• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর

লাইব্রেরি » অভিজিৎ রায়, রায়হান আবীর » অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর
অবিশ্বাসের দর্শন

অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর

অবিশ্বাসের দর্শন – অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীর
প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১১

লেখক পরিচিতি – অভিজিৎ রায় (১৯৭১– ২০১৫)

অভিজিৎ রায় যুক্তিবাদী লেখক, ব্লগার এবং মুক্তমনা ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা। বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্যের সুসংবদ্ধ বিশ্লেষণের আলোয় লেখা ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’, ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’, ‘সমকামিতা:একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’, ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইগুলো তাঁকে প্রতিষ্ঠিত করেছে বর্তমান সময়ের বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখক হিসাবে। তার লেখা দুটি বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্তমনা মহলে ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। সুসাহিত্যিক, অনুসন্ধিৎসু, সমাজ সচেতন এবং সত্য সন্ধান ও প্রকাশে আপোষহীন অভিজিৎ রায়ের স্বপ্ন ছিলো বিজ্ঞান, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের আলোকে সমাজ প্রতিষ্ঠার। সেই অর্জনের পথের সমমনাদের নিয়ে শুরু করেছিলেন মুক্তমনা ব্লগ যা আজও বাংলাভাষী বিজ্ঞানকর্মী, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী ও নির্ধামিকদের সবচেয়ে বড় অনলাইন সংগঠন।

অভিজিৎ রায়ের জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সালে। তখন বাবা অধ্যাপক অজয় রায় সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, আর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে রক্ষা পেতে তাঁর মা শেফালি রায় আশ্রয় নিয়েছেন ভারতের আসামে। স্বাধীনতার পরে বাবার কর্মসূত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শৈশব-কৈশোর কাটে অভিজিৎ রায়ের। তিনি যন্ত্রকৌশলে স্নাতক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এরপরে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন আমেরিকার আটলান্টা শহরে।

অনলাইনে অজস্র লেখালেখি ও প্রকাশিত দশটি বইয়ের মধ্যে দিয়ে অভিজিৎ অন্ধবিশ্বাস আঁকড়ে থাকা সমাজব্যবস্থার ভিত্তিমূলে আঘাত করে করে অবিরাম তুলে ধরেছেন মানবতার কথা। সাহস যুগিয়েছেন বিজ্ঞান ও যুক্তি’তে আস্থা রাখতে। ‘সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে যার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের সমাজচ্যুত করে রাখা সমকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিজ্ঞান ও যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন মানুষের ক্ষুদ্র একটি অংশের মধ্যে সমকামী প্রবৃত্তি থাকা অপরাধ বা ক্ষতিকর নয়, বরং তা। প্রাণীজগতের স্বাভাবিক চিত্র। এর মাত্র দুই বছর পর প্রকাশিত হয় ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (সহ-লেখক: রায়হান আবীর) বইটি যা বিজ্ঞানপ্রিয় ও মুক্তমনা মহলে ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। এই বইটিতে আধুনিক বিজ্ঞান ও দর্শনের আলোকে নাস্তিকতাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সবচেয়ে যৌক্তিক ও মানবিক অবস্থানে। ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ (২০১৪) বই খানিতে তিনি ধর্মকে তুলনা করেছেন ভাইরাসের সাথে এই বলে যে, ‘ধর্ম’ ব্যপারটি মানুষকে অযৌক্তিক ঈশ্বর ও অমানবিক প্রথায় বিশ্বাস স্থাপন থেকে শুরু করে আত্মঘাতী পর্যন্ত করে তুলতে পারে।

মানব মননের ক্রমাগত উন্নতিতে বিশ্বাসী অভিজিৎ রায় উৎসাহী ছিলেন বিভিন্ন বিষয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, চিত্রকলায়, ও নারীর সামাজিক অবস্থান উন্নয়নের ভাবনাচিন্তায় সুসাহিত্যিক এবং মানবতাবাদী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রভাব নিয়ে লেখা ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে’, অসামান্য এই বইটি প্রকাশ হয়েছিল ২০১৫ সালে। একই বছরে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও অস্তিত্বের সাম্প্রতিকতম ধারণা নিয়ে গণিতবিদ অধ্যাপক মীজান রহমানের সাথে লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইটিও প্রকাশ পায়। বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য, সমাজচিন্তা, ধর্ম ও আরো বহু বিষয়ে অভিজিৎ রায়’এর লেখা কৌতূহলী-অনুসন্ধিৎসু-জিজ্ঞাসু মানুষকে যোগান দিয়েছে বস্তুবাদী চিন্তার বিপুল রসদ, যা আঘাত করেছে। আজকের পশ্চাৎগামী ও অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজের সাম্প্রদায়িক ধর্মব্যবসায়ী এবং অসৎ রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের’কে।

যুক্তি দিয়ে যুক্তির মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়ে ইসলামি জঙ্গিরা ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি নির্মমভাবে আক্রমণ করে অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদকে। বন্যা আহমেদ গুরুতর আহতাবস্থা থেকে বেঁচে উঠলেও সেই রাতেই অভিজিৎ রায়। মৃত্যুবরণ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এমন নৃশংস পরিণতির বা সম্ভাবনার কথা অভিজিৎ জানতেন না তা নয়, তবু তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন ‘পাণ্ডুলিপি পোড়ে না। তাঁর সেই বিশ্বাসের অমোঘ প্রমাণ তাঁর রচনাসমূহ, যে সব আজও মানবতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রেরণার উৎস হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবুদ্ধির আন্দোলনে অভিজিৎ রায় আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন।

তাঁর লেখা ও সম্পাদিত বই:

আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী (২০০৫, অঙ্কুর প্রকাশনী)

মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭, অবসর প্রকাশন সংস্থা, সহলেখক: ফরিদ আহমেদ)

স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)।

সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০, শুদ্ধস্বর)।

অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: রায়হান আবীর) বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২, অঙ্কুর প্রকাশনী, মুক্তমনা প্রবন্ধ সংকলন)

ভালবাসা কারে কয় (২০১২, শুদ্ধস্বর)

শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪, শুদ্ধস্বর, সহলেখক: অধ্যাপক মীজান রহমান)

বিশ্বাসের ভাইরাস (২০১৪, জাগৃতি প্রকাশনী)

ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫, অবসর প্রকাশনা সংস্থা)

.

লেখক পরিচিতি – রায়হান আবীর

রায়হান আবীর, মুক্তমনা ব্লগার। বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী সমাজ গঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখালেখি করেন। পছন্দের বিষয় বিবর্তন, পদার্থবিজ্ঞান, সংশয়বাদ। ব্লগিং করেছেন অনলাইন রাইটার্স কমিউনিটি সচলায়তন ডট কম এবং ক্যাডেট কলেজ ব্লগে। মুক্তমনা সম্পাদক অভিজিৎ রায়ের অনুপ্রেরণায় মুক্তমনা বাংলা ব্লগে বিজ্ঞান, সংশয়বাদ সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছেন তিনি।

অভিজিৎ রায়ের সাথে ২০১১ সালে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয় প্রথম বই ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (দ্বিতীয় প্রকাশ: শুদ্ধস্বর ২০১২, তৃতীয় প্রকাশ: জাগতি ২০১৫), দ্বিতীয় বই ‘মানুষিকতা’ প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর প্রকাশনী থেকে ২০১৩ সালে।

শৈশবের বিদ্যালয় আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং এসওএস হারমান মেইনার কলেজ। কৈশোর পেরিয়েছে খাকিচত্বর বরিশাল ক্যাডেট কলেজে। ২০০৯ সালে তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক প্রকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন গাজীপুরের ইসলামিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউটি) থেকে। এরপর কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে।

প্রথিতযশা বিজ্ঞানী অধ্যাপক সিদ্দিক-ই-রব্বানীর নেতৃত্বে আরও একদল দেশসেরা বিজ্ঞানীর সাথে গবেষণা করে যাচ্ছেন তৃতীয় বিশ্বের মানুষের জন্য উন্নত স্বাস্থ্যসেবা প্রযুক্তি উদ্ভাবনে।

.

বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখো দ্বিতীয় বিদ্যায়।
বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে।
বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো।
অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায়
অনায়াসে সম্মতি দিও না।
কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়,
তারা আর কিছুই করে না,
তারা আত্মবিনাশের পথ
পরিষ্কার করে।
—নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

.

চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা

অভিজিৎ রায়ের সাথে লেখা ‘অবিশ্বাসের দর্শন বইটা প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০১১ সালে। আমার ছোটভাই আহমেদ রেদওয়ান জান্না তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ইন্টারনেট, মোবাইল, কম্পিউটারবিহীন ওর জীবনের একমাত্র সঙ্গী ছিল ‘আউট বই। কিন্তু সে বয়সের জন্য অবিশ্বাসের দর্শন একটু বেশিই ‘আউট হয়ে যায়, তাই আমি তখন পড়ে দেখার জন্য জোর করি নি। ধর্মান্ধদের মতো আগ বাড়িযে ওকে নির্ধর্ম নিয়ে কখনও প্রেরণা দিতে ইচ্ছা করত না, কাউকেই করে না। তবে ও যেন যৌক্তিক চিন্তা করতে শেখে, সত্য মিথ্যা নির্ধারণ শিখতে পারে সে চেষ্টা করতাম সবসময়। উপযুক্ত বয়স হলে ও নিজেই সিদ্ধান্ত নেবে, কোনো প্রশ্ন আসলে উত্তর দিতে আমি তো আছি। বইটা প্রকাশিত হবার পর জান্না না পড়লেও অসম্ভব খুশি হয়েছিল তার বড় ভাই বই লিখেছে বলে, পরিবারের একমাত্র সদস্য যাকে আমি আমার লেখালেখির কথা বলতাম। প্রথম বই প্রকাশের আনন্দটা পরিবারের এই একজনের সাথেই তখন ভাগাভাগি করতে পেরেছিলাম।

দেখতে দেখতে দিন চলে যেতে থাকলো। অবিশ্বাসের দর্শনের সাথে সাথে জান্নাও বড় হতে থাকল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ সেরে রাতে বাসায় ফিরে প্রায়ই একটু সময়ের জন্য শুয়ে থাকতাম জান্না’র বিছানায়। ও পাশের টেবিলে পড়ত। ২০১৪ সালের ত্রিশ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে ঘোষিত হয় যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায়। এর বিরোধীতা করে যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াত ইসলামী হরতাল ডাকে, যে কারণে স্কুলে যেতে পারে নি ও। জান্না তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং মাত্রই স্কুলের মান যাচাই পরীক্ষার তত্বীয় অংশ শেষ করেছিল। যেদিন স্কুলে যেতে পারে নি, সেদিন ওর পদার্থবিজ্ঞান ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। হরতাল হলে অঘোষিত নিয়ম পরীক্ষা বাতিল। কিন্তু সেদিন হয় নি। রাতে বাসায় অভিযোগ আসলো, ব্যবহারিক পরীক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় জান্নাকে হুমকি দেওয়া হলো তাকে মূল পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না বলে। জান্না খুব মন খারাপ। করেছিল এবং ধরে নিয়েছিল ও পরিবারকে ‘অসম্মান করেছে এবং আর কখনও অসম্মান না করার উপায়ও সে বের করে ফেলে সেরাতে আত্মহত্যা করে। পরদিন সকালে দরজা ভেঙ্গে যখন ওর ঘর ঢুকি, যে ঘরটায় একসময় এক বিছানায় ঘুমাতাম আমি আর জান্না, সেই বিছানার উপরে উপরে ঝুলে আছে জান্না। তার পরনে বিবর্তনের ওপর আমার ডিজাইন করা একটা টি-শার্ট, যেটা কয়েকজন মুক্তমনা সদস্য মিলে করেছিলাম; গেঞ্জিতে লেখা ছিল- ‘বিবর্তন শুধু একটু তত্ব, ঠিক যেমন মহাকর্ষ”!

আমাদের ছেড়ে চিরতরে চলে যাবার সাত দিন আগে সে জানতে চেয়েছিল বিগব্যাং থেকে যদি আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়, তাহলে বিগব্যাং এর আগে কী ছিল? বিছানা থেকে উঠে বসে ওকে নিজে যতটুকু জানি ততটুকু ব্যাখ্যা করলাম। তারপর জানালাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটায় একটা অধ্যায় আছে ‘শুরুতে?” নামে, ও পড়ে দেখলে মজা পাবে। এই প্রথম ওকে বইটা পড়ে দেখতে বললাম, ওর সতেরো বছর বয়সে। অদ্ভুত হলেও সত্যি, আমার নিজের কাছে অবিশ্বাসের দর্শনের কোনো কপি ছিল না। প্রথম সংস্করণও না দ্বিতীয়টাও না। বইটা মাঝে দরকার ছিল বলে বন্ধু জামানের কপিটা নিয়ে এসেছিলাম বাসায়। জান্নাকে পড়তে দেবো ভেবে নিজের ঘরে গিয়ে বইয়ের জঙ্গলে খুঁজে দেখলাম, পেলাম না। ওকে গিয়ে বললাম, পাচ্ছি না, পরে দেবো। সে পর আর আসে নি আমার জীবনে।

প্রায় দীর্ঘদিন ‘আউট অফ প্রিন্ট’ অবিশ্বাসের দর্শন বইটি অভিজিৎ রাযের উৎসাহে প্রকাশিত হয়েছিল জাগৃতি প্রকাশনী থেকে, ২০১৫ সালের বইমেলায়। জানুয়ারির প্রথম দিনে শাহবাগে গিয়ে হাতে পেলাম নতুন ছাপা হওয়া অবিশ্বাসের দর্শন বইটি। আগৃতির প্রকাশক ফয়সাল আরেফীন দীপন ফোন করে আগের দিনই জানিয়েছিলেন যে, বইটি ছাপা হয়ে অফিসে চলে এসেছে। সত্যি বলতে কি, এই প্রথম আমি নতুন বই হাতে পেয়ে কেঁদে ফেললাম, সবচেয়ে প্রিয় মানুষকে হারিয়ে আমার জীবন যখন শূন্যতায় ভরা, তখন মনে হচ্ছিল- ইস বাসায় গিয়ে যদি জান্নাকে দেখাতে পারতাম বইটা। আমার মতো আবেগাক্রান্ত হয়েছিলেন অভিজিৎ রায়ও। যে বছরে ঘাতকরা আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেবে আমাদের অভিজিৎ রায়কে সেই বছরের প্রথম দিনটা তিনি শুরু করেছিলেন ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের দর্শনের কথা বলে–

