২৮. স্টোইকবাদ

২৮. স্টোইকবাদ

এপিকুরীয়বাদের সমসাময়িক আর একটি মতবাদ হলো- স্টোইকবাদ, তবে তার ইতিহাস দীর্ঘতর এবং সে মতবাদের স্থিরত্ব কম। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে এই মতবাদের প্রবর্তক জেনো (Zeno)-এর শিক্ষা এবং খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষদিকের মাকর্স আরেলিয়স-এর শিক্ষা কোনোক্রমেই এক নয়। জেনো ছিলেন একজন বস্তুবাদী, তাঁর মতবাদ ছিল প্রধানত অসূয়কবাদ (Cynicism-সিনিসিজম) ও হেরাক্লিসের দর্শনের মিশ্রণ কিন্তু ক্রমে ক্রমে প্লাতনবাদের সঙ্গে সংমিশ্রণের ফলে স্টোইকরা বস্তুবাদ পরিত্যাগ করেন, শেষ পর্যন্ত এর সামান্য চিহ্নই অবশিষ্ট ছিল। এ কথা সত্য, তাঁদের নৈতিক মতবাদের সামান্যই পরিবর্তন হয়েছিল এবং তাদের মধ্যে অধিকাংশ মনে করতেন এই মতবাদের গুরুত্বই সর্বাধিক। এমনকি এই ব্যাপারেও ঝোঁকের কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। কালের সঙ্গে স্টোইকবাদের অন্য অবয়বগুলো সম্বন্ধে আলোচনা ক্রমাগতই কমে এসেছে এবং ক্রমশই অন্য সবকিছু থেকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে নীতিশাস্ত্রের সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা প্রাসঙ্গিক। আদি যুগের স্টোইকদের ক্ষেত্রে আমাদের অসুবিধা তাঁদের লেখার বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু অংশমাত্র পাওয়ায়। শুধুমাত্র সেনেকা, এপিকতেতস ও মার্কস অরেলিয়স-এর লেখাগুলো সম্পূর্ণ পুস্তকাকারে পাওয়া যায়, এঁরা সবাই খ্রিষ্টিয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মানুষ।

আমরা এ পর্যন্ত যে কটি দার্শনিক গোষ্ঠী নিয়ে আলোচনা করেছি সেগুলোর ভিতরে স্টোইকবাদের গ্রিকত্ব স্বল্প। প্রথম যুগের স্টোইকরা ছিলেন প্রধানত সিরীয়, পরবর্তী যুগের স্টোইকরা ছিলেন প্রধানত রোমক। টার্ন (Hellenistic Civilization, ২৮৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)-এর সন্দেহ-স্টোইকবাদের উপর খালদীয় প্রভাব রয়েছে। উয়েবারওয়েগ (Ueberweg) সঠিকভাবেই বলেছেন বর্বর জগৎকে হেলেনীয় করার সময় গ্রিকরা যা একমাত্র তাদেরই উপযোগী, সেগুলো বাদ দিয়েছিলেন। পূর্বেকার শুদ্ধ গ্রিক দর্শনের তুলনায় স্টোইক দর্শন সঙ্কীর্ণহৃদয় এবং কোনো কোনো অর্থে গোঁড়া কিন্তু এর ভিতরে এমন কিছু ধর্মীয় উপাদান ছিল পৃথিবী যার প্রয়োজন অনুভব করেছিল এবং মনে হয় গ্রিকরা সেই উপাদান সরবরাহ করতে অসমর্থন ছিলেন। বিশেষ করে এর আবেদন ছিল শাসকদের কাছেঃ আলেকজান্দ্রসের প্রায় সব উত্তরাধিকারই- আমরা বলতে পারি জেনো-র পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় প্রত্যেক প্রধান রাজাই নিজেদের স্টোইক বলে ঘোষণা করতেন-এ কথা বলেছেন অধ্যাপক গিলবার্ট মারে।

জেনো ছিলেন ফিনিকীয়, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষভাগে সাইপ্রাসের সিতিয়ুম-এ তাঁর জন্ম। মনে হয় সম্ভবত তাঁদের পরিবার ব্যবসায় লিপ্ত ছিলেন এবং ব্যবসা সূত্রেই তিনি প্রথম আথিনাতে গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছে তিনি দর্শনশাস্ত্র পাঠ করতে ব্যর্থ হয়ে উঠলেন। অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় সিনিকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বেশি মনোমতো হয়েছিল কিন্তু তিনি সর্বদর্শনগ্রাহী ছিলেন। প্লাতনের অনুগামীরা তার বিরুদ্ধে আকাদেমি সাপেক্ষ কুম্ভীলক বৃত্তির অভিযোগ করেছিলেন। স্টোইকদের সমগ্র ইতিহাসের প্রধান ঋষি ছিলেন সাতেস, বিচারের সময় তাঁর মনোভাব, পলায়নে অস্বীকৃতি, মৃত্যুমুখে প্রশান্তি এবং তাঁর এই মত- অবিচারকারীরা অবিচারপ্রাপ্তদের তুলনায় নিজেদের ক্ষতি বেশি করেন- এ সমস্তই স্টোইকদের শিক্ষণের সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিলে গিয়েছিল। তেমনি মিলে গিয়েছিল শীত-গ্রীষ্মে তাঁর নিরুদ্বেগ থাকা, খাদ্য ও পোশাকের ব্যাপারে সারল্য এবং সমস্ত দৈহিক সুখে সম্পূর্ণ নিরাসক্তি। কিন্তু স্টোইকরা কখনোই প্লাতনের ধারণাভিত্তিক মতবাদ গ্রহণ করেননি এবং তাঁদের প্রায় সবই অমরত্ব বিষয়ে প্লাতনের যুক্তি মানতে অস্বীকার করেন। শুধুমাত্র পরবর্তী স্টোইকরাই প্লাতনকে অনুসরণ করে আত্মাকে অ-বস্তু বলে মেনে নেন। আত্মা পার্থিব অগ্নি দিয়ে গঠিত- এ বিষয়ে হেরাক্লিসের সঙ্গে পূর্ববর্তী স্টোইকরা সহমত ছিলেন। মৌখিকভাবে এই মতবাদ এপিকতেতস এবং মার্কস অরেলিয়সের লেখাতেও পাওয়া যায় কিন্তু মনে হয় তাদের লেখাতে যে অগ্নি উল্লেখ পাওয়া যায় তাকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করা ঠিক নয় অর্থাৎ যে চারটি উপাদান দিয়ে ভৌত পদার্থগুলো গঠিত তার একটি ভাবা ঠিক নয়।

অধিবিদ্যক সূক্ষ্মতা সম্পর্কে ধৈর্য জেনো-র ছিল না। তাঁর কাছে সদগুণই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং শুধুমাত্র সদগুণের ক্ষেত্রে পদার্থবিদ্যা এবং অধিবিদ্যার যতটুকু অবদান ছিল সেটুকুই ছিল তার কাছে মূল্যবান। তিনি সেই যুগের অধিবিদ্যক ঝোঁকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চেষ্টা করেছিলেন, এই সংগ্রামের অস্ত্র ছিল কাণ্ডজ্ঞান, গ্রিসে কাণ্ডজ্ঞানের অর্থ ছিল বস্তুবাদ। জ্ঞানেন্দ্রিয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ তাঁকে বিরক্ত করত এবং এর বিপরীত মতবাদকে তিনি চরমে ঠেলে দিয়েছিলেন।

জেনো শুরু করেছিলেন বাস্তব জগতের অস্তিত্বকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে। সন্দেহবাদীর প্রশ্ন, বাস্তব বলতে আপনি কী বোঝেন? আমি বুঝি ঘন ও পদার্থ পূর্ণ। আমি বলতে চাই এই টেবিলটা ঘনপদার্থপূর্ণ। সন্দেহবাদীর প্রশ্ন, আমি ঈশ্বর এবং আত্মা? জেনো বলছেন, নিখুঁতভাবে ঘন- যদি টেবিলটির চেয়ে অধিকতর ঘন কিছু হয় তাই। আর সদগুণ অথবা ন্যায্যতা কিংবা তিনের নিয়ম- এগুলোও ঘনপদার্থ? জেনো-র উত্তর, অবশ্যই রীতিমত ঘন।

স্পষ্টত এই অবস্থায় অন্য অনেকের মতোই জেনো অধিবিদ্যকবিরোধী উৎসাহে দ্রুত অগ্রসর হতে চেয়ে নিজস্ব এক অধিবিদ্যায় ঢুকে পড়েছিলেন।

যে প্রধান মতবাদগুলোতে এই গোষ্ঠী প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত স্থির ছিল সেগুলো সংশ্লিষ্ট মহাবিশ্বের নিয়তিবাদ ও মানবিক স্বাধীনতার প্রশ্নের সঙ্গে। জেনো-র বিশ্বাস ছিল আপতন বলে কোনো পদার্থ নেই এবং প্রকৃতির কর্মপ্রণালী প্রাকৃতিক বিধি দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। প্রথম ছিল শুধুমাত্র অগ্নি, তারপর এল অন্য উপাদানগুলো- বায়ু, অপ, ক্ষিতি, ক্রমশই এদের উদ্ভব হলো উল্লিখিত ক্ৰমে। কিন্তু আগে হোক পরে হোক মহাবিশ্বে একটা অগ্নিকাণ্ড হবে এবং সমস্তই আবার পরিণত হবে অগ্নিতে। খ্রিষ্টান মতবাদে যেরকম বিশ্বের অন্তিম সময়। আছে, অধিকাংশ স্টোইকদের মতে এটা সেরকম অন্তিম পূর্ণতা নয়-শুধুমাত্র একটা চক্রের অন্ত, এই চক্রের অন্তহীন পুনরাবর্তন হবে। যা ঘটে তা সবটাই আগে ঘটেছে এবং আবার ঘটবে, একবার নয় কিন্তু অগণিতবার।

