অতল জলের বন্ধু – স্মরণজিৎ চক্রবর্তী
.
.
১
জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল আদেশ। রোদ ঝলমল করছে চারদিকে। বঙ্গোপসাগরের নীল জলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সাদা বালির বিচে।
মায়ানমারের এই সমুদ্রতটটির নাম ‘নে সন’। তবে কেউ-কেউ একে ‘ওয়ে জঙ’ বিচও বলে। কিন্তু বিদেশিদের কাছে সাদা বালির জন্য এই সমুদ্রতট ‘সিলভার বিচ’ নামেই খ্যাত।
ইয়াঙ্গন থেকে প্লেনে করে আজ সকালেই এখানে এসেছে আদেশ। প্লেন থেকে নেমেই দেখেছিল এখানে বিদেশিদেরই ভিড় বেশি। আসলে দক্ষিণ এশিয়ায় থাইল্যান্ডের পরে মায়ানমারের এই সিলভার বিচ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে পশ্চিমি মানুষদের কাছে।
তবে আজ যারা বিচে যেতে চাইবে তাদের কপাল খারাপ, মনে-মনে ভাবছিল আদেশ। আজ বিচের গোটাটাই ঘিরে রেখেছে পুলিশ আর মায়ানমারের আধা-সামরিক বাহিনীর লোকজন। কারণ, আজ ভোররাতে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে এই পনেরো কিলোমিটার ছড়ানো সমুদ্রতটটিতে।
কালো পিচের রাস্তাটা বিচের পাশে-পাশেই চলেছে। ঠিক পুরীর সমুদ্রের পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তার মতো। তবে এখানে চারদিক খুব পরিষ্কার। বিচের দোকানপাট আজ খোলেনি। একটু দূরে-দূরে পুলিশের গাড়ি আর আধা-সামরিক বাহিনীর ট্রাক দাঁড়িয়ে।
এয়ারপোর্ট থেকে সরকারি গাড়িতেই এসেছে আদেশ। তাই সিকিউরিটির ঝামেলা ওকে পোয়াতে হয়নি বিশেষ। শুধু দুটো জায়গায় ওর পরিচয়পত্র দেখতে চাওয়া হয়েছে। তবে ‘ওশিয়ানিক লাইফ রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন’ এমন একটা সংস্থা, যাদের নামটাই ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রের মতো কাজ করে! এখানেও করেছে।
গাড়িটা আরও মিনিটপাঁচেক চলার পর রাস্তা ছেড়ে বিচের দিকে বাঁক নিল।
সামনে একটা বড় হলুদ রঙের তাঁবু খাটানো। গাড়িটা গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। আদেশ পাশে রাখা ব্যাগটা তুলে তাকাল উদয়ের দিকে। ওশিয়ানিক লাইফ রিসার্চ অর্গানাইজ়েশনের উদয় ওর জুনিয়র।
ওশিয়ানিক লাইফ রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সারা পৃথিবীতে এর অনেক শাখা আছে। আদেশ নিজে সাউথ ইস্ট রিজিয়নের সিনিয়ার সায়েন্টিস্ট। সমুদ্রের বিভিন্ন প্রাণী আর গাছপালা নিয়ে গবেষণা করাই ওদের কাজ। তেমন একটা কাজেই আদেশ আর উদয় এসেছিল চট্টগ্রামের কক্সবাজারের কাছে। আজ সকালে কক্সবাজারের হোটেলের ঘরেই আদেশ ফোন পায় ওর বস মিস্টার রাজন নাচাপ্পার থেকে। নাচাপ্পা ওকে বলে সব ছেড়ে এখুনি ওদের মায়ানমারের এই বিচে যেতে হবে। কাজটা খুবই জরুরি! ওরা যেন এখুনি এয়ারপোর্টে চলে যায়। এয়ারলাইন্সে ওদের টিকিট রিজ়ার্ভ করা আছে।
জিপের থেকে নেমে সামান্য আড়মোড়া ভাঙল আদেশ।
সামনেই একটা ব্যারিকেড মতো করা। আদেশরা ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই দু’জন আধা-সামরিক বাহিনীর লোক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল ওদের দিকে। আদেশ নিজের আইডেন্টিটি কার্ডটা দেখাল। সঙ্গে পকেট থেকে মায়ানমার সরকারের তরফ থেকে ওদের পাঠানো আর্জেন্ট ইনভিটেশন লেটারটাও বের করল।
“প্লিজ় স্যার,” গার্ডটি গেটের সামনে লাগানো শিকলটা সরিয়ে ভিতরে যাওয়ার পথ দেখাল ওদের।
আদেশ দেখল ওদের দেখে একজন ভদ্রলোক এগিয়ে আসছে ওই দূরের তাঁবুটা থেকে। দূর থেকে হলেও লোকটাকে চিনতে পারল আদেশ। রবার্ট জোন্স। একজন ফ্রিলান্স জার্নালিস্ট।
ও উদয়কে বলল, “এই লোকটাকে একটু সামলে কিন্তু। খ্যাপাটে ধরনের আছে। মাথাও গরম।”
উদয় অবাক হল, “খ্যাপা মানে?”
আদেশ বলল, “লোকটা আগে ‘এন ও এ এ’ মানে ‘নোয়া’-এ চাকরি করত। কিন্তু একটা ঝামেলায় চাকরিটা গিয়েছে।”
“নোয়া?” উদয় অবাক হয়ে তাকাল।
আদেশ বলল, “নোয়া জানিস না? নোয়া হল, ‘দ্য ন্যাশনাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। খুবই নামকরা সংস্থা। সেখানেই চাকরি করত এই বব।”
“বব! সেটা কে?” উদয় অবাক হল আবার!
“ওহ, তোকে কি সব বলে দিতে হবে? শোন, বিদেশে রবার্ট নামের লোকদের ডাকনাম হয় বব। রিচার্ডদের নাম হয় ডিক। বুঝেছিস? আলাদা করে এদের ডাকনাম রাখতে হয় না।”
“ও। কিন্তু নোয়া…”
উদয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না আদেশ। কারণ তার আগেই ববের চিৎকার শুনল, “হাই আদেশ! তুমি চলে এসেছ?”
আদেশ হাসল, “হ্যাঁ। কী ব্যাপার? এমন কী হয়েছে এখানে?”
বব বলল, “কী হয়নি? সারা পৃথিবী তলায়-তলায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ফল ভুগতে হচ্ছে এই নিরীহ প্রাণীদের।”
আদেশ দেখল ববের মুখটা রাগে লাল হয়ে আছে। সোনালি চুল আর দাড়িগুলো যেন বিড়ালের লোমের মতো খাড়া হয়ে আছে!
বব আবার বলল, “তুমি তো মেরিন বায়োলজিস্ট। তোমার মনে হয় না এসবের প্রতিবাদ করা উচিত? এখানে ওশিয়ানিক লাইফ রিসার্চ অর্গানাইজ়েশন থেকে তোমাকে ডেকে আনা হয়েছে কেন? আনা তো উচিত ছিল ইউনাইটেড নেশন্স-এর প্রতিনিধিদের। তাদের তো দেখা উচিত ছিল মানুষ কী শুরু করেছে চারদিকে। যাকগে, দেখবে চলো কী অবস্থা হয়েছে।”
বব ওদের জন্য অপেক্ষা না করে আবার এগিয়ে গেল সামনের দিকে। আদেশও ওর পিছন-পিছন হাঁটা দিল।
উদয় জিজ্ঞেস করল, “ইউনাইটেড নেশন্সের আসা উচিত ছিল মানে? বব এমন করে বলছে কেন? ‘নোয়া’ থেকে চাকরি গেল কেন ওর?”
আদেশ বলল, “সেটা অনেকবছর আগের ব্যাপার। দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে আমেরিকান নেভি আর দক্ষিণ আফ্রিকান নেভি একসঙ্গে জয়েন্ট এক্সারসাইজ় করার সময় ‘সোনার ওয়েপন’ পরীক্ষা করছিল। জানিস নিশ্চয়ই যে, সোনার ওয়েপন এক ধরনের শব্দাস্ত্র। এই অস্ত্র থেকে আলট্রাসনিক শব্দ জলের ভিতর এমন ভাবে ছাড়া হয় যে, তার প্রভাবে শত্রুপক্ষ মারা যায় বা অসাড় হয়ে পড়ে। এটা ওই দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে পরীক্ষা করার ফলে প্রচুর সামুদ্রিক প্রাণী মারা গিয়েছিল সে সময়! উপকূলের কয়েকটা বিচ তো মৃত হাঙর, ডলফিন, টার্টলে ভরে গিয়েছিল একদম। তখন নোয়ার হয়ে ওখানে গিয়েছিল বব। আর বব সেখানে এমন একটা জিনিস দেখেছিল যে…”
“যে?” উদয় বড়-বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করল।
কিন্তু এবারও কথা শেষ করতে পারল না আদেশ। হলুদ তাঁবুর সামনে থেকে দু’জন মিলিটারি পোশাক পরা মানুষ এগিয়ে এল ওদের দিকে।
“হ্যালো স্যার!” দু’জনের মধ্যে যিনি বয়স্ক তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন ওর দিকে, “আয়াম ডোরা সেইন। নেভাল কম্যান্ডার। ওয়েলকাম।”
“থ্যাঙ্কস,” আদেশ হ্যান্ডশেক করল।
কমান্ডার হেসে বললেন, “লেট মি গেট টু দ্য পয়েন্ট। গতকাল একদম আচমকা কিছু সামুদ্রিক প্রাণী মৃত অবস্থায় এই সিলভার বিচে ভেসে এসেছে। কিন্তু সব দেখে আমরা বুঝতে পারছি না কী ব্যাপার। ঘটনাটা যদিও আমরা এখনও গোপন রেখেছি, কিন্তু বুঝতেই তো পারছেন এটা একটা টুরিস্ট ডেস্টিনেশন। প্রচুর মানুষ আসেন এখানে। তাই তাদের থেকে খুব বেশি সময় এটাকে গোপন রাখতে পারব না। আমরা চাই আপনাদের সংস্থার তরফ থেকে মৃত প্রাণীদের পরীক্ষা করা হোক। দেখা হোক তাদের মৃত্যুর কারণ কী!”
“কারণ কী মানে?” পাশে দাঁড়ানো বব চিড়বিড় করে উঠল, “আরে, চায়নার সঙ্গে মিলে আপনারা বে অফ বেঙ্গলে সোনার ওয়েপন টেস্ট করছেন। তাই প্রাণীগুলো মারা গিয়েছে। আমরা জানি না নাকি?”
“প্লিজ় মি. জোন্স,” কমান্ডার গলা শক্ত করলেন, “এখানে আমরা কাউকে আসতে দিইনি। আপনাকে আসতে দিয়েছি। শুধু নিজের আতিথেয়তার মর্যাদা দিন।”
আদেশ দেখল ব্যাপারটা খারাপ দিয়ে বাঁক নিচ্ছে। ও বলল, “বব প্লিজ়। লেট মি হ্যান্ডল ইট।”
বব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করতে-করতে পিছিয়ে গেল কয়েকপা।
আদেশ বলল, “কম্যান্ডার, মৃত প্রাণীদের থেকে আমাদের টিস্যু, ব্লাড স্যাম্পেল আরও নানান জিনিস কালেক্ট করতে হবে।”
কমান্ডার বললেন, “হ্যাঁ যা লাগবে সব নিন। কিন্তু আপনারা সব কিছু টেস্ট করার পর বলবেন যে, এই সিলভার বিচে কোনও বিপদ নেই। আপনাদের রাজন নাচাপ্পা আমাদের কথা দিয়েছেন যে, আমাদের ফেভারেই রিপোর্ট দেবেন। আপনারা এখানে কিছুদিন থাকুন। ঘুরুন। আমাদের আতিথেয়তা উপভোগ করুন। তারপর আমাদের হয়ে রিপোর্ট দিন। সিম্পল।”
আদেশ চোয়াল শক্ত করল। এই জন্য রাজন তড়িঘড়ি ওকে এখানে পাঠিয়েছে! এখন ওকে এই সব করতে হবে? সত্যিটা চেপে মিথ্যে রিপোর্ট দিতে হবে! এসব দেখলে আদেশের মাথায় আগুন লেগে যায়!
“আসুন, যাওয়া যাক,” কম্যান্ডার পাশের লোকটিকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। ওরাও এগোল।
“একটা জিনিস দেখবে?” বব হাঁটতে-হাঁটতে পাশের থেকে ফিসফিস করে বলল এবার।
“কী?”