নববর্ষের প্রথম দিনেই প্রকাশকের কাছ থেকে একটা আনন্দের সংবাদ পেলাম। অবিশ্বাসের দর্শন বইটির তৃতীয় সংস্করণ আসছে। ছাপা শেষ, প্রচ্ছদও হয়ে গেছে। বিভিন্ন কারণেই ২০১৪ সালটি ছিল এক বিভীষিকাময় বছর। ২০১৫ সালের শুরুটা অন্ততঃ একটা আনন্দের বার্তা দিয়ে শুরু হলো, এটাই বা কম কী! ‘মুক্তি আসুক যুক্তির পথ ধরে! জীবন হোক বিশ্বাসের ভাইরাস মুক্ত”। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

মায়ের গর্ভ থেকে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল অভিজিৎ রায়ের। ১৯৭১ এর উত্তাল মার্চে, তাঁর বাবা অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র চার বছর আগে লীডস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি এবং পোস্টডক্টরেট গবেষণা শেষ করে অজয় রায় ফিরে আসেন বাংলাদেশে, প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশে এসে শিক্ষকতা, গবেষণার পাশাপাশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন প্রিয় দেশকে পাকিস্তানি শোষকদের হাত থেকে রক্ষার আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পৃথিবীর ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাংলাদেশের উপর। রাত এগারোটায় ঢাকায় কারফিউ জারি করা হয়। টেলিফোন, টেলিগ্রাফসহ বাংলাদেশের সকল পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকাকে আলাদা করে ফেলা হয় পুরো বাংলাদেশ থেকে। মানুষ হত্যার জন্য একের পর এক সামরিক অভিযান চলতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, ইপিআর এর সদর দফতর থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব স্থানে। ট্যাঙ্ক, গ্রেনেড, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নির্বিচারে চলে সাধারণ মানুষ, ছাত্র, নারী, পুলিশ, আধা-সামরিক সদস্যদের উপর আক্রমণ। সেই ভয়ঙ্কর সময়টাতে অজয় রায়, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শেফালী রায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের ফুলার রোডের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায়। ক্র্যাক ডাউনের সেই সময়ে তালিকা হাতে অজয় রায়কে হত্যার উদ্দেশ্যে হাজির হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দল। সদর দরজায় নকল তালা লাগিয়ে সেরাতে পাকিস্তানী সেনাসদস্যের বোকা বানিয়ে নিজেকে, পরিবারকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন অজয় রায়। ইংল্যান্ডের চাকরি-গবেষণা-নিশ্চিত জীবনকে ঠেলে সরিয়ে যেই মানুষটি বাংলাদেশে ফিরেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযে যোগ দিয়েছিলেন, পরদেশের হায়েনাদের আক্রমণে সপরিবারে বাধ্য হন গৃহত্যাগে। তাঁর স্ত্রীর শেফালী রায়ের গর্ভে তখন বড়ো হচ্ছে বড়ো ছেলে অভিজিৎ রায়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ছেড়ে তখন ঢাকায় আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবের বাসায় আশ্রয় নেন অজয় রায়। কারফিউ উঠে যাবার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সপরিবারে ঢাকা ত্যাগ করেন কুমিল্লার সোনামুড়া সীমান্ত দিয়ে। ভারতের আপার আসামে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কমিশনে কর্মরত প্রকৌশলী বড়ো ভাইয়ের বাসায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে রেখে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের জন্য চলে যান অজয় রায়। পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাকে আপাতত দূরে ঠেলে কাঁধে তুলে নেন অস্ত্র, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে গেরিলা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। অজয় রায়ের সেই মুক্তিযোদ্ধা দলটির বীরত্বপূর্ণ অভিযানের কথা বর্ণনা হতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া বেতার তরঙ্গে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা এম. আর. সিদ্দীকীর পরামর্শে আগরতলা হয়ে মুজিবনগরে চলে আসেন অজয় রায়। সেখানে গিয়ে জড়িত হয়ে পড়েন তাজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত প্রবাসী স্বাধীন বাংলা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। অবৈতনিক সদস্য হিসেবে যোগ দেন বাংলাদেশ সরকারের প্ল্যানিং সেলে এবং পরবর্তীকালে সেক্রেটারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যুদ্ধের সেই উত্তাল সময় সেপ্টেম্বরের বারো তারিখ রোববার সকাল ১২:৪২ মিনিটে শিবসাগর জেলার নাজিরাতে একটি মাতৃসেবা হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন অভিজিৎ রায়। রণাঙ্গনে থাকা বাবা অজয় রায় এক স্বেচ্ছাসেবকের কাছে জানতে পারেন তার প্রথম পুত্র সন্তানের পৃথিবীতে আগমনের খবর। চাইলেই তখন ছেলের কাছে চলে যাওয়ার উপায় ছিল না তার, ছেলেকে কোলে তুলে নেবার সৌভাগ্য হয় অভিজিৎ রাযের চৌদ্দ দিন বয়সে। তারপর আবার ফিরে গিয়েছিলেন রণাঙ্গনে। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলে, ১১ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে সদ্য ভূমিষ্ঠ অভিজিৎ রায়কে নিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন অজয় রায়। যোগ দেন কর্মস্থলে। ফিরে আসেন ফুলার রোডের বাসায়।

শিক্ষকদের আবাসিক এলাকার স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালের ছোট এক বাড়িতে বেড়ে উঠতে থাকেন অভিজিৎ রায়। ছোট বেলার সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অভিজিৎ রায় লিখেছিলেন–

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এক ছোট্ট বাড়ির নোনাধর দ্যোল আর স্যাঁতস্যাঁতে ছাদের নীচে থেকে সেটাকেই আমরা দু-ভাই তাজমহল ভেবেছি। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই ছিল উদয়ন স্কুল। সেখানে পড়তে গেছি পায়ে হেঁটে। দূরে কোথাও যেতে হলে রিক্সাই ছিল অবলম্বন। বাড়ির পাশেই বিরাট মাঠে ফুটবল ক্রিকেট খেলে কাটিয়েছি। বাবার কাছে বায়না ছিল ভালো একটা ক্রিকেট ব্যাট। আমার মনে আছে, প্রথম যখন একটা ভালো ক্রিকেট ব্যাট বাবা নিউমার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলেন, আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলেছিলাম। পরে শুনেছিলাম বাবাও নাকি ছাত্রজীবনে ক্রিকেট খেলতেন। বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রের মতো বড়ো করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিল মুক্তধারার কিশোর বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের ‘মহাকাশে মহাত্রাস’ কিংবা স্বপন কুমার গাযেনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা এগুলো তাঁর কল্যাণেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রাযের রচনা সমগ্র। হয়বরল এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রির কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের ‘প্রশ্ন’ কবিতা।

মুক্তিযুদ্ধ করে বিদেশী হায়েনাদের কাছ থেকে প্রিয় বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছিল ঠিকই, যদিও আমাদের অনেকের মনে-প্রাণে লালিত পাকিস্তানি ভাইরাস ঠিকই রয়ে গেলো। সকল মুসলমান ভাই ভাই, এই বালখিল্য ফালতু কথার অসাড়তা আমরা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন টের পেয়েছিলাম। আমরা ধর্মীয় সকল কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে একটি বৃহৎ মুসলমান রাষ্ট্র দ্বিখণ্ডিত করে বের হয়ে এসেছিলাম। আমরা যুদ্ধ করেছিলাম মোল্লাদের বিপক্ষে, মেয়েদের গনিমতের মাল আখ্যা দিয়ে আল্লাহর আইন দিয়ে জাস্টিফায়েড করা ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই গৌরব কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? পারি নি। ফেব্রুয়ারি, যে মাসটাকে আমি ভাবতাম ঢাকা শহরের সবচেয়ে প্রাণম্য মাস, ২০১৫ সালের সেই মাসটির ছাব্বিশ তারিখ রাতে ইসলামিক সেকুলার বাংলাদেশে চাপাতি দিয়ে হামলা করে মেরে ফেলা হয় বাংলাভাষী মুক্তচিন্তকদের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম মুক্তমনার প্রতিষ্ঠাতা, বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে। অভিজিৎ রায় ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, মানবতাবাদী, নাস্তিক। তিনি ভালোবেসেছিলেন বিজ্ঞান, ভালোবেসেছিলেন যুক্তি। তিনি লিখেছেন বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তা, মানবতাবাদ, সাহিত্যসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষযে। শুধু লেখালিখি করেই থেমে থাকেন নি তিনি, একইসাথে বাংলাদেশের মুক্তচিন্তার আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। ভাইরাসের চাপাতির আঘাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অভিজিৎ রায় বাংলায় লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন দশটি বই। সেরাতে অভিজিৎ রায়ের সাথে থাকা। তার স্ত্রী, মুক্তমনা সদস্য ও ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটির লেখক বন্যা আহমেদকেও কুপিয়ে আহত করা হয়, বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় তার হাতের আঙ্গুল, চাপাতি দিয়ে আঘাত করা হয় তার মাথায় এবং চোখের সামনে ধ্বংস করে দেওয়া হয় তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। অসহায়ের মতো বন্যা আহমেদ হারিয়ে যেতে দেখলেন তার প্রিয়তমকে আর আমরা দেখলাম আমাদের প্রিয় দাদার মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকা, শুনলাম আমাদের বোনের আর্তচিৎকার, আরও দেখলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের কেচিগেট। কেচিগেটের ওপারে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা আমার ভাই কিছুক্ষণ আগেই হাঁটছিলেন আমার বোনের হাত ধরে, হাজারো মানুষকে আপন ভেবে তারা এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনের দিকে, তখনও হয়ত তার মস্তিষ্কের নিউরনে লেখা হচ্ছিল নতুন কোনো প্রবন্ধ, সমাধান হচ্ছিল মুক্তমনার কারিগরি কোনো সমস্যা। আমার দাদা কিংবা বোন, আমার দেখা শ্রেষ্ঠতম মানুষ, তারা নিজেদের বদলে ভালোবেসেছিলেন তাদের দেশকে, ভালোবেসেছিলেন দেশের মানুষকে, আলোকিত করতে চেয়েছিলেন অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজকে। কিন্তু আলো অন্ধকারের সবচেয়ে বড়ো শত্রু, কারণ আলো জ্বালালেই দূর হয় অন্ধকার। আলোকে চাপাতি দিয়ে অন্ধকারকে কোপাতে হয় না, গুলি করতে হয় না, ঘিলু ফেলে দিতে হয় না। অন্ধকারে আলো হাতে পথ চলাই ছিল তাদের অপরাধ, আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া সমাজে এই অপরাধ সর্বোচ্চ অপরাধ, এমন অপরাধীদের আমরা পেছন থেকে এসে হত্যা করি। কারণ আমরা অন্ধকার চাই। নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা থাকা সত্বেও সে রাতে আলো হাতে গিয়েছিলেন আমাদের আঁধারের যাত্রী, কারণ তাকে বলা হয়েছিলো বিজ্ঞান লেখকদের সাথে আড্ডার কথা। যদিও সেখানে বিজ্ঞান লেখকদের সংখ্যার তুলনায় অনেক অনেক বেশি ছিল গুপ্ত ঘাতকেরা। যারা তাকে ডেকে নিয়ে অন্ধকারের হাতে সঁপে দিয়েছিল, তারা সেদিন তার মৃত্যুতে একটুও আলোড়িত হয় নি, ক্ষুধা পেলে আমাদের যেমন খেতে হয়, তাদেরও সেরাতে ক্ষুধা মেটাতে বিরিয়ানি খেতে হয়েছে, কারও বা খেতে হয়েছে মার হাতের রাতের খাবার কিংবা অংশ নিতে হয়েছে পাঁচ তারকা হোটেলের পার্টিতে। সব শেষে তারা শান্তির নিদ্রা দিতে পেরেছে, কারও কারও সেই নিদ্রা ভাঙ্গতে লেগেছে বিশ দিন।

স্বাধীন বাংলাদেশের এক অসম্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে, টুপি পরে আইডিয়াল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করে সপ্তম শ্রেণীতে চলে গেলাম থাকি চত্বরের খোঁয়াড় ক্যাডেট কলেজে। কলেজ শেষ করে মুসলমান কোটায় কোনো ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে ঢুকে গেলাম ইসলাম প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (আইইউটি) তে। আইইউটি, ওআইসিপরিচালিত বাংলাদেশের অন্যতম ‘আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গল্প শুনেছি তারা প্রত্যেক ছাত্রের পেছনে পনেরো হাজার ডলার ব্যয় করে শিক্ষাজীবনের চার বছরের বাজেট হিসেবে। ওআইসির সেই টাকা আমার কপালে জুটে নি, কারণ মুসলমান হলেও ভালো মুসলিম ছাত্র ছিলাম না, বাবা-মার পকেট থেকে মোটা অংকের টিউশন ফি দিয়েই তাই পড়াশোনা করতে হয়েছে।