এ পর্যন্ত মতবাদটিকে মনে হতে পারে নিরানন্দ এবং কোনোক্রমেই সাধারণ বস্তুবাদের, যেমন দেমক্রিতসের চাইতে অধিক সান্ত্বনা প্রদায়ী নয়। কিন্তু এটা শুধুমাত্র ঐ দর্শনের একটা দিক। প্রকৃতির কর্মপ্রণালী- যেমন স্টোইকবাদে তেমনই অষ্টাদশ শতাব্দীর ধর্মতত্ত্বে- একজন আইন প্রণেতার দ্বারা সৃষ্ট, তিনি পরম উপকারী ঈশ্বর। এর সম্পূর্ণটাই, এমনকি ক্ষুদ্রতম খুঁটিনাটি পর্যন্ত পরিকল্পিত হয়েছিল প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে কয়েকটি উদ্দেশ্য সাধনের জন্য। দেবতা ও দানবদের (demons) কথা বাদ দিলে এই উদ্দেশ্যগুলো মানুষের জীবনেই দেখা যায়। প্রতিটি জিনিসেরই একটা উদ্দেশ্য আছে, সে উদ্দেশ্য মানুষের সঙ্গে জড়িত। কিন্তু পশু খেতে ভালো, কোথাও পশু সাহসের পরীক্ষা দিতে সাহায্য করে, এমনকি ছারপোকারও প্রয়োজন আছে, কারণ তারা আমাদের ভোরবেলা উঠতে সাহায্য করে এবং সাহায্য করে বেশিক্ষণ শয্যাশায়ী না থাকতে। সর্বোচ্চ শক্তিকে কখনো বলা হয় ঈশ্বর, কখনো জিউস। সেনেকা এই জিউসকে জনসাধারণের বিশ্বাসের পাত্রের সঙ্গে পৃথক করেছেন, তিনিও বাস্তব তবে অধস্তন।

ঈশ্বর বিশ্ব থেকে পৃথক নন, তিনি বিশ্বের আত্মা এবং আমাদের প্রত্যেকের ভিতরেই ঐশ্বরিক অগ্নির একটা অংশ রয়েছে। সব জিনিসই একক একটি তন্ত্রের অংশ, সে তন্ত্রের নাম প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে সুসঙ্গত যে ব্যক্তি জীবন তাই উত্তম। এক অর্থে প্রতিটি জীবনই প্রকৃতির সঙ্গে সুসঙ্গত, কারণ, প্রকৃতির বিধি তাকে এরকম করছে কিন্তু অন্য একটি অর্থে মানবজীবন তখনই প্রকৃতির সঙ্গে সুসঙ্গত যখন ব্যক্তিগত ইচ্ছার অভিমুখ প্রকৃতির লক্ষ্যগুলোর দিকে। সদগুণ সেই ইচ্ছা যাতে প্রকৃতির সম্মতি আছে। যে মন্দ, সে বাধ্য হয়ে ঈশ্বরের বিধি মানে, স্বেচ্ছায় নয়। ক্লিন্থেস এর উপমা অনুসারে এরা গাড়ির সঙ্গে বাঁধা একটি কুকুরের মতো অর্থাৎ গাড়িটা যেখানে যায় কুকুরটাও সেখানে যেতে বাধ্য হয়।

একটি ব্যক্তিজীবনের ক্ষেত্রে সদগুণই একমাত্র উত্তম। স্বাস্থ্য, সুখ, সম্পদ ইত্যাদি বস্তুর কোনো গুরুত্ব নেই। সদগুণের অবস্থান ইচ্ছাতে, সেইজন্য একটি মানুষের জীবনে সত্যিকারের ভালো কিংবা মন্দ নির্ভর করে শুধুমাত্র তার নিজের উপরে। সে গরিব হয়ে যেতে পারে কিন্তু তাতে কী? তা সত্ত্বেও সে গুণান্বিত হতে পারে। একজন স্বৈরাচারী তাকে কারাগারে দিলেও সে প্রকৃতি সঙ্গত জীবনযাপনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে। তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলে সাতেসের মৃত্যুর মতো তার মৃত্যুও মহান হতে পারে। অন্যের ক্ষমতা শুধুমাত্র বাহ্যিকের উপর। সদগুণই একমাত্র সত্য উত্তম, এটা সম্পূর্ণরূপে ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল। সুতরাং জাগতিক আকাক্ষা থেকে মুক্ত হতে পারলে প্রত্যেক মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে। এই আকাঙ্ক্ষাগুলোর অস্তিত্ব সম্ভব হয় শুধুমাত্র ভুল বিচারের ফলেই। যে ঋষির বিচার সত্য তিনি নিজের কাছে মূল্যবান সবকিছুই ভাগ্যনিয়ন্তা, কারণ, কোনো বহিঃশক্তি তাকে সদগুণ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।

এই মতবাদে সুস্পষ্ট যৌক্তিক অসুবিধা আছে। বাস্তবে শুধুমাত্র সদগুণই যদি উত্তম হয় তাহলে একজন উপকারী বিধাতা শুধুমাত্র সদগুণ সৃষ্টি করাতেই ব্যাপৃত থাকতেন অথচ প্রাকৃতিক বিধি প্রচুর পাপী সৃষ্টি করেছে। সদগুণই যদি একমাত্র উত্তম হয় তাহলে নিষ্ঠুরতা ও অবিচারের বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না, কারণ, স্টোইকরা ক্লান্তিহীনভাবে বলেন- নিষ্ঠুরতা ও অবিচারের শিকারদের সেগুলো সদগুণ অভ্যাস করার সুযোগ দান করে। বিশ্ব যদি সম্পূর্ণ রূপে নিয়তিনির্ভর হয় তাহলে প্রাকৃতিক বিধিই স্থির করবে আমি সদগুণের অধিকারী হব না। যদি আমি দুবৃত্ত হই তাহলে তার কারণ প্রকৃতি আমাকে দুবৃত্ত হতে বাধ্য করে এবং সদগুণ যে মুক্তি দেবে বলে মনে হয় সেটা পাওয়া অসম্ভব।

কোনো প্রাপ্তি না থাকলে শুধুমাত্র সদগুণসম্পন্ন জীবন নিয়ে উৎসাহিত হওয়া আধুনিক মানসের পক্ষে খুবই কঠিন। প্লেগের মহামারীর সময় যে চিকিৎসক নিজের জীবন বিপন্ন করেন আমরা তার প্রশংসা করি, কারণ, আমাদের চিন্তনে অসুস্থতা মন্দ এবং আমরা এর সঙ্টন হ্রাস করার আশা করি। কিন্তু অসুস্থতা যদি মন্দ কিছু না হয় তাহলে চিকিৎসক বেশ আরামে বাড়িতে থাকতে পারেন। একজন স্টোইকের কাছে সদগুণ নিজেই নিজের লক্ষ্য, সেটা উত্তম সাধক নয়। এবং দূরদৃষ্টি গ্রহণ করলে এর অন্তিম ফল কি দাঁড়ায়? বর্তমান জগৎ অগ্নিতে ধ্বংস হওয়া এবং এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার পুনবৃত্তি। এর চাইতে ভয়ংকর অর্থহীন আর কিছু কী হতে পারে? কিছুদিনের জন্য এখানে ওখানে প্রগতি হতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র পুনবৃত্তিই হবে। অসহ্য বেদনাদায়ক কিছু দেখলে আমরা আশা করি কিছুকাল পর এরকম ঘটনা আর ঘটবে না কিন্তু স্টোইকরা আমাদের আশ্বাস দেন এখন যা ঘটেছে তা বারবারই ঘটবে। মনে হয়, যে ঈশ্বর সবটা দেখছেন শেষ পর্যন্ত তিনি নিরাশায় ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।

স্টোইকীয় সদগুণের কল্পনের সঙ্গে থাকে একরকম শীতল ঔদাসীন্য। শুধু মন্দ আবেগেরই নিন্দা করা হয়নি, নিন্দা করা হয়েছে সমস্ত আবেগের। ঋষির সমবেদনা নেই, স্ত্রী কিংবা সন্তান বিয়োগ হলে তিনি চিন্তা করেন এই ঘটনায় তাঁর সদ্‌গুণের কোনো ক্ষতি হবে না এবং সে কারণেই তাঁর গভীর দুঃখ হয় না। বন্ধুত্ব, যা এপিকুরসের কাছে খুবই মূল্যবান, তা খুবই ভালো কিন্তু সেটা এমন গম্ভীর হওয়া উচিত নয় যাতে বন্ধুর দুর্ভাগ্যে নিজের পবিত্র প্রশান্তি ক্ষুণ্ণ হয়। রাজনীতি সম্পর্কে- এতে যুক্ত হওয়া আপনার কর্তব্য হতে পারে, কারণ, এর সাহায্যে সুবিচার, বীরের মতো সহিষ্ণুতা ইত্যাদি অভ্যাসের সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু মানুষের উপকার হবে এই আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ হওয়া অবশ্যই অনুচিত। কারণ, শান্তি কিংবা আরও পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ ইত্যাদি যে সমস্ত উপকার মানুষের করা যায় সেগুলো সত্য উপকার নয় এবং যাই হোক না কেন, নিজের সদ্‌গুণ ছাড়া কিছুরই মূল্য নেই। স্টোইকরা সদগুণসম্পন্ন হন মঙ্গল করার জন্য নয় কিন্তু তাঁরা মঙ্গল করেন সদগুণান্বিত হওয়ার জন্য। নিজের প্রতিবেশীকে নিজের মতো করে ভালোবাসার কথা তার মনে হয়নি, অগভীর অর্থে ছাড়া ভালোবাসা তাঁর সদগুণের কল্পনে অনুপস্থিত।

এ কথা আমি বলছি ভালোবাসাকে একটি আবেগ ভেবে, নীতি ভেবে নয়। নীতি হিসেবে স্টোইকরা বিশ্বপ্রেম প্রচার করেছেন। এই নীতি পাওয়া যায় সেনেকা ও তার উত্তসূরিদের লেখায় এবং এই নীতি হয়তো তাঁর পূর্বতন স্টোইকদের কাছ থেকে নিয়েছেন। এই সংগঠনের যুক্তি তাঁদের যে মতবাদে নিয়ে গিয়েছিল সে মতবাদ অনুগামীদের মানবতার প্রভাবে অনেক কোমল হয়ে ওঠে, তাঁদের মতবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলে যেরকম মানুষ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল এই অনুগামীরা ছিলেন তার চাইতে অনেক ভালো। কান্টের সঙ্গে এঁদের সাদৃশ্য রয়েছে, তিনি বলছেন, নিজের ভাইয়ের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে হবে তার কারণ এই নয় যে, আপনি ভাইকে ভালোবাসতেন কিন্তু তার কারণ নৈতিক বিধি করুণা করতে নির্দেশ করে। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এই উপদেশ পালন করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।

