নির্বাচিত রহস্য রোমাঞ্চ – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ১৯৮৫
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
.
প্রসঙ্গ : নির্বাচিত রহস্য রোমাঞ্চ
জীবন-মৃত্যুর রহস্য জানতে নচিকেতা যমের কাছে গিয়েছিলেন। কঠোপনিষদে এই যে অতিকথা বলা হয়েছে তার সত্যাসত্য বড় নয়, বড় হল এই যে নচিকেতার প্রশ্ন ও যমের উত্তরের ভিতর দিয়ে জীবনের রহস্যেরই মীমাংসা খোঁজা হয়েছিল। যম বলেছিলেন যে মানুষ শ্রেয় বা প্রেয়—এর যে-কোন একটির দ্বারা আবদ্ধ। বাইবেলে ইডেন উদ্যানের শ্রেয় জীবনকে ঠিক এইভাবে উপেক্ষা করে আদি পিতা ও আদি মাতা আদম ও ইভ শয়তানের প্ররোচনায় নিষিদ্ধ ফলে কামড় দিয়ে এই প্রেয় বস্তুতে আসক্ত হয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত হয়েছিলেন। দুঃখবাদী বৌদ্ধরাও পৃথিবীকে শোক দুঃখ জরা মৃত্যুর অধীন মনে করেছিলেন। সমস্ত দর্শনচিন্তার মূলেই এই শ্রেয় ও প্রেয়-র প্রশ্ন মানুষকে উদ্বেল করেছে। গ্রীক পুরাণে বলা হয়েছে যে প্রমিথিউস স্বর্গ থেকে আগুন চুরি করে আনার পর এই অপরাধে স্বর্গের দেবতা জিউস প্রথম যে নশ্বর নারীকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন তার নাম প্যাণ্ডোরা। জিউস তাকে একটি পেটিকা উপহার দিয়েছিলেন। এই পেটিকায় ছিল মানুষের সমস্ত দুঃখ শোক পাপ অপরাধ ইত্যাদি। কৌতুহলী প্যাণ্ডোরা যে-মুহূর্তে এই পেটিকা খুলেছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকে পৃথিবী এই সমস্ত শোক দুঃখ পাপ তাপ অপরাধ ও হিংসায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। মানুষ কোথা থেকে এসেছে সে জানে না, সে কোথায় যাবে তাও তার অজানা—এও যেমন এক রহস্য, তেমনি এই যে তার বাস্তব জীবন তারও সমস্ত রহস্য কি সে জানে? শ্রেয়কে ছেড়ে সে যখন প্রেমকে আকাঙক্ষা করে, তখন থেকেই তার মনে রহস্যের জন্ম হয়। এই প্রেয়কে পাবার পথ সীমাহীন সংখ্যাহীন। তার পথ ও পরিণাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রহস্য রোমাঞ্চে জড়ানো। প্রত্যেকটি প্রেয়র সামনে একটি লক্ষ্য থাকে। এই লক্ষ্যেই মানুষ যখন তার বিবেক, তার বিচারবোধ ও স্বার্থহীনতা ভুলে অন্য কোন অ-বিবেকী পথে যায়, তখনই সে হয়ে ওঠে ব্যতিক্রম। আসলে মানুষ যখন তার মানবিকতা ভুলে অন্য পথে যায়, তখনই সে ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে। আর এই ব্যতিক্রম থেকেই জমে ওঠে রহস্য আর রোমাঞ্চ।
রহস্য আর রোমাঞ্চ ওতপ্রোত। যা স্বাভাবিক তার মধ্যে যেমন রহস্য নেই, তার মধ্যে তেমনি রোমাঞ্চও নেই। মানুষের মনের ও কাজের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি থেকেই তৈরি হয় রহস্য ও রোমাঞ্চের ঘটনা ও গল্প। পৃথিবীর আদিতম রহস্য-রোমাঞ্চকর ঘটনা অনুসন্ধান সাপেক্ষ, কিন্তু সাহিত্যে কবে থেকে এর সুত্রপাত তার একটা হদিস করা যায়। বাংলা গদ্যসাহিত্য বা যাকে আমরা গল্প বলি, তা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন। যদিও চর্যাপদ থেকে মঙ্গলকাব্য পর্যন্ত কাব্যসাহিত্যে রহস্য রোমাঞ্চের অভাব নেই।
