এসেছিল সে পূর্ণিমা সন্ধ্যায় (কবিতাগ্রন্থ)
কোয়েল তালুকদার
প্রকাশকাল – জুন ২০২৪ ইং
উৎসর্গ
এসেছিল সে পূর্ণিমা সন্ধ্যায়
মন্দাক্রান্তায় রচিত হয়েছিল সে আবেগে অনুরাগে –
মায়াবতী কে।
১ . প্রস্থানের দিনে
মনে করো, এই যে আমি কবিতা লিখছি, গল্প লিখছি-
আমি যদি আর না লিখতে পারি !
একদিন আকাশ দেখব বলে বেরিয়ে গেলাম।
যদি আর ফিরে না আসি।
যদি আকাশের তারাদের কাছে যেয়ে বসে থাকি।
এই যে দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি টানানো আছে,
ওটা নামিয়ে দিয়ে নজরুলের মতো ঝাঁকড়া চুলের
আমার ছবিটি কি তুমি ওখানে লাগাবে?
সন্ধ্যার বুকে নিভে যাওয়া আলোয় দেখবে কি
ছবির মূখ খানি ?
তুমি কি সেই ছবিতে ফুল দেবে ?
টেবিলের উপর কবিতার খাতাটি পড়ে থাকবে,
হিবিজিবি কাটাকাটি করা অনেক কিছুই লেখা,
পাতা উল্টালেই দেখতে পাবে- রাত জেগে কত প্রহরে
তোমাকে নিয়ে কত কথা লিখে রেখেছি-
কত ভালোলাগা, কত গ্লানি, কত অভিমান আর দীর্ঘশ্বাসের কথা,
তুমি কি পড়বে সেই সব কথা ?
বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলমেল হয়ে থাকবে তারাশঙ্কর ও বিভূতিভূষণের বই,
পুরনো হয়ে যাওয়া ‘খোয়াবনামা’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’। হুমায়ুন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’ পৃষ্ঠা খোলা অবস্থায় পড়ে রবে এক কোণে,
এ্যাসট্রের ছাই উড়বে ফ্যানের বাতাসে. . লগআউট করা থাকবে না ল্যাপটপ, মুঠোফোনও ডিফল্ট হয়ে থাকবে.. . লাস্ট ডায়াল কলটাও হয়ত তোমাকেই করা থাকবে …
খুব কী মনখারাপ হবে তোমার?
তুমি সেদিনও আমাকে ভালোবাসবে কি?
নাকি মোমবাতি জ্বেলে আধো অন্ধকারে পড়বে তোমাকে নিয়ে লেখা ‘আরক্ত সুন্দর মুখে’র এই কয়েকটি চরণ —
‘ একদিন মনখারাপ হবে খুব,
অথচ কান্না নেই
সে মুখোমুখি এসে দাঁড়ানোর পর হয়ত কান্না এসে যাবে
বড্ড অচেনা লাগবে তখন পৃথিবী,
একদিন সবকিছু ফুরোবার আগেই আমিও হারিয়ে যাবো..
তখন কারও চোখে আমার কান্না
রয়ে যাবে।
কোন্ আলোয় দেখেছিলাম তার মুখখানি!
ক্ষণকালের দেখায় চিরকালের ভালোবাসা হলো
তার সেই আরক্ত সুন্দর মুখ।
কেন যে কিছু মুখে পৃথিবীর মায়া লেগে থাকে
কেন যে কিছু মুখে পাই শুকপাখির পালকের ঘ্রাণ
কেনই আবার দুঃখ কাতরতা দেখি সেই মুখখানিতে।
সেই মুখেই —
জীবন থেকে মৃত্যুর খেয়া পারাপার দেখি।’
২ . আজ দুপুরের পংক্তিমালা –
মিথ্যা নয়
বসন্তে পাতা ঝরে, বসন্তেই আবার নতুন করে পল্লবিত হয় বৃক্ষ — ভালোবাসা চলে গেলে ভালোবাসা আসে, রাজা থাকলে যেমন রানী আস–
আসলে কথাটা কেমন হলো! কথাটা হবে — সব ভালোবাসাই মিথ্যা হয় না।
এক কমলিত ঊষা প্রহরে কেউ একজন বিগলিত প্রেমকণ্ঠে বলেছিল — ‘জীবন জীবনকাল আমি তোমার হয়ে থাকব।’ এরপর রুপালি জলের ঢেউ তুলে কত ভালোবাসা সে ঢেলে দিল।
তারপর সে একদিন চলে গেল সব স্রোতধারা থামিয়ে দিয়ে। কিন্তু তার রেখে যাওয়া ভালোবাসা কী সে নিয়ে যেতে পেরেছে?
আসলেই পারে নাই —
ভালোবাসার চুম্বন, আলিঙ্গন, নিমগ্ন প্রেমময় মুহূর্তগুলি কেউ কখনও ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারে না, এই ভালোবাসাগুলি কখনও মিথ্যা হয় না।
৩ . পদরেখা
যে পথ দিয়ে চলে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই
চলে যাব একা
তোমার ভুবনে তুমি পড়ে রবে কোথাও পাবে না
আমার দেখা
যদি আমাকে খুঁজে পেতে চাও আঁধারে জ্বালিও আলোক রেখা
চিনিয়ে দেবে তোমাকে পথের উপর ফেলে রাখা
আমার পদরেখা।
৪ . হে বৈশাখ
হে বিষণ্ণ বৈশাখ, হে ঝরা পাতা —
হে আগুন রোদ্দুর!
তুমি পুড়িয়ে দাও জীর্ণ যত দুঃখ দূর্দশা
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ে এসে
তুমি উড়িয়ে দাও পথের তপ্ত ধূলো
তুমি ভাসিয়ে নাও য়ত গ্লানিও।
হে বৈশাখ, হে ঈষাণের মেঘ
হে দূরন্ত বৈশাখী ঝড়
তুমি ভেঙে দাও কূপমণ্ডুকদের বিষ দাঁত
উড়িয়ে দাও সাম্প্রদায়িক অচলায়তন
লণ্ডভণ্ড করে দাও কুসংস্কার।
হে বৈশাখ, হে নবদূত
তুমি নিয়ে এসেছ মঙ্গলবার্তা
তুমি জ্বেলেছ ঐ দিগন্তে সূর্যপ্রদীপ
সব শোষণ দুঃশাসন দূর করো
দূর করো ক্ষুধা দারিদ্র্য জরাও —
তুমি আলোর রোশনাইতে ভরো
এই দেশ এই জনপদ।
হে বৈশাখ, হে নববর্ষ —
তুমি আছ লালনের বাউল গানে
জয়নুল- কামরুলের পটচিত্রে
জসীম উদ্দীনের নকশি কাঁথার মাঠে
আর আমার দেশের মাটির গন্ধে।
৫ . একটি বারান্দা চাই
এমন একটি বারান্দা চাই ঠিক তার গা ঘেঁসে জড়িয়ে থাকবে হাস্নাহেনার ঝাড়,
যে বারান্দায় বসে দেখা যাবে খোলা আকাশ, বসে থাকব সেখানে –
কেউ এসে পাশে বসুক গল্প করুক
নিঃসঙ্গ-ভূক প্রহরগুলো দূর করুক কফি খাওয়ার আনন্দে।
একটি ম্যাগপাই বসে থাকবে ম্যাগনোলিয়ার ডালে, শুনব তার কিচিরমিচির – নাকি দেখব তাকে যে এসে বসবে পাশে,
কী রূপশ্রী রূপ তার ! জলভরা কুঞ্চিত কেশদাম, শঙ্খের মতো সুউন্নত বুক, গোলাপের পাপড়ি জড়ানো চোখ, ক্ষীণ কটিদেশ- এইসবই দেখব, নাকি কথা বলব!
কথাই বলব তার সাথে –
কথা বলতে বলতে বিকেল ফুরিয়ে যাবে
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো সন্ধ্যা নামবে
আকাশ ফুঁড়ে চাঁদ উঠবে,
নক্ষত্ররা আলো ছড়াবে- লাক্ষারস রক্তিমায় ললাটপটকে উজ্জ্বল করে
মৃদু চন্দ্রালােকের সামনে বসে সে তখনও গল্প করতে থাকবে আমার সাথে।
একসময় চাঁদ ডুবে যাবে, তারাও হারিয়ে যাবে, ঝিঁঝি পোকারাও রিপু উম্মদনায় লুকিয়ে যাবে পাশে বেতস ঝাড়ে –
হিম কার্তিকের বিস্তৃত অন্ধকারের ভিতর
সে তখনও বসে থাকবে বারান্দায়,
কোথাও হারাবে না সে, কথাও ফুরাবে না তার , গল্পও শেষ হবে না।
৬ . ময়ূরাক্ষী বৃষ্টি
তোমার চোখ ময়ূরাক্ষী বৃষ্টির জলে ভিজে
কী দুঃখ তুমি জাগিয়ে দিলে,
আজন্ম ঋণী হলাম তোমার ঐ সিক্ত চোখের কাছে,
আমার চোখও জলে ভিজল,
চৌচির এই জলাভুমিতে অকাল বন্যা হলো,
তারপরও তোমাকে পাওয়া হলো না।
তোমাকে হারিয়ে খুঁজি অরণ্যানীতে,
ধুলি পথের উপরে, অস্তরাগের রং লুপ্ত হয়ে যাওয়া দিগন্তের প্রান্তরে,
শীর্ণাকান্ত তটিনী তীরে, পর্বত গুহার আঁধারে,
ধাবমান উত্তর মেঘে।
লিখি শ্লোক, লিখি গল্পকথা, লিখি গ্লানিবদ্ধ শব্দ
দিয়ে যত মর্মরিত কবিতা ।
৭ . অপেক্ষা
প্রথমে পরিচিত সেই পায়ের শব্দ, তারপর কড়া নাড়লো কেউ এসে দরজায় —
বিভ্রম নয়, পুরনো ভালোবাসারা এইভাবেই কড়া নাড়ে এসে দরজায়।
ওপাশে যে আছে তাকে আমি চিনি, এইভাবেই সে এসে মাঝে মধ্যে কড়া নাড়ে ঝুমবর্ষা দুপুরে !
বাতাসের বেগ থেমে যায়, বাঁশতলায় শুকনো পাতা ঝরঝর করে ঝরে পড়ে –
বহুবছর আগে একদিন এমনি করে এসে দরজায়
কড়া নেড়েছিল গুলনাজ মহল –
স্বপ্ন দেখিয়েছিল সে আমাকে, শুনিয়েছিল মৃত্যু ভয়, একা হয়ে গেলে কীভাবে নিঃসঙ্গতা
কাটাতে হয় সেই কথাও বলেছিল , শোকের ভিতর সুখ খুঁজে নিতে হয় কীভাবে তাও জেনেছিলাম তার কাছে থেকেই।
পদশব্দ মিলিয়ে যায়, কড়া নাড়ার শব্দ থেমে যায় তারপরও দূর হতে ছায়ার মতো মায়ার মতো হেঁটে হেঁটে যে আসে তাকে আমি চিনি —
সে যে কোনও বিভ্রম নয়, তাকে আমি আলোতেও দেখতে পাই, অন্ধকারেও দেখতে পাই।
এমনই করে প্রায়শঃই পুরনো ভালোবাসারা এসে দরজায় কড়া নাড়ে, আনমনে সেইসব শব্দ শোনার জন্য
কান পেতে থাকি, দরজা খুলে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করি….।
৮ . অমরতা
আজ যদি আমি চলে যাই
কাল কী কেউ রাখবে মনে,
কাল থেকে কেবল স্মৃতি আমি
কেউ কী রাখবে স্মরণে।
কেউ মাটির সাথে মিশে যাবে
কেউ পুড়ে ছাই হয়ে যাবে
কেউ কাঁদবে বসে নিরালায়!
এই পার্থিবে জড়িয়ে রবো না
কারোর জীবনে
ফিরে আসব না আর কখনও
নিঃশব্দ চরণে।
আমি থাকব না, থাকবে না
দেহ ও করোটি আমার,
স্বপ্নগুলো থাকবে কেবল গল্প
ও কবিতার ভিতর।
৯ . হৃদয়তমা
যে আছে আমার হৃদয় জুড়ে, খুঁজিনা তাই
তারে হৃদয়ের বাইরে।
যে আছে চোখের তারায়, দেখি না তাই
তারে আকাশের তারায়।
থাকিনা যার কাছাকাছি, সেই জানে আমি
তার কোনখানে আছি।
কাছে দূরে যেখানেই থাকি, আমি জান–
সে আমার হৃদয়খানিতেই।
১০ . ছুটি
একদিন দেখব, আমি আর সংসারে নেই
স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ছুটি দিয়েছে আমাকে,
অফিসে যেয়ে দেখব, ওখানেও কাজ নেই,
ওখানেও ছুটি।
যে পথ দিয়ে হেঁটে বাজারে যেতাম প্রতিদিন ,
সে পথে আর হাঁটব না, পথও দিয়েছে ছুটি ,
ছুটি দিয়েছে মুদির দোকানের টিটু…
সব্জির দোকানদার রাসেল..
মসজিদে ইমামের পিছনে দ্বিতীয় সারিতে
আমাকে আর দেখা যাবে না,
ওখানে অন্য কেউ থাকবে সিজদারত-
ফার্মেসিতে অসুস্থ স্ত্রীর ঔষধ কিনতে যেতে হবেনা আর, প্রেসক্রিপশন নিয়ে আমার স্ত্রী নিজেই যাবে তখন, অথবা আমার পুত্র কন্যাগণ ।
আমি আর দেখব না নদী, দেখব না নিবিড় সবুজ অরণ্য,
শরতের মেঘ, হাস্নাহেনার ঝাড়, রোদ্দুরের নিঝুম দুপুর, সূর্যাস্তকালীন লাল আভা, সন্ধ্যারাতের ধ্রুবতারা –
সবাই দেবে আমাকে ছুটি।
শোনা হবেনা রবীন্দ্র সংগীত, গীত হবেনা রামপ্রসাদী, আবদুল আলীমের পল্লীগীতি, নজরুলের গজল ও হাছন রাজার গান।
পড়া হবেনা হুমায়ুন আহমেদের ‘আমার আছে জল’
ও ‘একজন মায়াবতী’,
ফুটপাতে বইয়ের দোকানে তন্ন তন্ন করে খুঁজব না বিভুতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ , মানিকের ‘চতুষ্কোণ’, তারাশঙ্করের ‘কবি’ পড়ে মন খারাপ হবে না আর – ‘জীবন এত ছোট ক্যানে’।
কৈশোরের খেলার সাথীদের মনে পড়বে না,
শুনব না আষাঢ়ের ঝুমবৃষ্টি, শ্রাবণের বন্যার জল কলরল ধ্বনি ,
মসজিদে কামাল মুন্সির আযান–
ছোনের চালের কোঠরে খুঁজব না চড়ুই পাখির বাসা।
ছুটি দেবে আমাকে ধনিদহ বিলের ঝিনুক,
আকন্দ ঝোপের টুনটুনি, স্কুল পথের রাঙা ধূলো,
ছুটি দেবে গোল্লাছুট খেলার মাঠ, সবুজ ঘাস,
ধানক্ষেত, খড়োকুটো —
ছুটি দেবে সমীর আলীর পাতার বাঁশি।
ছুটি দেবে নবমী চাঁদের রূপালি আলো,
চৈত্রের খরতাপ, হেমন্ত আকাশে রাতের নক্ষত্রবীথি-
কোথাও পাবো না আর ভাঁটফুলের ঘ্রাণ,
যমুনার জল ছুঁয়ে আসবে না শীতল বাতাস,
ভাসব না রাতভর অথৈ জোছনার জলে।
লিখতে হবে না তোমাদের জন্য কবিতা,
শোনাতে হবে না গল্পকথা..
তখন শোনাবে গল্প অন্য কোনো গল্পকার,
তখন আমার ছুটি।
তখন তোমাকেও আমি ছুটি দেব হে পৃথিবী ,
ছুটি দেব মহাকালের বেদনা মর্মর, গ্লানি ও শ্লেষকে-
ছুটি নিয়ে চলে যাব আমিও.. .
যেখানে যাব সেখানে কেউ নেই. .
কিছু নেই. .
সেখানে বিরাজিত নীরব হাহাকার আর স্তব্ধ নৈঃশব্দ..
সেখানে কেবল অনন্ত আঁধার।
১১ . গোপন তুমি
তোমাকে রেখে দেই আমার কবিতায়
কেউ তা জানে না
তোমার কথা বলে যাই আমার গল্পে
কেউ তা বোঝে না
তোমাকে দেখি চোখের কোঠরে রেখে
কেউ তা দেখে না
তোমাকে সযতনে লুকিয়ে রাখি হৃদয়ে
স্পন্দন কেউ শোনে না
তোমার মুখের ছবি আঁকি বিমূর্ত করে
কেউ তা চেনে না
একটা ম্যাগপাই এসে বসে অলিন্দে
শীশ কেউ শোনে না
কত কবিতা কত গান কাটাকুটি করি
ছন্দ কখনও মেলে না
তোমার অস্তিত্ব সর্বত্র তরঙ্গায়িত হয়
কেউ উপলব্ধি করে না
তোমার ঘুম নির্ঘুম আশা নিরাশা বেদনা,
তোমার মৃত্যু – আমিই শুধু বুঝতে পারি–
আর কেউ না।
১২ . বিদায়ের চরণচিহ্ন
কে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে মহুয়ার ঝাড়ে,
কে যেন কাঁদছে কোথাও নিশীথের অন্ধকারে।
রাত শেষ হয়ে গেল
কান্নাও স্তব্ধতায় মিলিয়ে গেল
ভোরের শূন্যতা পূর্ণ করতে কেউই এল না।
দেখলাম কেবল –
দিগন্তে উদয়াস্তরাগের সুবর্ণরেখায়
কে যেন বিদায়ের চরণচিহ্ন এঁকে চলে গেছে।
১৩ . বত্রিশ নম্বর রোডের বাড়িটা
কাল আশ্চর্য সুন্দর একটি ভোর হবে,
পাখি ডাকবে ফুল ফুটবে, রাঙা আলোয় আলোকিত হবে পূর্ব দিগন্ত —
কাল এমনই উজ্জ্বল আলোর সকাল থেকে
হাজারও মানুষ মিছিল করে যাবে
ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে,
কাল শোকার্ত মানুষের ঢল নামবে রবীন্দ্র সরোবরে।
কাল মিছিল আসবে বুড়িগঙ্গার ওপার থেকে
মিছিল আসবে শীতলক্ষ্যার তীর থেকে
মিছিল আসবে বালু, তুরাগ, বংশী নদীর অববাহিকা থেকে, মিছিল আসবে ধলেশ্বরীর উজান থেকে… .
মিছিলে থাকবে কামার কুমার, ধীবর, কৈবর্ত —
মিছিলে থাকবে ছাত্র, শ্রমিক, মুটে, কুলি,ধীবড়, মুচি, রিক্সাচালক ও গৃহিণী.. .
কাল শহরের সব দোকানপাট বন্ধ থাকবে
বন্ধ থাকবে কলকারখানা শপিং মল, শিশু পার্ক
বন্ধ থাকবে প্রেক্ষাগৃহ, অফিস আদালত —
কাল স্কুল কলেজের ছাত্ররা কেউ ক্লাসে যাবে না
সবাই শোকমিছিলে যাবে… .
কাল সবাই জমায়েত হবে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে
সব মিছিল গিয়ে মিলবে রবীন্দ্র সরোবরে।
ঐ যে সাদা রঙের বাড়িটি দেখছেন, ঐ বাড়িতে থাকতেন এক রাখাল রাজা, লুঙ্গি পরে স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন তিনি তখন–
চিৎকার, কান্না আর গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছিল যাঁর, তিনি হলেন আমাদের স্বাধীনতার মহান স্থপতি,
তিনি হলেন আমাদের জাতির জনক,
ঐ বাড়ির সিঁড়িতেই এই জনকের রক্ত ঝরেছিল,
রক্ত ঝরেছিল এক মহিয়সী জননীরও,
পুত্র -পুত্রবধুদের রক্ত ঝরেছিল-
ঝরেছিল শিশু রাসেল ও কর্নেল জামিলের রক্ত. . আরও অনেক স্বজনের রক্ত গড়িয়ে গিয়ে মিশেছিল রবীন্দ্র সরোবরে !
কাল সব মানুষ অশ্রুত নয়নে দেখতে পাবে
সরোবরের সাদা কমলগুলো রক্তকমল হয়ে ফুটে আছে
কাল লক্ষ মানুষের নিযুত অশ্রু ঝরে পড়বে
ঐ ফুলগুলোর উপরে, বাতাসও ভারী হয়ে উঠবে উপস্থিত জনতার ক্রন্দনধ্বনির হাহাকারে ।
সেদিনের শ্রাবণ রাতের শেষ প্রহরে জনক যখন
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলেন, তখনও তাঁর হাতে ছিল তামাক পাইপ, চোখে ছিল কালো ফ্রেমের চশমা –
তখন কিছু উর্দি পরা দানব বুটের কর্কশ শব্দ তুলে হাঁটছিল তাঁরই বাড়ির আঙ্গিনায়.. .
তারপর অজস্র গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে শহরের মানুষের, সচকিত হয় ওঠে ঘুমন্ত পাখি,
জেগে ওঠে মায়ের বুক জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকা শিশুও.. .
ঘুম ভাঙে মুয়াজ্জিনের,
ঘুম ভাঙ্গে শহরের ক্লান্ত বারবনিতার —
তারপর ফের মেশিন গানের গুলির শব্দ!
ঝাঁজরা হয় বাংলাদেশের স্ফীত বুক, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় মানচিত্র. . তারপর জনক লুটিয়ে পড়লেন সিঁড়ির সোপানে. . স্রোতবেগে রক্ত ভেসে যায় সিঁড়ি বেয়ে
রবীন্দ্র সরোবরে।
আপনি চলে যাওয়ার পর এই জনপদ বিরাণ হলো, ফসলের ক্ষেতগুলো হলো চৈত্রের খরার মতো চৌচির, খাল বিল নদী হলো জলহীন স্রোতহীন —
শকুনেরা তখন আকাশে উড়ছে, শুকুরেরা বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, খুনীরা অট্টহাসিতে উল্লম্ফন করছে আপনার সোনার বাংলায়।
জনক, কাল অসম্ভব সুন্দর একটি সকাল হবে,
হাজারো মানুষ একীভূত হবে বত্রিশ নম্বর সড়কে,
সবার হাতে থাকবে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল, কেউই তখন আর ফুলের গন্ধ নেবে না.. .
কাল মিছিল হবে, শোকসভা হবে.. . হাজারো মানুষ একিভূত হবে।
এরই মধ্যে কত অশ্রুজল মিশে গেছে পদ্মা মেঘনা যমুনা মধুমতীর জলে, শ্রাবণ বৃষ্টি ধারায় ভিজেছে
কত কদমফুল,
বাংলার পথে ঝোপে ঝাড়ে ফুটেছে কত ভাঁটফুল. . স্বর্ণলতায় ছেয়ে গেছে কত আকন্দ বৃক্ষ, তুমি আছ ঘাসফুল হয়ে এই বাংলার শ্যামল মাঠে.. .
আপনার মৃত্যু হয়নি, মহামানবদের মৃত্যু হয়না কখনও,
কাল রবীন্দ্র সরোবরে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষ ধারণ করবে আপনার হৃদয় থেকে ঝরে পড়া ঝংকৃত হৃদ স্পন্দন! কাল সব মানুষ শোক থেকে নেবে শক্তি —
কাল আর কারোর মৃত্যু হবে না।
ঐ বাড়ি থেকে এখনও বজ্রকণ্ঠ ভেসে আসে এক শ্রেষ্ঠ বাঙালীর–পাইপ হাতে তাঁর , ব্যাকব্রাশ করা চুল, সাদা পাঞ্জাবি পরে দাঁড়ালেন তিনি এসে করিডোরে, বলছেন তর্জনী উঁচু করে বজ্রকণ্ঠে —
‘মরতে যখন শিখেছি তখন কেউই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না.. . ‘
টুঙ্গিপাড়ার এক ছায়াশীতল গাঁয়ে মৃত্তিকা তলে আপনি ঘুমিয়ে আছেন, শোনেন কান পেতে নিঝুম রাত্রিতে
বাইগার নদীর শান্ত জলকলধ্বনি —
বৃষ্টি হলে জলাশয়ে আজও সেখানে ব্যাঙ ডাকে,
সন্ধ্যা নামলে ঝিঁঝি পোকাদের নীল আলো জ্বলে ওঠে,
শোনায় ওরা গান আপনাকে গুনগুন করে —
প্রতি ঋতুতে চাঁদের আলোয় ভাসে সমাধি প্রাঙ্গন,
থৈথৈ জোছনার প্লাবন নামে দূরের চরাচরে
আর হিজলতলা ঘাটে…
বঙ্গবন্ধু , তুমি আছ গীতি-গন্ধভরা স্নিগ্ধ বাতাসে — ধানক্ষেতের কচি পাতার মিহি দোলায়, নৌকার পালে, তুমি আছ চির শস্য শ্যামলে, আকুল করা জোছনার আকাশে..তুমি আছ অনেক তারার ঝিলমিলে.. .
কাল আর তোমার মৃত্যু হবে না।
১৪ . আমরা ভেসে যাই
সেই কবে একদিন মেঘ গুরুগম্ভীর আকাশ দেখে
তুমি ইশারায় বলেছিলে,
‘চলে যাও যমুনা কূলে – শ্রাবণ কদম্বের সুগন্ধি মেখে ভিজব দুজনে! আমি আসব।’
আহা! এমন নিমন্ত্রণ কেউ ফেরায় কখনও
এমন ভর বৃষ্টির জলে শীতল স্নান,
দোঁহে এমন হিম স্পর্শ, সন্ত্রস্ত মৎস কন্যার মতো
নিবিড় আলিঙ্গন,
এমন জড়িয়ে রাখার আকুলতা, কেউ গ্রহণ না করে থাকতে পারে !
আমি এর আগেও স্নান করেছি দিঘির জলে
বৃষ্টির জল পড়ত জলে,
মুক্তার মতো রুপালি জলের ফোঁটা পড়ত, কস্তোরির আড়ালে চলত জলকেলি
কীভাবে ক্লান্ত দুপুর গড়িয়ে যেত নিমিষে!
