কুদৃষ্টি-কুসম্পর্কের ভয়াবহ ক্ষতি ও প্রতিকার
মূল : সিলসিলায়ে চিশতিয়া কাদেরিয়া নকশবন্দিয়া সাহোরওয়ার্দিয়ার
বিশ্ববিখ্যাত বুযুর্গ
শায়খুল-আরব অল-আজম আরেফবিল্লাহ
হযরত মাওলানা শাহ্ হাকীম মুহাম্মদ আখতার ছাহেব র.
তরজমা : মাওলানা আবদুল মতীন বিন হুসাইন
খলীফায়ে আরেফবিল্লাহ হযরত মাওলানা শাহ্ হাকীম মুহাম্মদ আখতার ছাহেব র.
.
কুদৃষ্টি-কুসম্পর্কের ভয়াবহ ক্ষতির বিবরণ ও অমূল্য উপদেশ
এখানে আমি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করতে চাচ্ছি। তা এই যে, বর্তমান যমানায় দ্বীনদার, নেক্কার, মোত্তাকী-পরহেযগার ও তরীকতের সমস্ত ছালেকীনের জন্য নারীর ফেতনার চেয়ে দাড়ি-মোচ বিহীন সুশ্রী বালক-তরুণের ফেতনা বেশী মারাত্মক ও বেশী ধ্বংসাত্মক। এবং যেহেতু সুশ্রী বালক-তরুণদের ফেতনার পথে অর্থাৎ তাদের সাথে কোন পাপাত্মক কাজে লিপ্ত হওয়ার পথে বাহ্যিক বাধা-বিঘ্ন কম, তাই শয়তান মানুষকে সহজে ও দ্রুততর এই ফেতনায় (পাপের ফাঁদে) লিপ্ত করে দেয়। এর বিপরীতে না-মাহরাম ভিন্ নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ বেশী-ছে বেশী কুদৃষ্টির অপরাধ সংঘটিত হয়।
এর কুফল সম্পর্কে হাকীমুল-উম্মত, মুজাদ্দিদুল-মিল্লাত হযরত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানবী (রঃ) বলেন যেঃ
১— না-মাহরাম নারী ও সুদর্শন বালক-তরুণের সাথে যে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখা, যেমন তার দিকে দৃষ্টি করা, মনে আনন্দ লাভের জন্য তার সাথে কথা বলা, নির্জনে তার সাথে বসা বা অবস্থান করা, অথবা তার মনতুষ্টির জন্য সাজগোজ করে পোশাক পরিধান করা, মোলায়েম ভাষায়, মিষ্টি সুরে কথা বলা ইত্যাদি—এ ধানের সম্পর্কের দরুণ যে সকল ক্ষতি ও খারাবী পয়দা হয় এবং যে সকল মুসীবতের সম্মুখীন হতে হয় তা লিখে শেষ করার মত ভাষা আমার কাছে নাই।
২— একে-মাজাযী বা উক্তরূপ কু-সম্পর্ক আল্লাহর আযাব। (যেভাবে দোযখের মধ্যে না মৃত্যু, না জীবন—এরূপ এক আযাবের মধ্যে থাকবে, (মরেওনা বাঁচেওনা এমন এক যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্যে কাটাবে) তক্রপ, কুদৃষ্টি করার পর কুসম্পর্ক আকর্ষণে আক্রান্ত হয়ে মানুষ সর্বদা ছটফট করতে থাকে। অস্বস্তির আগুনে জ্বলতে থাকে। আরামের ঘুম থেকেও মাহরূম হয়ে যায়। দ্বীন-দুনিয়া সবই ধ্বংস হয়। অবশেষে পাগলা গারদে ভর্তি হতে হয়। আজকাল পালা গারদের শতকরা নব্বই জনই কুপ্রেম-কুসম্পর্কের রোগী যারা টিভি, ভিসিআর, সিনেমা ও নভেল পাঠের পরিণামে পাগল হয়ে গেছে।
৩— কুদৃষ্টির পর অসৎ প্রেমের শিকার হয়ে যদি কখনও অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়, তাহলে উভয়ে উভয়ের চোখে চিরদিনের জন্য ঘৃণার পাত্র হয়ে যায়। লজ্জিত ও ঘৃণিত অনুভূতির দরুণ জীবনে কখনও পরস্পরে চোখে চোখ মিলানো আর সম্ভব হবে না। একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। এবং যেভাবে স্নেহশীল দরদী পিতা আন্তরিক ভাবে চান যে, আমার ছেলেরা সম্মান ও মর্যাদার সাথে থাকুক, কখনও কোন অপকর্মে লিপ্ত হয়ে অপদস্ত-অপমানিত না হোক, তদ্রুপ, অপার-অসীম দয়া-মায়ার আধার আল্লাহপাকও চান যে, আমার বান্দারা কোন ঘৃণিত কাজে লিপ্ত হয়ে হেয়/ঘৃণ্য ও অপমানিত না হোক। অপরাধমুক্ত থেকে, তাক্বওয়ার সাথে থেকে মান-ইযতর সাথে জীবন যাপন করুক। হালালের উপর তুষ্ট থাকুক এবং হারাম থেকে বিরত থাকুক। দুনিয়াদাররা যখন দুনিয়ার স্বাদ-লযযতের দ্বারা তাদের চক্ষু শীতল করে, কলিজা ঠাণ্ডা করে, তখন আমার বান্দারা যেন আমার ইবাদত ও আমার যিকিরের স্বাদ-লযযতের দ্বারা তাদের চক্ষু শীতল করে এবং কলিজা ঠাণ্ডা করে। এই শান্তি ও শীতলতা হচ্ছে চিরস্থায়ী। আর দুনিয়ার মোহগ্রস্তদের স্বাদ ও শীতলতা অতি ক্ষণস্থায়ী এবং, তাও আবার হাজারো বালা-মুসীবতের দ্বারা পরিবেষ্টিত। একদিকে স্বাদ গ্রহণ করে, আরেক দিকে হাজারো বিপদ তাদেরকে ঘিরে ধরে।
আল্লাহ্পাক দুশমনদেরকে দিয়েছেন আরাম-আয়েশের সামান ও সুখের উপকরণাদি, আর প্রিয়দেরকে দিয়েছেন তার ভালবাসা, তার প্রেমের ব্যথা। কিন্তু কুলে থেকেও এরা যেন সাগরবক্ষে হাবুডুবু খায়, আর সাগর বক্ষে প্রবল তুফানের কবলে পড়েও আমি ফুলের শান্তির মধ্যে কাটাই। অর্থাৎ সুখের সহস্র উপকরণের মধ্যেও আল্লাহর নাফরমানীর ফলে সাগরবক্ষে ডুবন্ত মানুষের মত ওরা অজস্র বিপদ ও অশান্তির কষাঘাতে জর্জরিত ও নিস্পৃষ্ট হতে থাকে। পক্ষান্তরে যারা আল্লাহর অনুগত বান্দা, তারা আল্লাহর ভালবাসা ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে পাপাচার হতে বেঁচে থাকার যুদ্ধে যদি অসংখ্য মানসিক আঘাতের তুফান বরদাশত করতে থাকে, কিন্তু এই তুফানের মধ্যেই দয়াময় আল্লাহ তাদের অন্তরে এমন এক অনাবিল আনন্দ-ফুর্তি বর্ষণ করেন যা তুফানের মধ্যেও তাদেরকে কূলের শান্তি প্রদান করে।
শত্রুদেরে দিলেন খোদা
দালান-কোঠা, টাকা-পয়সা,
বন্ধুদেরে দিলেন তিনি
প্রেমের ব্যাথা, ভালবাসা।
কূলেও ওরা মরছে ডুবে
অবাধ্যতার তীব্রাঘাতে,
হাসছি আমি কুলের মত
সাগর বুকের নিত্যপদে।
হযরত খাজা আযীযুল হাসান মজযূব (রঃ) একারণেই বলেছেন—-
যদিও তাদের প্রতি দৃষ্টি করার ভারী আগ্রহ জাগে, তবুও তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে আমি আমার জান ও ঈমানকে বিপদের মধ্যে ফেলবনা ।
তিনি আরও বলেন—
যদি তুমি ক্ষয়শীল-লয়শীল সৌন্দর্যের পিছনে পড়, তবে এই চাকচিক্যময় সুদর্শন সর্পের দংশনে তোমার সর্বনাশ ঘটে যাবে।
ভারতের মাযাহেরুণ-উলূমের মোহাদ্দেছ, হাকীমুল-উম্মত হযরত থানবীর খলীফা হযরত মাওলানা আসআবদুল্লাহ ছাহেব সাহারানপুরী (রঃ) বলেন—
সুশ্রী বালক-তরুণ কিংবা ভিন্ নারীর ভালবাসার মধ্যে তুমি আরাম-আনন্দ ও সুখ অন্বেষণ করতেছ? তার মানে, দোযখের মধ্যে তুমি বেহেশতের সুখনিদ্ৰালয় কিংবা বেহেশতের ফুলশয্যা তালাশ করতেছ?
ক্ষণস্থায়ী রূপ-সৌন্দর্যের ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে আমার মোর্শেদ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক ছাহেব (দামাত বারাকাতুহু) করাচীর খানকাহ্-এ গুলশান-এ ইকবালে এই ছন্দটি শুনিয়েছিলেন—
সেই আনন্দঘন দিনগুলো চির বিদায় নিয়েছে। সুরাপায়ীদের পালাক্রমে সুরাপাত্র পানের উল্লাসেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে। হে সুরা পরিবেশক, থাম। কারণ, আমার প্রিয়জনের সৌন্দর্যলীলাও নিপাত হয়েছে, আমার প্রেমের খেলাও সাঙ্গ হয়েছে। অর্থাৎ সেই বল্লাহীন জীবনের অন্যায় ভালবাসার প্রতিটি মুহূর্ত ও প্রতিটি কর্মের জন্য আজ শুধু দুঃখ বোধ ও পরিতাপ করছি যে, হায়, কেন যে সেদিন সেই ধ্বংসশীলের পিছনে ঘুরে ঘুরে দ্বীন-দুনিয়া সব বরবাদ করেছিলাম।
অধম আখতার আরয করতেছি যে, কুদৃষ্টিকারীর প্রতি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম বদ-দোআ করে বলছেন—
“আল্লাহ তাআলা লা’নত বর্ষণ করুন নজরকারীর উপর এবং যার প্রতি নজর করা হয় তার উপর।” অর্থাৎ যে বেপর্দা চলাফেরার দ্বারা কুদৃষ্টির আহবান জানায় তার উপরও লা’নত বর্ষণ হোক। পীর-আউলিয়ার বদদোআকে যারা ভয় করেন তাদেরকে আল্লাহর রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম-এর বদদোয়াকে ভয় করা উচিত। আল্লাহপাক আমাদের সকলের হেফাযত করুন। আমীন!