এই সাধারণ কথাগুলো বাদ দিয়ে স্টোইক দর্শনের ইতিহাসে আসা যাক।

জেনো সম্পর্কে কিছু ছিন্নপত্র পাওয়া যায়। এগুলো থেকে মনে হয় ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর সংজ্ঞা ছিল- ঈশ্বর বিশ্বের অগ্নিময় মন, তিনি বলেছিলেন ঈশ্বর একটি দেহময় বস্তু এবং সমগ্র মহাবিশ্ব দিয়েই ঈশ্বরের বস্তু গঠিত। তেতুল্লিয়ান (Tertullian) বলেন, জেনোর মতানুসারে মধু যেমন মৌচাকে পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরও তেমনি বস্তুর জগতে পরিব্যাপ্ত। দিঅগেনেস লারতিয়স-এর মতানুযায়ী জেনো বলেছেন- সাধারণ বিধি যা কিনা সঠিক যুক্তি, যা সব বস্তুকে পরিব্যাপ্ত, তা জিউসের সঙ্গে অভিন্ন, তিনি মহাবিশ্ব সরকারের সর্বোচ্চ পদে রয়েছেন : ঈশ্বর, মন, নিয়তি, জিউস অভিন্ন। নিয়তি এমনই একটি শক্তি যা পদার্থকে চালনা করে, ঈশ্বর এবং প্রকৃতি এরই অন্য নাম। দেবতাদের মন্দির থাকা উচিত- জেনো এ কথা বিশ্বাস করেন না? মন্দির নির্মাণের কোনো প্রয়োজন হবে না : কারণ, একটা মন্দিরকে খুব মূল্যবান কিংবা পবিত্র ভাবা অবশ্যই অনুচিত। যন্ত্রবিদ কিংবা রাজমিস্ত্রীরা যা বানায় তাকে কখনোই খুব মূল্যবান কিংবা পবিত্র ভাবা যায় না। মনে হয় পরবর্তী স্টোইকদের মতো তিনি জ্যোতিষ ও ভবিষ্যদ্বাণীতে বিশ্বাস করতেন। কিকের বলেছেন, তিনি তারকাদের উপর একটা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অস্তিত্ব আরোপ করতেন। দিঅগেনেস লারতিয়স বলেনঃ স্টোইকরা সব ধরনের ভবিষ্যদ্বাণীকে বৈধতার ছাড়পত্র দিয়েছেন। তাঁরা বলেন, দৈব বলে যদি কিছু থাকে তাহলে ভবিষ্যদ্বাণী থাকতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে- এ কথা জেনো জোরের সঙ্গে বলেন, এর ভিত্তিতেই তাঁরা ভবিষ্যদ্বাণীর কলাবিদ্যার বাস্তবতা প্রমাণ করেন। এ ব্যাপারে খুসিপ্পস (Chrysippus) স্পষ্টভাষী।

 জেনো-র যে কটি ছিন্নপত্র পাওয়া যায় তাতে সদ্‌গুণ সম্পর্কে স্টেইকবাদ অনুপস্থিত কিন্তু মনে হয় এই মত তিনি পোষণ করতেন।

জেনো-র সাক্ষাৎ উত্তরাধিকারী অ্যাসস্ (Assos)-এর ক্লিন্থেস উল্লেখযোগ্য প্রধানত দুটি কারণে। প্রথমঃ আমরা আগেই দেখেছি তার মতে সামস-এর আরিস্তারখসকে অধর্মের জন্য অভিযুক্ত করা উচিত, কারণ, তিনি পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র না করে সূর্যকে করেছিলেন। দ্বিতীয় ও তাঁর জিউসের স্তোত্র (Hymn to Zeus), এই স্তোত্রের অনেকটাই পোপ কিংবা নিউটনের পরবর্তী শতাব্দীর যে কোনো শিক্ষিত খ্রিষ্টানের পক্ষে লেখা সম্ভব ছিল। এমনকি ক্লিন্থেস-এর ক্ষুদ্র প্রার্থনা আরও বেশি খ্রিষ্টীয়ঃ

হে জিউস, এবং হে ভাগ্যদেবতা, তুমি আমাকে নিয়ে চল,
নিয়ে চল এগিয়ে,
যে কাজেই তুমি আমাকে পাঠাবে,
তার পথ দেখিও তুমি।
আমি অনুসরণ করব নির্ভয়ে, কিংবা, যদি আমি অবিশ্বাসে
 পিছিয়ে পড়ি আর ইচ্ছা আমার না থাকে,
তবুও আমার-তোমাকে অনুসরণ করতেই হবে।

ক্লিন্থেস-এর উত্তরাধিকারী খ্রসিপ্পস (২৮০-২০৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ছিলেন বহু গ্রন্থপ্রণেতা এবং শোনা যায় তিনি সাতশ পাঁচখানি বই লিখেছিলেন। স্টোইকবাদকে তিনি প্রণালীবদ্ধ ও পাণ্ডিত্যপূর্ণ করেছিলেন। তাঁর মত ছিল শুধুমাত্র পরম অগ্নি জিউসই অমর, সূর্য এবং চন্দ্রসমেত অন্য সব দেবতারই জন্ম ও মৃত্যু হয়। শোনা যায়, তাঁর মতে মন্দের উৎপত্তিতে ঈশ্বরের কোনো অংশ নেই কিন্তু এই মতবাদের সঙ্গে তিনি কী করে নিয়তিবাদের সমন্বয়সাধন করেছিলেন সেটা স্পষ্ট নয়। অন্যত্র তিনি হেরাক্লিসের পদ্ধতিতে মন্দ নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, তাঁর বক্তব্য ছিল বৈপরীত্যে একের মধ্যে অন্য নিহিত থাকে ও মন্দ ছাড়া ভালো-র অস্তিত্ব যৌক্তিকভাবে অসম্ভব? যারা মনে করেন মন্দের অস্তিত্ব ছাড়াই ভালো-র অস্তিত্ব থাকতে পারে তাঁদের চাইতে মূর্খ কেউ নেই। ভালো এবং মন্দ পরস্পরবিরোধী হওয়ার দরুন দুইয়েরই প্রয়োজন বিরোধী হয়ে বেঁচে থাকা। এই মতবাদের সপক্ষে তিনি প্লাতনের সাহায্য নিয়েছিলেন, হেরাক্লিসের নয়।

খ্রুসিপ্পস মনে করতেন ভালো লোক সবসময়ই সুখী এবং মন্দ লোক অসুখী আর ভালো লোকের সুখের সঙ্গে ঈশ্বরের সুখের কোনো পার্থক্য নেই। মৃত্যুর পর আত্মা জীবিত থাকে কিনা এবিষয়ে পরস্পরবিরোধী মত ছিল। ক্লিন্থেসের মতে পরবর্তী মহাবিশ্বব্যাপী অগ্নিকাণ্ড পর্যন্ত (তখন বস্তুই ঈশ্বরে লীন হয়) সমস্ত আত্মাই বেঁচে থাকে কিন্তু খুসিপ্পসের মতে এ তথ্য শুধুমাত্র জ্ঞানীদের আত্মা সম্পর্কেই সত্য। পরবর্তী স্টোইকদের তুলনায় তাঁর নৈতিকতা নিয়ে অবিমিশ্র আবিষ্টতা ছিল কম, আসলে যুক্তিবিদ্যাকেই তিনি মূলগত করেছিলেন। প্রাকল্পিক ও বিয়োজক ন্যায়, এবং এমনকি বিয়োজক শব্দটির স্রষ্টা স্টোইকরা, ব্যাকরণ পাঠ ও বিভক্তিযোগে শব্দরূপ করা ছিল স্টোইকদের আবিষ্কার।২৯ খ্রসিপ্পস কিংবা তার কর্ম দ্বারা উদ্বুদ্ধ অন্যান্য স্টোইকদের বিস্তৃত একটি জ্ঞানতত্ত্ব ছিল, এটা ছিল প্রধানত পরীক্ষামূলক ও অনুভূতিভিত্তিক। অবশ্য তারা কিছু ধারণা ও নীতি অনুমোদন করতেন, তাঁদের মতে সেগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কনসেনসাস জেনসিয়াম (consensus gentium)-অর্থাৎ মানবজাতির সম্মতির ভিত্তিতে। কিন্তু জেনো এবং অন্যান্য রোমক স্টোইকদের মতে সমস্ত তাত্ত্বিক পাঠেরই অবস্থান নীতিশাস্ত্রের নিচেঃ তিনি বলেন, দর্শনশাস্ত্র একটা বাগানের মতো যুক্তিবিদ্যা এই বাগানের বেড়া, পদার্থবিদ্যা বৃক্ষরাজি এবং নীতিশাস্ত্র হলো ফল। কিংবা দর্শনশাস্ত্র হলো ডিমের মতো যুক্তিবিদ্যা হলো ভোলা, পদার্থবিদ্যা হলো ভিতরের সাদা অংশ এবং নীতিশাস্ত্র হলো কুসুম।১৩০ মনে হতে পারে খুসিপ্লস তত্ত্বপাঠের অনেক অন্য নিরপেক্ষ মূল্য স্বীকার করেছিলেন। হয়তো তার প্রভাবেই স্টোইকদের ভিতরে অনেক মানুষ গণিতশাস্ত্র ও অন্যান্য বিজ্ঞানের অগ্রগতি করেছিলেন।

খ্রুসিপ্পস-এর পর পানায়েতিয়স এবং পসিনিয়স নামে দুজন দার্শনিক স্টোইকবাদের উল্লেখযোগ্য পরিমার্জন করেন। পানায়েতিয়স বেশ খানিকটা প্লাতনবাদের উপাদান উপস্থাপন করেন এবং বস্তুবাদ পরিত্যাগ করেন। তিনি ছোট স্কিপিয় (Scipio)-র বন্ধু ছিলেন এবং কিকের-র উপর তার প্রভাব ছিল, প্রধানত তার মাধ্যমেই স্টোইকদের সঙ্গে রোমাকদের পরিচয় হয়। কিকের শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন পসিনিয়সের কাছে, রদেস (Rhodes)-এ, কিকের-র উপর তার প্রভাব ছিল আরও বেশি। পসিনিয়স শিক্ষাগ্রহণ করেন পানায়েতিয়স–এর কাছে, পানায়েতিয়সের মৃত্যু হয় ১১০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি।

পসিদনিয়স (ca, ১৩৫- ca. ৫১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ছিলেন একজন সিরীয় গ্রিক এবং সেলেউকীয় (Selecid) সাম্রাজ্যের পতন ঘটে তাঁর শৈশবে। বোধ হয় সিরিয়ার নৈরাজ্যের ফলেই তিনি পশ্চিমদিকে যাত্রা করেন, প্রথমে যান আথিনাতে, সেখানে স্টোইক দর্শনশাস্ত্র আত্মস্থ করেন এবং তারপর যান আরও দূরে রোমক সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশে। তিনি স্বচক্ষে জানিত বিশ্বের সীমানা পেরিয়ে অতলান্তিক-এ সূর্যাস্ত দেখেছিলেন আর দেখেছিলেন স্পেনের ওপারে আফ্রিকার উপকূল-সেখানে গাছগুলো বাঁদরে পূর্ণ ও মার্সাই থেকে ভিতরের গ্রামগুলো ছিল বর্বর মানুষে পূর্ণ। সেখানে তাদের বিজয়ের স্মারক হিসেবে মানুষের মাথা দরজায় ঝুলছে দেখতে পাওয়া প্রতিদিনের ঘটনা। তিনি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে প্রচুর বই লিখেছিলেন, আসলে তার ভ্রমণের একটা উদ্দেশ্য ছিল জোয়ারভাটা পর্যবেক্ষণ করা, ভূমধ্যসাগরে এই পর্যবেক্ষণ করা যেত না। জ্যোতির্বিজ্ঞানে তিনি খুবই ভালো গবেষণা করেছিলেন, আমরা চব্বিশতম অধ্যায়ে দেখেছি সূর্যের দূরত্ব সম্পর্কে তাঁর গণনা প্রাচীনকালে সর্বোত্তম ছিল। ঐতিহাসিক হিসেবেও তিনি উল্লেখযোগ্য ছিলেন- পলিবিয়সের কাজ তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানত একজন সর্বদর্শন সংগ্রহকারী দার্শনিকরূপেই তিনি খ্যাতঃ তিনি প্লাতনের শিক্ষণের অনেক অংশের সঙ্গে স্টোইকবাদের মিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন, সন্দেহবাদী পর্যায়ে আকাদেমি যার কথা ভুলে গিয়েছিল।