টলটলে জলে মৃদঙ্গ ঢেউ তুলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে
কূলে ফিরে আসতাম।
তোমার এমন আমন্ত্রণের অপেক্ষা করেছি
আমার যৌবনকাল থেকে ,
কত হাহুতাশ করেছি, হৃদয় ভেঙে কত ক্ষরণ হয়েছে বেদনা, তুমি মায়াচোখ মেলে তা দেখোনি কখনও,
সেই তুমি প্রেমজ আহবান করলে আামাকে,
আমি তা ফেরাই কী করে!
বৃষ্টি নামুক সেখানে, জলে ভরুক যমুনা, উপচে উঠুক একূল ওকূল —
কদম্ব ফুটুক, সুগন্ধ ছড়াক চারিদিকে —
মেঘমেদুর বরষায় ভিজব শ্রাবণ অঝোর ধারায় —
আত্মহননের মতো কী ভয়ংকর মুহূর্ত হবে, ঢেউয়ের দোলায় তোমার দিগন্ত জোড়া ধবল পিঠ ,
বাঁক খাওয়া কোমড় ও উরু ডুবে বুঁদবুঁদ হবে ,
কী অদ্ভুত জলস্রোত, কী সুন্দর জলস্রাব!
জাদুর চুম্বকের মতো আমরা দুজন একজন হয়ে যাব!
আমরা শুচি হবো দোঁহের শরীর ছুঁয়ে, আরও কত শ্বেত জল একাকার হবে স্রোত বক্ষে! কত কাঙ্গাল ছিলাম আমি এই ক্ষণটির জন্য।
আশ্চর্য শিহরণে গা কাঁপে, আমরা উথাল-পাতালে ডুবে যাই.. . জলতরঙ্গে ভেসে ভেসে যাই, অতলে তলিয়ে যাই নিরুদ্দিষ্ট হাঙ্গরের মতো।
১৫ . একটি নিখোঁজ গল্প
তুমি একদিন বললে, ‘চলে আসো – দেখা করো কোথাও চন্দনের বনে।’ আমি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি — রাস্তায় নেমে দেখি আগুনের ফুলকির মতো চৈত্রের রোদ ঝরে পড়ছে, তবুও আমার শরীরে ফোসকা ফেলে চলে যাই তোমার কাছে।
আর একদিন বললে — ‘চলে আসো নীলকমলের তীরে।’
তখন মেঘ গুরুম গুরুম বিজলি চমকাচ্ছে, আকাশ ভেঙ্গে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ভেজা কাকের মতো ভিজতে ভিজতে চলে যাই তোমার কাছে নীল কমলের তীরে।
সেদিন ছিল শীতের শৈত্যপ্রবাহের এক গায়ত্রী বিকাল। বললে- ‘খালি প্রান্তরে দাঁড়িয়ে দেখবে তুমি লাল আভা ছড়ানো সূর্যাস্ত।’ আমি কমলা রঙের একটি ফিনফিনে পাঞ্জাবি পরে হাড় কাঁপুনি শীতে কাঁপতে কাঁপতে চলে যাই উদ্বাহুর মতো তোমার কাছে।
আর একদিন ছিল কার্তিকের অমাবস্যার রাত। তোমার
খুব তারা দেখার ইচ্ছে হলো। বললে — ‘নিকষিত অন্ধকারে তারা নাকি খুব উজ্জ্বল দেখায়।’ আমাকে আসতে বললে। আমি অন্ধকারে পথ খুঁজে চলে যাই
তোমার কাছে। মায়াবী তারার আলোয় দেখলাম দুজন দুজনকে।
আর একদিন তোমার মন খারাপের দিনে বললে — ‘আমি একাই ভোরের আলো গায়ে মাখতে মাখতে চলে যাব কোথাও।’ বললাম — ‘কোথায় যাবে? কেন যাবে?’ বললে — ‘ আমার চিরবদ্ধ এক অভিমান আছে।’ আরও বললে — ‘এই শহরেই জনারণ্যে হারিয়ে যাব।’ বললাম — খুঁজে বের করব তোমাকে এই জনারণ্য থেকেই।’ বললে– ‘পাবে না।’
আসলেই পাইনি আর তাকে। কত অলিগলি, রাজপথ ঘুরেছি। হণ্য হয়ে কত খুঁজেছি তাকে পার্কে, রেস্তোরাঁয়, বাসস্ট্যান্ডে, স্টিমারঘাটে, স্টেশনে, উদ্যানে। আমাদের যত চেনা পথে, যেখানে হাজারও পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে , সেই সবখানে। কিন্তু কোথাও তারে খুঁজে পাইনি।
”এই হাওয়া যেন হা-হা করে!
হু-হু ক’রে ওঠে অন্ধকার!
কোন্ রাত্রি- আঁধারের পার
আজ সে খুঁজিছে!
কতোরাত ঝরে গেছে,- নিচে- তারো নিচে
কোন্ রাত- কোন্ অন্ধকার
একবার এসেছিলো,- আসিবেনা আর…।”
১৬ . কে যেন কাঁদছে
কে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে মহুয়ার ঝাড়ে,
কে যেন কাঁদছে কোথাও নিশীথের অন্ধকারে।
রাত শেষ হয়ে গেল
কান্নাও স্তব্ধতায় মিলিয়ে গেল
ভোরের শূন্যতা পূর্ণ করতে কেউই এল না।
দেখলাম কেবল –
দিগন্তে উদয়াস্তরাগের সুবর্ণরেখায়
কে যেন বিদায়ের চরণচিহ্ন এঁকে চলে গেছে।
১৭ . বিসর্জন
মৈনাক পর্বতের সিড়ি ভেঙ্গে মন্দির দর্শনে উঠছিলাম তখন,
কত পুণ্যার্থী এসেছে , কত নারী পুরুষ, কত সন্ন্যাসী!
এসেছে যোগিনী, এসেছে ডোম্বি,
এসেছে যক্ষিণী, চন্দ্রকান্তি –
মানুষ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে নামছে.. .
মন্দির প্রাঙ্গন থেকে ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছিল কেবল…
হঠাৎ সিঁড়ির একধাপ উপরে মুখোমুখি হলো একটি রমণী!
তাকে দেখে আমি চিনতে পারি , একে আমি দেখেছিলাম উজ্জ্বয়িনীর শিপ্রা নদীর তীরে. .
মুখে তার লোধ্ররেণু, ললাটে ও গালে চন্দন মাখা
মাথায় পারিজাত ফুল দিয়ে খোঁপা বেঁধেছিল সে , চোখে ও ভ্রুতে ছিল কাজল আঁকা।
বললাম ওকে – তুমি কমলিকা না !
রমণী বলছিল – হ্যাঁ গো আমি কমলিকা। আমি মরিনি গো!
কত মন্দির, কত মঠ, কত পথে, কত ঘাটে, কত নদীর কূলে তোমাকে খুঁজেছি আমি!
আমি কমলিকার একটি হাত ধরে বলি-
কত তপস্যার পর আজ তোমার দেখা পেলাম এই মৈনাক পাহাড়ে, এই মন্দির দর্শনের পথে — তোমাকে আমিও খুঁজেছি অনেক! তোমাকে আর হারাতে দেবো না!
আমরা সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠি —
মন্দিরে যেয়ে মা দূর্গার মূর্তির সম্মূখে কমলিকার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিয়ে বলি —
আজ নবরাত্রি!
সাক্ষী থাকুক এই পাহাড়
সাক্ষী থাকুক সাগর
সাক্ষী থাকুক এই নবমীর ধূপছায়া রাত্রি!
চলো – ঐ সাগর কূলে, চাঁদের আলোয় ভিজে ভিজে বালুকাবেলায় আমারা
ফুলসজ্জা পাতি!
সব পাওয়াই কী পার্থিব হয়?
সবই অস্পষ্ট পটচিত্রের মতোন আক্ষেপের,
মনে পড়ে মনে পড়েনা – কুচকলি নাক, তারা-খচিত চোখ, কমলগ্রীবা, কাঞ্চি পরা কটি, মায়াবী মৃগনাভি, রুপালি শুভম জঘন–
পুণ্যবতী ঐ রমণী অধরাই থেকে গেল! যখন ঘুম ভাঙ্গে – তখন ভোর!
চোখ মেলে দেখি কমলিকা নেই!
ওর খোঁপার পারিজাত-সুরভিত ফুলগুলো সাগরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছে।
১৮ . কেউ আসুক না আসুক
এ কেমন নিশি রাত্রি! এ কেমন থমকে যাওয়া শ্বাসের মতো নিস্তব্ধ প্রহরবাস
ঘুম নির্ঘুম ঠাহর করতে পারিনা, এ কেমন ক্ষণ পোহাতে হয়!
ভুল নর্দমায় কত আনন্দবীর্য ভাসিয়ে দিয়েছি, কত ব্যবচ্ছেদ করেছি উল্টেপাল্টে,
কত কাঁটাছেঁড়া করেছি ত্রস্ত হরিণীর দেহ, করোটি, তার মাংস, মজ্জা — কত মাতোয়ারা হয়েছি উন্মুক্ত নাভিমূলে মুখ গুজে, কত অমল অম্বুজ ভেসে গেছে রুপালী ধারায়, কত পাপড়ি হয়েছে ছিন্নভিন্ন.. .
তুমি কে? তুমি কী! তখন বুঝতাম না
তোমার নালন্দা কুচের ভার, আর জঙ্ঘা পাড়ের রেশম কোমল চুলের ধানী গন্ধ নিতাম,
নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে দেখতাম ধবল পর্বত শৃঙ্গ, মধুবনি নদী, জগৎ বলতে তোমাকেই জানতাম, তুমিই ছিলে যৌবনজম কক্ষপথ…
তুমি চিনতে পারতে কে তোমার নিষ্ঠুরতম পুরুষ,
কে শুধু ধ্বংস করে, সৃষ্টির আদিঅন্তে যে কোনও বীজ বপন করেনি প্রাজ্ঞভূমিতে, যার কোনও বংশবৃদ্ধি নেই. .
তুমি দেখেছ শ্মশানে ছাই উড়ছে.. .
তুমি দেখতে পাওনি কবর ফুঁড়ে কোথাও কোনও ফুল ফোটেনি ।
বাইরে এখন আশ্বিনের বিগলিত ধূম জোছনার নহর বইছে – পৃথিবীর কোথাও কোনও উপত্যকায় কী থোকা থোকা গাঁদা ফুল ফুটেনি আজ?
আমার কোনও নিঃসঙ্গতা নেই, নেই কোনও অনুশোচনাও…নেই চন্দ্রচেতনা, দীপ্তি ছড়ান কোনও ভৃগুর খোঁজে উন্মাতালও নই,
এই রাত্রি নিশীথে কেউ আসুক না আসুক, কেউ থাক্ বা না থাক্ —
এই রাত্রি এই জীবনকাল একসময় নিঃশেষিত হবেই।
১৯ . ধ্রুপদী প্রেমের কবিতা
প্রেম আসে প্রেমিকা আসে
বিরহ আসে ,
প্রেম যায় প্রেমিকা চলে যায়
বিরহ আর যায়না।
কী যে উন্মুখ ছিলাম তোমাকে উন্মোচন করতে
কী যে প্রস্ফুটনের জন্য অপেক্ষার ক্ষণ ছিল আকুলতায় ভরা,
মাধবী, তুমি আমাকে সেই অমরত্ব দিলেনা,
তুমি আর আমার হলেনা।
ভুলতে পারিনি দেহশ্রম ,
ভুলতে পারিনি নিশিকনকচাঁপার মাতাল গন্ধ
ভুলতে পারিনি অস্তসন্ধ্যার প্রগাঢ় চুম্বন,
ভুলতে পারিনি হাজার নক্ষত্রবীথির চন্দ্ররাত্রির আকাশভূক দ্যুতি ।
কে যে কখন হয় শোকগাঁথা, কে যে হয় মৌনতার করণ সুর, কে যে হয়ে যায় দূরের দূরবর্তিনী –
মাধবী, আফসোস তোমারই
তুমি হতে পারলেনা আমার পুণ্যমহিমার একটি ধ্রুপদী প্রেমের কবিতা।
২০ . মার্জিনের লেখা
তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে এই বাড়ির
বাকি আত্মকথা কীভাবে লেখা হবে ?
তোমার প্রস্থান বন্ধ করো, এই তোমার শাড়ির আঁচল টেনে ধরলাম, যাও দেখি কী করে?
তুমি অপরিহার্য অঙ্গ এই বাড়ির, এর আঙ্গিনার সীমারেখা অতিক্রম করে তুমি
উড়ে চলে যাবে পরিযায়ী পাখির মতো
দূর ছায়াপথে, তা কী করে হয়?
এই তোমার দুই বাহু বক্ষে টেনে নিলাম, উড়ে যাও তো দেখি কী করে?
তুমি যেদিন প্রথম পা রেখেছিলে উঠোনে
সেই পদচিহ্ন এখনও আছে, উঠোনের উপরের আকাশ এখনও খালি –
আমরা দেখতাম নীল আকাশ, মাদুর পেতে বসে উপভোগ করতাম তারাভরা রাত্রি,
দেখতাম কত চন্দ্র কিরণের আবীর মাখা মায়াবী অন্ধকার!
