• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস – বার্ট্রান্ড রাসেল

লাইব্রেরি » বার্ট্রান্ড রাসেল » পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস – বার্ট্রান্ড রাসেল

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস – বার্ট্রান্ড রাসেল

প্রাককথন

এ পুস্তকের যা প্রাপ্য তার চাইতে কঠোর নিন্দাবাদ এড়াতে হলে কিছু ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত, আর উচিত কিছু ব্যাখ্যা করা।

ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত বিভিন্ন দার্শনিকগোষ্ঠী এবং কিছু দার্শনিকদের কাছে। লিবনিজ সম্পর্কিত সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য যত দার্শনিক নিয়ে আলোচনা করেছি তাদের সবার সম্পর্কেই অন্যরা আমার চাইতে ভালো জানেন। তবে বিরাট বিস্তার নিয়ে কোনো বই যদি আদৌ লিখতে হয় তাহলে এরকম হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যেহেতু আমরা অমর নই সেজন্য যারা একজন লেখক অথবা একটা ক্ষুদ্র যুগে মনঃসংযোগ করেন তাদের তুলনায় এই ধরনের বই যারা লেখেন তারা যে কোনো একটি অংশের জন্য সময় কম ব্যয় করতে পারেন। সেজন্য যাদের পাণ্ডিত্যের মান কঠোর এবং অনমনীয় তারা সিদ্ধান্ত করবেন এরকম বিরাট বিস্তার নিয়ে কোনো বই লেখাই উচিত নয় কিংবা যদি লেখা হয় তাহলে সেটা হওয়া উচিত বহু লেখকের প্রত্যেকের এক একটি বিষয়ে লেখার সমন্বয়। তবে অনেকের লেখার সঞ্চয় হলে কিছু ক্ষতিও হয়। ইতিহাসের গতিতে যদি কোনো ঐক্য থাকে, যদি অগ্র-পশ্চাতে কোনো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকে তাহলে সেগুলো লিখবার জন্য পূর্ব যুগ ও পরবর্তী যুগের সংশ্লেষণ করা প্রয়োজন একটিমাত্র মনে। যে ছাত্র রুশো-র লেখা পাঠ করে, প্লেটো এবং পুটাখের স্পার্টার সঙ্গে রুশোর সম্পর্ক নির্ণয়ের ব্যাপারে সুবিচার করতে তার অসুবিধা হতে পারে। স্পার্টার ঐতিহাসিক হয়তো হবস, ফিকটে এবং লেনিন সম্পর্কে যুগদর্শীর মতো সচেতন হবেন না। এই রকম সম্পর্ক প্রকাশ করা এই পুস্তকের একটি উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্য সাধিত হতে পারে শুধুমাত্র ব্যাপক নিরীক্ষার ফলেই।

দর্শনশাস্ত্রের ইতিহাস বিষয়ক অনেক পুস্তক আছে কিন্তু আমার জ্ঞানত এমন কোনো পুস্তক নেই যে পুস্তক আমার গৃহীত উদ্দেশ্য পালন করে। দার্শনিকরা কার্য ও কারণ উভয়ইঃ তাঁদের সামাজিক পরিস্থিতি, তাঁদের কালের রাজনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো হলো তাদের কার্য; কারণগুলো হলো (যদি তাঁরা ভাগ্যবান হন)-যে বিশ্বাসগুলো দিয়ে পরবর্তী যুগের রাজনীতি এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো গঠিত। অধিকাংশ দর্শনের ইতিহাস বিষয়ক পুস্তকে প্রত্যেক দার্শনিক প্রকাশ পান যেন এক শূন্যতার ভিতরে; তাঁর মতামতগুলো প্রকাশ পায় অসম্পর্কিতভাবে, খুব বেশি হলে সম্পর্ক দেখানো হয় পূর্বের দার্শনিকদের সঙ্গে। এর বিপরীতে, আমি চেষ্টা করেছি সত্যের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রত্যেক দার্শনিককে তার সামাজিক পরিবেশের ফলরূপে দেখাতে অর্থাৎ, তিনি এমন একজন মানুষ যার ভিতরে যে সমাজের তিনি অংশ ছিলেন সেই সমাজের চিন্তা এবং বোধের বিমূর্ত ও পরিব্যাপ্ত রূপ কেন্দ্রীভূত হয়ে দানা বেঁধেছিল।

এর জন্য প্রয়োজন হয়েছে শুদ্ধ সামাজিক ইতিহাস বিষয়ক বিশেষ কয়েকটি অধ্যায় যোগ করা। হেলেনায়িত যুগ সম্পর্কে কিছু জানা না থাকলে স্টোইক এবং এপিকুরীয়দের সম্পর্কে কেউই কিছু বুঝতে পারবে না কিংবা পঞ্চম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত চার্চের বৃদ্ধি সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান না থাকলে কেউই স্কলাস্টিকদের (Scholastic-মধ্যযুগের খ্রিষ্টীয় পণ্ডিত) বুঝতে পারবে না। সেই জন্য ঐতিহাসিক রূপরেখার যে সমস্ত প্রধান অংশ আমাশ মনে দার্শনিক চিন্তাকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছিল সেগুলো আমি সংক্ষেপে বিবৃত করেছি এবং ইতিহাসের যে অংশগুলো কিছু পাঠকের কাছে অপরিচিত মনে হবে ভেবেছি সেগুলো বিস্তারিতভাবে লিখেছি-উদাহরণ, মধ্যযুগের প্রথম অংশ বিষয়ে। কিন্তু সেই সমস্ত ঐতিহাসিক অধ্যায়ে যেগুলোকে আমার মনে হয়েছে সমসাময়িক কিংবা পরবর্তী যুগের দর্শনের উপর প্রভাবহীন-সেগুলোকে সযত্নে বাদ দিয়েছি।

এইরকম একটি পুস্তকের নির্বাচন সমস্যা খুবই কঠিন। খুঁটিনাটি না দিলে পুস্তকটি হয়ে যায় শূন্যগর্ভ ও আকর্ষণহীন; খুঁটিনাটি দিলে অসহনীয় রকমের দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আমি একটা আপস-মীমাংসা খুঁজেছি অর্থাৎ যে সমস্ত দার্শনিককে আমার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে শুধু তাদের নিয়ে আলোচনা করেছি এবং তার সঙ্গে এমন কিছু খুঁটিনাটি ব্যাপার উল্লেখ করেছি যেগুলো মূলগত গুরুত্ব না থাকলেও দৃষ্টান্তের জন্য কিংবা লেখাটিকে জীবন্ত করার জন্য সেগুলোর মূল্য আছে।

প্রাচীনতম যুগ থেকেই দর্শনশাস্ত্র শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা মুষ্টিমেয় পণ্ডিতদের আলোচ্য বিষয় নয়। এই শাস্ত্র সমগ্র গোষ্ঠীজীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থেকেছে এবং সেভাবেই এর বিচার করতে চেষ্টা করেছি। এই পুস্তকের যদি কোনোও ভুল থাকে তাহলে সেটা আহরিত হয়েছে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। অস্তিত্বের জন্য এই পুস্তক ঋণী ড.অ্যালবার্ট সি. বার্ণস (Dr. Albert C. Barnes) এর কাছে। প্রথমে এই পুস্তকের ছক করা হয়েছিল এবং বক্তৃতায় অংশত বলা হয়েছে পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্গস ফাউন্ডেশনের বক্তৃতায়।

গত তেরো বছরে আমার অধিকাংশ কাজের মতোই গবেষণায় ও অন্যান্য অনেক কাজে সাহায্য করেছেন আমার স্ত্রী প্যাট্রিসিয়া রাসেল (Patricia Rasel)।

— বার্ট্রান্ড রাসেল
লন্ডন
১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ।

.

