথা, প্রায় ১২-১৪টি দেশে তিনি ভ্রমণ করেছেন উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণার প্রচার-প্রসারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়েই। তাই এতো নদ-নদী আর সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এই গগনচুম্বী পরিবেষ্টিত সুদূর আমেরিকার মাটিতে তার প্রথম ও একমাত্র প্রবাস জীবন বললে ভুল হবে। কারণ আগেই বলেছি, ছাত্র জীবন থেকেই তিনি অতি ব্যাপক ভাবে সস্ত্রীক পরিভ্রমণ করেছেন বিচিত্র দেশের পথ-প্রান্তরে। প্রত্যক্ষ করেছেন বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরণের জাতি, ধর্ম ও মানুষ এবং নানা অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জীবনধারা। সব কিছুই দেখতে চেয়েছেন অতি সহজ, সরল, অনাড়ম্বর এবং স্বচ্ছ দৃষ্টি দিয়ে এবং অকপটে ব্যক্ত করেছেন স্বীয় পছন্দ, অপছন্দ ও ভালো মন্দের কথা।

পূর্বেই বলেছি, মিসরের মাটি থেকে আরবী ভাষায় পি. এইচ. ডি. করতে চেয়েও তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। কিন্তু এ সত্ত্বেও এই মিসরকে তিনি অন্তর দিয়ে ভালবাসেন। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিসাবে তার লেখা “মিসরের ছোট গল্প” “মার্গারেট; “স্মৃতিময় শৈশব” প্রভৃতির নামোল্লেখ করা যেতে পারে। এই শেষোক্ত গ্রন্থদ্বয় দীর্ঘ এক বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে দৈনিক মিল্লাতের সাহিত্য পাতায় এবং মাসিক ‘অনুক্তের’ পৃষ্ঠা সমূহে। বিভিন্ন সংস্করণ এই বইগুলির জনপ্রিয়তার প্রমাণ।

স্বীয় মাতৃভাষা বাংলায় রচিত তার অধিকাংশ রচনাশৈলীর মাধ্যমে এই ভাষা ও সাহিত্যের ইসলামী ধারাটিকে সুসমৃদ্ধ ও সরস করে তুলতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। এভাবে মুসলিম মানস ও ব্যক্তিত্ব, ইতিহাস এবং প্রাসঙ্গিক বিষয় বস্তুগুলিকে নতুন আঙ্গিকে প্রথম বারের মতো তিনি বিদগ্ধ পাঠক মহলের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। এসব রচনাশৈলী ও সাহিত্যধারা প্রকৃত প্রস্তাবে তার অনুসন্ধিৎসু পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা মূলক মনোবৃত্তিরই পরিচায়ক। এসবের মাধ্যমে বহু অজ্ঞাত ইতিহাস এবং দুর্লভ ও অপ্রাপ্তব্য তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে আমাদের সম্যক পরিচয় ঘটেছে।

একান্তই নিঃস্ব, রিক্ত ও নিঃসহায়দের যুগ যন্ত্রণা বুকের মাঝে পুষে রেখে এক মাত্র আল্লাহর আশীষ ধারাকে রক্ষাকবজ করে শিক্ষকতার মাধ্যমে তার এই ক্ষণস্থায়ী নশ্বর জীবনের সূত্রপাত ঘটে। প্রায় তিন যুগ ধরে নিরলস শিক্ষাদান ও লাগাতার সাহিত্য সেবাই তার জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। বিষয় বস্তুর গভীরতম প্রদেশে অনুপ্রবেশ করে তথ্যানুসন্ধানের আজন্ম প্রবণতাই তার সম্মুখ পানে হাজির করেছে পরিশীলিত বাণী আর তার সাহিত্য সৃষ্টিতে যুগিয়েছে বিচিত্র ধরণের মাল-মসলা এবং উপাদান উপকরণ। নিরন্তর সাহিত্য সৃষ্টিতে তার বিচিত্র অর্ন্তদৃষ্টি ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সমাহার ঘটেছে উপর্যুপরি প্রকাশিত গ্রন্থমালায়। বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্যশিল্পের স্মরণীতে তার প্রকাশনাগুলি নিঃসন্দেহে যেন এক একটি স্বগর্ব অধ্যায় ও পথ নির্দেশক। এই অবিশ্রান্ত সংগ্রাম এবং অবিরাম প্রচেষ্টার মাধ্যমেই তিনি প্রথমে উপনীত হয়েছেন গন্ড গ্রাম-গঞ্জের নিভৃত কোণ থেকে শহরে বন্দরে এবং পরে রাজধানী নগরে, আর সর্বশেষে এসেছেন সুদূর আমেরিকার মাটিতে তথা নিউ ইয়র্ক নগরীতে। বর্তমানে তিনি এই শহরে এক উচ্চাঙ্গের শিক্ষা কেন্দ্রের (এডুকেশন সেন্টার) পরিচালক। আর ইতিপূর্বে ছিলেন “টেষ্টিমনি” নামক এক ইংরেজী মাসিক পত্রিকার সহ-সম্পাদক।

কিন্তু এই সুদূর প্রবাসের অতি ব্যস্ত সমস্ত এবং সংগ্রাম মুখর জীবনেও কি তার লেখনী কিংবা সাহিত্য চর্চায় কোন রূপ ছেদ বা ভাটা পড়েছে কিংবা একেবারেই এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে? না আদৌ তা হয়নি, বরং তার বলিষ্ঠ কলমের মাধ্যমে তা পূর্বের মতোই রয়েছে চলমান এবং সদা আগুয়ান।

ওয়া আখিরু দাওওয়ানু আনিল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন

প্রকাশক

.

প্রথম সংস্করণের মুখবন্ধ

বিশ্বাস প্রতিরক্ষাকারীদের প্রধান মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর পরিবারের সদস্যবৃন্দ, তাঁর সাহাবী ও আল্লাহর অনুগত যোদ্ধাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এবং একমাত্র আল্লাহর কাছেই আমরা আমাদের সকল কাজে সাহায্য ও সমর্থন চাই।

ইসলামের যে সব যুদ্ধ ক্ষমতার মানদন্ড ঘুরিয়ে দিয়েছিল এবং মানবেতিহাসের সম্পূর্ণ ধারা পরিবর্তন করে দিয়েছিল তাদের উপর আমি কয়েকটি ধারাবাহিক বই প্রকাশ করতে চাই। এই সব যুদ্ধই ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং পৃথিবীতে ইসলামের আদর্শ প্রচারের পথকে সুগম করে দিয়েছিল।

প্রস্তাবিত ধারাবাহিক বইগুলি শুধুমাত্র বদরের যুদ্ধের মত বড় যুদ্ধগুলির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এতে থাকবে ইসলামের ইতিহাসের সেই সব যুদ্ধ যেগুলিতে মুসলমানদের অবস্থার অবনতি হয়েছিল, যেমন ওহুদের যুদ্ধ এবং বালাতের (ফ্রান্স) যুদ্ধ।

বইগুলির প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণভাবে সারা পৃথিবীর জন্য এবং বিশেষভাবে মুসলমান যুবকদের জন্য তাদের গৌরবময় ইসলামী অতীতকে পুনরাবিষ্কার করা। অতীতে ইসলাম ছিল বীর-যোদ্ধা এবং আত্ম-ত্যাগের দৃষ্টান্ত সমৃদ্ধ এবং এই সমৃদ্ধির ইতিহাস সম্পর্কে তাদের শত্রুরা (দেশের ও বিদেশের) তাদেরকে সব সময় অন্ধকারে রাখতে চেয়েছে।

মিল্লাতের মধ্যেই শত্রুদের অস্তিত্ব নতুন কোন অগ্রগতি নয়। মুসলমান সমাজ বরাবরই তাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছে। এই বিদেশী শাসনের কল্যাণেই তারা তাদের পূর্বকালীন প্রভুদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা, সম্প্রচার ও প্রেসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেছিল যেগুলোর উপর এখনো তাদের একচেটিয়া অধিকার। এই সমস্ত লোকেরাই আমাদের ইসলামী অতীতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছিল। ইসলাম সাহস, আত্ম-ত্যাগ ইত্যাদি মানবিক গুণাবলীর মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও স্কুল-কলেজের বইতে এই সব লোকেরা ইসলামকে সব সময় কলুষিত করে চিত্রায়িত করেছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ইসলামের সঙ্গে অবিশ্বাস, ন্যায়ের সঙ্গে অন্যায়ের যুদ্ধগুলির প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। এসব যুদ্ধ চূড়ান্তভাবেই মিথ্যা ও অধর্মের উপর সত্য ও ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

