ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ – সৈকত মুখোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৮
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ – প্রদীপ্ত মুখার্জি
.
জঁর-ফিকশনের জহুরি
সৌভিক চক্রবর্তী
ভ্রাতৃপ্রতিমেষু
.
অন্ধকার স্রোতের সৈকতে
সাহিত্যের মূল ধারাটিকে যদি আলোকিত উজ্জ্বল স্রোত হিসেবে কল্পনা করা যায় তা হলে রহস্য, রোমাঞ্চ, গোয়েন্দা, ভৌতিক, হরার, ফ্যানটাসি, কল্পবিজ্ঞান ইত্যাদি কাহিনি নিয়ে সাহিত্যের যে-ধারাটি বয়ে চলেছে তাকে বোধহয় অন্ধকার ‘অশুভ’ স্রোত বলা যেতে পারে। না, এটা আমার কথা নয়—সাহিত্য সমালোচক পণ্ডিতদের কথা। কারণ, আমি তো সেই ১৯৬৮ সাল থেকে, বাণিজ্যিক পত্রিকায় আমার প্রথম গল্প ‘ভারকেন্দ্র’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই তথাকথিত ‘অন্ধকার’ স্রোতেই সাঁতার কেটে চলেছি। এবং চলেছি মনের আনন্দে। যদি এই অন্য ধারার সাহিত্যকে সাধারণভাবে ‘জঁর ফিকশন’ নাম দেওয়া যায় তা হলে বলতে পারি, আমার কিশোর অথবা সদ্য-তরুণ বয়েসে জঁর ফিকশনের লেখক এবং পাঠক, দুই-ই ছিল কম। সাহিত্যের আসরে জঁর ফিকশন ছিল মোটামুটিভাবে ব্রাত্য। আর সেই ফিকশন লিখিয়েরা বসার জায়গা পেতেন একেবারে পিছনের সারিতে।
অবস্থাটা এরকম ছিল বলেই বোধহয় ১৯৫৭ সালে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার রজত জয়ন্তী সংখ্যায় ‘সাহিত্যে রোমাঞ্চ’ নামে একটি রচনায় প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন ‘জাত যদি যায় যাক, তবু নির্লজ্জভাবেই স্বীকার করছি যে রহস্য-কাহিনী আমি ভালোবাসি।’
১৯৫৯ সালে নেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে (১৯৭০ সালে ‘মাসিক রোমাঞ্চ’ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত) ‘মাসিক রোমাঞ্চ’-র সম্পাদককে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন ‘কনান ডয়াল, চেস্টারটন প্রমুখ লেখক যে সাহিত্য রচনা করতে লজ্জিত নন, তা রচনা করতে আমারও লজ্জা নেই।’
বাংলা সাহিত্যের এই দুই দিকপালের এই দুটি মন্তব্যের পর একটি বিদেশি উদাহরণ দেওয়া যাক।
স্টিফেন কিং। জঁর ফিকশনের লেখক। ১৯৪৭-এ, ভারতের স্বাধীনতার বছরে, আমেরিকায় কিং-এর জন্ম। ১৯৬৭-তে লেখালিখি শুরু করে এখনও তাঁর কলম থামেনি। এ পর্যন্ত প্রায় ৫৪টি উপন্যাস, ২০০ ছোটগল্প আর কয়েকটি প্রবন্ধের বই লিখেছেন। আর এই জঁর ফিকশনের যে-যে ‘সাব-জঁর’-এ তিনি লেখালিখি করেছেন সেগুলো হল ঃ হরার, ফ্যানটাসি, সায়েন্স ফিকশন, সুপারন্যাচারাল ফিকশন, ড্রামা, গথিক জঁর ফিকশন, ডার্ক ফ্যানটাসি, পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপটিক ফিকশন, ক্রাইম ফিকশন, সাসপেন্স এবং থ্রিলার।
এই সাব-জঁরগুলোর বেশিরভাগের প্রচলিত বাংলা নাম অমিল বলে ইংরেজি নামের তালিকাটিই পেশ করেছি।
লেখক হিসেবে স্টিফেন কিং-এর অবস্থান বিশ্লেষণ করার জায়গা এটা নয়। তবে শুধু এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, কোনও সংস্কৃতিমান পাঠক স্টিফেন কিং-এর পাঠক হতে পারলে গর্ব বোধ করেন এবং নিজের বইয়ের আলমারিতে ‘স্টিফেন কিং রচনাবলী’-কে সসম্মানে জায়গা দেন।
১৯৮০ সালে একজন সাংবাদিক স্টিফেন কিং-এর একটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় প্রশ্ন করেছিলেন, ‘Why do you write about fear and terrible manifestations?’