পরিচয়

 আমাদের চিন্তায় বিশ্ব এবং জীবন সম্পর্কিত ধারণাই হলো দার্শনিক ধারণা। দুটি উপাদান দ্বারা এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত। প্রথমতঃ উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ধর্মীয় এবং নৈতিক ধ্যান-ধারণা, দ্বিতীয়তঃ সেই জাতীয় অনুসন্ধান- যেগুলোকে বৈজ্ঞানিক আখ্যা দেওয়া হয়েছে এবং এক্ষেত্রে শব্দটি বিস্তৃততম অর্থে ব্যবহার করা হয়। একক দার্শনিকদের নিজস্বতন্ত্রে দুটি উপাদানের আপেক্ষিক অনুপাত সম্পর্কে গভীর মতবিরোধ রয়েছে, তবু কিছু মাত্রায় উভয়ের অস্তিত্ব থাকাই দর্শনশাস্ত্রের বৈশিষ্ট্য।

নানাভাবে ব্যবহৃত হয়েছে দর্শনশাস্ত্র শব্দটি, এর ব্যবহার কোথাও সুপ্রসারিত, কোথাও সঙ্কীর্ণ। এ শব্দটিকে আমি ব্যবহার করতে চাই অতি ব্যাপক অর্থে, আর তা নিয়েই এখন ব্যাখ্যা করব।

আমি বিশ্বাস করি-দর্শনশাস্ত্র হলো ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মধ্যবর্তী একটা কিছু। ধর্মতত্ত্বের মতোই এতে রয়েছে এমন সব ব্যাপার সম্পর্কে দূরকল্পন (speculations) যেসব ব্যাপার আজও নির্দিষ্ট নিশ্চিত নয়; কিন্তু ঐতিহ্য কিংবা উদঘাটিত (revelation) জ্ঞানের কাছে নয়, বিজ্ঞানের মতোই এর আবেদন মানুষের যুক্তির কাছে। সমস্ত নির্দিষ্ট নিশ্চিত জ্ঞানই বিজ্ঞানের অধিকারে-আমি এটা বলতেই দৃঢ়তা পোষণ করি। যে সমস্ত ভ্ৰান্তবাদী (dogma) নির্দিষ্ট নিশ্চিত জ্ঞানকে অতিক্রম করে তারা ধর্মতত্ত্বের অধিকারে কিন্তু ধর্মতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের মাঝখানে রয়েছে একটা বেওয়ারিশ এলাকা যাকে দুদিক থেকে আক্রমণ করা সম্ভব। সেই বেওয়ারিশ এলাকাটিই দর্শনশাস্ত্র। দূরকল্পনাকারীদের পক্ষে যা কৌতূহলজনক সেই ধরনের বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে বিজ্ঞান অপারগ। ধর্মশাস্ত্রবিদদের সুনিশ্চিত উত্তরগুলো পূর্ব শতাব্দীর বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে এই শতাব্দিতে এসে। বিশ্ব কি মন এবং জড়বস্তুতে বিভক্ত? যদি তাই হয়, তাহলে মন আর জড়বস্তু আসলে কী? মন কি পদার্থের অধীন? না কি মনের স্বাধীন ক্ষমতা রয়েছে? মহাবিশ্বের কি কোনোও ঐক্য বা উদ্দেশ্য আছে? কোনো স্থির লক্ষ্যের অভিমুখে কি তার বিবর্তন হচ্ছে? প্রাকৃতিক বিধিগুলোর অস্তিত্ব কি সত্য, না নিয়মশৃঙ্খলার প্রতি আমাদের সহজাত ভালোবাসার জন্য আমরা এগুলোতে বিশ্বাস করি? জ্যোতির্বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে মানুষের যে রূপ-অবিশুদ্ধ অঙ্গার ও জল দ্বারা নির্মিত একটি অতিক্ষুদ্র পিন্ড এবং এক ক্ষুদ্র গুরুত্বহীন গ্রহের উপরে অসহায়ভাবে সঞ্চরণশীল-সেটাই কি সত্য? না হ্যামলেটের কাছে উন্মোচিত রূপ সত্য? সে কি একই অঙ্গে দুই রূপ? জীবনযাপনের একটি প্রকার কি শ্রেয় এবং অন্য একটি কি হেয়? না কি সবরকম জীবনধারাই অর্থহীন? যদি শ্রেয়তর জীবনযাত্রার অস্তিত্ব থাকে তাহলে কি তার গঠন? এবং আমরা কি করে তা লাভ করব? শুভকে মূল্যবান হতে হলে তাকে কি শাশ্বত হতে হবে? না কি ব্রহ্মাণ্ড অপ্রতিরোধ্যভাবে মৃত্যুপথগামী হলেও শুভের অনুসন্ধান করা উচিত? প্রজ্ঞা বলে কোনোও বস্তু আছে কি? না কি যাকে প্রজ্ঞা বলে মনে হয় সেটা আসলে মূর্খতারই চরম সংস্কৃত রূপ? বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারে এই সমস্ত প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না।

ধর্মতত্ত্বগুলো মুক্তকণ্ঠে প্রশ্নগুলোর অতি নির্দিষ্ট নিশ্চিত উত্তর দিতে পারে। কিন্তু তাদের এই পরম নিশ্চয়তার জন্যই আধুনিক মানস সেগুলোকে সন্দেহ করে। এই সমস্ত প্রশ্নের বিচার এবং ক্ষেত্র বিশেষে উত্তর অনুসন্ধান দর্শনশাস্ত্রের কাজ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এইসব সমাধানহীন প্রশ্ন নিয়ে সময় নষ্ট করে কি কোনো লাভ আছে? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে মহাজাগতিক নিঃসঙ্গতায় আশঙ্কিত একক মানবের দৃষ্টিতে অথবা ঐতিহাসিকের দৃষ্টিতে।

ঐতিহাসিকের উত্তর এই পুস্তকে ক্রমশ প্রকাশ্য, অবশ্যই তা আমার ক্ষমতা অনুসারে। স্বাধীন দূরকল্পনের ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়ে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ভালো-মন্দ বিচার করার জন্য মানুষ নির্ভর করেছে বিশ্ব এবং মানবজীবন সম্পর্কে তার তত্ত্বজ্ঞানের উপর। এ তথ্য, যে কোনো অতীতে যতটা সত্যি ছিল আজও ততটা সত্যি। একটা যুগ কিংবা একটা জাতিকে বুঝতে হলে তার দর্শন বোঝা আবশ্যক এবং তার দর্শন বুঝতে গেলে আমাদেরও খানিকটা দার্শনিক হতে হয়। এখানে একটা পারস্পরিক কারণ রয়েছে। মানুষের জীবনের পরিস্থিতি অনেকাংশে নির্ধারণ করে তার দর্শন আবার উল্টোদিক থেকে বলা যায়, তার দর্শন অনেকাংশেই নির্ভর করে তার পরিস্থিতির উপর। শতাব্দীর পর শতাব্দী এই পারস্পরিক ক্রিয়াই পুস্তকে আলোচ্য বিষয়।

