নানা রসের ৬টি উপন্যাস – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
প্রথম সংস্করণ : বইমেলা ২০১২
প্রচ্ছদ : অনুপ রায়
প্রকাশক : শংকর মণ্ডল
দীপ প্রকাশন
ভূমিকা
গত অর্ধশতকে অর্থাৎ উত্তর—ঔপনিবেশিক পর্বে মুসলিম লেখকেরা বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম—অধ্যুষিত ভূখণ্ডের মতো পশ্চিমবঙ্গের উপন্যাসেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। আবদুল জব্বার, আবুল বাশার, আফসার আমেদ, কামাল হোসেন, সোহারাব হোসেন প্রমুখ নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। তবে এই তালিকায় যার স্থান সবার প্রথমে, তিনি হলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। বঙ্গদেশে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় মুসলিম জনজীবনের আত্মপরিচয়ের অনাবিষ্কৃত স্বরূপটিকে তিনি উন্মোচিত করতে চেয়েছেন এবং একাজ করেছেন অত্যাধুনিক আখ্যান—কৌশলের বহুমুখী প্রয়োগে। তাঁর রচনায় উত্তর—ঔপনিবেশিক বাস্তবতা হয়ে উঠেছে জাদু—বাস্তবতা, উপনিবেশিত—বিপন্ন—আক্রান্ত লোকজীবনের বেঁচে থাকার নির্মম ইতিহাসের গায়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জাদুর রঙিন অথচ স্বচ্ছ মোড়ক, দৃশ্যমান হয়েও তাই তাকে সরস এবং সহনীয় মনে হয়েছে। জনপ্রিয় সাহিত্যের পাশাপাশি সমান্তরাল সাহিত্যের যে ধারাটি নিরলস সাধনায় বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজের জীবনীশক্তিকে স্পন্দিত করে চলেছে, সিরাজ সেই ধারার এক কীর্তিমান লেখক, একথা নিঃসংশয়ে বলা যায়।
বাংলা সাহিত্যের চিরস্থায়ী সম্পদ তাঁর ধ্রুপদি উপন্যাস ‘অলীক মানুষ।’ কোলাজ রীতিতে কখনও সিধে ন্যারেটিভ, কখনও মিথ ও কিংবদন্তি, কখনও ব্যক্তিগত ডায়েরি বা সংবাদপত্রের কাটিং মিলিয়ে মিশিয়ে, সর্বোপরি জাদু বাস্তবতার অবাধ প্রয়োগে দূর—ধূসর এক সময় এবং বিস্ময়কর কিছু মানুষের বৃত্তান্ত একশো বছরের পরিধিতে মূলত একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে উপস্থাপিত করা হয়েছে, গড়ে উঠেছে আস্তিক্যবোধ, ধর্মনির্লিপ্ততা এবং প্রাকৃতিকতার দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। একজন ধর্মবন্দি ও একজন ধর্মদ্রোহী ব্যক্তিগত পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিতে চেষ্টা করে, বাস্তব ও পরাবাস্তবতার আলোছায়ায় দুটি মানুষ দু’রকমভাবে অলীক মানুষে পরিণত হয় এবং অলীক চেতনার জগতেই থেকে যান। উনিশ—বিশ শতকের একটি পির পরিবারের অবস্থান, মুসলিম সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ, বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের যুগচিত্র উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। এই একটি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায়, সিরাজ তাঁর উপন্যাসগুলিতে আখ্যান—শৈলীর নানা পরীক্ষামূলক প্রয়োগে, বহু চরিত্রের সমাবেশে, বিষয়ের বহুমাত্রিকতায় কীভাবে জটিলতার জাল বুনতে ভালোবাসেন।
