• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

কবিতাসমগ্র ১ – সুবোধ সরকার

লাইব্রেরি » সুবোধ সরকার » কবিতাসমগ্র ১ – সুবোধ সরকার

কবিতাসমগ্র ১ – সুবোধ সরকার

কবিতাসমগ্র ১ – সুবোধ সরকার

প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০১৪

পৌলোমী ও ব্রাত্য বসুকে
বিপ্লব নয়, বন্ধুত্বই দীর্ঘজীবী হল
আরও হবে।

ভূমিকার বিরুদ্ধে ভূমিকা

আমি কোনও থিয়োরির গেটকিপার নই। কোনও সৌন্দর্যের দারোয়ান নই। আমার কোনও অ্যাটাচি কেস নেই যে তার ভেতরে একটা পর্বতমালা নিয়ে আমি বিমানে উঠে পড়ব। আমি চেয়েছিলাম কবিতাই লিখতে, একটা লোক এসে বলল, আপনি যা লিখছেন, একে কবিতা বলে না, বলে অ্যান্টি-পোয়েট্রি। সেটাই বা কী বস্তু? সেটা বুঝতেই যৌবন চলে গেল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আমাকে উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে পারবেন?

তিনি বললেন, শিয়োর। মিস্টার রামোকৃষ্ণের গল্পটা ধরুন। ফাইভ ব্লাইন্ড মেন অ্যান্ড দ্য এলিফ্যান্ট। যিনি পা ধরে দেখলেন, তিনি হাতিকে ঠাউরেছিলেন একটি ল্যাম্পপোস্ট। যিনি পেট ধরে দেখলেন তিনি ভাবলেন হাতি একটা বিরাট বালির বস্তা। যিনি কান ধরে দেখলেন, তিনি বললেন, হাতি আসলে একটা কুলো। ব্লা ব্লা ব্লা।

ভদ্রলোক বিদেশে পড়ান, এক কলমেই বাঘে গোরুতে জল খাওয়ান, আমি তাঁকে বললাম, আমি হাতিকে কী বলে ঠাউরেছি, আপনার কী মনে হয়? উনি বললেন, আপনি হাতিকে ভেবেছেন ঝাঁটা। অর্থাৎ আপনি হাতির পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন, লেজটাকে ধরেছিলেন।

আপনি কি বলতে চান আমি কবিতাকে ঝাঁটা হিসেবে ব্যবহার করি? ভদ্রলোক বললেন, সে তো কিছুটা সত্যি। আপনি কোথাও ধুলো দেখলেই ঝাঁটা বের করেন, আপনি ঘুষ দেখলেই ঝাঁটা বের করেন, গুজরাত দেখলেই ঝাঁটা বের করেন, বানতলা হলেই ঝাঁটা বের করেন, কামদুনি হলেই ঝাঁটা বের করেন। কোথাও কেওরামি দেখলেই, ধুলো জমলেই আপনি প্রতিবাদের ঝাঁটা নিয়ে নেমে পড়েন।

আমি বললাম, যা বাবা, আমি কোনওদিন গেটকিপার হতে চাইনি, দারোয়ান হতে চাইনি, কিন্তু হয়ে গেলাম ঝাড়ুদার।

২

কেন আমি কবিতা লিখতে এসেছিলাম?

কবিতার জন্য সবসময় একটা অ্যাক্সিডেন্ট লাগে না। বাসের জানলায় একটা বিষণ্ণ মুখ দেখেও একটা মানুষের জীবন পালটে যায়। জীবনে প্রথম রেফ্রিজারেটরের ডালা খুলে হতবাক হয়েও একজন কবিতা লিখতে পারে। আমার কবিতা লিখতে আসার কোনও কারণ ছিল না। আমি যে জীবনে জন্মেছিলাম সেখানে না ছিল কোনও কবিতা, না কোনও বই। আমার বাবা ঘরবাড়ি ফেলে পালিয়ে এসেছিলেন এপারে। তাঁকে দেখে মনে হত তিনি তাঁর শরীরের অর্ধেকটা ফেলে এসেছিলেন ওপারে। একটা অর্ধেক মানুষ এপারে এসে একটা গোটা মানুষের মহড়া দিত। আমার মা-কে সীমান্তে আর্মি অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হোয়ার আর য়্যু গোয়িং’? আমার মা বলেছিল, ‘ওরা আমার তুলসী মঞ্চ ভেঙে দিয়েছে, এপারে তুলসী লাগাতে দাও তোমরা?’ কী প্রশ্নের কী উত্তর! কোনওদিন স্কুলে না যাওয়া আমার অশিক্ষিত মা যা বলেছিলেন সেদিন, তার ভেতরে যদি কবিতা না থাকে, তা হলে কোথাও থাকতে পারে না কবিতা।