বাঁশঝাড়টা এখনও আছে,
এখনও সন্ধ্যা রাত্রিতে জোনাক জ্বলে, মিটিমিটি করে আলো জ্বলে তোমার নামে,
রবি ঠাকুরের গান থামিয়ে দিয়ে আমরা শুনেছি ঝিঁঝি পোকাদের গান –
উঠোনে বসে আর দেখা হবেনা নীলআকাশ, শোনা হবেনা ঝিঁঝি পোকাদের গান –
তাই কী হয়? এই তোমার যাবার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়ালাম, আমার দেহ মাড়িয়ে তুমি যাও তো দেখি কী করে?
কত কথা মনে পড়ে –
বালিকা তখনও শাড়ি পরা শেখেনি, পিঠের উপরে এলমেল পড়ে থাকত আঁচল –
খোলা অলিন্দে দাঁড়িয়ে এই বাড়িতে প্রথম যেদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, তা দেখে ফেলেছিল আকন্দ গাছে বসে থাকা দুটি দাঁড়কাক,
লজ্জাবতীর লজ্জার মতো তুমি লুকিয়ে যেতে চেয়েছিলে বেতসের ঝাড়ে…
আরও কত কথা মনে পড়ে –
আমি তখন উঠতি অখ্যাত এক কবি, ঋষির মতো মাথাভর্তি চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, আঁতেলদের মতো কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে পথ চলতাম, এসব প্রশ্রয় দিতে তুমিও।
যে আমি দিনরাত জীবনানন্দ দাশ, ওমর খৈয়াম আর গালিবের কবিতা পড়তাম ,
সেই আমি কবিতার বদলে তোমাকে পেলাম,
কবির পরিবর্তে হয়ে গেলাম প্রেমিক স্বামী,
আর তুমি হয়ে গেলে আমার কবিতা, যত পাঠ তোমাকেই করতাম।
তুমি কখন অলক্ষ্যে এই বাড়ির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিলে তা তুমিও জানোনা,
এই অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিন্ন করে তুমি চলে যাবে, তা হয়না- প্রফেসর ডাক্তার রোকনুজ্জামান যতই রিপোর্ট দেখাক – ‘তোমার রক্তের হিমোগ্লোবিন কমে গেছে।’
কিন্তু তা যেন মিথ্যা হয়,
আমি জানি – তোমার শরীরে আবার রক্তের প্রবাহ বইবে।
কুসমপুরের পথে পথে আমরা আবার দুজন হাঁটব, আলপথ ধরে ধানের গন্ধ শুকে হেঁটে হেঁটে চলে যাব যমুনা কূলে, নদীও দেখবে তোমাকে, নদী তার জলের শব্দ শোনাবে তোমার কানে কানে, স্রোত বক্ষে দেখবে তুমি তোমার আরক্ত সুন্দর মুখ, দেখবে বালিহাঁস উড়ছে মেঘের নীচ দিয়ে –
দেখবে বালুচরে ফুটে আছে অজস্র কাশফুল।
মনে আছে তোমার!
একদিন এক অবসন্ন বিকেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা ভেবে রেখেছিলাম –
কোনও একদিন শ্রাবণ দুপুরে ক্রিস্টাল ধবধবে শিলাবৃষ্টি হবে, বরফের স্তুপ জমবে উঠোনে,
তুমি সেই স্বচ্ছ শিলা কুড়িয়ে এনে জল করে পান করবে,
দু’জনে আরও ভেবে রেখেছিলাম –
একদিন এক শরতরাতে আকাশে মস্ত বড় একটি চাঁদ উঠবে,
ধবল জোছনায় ভাসবে এই বাড়ির উঠোন, দার্জিলিং থেকে আনা সাদা জর্জেট শাড়িটি পরে হাঁটবে তুমি উঠোনে. .
যে শাড়িটি তুমি সযত্নে তুলে রেখেছ তোরঙ্গে —
সেই ঝুম শিলাবৃষ্টি এখনও হয়নি,
সেই মস্ত বড় চাঁদ আজও আকাশে ওঠেনি,
সেই শিলাবৃষ্টি, সেই চাঁদ তুমি না দেখেই চলে যাবে, তাই কী হয়?
কত স্বপ্ন দেখেছি দুজন, কত স্বপ্ন দেখা এখনও রয়েছে বাকি, সেইসব স্বপ্ন অপূর্ণ রেখে তুমি আগে চলে যাবে – তাই কী হয় কখনও ?
****
মুখবন্ধ –
এই লেখাটি দেখে মনে হচ্ছে এটি একটি কবিতা। আসলে এটি কবিতা ছিল না। ২০১৯-২০ সালে আমার স্ত্রী যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর দুয়ারের কাছাকাছি চলে গিয়েছিল, তখন টুকরো টুকরো করে আমার কিছু অনুভূতির কথা খাতার মার্জিনে টুকে রেখেছিলাম। মার্জিনে লেখা সেই সব লেখাগুলি একত্রিত করে এখানে একটি কবিতার রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।
২১ . দেখা হবে
পথে চলতে চলতে বনবীথির গন্ধে-
মায়ালোকের মলিন ধুলিতে
কত খুঁজলাম তারে চন্দ্রসূর্যের উজ্জ্বল
আলোর দীপ্ত প্রভায়।
কত সময় নষ্ট হলো,
ক্লান্তিতে দেহ ন্যুব্জ হয়ে গেল
তবুও দেখতে পেলাম না তারে।
সুনিশ্চিত দেখা মিলবে এই জীবনে কিংবা
অন্য আরেক জীবনের
কোন মৌন সন্ধ্যায় অস্তদিনের ধূসর
আলোয়।
২২ . একজন মাধবীলতা
একজন মাধবীলতা ছিল গত শতাব্দীতে ক্ষণকাল! সেই মুখ কিছুতেই মনে করতে পারিনা আর এখন, খুব আফসোস হয়, অনুশোচনাও করি।
প্রায়ই বিকালে ডাক দিয়ে নিয়ে যেত বংশী নদীর তীরে, ওখানে মিষ্টি রোদ আর শীতল হাওয়া মিশানো আলিঙ্গনের উষ্ণতা নিত সে,
আর আমি নিতাম তার কদলীকান্ত বুকের নির্মোহ গন্ধ.. .
এক হেমন্ত সন্ধ্যায় রহস্য ইশারায় ডাক দিয়েছিল সে – আলোছায়ার পথ ধরে আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম চামেলীবাগে সাহানা ভাবীর বাড়িতে –
ওখানে কাঁচা পিয়ারা কামড় দিতে গিয়ে কামড় লেগেছিল জিহবায়.. . যেন বৃশ্চিক দংশন করেছিল!
আর একবার গিয়েছিলাম পান্থপথে কাফে চিরোকীতে, ওয়েটার হলুদ বাতি নিভিয়ে দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল নীল বাতি, কমলার কোয়া চুষতে গিয়ে আশ্লেষ হয়েছিল ঠোঁট.. . মগ্ন আবেশে কেটেছিল দ্বিপ্রহর।
আশ্বিনের এক নিঝুম জোছনা রাতে
সাদা শাড়ি পরে রাধিকা হয়ে কাছে এসেছিল সে, আমলকীর বনে চলে গিয়েছিলাম সন্তর্পণে.. . জোনাকিরা জ্বলে উঠেছিল, চাঁদে লেগেছিল আগুন.. . রাতভর কুসুমের গন্ধে মাতাল হয়েছিল বাতাস, আর সে হয়ে উঠেছিল লীলাবতী।
২৩ . এসো প্লাবনে
আমার শরীরের ভিতর চলছে অগ্নি উৎসব,
দাবানলের মতো পুড়ছে অস্থি, মাংস, হৃদতন্ত্রী-
তুমি এক সমুদ্র জল হয়ে এসো,
এসো তুমি প্লাবনে , এসো তুমি জলোচ্ছ্বাসে।
আমার বুকের বিভাজনে ভিজাও চুম্বনে,
নাভিকমলে ঢালো সফেদ জল,
বিভৎস আগুন নিভিয়ে উদ্ধার করো নরক থেকে,
তুমি হিম প্রবাহে শীতল করো উর্বর দেহভূমি,
আমাকে পুণ্য করো, উজ্জীবিত করো।
২৪ . ক্ষমা চাই
তোমার কাছে ক্ষমা চাই,
আমার আচরণে হয়তো নিষ্ঠুরতা ছিল, শ্লেষ ছিল,
কাণ্ডজ্ঞানহীন অবহেলা ছিল
প্রসন্ন করে ভালোবাসা হয়তো দিতে পারিনি শতভাগ,
ক্ষোভ রেখো না মনে ওগো প্রিয়তমাসু
ক্ষমা করে দিও।
আমরা চাইনি বিচ্ছেদ, চেয়েছি মুঠো ভর্তি প্রেম
জেনেছি জীবন একটাই
ভরেছি তাই অমিয় ক্ষণগুলি বিমল আনন্দে
হৃদয়ের গান মৃদঙ্গ সুরে বেজেছে
জীবনেরই সর্বত্রে।
পৃথিবীর রোদ্দুর দিয়ে সরিয়েছি অমানিশার তমিস্রারাত্রি, দুঃখ জরাকে বিদূরিত করে ভরেছি আলো- দীপ্ত করেছি জীবন –
এরই ফাঁকে যদি মনঃকষ্ট দিয়ে থাকি তোমাকে,
ক্ষমা করে দিও ওগো প্রিয়তমা।
২৫ . সেতার
উৎসর্গ – কবি দিলারা হাফিজ
যখন একলা থাকতাম তখন রাতভর
বৃষ্টি হলেও ভালো লাগত না,
তখন রাতভর জোছনার বন্যা নামলেও
নিজেকে ভাসাতে ইচ্ছে করত না,
প্রেমিক প্রেমিকাদের দেখতাম বৃষ্টিতে ভিজে
রাত্রি অভিসারে যাচ্ছে,
দেখতাম – জোছনার নিচ দিয়ে হেঁটে হেঁটে
তারা চলে যাচ্ছে যমুনার তীরে ।
মনখারাপ করে হাঁটুতে মুখ গুজে বসে থাকতাম-
কেউই আমাকে নিয়ে যায়নি কোনও দিঘির পাড়ে
কেউই চাঁদের তলায় বসে গল্প করেনি একদণ্ড,
কেউই তার বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে বলেনি-
‘ তোমাকে খু-উ-ব ভালোবাসি’।
অথচ, কী যে ইচ্ছে করত আমারও
কারোর হাত ধরে ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে,
ইচ্ছে করত অরণ্য নিবিড়ে বসে কেউ একজনের
কণ্ঠলগ্ন হয়ে গান শুনতে —
ইচ্ছে করত মালকোষ রাগে সেতার বাজাতে।
২৬ . সুদূরতমা
এত বড়ো এই শহরে কোথায় যে হারিয়ে যাও
কোথায় যে তুমি লুকাও
প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে
কত খুঁজি অলিগলিতে,
কত বিষণ্ণ দুপুরে ক্লান্তিতে ডানা ভেঙে যায়।
চলে গেছ তুমি অচেনা অন্য কোনও শহরে
তোমাকে না পেয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই
কেমন একা লাগে কেমন স্তব্ধ অন্ধকার
আর.. . মনে পড়ে তোমার বিষাদমাখা চোখ
ঐ চোখের জন্যই করি শোক।
২৭ . সুচরিতাষু,
তুমি নিজেকে লুকাতে পারবে না কোথাও ,
না যমুনার জলে, না ধুরবাহাটির অরণ্যে –
তোমাকে ছুঁইতে গিয়ে ছুঁয়েছি আগুন
তবুও তুমি আগুন হতে চাওনি কখনও।
তুমি নিজেকে যেমন লুকাতে পারবে না
তেমনি আমিও যেতে পারব না দূরে –
অথচ কতকাল ধরে আমরা হয়ে আছি ছাড়াছাড়ি.. .
তোমাকে পেতে অরণ্য গহীনে গিয়েছি বারবার,
জলে ভেসে গিয়েছি অতলান্তে।
তুমি নিমগ্ন আমার চেতনা জুড়ে, দ্বিধার দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসো পথে , যে পথের উপর নির্বাসিত বহিমিয়ান জীবন আমার.. .