বব নিজের ডি এস এল আর ক্যামেরাটা বের করে অন করল। তারপর চট করে একবার দেখে নিল কম্যান্ডারকে। বলল, “এই দেখো।”
আদেশ দেখল ফোটোটা। একটা বড় হাঙর। আর তার পেটের কাছটা কাটা। সেখান থেকে অদ্ভুত একটা জিনিস বেরিয়ে রয়েছে।
“কী এটা? কোথায় পেলে?” আদেশ ঝুঁকে পড়ল স্ক্রিনের উপর।
বব বলল, “এটা একটা গুপ্তধন। আজ সকালে এসেই ভাগ্যবলে এটা আমি পেয়ে গিয়েছি বিচে। একটা মরা হাঙরের পেটের কাছে। তুমি সামনে চলো। তোমায় দেখাচ্ছি। কিন্তু ওদের সামনে এটা দেখে কোনও রকম রিঅ্যাক্ট করলেই ওরা জিনিসটা লোপাট করে দেবে। সত্যিটা আর বেরবে না মানুষের সামনে। এখনও এই কম্যান্ডার লোকটা জানে না ওর সামনে কী অমূল্য জিনিস পড়ে রয়েছে! জান আদেশ, এটার জন্যই নোয়া ছেড়েছি আমি। তারপর থেকে সারা পৃথিবীতে এটাকেই হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছি।”
“মানে?” আদেশ অবাক হয়ে তাকাল ববের দিকে।
বব বলল, “এটা এমন একটা জিনিস আদেশ যা সমস্ত দেশের সরকার মানুষের থেকে গোপন করে রাখতে চায়। তাদের বোঝাতে চায় এটা একটা মিথ। মিথ্যে। কিন্তু তারা আর পারবে না। আমি রবার্ট জোন্স এটা এবার তুলে ধরব সারা পৃথিবীর সামনে! এবার সবাই দেখবে সেই দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলে আমি ভুল দেখিনি! ভুল বলিনি! সবাই দেখবে এত হাজারবছর ধরে চলা একটা মিথ, একটা রূপকথা এবার কী করে সত্যি হয়ে ওঠে!”
২
শিরীষ গাছটা আরও বড় হয়ে গিয়েছে! দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেন ওদের বাগানটার মাথায় একটা বড় ছাতা মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
অ্যালবামে একটা ফোটো আছে। এই গাছটার সামনে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা দুই ভাই।
“কীরে তাতার, তোকে দুধ দিলাম ডাইনিং টেবিলে, খেলি না তো!” পিছন থেকে মাধুদার গলা শোনা গেল।
তাতার পিছন ঘুরে বলল, “ক্লাস সেভেনের ছেলেরা দুধ খায়? সত্যি মাধুদা! তুমি এখনও নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে পড়ে আছ!”
“কেন এই সেঞ্চুরির ছেলেরা কী খায়? খুব পেকেছিস না!” মাধুদা চোখ পাকাল।
“কেন এমন করছ মাধুদা?” তাতার গলা নরম করল। ও জানে মাধুদা ইলেকট্রিক মোটরের মতো। ঠিকঠাক গ্রিজ়-অয়েল করলেই মসৃণ ভাবে চলে।
“কী করছি?” মাধুদার গলাটা সামান্য নরম হল, “এই যে রোজ দেড় লিটার দুধ রাখা হয়, সেটা কার জন্য? তোর দাদা কলেজে পড়ে। সেও তো খেতে চায় না!”
তাতার বলল, “নতুন জায়গায় এসেছি তো। এবার ওটা এক লিটার করে দাও।”
“নতুন জায়গা!” মাধুদা কেমন থমকে গেল যেন। যেন মনে পড়ে গেল কিছু। বলল, “শেষবার এখান থেকে যখন গিয়েছিলাম তখন তোর বয়স ছিল চার। তোর হয়তো কিছুই মনে নেই। তাই নতুন লাগছে। আমাদের কাছে এই জায়গাটা নতুন নয় রে।”
তাতার চুপ করে গেল। সত্যি কিছুই প্রায় ওর মনে নেই। কিন্তু এখনও আচমকা কিছু-কিছু দৃশ্য ভেসে ওঠে ওর চোখের সামনে। বাদামকাঠের একটা হারমোনিয়ামের কথা ওর মনে পড়ে। আর মনে পড়ে মায়ের গলায় ঝোলানো পানপাতার মতো একটা সোনার লকেটের ভিতর আটকানো মায়ের সঙ্গে ওর আর দাদার ছোট্ট ফোটো!
মা! মায়ের কথা এমন ভাঙা-ভাঙা ভাবেই মনে পড়ে তাতারের। আর মাঝরাতে আচমকা ঘুম ভেঙে গেলে যেন মায়ের গা থেকে ভেসে আসা এলাচ-লবঙ্গের গন্ধ পায় ও! মা আজ নেই। কিন্তু যেতে-যেতে এই গন্ধের স্মৃতিটুকুই যেন ফেলে গিয়েছে ওর জন্যে!
“যাক গে,” মাধুদা যেন মনখারাপটুকু ঝেড়ে ফেলার জন্য বলল, “তুই দুধ না খেলে কিন্তু বাবাকে বলে দেব। তখন দেখবি মজা।”
বাবাকে সবাই ভয় পায়, তাতার জানে।
ও বলল, “বলো বাবাকে। তারপর বাবা যখন আমায় চড়-থাপ্পড় মারবে তখন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মজা দেখো।”
মাধুদা কিছু বলতে গিয়েও বলল না। কারণ, তাতার জানে বাবা বকলে বা মারলে মাধুদাই সবার আগে এসে আড়াল করে ওকে। মাধুদাকে ও দাদা বলে ডাকলেও মাধুদার বয়স পঞ্চান্ন। বাবার চেয়েও বছরসাত আটেকের বড়। সেই ছোট বয়স থেকে ওদের বাড়িতে আছে। বাড়ির সবটা মাধুদাই দেখে।
তাতার বলল, “দুধটা দিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দাও, খাব। কেমন? এখন আমি একটু বেরই? পরশু থেকে নতুন স্কুল, তার আগেই রাস্তাঘাটগুলো একটু রিভিশন করে নিই!”
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার এই জায়গাটার নাম মুকুটপুর। ছোট্ট সুন্দর ছবির মতো একটা টাউন এই মুকুটপুর। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গার একটা খাঁড়ি যেন এই সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এই খাঁড়িকে এখানকার লোকে বলে ছোট গাঙ।
ছোট হলেও এই মুকুটপুর জায়গাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বড় তেল কোম্পানির দুটো অয়েল স্টোরেজ আছে এখানে। আর তার সঙ্গে আছে কয়েকটা ইটখোলা আর জুটমিল।
এমনই একটা তেলের স্টোরেজে ওর বাবা সোমেন সিংহ মেনটেন্যান্স ম্যানেজার হয়ে এসেছেন।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে তাতার বড় রাস্তায় একটু দাঁড়াল। বাঁদিকে গেলে ছোট গাঙ। ডানদিকে টাউনের মূল বাজার। তাতার ডানদিকেই সাইকেল ঘোরাল।
তাতাররা যে বাড়িতে এসেছে সেটা ওদের নিজেদের বাড়ি। জেঠু আর বাবার ছেলেবেলাটা এই বাড়িতেই কেটেছে। তারপর জেঠু বিদেশে চলে যাওয়ার পরে বাবা এখানেই ছিলেন। কিন্তু ওই মায়ের ঘটনাটা হওয়ার পর কাজ নিয়ে চলে গিয়েছিলেন মুম্বই। কিন্তু এখন ঠাকুরদার অবর্তমানে বাড়ির দেখাশোনা করতে বাবা আবার ফিরে এসেছেন নতুন চাকরি নিয়ে।
তা ভালই হয়েছে। মুম্বইয়ে যেখানে ছিল সেই জায়গাটা ভাল লাগত না তাতারের। কেমন রুখাসুখা যেন। আর এখানে কত্ত জল! আসলে জল তাতারকে পাগলের মতো টানে। খুব ছোট বয়স থেকেই সাঁতার কাটতে পারে তাতার। আর তখন থেকেই জল দেখলে ওর মনে হয় কে যেন জলের ভিতর থেকে ওকে ডাকছে।
মাধুদা বলে, “একদম তোর মায়ের মতো হয়েছিস!” কে জানে, হবেও বা! তাতারের তো আর মনে নেই!
আর এটাতেই বাবার আপত্তি। বাবা কিছুতেই তাতারকে জলে নামতে দেন না। দাদাও ভাল সাঁতার কাটে। কিন্তু দাদাকেও বাবা জলের ধারেকাছে ঘেঁষতে দেন না। কেন যে বাবা এমন করেন কে জানে! বাবা কি ভিতু? কিন্তু মাধুদার থেকে শুনেছে বাবাও নাকি ছেলেবেলায় প্রচণ্ড দুষ্টু ছিল। মাধুদা বলে, “তোর বাপের মতো এমন দস্যি আমি কোনওদিন দেখিনি!”
কিন্তু সেই দস্যি ছেলেটা গেল কোথায়? এই বাবা তো মনমরা, রাগী আর সব সময় ভয় পাওয়া এক মানুষ!
সাইকেলটা আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল তাতার। এক্ষুনি বাজে একটা ব্যাপার ঘটে যেত। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল তাই ঠিক খেয়াল করেনি যে, চাকার সামনে ছোট্ট তুলোর বলের মতো একটা বিড়ালছানা চলে এসেছে।
সাইকেল থেকে নেমে ছানাটাকে আলতো করে তুলল তাতার। ছোট্ট, সাদা উলের গোল্লা যেন।
“এই যে, আমার বিড়াল চুরি করা হচ্ছে!”
একটা পাতলা গলার স্বরে মুখ তুলে তাকাল তাতার। ভীষণ রোগা আর বেঁটে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ছেলেটার মুখটা সরু। মাথার চুলগুলো স্পাইক করা। দেখে মনে হচ্ছে ওর মতোই বয়স।
“চুরি?” তাতার চোয়াল শক্ত করল, “আমার সাইকেলের সামনে চলে এসেছিল। তাই…”
“তাই নিয়ে কেটে পড়ার ধান্দা, না?”
তাতার পায়ে-পায়ে এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে, “কেটে পড়ার ধান্দা থাকলে তোমার মতো সাড়ে চারফুট আমায় আটকাতে পারত! নিজের বিড়ালকে সামলে রাখতে পার না?”
“তবে রে আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছিস! তুই জানিস আমি কে?” রোগা ছেলেটা মেজাজ নিয়ে বলল।
তাতারও পালটা বলল, “কেন তুই কি ভুলে গিয়েছিস নিজের নাম?”
“আমি চারু। আমার বাবা এখানকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী। বুঝেছিস?”
তাতার বিড়ালটা চারুর হাতে দিয়ে বলল, “সামলে রাখতে পারলে তবেই পুষবি। আর যদি ফের গায়ে পড়ে ঝগড়া করিস না, পিটিয়ে লম্বা করে দেব। মনে থাকে যেন।”
চারু বলল, “ঠিক আছে। এক মাঘে শীত যায় না। আমিও তোকে দেখে নেব।”
তাতার হেসে বলল, “এটা সবে মে। মাঘ আসতে সেই পরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি, বুঝলি!”
চারু চোয়াল শক্ত করে বলল, “কিন্তু সেটাও তো একদিন আসবে। তখন দেখবি কী করি!”
৩
নিজের ছোট্ট কিউবিকলটায় ফিরে চোখ বন্ধ করে একটু বসল আদেশ। মাথা ঝাঁঝাঁ করছে। মুখ, চোখ লাল হয়ে গিয়েছে অপমানে। এটা ওকে বলতে পারল রাজন! ও সস্তার পাবলিসিটি চাইছে? মিথ্যে কথা বলে নাম করতে চাইছে? ওর সব প্রমাণ বানানো? ওই সিলভার বিচ থেকে তোলা স্টিল ফোটো, ভিডিয়ো ফুটেজ সব মিথ্যে?
আর এর উপর রাজন কী করল, না ফোনে মায়ানমারের অফিশিয়ালদের বলে দিল সব গোপন রিপোর্ট! এখন তারা তো সব কিছু সরিয়ে ফেলবে!
আদেশ চোখ খুলে তাকাল এবার। না, রাগ করে লাভ নেই। এতে ওর নিজেরই ক্ষতি। তবে ও হারবে না। গোটা অফিসের সামনে রাজন যেভাবে ওকে অপমান করেছে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। এর একটা বিহিত ওকে করতেই হবে।
সামনের জলের বোতল থেকে একটু জল খেল আদেশ। তারপর টেবিলের ফাইলটা টানল। এতেই সব রিপোর্টগুলো রয়েছে। এগুলো আবার ও ভাল করে দেখবে একবার। নিজে আবার নিশ্চিত হয়ে নেবে সত্যিটা সম্বন্ধে। তারপর যা করার করবে।
একঘণ্টা পর ফাইল বন্ধ করে উঠল আদেশ। মাথাটা ঠান্ডা হয়েছে। কারণ গত একঘণ্টা ধরে ফাইলটা উলটেপালটে দেখে ও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে যে, ও যা ভাবছে সেটাই সত্যি। তা রাজন যাই বলুন না কেন।
এবার কিউবিকল থেকে বেরল আদেশ। ক্যাফেটেরিয়ায় যাবে একবার।
ওদের এই অফিসটা দিল্লিতে। মায়ানমারে ওদের কাজ শেষ করতে তিনদিন লেগেছে। মৃত প্রাণীদের নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলোকে ভাগ করে, প্রিজ়ার্ভ করে ল্যাব টেস্টের জন্য জমা দিয়ে তবে ফিরতে পেরেছে দিল্লিতে।
দিল্লিতে ফিরে কয়েকদিন পর ল্যাব টেস্টের রেজাল্ট পেয়ে খুব এক্সাইটেড হয়েছিল আদেশ। বুঝতে পারছিল ওর হাতে যা প্রমাণ এসেছে তা পৃথিবীর সামনে রাখলে সব্বাই চমকে উঠবে। বুঝতে পারছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদকে আবার নতুন আলোয় দেখা শুরু করবে বিজ্ঞান। জীববিদ্যার ইতিহাসে এটা আমেরিকা আবিষ্কারের মতো একটা ব্যাপার হবে! কিন্তু তার বদলে কী হল!
ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে এককাপ কফি নিয়ে ব্যালকনির একপাশে সরে এল আদেশ। চোদ্দো তলার উপরের এই ব্যালকনিতে হাওয়া খুব বেশি। সামনে অনেকটা দূর দেখা যায়। দূরে কুতুবমিনারটাকে দেখে আদেশের মনে হচ্ছে যেন মহাকাশে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত কোনও রকেট!
“আদেশদা, তুমি এখানে কী করছ?”
উদয়ের প্রশ্নে পাশে তাকাল আদেশ। ছেলেটা গাজিয়াবাদ গিয়েছিল অফিসেরই একটা কাজে। একটু আগে ফিরেছে হয়তো। নিশ্চয়ই এখনও ও আদেশের হেনস্থার খবরটা জানে না।
আদেশ বলল, “কিছু না। ওই কুতুবমিনারটা দেখছি। ভাবছি এটাকে সবাই মিনার হিসেবেই জানে, কিন্তু যদি এটা বহু পুরনো সময়ে এলিয়েন টেকনোলজি দিয়ে বানানো কোনও রকেট হয়, তবে?”
“এলিয়েন হয় নাকি? যাহ!” উদয় মাথা নাড়ল, “ওসব ফিকশন। সায়েন্স ফিকশন।”
“জানিস, নাইনটিন্থ সেঞ্চুরিতে জুলে ভার্ন যখন নটিলাসের কথা বলেছিলেন, এক শহর থেকে অন্য শহরে ছোড়া যায় এমন বোমার কথা বলেছিলেন বা যখন লোহার অভেদ্য গাড়ির কথা বলেছিলেন তখনও তোর মতো লোকজন বলেছিল ওসব ফিকশন। কিন্তু আজ এই একুশ শতকে সাবমেরিন, ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা প্যাটনট্যাঙ্ক কিন্তু রিয়্যালিটি। তাই কোনও কিছুকে এমন ফিকশন বলে উড়িয়ে দিস না।”
“তা বলে এলিয়েন! এর পর তো বলবে ইয়েতিও আছে!”
“এলিয়েন আছে কি না প্রমাণ হয়নি। কিন্তু নেই সেটাও কি প্রমাণ হয়েছে? আর ইয়েতি? ক্রিপ্টোজুলজ়ি জানিস তো?” আদেশ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “সেখানে অদ্ভুত লাইফ ফর্ম নিয়ে গবেষণা করা হয়। যেমন ধর, লকনেস মনস্টার! সেখানে ইয়েতি নিয়েও কিন্তু গবেষণা হয়! এসব গল্পকথা বলে বেশির ভাগ মানুষ উড়িয়ে দিলেও কয়েক হাজারবছরের মানুষের ইতিহাসে কিন্তু এমন অদ্ভুত প্রাণীদের কথা বারেবারে এসেছে। সে ইজিপ্টের ওল্ড স্ক্রিপচারেই বল বা এনশিয়েন্ট মেরিনার্স বা পাহাড়ের প্রাচীন মানুষদের কথাই বল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন সময়ের মানুষেরা কী করে একই রকম কথা বলল বল তো? সেই সময়ে তো নিউজ়পেপার ছিল না। ইন্টারনেট ছিল না। ইনফরমেশন শেয়ার করার তো উপায়ই ছিল না কোনও। তবে? আমরা পৃথিবীর কতটুকু জেনেছি বল তো! কতটুকু!”
“তুমি রাজনস্যারের কথায় খুব আপসেট হয়ে গেছ, না?” উদয় আচমকা বলল, “না হলে ক্রিপ্টোজুলজ়ির মতো সিউডো সায়েন্স থেকেও এগজ়্যাম্পল দিচ্ছ!”
“মানে? তুই…তুই তো ছিলি না অফিসে!” আদেশ কী বলবে বুঝতে পারল না।
“আদেশদা, তুমি ভুলে যাচ্ছ এখন কিন্তু ইন্টারনেট, মোবাইল সবই আছে।”
আদেশ কাপের কফিটুকু শেষ করে কাপটা পাশের ডাস্টবিনে ফেলে বলল, “তুই বল উদয় আমরা যা দেখেছি, যা ফোটো তুলেছি সেটা কি ভুল? সেখানে রাজনস্যার আমায় যা নয় তাই বললেন! তারপর…”
“তারপর?”
“জানিস, আমায় উনি মিডল ইস্টের অফিসে বদলি করে দিচ্ছেন। কোনও মানে হয়? চোখের সামনে সব প্রমাণ রাখলাম আর উনি বললেন এগুলো নিয়ে যেন ফারদার কথা না বলি! আমি নাকি নাম করার জন্য এসব গল্প বানাচ্ছি!”
“তুমি কী করবে ভাবছ?” উদয় জিজ্ঞেস করল।
আদেশ চোয়াল শক্ত করে বলল, “আমি ছাড়ব না। তিনমাসের একটা লিভ উইদাউট পে নেব। তারপর দেখব ব্যাপারটা। বঙ্গোপসাগরের উপকূল ধরে-ধরে আমি দেখব।”
“কী দেখবে আদেশদা? কেন শুধু-শুধু ঝামেলা করছ! ভাল চাকরি, এত ভাল প্রসপেক্ট! কী হবে এসবে ঢুকে? রাজনস্যারের সঙ্গে মিটিয়ে নাও ব্যাপারটা।”
“ভাল চাকরি? ভাল মানে তো আমার নিজের ভাল। কিন্তু সেটা কি সত্যিকারের ভাল উদয়?” আদেশ বাইরের দিকে তাকাল।
“সেটা সত্যিকারের ভাল নয়?”
আদেশ বলল, “না নয়। প্রাচীন গ্রিসের হাইপেশিয়া, ইতালির গ্যালিলেও বা পরের নিকোলাই টেসলা, এঁরাও তো নিশ্চিন্তে থাকতে পারতেন রে। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিশ্চিন্ত থাকার চেয়ে সত্যিটা সবার সামনে তুলে ধরতেই বেশি আগ্রহী হন। আমি যা দেখেছি তা আমি আরও প্রমাণসহ পৃথিবীর সামনে নিয়ে আসব। পৃথিবীর লোক জানবে রূপকথায় শোনা জলপরি কল্পনার জীব নয়, জলের গভীরে আজও এরা সত্যি বেঁচে আছে!”
৪
খাঁড়ির এদিকটায় বিশেষ কেউ আসে না। কেমন যেন নির্জন জায়গাটা। বড়-বড় ঝাঁকড়া গাছ আর খয়েরি রঙের ছায়ায় ঢাকা। মুকুটপুরে ওর দু’সপ্তাহ হয়ে গেলেও এদিকটায় আজ প্রথম এল তাতার।
“এই তাতার, আর যাস না। এবার ফিরে চল,” পাশ থেকে গামা ওর টি-শার্টটা টেনে ধরে বলল।
গামা মানে, গগনেন্দ্ৰ মুখুটি। ওর ক্লাসেই পড়ে। প্রথমদিন স্কুলে গিয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কী করে যে বন্ধুত্ব হল সেটাই আশ্চর্যের। তাতার যতটা দুষ্টু আর ডানপিটে, গামা ততটাই নিরীহ, ভাল৷
গামা রোগা। ওর মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। হাই পাওয়ারের চশমার পিছনে বড় গোল-গোল চোখ। দেখে মনে হয় সব সময় যেন অবাক হয়েই আছে।
গামা আবার বলল, “এই তাতার, এদিকটা কিন্তু ভাল নয়। ফিরে চল।”
“কেন ভাল নয় কেন?” তাতার তাকাল, “এখানে রাক্ষসের বাড়ি আছে? তারা কি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ধরে রাখে? হ্যান্সেল আর গ্রেটেল কি এখানেই ডাইনিবুড়ির খপ্পরে পড়েছিল?”
“আহ, কী বিপদ!” গামা ছটফট করল, “তুই সবসময় তর্ক করিস কেন রে? আমি এই মুকুটপুরে ছোট থেকে আছি। জানি বলেই বলছি। এখানে নানান খারাপ লোকের আনাগোনা। জুটমিল, তেলের স্টোরেজের লোভে বাজে লোকেরা এসে জোটে। তা ছাড়া সান্টাবুড়োও থাকে এদিকে। চল।”
“সান্টাবুড়ো? মানে?” তাতার সাইকেল থেকে নেমে ভুরু কুঁচকে তাকাল গামার দিকে।
গামা কিন্তু সাইকেল থেকে নামল না। বলল, “সে আছে। তোকে পরে বলব। আগে এই জায়গা থেকে চল। তোর জন্য বিপদে পড়ব।”
“আমার জন্য মানে?” তাতারের রাগ হল, “তুই ভিতুর ডিম।”
গামা বলল, “তুইও রাগ করবি আমার উপর? আমি কি তাই বললাম নাকি?”
তাতার দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “গামা তো নামী একজন পালোয়ান ছিলেন! তোর এমন নাম কে রেখেছেন বল তো? শোন, যে ভয় পায় তাকে সবাই ভয় দেখায়, বুঝেছিস?”
গামা বলল, “তাও, এখান থেকে চল। এই জায়গাটা ভাল না।”
তাতার চারদিকটা দেখল ভাল করে। ওর তো তেমন ভয়ংকর লাগছে না!
গামাকে পিছনে রেখেই সাইকেলটা হাঁটিয়ে নিয়ে সামনের দিকে এগোল তাতার। খাঁড়ির সমান্তরাল হয়ে পথ গিয়েছে। পাশে লম্বা গাছগাছালির জঙ্গল। পথটা যেন তার ভিতর দিয়ে হারিয়ে গিয়েছে সামনে। তাতার সেই পথ ধরে চলতে লাগল।
“কী যে করিস না!” পিছন থেকে সাইকেল চালিয়ে গামা এসে থামল ওর পাশে, “নিজে মরবি, আমাকেও মারবি।”
তাতার হাসল। গামা পিছনে একা দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাচ্ছে। না।
তাতার আরও কিছুটা এগোল। তারপর রাস্তার পাশে সাইকেলটা রেখে ছোট ঝোপ সরিয়ে এগিয়ে গেল খাঁড়ির দিকে। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারল না। খাঁড়ির পাড়ে একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল ও।
“ওটা কী?” তাতার তাকাল গামার দিকে।
গামা ঢোক গিলল একটু। তারপর বলল, “মোটরবোট। সান্টাবুড়োর মোটরবোট।”
“সান্টাবুড়ো? মানে?”
“মানে আমি,” আচমকা পিছন থেকে গমগম করে উঠল একটা গলা!
তাতার চমকে উঠে ঘুরতে গিয়ে দেখল গামা ভয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছে। ও নিজেও ভয় পেয়েছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। শুধু নিজের বুকের ভিতরে ছুটতে থাকা হাজারটা ঘোড়াকে সামলাতে- সামলাতে দেখল ওদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্যান্টাক্লজ়ের মতো সাদা দাড়ি-গোঁফ ঢাকা বড়সড় চেহারার একজন বৃদ্ধ!
৫
ডোরবেলটা পাখির মতো দু’বার ডেকে উঠে থেমে গেল। সামনের ব্যাগের চেনটা টেনে বন্ধ করে মুখ তুলে তাকাল আদেশ। দশটা বাজে। এমন রাতে কে এল এখন?
দিল্লির এই ফ্ল্যাটটা ছোট। ওয়ান বি এইচ কে।
সামনের বেশ কিছুদিন ফ্ল্যাটটা বন্ধ থাকবে। প্রথমে তিনমাস বললেও পরে ছ’মাসের জন্য অফিসের থেকে লিভ উইদাউট পে নিয়েছে আদেশ।
কথাটা শুনে উদয় যেমন আপত্তি করেছিল, তেমনই কলকাতার বাড়িতে আদেশের বাবা-মাও খুব রাগ করেছিলেন। বাবা তো বলেছিলেন, “আজকের দিনে এমন কেউ করে? তোর মাথা ঠিক আছে তো? ছেলেবেলা থেকেই তোর নিজের মর্জিমতো চলার অভ্যেস। আমি কোনওদিন কিছু বলিনি। কিন্তু তা বলে এমন পাগলামো করবি আর আমি চুপ করে থাকব? তুই যা খুঁজছিস সেটা তো রূপকথার গল্প রে! এবার তো বলবি ইউনিকর্নও আছে!”