পিউবার্টি হেয়ার দেখা দিলেই প্রতি তিন জন বাঙালির একজন বাঙালি ছেলে কবিতা লেখে। অপবাদটিকে সম্মান জানিয়ে আমি কলম ধরেছিলাম। ক্লাস ইলেভেন তখন, কৃষ্ণনগর রেল স্টেশনে আমরা তিন বন্ধু সাইকেল সমেত দাঁড়িয়ে গুলতানি মারছিলাম, একজন ভবঘুরে আমাদের পেছনে ঘুর ঘুর করছিল। দেখলাম ট্রেন আসছে কলকাতার দিক থেকে, আমাদের চমকে দিয়ে ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটা, গেল গেল রব। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে স্থির হয়ে দাঁড়াল, আমি দুটো কোচের মাঝখান দিয়ে উলটোদিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখলাম হাতে একটা পাঁউরুটির ঠোঙা, সে খাচ্ছে আর আমার দিকে ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে যে হাসিটা টাঙানো সেটা শ্মশান ঘাট থেকে এইমাত্র ছিনিয়ে আনা নিয়তির টাটকা হাসি। সেদিন ভোররাতে আমি একটা কবিতা লিখেছিলাম, আমার প্রথম কবিতা, যা হারিয়ে গেছে। তার জন্য আমার কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু লোকটার হাসি থেকে গেছে আমার কবিতায়। আমি হাসিটাকে কলকাতা থেকে সাব-সাহারান আফ্রিকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। বলিভিয়ার জঙ্গল থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীর পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে দেখলাম, দেখলাম নাইন ইলেভেন থেকে ইরাক, দেখলাম গুজরাতে, নন্দীগ্রামে, কামদুনিতে। ওই হাসিটাই আমাকে লেখায়, ওই হাসিটাই আমাকে ছ্যাঁকা দেয়, পোড়ায়। যদি গুজরাত না হত, নাইন ইলেভেন না হত, নন্দীগ্রাম না হত, কামদুনি না হত, আমি কবিতা লিখতাম না। মধুর সুরে কিছু বালখিল্য অন্তমিল দিয়ে (ওই চোরাবালিতে আমিও নেমেছি) কবিতা লেখার জন্য আমি জন্মায়নি। সেই ভাল কাজ করার অনেক লোক আছে বাংলা কবিতায়। তাদের হাতেই সিলেবাস, রাষ্ট্র এবং সংবাদপত্র।

৩

মনুষ্যসমাজে প্রত্যেকের একটা থালা আছে। একটা নিজের থালা। ভিখিরির আছে, প্রেসিডেন্টের আছে, সন্ন্যাসীর আছে, এমনকী চলমান টেরোরিস্টেরও আছে। আমি আমার থালাটা জোগাড় করার পরে আমার থালাতেই ভাত খেতে চেয়েছি। অন্যের থালায় ভাত খেতে আমার ভাল লাগে না। নিজের থালা সোনারও নয় রুপোরও নয়, অত প্রতিভা আমার নেই। আমি একটা দোমড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের থালা পেয়েছি, সেটাতেই আমার লাঞ্চ, সেটাতেই আমার ডিনার। ওই অ্যালুমিনিয়ামের থালাই আমার গদ্য, আমি গদ্যতেই লিখে এলাম কবিতা৷ গদ্য আমার মাতৃভাষা। আমি আমার মাতৃভাষাতেই কবিতা লিখি। আমি যে গরিব পরিবারে জন্মেছিলাম, সেখানে কোনও ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজ কোর্স ছিল না। কিন্তু জানি আমার হাত থেকে থালাটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার লোক মজুত আছে। আমাকে একটা পোস্টকার্ডে মারাত্মক একটা সন্দেহ রেখে গিয়েছিলেন ভাস্করদা, কবি ভাস্কর চক্রবর্তী, ‘গদ্যে লেখা কবিতা একদিন বাতিল হয়ে যাবে না তো, সুবোধ।’ সেদিন আমি কৃষ্ণনগর থেকে উত্তর দিই, ‘আপনি আমাদের বিষণ্ণতম আধুনিক কবি, এত ভাল লেখেন, আপনি কি মনে করেন আপনার গদ্যে লেখা কবিতাগুলো শঙ্খবাবুকে দিয়ে ছন্দে ট্রান্সফার করিয়ে নিলে আরও ভাল হবে?’ আমি আমার পোস্টকার্ডটা ডাকে দিইনি। দিলে উনি ঘুমোতে পারতেন না। আমি তাঁর বরানগরের বাড়িতে ঘুম থেকে উঠে বলেছিলাম, ‘ভাস্করদা, সুললিত ছন্দে লেখা অজস্র কবিতা বাতিল হয়ে গেছে, আসুন দিনের প্রথম চা দিয়ে আমরা তার ইতিহাস সেলিব্রেট করি।’