কোনও বিষাদ অপরাহ্ণে দুরবাহাটির অরণ্যে
কিংবা নির্জন যমুনা কূলে আর কী কখনও হবে না আমাদের দেখা।
২৮ . অ-সুখ
( উৎসর্গ – ফজলুর রব স্বপন ও ফারহানা স্বপন, চিরসুখী দম্পতিকে।)
ছুঁয়ে দিলেই অসুখ থাকে না তোমার
একদম সেরে ওঠো – ঔষধ, হাসপাতাল, ডাক্তার অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়,
স্পর্শ করলেই অবসাদ আর নীরবতা ভেঙে
মুখর হয়ে যাও তুমি।
এমনই করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকো অ-সুখ সরিয়ে
দিয়ে আমার ভুবনে।
২৯ . দেখা হবে না
আমাদের আর কথা হবে না
শূন্যতার মতো নিশ্চুপ পৃথিবীর আদিগন্ত,
নিঃশব্দে বাতাস বয়ে আসবে
তবুও কেউই কারোর কথা শুনব না।
দিঘির পাড়ের ঘাস ম্রিয়মাণ হবে না
কেউ বসে দেখব না স্তব্ধ জলের ঢেউ
ধবল গাংচিল উড়বে আকাশে
রোদ্দুর নিভে যাবে অস্তসূর্যের সন্ধ্যায়
আমরা কখনই আর মুখোমুখি বসব না।
চন্দ্রমৌলির গন্ধ ঝরবে উতল চন্দ্ররাতে
জোছনার রং মিলিয়ে তুমি পরবে না শাড়ি
রাতের আকাশ আকুল হবে
আমাদের আর কখনই দেখা হবে না।
৩০ . কত রূপে তুমি
মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতের মতো মাধুর্যমণ্ডিত
তোমার রূপ লাবণ্য, তোমার কটিদেশ মাইনী নদীর বাঁকের মতো আঁকাবাকা ,
সুন্দরবনের সুন্দরী পাতার গন্ধের মতো সৌরভ আসে তোমার শরীর থেকে।
তোমাকে অপ্সরী মনে হয় –
পৃথিবীর মতো রূপবতী তুমি, রামসাগরের জলের মতো রুপোলী তোমার গায়ের রং,
হেমন্তের সরিষা ফুলের সুবাস ঝরে, যেখানে কেবলই মৌমাছি গুনগুন করে,
ময়ূরাক্ষী তোমার চোখ বুক চিবুক ওষ্ঠ
বর্ষার জলের মতো মাদল বাজে বক্ষে তোমার,
অনাবৃত জঙ্ঘাস্থিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোরের আলোর দ্যূতি ছড়ায়…
মহাস্থান গড়ের লালমাটির রং তোমার মুখশ্রীতে
খোঁপায় গুঁজে রাখো ভাঁটফুল –
মেঘের আয়নায় দেখো মুখ ,
পরনে ঝলকিত হয় রাজশাহীর লাল রেশমি শাড়ি, যেন মধুপুরের শিমুল ফুল ফুটে দাউ দাউ জ্বলছে।
দূর মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের ছাদ থেকে দেখব তোমাকে, যে রূপেই দেখি – সাগর কন্যা কিংবা মেঘদূহিতা.. .
অপরাহ্নের আবছা আলোয় দেখে চিনে নেব ঠিকই তোমার কাজল আঁকা চোখ, ঠোঁট, আঙুল, চুল, কপোল।
৩১ . গল্পে লেখা নেই
পুরনো বছরে কত কথা হয়েছিল আমাদের সাথে
কত গল্প করেছিলাম দুজনে
কোনো কথাই গল্পে লিখে রাখা হয়নি,
কত মৌন বিকেল, কত শান্ত সন্ধ্যা কেটে গেছে
কথাহীন, কত প্রণয় দেখেছে অরণ্য বৃক্ষ-
কত দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল গোপন চাহনির পুলকে
কত চুম্বন উড়ে গেছে দক্ষিণ হাওয়ার দোল লেগে, সবই এখন বিস্মৃতির আঁধার.. .
পুরনো বছরের সেই তুমি সেই আমি এখন নেই
সেই নির্জন চাঁদের ম্লান আভা, শীতের ভোরে হাতের স্পর্শ লাগা সলজ্জিত শিশির – কোনো কিছুই আর ফিরে পাবো না,
কৃষ্ণ পক্ষের মেঘের ছায়া থেকে বিচছূরিত অন্ধকার ঢেকে দিয়ে গেছে মধূত্থ আমাদের সব প্রেম চিহ্ন.. .
সবই এখন চূর্ণ শঙ্খ, সবই ধুলোমাটির কাঁকড়-
বিষাদ গানের সুর বাজে প্রাণে
পুরনো বছরের কোনো কথা, কোনো উপকথাই গল্পের ভিতর লেখা হয়নি.. .
৩২ . কমলদিঘির জল
নিজেকে লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে খুব-
ধূপছায়া সন্ধ্যার মেঘকে তাই ডেকে বলি- তোমার অমল ধবল দরজাখানি খুলে দাও,
মিশে যাব তোমার অন্তরগৃহে- বৃষ্টি হয়ে ঝরে ফিরে আসব আবার পৃথিবীর ‘পরে।
মেঘ নিঃশঙ্কচিত্তে দ্বিধাহীন বলে ওঠে –
আমার ভুবন এমনিতেই জলে জলে ভরা,
এখানে তোমার স্থান হবে না।
পূর্ণিমার রাত্রির নক্ষত্রমণ্ডলীদের ডেকে বলি-
তোমাদের পাশে আমি নাহয় আর একটি তারা হয়ে মিটিমিটি জ্বলে থাকব, নেবে আমাকে?
রাতের সব তারা সমস্বরে বলে ওঠে –
আমরা এমনিতেই লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল তারা,
তোমার মতো নিষ্প্রভ কাউকে নিয়ে আমাদেরকে অনুজ্জ্বল করব না।
হেমন্ত ভোরে শিশির ঝরে পড়ে দূর্বাঘাসের উপর
সন্তর্পণে শিশিরের কাছে হেঁটে গিয়ে বলি-
আমার কিছু অশ্রু বিন্দু তোমাতে মিশাতে দেবে? পাশে থেকে দুর্বা ঘাস ধমকে বলে ওঠে —
আমার আছে অজস্র শিশির কণা, তোমার আঁখি জলের প্রয়োজন নেই।
নিঝুম রাত্রি প্রহরে চলে যাই চৌধুরীদের কমলদিঘির পাড়ে, রূপালি জোছনা পড়ে ঝিলমিল করছে জল, রাতের নিবিড়ে পদ্মফুলগুলো সুবাস ছড়াচ্ছে চারদিক, আমি জলের কাছে গিয়ে মিনতি করে বলি- তোমার অতলে আমাকে একটু ঠাঁই দেবে?
নিস্তব্ধ দিঘির টলটলে জল অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে- নেমে এসো, ঠাঁই হবে, তুমিও পদ্মফুল হয়ে ফুটে থাকবে আমার জলে।
৩৩ . গীতিময়
এমনই কনকনে শীতের দিনে এক কলেজ ফেরা বিকেলে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল
পরনে ছিল তার লাল রঙের কামিজ,
চুল ছিল বেণীখোঁপা বাঁধা,
চোখে ছিল বিকেলের ছায়ার মতো নিঝুম মায়া , দেখেছিলাম তার রূপসজ্জাহীন নিরাভরণ মুখ, ঐ মুখখানির মধ্যে ভুবনজয়ী ভালোবাসা ছড়িয়েছিল…
জামতৈল স্টেশনে গরম চায়ের চুমুক দিয়ে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর.,
তারপর কুয়াশা নামলো, কুয়াশা ভেঙে
আকাশে চাঁদ উঠলো…পথের দু’ধারে বুনো গাছগাছালির পাতার গন্ধ!
কত কথা হলো দুজনের
কত গান ভেসে গেল সন্ধ্যার বাতাসে,
কত ছন্দ বাজল পায়ে পায়ে
আমরা সেদিন মিশতে পারতাম অনন্ত জোৎস্নায় ভিজে পূর্ণিমা প্রহরে
আমরা উড়তে পারতাম মুক্ত ডানার চিলের মতো আকাশের নীলে
আমরা ভাসতে পারতাম রাজহংসের মতো উত্তাল ঢেউয়ের উপরে…
কিন্তু —
আমরা মিশিনি উন্মত্ত হয়ে অথৈ জোৎস্নায়
আমরা উড়িনি মুক্ত ডানায় লক্ষ তারার নীড়ে
আমরা ভাসিনি বুঁদ হয়ে স্বেদ জলে…
আমাদের ক্ষণগুলো ছিল
রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের কবিতার মতো গীতিময়।
৩৪ . নীলকমলের জল
আজ এই ম্রিয়মান অপরাহ্ণে শেষ আলোটুকু নিভে দিয়ে লাল টিপের মতো সুর্যটা নিভে গেল, বিষণ্ণ অভিমানের মতো নেমে এল সন্ধ্যা।
এই যে আমি আনমনে বসে আছি –
দেখছি দূরে বহতা একটি নদী,
সেই কবে এমনই ধুসর বিকেলে একটি মেয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল নীলকমলের তীরে,
চোখে ছিল তার ভাঁটফুলের শিশির ভেজা জল,
ঐ মেয়ে বলেছিল – এই নদীর মতো সুন্দর একটি নাম দেবে আমায় তুমি!
আজিকার এই শীতের মঙ্গলবারের সন্ধ্যা
বহু বছর আগের এক অস্তগামী হেমন্ত সন্ধ্যাকে ফিরিয়ে দিল – সেই নীলকমল নদীর বাঁক,
কাশবনের সেই সুগন্ধ ছড়ানো ঝিরিঝিরি হাওয়া, আকাশে উড়ে যাওয়া বালিহাঁসদের সেই মায়াবী পাখার শব্দ!
সেই রকমই এল চুল তার , কাঞ্চি আঁকা ভ্রূ,
নাকে নথ, হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, আনত চোখ- সেই মেয়েটি সলজ্জ গাঁয়ের বধু বেশে ঘোমটা মাথায় কাশবনের ঝাড় সরিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে আসছে!
সেই নীলকমল নদী নাকি শুকিয়ে গেছে-
নেই জলছবি, নেই তার জলতরঙ্গ,
নেই সেই জলের ধারা , ঐ মেয়েকে আর নাম দেওয়া হয়নি, সে অশ্রুমতি হয়ে লুপ্ত হয়ে গেছে নীলকমলের জলে।
৩৫ . যারা এসেছিল
সব বুকেই মুখ লুকালে দুচোখ মুদে ঘুম আসে না।
সব বুকেই শীতল পাটি বিছিয়ে বসে বসে কান্না করা যায় না। কেউ কেউ আসে জীবনে যার শাড়ির আঁচলে শৈশবের মায়ের আদর ছুঁয়ে থাকে।
কারো কারোর গায়ে নিরবতার মতো শান্তি লেগে থাকে। কেউ কেউ আসে জীবনে স্বার্থহীন ভালোবাসা অকাতরে বিলিয়ে দিতে। বিনিময়ে নেয় না কিছুই। বুকে জড়িয়ে ছোট্ট একটি আলিঙ্গনও…
কেউ কেউ চলে গেলে তাদের মনে পড়ে দীপ জ্বালা সন্ধ্যায় কিংবা রাত্রির মধ্য প্রহরে। যখন বাইরে জোছনার প্লাবন বয়। দূরাগত তার মৌন পদধ্বনি শোনা যায়। মনে হয় তার জন্য ঘরের একটি দরজা খুলে রাখি।
কিছু কিছু মানুষকে মনে পড়ে দুঃখের দিনে। যারা দুঃখগুলো মুছে দিত ভোরের মিষ্টি রোদ্র দিয়ে। যারা এসেছিল জীবন প্রাতে। তাদের হাত ধরতে ইচ্ছে করে আবার কাঙ্গালের মতো…
যারা আর কোনোদিন আসবে না, বলবে না আর কখনও — ‘মুখখানি কেমন মলিন হয়ে আছে, এসো আঁচলে মুছে দেই।’ যারা নিঝুম রাতের স্বপ্ন হয়ে চলে গেছে। যারা আমার গল্প হয়ে আছে।
৩৬ . জোছনার অলীক আলোয়
এক ফাগুনে আগুন জোছনার অলীক আলোয় পথ চিনে চিনে তুমি এসো,
কৃষ্ণচূড়ার পরাগরেণু অঙ্গে মেখে চঞ্চল বাতাসে
তুমি এসো,
রুপালি নদীর ঢেউ তরঙ্গের মতো উদ্দাম বেগে তুমি এসো।
আমি জানালা খুলে রাখব
তুমি এসো,
ঘরের দুয়ার খুলে রাখব
তুমি এসো,
উঠোনের উপর ঝরা পাতা ঝরে থাকবে,
তুমি সেই পাতা মাড়িয়ে এসো।
আকন্দ গাছের ডালে বসে ডাকবে খঞ্জনা পাখি
দুপুরের রোদ ঝরে পড়বে পথে পথে —
তুমি রোদ্রতাপে নীল শাড়ি পরে দেহখানি নীলাদ্রি
করে নীলাম্বরী হয়ে এসো।
তুমি এলে আমরা কথা বলব নিঝুম বারান্দায়
বসে মুখোমুখি,
দুচোখ মেলে দেখব ভালবাসাময় পৃথিবী,
আমরা গল্প করব রাজপুত্র রাজকুমারীর মতো
স্মিত হেসে ,
আমরা প্রতিশ্রুতি করব ভালোবাসার,
ভুলব না কেউ কাউকে, আমরা একই ভুবনে দুজন
বসবাস করব।
আমাদের প্রতিশ্রুতির সাথে জোছনার আলোয় পুণ্যতা মিশানো থাকবে,
আমাদের প্রেম ফাগুন বাতাসে ধুলির মতো
উড়ে যাবে না,
আমরা সব অবিশ্বাস, সব অপ্রেম ধূলো বাতাসে উড়িয়ে দেবো। তুমি এসো।
৩৭ . এক সন্ধ্যার গল্পকথা
তুমি আজ কোথায় কোন্ রোদ্দুরে হলুদ সোনাল ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছ, কোন্ দিগন্তে মেলেছ গাংচিলের ডানা, ভাসছ কলমিলতা হয়ে কোন্ জলবতী নদীর জলে।
আমি তোমাকে খুঁজি সজিনা ফুলের গন্ধে, ডুমুরের সাদা রেণুতে, দোয়েলের পালকের নীচে কুসুমপুরের ভাঁটফুলের ঝাড়ে, আকন্দের হরিৎ পাতায়, মহুয়া ফুলের পাহাড়ের ঢালে –
কিন্তু তুমি যে চলে গেছ দ্বিধাহীন ভঙ্গিতে অনেক দূর!
যেখানে গেছ সেখান থেকে আসবে না তুমি আর, জানালা খুলে দেখতে পাই ধূ-ধূ বালিয়াড়ি, মিছেই জলস্রোত ধারা, হাহাকার করা আকাশের মেঘ, আর কেবল নিঃসীম শূন্যতা.. .
তোমার বাড়িটি দেখলাম কাছে থেকে, কবেকার একটি ভাঙা গরুর গাড়ির জীর্ণ চাকাগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে আঙিনায়, কোথাও কোনও শব্দ নেই, বাতাস নেই, পাখি নেই, ছবি নেই, কোনও গল্প নেই.. .
একটি বালিকাকে দেখলাম, তার ফ্রকের কোচে
বকুল ফুল, খুঁজছে সুতো, হয়ত গাঁথবে মালা,
দেখলাম ওর ভিতর আমার ছেলেবেলা,
মনে পড়ল কবে এক মেঘবালিকা সন্ধ্যার ম্লান আলোয় দিয়েছিল আমাকে একগাদা গাঁদাফুল.. .
পুরনো পদরেখাগুলো খুঁজছিলাম, সব চিহ্ন মিশে গেছে ধুলোয়, চোখ দুটো আচানক আদ্র হয়ে উঠল, পথে ফিরতে ফিরতে মনে হলো- কিছু নাহোক আজ এই সন্ধ্যার বেদনার রেশটুকু দিয়ে তোমাকে নিয়ে একটি গল্প তো লিখতে পারি!
৩৮ . তোমার আগমন ধ্বনি
ভোর হলেই জানালা খুলে কান পেতে থাকি
যদি তুমি পাখির কলকাকলিতে গান গাও।
কাঠপোড়া তপ্ত দুপুরে ধুলির পথে পথে হাঁটি
যদি তুমি রোদ্দুর মেখে আমাকে উষ্ণতা দাও।
মেঘ দেখলেই উঠোনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি
যদি তুমি বৃষ্টি হয়ে আমাকে ভিজাতে চাও।।
মৌনতার সন্ধ্যায় নদীর কূলে গিয়ে বসে থাকি
জলেরধ্বনিতে যদি তুমি প্রাণের বীণা বাজাও।
পূর্ণিমা রাত্রি প্রহরে নির্ঘুমে দু’চোখ মেলে রাখি
চন্দ্রকিরণে এসে তুমি যদি নিঃশব্দে ফিরে যাও।
আমার সকল শ্রান্ত অবসরে নিমগ্ন হয়ে থাকি
যদি তুমি শান্ত চরণে এসে বুকে জড়িয়ে নাও।
৩৯ . চলে যাব একদিন কুসুমপুর
নীল আকাশের ছায়াতল দিয়ে,
বেতস ঝাড়ের পাশ দিয়ে, মেঠো পথে হেঁটে যেতে যেতে আবারও গন্ধ নিতে মন চায় ভাঁটফুল আর আমলকির।
যদি সেই পথ এখন হয়ে থাকে
লাল ইটের সুড়কি বিছানো কংক্রিটের , যদি দেখতে না পাই কোথাও ফুটে নেই ভাঁটফুল, যদি আর গন্ধ না বিলায় আমলকি।
তাতে কী!
হয়তো দেখতে পাব সেখানে — বেতস বনে জ্বলছে আজও সন্ধ্যা রাতে অসংখ্য জোনাকি।
৪০ . সূর্য ওঠার আগে
২৫ শে মার্চ,১৯৭১, আমাদের স্বাধীনতার ঠিক আগের দিন
পরাধীনতার শেষ দিন, কিংবা শেষ কালো রাত-
কি হয়েছিল সেদিন, সেই রাতে ?
সারি সারি জলপাই রঙ্গের ট্যাংক নামল রাজপথে
বুটের খট খট শব্দ, ট্যাংকের চাকার শব্দ
তারপর গোলার শব্দ, রাইফেলের গুলির শব্দ
এলোমেলো লাশ পড়তে থাকে পথের দু’ধারে, নর্দমায়-
এমন শব্দ এমন আর্তনাদ শোনেনি এর আগে এই শহরের মানুষ।
রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তাক করে চালানো হয়েছে গুলি
আক্রমন হয়েছে পিলখানায় ইপিআর ব্যারাকে
আক্রমন হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ হল, মধুর রেস্তোরা,
আক্রমন হয়েছে নিলক্ষেত পুলিশ ক্যাম্প, মোহসীন হলে
জ্বলছে শহর, হঠাৎ এ কেমন আলোকিত হয়ে উঠেছে নগরী !
দুগ্ধপানরত শিশু ত্রস্ত হয়ে মুখ খুলে ফেলে মায়ের স্তন থেকে
মসজিদে সিজদারত মুসুল্লীরা ভীত হয়ে ওঠে– এ কোন কিয়ামতের আলামত !
মন্দিরে উলুধ্বনি দেওয়া রমণীদের কন্ঠ রোধ হয়ে আসে
গির্জায় যিশুর সামনে প্রার্থনারত মানুষগুলোর প্রার্থনা থেমে যায়
ওয়াইজঘাটের বারবনিতাদের কুঠুরীর আলোগুলো একে একে নিভে যায়
বন্ধ হয়ে যায় সিনেমা হলের রাতের সব প্রদর্শনী।
রক্তে ভাসছে রাজপথ, মুহূর্তেই বুড়িগঙ্গার জল লাল হয়ে গেল
এত লাশ আগে দেখেনি কখনো এই শহরের মানুষ
এত বিধ্বংসী আলো দেখেনি কখনো এই শহরের মানুষ
এত আর্তনাদের কান্না শোনেনি এই শহরের মানুষ।
ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর বাড়িতে বিমর্ষ হয়ে পায়চারী করছেন এক নেতা
মুখে তার কালো রঙ্গের তামাক পাইপ, পরনে পায়জামা পাঞ্জাবী–
শতাব্দীর স্তব্ধতা ভেদ করে তিনি ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার অমর বানী–
“এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা: আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমার আহবান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।”
তখন সময় কালো রাতের মধ্য প্রহর, ঠিক নতুন একটি দিনের সূর্য ওঠার আগে।
৪১ . কালের দীর্ঘশ্বাস
শতবছর পরে এমনই এক স্থবির বিকেলে
কেউ একজন বিষণ্ণ চোখ মেলে বসে থাকবে
এই বাড়ির বারান্দায়,
অফিস থেকে ফিরে আসবে আমারই মতো কেউ একজন কর্ম ক্লান্ত শরীরে..
ঐ দুজন আমাদেরই বংশ পরম্পরার কেউ হবে,
অথচ ওরা জানবে না —
শতবছর আগে এখানে এই বারান্দায়
ওদের মতো করে কেউ একজন বসে থাকত মায়া চোখে পথের দিকে ,
কারোর ঘরে ফেরার অপেক্ষায়।
৪২ . কথা হয় না
কুসুমপুরের ঝোপে ঝাড়ে আজও ফুটে
থাকে ভাঁটফুল, একাকী বসে ঘুঘু ডাকে
রাঙা পলাশের ডালে –
দূর দিগন্তে ডানা ঝাপটে উড়ে যায় চিল
আমাদের শুধু কোনও কথা হয় না।
কত কথা বলা ছিল বাকী,
কত গল্প হয়নি বলা –
দিনগুলো বিষাদে কোথায় হারাল
কত ক্লান্তির সন্ধ্যা পেড়িয়ে গেল
আমাদের আর কথা হলো না।
শীর্ণা নদীটি আজও আছে সেখানে,
দুকূলেই নির্জনতা-
গাঙচিল ডাকে না আর চ্রিহি চ্রিহি,
কাশবনের সব ফুল ঝরে গেছে
আমাদের কেবল কথা হয় না।
গন্ধ বিলায় না আর সন্ধ্যামণি ফুল
দূর্বাঘাসের উপর হয় না আসন পাতা,
সন্ধ্যা নামে, ঝিঁঝি ডাকে, রাতের পাখিরা বলে কথা – আমাদের শুধু কোনও
কথা হয় না।
কেউ আর কোথাও নেই,
অনেকেই চলে গেছে প্রিয় মানুষটির হাত ধরে , আমরাও চলে গেছি ভীন্ন পথে দুই দিকে –
আমাদের তাই কোনও কথা হয় না।
এখন দূর শহরে বসে লিখি গল্প,
লিখি হাবিজাবি প্রাণের কত গান –
কত দীর্ঘশ্বাস ফেলি স্মিত মর্মরে ,
রাতের নিঃশব্দে অপসৃয়মান তারাদের সাথে
বলি কথা, হায়! আমাদের কেবল
কোনও কথা হয় না।
৪৩ . খুঁজি অরণ্য
বহু বছর আগে এক রোদ্দুর দিনে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিল,
তপ্ত বাতাস এসে ছুঁয়েছিল আমাদের দেহ , সেদিন কৃষ্ণচূড়াও উন্মুখ হয়ে ফুটেছিল
শত শত পাপড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল আমাদের উন্মত্ত শরীরের উপর.. .
সেদিন আকাশও যেন আগুনে জ্বলছিল
কৃষ্ণচূড়ার পাপড়িগুলো প্রখর উত্তাপে শ্বাস নিতে পারছিল না বাতাসের কাছ থেকে ,
এই জনপদ, এই শহরও যেন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল, আমিও পুড়েছিলাম তুমিও পুড়েছিলে সেদিনের সেই অনলে.. .
সব পুড়লেও ক্রান্তির এই দহনকালে তোমার কুসুমগন্ধী দেহখানির মাঝে নিমগ্ন হয়ে
ডুবে থাকি আজও,
আজও অঙ্গারের ভিতর সবুজের ঘ্রাণ খুঁজি.. .
খুঁজি অরণ্য –
অনিত্য কালস্রোতে সবই পুড়ে ছাইভস্ম হয়নাই , আজও কোথাও না কোথাও কৃষ্ণচূড়া ফুটে থাকে।
৪৪ . তার পায়ের শব্দ
আসবে না জেনেও পথ চেয়ে থাকি
যদি শুনতে পাই সেই চেনা পায়ের শব্দ
তোমার পথের থেকে –
আসবে না জানি, তবুও,
ইচ্ছে করে পথের উপর ঝরা ফুল বিছিয়ে দিতে,
আসবে না জেনেও সাধ হয় ফুলের রেণুতে যেন ভরে যায় তোমার চরণখানিতে।
৪৫ . অস্তিত্ব
সেদিন পথে তোমার সাথে আমার দেখা হলো। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম পথের উপরে। তুমি কোনো কথা বললে না। আমাকে না দেখে পাশ ফিরিয়ে চলে গেলে তোমার গন্তব্যের দিকে। আমি দেখলাম, তোমার চোখ তাকিয়েছিল নীলিমার দিকে। সেখানে চেয়ে দেখেছিলে হয়ত আমাকেই। কারণ তুমিই একদিন ঐ নীলে আমাকে ভাসতে বলেছিলে।
পথের উপরে আমি দাঁড়িয়ে থাকলেও, তুমি বুঝতে পেরেছিলে — আমি তোমার অন্তরের মাঝেই দাঁড়িয়ে আছি। কারণ, আমিই একসময় তোমার অন্তরে ঠাঁই করে নিয়েছিলাম। এবং এখনো সেখানেই আছি।
৪৬ . স্বপ্ন ভঙের গল্প
একটু বসো, একটি গল্প বলব, শোনো।
আমার একটি নদী ছিল — সেই নদী পাহাড়ের কোল পেরিয়ে, যোজন যোজন মাঠ পেরিয়ে, বালি নুড়ি পলিমাটি ভেঙে এসে পৌঁছেছিল আমার আঙিনার কাছে।
সে এসেছিল হিমবাহ থেকে ব্রহ্মপুত্র নামে
তারপর আরও কত নাম হলো তার,
আমি তাকে চেয়েছিলাম — কিন্তু সে চলে যেতে চাইল মহাসমুদ্রের কাছে।
সে আর আমার কাছে রইল না —
সে বদলে গেল, অন্য একটি নদীর কাছে লীন হয়ে
চলে গেল সাগর মোহনার দিকে।
পৃথিবীর রমণীগুলো মনে হয় এমনই নদীর মতো হয়,
ওরা বদলে যায়, ওরা লীন হয়ে যায়, বাহুলগ্না হয়ে চলে যায় অন্য দয়িতের কাছে!
নদীর চেয়ে পাহাড় ভালো, ওরা স্থির থাকে এক জায়গায়। আকাশও ভালো — রাতভর তারা জ্বেলে রাখে। মেঘমালাও সুন্দর! ওরা বৃষ্টি হয়ে শীতল করে পৃথিবী । বৃক্ষও ভালো, ছায়া হয়ে থাকে।
যদি শোনো, আরও কিছুক্ষণ বসো —
আরও অনেক কথা আছে বলার, ভালোবাসাহীনতার সে কথা, বঞ্চনার সে কথা।
যদি বসো, বনকুঞ্জে জ্বলে থাকা অজস্র জোনাকির আলোয় তোমাকে দেখব আর আমার গল্প শোনাবো ।
রাজপুত্তুরদের প্রেমের কোনও রূপকথা নয়, শোনাবো আমারই স্বপ্ন ভাঙার গল্প, নৈসঙ্গের গান।
তুমি না শুনতে চাইলে অন্য কাউকে শোনাবো —
সে হয়তো প্রেমময়ী প্রেয়সী কেউ নয়,
নিতান্তই ঘাস ফড়িং হবে , তাকেই শোনাবো আমার স্বপ ভঙের গল্প।
৪৭ . বিদায়ী পংক্তিমালা
যে ছেলেটি একদিন ট্রেনে করে এসেছিল এই ঢাকা শহরে
সে আজ শববাহী যাত্রী হয়ে চলে যাচ্ছে তারই শহরে,
তার জ্বলজ্বলে চোখ ভালোবেসেছিল বাংলাদেশের মানচিত্র।
উদ্দাম তারুণ্যে বার বার হেঁটে গেছে সে রবীন্দ্র সরোবরের কাছে
যেখানে নিহত হয়েছিলেন স্থপতি, জাতির পিতা ইতিহাসের সেই আদর্শিক পিতার ছবিকে করেছে কুর্নিশ।
বহিমিয়ান ছিল না সে, সে লিখত কবিতা
জীবন থেকে শব্দ তুলে এনে লিখত গল্প
কোনোই অভিমান ছিল না তার ! ধূসর এই হেমন্ত সন্ধ্যায়
চলে গেল সে শীর্ণ এক নদীর তীরে, শেষ খেয়াটির জন্য অপেক্ষা না করে।
৪৮ . আকাশের সব নীল
আমি প্রতিদিন বিস্ময়ে দেখি-তুরাগ পাড়ের কাশবন
বালি মাটিতে ফুটে থাকা তুচ্ছ ঘাস ফুল
দেখি দিয়াবাড়ির আকাশ,শুনি কানপেতে সন্ধ্যার শব্দ,
কপালের উপর তোমার উড়ে পড়া চুল
দেখি স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসার কাতরতা ।
ঘর থেকে বের হওয়ার বাঁশি শুনি
ধূসর বসন্ত সন্ধ্যায় যদি তুমি ডাক দাও
উড়ন্ত শশারের মতো স্বপ্ন নিয়ে উড়ে যাই
আকাশের সব নীল তখন লালচে হতে থাকে।
তোমাকে সাথে নিয়ে যে সন্ধ্যা আমি দেখি
যে রাত দেখি- বিমুগ্ধ প্রণয়ের যে কাতরতা
চোখের উপর চোখ রেখে বুঝতে পারি-
এই ক্লান্তির শহরে আমাদের সব প্রেমই অম্লান।
৪৯ . সংসারভূক
একটি কোমল হাতের স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
সে কি ছু্ঁয়েছিল আমার কপাল ?
ঘুম ভাঙ্গবার আগে হাতের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ বেজেছিল কি ?
চোখ মেলে রাতের স্বপ্নগুলি মনে করতে পারিনি কিছুতেই। চুম্বনগুলো কি স্বপ্নের মধ্যে ছিল ? তার দিকে অপলক চেয়ে থেকেই সকাল শুরু হয়ে যায।
কোর্টের বোতাম লাগিয়ে শেষে কপাল রেখেছিলো বুকের উপর, অফিসের চাবীটা তুলে দিয়ে দিয়েছিল হাতে। এত যে ভালোবাসা, এতো যে টান, তারপরও নিজকে আজও সংসারভূক করতে পারিনি।
৫০ . রোদ্রক্লান্ত দুপুর
একি কোনো মায়াজাল তবে?
আমার সকল ভাবনায়
সকল পাওয়ার আকুলতায়
এই রোদ্র ক্লান্ত দুপুরে তোমাকে কাছে টানতে
মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে
আমার অন্তর্মহলের সমস্ত দুয়ার খুলে যায়
আমি নির্মোহে শূন্য করে দিতে চাই সব।
তখন তুমি ছিলে রবীন্দ্র সঙ্গীতে
থামিয়ে দিয়ে সব গান দিলে বাহু পেতে
বললে, ‘এসো এসো আমার ঘরে এসো।’
৫১ . ভালোবাসি
যদি কখনও নাম ধরে তোমাকে ডেকে বলি — ভালোবাসি।
আর ঠিক তখনই যদি কল্লোলিত হয়ে ওঠে সমুদ্র,
যদি প্রচণ্ড ঢেউ ব্যেপে এসে বলে — আমার জলে তোমাদের স্থান নেই।
আর ঠিক তখনই আকাশ তার ছায়া ফেলে বলে — স্হান দিতে না পারি, ছায়ামাখা রোদ্রের দিন তোমাদের দেবো।
তবুও তুমি বলে দাও — ভালোবাসি।
৫২ . সুচরিতাসু
তুমি নিজেকে লুকাতে পারবে না কোথাও ,
না যমুনার জলে, না ধুরবাহাটির অরণ্যে –
তোমাকে ছুঁইতে গিয়ে ছুঁয়েছি আগুন
তবুও তুমি আগুন হতে চাওনি কখনও।
তুমি নিজেকে যেমন লুকাতে পারবে না
তেমনি আমিও যেতে পারব না দূরে –
অথচ কতকাল ধরে আমরা হয়ে আছি ছাড়াছাড়ি.. .
তোমাকে পেতে অরণ্য গহীনে গিয়েছি বারবার, জলে ভেসে গিয়েছি জলধির অতলান্তে।
তুমি নিমগ্ন আমার চেতনা জুড়ে,
দ্বিধার দুয়ার খুলে বেরিয়ে আসো পথে , যে পথের উপর নির্বাসিত বহিমিয়ান জীবন আমার.. .
কোনও বিষাদ অপরাহ্ণে দুরবাহাটির অরণ্যে
কিংবা নির্জন যমুনা কূলে আর কী কখনও হবে না আমাদের দেখা।
৫৩ . শিকারী
মনে করো প্রশান্ত সাগর থেকে উঠে আসা
তীব্র ঢেউ তোমার শরীর ফেনায়িত করল
তুমি ক্রমশঃ দুই চোখ মেলে বললে — জড়িয়ে ধরো।
কিন্তু তার আগেই আসন্ন সেই শীতের রাতে তুষারপাত শুরু হলো।
সাদা বরফের কুচি তোমার সর্বাঙ্গে লেপ্টে আছে
তুমি তখন অভিমানহীন উদাসীন এক নির্জন হরিণী।
যে প্রেম পালঙ্ক আসনে, যে আসন চিত্রিত মেঘে ঢাকা
যে মেঘের নীচে গুচ্ছ গুচ্ছ তারা
যেথায় ত্রস্ত হয়ে ওঠো তুমি, আমি সেথারই এক নিষ্ঠুর হরিণ শিকারী।
৫৪ . কত রূপে তুমি
মাধবকুণ্ডের জলপ্রপাতের মতো মাধুর্যমণ্ডিত
তোমার রূপ লাবণ্য, তোমার কটিদেশ মাইনী নদীর বাঁকের মতো আঁকাবাকা ,
সুন্দরবনের সুন্দরী পাতার গন্ধের মতো সৌরভ আসে তোমার শরীর থেকে।
তোমাকে অপ্সরী মনে হয় –
পৃথিবীর মতো রূপবতী তুমি, রামসাগরের জলের মতো রুপোলী তোমার গায়ের রং,
হেমন্তের সরিষা ফুলের সুবাস ঝরে, যেখানে কেবলই মৌমাছি গুনগুন করে,
ময়ূরাক্ষী তোমার চোখ বুক চিবুক ওষ্ঠ
বর্ষার জলের মতো মাদল বাজে বক্ষে তোমার,
অনাবৃত জঙ্ঘাস্থিতে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোরের আলোর দ্যূতি ছড়ায়…
মহাস্থান গড়ের লালমাটির রং তোমার মুখশ্রীতে
খোঁপায় গুঁজে রাখো ভাঁটফুল –
মেঘের আয়নায় দেখো মুখ ,
পরনে ঝলকিত হয় রাজশাহীর লাল রেশমি শাড়ি, যেন মধুপুরের শিমুল ফুল ফুটে দাউ দাউ
জ্বলছে।
দূর মহেশখালীর মৈনাক পাহাড়ের ছাদ থেকে দেখব তোমাকে, যে রূপেই দেখি- সাগর কন্যা কিংবা মেঘদূহিতা.. .
অপরাহ্নের আবছা আলোয় দেখে চিনে নেব ঠিকই তোমার কাজল আঁকা চোখ, ঠোঁট, আঙুল, চুল, কপোল।
৫৫ . স্বপ্নের কথা বলি
যদি আমি স্বপ্নের কথা বলি
গল্প বলার মতো করে রূপকথা
চন্দ্র রাত্রির কথা
স্বপ্নবাজ এক রাজপুত্তুরের কথা
এক মিথের রাজকুমারীর কথা,
শুনবে তুমি?
মধ্যরাত্রিতে ঘোড়ার পায়ের খট খট শব্দ
রিনিকঝিনি নুপুরের শব্দ
তারা ঝরে পড়ার শব্দ, আমাদের পায়ের শব্দ
হাওয়ায় মিলে যায় নিঝুম প্রান্তরে দিগ্বিদিকহীন।
যাই কংসাবতীর তীরে,
এক পাটনী নৌকায় তুলে নেয় আমাদের,
দেখি নদীর বাঁক, শুনি জলের শব্দ, চুড়ির শব্দ।
স্বপ্নযাত্রায় যখন ঘোর কাটে,
তখন তুমি আর রাজকুমারী নও
কোনো পাটনীও নওত
দেখি তুমি সে এক কৈবর্ত বউ নিশি রাই
তারপরে আর কোন স্বপ্নের কথা বলি না
রাতভর রাত্রিচরা পাখিদের মতো
উড়তে থাকি, উড়তে থাকি, উড়তে থাকি —
রাতের গহীনে, তোমার হৃদয়ের গহীনে।
৫৬ . চাই অমৃত শিউলি চন্দনে
রাতের নির্জনতায় অন্তরমহলের দরজাটা
খুলে দাও,
এই তো তুমি আছ তোমার মতো করে —
হৃদয় ভরে নিয়ে শিউলি আর চন্দনের গন্ধে !
সব দুঃখকে ভুলে দিতে পারো তুমি।
আমি চাই বাগদাদের একটি রাত আর রাজস্থানের একটি সকাল,
যেখানে রাতের ভালবাসা শরাব আর
সাকীতে বিভোর থাকে।
সকালবেলা ধ্বনিত হয় মীরা বাঈয়ের কণ্ঠে
প্রভুর জন্যে গাওয়া গীত ও সংগীত ।
৫৭ . আমাদের ভালোবাসা
নয়নে নয়ন রেখে দেখলাম তোমাকে, তুমি বললে অন্তরে দেখো।
অন্তরে অন্তর ছু্ঁয়ে ভালোবাসতে চাইলাম,
তুমি বললে বুকে তলে নাও।
বুকে বুক রাখতেই শীতের সকাল আগুন জ্বলে উঠল। আগুনের লেলিহান ছড়িয়ে গেল দেহ থেকে দেহান্তরে। তুমি জ্বললে, আমাকেও জ্বালালে। ছাই ভস্ম হয়ে দেহ দুটি এখন ছিন্ন তুলোর মতো আকাশে উড়ছে।
৫৮ . পৃথিবীর ধূলির পথে
কোনো একদিন সব কোলাহল থেমে যাবে
স্তব্ধ হয়ে যাবে বাতাসের বেগ দিগন্তে
মুখর পাখিরা এসে গাইবে না গান অলিন্দে বসে
মৃতেরা যেয়ে ঠাঁই নেবে মাটির গহ্বরে
সেদিন পাশে থাকবে না কেউ আর।
আমার সমস্ত জীবন ভার
বেদনার সব ভার
পৃথিবীর ধুলোর পথে বয়ে বেড়াবে না আর
হারাবে সমস্ত পথ তার অন্ধকারে
আমার প্রাণের প্রান্তে নৈঃশব্দরা উন্মাতাল হবে।
কার হাতে দেবো তখন জীবনের ক্লান্তির ভার
সাদা কফিনের পাশে তোমরা কেউ উৎসব করো না
লোবানের গন্ধ উড়িও না বাতাসে
পৃথিবীর সমস্ত রোদ্র যখন ছায়ায় ভাসতে থাকবে
প্রিয়জনেরাও শান্ত হবে তখন।
সব পাপ প্রায়শ্চিত্ত হবে একদিন
স্তব্ধ হয়ে যাবে সব জনকলরোল
আত্মারা তখন উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে থাকবে পুনর্জন্মের জন্য পৃথিবীর ধূলির পথে পথে
আমারই আজন্ম ক্রন্দনধবনির মতো।
৫৯ . আজন্ম প্রেমিক
আজন্ম প্রেমিক আমি, বুদ হয়ে থাকি আনন্দে,
আনন্দ আমার পূর্বপুরু্ষ থেকে পাওয়া অধিকার।
তুমি কি আনন্দ করতে পারবে ?