অল্প ক’দিনের রূপ-লাবণ্য যাদুর মত পাগল করে তোলে। তারপর কিছুদিনের মধ্যেই সেই চেহারার ভূগোল পরিবর্তন হয়ে ভিন্নতর হয়ে যায়। আর বৃদ্ধকালে ত সম্পূর্ণ নকশাই একদম আজব ধরনের হয়ে যায়। সৌন্দর্যের এই ধ্বংসলীলা সম্বন্ধে আমার একটি ছন্দ আছে,
একদিকে প্রিয়জনের লাবণ্যময় চেহারার ভুগোল বদলে গেল, অপরদিকে প্রেমিকের ইতিহাসও বদলে গেল। প্রিয়জনের হিষ্ট্ৰীও খতম, প্রেমিকের মিষ্টারীও যতম।
আরেকটি পুরানো ছন্দ মনে পড়ে গেল
কোন মাটির মানুষের উপর তোমার জীবনটাকে তুমি মাটি করে দিওনা। তোমার মূল্যবান এ যৌবনকে তুমি সেই মহান সত্তার উপর উৎসর্গ কর যিনি তোমাকে যৌবন দান করেছেন।
এই ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কতনা যুবক-যুবতীর জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে। এ বিষয়ে আমার কতিপয় উপদেশমূলক ছন্দ আছে—
হে মন, যৌবনের এই সাগরে হাজার হাজার জাহাজের সমান রক্ত ও শক্তি মওজুদ আছে। অতএব, হে মন, ক্ষণস্থায়ী রূপ-সৌন্দর্যের মোহনীয় বসন্ত সম্পর্কে তোমাকে খুব সতর্ক পদক্ষেপ নিতে হবে। যাতে তোমার রক্ত ও শক্তির অমূল্য সম্পদ। অপথে বিনষ্ট না হয়।
জগত-কাননের যুবক-তরুণদের যৌবনের অপূর্ব আকর্ষণ দেখতেই না দেখতে কখন যে ‘তা মরুভূমির ন্যায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।
কুদৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহপাক যে আয়াত নাযিল করেছেন তা হলো—
‘আল্লাহপাক তাদের কুদৃষ্টি ও কুদৃষ্টি জনিত সকল অপকীর্তি সম্পর্কে যথাযথ খবর রাখেন।’ এই মর্মেই আমার একটি ছন্দ আছে—-
দুনিয়ার লোকজনের আড়ালে-আবডালে তুমি যা-কিছুই করনা কেন, একজন তোমাকে আসমান হতে অবশ্যই দেখতেছেন।
এখানে লক্ষণীয় যে, পবিত্র কোরআনে কুদৃষ্টি নামক ক্রিয়াকে আল্লাহপাক ‘ছানআত’ (কারিগরি) ধাতু দ্বারা অভিব্যক্ত করেছেন। এতে কি রহস্য বিদ্যমান? রহস্য এই যে, যে ব্যক্তি কুদৃষ্টি করে, সে তার ঐ প্রিয়জন সম্পর্কে মনে মনে নানা ধরনের কামনা-বাসনার ফিচার (কল্পিত ছবি) তৈরী করতে থাকে। কল্পনার মধ্যে কখনও তাকে চুম্বন করে, কখনও নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে। ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই, আল্লাহপাক তার ইত্যাকার সর্ব প্রকার কারিগরি ও অপকীর্তি সম্পর্কে সম্যক খবর রাখার কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছেন। এজন্যই মুফতীয়ে-বাগদাদ আল্লামা সাইয়েদ মাহমূদ আ-লুসী বাগদাদী (রঃ) তার তাফসীর রুহুল মাআনীতে চারটি বিশেষ শব্দের দ্বারা এই ‘ইয়াছনাউন’ শব্দের তাফসীর (ব্যাখ্যা) করেছেন—
১. নজর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কুদৃষ্টি করণ সম্পর্কে আল্লাহপাক সম্যক অবগত আছেন।
২. কুদৃষ্টিকারী তার ত্বক, রসনা, চক্ষু কর্ণ, নাসিকা এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা যে হারাম স্বাদ গ্রহণের অপচেষ্টা করে আল্লাহপাক তারও খবর রাখেনি।
৩. কুদৃষ্টিকারী তার ক্ষণস্থায়ী প্রিয়জনকে অর্জন করার জন্য যেভাবে তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালন করে, হাত-পা ইত্যাদি অঙ্গ সমূহকে পরিচালনা করে, আল্লাহপাক তাও জানেন।
৪. কুদৃষ্টিকারীর যা সর্বশেষ লক্ষ্য অর্থাৎ অপকর্মে লিপ্ত হওয়া, আল্লাহপাক সে বিষয়েও পরিজ্ঞাত।
এভাবে তার প্রতিটি বিষয়ের খবর রাখার সংবাদ নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এ অপকর্ম থেকে বিরত থাক। নতুবা শক্ত আযাব দেওয়া হবে।
আমি একজন হাকীম। সারা জীবন আমি কুদৃষ্টি ও অবাঞ্ছিত প্রেমে আক্রান্ত বহু রোগী পেয়েছি। সকলে এই কথাই বলেছে যে, আমার যিন্দেগী তিক্ত ও অশান্তিগ্রস্ত। ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সর্বক্ষণ অস্থিরতা, মৃত্যুর আকাংখী ও আত্মহত্যার খেয়াল হয়। স্বাস্থ্য নষ্ট। সর্বদা আতংকগ্রস্ত। মন-মস্তিষ্ক দুর্বল। কোন কাজে মন লাগেনা। ইত্যাদি। আমিও সর্বদা তাদেরকে একথাই বলেছি যে, এসব কিছুই অবস্থিত পার্থিব ভালবাসা এবং অন্তরে আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কাউকে স্থান দেওয়ার আযাব। এবং আমি এ ধরণের পেরেশানীতে আক্রান্ত লোকদের খেদমতে আমার এ ছন্দটি পেশ করে থাকি–
মনে হয়, অন্তরের মধ্যে সর্বদা হাতুড়ি মারা হচ্ছে এবং মাথার মগজের মধ্যে খুটা ঠোকা হচ্ছে। বল, হে প্রেমিক দল, তোমরা পার্থিব প্রেমের কেমন মজা লুটলে?
এশকে-মাজাযীর (ক্ষণস্থায়ী ভালবাসার) এছলাহ সংক্রান্ত আমার আরও কতিপয় ছন্দ শুনুন—-
যাদের মধ্যে সৌন্দর্যপূজার মেযাজ ও রুচি হয়ে গেছে তাদের জন্য এটাই প্রতিকার যে, চোখের হেফাযত কর এবং ঘরের নিরাপদ কোঠায় অবস্থান কর। যাতে কোন সুশ্রীমুখের সম্মুখীন না হতে হয়। একান্ত প্রয়োজনে যদি বের হতেই হয় তবে অবশ্যই তোমাকে নজর হেফাযতের সম্বল তোমার সঙ্গে রাখতে হবে। এশকে-মাজাযীর ধ্বংসলীলা সংক্রান্ত আমার আরেকটি ছন্দ পেশ করতেছি—-
যেদিন ওদের সৌন্দর্যের চেরাপ নিভে গেল, এদের ভালবাসার বাতিও নিভে গেল। ফুলের মত প্রিয়মুখের আশ্চর্যজনক ক্ষয় দেখে প্রেমিকের প্রেম খতম হয়ে গেল এবং অতীত জীবনের কীর্তিকলাপ মনে পড়ে লজ্জায় মস্তক অবনত হয়ে গেল। আর মাথা তুলতে পারেনা, চোখ খুলতে পারেনা।
আজ যে সকল সুন্দর সুন্দরীরা এই যমীনের উপর চলাফেরা করতেছে, একদিন তারা কবরের মধ্যে মাটি হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর কখনও কবর খুলে দেখ, শুধু মাটি আর মাটিই দেখতে পাবে। যদি তাকে জিজ্ঞাসা কর যে, হে মাটি, তোমার কোন অংশ আমার প্রিয়জনের পাল ছিল? কোন অংশ চুল ছিল? কোন অংশ তার দুই নয়ন ছিল? এর উত্তরে তুমি মাটির স্তুপই শুধু দেখতে পাবে। চিনতেই পারবেনা যে, মাটির কোন্ ভাগ ছিল চোখ, কোন্ ভাগ নাক এবং কোন্ ভাগ গাল। আল্লাহপাক আমাদের পরীক্ষার জন্য মাটির উপর ডিস্টেম্পার করে দিয়েছেন (মাটিকে সুন্দর ও চাকচিক্যময় করে দিয়েছেন) যাতে তিনি দেখে নিতে পারেন যে, কে এই ক্ষণস্থায়ী ডিস্টেম্পারের উপর মরতেছে, আর কে পয়গাম্বরের হুকুমের উপর জান দিতেছে।
যদি তিনি মাটির উপর এরূপ কারুকার্য ও চাকচিক্য করে না দিতেন তাহলে সেই পরীক্ষাই বা কিভাবে হতো? তাই, ডিস্টেম্পারের দ্বারা ধােকা খাবেন না। আল্লাগামী আনেক পথিক ধােকা খেয়ে ধংসপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। এবং তারা আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। এবিষয়ে আমার একটি ছন্দ আছে—-
সৌন্দর্যপ্রেমিক মানুষ বাহ্যিক চাকচিক্যের ফাদে পড়েই বরবাদ হয়ে গেছে। নতুবা মাটি ত মাটিই । মাটিও কি কোন মূল্যবান জিনিস? কোন কদরের জিনিস? অতএব, হে বন্ধু, ধ্বংসশীল এই চাকচিক্যের মোহে কেন আক্রান্ত হচ্ছ? সৌন্দর্যের ধ্বংসলীলা সম্পর্কে আমার আরও কয়েকটি উপদেশমূলক ছন্দ শুনুন–
আজ আমার সেই প্রিয়জনকে আমি নিজ হাতে কাফন পরাচ্ছি। সেই রূপ-সৌন্দর্যকে আজ মাটির বুকে দাফন করে দিচ্ছি। তাই আজ আমি আমার মনকে বারবার একথাই বুঝাবার চেষ্টা করতেছি যে, ক্ষয়শীল, লয়শীল ও ধ্বংসশীল এই সুন্দর দেহের সাথে ভালবাসা স্থাপন করা সত্যি ত বড়ই অনর্থক কাজ।
প্রিয়মুখের শেষ পরিণতি সম্পর্কে উপদেশমূলক আরেকটি ছন্দ—
যার মুখ ছিল সুমিষ্ট, ওষ্ঠাধর ছিল মধুর, একদিন তাকে মৃত্যুর কোলে কাফন পরিহিত দেখতে হল।
বরং মৃত্যুর পূর্বেই যতই সময় আতিক্রান্ত হয়, ধীরে ধীরে মুখের লাবণ্যও ঝরে যেতে থাকে। নাক-মুখ-চোখের পূরা ভূগোলই বিকৃত হয়ে যায়।
একদিন সেই প্রিয়জনের কোমর ঝুকে ঘড়ির কাঁটার মত দেখা যাচ্ছে। সেদিনের সেই প্রিয়জনদের কেউ আজ নানা হয়েছে, কেউ নানী হয়েছে। মোহনীয় কালো চুলগুলো যখন ব্যাপকভাবে সাদা হয়ে গেল তখন তাদের কেউ দাদা হলো, আর কেউ দাদী হলো। কি থেকে কি হয়ে গেল ? কি বিকৃতি ? কি পরিণতি ?