আদেশ বলেছিল, “আমি জানি কী করছি। জানি পৃথিবী প্রমাণ ছাড়া কিছু মানতে চায় না। তাই সেই প্রমাণটা জোগাড় করার জন্যই আমি ছ’মাস সময় নিলাম। তা ছাড়া রাজন আমায় যেভাবে অপমান করেছে তার একটা উত্তর তো দিতেই হবে! ছেলেবেলার কথা যখন বললে, তখন এটাও তো জান কেউ আমায় অপমান করলে সেটার শেষ না দেখে আমি ছাড়ি না। তার জন্য আমায় যা করতে হয়, করি!”
দরজাটা খুলে আদেশ জিজ্ঞেস করল, “তুই? এখন?”
“ভিতরে আসতে দেবে না?” উদয় কথাটা বলে আদেশের উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওকে ঠেলে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল।
আদেশ জিজ্ঞেস করল, “সে তো ঠিক আছে। কিন্তু এমন সময় তুই?”
উদয় হাতের প্লাস্টিকের প্যাকেট থেকে দুটো বড় প্যাকেট বের করে বলল, “কাল চলে যাচ্ছ। আবার কবে দেখা হবে জানি না। তাই ভাবলাম বিরিয়ানি নিয়ে যাই তোমার জন্য।”
“তাই?” আদেশ হাসল, “থ্যাঙ্কস। তবে তুই শুধু-শুধু এটা…”
ওকে কথা শেষ করতে দিল না উদয়, “শুধু-শুধু কাজটা আমি করছি না আদেশদা, তুমি করছ! আমি তো এখনও ভাবতে পারছি না এমন কেউ করতে পারে!”
আদেশ কিছু না বলে তাকিয়ে রইল উদয়ের দিকে।
উদয় আবার বলল, “আদেশদা, তুমিই বলো, পৃথিবীতে স্থলভাগের পরিমাণের চেয়ে জলভাগের পরিমাণ কত বেশি! তাই না!”
“তো?” আদেশ উদয়ের দিক থেকে চোখ সরাল না।
উদয় মুখ-চোখ লাল করে উত্তেজিত হয়ে বলল, “আমি ধরে নিলাম যে, তুমি যা বলছ সেটাই সত্যি। কিন্তু এত ভাস্ট ওশান! এত হাজার-হাজার স্কোয়্যার মাইল জলভাগ! সেখানে তুমি কী করে খুঁজে পাবে মারমেড! এটা বাস্তব!”
আদেশ বলল, “আমি এই ক’দিনে বাড়িতে বসে কিছু-কিছু ছক করেছি। সারা পৃথিবীর সামুদ্রিক স্রোতের প্যাটার্ন। তিমিমাছেদের গতিপথের প্যাটার্ন। আর ডলফিনদের পপুলেশন প্যাটার্ন। তোর এই মারমেডদের খোঁজার ব্যাপারটা যত দূর অসম্ভব মনে হচ্ছে, আসলে সেটা তত দূর অসম্ভব কিন্তু নয়।”
উদয় হাঁ করে তাকিয়ে রইল সামান্য সময়। তারপর বলল, “মানে? এই সব প্যাটার্ন দেখে তুমি কিছু পেয়েছ বলছ? তাই কলকাতার দিকে যাচ্ছ?”
আদেশ হাসল, “কলকাতার দিকে যাচ্ছি অন্য কারণে। অনেক দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করিনি। ইচ্ছে আছে ওখানে কয়েকটা দিন কাটাব। কাজের আগে দম নিয়ে নিতে কলকাতায় যাচ্ছি বলতে পারিস।”
উদয় কী বলবে যেন বুঝতে পারল না। বলল, “খাবারটা গরম আছে। আমি টেবিলে সার্ভ করে দিই?”
আদেশ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে শোয়ার ঘরের দিকে এগোল। শেভিং কিটটা নিতে ভুলে গিয়েছে। ওটা ব্যাগে ঢোকাতে হবে।
বিরিয়ানি থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে! আদেশ বসে পড়ল। তারপর থালাটা টেনে নিতে-নিতে বলল, “তুই এমন মুখ করে আছিস কেন?”
উদয় বলল, “একটা মিথের পিছনে না দৌড়লেও পারতে।”
আদেশ বলল, “মিথ! এটাই আশ্চর্যের জানিস। এত প্রমাণ থাকার পরও মারমেডদের বলা হয় মিথ! আমরা ওই সিলভার বিচে যে দেহাংশটা পেয়েছি সেটার রিপোর্ট তো তুই দেখেছিস! প্রাণটার শরীরে ইলিয়্যাক ক্রেস্ট রয়েছে। ঠিক যেমন মানুষের শরীরে থাকে। প্রাণীটার কোমরের নীচের যেটুকু অংশ পাওয়া গিয়েছে তাকে স্ক্যান ও মডেল রিকনস্ট্রাকশন করে হাড়ের যে ফরমেশন পাওয়া গিয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, এরা একসময় হাঁটতে পারত। হাতের যেটুকু অংশ পাওয়া গিয়েছে তাতে বোঝ যাচ্ছে যে, এর হাতের ছোট-ছোট হাড়, মানে ফ্যালাঞ্জেসগুলোর গঠনও মানুষেরই মতো। প্রাণীটার দাঁতের গঠনটা মনে করে দ্যাখ। অন্যান্য জলচর প্রাণীদের মতো মনোডেন্ট কিন্তু নয় এদের দাঁত। বরং স্তন্যপায়ীদের মতো মোলার, ইন্সিসার ইত্যাদি নিয়ে দাঁত গঠিত। আর প্রাণীটার সঙ্গে পাওয়া বর্শার মতো জিনিসটা দেখেও বোঝা যাচ্ছে এটা উন্নত এক লাইফ ফর্মের দ্বারা তৈরি। তবে!”
“তবে কী আদেশদা? গোটা প্রাণীটা পাওয়া গিয়েছে কি?”
“আর যেটুকু পাওয়া গিয়েছে, তা তো মায়ানমার সরকারের লোকজন রাজনের থেকে খবর পেয়ে সরিয়ে দিয়েছে। শোন উদয়, চাঁদের মাটিকে মানুষ যেভাবে খুঁটিয়ে দেখেছে তার সিকিভাগ এফর্টও তারা সমুদ্রের তলা খোঁজায় দেয়নি। আর অ্যাক্রস দ্য সেঞ্চুরিজ় কত-কত মানুষ এই মারমেডদের কথা বলে গিয়েছে বল তো! এখনকার কত ভিডিয়ো আছে যেখানে মারমেডদের দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা সেগুলো বানানো বলে যদি উড়িয়েও দিই, তা হলেও পুরনোদিনের ভাইকিং থেকে শুরু করে চাইনিজ় নাবিক, উনিশ শতকের তিমি শিকারিরা, কলম্বাস, হেনরি হাডসন। কে না বলেছেন এদের কথা? কেন মারমেডদের কথা বলেছেন এঁরা? তখনকার দিনে মিথ্যে বলে এঁদের কী লাভ?”
“তোমারই বা কী লাভ এদের খুঁজে বের করে?” উদয় জিজ্ঞেস করল, “এমন একটা প্রাণীকে খুঁজে পেলে মানুষের কী উপকার হবে?”
“হবে, নিশ্চয়ই হবে। জলের গভীরেই কিন্তু পরবর্তী পৃথিবীর সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। কে বলতে পারে এমন প্রাণীদের থেকে আমরা জলের গভীরের জীবন সম্বন্ধে আরও তথ্য জানতে পারব না! হয়তো খাদ্যসংকট মোকাবিলা করার সুযোগ আসবে। হয়তো দুরারোগ্য কোনও অসুখের ওষুধ এদের সাহায্যেই খুঁজে পাব জলের তলার ফ্লোরা আর ফনা থেকে। কোটি-কোটি টাকা যে রিসার্চের পিছনে বেরিয়ে যায় সেটা বেঁচে যাবে সরকারের। সেটা তাঁরা আরও দরকারি কাজে লাগাতে পারবেন! কে বলতে পারে মানুষের বেঁচে থাকার ধরনটাই হয়তো বদলে যাবে এই প্রাণীদের হাত ধরে!”
উদয় দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুধু। তারপর বলল, “এতই যদি সব হয়, তা হলে গভর্নমেন্ট এদের খোঁজে না কেন?”
আদেশ বলল, “হয়তো খুঁজে পেয়েছে। হয়তো জানে এদের অস্তিত্ব। কিন্তু তারা হয়তো চায় না সাধারণ মানুষ এসব জানুক। তাই আমার মতো যারা মারমেডদের নিয়ে কথা বলে তাদের চুপ করিয়ে দিতে চায়।”
“এটা কনট্রাডিক্টারি কথা হয়ে গেল না? মানুষের যেখানে ভাল হবে সেখানে বিভিন্ন দেশের সরকার কেন চাইবে এদের কথা লুকিয়ে রাখতে?”
আদেশ হাসল এবার। খাওয়া শেষ করে থালাটা সরিয়ে রাখতে-রাখতে বলল, “হয়তো তারা চায় না মানুষের মনে প্যানিক আসুক। চায় না মারমেডদেরও শিকারিরা শিকার করে শেষ করে দিক। বা হয়তো তারা চায় না…”
“কী চায় না?” উদয় অবাক হয়ে তাকাল।
আদেশ বলল, “ইনফরমেশন ইজ় পাওয়ার। সাধারণ মানুষের কাছে সব পাওয়ার চলে গেলে সেটা কিন্তু খুব একটা সুখের হয় না সব সময়। তা ছাড়া বিশ্ব রাজনীতি অনেক গভীর জলের ব্যাপার উদয়। আমি জানি এই অনুসন্ধানের পথ সহজ হবে না। কিন্তু তাও আমায় সত্যিটা বের করতেই হবে। যেভাবেই হোক করতে হবে, বুঝেছিস!”
৬
আজ তাতারের মন খারাপ। যেন বুকের ভিতরে মেঘ করে রয়েছে।
তবে সকালটা এমন ছিল না একদমই। বরং আজ স্কুল ছুটি বলে মনে-মনে বেশ আনন্দেই ছিল তাতার। ভাবছিল একটু লেখাপড়া করে গামার সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।
মাধুদার আনা ডিমের পোচ আর স্যান্ডউইচ খেয়ে তাড়াতাড়ি পড়তেও বসে গিয়েছিল তাতার। কিন্তু গোলমালটা বেধেছিল তার পরেই।
তাতার সবে জিওগ্রাফি বইটা খুলেছে, এমন সময় মাধুদা এসে বলেছিল, “তাতার বাইরের ঘরে আয় তো। সামু তোকে ডাকছে।”
বাবা ডাকছে! তাতার বেশ অবাক হয়েছিল। বাবা সকালে অফিস বেরবার সময়টা বেশ তাড়ায় থাকেন। খুব দরকার না পড়লে কারও সঙ্গেই বিশেষ কথা বলেন না।
“বাবা,” তাতার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে।
সোমেন গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “তুই আবার আমার কথা অমান্য করেছিস?”
“আমি?” তাতার বুঝতে পারছিল না ঠিক কী করেছে ও!
সোমেন বলেছিলেন, “রণজয়বাবু যদি আমায় আজ এসে না বলতেন তবে তো আমি জানতেই পারতাম না। তুই নাকি আজকাল প্রায়ই ছোট গাঙের ওইদিকে নির্জন জায়গায় ঘোরাঘুরি করিস?”
তাতার কিছু বলার আগে চট করে একবার গামাকে দেখে নিয়েছিল। এটা নির্ঘাত ওই ভিতুর ডিমটার কাজ!
সোমেন বলেছিলেন, “আমার দিকে তাকা। কেন গিয়েছিস ওখানে? গামা তোকে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও তুই কেন গিয়েছিস? জানিস না ওই জায়গাটা ভাল নয়!”
তাতার চোয়াল শক্ত করে গামার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “তুই নালিশ করেছিস?”
“বেশ করেছে,” সোমেন উঠে এসে আচমকা কানটা পেঁচিয়ে ধরেছিলেন তাতারের। বলেছিলেন, “তোকে আবার বলছি, এসব করবি না।”
“আহা, ওকে মারবেন না প্লিজ়,” গামার বাবা ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, “আমি কিন্তু নালিশ করতে আসিনি। যাতে কোনও বিপদ না ঘটে সেটা শুধু বলতে এসেছি। প্লিজ় সোমেনবাবু, আপনি ওকে মারবেন না।”
সোমেন তাতারের কানটা ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি অফিসে বেরচ্ছি। তোর দাদাও কলকাতায় গিয়েছে। তুই কিন্তু সারাদিন ঘর থেকে বেরবি না। মনে থাকে যেন।”
তাতারের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। গামাটা যে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করবে, সেটা বুঝতেই পারেনি।
তাতার ভাবল যতই যে যা বলুক আর করুক, ও একাই ওইদিকে যাবে। কারণ ওখানে ওই যে মানুষটি থাকেন তাঁর সম্বন্ধে ওর খুব কৌতূহল হয়!