এভাবে তাদের জনগণের মধ্যে সংখ্যালঘিষ্ট হওয়া সত্ত্বেও এইসব বিদেশ-অনুপ্রাণিত লোকেরা অধিকাংশ মুসলমান দেশে শিক্ষার একচেটিয়া অধিকার ভোগ করেছে। তারা তাদের বিদেশী প্রভুদের ইচ্ছা অনুসারে তাদের ছাত্রদের গড়ে তুলছে। উপরন্তু, তারা মুসলমান দেশগুলোতে ইসলামী পুনর্জাগরণের ভবিষ্যৎ ধারাকেও প্রতিহত করছে।

ইতিহাস পড়ানোর সময় এই লোকেরা মুসলমানদের উদীয়মান প্রজন্মকে ইসলামের গৌরবময় অতীত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নশীল।

তারা ইসলামের ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি দিতে অনাগ্রহী। যদি কোন সময় ক্লাশে, বক্তৃতায় কিংবা বেতারে ইসলামের ইতিহাসের উল্লেখ করতেই হয় তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সেই সব বিষয় বেছে নেয় যেগুলো মুসলমানদের মধ্যেই ভীষণ বিতর্কমূলক-যেমন খলিফা ওসমানের শাসনামল ও তার পরের দুঃখজনক ঘটনাবলী, আলী ও মুয়াইয়ার মধ্যেকার বিভেদ, আয়েশা এবং তালহা এবং আল-যুবাইর (আল্লাহ্ তাদের সবার মঙ্গল করুক)।

এই সব বিতর্কিত বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তারা খুব বাকপটু হয়ে পড়ে এবং এ সব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দেয়। তারপর তারা দার্শনিক দৃষ্টিতে বিচার করে এসব বিষয়ে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা উপস্থাপন করে। এবং এভাবে তাদের কোমলমতি ছাত্রদের মনে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে তাদের নিজস্ব ধারণা এমনভাবে ঢুকিয়ে দেয় যেন সেটাই ইসলামের ইতিহাসের একমাত্র সত্য বিশ্লেষণ। ইসলামী শিক্ষায় অনুপ্রাণিত বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং অধ্যাবসায় ইত্যাদি বিষয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তগুলি সম্পর্কে তারা তাদের ছাত্রদের কিছুই বলে না।

ইসলামের ইতিহাসের এহেন অপব্যাখ্যা মুসলমান সমাজের অখন্ডতার বিরুদ্ধে একটা অন্তর্ঘাত ছাড়া কিছু নয়। এতদসত্ত্বেও আমাদের তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইহা অপ্রতিহতভাবে বহু দশক ধরে চলে আসছে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী বিশ্বের উপর থেকে তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার পর সাম্রাজ্যবাদীদের বুদ্ধিগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাবকে শক্তিশালী করা। এই বুদ্ধিগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রাজনৈতিক দাসত্ব অপেক্ষা কম দোষণীয় হলেও আসলে ইহা সবচেয়ে খারাপ ধরণের সাম্রাজ্যবাদ যা মুসলমান দেশগুলির শিক্ষার একচেটিয়া অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের দেশবাসীর উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল।

সামান্য কয়েকটা দূর্লভ ক্ষেত্র ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করার অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ছড়ানো কিংবা মুসলমান শাসকদের ঘৃণা বা উপহাস করা এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে মুসলমান যুবকদেরকে ইসলামের গৌরবময় অতীত ও তার বীরদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা। কারণ, এইসব ঈর্ষান্বিত বিদেশী শাসকদের মনে ভয় ছিল যে ইসলামের বীর-যোদ্ধাদের জীবন এবং ইহার গৌরবময় অতীত মুসলমান যুবকদের নতুন বীরত্বের কার্যাবলীকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ তারা এটা পড়তে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, ইসলাম কিভাবে তার বিশ্বাসের শক্তিবলে অসভ্য বেদুইনদের রূপান্তরিত করে বিশ্বের নেতা বানিয়ে দিয়েছিল। ইসলামই তাদের ইতিহাসকে নির্মাণে সক্ষম করেছিল-যা এখনো গৌরব ও মহিমায় অনতিক্রম্য। প্রকৃতপক্ষে এটি এমন একটা ইতিহাস যা স্কুলকলেজে যথাযথভাবে পঠিত হলে এখনো সুঠামদেহী, আত্মবিশ্বাসী, ভদ্র, সাহসী, সফল নেতৃত্ব দানকারী যুবশক্তি তৈরীতে সক্ষম। হ্যাঁ, ইহা এখনো আমাদেরকে এমন যুবক উপহার দিতে পারে যারা আবু বকরের সত্য, ওমরের ন্যায় বিচার, ওসমানের মহত্ত্ব, আলীর সাহসিকতা, খালিদের সেনাপতিত্ব, আমরের অভিজ্ঞতা, মুয়াইইয়ার প্রজ্ঞা ও রাজনীতি এবং ইবনে আল-জুবাইরের নির্ভীকতাকে তাদের চরিত্রে একীভূত করতে পারে।

কিন্তু একটা অন্ধকার অতীতের এইসব অনুসারী এবং আত্ম-ঘোষিত প্রগতিবাদী ও উদারনৈতিকতাবাদীদের উপস্থিতি মুসলমান দেশগুলিতে মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর সমস্যা সৃষ্টি করেছে। খ্রীষ্টান মিশনারী কিংবা ইসলামের অন্যান্য শত্রুদের চেয়ে তারাই অধিকতর ফলপ্রসূভাবে ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত ও অপব্যাখ্যা করেছে।

মুসলমান দেশগুলোতে শিক্ষার এই একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের মাধ্যমেই দুষ্ট সাম্রাজ্যবাদীরা আমাদের গৌরবময় অতীতকে বিকৃত করার কাজে সফল হয়েছিল। তারা লেখাপড়ার কোর্স থেকে ইসলামের ইতিহাসকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়েছিল কিংবা পাঠকের মনকে পক্ষপাতগ্রস্ত করার জন্য এই ইতিহাসকে কেচে-ছেটে অপূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছিল। একইভাবে ইসলামের বীর এবং সক্ষম জেনারেলদের মানহানির জন্যও ইসলামের ইতিহাসের এইসব কুঁড়ানো অংশগুলির অন্তর্ভূক্তিকে কাজে লাগানো হয়েছিল। আমাদের ওসমান, আল-জুবাইর, মুয়াইইয়া এবং আমর বিন আল আস প্রমুখ বীরদের প্রতি তাদের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁদেরকে অনান্তরিক ও স্বার্থপর হিসেবে চিত্রিত করার প্রচেষ্টা একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। একই উদ্দেশ্যে তারা প্রখ্যাত সাহাবী আবু জর আল-গিফারীর কতিপয় ধারণার উপর জোর দিতে ভালবাসে, যদিও তার কথা আর কোন সাহাবী বিশ্বাস করেননি এবং ফলশ্রুতিতে তৃতীয় খলিফা তাকে আল-রাবধায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

এছাড়া তারা উমাইয়া খলিফা এবং তাঁদের মহান জেনারেলদের সম্পর্কেও এ ধরণের বানানো গল্প প্রচার করেন এবং এমন মিথ্যা বর্ণনায় তাঁদেরকে উপস্থাপন করেন যে সাধারণ পাঠকদের মনে তাঁদের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক হয়। ঘটনাক্রমে, এই সব উমাইয়া খলিফাই এবং তাঁদের মহান জেনারেলরাই খ্রীস্টান মিশনারী, মূর্তি-উপাসক এবং প্রাচীন পারস্যের পুরোহিতদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অজনপ্রিয়, কারণ এই খলিফাদের আমলেই এবং এই জেনারেলদের অধীনেই রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে ইসলামী শক্তির শ্রেষ্ঠত্ব চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তাঁদের সেনাবাহিনী ইউরোপের হৃৎপিণ্ডের গভীরে প্রবেশ করেছিল এবং তাঁদের পাঁচ লক্ষ সৈন্য প্যারিস নগরী থেকে মাত্র তিনশ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থান নিয়েছিল। একই সময় দামাস্কাস থেকে শত সহস্র সৈন্য বেরিয়ে পড়ে পৌত্তলিক ও সম্মোহকদের যাবতীয় চিহ্ন ধ্বংস করে দিচ্ছিল।