এভাবে একদিন প্রেমের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। এবং প্রেমিকগণ স্বহস্তে প্রেমের জানাযা দাফন করে লজ্জিত ও অনুতপ্ত মনে সেখান হতে কোনসুদূরে চলে যায়। এবিষয়ে আমার আরও দুটি ছন্দ আছে—
হে প্রেমিক, শোন, একদিন তুমি তোমার প্রিয়জনের মুখে সাদা-কালো রঙের দাড়ির খিচুড়ী দেখতে পাবে। সেদিন তুমি নিজ হাতে তোমার ভালবাসার জানাযা দাফন করে দিবে। তাই, ভালবাসার উপযুক্ত সত্তা ত শুধু আল্লাহ যিনি চিরঞ্জীব, চির সুন্দর। যাঁর সৌন্দর্যের কোন লয় নাই, ক্ষয় নাই। বরং প্রতিটি মুহূর্তে তার সৌন্দর্যের এক নতুন নুতন শান।
প্রতিটি মুহূর্তে তিনি এক এক শানে থাকেন।
আল্লাহ পাকের সত্তা হতে তার সৌন্দর্য ও গুণাবলী কখনও পৃথক হতে পারেনা। এবং তা অসম্ভব। এর বিপরীতে দুনিয়ার সকল সুন্দর-সুন্দরীদের রূপ-লাবণ্য প্রতিটি মুহুর্তেই ক্ষয়িষ্ণু ও ক্ষয়ের দিকে ধাবমান। এদের দেহ সমূহকে কবরে প্রবেশ করতেই হবে। এদের কালো চুল সাদা হয়ে যাবে। কোমর ঝুকে যাবে। চোখ হতে ক্লেদাক্ত পানি প্রবাহিত হবে। চেহারার জ্যোতি নিঃশেষ হয়ে তদস্থলে ধোঁয়া উঠতে থাকবে। হায়, তোমার এজ্জীবনকে তুমি কোথায় ধ্বংস করে দিচ্ছে? একটু চিন্তা ভাবনা ত করে দেখ। আমার আরও কয়েকটি ছন্দ শুনুন
আজ এক রকম আছে, তো কাল অন্য রকম হবে। যেই সৌন্দর্যের ধ্বংস অনিবার্য, কেন তুমি তার সঙ্গে মন লাগাও ? হে যুবক, হে তরুণ, হে মানুষ, আমার উপদেশ গ্রহণ কর। ক্ষয়শীল কোন চন্দ্রমুখের উপর তোমার জীবনকে তুমি বরবাদ করোনা। একদিন তুমিই এদের দেহের উপর মাটি ঢালবে, মাটি চাপা দিবে।
সাপ যেদিক দিয়ে যায়, তার গমনপথে একটা ছোট্ট রেখ রেখে যায়। কিন্তু সৌন্দর্যের সাপ এমনিভাবে চলে যায় যে, সৌন্দর্যের একটু চিহ্ন, একটি রেখা ও অবশিষ্ট থাকেনা। তখন এই অদূরদর্শী বা প্রেমিকেরা হতবাক-হতবুদ্ধি হয়ে হাত কচলাতে থাকে। আফসোস করতে থাকে।
প্রিয়জনের সৌন্দর্যের ধ্বংসাত্মক কীর্তি দেখে প্রেমিকের আক্কেল গুড়ুম। সুশ্রীকানের সৌন্দর্যের পরিণাম যদি নজরের সামনে থাকে তাহলে তাদের থেকে দূরে থাকার মোজাহাদা (সাধনা) সহজ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমার একটি ছন্দ আছে—
শৈশব ও তারুণ্যের পর বার্ধক্য যে তার দিকে ধেয়ে আসতেছে তা যদি তুমি আগেই ভেবে দেখ, তাহলে তুমি তার প্রেমে পড়বে না।
এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা এই যে, রূপ-সৌন্দর্যের ধ্বংসলীলার এই যে মোরাকাবা, তা শুধু মনকে একটা বুঝ দেওয়ার জন্য যে, দেখ, এসব ত অস্থায়ী, ক্ষণস্থায়ী, ধ্বংসশীল, পচনশীল। এমন বস্তুর প্রতি তুমি আকৃষ্ট হয়োনা। কিন্তু সৌন্দর্যের এই ধ্বংসলীলার কথা চিন্তা করে সে-কারণে সৌন্দর্যের মোহ-মায়া হতে বিরত থাকা— এ ত বন্দেগীর অতি নিম্ন স্তর। এর অর্থ ত এই দাঁড়ায় যে, এসকল সুন্দর-সুন্দরীদের রূপ-সৌন্দর্য যদি ক্ষশীল ও ধ্বংসশীল না হত তাহলে অবশ্যই আমরা তাদের প্রতি প্রেমাসক্ত হতাম, তাদের সঙ্গে দিল লাগাতাম। নাউযুবিল্লাহ। তাই বন্দেগী ও দাসত্বের উচ্চ স্তর হলো এই যে, আমরা প্রিয় মা’বূদকে এরূপ বলবো যে, হে আল্লাহ, আপনার অনুপম সৌন্দর্য ও মহত্বের এবং আমাদের প্রতি আপনার সীমাহীন দয়া ও এহসানের হক ত এই যে, কিয়ামত পর্যন্তও যদি এসকল সুশ্রী-সুন্দরীদের সৌন্দর্যে কোনও পরিবর্তন না আসে বরং তা পূর্ণভাবে মোহনীয়-কমনীয় হয়েই অব্যাহত থাকে তবুও আমরা আপনার মহব্বত, আপনার
আযমত ও এহসানাতের তাগিদে একটিবারও তাদের প্রতি নজর তুলে দেখবনা। কারণ, যেই আনন্দের উপর আপনি অসন্তুষ্ট, যেই আনন্দ আপনার অসন্তুষ্টির পথে অর্জিত হয় নিঃসন্দেহে তা লা’নতওয়ালা আনন্দ। এমর্মেও আমার একটি ছন্দ আছে—
হে বন্ধুগণ, শোন, এমন স্বাদ ও আনন্দকে আমরা লা’নতী ও অভিশপ্ত মনে করি যেই স্বাদ ও আনন্দের দ্বারা প্রিয় মা’বুদ আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন।
সামান্য সময়ের পাপের মজার মধ্যে হাজার হাজার বিপদ-আপদ এবং হাজার হাজার দুঃখ কষ্ট ও লাঞ্ছনা লুকায়িত থাকে। পাপের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার প্রথম বিন্দু আল্লাহর আযাব ও আল্লাহ হতে দূরত্বেরও প্রথম বিন্দু। যে কোন পাপের ইচ্ছা বা পরিকল্পনা করার অর্থ নিজেকে আল্লাহর অসন্তোষ ও আল্লাহর আযাবের সম্মুখীন করে দেওয়া। মানুষ পাপের দিকে রোখ করে, তো আল্লাহর আযাব তার দিকে রোখ করে। ফলে, এর পর তার অন্তরে কোনরূপ শান্তি ও স্বস্তির কল্পনাও করা যায় না।
যে কোন এশকে-মাজাযীর (‘অবাঞ্ছিত প্রেমের) শুরুই বিশ্রী ও বিপজ্জনক দেখা গিয়েছে। খোদা জানে যে, এর পরিণাম কতনা ভয়াবহ হয়েছে। কারণ, এর দ্বারা অন্তরে মুর্দার প্রবেশ করেছে। ফলে, অন্তরও মুর্দা হয়ে গেছে। এই সুশ্রী তরুণ ও নারীরা অবশ্যই একদিন মুর্দা হবে। যদিও এখন জিন্দা আছে। কিন্তু যেহেতু এরা ধ্বংসশীল ও মরণশীল, তাই যদি এরা কোন অন্তরে প্রবেশ করে তবে সেই ধ্বংসশীলতা ও মরণশীলতার প্রতিক্রিয়া সহই প্রবেশ করে। ফলে, ঐ অন্তরে তাআলুক মাআল্লাহ বা আল্লাহর মহব্বত ও আল্লাহর সাথে সম্পর্কের স্বাদ ও মাধুর্য বর্তমান থাকতে পারে না। যেমন, মনে করুন, কোন কামরার মধ্যে আপনার খানা খাচ্ছেন। আপনাদের সামনে বিভিন্ন প্রকার মজার মজার খানা। হঠাৎ এক মৃত ব্যক্তির লাশ এনে ঐ কামরার মধ্যে আপনাদের সম্মুখে রাখা হল । বলুন, এখন আপনারা ঐ খানার মধ্যে কোনও মজা পাবেন কি ? অনুরূপভাবে কোন মুর্দা (মরণশীল লোক) যদি অন্তরে স্থান পায় তবে সেই অন্তর কিছুতেই আল্লাহর মহব্বত ও ভালবাসার স্বাদ পেতে পারেনা। এমন অন্তরে আল্লাহ আসেনা, আল্লাহর নূর আসেনা যেই অন্তরে গায়রুল্লাহর দুর্গন্ধ ও ময়লা বিরাজমান থাকে। ভারতের হযরত মাওলানা শাহ মুহাম্মদ আহমদ ছাহেব (রঃ) বলেন—
অন্তরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ না করে অথবা প্রবেশের পথ না ধরে, সে জন্য সর্বদা তোমাকে তোমার অন্তরের কঠোর পাহারায় রত থাকতে হবে।
এজন্যই আল্লাহর ওলীগণ সর্বদা তাঁদের নিজ নিজ অন্তরের দেখাশুনা করতে থাকেন যে, নফছ যেন কোন চোরা পথে হারাম মজা না লুটতে পারে। এজন্যই তারা এমন চেহারা সমূহকে কাছেই আসতে দেন না যা থেকে সাবধান থাকা ওয়াজিব। এর ফলে তাদের অন্তরে খানিকটা কষ্ট অনুভব হয় বটে, কিন্তু সেই কষ্টের বরকতে হৃদয়-মন সদা সজীব, উৎফুল, আনন্দিত ও আল্লাহপাকের মস্ত বড় নৈকট্যের দ্বারা ধন্য থাকে। এ মর্মে আমার একটি ছন্দ আছে—
আমার কষ্টের দিনগুলিও আসলে ঈদের দিন ছিল। আল্লাহর জন্য আকর্ষণীয় চেহারা-সূরত থেকে দূরে থাকা আমার জন্য বড়ই মঙ্গলময় হয়েছে।
যখন সূর্য উদয়ের সময় হয় তখন আকাশের পূর্বদিগন্ত সম্পূর্ণ লাল হয়ে যায়। ইহা আলামত যে, এক্ষণই সূর্য উদয় হবে । তদ্রুপ, যে ব্যক্তি পাপের সর্বপ্রকার হারাম কামনা-বাসনাকে খুন করতে থাকে এবং এভাবে হারাম কামনা-বাসনার রক্তের দ্বারা যখন তার হৃদয়ের সমগ্র আকাশ লাল হয়ে যায়, ঐ হৃদয়ে তখন আল্লাহর নূর ঔ নৈকট্যের সূর্য উদয় হয়। এমর্মে আমার কয়েকটি ছন্দ শুনুন—-
হৃদয়ের সেই অসংখ্য লাল চিহ্ন সমূহ যা মনের হারাম কামনা-বাসনাকে খুন করার ফলে সৃষ্টি হয়ে থাকে, আল্লাহর নৈকট্যের সূর্য উদয়ের জন্য তা-ই হয় রক্তিম দিগন্ত।
হে বীর, আমার ভালবাসার পরিণামফল তুমিও দেখতে থেক। আমার জীবনের সকল বিরান ভূমিকে আমি হারাম কামনা-বাসনার রক্তের দ্বারা আবার করেছি। অর্থাৎ যে হৃদয় পাপের আবেগ-আগ্রহকে আল্লাহর জন্য বর্জন করে, সে-হৃদয়কে আল্লাহর নূর, আল্লাহর মহব্বত ও রহমতের দ্বারা আবাদ করে দেওয়া।
মনের হারাম আগ্রহ-অনুরাগ বর্জনের কষ্ট সহ্যের ফলে অন্তরে যে রক্তিম দিগন্ত সৃষ্টি হয়, হৃদয়ের সে অসংখ্য রক্তিম দিগন্ত জুড়ে আল্লাহর নূরের সূর্য, আল্লাহর সন্তুষ্টির সূর্য, আল্লাহর নৈকট্যের সূর্য বিরাজমান থাকে।