৪

আমি একটা লোকের সঙ্গে সাত দিন কাটিয়েছিলাম ভোপালে। ২৫ বছর আগে। লোকটা সারাক্ষণ কবিতা লিখত। তার হাতে একটা খাতা। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি কী করে সারাক্ষণ কবিতা লেখো? সে বলেছিল, ওটা কাঁচামাল, আমি যা পাই কুড়িয়ে নিয়ে খাতায় তুলে রাখি। পরে সেখান থেকে কবিতা লিখি। লোকটার নাম নিকানোর পাররা, এখন বয়েস ৯৫, চিলির এক নম্বর কবি, যাঁকে নোবেল দেওয়ার জন্য একান্ন জন নোবেল লরিয়েট লিখিত আবেদন করেছিলেন নোবেল কমিটির কাছে। গত ২৫ বছর আমি তাঁকে অ্যালবাট্রসের মতো গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ালাম। আমি স্প্যানিশ জানি না। তাঁর কবিতার ইংরেজি অনুবাদেই আমার ২৫ বছর গনগনে হয়ে থাকল, স্প্যানিশ জানলে হয়তো আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠতাম। ভাগ্যিস জানি না। আমি যেহেতু পাররা-র উপাসক, সুতরাং অতি দ্রুত শুনতে পেলাম, আমি অ্যান্টি-পোয়েট্রি লিখি। বাংলায় যার নাম হল, প্রতি- কবিতা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে পাররা বলেছিলেন, মি. হোমারও অ্যান্টি-পোয়েট্রি লেখেন। আমরা হেসে উঠেছিলাম, কিন্তু কথাটা তো সত্যি যে বাল্মীকিও অ্যান্টি-পোয়েট্রি লিখেছেন। অপহরণের পথে, সীতা গা থেকে গয়না ফেলতে ফেলতে চলে গিয়েছিলেন, সেই অংশটা মনে হয় যেন নিকানোর পাররা-র লেখা।

আমিও ছোট স্কেলে আমার মতো গয়না ফেলতে ফেলতে গত ৩৫ বছর আমার রাস্তা দিয়ে আমি হেঁটে এসেছি। যদিও আমি জানি সব রাস্তা রোমে যায় না। আমি কবিতার গা থেকে গয়না খুলতে খুলতে এগিয়ে এসেছি। খুব যে ভাল জায়গায় এসেছি, তা নয়, সামনে তাকিয়ে দেখছি অন্ধকার খাদ। অলংকারহীন আমি একা। আমি যখন ‘ঋক্ষ মেষ কথা’ লিখেছিলাম, তখন আমি এম.এ ক্লাসের ছাত্র, অনেকগুলো সনেট ছিল, আর আমি ছিলাম ‘দুরূহতার উপাসক’, কথাটা বলেছিলেন কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত। কিন্তু আমি যখন কলকাতায় এসে দাঁড়ালাম, আমার সামনে একটা নতুন জগৎ খুলে গেল, একটা গোটা পার্ক স্ট্রিট আমার সামনে দিয়ে ঢুকে পাকস্থলী থেকে কিছুটা খাবার নিয়ে আবার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমার ভাষা গেল পালটে। আমার পোশাক গেল পালটে, আমার কৃষ্ণনগরের খাদ্যাভাস পালটে গেল, আমি যাদের সঙ্গে মিশতাম তারা আর আমার পাশে থাকল না, আর যাদের সঙ্গে কোনওদিন মিশব না ভেবেছিলাম তারা হয়ে উঠল আমার ওঠানামা। আমার কবিতা হয়ে উঠল সহজ, আমি ছন্দে না লিখে গদ্যে লিখে যেতে লাগলাম। যে গদ্য কবিরা ফেলে দেন আমি সেই সেই গদ্য কুড়িয়ে নিলাম। যে গল্প বাদ দিয়ে কবিরা লেখেন, আমি সেই গল্প ফিরিয়ে আনলাম আমার কবিতায়। ফলে আমার কবিতা পড়ে কিছু লোকে বুঝতে পারল, কিছু কবি তাতে রেগে গেল। তাঁরা বললেন, কবিতা বোঝা গেলে সেটা আর কবিতা থাকে না। আমি মন খারাপ করে বসে থাকলাম। মন খারাপ করে কী করব? দশ বছর ধরে মন খারাপ করে বসে থাকা যায় না। আবার উঠে দাঁড়িয়ে লিখতে শুরু করলাম যে লেখা আজও লিখে চলেছি। সম্প্রতি চিন্ময় গুহ আনন্দবাজার-এ লিখেছেন যে ফরাসিতে প্রবাদ আছে, ‘যা স্বচ্ছ নয়, তা ফরাসি নয়।’ এতদিন বাদে সান্ত্বনা পেলাম, যাক আমি তা হলে গোপনে গোপনে ফরাসি৷ অথচ স্বচ্ছ লেখার অপরাধে আমি এতদিন গঞ্জনা সয়ে এলাম।

৫

কবিতা জেরক্স নয়।

দুটি যুযুধান ভাল কবিতাকে পাশাপাশি রেখে দেখা যায় ভাল কবিতার একটা গুণ দু’জনেরই আছে। কাঁদাতে পারার ক্ষমতা। আমরা নিশ্চয় কোনও ভাল কবিতা পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি না। চোখের কোণটা চিকচিক করে, কেউ বাথরুমে ঢুকে কল খুলে দেন, কেউ হয়তো টুপিটা নাক অব্দি নামিয়ে হেঁটে যান। কিছু কবিতা অল্প লোকের জন্যে লেখা হয়, কিছু কবিতা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য লেখা হয়ে যায়। কেউ আগে থেকে কলম বাগিয়ে বলতে পারে না, আমি এবার বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য একটা কবিতা লিখব। আমি কি লিখতে পারব আর একটা বিদ্রোহী? আর একটা আফ্রিকা? আর একটা বনলতা সেন? পারব, সেটা কবিতা হবে না, হবে জেরক্স। ইতিহাস জেরক্স কপি নিয়ে কখনও মাথা ঘামিয়েছে বলে আমি শুনিনি।

৬

বাংলা কবিতা এলিটিস্ট ছিল না। হয়ে গেল।

গত পঞ্চাশ বছরে বাংলায় কোনও চামার কবি হতে পারেননি, কোনও দলিত কবি হতে পারেননি, কোনও মুচি মেথর ডোম কবি হতে পারেননি। আমাদের হাবভাবটা এ রকম যে আমরা ওদেরকে নিয়ে কবিতা লিখব, ওরা কেন নিজেরা কবিতা লিখবে। আমরা নিচু শ্রেণিকে নিয়ে লিখে আরও উঁচু এলিটিস্ট হব, ঠিক যেরকম ‘সাবলটার্ন’ নিয়ে লেখালেখি করে সবচেয়ে দামি অভিজাত হোটেলে গিয়ে আমরা ডিনার করে আসি।

আমাদের কবিতা থেকে ওরাল ট্র্যাডিশনা সরে গেল, বাউলকে আমরা পৌষমেলার জন্য বুক করে রাখলাম, তার বদলে আমরা ঢুকিয়ে দিলাম এলিয়ট পাউন্ড। বাংলা কবিতাকে গ্রাস করে নিল কয়েকটা লোক যারা সিলেবাস কমিটিতে থাকে, ড্রয়িংরুমে ফুকোদেরিদা বলে, কলেজ ইউনিভার্সিটি চালায়। এও এক প্যারাডক্স, কলম্বিয়াতে এখন ভারতীয় দলিত সাহিত্যের খুব রমরমা, কিন্তু বাংলায় ঢু ঢু। ভাঁড়ে মা ভবানি।

যদি বাঁচতে চায় বাংলা কবিতা, তাকে রাস্তায় নামতে হবে। দুটো কমিটির মিটিঙে কবিতা নিয়ে গুজুর গুজুর ফুসুর ফুসুর করে গেলে কবিতা বাঁচবে না। তাকে জনপদ দিয়ে হাঁটতে হবে, তাকে গাছতলায় দাঁড়াতে হবে, তাকে ট্রামে বাসে নৌকোয় ভ্যান রিকশোতে চড়তে হবে। আমি ৩৫ বছর প্রতিদিন সকালবেলা তিন ঘণ্টা করে কবিতার পেছনে দিলাম, লিখে গেলাম ছিঁড়ে ফেললাম, তবু একটা কবিতাকেও কি পেরেছি ট্রামে বাসে নৌকোয় চড়াতে?

৭

আমি কার মতো? এটা একটা অবধারিত সন্দেহ। আমার বাবা কে? কার মতো লিখি? আমি ভেবে দেখেছি আমি আসলে বাস্টার্ড। আমার মা ছিলেন কোনও সারোগেট মাদার। লিগ্যাল স্টেটাস ঠিক আছে, কিন্তু জিন নির্ণয় না করা পর্যন্ত বলা যায় আমি বাংলা কবিতায় সূতপুত্র। আমার বাবা কি নিকানোর পাররা না নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী? আমার জ্যাঠামশাই কি সুভাষ মুখোপাধ্যায় না রামপ্রসাদ সেন? আমার মামাশ্বশুর কি ব্যোদলেয়র না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়? জিন নির্ণয় করতে পারলে, শুধু বাংলা কবিতা নয়, মানবজাতি ক্যানসারের হাত থেকে বেঁচে যাবে।

৮

ন’টা বাহান্নর কৃষ্ণনগর লোকালে জানলার ধারে হাতে বই নিয়ে বসে থাকা ছিপছিপে দীর্ঘাঙ্গী, তন্বী কালো মেয়েটির সঙ্গে আমার যদি দেখা না হত, আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিতাম। অনেক ভাল কাজ আছে পৃথিবীতে। পঁচিশ বছর আগে ব্যান্ডেল চার্চে জিশুর সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি আমাকে বলেছিল, ‘লেখো, লিখে যাও।’ পঁচিশ বছর পরে ঢাকুরিয়ার এম আর আই হসপিটালের চারশো আঠাশ নম্বর বেডে শুয়ে আমার হাত ধরে বলেছিল, ‘লেখো, লিখে যাও, কে কী বলল, কান দিয়ো না।’

আর একজন।

ছোটবেলার সেই মিষ্টি ফরসা ছেলেটা যে প্যান্ট শার্টের ওপর শীতকালে ঝলমলে লাল সোয়েটর পরে রাণাঘাটের রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকত কতক্ষণে কৃষ্ণনগর লোকাল ঢুকবে, আমি নেমে পড়ব এক পকেট কবিতা নিয়ে। সে আমার জীবনে এসে চলে না গেলে আমি এতগুলো বই লিখতাম না।

৯

বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা ছ’ভাইবোন সাদা থান পরা মা-কে নিয়ে রাস্তায় বসেছিলাম, তখন কেউ আমাকে এক বেলাও খেতে ডাকেনি। মস্কোর বিরাট ব্যাঙ্কোয়েট হলে দাঁড়িয়ে, অশোক বাজপেয়ি যখন আমাকে হাতে একটা ভদকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, টেক ইট অ্যাট ওয়ান গো, তখন আমার মনে হয়েছিল, এখানে আসার কথা ছিল না আমার, পাঁচ হাজার লোকের ডিনার চলছে, কোথায় মায়াকভস্কি?

একটা আদর্শের জন্য আমরা বাঁচতে চেয়েছিলাম। সোভিয়েত ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। কমিউনিস্টরা কত খারাপ হতে পারে দেখলাম। ভাল কমিউনিস্টরা হয় হারিয়ে গেল, নয় তো তাদের মেরে ফেলা হল। আগুন এখানেও লাগল। সেই আগুনের মধ্যে দিয়ে আমি এলাম। আমার ডানা পুড়ে গেছে। পোড়া ডানা দিয়ে আমি লিখে চলেছি আমার কবিতা।