এ কারণেই এ সব খ্রষ্টান মিশনারী এই খলিফা ও তাঁদের জেনারেলদের প্রতি এত বিরক্ত। প্রকৃতপক্ষে, এই খ্রীষ্টীয় বিদ্বেষই তাদের আধ্যাত্মিক শিষ্যদের (যারা দৃশ্যতঃ একটা মুসলমান সম্প্রদায়ের অংশ) বক্তৃতা ও বিভিন্ন প্রবন্ধে প্রতিফলিত হয়েছে। তাদের আধ্যাত্মিক গুরুদের মত তারাও এইসব খলিফা ও মহান জেনারেলদের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে চেষ্টা করেছে যাদের অধীনে ইসলামিক সৈন্যরা তাদের পাশ্চাত্য শত্রুদের বিরুদ্ধে এবং প্রাচ্যের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

এভাবে ইসলামের ইতিহাসকে বিস্মৃতির গর্ভে ঠেলে দিয়ে এবং স্কুল-কলেজের সিলেবাস থেকে তাকে বহিষ্কার করে কিংবা এর একটা বিকৃত ধারণা উপস্থাপিত করে ইসলামের শত্রুরাই কেবল উপকৃত হতে পারে। এ ধরণের উপস্থাপনা যুবকদের মনে ইসলামের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করতে পারে। কিন্তু বিকৃত ভাবে ইসলামের ইতিহাস পড়ানোর পিছনে আমাদের শত্রুদের উদ্দেশ্য ছিল এটাই। মুসলমান সমাজের এসব সংহতি নাশক লোকদের কল্যাণেই তারা মুসলমান যুবকদের দ্রুত ইসলামের পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার কাজে সফলতা লাভ করেছিল। শুধু তাই নয়, মুসলমানদেরকে তারা এরকম ধারণাও দিতে পেরেছিল যে ইউরোপই হচ্ছে তাদের জন্য একটা অনুকরণীয় আদর্শ এবং তাদের সভ্যতা ও বীরযোদ্ধগণই হচ্ছে একমাত্র পঠনযোগ্য বিষয়। ব্যাপারটা এমনই দাঁড়িয়েছে যে আমাদের যুবসমাজ পাশ্চাত্যে বিকশিত হয়নি এমন কোন জিনিসেরই প্রশংসা করতে পারে না।

ইসলামের ইতিহাসের প্রতি তাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে প্রকৃত কারণ হচ্ছে এই যে, নিজেদের চিন্তাশক্তি বিকশিত হবার পর থেকে তারা কখনোই ইসলামের ইতিহাস এবং এর বীর কিংবা পন্ডিতদের সম্পর্কে কিছু শোনেনি বা পড়েনি। তাদের অধ্যয়ন সীমাবদ্ধ ছিল ট্রাফালগার এবং ওয়াটারলুর যুদ্ধ, এন্টনিওর দুঃসাহসিক অভিযাত্রা, ক্লিওপেট্রার প্রেম, নেপোলিয়নের নির্ভীকতা, উইলিংটনের অধ্যবসায়, নেলসনের সাহসিকতা, ক্রিষ্টফার কলম্বাসের কৃতিত্ব ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যে। এ ছাড়া তাদের পঠিত বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত ছিল ফারাওদের সভ্যতা, রোমের সংস্কৃতি, গ্রীসের দর্শন, সেইন্ট মারিয়ার পূণ্য, জেয়াউন ডি আর্কের সতীত্ব এবং আরো কিছু বিষয়। মুসলমান যুবকদের শিক্ষকরা কখনোই তাদেরকে তাদের নিজেদের ধর্মের ইতিহাস সম্পর্কে, তাদের বীরযোদ্ধা, মুসলিম সেনাপতিদের সাহসিকতা, মুসলমান শাসকদের পরিচ্ছন্ন জীবন, ইসলামের খলিফাদের ন্যায়পরায়ণতা, তাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির গৌরব, মুসলমান মনীষীদের পাণ্ডিত্য এবং তাদের দার্শনিকদের সূক্ষ্ম দূরদর্শিতা সম্পর্কে কিছু বলেনি।

ইসলামের ইতিহাসের এই কলঙ্ক রটনাকারীদের ব্যাপারে সবচেয়ে আশ্চর্য্য বিষয় হচ্ছে এই যে, এ বিষয়ে কথা বলার সময় ইসলামের প্রসঙ্গ তারা সযত্নে এড়িয়ে চলে। তারা এটাকে উপস্থাপন করে একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের (আরবীয়) ইতিহাস হিসেবে এবং তারা বুঝায় যে ইসলামের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই।

এই ধরণের একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সর্বোচ্চ ডিগ্ৰী প্ৰাপ্ত একজন যুবককে একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সাওয়ারীর যুদ্ধ সম্পর্কে। তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা প্রদর্শন ক’রে হাসতে হাসতে আমাকে বললেন যে এহেন অদ্ভুত নামের কোন যুদ্ধের কথা তিনি কখনোই শোনেননি।

অথচ যুদ্ধের ইতিহাসে সাওয়ারীর যুদ্ধকে একটি চূড়ান্ত সমুদ্র যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ইসলাম এবং রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই যুদ্ধে মুসলমান নৌবাহিনী রোমান নৌবহরকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল খলিফা ওসমান বিন আফ্ফান এর আমলে তিউনিসিয়ান সাগরে। এই যুদ্ধে মুসলমান পক্ষের সেনাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ্ বিন সা’দ বিন আবি সার।

তবে আমি যখন এই ‘শিক্ষিত’ স্নাতকোত্তর যুবককে ট্রাফালগারের যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম তখন তিনি চটপট এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিলেন। তিনি প্রচুর উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে নেলসনের সাহসিকতা ও অধ্যবসায়ের বর্ণনা দিলেন। তিনি জানালেন কিভাবে তার সৈন্যদের পরিচালনা করার সময় নেলসন আহত হয়েছিলেন, কিভাবে ফরাসী নৌবাহিনী আঠারোটি জাহাজ হারিয়ে অবশেষে পরাজয় বরণ করেছিল এবং কিভাবে ইংরেজরা ফরাসী এ্যাডমিরালকে বন্দী করেছিল।

আমরা আল্লাহ্তায়ালার সবগুলো সুন্দর নাম ধরে তাঁকে ডেকে প্রার্থনা জানাই, তিনি যেন আমাদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে দেন এবং সঠিক সত্য পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন, কারণ তিনিই সত্যি সত্যি সর্ব-শক্তিমান।

মক্কা
রমযান, ১৩৮২ হিজরী/১৯৬৩ ইং
মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল

.

দ্বিতীয় সংস্করণের মুখবন্ধ

প্রশংসা আল্লাহর জন্য! একমাত্র তাঁর কাছেই আমরা সাহায্য ও পথ নির্দেশনা চাই। আমাদের ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধনের জন্য আমরা কেবল তাঁরই আনুকূল্য চাই। মহানবী মুহাম্মদ (সঃ)ও তাঁর পরিবারবর্গের উপর এবং তাঁর যে সব সাহাবী সর্বক্ষণ তাঁর পাশে থেকেছিলেন তাঁদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

ইসলামের প্রথম চূড়ান্ত যুদ্ধের উপর লিখিত এই বইটির প্রকাশনা ছিল পরীক্ষামূলক এবং এটির সাফল্যই আমাকে এই সিরিজ লিখতে উৎসাহিত করেছিল।

বর্তমান বইটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৮৩ হিজরী সালের মহররম মাসে এবং শাওয়াল মাস আসতেই এর সমস্ত কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। এই সাফল্য আমাকে এর দ্বিতীয় মুদ্রণে উদ্বুদ্ধ করে এবং অনেক নতুন উপাদান যোগ ক’রে এর কলেবর অনেক বৃদ্ধি করা হয়।

বইটির প্রথম সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৬০ এর বেশী ছিল না, পক্ষান্তরে (পাঠক নিজেই দেখতে পাচ্ছেন) বর্তমান সংস্করণের পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৬ অতিক্রম করেছে। এই বইয়ের জনপ্রিয়তাই আমাকে ওহুদ এবং মোত আল-আহযাবের যুদ্ধ সম্পর্কিত বই প্রকাশে উৎসাহিত করেছিল। আল্লাহ্ চাইলে শেষোক্ত বইটি শীঘ্রই প্রেসে যাবে।

আল্লাহ্ই হচ্ছেন আমাদের সকল প্রার্থনার আদ্যন্ত। আমাদের সব প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা তাঁরই প্রাপ্য, কারণ তিনিই আমাদেরকে তাঁর সকল আশির্বাদে ধন্য করেছেন। এবং তাঁর কাছেই আমরা সকল প্রকার সাহায্য, সমর্থন ও সকল অন্যায়, গর্ব ও পাপ থেকে সুরক্ষা চাইব। এবং কেবল তাঁর কাছে আমরা কাজ করার শক্তি প্রার্থনা করবো। আমরা সঠিক পথে থেকে তাঁর আনন্দ যেন অর্জন করতে পারি। সত্যি, তিনিই হচ্ছেন সর্বোত্তম বন্ধু ও সাহায্যকারী।

—মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল
মক্কা, ১৩৮৪

.

