গোয়েন্দা কালকেতু সমগ্র (২য় খণ্ড) – রূপক সাহা
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ১৪২৭, জানুয়ারি ২০২১
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
.
উৎসর্গ
সেজদা মৃত্যুঞ্জয় সাহাকে
.
ভূমিকা
গোয়েন্দা কালকেতু নন্দীর প্রথম খণ্ড নিয়ে পাঠক সমাজের আগ্রহ দেখে আমি অভিভূত৷ এখন মনে হচ্ছে, ইস…কেন তার অত্যাশ্চর্য কার্যকলাপ নিয়ে আরও লিখলাম না? দ্বিতীয় খণ্ডে আরও নয়টা কাহিনি প্রকাশিত হল৷ বিষয় বৈচিত্র্যে যার কোনো তুলনা হয় না৷ এর মধ্যে তিনটি গল্প খেলার জগতের অপরাধ নিয়ে৷ কালকেতু তার ক্ষুরধার মস্তিষ্ক দিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব রহস্যের সমাধান করেছে৷ মাত্র একটি ঘটনা ছাড়া৷ ‘গীতার অন্তর্ধান রহস্য’ গল্পে কালকেতু গীতার সন্তানকে কথা দিয়েছিল, নিখোঁজ মাকে ফিরিয়ে এনে দেবে৷ কিন্তু, বন্ধুপত্নীর করুণ পরিণতির কথা এমন সময় কালকেতু জানতে পারে, যখন আর তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়৷ এই ব্যর্থতা নিয়ে কালকেতু এখনও আপশোশ করে৷
খেলার সাংবাদিকতা করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে কালকেতুর৷ ও এমন অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছে, যারা নিজেরা ভালো খেলোয়াড় হতে পারেনি৷ কিন্তু খেলা নিয়ে তাদের টেকনিক্যাল জ্ঞান অসীম৷ কালকেতুর ছোটবেলার বন্ধু প্লেটো এমনই একজন মানুষ৷ বরাবর সে একটু খ্যাপাটে টাইপের৷ নিজে নামী তিরন্দাজ হতে চেয়েও, পারেনি৷ কিন্তু তিরন্দাজি নিয়ে প্লেটো প্রচুর পড়াশুনো করেছে৷ রামায়ণ-মহাভারতে বীর যোদ্ধাদের কাহিনি পড়ে ওর মনে বিশ্বাস জাগে, এটাই ভারতীয়দের আসল খেলা৷ সেই ত্রেতা যুগ থেকে কত বিশ্বসেরা ধনুর্ধর এদেশে জন্মেছেন! প্লেটো জিদ ধরেছিল, ফের অর্জুনের মতো তিরন্দাজ তৈরি করবে৷ একজনকে তৈরিও করে৷ কিন্তু সেই ছাত্র একটু নাম করার পর অন্য কোচের কাছে চলে যায়৷ ছাত্রের বিশ্বাসঘাতকতায় প্লেটো খুব দুঃখ পায়৷
একদিন হঠাৎ রামায়ণে বানর সেনাদের কথা পড়ে ও সিদ্ধান্ত নেয়, মানুষ নয়, এবার থেকে তিরন্দাজির ট্রেনিং দেবে হনুমানদের৷ যারা দেখতে মানুষেরই মতো৷ কিন্তু মানুষের মতো বিশ্বাসঘাতকতা করে না৷ মেদিনীপুরে দেশের বাড়িতে চলে গিয়ে ও গোপনে হনুমানদের ট্রেনিং দিতে থাকে৷ আশ্চর্যরকম ফলও পায়৷ নেপালের কাঠমান্ডুতে এক আন্তর্জাতিক কম্পিটিশনে গিয়ে প্লেটো মারাত্মক ধাক্কা খায়৷ জানতে পারে, মানুষদের কম্পিটিশনে হনুমান অংশ নিতে পারে না৷ তিরন্দাজি জগতের অপরাধ সম্পর্কেও ওর আন্দাজ ছিল না৷ আন্ডারওয়ার্ল্ডের লোকজন ওকে ঘিরে ফেলে৷ এইসময় কাঠমান্ডুর রাস্তায় কালকেতু নন্দীর সঙ্গে হঠাৎ প্লেটোর দেখা হয়ে যায়৷ সব শুনে কালকেতু ওকে বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার করে, সেই ঘটনা নিয়ে গল্প ‘পাগলা প্লেটো’৷ কিন্তু তখনও শেখার অনেক কিছু বাকি ছিল প্লেটোর৷ ওর মনে প্রশ্ন থেকে যায়, হনুমানরাও কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