পারলে পারবে, না পারলে চলে যাবে
যেমন চলে গেছে পূর্বের অক্ষম সব প্রেমিকারা।
আমি তো ভিখারী রাঘব নই,
আমৃত্যু আনন্দ করা আমার অধিকার।
৬০ . গীতিময়
এমনই কনকনে শীতের দিনে এক কলেজ ফেরা বিকেলে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল
পরনে ছিল তার লাল রঙের কামিজ,
চুল ছিল বেণীখোঁপা বাঁধা,
চোখে ছিল বিকেলের ছায়ার মতো নিঝুম মায়া , দেখেছিলাম তার রূপসজ্জাহীন নিরাভরণ মুখ, ঐ মুখখানির মধ্যে ভুবনজয়ী ভালোবাসা ছড়িয়েছিল…
জামতৈল স্টেশনে গরম চায়ের চুমুক দিয়ে আমরা রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম অনেক দূর.,
তারপর কুয়াশা নামলো, কুয়াশা ভেঙে
আকাশে চাঁদ উঠলো…পথের দু’ধারে বুনো গাছগাছালির পাতার গন্ধ!
কত কথা হলো দুজনের
কত গান ভেসে গেল সন্ধ্যার বাতাসে,
কত ছন্দ বাজল পায়ে পায়ে
আমরা সেদিন মিশতে পারতাম অনন্ত জোৎস্নায় ভিজে পূর্ণিমা প্রহরে
আমরা উড়তে পারতাম মুক্ত ডানার চিলের মতো আকাশের নীলে
আমরা ভাসতে পারতাম রাজহংসের মতো উত্তাল ঢেউয়ের উপরে…
কিন্তু —
আমরা মিশিনি উন্মত্ত হয়ে অথৈ জোৎস্নায়
আমরা উড়িনি মুক্ত ডানায় লক্ষ তারার নীড়ে
আমরা ভাসিনি বুঁদ হয়ে স্বেদ জলে…
আমাদের ক্ষণগুলো ছিল
রবি ঠাকুরের ক্ষণিকা কাব্যগ্রন্থের কবিতার মতো গীতিময়।
৬১ . তুমি স্বৈরিণী নও
পুরুষকে তুমি কি মনে করো ? পুরুষ মানেই মধুকর ?
তুমি স্বৈরিণী নও, ময়ুরাক্ষীও নও, তুমি প্রেমিকা
আমি চাইলেই স্ত্রৈণ হতে পারি না, তুমি পারো না স্বৈরিণী হতে,
আমরা যাই হই, স্ত্রৈণ কিংবা স্বৈরিণী
আমরা আসলে প্রেম বুভূক্ষু এক যুগল, ভালোবাসি প্রেম
যে প্রেম উৎসব করে দেহে, স্বর্গে কিংবা নরকে।
৬২ . তুমি এসো
ঝুমঝুম পায়েলের শব্দ তুলে তুমি এসো। চুড়ির রিনঝিন শব্দ তুলে তুমি এসো। নিশীথ রাত্রির দ্বিপ্রহরে তুমি এসো। আমার ঘুমিয়ে পড়া দুচোখের স্বপ্নে তুমি এসো।
আমার ঘুম ভাঙিয়ে তুমি দিও।
যদি চোখ ছোঁয়াতে চাও চোখে, তবে ছুঁয়ে দিও।
যদি চুমু দিতে চাও ঠোঁটে, চুম্বন দিও।
যদি আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে চাও, জড়িও।
যদি আরও কিছু চাও, তাও নিও
যদি ভাসতে চাও সমুদ্রে, ভাসিও। যদি চাও অমরত্ব, অমরত্বই তুমি নিও।
ভালো থেকো। ভালোবাসা নিও।
৬৩ . স্বর্গের পথে আছি
দীর্ঘ পথ পায়ে মারিয়ে পৌঁছতে পারিনি গন্তব্যে,
জীবনভর হাঁটলাম মাইল মাইল পথ ।
কিন্তু কোনও স্বর্গের পথ খুঁজে পাইনি আজও,
এখন কোথায় যাবো লুকিয়ে কোন্ নরকে?
আমার জন্য ঈশ্বর তৈরি করেছিলেন একজন ধ্রুপদী রমণী —
যার চোখ মুখ আমার চোখে রং মাখে উজ্জ্বল তুলিতে,
কিছু সৌন্দর্যের ছ্বটা রয়ে যায় ভাবনায়,
কিছু থাকে স্বর্গের পথে হারিয়ে যাবার জন্য–
আমি এখন সেই স্বর্গের পথে আছি।
৬৪ . নিভে গেল আলো
আমাদের সম্পর্ক যখন ছিন্ন হলো, সব লেনদেন শুন্য করে যখন পথে নামলাম — দেখি, পথ শুয়ে আছে মনখারাপ করে সমান্তরাল,
তাকে আমি ফেলে রেখে আসলাম স্তব্ধ অন্ধকারে
কিংবা সেই নীভে দিল সব আলো।
দুপাশের বৃক্ষরাজি শেষ শীতের রোদ্রে চৌচির করছে
পাতা ঝরছে একটি দুটি করে টুপটাপ
সব ছেড়েছুরে পথে নেমে আসলে পথও কী পর হয়?
কেমন নির্জনতা চষে বেড়াচ্ছে চারদিক
পৃথিবীর বুক থেকে অজস্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে অনবরত।
কোথাও পাখি ডাকে না, কোথাও মেঘের ছায়া নেই
লতাচাপালি শুকিয়ে জড়িয়ে আছে ঝোপে ঝাড়ে
কৃষক ঋজু পায়ে গরু নিয়ে যাচ্ছে মাঠে
কোথাও কোনো ঘাসফুল আজ ফুটে নেই পথের ধারে।
এর আগে এমন শুন্যতা দেখিনি কখনো
এমন করে খেয়াল করিনি একাকীত্ব নিজের অস্তিত্বের ভিতর, এমন কান্নার ধ্বনি শুনিনি বাতাসে।
আমি হেঁটে নদীর কাছে যাই, কেমন শীর্ণা শুষ্কতোয়া নদী , জলের শব্দ শোনার জন্য কূলে বসে থাকি,
যদি ভরে ওঠে অথৈ হয়ে, যদি কুলকুল ধ্বনি বাজে —
নিজের গোপন ক্রন্দনধ্বনি মিলিয়ে দেওয়ার জন্য
কান পেতে থাকি নদীর দিকে…।
৬৫ . যদি বলো চলে যাও
যদি বলো চলে যাও –
আমি চলে যাব ভোরের কমলা রোদ্দুর
তপ্ত কাঠপোড়া হয়ে ওঠার আগেই।
যদি বলো চলে যাও –
আমি চলে আসব নৈঋতে জমে থাকা মেঘের জলস্রোতে, ঈষাণের বায়ুর মতো দ্রুত বেগে,
ঘাসের উপর ভোরের শিশির শুকিয়ে যাবার
আগে।
যখন চলে আসব –
কোথাও আমার শরীরের ঘ্রাণ রাখব না
ধুয়ে রেখে যাবো বিছানাপত্তর, আমার গায়ের ছোঁয়া লাগা তোমার কাপড়ও।
মুছে দিয়ে যাব সারা বাড়িতে আমার ফেলে রাখা পায়ের চিহ্ন, নামিয়ে ফেলব দেয়াল থেকে যুগল প্রতিকৃতি।
যদি বলো চলে যাও —
ব্যবহৃত তোয়ালে, টুথব্রাশ, পারফিউমের শিশি, তোমার দেওয়া অঙ্গুরীয়, হাতঘড়ি, ব্রেসলেট সব ছুড়ে ফেলে দেবো, সরিয়ে ফেলব এ্যালবাম থেকে সমস্ত প্রণয় ছবি,
কোথাও কোনও অভিজ্ঞান রাখব না।
তুমি চলে যাও বললেই –
ল্যাপটপে ডাউনলোড করা আমাদের প্রিয় গানগুলি ডিলিট করে দিয়ে যাব, যে গানগুলো শুনতাম মৌনতার কোনও বিকেলে ও সান্ধ্য অন্ধকারে।
পুরনো একটি চিঠিও তোরঙ্গে রাখব না, সব ছিঁড়ে ফেলে রেখে যাব।
আমাদের খুনসুটি, বিরাগ, অভিমান, আমাদের অপেক্ষা, প্রণয় উম্মাদনা, মধুময় আলিঙ্গন, কোনও কিছুই মনে গেঁথে নিয়ে যাব না,
সব এই ঘরে তোমার কাছে দগ্ধ ক্ষত করে রেখে যাব।
এই ঘরে রেখে যাব খা-খা শূন্যতা, উঠোনে পড়ে থাকবে ঝরা পাতা,
তুমি জীর্ণ পাতা মাড়িয়ে হেঁটে হেঁটে খুঁজবে আমাকে,
কোথাও পাবে না আামার অস্তিত্ব, আমার ঘ্রাণ, আমার উপস্থিতির ছায়া।
যদি কখনও ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামে, থইথই জলের উঠোনে দাঁড়িয়ে তুমি একাকী ভিজবে, স্মৃতিরা ফিরে আসবে তোমার কাছে, কিন্তু আমি আসব না। মানুষ চলে গেলে মানুষ আর ফিরে আসে না।
৬৬ . একটি এলিজি
মৌনতা দিয়েই ঢেকে থাক
তোমার মুখখানি
বিস্মৃতির মেঘে ঢেকে যাক আকাশটিও।
প্রতিরাত বেঘোর ঘুমের মাঝে কোনো
স্বপ্ন দেখা হয় না
শোনা হয় না আর কারোর গল্প কথাও।
৬৭ . স্টপ ইট
রূপবতী রমণীর কাছে যাসনে যুবক
ঐটি আত্মহণনের পথ, যাসনে ,স্টপ ইট!
রাতের নীলে নীলকণ্ঠ পাখি হোস নে
পাগলা মেহের আলী হয়ে বলিস না –
‘তফাৎ যাও, দুনিয়া সব জুট হ্যায়।’
যুবক, তুই হেমন্তের সুর ছবি আর গান
বসন্তের ঐ ঘূর্ণী হাওয়ার ধুলি লাগাস নে
ওখানে বিষের সাপ, ছোবল তুলে আছে
যাস নে ঐ রমণীর কাছে – স্টপ, স্টপ ইট।
৬৮ . এখানেই নোঙ্গর
বন্দরে জাহাজ দাড়িয়ে আছে ভেঁপু বাজিয়ে আমায় ডাকছে
তুমি এসে ধর আমর হাত তোমার হাতে।
তারপর …
জাহাজ সাগরের স্রোত ছুঁতে ছুঁতে চলে যাবে
অচেনা বন্দরে
অকূলে ভাসতে ভাসতে মনে হবে
দূরের ঐ বন্দর আমাদের নয়
তুমি তখনও ধরে আছ আমার হাত, মনে হবে এই জলধি আমাদের
এই জল আমাদের, এখানেই আমাদের নোঙর।
৬৯ . সুপ্রভাত
কোনো একদিন ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে যাবে
মেলতে পারব না আর সে চোখ
শরীরের সব চেনা গন্ধ ঢেকে যাবে আতরে-
কর্পূরের সুবাস ছড়িয়ে দেয়া হবে কফিনে,
কবরে মাটি ঢাকা পড়তেই দেখতে পাবো না সূর্যাস্ত, দেখতে পাবো না মৌনতার আকাশ,
দেখতে পাবো না চাঁদ নক্ষত্র জোনাকীদের আলো।
উঠবে আবার সূর্য, শুরু হবে নতুন অন্যরকম আরেক জীবনের–
তখনও কী এমনই মায়া ছড়ানো কোনও ভোরে কেউ এসে বলবে না আর ‘সুপ্রভাত’।
৭০ . শুভাশিস
তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাও না, আকুলও হও না, ভালবাসো না, অন্তর গৃহ তখন তোমার মৌনব্রত থাকে।
তুমি আমাকে মনে রাখতে পারো আবার সহজে ভুলে যেতে পারো যেভাবে সন্ধ্যার তারা মেঘে ঢেকে রাখে।
এত নিবিড় করে কেন এত প্রেম দাও, আবার কেন
তুমি দিতে চাও জীবনের যত অজস্র ঘৃণার লেশ?
অহং উল্লাসে কি এত সুখ পাও? হৃদয় দিয়ে হৃদয় পোড়াও, আমাকেও শেষ করো, নিজেও হও শেষ।
কে আর আমায় দেবে অমৃত সুধা, কে আর আমায় বলবে ভালো থেকো, কে আর আমায় দেবে অভিশাপ।
কে আর আমায় নেবে স্বর্গবাসে, কে আর আমায় দেবে শান্তি, কে আর আমায় দেবে মুক্তি নরকের যত পাপ।
fayzur rahman hasib
please give me number of koyel talukdar . I am a big fan he. kindly give me 0140148**** in this number