তৃতীয় আরবী সংস্করণের ভূমিকা

জেনারেল শিত খাত্তাব
সদস্য, ইরাকী বিজ্ঞান একাডেমি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি বিশ্বজগতের প্রভু। তাঁর আশির্বাদ বর্ষিত হোক আমাদের ত্রাণকর্তা এবং তাঁর নিজের প্রেরিত পুরুষের উপর, তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গের উপর, তাঁর সাহাবীদের উপর এবং ঐসব মহান সেনাপতিদের উপর যারা বিশ্বাসীদের সৌভাগ্যবান যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে সাফল্য ও গৌরব বয়ে এনেছিলেন।

মহানবী তাঁর নবুয়ত প্রাপ্তির আগ থেকে শুরু করে মদীনায় হিযরত পর্যন্ত মক্কা নগরীতে বসবাস করেন। মদীনাতে গিয়েও তিনি তাঁর মহান সংগ্রাম চালিয়ে যান এবং এই সংগ্রামের ফলশ্রুতিতেই ইসলামিক রাষ্ট্র একটি সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।

এই সময় মুসলমানদের জীবনে অনেক দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসে। তাদেরকে গৃহচ্যুত করে জঘন্যতম নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়। কোন রকম যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই তাদের সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। তাদের একমাত্র দোষ ছিল এই যে তারা এক আল্লায় বিশ্বাস করতেন।

এমন সময়ই আসে মহান হিযরত। মুসলমানরা তাদের সহায়-সম্পত্তি ও আত্মীয়-স্বজনকে তাদের শত্রুদের হাতে মক্কায় ফেলে মদীনায় দেশান্তরী হন। মহানবীর মদীনায় অভিপ্রয়াণের পর প্রভুর উদ্দেশ্যে তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে।

যে সব মুসলমান এতদিন নির্যাতনের শিকার ছিলেন হিযরতের পরে তারা জুলুমবাজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেয়ার অনুমতি লাভ করেন। আল্লাহর সেনারা এবার তাদের শত্রুদের মোকাবিলা করতে বেরিয়ে পড়েন। এরা ছিলেন এমনই এক অসাধারণ সেনাবাহিনী যারা দিনের বেলা কাটাতেন অশ্বপৃষ্ঠে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই ক’রে এবং রাত্রি যাপন করতেন সাধুসন্তের মত আল্লাহর কাছে প্রার্থনা ও কান্নাকাটি ক’রে। চরম প্রতিকূল অবস্থায় একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া তাদেরকে রক্ষা করার কেউ ছিল না এবং আত্মরক্ষার জন্য তাদের একমাত্র হাতিয়ার ছিল নিজ নিজ তরবারি। আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ আশা ও আস্থা স্থাপন ক’রে এবং সব সময় তাঁর সাহায্য কামনা করে মুসলমান সেনারা সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন।

বদর নামক স্থানেই অন্ধকার ও আলোর, অবিশ্বাস ও বিশ্বাসের, মিথ্যা ও সত্যের এবং অজ্ঞতা ও ইসলামের মধ্যেকার মহান যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই মহান যুদ্ধে সত্য, আলো, বিশ্বাস এবং ইসলামের বিজয় সূচিত হয় এবং মিথ্যা, অন্ধকার, অবিশ্বাস ও অজ্ঞতার শক্তির অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। আলোর শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে এ ধরণের অপশক্তির পরিণাম সব সময় এমনই হয়।

বদরের প্রচণ্ড যুদ্ধ ছিল দু’টি অসম শক্তির প্রতিযোগিতা এবং এই প্রতিযোগিতায় আল্লাহর বিশেষ সহযোগিতায় সামান্য কয়েকজন মুসলমান সৈন্য তাদের শক্তিশালী প্রতিপক্ষের উৎকৃষ্ট বাহিনীকে পরাস্ত করেন : “এবং প্রকৃতপক্ষেই আল্লাহ্ বদরে তোমাদেরকে সাহায্য করেছিলেন যখন তোমরা অত্যন্ত নগণ্যভাবে সংখ্যালঘু ছিলে।”

যুদ্ধের ইতিহাসে এমন চূড়ান্ত আর কোন যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে বলে আমার জনা নেই। বদরের যুদ্ধে মিথ্যা ও পুরনো ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে লড়াই ক’রে সত্য ও প্রগতিশীল ধর্মবিশ্বাস জয়লাভ করে। প্রকৃতপক্ষে বদরে মুসলমানদের নীতি ও আদর্শের এই সত্যতাই শত্রুদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয়কে সম্ভব ক’রে তোলে।

মুসলমানদের প্রতিপক্ষ পৌত্তলিকরাই ছিল সংখ্যায় বেশী এবং অস্ত্রশস্ত্রের দিক থেকেও তারা ছিল অধিকতর সুসজ্জিত। মহানবীর সঙ্গীদের মোট সংখ্যা ছিল তিনশ’র সামান্য কিছু বেশী: পক্ষান্তরে মক্কী বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা ছিল এক হাজার। মুসলমান বাহিনীর কাছে যেখানে মাত্র দু’টি ঘোড়া, সেখানে পৌত্তলিকদের ছিল এক শত। মুসলমানদের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা ছিল যেখানে নিতান্তই নগণ্য, তাদের প্রতিপক্ষের আহারের আয়োজন হতো সেখানে দৈনিক নয়-দশটি উট মেরে। এ ছাড়া মুসলমান সৈন্যরা যেখানে এসেছিল বিভিন্ন গোত্র থেকে, সেখানে মক্কী সৈন্যরা ছিল একই গোত্রের অর্থাৎ কুরাইশ বংশের।

সত্যিকার অর্থেই এটি ছিল একটা আদর্শের বিজয়, একটা ধর্মবিশ্বাসের বিজয়। আসুন আমরা দেখি কিভাবে এসব ঘটেছিল।

মহানবী তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্রের মাধ্যমে মুসলমানদের সামনে আত্ম-ত্যাগ ও উৎসর্গের এক অনুপম আদর্শ স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম ও মুসলমানদের চিন্তা ও আত্মার জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।

বদরে মুসলমান সেনাদের হাতে ছিল মাত্র তিনটি উট। এদের মধ্যে একটি উটকে মহানবী তাঁর কিছু সাহাবীদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ব্যবহার করেন। এতে সাহাবীরা নিজেরা পায়ে হেঁটে মহানবীকে একাই ঐ উটের পিঠে আরোহণ করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু মহানবী এতে সম্মত না হয়ে বলেনঃ “আপনারা আমার চেয়ে ভাল হাঁটিয়ে নন, কিংবা আল্লাহর পুরষ্কার আপনাদের চেয়ে আমার কম দরকার নেই।”