কিন্তু আমাদের এই সংকলনের কারবার রহস্য রোমাঞ্চ ভিত্তিক গল্পকে নিয়ে। তবে এই সংকলনে রহস্য রোমাঞ্চের মেজাজ একটু আলাদা। এখানে স্বাভাবিক ভাবেই আমরা ভূতের গল্প আর গোয়েন্দা গল্প বাদ দিয়েছি। কারণ এই দু ধরনের গল্প রহস্য রোমাঞ্চের বড় পরিসীমায় এলেও এই দু ধরনের গল্পের আলাদা শ্রেণীবিভাগ অনেকদিন থেকেই হয়ে আছে। এর আগে দুটি স্বতন্ত্র সংকলনে আমরা যথাক্রমে গোয়েন্দা ও ভৌতিক গল্প গ্রন্থিত করেছি। এই সংকলনটি গ্রন্থিত হল অপরাধধর্মী রহস্য রোমাঞ্চের গল্প নিয়ে। বলা বাহুল্য, দু-একটি গল্পে এক-আধবার গোয়েন্দারা উকিঝুঁকি দিয়েছেন এবং প্রসঙ্গক্রমে অলৌকিকের অবতারণাও ঘটেছে। কিন্তু তা যে নিতান্তই নামমাত্র এবং এই সংকলনের চরিত্রের দিক থেকে স্বাভাবিক, পাঠক বুঝতে পারবেন।
বাংলা কথা সাহিত্যের সূচনাকাল থেকে অসংখ্য লেখক এসেছেন। রহস্য রোমাঞ্চর বিশদ সম্ভারও তাঁরা রচনা করেছেন। তার থেকে প্রতিনিধিত্বমূলক কিছু গল্প যা রসের দিক থেকে বিচিত্র এবং স্বতন্ত্র, সেগুলিকেই এই সংকলনে গ্রহণ করা হল। আমাদের সম্ভাব্য লেখকসূচীতে বাংলা সাহিত্যের একটি প্রামাণিক পরিচয় রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংগ্রহ ও অনুমতির প্রয়োজন, কিন্তু কোন-কোন ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যবশত আমরা তা না-পাওয়ায় অনিচ্ছাকৃতভাবেই কোন-কোন লেখককে আমরা নিতে পারিনি। পাঠক যেন কারো অনুপস্থিতিকে সম্পাদকের অনবধানতা বলে ধরে না নেন। বিশেষ করে এই সংকলনের নান্দীমুখ পর্বে যে নামটি একেবারেই অপরিহার্য, তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ। একশো বছরের গল্প সংকলনে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত—একথা ভাবাই যায় না। কিন্তু আমাদের তা ভাবতে হয়েছে। কারণ রবীন্দ্র-রচনার, নিয়ন্ত্রণ এখন যাঁদের হাতে এবং যাঁদের আগাম অনুমতি ছাড়া কোন রচনাই সম্পূর্ণ সংকলিত করা চলে না, বিস্তর চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমরা তাঁদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ কেন এই সংকলনে নেই তার জন্যে সম্পাদক বা প্রকাশক কোনভাবেই দায়ী নন। আরো একটি কথা এই যে রহস্য রোমাঞ্চের গল্প বিশেষ এক স্বাদের গল্প। কিন্তু বহু খ্যাতকীর্তি লেখক হয়তো অপরাধর্মী রহস্য রোমাঞ্চের গল্প লেখেননি। তাই তাঁদেরও আমরা এখানে দেখতে পাব না।