সেদিন অমন করে পিছন থেকে গম্ভীর গলাটা শুনে প্রথমে তো বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল তাতার। অমন বড় চেহারার একজন সাদা দাড়ি-গোঁফওয়ালা মানুষ তো খুব একটা দেখেনি ও! তার উপর আবার লোকটার হাতে একটা বন্দুক! তাতারের বুকের ভিতরে যেন হাজার-হাজার ঘোড়া দাপাচ্ছিল!
“কী করছ তোমরা এখানে?” মানুষটার বাংলায় কেমন যেন একটা টান ছিল।
তাতার বলেছিল, “এক্সপ্লোর করছি স্যার। মানে চারদিকটা দেখছি।”
“কী নাম তোমাদের?”
তাতার নিজের আর গামার নাম বলেছিল। আর দেখেছিল মাটিতে বসে গামা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।
“গামা! লাইক দ্যাট পালোয়ান!” এই প্রথম বৃদ্ধের মুখে হাসি দেখেছিল তাতার।
ও সাহস পেয়ে বলেছিল, “আপনার নাম কী? সান্টাক্লজ় তো নয়। আর ওই মোটরবোটটা আপনার?”
“হ্যাঁ মোটরবোটটা আমার,” বৃদ্ধ বলেছিলেন, “আমার নাম জন প্রেসলে।”
“কিন্তু আপনার বাংলা…” তাতার অবাক হয়ে গিয়েছিল।
“ছোট থেকে আমি কলকাতায় মানুষ,” জন বলেছিলেন, “তোমরা ইংলিশ শিখতে পার কিন্তু আমরা বাংলা শিখলে অবাক হও কেন?”
তাতার মাথা নেড়েছিল, “ঠিক বলেছেন।”
জন বলেছিলেন, “এখন আমার রিটায়ার্ড লাইফ। এই নির্জনতা আর জল আমায় শান্তি দেয়! আর রহস্য আমায় টানে!”
“রহস্য মানে?” তাতার অবাক হয়েছিল।
জন বলেছিলেন, “ইউ আর টু ইয়ং টু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট ল্যাড।”
“আচ্ছা, ওই বোটটা আপনার? আমাদের চড়তে দেবেন?” তাতার কথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
“না, দেব না,” জনের গলার স্বর পালটে গিয়েছিল আচমকা। উনি বলেছিলেন, “এখানে একদম আসবে না। জায়গাটা ভাল নয়। বেশি এক্সপ্লোর করতে হবে না। এখন যাও।”
সেদিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলেও পরে আরও বেশ কয়েকবার সেখানে গিয়েছে তাতার। গামাও ছিল সঙ্গে। কিন্তু আর কোনওবারই জনকে দেখতে পায়নি। শুধু দেখেছে ওই মোটরবোটটা। দেখেছে ছোট গাঙের ধারে বাঁধা অবস্থায় সেটা অল্প- অল্প দুলছে! তাতার ঠিক করেছিল, জন যতই ‘না’ বলুন, ওটায় একদিন ও চড়বেই!
চড়া তো হলই না! উলটে…তাতারের মাথার ভিতরে যেন চায়ের জল ফুটছে। গামা ব্যাটা ভিতুর ডিম। আর কোনওদিনও যদি গামার সঙ্গে কথা বলে ও!
তাতার বইপত্র গুছিয়ে ঘর থেকে বেরল। বারান্দায় সাইকেলটা রাখা আছে। বাড়িতে বসে থাকলে ওর মাথা আরও গরম হবে।
“কীরে, তোকে না বাবা বেরতে বারণ করেছে?” মাধুদা সাইকেলের আওয়াজ পেয়ে বেরিয়ে এসেছে বারান্দায়।
“বেরতে তত বারণ করেনি!” সাইকেলটা বাগানে নামিয়ে তাতার উঠে বসল সিটে, “বলেছে ছোট গাঙের দিকে না যেতে। আমি যাব না। আমি জাস্ট স্টেশন রোডের দিকে যাব। প্র্যাক্টিকাল খাতা কিনতে হবে। তুমি টেনশন নিও না।”
“টেনশন নেব না? তোকে নিয়ে শান্তি আছে?”
মাধুদা আরও কিছু বলত, কিন্তু তার আগেই বেরিয়ে গেল তাতার।
স্টেশনের দিকে মোটেও যাবে না ও। আসলে এখানে একটা নিজের জায়গা খুঁজে পেয়েছে তাতার। ছোট গাঙের কাছে একটা বড় বিল আছে। লোকে বলে পিরবাবার বিল। তাতার শুনেছে শীতকালে এখানে নানান রকমের পাখি এসে বসে। শুনেছে বিলের জল কখনও শুকোয় না। কারণ, বিলের সঙ্গে নাকি তলা দিয়ে গঙ্গার যোগ রয়েছে। আর এও শুনেছে যে, এই বিলটা নাকি অভিশপ্ত। বহু মানুষ মারা গিয়েছে। তাই এই বিলের ধারে বিশেষ কেউ ঘেঁষে না! শুধু একটা দিক ইজারা দেওয়া হয় মাছ ধরার জন্য।
যদিও বহু আগে নাকি এমন ছিল না বিলটা। তখন লোকজন আসত। স্নান করত। তাই হয়তো এখনও বিলের একপাশে একটা লাল সিমেন্টের বাঁধানো ঘাটের ভগ্নাবশেষ পড়ে রয়েছে।
তাতারের কিন্তু ভয় লাগে না একটুও। সময় পেলেই ও চলে যায় ওই বিলে। নামে। সাঁতার কাটে। যদিও এটা জানে না কেউ। কারণ, জানলে বাবা ওর পিঠের চামড়া তুলে দেবেন মেরে।
মেঘ আরও ঘন হয়ে এসেছে আকাশে। আজ বিলের ধারে কেউ নেই। আসলে এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। মাছ ধরা হয়। কিন্তু এখনও সেভাবে জাল ফেলা হয়নি। যদিও সপ্তাহখানেকের মধ্যেই হয়তো হবে।
বিলের পাশেই একটা ছাতিম গাছ রয়েছে। তার তলায় সাইকেলটা রেখে গায়ের জামাটা খুলে তার উপর রাখল তাতার। তারপর জুতোটাকেও খুলল।
সামনে বিলের জলটা টলটল করছে একদম। যেন লক্ষ-লক্ষ আঙুল দিয়ে ওকে ডাকছে। তাতার এদিক-ওদিক দেখে নিল আর-একবার। তারপর দৌড়ে গিয়ে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়ল জলে।
জলের গভীরে অসংখ্য বুদবুদ, ঠান্ডা, শান্তি। তাতারের রাগটা গায়েব হয়ে গেল নিমেষে। ও চোখ বন্ধ করে একটু ডুবে থাকল জলের তলায়। তারপর ধীরে-ধীরে ভেসে উঠল। আবার ডুবল। আবার ভাসল!
এভাবে কতক্ষণ যে কেটে গেল, নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না। তাতার। ওর হুঁশ হল যখন বৃষ্টির ঝালর এসে ঝাপটা মারল বিলের জলে। ও দেখল দূরে ছাতিম গাছের তলায় ওর সাইকেল আর জামা ভিজছে।
এই সেরেছে! মাধুদাকে বলে বেরিয়েছে স্টেশনে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও ফিরছে না দেখে যদি মাধুদা বাবাকে ফোন করে দেয়, তবে!
আর দেরি না করে জল থেকে দ্রুত উঠে পড়ল তাতার।
ভেজা জামাটাকেই কোনও মতে গায়ে জড়াল। জুতোটাকে গলিয়ে নিল পায়ে। তারপর সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে গিয়ে কেমন যেন একটা মনে হল ওর! মনে হল কী যেন নেই! কীসের যেন অস্বস্তি! একসেকেন্ড সময় নিল ও। তারপর নিজের কোমরে হাত দিল। আর সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠল ও। সর্বনাশ!
কোমরে একটা সোনার মাদুলি ছিল তাতারের। মায়ের পরানো। বাবা সব সময় ওটা ওকে পরে থাকতে বলেন। এখন সেটাই নেই!
তাতারের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে! ও দ্রুত জলের দিকে তাকাল। বিলে নামার আগেও মাদুলিটা ছিল কোমরে। আর এখন নেই। মানে জলেই কি তবে পড়ে গেল? কোথায় গেল?
ভয়ে পিঠ দিয়ে বরফের গুলি গড়িয়ে গেল তাতারের।
৭
এতদিন পর নিজের ঘরে ঘুমোতে পেরে বেশ ভাল লাগছে আদেশের। আসলে বেশ কিছুদিন পর কলকাতায় এসেছে ও। এখানে সপ্তাহখানেক থাকবে। তারপর বেরিয়ে পড়বে কাজে। তবে এই সপ্তাহখানেকের মধ্যে কিছুটা হোমওয়ার্ক করে নেবে। সারা পৃথিবীতে গত দশবছরের মধ্যে কোথায় মারমেড দেখা গিয়েছে সেটার একটা তালিকা তৈরি করে ম্যাপে চিহ্নিত করবে। তারপর হিসেব করে বের করবে কোন অঞ্চলে এই মারমেডদের দেখতে পাওয়ার ঘটনা বেশি ঘটেছে। বোঝার চেষ্টা করবে সেই সব অঞ্চলে সমুদ্রের বৈশিষ্ট্য কী! কোন ধরনের মাছের সংখ্যা বেশি! আসলে মারমেডরা যে মাংসাশী, সেটা ওদের দাঁতের গঠন দেখলেই বোঝা যায়। তাই মারমেড-সাইটিংয়ের জায়গাগুলোয় নিশ্চয়ই জলচর প্রাণী, বিশেষ করে মাছেদের সংখ্যা বেশি হবে!
“কী রে, জানলার ধারে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”
বাবার গলা পেয়ে মুখ ফেরাল আদেশ। সকাল-সকাল বাবা স্নান করে নেন। আজও নিয়েছেন। নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরেছেন বাবা। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও বেরবেন।
“তুমি বেরবে?” আদেশ জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, পাবলিশারের কাছে যেতে হবে।”
আদেশের বাবা, শীর্ষ বসু একজন নামকরা অর্থনীতিবিদ। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয়।
“তা কিছু বলবে?”
শীর্ষ বললেন, “কী আর বলব! তোর মা তো টেনশনে অর্ধেক হয়ে যাচ্ছে! এমন ভাল চাকরি ছেড়ে এসেছিস শোনার পর থেকেই ব্লাডপ্রেশার তাল গাছে উঠে বসে আছে।”
“ছেড়ে!” আদেশ মাথা নাড়ল, “আরে বাবা লিভ উইদাউট পে। চাকরি ছাড়িনি।”
শীর্ষ মাথা নেড়ে বললেন, “সেটা তুই তোর মাকে বোঝা। তুই সত্যি বল তো এটা কোনও সুস্থ মানুষের কাজ? তুই মারমেড ধরবি? এর চেয়ে যদি বলতিস, নীল তিমি ধরতে যাবি, তাও নয় মানতাম!”
“কেন? এখন মানতে অসুবিধে কোথায়?” আদেশ বলল, “সব কিছুই রহস্যের আড়ালে থাকে যতক্ষণ না কেউ সেই আড়ালটা সরায়। বুঝলে?”
“শোন, এসব বক্তৃতায় ভাল লাগে, কাজে নয়। মারমেড যদি থেকে থাকে, তবে সেটা এতদিন চোখে পড়েনি কারও? আর যদি থেকেও থাকে, তবে তারা লুকিয়ে আছে। তার মানে লুকিয়ে থাকতে চায় তারা। যারা লুকিয়ে থাকতে চায় তাদের ধরবি কী করে? এটা কি লুকোচুরি খেলা নাকি?”
আদেশ হাসল। বলল, “গত একদশকের মধ্যে দু’-দুটো প্রজাতির তিমি ধরা পড়েছে! ভাবতে পার এমন তিরিশ-চল্লিশফুট লম্বা প্রাণী এতদিন ধরে জলের তলায় ছিল কিন্তু মানুষ এত উন্নত হয়েও তাদের ধরতে পারেনি! মারমেডদের বেলায় তেমন কিছু হয়নি কে বলতে পারে! আর আমিও কিন্তু একদম চুপ করে বসে নেই। এই পৃথিবীতে আমাদের দৃশ্য জগতের বাইরেও একটা জগৎ আছে জান তো! মানে, যারা খুব একটা সমাজের আইনকানুন মানে না, তাদের জগতের কথা বলছি আর কী! যেমন ধরো সোমালিয়ান জলদস্যু। মগ জলদস্যু।”
“মানে?” শীর্ষ অবাক হলেন, “এদের সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে নাকি?”
