প্রেত-প্রেয়সী – অদ্রীশ বর্ধন
অ্যালফ্রেড হিচককের ‘ভার্টিগো’ অবলম্বনে রচিত
প্রেত-প্রেয়সী
রুদ্ধশ্বাস থ্রিলার
ফ্যানট্যাস্টিক ও মন্তাজ যৌথ প্রয়াস
বিষয়বস্তু – অদ্রীশ বর্ধন
গ্রন্থনা – কল্পবিশ্ব পাবলিকেশনস
প্রথম যৌথ প্রকাশ: জুন ২০২০
ইবুক প্রকাশ: জুন ২০২০
প্রচ্ছদ: কল্পবিশ্ব
হরফ সজ্জা ও পৃষ্ঠাবিন্যাস: সন্তু বাগ
বর্ণশুদ্ধি: সুদীপ দেব ও সন্তু বাগ
ইবুক সংস্করণ: বাংলা ডিজিটাল প্রেস
প্রকাশক: ফ্যানট্যাস্টিক এবং মন্তাজ পাবলিকেশনস যৌথ প্রয়াস
.
শ্ৰীমনোজ বসু
শ্রদ্ধাস্পদেষু—
নিরীক্ষামূলক রহস্যকাহিনির প্রতি যিনি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতার পরিচয় দিয়েছেন
.
‘প্রেত-প্রেয়সী’ আলফ্রেড হিচককের অসাধারণ ছায়াছবি ‘ভার্টিগো’ অবলম্বনে রচিত। এ উপন্যাসের প্রতি ছত্রে তীব্র উৎকণ্ঠা আর শ্বাসরোধী রোমাঞ্চ; কারণ এ কাহিনি এক অনিন্দ্যসুন্দরী মোহিনীর— যার মৃত্যু হয়েছিল পরপর তিনবার!
মুখবন্ধ
‘প্রেত-প্রেয়সী’ একটি ফরাসি রোমাঞ্চ-কাহিনির কাঠামোয় রচিত। সে কাহিনির নাম ‘D’entre les morts’। ইংরেজি ভাষায় একই কাহিনি ‘দ্য লিভিং অ্যান্ড দ্য ডেড’ নামে প্রকাশ পায়। রুপোলি পর্দায় গিয়ে আলফ্রেড হিচককের হাতে কাহিনিটি নতুন নাম নেয়— ‘ভার্টিগো’।
‘প্রেত-প্রেয়সী’ ১৯৬৫ সালের মে মাসে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-তে প্রকাশিত হয়েছিল।
.
ভূমিকা
বোলিউ-নার্সেজ্যাক এই ছদ্মনামের আড়ালে বিংশ শতাব্দীর মনস্তাত্ত্বিক রহস্য গল্পের ক্যানভাসে বহু বিচিত্র প্লটের বর্ণালী বীক্ষণ করে গেছেন অন্যতম সেরা ফরাসি লেখক জুটি পিয়ের বোলিউ এবং পিয়ের অরো (ওরফে টমাস নার্সেজ্যাক)। ‘Le roman de la victime’ (The victim novel) অর্থাৎ গোয়েন্দা গল্পের প্রচলিত কাঠামোর পরিবর্তে রহস্যের উৎকেন্দ্র এবং দ্রষ্টার অভিমুখের কম্পাস শলাকা কিছুটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেখানে রহস্যের মোড়ক উন্মোচিত হবে এই ট্র্যাজেডির বলি যে তারই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এই ধারার প্রবক্তা ছিলেন এঁরা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে প্রকাশিত ইউজিন ফ্রাসোয়াঁ ভিদখের মেমোয়ার্স বা তাঁর দ্বারা প্রভাবিত এডগার অ্যালান পো সৃষ্ট দ্যুপঁ অথবা এমিল গ্যাবোরিও প্রণীত মঁসিয়ে লেখকের রহস্য কাহিনি থেকে শুরু করে অক্সিডেন্ট ডিটেকটিভ ক্যানন যেভাবে গড়ে উঠেছে, পরবর্তীকালে ব্রিটিশ এবং ইউরোপিয়ান লেখকদের কলমে (উইকি কলিন্স, আর্থার কন্যান ডয়াল, রিচার্ড অস্টিন ফ্রিম্যান, আগাথা ক্রিস্টি, ডরোথি লে সেয়ার্স প্রমুখ) সেই রহস্যের যে ক্লাসিক বা ধ্রুপদী ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে এবং তারও পরে আমেরিকান হার্ড বয়েল্ড ঘরানায় ড্যাসিয়েল হ্যামেট, রেমন্ড শ্যান্ডলার প্রমুখ লেখকদের কলম থেকে জন্ম নেওয়া প্রাইভেট-আই গোয়েন্দারা যেভাবে অপরাধের কূলকিনারা