এর বিপরীতে যারা দৃষ্টি সংযত রাখেনা তারা অবশেষে কামুক প্রেমে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এবং দুনিয়াতেই তারা যেই পরিমাণ পেরেশানীর আযাব ভােগ করে প্রত্যেক কামুক তা হাড়ে-হাড়ে অনুভব করে থাকে। তাছাড়া, এর অশুভ পরিণতিতে কত লোক যে মৃত্যুর সময় কালেমার বদলে হারাম-প্রিয়জনের নাম নিতে নিতে মৃত্যু বরণ করেছে। তাদের কালেমা নসীব হয় নাই। এজন্যই মাশায়েখগণ বলেছেন যে, ছালেকের (আল্লাহগামী পথিকের বা তরীকতভুক্ত লোকের) জন্য মেয়েলোক ও দাড়ি-মোচ বিহীন বালক-তরুণের সাথে উঠাবসা ও মেলামেশা করা বিষতুল্য ধ্বংসাত্মক। শয়তান যখন সূফীদেরকে লক্ষ্যচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার আর কোন পথই দেখতে না পায় তখন তাদেরকে মেয়েলোক ও শুশ্রবিহীন বালক-তরুণদের ফাদে ফেলবার চেষ্টা করে। শয়তানের এই অস্ত্র এত ভয়াবহ ও এর সফল যে, যে-ই এর শিকার হয়েছে সে-ই ধ্বংস হয়েছে। লক্ষ্যপথ হারিয়ে ফেলেছে। কারণ, অন্যান্য পাপের দরুন আল্লাহ হতে এতটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় না যতটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় এই কামুক প্রেমের দ্বারা। যেমন কেই যদি মিথ্যা কথা বলল কিংবা গীবত করল অথবা নামাযের জামাত তরক করে দিল তা হলে মনে করুন তার অন্তর আল্লাহু থেকে চল্লিশ ডিগ্রী সরে গেল। অতঃপর সে তওবা করে নিল, ফলে আবার অন্তরের রোখ পুরাপুরি আল্লাহর দিকে হয়ে গেল। কিন্তু যদি কেহ কোন সুশ্রী-ছুরতের প্রেমে আক্রান্ত হয় তাহলে তার অন্তরে রোখ আল্লাহ থেকে ১৮০ ডিগ্রী পরিমাণ হটে যায়। এক কথায় তার অন্তরের কেবলাই পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে, এখন সে নামায পড়তেছে, তো ঐ সুশ্রী-সুরত তার সম্মুখে আছে। তেলাওয়াত করতেছে, তো ঐ সূরত সমুখে আছে। কলবের (অন্তরের) রোখ আল্লাহ থেকে হটে গিয়ে এখন রোখ হয়েছে গলনশীল-পচনশীল এক মুর্দা-লাশের দিকে। আল্লাহপাক থেকে এতটা দূরত্ব আর কোন গুনাহের কারণে পয়দা হয় না যতটা দূরত্ব পয়দা হয় কোন হারাম ছুরতের প্রেমের দ্বারা। শিকারীরা যেই পাখী শিকার করতে চায় তার পালক সমূহে আঠা লাগিয়ে দেয় যাতে উড়তে না পারে। এভাবে তারা সহজে পাখী শিকার করে। অনুরূপ শয়তান যখন দেখে যে, কোন ছালেক অতি দ্রুত পতিতে আল্লাহগামী পথ অতিক্রম করতেছে, খুব অগ্রগতি লাভ করে চলেছে, জান কোরবান করে এক-একটি গুনাহ থেকে বাঁচতেছে, তখন তাকে কোন ছূরতের (সুশ্রীমুখের) প্রেম-ভালবাসার ফাদে ফেলে দেয়। এভাবে সে তাকে আল্লাহ থেকে মাহরুম (বঞ্চিত) করে দেয়।
অতএব, যত সুন্দর চেহারাই সম্মুখে অসুকনা কেন, কোন ক্রমেই আড়চোখেও তার দিকে নজর করবেন না। তখন অন্ধ হয়ে যাবেন। চোখে আলো থাকা সত্ত্বেও আলোহীনের মত হয়ে যাবেন। অপাত্রে সেই আলোর ব্যবহার করবেন না। এমর্মে আমার একটি ছন্দ আছে—
আসিল যখন সম্মুখে সে-জন।
বনিলাম অন্ধজন,
যেই হটিল সম্মুখ হতে
আমি সে-দৃষ্টিমান।
আরহাম-রাহিমীন অপার দয়ার সাগর আল্লাহ যখন দেখবেন যে, আমার বান্দাটি কি আমানতদারীর সাথে আমার দেওয়া চোখের আলো খরচ করতেছে তখন কি তার প্রতি আল্লাহ পাকের মায়া লাগবেনা ? রহমতের দরিয়া তার প্রতি উথলে উঠবে না? তিনি দেখবেন যে, যে ক্ষেত্রে আমি রাযী সেই ক্ষেত্রে সে দেখে, আর যেখানে আমি নারাজ সেখানে সে তার চোখের জ্যোতি ব্যবহার করেনা। আমাকে রাযী করার জন্য সে তার মনের আবেগ-আগ্রহ সমূহকে জলাঞ্জলি দিতেছে। আমার জন্য ‘দুঃখ-কষ্ট’ বরদাশত করতেছে। আল্লাহর রহমত এরূপ অন্তরকে আদর-সোহাগ করে। ভালবাসে। এমর্মে আমার একটি (মায়াময়) ছন্দ শুনুন
আমার বেদনাক্লিষ্ট ও দুঃখ জর্জরিত প্রাণের প্রতি তার এমনি ভাবে মায়া লাগে, যেভাবে মা অশ্রুসিক্ত নয়নে তার আদরের দুলালের মুখে চুমু খায়।
যে দিল এভাবে আল্লাহর জন্য বিরান হয়, চুর্ণ-বিচূর্ণ হয়, আল্লাহপাক সেই দিলে আসন গ্রহণ করেন। সেই দিলের উপর তিনি আনন্দ ও খুশীর বৃষ্টি বর্ষণ করেন।
যে হৃদয় আল্লাহর জন্য বিরান হয়, বিদীর্ণ হয়, বিচূর্ণ হয়, আমার আল্লাহ স্বয়ং সেই হৃদয়কে আবাদ করে দেন। হে মীর, আল্লাহর পথে, আল্লাহর মহব্বতে জান কোরবান করাকে তুমি বরবাদী মনে করেনা।
আমার প্রথম উস্তাদ হযরত শাহ আবদুল গনী ফুলপুরী (রঃ) বলতেন, সবুজ-সৰ্জীব গাছের পাশে যদি আগুন জ্বালাও তবে ঐ গাছের তাজা তাজা পাতাগুলো আগুনের উত্তাপে মরা মরা হয়ে যাবে। বড় মুশকিলে তা পুনরায় আগের মত শ্যামল ও সঞ্জীব হয়। সারা বৎসর ওর পিছনে মেহনত কর, সার দাও, পানি দাও। তারপর হয়তঃ ঐ পাতাগুলো নতুন জীবন লাভ করবে। তদ্রুপ, যিকির, এবাদত, বুযুর্গদের সোহবত প্রভৃতির দ্বারা অন্তরে যে নূর পয়দা হয়, একটি মাত্র কুদৃষ্টির দ্বারা সেই নূরানী হৃদয়ের সর্বনাশ ঘটে যায়। সেই অন্তরে পুনরায় যিকিরের নুর ও ঈমানের হালাওয়াত (রস-তুষ) বহাল হতে অনেক সময় লেগে যায়। কুদৃষ্টির যুলুম (কলুষ-কালিমা) সহজে দূর হয় না। বড়ই মুশকিল হয়। বহু তওবা-এস্তেগফার, কান্নাকাটি এবং কঠোরভাবে বারবার দৃষ্টি সংযত রাখার কষ্ট স্বীকারের পর হয়তঃ দ্বিতীয়বার অন্তরে সেই ঈমানী-হায়াত উজ্জীবিত হয়।
আমি সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি যে, আমাদের থেকে যে গুনাহ ছুটতেছেনা এর কারণ এই যে, আমরা হিম্মতকে এস্তেমাল করতেছিনা। গুনাহ ত্যাগের জন্য দৃঢ়সংকল্প, দৃঢ় মনোবল ও সৎসাহস প্রয়োগ করতেছিনা। যদি গুনাহ ত্যাগ করা কোন অসম্ভব কাজ হতো তাহলে আল্লাহপাক আমাদেরকে এই ভাষায় হুকুম দিতেন না যে
‘তোমরা প্রকাশ্য গুনাহু ও অপ্রকাশ্য গুনাহু বর্জন কর।’
আল্লাহ কর্তৃক আমাদেরকে এই হুকুম দান করা এর সুস্পষ্ট প্রমাণ যে, আমাদের মধ্যে গুনাহু ত্যাগের ক্ষমতা আছে। কারণ, আল্লাহপাক এমন কোন হুকুম দেন না যা আমাদের ক্ষমতার বাইরে।
“আল্লাহু কারো প্রতি তার ক্ষমতা বহির্ভূত কোন দায়িত্ব-কর্তব্য আরোপ করেন না।”
আসল ব্যাপার এই যে, আমরা আমাদের মনের প্রস্তাব মত কাজ করতেছি, মনের পক্ষে সায় দিতেছি, সাড়া দিতেছি। যাকে আজকালের ভাষায় বলা হয় মনের ‘ফ্যাবারে’ কাজ করতেছি। এজন্যই আমরা পাপের ফিভারে (জ্বরে) আক্রান্ত আছি। অথচ, এই মনই (নফছই) আমাদের সবচেয়ে বড় দুশমন। এর দুশমনীর সংবাদ দিয়েছেন স্বয়ং চির সত্যবাদী প্রিয়নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম—
‘তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু তোমার দুই পাঁজরের মধ্যখানে অবস্থিত (অর্থাৎ নফছ যাকে স্বেচ্ছাচারী মন বা বল্গাহীন প্রবৃত্তি বলা চলে।)’
বলুন, আপনার শত্রু যদি আপনাকে মিষ্টি পেশ করে তবে কি আপনি নির্ধিধায় তা গ্রহণ করেন ? নাকি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন যে, খোদা ভাল করুক, নাজানি এর মধ্যে বিষ-টিষ মিশিয়ে দিল কিনা? কিন্তু আফসোস, নফস নামক দুশমন আমাদেরকে কুদৃষ্টির সামান্য একটু মজা পেশ করলেই আমরা সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করে নিই। অথচ, দৃশ্যতঃ যদিও সে মজা পেশ করতেছে কিন্তু আসলে সে সাজার ব্যবস্থা করতেছে। কুদৃষ্টির পর আখেরাতের আযাব তো রয়েছেই, দুনিয়াতেও অন্তর সর্বদা অস্থির, অশান্ত থাকে। তার স্মরণে মন দুটফট করতে থাকে। রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কাটাতে হয় । ঘুম হারাম হয়ে যায় এবং আল্লাহ্ থেকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আযাব তাকে গ্রাস করে ফেলে।
কুষ্টির পাপ নেহায়েত আহাম্মকী পাপ। কারণ, পাওয়া তো যায়না কিছুই। অনর্থক অন্তরকে পোড়ানো হয়, যন্ত্রণার শিকার বানানো হয়। বলুন, পরের সম্পদের উপর লোভের নজর করা আহাম্মকী কিনা ? শুধু দেখলে কি তা পাওয়া যাবে? যা পাওয়া যাবেনা তার প্রতি দৃষ্টি করে করে মনে মনে জ্বলতে থাকা ও ছটফট করতে থাকা বোকার বোকামী ছাড়া আর কিছু? এবং ধরুন, যদি তা পাওয়াও যায় তবুও অশান্তির আগুন হতে তো কোন রক্ষা নাই। কারণ, হারাম রাস্তায় বা আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথে যে আনন্দ অর্জিত হয় তার মধ্যে অশান্তি, পেরেশানী ও লানার শত-সহস্র সাপ-বিচ্ছু থাকে যার দংশনে জীবনটা আষ্টেপৃষ্ঠে অতীষ্ঠ ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে সুখ-শান্তির স্বপ্ন দেখা চরম বোকামী ও চরম ধরনের গাধামি। কারণ, শান্তি, অশান্তি, দুখ ও আনন্দের স্রষ্টা ও আল্লাহ। তাই, যে বান্দা আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখে, আল্লাহকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য গুনাহ থেকে বাঁচার কষ্ট সহ্য করে অর্থাৎ আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য স্বীয় হৃদয় মনকে কষ্ট দেয়, ব্যথা-বেদনায় জরিত করে, আনন্দের কোন উপায়-উপকরণ ছাড়াই তার অন্তরে অসংখ্য অনন্দের সাগর ঢেউ খেলতে থাকে। আল্লাহ পাক তাকে এমন আনন্দ দান করেন যা রাজা-বাদশারা কোনদিন স্বপ্নে দেখতে পায় নাই।
পক্ষান্তরে, যে-ব্যক্তি আল্লাহকে নারাজ করে, আল্লাহ্পাক তার জীবনে তিক্ত, অতীষ্ঠ ও কণ্টকাবেষ্টিত করে দেন। আল্লাহপাক বলেন-
‘যে আমার স্মরণ হতে মুখ ফিরাবে, আমি তার জীবনকে কঠিন ও সংকটময় করে দিব।’
.