“আমার ডাইরেক্ট নেই। কিন্তু একজনের আছে। সেও আমারই মতো মারমেডদের খুঁজছে। আর তাই পৃথিবীর নানান জায়গার এমন অসামাজিক কাজকর্ম করে লোকেদের সঙ্গেও সে মেশে। তার থেকেই আমি খবর নিয়েছি।”
“কিন্তু তাও কি এটা বিশ্বাসযোগ্য! একটা কথা ভাব আজ পর্যন্ত কিন্তু এর কোনও প্রমাণ মেলেনি।”
আদেশ বলল, “প্রমাণ সব সময় ওভাবে মেলে না। তুমি কি জান যে, দীর্ঘদিন ধরে ডলফিন মানুষকে মাছ ধরায় সাহায্য করে! ব্রাজ়িল, কোস্টাল ওয়েস্ট আফ্রিকা বা সাউথ-ইস্ট এশিয়ায় একটা অদ্ভুত ঘটনা দেখা যায়। সামুদ্রিক ডলফিনরা মাছের ঝাঁককে তাড়িয়ে আনে সমুদ্রের পাড়ের দিকে। সেখানে জেলেরা অপেক্ষা করে তাদের জন্য। আর যেই সেই মাছের ঝাঁক আসে, জেলেরা জাল ফেলে ধরে নেয় তাদের। এই জালে কিন্তু ডলফিনরাও ধরা পড়ে। কিন্তু তারা প্যানিক করে না। জেলেরা জাল থেকে মাছ তুলে নিয়ে ডলফিনদের আবার সমুদ্রে ছেড়ে দেয়। আর শুধু তাই নয়, তাদের ওই ধরা-পড়া মাছের থেকে ভাগও দেয়! শয়ে-শয়ে বছর ধরে ডলফিন আর মানুষের মধ্যে এই অদ্ভুত এক পার্টনারশিপ চলে আসছে। পৃথিবীতে এ এক অনন্য ঘটনা! কিন্তু ডলফিনদের এমন একটা ব্যাপার শেখাল কে? কারা জলের এমন একটা প্রাণীকে ডাঙার প্রাণীর সঙ্গে একযোগে কাজ করার রাস্তা দেখাল?”
শীর্ষ অবাক হয়ে বললেন, “মানে? কী বলতে চাইছিস?”
আদেশ বলল, “ইজিপ্টের একটা মরুভূমিতে এর উত্তর পাওয়া গিয়েছে। তিরিশ হাজার বছর আগে সেই মরুভূমিতে জল ছিল। কিন্তু পরে জল সরে যায়। আর সেই জলের পাড়ে বসতি গড়া মানুষজনও লুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু গুহার দেওয়ালে তাদের এঁকে রাখা ছবি কিন্তু অন্য কথা বলে। সেখানে দেখা যায় ডলফিনদের সঙ্গে একযোগে এক ধরনের প্রাণী হাতে বর্শা আর জাল নিয়ে মাছ শিকারে ব্যস্ত। সেই ছবি দেখলে অবাক হবে তোমরা। কারণ, সে ছবিতে স্পষ্ট, যে ডলফিনদের সঙ্গে অমন করে যারা মাছ শিকার করছে তাদের কোমরের তলা থেকে গোটা নীচের অংশটাই মাছের মতো! তাই আমাদেরই শুধু নয়, ডলফিনদের স্মৃতিতেও কিন্তু রয়ে গিয়েছে মারমেডরা!”
শীর্ষ ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আদেশের দিকে। তারপর বললেন, “শুনতে খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। কিন্তু এদের খুঁজে বের করার কাজটা কিন্তু খুব কঠিন। আর একা-একা তো…”
আদেশ কথাটা শেষ করতে দিল না। তার আগেই বলল, “একা নই বাবা। পৃথিবীতে অনেকেই এই কাজটা নিঃশব্দে করে যাচ্ছে। তবে আমায় এখানে হেল্প করতে আসছে একজন। যে-কোনও সময়ে সে এসে পড়বে। মিনিটচল্লিশ আগে দমদম এয়ারপোর্টে নেমে সে ফোন করেছিল আমায়।”
আদেশ কথাটা শেষ করতেই দরজায় আওয়াজ হল। বাড়িতে রান্না করে টুকুদি এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। সঙ্গে মাও আছেন।
মা বললেন, “একজন খুঁজছেন তোকে। নীচে আয়।”
শীর্ষ অবাক হয়ে তাকালেন আদেশের দিকে।
আদেশ হেসে বলল, “ওই এল বোধ হয়, চলো।”
সিঁড়ি দিয়ে নেমে বসার ঘরে এসে দাঁড়াল সবাই। আদেশ দেখল লোকটা ওদের শোকেসে রাখা বিভিন্ন গাড়ির মডেল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ডাইকাস্ট গাড়ি জমানো বাবার হবি।
ওদের পায়ের শব্দ শুনে লোকটা এবার পিছন ফিরল। উসকোখুসকো একরাশ সোনালি চুল আর একমুখ দাড়িতে লোকটাকে অদ্ভুত লাগছে। লোকটা আদেশের দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, “ওয়েল, আই অ্যাম হিয়ার।”
আদেশ বাড়ানো হাত ধরে হাসল। তারপর বাবা আর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মিট মাই পার্টনার ফর দিস সার্চ। ইনি রবার্ট জোন্স। তবে আমরা ওকে বব বলেই ডাকি।”
৮
স্কুলের গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। তাই দিনগুলো কে যেন রবারের মতো টেনে লম্বা করে দিয়েছে। সকালবেলাটা লেখাপড়া করে তাতার। আর বিকেলে সাইকেল নিয়ে টহল দিতে বেরয় একবার। তখন গামাও আসে। আসলে বেশ কয়েকদিন গামাকে এড়িয়ে গিয়েছিল তাতার, কিন্তু তারপর আর পারেনি। গামার ওই করুণ মুখটা দেখলে আর রাগ করতে পারে না ও।
গামাও বিকেলে ওর সঙ্গে সাইকেল নিয়ে বেরয়। তবে আর ওই ছোট গাঙের দিকে যায় না।
তাও আজ সকালে বাবা মেরেছে। যদিও খুব বেশি নয়। কিন্তু অন্যদিনের বেশি মারের চেয়ে আজকের কম মারটাই ওকে কষ্ট দিয়েছে বেশি!
আসলে সেই যে কোমরের মাদুলিটা পিরবাবার বিলে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা এতদিন সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল তাতার। কিন্তু আজ সকালে সেই ব্যাপারটা জুলু ফাঁস করে দিয়েছে। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে জুলু আচমকা জিজ্ঞেস করেছিল, “হ্যাঁরে তাতার, তোর কোমরের মাদুলিটা কোথায় বল তো?”
“অ্যাঁ?” তাতারের হাতের থেকে দুধটা চলকে গিয়েছিল সামান্য।
“মাদুলিটা! কোথায়?” জুলু তাকিয়েছিল ওর দিকে, “ক’দিন হল দেখছি তোর কোমরে নেই।”
তাতার কী বলবে বুঝতে না পেরে বাবার দিকে তাকিয়েছিল।
সোমেন এই সময়টা ওদের সঙ্গে খেয়ে অফিসে বের হন। কথাটা শুনে টোস্টটা নিয়ে জুলুর দিকে তাকিয়েছিলেন, “মাদুলি মানে? কী বলছিস তুই?”
জুলু বলেছিল, “মানে তাতারের কোমরের মাদুলিটা! সেটা কোথায় জানতে চাইছি!”
সোমেন এবার চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিলেন তাতারের দিকে, “কীরে, জুলু কী জানতে চাইছে? উত্তর দে।”
তাতার গ্লাসটা রেখে মাথা নামিয়ে নিয়েছিল।
সোমেন চেয়ার থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ওর পাশে, “কোথায় তোর মাদুলি? মা তোকে এটা পরিয়ে গিয়েছিলেন মনে আছে? বলেছিলাম না এটা খুলবি না!”
তাতারের হাতের তালু ঘেমে গিয়েছিল নিমেষে। ও কী বলবে বুঝতে পারছিল না। আসলে পিরবাবার বিলে গিয়ে ও যে এটা হারিয়েছে সেটা যদি বলে তবে আর রক্ষে থাকবে না। তাই মাথা নিচু করে নিয়েছিল কেবল। আর ঠিক তখনই থাপ্পড়টা এসেছিল। উপরের থেকে কোনাকুনি সোমেনের হাতটা এসে লেগেছিল ওর কানের পাশে।
জুলু চট করে উঠে ধরে ফেলেছিল সোমেনকে। বলেছিল, “বাবা, প্লিজ়…”
সোমেন কাঁপছিলেন থরথর করে, “তোর মা তোকে ওটা সব সময় পরিয়ে রাখতে বলেছিলেন আমায়। তোর মায়ের কথা মানতে ইচ্ছে করে না! মাকে মনে পড়ে না তোর? তুই মানুষ!”
“তুই মানুষ!” বাবার কথাটা এখনও ভোমরার মতো পাক মারছে তাতারের মাথায়। আর কেন কে জানে চোখে জল চলে আসছে!
মাকে ওর স্পষ্ট মনে পড়ে না। শুধু আবছা একটা মুখ, শীতের রাতে লেপের ভিতর ওকে জড়িয়ে ধরে মোটা সোনার বালা-পরা একটা হাত আর এলাচ-লবঙ্গের একটা গন্ধ মাথার চারদিকে কুয়াশার মতো ঘিরে ধরে ওকে। মনে হয়, এই কুয়াশাটা কাটলেই বোধ হয় মাকে দেখতে পাবে ও। ধরতে পারবে আবার। কিন্তু কুয়াশা কাটে না। মা আর ফিরে আসেন না ওর কাছে।
এসব বাবাকে কী করে বোঝাবে তাতার!
সোমেন বেরিয়ে যাওয়ার পর জুলু এসেছিল ওর কাছে। বলেছিল, “মাদুলিটা পিরবাবার বিলে হারিয়েছিস, না?”
ঘাসের থেকে উঠে বসল তাতার। সেই মাদুলি হারাবার পরে আজ এই প্রথম বিলের ধারে এসেছে ও।
গামা বলেছিল এখানে এসে দেখা করবে ওর সঙ্গে। কিন্তু এখনও তো এল না!
“তুমি কুমড়োপটাশ দেখেছ?”
পিছন থেকে খোনা গলায় আসা প্রশ্নটা শুনে ঘাবড়েই গেল তাতার। চট করে পিছনে ফিরে দেখল একটা লোক। রোগা, বেঁটে। এই গরমেও একটা ফুলহাতা খয়েরি সোয়েটার পরে আছে। আর সবচেয়ে অদ্ভুত লাগল দেখে যে, লোকটার মাথার সামনের দিকে চারটে চুল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
লোকটা গম্ভীর হয়ে বসে পড়ল তাতারের পাশে। বলল, “কুমড়োর ইংরেজি কী বলো তো? বা পটাশের? আসলে এই মুকুটপুর জায়গাটা খুব অদ্ভুত। এখানে নানান জিনিস আছে। যেমন ধর, পক্ষীরাজ! নীল তিমি, ডোডোপাখি, আরকিওপটেরিক্স, নিয়ানডারথাল, ইত্যাদি-ইত্যাদি।”
“আপনি কে?” তাতার কী বলবে বুঝতে পারল না।
“আমি ডারউইন। তা কুমড়োর ছক্কা খেয়েছ? জান ছোট গাঙের ওই বুড়ো লোকটার একটা হাতিমি আছে? গতবছর একটা রামগরুড় ছিল। কিন্তু এবছর হাতিমি কিনেছে। তুমি জান রাজার পিসি কেন কুমড়ো দিয়ে ক্রিকেট খেলে?”
তাতার উঠে দাঁড়াল। আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়েছে তো!
“তুমি উঠলে! তবে খবরদার জলে নেমো না কিন্তু। এই জলে দানো ঢুকেছে। আমি দেখেছি। কেমন?”
“আরে তুই এসে গিয়েছিস?”
ডারউইনের পিছনে এবার গামাকে দেখল তাতার। সাইকেল থেকে একটা পা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাতার একটু অবাক হল। গামার পাশে একটা মেয়ে। এটা আবার কাকে আনল ছেলেটা?
গামা আর মেয়েটা সাইকেল থেকে নামল।
গামা লোকটার দিকে এক প্যাকেট চিপ্স বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও তো।”
লোকটা হাত বাড়িয়ে নিল প্যাকেটটা। হাসল। বলল, “কুমড়োর চিপস! দারুণ! আজ আমি আসি।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর তাতার জিজ্ঞেস করল, “এ কে রে?”