একটা ব্যক্তিগত উত্তর অবশ্য রয়েছে এখানে। বিজ্ঞান বলে-আমাদের পক্ষে কি জানা সম্ভব, কিন্তু আমাদের জানার পরিমাণ কত অল্প সেটা যদি ভুলে যাই তাহলে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বহুবিধ বিষয় অনুভব করতে পারি না। অন্যদিকে, ধর্মতত্ত্ব একটা যুক্তিহীন গোঁড়া বিশ্বাস সৃষ্টি করে যে, জ্ঞান আমাদের রয়েছে অথচ আমাদের যা রয়েছে আসলে সেটা হলো অজ্ঞতা। এই ধরনের বিশ্বাস মহাবিশ্ব সম্পর্কে দুর্বিনীত ঔদ্ধত্বের জনক। অনিশ্চিত, সুস্পষ্ট আশা এবং ভীতির সামনে বেদনাদায়ক কিন্তু আমরা যদি রূপকথার সান্ত্বনা ছাড়াই বাঁচতে চাই তাহলে এ অনিশ্চিতি সহ্য করতে হবে। দর্শনশাস্ত্রের উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর ভুলে যাওয়া ঠিক নয়, আবার এ প্রশ্নগুলোর সন্দেহাতীত উত্তর পেয়ে গেছি-নিজেদের এরকম বিশ্বাস করানোও ভালো নয়। অনিশ্চিত নিয়ে, দ্বিধায় পঙ্গু না হয়ে বাঁচতে শেখাই বোধহয় আজকের যুগের দর্শনের ছাত্রদের প্রধান প্রাপ্তি।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দিতে গ্রিসে দর্শনশাস্ত্র ধর্মতত্ত্ব থেকে পৃথক হয়ে স্পষ্ট রূপ লাভ করতে শুরু করে। প্রাচীন যুগ পরিক্রমা করে রোমের পতন এবং খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের সময় থেকে আবার ধর্মতত্ত্বে দর্শনশাস্ত্রের ভরাডুবি হয়। দর্শনশাস্ত্রের দ্বিতীয় মহান যুগ একাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক (১১৯৫-১২৫০) এর মতো দু একজন বিদ্রোহীর কথা বাদ দিলে এ যুগে দর্শনশাস্ত্রের উপর প্রভুত্ব করেছে ক্যাথলিক চার্চ। খ্রিষ্টীয় ধর্মবিপ্লবের (the Reformation) নানা গোলমালে এই যুগের অবসান। সপ্তাদশ শতাব্দী থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যে তৃতীয় যুগ-তার উপর প্রভুত্ব করেছে। বিজ্ঞান পূর্ববর্তী দুই যুগের তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায়। চিরায়ত ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্ব বিরাজমান কিন্তু তার যৌক্তিকতা প্রমাণের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। বিজ্ঞানের জবরদস্তিতে প্রয়োজন অনুসারে ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তিত হয়েছে। এই যুগের খুব কম দার্শনিক ক্যাথলিক দৃষ্টিভঙ্গি সনাতনী মনে করবে এবং চার্চের চেয়ে তাঁদের দূরকল্পনে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

পুরো সময়টি জুড়েই ধর্ম এবং বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বের মতোই সামাজিক সংযুক্তি (social cohesion) এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার দ্বন্দ্ব রয়েছে। অথবা তাদের মধ্যে রয়েছে অস্বস্তিজনক সহাবস্থান। গ্রিসে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য সামাজিক সংযুক্তি নিশ্চিত করত। এমনকি অ্যারিস্টটল, যদিও তাঁরই সময় আলেকজান্ডার নগররাষ্ট্রকে অচল করে তুলেছিলেন, তিনিও অন্য ধরনের রাজনৈতিক (polity) কোনো গুণ দেখতে পাননি। নগরের প্রতি কর্তব্যের দরুন ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব হতো, কিন্তু এই খর্বতার পরিমাণ ছিল স্থান থেকে স্থানান্তরে ভিন্ন। স্পার্টাতে ব্যক্তি স্বাধীনতা ছিল আধুনিক জার্মানি কিংবা রাশিয়ার মতো স্বল্প; এথেন্সে, সর্বশ্রেষ্ঠ যুগে মাঝে মাঝে পীড়ন সত্ত্বেও রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত বিধিনিষেধ থেকে নাগরিকদের অসাধারণ স্বাধীনতা ছিল। অ্যারিস্টটলের যুগ পর্যন্ত গ্রিক চিন্তাধারায় নগরের প্রতি ধার্মিক এবং দেশপ্রেমিক আনুগত্যের প্রাধান্য এর এনৈতিক তন্ত্রগুলোকে (systems) নাগরিকদের জীবনের সঙ্গে মানানসই করে নেওয়া হয়েছে এবং এগুলিতে রাজনৈতিক উপাদান বিরাট। গ্রিকরা প্রথমে ম্যাসিডোনিয়া এবং পরে রোমকদের অধীন হলে স্বাধীন যুগের ধারণাগুলো ক্রমশ অপ্রযোজ্য হয়ে উঠল। এর ফল হলো, একদিকে ঐতিহ্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার দরুন বীর্যের অবক্ষয় আর অন্যদিকে নীতিগুলো হয়ে উঠল সামাজিকের চেয়ে অধিক পরিমাণে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। স্টোইকদের (stoics) ধারণা ছিল নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সম্পর্ক তার চাইতে ধর্মজীবনে আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই তারা খ্রিষ্টধর্মের পথ প্রস্তুত করলেন, স্টোইক দর্শনের মতো এ ধর্মও প্রাথমিকভাবে ছিল অরাজনৈতিক, কারণ, প্রথম তিন শতাব্দীতে এই ধর্মের অনুগামীদের রাষ্ট্রের উপর কোনো প্রভাব ছিল না। আলেকজান্ডার থেকে কনস্ট্যানটিন পর্যন্ত ৬৫০ বছর সামাজিক সংযুক্তির ভিত্তি ছিল বলপ্রয়োগ। প্রথমে সামাজিক বল, তারপর অসামরিক শাসনব্যবস্থা-দর্শন বা প্রাচীন আনুগত্য নয়। রোমক সৈন্যবাহিনী, রোমক সড়ক, রোমক আইন এবং রোমক অধিকারিকরা শক্তিশালী কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের পত্তন করেন, পরে সেই রাষ্ট্রকে রক্ষাও করেন। কোনোটাই রোমক দর্শনের দান নয়, কারণ রোমকদের কোনো দর্শনই ছিল না।