আইইউটিতে ভর্তি হবার আগেই জানতাম এখানে কেবলমাত্র ‘মানুষ’ (শর্ত প্রযোজ্য) দের ভর্তি হবার সুযোগ দেওয়া হয়। ‘মুসলিম পুরুষ’ হওয়াটাই সেখানে মানুষ হবার একমাত্র শর্ত। আইইউটির দুয়ার নারী এবং অমুসলিমদের জন্য বন্ধ। এই চরম সাম্প্রদায়িক আচরণ আমাকে অবাক করলেও অন্য সবার কাছে শুনেছি- জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবস্থা সারাবিশ্বেই খুব খারাপ, মুসলমানরা নিজেরা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে নিজেরা পড়াশোনা করে নিজেদের উন্নতি সাধনের চেষ্টা নাকি খুব ভালো। নারীদের ঢুকতে না দেওয়ার উছিলাটা ছিল- তাতে করে নাকি বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে শুধু পাপাচার হবে। প্রথম বর্ষেই আমাদের তৎকালীন তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের প্রধান পাকিস্তানি অধ্যাপক বলেছিলেন ঠিক এই কথাটাই। রুমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতেও তার যুক্তি ইসলাম ধর্মে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে যাবার পর ভাই আর বোনেরও এক রুমে থাকা নিষিদ্ধ। ইন্টারনেটও ঠিক তেমন একটি প্রাপ্ত বয়স্ক আপন বোন, রুমে তাকে আমাদের সাথে একা রাখা যাবে না।

২০০৭ সাল। দ্বিতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা শেষে দীর্ঘ তিনমাসের ছুটি চলছে। আমার বাসায় থাকতে ভালো লাগত না, তাই ছুটির সময়েও হলে থাকতাম। সপ্তাহান্তে ছোট ভাই জান্নাকে দেখতে খুব ইচ্ছা হতো। ও তখন ক্লাস টু এর পুচকা এবং প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে আমাকে দেখতে পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেত কারণ আমাকে বললেই আমি চকলেট, আইসক্রিম আর কোক খাওয়াতাম। গাজীপুর থেকে জ্যাম ঠেলে ঢাকা আসতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। সেই সময় আমার প্রথম পরিচয় হয় ‘অভিজিৎ রায় এর লেখার সাথে। প্রিয় বন্ধু ‘শিক্ষানবিস’ আজিজ মার্কেট থেকে দুটো বই কিনে এনেছিল। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ এবং ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’। শিক্ষানবিস ময়মনসিংহের এক লাইব্রেরিতে আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী বইটির সামান্য অংশ পড়ে অভিজিৎ রাযের লেখনীতে বেশ মুগ্ধ হয়েছিল, তাই আজিজ থেকে ‘আস্ত” দু’টি বই কিনে আনা। পরের সপ্তাহান্তে জান্নাকে দেখার জন্য আলো। হাতে আঁধারের যাত্রীকে সঙ্গী করে জ্যাম হাতে বাসযাত্রী হলাম। সেই থেকে শুরু। অভিজিৎ রায়ের আলোয় কাল্পনিক সত্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত জীবন।

আমাদের সমাজ সদ্যজন্মজাত শিশুর ইহলৌকিক খেলার মাঠের মৌলিক চাহিদা পূরণে খুব একটা আগ্রহী না হলেও তার। পরকাল নিশ্চিত করতে সিদ্ধহস্ত। জন্মগ্রহণ করতে না করতেই সে একটি নির্দিষ্ট ধর্মযুক্ত হয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে তাকে শেখানো হয় সে যে দলভুক্ত তারাই সেরা, একমাত্র সত্যপথের অনুসারী। অন্যান্যদের জন্য রয়েছে…… (কী রয়েছে সেটা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করুন)। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ছোটবেলা থেকেই আশেপাশের সবার কাছে আমার ধর্মের মুজেজা শুনেছি, আর ভেবেছি ‘ওয়াও!!”। আমার বন্ধু-বান্ধব কেউ অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী ছিল কিনা এখন মনে নেই, থাকলেও তাদের সাথে ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার কথা হয়নি নিশ্চিত। হলে তখনই জানতে পারতাম, নিজ ধর্মকে অন্যদের চেয়ে সেরা প্রতীয়মান করার জন্য প্রত্যেক ধর্মই নানা ধরনের আকর্ষণীয় মুজেজা সংবলিত গল্পের আশ্রয় নেয়। এই সহজ সত্যটা বোধহয় পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই না জেনে ইন্তেকাল করেন।

আমিও হয়ত সে পথেই যাচ্ছিলাম। ক্যাডেট কলেজে কোনো এক শুক্রবার আমাদের মসজিদের ঈমাম, আবেগঘন ওয়াজ করতে করতে এক গল্প শোনালেন। সে গল্পে ঈশ্বরের অসীম কুদরতে বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির পাতে থাকা ভাজা মাছ হঠাৎ করে অভাজা মাছ হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে থর্পের মতো সাঁতার কেটে হারিয়ে যায় গভীর জলে। সমসাময়িক আর আট-দশটা ছেলের মতই বাংলাদেশি মুসলমান পরিবারে বডো হবার ফলে তখনও আমি নিজেকে ধার্মিক ভাবতাম, যদিও পালন করতাম না সেভাবে। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পারলে ‘মানত” করেছিলাম সেখানে ছয় বছর এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ দেবো না। সেটা সম্ভব হয় নি। যদিও কোনো ঝামেলায়পড়লে আর রহমান সুরা এগারো বার পড়ে আল্লাহর নিকট ঝামেলা মুক্তির আবেদন করতাম এ আশায় যে এগারো বার ‘সুরা আর রহমান’ পড়লে যেকোনো ধরনের ঝামেলা থেকে প্যারোলে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টা একেবারেই অব্যর্থ। এছাড়া পাশের বাড়ির কোনো মেয়েকে ভালো লাগলেও ‘আর রহমান এবং সুরা ইয়াসিনের আশ্রয় নিতাম, কারণ সুরাগুলো যথাক্রমে এগারোবার ও তিনবার পড়লে, মনোবাসনা পূরণ হতে বাধ্য। কিন্তু ভাজা মাছের জ্যান্ত হয়ে যাওয়া বিশ্বাস করা অসম্ভব। মনে মনে ভাবলাম- যদি সত্যিকার অর্থেই এমন ঘটনা কোরান হাদিসে থেকে থাকে, তবুও আমি ভাজা মাছের অভাজা হয়ে যাওয়া বিশ্বাস করতে পারব না। ধন্যবাদ।

কিন্তু তাতে করে কোনো কিছুই বদলায় না। কোরান মহাসত্য গ্রন্থ এবং আল্লাহ এক এবং তিনি শুধু আমাদের দলে। এমন করে কেটে যেতে থাকা সময়ে একদিন কাঁটাবন মসজিদের লাইব্রেরিতে একটা বই দেখলাম। ইসলাম ও বিজ্ঞান বিষয়ে জনৈক ‘আহমদ দীদাত’ এর লেখা। সে বইয়ে ‘মিরাকল নাইন্টিন” নিয়ে একটি অধ্যায় ছিল- যা পড়ে আল্লাহ এবং বিশেষ করে কোরান যে অলৌকিক গ্রন্থ সে ব্যাপারে একেবারে নিঃসংশয় হয়ে গেলাম। ‘রাস্তা ঠিকাছে, এখন শুধু ঠিকঠাক ড্রাইভ করে বেহেশতে পৌঁছাতে হবে, তারপরইইইই …”। তখন বাংলা উইকিপিডিয়াতে সময় পেলেই নতুন নতুন নিবন্ধ তৈরি করি। বইটা পড়ার পর কোরানের সাংখ্যিক মাহাত্ম্য নিয়ে একটা নিবন্ধ খুলে ফেললাম। এই নিবন্ধই পরবর্তীতে জীবন বদলে দিয়েছিল, কীভাবে, সেটাতেই আসছি।

সচলায়তন ব্লগে অভিজিৎ রায় ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ নামে এক পোস্ট দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের মে মাসে। ধর্মসংক্রান্ত অনেক বিষয়েই আমার সংশয় ছিল, ছিল সেই সংশয় মনের এক কোণে ফেলে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টাও। ধর্ম পালন না করলেও সমাজের অন্ধকার শিক্ষায় তখনও। মানতাম ইসলাম একমাত্র ধর্ম, মানতাম আল্লাহ বলে আসলেই একজন আছে, মানতাম তিনি বই লিখে সেটা গোপনে একজনের কানেকানে বলে বিশ্বমানবতাকে পথ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু অভিজিৎ রাযের ‘বিজ্ঞানময় কিতাব” লেখাটা পড়ে সেদিন সবকিছু তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ল। অনুভব করলাম এতোদিন যা জানতাম সব মিথ্যা, যে গ্রন্থকে বিজ্ঞানময় ভাবতাম সেটা মোটেও বিজ্ঞানময় নয়, বিজ্ঞানময়তার উদাহরণগুলো ভক্তদের বানানো মিথ্যা কথা। এভাবে শুধু মিথ্যা বলে একটা গ্রন্থকে এভাবে অলৌকিক করে ফেলা সম্ভব বুঝতে পারলাম। অবশ্য বিজ্ঞানময় কিতাব লেখাতে অভিদা মিরাকল নাইন্টিনের উল্লেখ করেননি। বুঝে গেলাম এটাও মিথ্যা দাবিই হবে। ইন্টারনেটে খুঁজলাম, অভিদার কাছে জানতে চাইলাম এবং দেখলাম আসলেই তাই। সেই থেকে শুরু আমার ধর্ম সংক্রান্ত সংশয়ী চিন্তা। যত গভীরে যেতে থাকলাম, যত পড়তে থাকলাম, তত দেখলাম শৈশব থেকে লালন করা সংস্কারগুলো তাসের ঘরের মতো ভেঙে যাচ্ছে। হাজার বছর ধরে চলা ধর্মীয় ভণ্ডামি আর মিথ্যাচারের মুখোশ ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকল আমার কাছে। শিক্ষানবিস তখন বিজ্ঞান এবং মাঝে মাঝে ধর্ম বিজ্ঞান, সংশয়বাদ নিয়ে লিখত। আমি সেগুলো পড়তাম, আর পড়তাম মুক্তমনার বিশাল আর্কাইভ। নিজেও তখন একটু একটু ব্লগিং শুরু করেছি যদিও সেটা নিতান্ত- ‘ভাত খেতে যাচ্ছি, খেয়ে এসে ঘুমাবো’ টাইপের কথাবার্তা। এভাবেই চলছিল দিন। হঠাৎ একদিন মনে হলো, একটা পাপ মোচন করা দরকার। উইকিতে মিরাকল নাইন্টিন নিবন্ধের পাপ মোচন। চিন্তা পর্যন্তই। এরপর হঠাৎ একদিন ক্যাডেট কলেজ ব্লগে মিরাকল নাইন্টিন নিয়ে পোস্ট আসলো। সেখানে বর্ণনা করা হয়েছে কোরানের সব কিছুতে আছে মহান উনিশ। আল্লাহর অস্তিত্বের বাস্তব প্রমাণ একেবারে। আমি গা ঝাড়া। দিয়ে বসলাম। মিরাকল নাইন্টিনের ভণ্ডামি তুলে ধরে একটা ব্লগ লিখলাম। এই লেখা যেহেতু আমার পাপমোচন লেখা ছিল তাই এসব বিষয় নিয়ে পুনরায় আর কোনো লেখার আগ্রহ ছিলোনা। কয়েকমাস পরে, অভিদা আমাকে একটা মেইল দিলেন, মেইলের বিষয়বস্তু উনি নেট খুঁজে আমার মিরাকল নাইন্টিন লেখাটা পড়েছেন, আমি যেন মুক্তমনায় নিবন্ধন করে লেখাটা সেখানেও রাখি। আরেকবার মুগ্ধ হবার পালা। কারণ তখন অভিজিৎ রায় এবং বন্যা আহমেদের লেখা বই পড়ে, মুক্তমনার লেখা পড়ে তাদের চিনেছি এবং তারা দুইজনেই ছিলেন আমার কাছে বিশাল উচ্চতার একজন মানুষ। সেই অভিদা আমাকে মেইল করেছেন। তারপরই থেকেই মুক্তমনায় নিবন্ধন করে ধীরে ধীরে সেখানে লেখালেখি শুরু করি মূলত বিবর্তন, জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে।

২০০৯ এর ডিসেম্বরের দিকে অভিদা আর বন্যাপা ঢাকায় এসেছিলেন। অভিজিৎ রায় আগে থেকেই বলেছিলেন আগমনের খবর। উনারা ঢাকা আসা মাত্রই ছুটে গেলাম বন্ধু শিক্ষানবিস সহ। সুটকেস ভর্তি বই এবং চকলেট নিয়ে এসেছিলেন বন্যাপা আর অভিদা। আমরা নিজেদের বই ভাগাভাগি করে, সে বইয়ের গন্ধ শুকতে শুকতে আর চকলেট খেতে খেতে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনে তরুণদের ভূমিকা এবং করণীয় নামক বিষয় নিয়ে বিশাল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছিলাম। একেবারে শেষ মুহূর্তে অভিদা কোন চিপা থেকে যেন ভিক্টর স্টেংগরের ‘নিউ এইথিজম” বইটা বের করে শিক্ষানবিসের হাতে দিয়ে বললেন- পড়তে। অনেক কিছু জানা যাবে। শিক্ষানবিসের আগে সে বই আমি পড়া শুরু করলাম। ‘অনেক কিছু জানার জন্য” না বরঞ্চ বইয়ের শুরুতে INGERSOLL’S VOW নামে ইঙ্গারসল সাহেবের একটি বক্তৃতার কিয়দংশ পড়ে মুগ্ধ হবার কারণে। অবিশ্বাসের দর্শন নিয়ে তখন আমার অনেক আগ্রহ, যা পাই তাই খাই অবস্থা। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে প্রায় একবছর পর অভিদা চিঠি দিয়ে বললেন- অবিশ্বাসের দর্শন নিয়ে একটা বই আমরা দুইজন মিলে লিখতে পারি কিনা। অভিদার সাথে লেখালেখির সূচনা হলো আমার। ২০১১ সালে শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত হয় ‘অবিশ্বাসের দর্শন। বইটি সম্পাদনা কাকে দিয়ে করানো হবে সেটা ঠিক করতে আমার কিংবা অভিদার এক মুহূর্তও চিন্তা করতে হয় নি। ছিলেন অকালে হারিয়ে ফেলা অনন্ত বিজয় দাশ। অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি সম্পর্কে অনন্ত দা ফ্ল্যাপে লিখেছিলেন,