করেছেন, তার থেকে একটা বড় বাঁক ছিল এই ধরনের রহস্য প্লটের বুনন। এঁরা দুজনেই ভক্ত ছিলেন বেলজিয়ান ওয়ালুনিজ (ফরাসি ভাষী) বিখ্যাত লেখক জর্জেস সিমেনঁ’র। তাঁর সৃষ্ট মেইগ্রে চরিত্রে যেভাবে মনস্তত্ত্বের আলোতে অপরাধের বিশ্লেষণ করা হয়েছে সেই স্টাইলের দ্বারা এঁরা দুজনেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে এই জুটির দ্বিতীয় উপন্যাস ‘Celle qui n’était plus’ বা ইংরেজি তর্জমায় ‘She Who Was No More’ বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে এই আঙ্গিকে প্লট উন্মোচনের অভিনবত্ব সাড়া ফেলেছিল রসিক মহলে। যে উপন্যাস থেকে বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক হেনরি জর্জেস ক্লুসোর পরিচালনায় জগদ্বিখ্যাত ফরাসি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার চলচ্চিত্র ‘Les Diaboliques’ নির্মিত হয় ১৯৫৫ সালে। এই উপন্যাসের ফিল্ম রাইট কিনতে ব্যর্থ হন আলফ্রেড হিচকক। যদিও লেখক রবার্ট ব্লকের উপন্যাস অবলম্বনে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ‘সাইকো’র প্লটের চমকত্বে এই উপন্যাসের একটা বড় ভূমিকা আছে।
১৯৫৪ সালে বোলিউ-নার্সেজ্যাক জুটির লেখা মূল ফরাসি উপন্যাস ‘D’entre les morts’ প্রকাশিত হয় যা ইংরেজি শিরোনামে দাঁড়ায় ‘From Among the Dead’ অথবা ‘The Living And The Dead’। ফরাসি নব তরঙ্গের এক অন্যতম পুরোধা পরিচালক ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফো যদিও দাবি করেছিলেন যে হিচককের কথা ভেবেই এই উপন্যাস লেখা কিন্তু এই দাবি নস্যাৎ করেছিলেন নার্সেজ্যাক। তবে প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্টকে প্রভাবিত করে আলফ্রেড হিচকক এই উপন্যাসের এক সিনপসিস করিয়েছিলেন ওই লেখকদের সঙ্গে রীতিমতো অফিসিয়াল চুক্তি করে, তখনও এই উপন্যাসের ইংরেজি তর্জমা প্রকাশিত হয়নি। এই ধরনের লেখাকে ভিস্যুয়াল ন্যারেটিভে ধরার স্বপ্ন ছিল ওঁর, যে স্বপ্নেরই ফসল জেমস স্টুয়ার্ট এবং কিম নোভাক অভিনীত ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি ‘ভার্টিগো’।
হিচকক সাহেব তাঁর ছবির পটভূমিকা করেন ১৯৫০ এর দশকের ক্যালিফোর্নিয়া শহরে এবং অন্তিমে নায়িকার মৃত্যুও দেখান অন্যভাবে, যদিও মূল আখ্যানের অধিকাংশই রয়ে গেছিল অক্ষত। সমকালে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেলেও এই সিনেমা সমালোচক এবং সিনেমাপ্রেমী দর্শকদের সমীহ আদায় করে নিয়েছে কালের পরীক্ষায়। এমনকি বিখ্যাত ব্রিটিশ সিনেমা পত্রিকা ‘সাইট অ্যান্ড সাউন্ড’ এর ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্রের তকমাও জোটে এই চলচ্চিত্রের ভাগ্যে, আর এক আইকনিক ছায়াছবি ‘সিটিজেন কেন’কে প্রতিস্থাপিত করে।