যুদ্ধের শুরুতে পৌত্তলিকদের তিনজন নেতা এগিয়ে এসে মুসলমানদেরকে দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান জানায়। আনাসার বাহিনীর তিনজন সদস্য তাদের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চান। কিন্তু মহানবী চাননি যে মুসলমান ও পৌত্তলিকদের মধ্যেকার এই সংঘর্ষে তারাই প্রথম প্রাণ দিক তাঁর ইচ্ছে তাঁর নিজের পরিবার এবং গোত্রের লোকেরাই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করুক। এই ভেবে তিনি বনী-হাসিম গোত্রের সাহাবীদের ডাকলেন এবং প্রতিপক্ষের চ্যালেঞ্জারদিগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে বললেন, যারা এসেছিল ঐশ্বরিক আলো নিভিয়ে দিতে। বনী হাসিম গোত্র থেকে নবী নির্বাচন করে আল্লাহ্ তাদেরকেই মহিমান্বিত করেছিলেন।

যুদ্ধেও মহানবী সাহসিকতা ও কর্মতৎপরতার কয়েকটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। আলী বিন আবু তালিব (আল্লাহ্ তাঁর প্রতি সহায় হোন) বলেনঃ “বদরের যুদ্ধের সময় আমরা আল্লাহর রসূলের (সঃ) নিরাপত্তার বিষয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম, কারণ আমাদের যোদ্ধাদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বোত্তম এবং যুদ্ধের ময়দানে তিনি অপেক্ষা আর কেউ শত্রুদের বেশী নিকটবর্তী হননি।”

শত্রুপক্ষ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে পর মহানবী তাঁর যোদ্ধা-সাহাবীদের নিয়ে কুরআনের এই আয়াতটি আবৃত্তি করতে করতে তাদের পিছু ধাওয়া করেন : “সেনাবাহিনী পরাজয় বরণ করবে এবং পলায়ন করবে”। তিনি প্রতিপক্ষের আহত ব্যক্তিদের পাশ দিয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপযুক্ত চিকিৎসার আদেশ জারি করেন।

শত্রুপক্ষের ফেলে যাওয়া দ্রব্যাদি বিতরণের সময় মহানবী অন্যের চেয়ে বেশী ভাগ দাবি করেননি এবং তার সাহাবীদের অপেক্ষা কোন জিনিস একটুও বেশী নেননি। তিনি নিজের জন্য কোন বিশেষ অধিকার দাবি করেননি, বরং যে কোন অকুতোভয় সেনাপতির মত তাঁর সঙ্গীদের পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করেছেন। একইভাবে, তাঁর স্বীয় আত্মীয়-স্বজনও যুদ্ধ করে সব রকম বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, কারণ তিনি অন্যকে অবহেলা করে তাদের প্রতি কখনোই কোন অনুগ্রহ দেখাননি।

এতেই যথেষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে মহানবী (সঃ) নিজেই ছিলেন তাঁর মহৎ আদর্শসমূহের সবচেয়ে প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ। তিনি কোন কল্পনা-বিলাসী লোক ছিলেন না, বরং ছিলেন কর্মে বিশ্বাসী। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যা অর্জন করেছিলেন কোন রকম অবিস্বস্ত কথামালা দিয়ে তা কখনো সম্ভব হতো না।

তিনি ছিলেন মহান নবী এবং মহান সেনাপতি (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হোক)। তাঁর সঙ্গীরাও ছিলেন কাজে ও আচরণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

মহানবী যখন মুহাজিরিন এবং আনসারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন, তখন সা’দ বিন রাবিয়া একদিন তার মুসলমান ভাই আব্দুর রহমান বিন আউফকে বলেন : “আমি আনসারদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি, অতএব আপনি আমার সম্পত্তির অর্ধেক নিতে পারেন। এ ছাড়া আমার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে থেকেও একজনকে আপনি বেছে নিতে পারেন। আপনি আপনার পছন্দের কথা জানালে আপনার বিয়ের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমি তাকে যথাসময়ে তালাক দিতে পারবো।” সঙ্গীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রতিষ্ঠার পর যে সব আত্ম-ত্যাগের ঘটনা ঘটেছে এটি হচ্ছে তাদের একটা মহৎ দৃষ্টান্ত।

যুদ্ধের ময়দানে যাবার পথে মুহাজিরিনরা মহানবীকে এই বলে তাদের সমর্থনের কথা জানানঃ “যে আল্লাহ্ আপনাকে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে আমরা শপথ করে বলছি, আমরা দুনিয়ার অপর প্রান্ত পর্যন্ত আপনাকে অনুসরণ করবো।” অন্যদিকে আনসাররা এই বলে তাদের আনুগত্য পুনর্ব্যক্ত করেন : “হে আল্লাহর দূত, আপনার যেখানে ইচ্ছা আমাদেরকে নিয়ে চলুন। যিনি আপনাকে সত্য দিয়ে পাঠিয়েছেন সেই পরম স্বত্তার নামে শপথ করে বলছি, আপনি আদেশ করলে আমরা সমুদ্রের মধ্য দিয়েও হেঁটে যেতে পারি। আমাদের মধ্যে কেউই পিছিয়ে থাকবে না।”

এই যুদ্ধে নিজেদের আদর্শের খাতিরে পিতা পুত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং এক ভাই অন্য ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, ওবায়দাহ্ বিন আল-জারাহ লড়েছিলেন তাঁর পিতার বিরুদ্ধে, আধু বকর লড়েছিলেন তাঁর পুত্র আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে এবং আবু হুযাইফা লড়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত পিতা উত্ত্বা বিন রাবিয়ার বিরুদ্ধে

মুসলমানরা জীবনের চেয়ে মৃত্যুকেই বেশী ভালবাসতেন, কারণ তারা জানতেন যে আল্লাহর জন্য যুদ্ধ করতে করতে মৃত্যুবরণ করলে তারা শহীদ হবেন। এজন্য প্রত্যেকেই তারা প্রভুকে এই বলে সম্বোধন করে দ্রুত যুদ্ধের ময়দানে যেতেন : “আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম যাতে তুমি খুশী হও।” পক্ষান্তরে, একজন মূর্তি-উপাসক যুদ্ধ করতো দূর্বল-চিত্তে এবং যুদ্ধে নিজের প্রাণ বাঁচাতে পারলেই সে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতো।

যুদ্ধের পর বন্দীদের সমস্যা নিয়ে মহানবী যখন তাঁর সাহাবীদের পরামর্শ কামনা করেন, তখন উমর বিন আল-খাত্তাব বলেন : “(হে আল্লাহর দূত)! আমার নিজের হাতে অমুক অমুক লোকের গর্দান (তিনি তার একজন নিকট আত্মীয়ের নাম উল্লেখ করেন) নিতে দিন, যাতে আল্লাহ্ বুঝতে পারেন যে আমাদের অন্তরে এই সব পৌত্তলিক এবং তাদের নেতাদের জন্য কোন রকম ভালবাসা নেই।”

প্রত্যেক যুদ্ধবন্দীর জন্য মুক্তিপণ ধার্য করা হয়েছিল প্রায় চার হাজার দিরহাম। কিন্তু যারা এই পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি তাদেরকে এই শর্তে মুক্তি দেয়া হয়েছিল যে তারা আনসারদের ছেলেমেয়েদেরকে লেখাপড়া শেখাবেন।

ইসলামের এই সেনারা আত্ম-ত্যাগের মহৎ গুণাবলীতে ভূষিত ছিলেন এবং নিজেদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা জীবন ও সহায়-সম্পত্তি উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। নিজেদের স্বার্থের চেয়ে অন্যের মঙ্গলের কথাই তারা বেশী ভাবতেন এবং সঙ্গীদের জন্য নিজেদের স্বার্থ বিসর্জন দিতে কখনোই কুণ্ঠাবোধ করতেন না। এদের প্রত্যেকেই চাইতেন ইসলামের জন্য কে প্রথম শহীদ হবেন। তারা একজন আরেকজনকে এই বলে অভিবাদন জানাতেন : “আল্লাহ্ তোমাকে শহীদ হবার সুযোগ দিন।” মা, বোন এবং স্ত্রীরা তাদের পুত্র, ভাই ও স্বামীদের মৃত্যুর খবর পেয়ে বলে উঠতেন, “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন।”

সেনা ও সেনাপতিরা ছিলেন ভবিষ্যৎ নির্মাতা। তারা ধর্মীয় উৎসর্জনের লক্ষ্যে জ্ঞানানুসন্ধান করতেন। জ্ঞানানুসন্ধানের কাজকে তারা কখনোই গৌনভাবে দেখতেন না।