স্বাধীন যুগের প্রচলিত গ্রিক চিন্তাধারায় উত্তরাধিকার ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে লাগল এই দীর্ঘ সময় ধরে। যেসব প্রাচীন ধ্যান-ধারণা বিশেষ করে ধর্মীয়, সেগুলোর আপেক্ষিক গুরুত্ব বাড়ল, আর তুলনায় বেশি যুক্তিবাদী চিন্তা পরিত্যক্ত হলো। কারণ, যুগের মেজাজের সঙ্গে সে চিন্তাধারা খাপ খেত না। এইভাবে পরবর্তী পৌত্তলিকরা গ্রিক ঐতিহ্যকে ছাঁটকাট করতে করতে খ্রিষ্টীয় মতবাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত করে তোলে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদকে জনপ্রিয় করে তোলে খ্রিষ্টধর্ম। স্টোইক শিক্ষণে এই মতবাদ ছিলই কিন্তু প্রাচীন যুগের মেজাজের সঙ্গে সে মতবাদ ছিল বেমানান-অর্থাৎ এই মতবাদ যে, ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যের তুলনায় বহুগুণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের বাধ্য হওয়ার চেয়ে ঈশ্বরের বাধ্য হওয়া উচিত-সক্রেটিস এবং ভগবত্বাক্য প্রচারকদের (apostles) এ মতবাদ কনস্ট্যানটিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পরেও টিকে ছিল। কারণ, প্রথমদিকে খ্রিষ্টীয় সম্রাটরা ছিলেন শাস্ত্রনিষ্ঠ (orthodox) মতবাদ গ্রহণ করলেন এ মতবাদ সাময়িকভাবে পরিত্যক্ত হলো। বাইজানটাইন সাম্রাজ্যে এ মতবাদ প্রচ্ছন্ন ছিল এবং পরবর্তী যে রুশ সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপল থেকে খ্রিষ্টধর্ম পেয়েছিল, সেখানেও প্রচ্ছন্নই রয়ে গেল। কিন্তু পশ্চিমে, ক্যাথলিক সম্রাটরা প্রায় তৎক্ষণাৎ বর্বর (barbarian) বিধর্মী বিজেতাদের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে (গল দেশের কিয়দংশ বাদে) রাজনৈতিক আনুগত্যের তুলনায় ধর্মীয় আনুগত্যের উচ্চতর মূল্য বেঁচে রইল এবং এখনও কিয়দংশে বেঁচে রয়েছে।

পশ্চিম ইউরোপের সভ্যতা ধ্বংস করে বর্বর আক্রমণ এবং ৬০০ বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকে। আয়ারল্যান্ডে এই সভ্যতার রেশ ছিল নবম শতাব্দী পর্যন্ত। নবম শতাব্দীতে ডেনরা (Danes) এই সভ্যতাকে ধ্বংস করে। লুপ্ত হওয়ার আগে এই সভ্যতা এক উল্লেখযোগ্য চরিত্রের জন্ম দিয়েছিল, তার নাম স্কোটাস এরিজেনা (Scotus Erigena)।১৪৫৩ সালে কনস্টান্টিনোপলের পতনের পূর্ব পর্যন্ত সাম্রাজ্যে গ্রিক সভ্যতা খানিকটা বিশুষ্ক অবস্থায় বেঁচেছিল, যেমন থাকে জাদুঘরে। কিন্তু একটি শৈল্পিক ঐতিহ্য এবং রোমক আইনের জাস্টিনীয় বিধান ছাড়া কনস্টান্টিনোপল থেকে পৃথিবীর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই আসেনি।

পঞ্চম শতাব্দীর শেষ থেকে একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত অর্থাৎ অন্ধকার যুগে পাশ্চাত্য রোমক জগতে আকর্ষণীয় কিছু পরিবর্তন ঘটে। ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যের যে দ্বন্দ্ব খ্রিষ্টধর্ম প্রবর্তন করে, পরে তা চার্চ এবং রাজার দ্বন্দ্বে রূপান্তিত হয়। পোপের যাজকীয় কর্তৃত্বের ব্যাপ্তি ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, গ্রেট ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, জার্মানি, স্ক্যান্ডিনেভিয়া এবং পোল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। প্রাথমিকভাবে ইতালি এবং দক্ষিণ ফ্রান্সের বাইরে বিশপ (bishop-উচ্চপদস্থ যাজক) এবং মঠাধিকারীদের উপরে পোপের নিয়ন্ত্রণ ছিল সামান্য। কিন্তু সপ্তম গ্রেগরীর (একাদশ শতাব্দীর শেষভাগে) আমল থেকে এই নিয়ন্ত্রণ বাস্তব এবং কার্যকরী হলো। সেই সময় থেকে, সমগ্র পশ্চিম ইউরোপে, যাজকতন্ত্র রোমনিয়ন্ত্রিত একটি একক সংগঠন গঠন করে, নির্দয়ভাবে ও ক্ষুরধার বুদ্ধি প্রয়োগ করে ক্ষমতা অধিকার করতে শুরু করে এবং সাধারণত ধর্মনিরপেক্ষ শাসকদের বিরুদ্ধে জয়লাভই করে চলেছিল প্রায় ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের পরবর্তী কাল পর্যন্ত। চার্চ এবং রাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব যাজক ও লোকসাধারণের দ্বন্দ্ব মাত্র ছিল না, এই দ্বন্দ্ব ছিল ভূমধ্যসাগরীয় জগৎ ও উদীচ্য বর্বরদের প্রাচীন দ্বন্দ্বের নবীকরণ। চার্চের ঐক্য রোমক সাম্রাজ্যেরই ঐক্য, এদের প্রার্থনার বিধি ছিল লাতিন এবং প্রধান ব্যক্তিরা অধিকাংশই ইতালীয়, স্পেনীয় কিংবা দক্ষিণ ফ্রান্সের অধিবাসী। তাদের শিক্ষা, শিক্ষার পুনর্জন্মের পর ছিল প্রাচীন গ্রিস ও রোমের আদর্শে, আইন এবং সরকার সম্পর্কে তাদের ধারণা তৎকালীন রাজাদের চেয়ে মার্ক অরেলিয়স (Marcus Auralius) এর বেশি বোধগম্য হতো। চার্চ ছিল একই সঙ্গে অতীতের ধারাবাহিক এবং বর্তমানের সভ্যতম।

অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ক্ষমতা ছিল টিউটনীয় বংশের রাজা এবং জমিদারদের (baron) করতলগত, এঁদের প্রচেষ্টা ছিল জার্মানির জঙ্গল থেকে আনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাসম্ভব রক্ষা করা। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার সঙ্গে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিচয় ছিল না এবং তেজস্বী এই বিজয়ীদের মনে হয়েছিল এগুলো নির্জীব ও নীরস আইনের প্যাঁচ। সামন্ততান্ত্রিক অবিজাতদের রাজকীয় ক্ষমতার অংশীদার করতে হতো কিন্তু সবাই আশা করতেন যুদ্ধ, খুন, লুণ্ঠন কিংবা বলাকারের মাধ্যমে মাঝে মাঝে ভাবাবেগের বিস্ফোরণ অনুমোদন করা হবে। রাজারা হয়তো অনুশোচনা করতেন, কারণ তাঁরা সত্যিই ধার্মিক ছিলেন, তাছাড়া অনুশোচনাও তো একরকমের ভাবাবেগের বিস্ফোরণ। কিন্তু আধুনিক নিয়োগকারী (employer) তাঁর কর্মচারীদের কাছ থেকে যেরকম শান্ত, নিয়মিত সদ্ব্যবহার আশা করেন এবং পেয়ে থাকেন, চার্চ রাজাদের সে ব্যবহার শিক্ষা দিতে পারেনি। যদি প্রাণভরে মদ খাওয়া না যায়, অবাধে খুন করা কিংবা প্রেম করতে না পারলে বিশ্ববিজয় করে আর কী লাভ? গর্বিত নাইট (knight) সমৃদ্ধ সেনাবাহিনীর অধিকারী হয়ে কেনই বা কিছু আজীবন ব্রহ্মচারী, সৈন্যরিক্ত, গ্রন্থ সর্বশ্বের পদানত হতে হবে? যাজকদের অমত সত্ত্বেও দ্বন্দ্বযুদ্ধ, যুদ্ধ দ্বারা বিচার মীমাংসা তাঁরা ত্যাগ করেননি। তাঁরা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মধ্যযুগীয় তরল প্রেম (courtly love) প্রচলন করেছিলেন। মাঝে মাঝে রাগের মাথায় তাঁরা বিখ্যাত যাজকদের হত্যাও করতেন।