এবার উত্তর দিল মেয়েটা, “রক্তিম গাঙ্গুলি। এখানে আগে একটা স্কুলে পড়াত। বায়োলজি! তারপর একবার ঘুরতে মুম্বই গেল। সেখানে কী যে হল কে জানে, তারপর থেকেই মাথাটা গিয়েছে। এখন সারাদিন কী সব যে বলে বেড়ায়!”
তাতার কিছু না বলে তাকাল গামার দিকে। কে মেয়েটা!
গামা বুঝতে পারল তাতার কী বলতে চাইছে! ও বলল, “তাতার, এ হল রুপু। মানে রূপশ্রী। চারুর বোন!”
“চারু!” তাতারের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।
রুপু হাসল, “ও তোমাদের শত্রু, না? আমি জানি।”
গামা চশমা ঠিক করে বলল, “না, মানে ঠিক তা নয়…”
রুপু হাসল, “আরে, লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি জানি চারু খুব বদমাশ। আসলে শরীরের জোরে পারে না তো! তাই কেমন যেন হিংসুটে হয়ে গেছে। আর…”
কিন্তু কথাটা শেষ করতে পারল না রুপু, তার আগেই আচমকা কী যেন একটা সরসর করে চলে গেল ওদের পায়ের সামনে দিয়ে আর তার পিছন-পিছন একটা খাকি রঙের জন্তু যেন দৌড়ে গেল দ্রুত।
রুপু আর গামা চিৎকার করে ছিটকে গেল পিছনে। কিন্তু তাতার ভয় পেল না। বরং ব্যাপারটা কী দেখার জন্য এগিয়ে গেল। দেখল, খাকি রঙের জন্তুটা আসলে একটা বেজি! জলের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মানে আগেরটা সাপ ছিল!
বেজি নামক জন্তুটা তাতার আগে ফোটোতে দেখেছে! আজ সত্যি-সত্যি দেখল। মেঠো ইঁদুরকে যেন টেনে ফুলিয়ে কেউ বড় করে দিয়েছে। ও আর-একটু এগোল ভাল করে দেখবে বলে। কিন্তু তার আগেই বেজিটা পাশের একটা ঝোপের মধ্যে সুট করে ঢুকে গেল।
কিন্তু তবু তাতার যেন নড়তে পারল না! বিলের পাড়ের দিকে তাকিয়ে ও স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ! কী ওটা? আলোয় চকচক করছে?
তাতার ধীরে-ধীরে সামনে এগিয়ে ঝুঁকে পড়ল মাটির দিকে। দেখল, বিলের পাড়ের ঘাসের উপর একটা ছোট্ট পদ্মপাতা বিছানো রয়েছে। আর সেই পাতার ওপর খুব যত্ন করে রাখা আছে ওর সেই হারিয়ে যাওয়া মাদুলিটা!
৯
রুপু মেয়েটা বেশ ভাল। তবে কথাটা একটু বেশি বলে, এই যা। প্রথম কয়েকদিন তাতার একটু এড়িয়েই যেত রুপুকে। ভাবত যার দাদা চারু, সে কেমন আর হতে পারে! কিন্তু এই ক’দিনে মিশে দেখেছে যে, মেয়েটা ভাল।
আজ সাইকেল নিয়ে বেরবার সময় মাধুদা বারণ করেছিল যেতে। কে জানে কেন, মাধুদা সব কিছুতেই বারণ করে। কিন্তু তাতার ম্যানেজ করে নিয়েছিল। বলেছিল, অফিস থেকে বাবা ফিরে আসার আগেই ও বাড়ি ঢুকে পড়বে।
আসলে সেই সোনার মাদুলির ঘটনার পর থেকে বাবা যেন আরও বেশি রাগী হয়ে গিয়েছেন। তাতার ফিরে পাওয়া মাদুলিটা দেখিয়েছে সোমেনকে, কিন্তু তাতেও সোমেনের রাগ একটু পড়েনি।
তবে একটা ব্যাপার এখনও ঠিক বুঝতে পারছে না তাতার। মাদুলিটা এল কী করে ওখানে? অমন পদ্মপাতায় সাজিয়ে কে রেখে গেল ওটা বিলের ধারে?
ব্যাপারটা ও বলেছিল গামাকে।
গামা হেসে বলেছিল, “কে আর রাখবে? তুই যেদিন হারিয়ে ফেলেছিলিস সেদিন থেকে ওটা ওখানেই পড়েছিল। ওদিকটায় বিশেষ কেউ আসে না, তাই আবার পেয়ে গিয়েছিস!”
তাতার আর কথা বাড়ায়নি। কিন্তু মনে-মনে ব্যাপারটা মানতেও পারেনি। কারণ ও নিজে তো নিশ্চিত জানে জলের ভিতরেই হারিয়ে ফেলেছিল মাদুলিটা!
এই সব ভাবতে-ভাবতে ছোট গাঙের দিকে সাইকেলটা ঘোরাল তাতার। আজ বাবা নেই বাড়িতে।
বাবা থাকলে ছোট গাঙের দিকে যেতে ভয় করে ওর। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করে খুব। তাই আজ সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছে। আসলে অমন একটা মোটরবোট আর সান্টাক্লজ়ের মতো লোক এখানে কী করছে সেটা জানতে খুব ইচ্ছে করে ওর!
ছোট গাঙের দিকে যাওয়ার পথটা বেশ সুন্দর। দু’দিকে মাঠ আর তাতে ছড়িয়ে থাকা বড়-বড় গাছ! আজ দিনটা মেঘলা আর তার সঙ্গে হাওয়াও দিচ্ছে বেশ। এই সকালবেলাটা সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর!
সাইকেলটা ডানদিকে ঘুরিয়েই ব্রেক কষে মাঝপথে দাঁড়িয়ে পড়ল তাতার। দেখল সামনে থেকে জুলু আর জুলুর বন্ধু বুজুদা আসছে সাইকেল করে!
জুলু কাছে এসে সাইকেলটাকে দাঁড় করাল। মুখ-চোখ গম্ভীর। বলল, “তোকে না বাবা এই দিকে আসতে বারণ করেছে! তাও এখানে কী করছিস?”
তাতার ঢোক গিলল। তারপর পালটা বলল, “তুই কী করছিস এদিকে? বাবাকে বলব?”
“বেশি স্মার্ট হবি না কিন্তু,” জুলু চোয়াল শক্ত করল, “জানিস গতকাল রাতে এইদিকে ইটভাঁটায় কত বড় ডাকাতি হয়ে গিয়েছে। একজন মারাও গিয়েছে। পুলিশ, প্রেস গিজগিজ করছে একদম। চল, বাড়ি চল। ওদিকে যাবি না খবরদার।”
“মানে? ডাকাতি?” তাতার অবাক হল।
এবার বুজু উত্তর দিল। বলল, “জায়গাটা ভাল নয় তাতার। তুই জুলুর কথা শোন। বাড়ি চল।”
ঠিক সেই সময় পাশ থেকে একটা পায়ের শব্দ শুনে তাতার তাকাল রাস্তার দিকে। দেখল ওদের পাশ দিয়ে দৌড়ে ঘটনাস্থলের দিকে বেরিয়ে গেল সেই পাগলা রক্তিম গাঙ্গুলি!
বুজু তাকাল সেই দিকে। তারপর ধীরে-ধীরে বলল, “এই রে, ডারউইন যাচ্ছে ওখানে! এবার কী যে হবে কে জানে!”
বব বেরিয়েছে ভোরবেলা। এখনও ফেরেনি। আসলে আদেশ দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছে বেশ কিছুদিন হল। ও ভেবেছিল এখানে বসে গোটা অনুসন্ধানটার একটা ব্লু প্রিন্ট বানিয়ে তারপর কাজে বেরিয়ে পড়বে। সেইমতো ও ববের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল সাহায্য নেবে বলে।
কিন্তু কলকাতায় আসার পর থেকেই বব কিছুতেই এখান থেকে যেতে চাইছে না।
গতকাল রাতেও ববকে আদেশ জিজ্ঞেস করেছিল, “আমরা কীসের জন্য অপেক্ষা করছি বব? কলকাতা শহরে কি তুমি মারমেড খুঁজে পাবে ভেবেছ?”
বব হেসে বলেছিল, “তা নয় আদেশ। আসলে আমি অপেক্ষা করছি খবরের জন্য।”
“খবর? মানে?” আদেশ অবাক হয়েছিল খুব।
“মানেটা সিম্পল,” বব ওর এলোমেলো সোনালি চুলগুলো হাত দিয়ে পিছন থেকে টেনে বলেছিল, “তুমি কি জান যে, কোনও জিনিসের ডিসকভারি কীভাবে হয়? সেটা হয় লিডের মাধ্যমে। খবরের মাধ্যমে। এতবছর মারমেড খোঁজার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি আমি। সেখানে কত রকম মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে জান? মাঝসমুদ্রে ট্রলার নিয়ে যাওয়া জেলে, ছোট স্টিমারের নাবিক থেকে শুরু করে সোমালিয়ান পাইরেট পর্যন্ত কত মানুষের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে!”
অবাক হয়ে গিয়েছিল আদেশ, “জানি তো। তাই তো তোমার হেল্প লাগবে আমার। তবে পাইরেট ভাবলেই কেমন লাগে!”
“এরা সবাই জলের পোকা!” হেসেছিল বব, “এদের কাছেই আসল খবর পাওয়া যায়! জানবে মারমেডদের যা সব ফোটোগ্রাফিক এভিডেন্স আছে তা এমন মানুষদেরই তোলা!”
আজ সকালে এমনই একজন সোর্সের থেকে খবর নিতে বেরিয়েছে বব। কিন্তু এখনও ফেরেনি। আদেশ ঠিক করেছে আর তিনদিন দেখবে, তারপর বেরিয়ে যাবে নিজেই।
খবরের কাগজ গুটিয়ে টিভিটা চালাল আদেশ। তারপর খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসল। টিভিতে দেখাচ্ছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মুকুটপুর বলে একটা জায়গার বড় ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। একজনের মৃত্যুও হয়েছে এতে।
ধুর, ভাল লাগছে না এসব। আদেশ রিমোটটা তুলল চ্যানেল পালটাবে বলে কিন্তু আচমকা থেমে গেল। দেখল খবরের যে সাংবাদিকটি ঘটনাস্থলে সবার লাইভ ‘বাইট’ নিচ্ছে তার সামনে হুড়মুড় করে ঢুকে এল একটা উসকোখুসকো মানুষ। এই গরমেও লোকটার গায়ে সোয়েটার পরা! দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিক ভাবে সুস্থ নয় মানুষটি!
এমন একজন মানুষের আচমকা ছিটকে সামনে চলে আসায় সাংবাদিকটি ঘাবড়ে গেল সামান্য। তারপর ভুলভাল যাতে কিছু না ঘটে সে জন্য সরেও যেতে গেল, কিন্তু তার আগেই লোকটা বুমের মাথাটা খপ করে চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলল, “ডাকাতি কেন? এবার অনেক কিছু হবে এখানে! এখানে যে দানো ঢুকেছে! বিলের জলে দানো ঢুকেছে! আমি লুকিয়ে দেখেছি! অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছ! প্যাটপ্যাট করে তাকায়। জলে ঘাই মারে! আর মানুষের আওয়াজ পেলেই ডুবে যায়! অভিশাপ লেগেছে মুকুটপুরে। দেখো না এর পর কী হয়!”
এটা কী শুনল ও! অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক মাছ! মানে? আদেশ নড়তে পারল না! রিমোট হাতে স্থির হয়ে গেল একদম!
১০
সাইকেলটা আচমকা ব্রেক কষে থামিয়ে দিল তাতার। আরে, এটা কী! ও রাস্তার উপরে টাঙানো ব্যানারটা এবার দেখল ভাল করে। দেখল নীলের উপর হলুদ দিয়ে লেখা আছে, ‘মুকুটপুর অয়েল স্টোরেজ’ আয়োজিত সুইমিং টুর্নামেন্ট হবে মুকুটপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তায়। আর সেখানে বিভিন্ন বিভাগে নাম নেওয়া শুরু হয়েছে।
ভাল করে ব্যানারটা দু’বার পড়ল তাতার। ‘মুকুটপুর অয়েল স্টোরেজে’ ওর বাবা চাকরি করেন। সেখান থেকেই টুর্নামেন্টটা আয়োজন করা হচ্ছে! কিন্তু বাবা তো কিছু বলেননি ওকে! বাবা তো জানেন সাঁতার কাটতে পারলে তাতার আর কিছু চায় না, তবু বলেননি!
মাধুদা বলে বাবা নাকি আগে এমন ছিলেন না, কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পরই বাবা নাকি এমন গোমড়া আর রাগী হয়ে গিয়েছেন।
মা যে দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন, এটা জানে তাতার। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল সেটা আজও জানতে পারেনি। বাবার কাছ থেকে যে জানবে তার তো প্রশ্নই নেই। কিন্তু জুলু বা মাধুদাও কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করলেই প্রসঙ্গ পালটে দেয়!