‘আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ তত্ব-তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে লেখা অবিশ্বাসের দর্শন বইটি বাংলাভাষী ঈশ্বরবিশ্বাসী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেযবাদী, নিরীশ্বরবাদী কিংবা মানবতাবাদী এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক সবার মনের খোরাক জাগাবে। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে আগামী দিনের জাত-প্রথা-ধর্ম বর্ণ-শ্রেণিবৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষের গণজোয়ারকে এই বই প্রেরণা জোগাবে।

এলাম আমরা কোথা থেকে, কোথায়ই বা যাচ্ছি আমরা, এই অনন্ত মহাবিশ্বের সূচনা হলো কীভাবে, এর শেষই বা কোথায়, এই মহাবিশ্ব তৈরি বা চালানোর পেছনে কি আছেন কোনো অপার্থিব সত্ত্বা, তিনি কি আমাদের প্রার্থনা শোনেন- এ প্রশ্নগুলো শতাব্দী-প্রাচীন চিরচেনা প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো নতুন নয়। নানা ধরনের উত্তর সমৃদ্ধ বইও বাংলা ভাষায় কম লেখা হয় নি। তবে এ ধরনের অধিকাংশ প্রচলিত বইয়ে যুক্তির চেয়ে স্থান পেয়েছে অন্ধবিশ্বাস, বিজ্ঞানের বদলে স্থান পেয়েছে কূপমন্ডুকতা। অবিশ্বাসের দর্শন বইটিতে চিরায়ত গড়ালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে আমরা বরং প্রশ্ন করেছি, পাঠকদেরও অনুরোধ করেছি ‘ক্ষতবিক্ষত হতে প্রশ্নের পাথরে। সেই সাথে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেছিলাম এই অন্তিম প্রশ্নগুলোর রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো। এই চিরচেনা প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে বিজ্ঞানের অর্জন স্থান পাওয়ায় তা চুয়াডাঙ্গা থেকে সুদূর আইসল্যান্ড প্রবাসী বাংলাভাষী বহু বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের মনে আলোড়ন জাগিয়েছে। বইটি প্রকাশের পর থেকে অসংখ্য মানুষ ফোন, ইমেইল, ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারে তাদের মতামত জানিয়েছেন। বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তা, সংশয়বাদ এবং যুক্তিবাদ নিয়ে বাংলায় প্রকাশিত যে সমস্ত বই বাজারে আছে, তার মধ্যেও অগ্রগণ্য বই হিসেবে পাঠকেরা অবিশ্বাসের দর্শনকে স্থান দিয়েছেন। ২০১২ সালে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। তারপর দীর্ঘ বিরতি। ২০১৩ সালেই সব কপি শেষ হয়ে গেলো দ্বিতীয় সংস্করণের। ২০১৪ সালে অভিদার সাথে মিলে বইটি আবার ঠিকঠাক করে দেওয়া হলো জাগৃতিকে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য। ফয়সাল আরেফীন দীপন ভাই বইটা নিষ্ঠার সাথে প্রকাশ করেছিলেন, এবং বিশ্বাসের ভাইরাস ও অবিশ্বাসের দর্শন প্রকাশের মাধ্যমে হয়ে গিয়েছিলেন অপরাধী। বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত মৌলবাদী জঙ্গীরা তাকে হত্যা করেছিল চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তার অফিসে ঢুকে।

২০০৯ সালে অভিজিৎ দা ঢাকায় এসে ‘সমকামিতা’ বইটির জন্য বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। পরের বছর শুদ্ধস্বর বইটি প্রকাশ করে। সচলায়তনের কল্যাণে টুটুল ভাইযের সাথে আমার আগেই পরিচয় ছিল। অভিদাকেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম তার বইগুলো প্রকাশে টুটুল ভাইযের আগ্রহ দেখে। সমকামিতার পরে অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১), বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের আলোকে লেখা অভিদার ‘ভালোবাসা কারে ক্য’ ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় শুদ্ধস্বর থেকে। সেবার অভিদা ঢাকায় এসেছিলেন লেখক হিসেবে প্রথমবারের মতো বইমেলা পালন করতে, একা। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করি। অভিদা যতদিন ছিলেন, প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো, বইমেলায় ঘোরাঘুরি, আজ্ঞা, খাওয়াদাওয়া, রাতের বেলা কার্জন হলের পুকুর পাড়ে বিশ্রাম নেওয়া, বাইকে করে অভিদাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া। মনে আছে ২০১২ সালের বইমেলা থেকে অভিজিৎ দা বন্যাপাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন- বন্যা তুমি বিশ্বাস করবানা কত মানুষ আমাদের লেখা পড়ে, কতো আগ্রহী মানুষ ঘিরে ধরে রেখেছে আমাকে মেলা জুড়ে, তোমাকে মিস করছি, এরপর আমি বইমেলায় আসলে তোমাকে আমার সাথে আসতেই হবে।

২০১৫ এ বন্যাপাকে সাথে নিয়ে আসবেন বলে গিয়েছিলেন অভিদা। আসলেন তিনি। এবার বইমেলায় তার নতুন দু’টো বই, শুদ্ধস্বর থেকে প্রয়াত গণিত অধ্যাপক মীজান রহমানের সাথে যৌথভাবে লেখা ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব এবং অবসর থেকে ‘ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’ প্রকাশিত হলো। এরসাথে যুক্ত হলো, অবিশ্বাসের দর্শনের জাগৃতি সংস্করণ এবং বিশ্বাসের ভাইরাসের দ্বিতীয় সংস্করণ। শূন্য থেকে মহাবিশ্ব বইটার সম্পাদনায় জড়িত ছিলাম। বইয়ের সম্পর্কে মন্তব্য জানাতে বলেছিলেন অভিদা। পাঠিয়েছিলাম তাকে। আরও কয়েকজনের মতামতের সাথে আমার মন্তব্যটাও বইয়ে যুক্ত করেছিলেন তিনি–

মীজান রহমান এবং অভিজিৎ রায় লিখিত ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব বইটি গণিতের শূন্যের মূৰ্ছনার ঘোড়ায় চড়িযে পাঠককে নিয়ে যাবে শূন্য থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সম্ভাবনা নিয়ে বর্তমানের কালের সেরা বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিকতম ধারনার এক বৈজ্ঞানিক সঙ্গীতানুষ্ঠানে। সৃষ্টির সূচনা ধর্ম এবং বিজ্ঞান দুটি প্রতিষ্ঠানেরই আগ্রহের বিষয় হলেও দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে পাওযা উত্তর সম্পূর্ণ আলাদা। আধুনিক বিজ্ঞান থেকে পাওয়া ফলাফল থেকে আমরা আজ বুঝতে পারছি মহা পরাক্রমশালী কোনো সম্বার হাতে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়নি। মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে শূন্য থেকে, সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে। সভ্যতার এ পর্যায়ে এসে বিজ্ঞান তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে। এই বইটি তাই বাংলাভাষী বিজ্ঞান ও দর্শনে কৌতূহলী পাঠকের অবশ্যপাঠ্য বই।

২০১৪ সালে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে বিশ্বাসের ভাইরাস বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই মৌলবাদী অপশক্তিরা অভিজিৎ রায়কে রুটিন করে হত্যা করার হুমকি দিতে থাকে। প্রতিদিন একজন করে মানুষকে ‘নাস্তিক’ প্রমাণ শেষে তাকে হত্যা করার আহবান জানিয়ে ফারাবী নামক এক বিকৃত মস্তিষ্কের অমানুষ ততদিনে বাংলাদেশের সামাজিক নেটওয়ার্কের পরিচিত মুখ। নিজেকে কখনও নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘হিজবুত তাহরির’, কখনও ‘শিবিরের অনুসারী বলে প্রচার করা ফারাবীর ব্লগে আগমন ঘটেছিল মূলত সহব্লগার মেয়েদের বিরক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। তার প্রথম পোস্টও ছিল অজানা অচেনা মেয়েদের বিয়ে করার অনুরোধ জানিয়ে’। মূলত বিভিন্ন ভুয়া আইডি খুলে ফেসবুক এবং ব্লগে মেয়েদের অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাব দেওয়াই ছিল তার কাজ। ফেসবুকে আপনারা যারা নিয়মিত, তারা খেয়াল করে দেখবেন, বাংলা ভাষায় ফেসবুকে যে সকল নারী বিদ্বেষী, অশ্লীল, যৌন সুড়সুড়ির পাতা রয়েছে তাদের মধ্যে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। এরা ইন্টারনেট থেকে নারীদের বিভিন্ন ছবি সংগ্রহ করে সেটা তাদের অনুসারীদের সামনে উপস্থাপন করে এবং একই সঙ্গে আরও একটা বিষয়ে তারা সমান কম্পাঙ্কে পোস্ট করে। কী সেই বিষয়টা? ধর্ম। যেহেতু বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলাম, তাই এই অশ্লীল পাতাগুলোর কাছেও ধর্ম বলতে কেবল ইসলাম। ফারাবী যেন এই মানুষগুলোরই প্রতিনিধি। যার একমাত্র কাজ ছিল নারীদের উত্যক্ত করা এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে পোস্ট দেওয়া। মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে নিজ বাসার সামনে খুন হওয়া আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজার ইমামকে হত্যা করার হুমকি দিয়ে গ্রেফতার হয় ফারাবী। জামিনে বের হয়ে আসার পর থেকে নিজেকে শোধরানো তো দূরের কথা, উল্টো ব্যাপক উদ্যমে সে ইসলাম ধর্মকে নিজের মতো ব্যাখ্যা করে সন্ত্রাস কায়েমের আহবান জানানো শুরু করে। সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘যুক্তি’ পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত বিজয় দাশ সিলেটে নিজ বাসার সামনে নিহত হন মান্নান রাহী নামক ফারাবীর এক ঘনিষ্ঠ সহচরের হাতে। এর আগে তিনি ‘ফারাবীর ফাতরামি’ লেখায় এ প্রসঙ্গে বলে গিয়েছিলেন

এরপর ফারাবী আবির্ভূত হয় ইসলামের খেদমতগার হিসেবে। হেফাজতকারী হিসেবে। আমাদের এখানে একটা কথা প্রচলিত আছে, এরশাদ যদি আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির রক্ষক হয় তবে এই রাজনীতিকে ধর্ষণ করার জন্য বাহির থেকে কোনো শত্রু আসার প্রয়োজন নেই, তেমন ফারাবীর মতো লুইচ্চা যদি হয়ে যায় ইসলামের খেদমতগার, তবে ইসলামের মুখে চুনকালি মাখাতে কোনো ইসলামবিরোধী, ইসলামবিদ্বেষীর প্রয়োজন নাই।

ইমামকে হত্যার হুমকির অভিযোগে ফারাবীকে আটক করা হলেও সে অস্থায়ী জামিনে জেলহাজত থেকে বের হয়ে আরও বেশি উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ফেসবুকের অসংখ্য ভুয়া আইডি নিয়ে। আল্লাহ ও রসুলকে তার ভাষায়- যারা অপমান করে, তাদের হত্যা করা জায়েজ। এই ফতোয়া দিয়ে সে একের পর এক শুভবুদ্ধির লেখক, ব্লগার, অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের হত্যার হুমকি প্রদান শুরু করে।

ফারাবীর ভাষ্যমতে–

ইসলাম অর্থ শান্তি নয়, ইসলাম অর্থ হল আত্মসমর্পণ। ইসলামের ভিতরে জিহাদ, কিতাল সবই আছে। আল্লাহ-রসুলকে যারা ঠাণ্ডা মাথায় গালিগালাজ করবে আমরা তাদেরকে হত্যা করব এতে লুকোচুরির কিছু নাই।

২০১৪ সালে বিশ্বাসের ভাইরাস বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই মৌলবাদী অপশক্তিরা অভিজিৎ রায়কে রুটিন করে হত্যা করার হুমকি দিতে থাকে। উনি দেশের বাইরে থাকেন বিধায়, তাঁর বই বিক্রির দায়ে বাংলাদেশের অনলাইন বই কেনার সাইট ‘রকমারি ডটকম’-এর অফিসের ঠিকানা প্রদান করে পোস্ট দেয় ফারাবী নামক বিকৃত মস্তিষ্কের অমানুষটি। বাংলাদেশে নাস্তিকতা ছড়ানোর অপরাধে সে তার অনুসারীদের রকমারির অফিস আক্রমণের আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে স্বত্বাধিকারীর প্রোফাইল উল্লেখ করে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর বাংলাদেশের শুভবুদ্ধির সব মানুষকে অবাক করে দিয়ে রকমারির স্বত্বাধিকারী মাহমুদুল হাসান সোহাগ তার স্ট্যাটাসে অভিজিৎ রায়সহ অন্যান্য লেখকদের বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার বই বিক্রি করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন। কিন্তু তারপরও ফারাবী সন্তুষ্ট না হওয়ায় রকমারি ডটকম তার দেওয়া লিস্ট ধরে নিমেষেই সকল বই তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করে বিক্রি বন্ধের ঘোষণা দেয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ধরে এই ঘটনার সময় থেকেই আমি রকমারি ডটকমের সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ করি, ফারাবীর ভয়ে ভীত হওয়ার বদলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। আমাদের সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে ওরা মৌলবাদী তোষণকেই তাদের নীতি হিসেবে গ্রহণ করে এবং নাস্তিকদের বই (পড়ুন। বিজ্ঞান, যুক্তিবাদী এবং প্রগতিশীল বই) বিক্রি চিরতরে বন্ধ করে দেয়। অবশ্য বন্ধ করার আগে নিজেদের মেরুদণ্ডহীনতা ঢাকতে তারা জানিয়ে দেয়, ফারাবীর হুমকির আগে থেকেই তারা এ ধরনের বই সরিয়ে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং সে উদ্যোগের কারণেই এখন বইগুলো চিরতরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অপকর্মের হোতা ফারাবীর বিরুদ্ধে কোনো ধরনের আইনি ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেনি।

মৌলবাদীদের হত্যার পরোয়ানা সত্ত্বেও প্রিয় বাংলাদেশে এসেছিলেন অভিজিৎ রায়। এসেছিলেন অসুস্থ মা কে দেখতে, অসুস্থ বাবাকে দেখতে, বইমেলায় প্রকাশিত নতুন নতুন বইয়ের গন্ধ শুকতে, বাংলাদেশের বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে। তিনি এসেছিলেন আমাদের অতিথি হয়ে। তিনি জানতেন না, তার প্রিয় বাংলাদেশ বদলে গেছে। ২৩ তারিখ রাতে অভিদাকে মনে করিয়ে দিলাম, হুমকিগুলোকে হালকাভাবে না দেখতে। উনি হেসে উড়িয়ে দিলেন। আমি লেখক মানুষ, আমাকে কেন মারবে?