এশকে মাজাযী বা অসৎ প্রেম হতে মুক্তি লাভের পাঁচটি কাজ
যারা এশকে মাজাযী বা অসৎ প্রেমে (পুরুষে-পুরুষে কিংবা নারী-পুরুষে পার্থিব ভালবাসায়) আক্রান্ত আছে এবং এর ফাঁদ থেকে বের হতে চাচ্ছে, কিন্তু বের হতে পারছেনা, তারা যদি এই পাঁচটি কাজ করে তাহলে, ইনশাআল্লাহ তারা এ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে।
১- আল্লাহপাক যে “হিম্মত দান করেছেন তাকে কাজে লাগবে। (এখানে হিম্মত অর্থ, নেক কাজ করার বা বদকাজ ত্যাগের দৃঢ় ইচ্ছা করা, আন্তরিক চেষ্টা করা বা দৃঢ় মনে সচেষ্ট হওয়ার ক্ষমতা। – অনুবাদক)।
২- নিজে আল্লাহপাকের নিকট হিম্মতের জন্য দোআ করবে ।
৩- আল্লাহর খাস বান্দাদের দ্বারা, বিশেষতঃ নিজের দ্বীনী মুরব্বী বা উপদেশদাতার (উস্তাদ বা এলাহী মুরুব্বীর) দ্বারা ‘হিম্মত পানের জন্য দোআ করবে।
৪- নিয়মিত আল্লাহর যিকির করবে, এ বিষয়ে খুব যত্মশীল হবে।
৫- যে সব বস্তু বা যে সব কাজ পাপের দিকে নিয়ে যায়, পাপের ঐসব পথ বা উপকরণ হতে দূরে থাকবে। অর্থাৎ সকল সুশ্রী-ছূরত হতে অন্তরকেও মুক্ত রাখবে, দেহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও দূরে রাখবে। (অনুবাদক)।
কুদৃষ্টি ও অসৎ, ভালবাসার প্রতিকার সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা ইনশাআল্লাহ তায়লা সম্মুখে আসতেছে। মোটকথা, যত খারাপ অবস্থাই হোকনা কেন, অথবা অন্তরে যত খারাপ খেয়াল, খারাপ কামনাই পয়দা হোকনা কেন, মোটেই নিরাশ হবেন না। আসলে মহব্বতের এই শক্তিটা বড় মূল্যবান সম্পদ, যদি এর সদ্ব্যবহার করা হয়। যে ইঞ্জিনে পেট্রোল বেশী থাকে তা জাহাজকে সেরূপ প্রচণ্ড গতিতে উদ্ধে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তবে শর্ত এই যে, তার গতি সঠিক লক্ষ্যমুখী করে নিতে হবে। যদি ঐ জাহাজকে কা’বামুখী করে দেওয়া হয় তবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা তোমাকে কাবায় পৌছে দিবে। আর যদি তাকে মন্দিরমুখী করে দেওয়া হয় তাহলে অনুরূপ দ্রুতগতিতেই তোমাকে মন্দিরে পৌছে দিবে। এশক ও মহব্বতের শক্তি হচ্ছে পেট্রোল। যদি কোন ওলীআল্লাহর সোহবত ও বেশী-বেশী আল্লাহর যিকিরের দ্বারা একে সঠিক লক্ষ্যগামী করে দেওয়া হয় তবে এধরনের লোকেরা এত বেশী দ্রুতগতিতে আল্লাহর রাস্তা অতিক্রম করে যে, মহব্বতহীন লোকেরা বহু বহু বছরের মেহনত ও সাধনার দ্বারাও সেই পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনা। তাই ত দেখা গেছে যে, কোন কোন শরাবখোর ও বিপথগামী প্রেমিক আল্লাহর পথে এসেছে এবং কলিজাপোড়া এক ‘আহা’ বেরুতেই সে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। আল্লাহকে পেয়ে গেছে। যত প্রচণ্ড বেগে সে পার্থিব অন্যায় ভালবাসার দিকে ছুটে চলেছিল, ঠিক অনুরুপ প্রচন্ড গতিতে সে আল্লাহর দিকে উড়ে গেছে। তার প্রাণের বেদনা, জ্বালাময় দীর্ঘনিঃশ্বাস, কান্নাকাটি, অনুতাপ-অনুশোচনা, হৃদয়ের বিষন্নতা, বিদীর্ণতা, কোন খোদাপ্রেমিক ওলীর প্রতি তার প্রেমাসক্তি, প্রাণ কোরবান ও আত্মেসর্গ করণ এক পলকে এক মহতকালের মধ্যে তাকে যমীন হতে তুলে নিয়ে আরশে পৌঁছে দিয়েছে। এধরনের লোকদের সম্পর্কেই অধমের এই ছন্দ—
আগে লোকটার ভালবাসা ও উঠাবসা ছিল সুশ্রীমুখদের সাথে। আর এখন তার ভালবাসা, উঠা-বসা ও মেলামেশা আল্লাহর ওলীদের সাথে। অতএব, তোমরা কেহ তাকে ঘৃণা করোনা, হেয় মনে করোনা। কারণ, সেত এখন আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রাখে।
.
কুদৃষ্টি ও অসৎ প্রেমের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা
এখন আমি আমার ‘দস্তূরে তাযকিয়ায়ে নফছ’ পুস্তিকায় এতদসম্বন্ধে প্রতিকারমূলক যে ব্যবস্থাবলী উল্লেখিত আছে, যা কোরআন-হার্দীছ ও যুর্গানেদ্বীনের অমূল্যবাণী থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, নিম্নে তা উদ্ধৃত করতেছি। ইনশাআল্লাহ এর উপর আমল করলে কুদৃষ্টি ও অসৎ সম্পর্কের পুরানো হতে পুরানো ব্যাধি হতেও নাযাত নসীব হবে। একটা মেয়াদ পর্যন্ত নিম্নলিখিত মা’মূলাত (করণীয় কাজগুলো) নিয়মিত ঠিকঠিকভাবে পালন করলে ইনশাআল্লাহ এরুপ অবস্থা হবে, মনে হবে যেন আখেরাতের যমীনের উপর চলাফেরা করতেছি এবং জান্নাত-জাহান্নাম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতেছি। এবং দুনিয়ার মোহ-মায়া, স্বাদ-আনন্দ ও খাহেশতি সবকিছু তুচ্ছ মনে হবে।
১. তওবার নামায
প্রত্যহ কোন এক নির্দিষ্ট সময় নির্জন স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কাপড় পরিধান করে এবং সম্ভব হলে খোশবু লাগিয়ে নিয়ে প্রথমতঃ দুই রাকত নফল নামায তওবার নিয়তে পড়বে। নামাযের পর আল্লাহপাকের নিকট সর্বপ্রকার গুনাহ থেকে খুব এস্তেগফার করবে, খুব মাফ চাইবে। এরূপ বলবে যে, হে আল্লাহ, যেদিন আমি বালেগ হয়েছি সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমার চোখের দ্বারা যত খেয়ানত হয়েছে, যত গুনাহ্ হয়েছে, মনে মনে খারাপ চিন্তা-কল্পনার দ্বারা যত হারাম মজা গ্রহণ করেছি, অথবা আমার দেহের ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা যত হারাম স্বাদ ও আনন্দ উপভােগ করেছি, আয় আল্লাহ! আমি ঐ সবকিছু হতে তওবা করতেছি এবং ক্ষমা প্রার্থনা করতেছি এবং আমি পাক্কা এরাদা (দৃঢ় সংকল্প) করতেছি যে, ভবিষ্যতে কোন পাপের কাজ করে আপনাকে আমি নারাজ করবো না। আয় আল্লাহ, যদিও আমার পাপের কোন সীমা নাই, কিন্তু নিশ্চয়ই আপনার রহমাতের সাগর আমার পাপের চেয়ে অনেক বড়, অনেক প্রশস্ত। অতএব, আপনার সীমাহীন, কূল-কিনারাহীন রহমতের ওছীলায় আপনি আমার জীবনের সমস্ত গুনাহ সমূহ মাফ করে দিন। আয় আল্লাহ, আপনি ত বহুত বহুত ক্ষমাকারী এবং আপনি ক্ষমা করাকে ভালবাসেন। অতএব, আমার যাবতীয় দোষ-ত্রুটি, খাতা-কসুর আপনি আপন মেহেরবানী বশতঃ ক্ষমা করে দিন।
২. হাজতের নামায (মনে কোন উদ্দেশ্য স্থির করে যে নামায পড়া হয়।)
অতঃপর হাজতের (নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের) নিয়তে দুই রাকাত নামায পড়ে এই দোআ করবে যে, হে আল্লাহ, আমার অসংখ্য পাপরাশির দ্বারা ধ্বংস ও বরবাদ জীবনের প্রতি আপনি রহম (দয়া) করুন। আমার এছলাহ্ (সংশোধন) করে দিন। আমাকে নফছের (স্বেচ্ছাচারী মনের) গোলামী থেকে মুক্ত করে আপনার গোলামী ও ফরমাবদারীর (আনুগত্যের) ইযযতওয়ালা যিন্দেগী দান করে দিন। আপনার এই পরিমাণ ভয়-ভক্তি আমাকে দান করুন যা আমাকে আপনার সকল নাফরমানীর কাজ থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। আয় আল্লাহ, আপনার কাছে আমি শুধু আপনাকেই চাই।
আয় আল্লাহ। শত মানুষ আপনার কাছে শত কিছু চায়। আমার মাওলা, আপনার কাছে আমি শুধু আপনাকে চাই। আপনি যদি আমার হন তবে ত সবই আমার। আসমান আমার, যমীন আমার, চন্দ্র আমার, সূর্য আমার। আর যদি আপনি আমার না হন তাহলে ত আমার কিছুই নাই। তাহলে ত আমি সর্বহারা, কপালপোড়া।
শত জনে তোমার কাছে শতকিছু চায়
মাওলা ওগো, একাঙ্গালে চায় শুধু তোমায়। তুমি আমার, তো সবি আমার
আকাশ আমার, যমীন আমার,
তুমি যদি নওগো আমার
৩. নফী-এছবাতের যিকির
অতঃপর পাঁচশত বার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ যিকির করবে। লা-ইলাহা বলার সময় এরুপ খেয়াল করবে যে, আমার দিল্ (অন্তর) সমস্ত গায়রুল্লাহ্ (আল্লাহ্ ছাড়া সবকিছু) থেকে পাক-পবিত্র হচ্ছে। এবং ইল্লাল্লাহু বলার সময় এই খেয়াল করবে যে, আমার অন্তরে আল্লাহর মহব্বত দাখেল হচ্ছে (প্রবেশ করতেছে)।
৪. ইছমে-যাতের যিকির
প্রত্যহ কোন এক সময় এক হাজার বার আল্লাহ্-আল্লাহ্ যিকির করবে। যবানের দ্বারা, যখন আল্লাহ বলবে তখন এরূপ ধ্যান করবে যে, যবানের সাথে সাথে আমার অন্তর হতেও আল্লাহ শব্দ বের হচ্ছে। বড়ই মহব্বত ও ব্যথাভরা দিলে আল্লাহর নাম নিবে। আমরা আমাদের মা-বাপকে ছেড়ে দূরে কোথাও গেলে যেভাবে আমরা মনের বেদনা ও বিচ্ছেদ-ব্যথার সাথে আমাদের মা-বাপকে স্মরণ করি, কমছে-কম এতটুকু প্রাণের ব্যথা, এতটুকু প্রাণের জ্বালা সহ, তো আল্লাহর নাম আমাদের যানে আসা উচিত। অবশ্য অন্তরে যদি এতটুকু মহব্বত অনুভব না হয় তাহলে মাওলাপাগল-মহব্বতওয়ালা বান্দাদের নকল করলেও কাজ হবে। তাই, আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের মত ছূরত ধারণ করে এবং তাঁদের মহব্বতের নকল বা ঢং অবলম্বন করে আল্লাহর নাম নিতে শুরু করুন। আল্লাহর নাম বহুত বড় নাম। এই নাম যখন যবানে আসবে, কিছুতেই তা বৃথা যাবেনা, বরং অবশ্যই কাজে লাগবে। অবশ্যই উপকার হবে। অবশ্যই এতে নূর পয়দা হবে।
৫. মোরাকাবায়ে আলাম ইয়া’লাম বিআন্নাল্লাহা য়ারা বা মোরাকাবায়ে রূইয়ত:
অতঃপর আল্লাহপাকের বাছীর ও খাবীর হওয়ার মোরাকাবা করবে। বাছীর মানে তিনি সবকিছু দেখেন, খাবীর মানে তিনি সবকিছুর খবর রাখেন। অর্থাৎ কয়েক মিনিট এই ধ্যান করবে যে, আল্লাহ আমাকে দেখতেছেন। আমি সেই মাহবুব-হাকীমের (প্রকৃত প্রিয়জনের) সামনে বসা আছি। এবং খুব দোআ করতে থাকবে যে, আয় আল্লাহু, আপনি যে সব সময় আমাকে দেখতেছেন এই ধ্যানকে আমার অন্তরে খুব বদ্ধমূল করে দেন, যাতে করে আমি আর কোন গুনাহ না করতে পারি। কারণ, আমার অন্তরে এই ধ্যান যদি বদ্ধমূল হয়ে যায় যে, সর্বদা আপনি আমাকে দেখতেছেন, তাহলে আমি কোন পাপ করার সাহস পাবোনা, পাপে লিপ্ত হতে পারবো না।