আত্ম ও মৃত্যুর পরবর্তী জীবন সম্পর্কে তাঁর যা শিক্ষণ তা থেকে প্লাতনের প্রতি এই আকর্ষণ (affinity) বোঝা যায়। অধিকাংশ স্টোইকদের মতো পানায়েতিয়স বলেছিলেন দেহের সঙ্গেই আত্মার মৃত্যু হয়। এর বিপরীত পসিনিয়স বলেন, মৃত্যুর পরও আত্মা বায়ুতে বেঁচে থাকে, সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরবর্তী বিশ্ব-অগ্নিকাণ্ড পর্যন্ত আত্মা অপরিবর্তিতরূপে বিরাজমান থাকে। নরক বলে কিছু নেই কিন্তু মৃত্যুর পর পাপীদের ভাগ্য ভালো লোকেদের ভাগ্যের মতো ভালো হয় না, কারণ, পাপের কারণে আত্মার বাস্প কর্দমাক্ত হয়, ফলে ভালো আত্মা যত উপরে ওঠে পাপী আত্মা ততদূর উঠতে বাধা পায়। অত্যন্ত পাপীরা পৃথিবীর কাছাকাছি থাকে এবং তাদে পুনর্জন্ম হয়, সত্যিকার সদগুণান্বিতরা তারকালোকে উত্থান করে এবং তারকাদের প্রদক্ষিণ দেখে কাল কাটায়। তারা অন্য আত্মাদের সাহায্য করতে পারে, এই তথ্যই (তার মতে) জ্যোতিষশাস্ত্রের সত্যতার ব্যাখ্যা। বেভান ইঙ্গিত দিয়েছেন, অফীয় মতবাদের পুনরুজ্জীবন এবং নব-পুথাগোরীয় বিশ্বাসগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পসিনিয়স হয়তো আধাত্মিক রহস্যবাদী দর্শনের (Gnosticism) পথিকৃৎ হয়েছিলেন। তিনি আরও যোগ করেছেন এবং তা অতি সত্যি যে, এই জাতীয় দর্শনের পক্ষে যা সবচাইতে মারাত্মক ছিল সেটা খ্রিষ্টধর্ম নয় কিন্তু সেটা ছিল কোপারনিকাসের তত্ত্ব। ক্লিন্থেস ঠিকই ভেবেছিলেন সামস-এর আরিস্তারখস এক বিপজ্জনক শত্রু।

প্রথম যুগের স্টোইকদের চাইতে ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন (যদিও দার্শনিকভাবে নয়) রোমের সঙ্গে যুক্ত তিনজন : সেনেকা, এপিকতেতস এবং মার্কস অরেলিয়স-যথাক্রমে একজন মন্ত্রী, একজন ক্রীতদাস এবং একজন সম্রাট।

সেনেকা (খ্রিষ্টপূর্ব ৩ থেকে খ্রিষ্টীয় ৬৫ পর্যন্ত) ছিলেন স্পেনীয়, তাঁর পিতা ছিলেন রোমে বসবাসকারী একজন পরিশীলিত ব্যক্তি। সেনেকা রাজনীতিকে বৃত্তিরূপে গ্রহণ করেছিলেন এবং মাঝামাঝি রকম সাফল্যও লাভ করছিলেন, এমন সময় সম্রাট ক্লদিয়স (Claudius) তাঁকে কর্সিকা (Corsica)-তে নির্বাসিত করেন (৪১ খ্রিষ্টাব্দ)। কারণ, সম্রাজ্ঞী মেসালিনা (Messalina)-র সঙ্গে তাঁর শত্রুতা হয়। ক্লদিয়সের দ্বিতীয় স্ত্রী আগ্রিপ্পিনা (Agrippina) সেনেকাকে ৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে নিজের একাদশবর্ষীয় পুত্রের শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ছাত্রের ব্যাপারে সেনেকা আরিস্ততেলেসের চাইতে কম ভাগ্যবান ছিলেন, তাঁর ছাত্রটি ছিলেন সম্রাট নিরো। যদিও স্টোইক হিসেবে সেনেকা সরকারিভাবে সম্পত্তিকে ঘৃণা করতেন তবুও তিনি বিরাট সম্পত্তি সঞ্চয় করেছিলেন, শোনা যায় তার পরিমাণ ছিল ত্রিশ কোটি সেস্টারসেস (প্রায় তিন লক্ষ পাউন্ড)। এই সম্পদের অনেকটাই তিনি আহরণ করেছিলেন ব্রিটেনে অর্থ ধার দিয়ে। দিঅ (Dio)-র বক্তব্য অনুসারে তিনি যে অত্যধিক সুদ আদায় করতেন সেটা ছিল সেদেশে বিদ্রোহের কারণগুলোর মধ্যে একটি। এই তথ্য যদি সত্য হয় তাহলে বীর রানী বোয়াদিকেয়া (Boadicea) ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন, এই ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি ছিলেন কঠোরভাবে বিলাসবর্জনকারী একজন দার্শনিক ধর্মগুরু।

নিরো-র অত্যাচার যখন অবাধ হতে লাগল সেনেকাও ক্রমশ অপ্রিয় হতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে অভিযুক্ত করা হয় নিরোকে হত্যা করে নতুন সম্রাটকে সিংহাসনে বসানোর এক বিস্তৃত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে-অভিযোগটা ন্যায্য কিংবা অন্যায্য হতে পারে। অনেকে বলেন, সেনেকা নিজেকেই সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। অতীতে তাঁর সেবার কথা স্মরণ করে তাঁকে আত্মহত্যা করার উদার অনুমতি দেওয়া হয় (৬৫ খ্রিষ্টাব্দে)।

তাঁর অন্তিম কাহিনি নৈতিকভাবে শিক্ষণীয় ছিল। সম্রাটের সিদ্ধান্ত শোনার পর থেকে প্রথমে তিনি নিজের ইচ্ছাপত্র (will) করার কাজ শুরু করেন। যখন তাকে বলা হতো দীর্ঘ কাজের জন্য সময় দেওয়া হবে না তখন তিনি তাঁর শোকার্ত পরিবারের দিকে তাকিয়ে বললেনঃ কিছু ভেব না, আমি তোমাদের জন্য পার্থিব সম্পদের চাইতে অনেক বেশি মূল্যবান সম্পদ রেখে যাচ্ছি- রেখে যাচ্ছি সদগুণান্বিত জীবনের দৃষ্টান্ত কিংবা এধরনের কিছু কথা। তারপর তিনি নিজের রক্তবাহী শিরা কেটে দিয়ে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী লিখে নেওয়ার জন্য সেক্রেটারিকে ডাকলেন। তাকিতস (Tacitus) বলছেন, তাঁর বাগ্মিতার স্রোত শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র (nephew) কবি লুকানেরও একই সময়ে একই ভাবে মৃত্যু হয় এবং তিনি নিজের লেখা কবিতা আবৃত্তি করতে করতে মৃত্যুবরণ করেন। একটু সন্দেহজনক কাজকর্ম দিয়ে নয় বরং প্রশংসাযোগ্য উপদেশাবলি দিয়ে ভবিষ্যৎকাল সেনেকাকে বিচার করেছে। বহু খ্রিষ্টান ফাদার তাঁকে খ্রিষ্টান বলে দাবি করেছেন এবং সেন্ট জেরোম (Saint Jerome) এর মতো লোক তাঁর সঙ্গে সেন্ট পলের পত্রালাপকে সত্য বলে মেনে নিয়েছিলেন।

এপিকতেতস (জন্ম প্রায় ৬০ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু প্রায় ১০০ খ্রিষ্টাব্দে) একদম অন্য ধরনের মানুষ, যদিও দার্শনিকের অত্যন্ত নিকটজাতীয়। তিনি ছিলেন গ্রিক, আদিতে এপাদিতস (Epaphroditus)-এর ক্রীতদাস, নিরো তাঁকে মুক্তি দেন এবং পরে মন্ত্রী করেন। শোনা যায়, ক্রীতদাস জীবনে তার নিষ্ঠুর শাস্তির ফলে তিনি খঞ্জ ছিলেন। ৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রোমে থাকতেন ও শিক্ষা দান করতেন, ঐ সময় ম্রাট দমিতিয়ান (Domitian) সমস্ত দার্শনিকদের রোম থেকে নির্বাসিত করেন, কারণ, বুদ্ধিজীবীদের কোনো প্রয়োজন তার ছিল না। তারপর এপিকতেতস অবসর গ্রহণ করে এপিরস-এর নিকোপলিস-এ থাকতেন, সেখানে কয়েক বছর লেখক ও শিক্ষকরূপে কাটিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