তারা পরস্পরকে ভাইয়ের মত (আল্লাহর পরিবার) ভালবাসতেন। পরস্পরের কাছ থেকে শক্তি নিয়ে তারা একটা শক্তিশালী ভিত রচনা করেন। তারা ছিলেন একটা সুঠাম শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মত, যার একটিতে ব্যথা হলে গোটা শরীরটাই বিচলিত হয়।

ইসলামের এই সব সৈন্য এবং তাদের সেনাপতিরা ছিলেন নির্মাতা, ধ্বংসকারী নয়। তারা পৃথিবীতে ধ্বংসলীলার পরিবর্তে উন্নতি বয়ে আনেন। স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকের মত তারা শুধু সুন্দর সুন্দর কথাই বলেননি, বরং মহৎ কাজও করেছেন।

বদরের যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিমদের বিজয় প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। এর পর থেকেই মুসলমানরা ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং গোটা পৃথিবীকে ভক্তি, উন্নতি, সভ্যতা ও আলোর পথে পরিচালিত করেন। তাদের বিজয় ছিল ইসলামের জন্য, অন্য কিছুর জন্য নয়। পরবর্তী ইসলামের ইতিহাস এই সত্যেরই সাক্ষ্য বহন করে।

জাহিলিয়া যুগে আরবদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ও ঐক্য ছিল না। ইসলামই প্রথম তার পতাকাতলে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে। প্রেমের বন্ধনে ইসলাম শত্রুকে মিত্রে পরিণত করে। তারা ছিল আগে নরককুণ্ডে, সমূহ বিপদের সম্মুখীন। ইসলাম তাদেরকে রক্ষা করে এবং তাদেরকে এটা বৃহৎ শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এটাও ইসলামের একটি বড় বিজয়।

এ ছাড়া, কেবলমাত্র ইসলামের কল্যাণেই মুসলমানরা শিক্ষা, প্রগতি, সততা ও সভ্যতার প্রতীক হয়ে উঠেন এবং উত্তরে সাইবেরিয়া থেকে পশ্চিমে ফ্রান্স পর্যন্ত এবং পূর্বে চীন থেকে দক্ষিণের মহাসাগর পর্যন্ত বিশাল এলাকা দখল করেন।

তাদের বংশধররা ধর্মীয় কর্তব্য ও উপাসনায় অবহেলা করে নিজেদের আবেগ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কারণে অন্য জাতির কাছে হেয় প্রতিপন্ন ও নির্যাতিত হয়। তারা তাদের সম্মান, প্রতিপত্তি সবকিছুই হারিয়ে ফেলে এবং ঝড়ে উড়ে যাওয়ার জঞ্জালে পরিণত হয়। কারণ, “আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা (প্রথম) নিজেদের অন্তরের পরিবর্তন ঘটায়।”

এইসব মুসলমানরা অন্যের কীর্তিতে অভিভূত হয় এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিদেশী কৃষ্টিকে ভালবেসে বিনা বিচারে তাদের জীবন-ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নিজেদের ইতিহাস বিসর্জন দিয়ে তারা তাদের সন্তানদের শত্রুদের (যাদেরকে সংস্কৃতির দিক থেকে নিজেদের তুলনায় উৎকৃষ্ট মনে করেছিল) ইতিহাস শিক্ষা দেয়। এতে করে অবশেষে এমন একটা সময় আসে যখন এই সব পাশ্চাত্য ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ মুসলমানরা সংস্কৃতি ও উদারতার নামে এমন কিছু বলে এবং লেখে যা নাকি প্রাচ্যের কোন লোক এবং ইসলামের কোন ঘোরতর শত্রুও প্রকাশ করতে সাহস পাবে না।

অধিকাংশ প্রাচ্যবাদীদেরকে অবশ্য এই অজুহাতে ক্ষমা করা যেতে পারে যে তারা আরব ও মুসলমান বিশ্বে একটা সুদৃঢ় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমাদের এই সব পাশ্চাত্যবাদীদের কি দশা? ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি তাদের বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে তারা কি বলবেন?

খ্রীষ্টান মিশনারীদের প্রচারণা এবং ইসলামী বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ট তাদের সহযোগীদের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামকে জীবন থেকে বহিষ্কার করা এবং আরবদেরকে তাদের আধ্যাত্মিক পরিচয় থেকে বঞ্চিত করা, কারণ তারা জানে যে ইসলাম ছাড়া আরবরা টিকেত পারে না। ইসলামের অনুপস্থিতিতে তারা হচ্ছে আত্মা ছাড়া দেহ।

এই লক্ষ্য অর্জনে তারা পরিশীলিত আরবী ভাষার স্থলে আঞ্চলিক ভাষার পক্ষে ওকালতি করে। এভাবে তারা আরবজাতিকে অন্যান্য জাতির মত একটা পৃথক জাতিসত্ত্বা দিতে চায়, কারণ পরিশীলিত আরবী হচ্ছে কুরআনের ভাষা এবং সর্বোপরি মুসলমান দর্শন ও দার্শনিকদের ভাষা।

এছাড়া, মুসলমানদের চিরাচরিত বিশ্বাস এবং পবিত্র ঐতিহ্যের বিপরীতে তাদের কোমল ও মেয়েলী গুণাবলীকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টার মাধ্যমে শুধুমাত্র ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু সাম্রাজ্যবাদ ও ইসরাইলের স্বার্থ সংরক্ষিত হতে পারে। একথা নিশ্চিত যে, পাশ্চাত্য (কিংবা প্রাচ্যের) সাম্রাজ্যবাদের এই সব দালালদের দ্বারা অন্যদেরকে পরিচালিত করার মত সম্মান, মহিমা ও আত্মত্যাগের কোন মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হতে পারে না।

যারা বিশ্বাস করে যে এই পৃথিবীতে ইসলামের দর্শনের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোন দর্শন আছে, অথবা আমাদের ধার্মিক বীরদের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কোন মানুষ আছেন, অথবা আমাদের পূর্ব-পুরুষদের কাছে থেকে পাওয়া সম্পত্তির চেয়ে অধিকতর সম্মানজনক কোন কিছু আছে আমি তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করছি।

এমন অনেকে আছেন যারা দাবি করেন যে, তারা সাম্রাজ্যবাদী নিষ্পেষণ থেকে তাদের দেশকে মুক্ত করে তাদের আর্থ-রাজনৈতিক শোষণের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন, কিন্তু এতদসত্ত্বেও তারা নিজেদের দেশবাসীর উপর ঐসব বহিঃশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করে নিজেদের দেশেই তাদের শত্রুদের উদ্দেশ্যকে প্রবল উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করে চলেছেন। প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদকে তারা ছোট দরজা থেকে তাড়িয়ে বড় দরজা দিয়ে ঢুকার পথকেই সুগম করে দিয়েছেন। অন্যথায় এটা কিভাবে সম্ভব যে, একদিকে তারা দাবী করছেন যে সাম্রাজ্যবাদের সাথে কোন সম্পর্ক তাদের নেই, আর অন্যদিকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী দোসরদের নীতিই অনুসরণ করে চলেছেন এবং নিজেদের আইন-কানুন অপেক্ষা নিকৃষ্টতর কিছু গ্রহণ করে তাদের জীবনধারাকে নিয়ন্ত্রিত করছেন? যে নৈতিক বিশৃঙ্খলা আমাদের প্রজন্মকে অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তার প্রতি আমাদের আত্মপ্রসাদ অসুস্থ নীতিরই পরিচায়ক।

উদাহরণ স্বরূপ, তারা যখন ইসলাম নির্দেশিত আইনানুগ শাস্তির কথা বলেন তখন তাদের মানসিক দেউলিয়াত্বও প্রকাশ পায়। ইসলামে চুরির জন্য শাস্তি হচ্ছে চোরের হাত কেটে দেয়া। এটা শুনে তারা বলেন : “এটি একটি পশ্চাদগমনের নীর্তি, একটি জংলী অতীতের নিয়ম, অতএব বিংশ শতাব্দীর সঙ্গে মানানসই নয়।” কিন্তু তাদেরকে যখন বলা হয় যে একই অপরাধের জন্য আধুনিকতম আদর্শ কমিউনিষ্ট রাষ্ট্র রাশিয়াতে মৃত্যুদণ্ড পেতে হয় তখন তারা বলেন : “এটি একটি প্রগতিশীল দেশ, একটি আদর্শ রাষ্ট্র এবং এটি হচ্ছে আধুনিক সময়ের একটি প্রগতিশীল নীতি।” তাদের এই অযৌক্তিক চিন্তাধারা এসেছে তাদের সুবিধাবাদী দর্শন থেকে- যা হচ্ছে একটা জাতির বুদ্ধিগত দাসত্বের সবচেয়ে ঘৃণ্য একটা বৈশিষ্ট্য।