সেই মূল গল্পের নির্যাস এই বাংলার মাটির প্রকৃতি প্রত্যয়ের বিনির্মানে একদা অনুপম অনুবাদে এনেছিলেন আর এক জিনিয়াস লেখক-অনুবাদক-সম্পাদক শ্রী অদ্রীশ বর্ধন। অদ্রীশবাবুর অনূদিত ‘প্রেত-প্রেয়সী’ প্রকাশ পায় মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত পত্রিকা ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-এর মে, ১৯৬৫ সংখ্যায়, পরে যে পত্রিকার নাম হয়েছিল ‘রোমাঞ্চ’। এই রূপান্তরে অদ্রীশ তাঁর গল্পের পটভূমিকা রেখেছেন গত শতাব্দীর চারের দশকের কলকাতা শহরে যেখানে ঘনিয়ে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া, যদিও গল্পের বহিরঙ্গে তিনি মূলত সিনেমার প্লটটিকেই অনুসরণ করেছিলেন। ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার ১৯৬৫ সালের ‘মে’ সংখ্যার কভারটি অন্বেষা সাহার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
মন্তাজ এবং ফ্যানট্যাস্টিক প্রকাশনীর যৌথ উদ্যোগে সেই অনুবাদের এই পুনঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে বোলিউ-নার্সেজ্যাক, আলফ্রেড হিচকক এবং অদ্রীশ বর্ধন— এই সব আলোর দিশারীদের কাছেই ঋণস্বীকার করা হল রহস্যে রোমাঞ্চ সাহিত্যের মুগ্ধ পাঠককুলের তরফ থেকে। রহস্যের অলিন্দে আমাদের সত্যান্বেষণ জারি থাকুক।
সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
জুন ২০২০
কলকাতা
.
পরিচিতি
বোলিউ-নার্সেজ্যাক
বোলিউ-নার্সেজ্যাক এই ছদ্মনামের আড়ালে বিংশ শতাব্দীর মনস্তাত্ত্বিক রহস্য গল্পের ক্যানভাসে বহু বিচিত্র প্লটের বর্ণালী বীক্ষণ করে গেছেন অন্যতম সেরা ফরাসি লেখক জুটি পিয়ের বোলিউ এবং পিয়ের অরো (ওরফে টমাস নার্সেজ্যাক)। ‘Le roman de la victime’ (The victim novel) অর্থাৎ গোয়েন্দা গল্পের প্রচলিত কাঠামোর পরিবর্তে রহস্যের উৎকেন্দ্র এবং দ্রষ্টার অভিমুখের কম্পাস শলাকা কিছুটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেখানে রহস্যের মোড়ক উন্মোচিত হবে এই ট্র্যাজেডির বলি যে তারই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, এই ধারার প্রবক্তা ছিলেন এঁরা। এই দুই জুটি লিখেছেন ৪৩টি উপন্যাস, ১০০র বেশি ছোটগল্প এবং চারটি নাটক। তাঁদের লেখা প্রচুর সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক হেনরি জর্জেস ক্লুসোর পরিচালনায় জগদ্বিখ্যাত ফরাসি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ‘Les Diaboliques’ এবং আলফ্রেড হিচককের পরিচালিত জেমস স্টুয়ার্ট এবং কিম নোভাক অভিনীত ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছায়াছবি ‘ভার্টিগো’।
আলফ্রেড হিচকক
স্যার আলফ্রেড জোসেফ হিচকক ছিলেন গত শতাব্দীর এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালক এবং প্রযোজক। সাসপেন্স ছায়াছবি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অগ্রগণ্য, রহস্যের অন্দরে চূড়ান্ত গা ছমছমে আবহ তৈরির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৯২৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দ্য প্লেজার গার্ডেন’ থেকে শুরু করে ১৯৭৬ সালে ‘ফ্যামিলি প্লট’ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ের যাত্রাপথে হিচকক সাহেব পঞ্চাশেরও বেশি ছায়াছবি পরিচালনা করেন, যার অনেকগুলোই সাধারণ দর্শক এবং বিদগ্ধ সমালোচক দুই মহলেই উচ্চ-প্রশংসিত হয়। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ এই ভদ্রলোক প্রাথমিকভাবে প্রযুক্তিগত শিক্ষা নিয়েও আগ্রহী হয়ে পড়েন চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রতি। বিশেষ করে জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট জাতীয় ছায়াছবি তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। এই সূত্রে উল্লেখ্য যে বিখ্যাত জার্মান পরিচালক ফ্রিৎজ ল্যাং পরিচালিত ১৯২১ সালের অন্যতম ছায়াছবি ‘ডেস্টিনি’ তাঁর ওপর প্রভাব ফেলেছিল গভীরভাবে। ১৯২৭ সালের ছবি ‘দ্য লজার: আ স্টোরি অব দ্য লন্ডন ফগ’ থেকে তাঁর ছবি নজর কাড়তে শুরু করে সমালোচকের এবং সাসপেন্স থ্রিলার ছায়াছবির ক্ষেত্রে হিচকক এই নাম প্রায় সমার্থক হতে শুরু করে। ১৯২৯ সালে মুক্তি পাওয়া প্রথম ব্রিটিশ টকি অর্থাৎ সবাক ছায়াছবি ‘ব্ল্যাকমেইল’ পরিচালনার কৃতিত্বও ছিল তাঁরই। পরবর্তীকালে হলিউডের বিখ্যাত প্রযোজক ডেভিড সেলজনিকের প্রভাবে তিনি হলিউডে যান এবং সেই পর্বে সাসপেন্স ছায়াছবির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টি হয় তাঁরই পরিচালনায়। টিভিতে সাসপেন্স ধারাবাহিক হিসেবে ‘আলফ্রেড হিচকক প্রেজেন্টস’ এবং ‘দ্য আলফ্রেড হিচকক আওয়ার’ এক সময় সাড়া ফেলেছিল যে দুই অনুষ্ঠানের সূত্রধর ছিলেন তিনি। ‘রেবেকা’, ‘লাইফবোট’, ‘ভার্টিগো’, ‘সাইকো’, ‘দ্য বার্ডস’ এমন সব আইকনিক ছায়াছবির পরিচালক আলফ্রেড হিচকক ‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ অভিধায় চিরস্থায়ী রয়ে গেছেন রহস্যপ্রেমী দর্শকের হৃদয়ে।
অদ্রীশ বর্ধন
জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৩২, কলকাতায়। একটি প্রাচীন শিক্ষাব্রতী পরিবারে। ছোট থেকেই অজানার দিকে দুর্নিবার আকর্ষণ। অ্যাডভেঞ্চারের টান জীবনে, চাকরিতে, ব্যবসায়, সাহিত্যে। নামী একটি প্রতিষ্ঠানের পারচেজ ম্যানেজার পদে ইস্তফা দিয়ে পুরোপুরি চলে আসেন লেখার জগতে। গোয়েন্দা সাহিত্যে একনিষ্ঠ থেকে বাংলায় সায়েন্স ফিকশনকে ত্রিমুখী পন্থায় জনপ্রিয় করতে শুরু করেন ১৯৬৩ সাল থেকে। ভারতের প্রথম কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’-র ছদ্মনামী সম্পাদক। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন ‘ফ্যানট্যাসটিক’। ইন্দ্রনাথ রুদ্র, ফাদার ঘনশ্যাম, প্রোফেসর নাটবল্টু চক্র প্রমুখ চরিত্রের স্রস্টা। পেয়েছেন একাধিক পুরষ্কার। দীনেশ্চন্দ্র স্মৃতি পুরষ্কার, মৌমাছি স্মৃতি, রণজিৎ স্মৃতি ও পরপর দু’বছর দক্ষিণীবার্তার শ্রেষ্ঠ গল্প পুরষ্কার। অনুবাদের ক্ষেত্রে সুধীন্দ্রনাথ রাহা পুরষ্কার। ভালোবাসেন লিখতে, পড়তে ও বেড়াতে।
Leave a Reply