ফেব্রুয়ারির ছাব্বিশ তারিখ রাত আটটা তেইশ মিনিটে অভিদার কাছ থেকে শেষ এসএমএসটা আসে আমার ফোনে। ‘রায়হান, তুমি কই?’। আমি আর সামিয়া তখন বাসার বাইরে, বইমেলা থেকে অনেক দূরে, বাজার করছি, পরের দিন অভিদা আর বন্যাপা আমাদের বাসায় আসবেন! দেশে আসার পর থেকেই বন্যাপা বলছিলেন, মুক্তমনা ব্লগের যারা দেশে আছে তাদেরকে কোথাও একত্র করতে, তিনি সবাইকে খাওয়াতে চান। আমরা তখন একটা নতুন বাসায় উঠেছি, পাঁচতলার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই আধখানা ছাদ, আর আধখানা বাসা। ইচ্ছে ছিল আমরা আট-দশজন মিলে সারাদিন আড্ডাবাজিতে কাটাব, বন্যাপার সাথে মিলে অভিদাকে পঁচাবো, তারপর অভিদার সাথে মিলে বন্যাপাকে, ক্ষুধা পেলে পেট সাঁটিযে অভিদার প্রিয় বিরিয়ানি খাব। ফেব্রুয়ারির চব্বিশ তারিখে আমি আর সামিয়া প্রথম জানতে পারি আমাদের মাতা-পিতা হবার সম্ভাবনার কথা, আমাদের সোফির আগমনের কথা। খবরটা শুনে আমি সামিয়াকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলাম অনেকক্ষণ এবং আমরা দুইজনেই একই সাথে ঠিক করি, বাবা-মা-ভাই-বোনদের পর পরবর্তী পরিবারের সদস্য হিসেবে জানাব বন্যাপা আর অভিদাকে, ফেব্রুয়ারির সাতাশ তারিখে। পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও ছাব্বিশ তারিখের পরের সেই দিনটা আমার জীবনে আর আসে নি। না ঘটা সেই দিনটা নিয়ে আমি আজও ভাবি, চোখের সামনে নানাভাবে চিত্রায়িত হয় দিনটির প্রতিটি ক্ষণ। ফারাবীতে পরিপূর্ণ এইদেশে আমরা পেয়েছিলাম অভিজিৎ রায়কে, অনন্ত বিজয় দাশ, নীল নীল, ফয়সাল আরেফীন দীপন, রাজীব হায়দারকে। তাঁরা আলো ছড়িয়েছেন, চিন্তার দাসত্ব থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছেন মানুষকে। অভিজিতের আলোকে গ্রাস করতে অন্ধকার হামলা করেছিল পেছন থেকে। অভিজিতের সেই আলোর মশাল লক্ষ অভিজিতের তুলে ধরতে দেরি হয় নি। এক অভিজিৎ থেকে বাংলাদেশে জন্ম নিচ্ছে লক্ষ অভিজিৎ। অভিজিৎ রাযের বই প্রকাশের জন্য জীবন দিয়েছেন ফয়সাল আরেফীন দীপন, মৌলবাদীদের চাপাতির আক্রমণে প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন শুদ্ধস্বর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল। জীবন দিয়েছেন বইটির সম্পাদক ‘অনন্ত বিজয় দাশ’। মৌলবাদীরা আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল, মেডিক্যাল প্রযুক্তিবিদ্যা নিয়ে গবেষণা বন্ধ রেখে, দেশের জন্য কাজ করা বন্ধ রেখে আমাকে দেশ ছেড়ে হতে হয়েছে ‘শরণার্থী’।

আবার আসলো ফেব্রুয়ারি। মহাবিশ্ব সমান শূন্যতা আর বিষাদ নিয়ে। শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল নিজে থেকে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এই বই প্রকাশের যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন তাতে আসলেই প্রমানিত হয় তাঁর প্রতিষ্ঠিত শুদ্ধস্বর আসলেই ‘মন যোগাতে নয়, মন জাগাতে’ কাজ করে শত বাধা-বিপত্তি-প্রতিকূলতা সত্বেও। বইটির ভেতরের অধ্যায়গুলো অভিজিৎ রায়, অনন্ত বিজয় দাশ, ফয়সাল আরেফীন দীপন যেভাবে রেখে গিয়েছিলেন সেভাবেই রইল। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক প্রকাশকদের মেলা শুরু আগেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন। ‘উস্কানিমূলক বই’ প্রকাশ না করতে। জানি না, উনি অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাসের ভাইরাস বইগুলোর কথা বুঝিযেছেন নাকি বুঝিয়েছেন হিংসা-বিদ্বেষ-হানানাহিতে পরিপূর্ণ ধর্মগ্রন্থগুলোর কথা। জানি না বলা ঠিক না, আসলে জানি।

ঈঙ্গারসলের সেই প্রতিজ্ঞার কথা আমি ভুলে যাই নি, ভুলে যাননি অভিজিৎ রায়ও। সেই প্রতিজ্ঞা দিয়েই শেষ হোক, অবিশ্বাসের দর্শনের চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা। আমাদের জীবন দীপান্বিত হোক, মুক্ত হোক বিশ্বাসের ভাইরাস থেকে।

যেদিন নিশ্চিতভাবে বুঝে গেলাম আমার চারপাশের সবকিছুই প্রাকৃতিক, সকল দেবতা, অপদেবতা কিংবা ঈশ্বর মানুষের সৃষ্ট পৌরাণিক চরিত্র ব্যতীত কিছুই নন, সেদিন সত্যিকারের স্বাধীনতার তীব্র আনন্দে মাতোয়ারা হয়েছিল আমার মন, শরীরের প্রতিটি কণা, রক্তবিন্দু, ইন্দ্রিয়। আমাকে সীমাবদ্ধ করে রাখা চার দোল টুকরো টুকরো হয়ে মিশে গেলো ধুলোয়, আলোর স্রোতে আলোকিত হয়ে গেলো আমার অন্ধকূপের প্রতিটি কোণ। সেদিন থেকে আমি কারও চাকর, সেবক বা বান্দা নই। এই পৃথিবীতে আমার কোনো মনিব নেই, আমার কোনো মনিব নেই এই সীমাহীন মহাবিশ্বেও।

আমি স্বাধীন, মুক্ত চিন্তা করতে, চিন্তারাজি প্রকাশে, আদর্শ নির্ধারণে, ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গী করে নিজের মতো বাঁচতে। আমি স্বাধীন আমার মানসিক এবং শারীরিক ক্ষমতা ব্যবহারে, প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে কল্পনার ডানা মেলে উড়ে যেতে, নিজের মতো স্বপ্ন দেখতে, আশা করতে। আমি স্বাধীন— নিজের মতো ভাবতে। আমি স্বাধীন নির্দয়, উগ্র ধর্মকে অস্বীকার করতে। আমি স্বাধীন- অসভ্য, মূর্খের ‘অলৌকিক গ্রন্থসমূহ’ এবং এগুলোকে পুঁজি করে ঘটা অসংখ্য নিষ্ঠুরতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। আমি স্বাধীন অসংখ্য মহাজাগতিক মিথ্যা থেকে, স্বাধীন সীমাহীন শাস্তির ভীতি থেকে, আমি স্বাধীন ডানাওয়ালা ফেরেশতা থেকে, শয়তান থেকে, জ্বিন-ভূত এবং ঈশ্বর থেকে। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি স্বাধীন। আমার চিন্তার রাজ্যে সেদিন থেকে নেই আর কোনো নিষিদ্ধ জায়গা, নেই কোনো অশরীরী শৃঙ্খল যা বেঁধে রাখে আমার অবয়বকে, আমাকে রক্তাক্ত করার জন্য নেই কোনো অলৌকিক চাবুক, আমার মাংসের জন্য নেই কোনো আগুন। আমার মাঝে নেই ভয, আমার মাঝে নেই অন্যের দেখানো পথে হাঁটার দায়বদ্ধতা, আমার প্রয়োজন নেই কারও সামনে অবনত হওয়া, কাউকে পূজা করা, আমার প্রয়োজন নেই মিথ্যে কথা বলারও। আমি মুক্ত। ভয়-ভীতি, মেরুদণ্ডহীনতা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সেদিন আমি প্রথমবারের মতো উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, জগতকে নতুন করে দেখার, ভাবার চেতনা নিয়ে।

আমার অন্তর সেদিন কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিল। আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করেছিলাম ইতিহাসের সেই সব নায়কদের প্রতি, মানুষের প্রতি যারা নিজের জীবন বিপন্ন করেছিল, বিসর্জন দিয়েছিল মানুষের হাত এবং মস্তিষ্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে। আমি ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম পৃথিবীর আলোকিত সকল সন্তানদের, যাদের কেউ আত্মাহুতি দিয়েছিল মূর্খের সাথে যুদ্ধে, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল অন্ধ প্রকোষ্ঠে আবদ্ধাবস্থায়, যাদের মাংস পুড়েছিল ধর্মান্ধদের আগুনে। আলোকিত সেইসব সাহসী মানুষেরা, যারা এসেছিল পৃথিবীর আনাচে-কানাচে, যাদের চিন্তায় কর্মে স্বাধীনতা পেয়েছে মানুষের সন্তানেরা। অতঃপর আমি নীচু হলাম, যে আলোর মশাল তারা জ্বালিয়েছিলেন সে আলোর মশাল তুলে নিলাম নিজের হাতে, উঁচু করে তুলে ধরলাম সেটা, এ আলো নিশ্চয়ই একদিন জ্য করবে সকল অন্ধকার।

রায়হান আবীর
কানাডা
ফেব্রুয়ারি ১, ২০১৬

.

জাগৃতি সংস্করণের ভূমিকা

সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘যুক্তি’ পত্রিকার সম্পাদক অনন্ত বিজয়। দশ ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি সম্পর্কে ফ্ল্যাপে লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞানের সর্বশেষ তত্ব-তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে লেখা অবিশ্বাসের দর্শন বইটি বাংলাভাষী ঈশ্বরবিশ্বাসী থেকে শুরু করে সংশয়বাদী, অজ্ঞেয়বাদী, নিরীশ্বরবাদী কিংবা মানবতাবাদী এবং সর্বোপরি বিজ্ঞানমনস্ক সবার মনের খোরাক জাগাবে। ধর্মান্ধতা এবং কুসংস্কার মুক্তির আন্দোলনের মাধ্যমে আগামী দিনের জাত-প্রথা-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেনিবৈষম্যমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষের গণজোয়ারকে এই বই প্রেরণা জোগাবে। সে প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে আমরা জানিনা, তবে বইটি যে বহু পাঠকের হৃদয়ে একটি স্থায়ী আসন তৈরি করে ফেলেছে সেটি বলাই বাহুল্য। ঈশ্বরে বিশ্বাস এবং প্রথাগত ধর্ম নিয়ে যৌক্তিক আলোচনা সমৃদ্ধ ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি শুদ্ধস্বর থেকে প্রথমে প্রকাশিত হয় ২০১১ সালের ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র প্রথম দিনে। প্রথম সংস্করণের যে কয়টি কপি ছাপা হয় তা ২০১১ সালের মেলার প্রথম দশ দিনেই শেষ হয়ে যায়। বইয়ের চাহিদার কারণে মেলার শেষ দিকে দ্বিতীয় দফায় আবার ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বইটির প্রথম সংস্করণের অতিমূল্যের কারণে অনেক পাঠকের কাছে বইটি পৌঁছাতে পারছে না এই বিবেচনায় ২০১২ সালে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় পেপারব্যাকে। মাত্র এক বছরে পেপারব্যাকে ছাপানো সহস্রাধিক কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটি বাংলাভাষী শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে পৌঁছুবে এমন একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা লেখকদের মনে ছিলো না-তা নয়, কিন্তু বইটি সাধারণ পাঠকদের মাঝেও যে ভাবে আলোড়ন তৈরি করেছে তা ছিলো সত্যিই অপ্রত্যাশিত। অনেক পাঠক বইটি পড়ে জানিয়েছিলেন, প্রয়াত ড. হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটির পর ঈশ্বর-ধর্ম সংক্রান্ত এতো গভীর আলোচনাসমৃদ্ধ বই বাংলা ভাষায় আর প্রকাশিত হয় নি। অসাধারণ কাব্যিক ভাষায় লেখা ‘আমার অবিশ্বাস’ বইটি এ বইয়ের দু’লেখকেরই প্রিয় বইয়ের তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে। ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটিকে সে বইয়ের সাথে তুলনা আমাদের জন্য বিব্রতকর, কিন্তু সেই সাথে অনেক আনন্দ এবং গর্বেরও।

এলাম আমরা কোথা থেকে, কোথায়ই বা যাচ্ছি আমরা, এই অনন্ত মহাবিশ্বের সূচনা হল কীভাবে, এর শেষই বা কোথায়, এই মহাবিশ্ব তৈরি বা চালানোর পেছনে কী আছেন কোনো অপার্থিব। সত্ত্বা?, তিনি কি আমাদের প্রার্থনা শোনেন- এ প্রশ্নগুলো শতাব্দী প্রাচীন চিরচেনা প্রশ্ন। প্রশ্নগুলো নতুন নয়। নানা ধরণের উত্তর সমৃদ্ধ বইও বাংলা ভাষায় কম লেখা হয় নি। তবে এ ধরণের অধিকাংশ প্রচলিত বইয়ে যুক্তির চেয়ে স্থান পেয়েছে অন্ধবিশ্বাস, বিজ্ঞানের বদলে স্থান পেয়েছে কূপমণ্ডুকতা। অবিশ্বাসের দর্শন বইটিতে আমরা সেই পুরনো ধারা অনুসরণ করিনি। চিরায়ত গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে আমরা বরং প্রশ্ন করেছি, পাঠকদেরও অনুরোধ করেছি ‘ক্ষতবিক্ষত হতে প্রশ্নের পাথরে’। সেই সাথে নির্মোহভাবে উপস্থাপন করেছি এই অন্তিম প্রশ্নগুলোর রহস্য উন্মোচনে বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক অর্জনগুলো। এই চিরচেনা প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে বিজ্ঞানের অর্জন স্থান পাওয়ায় তা চুয়াডাঙ্গা থেকে সুদূর আইসল্যান্ড প্রবাসী বাংলাভাষী বহু বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের মনে আলোড়ন জাগিয়েছে। বইটি প্রকাশের পর থেকে অসংখ্য মানুষ ফোন, ইমেইল, ব্লগ, ফেসবুক, টুইটারে তাদের মতামত জানিয়েছেন। বিজ্ঞান, মুক্তচিন্তা, সংশ্যবাদ এবং যুক্তিবাদ নিয়ে বাংলায় প্রকাশিত যে সমস্ত বই বাজারে আছে, তার মধ্যেও অগ্রগণ্য বই হিসেবে পাঠকেরা অবিশ্বাসের দর্শনকে স্থান দিয়েছেন। কোনো ধরনের প্রচারণা ব্যতীত ফেসবুকে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ বইটিকে পছন্দ করেছেন, অনেকেই রেখেছেন তাদের প্রিয় বইয়ের তালিকায়। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। ফেসবুক ছাড়াও টুইটার, ব্লগ, বইয়ের ওযেবসাইট গুডরিডস ডট কম সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবহার করে পাঠকেরা বইটি সম্পর্কে তাদের মতামত জানিয়েছেন। বাংলা উইকিপিডিয়ার নিবন্ধসহ বেশ অনেক ধরনের নিবন্ধ/ প্রবন্ধে মুক্তমনা লেখকেরা বইটিকে উদ্ধৃত করেছেন। বিগত বছরগুলোতে বইটি নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে। যেমন, অবিশ্বাসের দর্শন বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা স্থান পেয়েছিল সুসাহিত্যিক আহমদ মাযহার সম্পাদিত ‘বইয়ের জগৎ’ পত্রিকার নবম সংখ্যায়। নৃবিদ্যার ছাত্র এবং সাহিত্য সমালোচক শফিউল জয়ের করা সেই শিরোনাম ছিল ‘অবিশ্বাসের দর্শন: যৌক্তিকভাবে মনকে জাগানোর ঐকান্তিক প্রয়াস’[১]। সেই রিভিউটিতে শফিউল জয় ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটিকে বাংলা সাহিত্যের জগতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, এবং রিভিউটি সমাপ্ত করেছিলেন এই বলে ‘প্রতিক্রিয়াশীল আর অবৈজ্ঞানিক ধর্মগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অসুস্থভাবে মন জুগিয়ে এসেছে মানুষের, এখন না হয় মন। আমাদের যুক্তির আলোয় জেগে উঠুক’ শফিউল জয়ের এই ঐকান্তিক কামনা যেন আমাদের প্রত্যাশারই নান্দনিক প্রকাশ।

বইটির আরেকটি মূল্যবান রিভিউ করেছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী পদার্থবিজ্ঞানী এবং সুলেখক ড. প্রদীপ দেব। মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত ‘অবিশ্বাসের দর্শন: নবযুগের যুক্তিবাদীর দৃপ্ত পদক্ষেপ’ শিরোনামের এ রিভিউটিতে প্রদীপ দেব যে কথাগুলো উল্লেখ করেছিলেন তা আজও আমাদের জন্য নির্মল আনন্দ এবং অফুরন্ত প্রেরণার নৈমিত্তিক থোরাক”[২]

পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু খুব সামান্য সংখ্যক। কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ আছেন যাঁরা পৃথিবীটাকেই বদলে ফেলার চেষ্টা করেন। দিনের পর দিন নিরলস সংগ্রাম চেষ্টা পরিশ্রম অধ্যবসায় দিয়ে পৃথিবীটাকে একটু একটু করে ঠিকই বদলে ফেলেন এই ব্যতিক্রমী মানুষেরা। অথচ তার সুফল ভোগ করেন সবাই যাদের মধ্যে তাঁরাও আছেন যাঁরা ক’দিন আগেও এ পরিবর্তনের ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। ধর্মবাদীদের সাথে মুক্তমনাদের পার্থক্য এখানেই যে ধর্মবাদীরা বড় বেশি বিভাজনপটু। ধর্মবাদীরা তাঁদের নিজস্ব ধর্মের অনুশাসনগুলোর প্রতি কেউ প্রশ্ন তুললেই সেটাকে ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেন না অনেক সময়। বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক যুক্তিতে টিকে থাকতে না পারলে পেশীশক্তি ব্যবহার করেন ধর্মবাদীরা। মধ্যযুগে ধর্মের প্রসার ঘটেছে তলোয়ারের আস্ফালনে, বর্তমানেও ধর্মবাদীদের মূল অস্ত্র আর যাই হোক—যুক্তি নয়। অথচ সারা পৃথিবীতে একজনও যুক্তিবাদী মুক্তমনা পাওয়া যাবে না যিনি যুক্তির বদলে শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করার পক্ষপাতী। যুক্তির শক্তি যে কত প্রবল তা আরো একবার বুঝতে পারলাম অভিজিৎ রায় ও রায়হান আবীরের ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ পড়তে পড়তে।

তবে রিভিউটিতে ড.দেব অফুরন্ত প্রশংসাবাক্য প্রক্ষেপণের পাশাপাশি গুটিকয় দুর্বলতারও উল্লেখ করেছিলেন। বিশেষত কিছু লজ্জাজনক বানান এবং মুদ্রণপ্রমাদ গুরুত্বপূর্ণ বইটিকে লঘু করে দিয়েছিল নির্দ্বিধায় বলা যায়। যদিও প্রদীপ দেব রিভিউটি লিখেছিলেন বইটির প্রথম সংস্করণের উপর ভিত্তি করে, এবং তার দেওয়া প্রমাদের তালিকার অধিকাংশই ইতোমধ্যে পরবর্তী সংস্করণে ঠিক করে ফেলা হয়েছিল, তারপরেও কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা থেকেই গিয়েছিল। সেগুলোও এবারকার এই নতুন সংস্করণে সংশোধন করে দেয়া গেল। যেমন, ‘বিগব্যাঙ এর জায়গায় ‘বিগব্যাং’ করা হয়েছে, গণিতবিদ ‘ফিবোনাক্কি’র নাম মূল ইতালীয় উচ্চারণ অনুসরণ করে ‘ফিবোনাচি করা হয়েছে। ফিবোনাচি সিরিজে (০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪, ৫৫) মাঝখানের একটি সংখ্যা (১) বাদ পড়েছিল। সেটা যোগ করে দেয়া হয়েছে। এ ধরণের ছোটখাটো ভুলভ্রান্তি সংশোধনের পাশাপাশি নতুন নতুন তথ্যের আলোকে পূর্ববর্তী কিছু অনুচ্ছেদ রদবদল করা হয়েছে। বিশেষত লরেন্স ক্রাউসের ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ গ্রন্থটির প্রকাশ (বাংলাতেও প্রকাশিত হতে চলেছে অভিজিৎ রায় এবং মীজান রহমানের ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব[৩]), মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সনাক্তকরণের সাফল্য প্রভৃতি ঘটনা মহাবিশ্বের উৎপত্তির পেছনে স্ফীতিতত্ত্বের অনুমানকে আরো জোরালো করেছে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ অধ্যায়ের ‘প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে’ অংশটি বিবর্ধিত করা হয়েছে।

বইটির বেশ কিছু জায়গায় নতুন তথ্য এবং রেফারেন্স যোগ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি,নতুন সন্নিবেশগুলো বইটির মানের উন্নয়ন যেমন ঘটাবে, সেইসাথে সর্বাধুনিক এ তথ্যগুলো পাঠকদের চিন্তার খোরাকও যোগাবে পুরোদমে।

অবিশ্বাসের দর্শনের নতুন এ সংস্করণটি বইটির তৃতীয় সংস্করণ। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে ২০১২ সালে প্রকাশিত বইটি পেপারব্যাক সংস্করণের সহস্রাধিক কপি প্রকাশিত হয়েছিল। এক বছরের মাথায় বইটির সকল কপি নিঃশেষ হয়ে যায়। ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্বেও পূর্ববর্তী প্রকাশকের (শুদ্ধস্বর) ব্যর্থতায় বইটি দীর্ঘদিন ধরেই ‘আউট অব প্রিন্ট’। শুধু তাই নয়, একটা সময় পর শুদ্ধস্বরের সত্ত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল বইটির পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশে অপারগতার কথা জানিয়ে দিলে আমরা নিরুপায় হয়ে বইটি প্রকাশের ভার তুলে দিয়েছি জাগৃতি প্রকাশনীর হাতে প্রকাশনার জগতে জাগৃতি একটি পরিচিত এবং বিশ্বস্ত নামা জাগৃতির সত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনের হাত দিয়ে ইতোমধ্যেই বের হয়েছে বহুল আলোচিত ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ গ্রন্থটি[৪]। পাঠকপ্রিয় এ গ্রন্থটির জন্য হুমকি ধামকি কম পোহাতে হয়নি লেখক এবং প্রকাশককে রকমারি ডট কম নামে একটি অনলাইন গ্রন্থ-বিপণন প্রতিষ্ঠান তো এক মুখচেনা লুম্পেনের জিহাদি হুমকির মুখে নতি স্বীকার করে বইটিকে তাদের স্টোর হতে সরিযেও নিয়েছেন। এর কিছুটা রেশ ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ বইটির উপরেও পড়েছিল। অনেকেই বইটির ভাগ্য নিয়ে ছিলেন চিন্তিত। আমাদের বইয়ের নতুন প্রকাশক অবশ্য সেই সব মৌলবাদী আস্ফালনে ভীত না হয়ে এ ধরণের ‘নাফরমানি’ বই আরো প্রকাশের অঙ্গীকার করেছেন; অবিশ্বাসের দর্শনের পাণ্ডুলিপির জন্য জন্য নিয়মিতভাবে তাগাদা দিয়ে চলেছেন। তার এই নিঃসীম তাগাদার ফসল এই অবিশ্বাসের দর্শনের নতুন সংস্করণ। দীপনের নিষ্ঠা,আগ্রহ,উদ্যম এবং সদিচ্ছা বইটিকে নতুন মাত্রা দেবে বলে আমরা মনে করছি।

মুক্তি আসুক যুক্তির পথ ধরে; আর জীবন হোক দীপান্বিত!

.

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

কীভাবে এলাম আমরা? এই অসীম মহাবিশ্ব, কিংবা সুন্দর ফুল, সুন্দর ফল, মিঠা নদীর পানি-এগুলোই বা কেমন করে হলো? সবকিছুই কি একজনের ইশারায় একটি নির্দিষ্ট কারণে সৃষ্টি হয়েছে? কৌতূহলী মানুষ সহস্র বছর ধরে সন্ধান করছে এমন সব প্রান্তিক প্রশ্নের উত্তর। ক্ষুদ্র জীবনের সর্বক্ষণ চিন্তিত না থাকলেও প্রশ্নগুলোর কাঁপুনি সামান্য সময়ের জন্য হলেও আমরা সবাই অনুভব করেছি। প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকেই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সন্ধানে নিয়োজিত ছিল প্রথাগত দর্শন। বিজ্ঞান বসে ছিল সাইড লাইনে, সেই ঘোড়দৌড় উপভোগকারী হাজার দর্শকের একজন হিসেবে। কিন্তু এখন দিন পাল্টেছে। প্রান্তিক এই সমস্যাগুলোর অনেকগুলোরই নিখুঁত সমাধান হাজির করতে পারে বিজ্ঞান। গতানুগতিক দর্শন নয় বরং বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানের দার্শনিকরাই আজ গহীন আঁধারের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা। আজকের দিনে কয়েকজন বিখ্যাত দার্শনিকের নাম বলতে বললে হকিং, ওয়াইনবার্গ, ভিক্টর স্টেঙ্গর, ডকিন্স-এদের কথা সবার আগেই চলে আসে। এরা কেউ প্রথাগত দার্শনিক নন, কিন্তু তবুও দর্শনগত বিষযে তাঁদের অভিমত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

সবসময়ই দর্শন আমাদের জ্ঞান চর্চার মধ্যমণি। কিন্তু প্রথাগত দর্শনের স্বর্ণযুগে প্রাকৃতিকবিজ্ঞান ছিল তার সহচরী। এখন দিন বদলেছে-বিশ্বতত্ব, জ্ঞানতত্ব এমনকি অধিবিদ্যার জগতেও প্রাকৃতিকবিজ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা শুধু প্রবেশ করে নি, প্রথাগত দর্শনকে প্রায় স্থানচ্যুত করে দিয়েছে। অধিবিদ্যা জানতে হলে তো এখন আর স্পেশাল কোনো জ্ঞান লাগে না। কেবল ধর্মের ইতিহাস, নন্দনতত্ব আর ভাষার মধ্যে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ পায় নি আধুনিক অধিবিদ্যা এবং প্রথাগত দর্শন। অন্যদিকে, আধুনিক পদার্থবিদ্যা আজকে যে জায়গায় পৌঁছেছে সেটি অধিবিদ্যার অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে। আমরা আজ জানি, মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর পরিণতি নিয়ে একজন প্রথাগত দার্শনিক কিংবা বেদ জানা পণ্ডিত কিংবা কোরআন জানা মৌলবির চেয়ে অনেক শুদ্ধভাবে বক্তব্য রাখতে সক্ষম হবেন একজন হকিং কিংবা ওয়াইনবার্গ। ডিজাইন আর্গুমেন্ট নিয়ে অধিবিদ্যার গবেষকের চেয়ে বিজ্ঞান থেকেই অনেক ভালো দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন ডকিন্স বা শন ক্যারল। আজকে সেজন্য মহাবিশ্ব এবং এর দর্শন নিয়ে যেকোনো আলোচনাতে। পদার্থবিজ্ঞানীদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়, অ্যারিস্টটলের ইতিহাস কপচানো কোনো দার্শনিককে কিংবা সনাতন ধর্ম জানা কোনো হেডপণ্ডিতকে নয়। মানুষও বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে নানা রকমের দর্শনের কথা শুনতে চায়, তাদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা বিজ্ঞানের দর্শন এবং চেতনার কথাগুলো বাঙালি পাঠকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছি, যে দর্শন মহাবিশ্ব এবং জীবনের প্রান্তিক সমস্যাগুলোর সমাধানে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে এবং ধর্ম ও প্রথাগত দর্শনকে তার আগের অবস্থান থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে।

আমরা, এ বইয়ের দু’জন লেখকের কেউই প্রথাগত দার্শনিক নই। বরং আমাদের পেশাগত এবং অ্যাকাডেমিক জীবন খুব কঠোরভাবেই বিজ্ঞানের সাথে জড়িত। বিজ্ঞান এবং এর কারিগরি প্রয়োগ নিয়েই আমাদের কাজ কারবার। কাজেই আমরা আমাদের বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই প্রান্তিক সমস্যাগুলোকে দেখেছি। পাশাপাশি বহুদিন ধরেই মুক্তমনাসহ বিভিন্ন ব্লগে জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান, বিবর্তন, মানবতাবাদ, সংশ্যবাদ, যুক্তিবাদসহ বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রান্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে লিখছি। বহু গ্রন্থ, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন এবং সংকলন সাময়িকীতে আমাদের ধ্যানধারণা বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এই বইটি সেসব ধারণারই সুসংবদ্ধ এবং সুগ্রন্থিত প্রতিফলন। আমাদের এই বইটি অবিশ্বাস নিয়ে, এর অন্তর্নিহিত দর্শন নিয়ে। আমরা দু’জনেই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস মুক্ত এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। কেন অবিশ্বাসী, তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ দেখানোই এ বইয়ের উদ্দেশ্য। বলা বাহুল্য, এ বিশ্লেষণ আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত মনগড়া কোনো গল্প নয়, বরং তা হাজির করা হয়েছে একেবারে আধুনিক বিজ্ঞানের জগৎ থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সাম্প্রতিক তথ্যের নিরিখো আমাদের এই গ্রন্থে ঈশ্বর ছাড়াই কীভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, যা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক তত্ব এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা খুব জোরালো ভাবে সমর্থিত। এছাড়াও মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে একটি আদি ঐশ্বরিক কারণ খণ্ডন, স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহাবিশ্ব উৎপত্তির পেছনে কোনো ধরনের অলৌকিকতার উপস্থিতির অপ্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা ছাড়াও পদার্থের উৎপত্তি এবং শৃঙ্খলার সূচনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। প্রাণের উৎপত্তি থেকে শুরু করে বিবর্তন তত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা রয়েছে আমাদের বইয়ে। পাঠকেরা এই বইয়ের পথ-পরিক্রমায় জানতে পারবেন, মহাবিশ্ব কিংবা প্রাণ কোনোকিছুর উৎপত্তির ব্যাখ্যাতেই ঈশ্বরকে হাজির করার প্রয়োজন আজ আর পড়ে না। এর পাশাপাশি, আমরা আধুনিক জ্ঞানের নিরিখে সুচারুভাবে খণ্ডন করেছি ‘প্যালের ঘড়ি’ এবং হয়েলের টর্নেডো থেকে বোয়িং’ নামের ছদ্মবৈজ্ঞানিক ধারণাকে। জীবজগতের ডিজাইন এবং ব্যাড-ডিজাইন নিয়েও আলোচনা করেছি নির্মোহ দৃষ্টিকোণ থেকে। শুধু তাই নয়, এই বইয়ে নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের উৎসেরও বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করা হয়েছে। আমরা দেখিয়েছি যে, নাকের সামনে ‘স্বর্গের মুলো’ ঝোলাবার কারণে নয়, বরং ডারউইনীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবেই পরার্থপরায়ণতা, সহযোগিতা, নৈতিকতা আর মূল্যবোধের মতো অভিব্যক্তিগুলো জীবজগতে উদ্ভূত হতে পারে, যা বিবর্তনের পথ ধরে মানবসমাজে এসে আরও বিবর্ধিত আর বিকশিত হয়েছে। আমরা আশা করি, এ বইটি একজন সচেতন পাঠককে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতাই যে একজন বুদ্ধিমান মানুষের সবচেয়ে যৌক্তিক অবস্থান হতে পারে তা বোঝাতে সক্ষম হবে। সে কথা মাথায় রেখেই এ বইয়ের নামকরণ করা হয়েছে ‘অবিশ্বাসের দর্শন’। এই বইটির নাম ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ যেমন হয়েছে, তেমনই এ বইয়ের নাম অবলীলায় হতে পারত ‘অবিশ্বাসের বিজ্ঞান’, কিংবা প্রান্তিক বিজ্ঞান’। কারণ আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই দর্শনের প্রান্তিক সমস্যাগুলোকে দেখেছি, ঠিক যেমন স্টিফেন হকিং তার পদার্থবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে দর্শনের প্রান্তিক সমস্যা আর আমাদের অস্তিত্বের রহস্য নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা করেছেন তার অতি সাম্প্রতিক গ্র্যান্ড ডিজাইন”[৫] বইয়ে, কিংবা জীববিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স করেছেন তার ‘গড ডিলুশন[৬]’ বইয়ে।

বিশ্বাস এবং ধর্ম সবসময়ই একে অন্যের পরিপূরক, আমাদের সমাজে তো বটেই, পাশ্চাত্যেও। আর এ নিয়ে বহু খ্যাতনামা দার্শনিকই চিন্তাভাবনা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। স্পিনোজা থেকে ভলতেয়ার, ফুযেরবাক থেকে মার্ক্স পর্যন্ত অনেকেই ভেবেছেন। রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক মডেলও তুলে ধরা হয়েছে অনেক। বাংলা ভাষায়ও বেশকিছু বই লেখা হয়েছে। আরজ আলী মাতুব্বর লিখেছেন, লিখেছেন হুমায়ুন আজাদ, লিখেছেন আহমদ শরীফ, লিখেছেন প্রবীর ঘোষ কিংবা ভবানীপ্রসাদ সাহু। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের দার্শনিকেরা বিভিন্নভাবে ধর্মবিশ্বাস এবং সমাজে এর প্রভাবকে বিশ্লেষণ করলেও আমরা মনে করি রিচার্ড ডকিন্সের ‘ভাইরাসেস অব দ্য মাইন্ড’ রচনাটির আগে জৈববৈজ্ঞানিক ভাবে ধর্মের মডেলকে বোঝা যায় নি[৭]। এই প্রবন্ধ থেকে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রীতিনীতিগুলো অনেকটা জু-ভাইরাসের মতোই আমাদের সংক্রমিত করে। সেজন্যই ধর্মের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ বহু কিছুই করে ফেলে, যা সুস্থ মস্তিষ্কে কল্পনাও করা যায় না। বিখ্যাত বিজ্ঞানের দার্শনিক ড্যানিয়েল ডেনেট, ডকিন্সের এই ধারণাকেই আরও সম্প্রসারিত করে একটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি ব্রেকিং দ্য স্পেল’ শিরোনামে[৮]। একই ভাবধারায় ড্যারেল রে সম্প্রতি লিখেছেন ‘গড ভাইরাস”[৯]। রিচার্ড ব্রডি লিখেছেন ‘ভাইরাস অব দ্য মাইন্ড’[১০] প্রভৃতি। ডকিন্স নিজেও ভাইরাস সংক্রমণের ব্যাপারগুলোকে মিম তত্ত্বের আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। সেলফিশ জিন’[১১]এবং সাম্প্রতিক ‘গড ডিলুশন’ বইয়ে তার সেসমস্ত ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য সেসব বই সংগ্রহ অনেকটাই দুরুহ। আমরা আশা করছি, আমাদের এই বইয়ের মাধ্যমে সেসব সাম্প্রতিক ধ্যানধারণাগুলোর সাথে তারা পরিচিত হতে পারবেন। তবে, পাঠকেরা উপলব্ধি করবেন যে, আমরা এই বইয়ে ডকিন্সের ‘মিম’-এর বদলে ‘ভাইরাস’ শব্দটিই অনেক বেশি ব্যবহার করেছি। এর কারণ হচ্ছে, ভাইরাস ব্যাপারটির সাথে সাধারণ পাঠকেরা পরিচিত, মিম’-এর সাথে তেমনটি নয় এখনও। যেকোনো গতানুগতিক ধর্মে বিশ্বাস যে মানুষের মনে একটি ভাইরাস হিসেবেই কাজ করে সেটা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে বিশ্বাসের ভাইরাস’ নামের অধ্যায়ে। আমরা এই বইয়ে উল্লেখ করেছি, মানব মনে প্রোথিত বিশ্বাসগুলো আসলে অনেকটাই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মতো কাজ করে। এদের আক্রমণে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার বহু উদাহরণ আছে বিজ্ঞানীদের কাছে। যেমন–

.

নেমাটোমর্ফ হ্যেরওয়ার্ম নামে এক ফিতাকৃমি সদৃশ প্যারাসাইট ঘাসফড়িং-এর মস্তিষ্ককে সংক্রমিত করে ফেললে ঘাসফড়িং পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে, যার ফলে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্মের প্রজননে সুবিধা হয়। অর্থাৎ নিজের প্রজননগত সুবিধা পেতে নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম বেচারা ঘাসফড়িঙকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে’[১২]’।

জলাতঙ্ক রোগের সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। পাগলা কুকুর কামড়ালে আর উপযুক্ত চিকিৎসা না পেলে জলাতঙ্ক রোগের জীবাণু মস্তিষ্ক অধিকার করে ফেলে। ফলে আক্রান্ত মস্তিষ্কের আচরণও পাগলা কুকুরের মতোই হয়ে ওঠে। আক্রান্ত ব্যক্তি অপরকে কামড়াতেও যায়। অর্থাৎ, ভাইরাসের সংক্রমণে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।

ল্যাংসেট ক্ষুক নামে এক ধরনের প্যারাসাইটের সংক্রমণের ফলে পিঁপড়া কেবল ঘাস বা পাথরের গা বেয়ে উঠানামা করে। কারণ এই প্যারাসাইটগুলো বংশবৃদ্ধি করতে পারে শুধু তখনই যখন কোনো গরু বা ছাগল একে ঘাসের সাথে চিবিযে খেয়ে ফেলে। ফলে প্যারাসাইট নিরাপদে সেই গরুর পেটে গিযে বংশবৃদ্ধি করতে পারে[১৩]।

নেমাটোমর্ফ হেয়ারওয়ার্ম যেমনি ভাবে ঘাসফড়িংকে আত্মহত্যায় পরিচালিত করে, ঠিক তেমনই ধর্মের বিভিন্ন বাণী এবং জিহাদি শিক্ষা মানুষকে অনেক সময়ই ভাইরাস কিংবা প্যারাসাইটের মতো সংক্রমিত করে আত্মঘাতী করে তোলে। ফলে আক্রান্ত সন্ত্রাসী মনন বিমান নিয়ে আছড়ে পড়ে টুইন টাওয়ারের ওপর, কখনোবা সিনেমা হলে, কখনোবা রমনার বটমূলে। নাইন ইলেভেনের বিমান হামলায় উনিশ জন ভাইরাস আক্রান্ত মনন ‘ঈশ্বরের কাজ করছি’-এই প্যারাসাইটিক ধারণা মাথায় নিয়ে হত্যা করেছিল প্রায় তিন হাজার সাধারণ মানুষকে। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর অধ্যাপক ব্রুস লিংকন, তার বই ‘হলি টেররস : থিংকিং অ্যাবাউট রিলিজিয়ন আফটার সেপ্টেম্বর ইলেভেন’ বইয়ে বিষয়টির ওপর আলোকপাত করে বলেন, ‘ধর্মই, মুহাম্মদ আতাসহ আঠারজনকে প্ররোচিত করেছিল এই বলে যে, সংগঠিত বিশাল হত্যাযজ্ঞ শুধু তাদের কর্তব্য নয়, বরং স্বর্গ থেকে আগত পবিত্র দায়িত্ব’[১৪]। হিন্দু মৌলবাদীরাও একসময় ভারতে রাম জন্মভূমি অতিকথনের ভাইরাস বুকে লালন করে। ধ্বংস করেছে শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্মীয় অপবিশ্বাসের অপকারিতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে ‘ধর্মীয় নৈতিকতা, এবং এর পরবর্তী ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’ অধ্যায়টিতে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, পৃথিবীতে শান্তি আনার পরিবর্তে অশান্তি সৃষ্টিতেই যুগযুগ ধরে অবদান রেখেছে ধর্মগুলো, হয়ে উঠেছে বিভেদের হাতিয়ার। এই বইয়ে বহু পরিসংখ্যান হাজির করে দেখানো। হয়েছে যে, ধর্ম নৈতিকতার একমাত্র উৎস নয়, কিংবা নাস্তিক হলেই কেউ খারাপ হয় না, যদিও আমাদের সমাজে এটাই ঢালাওভাবে ভেবে নেওয়া হয় আর শেখানোর চেষ্টা করা হয়। আমরা বিভিন্ন দেশের জেলখানার দাগী আসামীদের পরিসংখ্যান উপস্থাপন করে দেখিয়েছি যে, তাদের প্রায় সবাই ঈশ্বরে বিশ্বাসী-আস্তিক। ঈশ্বরে বিশ্বাস, পরকালে বিশ্বাস, বেহেস্তের লোভ বা দোজখের ভয় কোনটাই কিন্তু অপরাধীদের অপরাধ থেকে নিবৃত্ত রাখতে পারে নি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অবস্থাই এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ আল্লাহর গোনাহ কিংবা ঈশ্বরের ভয়েই যদি মানুষ পাপ থেকে, দুর্নীতি থেকে মুক্ত হতে পারত, তবে তো বাংলাদেশ এতদিনে বেহেস্তে পরিণত হতো। বাংলাদেশে অধিকাংশ লোকই আল্লাহ-খোদা আর পরকালে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও দুর্নীতিতে এই দেশটি পৃথিবীতে শীর্ষস্থানীয়। ধর্মে বিশ্বাস কিন্তু দেশবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে পারে নি। এ বইয়ে ব্যক্তিবিশেষের পরিসংখ্যান যেমন দেওয়া হয়েছে, ঠিক তেমনই পাশ্চাত্য বিশ্বে সুইডেন বা ডেনমার্কের মতো প্রায় ধর্মহীন’ দেশগুলোর সমাজব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে ধর্মহীন হওয়া সত্বেও সেসব দেশে পৃথিবীর অন্য অনেক জায়গার চেয়ে অপরাধ প্রবণতা কম এবং সেখানকার নাগরিকেরা অনেক সুখী জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন দেশের সামাজিক পরিসংখ্যান উপস্থাপনের পাশাপাশি এ বইয়ে সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার সঠিক ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে; ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কখনোই সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিত। এধরনের অনেক গভীর রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং দার্শনিক আলোচনা বইটিতে স্থান পেয়েছে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। কাজেই আগেকার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ধারা থেকে আমাদের বইটি অনেক দিক থেকেই স্বতন্ত্র, সম্পূর্ণ নতুন একটি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে আমরা বিশ্বাস এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনার সুত্রপাত ঘটিযেছি বাঙালি পাঠকদের জন্য। আমরা মনে করি, এই আঙ্গিকে ঈশ্বর ও ধর্মালোচনা বাংলা ভাষায় এই প্রথম।

ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদাভাবে আলোচনা করা হয়েছে এই বইয়ে। ঈশ্বরে বিশ্বাস করাটা এক ধরনের কুসংস্কার এবং আমাদের মতে সবচেয়ে। বড় কুসংস্কার। আর সে অপবিশ্বাসকে পুঁজি করে মানুষের আবিষ্কৃত ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থগুলোও অযৌক্তিক মতবাদে পরিপূর্ণ। অন্য সকল ধরনের কুসংস্কার, অপবিশ্বাস, অযুক্তি বধ করতে যেমন আমরা বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হই বিনা দ্বিধায়, তেমনই ঈশ্বর এবং ধর্মালোচনাতেও আমাদের অস্ত্র হতে পারে বিজ্ঞান। বিবর্তন তত্ব থেকে শুরু করে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইতোমধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। যদিও অনেকেই ঢালাওভাবে বলে থাকেন, ‘ঈশ্বর সংজ্ঞায়িত নন’, কিংবা ‘বিজ্ঞান দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব কোনটাই প্রমাণ করা যায় না, কিংবা বলেন ‘ঈশ্বরের অনুপস্থিতি প্রমাণ করা গেলেও সেটা তার অনস্তিত্বের প্রমাণ হতে পারে না’ ইত্যাদি। এই বইয়ে আমরা দেখাব স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেওয়া এই ধরনের প্রতিটি অনুকল্পই ভুল। আব্রাহামিক ধর্মের ঈশ্বরের বৈশিষ্ট্যগুলোর অনেক কিছুই খুব ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত। এ বইয়ে বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে তার অনেক বৈশিষ্ট্যই আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে ভ্রান্ত কিংবা যুক্তির কষ্টিপাথরে পরস্পরবিরোধী। তাছাড়া, আধুনিক বিজ্ঞান এখন যে জায়গায় পৌঁছে গেছে ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকলে কোনো না কোনোভাবে বিজ্ঞানের চোখে তা ধরা পড়ার কথা ছিল। যেসব ক্ষেত্রে ঈশ্বরের উপস্থিত থাকার কথা এতদিন আমরা শুনে এসেছি, সেখানে তার অনুপস্থিতি অবশ্যই তার অনস্তিত্বের উপযুক্ত প্রমাণ আমাদের কাছে। বিবর্তন তত্ব রঙ্গমঞ্চে আসার আগ পর্যন্ত সকল ধর্মগ্রন্থের কল্যাণে আমরা জানতাম ঈশ্বর আদম-হাওয়ার মাধ্যমে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন। ধর্মগ্রন্থের আয়াতসমূহে আল্লাহ বলেছেন, তিনি আমাদেরকে এক আদি মানুষ আদম হতে সৃষ্টি করেছেন, এবং বিবি হাওয়াকে সৃষ্টি করেছেন আদমের হাড থেকে’[১৫]। আর অন্যদিকে বিবর্তন। বলছে আদি এককোষী জীবের লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তিত রূপ বর্তমান মানুষ। বিবর্তন তত্ত্ব বহু আগেই প্রমাণ করেছে, খ্রিস্টান পাদ্রি জেমস আশারের ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ঈশ্বরের বিশ্বসৃষ্টির বাইবেলীয় গণনা কিংবা ২৩৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে নুহের প্লাবনের কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক সত্যতা নেই। বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কারের ফলে মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে, এই মহাবিশ্ব এবং এই পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভবের পেছনে আসলে কোনো ডিজাইন নেই, পরিকল্পনা নেই, নেই কোনো বুদ্ধিদীপ্ত সত্বর সুমহান উদ্দেশ্য। মহাবিশ্বের উদ্ভব এবং প্রাণের উৎপত্তির পেছনে মুস্থিত প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা এখন আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যেই দেওয়া সম্ভব, যা পরীক্ষালব্ধ উপাত্তের সাথে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ। এছাড়া প্রার্থনায় সাড়া দেওয়ার পরীক্ষাসহ বহু পরীক্ষায় ঈশ্বরের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়ার কথা থাকলেও সে ধরনের কিছু কথনও পাওয়া যায় নি। ঈশ্বর আজ আধুনিক বিজ্ঞানের চোখে একটি ‘ব্যর্থ অনুকল্প। আমাদের চারপাশের জগতে অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। একটা সময় প্রাণের অস্তিত্ব ব্যাখ্যার জন্য আর শরণাপন্ন হতে হয়েছিল মানুষকে। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে ঈশ্বরের মতো আত্মাও একটি বাতিল অনুকল্প। বইয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায়ে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনায় বলা হয়েছে, মানুষের অনুভূতি, জন্ম-মৃত্যু থেকে শুরু করে জগতের সবকিছুই প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, আত্মার মতো অতিপ্রাকৃত কোনোকিছু আমদানির দরকার নেই।

ঈশ্বর অনুকল্পের পাশাপাশি এসেছে ধর্মগ্রন্থে আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়ার বিষয়টিও। শতাব্দী-প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলোর বিভিন্ন আয়াত বা শ্লোকের বিভিন্ন চতুর অপব্যাখ্যার মাধ্যমে ইদানীং এর ভেতর আধুনিক বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং মানুষজনকে ভুল বোঝানো হচ্ছে। মরিস বুকাইলি থেকে শুরু করে হারুন ইয়াহিয়া, জাকির নায়েক এবং বাংলাদেশের বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শমশের আলীসহ আধুনিক বিরিঞ্চি-বাবাদের বিভিন্ন অপব্যাখ্যার জবাব দেওয়া হয়েছে বইয়ের ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ অধ্যায়ে। একই অধ্যায়ে রাশাদ খলিফা বর্ণিত কোরআনের তথাকথিত উনিশ তত্ত্বের নির্মোহ বিশ্লেষণ সংযুক্ত হয়েছে। আমরা দেখিয়েছি কীভাবে রাশাদ খলিফা কোরআনের আয়াতে ইচ্ছেমতো নিজস্ব সংযোজন বিযোজনের মাধ্যমে অর্থাৎ কোরআন টেম্পারিং করে নিউমেরোলজি বা সংখ্যাতত্ব নামক অপবিজ্ঞানের সাহায্যে কোরআনকে অলৌকিক গ্রন্থ বানাতে চেয়েছেন।

বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা নতুন কোনো ঘটনা নয়, এটি চলছে হাজার বছর ধরে। কিন্তু বিজ্ঞানের উপকার গ্রহণে আমরা যতটা না আগ্রহী তার চেয়ে বেশি আগ্রহী বিজ্ঞানের চেতনা পরিহারে। কিন্তু আমরা, নতুন দিনের নাস্তিকেরা উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া অযৌক্তিক বিশ্বাসকে সামান্যতম শ্রদ্ধা দেখাতে রাজি নই। আমরা মনে করি, ধর্মীয় বিশ্বাস আসলে অপবিশ্বাস, যা সমাজের শান্তি বিনষ্টকারী এবং সেইসাথে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা রোধের প্রধানতম অন্তরায় ছাড়া আর কিছু নয়। ছোটবেলার মগজধোলাইয়ের কারণে সমাজের বেশিরভাগ। মানুষই মনে করে থাকেন, জীবনে শান্তি, পবিত্রতা এবং আনন্দ বজায় রাখার জন্য ধর্ম জরুরি। তাদের এই অনুভূতি আমরা কেড়ে নিতে চাই না, তবে আমরা দেখাতে চাই, ধর্ম বিশ্বাস ছাড়াও জীবন একই রকম কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি নৈতিক,আনন্দ এবং পরিপূর্ণতায় ভরা হতে পারে। অধ্যাপক রিচার্ড ডকিন্সের উক্তি দিয়েই বলি-You can be an atheist who is happy, balanced, moral and intellectually fulfilled.’ এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে বইটির শেষ তিনটি অধ্যায়ে।

২০০৪ সালে স্যাম হ্যারিসের লেখা ‘বিশ্বাসের সমাপ্তি বইটির মাধ্যমে পাশ্চাত্যে সূচনা হয় নতুন এক আন্দোলনের[১৬]। পরবর্তীকালে রিচার্ড ডকিন্স, ভিক্টর স্টেঙ্গর, ড্যানিয়েল সি ড্যানেট এবং ক্রিস্টোফার হিচেন্সের মতো খ্যাতনামা বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকেরা আরও ছয়টি দুনিয়া কাঁপানো বইয়ের মাধ্যমে সমাজ থেকে ধর্মীয় কুসংস্কার দূর করার জন্য শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। উল্লিখিত নাস্তিকদের প্রতিটি বই আমেরিকায় বেস্ট সেলার হয়েছে, যা কিছুদিন আগেও ছিল অকল্পনীয়। এই আন্দোলন পাশ্চাত্যে পরিচিত হয়েছে নতুন দিনের নাস্তিকতা (নব্য নাস্তিকতা New Atheism) হিসেবে। বাংলায় এখনও সে ধরনের কোনো আন্দোলন চোখে পড়ে নি, যদিও আমরা প্রায়ই নিজেদের প্রবোধ দিতে উচ্চারণ করি যে, আমাদের সংস্কৃতিতে বস্তুবাদিতার উপাদান অনেক প্রাচীন। আধুনিক বিজ্ঞানের আলোকে নতুন দিনের নাস্তিকতা আন্দোলনে নিজেদের সম্পৃক্ত করার জন্যই আমাদের এই বই। সকল ধরনের অপবিশ্বাস থেকে সমাজকে মুক্ত করাই এই আন্দোলনের লক্ষ্য। আশা করি, এই বইয়ের মাধ্যমে আমরা দেখাতে পারব যে, নতুন দিনের নাস্তিকতাই একজন বুদ্ধিমান মানুষের জন্য আজ অবশ্যম্ভাবী ও শক্তিশালী একটি যৌক্তিক অবস্থান। আমরা আরও আশা করি বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নাস্তিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী এবং মানবতাবাদীরা এই আন্দোলনে শরীক হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কুসংস্কার দূরীকরণে এগিয়ে আসবেন। সেটা কেবল একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গঠনেই আমাদের সাহায্য করবে না, সাহায্য করবে কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে আমাদের সমাজকে রক্ষা করতে। রক্ষা করবে, ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা প্রতিক্রিয়াশীল মহলের স্বাধীন বাংলাদেশকে আরেকটি ছোট পাকিস্তান কিংবা তালিবানি আফগানিস্তান বানানোর অপচেষ্টা থেকেও।

আমাদের জীবন দীপান্বিত হোক!

অভিজিৎ রায়।
রায়হান আবীর
ফেব্রুয়ারি, ২০১১

Book Content

০১. বিজ্ঞানের গান
০২. এই সুন্দর ফুল, সুন্দর ফুল কিংবা মিঠা নদীর পানি
০৩. ফ্রেডরিক হয়েলের বোয়িং ৭৪৭ ফ্যালাসি
০৪. শুরুতে?
০৫. আত্মা নিয়ে ইতং বিতং
০৬. বিজ্ঞানময় কিতাব
০৭. ধর্মীয় নৈতিকতা
০৮. বিশ্বাসের ভাইরাস
০৯. নতুন দিনের নাস্তিকতা : আগামী দিনের ভাইরাস-মুক্ত সমাজ
১০. পরিশিষ্ট – অক্কামের ক্ষুর এবং বাহুল্যময় ঈশ্বর
লেখক: অভিজিৎ রায়, রায়হান আবীরবইয়ের ধরন: ধর্ম ও দর্শন
বিশ্বাসের ভাইরাস – অভিজিৎ রায়

বিশ্বাসের ভাইরাস – অভিজিৎ রায়

ভালোবাসা কারে কয় - অভিজিৎ রায়

ভালোবাসা কারে কয় – অভিজিৎ রায়

Reader Interactions

Comments

  1. ARIF

    February 11, 2022 at 1:10 am

    THIS STORY IS BARY GOOD
    THANK YOU

    Reply

Leave a Reply to ARIF Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.