‘কিরকেট’ গল্পটা ক্রিকেটের বেটিং নিয়ে৷ ছিয়ানব্বই সালে লেখা৷ তখনও সাধারণ লোকের ধারণা ছিল, ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা৷ খেলাটা থেকে বেআইনিভাবে কিছু মানুষ যে টাকা লুঠছে, সে সম্পর্কে কারও আন্দাজ ছিল না৷ ইডেনে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি ভারত-শ্রীলঙ্কা৷ সেই ম্যাচের আগের দিন বেটিং সিন্ডিকেটের মাথা রাজু কেডিয়া কিডন্যাপ করে কালকেতুকে৷ বড়বাজারের পগেয়াপট্টিতে কেডিয়ার আড্ডায় গিয়ে কালকেতু জানতে পারে, অবৈধ বেটিং চলে কীভাবে৷ নিজের জবানিতে লেখা এই কাহিনিতে কালকেতু খোলসা করে দিয়েছে, শারজায় চেতন চৌহান কেন ম্যাচ খেলার আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল৷ কারা ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল? ইডেনের ম্যাচটা কালকেতু শেষ পর্যন্ত বাঁচায়, পগেয়াপট্টি থেকে কোনো রকমে পালিয়ে এসে৷ এর পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ৷ একদিন অফিসের নীচে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করছিল কালকেতু৷ সেইসময় পান্টারদের একজন এসে ওকে ভয় দেখিয়ে যায়, রাজু কেডিয়া ওকে ছাড়বে না৷ লাখ লাখ টাকা গচ্চ দিয়েছে৷ কেডিয়া ওকে দেখে নেবে৷
‘নখের আঁচড়’ মেয়ে ফুটবলারদের গল্প৷ গত শতাব্দীর সাতের দশকে ভারতে মেয়েদের ফুটবল চালু হয়৷ সেইসময় খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ গ্রামে-গঞ্জে মেয়েদের ডাক পড়ত প্রদর্শনী ম্যাচ খেলার জন্য৷ আর্থিক লেনদেন কম হত না৷ কিন্তু তা পৌঁছোত না মেয়ে ফুটবলারদের কাছে৷ সংগঠনটা তখন ছিল পুরুষ কর্তাদের হাতে৷ তাই যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ঘটত৷ দীর্ঘদিন ক্যাম্পে একসঙ্গে থাকার জন্য সমকামিতাও ছড়িয়ে পড়েছিল মেয়েদের মধ্যে৷ ইতিমধ্যে বসিরহাটে একটা ম্যাচ খেলতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায় এক মেয়ে ফুটবলার৷ আপাতদৃষ্টিতে দুর্ঘটনা বলে পুলিশের মনে হয়েছিল৷ কিন্তু কালকেতু প্রমাণ করে দেয়, খুন৷ সামান্য একটা নখের আঁচড় তাকে খুনি অবধি পৌঁছে দিয়েছিল৷ ধরা পড়ে, সমকামী কোচ অনুরাধা৷ মেয়ে ফুটবলারদের সমকামিতা নিয়ে লেখার জন্য আমার বিরুদ্ধে অনেকেই চটে গেছিলেন৷ হুমকি দিয়েছিলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা করবেন৷ সেইসময় মেয়েদের বিশ্বকাপ চলছিল আমেরিকায়৷ ওখান থেকে একটা রিপোর্ট আসে, সারা বিশ্বে মেয়ে ফুটবলারদের অনেকেই সমকামী৷ এজন্য তারা লজ্জাবোধ করে না৷ খবরের কাগজের রিপোর্টটা প্রকাশিত হওয়ার পর অবশ্য কেউ আমাকে বিরক্ত করেননি৷
‘ইচ্ছের মৃত্যু’, ‘সরষের মধ্যে ভূত’ বা ‘লখিন্দরের ভেলা’ গল্পগুলোতে গোয়েন্দা হিসেবে কালকেতু অনেক পরিণত৷ শুধু খেলার জগতে গোয়েন্দাগিরি করা থেকে সে বেরিয়ে এসেছে, পুলিশ অফিসার বন্ধু সুদীশ নাগের পরামর্শে৷ ‘লখিন্দরের ভেলা’ গল্পটা প্রকাশিত হয়েছিল নবকল্লোল পত্রিকায়৷ সুন্দরবন অঞ্চলে এই ধরনের ভেলা প্রায়ই নদীর উপর দিয়ে ভেসে যেতে দেখা যায়৷ ওই অঞ্চলে এখনও লোকে মনে করে সাপে কাটা মরা মানুষদের দাহ করা উচিত নয়৷ বেহুলা যেমন করে লখিন্দরকে বাঁচিয়েছিলেন, তেমনই ভেলায় করে নেতা ধোপানির ঘাটে পৌঁছোলে মৃত মানুষ বেঁচে উঠবে৷ সুন্দরবনে একটা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে স্পোর্টস প্রাইজ দিতে গিয়ে এই রকম একটা ভেলা চোখে পড়ে কালকেতুর৷ ভেলায় মৃতদেহটা ছিল স্কুলের সেরা স্পোর্টসম্যান-এর৷ কালকেতু দু-দিনের মধ্যে রহস্যের সমাধান করে দেয়৷ বাইরে থেকে সর্পদংশনে মৃত্যু বলে মনে হলেও, এটা একটা পরিকল্পিত খুন৷
দ্বিতীয় খণ্ডে অভিনব আরও একটা গল্প হল ‘থিম রহস্য’৷ বেশ কয়েক বছর হল, কলকাতায় চালু হয়েছে দুর্গোৎসবের সময় থিম পুজো৷ শুরুর দিকে সংখ্যাটা কম ছিল৷ বড় বড় পুজোর সংগঠকরাই পুরস্কার পাওয়ার লোভে থিম পুজো করতেন৷ কিন্তু চিট ফান্ড কর্তারা পুজোয় টাকা ঢালতে শুরু করার পর থিম পুজোর সংখ্যাটা বেড়ে যায়৷ এ দিকে, তুলনায় থিম আর্টিস্ট কম৷ ফলে আর্টিস্টদের নিয়ে কাড়াকাড়ি চলতে থাকে৷ এইরকম পরিস্থিতিতে এক থিম আর্টিস্ট রুদ্র মারাত্মক বিপদের মধ্যে পড়ে যায়৷ সে দ্বারস্থ হয় কালকেতু নন্দীর৷ টাকা আত্মসাৎ আর খুনের অভিযোগ থেকে রুদ্র কীভাবে বেরিয়ে এল, তা নিয়ে গল্প৷ পুজোর মাতব্বর রাজনৈতিক নেতা আর মাস্তানরা কীভাবে চাপ দিয়ে পুরস্কার জেতেন, তাও জানা যায় এই গল্পে৷
গোয়েন্দাগিরিতে প্রায় দু-দশক কাটিয়ে দিল কালকেতু৷ সম্প্রতি বাংলাদেশি এক মহিলার খোঁজে আমেরিকায় যেতে হয়েছিল ওকে৷ সেখানে গিয়ে ও বুঝতে পারে, সাইবার ক্রাইম এত বেড়ে গেছে যে, রহস্য উদ্ধার করা একজনের পক্ষে এখন আর সম্ভব না৷ এটা টিম ওয়ার্ক৷ তখনই একটা ডিটেকটিভ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট করার কথা ও ভাবে৷ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে নিখোঁজ বাংলাদেশি মহিলাকে আবিষ্কার করে দেশে ফিরে আসার পর ইদানীং কালকেতু কলকাতায় ইনস্টিটিউট খুলেছে৷ ইতিমধ্যে ছাত্রদের কাজে লাগিয়ে ও দুটো বড় রহস্যের সমাধান করেছে৷ সেই দুটি কাহিনি হয়তো তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হবে৷ আমেরিকায় কালকেতুর সাফল্যের কথা লিখেছি ‘জিহাদি’ উপন্যাসে৷ প্রকাশিত হয়েছে দেব সাহিত্য কুটীর থেকেই৷ সম্পাদক রূপা মজুমদারকে ধন্যবাদ, উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদের কথাও তিনি ভাবছেন৷
রূপক সাহা
এপ্রিল ২০২০
Leave a Reply