আর মনে-মনে (অর্থাৎ ধ্যানের মধ্যে) আল্লাহর সঙ্গে এভাবে কথা বলবে যে, আয় আল্লাহ, যখন আমি গুনাহু করতেছিলাম, কুদৃষ্টি ইত্যাদি করতেছিলাম তখন আপনার কুদরতে-কাহেরাও (অপরাজেয় কহরী কুদূরতও) ঐ পাপে লিপ্ত অবস্থাতেই আমাকে দেখতেছিল। তখন যদি আপনি হুকুম দিতেন যে, হে যমীন, তুমি ফাঁক (বিদীর্ণ) হয়ে যাও এবং এই নালায়েককে গিলে ফেল, অথবা আপনি যদি হুকুম করতেন যে, হে নালায়েক, তুই ঘৃণ্য বান্দায় পরিণত হয়ে যা, তাহলে নিঃসন্দেহে আপনার হুকুমে তাই ঘটতো এবং শত শত মানুষ আমার অপমান, যিল্লতি ও লাঞ্ছনার তামাসা দেখতো। অথবা যদি ঐ মুহূর্তেই আপনি আমাকে কোন কঠিন যন্ত্রণাদায়ক ব্যাধিতে আক্রান্ত করে দিতেন তাহলে আমার কি দশা হতো! হে আল্লাহ, হে দয়ার সাগর, আপনার অপার করম (দয়া) ও হেলম্ (সহ শক্তি) আমাকে বরদাশত করতেছে এবং সেজন্য আপনার কহরী-শক্তি আমার নিকট হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করেনি। অন্যথায় আমার ধ্বংস ও বরবাদী সুনিশ্চিত ছিল।
৬. মউত ও কবরের মোরাকাবা
অতঃপর কিছুক্ষণ মুত্যুর কথা স্মরণ করবে যে, দুনিয়ার সকল প্রিয়জন, বিবিবাচ্চা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, চাকর-নেকর, সালাম দেনেওয়ালা, হুযূর হুযুর করূনেওয়ালা প্রভৃতি সকলকে ছেড়ে আমি পরপারের জন্য রওনা হয়ে গেছি। আমার মরে যাবার পর কাচি দ্বারা কেটে আমার শরীর থেকে কোর্তা-কাপড়গুলো খুলে ফেলা হচ্ছে। এখন আমাকে গোসল দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর এখন আমাকে কাফন পরানো। হচ্ছে। যেই ঘর-বাড়ীকে আমি আমার ঘর, আমার বাড়ী মনে করতাম, আমার আপনজনেরা, বিবি-বাচ্চারা জোর-জবরদস্তি করে আমাকে আমার সেই ঘর-বাড়ী হতে বের করে দিয়েছে। আমার যেই পঞ্চইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমি বিভিন্ন স্বাদ-রস আস্বাদন করতাম তা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেছে। যেই চোখের দ্বারা সুশ্রীদেহ সমূহ দেখে দেখে অন্তুরে হারাম মজা এহণ করতাম সেই চক্ষু এখন আর দেখার ক্ষমতা রাখেনা। (এখন আরসিনেমা-টেলিভিশনের রং-তামাসা দেখার কোন শক্তি নাই ।) কান আর গান-বাজনা শুনতে পারতেছেনা। রসনায় (মুখে) শামী-কাবাব ও মোরগ-পোলাউর স্বাদ গ্রহণের শক্তি নাই। বস্তুজগতের স্বাদ-আনন্দের সকল পথ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অন্তরের মধ্যে যদি এবাদত-বন্দেগী, তাওয়া-পরহেযগারীর নুর থেকে থাকে তবে একমাত্র তা-ই আমার কাজে আসবে। অন্যথায় আর সবকিছুই ত স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে।
অতঃপর এই ধ্যান করুন যে, এখন আমাকে কবরের মধ্যে শোয়ানো হচ্ছে। তারপর বাঁশ-চাটাই লাগানো হচ্ছে। এখন সকলে কবরে মাটি ফেলতেছে। এখন আমি নির্জন-কবরের মধ্যে কত মণ মাটির তলে চাপা পড়ে আছি। আমার বুকের উপর শুধু মাটি আর মাটি। এখানে আমার কোন সাথী নাই। যা কিছু নেক কাজ করেছিলাম একমাত্র তা-ই এখন উপকারে আসবে। কবর হয়ত জান্নাতের বাগান সমূহের মধ্য হতে একটি বাগান অথবা দোযখের গর্ত সমূহের মধ্য হতে একটি গর্ত।
মৃত্যুর কথা বেশী বেশী স্মরণ করার দ্বারা হৃদয়-মন দুনিয়া-বিরাগী হয়ে যায়, দুনিয়ার মোহ-মায়া থেকে মন উঠে যায় এবং আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণের তথা নেক কাজ নেক আমলের তওফীক লাভ হয়। জামেউছ ছগীর কিতাবের প্রথম খণ্ডের ৫৩ পৃষ্ঠায় বর্ণিত একটি হাদীছ শরীফে আছে যে, সকল স্বাদ-আনন্দের বিচুর্ণকারীকে অর্থাৎ মৃত্যুকে তোমরা বেশী-বেশী স্মরণ কর। অতএব, মৃত্যুর ধ্যান এত বেশী পরিমাণে করবে যেন মৃত্যুর আতঙ্কের স্থলে মৃত্যুর প্রতি আগ্রহ ও আসক্তি পয়দা হয়ে যায়। অপ্রিয় এই মৃত্যু যেন এখন মনের কাছে প্রিয় হয়ে যায়।
আসলে মোমেনের জন্য মৃত্যু হচ্ছে মাহবুবে-হাকীকীর (আল্লাহর) পক্ষ হতে মোলাকাতের (সাক্ষাতের) পয়গাম। মৃত্যুর পর ত মোমেনের শুধু আরাম আর আরম, শান্তি আর শান্তি।
৭. হাশর-নশরের মোরাকাবা
অতঃপর কয়েক মিনিট এই ধ্যান করবে মে, হাশরের ময়দান কায়েম হয়ে গেছে। এবং হিসাব-নিকাশের জন্য আমি আল্লাহপাকের সামনে দণ্ডায়মান আছি। আল্লাহপাক বলতেছেন, হে বে-হায়া, তোর কি একটুও শরম লাগলোনা যে, তুই আমাকে ত্যাগ করে অন্যের উপর নজর করলি? যে নাকি অচিরেই মরে লাশ হবে, তুই আমাকে ছেড়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হলে? বল, এই ছিল তোর উপর আমার হক? এই ছিল আমার প্রতি তোর কর্তব্য? আমি কি তোকে এজন্যই সৃষ্টি করেছিলাম যে, তুই অন্যদের উপর উৎসর্গ হবি, অন্যদেরকে ভালবাসবি আর আমাকে ভুলে যাবি? আমি কি তোর চোখের মধ্যে দৃষ্টিশক্তি এজন্য দান করেছিলাম যে, তুই তা হারাম ক্ষেত্রে ব্যবহার করবি? হে বে-হায়, বেশরম, তুই আমার দেওয়া বস্তু সমূহকে, আমার দেওয়া চোখ-কান-প্রাণকে তুই আমার নাফরমানীর কাজে ব্যবহার করতে তোর কি একটুও লজ্জা হলোনা?
অতঃপর এই ধ্যান করবে যে, এখন অপরাধীদের সম্পর্কে হুকুম জারী হচ্ছে যে–
ধর এই নালায়েককে। ওকে জিঞ্জির পরিয়ে দাও। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।
এরপর খুব মিনতি সহকারে কেঁদে-কেঁদে আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে। আমল আখলাকের এছলাহ (সংশোধন) ও ঈমানের সাথে মৃত্যুর জন্য দোআ করবে। এবং আল্লাহর আযাব ও গযব হতে পানাহ চাইবে।
৮. জাহান্নামের আযাবের মোরাকাবা
তারপর এভাবে দোযখের আযাবের মোরাকাবা করবে যে, জাহান্নাম এখন আমার চোখের সামনে আছে। এবং আল্লাহপাকের সঙ্গে এভাবে কথা বলবে যে, আয় আল্লাহ, এই জাহান্নাম ত আপনার হুকুমে প্রজ্জ্বলিত আগুন।
আয় আল্লাহ, এই আগুনের কষ্ট ও দাহ এদের অন্তর পর্যন্ত পৌঁছতেছে।
আয় আল্লাহ্! জাহান্নামী লোকেরা আগুনের লম্বা-লম্বা স্তম্ভের নীচে চাপা পড়ে জ্বলছে আর কাতরাচ্ছে।
আয় আল্লাহ! যখন তাদের চামড়া সমূহ পুড়ে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল, তখন আপনি তাদের সেই চামড়া সমূহকে সম্পূর্ণ তাজা চামড়ায় রূপান্তরিত করে দিলেন যাতে তাদের দুঃখ-কষ্ট ও জ্বালা-যন্ত্রণা আরো বৃদ্ধি পায়।
আয় আল্লাহ! যখন তাদের ক্ষুধা লাগলো তখন তাদেরকে কাটাদার যাকূম গাছ খেতে দেওয়া হলো। এবং তা এমনও নয় যে, কাটার কষ্টের দরুণ খেতে না পারলে তারা অস্বীকার করতে পারবে, বরং বাধ্য হয়ে তাদেরকে পেট ভরে খেতেই হবে।
আয় আল্লাহ। যখন তাদের পিপাসা লাগলো তখন আপনি তাদেরকে ফুটন্ত গরম পানি খেতে দিলেন। এবং তারা তা পান করতে অস্বীকারও করতে পারবেনা বরং পিপাসার্ত উট যেভাবে ডগডগ করে পান করতে থাকে তারাও তদ্রুপ পান করতেই থাকবে। প্রতিদান দিবসে এই হবে তাদের মেহমানদারী।
আয় আআল্লাহ! যখন তাদেরকে ফুটন্ত গরম পানি পান করানো হবে এতে তাদের নাড়িভুড়ি কেটে টুকরা টুকরা হয়ে তাদের মলদ্বার দিয়ে বের হয়ে যাবে।
এবং আয় আল্লাহ! এই জাহান্নামী লোকগুলি আগুন ও ফুটন্ত গরম পানির মাঝে ছুটাছুটি করতে থাকবে। একবার আগুনের দিকে যাবে, একবার গরম পানির দিকে যাবে। আবার অনুরূপ করবে এবং করতে থাকবে।
আয় আল্লাহ। যখন তারা কাঁদতে চাইবে, তো পানির অশ্রুর বদলে রক্তের অশ্রু ঝরবে। এবং অসহনীয় কষ্টের ফলে যখন তারা ভাগতে চেষ্টা করবে তখন তাদেরকে পুনরায় জাহান্নামের ভিতর ঠেলে দেওয়া হবে।
আয় আল্লাহ! এদের সকল চেষ্টাই যখন ব্যর্থ হবে তখন তারা আপনার নিকট ফরিয়াদ করার অনুমতি চাইবে। তখন আপনি তাদেরকে গোস্বাভরে বলবেন—
‘লাঞ্ছিত-অপমানিত হয়ে এই জাহান্নামের মধ্যেই পড়ে থাক এবং তোমরা আমার সাথে কোন কথা বলবেনা।’
আয় আল্লাহ! আমরা ত এই দুনিয়ার আগুনের একটি অঙ্গারই সহ্য করতে পারিনা। তাহলে জাহান্নামের আগুন যা দুনিয়ার আগুনের চেয়ে সত্তর গুণ বেশী তেজ হবে তা আমি কিরূপে সহ্য করবো।
আয় আল্লাহ! আমার আমল ও কার্যকলাপ ত জাহান্নামেরই উপযুক্ত । আপনার অকূল-অসীম রহমতের কাছে আমার কাতর ফরিয়াদ, দয়া করে জাহান্নামের যন্ত্রণাদায়ক আযাব হতে আমাকে রক্ষা করুন। আমার জন্য আপনি মুক্তি মঞ্জুর করুন।
উপরোক্ত এই দোআটি কেঁদে-কেঁদে তিনবার আরয করবে। কান্না না আসলে ক্রন্দনকারীদের ভান করবে। ক্রন্দনকারীর আকৃতি ধারণ করবে। প্রত্যহ পাবন্দির সাথে এই আমলটি জারী রাখবে। ইনশাআল্লাহ্, ধীরে ধীরে ঈমানের মধ্যে তরক্কী হতে থাকবে। এবং এর বরকতে এমন একদিন আসবে যে, জাহান্নাম বিলকুল চোখের সামনে মনে হবে। তখন আর কোন নাফরমানীর হিম্মত হবেনা। এবং সর্বপ্রকার শুনাহ থেকে সম্পূৰ্ণরূপে বেঁচে থাকার তওফীক নসীব হবে ইনশাআল্লাহু তাআলা।
৯. মোরাকাবায়ে এহছানাত (আল্লাহপাকের অনুগ্রহ রাশির মোরাকাবা)
অতঃপর নিজের প্রতি আল্লাহপাকের এহ্ছানাত ও অনুগ্রহ রাশির এভাবে মোরাকাবা করবে এবং আল্লাহপাকের নিকট এরূপ আরয করবে যে, আয় আল্লাহ। আমার রূহ্ কখনও আপনার নিকট সৃষ্টি হওয়ার জন্য বা অস্তিত্ব লাভের জন্য কোন দরখাস্ত করে নাই। আপনার দয়া ও করম বিনা-দরখাস্তে আমাকে অস্তিত্ব দান করেছে। তদুপরি আমার রূহ্ ত এই দরখাস্তও করে নাই যে, আমাকে আপনি মানুষের দেহ দান করুন। ইচ্ছা করলে আপনি আমাকে শূকর ও কুকুরের দেহের মধ্যেও স্থাপন করতে পারতেন। ফলে আমি হতাম একটা শূকর কিংবা কুকুর। আয় আল্লাহ! তা না করে আমার কোনও আর্যি ব্যতিরেকে আপন করুণায় আপনি আমাকে সৃষ্টির সেরা মানুষের দেহ দান করেছেন। আমাকে মানুষ বানিয়েছেন।
তদুপরি, হে আমার আল্লাহ! আপনি যদি আমাকে কোন কাফের-মোশরেকের ঘরে সৃষ্টি করতেন তাহলে নাজানি কত ভয়াবহ ক্ষতি ও বরবাদীর শিকার হয়ে যেতাম । ঐ অবস্থায় যদি আমি কোন দেশের প্রেসিডেন্ট কিংবা বাদশাও হয়ে যেতাম, তবুও কাফের-মোশরেক হওয়ার দরুণ আমি জন্তু জানোয়ার অপেক্ষা ঘৃণ্য ও নিকৃষ্ট হতাম। আপন দয়ায় আমাকে মুসলমানের ঘরে সৃষ্টি করে আপনি যেন আমাকে শাহজাদা রূপে সৃষ্টি করেছেন। ঈমানের মত বিরাট নেয়ামত যার সামনে পৃথিবীর সমস্ত নেয়ামত এবং সমস্ত রত্নভাণ্ডারের কোন মূল্য নাই, বিনা-চাওয়ায় আপনি আমাকে এত বড় অমুল্য নোমত দান করেছেন। আয় আল্লাহ, বিনা দরখাস্তেই যখন আপনি এত বড় বড় এবং এত অসংখ্য নেআমত দান করেছেন তাহলে দরখাস্তকারীকে আপনি কিরূপে মাহরুম করবেন?
আমার অপার করুণার আধার মাওলার কাছে কেহ যদি একটি ফোটা চেয়েছে, তো তিনি তাকে এক সাগর দান করেছেন। সেইসঙ্গে কত অমুল্য মনিমুক্তাও দান করে দিয়েছেন।
আয় আল্লাহু, বিনা-দরখাস্তে আপনি আমার প্রতি যে অজস্র অনুগ্রহ করেছেন সেই-অনুগ্ৰহরাশির ওছীলা দিয়ে আমি আপনার কাছে ফরিয়াদ করতেছি, দয়া করে আপনি আমার এছলাহ করে দিন। আমার অন্তর-আত্মাকে সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে দিন। যেন মৃত্যু পর্যন্ত আমি আপনার সকল নাফরমানী হতে সম্পূর্ণ মুক্ত ও বিরত থাকতে পারি।
আয় আল্লাহ! আপনি আমাকে ভাল ঘরে, ভাল বংশে সৃষ্টি করেছেন। আপনি আমাকে আপনার নেক-বান্দাদের প্রতি মহব্বত দান করেছেন। এবং দ্বীনের উপর আমলের তওফীক দান করেছেন। অন্যথায় আপনি যদি পথ প্রদর্শন না করতেন তাহলে আমার কোন উপায় ছিলনা। কারণ, বহুলোক মুসলমানের ঘরে পয়দা হওয়া সত্ত্বেও বদদ্বীন, নাস্তিক ও পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। এবং আয় আল্লাহ! আপনারই দয়ায় আল্লাহওয়ালাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের তওফীক হয়েছে। এবং আপনি হকপন্থীদের সাথে সম্পর্ক নছীব করেছেন। অন্যথায় যদি কোন বদদ্বীন, ভণ্ড বা আনাড়ীর হাতে পড়ে যেতাম তাহলে আজ আমি গোমরাহীর শিকার থাকতাম। আয় আল্লাহ! দুনিয়াতে আপনি ছালেহীনের (নেককারদের) সঙ্গ দান করেছেন। দয়া করে আখেরাতেও ছালেহীনের সঙ্গ নসীব করুন। আয় আল্লাহ, কত অসংখ্য পাপ আমার দ্বারা সংঘটিত হয়েছে, তখন আপনার কহরী-কুদরত (মহাপরাক্রমী রাজশক্তি) তা প্রত্যক্ষ করতেছিল। কিন্তু আপনি আপনার ক্ষমা ও সহনশীলতার অচল-তলে আমার ঐ সমস্ত পাপরাশিকে ঢেকে রেখেছেন। এবং আপনি আমাকে অপমানিত করেন নাই। আয় আল্লাহ! আমার মত নালায়েকের অসংখ্য নালায়েকী আপনার হেলমের ছেফতের দ্বারা আপনি বরদাশত করেছেন। আয় আল্লাহ! আমার লাখো-কোটি জান্ আপনার সেই হেলমের (সহাশক্তির গুণের) উপর কোরবান। অন্যথায় আজও যদি আমার সকল গোপন বিষয়াদি আপনি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন তাহলে কোন মানুষ আমাকে তার কাছে বসতেও দিবেনা ।
আয় আল্লাহ, আপন করমে আমার জন্য ঈমানের সাথে মৃত্যু মঞ্জুর করুন। আয় আল্লাহ! সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী জান্নতীদের সাথে আপনি এই অধমকেও কবুল করুন ও তাদের অন্তর্ভূক্ত করুন।
মোটকথা, এভাবে এক-একটি নোমতের কথা চিন্তা করবে যে, আল্লাহপাক আমাকে মাল-দৌলত, ইত-আক্র, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা ইত্যাদি দান করেছেন। এক এক নেয়ামতের খেয়াল করবে ও খুব প্রাণভরে শোকর আদায় করবে।
সবশেষে আল্লাহপাকের নিকট আরয করবে যে, আয় আল্লাহ, আপনার নেআমত, এহছান ও অনুগ্রহনয়াজি এত অনন্ত ও অসীম যে, সেগুলোর কথা স্মরণে আনা বা অন্তরে উপস্থিত করাও অসম্ভব। আয় আল্লাহ, আপনার সীমাইনি নেয়ামত ও অনুগ্রহের মধ্য হতে যা-যা আমি স্মরণ করতে পেরেছি এবং যেগুলো স্মরণ করা সম্ভব হয় নাই, আমার দেহের প্রতিটি পশম, প্রতিটি বিন্দুর যবানে এবং বিশাল এই পৃথিবীর প্রতিটি অণু-পরমাণুর অসংখ্য যবানে আমি আপনার সমস্ত নেয়ামতের শোকর আদায় করতেছি। আয় আল্লাহ! দয়া করে আপনি আমার নফছের এছলাহ ও তাযকিয়ার ফয়সালা করুন। পূর্ণ সংশোধন ও পরিমার্জনের ফয়সালা করুন।
১০. নজর হেফাযতের আপ্রাণ চেষ্টা
যারা শহরে বা বাজারে যাতায়াত করে থাকেন তার ঘর থেকে বের হওয়ার আগে দুই রাকাত হাতের নামায পড়ে দোআ করে নিবেন যে, আয় আল্লাহ, আমি আমার চক্ষুদ্বয় ও আমার অন্তরকে আপনার হেফাযতে রাখতেছি। নিশ্চয় আপনি সর্বোত্তম হেফাযতকারী। অফিস-আদালতে, দোকানপাটে এবং বাজারে থাকা অবস্থায় যথাসম্ভব উযু সহকারে থাকবেন। এবং যিকিরে মশগুল থাকবেন। তারপরও যদি কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে যায় তাহলে ঘরে ফিরে এস্তেগফার করে নিবেন। আল্লাহর কাছে খুব মাফ চেয়ে নিবেন। এবং প্রতি বারের অন্যায়ের জন্য জরিমানা স্বরূপ চার রাকআত নফল নামায পড়বেন। সামর্থ্য অনুসারে কিছু আর্থিক জরিমানা আদায় করবেন। অর্থাৎ কিছু টাকা-পয়সা সদকা করে দিবেন। নিজের উপর এই নিয়ম চালু রাখবেন। আর যদি হেফাযতে থাকার তওফীক হয় তাহলে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করবেন।
১১. রূপ-সৌন্দর্যের ধ্বংসের মোরাকাবা
যদি হঠাৎ কখনও কোন সুশ্রী-চেহারার উপর নজর পড়ে যায় তাহলে সাথে সাথে কোন বিশ্রী-চেহারার দিকে তাকাবে। যদি সামনে না থাকে তাহলে মনে-মনে একটি বিশ্রী-আকৃতির মানুষের ছবি কল্পনা করবে যার চেহাৱা একেবারে বিদঘুটে কালো, সমস্ত মুখে বসন্তের সাপ, চেপ্টা নাক, লম্বা লম্বা দাঁত। কানা। মাথায় টাক পড়া। মোটা ও বেটা দেহ। ভুড়ি বের হয়ে আছে। ঘন-ঘন পাতলা পায়খানা হচ্ছে। তার পায়খানার উপর ও তার আশপাশে অসংখ্য মাছি পড়তেছে আর ভনভন করতেছে। অতঃপর খেয়াল করবে যে, আজ যাকে প্রিয় ও সুন্দর লাগতেছে একদিন তারও এই পরিণতি হবে।
তাছাড়া এও চিন্তা করবে যে, এই সুশ্রী লোকটি যখন মারা যাবে তখন তার লাশ পচে-গলে কিরূপ বিশ্রী-বীভৎস দেখা যাবে। শত শত কীড়া তার পচা গাল ও গোশ ইত্যাদির উপর হাটতে থাকবে এবং মজাছে ভক্ষণ করতে থাকবে। পেট ফুলে ফেটে যাবে এবং এত দুর্গন্ধ হবে যে, ওদিকে নাক দেওয়াই মুশকিল হয়ে যাবে। অতএব, কেন আমি পচনশীল, মরণশীল, ধ্বংসশীল এরূপ বস্তুর প্রতি অনুরক্ত হবো।
তবে স্মর্তব্য যে, কোন বিশ্রী-ছূরাতের এরূপ কল্পনার দ্বারা সাময়িক উপকার হবে বটে। পরে আবারও তাযাকা পয়দা হবে। অন্তরে আবার সেই সুশ্রীমুখের প্রতি আবেগ-অনুরাগ জাগবে। তাই ভবিষ্যতে সেই তাযাকা ও আবেগকে দুর্বল করার পদ্ধতি এই যে, হিম্মত করে ঐ আকার অনুকূলে সাড়া দান থেকে বিরত থাকবে। মনের আবেগ পুরা করবে না। বরং কঠোরভাবে তার বিরোধিতা করবে। এবং বেশীবেশী আল্লাহ্ তাআলাকে স্মরণ করবে। অন্তরে আল্লাহর আযাবের ধ্যান জমাবে।
১২. কুদৃষ্টির ক্ষতি ও ধ্বংসাত্মক পরিণতির মোরাকাবা
কুদৃষ্টির ক্ষতি ও ধ্বংসলীলার কথা চিন্তা করবে যে, ইহা এমনই এক ধ্বংসাত্মক ব্যাধি যে, এই ব্যাধির শিকার হয়ে বহু লোক শেষ পর্যন্ত কাফের হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। অর্থাৎ কুদৃষ্টির অশুভ প্রতিক্রিয়ায় অসৎ প্রেমে লিপ্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত আর তা থেকে মুক্ত হতে পারেনি এবং মৃত্যুকালে মুখ দিয়ে কালেমার বদলে কুফরী কথা উচ্চারিত হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ্।
আমার উস্তাদ ও আমার মাহামান্য মুরব্বী হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক ছাহেব (দামাত বারাকাতুহু) দৃষ্টি সংযত রাখার ব্যাপারে অতীব গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো হেদায়াত সম্বলিত একটি ব্যবস্থাপত্র রচনা করেছেন। এখানে তা উদ্ধৃত করতেছি। স্বীয় এছলাহের উদ্দেশ্যে প্রত্যহ একবার তা পাঠ করবেন।
.