মার্কস অরেলিয়স (১২১-১৮০ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন সামাজিক মাপনদণ্ডের অন্যপ্রান্তে। তিনি ছিলেন উত্তম সম্রাট আন্তনিনস পিয়স (Antoninus Pius)-এর দত্তকপুত্র, সম্রাট ছিলেন তাঁর কাকা ও শ্বশুর। ১৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সম্রাটের উত্তরাধিকারী হন এবং তাঁর স্মৃতিকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন। সম্রাটরূপে তিনি নিজেকে স্টোইক সদগুণ পালনে নিযুক্ত করেন। তাঁর প্রচুর সহিষ্ণুতার প্রয়োজন হয়েছিল, কারণ তাঁর রাজত্বকাল দুর্যোগে আক্রান্ত ছিল- একাধিক ভূমিকম্প, মহামারী, দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধ এবং সামরিক অভ্যুত্থান। তাঁর লেখা বই ধ্যান (Meditations) নিজের জন্যই লেখা হয়েছিল এবং আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সেটা প্রকাশ করার ইচ্ছা ছিল না। তাতে দেখা যায় তাঁর রাজনৈতিক কর্তব্যকে তিনি বোঝা বলে বোধ করতেন এবং পরম ক্লান্তিতে ভুগতেন। তাঁর একমাত্র কমদস (Commodus) পিতার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হন, অনেক মন্দ সম্রাটদের ভিতরে তিনি ছিলেন নিকৃষ্টতমদের একজন কিন্তু পিতার জীবনকাল পর্যন্ত তাঁর অসৎ চারিত্রিক প্রবণতা সাফল্যের সঙ্গে লুকিয়ে রেখেছিলেন। হয়তো অন্যায়ভাবেই, দার্শনিকের স্ত্রী ফস্তিনা (Fustina)-কে গর্হিত অনৈতিকতার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল কিন্তু তিনি কখনো তাঁকে সন্দেহ করেননি এবং মহিলার মৃত্যুর পর তার উপর দেবত্ব আরোপের জন্য কষ্টকর চেষ্টা করেছিলেন, খ্রিষ্টানরা রাষ্টীয় ধর্মকে বর্জন করেছেন। এই অপরাধে তিনি তাঁদের উপর অত্যাচার করেছিলেন, এ কাজকে তিনি রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় মনে করতেন। তাঁর সমস্ত কর্মেই বিবেকবোধ ছিল কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি সফল হননি। তিনি এক করুণ চরিত্র : যে সমস্ত পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিরোধ করেছেন তার একটি তালিকায় দেখা যায় শান্ত গ্রাম্য জীবন গ্রহণ করে অবসর বিনোদন করাকে তিনি সবচেয়ে শোভনীয় মনে করতেন। এ সুযোগ তিনি কখনোই পাননি। ধ্যান বইটিতে কিছু কিছু তারিখ দেওয়া আছে দূরদেশে যুদ্ধক্ষেত্রের সামরিক ছাউনি থেকে, সেখানকার কঠোর জীবনই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়।

সমস্ত দার্শনিক প্রশ্নে এপিকতেতস ও মার্কস অরেলিয়স সম্পূর্ণ একমত। ব্যাপারটা লক্ষণীয়। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যদিও একটি যুগের সামাজিক পরিস্থিতি সে যুগের দর্শনকে প্রভাবিত করে তবুও ব্যক্তির দর্শনের উপর তার পরিবেশের প্রভাব অনেক সময় যতটা ভাবা হয় আসলে ততটা নয়। দার্শনিকরা সাধারণত খানিকটা প্রশস্ত হৃদয়ের মানুষ, নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের দুর্ঘটনাকে অনেকটা কমিয়ে দেখতে পারেন কিন্তু এমনকি তাঁরাও নিজেদের কালের ভালো-মন্দের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না। সময় মন্দ হলে তাঁরা সান্ত্বনা খুঁজে বার করেন, সময় ভালো হলে তাদের আকর্ষণগুলো হয় আরও শুদ্ধ বৌদ্ধিক।

গিবন (Gibbon) তার বিস্তৃত ইতিহাস শুরু করেছেন, কমদস-এর পাপকর্ম থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর অধিকাংশ লেখকদের সঙ্গেই তিনি সহমত ছিলেন যে আন্তনিনেস (Antonines)-এর যুগ ছিল স্বর্ণযুগ। তিনি বলেন, যদি কোনো লোককে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন একটি যুগ স্থির করতে বলা হয় যখন মানবজাতি ছিল সবচাইতে সুখী ও সম্পন্ন, তাহলে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলবেন দমিতিয়ানের (Domitian) মৃত্যু থেকে কমদসের সিংহাসনে আরোহণ কাল পর্যন্ত সময়ের কথা। এই বিচারের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া সম্ভব নয়। দাসপ্রথা ছিল বিশাল দুঃখের সঙ্গে জড়িত এবং সে প্রথা প্রাচীন বিশ্বের বীর্য শোষণ করেছিল। গ্ল্যাডিয়েটরদের (gladiator- প্রাচীন গ্রিসের ক্রীতদাসমল্ল, তাদের আমৃত্যু ও প্রাণপণ যুদ্ধ করতে হতো- অনুবাদক) পারস্পরিক লড়াই এবং বন্যপশুর সঙ্গে লড়াই হতো, এগুলো ছিল অসহনীয় নিষ্ঠুরতা এবং যারা এই দৃশ্য দেখে আনন্দলাভ করত নিশ্চিতভাবে এটা তাদের চরিত্রে হীনতা নিয়ে আসত। এ কথা সত্য, মার্কস অরেলিয়স আইন করেছিলেন- গ্ল্যাডিয়েটরদের ভোতা তরোয়াল দিয়ে লড়াই করতে হবে, কিন্তু এই সংস্কারও ছিল স্বল্পস্থায়ী, তাছাড়া তিনি বন্যপশুদের সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারে কিছুই করেননি। অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল অতীব মন্দ, ইতালিতে চাষ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ও রোমের মানুষ নির্ভর করতেন বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আগত খাদ্যশস্যের বিনামূল্যের বিতরণের উপর। সমস্ত উদ্যোগই ছিল সম্রাট ও তাঁর মন্ত্রীদের হাতে, মাঝে মাঝে দুএকজন সেনাপতির বিদ্রোহের সময় ছাড়া বিশাল সাম্রাজ্যের সর্বত্র কারোরই বশ্যতা স্বীকার করা ব্যতীত আর কিছু করার ছিল না। যা কিছু শ্রেষ্ঠ, মানুষ তার জন্য অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকত, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা ভাবত- সবচাইতে ভালো হলে হবে ক্লান্তিকর আর সবচাইতে মন্দ হলে হবে ভয়ংকর। মার্কস অরেলিয়সের সুরের সঙ্গে বেকন (Bacon), লক (Locke) কিংবা কন্দর্চে (Condorcet)-এর বাগভঙ্গির তুলনা করলে ক্লান্ত যুগ ও আশাদীপ্ত যুগের পার্থক্য দেখতে পাব। একটা আশাদীপ্ত যুগে অত্যন্ত মন্দ অবস্থাও সহ্য করা যায়, কারণ, লোকে ভাববে এ সমস্তই গত হবে। কিন্তু ক্লান্ত যুগে সত্যকারের ভালো বস্তুরও সুস্বাদ থাকে না। স্টোইক নীতিশাস্ত্র এপিকতেতস কিংবা মার্কস অরেলিয়সের যুগের উপযুক্ত ছিল, কারণ, এযুগগুলোর ধর্মশাস্ত্র ছিল সহনশীলতার, আশার নয়।

সাধারণ সুখের দিক থেকে নিঃসন্দেহে আন্তনিনেসের যুগ রেনেসাঁ-র পূর্ব পর্যন্ত তার পরবর্তী যে কোনো যুগের চাইতে ভালো ছিল। কিন্তু সতর্ক পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- এদের স্থাপত্যশিল্পের ধ্বংসাবশেষ দেখলে যা মনে হয় আসলে এরা ততটা সমৃদ্ধশালী ছিল না। গ্রিক-রোমক সভ্যতা কৃষি অঞ্চলের উপর খুব সামান্যই ছাপ ফেলেছিল, কার্যক্ষেত্রে এই সভ্যতা নগরগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিল। এমনকি নগরগুলোতে একটা সর্বহারা শ্রেণি ছিল, তারা কঠিন দারিদ্র্যে থাকত এবং ছিল বিশাল এক ক্রীতদাস শ্রেণি। নগরগুলোর সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থার সংক্ষিপ্তসার করেছেন রস্তভস্টেফ (Rostovsteff), নিম্নলিখিতভাবেঃ

তাদের সামাজিক অবস্থার এই চিত্র তাদের বাহ্যরূপের মতো অত আকর্ষণীয় নয়। আমাদের উৎসগুলো যে ধারণা তৈরি করে তা হলো নাগরগুলোর জাঁকজমক সৃষ্টি হয়েছিল জনসাধারণের ক্ষুদ্র এক সংখ্যালঘু অংশের জন্য এবং তাদেরই স্বার্থে। এমনকি এই ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু অংশের স্বাচ্ছন্দ্যের ভিত্তিও ছিল তুলনায় দুর্বল। নাগরিকদের বৃহত্তম অংশের আয় ছিল খুবই অল্প কিংবা তারা জীবনযাপন করত চরম দারিদ্র্যে। এক কথায়, নগরগুলোর সম্পদ বাড়িয়ে বলা অবশ্যই অনুচিতঃ তাদের বাহ্যরূপ আমাদের ভুল বোঝায়।

এপিকতেতস বলেন, পৃথিবীতে আমরা বন্দী এবং বন্দী একটি পার্থিব দেহে। মার্কস অরেলিয়সের মতে তিনি বলতেন, তুমি একটি ক্ষুদ্র আত্মা, বয়ে বেড়াচ্ছ এক মৃতদেহ। জিউস সে দেহকে স্বাধীন করতে পারেননি। কিন্তু তিনি আমাদের দান করেছেন তাঁর ঈশ্বরত্বের একটি অংশ। ঈশ্বর মানুষের পিতা এবং আমরা সবাই ভাই। আমি আথিনীয় কিংবা আমি রোমক-এরকম বলা উচিত নয় কিন্তু বলা উচিত আমি মহাবিশ্বের নাগরিক। আপনি যদি সীজারের আত্মীয় হন তাহলে আপনি নিজেকে নিরাপদ বোধ করতেন, নিজেকে ঈশ্বরের আত্মীয় বোধ করলে আরও কত বেশি নিরাপদ বোধ করতেন? আমরা যদি বুঝতে পারি সদগুণই শুধুমাত্র সত্যিকারের উত্তম তাহলে আমরা দেখব সত্যিকারের কোনো বিপদে আমরা পড়ব না।

মরতে আমাকে হবেই। কিন্তু তা বলে কি গভীর আর্তনাদ করে মরা আবশ্যিক? আমাকে কারাগারে যেতেই হবে। কিন্তু তা বলে কি নাকিকান্না কাঁদা আবশ্যিক? আমাকে নির্বাসন ভোগ করতেই হবে, তা বলে কি কেউ আমাকে মৃদু হেসে ও উত্তম সাহসের সঙ্গে এবং শান্তিতে যেতে বাধা দিতে পারে? গোপন কথাটি আমাকে বল। আমি বলতে অস্বীকার করি, কারণ, এ ক্ষমতা আমার আছে। আমি কিন্তু তোমাকে শিকল পড়াব। কী বলছ তুমি স্যাঙাৎ? শিকল পরাবে? হ্যাঁ, আমার পায়ে তুমি শিকল পরাতে পার কিন্তু আমার ইচ্ছাকে-না, পারো না, এমনটি জিউসও পারেন না সেটা জয় করতে। আমি তোমাকে কারাগারে পুরব। মানে আমার দেহকে তো? আমি তোমার মুণ্ডচ্ছেদ করব। কেন? কখন আমি তোমাকে বলেছি- আমিই পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ যার মুণ্ডচ্ছেদ করা যায় না?