ব্যানারটা চারবার পড়ল তাতার। অরুণাচল ক্লাবে নাম নেওয়া হচ্ছে।
ও চুপ করে ভাবল একটু। বাবা একদম চান না তাতার সাঁতার কাটুক। তাই নাম দিয়েছে জানতে পারলে নিশ্চয়ই খুব বকবেন। কিন্তু তা বলে কি ও নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারবে না? কেন শুধু-শুধু বাবার ভয়ে গুটিয়ে থাকবে!
তাতার ঠিক করল এখন তো শুধু নামটা দিতে হবে। টুর্নামেন্টটা তিনসপ্তাহ পরে। এর মধ্যে তো আর বাবা জানতে পারবেন না।
ও ঘড়ি দেখল। স্টেশনের ওই পারে কল্যাণদার দোকান থেকে জ্যামিতি বক্স কিনতে হবে। হাতে সময় আছে অনেক। তা ছাড়া যাওয়ার পথেই ক্লাবটা পড়বে।
তবে সমস্যা আছে একটা। পঞ্চাশটাকা এন্ট্রি ফি রয়েছে। ওকে বাবা একটা পাঁচশোটাকার নোট দিয়ে গিয়েছেন। জ্যামিতি বক্স কেনার পর বাকি টাকাটা বাবাকে ফেরত দিতে হবে। সেখানে যদি পঞ্চাশটাকা কম থাকে তো বাবা প্রশ্ন করবেন।
আর তাতার কোনওদিন বাবাকে না বলে এক টাকাও নেয়নি! প্রশ্নই নেই তেমন কাজ করার। কিন্তু আজ পরিস্থিতি অন্য।
ও ঠিক করল বাড়িতে ফিরে মাধুদাকে বলে পঞ্চাশটাকা নিয়ে নেবে। ও জানে মাধুদা মুখেই যত কড়া হওয়ার চেষ্টা করে। আসলে মানুষটা কিন্তু একদম কড়া নয়।
অরুণাচল ক্লাবটা বেশ বড়। দোতলা। সাদা আর নীল রং করা।
ক্লাবের সামনে গিয়ে সাইকেলটাকে একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ভিতরে ঢুকল তাতার।
বড় ঘরের এক পাশে একটা টেবিল। সেখানে মাঝবয়সি একটা লোক বসে রয়েছে। লোকটার পাশের দেওয়ালে ঝুলছে সেই সাঁতার টুর্নামেন্টের ব্যানারটা।
তাতার এগিয়ে গেল, “কাকু।”
লোকটা বলল, “কী চাই?”
“এখানেই কি নাম নেওয়া হচ্ছে?”
“তুমি নাম দেবে?” লোকটা একটা ফর্ম এগিয়ে দিল, “ঠিক আছে, এটা ফিলআপ করে দাও।”
ফর্ম হাতে নিয়ে সামান্য দ্বিধা করল তাতার। তারপর বলল, “কাকু এখানে তো পঞ্চাশটাকা এন্ট্রি ফি। কিন্তু আমার কাছে পাঁচশোটাকার নোট রয়েছে। তাই…”
লোকটা এবার থমকাল একটু। তারপর বলল, “তুমি এখানে এসেছ তোমার বাবা-মা জানেন তো?”
তাতার হাসল, বলল, “আমার বাবা অয়েল স্টোরেজেই চাকরি করেন কাকু।”
“ও!” লোকটা যেন স্বস্তি পেল। বলল, “খুচরো হয়ে যাবে। তুমি ফর্মটা ফিলআপ করে দাও। এতে তোমার বাবার নাম আর মোবাইল নম্বরটাও কিন্তু লিখবে। কেমন?”
বিকেলে তাতার কম্পিউটারে ফুটবল খেলছিল। আজ গামা আসেনি। ও সবে একটা ম্যাচ শেষ করে আর-একটা শুরু করতে যাবে, এমন সময় সদর দরজার বেলটা বাজল। ছোট, পরপর দুটো বেল। তাতার সচকিতে তাকাল। বাবা এসেছেন!
সবে পাঁচটা বাজে। আজ এত তাড়াতাড়ি এলেন বাবা!
আজ সকালে কাজ সেরে ফিরে মাধুদাকে ও বলেছে সাঁতারের ব্যাপারটা। মাধুদা গাঁইগুঁই করলেও পঞ্চাশটাকা দিয়েছে ওকে। তাতার পাখি পড়ানোর মতো করে মাধুদাকে বলেছে বাবাকে যেন এখনই কিছু না বলে ফেলে।
তাতার উঠে ওর টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফেরত আসা টাকাটা বের করল। সঙ্গে জ্যামিতি বক্স কেনার বিলটাও নিল।
সোমেন বসার ঘরেই ফ্যানের তলায় বসে ছিলেন চোখ বন্ধ করে।
তাতার আলতো করে ডাকল, “বাবা।”
সোমেন চোখ খুলে তাকালেন তাতারের দিকে। তাতার টাকা আর বিলটা এগিয়ে দিল, “বাবা এটা ওই বিল আর ব্যালেন্সটা।”
সোমেন টাকাটা নিয়ে বিলটা দেখলেন একবার, মেলালেন টাকাটা। তারপর আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে ডানহাতে সপাটে চড় মারলেন তাতারকে।
কিছু বোঝার আগেই পাশের সোফায় পড়ে গেল ও। মনে হল গালে যেন একটা চকোলেট বোমা ফাটল।
সোমেন আবার ঝুঁকে পড়ে ধরতে গেলেন ওকে। কিন্তু এবার পারলেন না। পিছন থেকে মাধুদা এসে জড়িয়ে ধরেছে সোমেনকে।
সোমেন চিৎকার করে বললেন, “আমায় ছেড়ে দাও মাধুদা। ও এত অসভ্য হয়ে গিয়েছে। আমার কথা অমান্য করার সাহস কে দিয়েছে ওকে? ও কি ভেবেছে আমি জানতে পারব না?”
মাধুদা সোমেনকে জড়িয়ে ধরে তাতারকে বলল, “তুই বসে কী করছিস? ঘরে যা। যা বলছি!”
চড়টা খুব জোরেই মেরেছেন সোমেন। তাতারের গালটা জ্বলছে।
ও তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে চলে গেল। কিন্তু ভিতরে ঢুকল না। দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে রইল। শুনল মাধুদা বলছে, “তোমার কি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে? কী করেছে ও যে এমন করে মারতে হবে? দিনকে দিন কী হয়েছে তোমার?”
সোমেন বললেন, “কী হয়েছে? তুমি জান না কী হয়েছে? তুমি নিশ্চয়ই ওই টাকাটা ওকে দিয়েছ, না? আমায় সবাই বোকা পেয়েছ? আমার কোম্পানির ব্যাপার আমি জানব না? আমি পইপই করে তাতারকে বলেছি জলের থেকে দূরে থাকতে। সেখানে কোন সাহসে ও সাঁতারে নাম দিয়েছে?”
“তো কী হয়েছে?” মাধুদা শক্ত গলায় বলল, “সারা জীবন ওকে এভাবে বাঁচতে হবে? এর কোনও মানে হয়?”
“তুমি একথা বলছ মাধুদা?” সোমেনের গলায় বিস্ময়, “তুমি জান না? মনে নেই তোমার?”
মাধুদা বলল, “সব মনে আছে। কিন্তু অতীত আঁকড়ে থাকলে হবে? ও দারুণ সাঁতার কাটে। প্রতিভা আছে ওর। ওকে ওর মতো করে বাঁচতে দাও।”
সোমেন ভাঙা গলায় বললেন, “কী বলছ মাধুদা? একজনকে হারিয়েছি। আর তাতারেরও যদি ওর মায়ের মতো অবস্থা হয়? ওর মা তো জলে ডুবেই… তুমি ভুলে গেলে? ওই পিরবাবার বিলেই তো ওর মা… এবারও কি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখব আমি? তুমি বলো মাধুদা, জুলু আর তাতার ছাড়া আমার কে আছে? তাতারেরও ওর মায়ের মতো জলের দিকে এত টান! কিন্তু ওর মায়ের মতো তাতারও যদি জলে ডুবে যায়, তবে সেটা কি আমি হতে দিতে পারি? একই ঘটনা আমি আবার ঘটতে দিতে পারি কোনওদিন?”
১১
আজ ভোর থাকতে তাতারের ঘুমটা ভেঙে গেল। শরীরে কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। আসলে গত দু’দিন ধরেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর! বিশেষ করে বাবার সেই কথাটা শোনার পর থেকেই ওর ভিতরে কেমন যেন ঘেঁটে গিয়েছে!
মায়ের মৃত্যুটা তবে অ্যাক্সিডেন্ট ছিল? আর এই পিরবাবার বিলেই মা মারা গিয়েছিল!
গতকাল রাতে ডিনারের পরে জুলু যখন শুতে এসেছিল তাতার ধীরে-ধীরে গিয়ে বসেছিল দাদার কাছে।
জুলু তাতারকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, “কী চাই তোর?”
“একটা কথা বল তো,” তাতার সোজা তাকিয়েছিল দাদার দিকে, “মা পিরবাবার বিলের জলে ডুবে মারা গিয়েছিল বলেই কি বাবা জলকে ভয় পায়? ভয় পায় যে, জলে নামলে আমিও মারা যাব?”
“কী!” চমকে উঠেছিল জুলু, “তোকে কে বলল এসব? মাধুদা?”
“না,” তাতার চোয়াল শক্ত করে বলেছিল, “আমি শুনেছি। বাবা মাধুদাকে বলছিল।”
“তোর লজ্জা লাগে না অন্যের কথা লুকিয়ে শুনিস? তুই এই শিক্ষা পাচ্ছিস?”
“দেখ দাদা,” তাতার চোখ সরায়নি জুলুর থেকে, “কথা ঘোরাস না। আমায় এটা জানতে দিতে চাস না কেন তোরা? আমি কি ছোট আছি?”
জুলু মাথা নামিয়ে নিয়েছিল। ঠোঁট কামড়ে বসে ছিল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর বলেছিল, “বিলটা যেখানে ছোট গাঙের দিকে বাঁক নিয়েছে সেখানে ঘটেছিল ঘটনাটা। আমার তখন এগারোবছর বয়স। অনেকে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। আমরা সবাই ওখানে গিয়েছিলাম পিকনিক করতে। তখন মা নেমেছিলেন জলে। সাঁতার কাটতেই নেমেছিলেন। আর কাটতে-কাটতে সবাইকে ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে চলে যান। তারপর মাঝ বিলে গিয়ে কী যেন হল। আচমকা মাকে আর দেখা গেল না। প্রথমে সবাই ভেবেছিল মা ডুবসাঁতার দিচ্ছেন। কিন্তু মিনিটদুয়েক হওয়ার পরও যখন মা উঠছেন না তখন সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। খোঁজও শুরু হয়। শেষে দেড়ঘণ্টা পরে মাকে পাওয়া যায়। নিথর, ঠান্ডা মা। জলের নীচের ঝাঁঝরিতে পা থেকে কোমর পর্যন্ত জড়িয়ে গিয়েছিল একদম!”
তাতার নড়তে পারছিল না। দেখেছিল কথা বলতে-বলতে জুলুর চোখে জল চলে এসেছে!
জুলু ভেজা গলায় বলেছিল, “মায়ের গলায় একটা লকেট ছিল। পানপাতার মতো দেখতে। তার ভিতরে ফোটো ছিল একটা। আমাদের দুইভাইকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন মা। মা সব সময় পরে থাকতেন ওটা। সেই লকেটটা মায়ের গলা থেকে খুলে পড়ে গিয়েছিল জলের তলাতেই। ওটা আর কোনওদিন পাওয়া যায়নি!”
কষ্টের চেয়েও তাতারের কেমন যেন ফাঁকা-ফাঁকা লাগছিল সব কিছু। মনে হচ্ছিল বিশাল বড় একটা শূন্যতা যেন গিলে নেবে ওকে!
জুলুর দিকে তাকিয়ে ও বলেছিল, “বাবা যদি এখান থেকে চলেই গেলেন তবে আবার ফিরে এলেন কেন?”
জুলু বলেছিল, “ঠাকুরদার এই বাড়িটা কে দেখত না হলে? জানবি ব্যক্তিগত কষ্টের চেয়েও জীবনে কর্তব্য অনেক বড়! প্লাস, বাবা ভেবেছিলেন পালিয়ে আর কতদিন থাকবেন? তার চেয়ে এখানে এসে যদি পুরো ঘটনাটাকে ওভারকাম করা যায়। কিন্তু তোর জ্বালায় সেটাও বোধ হয় হবে না!”
ধীরে-ধীরে বিছানা থেকে নামল তাতার। দেখল পাশের বিছানায় ঘুমিয়ে রয়েছে জুলু।
ও পা টিপে-টিপে ঘরের দরজা খুলে বেরল। আজ বাবার নাইট ডিউটি। বাড়িতে নেই। পিছনের ঘরে মাধুদাও ঘুমোচ্ছে। অর্থাