ধন্যবাদ, মরীচিকা সেন
[একই বছরে আর একটি বই।
বনলতা সেন কি সুবোধ সরকারের হাতে মরীচিকা সেন হয়ে উঠল? ‘চমৎকার কেটেছিল একটি দুপুর/ আপনি অরুণাচল, আমি মণিপুর।’ তা হলে কি প্রেমের কবিতার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন? তিনি বারবার বলে এসেছেন, ‘আমি প্রেমের কবিতা লিখতে পারি না, হাঁটু কাঁপে’, তিনি পালটে গেলেন?
প্রথম প্রকাশ: কলিকাতা পুস্তক মেলা, ১৯৯৯। প্রকাশক: কথা ও কাহিনী প্রা. লি.। মূল্য: ৩০ টাকা। প্রচ্ছদ: কার জানা যায় না। উৎসর্গ: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়-কে।]
হাই হানি, হাই মধু
জন্ম: ১৯৫৮
স্থান: কৃষ্ণনগরের মাতৃসদন, রাত দুটো নাগাদ
কুকুর খেতে এসেছিল আমাকে। পারেনি,
আর একটা কুকুর এসে পড়ায় প্রসূতিদের ঘুম ভেঙে যায়।
বাবা: গরিব মাস্টার, মৃত্যু ক্যান্সারে। বাবার মৃত্যুর পর
এক বেলা ভাত খেতাম, এক বেলা মাইলো।
হাই হানি, এই যার শুরুয়াৎ, তাকে কি ভালবাসবে তুমি?
শিক্ষা: কুপি জ্বেলে। ছ’ভাই বোন। চাল উড়ে যাওয়া প্রাইমারি স্কুল।
১৯৭১: প্রথম প্রেম। হায়রে পোড়ারমুখী প্রেম।
প্রেমে পড়ার কারণ শালবাগানের পেছনে মেয়েটা
চুরি করে এনে ভাত খাওয়াত।
সেই প্রথম পেট ভরে ভাত খাওয়া। আঃ খেতে যে
এত ভাল লাগে সেটা ১৯৭১ সালে
প্রেমে না পড়লে জানতে পারতাম না।
১৯৭৫: কোনওরকমে স্কুল পাস করে পাশের বাড়ি থেকে
জিনস ধার করে কলেজ গমন।
সীতা কৃষ্ণমূর্তি নামে বোতাম খোলা
তেজি একটা মেয়েকে ভাল লেগেছিল।
কিন্তু তার ভাল লাগেনি আমাকে।
আধ কেজি বিরহ এবং আড়াইশো গ্রাম অভিমান নিয়ে
নিয়মিত পেটের রোগে চেহারা ভেঙে পড়ে
তার সঙ্গে আগের একটি রোগের প্রকোপ বাড়তে থাকে
তার নাম—ক্লেপটোম্যানিয়া।
দু’বার জুতো চুরি করে একবার ধরা পড়ি। সীতার দাদার কাছে।
প্রথম চাকরি: ৬০০ টাকা। মাকে দুটো ধুতি। ছোট বোনকে একটা ধনেখালি।
এবং চাঁদের নীচে আমি আর আমার আত্মহারা সাইকেল।
জীবিকা: একে ওকে ধরে, এর বাজার করে দিয়ে
ওর টেলিফোন বিল দিয়ে একটা মাস্টারি জোগাড়
তারপর থেকে ষোলো জন লোকের সতেরো রকম দয়ায়
মাস্টারি বাঁচিয়ে রেখেছি।
হাই হানি, এই যার বায়োডেটা, তাকে কি ভালবাসবে তুমি?
পুরস্কার: বন্ধুর পশ্চাৎদেশ, ব্যাঙের হাঁচি
মৃত্তিকা বসু নামে এক মানবীর ছুটে আসা ক্ষুর।
বিদেশভ্রমণ:প্যাকিং বাক্সে
সম্পাদনা: বমি
প্রকাশিত গ্রন্থ: ছ’টি (কনডোমে ফুটো ছিল)
স্মরণীয় ঘটনা: এক বৃষ্টির রাতে উনিশটা ঘুমের বড়ি খেয়ে বেঁচে যাই
ডাক্তার বলেছিলেন, উনিশটাতে হয় না আজকাল
পরের বার উনত্রিশটা খাবেন।
তা, এই যার বায়োডেটা তার কি ওসব হয় টয়, হানি?
কাঁচালঙ্কা, নুন, আর এক বাটি ভাত হলেই চলবে আমার
ভাল বায়োডেটা ছাড়া কি ভালবাসা যায়?
না তাকে কেউ ভালবাসে, মধু?
দ্বিপদী
কঞ্চি
তুমি কত যত্ন করে ভালবেসে দিয়েছিলে বাঁশ।
বাঁশ ধরে উঠি আমি যদি পাই কঞ্চির আভাস।
কানকাটা
বিচ্ছিরি তোমার স্বামী, কোলাব্যাঙ, আর কাটা কান
তিনি কিন্তু ভাঙলেও, এখনও ভালই মচকান।
পোড়া ভাত
সেদিন ছিল না বউ, তুমি ছিলে রান্নাঘর জুড়ে
পোড়া ভাত খেতে দিলে, বউ হলে নিজে যেত পুড়ে।
নব্বই দশক
গ্লাসে গ্লাসে থ্রি চিয়ার্স, খুরিতে খুরিতে দার্জিলিং
মুখে মুখে, ঠোঁটে ঠোঁটে, তবু তোরা ভালবাসাহীন।
আমি আমি, তুমি তুমি, তবু আমি প্রেমিক গবেট
পেট ভরে ভালবেসে লিভার হয়েছে আপসেট।
চাঁদ
একটা সাংঘাতিক ভুল প্রশ্ন আমরা সারাজীবন করে আসি।
যে মেয়েটি উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, খাদ্য কিনে, ওষুধ কিনে
পঙ্গু স্বামীর কাছে ফিরে আসে
সেই পঙ্গু স্বামী, একদিন
একটা চোখ বন্ধ করে প্রশ্ন করে: তুমি আমাকে ভালবাসো তো?
চাঁদ ওঠে, দু’ পায়ের ফাঁকে সবচেয়ে বিতর্কিত অংশে
চাঁদের আলো এসে পড়ে: চাঁদের কোনও দোষ নেই।
যে মেয়েটি কামুকের হাত থেকে পালাতে পালাতে নদী পেরিয়ে জঙ্গল পেরিয়ে
তোমার কোমরে এসে মাথা রেখেছিল তিরিশ বছর আগে,
তাকে এতদিন বাদে প্রশ্ন করলে: আমাকে ভালবাসো তো?
বাড়ির বউ সংসার ছেড়ে, তুলসীতলা ছেড়ে যাযাবরের সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল
সেই যাযাবর তাকে আজ
পেট-অব্দি বালির মধ্যে দাঁড় করিয়ে প্রশ্ন করে:
বলো, বলো আমাকে ভালবাসো?
চাঁদ ওঠে, দু’ পায়ের ফাঁকে, অর্থাৎ মধ্যবিত্তের সবচেয়ে
মানসম্মানের জায়গায় চাঁদের আলো এসে পড়ে,
আমি জানি, চাঁদের কোনও দোষ নেই।
দোষ আমাদের, আমরা ঠিক কী জানতে চাই মেয়েদের কাছে?
ওই মানসম্মানের জায়গায় ওটা কী?
চাঁদের আলো? নাকি নষ্টাচারের আপেল?
বাংলা না ইংরেজি
ইংরেজিরও বাবা আছে, বাংলারও বাবা আছে।
একদিন বৃষ্টির সন্ধ্যায় ন’ তলার ঘরে
ইংরেজির সঙ্গে দেখা হল বাংলার।
বাংলা বলল, ‘ইংরেজি তোমাকে কী সুন্দর দেখতে
ঝকঝকে দাঁত, মোম মাখা পা, পরিষ্কার গোড়ালি
চুল কেটে ফেলার পর তোমাকে আরও ভাল দেখাচ্ছে।’
ইংরেজি বলল, ‘ও রিয়্যেলি! আমি ভাবলাম য়্যু হেট মি,
তুমি আমার হেয়ার-স্টাইল ডিসলাইক করবে।’
বাংলা বলল, ‘আমার হাতে পায়ে মাটি, চুলে আঠা
গায়ে এখনও চর্যাপদের ঘাস, থাকতাম সেই নদিয়ায়
তোমাকে দেখে লোভ হল, বাবা মাকে ফেলে
কলকাতায় চলে এলাম। আমার এই কালো কালো হাত
কালো কালো লোম ভরতি পা, এসব দিয়ে এখানে
কিচ্ছু হবে না, আমি দেশে ফিরে যাব।’
ইংরেজি সিগারেট ধরিয়ে বলল, ‘নো, নো, য়্যু লুক সো ম্যানলি
তোমার গায়ে মাটি, আই লাইক ইট, আই লাইক আর্থ
তোমার চুলে ঘাস, আমি তোমাকে ভালবাসি
ডু য়্যু লাভ মি? দেন, কাম, এসো, লেট আস মেক লাভ।
আমি দরজার পরদায় ক্লিপ আটকে দিচ্ছি, কেউ আসবে না
অ্যালবার্ট, আমার হাজব্যান্ড ফিরবে সেই রাত্রি আটটায়’
দশ মাস বাদে এক বৃষ্টির রাতে একটি সন্তানের জন্ম হল
লোকে তার নাম দিল—বাংরেজি।
কিন্তু বছর পাঁচেক বাদে জোড়াগির্জার কাছে একদিন
বাংলা আর ইংরেজির মধ্যে তুমুল হাতাহাতি
(ততদিনে প্রাইমারি থেকে ইংরেজি উঠে গেছে)
রাস্তায় ইংরেজি মাধ্যমের আর বাংলা মাধ্যমের
ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সবাই বেরিয়ে এল
ইংরেজি বলছে, ‘আই হেট য়্যু’
বাংলা বলছে, ‘আমি তোমায় ভালবেসেছিলাম’
ইংরেজি বাংলার চুল ছেড়ে দিয়ে, কলার ছেড়ে দিয়ে
হাত থেকে ঘাসপাতা ঝেড়ে বলল, ব্রুট
কিন্তু বাংলা ততদিনে ইংরেজি শিখে গেছে
ইংরেজির পশ্চাতের দিকে তাকিয়ে
মুখ বিকৃত করে উচ্চারণ করল, বিচ।
দেবদাস
চল্লিশ বছরের লোককে প্রেম সম্পর্কে পরামর্শ দিতে নেই।
দিনে দিনে দেবদাস হয়ে যাবে, সেও তো অসহ্য
সকাল সাতটায় বাড়ি এসে বলল:
‘আমি সারা পৃথিবীতে চন্দনের গন্ধ পাচ্ছি।’
রাত একটার সময় বলল,
‘চল, দু’জনে রেড রোডে গিয়ে শুয়ে থাকি।’
সেই ভরদুপুরে আমাকে বলল
‘তুই নক্ষত্র দেখতে পাচ্ছিস?
আমার মাথার ভিতর এক মিনিটে
তিন হাজার পরমাণুর জন্ম হয়, কী করি বল তো?’
আমি সেদিন আর পারিনি
বললাম, ‘শোন ভ্যানতারা করিস না
তুই ছোটবেলার বন্ধু, ইলোপ করতে পারবি?
আন্দামান বা পাপুয়া নিউগিনিতে পালাতে পারবি?
মেয়েটার বরকে এক থাপ্পড় মার, এক না তিন থাপ্পড়
থাপ্পড় মেরে মেরে যোগ্য হয়ে ওঠ।
এ সব যদি পারিস, আমি তোর সঙ্গে আছি
থানা পুলিশ আমি করব। আর তুই আন্দামানের
সমুদ্র কল্লোলের ধারে বসে সনজিতাকে গল্প বলবি
নক্ষত্রের আর পরমাণুর গড়ে ওঠা ও ভেঙে পড়ার।
ওরে দেবদাস, চন্দনের গন্ধ নয়, তোর দরকার সনজিতাকে।
কাল সন্ধ্যায়
কাল সন্ধ্যায়, তোমাকে শেষ চুম্বন করব।
কী রকম লাগে শেষ চুম্বন করতে?
তিতো?
গোলাপের পাতা খেয়ে দেখেছ কখনও?
সেরকম।
কাল শেষ
হে পাতাল, হে ঠান্ডা, ঝরে পড়ার পর
যে পাতা এখন উঠছে
আমি সেই পাতা, পাতা না কাগজ,
কাগজও না পৃষ্ঠা
এক পৃষ্ঠার আত্মজীবনী।
কাল শেষ
তার আগেই আমি বা তুমি শেষ হয়ে যাব না তো?
চাকার তলায়
পাশাপাশি
মুন্ডু দুটো যখন রেড রোড দিয়ে হাসতে হাসতে গড়িয়ে যাবে
আর এ ওকে বলবে:
‘ভালবাসতে ইচ্ছে করছে খুব, কাছে এসো, আরও কাছে।’
বোবা
ওদের বয়স একুশ বাইশ
ছেলেটা বলছে—ই…ই…ই
মেয়েটা বলছে— অ…অ…অ
ছেলেটা বলছে—তা…তা…তা
মেয়েটা বলছে—চা…চা…চা
এর বেশি বাংলা ওরা বলতে পারে না
দু’জনেই বোবা।
জঙ্গলে ঢাকা বিহারে একটা রেল স্টেশন থেকে
ওরা চাঁদ দেখে ওরকম করছিল।
চাঁদ সম্পর্কে পৃথিবীতে এত কম শব্দে
এত বেশি কথা আর কেউ কখনও বলেনি।
অথচ ওদের জীবনে কোনও চন্দ্রালোক নেই।
বিবাহবিচ্ছেদের আগে
মা, আমি বড় হয়ে গেছি
মা, আমি নিজে নিজে জামা পরেছি আজ
মা, আমি বড় হয়ে গেছি
মা, আমাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে তো?
মা, আমি আর জল ঘাঁটব না
মা, আমি আর কাচের বাসনে হাত দেব না
মা, দেখো আমি নিজে নিজে জুতো খুলেছি
মা, তুমি ব্যাগ গুছোচ্ছ কেন?
মা, বাবা আমাকে চড় মারল কেন?
তুমি ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
মা, আমি আর ক্যাডবেরি খাব না৷
তুমি ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় যাচ্ছ?
আমি যাব, আমি যাব, আমি যাব, তুমি দাঁড়াও
আমি বন্ধ দরজা খুলে বাবাকে নিয়ে আসছি।
বাবা, দরজা খোলো, মা চলে যাচ্ছে
মা ব্যাগ নিয়ে চলে যাচ্ছে, তুমি মাকে বকছ না কেন?
হে পুরুষ
যখন তখন যেখানে সেখানে বাড়িতে রাস্তায়
বৃষ্টির আগে এবং
বৃষ্টির পরে
নদীর এপারে এবং
নদীর ওপারে
রেস্তোরাঁয়, পেজারে, টেলিফোনে
ওভাবে বোলো না, ‘আমি তোমাকে ভালবাসি।’
সত্যি সত্যি ভালবাসলে তোমার জিভ জড়িয়ে আসত, কথা বলতে পারতে না।
খুন
ছেলেটি বলত:
খুন হয়ে যাবে যদি ভালবাসো কাউকে
মেয়েটি বলত:
মেরে ফেলে দেব অন্য মেয়েকে ধরলে।
ছেলেটি নেপাল, রেঙ্গুন
বলতে পারেন, ওরা কেন আজও
এ ওকে করেনি খুন?
মৃত সমুদ্র
ইজরেইল এবং জর্ডনের মাঝখানে
একটা নুনের হ্রদ আছে
সেটাকেই বলা হয় মৃত সমুদ্র।
হ্যাঁ, ওটাই আমি
তোমার দুই প্রেমিক মি. ইজরেইল এবং
মি. জর্ডনের মাঝখানে।
আমি নুন, আমার চোখ নুন, যকৃৎ নুন
মি. ইজরেইল আমার শরীর থেকে লরি ভরতি
নুন নিয়ে গিয়ে ডলারে বিক্রি করেছেন মি. জর্ডনকে।
আজ পরিষ্কার বুঝি
আমি মারা না গেলে, মরে পচে গলে
একটা নুনের হ্রদে পরিণত না হলে
তোমরা তিন জন নুন পেতে না!
খেতে কী করে?
আপনার স্ত্রীকে ধার নিতে পারি?
সৌজন্য: গ্রাহাম গ্রিন
মাইরি বলছি, কিচ্ছু করব না
কিচ্ছু ধরব না
কিচ্ছু টানব না
শুধু একদিনের জন্য
আপনার স্ত্রীকে ধার নিতে পারি?
মাইরি বলছি
ডায়মন্ডহারবারে নিয়ে যাব না
ও দিকে আমার প্রাক্তন প্রেমিকা যায়
সে যদি আমায় দেখে ফেলে
আমার চাকরি চলে যাবে, হাসি চলে যাবে
আষাঢ় শ্রাবণ সব চলে যাবে।
মাইরি বলছি, কিচ্ছু করব না
আপনি বর হিসেবে কত খারাপ
আপনার বউকে বলব না।
আপনার হাঁটা খারাপ, কাঁটা চামচে খেতে জানেন না
ভুল ইংরেজি বলেন,
আপনি কাল দুপুরে কোথায় ছিলেন
প্রতিজ্ঞা, আপনার বউকে বলব না।
আপনার বউকে আমি
চে গুয়েভারার ডায়েরি পড়াব না
আপনার বউকে আমি
চুড়ি কিনে দেব না, রুমাল কিনে দেব না
চুড়ি পরিয়ে কিচ্ছু হয় না। বিশ্বাস লোহায় থাকে না।
মাইরি বলছি, আপনার নুন খেয়েছি—
আমি আপনার বউকে মরে গেলেও ভালবাসব না
শুধু একটা দিনের জন্য
মাত্র একটা দিনের জন্য, হো হো
এবং হা হা
আমি ধার চাইছি, বিশুদ্ধ মতে ধার চাইছি
আপনার বউকে।
অয়ন
বাবা না মা
তুমি কার কাছে থাকবে?
কোনও বালককে আমি এত বিষণ্ণ দেখিনি
তেজপাতার মতো তিরতির করে কাঁপছে তার আঙুল
অয়ন, তুমি কার কাছে থাকবে?
প্রথম যেদিন স্কুলে গিয়েছিল, এ পাশে ডুডাই, মানে বাবা
ওপাশে মাসাই, মানে মা, পেছন পেছন দাদু।
দাদু ঘাড়ে চাপিয়ে ঘুরে বেড়াত, আর বকা খেত
দিদার কাছে, ‘ছেলেটা পড়ে যাবে।’
প্রধান বিচারপতি গলার স্বর নামিয়ে বললেন
অয়ন, তুমি কোথায় থাকবে, হাতিবাগান না গড়িয়াহাট?
প্রথম যেদিন তাদের বাড়ি পুলিশ এল
প্রথম যেদিন রাত্রে বাড়ি ফিরল না মা
প্রথম যেদিন বাবা তাকে থাপ্পড় মারল
পরক্ষণেই বুকে জড়িয়ে বলল, সরি
প্রথম যেদিন আমি আদালত এলাম
দাদু কোথায়, দাদু কোথায়, দাদু
আমাকে যখন গাড়িতে তোলা হচ্ছিল, আমি দেখলাম
রাস্তার এ পাশে দাঁড়িয়ে ডুডাই
রাস্তার ও পাশে দাঁড়িয়ে মাসাই।
আজ নিয়ে তৃতীয় দিন এখানে এলাম
ওই তো মা, দূরে দাঁড়িয়ে বাবা
কত লোক, এত লোক কেন?
একজন এসে আমার চুল আঁচড়ে দিয়ে গেল
বিচারপতি গলার স্বর নামিয়ে বললেন
তুমি কার কাছে থাকবে, বলো?
অয়ন বলল, ‘একদিন বাবার কাছে, একদিন মা-র কাছে।’
বলেই তার মনে হল
দাদু তাকে কাঁধে চাপিয়ে দৌড়চ্ছেন, আর দিদা চেঁচাচ্ছেন
‘নামাও, নামাও, ছেলেটা পড়ে যাবে।’
বুড়ো দিদা তা হলে ঠিকই বলেছিলেন, ছেলেটা পড়ে যাবে।
মাকে চিঠি
মা,
বহুদিন তুমি আমাকে দেখতে আসেনি
আমি তোমার খারাপ ছেলে
খুব দামি স্কুলে দিয়েছিলে
তবু দামি হতে পারিনি।
মা, পৃথিবীতে সবাই কি ভাল হতে পারে?
ডাক্তার জেঠু আমাকে রোজ দেখে যান
আমি নাকি ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছি
আমার রক্ত স্বাভাবিক হচ্ছে, স্নায়ু সরল হচ্ছে
মাঝখানে একদিন তোমার হাতের রান্না খেতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব
ইলিশ, তুমি কী দারুণ রাঁধতে, মা!
এখনও আমার জ্বর হয়, বমি পায়, জিভ শুকিয়ে আসে
মাথার ভেতর কে যেন পেনসিল দিয়ে লিখতে থাকে
‘তুমি কোনওদিন ভাল হবে না, তোমার মা কোনওদিন ভাল হবে না
তোমার বাবা পালিয়ে গেছে
তোমার বোনও একদিন অ্যাডিক্ট্ হয়ে এখানে আসবে।
তোমাদের বাড়িই একটা হাসপাতাল, তোমাদের সবার অসুখ।’
ডাক্তার জেঠু আমাকে আবার বই পড়তে বলেছেন
‘আরণ্যক’ পড়ছি আমি,
বই পড়তে এত ভাল লাগে আমি আগে জানতাম না
মা, তুমি দেখো, আমি ঠিক ভাল হয়ে বাড়ি ফিরে যাব।
বাবা এখন কোথায় থাকে মা? কার বাড়িতে, কোন পাড়ায়?
বাবা কি তোমাকে আর ভালবাসে না?
আমাকে ভালবাসে না, বোনকে ভালবাসে না?
মা, আমি আবার স্কুলে যাব, কলেজে পড়ব
ফার্স্ট হতে না পারি ভাল রেজাল্ট করব
মনে আছে, একবার আমার পায়ে কাচ ফুটে জ্বর এসেছিল
তুমি সারারাত কোলে আমার মাথা নিয়ে বসেছিলে
ঠিক সেরকম করে ভালবাসবে তো আবার?
মা, আমার মতো কেউ যেন কষ্ট না পায়
ঘুমোতে কষ্ট হত, খেতে কষ্ট হত
বসে থাকতে কষ্ট হত, টয়লেটে কষ্ট হত
চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হত।
জুতো মোজা পরে, টাই পরে, পিঠে ব্যাগ নিয়ে
জলের বোতল নিয়ে আমি আবার তোমার
ছেলের মতো ছেলে হয়ে
বাবু অরিন্দম মিত্র হয়ে
রোজ বাড়ি ফিরব বিকেল সাড়ে চারটেয়
পাড়ার লোকেরা আমাকে অ্যাডিক্ট্, বলবে না তো?
বোন আমাকে অ্যাডিক্ট্ বলবে না তো?
বাবা আমাকে অ্যাডিক্ট্ বলবে না তো?
বাবার সঙ্গে থাকেন যে আন্টি, উনি বলবেন না তো?
যে বলে বলুক, আই ক্যের আ ফিগ
মা, মাগো, তুমি বোলো না, তুমি বোলো না, তুমি বোলো না কখনও।
ছোট মুখে ছোট কথা
কবিতা কীভাবে ছাপা হবে
বড় হরফে না ছোট হরফে?
লেটার প্রেসে
সঙ্গে ছবি যাবে না বায়োডেটা যাবে?
এই তো?
কবিতা কীভাবে পড়া হবে?
জোরালো গলায় না ক্ষীণকণ্ঠে?
জিনস পরে
না ধুতি পরে?
রবীন্দ্রসদনে না চিলেকোঠায়?
এই তো?
কবিতা বোঝা যাবে
না অর্ধেক বোঝা যাবে
কবিতা কারখানার গেট
না মেঘের পরে মেঘ?
কবিতা বহুলোকের জন্য
না বিধবা পিসির জন্য?
এই তো?
এ সব চিন্তা আগে করতাম, আর করি না
ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি:
কবিতাকে শেষ অব্দি কবিতাই হতে হবে
তা সে বেশ্যার দেয়ালেই ছাপা হোক
অথবা পুরোহিতের উঠোনে।
আপনি রবীন্দ্রসদনে দাঁড়িয়ে কবিতা পড়বেন
না জাহান্নামে
সেটা আপনি ঠিক করুন,
আমি বুঝে গেছি আমি কবি নই
আমি আরশোলা।
তিস্তা
তিস্তা সেন, আপনার মাথায় ব্যাঙ ঢুকেছে
তিস্তা ঘোষ, আপনি টিকটিকি হয়ে গেছেন
তিস্তা রায়, আপনি খাটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন
তিনটে পুরুষ
আর তাদের খেতে দিয়েছেন কাঁঠাল পাতা।
তিস্তা গুহ, আপনার শরীর আগে ভাল ছিল
এখন ফিনাইল দরকার।
আমাদের তিস্তা বছরে তিনবার পদবি পালটায়
আসলে বেচারা যখন যে পুরুষের সঙ্গে ঘোরে
শহরের দুষ্ট লোকেরা তার পদবি পালটে নেয়
তিস্তা, আপনি তাহলে কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছেন?
দাঁড়ালেই তো হয় না, মাটি চাই
মাটি গুহ, মাটি সেন, মাটি রায়, মাটি ঘোষ
তার চেয়ে বড় মাটি আপনি নিজে
নিজেই মৃত্তিকা
কিন্তু আপনার মাথায় ঢুকেছে ব্যাঙ
মাথার বাইরে একটা টিকটিকি ব্যাঙটাকে ভালবাসতে চাইছে।
পেরেক
তুমি যেখানে পেরেক পুঁতছ
সেটা আমার পিঠ।
তুমি যেখানে কাটি দিয়ে ঘেঁটে দেখছ
তুমি যে পাত্রে অ্যাসিড রেখে
নতুন পুরুষ বন্ধু নিয়ে পার্ক স্ট্রিটে
হাঁটতে বেরিয়েছ
সেই পাত্রটি আমার হৃদয়।
তবু তুমি ভাল থেকো।
ভাই চেয়ার
মেয়েটি নতুন করে বাঁচতে চায়
যত ছবি তুলেছিল ছেলেটার সঙ্গে
পুড়িয়ে ফেলল।
কাঠের ওপর লেখা ছেলেটার নাম
ঘসে ঘসে তুলে ফেলছে তিন অক্ষর।
যত বই পেয়েছিল তাদের প্রথম পৃষ্ঠা
ছিঁড়ে ফেলে দিল।
কালো কাপে চা খেত। মেয়েটি ছুড়ে মারল
নীচের রাস্তায়।
খান খান হয়ে গেল অতীত
যে চেয়ারে বসতো সে চেয়ার দিয়ে দিল রাস্তার লোককে।
আমি দেখলাম চেয়ার চলেছে রাস্তা দিয়ে, পথ দিয়ে
গলি দিয়ে তস্য গলি দিয়ে…
ভাই চেয়ার তুমি কোথায় চলেছ? অতীতের দিকে?
মেয়েটি নতুন করে বাঁচতে চায়, যে এসে চৌকাঠে
এখন দাঁড়িয়েছে তার নাম ভবিষ্যৎ।
ভাই চেয়ার! তুমি গলি দিয়ে তস্য গলি দিয়ে কোথায় চলেছ?
ছোট পরিবার
বর্ষার সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঝাল ঝাড়ি বউয়ের ওপর
বউ ঝাল ঝাড়ে মাসির ওপর
বুড়ি মাসি, ‘আমি দুধ খাই নাই
বেড়াল খাইছে’, বলে গর্জে ওঠে চার বছরের ছেলের ওপর।
চার বছরের ছেলে, বেচারা আর কী করে তখন?