বরাবরই চার্চ বিজয়ী হতো যদিও সমস্ত সশস্ত্রবাহিনী রাজার পক্ষ নিত। চার্চ বিজয়ী হতো-তার আংশিক কারণ শিক্ষায় একাধিপত্য, আংশিক কারণ রাজাদের নিরন্তর অন্তর্বিরোধ কিন্তু প্রধান কারণ দুটি একজন বাদে রাজা এবং প্রজা সবারই গভীর বিশ্বাস ছিল চাবিকাঠিটি (স্বর্গের চাবি) একমাত্র চার্চেরই হাতে। একজন রাজা অনন্তকাল স্বর্গবাসী হবেন, না নরকস্থ হবেন সে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র চার্চই নিতে পারবে। প্রজাদের অবশ্য পালনীয় রাজানুগত্য থেকে মুক্তিদান করে চার্চ বিদ্রোহের উৎসাহ দেওয়ার ক্ষমতা রাখত। অরাজকতার ভিতরে চার্চ নিয়মশৃঙ্খলার প্রতিনিধি হওয়ায় উদীয়মান বণিকশ্রেণির সমর্থন লাভ করেছিল। বিশেষ করে ইতালিতে এই সর্বশেষ কারণটি ছিল সিদ্ধান্তমূলক।

শুধু রাজনীতিতেই নয়, চার্চের কাছ থেকে অন্তত আংশিক স্বাধীনতা রক্ষায় টিউটনীয় প্রচেষ্টার প্রকাশ শিল্পে, বীরধর্মে (chivalry), বীরগাথায় (romance) এবং যুদ্ধেও ছিল। বৌদ্ধিক জগতে (intellectual world) তার প্রকাশ ছিল সামান্য, কারণ শিক্ষা প্রায় সম্পূর্ণভাবে যাজক সম্প্রদায়েই সীমাবদ্ধ ছিল। মধ্যযুগে ব্যক্ত দর্শন কিন্তু যুগের নিখুঁত প্রতিবিম্ব নয়, সেটা একটিমাত্র দলের চিন্তাধারা। কিন্তু ধর্মযাজকদের, বিশেষ করে সাধু ফ্রান্সিসের অনুগামী পাদ্রিদের বিভিন্ন কারণে পোপের সঙ্গে মতভেদ ছিল। তদুপরি ইতালিতে লোকসাধারণের কাছে সংস্কৃতির বিস্তার হয়েছিল এবং এ ঘটনা ঘটেছিল আল্পসের উত্তরে তা ঘটার কয়েক শতাব্দী পূর্বেই। সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিক একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে চরম পোপবিরোধী মতবাদের প্রতীক হয়েছিলেন। টমাস অ্যাকুইনাস (Thomas Aquinas) এর জন্ম নেপস রাজ্যে, যেখানে সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের ছিল নিরঙ্কুশ আধিপত্য। পোপীয় দর্শনের সর্বসম্মত প্রধান ব্যাখ্যাকার আজও পর্যন্ত টমাস অ্যাকুইনাস। প্রায় পঞ্চাশ বছর বাদে দান্তে (Dante) একটি সংশ্লেষণ করেছিলেন। সম্পূর্ণ মধ্যযুগীয় চিন্তাজগতের সুষম প্রকাশ একমাত্র তাঁর লেখাতেই পাওয়া যায়।

রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক কারণে দান্তের পর মধ্যযুগীয় দার্শনিক সংশ্লেষণ ভেঙে পড়ে। এই সংশ্লেষণ থাকাকালীন এর একটা পরিচ্ছন্নতা এবং ক্ষুদ্রকায় সম্পূর্ণতা ছিল। এ দর্শনের যা-ই আলোচ্য হোক না কেন, তাকে তাদের একান্ত নিজস্ব এবং অত্যন্ত সীমিত বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে নিখুঁতভাবে উপস্থিত করা হয়েছিল। কিন্তু বিরাট ধর্মীয় বিরোধ (Great Schism), মীমাংসার আন্দোলন (conciliar movement) এবং নবজাগরণের যুগে খ্রিষ্টিয় ধর্মবিপ্লব পর্যন্ত পোপতন্ত্র নেতৃত্বে ছিল। এ বিপ্লবে খ্রিষ্টিয় ধর্মজগতের ঐক্য এবং পোপকেন্দ্রিক শাসনের স্কলাস্টিক (scholastic- মধ্যযুগীয় পাণ্ডিতপূর্ণ) তত্ত্ব ভেঙে পড়ে। রেনেসাঁর যুগে সুদূর অতীত সম্পর্কে এবং পৃথিবীর উপরিতল সম্পর্কে নতুন জ্ঞান মানুষকে নানা তন্ত্র (System) সম্পর্কে ক্লান্ত করে, তাদের মনে হয় এগুলো আসলে মনের কারাগার। টলেমীর কালে মানুষ এবং পৃথিবীর যে সুউচ্চ স্থান ছিল কোপারনিকাসের জ্যোতির্বিজ্ঞান সেই স্থানকে নম্রতর করে। বুদ্ধিমানের কাছে যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং সুসংবদ্ধ করার আনন্দের স্থান গ্রহণ করেছিল নতুন তথ্যলাভের আনন্দ। শিল্পে যদিও রেনেসাঁ এখনও পর্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ, চিন্তার ক্ষেত্রে কাম্য ছিল বৃহৎ এবং ফলপ্রসূ বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গত, মনটেইন (Montaigne) ঐ যুগের ব্যাখ্যাতাদের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি।

সব ক্ষেত্রের মতোই রাজনীতির তত্ত্বেও নিয়মশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছিল, রেহাই পেয়েছিল শুধু শিল্প। মধ্যযুগ কার্যক্ষেত্রে অশান্ত হলেও আইনের প্রতি তীব্র আবেগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার নিখুঁত তত্ত্ব এ যুগের চিন্তাজগৎ দখল করে রাখত। শেষ পর্যন্ত সমস্ত ক্ষমতারই উৎস হয়ে দাঁড়ায় ঈশ্বর। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে এ ক্ষমতা ন্যস্ত করেছেন পোপের উপর এবং ধর্মবহির্ভূত বিষয়ে সম্রাটের উপর। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে পোপ এবং সম্রাট উভয়েই গুরুত্ব হারিয়েছিলেন। পোপ পরিণত হন শুধুমাত্র একজন ইতালীয় রাজপুরুষে (Prince), যার কাজ ইতালির রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে, অতিশয় জটিল এবং চূড়ান্ত নীতিজ্ঞানহীন কাজকর্মে লিপ্ত থাকা। ইংল্যাণ্ড, স্পেন এবং ফ্রান্সে নতুন দেশীয় রাজতন্ত্রের নিজ নিজ এলাকায় সেই ক্ষমতা ছিল তার ভিতরে পোপ কিংবা সম্রাট কেউই নাক গলাতে পারতেন না। মানুষের চিন্তা এবং অনুভূতির উপর প্রধানত বারুদের জোরে জাতীয় রাষ্ট্র অভূতপূর্ব প্রভাব বিস্তার করেছিল। এর ফলে সভ্যতার ঐক্য সম্পর্কে রোমক বিশ্বাসের অবশিষ্ট অংশও ক্রমশ ধ্বংস হয়ে গেল।

মেকিয়াভেলির (Machiavelli) প্রিন্স (Prince) নামক বইয়ে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রকাশ পেয়েছিল। নির্দেশক নীতির অভাবে রাজনীতি হয়ে দাঁড়ায় বেআব্রু ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, এ ক্ষমতার খেলা কী করে খেলতে হয় সে সম্পর্কে বিচক্ষণ উপদেশ আছে প্রিন্স বইটিতে। গ্রিসের গেীরবময় যুগে যা হয়েছিল সেই একই ব্যাপার ঘটে রেনেসাঁর সময়কার ইতালিতে ও ঐতিহ্যগত নৈতিক বাধাবিপত্তি দূর হয়, কারণ, তখনকার দৃষ্টিতে এগুলোকে কুসংস্কারের সঙ্গে জড়িত বলে ভাবা হলো। শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে ব্যক্তিমানুষ উৎসাহী এবং সৃজনশীল হয়ে ওঠেন, ফলে দুর্লভ প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। কিন্তু নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে জন্মানো অরাজকতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা ইতালিয়দের সামগ্রিকভাবে ক্ষমতাহীন করে এবং গ্রিকদেরই মতো তারা তাদের চাইতে কম সভ্য কিন্তু অধিক সামাজিক বন্ধনসম্পন্ন জাতির অধীন হলেন।

স্পেন বাদে অন্যান্য দেশগুলো, যারা নতুন করে ক্ষমতা লাভ করেছিল, তারাও ইতালীয়দের মতো মহৎ কীর্তি স্থাপনে সমর্থ ছিল তাই এর ফল গ্রিসের মতো অতটা মারাত্মক হয়নি।

ইউরোপীয় চিন্তাধারায় ধর্মবিপ্লব (Reformation) রাজত্ব করেছে যোড়শ শতাব্দী থেকেই। এই ধর্মবিপ্লব ছিল জটিল এবং বহুদিকে ব্যাপ্ত, বিপ্লবের সাফল্যের কারণও ছিল বহু। প্রধানত, এটি রোমের নবতর প্রাধান্যের বিরুদ্ধে উত্তরাবর্তের জাতিগুলোর বিদ্রোহ। ধর্মীয় বল উত্তরাঞ্চলের দেশগুলোকে পদানত করেছিল, কিন্তু ইতালিতে তখন ধর্মের অবক্ষয় হয়েছেঃ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পোপতন্ত্র তখনও ছিল এবং জার্মানি ও ইংল্যান্ড থেকে প্রচুর কর আদায় করত। এই জাতিগুলো ছিল তখনও ধর্মভীরু কিন্তু বরজিয়াস (Borgias) এবং মেডিসিন (Medicis) (যারা অর্থের বিনিময়ে আত্মাদের নরকবাস থেকে উদ্ধার করার আশ্বাস দিতেন। আর সেই অর্থ ব্যয় করতেন নীতিহীন বিলাসে) সম্পর্কে তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। জাতীয় উদ্দেশ্য, আর্থিক উদ্দেশ্য এবং নৈতিক উদ্দেশ্য-সব মিলিত হয়েছিল রোমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে শক্তিশালী করতে। তাছাড়া রাজারা শীঘ্রই উপলব্ধি করলেন চার্চ যদি দেশের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকে তাহলে চার্চের উপর প্রভুত্ব করা যাবে। পোপের সাথে ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার চেয়ে বরং এভাবে নিজের দেশে তারা অধিকতর শক্তিশালী হবেন, এজন্য লুথারের নবপ্রবর্তিত ধর্মতত্ত্বকে রাজা, প্রজা নির্বিশেষে অধিকাংশ উত্তর ইউরোপ স্বাগত জানিয়েছে।

তিনটি কারণে ক্যাথলিক চার্চের উৎপত্তি। এর পবিত্র ইতিহাস ইহুদিদের কাছ থেকে এসেছে, ধর্মতত্ত্ব এসেছে গ্রিকদের কাছ থেকে, এর সরকার এবং ধর্মীয় অনুশাসন মূলক আইন (canon law) অন্তত, পরোক্ষভাবে এসেছে রোমকদের কাছ থেকে। ধর্মবিপ্লব (The Reformation) রোমক উপাদানকে পরিত্যাগ করল, গ্রিক উপাদানকে মৃদুতর করল এবং ইহুদি উপাদানকে বিরাট শক্তিশালী করল। প্রথমে রোমক সাম্রাজ্য এবং পরে রোমক চার্চ যে সামাজিক সংযুক্তি (social cohesion) সাধন করেছিল তার ধ্বংস সাধনে ধর্মপুস্তকেই ঐশ্বরিক বাণী নিঃশেষ হয়নি, চার্চের মাধ্যমে এ বাণী চলেছে। যুগে যুগে, সুতরাং প্রত্যেকের উচিত তার একান্ত ব্যক্তিগত মতামতগুলোকেও এই ঐশ্বরিক বাণীর অধীনে স্থাপন করা। বিপরীতে প্রোটেস্টান্টরা চার্চকে ঐশ্বরিক বাণীর বাহন বলে মানতে অস্বীকার করেন, তাঁদের মত- সত্য খুঁজতে হবে একমাত্র বাইবেলে এবং বাইবেলের ব্যাখ্যা প্রত্যেকে নিজের মতো করে করবেন। ব্যাখ্যায় মানুষে মানুষে পার্থক্যের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ঈশ্বর নিযুক্ত কোনো কর্তৃত্ব নেই। কার্যক্ষেত্রে যে ক্ষমতা আগে ছিল চার্চের সে ক্ষমতার দাবিদার হলো রাষ্ট্র, কিন্তু এ দাবি হলো অধিকার লঙ্ঘন (usurpation) করা। প্রোটেস্টান্ট তত্ত্ব অনুসারে ঈশ্বর এবং আত্মার ভিতরে কোনো পার্থিব মধ্যস্থ থাকা উচিত নয়।

এই পরিবর্তনের ফল ছিল বিরাট। সত্য অনুসন্ধান করতে হবে উচ্চ কর্তৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে নয়, অন্তরের ধ্যানের সাহায্যে। এর ফলে রাজনীতিতে নৈরাজ্যবাদের এবং ধর্মে রহস্যবাদের দ্রুত বিকশিত হওয়ার ঝোঁক দেখা দিল, গোঁড়া ক্যাথলিক কাঠামোতে সবসময় এগুলো মানানো কঠিন ছিল। একটি মাত্র প্রোটেস্টান্টবাদের পরিবর্তে নানা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হলো; স্কলাস্টিসিজম (scholasticism-অ্যারিস্টটলীয় যুক্তির ভিত্তিতে গঠিত মধ্যযুগীয় খ্রিষ্টিয় চিন্তাধারা) বিরোধী একটি মাত্র ধর্ম রইল না, হলো যত দার্শনিক তত মত। এয়োদশ শতাব্দীর পোপবিরোধী একজন মাত্র সম্রাটের বদলে ধর্ম বিষয়ে স্বেচ্ছাচারী (heretical) বহু রাজার সৃষ্টি হলো। চিন্তায় এবং সাহিত্যে এর ফল ছিল গভীর থেকে গভীরতর ব্যক্তিনিষ্ঠা। প্রথমে এর অভিমুখ ছিল আত্মিক দাসত্ব থেকে সার্বিক মুক্তির দিকে কিন্তু ক্রমশ এর গতি হলো সামাজিক প্রকৃতিস্থতার বিরোধী ব্যক্তিগত বিচ্ছিন্নতা।

আধুনিক দর্শনের যাত্রারম্ভ মূলতঃ দেকার্তে (Descartes) থেকেই, তার মূলগত নিশ্চিত ছিল আপন আত্মা এবং আপন চিন্তার অস্তিত্বে-তা থেকেই বহির্জগৎকে বিশ্লেষণ করতে হবে। বিকাশের এই প্রথম স্তর বার্কলে (Berkeley) এবং কান্টের (Kant) মাধ্যমে ফিকটে (Fichte) অবধি পৌঁছেছে। ফিটকে বলতেন, সকলই অহং (ego) থেকে উদ্ভূত। এটা ছিল পাগলামি এবং তারপর থেকে দর্শনশাস্ত্র ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছে ঐ চরমবিন্দু থেকে পালিয়ে দৈনন্দিন কাণ্ডজ্ঞানের জগতে ফিরে আসতে।

রাজনীতিতে নৈরাজ্যবাদ এবং দর্শনশাস্ত্রের ব্যক্তিনিষ্ঠার তন্ত্র সব সময় তাল মিলিয়ে চলে। লুথারের জীবদ্দশাতেই তাঁর কিছু শিষ্য অ্যানাব্যাপ্টিজম্ (Anabaptism) মতবাদ বিকশিত করেন। এই শিষ্যদের স্বাগত জানানো হয়নি। তারা স্বীকৃতিও পাননি কিন্তু এই মতবাদ কিছুকাল মুনস্টার (Munster) নগরে প্রভুত্ব করেছে। অ্যানাব্যাপ্টিস্টরা সমস্ত আইনকানুনই স্বীকার করতেন, তাঁরা বলতেন-যারা ভালো লোক প্রতি মুহূর্তে তাদের নির্দেশ দেন পবিত্র আত্মা (Holy Spirit) অর্থাৎ ঈশ্বর-যাকে কোনো সঙ্কেতের বাঁধনে বাঁধা যায় না। এই পূর্বানুমান থেকে তাঁরা পৌঁছলেন সাম্যবাদে এবং যৌন অনাচারে, বীরত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তাঁদের নিশ্চিহ্ন করা হলো। কিন্তু এই মতবাদ একটু মৃদুভাবে হল্যান্ড, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকায় বিস্তার লাভ করে, ঐতিহাসিকভাবে এটা কোয়েকার মতবাদ (Quakerism) এর উৎস। ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য, তীব্রতর এক নৈরাজ্য উনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নিল। এ মতবাদ রাশিয়া, স্পেন এবং ইতালিতে অনেকটা নজরকাড়া সাফল্য লাভ করে- যা আজও আমেরিকার অভিবাসন দপ্তরের এক কাল্পনিক ভীতির কারণ। নৈরাজ্যবাদের এই আধুনিক রূপ ধর্মবিরোধী হলেও প্রোটেস্টান্টদের আদি মেজাজের অনেকটাই এর ভিতর রয়েছে। পার্থক্য প্রধানত এইঃ লুথারের শত্রুতার লক্ষ্য ছিলেন পোপ, আর এঁদের শত্রুতার লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

ব্যক্তিনিষ্ঠা একবার মুক্তি পেলে নিজস্ব পথ পরিক্রমা না করা পর্যন্ত তাকে সীমাবদ্ধ করা যায় না। নীতির ক্ষেত্রে প্রোটেস্টান্টদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিবেককে প্রাধান্য দেওয়া ছিল মূলত নৈরাজ্যবাদ। অভ্যাস এবং রীতি এতই শক্তিশালী ছিল যে, মাঝে মাঝে মুনস্টারের মতো দুর্ঘটনার প্রকাশ বাদ দিলে দেখা যায় ব্যক্তিনিষ্ঠার অনুগামীরা চিরাচরিত সুনীতিকেই অনুসরণ করতেন। কিন্তু এ ভারসাম্য (equilibrium) ছিল অনিশ্চিত (precarious)। অষ্টাদশ শতাব্দীর সংবেদনশীলতার (sensibiluty) গভীর বিশ্বাস ভাঙতে শুরু করে কোনো কাজের প্রশংসার কারণ তার পরবর্তী সাফল্য নিয় কিংবা কোনো বিশেষ নীতি অনুসরণ করে বলেও নয়, যে ভাবাবেগ ছিল এর উৎস সেটাই ছিল এর প্রশংসার কারণ। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উৎপন্ন হয় বীরধর্ম-যার প্রকাশ আমরা দেখি কার্লাইল (Carlyle) নিটশে (Nietzsche) এবং বাইরনীয় (Byribuc) হিংস্র আবেগমূলক ধর্মে-সেটা যেরকমই হোক না কেন।

শিল্প, সাহিত্য এবং রাজনীতিতে কল্পনাসমৃদ্ধ (romantic) আন্দোলন মানুষকে ব্যক্তিনিষ্ঠভাবে বিচার করার রীতির সঙ্গে জড়িত, সে মানুষ সমাজের অংশবিশেষ নয়, সে হলো নান্দনিকভাবে আনন্দদায়ক ধ্যানের একটি বস্তু। ভেড়ার চাইতে বাঘ অনেক সুন্দর কিন্তু বাঘকে আমরা খাঁচার ভিতরেই পছন্দ করি। জাত রোমান্টিক খাঁচার গরাদটা খুলে বাঘের ভেড়া মারার জন্য অসামান্য লাফকে উপভোগ করে। সে মানুষকে উপদেশ দেয় নিজেকে বাঘ ভাবতে, সে সফল হলে ব্যাপারটা যে পুরোপুরি ভালো হয় তা নয়।

আধুনিক যুগে ব্যক্তিনিষ্ঠার তন্ত্রের নানা বাতুলতার বিরুদ্ধে বহু রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রথমত, একটা মাঝামাঝি আপোসের দর্শন অর্থাৎ উদারনীতিবাদ- এই নীতিতে রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিকে তাদের নিজ নিজ বলয়ে স্থাপন করার চেষ্ট রয়েছে। আধুনিকরূপে এর শুরু লক (Locke)-কে দিয়ে, লক, পরম উদ্যম (enthusiasm) অর্থাৎ অ্যানাব্যাপ্টিস্টদের (Anabaptist) ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের যেমন বিরোধী, তেমনই বিরোধী পরম কর্তৃত্ব (absolute authority) এবং অন্ধভাবে অতীত ঐতিহ্য অনুসরণের। আরও ব্যাপক বিদ্রোহ রাষ্ট্র পূজার পথিকৃৎ ক্যাথলিক ধর্ম চার্চকে এবং কোনো এক সময়ে ঈশ্বরকে যে স্থান দিত রাষ্ট্র পূজারীরা রাষ্ট্রকে সেই স্থানে বসিয়েছিল। হস্ (Hobbes), রুশো (Rousseau) এবং হেগেল (Hgel) এই তত্ত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি, কার্যক্ষেত্রে তাঁদের মতবাদ ক্রমওয়েল, নেপোলিয়ন (Napoleon) এবং আধুনিক জার্মানিতে মূর্ত হয়েছে। সাম্যবাদ (communism) তাত্ত্বিকভাবে এই সমস্ত দর্শন থেকে বহু দূরে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করেছে, যে সমাজব্যবস্থার ফল রাষ্ট্র পূজা।

৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত দর্শনশাস্ত্র বিকাশের এই সুদীর্ঘকালে দার্শনিকরা দুটি দলে বিভক্ত হয়েছেন। একদল সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার পক্ষে আর অন্যদল সেই বন্ধন শিথিল করতে উৎসুক। এই পার্থক্যের সঙ্গে অন্য অনেক পার্থক্য জড়িত। যারা শৃঙ্খলার পক্ষপাতী ছিলেন তাঁরা চাইতেন নতুন কিংবা পুরোনো কোনো একটি গোঁড়া মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে, সুতরাং তাঁরা সবাই কমবেশি বিজ্ঞানবিরোধী হতে বাধ্য হয়েছেন। তার কারণ, তাঁদের মতবাদ পরীক্ষার সাহায্যে প্রমাণ করা যেত না। তাঁরা প্রায় সবাই শিক্ষা দিয়েছেন-সুখই শ্রেয় নয়, বরং মহত্ত্ব কিংবা বীরত্ব-এরই অগ্রাধিকার। তাদের সহানুভূতি ছিল মানব চরিত্রে অযৌক্তিক অংশগুলোর প্রতি, কারণ তাঁদের ধারণা ছিল যুক্তি সমাজ বন্ধনের বিরোধী। অন্যদিকে চরম নৈরাজ্যবাদীরা ছাড়া অন্য স্বেচ্ছাচারতন্ত্রীরা (libetarians) ঝুঁকতেন যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান এবং উপযোগবাদের (utilitarian) দিকে, তাঁরা ছিলেন প্রবল আবেগের বিরোধী এবং ধর্মের সমস্ত রকম গভীরতর রূপের শত্রু। আমরা যাকে দর্শন বলে থাকি তার আবির্ভাবের আগে থেকেই গ্রিসে এ দ্বন্দ্ব ছিল এবং আদিমতম গ্রিক চিন্তাধারায় এটা বেশ স্পষ্টই ছিল। অবয়বের পরিবর্তন হলেও আধুনিক যুগ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব রয়েছে। সন্দেহ নেই, আগামী বহুদিন পর্যন্ত এর অস্তিত্ব থাকবে।

যুগ যুগ ধরে যেসব দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব থাকে তাদের মতোই এ দ্বন্দ্বেও প্রতিটি পক্ষই অংশত সঠিক, অংশত ভুল-এটা পরিষ্কার। সামাজিক সংযুক্তির প্রয়োজন আছে এবং শুধুমাত্র যুক্তিতর্কের দ্বারা মানুষ আজ পর্যন্ত সে সংযুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। প্রতিটি সমাজকেই দুটি বিপরীত বিপদের মুখোমুখি হতে হয়; একদিকে অতীত ঐতিহ্যের প্রতি অত্যধিক শ্রদ্ধা এবং অতিরিক্ত নিয়মানুবর্তিতার ফলে শিলীভবন (ossification), অন্যদিকে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার বৃদ্ধিতে পারস্পরিক সহযোগিতা অসম্ভব হওয়ার ফলে সে সমাজের ধ্বংসপ্রাপ্তি কিংবা বিদেশি আক্রমণকারীদের পদানত হওয়া। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ সভ্যতাগুলোর সৃষ্টি অনমনীয় এবং সংস্কারাচ্ছন্ন তন্ত্র দিয়ে, তন্ত্রগুলো ক্রমে শিথিল হয়, তারপরে এক বিশেষ স্তরে একটা অসাধারণ প্রতিভার যুগে এসে পৌঁছায়। যতক্ষণ প্রাচীন ঐতিহ্যের ভালো গুনগুলো বর্তমান থাকে এবং যে অন্তর্নিহিত দোষগুলো তার ধ্বংসের বীজ, সেগুলো তখনও অঙ্কুরিত হয়নি, ততক্ষণ সেই যুগের অস্তিত্ব থাকে। কিন্তু দোষগুলো প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অরাজকতার সৃষ্টি হয়, এর অনিবার্য ফল নব স্বেচ্ছাচার (tyranny)-তা থেকে উৎপন্ন হয় নতুন গোঁড়ামির ভিত্তিতে এক নতুন সংশ্লেষণ (synthesis)। উদারনৈতিক মতবাদ এই অন্তহীন দোলাচল থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার একটু প্রচেষ্টা। উদারপন্থার মূলগত প্রচেষ্টা হলো এমন একটা সমাজ গঠন করা যার ভিত্তি অযৌক্তিক ভ্রান্তবাদ নয় এবং সমাজকে রক্ষা করার জন্য ও সমাজের স্থায়ীত্বের জন্য যতটুকু প্রয়োজন তার চাইতে বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ না করা। একমাত্র ইতিহাসই বলতে পারে এই প্রচেষ্টা সফল হবে কি না।

Book Content

০১. সভ্যতার আলোয় গ্রিক
০২. মিলেশীয় জনগোষ্ঠী
০৩. পীথাগোরাস
০৪. হেরাক্লিডস
০৫. পার্মেনিদেস
০৬. এমপেদক্লেস
০৭. আথিনা এবং সংস্কৃতি
০৮. আনাক্সাগরস
০৯. পরমাণুবাদী
১০. প্রতাগরস
১১. সক্রাতেস
১২. স্পার্তার প্রভাব
১৩. প্লাতনের মতবাদের উৎস
১৪. প্লাতনের স্বপ্নরাজ্য
১৫. অনুমেয় তত্ত্বাবলি
১৬. অমরত্ব বিষয়ে প্লাতনের তত্ত্ব
১৭. সৃষ্টিরহস্য সম্পর্কে প্লাতনের মতবাদ
১৮. প্লাতনের চিন্তায় জ্ঞান ও অনুভূতি
১৯. আরিস্ততেলেসের অধিবিদ্যা
২০. আরিস্ততেলেসের নীতিশাস্ত্র
২১. রাজনীতি সম্পর্কে আরিস্ততেলেসের চিন্তধারা
২২. আরিস্ততেলেসের যুক্তিবিদ্যা
২৩. পদার্থবিদ্যা নিয়ে আরিস্ততেলেসের বই
২৪. প্রাচীন গ্রিসে গণিত এবং জ্যোতির্বিদ্যাচর্চা
২৫. হেলেনায়িত যুগ
২৬. অসূয়ণকারী এবং সন্দেহবাদীগণ
২৭. এপিকুরীয় যুগ
২৮. স্টোইকবাদ
২৯. রোমক সাম্রাজ্য এবং সংস্কৃতি
৩০. প্লতিনস
লেখক: বার্ট্রান্ড রাসেলবইয়ের ধরন: অনুবাদ বই, প্রবন্ধ ও গবেষণা

দর্শনের সমস্যাবলি – বার্ট্রান্ড রাসেল

কর্তৃত্ব ও ব্যক্তিসত্তা – বার্ট্রান্ড রাসেল

সুখের সন্ধানে – বার্ট্রান্ড রাসেল

কেন আমি ধর্মবিশ্বাসী নই – বার্ট্রান্ড রাসেল

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.