১০

‘কার্ল মার্কসকে একটা থাপ্পড় মারা দরকার, গান্ধিকে একটা থাপ্পড় মারা দরকার, আপনারা গ্যান দিয়ে গেলেন কিন্তু রুটি দিয়ে গেলেন না’— কবিতার ভাষাকে আমি এভাবেই গোধূলির রহস্য থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। পারিনি। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার স্কিল আমার নেই। আমি হাতা না গুটিয়ে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম। ঠাট্টাকে পরিহাস এবং হাসিকে ডায়মন্ড ভেবে এসেছি। চেয়েছি পাঠকের চোখের কোনায় এক বিন্দু জল রেখে যেতে। আমি আমার খামতি জানি, আমার কবিতা সুভাষণ নয়, সরপুরিয়া নয়, অন্তমিলের সুষমা নয়। আমার কবিতা ফাজলামি দিয়ে, ইয়ার্কি দিয়ে ঢাকা একটা আধ-খাওয়া দর্শন, সেটাই হয়তো আমার মাছ। প্রতিবাদ মানেই সব সময় হাতা গুটিয়ে, শিরা ফুলিয়ে মেট্রো চ্যানেলে গিয়ে দাঁড়াতে হবে কেন? প্রতিবাদের মধ্যেও থাকে সুচিমুখ সংবেদন, আঠেরো রকমের ধানখেত, অষ্টবিংশতি গোধূলি। যখন আমার জীবন অপরাহ্নবেলা পার হয়ে চলেছে, যে অপরাহ্নকালে মানুষ থিতিয়ে পড়ে, তখন আমি তূণীর থেকে তির বের করে সংযোজনা করছি একটার পর একটা কবিতা, এটা জেনেই যে এই ধাবমান তির আর ফেরত নেওয়া যাবে না। দশ বছর পাশাপাশি দুটো চেয়ারে আমি আর ব্রাত্য বসেছিলাম, এটা যেমন আমার কবিতায় প্লাজমার মতো রয়ে গেছে, সিরিটির বাড়িতে মল্লিকা যেভাবে শ্রীজাত মিঠি বিনায়ক অংশুমানদের নিয়ে সাতশো স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটটাকে দু’হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাট বানিয়ে তুলত, সেটাও তো আমার কবিতার ধমনী। আমার জিন থেকে আমি কী করে বেরুব?

দুঃখকে ছুঁতে পারা যেরকম আধুনিকতা, দুঃখকে বালিশের নীচে চাপা দিয়ে রাখা আরও বড় আধুনিকতা। কবিতায় যদি আমি আমার কথাই বলতে না পারলাম, তা হলে কবিতা লিখতে এলাম কেন? গত ৩৫ বছরে ২৬টা কবিতার বই লিখেছি। এতগুলো বই আসলে একটাই বই। আমার বই, আমার গল্প, আমার ব্যর্থতা, আমার ঘুম থেকে উঠে ঘুমিয়ে পড়া, আবার জুতোর ফিতে বেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া, এবং সন্ধেবেলায় এক ব্যাগ অপমান নিয়ে বাড়ি ফিরে আসা।

আনন্দকে ধন্যবাদ। সুবীরদাকে ধন্যবাদ, তাঁর স্নেহ এবং প্রশ্রয় না পেলে আমি মরে যেতাম।

বিনীত
পৌষালি সুবোধ সরকার
সিরিটি হাউজ়িং, টালিগঞ্জ
কলকাতা ৭০০০৪১

গ্রন্থসূচি

  1. কবিতা ৭৮-৮০
  2. ঋক্ষ মেষ কথা
  3. সোহাগশর্বরী
  4. একা নরকগামী
  5. মরণোত্তর জল
  6. চন্দ্রদোষ ওষুধে সারে না
  7. আড়াই হাত মানুষ
  8. মরুভূমির গোলাপ
  9. ছিঃ
  10. রাজনীতি করবেন না
  11. ভালো জায়গাটা কোথায়?
  12. ধন্যবাদ, মরীচিকা সেন

Book Content

কবিতা ৭৮-৮০
ঋক্ষ মেষ কথা
সোহাগ শর্বরী
একা নরকগামী
মরণোত্তর জল
চন্দ্রদোষ ওষুধে সারে না
আড়াই হাত মানুষ
মরুভূমির গোলাপ
ছিঃ
রাজনীতি করবেন না
ভালো জায়গাটা কোথায়?
ধন্যবাদ, মরীচিকা সেন
লেখক: সুবোধ সরকারবইয়ের ধরন: কাব্যগ্রন্থ / কবিতা
কবিতাসমগ্র ২ সুবোধ সরকার

কবিতাসমগ্র ২ – সুবোধ সরকার

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.