তার হাতের কাছে পড়ে থাকা
সুপারম্যানকে তুলে নিয়ে একটা হাত ছিঁড়ে ফেলে।
বর্ষার সন্ধ্যায়, উনুনে হাঁড়ির ভেতর
আধ কেজি চাল ডাল গাজর মটরশুঁটি ফুটতে থাকে
ফুটতে থাকে একটা পরিবার
খুব ছোট একটা আধ কেজি পরিবার।
যার ভেতর একটা এক কেজি ওজনের ঝগড়া আটকে আছে।
রাসবিহারী থেকে সল্টলেক
দাঁড়ানো মোটরবাইক, চাবি ঢুকতেই গোঁ গোঁ করে উঠল চিতা
টাটকা টাকায় সদ্য কিনে আনা
এক দুরন্ত গতি, টগবগ করা রোমাঞ্চ
বাইশ বছরের যুবক, খোলা চেস্ট লোমে ঢাকা
পেট্রল সে শুধু বাইকে ঢালেনি, নিজের গলাতেও ঢেলেছে
মেয়েটিকে সে আস্তে করে বলল, ওঠো।
মেয়েটির উদ্ধত নাক, রাগী চোখ, পৃথিবীকে অবজ্ঞা করার মতো থুতনি
উনিশটা পলাশ গমগম করছে তার সর্বাঙ্গে
সন্ধ্যার রাসবিহারী দেখল, ছুটল মোটরবাইক
বালিগঞ্জ স্টেশনের দিকে।
কিন্তু পূর্বরেলের বালিগঞ্জ তাদের গন্তব্য নয়
বাইপাসে ঢুকতেই বাড়তে লাগল গতি, বাড়তে লাগল হাওয়া
বাড়তে লাগল রোমাঞ্চ
সাধারণত একটা বোতাম খোলা থাকে
মেয়েটি দ্বিতীয় বোতাম খুলে দিল, পা দুটো আর একটু ফাঁক করল
দুটো হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল ছেলেটির দুটো থাই
গতি, গতি, আরও ঝড়, আরও শোঁ শোঁ
ষাট, আশি, পঁচাশি, একশো, একশো পাঁচ… বাইপাস…
ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না মেয়েটা
মেয়েটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না ছেলেটা
নতুন চাকা, নতুন স্টিয়ারিং, নতুন পেট্রল, নতুন হেলমেট
কিন্তু হেলমেটে ঢাকা ছেলেটার চোখে জল? কেন?
সল্টলেক আসার আগে ছেলেটি চরম সীমায় পৌঁছল
আস্তে করে দুটো হাত তুলে নিল স্টিয়ারিং থেকে
জুতো দিয়ে চেপে ধরল ব্রেক। মুহূর্তে তার মনে হল
পঁচিশ হাজার টাকা নয়
পঁচিশ পয়সা দিয়ে সে এটা কিনেছে, মাত্র একটা সিকি
ছোট্ট একটু নিকেল, কয়েকটা ইংরেজি অক্ষর, হিন্দি অক্ষর।
থু, চার আনা। থু, জীবন। ইচ্ছে করে ধাক্কা মারল গাছের গুঁড়িতে
এরপর থেকে মোটরবাইকে বসা দুটো ছাত্রের বয়সি ছেলেমেয়ে
দেখলেই ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে
নতুন হেলমেট। হেলমেট দিয়ে ঢেকে রাখা চোখের জল।
শোনো, আমরা যারা মাস্টারমশাই তাঁদেরও চোখে জল থাকে
হেলমেট দিয়ে নয়, বই দিয়ে ঢেকে রাখি।
তোমাদের মতো বাইপাস ধরে ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যাব না
আবার রাসবিহারীতে ফিরে আসব।
মিস্টার মাফিয়ার দরবারে
টি. এন. দত্ত কে?
ভাইসচ্যান্সেলর।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও, মাছি।
এম. এন. রায় হাজির?
হাজির
এম. এন. রায় কে?
রাজ্যসভার মেম্বার।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও, মাছি।
হাজির
এস. কে. মুন্ডা কে?
বিরাট শ্রমিক নেতা।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও, মাছি।
পি. কে. বাজোরিয়া হাজির?
হাজির
পি. কে. বাজোরিয়া কে?
ইনি গোয়েঙ্কার মার্কসিস্ট নাতজামাই
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও, মাছি।
মার্কসিস্ট নাতজামাই, তওবা, তওবা!
আমরা লেনিন, গান্ধী, চারু মজুমদার
সব পিসে খৈনি করে খেলাম
আর নাতজামাই? ও সব গুটি পোকা দেখিও না।
বি. কে. দত্তগুপ্ত হাজির?
হাজির
বি. কে. দত্তগুপ্ত কে?
ইনি একজন মেয়র।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও, মাছি।
সব শেষে আমি, এস. সরকার হাজির?
জি, হাজির
ইনি কে? আমি একজন ব্যর্থ কবি
মিস্টার মাফিয়া চোখ খুললেন, চোখ বন্ধ করলেন
ছেড়ে দাও, এটা একটা মশা।
স্যর, আমাকে মাছি বলুন, মাছি বলুন, আমি মাছি
মশা যদি হতে পারতাম এ জীবনে
ম্যালেরিয়া সমেত প্রথমেই আপনাকে কামড়াতাম।
রামায়ণ, মার্চ, ১৯৯৮
দশরথ কথা বলতে পারছেন না
গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে
ভরতের অভিষেক আসন্ন
দ্রুতগামী অশ্ব পাঠানো হচ্ছে ভরতকে আনতে
রাম বললেন, সীতা এবং রাজ্য
দুটোই দিয়ে দিতে পারি ভরতকে।
সেদিন মোবাইল ফোন থাকলে ঘটনাটা
এরকম ঘটত না,
যৌন দুর্বলতা সত্ত্বেও দশরথবাবু উঠে দাঁড়াতেন
কথা বলতেন অন্ধ্রপ্রদেশের সঙ্গে
গতবার সূর্য নয়, চন্দ্রই ছিল
পশ্চিমবঙ্গের জুয়েল থিফ
এবার তিনি বলছেন প্যার কিয়া তো ডরনা ক্যায়া।
মাদ্রাজের বেডরুম থেকে শূর্পণখা শাড়ি পরতে পরতে
মোবাইলে পেয়ে গেলেন
ব্রহ্মপুত্রের ধারে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা
হনুমানকে।
হনুমান ফোন করল দিল্লিতে
দিল্লির হেডকোয়ার্টার্স বলল
নমস্তে হনুমানজি, আপনি নেক্সট ফ্লাইটে দিল্লি চলে আসুন
শুধু একটা কথা, আসার পথে
দমদমে কোনও বাংলা কাগজে সাক্ষাৎকার দেবেন না।
যিনি রাজ্য, রাজছত্র, রাজভূষণ, রথ
পরিত্যাগ করে বনে গিয়েছিলেন
তিনি কেন গিয়েছিলেন?
বাবার যৌন দুর্বলতার শিকার হয়েও তিনি
কিছু বলেননি কেন?
এরকম একটা ঘটনা সম্ভব হয়েছিল সেদিন
স্রেফ একটাই কারণে
রামের কাছে সেদিন কোনও মোবাইল ছিল না
দেশটা কিনবেন না বেচবেন সেটা মোবাইলই ঠিক করে দেয় আজকাল।
ইট
বাবা বললেন, কলেজ ছেড়ে দে
যা বলি, মন দিয়ে শোন।
ছেলে মোটরবাইকের স্টার্ট বন্ধ করে
এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে বলল, শুনছি
বাবা গলা নামিয়ে বললেন
ইট সাপ্লাই কর
তিনজন ইটভাটা মালিকের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে
এর থেকে সহজ এবং সুন্দর কোনও ব্যাবসা নেই।
ছেলের চোখে কোনও স্বপ্ন নেই
কানে কোনও আদর্শ নেই
ঠোঁটে নেই ভিয়েতনাম, নেই বলিভিয়া
নেই চে গুয়েভারার ডায়েরি।
তার সামনে এখন ইট।
একজন শ্রমিক দিচ্ছ
একজন শ্রমিক নিচ্ছে
চাঁদের আলোয়, অমাবস্যায়, সূর্যকরোজ্জ্বল দিনে
ট্রাক চলেছে দিকে দিকে
কলকাতায়, কলকাতার বাইরে
ইট ছড়িয়ে পড়ল দমদম থেকে গড়িয়ায়, বারাসাত থেকে সোনারপুর…
কিন্তু এবার, এ বছর
সেই ইট ফিরে এসে দমাদ্দম বাবার সামনে পড়ছে
বাবা, আপনাকে অনুরোধ
আমরা আপনার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে
আমরা একটা স্বপ্ন চেয়েছিলাম
আমরা ইট চাইনি।
বাবা রেগেমেগে বললেন, হুঁ, ইটে যখন হল না।
তা হলে এবার কাঠ নিয়ে দেখ হয় কি না।
দোষ
একে বলে বাড়া ভাতে ছাই।
ছেলেটি ভালই ছিল মেয়েটাও ভাল ছিল
দোষ হল প্রেমে পড়াটাই
ছেলেটার মেয়ে ছিল মেয়েটারও ছেলে ছিল
প্রেম হল তবু পুনরায়।
দোষী শুধু ছেলেমেয়েরাই?
দোষী নয় বাবা কাকা? ঝাড়গ্রাম এত ফাঁকা
রেলমন্ত্রী বুঝি দোষী নয়?
ঝাড়গ্রাম স্টেশনেই এক আর একে দুই হয়।
খুব লেটে ট্রেন এল দু’জনের দেখা হল
দোষ বুঝি দেখা হওয়াটাই!
দোষ করেছেন কিন্তু রেলমন্ত্রীরাই।
নন্দনে
আমার গণতন্ত্র তুমি
আমার মাথা ধরা
অনেক দোষ করেও তুমি
আমার বাঁচা মরা।
এক পা ছিল কালিয়াদহে
এক পা কলকাতা
আমার সুখ অসুখ নেই
পিছলে গেছে পা-টা।
ছিল তারাই ভাল
বাচ্চা মেয়ে, বসেই ছিল
হঠাৎ সে দাঁড়াল।
দাঁড়াল যেই আমি অবাক
বাচ্চা নয় তো সে
বড় মেয়েকে বাচ্চা লাগে
থাকলে দূরে বসে।
দাঁড়িয়ে ছিল উইলো গাছ
খুলল সানগ্লাস।
বোকা ছেলেরা, মারল চোখ
ওতে কী সুখ পাস?
হ্যালো সুবোধ, ভাল আছেন?
দেখিনি কত দিন
কোথায় যেন গিয়েছিলেন
সাইপ্রাস না চিন?
আমি অবাক, চেনে আমায়
কী করে চেনা হল?
কখনও আমি খেলিনি আগে
রাজার খেলা পোলো।
রাজার রোগ ছিল আমার
খেতাম ছাইপাঁশ
ছ’ভাইবোন কেড়ে খেতাম
মুখের থেকে গ্রাস।
ডেনিম পরা মেয়ে
আকাশ থেকে পেলাম চাঁদ
কী করি চাঁদ পেয়ে?
কী হল ভুলে গেলেন নাকি
তিন বছর আগে
আমরা গিয়েছিলাম উড়ে
প্যারিস থেকে প্রাগে।
অসভ্যতা করেছিলেন
গেলেন সব ভুলে?
গত জনমে ছিলাম প্রিয়া
গন্ধ আছে চুলে।
কী ভেবেছেন, আমি বধির
যা খুশি বলা যায়!
মনে পড়েছে, গড়িয়াহাট
আপনি সীতা রায়।
আপনি সীতা, দুঃখী সীতা
বর নেয়নি বলে
আপনি চলে গিয়েছিলেন
পৃথিবী ছেড়ে চলে।
ভালই হল চাঁদ পেলাম
নন্দন চত্বরে
ডেনিম পরা, নাইকি পরা
সীতারা আজও ঘোরে।
কী কী হবে
রাজস্থানে হাত-কাটা ব্লাউজ পরা বারণ
মেয়েরা পা দেখাতে পারবেন না।
মধ্যপ্রদেশে কবিতা নিষিদ্ধ হবে
রামায়ণ পাঠ করুন, পয়সা পাবেন।
হিমাচলে কিট্স এবং কার্ল মার্কসের
অসভ্য চিঠি পোড়ানো হবে।
ডোগরি ভাষায় হনুমান চর্চা বাড়বে
সরকারি অফিসে হনুমানের ছবি টাঙানো হবে।
হরিয়ানায় কাওয়ালি গাওয়া বন্ধ
কাওয়ালি গায়কেরা ফিরে যান ইসলামাবাদে।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যদি ঘোষণা করা হয়
মেয়েদের চুমু খাবেন না, হাত ধরবেন না, কোমর ছোঁবেন না
তাহলে একটা প্রশ্ন আছে, এই যে আপনাদের ন’-দশটা ছেলেমেয়ে
চুমু না খেয়ে কী করে ওদের পেলেন?
মন্ত্রীজি, খুব জোরে আপনি আমার কান মলে দিন
আজকেই আমি একটি মেয়েকে প্রাণ ভরে চুমু খেয়েছি।
থানা
আমরা থানার দরজা আটকে দাঁড়ালাম
হাবিলদারজি আনতে গেছে রাম।
আমরা তা হলে দরজা আটকে বসি
এফ.আই.আর নিচ্ছেন না যে ও.সি।
তা হলে আমরা দরজায় লিখে যাই
অপরাধীদের কাস্টডিতে চাই।
ও.সি বললেন আমার হাত পা বাঁধা
পাড়ার লোকেরা আস্ত আস্ত গাধা।
চকমকিতলা
সবুজ ঘাসের লোভে বর্ডার পেরিয়ে
গোরু নিয়ে ঢুকে পড়েছিল
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
গোরুকে ফিরিয়ে নিতে ফারুক ঢুকেছে
ভারতবর্ষে।
ভারতবর্ষ নয়, চকমকিতলা
যে কথা হয়নি বলা
রাত হয়ে গিয়েছিল, ফেরেনি ফারুক।
ভয়ে কাঁপে বুক
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
এ বছর দিল্লিতে মন্ত্রিসভা বসে।
ঘর ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, মাটি ছেড়ে দিয়ে
বর্ডার পেরিয়ে
ফারুকের জন্য এল
কাদম্বিনী নামে এক গরিবের অষ্টাদশী মেয়ে
রোগা মেয়েটির চোখে ভাত
এবং ফারুক
সমার্থক দু’রকম খিদে, খিদের কি আছে কোনও জাত!
এ বাড়িতে জল দিয়ে, ও বাড়ির ধান বুনে দিয়ে
ফারুককে চকমকিতলা
নিয়েছে খাটিয়ে।
বদলে পেয়েছে সেই সোনার কাগজ
একটি রেশন কার্ড
ছেঁড়া বালিশের নীচে ছুঁয়ে দেখে লাখ টাকা রোজ
শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে প্রেমিক ফারুক।
আমাদের ভয়ে কাঁপে বুক
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
বর্ষাকালীন এক মন্ত্রিসভা বসে।
চকমকিতলা
যে কথা হয়নি বলা
অনুপ্রবেশকারীর তালিকায় ফারুকের নাম
কী খাবে ফারুক তুমি হুইস্কি না রাম?
শরণার্থী তালিকায় কাদম্বিনী ওঠে।
আমি কি কয়েকটা দিন থেকে যেতে পারি?
ফারুক জানতে চায় রোজ
ডবলু. বি. সি. এস করা তরুণ বি. ডি. ও
বলতে পারে না কথা, যে কথা অপ্রিয়
শরণার্থী না অনুপ্রবেশকারী খুঁজে চলো খুঁজে চলো
এ হল ভারত এক খোঁজ।
সেই ছেলে যে বোমা বানাত
রাজু খুব ভাল ছেলে
গ্রাম থেকে এসেছিল, ফিজিক্স্ পায়নি
পেলে
থাকত না এত অভিমান!
কিন্তু তার দুটো চোখ পদার্থ বিজ্ঞান।
বছর যেতে না যেতে পার্টি, পোস্টার
দিনে নয়, রাতে ফিরে স্নান
কলেজের করিডোর, অধ্যক্ষ ঘেরাও
বুদ্ধিমান ছেলেটিকে রাস্তায় পাঠাও
ভাল ছেলে এখনও আকাল
হ্যারিসন রোডটাই হল তার কাল।
রেডবুক, বলিভিয়া, কিট্সের চিঠি
বিক্রি হয় না আর হ্যারিসন রোডে
একটি বাড়িতে এল, চিলেকোঠা ভীষণ নির্জন
সেখানেই শুরু হল রাজুর জীবন।
রাজু খুব বুদ্ধিমান ছেলে
ফিজিক্স্ পায়নি, কিন্তু মাথা জুড়ে পদার্থ বিজ্ঞান:
পেরেকের সঙ্গে দড়ি, বারুদের সঙ্গে লোহা দু’ ইঞ্চি করাত।
বোমা-স্পেশালিস্ট হতে লাগল ছ’মাস।
সম্ভব হয়নি শুধু পরীক্ষায় পাশ।
এক পার্টি আসে আর এক পার্টি যায়
রাজু একা গ্রেনেড বানায়।
একটি মারুতি থামে, ছোট নেতা নামে
কনট্র্যাক্ট—দু’ হাজার ছোট হাতবোমা
সাপ্লাই দেবার পর বড় নেতা রাজুকেই চান
সোজা জেলে রাজুকে পাঠান
রাজু যাতে অন্যের অর্ডার পেলে বোমা না বানায়।
রাজু খুব বোকা ছেলে, তার চোখে পদার্থ বিজ্ঞান।
আমার অবাক লেগেছিল
পুলিশের ভ্যান
যেদিন রাজুকে তুলে চিলেকোঠা সিল করে দিল
মহাবিশ্বে মহাকাশযান
সেদিন খবর হল রাজস্থান,
ছোট্ট পোখরান।
আপনারা পোখরান, আপনারা বালুচিস্তান
সেই ভাল, রাজুদের জেলেই পাঠান!
আটটা পঁয়তাল্লিশ
সকাল ৮:৪৫ এ কালো কাপড়ে ঢাকা একটা ছুরি
ভেসে ওঠে আমার চোখের সামনে।
আমি ডাক্তারকে বললাম
আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন, ওষুধে হোক
ইনজেকশানে হোক
আটটা পঁয়তাল্লিশের ব্যাধি আমাকে ভুলিয়ে দিন।
আটটা পঁয়তাল্লিশে আপনার ঠিক কী কী মনে পড়ে?
প্রথমে দেখা দেয় খোলা চুল
খোলা পিঠ বেয়ে নেমে
কোমরের কাছে ছড়িয়ে পড়ে
চুলের ভেতর দেখা দেয় দুটি নক্ষত্র—বিশাখা আর কৃত্তিকা
তারপর সেই চোখ ভেসে ওঠে
আর চোখের ভেতর ভেসে উঠি আমি নিজে
নিয়তি এসে ডাকছে, এসো, আমার চোখে
চোখ রেখে দাঁড়াও, দেখো, যা এতদিন
কোথাও দেখতে পাওনি।
আমি ওই চোখ ভুলতে পারি না, টেলিফোনেও আমি
ওই চোখ দেখতে পাই
চিঠিতেও ঘুরে বেড়াতে দেখি ওই চোখ
তার সঙ্গে একশো মাইল উঁচু শূন্য থেকে
চিলের মতো ছুটে নেমে আসতে থাকে একটা ছুরি
নিউ মার্কেটের একশো তিন নম্বর দোকান থেকে
এক বসন্তের সন্ধ্যায় কিনে বলেছিলে, দেখো, ডামাটটা কী শক্ত
ঠিক তোমার পিঠের হাড়ের মতো
দেখো, এপাশে কী ধার, আমি একে আরও
ধারালো করব, ভালবাসা দিয়ে,
অহংকার দিয়ে মোম দিয়ে
আমার ইগো সাংঘাতিক বুঝলে মশাই
তুমি যদি কথা না শোনো, তবে
বলে দিলাম এই ছুরি আমার কথা শুনবে,
নাও এক্ষুনি আমার এখানে একটা চুমু খাও
আমি বললাম, কী হচ্ছে, নিউ মার্কেটের
ভেতরটাও তো কলকাতা,
তুমি গুনতে শুরু করলে, ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর…
ডাক্তার বললেন, কিছু মনে করবেন না
চোখ থেকে কি আপনার কোনও যৌন স্মৃতি
তৈরি হয়? কোনও কাগজ, কোনও কাঠের টুকরো, প্লাসটিক
যা কিনা কোনও বিশেষ মুহূর্তে
ভালবাসতে গিয়ে লেগেছিল? কোনও অভাব?
অভাব থেকে প্রতিহিংসা
তারপর নারী সম্পর্কে ঘৃণা? এবং ঘৃণা থেকে
গোপনে কাউকে বলাৎকারের ইচ্ছা?
নিউ গিনিতে সম্প্রতি একজন, স্রেফ মেয়েদের সম্পর্কে
ঘৃণা থেকে নিজের বোনকে ধর্ষণ করেছে
কিন্তু করেই ছেড়ে দেয়নি, তার মনে হয়েছে
সমস্ত মেয়েরা তার বোনের ভেতর দিয়ে
ধর্ষণকে উপভোগ করছে, সে তারপর গরম ইস্তিরি
চেপে ধরে তার বোনের দু’ ঊরুর মাঝখানে।
মেয়েটা মরে যাবার আগে পুলিশকে বলে গেছে
‘আমি দাদাকে ভালবাসতাম, দাদাও আমাকে স্নেহ করত
এর জন্য ওই মেয়েটাই দায়ী, যে আমার দাদাকে
ভালবেসে আরও দুটো লোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত।’
ডাক্টারবাবু, ওসব ভয়ংকর গল্প আমাকে বলবেন না
আপনি আমাকে সেই ওষুধ দিন
যাতে আটটা পঁয়তাল্লিশের ব্যাধি ভুলে যেতে পারি।
ঘৃণা নয়, ভালবাসার গল্প বলুন
সকালবেলার রোদ এসে পড়েছে আমার হাতে
এই হাত যেন কারোর টুঁটি চেপে না ধরে
আটটা পঁয়তাল্লিশের ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাই।
ঠিক কী কী হয় আপনার?
হাতের আঙুল গরম হয়ে ওঠে, মাথার বাঁ দিকটা
মনে হয় খুলে যাবে
হু হু করে বাতাস ঢুকে পড়বে
ঢুকে পড়ছেও, দু’-এক ফোঁটা বৃষ্টিও ঢুকে পড়ল
দু’-একটা ঘাসের টুকরো,
তার সঙ্গে একটা গম
তারপর কেউ এসে মাথার দেওয়াল তুলে দিয়ে
ফাটা জায়গা সেলাই করে
মাথায় আলতো চাঁটি মেরে বলল,
‘আর য়ু অল রাইট? নাও য়্যু ক্যান ফাক মি৷’
কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মেয়েটার হারিয়ে যাওয়া গলা
শুনতে শুনতে মনে হল
আমার মাথার ভেতরে একটা গম, সেটা কী করে বেরুবে
নাক দিয়ে কি বেরুতে পারে? জানি না, জানি না
ডাক্তারবাবু, আমি সেই গিটার জানা আধুনিক মেয়েটাকে বললাম
তুমি তো ওসব জিনিস অনেক করেছ, জলভাত
হলিউড তোমাকে অনেক দিয়েছে
বেল বেজে ওঠা এবং দেরিতে দরজা খোলার
ভেতর যে সময়টুকু
সেটুকু সময়েও তুমি জাস্ট দাঁড়িয়ে এবং অর্ধেক দাঁড়িয়ে
য়্যু ডিড ইট উইথ ইয়োর স্কার্ট আপ।
আবার আমাকে কেন ওসব বলছ, তোমার তো বহু
জানাশোনা অধ্যাপক, আই. পি. এস, আই. এফ. এস।
স্প্যানিশ জানা, ফরাসি জানা, পর্তুগিজ জানা, এসপারান্তো জানা
ঘোড়া আছে, চাবুকটা তাদের মেরে দেখো না?
তারা তোমাকে একেক দিন এক এক এমবেসিতে
নিয়ে গিয়ে ও সব করবে, কত ভাল হবে?
ডাক্তারবাবু ঠিক এই সময়ে, কে যেন হাতের মুঠোয়
চেপে ধরে আমার শিশ্ন
তারপর দাঁত দিয়ে চেপে ধরে, কামড়ায়
আমার দমবন্ধ হয়ে আসে, হয়তো ভালও লাগে
ডাক্তারবাবু, আমার মনে হয় আটটা পঁয়তাল্লিশেই
আমি একদিন মারা যাব।
আমার আর গোলাপ ভাল লাগে না
গোলাপের প্রতি পাপড়িই
এখন রাজনীতি
প্রতিটি পাতাই এখন ষড়যন্ত্র
না হলে গত ২৯ আগস্ট আমাকে
গোলাপের পাতা ফোন করল কেন?
ফোন করে রবিবার সকালে
‘হট ব্রেড’ নামে একটা রেস্তোরাঁয় দেখা করতে বলল কেন?
ডাক্তারবাবু আমি একটা
ধারালো ছুরি
ছুরি না, ক্ষুর
দু’দিকেই কাটে এরকম একটা ক্ষুরকে
ভালবেসেছিলাম
সেই ক্ষুর আমার গলার কাছে
সেই ক্ষুর আমার গলার নীচে
আদর করত
সেই ক্ষুর আমার কবজির একটা
শিরার ওপর শুয়ে থাকত।
সেই ক্ষুরের সঙ্গে আমি তিন দিন তিন রাত
শুয়েছিলাম ‘ছুটি’ নামে একটা হোটেলে
মিসেস ক্ষুর ডলার হিসেব করে ডলারেই
বিল মিটিয়েছিল। স্বামীর ব্যাগ থেকে তুলে আনা ডলারে।
কোনওদিন আটটা পঁয়তাল্লিশে কিছু ঘটেছিল?
না
কখনও ঘটেনি?
কোনও স্মৃতি নেই?
না।
ফোনে কেউ খারাপ কথা বলেছিল?
না, না। না ডাক্তার, সকালবেলায় আমার জীবনে
কোনও ঘটনা ঘটেনি। সমস্ত ঘটেছে
দুপুর বারোটার পরে
আপনি চাঁদের স্বপ্ন দেখেন?
না। তবে চাঁদ নিশ্চয়ই আমার স্বপ্ন দেখে।
দৌড়তে পারেন ঘুমের ভেতর?
জীবনে কখনও আমি দৌড়ইনি, এমনকী স্কুলেও না।
কলেজেও না। যারা দৌড়য় তারা ভাল করে
হাঁটতে শেখে না।
নক্ষত্রের স্বপ্ন দেখেন?
সে তো ভিখিরিও দেখে।
ডাক্তার আমি একটা স্বপ্ন আগে দেখতাম
সেটা বলি:
একটা দ্বীপ, দ্বীপের ভেতরে কোনও মানুষ নেই
বিরাট বিরাট বাড়ি, আর বাড়ি ভরতি বই
এমনকী বাথরুমেও বই, কমোডেও বই
হুঁ, আর কোনও স্বপ্ন!
আর একটা স্বপ্ন খুব দেখতাম
নির্জন একটা রাস্তা, আমার পাশে পাশে হাঁটছে
একটা চমৎকার মেয়ে
আমি তার হাত ধরে আছি, বহুবছর হাঁটছি
কিন্তু প্রায় মনে হত তার হাত আমি ধরতে পারিনি
সে ইজিপ্টের রাস্তায়
একটা ফরসা লোকের সঙ্গে হাত ধরে হাঁটছে
হুঁ, আর কোনও স্বপ্ন?
একজন অধ্যাপিকা, হাতে বৈদ্যুতিক চাবুক নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছেন
রাত জেগে তিনি ছাত্রদের জন্য নোটস তৈরি করছেন
কাল তাঁকে হায়দ্রাবাদ যেতে হবে সেমিনারে
তিনি দাঁড়িয়ে আছেন
আমি তাঁর পায়ের কাছে পড়ে আছি
এবং আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে
ফার্নান্দো পেসোয়া নামে
এক পর্তুগিজ কবি।
আর, আর কোনও স্বপ্ন?