‘উত্তর জাহ্নবী’ (১৯৭৪) উপন্যাসটি সিরাজের একটি স্মরণীয় কীর্তি। দাতা কর্ণের রাজধানী ছিল, নাম তাই কর্ণসুবর্ণ, সেখানে তিনশো ফুট নিচে ভাগীরথীর মজা খাত, চিরুটি স্টেশন ও সংলগ্ন চিরোটিকোদলা গ্রাম, এইসব নিয়েই লেখকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই উপন্যাসের পটভূমি। হেরু বাউরি স্টেশনে জনমজুর খাটত, সেইসময়ই সে চিনে নেয় বাবুদের। বাইশ সের বলে তাকে আড়াই মণ বোঝা বওয়ায় গোকর্ণের দাসজীবাবু। কয়েকবছর পরে ডাকাত হয়ে যায় সে। এই ডাকাতের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক গড়ে ওঠে গৌরাঙ্গ ডাক্তার ও তার মেয়ে স্বর্ণলতার। ধীরে ধীরে গোঁড়া মুসলমান জুহা মৌলবী, গোঁড়া খ্রিস্টান ফাদার সাইমন, প্রেতসাধক ইয়াকুব তান্ত্রিক, স্টেশন মাস্টার জর্জ হ্যারিসন প্রভৃতি বিচিত্র চরিত্রের আনাগোনা শুরু হয়। ডাকাতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য গৌরাঙ্গ ডাক্তারের জেল হয়, পরে তিনি উন্মাদ হয়ে যান। কিন্তু এই কাহিনীর নায়িকা স্বর্ণ। একের পর এক পুরুষ তার প্রণয়প্রার্থী হয়ে আসে, সে মায়ের মতো আগলে রাখে হেরুর ছেলে আনন্দকে, স্বর্ণের মৃত্যুতেই শেষ হয় এই কাহিনী।
‘কিংবদন্তীর নায়ক’ (১৯৬৯) উপন্যাসে ১৯৫৮—৫৯ সালের উত্তররাঢ়ের গ্রামের পটভূমিতে সেখানকার মানুষজনের জাগালী জীবনের দুঃখসুখের আলেখ্য রচনা করেছেন লেখক। বছরের পর বছর ফসলের পাহারায় নির্জনরাতের মাঠে মাঠে ছড়িয়ে পড়ে যাদের কণ্ঠস্বর, তাদের বলে, ‘জাগল।’ এরাই সেই মাঠ—কোটাল যারা এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে রাত জেগে সারারাত ডাকে আর যাদের ভরসায় গ্রামের গৃহস্থ আশ্বস্ত হয়ে পাশ ফেরে শয্যায়। প্রতি বছর মাঠগুলোয় বন্দোবস্ত হয়। তিন—চারজন মিলে একেকটি মাঠ নেয়। কিছু টাকা দিতে হয় মণ্ডলদের হাতে। তারপর ঘরে যাওয়ার আর অবসর নেই, সারা দিন—রাত ফসলের মাঠে ক্লান্তিহীন চলাফেরা, গ্রীষ্মের ঝলসে যাওয়া, বর্ষার মত্ত বর্ষণধারা। এই ‘জাগাল’দের নিয়ে লেখা প্রথম বাংলা উপন্যাস এটি।
‘কৃষ্ণা বাড়ি ফেরেনি’ উপন্যাসে প্রেম ও যৌনতার তুলনামূলক ভূমিকাকে বুঝে নিতে চেয়েছেন লেখক। বাবা—মা, দু’জনেরই মৃত্যুর পর বোন কৃষ্ণাকে অনেক যত্নে মানুষ করে ননী। তার রয়েছে এক অদ্ভুত ক্ষমতা। আগে থেকেই সে কোনও অমঙ্গলের আভাস টের পায়, যদিও তাকে সে গ্রাহ্য করে অমঙ্গলটি ঘটে যাওয়ার পর। কৃষ্ণা তার শান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত স্বভাবের জন্য সকলের কাছেই প্রিয় ছিল। কিন্তু একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে আর ফিরে আসে না। পরদিন তার মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণাকে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করে রেখে যায় দুই যুবক। যৌনতা ননীর জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। আর প্রেম যেন তার পুনর্জন্ম দেয়। কৃষ্ণার মৃত্যুর পর ননীর জীবনে যে বিপুল অভাবের সৃষ্টি হয়, তার ক্ষতিপূরণ করতেই যেন সে পেয়ে যায় অন্য এক নারীকে, যার নাম মানু। এই মানুর ভাই জনই কৃষ্ণার দুই ধর্ষকের একজন। মানু তা টেরও পেয়ে যায়। ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা না করে, সে বরং অকপটে ননীর কাছে সব স্বীকারোক্তি করে যায়। সে চায়, ধর্ষকের বোনকে ননী প্রত্যাখ্যান করুক, ঘৃণা করুক। কিন্তু ঘৃণার চেয়ে বড় হয়ে ওঠে প্রেম। এক নারীকে হারিয়ে প্রেমের মধ্য দিয়েই অপর এক নারীকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেয়ে যায় ননী।