যারা বলেন যে রাজনীতি কোন ব্যক্তিকে কিংবা তার উচ্চতর নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনকে প্রভাবিত করে না বা করতে পারে না তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন অথবা অন্যের হাতে পুতুল হিসেবে কাজ করছেন। কারণ তাদের রাজনীতির মাধ্যমই তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু ও তাদের এজেন্ট ইসরাইলের স্বার্থকে সংরক্ষণের জন্যই তারা আমাদের তরুণদের মধ্যে নৈতিক বিশৃঙ্খলার বীজ ছড়াচ্ছেন।

আমাদের ধর্ম হচ্ছে আল্লাহর ওহীর উপর নির্ভরশীল এবং কিভাবে ইসলামের শিক্ষার বাস্তব অনুশীলন হয়েছিল তার সমস্ত তথ্য আমাদের ইতিহাসে আছে। আমাদের ইতিহাসে আরো আছে ঐ সব বীরদের কথা যারা ছিলেন প্রকৃত ইসলামী আদর্শের ধারক। অনুরূপভাবে, উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা যা পেয়েছি তা ইসলামী চিন্তা ও দর্শনেরই সারসংক্ষেপ। এটি হচ্ছে মানবেতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তি। একমাত্র মূর্খ ও অজ্ঞ ছাড়া আর কেউ এ সত্য অস্বীকার করতে পারে না।

অতীতই বর্তমানকে এবং একটা জাতির ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাহলে আমরা মুসলমানরা কিভাবে আমাদের গৌরবময় ইসলামী অতীত থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে পারি? আমাদের জন্য এহেন কাজ হবে ভিত স্থাপন না করে ছাদ নির্মাণ করার মত- যা কোন বুদ্ধিমান মানুষ সমর্থন করতে পারেন না।

ইসলাম হচ্ছে আমাদের আদর্শ, আমাদের অনুশীলন। ইসলামের কাছ থেকেই আমরা যাবতীয় দুঃখ- কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা লাভ করতে পারি। অন্য কোন দর্শন বা ‘বাদ’ই আমাদেরকে সত্য পথে পরিচালিত করতে পারে না। ইসলাম হচ্ছে পৃথিবীর গর্ব, একটা বড় রকম, অলৌকিক ঘটনা। এটা হচ্ছে আমাদের পথ-প্রদর্শক এবং আমাদের হাতের এমন একটা অস্ত্র যার সাহায্যে আমরা এর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি।

আমরা সারা পৃথিবীর মহানবী মুহাম্মদের (সঃ) উম্মতদের আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন তাদের নিজেদের প্রতি ও ইসলামের প্রতি দায়িত্বসমূহ ভালভাবে পালন করেন। ইসলামের নয়, মুসলমানদেরই এখন সাহায্য ও আত্মরক্ষার প্রয়োজন। কারণ আত্মরক্ষার জন্য ইসলাম নিজেই যথেষ্ট শক্তিশালী অতএব, এখন থেকে কেউ যেন না বলেন যে তিনি ইসলামকে রক্ষা করছেন। কারণ দেখ, “আল্লাহ্ বিশ্বাসীদেরকে রক্ষা করেন। সত্যি সত্যি আল্লাহ্ এ ধরণের বিশ্বাসঘাতক অকৃতজ্ঞদের ভালবাসেন না। অন্যায় জুলুম সহ্য করে যারা তার প্রতিবাদে যুদ্ধ করে আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করেন এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদেরকে জয়ী করতে সক্ষম”।

মুসলমানরা আবার বিশ্বস্তভাবে ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করুক এবং ইসলামের জন্য নিজেদের জানমাল বিসর্জন দিতে প্রস্তুত থাকুক। তাহলেই তারা তাদের পূর্বসুরীদের মত বিশ্ব-নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারবেন, কারণ আল্লাহর প্রতিশ্রুতির অবশ্যই মূল্য আছে :

“আর শহরের লোকেরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করতো এবং পাপ থেকে দূরে থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই আমরা তাদের জন্য আসমান ও জমিনের আশির্বাদ সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু (প্রতিটা দূতের কাছে) তারা মিথ্যা বলেছিল এবং সেজন্যই তারা যা রোজগার করতো তার জন্য আমরা তাদেরকে বন্দী করেছিলাম।”

আসুন, আমাদের প্রাচীনকালের বীরযোদ্ধাদের মত আমরাও আল্লাহর সাহায্য চাই এবং আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করি।

প্রকৃতপক্ষে, সারা পৃথিবীতে বিক্ষিপ্ত মুসলমানরা একই দলভুক্ত এবং তাদের অবস্থান সবার সাধারণ শত্রুদের বিরুদ্ধে। তারা সবাই পরস্পরের ভাই, কারণ “বিশ্বাসীরা ভাই ছাড়া আর কিছু নয়।”

তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এমনই এবং “অন্যায়কারী”ই[১] হোক আর “অন্যায় সাহ্যাকারীই হোক তাদেরকে সাহায্য করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব। নতুবা কেউ তাকে যথার্থ মুসলমান বলে দাবি করতে পারবেন না।

[১. মহানবী একদিন বলেছিলেন, “তোমাদের (মুসলমান) ভাইকে সাহায্য কর, সে অন্যায় সহ্যকারীই হোক আর অন্যায়কারীই (কিংবা নিষ্টুর) হোক।” কিভাবে একজন অন্যায়কারীকে সাহায্য করা হবে এ প্রশ্নের জবাবে মহানবী তাঁর সাহাবীদের বলেছিলেন যে, অন্যায়কারীকে সাহায্য করার অর্থ হচ্ছে তাকে অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখা।]

এখানে আমরা একথাও বলতে পারি যে, যে সব মুসলমান নেতা ও তাদের অনুসারীদের ব্যবহার ও দৃষ্টিভঙ্গী ইসলামের পরিপন্থী এবং যারা প্রকৃতপক্ষে ইসলাম প্রেমিক নন। তারা আসলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ইসরাইলের স্বার্থই সংরক্ষণ করেন।

এই সব বিপথগামী মুসলমান শাসক ও তাদের অনুসারীদের জন্য সতর্কবাণী হিসেবে আমরা পবিত্র কুরআন থেকে নিম্নোক্ত আয়াতগুলি উদ্ধৃত করতে চাই :

“আর তোমরা কি তাদেরকে দেখনি যারা ইতিপূর্বে নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছে এবং তোমাদের কাছে কি এটা পরিষ্কার হয়নি আমরা তাদের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছিলাম? এটা ছিল তোমাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত।”

দূরদর্শিতাই একদিন সমগ্র আরব বিশ্বকে ইসলামের পতাকাতলে একত্রিত করেছিল এবং তাদের ঐক্যই ছিল মুসলিম বিশ্বের পরবর্তী ঐক্যের মূল-ভিত্তি। কেবলমাত্র ইসলামই পারে আমাদেরকে শক্তি ও সততা দিতে। ইসলামের শক্তি ছাড়া আমাদের ধ্বংস অনিবার্য।

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব, সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা, আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ, আমাদের ত্রাণকর্তা ও পথ-প্রদর্শকের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তার সব সঙ্গীদের উপর এবং যারা আন্তরিকভাবে এবং সততার সঙ্গে ইসলামের খেদমত করছে তাদের সবার উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।

.

ভূমিকা

–সাইয়্যেদ আবুল আ’লা’ মওদূদী
আমীর, জামায়াতে ইসলামী, পাকিস্তান

ইসলাম সম্পর্কে ইউরোপের লেখকরা সাধারণতঃ তাদের ভাষায় “জেহাদ” শব্দটির অর্থ ক’রে থাকেন “ধর্ম-যুদ্ধ”। এতে ক’রে শব্দটির আসল অর্থ ও তাৎপর্যকে বদলিয়ে তারা একটা বিকৃত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেন তাদের দৃষ্টিতে এ নিজস্ব শব্দটির মধ্যে নিহিত আছে বিদ্বেষ, লোভ, ধর্মান্ধতা এবং রক্তপাত। সত্যকে বিকৃত করার দক্ষতাবলে তারা এমনভাবে বিষয়টিকে চিত্রায়িত করেছেন যে “জেহাদ” শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের মানসপটে এখন বর্বরতার দৃশ্য ভেসে উঠে। কেউ যেন শুনতে পায়, একদল ধর্মান্ধ ব্যক্তি তাদের হাতে খোলা তরবারি নিয়ে যুদ্ধের হুঙ্কার দিয়ে অসহায় অমুসলিমদেরকে মৃত্যুভয় দেখিয়ে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করছে।

জেহাদ সম্পর্কে এ ধরণের ধারণা ঐতিহাসিক সত্যের একটা হাস্যকর অপলাপ। পাশ্চাত্যের এই সব পণ্ডিত দুনিয়াকে যেভাবে বিশ্বাস করাতে চান, ইসলাম আসলে সেভাবে তার বাণী প্রচারের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের নীতিতে বিশ্বাস করে না। বরং ইসলাম মানুষকে তার নিজের পথে টানার জন্য তার বিশ্বজনীন শিক্ষার অপরিহার্য আবেদনের উপরই পুরোপুরি নির্ভরশীল।

অতএব, এই পাশ্চাত্য অপপ্রচারকে এখনই খণ্ডাতে হবে এবং এই সব তথাকথিত প্রাচ্য-বিশারদদের দ্বারা সৃষ্ট সংশয় ও ভ্রান্তিগুলিকে অবশ্যই দূর

করতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, স্বল্পসংখ্যক কিছু একক দৃষ্টান্ত ছাড়া ইসলামকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার জন্য মুসলমানরা কোন আন্তরিক প্রচেষ্টাই করেননি —বিশেষ করে মহানবী (সঃ) এবং খলিফাদের আমলে মুসলমানরা তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যে সব যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন সেগুলি সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। এই বিষয়ে সত্যিকারের প্রশংসনীয় বইয়ের অভাব খুবই তীব্র, বিশেষ ক’রে ইংরেজী ভাষায়।

The Great Battle of Badr নামের এই বইটি “গাজওয়াত বদর আল-কুবরা” এর অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন আমাদের সুযোগ্য ভ্রাতা মুহাম্মদ আহমদ বসুমাইল। এটি একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ, যাতে রয়েছে মহান মুসলিম ঐতিহাসিকদের ঐতিহ্যের ধারা অনুসারে প্রকৃত ঘটনাবলীর বিশ্বস্ত প্রকাশ।

বদরের যুদ্ধ (যা হচ্ছে এই গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়) ছিল ইসলামের ইতিহাসে সর্ব প্রথম এবং সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সংঘটিত হবার আগে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। আরবের প্রতিটি এলাকায় তারা তাদের শত্রুদের হাতে নির্দয়ভাবে নিহত হতেন এহেন প্রতিকূলতার মাঝেও ইসলামের স্বকীয় ক্ষমতা ও মহিমা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল, কারণ ইসলামের কোন অনুসারীই কোন চাপের মুখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। এতদসত্ত্বেও এটা দেখার বিষয় ছিল যে ইসলামের পতাকাতলে প্রকৃতপক্ষেই কিছু নিবেদিত-প্রাণ অনুসারী আছেন কিনা যারা তাদের আদর্শ ও বিশ্বাসের চাইতে অন্য কিছুকে বড় করে দেখেন না। ইসলামের বাণী ক্রমান্বয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লেও এর ক্ষমতা ও প্রভাব তখনও সুসংগঠিত হতে পারেনি। অথচ পৃথিবী থেকে কয়েক শতাব্দীর পুরনো জাহিলিয়ার (ইসলাম-পূর্ব যুগের অজ্ঞতা) পুরনো পঙ্কিলতাকে দূর করার জন্য ইসলামের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে তাকে সুসংহত করা একান্ত প্রয়োজন ছিল।

নতুন ধর্ম-বিশ্বাসটি তখনও নিজস্ব কোন আবাসভূমি খুঁজে পায়নি এবং তখনও এর মূল শক্তভাবে মাটিতে প্রোথিত হয়নি। শুদুমাত্র ক্ষুদ্র পরিসরের মদীনা ছাড়া মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সারা দেশেই সীমাহীন প্রতিকূলতার সম্মুখীন ছিলেন। প্রতিকূল পৌত্তলিক পরিবেশে তাদের উপস্থিতি ছিল পৌত্তলিকদের শরীরে কাঁটার মত যন্ত্রণাদায়ক।

প্রকৃতপক্ষে, বদরের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ইসলাম একটি সভ্যতা কিংবা মানব জীবনের একটি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারা সম্বলিত বাস্তবসম্মত ধর্ম হিসেবে যতটা না পরিগণিত ছিল, তার চেয়ে বেশী বিবেচিত হতো ইহা একটা তত্ত্বীয় ধর্ম হিসেবে। এর কারণ তখন পর্যন্ত এই ধর্মটি তার নিজস্ব রীতি-নীতি অনুসারে মানুষের জীবনধারা নিয়ন্ত্রণের বা পরিচালনার প্রকৃত কোন সুযোগ পায়নি, কিংবা অন্য কোন শক্তির সঙ্গে তার বিরোধিতাও হয়নি। যুদ্ধ কিংবা শান্তি জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এই ধর্মটি যে একটা উঁচু মানের নৈতিকতা অর্জন করেছে বলে দাবী করতো তা কখনো পুরোপুরিভাবে তখন পর্যন্ত প্রদর্শিত হবার সুযোগ পায়নি।

একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়ের যাবতীয় প্রয়োজনীয় শর্তগুলি একমাত্র বদরের যুদ্ধেই পূর্ণ হয়। এই যুদ্ধের মাধ্যমেই ইসলাম একটি হিসেবে ধরার মত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। জনৈক পাশ্চাত্যের পণ্ডিত বদরের যুদ্ধের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন : “বদরের পূর্বে ইসলাম ছিল একটা সামান্য ধর্ম মাত্র; কিন্তু বদরের পরে ইসলাম হয়েছিল একটা রাষ্ট্র-ধর্ম কিংবা প্রকৃতপক্ষে একটা রাষ্ট্রই।”

এখানে এটাও উল্লেখ করা যায় যে, মহানবীর (সঃ) জীবনীকাররা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিভিন্ন হাদিস ও মাগাজী (যুদ্ধের ইতিহাস) সংকলনে প্রাপ্ত ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করেছেন। কিন্তু এসব বিষয়ে সবচেয়ে বস্তু নিষ্ঠ তথ্য পাওয়া যায় পবিত্র কুরআনে। কুরআনের অষ্টম অধ্যায় নাযেল হয়েছিল বদরের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই। যে সমস্ত মুসলমানযোদ্ধা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন তারা এবং অন্যান্য বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীসহ শত শত আরববাসী এই অধ্যায়টি শুনেছিলেন এবং তা আবৃত্তি করেছিলেন।

বসুমাইল সাহেব তাঁর তথ্যাবলীর জন্য মূলতঃ নির্ভর করেছেন পবিত্র কুরআনের উপর। এজন্যই তাঁর যে গ্রন্থটির যথার্থতা অনস্বীকার্য। আমি আশা করি গ্রন্থটি বিপুলভাবে পঠিত হবে এবং এর গুণাবলী উষ্ণভাবে প্রশংসিত হবে।

Book Content

প্রথম অধ্যায় – লড়ায়ের আগে
দ্বিতীয় অধ্যায় – অভিপ্রয়াণ বা হিযরত
তৃতীয় অধ্যায় – মহানবী মদীনায়
চতুর্থ অধ্যায় – বদরের যুদ্ধ
পঞ্চম অধ্যায় – যুদ্ধের ফলাফল
ষষ্ট অধ্যায় – উপসংহার
বইয়ের ধরন: ইসলামিক বই
একেনবাবু সমগ্র ৩ – সুজন দাশগুপ্ত

একেনবাবু সমগ্র ৩ – সুজন দাশগুপ্ত

পটলা সমগ্র

পটলা সমগ্র – শক্তিপদ রাজগুরু (দুই খণ্ড একত্রে)

থ্রি এএম

থ্রি এএম – নিক পিরোগ

একটি সন্ধ্যা একটি সকাল – আশাপূর্ণা দেবী

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.