পিঠে চাবুক পড়তেই পেসোয়া উঠে দাঁড়ালেন
উঠে দাঁড়াল যেন একটা ঘোড়া
মুখটা তখনও মানুষেরই,
সেই অধ্যাপিকা এরপর
হাত আর হাঁটু মেঝেতে স্থাপন করে, চতুষ্পদ হয়ে
মাথা নামিয়ে পেসোয়ার কবিতা পড়তে লাগলেন
আর পেসোয়া পেছন থেকে নির্দেশ পাওয়া মাত্র
কাজ শুরু করলেন।
ডাক্তার বললেন, বড্ড প্রিমিটিভ এবং
পোস্ট-মডার্ন
স্বপ্নটা শেষ হয়নি এখনও
এক ঘণ্টা বাদে, সাধারণত এক ঘণ্টা বাদে বাদে
নিমফোদের পুরুষ লাগে,
আমার পিঠে চাবুক পড়তেই
আমি উঠে দাঁড়ালাম
এবার তিনি আমার পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখছেন
আমি বললাম, আমি একজন ব্যর্থ কবি
কবি সফল না হলে তার কবিতাও সফল হয় না
তিনি বললেন, কাম অন, ডোন্ট বি সিলি
আমার সেমিনার আছে, পেপার লিখতে হবে
হারি আপ, তাড়াতাড়ি।
ডাক্তারবাবু বললেন
মেঘের পরে মেঘ জমেছে গানটা শুনলেই
আমার এক রোগিণী হিংস্র হয়ে উঠত
বাসন ছুড়ে মারত, টেবিল উলটে দিত, সাবান খেয়ে ফেলত
ডাক্তারবাবুর মতে
ওই গানটা চালিয়ে নাকি তার স্বামী তাকে মারত।
কিন্তু ডাক্তার, আমার আটটা পঁয়তাল্লিশের কী হবে?
আপনি ভুলতে চাইছেন?
দেখুন আপনাকে ভুলিয়ে দিতে পারি ছ’মাসের জন্য
আপনি গোলাপ ভুলে যাবেন
পাপড়ি ভুলে যাবেন
ক্ষুর ভুলে যাবেন
ক্ষুরের ধার ভুলে যাবেন
কিন্তু ওষুধ ছাড়াই আপনার একটা চিকিৎসা আছে
সেটা করাবেন?
আমি বললাম, বলুন
আপনি তিনমাস ছুটি নিন, ছুটি নিয়ে
রাস্তার কয়েকটা ছেলেমেয়ে জড়ো করে
অ আ ক খ শেখান, গান শেখান, ছবি শেখান
লিখতে শেখান
আপনাকে বড় কিছু করতে হবে না, এই কাজটুকু
করে দেখুন, আপনি সম্পূর্ণ সেরে উঠবেন।
আমার আটটা পঁয়তাল্লিশের কী হবে?
ডাক্তারবাবু বললেন
সকাল আটটা পঁয়তাল্লিশে প্রতিদিন আপনাকে কয়েকটা
অনাথ শিশু এসে ঘিরে ধরবে, খেতে চাইবে
পড়তে চাইবে
এর থেকে সুন্দর কোনও আটটা পঁয়তাল্লিশ
আপনার জীবনে আসেনি।
অনাথ ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারেন না
ওরা আপনাকে কিছু বলতে চায়
এই তো সময়, শুনুন ওদের ভাষা
পৃথিবীর যে কোনও শ্রেষ্ঠ কবিতার থেকেও
সে ভাষা সুন্দর।
তিনমাস বাদে আপনার ই. সি. জি. করান,
সিটি স্ক্যান, থ্রোট সোয়াব, হিমোগ্লাবিন
একটা থরো চেক-আপ
করিয়ে নেব মেডিনোভায়।
ভাল থাকুন, তিনমাস বাদে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
দার্জিলিং
হেয়ার-পিন বাঁকের কাছে মারুতি থামিয়ে মণিকুমার বলল
কুয়াশা দু’রকম; হোয়াইট ফগ, ব্ল্যাক ফগ
শাদাটা তেমন কিছু না, কালো কিন্তু বিপজ্জনক
তৃতীয় কোনও কুয়াশা হয় কি না ভাবছিলাম।
ঘুমে পৌঁছে মণিকুমার গল্প বলছে পাহাড়ের
দুটো মেয়ে এল সেবার গ্যাংটক থেকে
তিনটে ছেলেকে বলল, আমাদের বন্ধু হবে?
পাঁচজন তারপর পাহাড়ে পাহাড়ে ঝরনায় হোটেলে হোটেলে।
দশদিন বাদে মেয়ে দুটোকে প্লেনে তুলে দিতে গেলে
মেয়ে দুটো বলল, তোমরা এত ভাল, এত সরল
তোমাদের জন্য রইল এই বাক্সটা, আমরা চলে গেলে খুলবে।
বাক্স খুলে গেল, টকটকে রডোডেনড্রন গুচ্ছ
সঙ্গে শাদা খাম, লেখা আছে
‘ফ্রেন্ডস, ওয়েলকাম টু এইডস অ্যাসোসিয়েশন।’
তৃতীয় কোনও কুয়াশা হয় কি না ভাবছি, রাত একটায়
সার্কিট হাউসের ঘরে ঢুকে মণিকুমার আমাকে
একটা মোমবাতি আর একটা কুকরি দিয়ে গেল।
এ জিনিস নিয়ে আমি কী করব?
মণিকুমারের ফরসা নেপালি মুখ— রেখে দিন
যদি রাত্রিবেলা কেউ আসে, আমি গাড়িতে থাকব।
কালো কুয়াশা মারাত্মক, কিন্তু কেন সেটা মণিকুমার বলেনি
বাতাসিয়া লুপে ঝমঝমে বৃষ্টি
তৃতীয় কুয়াশা কই?
মকাইবাড়ি চা বাগানের কাছে এসে গাড়ি থামল
বউ ঢুকল বাগানে চা কিনতে
খাদ থেকে ডাকছে ঝাউকিরি পোকা, এত জোরে
পোকার ডাক শুনিনি কখনও, এরা তিন মাস ডাকে
ন’মাস ডাকে না।
হঠাৎ ব্ল্যাক ফগ আমাকে, ঘুমন্ত শিশুপুত্র সমেত
ঢেকে নিল। এই, এই, এটা কী হচ্ছে?
কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?
মণিকুমারের গলা টিপে ধরেছে একটি নেপালি মেয়ে
হো হো করে হাসছে দূরে দাঁড়ানো সরল এক যুবক।
তৃতীয় কোনও কুয়াশা হয় কি না ভাবছিলাম
পাঙ্খাবাড়ি রোডে এসে গাড়ি পড়তেই মণিকুমার বলল
হিল কাউন্সিল হয়ে হয়তো ভালই হয়েছে
কিন্তু যারা দেড়শো বছর সরল ছিল
তারা নীচ থেকে আসা লোকদের আর বিশ্বাস করে না।
বাপব্যাটার গল্প
রোরোর বন্ধু বালতির জল।
রোরোর বন্ধু ডিউস বল।
আমার বন্ধু দুঃখী গেলাস
আমার বন্ধু গোধূলি
বলেই ফেলি, ভালই লাগে
চোখের থেকে চোখের ঠুলি।
রোরোর যত দুষ্টু বন্ধু
রোরোর বন্ধু ম্যাপের বই
আসুন হঠকারীর দল
রোরোর মতো দুষ্টু হই।
রোরোর বন্ধু সবুজ আন্টি
রোরোর বন্ধু রং পেনসিল
আমার বন্ধু ডিভোর্সিরা
আমার বন্ধু দুঁদে উকিল।
রোরোর সঙ্গে আমি হেরে যাই
‘বাবা, কেন যে হারো?’
রোরোর প্রশ্নে উত্তর দিই
‘জেতেনি বাবার বাবাও।’
রোরোর বন্ধু আলো সকাল
আমার বন্ধু রাত্রি
হঠকারীদের হাতে হুইস্কি
এখন চলছে পার্টি।
গুন্ডাগুলোর কী হইচই?
পার্টি ফেরত, আসুন আমরা
ওদের মতো গুন্ডা হই।
তা আর হতে পারলাম কই।
চাঁদু
চাঁদে চাঁদ চাঁদের ওপিঠ
পোকা মাকড়ের মধ্যে আমি পথিকৃৎ।
চাঁদে চাঁদে লিখি চন্দ্রদোষ
ছিলাম তোয়ালে আমি, এখন পাপোস।
চাঁদে চাঁদে রটে বদনাম
যা হবার হবে, বলো, হুইস্কি না রাম?
চাঁদে চাঁদ ভ্রষ্ট রাজনীতি
এম. এল. এ হস্টেল থেকে ছোট্ট এস. টি. ডি।
চাঁদে চাঁদে অমর্ত্য সেন
খাদ্য বণ্টনের ফুটো সারিয়ে দেবেন।
চাঁদে চাঁদে কত কাকা মামা
ধুতি পাঞ্জাবি পরা আলফা বিটা গামা।
পৌরসভার জ্যোৎস্না কিনছে আম্বানি।
চাঁদে চাঁদ আর কী কী হয়?
বেণুবনে মুক্তোগুলো হল নয় ছয়।
চাঁদে জন্ম চাঁদে নষ্ট মেয়ে,
রোগা হয়ে গেছ তুমি আদর না পেয়ে।
চাঁদে জন্ম চাঁদে নষ্ট ছেলে
ভাল হয়ে যেতে তুমি ভালবাসা পেলে।
চাঁদে চাঁদে আমি চন্দ্রদোষ
সমস্ত মূর্থের সঙ্গে করেছি আপস।
গরিবেরও আছে হানিমুন
ভাত আছে, পেতে পারি সঙ্গে একটু নুন?
হরিদাস পাল
হাসছেন হরিদাস পাল
যুগে যুগে হাসছেন, হেসেই কামাল।
কাঁদছেন হরিদাস পাল
যার জন্য তোলা আছে শ্রেষ্ঠ গালাগাল।
ঘুমোচ্ছেন হরিদাস পাল
আপাতত নেই কোনও খাদ্যের আকাল।
আপনাকে ভালবাসে গঙ্গা ও তিতাস।
দু’বাংলায় লোকে ডাকে হরি
ওদের মেয়ের সঙ্গে আমরা প্রেম করি।
লোকে বলে হরিদাস কেলো
চর্যাপদ থেকে নাকি ঘাস নিয়ে এল।
ঘাস কাটছেন হরিদাস
ক্লাসরুমে আমরাও কেটে থাকি ঘাস।
পার্লামেন্ট ভরতি হরিদাস
ভারতের ভাগ্যাকাশে আজ ভাদ্রমাস।
হাতে রাখো লোকাল পুলিশ,
চোর, জোচ্চোর তোরা ভালই আছিস।
হরিদাস লিখে চলেছেন
ঢাকাতেও কলকাতা কিছুটা পাবেন।
হরিদাস পাল তুমি বোকা?
ধর্ম করে বেড়াচ্ছেন যত বুড়ো খোকা।
আমি বুঝি হরিদাস নই?
হলিউড দেখি যত, দাসত্ব ততই।
বাংলাদেশের আমি দাস
ভালবেসে পুড়ে গেছে সব হাড়মাস।
মিসেস ভৌমিক হল আপনার কাল।
চিরতরে ওটাকে ছাড়ুন
ওপরটা ঝকঝকে, ভেতরটা ঘুণ।
সুপ্রভাত, হরিদাস পাল
ফেরাতে পারেন আপনি বাংলার হাল?
বাংলার মুখ আর বুক
হোয়াইটওয়াশ করে পেতে চাই সুখ।
সুখ চান, আপনি হরিদাস?
কিছুটা সুখের হোক যন্ত্রণা ছ’মাস।
ঢাকা ভাল, কলকাতা ভাল
কাটা হাত, কাটা মুন্ডু আসাম পাঠাল।
শুভরাত্রি, হরিদাস পাল
পৃথিবী বনগাঁ হোক, হোক বরিশাল।
ভগবান
আমাকে নিয়ে আপনাদের ভারতবর্ষে একটা গন্ডগোল শুরু হয়েছে
আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই
কোহিমা থেকে কোভালাম
আমাকে আজীবন শুনতে হয়েছে
কেউ আমাকে বলার সুযোগ দেয়নি।
আমি কী করে ভগবান হলাম আমি জানি না
কে আমার বাপ
কে আমার মা জানি না
কিন্তু ব্যর্থতার কৌতুক থেকে
আমার জন্ম হয়েছিল
আমার বাবার নাম ট্র্যাজেডি
মা-র নাম কমেডি।
বাইবেল নামে একটা বই আছে
সেখানে লেখা হয়েছিল
আমি নাকি আমার চেহারার মতো করে
আপনাদের সৃষ্টি করেছি
ডাহা মিথ্যে কথা
আমি আপনাদের সৃষ্টি করিনি
আপনারাই আমাকে সৃষ্টি করেছেন
বন্যার আগে
বন্যার পরে
খরার আগে
খরার পরে
এবং অবশ্যই মশা জন্মাবার আগে
এবং অবশ্যই
ম্যালেরিয়ার পরে।
আমি শুনলাম আমি নাকি গরিবের লোক
মানে কী?
আমি কমিউনিস্ট
না কালীপুজো?
আমি পাঞ্জাবের গমখেত
না পুরনো দিল্লির বস্তি?
আমি দুবাইগামী মারাঠি
আমি গোয়ার চোখে পর্তুগিজ
না জারোয়ার চোখে পোর্টব্লেয়ার?
তা আমি তো এতদিন দেখে এলাম
গরিব ক্রমশ গরিব হয়ে গেল
কী করতে পেরেছি আমি?
একটা লকআউটও তোলাতে পেরেছি?
একটা ছেলেকেও চাকরি দিয়েছি?
আমি নাকি বড়লোকদের লোক
মানে কী?
টাটা বিড়লারাও আমাকে মানে
গোয়েঙ্কার শোবার ঘরেও আমি আছি।
বড়লোকেরা বড়লোক হয়েছে বড়লোকের জন্য
আমার কোনও হাত নেই
আমার হাতই নেই, থাকলে
ওদের কান ধরে টেনে এনে
বস্তিগুলো দেখাতাম।
পি. জি. হোস্টেলের একটা ছাত্র টয়লেটে লিখেছিল
‘গড ইজ ডেড, বলেছেন নিৎসে’
সেটা কেটে অন্য একটা ছাত্র লিখেছিল
‘নিৎসে ইজ ডেড, বলেছেন গড’
দাঁত চেপে দারুণ হেসেছিলাম সেদিন।
আমাকে নিয়ে একটা গন্ডগোল পাকিয়ে উঠছে জানি
ভারতবর্ষের
৩৫ শতাংশ লোক দাবি করছেন
আমি নাকি ওদের
আমার জন্যই তাদের পার্টি
তাদের পরিবার, তাদের সংঘ, তাদের সেনা
তারাই নাকি মানবসম্পদ
তারাই নাকি মেজরিটি
৩৫ শতাংশ নিয়েও তাহলে বোকা বানানো যায়?
খেলতে দেব না বলা যায়?
গানের অনুষ্ঠানে ঢিল মারা যায়?
কোনও দল তেমনভাবে আমাকে পাত্তা দেয়নি
প্রথম প্রথম ভাল লেগেছিল।
পরে বুঝলাম, ও হরি,
এরা আমাকে বিক্রি করছে, আমি কোনওদিন
আমার নিজের সাবান, নিজের বানানো
টুথপেস্ট, আমের আচার
বিক্রি করতে পারলাম না
আর এরা আমাকে ক্যাপসুল করে গ্রামে গ্রামে পৌঁছে দিচ্ছে
আমার এরকম আত্মজৈবনিক সংকট
এর আগে কখনও দেখা দেয়নি।
আমাকে যখন রাশিয়া থেকে পিটিয়ে
বের করে দিয়েছিল ওরা
আমি বলেছিলাম, ওরা উন্নতি করবে
আমাকে যখন মেক্সিকো থেকে
পুলিশ দিয়ে তুলে দিয়েছিল
তখনও মজা পেয়েছিলাম।
কিন্তু এরা এখন আমাকে বেচে যা তুলে নিচ্ছে
তাতে আমার কষ্ট হয় আজকাল।
আমি গরিবকে আর মুখ দেখাব কী করে
গরিবরাই বা আমার মুখ দেখবে কেন?
সেমিনার হলে এক বিখ্যাত অধ্যাপক বলে চলেছেন
‘আই ডু নট বিলিভ ইন গড’
এক ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল:
‘স্যার, ডাজ গড বিলিভ ইন গড?’
সেই অধ্যাপকও হেসে ফেলে বললেন
কথাটা সেখানে নয়, কথা হল
আমরা যে এতদিন একজনকে
ভগবান ভগবান বলে ডেকে এলাম
সেটা কে?
সে কি আমাদের রুটি তরকারি খেতে এসেছিল?
সে কি দুঃখীর পাশে মদ হয়ে দাঁড়িয়েছিল?
সে কি বিয়ে না হওয়া মেয়েটির
শেষ বিকেলের ফুচকাওয়ালা?
সে কি পোড়াবাড়ির থেকে বের করে আনা
এক বাটি না-পোড়া ভাত
সঙ্গে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া
একটু নুন
আর একটা কাঁচালঙ্কা।
অধ্যাপকের কথা বাদ দিন
আমি আমার কথা বলি
আমার ওপর মানুষের সবচেয়ে বড় অভিশাপ
আমি মরি না
গির্জা পোড়াও, মন্দির পোড়াও, মসজিদ পোড়াও
আমি পুড়ি না
আমি পুড়ে যাওয়া কয়েকটা বালকের পাশে
সারারাত বসেছিলাম গুজরাতের গ্রামে
আমার যেহেতু চোখ নেই, কাঁদতে পারিনি
তা ছাড়া আমি কাঁদলে ভাল দেখাত না।
একটা ভাল দিন আসবে
একটা বড় দিন আসবে মানুষের
ভেবেছিলাম,
সেটা আসেনি, ভেবেছিলাম
গরিবের মুখে একটা বড় হাসি দেখতে পাবে সবাই
ভেবেছিলাম
আরব, ইরাক, পাকিস্তান, আমেরিকা
একটা স্কুল বাসে করে পিকনিক করতে আসবে
মুকুটমণিপুরে
তা আর হল কই!
আমি না পারলাম কারোর ভাল করতে
না কেউ পারল
আমার ভাল করতে
যেখানে জন্মেছিলাম, সেখানেই আছি
আমার বাবার নাম ট্র্যাজেডি, মায়ের নাম কমেডি।
মরীচিকা সেন
নমস্কার, মরীচিকা সেন
তেপান্তরে বসে একটু হুইস্কি খাবেন?
মাঘে শীত, চৈত্রে সেল, জ্যৈষ্ঠে বারগেন
নমস্কার, মরীচিকা সেন।
আপনার চোখে জল, তবু হাসছেন
নমস্কার, মরীচিকা সেন।
খান তবে ব্লাডিমেরি, আমি খাই রাম।
নমস্কার, মাদমোয়াজেল
আপনার হৃদয় ছিল সেন্ট্রাল জেল।
নমস্কার, মরীচিকা সেন
একদিন আমাকেও ভালবেসেছেন।
এরকম ক’জনকে ভালবাসলেন
আপনার লেন, বাইলেন?
আপনি নাকি ফ্ল্যাট কিনে একাই থাকেন
নমস্কার, মরীচিকা সেন।
ভগবান আছে নাকি, আছে এন.আর.আই
ঘোচাবেন দুঃখ তেনারাই।
চমৎকার কেটেছিল একটি দুপুর
আপনি অরুণাচল, আমি মণিপুর।
ন্যারোগেজ রেল চলে ছাঁইয়া ছাঁইয়া
হতে পারি আবার মরিয়া।
আপনার ভালবাসা যেন শেষ ট্রেন
মাঝরাতে ধানখেতে ফেলে পালালেন।