‘অশরীরী ঝড়’ উপন্যাসেও আসে শরীরী ও অশরীরী সম্পর্কের জটিল খেলা। হেমাঙ্গ ভালোবাসে অমিকে, তার সঙ্গে প্রেম ও যৌনতায় জড়িয়ে থাকে, যে অমি এক জটিল নারী চরিত্র, মাঝেমাঝে সে ঘোর লাগা মানুষের মতো আচরণ করে। এই অমির ভাই ডন, দিদিকে বিয়ে করার জন্য হেমাঙ্গকে সে চাপ দেয়, হেমাঙ্গর চোখে সে হয়ে ওঠে এক আততায়ী, যে সর্বদাই তাকে আঘাত করার জন্য অনুসরণ করে আর হেমাঙ্গ সন্ত্রস্ত হয়ে তার হাত থেকে পালাতে চায়। এই উপন্যাসে এসেছে নানা চরিত্র, তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিচিত্র সব সম্পর্ক ও চলেছে টানাপোড়েনের খেলা। রয়েছে সৈকার মতো নারী, হেমাঙ্গ যার সঙ্গে বারবার অমিকে একাকার করে ফেলে, যার ধর্ষককে হত্যা করে ডন, কারণ সে অমিকেও ধর্ষণ করতে চেয়েছিল। এরপর থেকেই অমি হয়ে ওঠে ‘অবশেসড’ এক নারী। এভাবেই কখনও শরীরী, কখনও অশরীরী, এই দুই বাস্তবতার টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে হেমাঙ্গর জীবনে অমি অপরিহার্য হয়ে ওঠে।
‘নীল ঘরের নটী’ উপন্যাসে লেখক লিখেছেন, ‘নারী, নটী ও ভালোবাসা, এই তিনটি শব্দ সেতারের তারে তিনটি স্তরের ধ্বনি হয়ে বাজছিল। আমি নারী চাই, নটীকেও চাই, তাদের ভালোবাসাও আকাঙ্ক্ষা করি। পৃথিবীতে আমার মতো উন্মাদ ভিখারি কেউ আছে কি?’ এই উপন্যাসে রয়েছে মোহিনী ভ্যারাইটি শো’র বিচিত্র জগৎ। মেলা থেকে মেলায়, জনতা থেকে জনতায়, কোলাহলে, ধারাবাহিক তার যাত্রা। আর সেই যাত্রার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে বাঘের গর্জন, সাপিনীর দেহের দোলা আর নটীমেয়ের নৃত্য—গীত, সবমিলিয়ে জীবনের এক অপরূপ ছন্দ। এই মায়াজগতের একজন হয়ে ওঠে কাহিনীর কথক, যে মায়াজগতের কেন্দ্রে রয়েছে নটী নয়নতারা। তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় গোটা দল, সেই দলের বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে নয়নতারার সম্পর্কই হয়ে ওঠে কাহিনীর উপজীব্য। শেষপর্যন্ত অবশ্য অনিবার্য পরিণতিই হয়, দল ভেঙে যায়, কথকও মায়াজগৎ ত্যাগ করে ফিরে আসেন তার পুরোনো জীবনে। যদিও ততদিনে তিনি পেয়ে গেছেন নারী, নটী ও ভালোবাসার স্বাদ।
‘নিষিদ্ধ প্রান্তর’ উপন্যাসে লেখক লিখেছেন, ‘আঠারো বছরের মুসলিম মেয়েটি জীবনে এই প্রথম জানতে পারল, ভালোবাসা মানে আসলে যন্ত্রণা।’ মুসলিম মেয়ে রুবির জীবন জড়িয়ে যায় হিন্দু ছেলে সুনন্দর সঙ্গে, আর রুবি একটা পরিপূর্ণ চেহারা তৈরি করতে চায় নিজের স্বাধীনতাবোধের, সুনন্দের মতো একটি শান্ত, নমনীয়, ভীতু ছেলেকে দিনে দিনে সাহসী করে তুলতে চায়। কিন্তু ধর্মের ভিন্নতাই তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে এক দুর্ভেদ্য দেয়াল। সুনন্দ অনুভব করে, ‘ধর্ম মানুষের শত্রুতা করতে পারে, ভীষণতম শত্রুতা। প্রেম ভালোবাসা যদি পাপ না হয়, তাহলে ধর্ম এখানে পরম শত্রু বৈকি! অতএব ধর্মকে অস্বীকার করা ভালো। সুযোগ পেলেই তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা দরকার।’ এই উপন্যাসে কবীর বলে ওঠে, ‘হিন্দু—মুসলমান আবার কী? স্রেফ মানুষ। তবে যার যে ধর্মটায় বিশ্বাস হবে, তাই নেবে। ওটা কোনও সমস্যাই নয়। ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার।’ এভাবেই ধর্মের চেয়ে ঊর্ধ্বে স্বাধীনতাবোধকে তুলে ধরতে চেয়েছেন লেখক।
রাহুল দাশগুপ্ত
Leave a Reply