নজরের হেফাযতের জন্য মুহীউচ্ছুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক ছাহেব (দামত বারাকাতুহুম)-এর অমূল্য ব্যবস্থাপত্রঃ
কুদৃষ্টির ক্ষতি এত ব্যাপক ও এত ভয়বহ যে, অনেক সময় এর পরিণামে দুনিয়া আখেরাত উভয়ই ধ্বংস হয়। বর্তমানে এই আত্মিক ব্যাধির শিকার হওয়ার আসবাব ও উপসর্গ সমূহ ব্যাপক ভাবে বিস্তার লাভ করতেছে। তাই, এর অপকারিতা ও এ থেকে বাঁচার জন্য কিছু প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা লিখে দেওয়া মুনাসিব মনে হলো। যাতে করে এর সমূহ ক্ষতি থেকে বাঁচা যেতে পারে। সুতরাং নিম্নলিখিত বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে পালন ও অনুসরণ করলে সহজেই নজরের হেফাযত সম্ভব হবে।
১. যখন মেয়েরা যেতে থাকে তখন আপ্রাণ চেষ্টা করে দৃষ্টি নীচু রাখা, চাই মন তাদেরকে দেখার জন্য যতই অস্থির হয়ে উঠুকনা কেন।
যেমন হিন্দুস্থানী আরেফ হযরত খাজা আযীযুল হাসান মজমূব (রঃ) বলেছেন
দেখ, সাবধান, এখানে তোমার দ্বীন ঈমান ধ্বংস হওয়ার আশংকা আছে। অতএব, কিছুতেই যেন এখানে কোন নারীর প্রতি তোমার নজর না যায়। এরূপ ক্ষেত্রে মাথা নীচু করে, নজর নীচু করে চলাই তোমার কর্তব্য।
২. যদি হঠাৎ কারুর উপর নজর পড়ে যায় তাহলে সাথে সাথে দৃষ্টি নীচু করে ফেলবে। এতে যত কষ্টই হোকনা কেন, এমনকি প্রাণ বের হয়ে যাওয়ারও যদি আশংকা হয় তবুও।
৩. চিন্তা করবে যে, চোখের হেফাযত না করলে দুনিয়াতেই যিল্লতি ও অপমানের আশংকা আছে। তা ছাড়া এর ফলে এবাদতের নূর ধ্বংস হয়ে যায়। তদুপরি আখেরাতের বরবাদী তো সুনিশ্চিত।
৪. কুদৃষ্টি হয়ে গেলে অবশ্যই এক সাথে বার রাকাত নফল নামায পড়া। সেই সাথে সামর্থ অনুযায়ী কিছু হকা-খয়রাত করা ও বেশী বেশী এস্তেগফারের এহতেমাম (সযত্ন প্রচেষ্টা) করা।
৫. এরূপ চিন্তা করবে যে, কুদৃষ্টির কুৎসিত কালিমার দ্বারা অন্তরের মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয় এবং কৃদৃষ্টির কালিমা অনেক দেরীতে দূর হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত পুনরায় মনের আগ্রহ সত্ত্বেও বারবার চোখের হেফাযত না করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত অন্তর পরিষ্কার হয় না ।
৬. চিন্তা করবে যে, কুদৃষ্টির দরুণ মনে আকর্ষণ পয়দা হয়। আকর্ষণের পর ভালবাসা জন্যে, এবং সেই ভালবাসাই পরে প্রেমের রূপ নেয়। আর নাজায়েয প্রেমের দ্বারা দুনিয়া-আখেরাত উভয়ই বরবাদ হয়।
৭. এই কথা চিন্তা করবে যে, কুদৃষ্টির ফলে আস্তে আস্তে এবাদত-বন্দেগী ও যিকির-শোগলের প্রতি আগ্রহ-অনুরাগ হ্রাস পেতে থাকে। এমনকি, এক পর্যায়ে সব ছুটে যায় । অতঃপর এবাদত ও যিকির-শোগল ইত্যাদি খারাপ লাগতে শুরু করে। নাউযুবিল্লাহ।
.
অসৎ প্রেম দমনের জন্য আরও কিছু জরুরী কাজ
কুদৃষ্টির অশুভ প্রতিক্রিয়া বশতঃ যদি অসৎ প্রেমে আক্রান্ত হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে এমতাবস্থায় উল্লেখিত বিষয়াদির পাশাপাশি আরও কয়েকটি কাজ করতে হবে।
১. ঐ মাশুকের সাথে সর্ব প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করবে। অর্থাৎ তার সাথে কথা বলা, তার প্রতি দৃষ্টি করা, তার সাথে উঠা-বসা করা, চিঠিপত্র দেওয়া বা কখনও কখনও সাক্ষাত করা এসবকিছু সম্পূৰ্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি, অন্য কেহ যদি তার কথা আলোচনা করতে শুরু করে তবে তাকে বাধা দিবে (অথবা সরে যাবে) এবং তার এত বেশী দূরে অবস্থান করবে ও এতটা দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। যাতে করে তার সাক্ষাতের সম্ভাবনাই না থাকে, বরং ভুলেও যেন তার উপর নজর পড়ার কোন সম্ভাবনাও না থাকে। মোটকথা, সম্পূর্ণরূপে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
২. যদি তার আগমনের আশংকা অনুভব হয় তবে ইচ্ছাকৃত ভাবে তার সাথে ঝগড়া করে নিবে যাতে করে তার মনে বন্ধুত্ব রক্ষার আর কোন আশাই অবশিষ্ট না থাকে।
৩. ইচ্ছাকৃত ভাবে তার কথা স্মরণ করবে না। অতীতের বিষয়াদি স্মরণ করেও স্বাদ গ্রহণ করবে না। কারণ, এটা অন্তরের খেয়ানত যা অতি শক্ত গুনাহ-গুনাহে কবীরা। এতে অন্তরের সর্বনাশ ঘটে যায়। এবং এর ক্ষতি কুদৃষ্টির ক্ষতি অপেক্ষা বেশী মারাত্মক।
৪. প্রেমের কবিতা, প্রেমের কাহিনী ও নভেল পাঠ করবে না। সিনেমা, টিভি, ডিসি আর, উলঙ্গ-অশ্লীল ছবি বা যৌন উত্তেজনা উদ্দীপক ছবি দেখা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকবে। এবং যেখানে উলঙ্গপনা, অশ্লীলতা ও নাফরমানী বিদ্যমান আছে তথা হতে দূরে থাকবে। নাফরমানদের সংস্রবে থাকবে না।
৫- দুনিয়াবী প্রেমিক-প্রেমিকাদের গাদ্দারী ও নিষ্ঠুরতার কথা স্মরণ করবে যে, কেহ তার প্রতি যতই ধন-দৌলত, মান-ইযযত ও প্রাণ উৎসর্গ করুক না কেন, কিন্তু যদি তার মন আরেক জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায় অথবা তুলনামূলক বেশী সম্পদশালী কেউ মিলে যায় তাহলে সে সাবেক প্রেমিক হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে আদৌ পরোয়া করে না। এমনকি, অনেক সময় তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বা অন্য-কথায়, পথের কাঁটা সরানোর জন্য বিষ প্রয়োগ করে তাকে হত্যাও করে ফেলে।
৬-চিন্তা করুন যে, ঐ প্রিয়জন যদি মারা যায় তাহলে আপনি দ্রুততর তাকে নিয়ে কবরস্তানে পৌছিয়ে দেন। আর যদি আপনার মৃত্যু আগে হয় তাহলে আপনার ঐ প্রিয়জন আপনার লাশ দেখে ঘৃণা বোধ করবে। অথবা যদি দুইজনের যেকোন একজনের শ্রী নষ্ট হয়ে চেহারা অসুন্দর হয়ে যায় তাহলে সমস্ত প্রেম-ভালবাসাই মুহূর্তের মধ্যে বরফে পরিণত হবে। তখন মনে হবে, হায়, এসবই ত ছিল এক প্রতারণা। এত ক্ষণস্থায়ী ক্ষণভঙ্গুর যে ভালবাসা, এও কি কোন ভালবাসা? হাকীমুলউম্মত হযতর থানবী (রঃ) তাঁর আত্-তাশাররুফ কিতাবের তৃতীয় খন্ডের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় একটি হাদীছ উল্লেখ করেছেন–
তুমি যাকে ইচ্ছা ভালবাস। একদিন তুমি তার থেকে অবশ্যই আলাদা হবে।
৭. এই ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখিত অন্যান্য সব কাজগুলো ঠিক ঠিক ভাবে আঞ্জাম দিবে। এতে করে আস্তে আস্তে তাকাযা (পাপের আগ্রহ) দুর্বল হতে থাকবে। এরূপ আকাংখা করবেনা যে, তাকাযা যেন একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়।
কারণ, কাম্য শুধু এতটুকুই যে, তাকায় যেন এতটা কমজোর ও স্তিমিত হয়ে যায় যে, সহজেই তাকে কাবু করা যায় বা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। উল্লেখিত নিয়মাবলীর উপর আমল করলে ইনশাআল্লাহ নফছ একদিন কাবু হবেই, নিয়ন্ত্রণে আসবেই। এবং গায়রুল্লাহর মহব্বত হতে নাজাত নসীব হবেই। এবং হৃদয়-মনে এমন এমন নেআমত অনুভব হবে যা সর্বদা হৃদয়-মনকে আনন্দমস্তু ও নেশাগ্রস্ত রাখবে। অন্তরে এমন অনাবিল শান্তি অনুভব হবে যে, রাজা-বাদশারা কোনদিন তা স্বপ্নেও দেখতে পায় নাই। এবং এরূপ মনে হবে যে, একটা দোযখী-জিন্দেগী জান্নাতী-জিন্দেগী লাভ করেছে।
আল্লাহর জন্য সাধনা ও কষ্ট স্বীকারের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহপাকের জন্য আধা জান পেশ করে। তিনি তা গ্রহণ করেন এবং আধা জানের বদলে শত শত জন্য তাকে দান করেন। এবং তার অন্তরে এমন-এমন নেয়ামত দান করেন যা তোমরা কল্পনাও করতে পারনা।
দোআ করি, আল্লাহপাক উল্লেখিত নিয়মাবলীকে নফছের যাবতীয় দুষ্টামী ও খারাবি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ‘উত্তম অবলম্বন’ রূপে কবুল করেন। এর ওছীলায় গায়রুল্লাহর সকল সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দেন। এবং আমার এই প্রচেষ্টাকে তিনি কবুলিয়তের মর্যাদায় ভূষিত করেন।
.
বিশেষ স্মর্তব্য—
প্রত্যহ দুই রাকাত নফল পড়ে খুব কাকুতি-মিনতির সাথে নফছের এছলাহ ও তাযকিয়ার জন্য আল্লাহপাকের নিকট দোআ করবে। কারণ, আল্লাহর দয়া ও করুণা ব্যতীত কারুরই নফছ পবিত্র হতে পারে না। আল্লাহর রহমত ও করম ব্যতীত এই নেআমত কেহই পেতে পারে না।
Leave a Reply