যাঁরা দর্শনশস্ত্রে পাঠ করেন তাঁদের এই সমস্ত ভাবনা ভাবা উচিত। দিনের পর দিন তাঁদের এই শিক্ষাগুলি লিখে রাখা উচিত, তাঁদের অভ্যাস করা উচিত এই শিক্ষাগুলো।

ক্রীতদাসরাও অন্য মানুষের সমান, কারণ সবাই একইরকম ঈশ্বরপুত্র।

ভালো নাগরিক যেমন নিজেকে আইনের কাছে সম্পন্ন করেন তেমনই আমরাও ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণ করব। সৈন্যরা শপথ নেয় তারা সীজারের উপরে কোনো মানুষকে মানবে না কিন্তু আমাদের শপথ- সবচাইতে আগে আমরা নিজেকে শ্রদ্ধা করব। পৃথিবীতে যখন তুমি সবচাইতে ক্ষমতাশালীর সামনে দাঁড়াও, মনে রেখো আর একজন উপর থেকে দেখছেন কী ঘটছে এবং ঐ মানুষকে নয়, তোমাকে

অবশ্যই খুশি করতে হবে তাঁকে অর্থাৎ ঈশ্বরকে।

তাহলে স্টোইক কে?

ফেইদিয়সের শিল্পশৈলীতে গঠিত একটি মূর্তিকে যেমন আমরা ফিদীয় বলি তেমনি এমন একজন মানুষ আমাকে দেখান, যিনি যে বিচার বুদ্ধির কথা বলেন নিজে সেই ছাঁচে গড়া। আমাকে দেখান এমন একজন যিনি অসুস্থ এবং তবুও সুখী, বিপদগ্রস্ত এবং তবুও সুখী, মৃত্যুমুখে এবং তবুও সুখী, নির্বাসিত এবং সুখী, মর্যাদাচ্যুত এবং সুখী। আমাকে দেখান সেইরকম লোক। দেবতাদের দিব্যি, আমি তখন সানন্দে বলব একজন স্টোইক দেখেছি। না, আপনি আমাকে একদম তৈরি একজন স্টোইক দেখাতে পারবেন না। তাহলে আমাকে এমন একজনকে দেখান যিনি স্টোইক হতে চলেছেন, একজনকে দেখান, যিনি সে পথে দিয়েছেন। এটুকু করুণা আমাকে করুন, যে দৃশ্য আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি আমার মতো একজন বৃদ্ধকে সে দৃশ্য দেখাতে কার্পণ্য করবেন না। কি! আপনার মনে হয় আপনি দেখাতে চলেছেন ফেইদিয়সের জিউস কিংবা তার আথিনা, সেই হাতির দাঁত আর সোনা দিয়ে তৈরি শিল্পটি? আমি চাই একটি আত্মা, আপনাদের ভিতরে যে কেউ আমাকে এমন একজন মানুষের আত্মা দেখান যিনি ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হতে চান এবং ঈশ্বর কিংবা মানুষকে আর দোষ দিতে চান না, কিছুতে বিফল হন না, দুর্ভাগ্য বোধ করেন না, যিনি ক্রোধ, ঈর্ষা এবং মাৎসর্য থেকে মুক্ত- এমন একজন (আমার অর্থকে কেন জড়াতে চান?) যিনি তাঁর মানবত্বকে দেবত্বে পরিবর্তিত করতে চান এবং যিনি তাঁর দীন নিয়ে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্য পোষণ করেন, সেরকম লোক আমাকে দেখান না, পারবেন না।

যাকে দুর্ভাগ্য বলা হয় সে অবস্থায় পড়লে কী করতে হবে সেটা বোঝানোর ব্যাপারে এপিকতেতস ক্লান্তিবিহীন, এ কাজ তিনি প্রায়ই করেছেন ঘরোয়া কথাবার্তাতে।

খ্রিষ্টানদের মতোই তিনি বলেন, শত্রুদের ভালোবাসা উচিত। সাধারণত অন্যান্য স্টোইকদের মতো তিনি আনন্দকে ঘৃণা করেন কিন্তু একধরনের সুখ আছে যাকে ঘৃণা করা উচিত নয়। আথিনা সুন্দর। হ্যাঁ, কিন্তু সুখ আরও বেশি সুন্দর-উন্মত্ত আবেগ এবং বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্তি, তোমার নিজের ব্যাপারে আর কারও উপর নির্ভরশীল নয় এই বোধ (পৃষ্ঠা-৪২৮)। প্রতিটি মানুষই নাটকের অভিনেতা, সে নাটকে ঈশ্বর প্রত্যেকের জন ভূমিকা নির্দিষ্ট করেছেন। আমাদের কর্তব্য নিজ নিজ ভূমিকায় ভালোভাবে অভিনয় করা- সে ভূমিকা যাই হোক না কেন।

যে লেখাগুলোতে এপিকতেতসের শিক্ষণ নথিভুক্ত আছে সেগুলো খুবই সরল ও আন্তরিক, (সেগুলো তার ছাত্র আরিয়ান অনুলেখ থেকে লিখেছেন)। তাঁর নৈতিকতা মহৎ এবং অপার্থিব, যে পরিস্থিতি মানুষের প্রধান কর্তব্য স্বৈরতন্ত্রী শক্তিকে বাধা দেওয়া সে পরিস্থিতি এর চাইতে অধিক সহায়ক কিছু খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোনো কোনো দিক থেকে, যেমন সমস্ত মানুষের ভ্রাতৃত্ব মেনে নেওয়াতে এবং ক্রীতদাসের সঙ্গে সাম্যের শিক্ষা দেওয়াতে, এটি প্লাতন কিংবা আরিস্ততেলেস অথবা নগর রাষ্ট্রের দ্বারা উদ্বুদ্ধ যে কোনো দার্শনিকের তুলনায় শ্রেয়। এপিকতেতসের সময়কার বাস্তব জগৎ পেরিক্লেসের আথিনার তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট ছিল কিন্তু মন্দের অস্তিত্ব তাঁর আকাঙ্ক্ষাকে মুক্ত করেছিল এবং তার বাস্তব জগৎ পঞ্চম শতাব্দীর আথিনার চাইতে যতটা হীন ছিল তাঁর আদর্শ জগৎ ছিল প্লাতনের আদর্শ জগতের চাইতে ততটাই উন্নত।

মার্কস অরেলিয়সের ধ্যান শুরু হয়েছে তাঁর পিতামহ, পিতা, পালক-পিতা, বহু শিক্ষক এবং দেবতাদের কাছে ঋণ স্বীকার করে। তিনি অদ্ভুত কতকগুলো ঋণ স্বীকার করেছেন। দিঅগনেতস (Diognetus)-এর কাছে তিনি শিখেছিলেন (তিনি বলেছেন) অলৌকিক-ক্রিয়াকারকদের কথা না শুনতে, রুস্তিকস (Rusticus)-এর কাছে কবিতা না লিখতে, সেক্সতস (Sextus)-এর কাছে ভান না করে সত্যিকারের গাম্ভীর্য অভ্যাস করতে, বৈয়াকরণ আলেকজান্দ্রসের কাছে শিখেছিলেন অপরের ব্যাকরণের ভ্রম সংশোধন না করতে কিন্তু তার স্বল্পকাল পরেই সঠিক ব্যাকরণ ব্যবহার করতে, প্লাতনীয় আলেকজান্দ্রসের কাছে শিখেছিলেন কাজের চাপের অজুহাতে চিঠির উত্তর দিতে দেরি না করতে, পালকপিতার কাছে শিখেছিলেন বালকদের সঙ্গে প্রেমে না পড়তে। দেবতাদের কাছে তাঁর ঋণ (তিনি আরও বলেছেন) ও তাঁর পিতামহের রক্ষিতার কাছে খুব বেশিদিন তিনি পালিত হননি এবং অত্যধিক দ্রুত পুরুষত্বের প্রমাণ দেননি, তাঁর সন্তানরা মূর্খ কিংবা বিকলাঙ্গ নয়, তাঁর স্ত্রী বাধ্য, স্নেহশীল ও সরল এবং তিনি যখন দর্শনশাস্ত্র পাঠ শুরু করলেন তখণ তিনি ইতিহাস ন্যায় কিংবা জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে সময় নষ্ট করেননি।

ধ্যান-এ যা কিছু নৈর্ব্যক্তিক তার সঙ্গে এপিকতেতসের ঐকমত্য খুব বেশি। অমরত্ব সম্পর্কে মার্কস অরেলিয়স সন্দিহান কিন্তু একজন খ্রিষ্টানের মতো বলেছেন, যেহেতু আপনি এই মুহূর্তে প্রাণত্যাগ করতে পারেন এ সম্ভাবনা আছে, সেইজন্য আপনার প্রতিটি কর্ম ও চিন্তা সেভাবেই নিয়ন্ত্রণ করুন। মহাবিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ জীবনই উত্তম এবং মহাবিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি ও ঈশ্বরের ইচ্ছায় বাধ্য থাকা একই বস্তু।

হে মহাবিশ্ব, তোমার সঙ্গে যা সঙ্গতিপূর্ণ তার সবকিছুই আমার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তোমার কাছে যা সঠিক সময় তার কোনোটিই আমার কাছে অতি দ্রুত কিংবা অতি বিলম্বিত নয়। হে প্রকৃতি, তোমার ঋতুর সঙ্গে যা আসে তার সব কিছু আমার কাছে ফলঃ তোমা হতে সব কিছুর আগমন, তোমাতেই সবকিছু থাকে, তোমার কাছেই সবকিছু ফিরে যায়। কবি বলেন, কেক্রপস-Cecrops-এর গ্রিকপুরাণে বর্ণিত আথিনার প্রথম রাজা) প্রিয় নগরকে আপনি কি বলবেন না জিউসের প্রিয় নগর?