শুদ্ধ রহস্য ও রোমাঞ্চের গল্প খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই যাঁকে আমরা সদর্থক ভাবেই চিহ্নিত করতে পেরেছি, তিনি হলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়। ত্রৈলোক্যনাথ ছিলেন পদস্থ সরকারী কর্মচারী ও প্রত্নতাত্ত্বিক। ভারতীয় যাদুঘর সংগঠনে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। প্রত্নতত্ত্বের কর্মসূত্রেই তিনি রহস্য ও রোমাঞ্চের দিকে ঝুঁকেছিলেন। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় তো কর্মসূত্রে রহস্য রোমাঞ্চের জগতেই জড়িয়ে ছিলেন। তিনি ছিলেন পুলিশের পদস্থ কর্মচারী। আর, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সব্যসাচী লেখক। এই পথিকৃতদের রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনীতে আমরা মানুষের মনের সেই চিরন্তন শ্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বকে দেখতে পাই। এই পরম্পরা বাংলা গল্পে এখনও যে নতুন নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে অব্যাহত রয়েছে তারই একটা সরেজমিন প্রায়-শতাব্দীব্যাপী-সঞ্চয়ন পাঠকের কাছে আমরা তুলে ধরলাম। এ-যাবৎ জ্ঞাত ও অজ্ঞাত সূত্রে অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই গল্পগুলি সংকলন করে বাংলা রহস্য ও রোমাঞ্চ গল্পের একটি আবয়বিক রূপ দেবার চেষ্টা করা হল। রমাপদ চৌধুরীর অনুরোধক্রমে জানাচ্ছি, গ্রন্থভুক্ত ‘চন্দ্ৰভস্ম’ গল্পটি তাঁর লেখক-জীবনের গোড়ার দিকের রচনা।
রহস্য রোমাঞ্চের সংজ্ঞার্থ এতই জটিল ও বিতর্কমূলক যে এই ধরনের গল্পের সংলনে তৎপর হওয়ার আগে সম্পাদককে একটা মাপকাঠি তৈরি করে নিতেই হয়। তা নইলে বিন্যাসে যেমন অগোছালো ভাব দেখা দিতে পারে, তেমনি গোটা ব্যাপারটা সামাল দেবার বাইরেও চলে যেতে পারে। তাই যেমন রহস্য রোমাঞ্চের বৈচিত্র্যের দিক আমরা প্রধান মনে করেছি, সেই সঙ্গে লক্ষ্য রেখেছি সাহিত্যমূল্যের দিকেও। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কথিত আপ্তবাক্য এই যে ‘মেস-এ রন্ধন ব্যবস্থার যারা অধ্যক্ষ, আর সংকলনের যারা সম্পাদক, লোকের মন পাওয়া তাদের কর্ম নয়।’ আমাদের ওই নিবেদনে বিচিত্র স্বাদের সমাহারের চেষ্টা অবশ্যই করা হয়েছে পাঠকের রসোপভোগের দিকে লক্ষ্য রেখে। পাঠক যদি এই পরিবেশনে সন্তুষ্ট হন, তাহলে সেটাকেই আমরা আমাদের পরম প্রাপ্তি বলে জানব।
এর পরেও সম্পাদকের একটা কৃত্য থেকে যায়, যেটা হল কর্তব্যপালন। যাঁদের সহযোগিতা এই সংকলনকে সার্থক করেছে, তাঁরা যদিও বিনিময়ের প্রত্যাশী নন, কিন্তু সম্পাদক হিসেবে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার অবশ্যই প্রয়োজন। গ্রন্থভুক্ত গল্পের যাঁরা লেখক কিংবা তাঁদের উত্তরাধিকারী—প্রত্যেকের কাছেই আমি বিশেষভাবে ঋণী। তাঁদের আন্তরিক সহায়তা না থাকলে এ সংকলন অবশ্যই প্রকাশিত হতে পারত না। এছাড়া, প্রুফ সংশোধনের কাজে শ্রীমান অভ্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীমান শুভ্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এবং শ্রীমতী বীথি চট্টোপাধ্যায় আমার সময় এবং পরিশ্রমকে অনেক লাঘব করেছেন। তাঁদের ঋণ অপরিশোধ্য।
রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়
Leave a Reply