এই প্রশ্নের উত্তরে কিং বলেছিলেন, ‘What makes you think I have a choice?’
শরদিন্দু, প্রেমেন্দ্র বলেছিলেন, জঁর ফিকশন লেখার ব্যাপারে তাঁদের লজ্জা নেই। স্টিফেন কিং গর্বের সঙ্গে এ-কথাই বলতে চেয়েছেন, এ ধরনের কাহিনি লেখা তাঁর ভবিতব্য।
১৯৫৭ থেকে ১৯৮০—তেইশ বছরে অবস্থাটা যেমন বদলেছে, তেমনই বদলেছে জঁর ফিকশনের লেখক-পাঠকের অবস্থান। ১৯৮০-র পর কেটে গেছে আরও সাঁইতিরিশ বছর! এখন মনে হয়, লেখক যেমন মাথা উঁচিয়ে গর্বের সঙ্গে জঁর ফিকশন লিখতে পারেন, পাঠকও লেখকের সঙ্গে একই স্তরে দাঁড়িয়ে সেই ফিকশন পড়তে পারেন।
এরকমই একজন লেখক সৈকত মুখোপাধ্যায়, যিনি গত একযুগ ধরে নামি-অনামি পত্রপত্রিকায় দারুণভাবে লেখালিখি করে এই প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে প্রায় সামনের দিকটা দখল করে নিয়েছেন। সৈকত সাহিত্যের মূল ধারায় নিয়মিত কলমকারি করলেও অন্ধকার স্রোতে কম সাঁতার কাটেননি। তারই প্রমাণ এই বইয়ের বারোটি গল্প। গল্পগুলো জঁর ফিকশনের অন্যতম উপশাখা ‘ডার্ক ফ্যানটাসি’ চরিত্রের। বাংলা সাহিত্যের এই উপশাখাটির চর্চা হয়েছে কম।
‘ডার্ক ফ্যানটাসি’-কে ফ্যানটাসি কাহিনির একটা সাব-জঁর বলা যেতে পারে। ফ্যানটাসি কাহিনির প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে মানুষের অন্ধকার নেগেটিভ দিক নিয়ে চর্চা করে ‘ডার্ক ফ্যানটাসি’। তার সঙ্গে কখনও-কখনও মিশে থাকে ভয়, আতঙ্ক, মরবিডিটি, র’ ট্র্যাজিক এলিমেন্ট কিংবা হরার এলিমেন্ট। এ ধরনের কাহিনির উদাহরণ হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ‘খগম’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে।
সৈকতের বারোটি গল্পের বিস্তার বারো রকম সুরে—একটির সঙ্গে অন্যটির কাহিনির কোনও মিল নেই। যেমন বিচিত্র তাদের প্লট, তেমনই অভিনব তাদের চমকের ভাঁজ। তবে গল্পগুলোর নানান সুর একজোট হয়ে যে-মন-কেড়ে-নেওয়া সঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে তার নাম ‘ডার্ক ফ্যানটাসি’। আর গল্পগুলোর প্লট নিয়ে সৈকত অপরূপ দক্ষতায় ক্ষুরধার ভাষা দিয়ে বুনে দিয়েছেন এক-একটি কাহিনি। এককথায় এই বই পড়া একটি অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতার শরিক হতে নিশ্চয়ই আপনিও চাইবেন।
I’m not able to have the access to this book named ঈশ্বরের নষ্ট ভ্রূণ – by সৈকত মুখোপাধ্যায়…….