দেখা যাচ্ছে সেন্ট অগস্তিনের ঈশ্বরের নগর অংশত পৌত্তলিক সম্রাটের কাছ থেকে গৃহীত।

মার্কস অরেলিয়সের বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বর প্রত্যেক মানুষেরই পথ নির্দেশক হিসেবে একজন বিশেষ ডেমন (demon-দানব) দান করেন-এই বিশ্বাস পুনঃ প্রকাশিত খ্রিষ্টানদের অভিভাবক দেবদূতের চিন্তনে। তিনি মহাবিশ্বকে ঘনিষ্ঠভাবে প্রথিত একটি সমগ্রতারূপে ভেবে সান্ত্বনা পেতেন; তিনি বলছেন, মহাবিশ্ব একটি জীবন্ত প্রাণী, তাকে একটি বস্তু ও একটি আত্মা আছে। তা একটি বাণী ছিলঃ মহাবিশ্বের সমস্ত জিনিসের পারস্পরিক সম্পর্ক বারবার চিন্তা করবে। তোমার ক্ষেত্রে যা ঘটে সেটা অনন্তকাল ধরে তোমার জন্য তৈরি ছিল এবং কারণগুলোর নিহিতার্থ হলো অনন্তকাল থেকে তোমার অস্তিত্বের সূত্র বোনা হচ্ছিল রোমক রাষ্ট্রে তাঁর নিজের অবস্থান সত্ত্বেও এর সঙ্গে জড়িত ছিল- মানব জাতি একই গোষ্ঠীভুক্ত, স্টোইকদের এই বিশ্বাস, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি আন্তনিনেস ততক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশ ও নগর রোম কিন্তু যখন আমি মানুষ তখন আমার দেশ বিশ্ব। সমস্ত স্টোইকিদের ভিতরেই একটা অসুবিধা দেখা যায়- নিয়তিবাদের সঙ্গে ইচ্ছার স্বাধীনতার সঙ্গতি রক্ষার্থে। তিনি যখন শাসক হিসেবে নিজের কর্তব্যের কথা ভাবছেন তখন বলেন, মানুষের অস্তিত্ব পরস্পরের জন্য। শুধুমাত্র সদগুণান্বিত ইচ্ছাই উত্তম- এই মতবাদের কথা যখন তিনি ভাবছেন তখন তিনি একই পৃষ্ঠায় বলেন, একজন দুবৃত্তের কুকর্মে অপরের কোনো ক্ষতি হয় না। একজনের উত্তমত্বে অপরের ভালো হয় না এবং তিনি যদি নিরো-র মতো মন্দ সম্রাট হতেন তাহলে নিজের ছাড়া অন্য কারও ক্ষতি করতেন না- এই সিদ্ধান্ত তিনি কখনো করেননি এবং তথাপি মনে হয় এই সিদ্ধান্তই এর ফল।

তিনি বলছেন, এমনকি যে অন্যায় কাজ করে তাকেও ভালোবাসা মানুষের বৈশিষ্ট্য। এবং এরকম ঘটে, যখন তারা অন্যায় করছে তখন যদি মনে হয় তারা তোমার আত্মীয়। তারা অন্যায় করছে অজ্ঞতার জন্য ও অনিচ্ছাকৃতভাবে এবং অনতিবিলম্বেই তোমাদের দুজনের মৃত্যু হবে। সর্বোপরি, যে অন্যায়কারী সে তোমার কোনো ক্ষতি করেনি, তার কারণ, সে তোমার বিচারবুদ্ধিকে পূর্বের চেয়ে মন্দ করতে পারেনি।

তাছাড়া আরও বলছেন : মানুষকে ভালোবাস, ঈশ্বরকে অনুসরণ কর এবং বিধি (Law) সবাইকে শাসন করে একথা মনে রাখাই যথেষ্ট।

এই অংশগুলো স্টোইক নীতিশাস্ত্র ও ধর্মতত্ত্বের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। একদিকে, মহাবিশ্ব কঠোরভাবে নিয়তিনির্দিষ্ট একটি একক সমগ্রতা সেখানে যা ঘটে সেগুলো পূর্ববর্তী কারণগুলোর ফল। অন্যদিকে, ব্যক্তির ইচ্ছা সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং কোনো মানুষকেই বহিরাগত কারণ পাপ করতে বাধ্য করতে পারে না। একটি দ্বন্দ্ব এই এবং এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্ক রয়েছে দ্বিতীয় একটি দ্বন্দ্ব। যেহেতু ইচ্ছা স্বাধীন এবং শুধুমাত্র সদগুণান্বিত ইচ্ছাই উত্তম সেহেতু কোনো ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তির ভালো কিংবা মন্দ কোনোটিই করতে পারে না, সুতরাং বদান্যতা এক বিভ্রান্তি। এই বিরোধগুলোর প্রত্যেকটির সম্বন্ধে অবশ্যই কিছু বলতে হবে।

আদিকাল থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত স্বাধীন ইচ্ছা এবং নিয়তিবাদের দ্বন্দ্ব দর্শনশাস্ত্রে চলে আসছে, ভিন্ন কালে ভিন্ন রূপে। বর্তমানে এই দ্বন্দ্বের স্টোইক রূপ আমাদের বিবেচ্য।

আমার মনে হয় কোনো স্টোইককে যদি সক্রাতেসীয় প্রশ্নোত্তরে রাজি করানো যায় তাহলে তিনি কমবেশি এইভাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সপক্ষে বলবেন : মহাবিশ্ব একক একটি সজীব পদার্থ, তার একটি আত্মা আছে, সে আত্মাকে ঈশ্বর যুক্তি বলা যায়। সমগ্রতা রূপে বিচার করলে এই সত্তা স্বাধীন। ঈশ্বর প্রথম থেকে স্থির করেছিলেন তিনি সুস্থির সাধারণ বিধি অনুসারে কাজ করবেন কিন্তু তিনি এমন সমস্ত বিধি বেছে নিয়েছিলেন যা শ্রেষ্ঠ ফল দেবে। অনেক সময় বিশেষ কতকগুলো ক্ষেত্রে ফলগুলো সম্পূর্ণ কাম্য নয় কিন্তু এই অসুবিধা সহ্য করার মূল্য আছে, ঠিক যেমন মূল্য আছে মানবিক বিধির সংহিতার, কারণ আইনের স্থিরত্বের সুবিধা। একটি মানুষ অংশত অগ্নি, অংশত নিম্নশ্রেণির মৃত্তিকা; তার যতটা অগ্নি (অন্তত যখন সেটা সেরা ধরনের), ততটাই সে ঈশ্বরের অংশ। যখন মানুষের ঐশ্বরিক অংশ তার ইচ্ছা প্রকাশ করে সদগুণান্বিতভাবে তখন সেই ইচ্ছাও ঐশ্বরিক ইচ্ছার অংশ, সে ইচ্ছা স্বাধীন। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে মানবিক ইচ্ছাও স্বাধীন।

কিছুদূর পর্যন্ত এই উত্তর উত্তম কিন্তু যখন আমরা ইচ্ছার কারণগুলো বিচার করি তখন এই উত্তর খান খান হয়ে যায়। উদাহরণ, পরীক্ষালব্ধ তত্ত্বরূপে আমরা সবাই জানি, অজীর্ণ রোগের সদগুণের উপর একটা মন্দ ক্রিয়া আছে এবং উপযুক্ত ওষুধ জোর করে প্রয়োগ করলে ইচ্ছাশক্তিকে ধ্বংস করা যায়। এপিকতেতসের প্রিয় একটা উদাহরণ নিন- একজন স্বৈরাচারী অযৌক্তিকভাবে একজনকে কারাগারে বন্দী করেছে, মানব ইতিহাসের যে কোনো অতীত যুগের তুলনায় আধুনিক যুগে এরকম ঘটনা অনেক বেশি ঘটেছে। এদের কয়েকজন স্টোইক বীরের মতো আচরণ করেছে আবার রহস্যজনকভাবে কেউ কেউ করেনি। এ তথ্য এখন স্পষ্ট যে, শুধুমাত্র যথেষ্ট অত্যাচার একটা মানুষের সহ্যশক্তি ভেঙে দিতে পারে তাই নয়, মরফিন কিংবা কোকেনও একটা মানুষকে পোষ মানাতে পারে। আসেল ইচ্ছা স্বৈরতন্ত্রী নিরপেক্ষ শুধুমাত্র ততক্ষণই যতক্ষণ স্বৈরতন্ত্রী অবৈজ্ঞানিক। এটা একটা চরম উদাহরণ কিন্তু যে যুক্তি জড় জগতের নিয়তিবাদ সম্পর্কে প্রযোজ্য সেই একই যুক্তি সাধারণভাবে প্রযোজ্য মানবিক ইচ্ছাগুলো সম্পর্কে। এই যুক্তিগুলো সিদ্ধান্তমূলক সে কথা আমি বলছি না, আমি ভাবছিও না। আমি শুধু বলছি যে, উভয় ক্ষেত্রেই যুক্তির শক্তি সমান এবং সেই যুক্তিগুলোকে এক ক্ষেত্রে গ্রহণ করার ও অন্যক্ষেত্রে বর্জন করার কোনো উত্তম কারণ থাকতে পারে না। যে স্টোইক পাপীদের সম্পর্কে সহিষ্ণুতার আবেদন করতে ব্যস্ত তিনি জোরের সঙ্গে বলবেন পাপপূর্ণ ইচ্ছা পূর্ববর্তী কারণের ফলে, তাঁর কাছে শুধুমাত্র সদগুণান্বিত ইচ্ছাই মুক্ত মনে হয়। এও কিন্তু অসঙ্গতিপূর্ণ। তাঁর নিজের সদগুণ সম্পর্কে মার্কস অরেলিয়স তাঁর পিতামাতা, পিতামহ-পিতামহী, মাতামহ-মাতামহীদের এবং শিক্ষকদের উত্তম প্রভাব বলে বলছেন। সদিচ্ছা এবং অসদিচ্ছা দুই-ই পূর্বতন কারণের ফল। একজন স্টোইক বলতে পারেন এবং সেটা সত্য যে, তাঁর দর্শন শুধুমাত্র তাদের জন্যই সদগুণের, কারণ, যাঁরা সে দর্শন গ্রহণ করেন কিন্তু মনে হয় এর সঙ্গে একটু বৌদ্ধিক ভুল মিশ্রিত না থাকলে এই দর্শনের আকাঙ্ক্ষিত ফল হবে না। সদগুণ এবং পাপ সমভাবে পূর্বতন কারণের ফল (স্টোইকদের যে মত হওয়া উচিত ছিল), এই উপলব্ধি নৈতিক প্রচেষ্টায় খানিকটা অসাড়তা এনে দেবে।

এবার আমি দ্বিতীয় দ্বন্দ্ব নিয়ে আলোচনা করব। স্টোইকরা বদান্যতার সপক্ষে প্রচার করতেন কিন্তু তাত্ত্বিক দিক দিয়ে তাঁরা মনে করতেন কোনো মানুষই অন্য একজনের ভালো কিংবা মন্দ করতে পারে না, কারণ, শুধুমাত্র সদগুণান্বিত ইচ্ছাই উত্তম এবং সদগুণান্বিত ইচ্ছা বহিরাগত কারণের অপেক্ষা রাখে না, এই দ্বন্দ্ব অন্য দ্বন্দ্বটির চাইতে আরও স্পষ্ট এবং এ ব্যাপারে স্টোইকদের বৈশিষ্ট্য আরও বেশি (কিছু খ্রিষ্টান নীতিবাদীও এর অন্তর্ভুক্ত। এটা তাদের লক্ষ্য এড়িয়ে যাবার কারণ, অন্য অনেকের মতো, তাঁদের ছিল দুটি নৈতিক তন্ত্র, অতি সূক্ষ্মটি নিজেদের জন্য এবং নিকৃষ্টতরটি এই বিধির আওতার বাইরে, একটু হীন মানুষের জন্য। যখন স্টোইক দার্শনিক নিজের কথা ভাবেন তখন তাঁর মতে সুখ এবং অন্যান্য তথাকথিত পার্থিব সম্পদ মূল্যহীন, এমনকি তিনি এ কথাও বলেন যে, সুখের আকাঙ্ক্ষাও প্রকৃতিবিরুদ্ধ, এর অর্থ ঈশ্বরের ইচ্ছায় আত্মসমর্পণের অভাব। কিন্তু রোমক সম্রাজ্যের পরিচালক ব্যবহারিক ক্ষেত্রের মানুষ মার্কস অরেলিয়স ঠিকই জানতেন এই ধরনের কর্মধারা অচল। তারই কর্তব্য খাদ্যশস্যের জাহাজগুলো আফ্রিকা থেকে রোমে যথাযথভাবে পৌঁছাচ্ছে কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখা, মহামারী থেকে উদ্ভূত কষ্ট লাঘব হচ্ছে কিনা নজর রাখা এবং লক্ষ্য রাখা বর্বর শত্রুরা যাতে সীমান্ত অতিক্রম না করে। বলতে গেলে তার যে সমস্ত প্রজাকে তিনি বর্তমানের অথবা ভবিষ্যতের স্টোইক দার্শনিক বলে মনে করেন না তাঁদের ক্ষেত্রে তিনি ভালো কিংবা মন্দের সাধারণ পার্থিব মান গ্রহণ করেন। এই মানগুলো গ্রহণ করে তিনি তাঁর শাসনকর্তার কর্তব্যের মানে এস পৌঁছান। যে ব্যাপারটা অদ্ভুত সেটা হলো যদিও এটা এমন একটা নীতি থেকে আহরিত যে নীতি স্টোইক ঋষিদের মতে মূলগতভাবে ভুল, তবুও তাঁর নিজস্ব এই কর্তব্য ছিল স্টোইক ঋষিদের উচ্চতর স্তরে অবশ্য পালনীয়।

এই অসুবিধার একমাত্র উত্তর যা আমি কল্পনা করতে পারি সেটা হয়তো যৌক্তিকভাবে অপরাজয়ের কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে খুব বিশ্বাসযোগ্য নয়। আমার মনে হয়, এই উত্তর হয়তো দিতেন কান্ট, তার নৈতিক তন্ত্রের সঙ্গে স্টোইকদের খুব সাদৃশ্য আছে। এ কথা সত্য, তিনি বলতে পারতেন ভালো কিছু নেই, রয়েছে শুধু সদিচ্ছা কিন্তু ইচ্ছা তখনই ভালো যখন সেটা কোনো উদ্দেশ্যের অভিমুখী সেই উদ্দেশ্যগুলো স্বকীয়ভাবে নিস্পৃহ। শ্ৰীমনা ক সুখী কি অসুখী তাতে কিছু এসে যায় না কিন্তু আমার যদি সদগুণ থাকে তাহলে আমি এমনভাবে কাজ করব, যে কাজ আমার বিশ্বাসমতো তাকে সুখী করবে, কারণ, নৈতিক বিধি এই নির্দেশ দান করে। শ্রীমান ক-কে আমি সদগুণান্বিত করতে পারব না, কারণ, তার সদগুণ নির্ভর করে শুধুমাত্র তারই উপর কিন্তু আমি তাকে সুখী কিংবা ধনী কিংবা পণ্ডিত কিংবা স্বাস্থ্যবান করার জন্য কিছু করতে পারি। সেইজন্য স্টোইক নীতিশাস্ত্র নিম্নলিখিতরূপে বিবৃত করা যেতে পারে ও সাধারণ মানুষ কিছু জিনিসকে ভালো মনে করে কিন্তু এটা ভুল, যা ভালো সেটা হলো এই মিথ্যা ভালগুলো অন্য লোকের জন্য সংগ্রহের ইচ্ছা। এই মতবাদে কোনো যৌক্তিক দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু আমরা যদি সত্যিই বিশ্বাস করি যেগুলোকে সম্পদ বলে মনে করি সেগুলো মূল্যহীন তাহলে এর আর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না, কারণ, সে ক্ষেত্রে সদগুণান্বিত ইচ্ছা অন্য যে কোনো উদ্দেশ্যের অভিমুখীও হতে পারে।

আসলে স্টোইকবাদে টক আঙুর ফলের একটা উপাদান আছে। আমরা সুখী না হতে পারি কিন্তু ভালো হতে পারি, সুতরাং ভালো করা যাক যতক্ষণ আমরা সৎ ততক্ষণ অসুখী হলেও কিছু এসে যায় না। এই মতবাদ বীরোচিত এবং একটা মন্দ জগতে কার্যকর কিন্তু এই মতবাদ সম্পূর্ণ সত্য নয়, মূলগত অর্থে খুব আন্তরিকও নয়।

যদিও স্টোইকদের প্রধান গুরুত্ব ছিল নৈতিক তবুও অন্য দুটি ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা ফলপ্রসূ হয়েছিল। এর একটি জ্ঞানতত্ত্ব এবং অন্যটি স্বাভাবিক বিধি ও স্বাভাবিক অধিকারের মতবাদ।

জ্ঞানতত্ত্বে প্লাতনের মত সত্ত্বেও তারা অনুভূতিকে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের মতে, জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলো ভুল বোঝালেও সেগুলো আসলে ভুল বিচার এবং একটু যত্ন নিলেই এড়ানো সম্ভব। জেনো-র প্রত্যক্ষ শিষ্য স্টোইক দার্শনিক স্খায়েরস (Sphaerus)-এর মতবাদের কথা শুনে রাজা টলেমী তাঁকে একবার নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেন ও মোমের তৈরি ডালিম খেতে দেন। দার্শনিক সেটা খেতে চেষ্টা করলেন, রাজা তখন তাঁকে উপহাস করলেন। দার্শনিক উত্তর দিলেন- ওটা আসলে ডালিম কিনা সে বিষয়ে তার নিশ্চয়তা ছিল না কিন্তু ভেবেছিলেন রাজকীয় ভোজে কোনো অখাদ্য পরিবেশনের সম্ভাবনা অল্প।৩৮ যে সমস্ত পদার্থ অনুভূতির ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে জানা যায় এবং যে সমস্ত বস্তু সেই ভিত্তিতেই শুধুমাত্র সম্ভাবনাপূর্ণ- এই উত্তরে তিনি এই দুইয়ের ভিতরে স্টোইকীয় পার্থক্যের সুযোগ নিয়েছিলেন। মোটের উপর, এই মতবাদ ছিল সুস্থ মস্তিষ্ক প্রসূত ও বিজ্ঞানসম্মত।

জ্ঞানতত্ত্বে তাদের অপর মতবাদের প্রভাব ছিল বেশি, যদিও সেগুলো বেশি বিতর্কিত। সেটা হলো সহজাত ধারণা এবং নীতি সম্পর্কে তাঁদের বিশ্বাস। গ্রিক যুক্তিবিদ্যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অবরোহী এবং এতে প্রথম প্রস্তাব সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। প্রথম প্রস্তাবকে অন্তত অংশত সাধারণ হতে হতো এবং সেগুলো প্রমাণ করার মতো কোনো পদ্ধতি ছিল না। স্টোইকদের মতে কিছু নীতি ছিল ভাস্বরভাবে স্পষ্টপ্রতীয়মান এবং সব মানুষই সেগুলো স্বীকার করে। এউক্লিদ-এর উপাদানসমূহ-র মতো এগুলোকে অবরোহণের ভিত্তি করা যায়। একইভাবে সহজাত ধারণাগুলোকে সংজ্ঞার প্রারম্ভ বিন্দুরূপে ব্যবহার করা যায়। এই দৃষ্টিভঙ্গি সমগ্র মধ্যযুগ জুড়েই গৃহীত হয়েছিল, এমনটি দেকার্তেও এই দৃষ্টিভঙ্গি মানতেন।

ষোড়শ, সপ্তম ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে যে সহজাত অধিকারের মতবাদ দেখা গিয়েছিল সেগুলো ছিল স্টোইকবাদের পুনরুজ্জীবন, যদিও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিমার্জনের পর! স্টোইকরাই সহজাত বিধির (jus naturale) সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিধির jus gentium)১৩৯ পার্থক্য করেছিলেন। সহজাত বিধি আহরিত হয়েছিল সমস্ত সাধারণ জ্ঞানের অন্তর্নিহিত যে প্রাথমিক নীতি থাকে বলে মনে করা হয় তা থেকে। স্টোইকরা মনে করতেন প্রকৃতিগতভাবে সমস্ত মানুষই সমান। মার্কস অরেলিয়স তাঁর ধ্যান বইটিতে যার সপক্ষে বলেছেন তা হলো, এমন প্রশাসনিক ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থায় থাকবে সবার জন্য অভিন্ন আইন, সকলের জন্য সমান অধিকার এবং বাক্যের সমান স্বাধীনতা ও এমন একটি রাজীয় সরকার যে সরকার শাসিতদের এই সমস্ত অধিকার মেনে চলে। এটা এমন একটা আদর্শ যা রোমক সাম্রাজ্যে অবিচ্ছিন্নভাবে বাস্তবায়িত হতে পারেনি কিন্তু এই আদর্শ আইন তৈরিকে প্রভাবিত করেছিল, এই কাজ বিশেষ করে করা হয়েছিল স্ত্রীলোক ও ক্রীতদাসদের অবস্থার উন্নয়নের উদ্দেশ্যে। খ্রিষ্টধর্ম স্টোইকদের শিক্ষণের এই অংশ সম্পূর্ণ গ্রহণ করেছিল, তার সঙ্গে অবশিষ্টাংশের অনেকটাই গ্রহণ করেছিল। এবং শেষে, সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন কার্যকরভাবে স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে যুদ্ধের সুযোগ এল তখন খ্রিষ্টীয় পোশাকে স্টোইকদের স্বাভাবিক বিধি ও সহজাত সাম্যের মতবাদ একটি ব্যবহারিক শক্তিরূপে প্রকাশ পেল। দূর অতীতে, এমনকি একজন সম্রাটও তাদের সে শক্তি দান করতে পারেননি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *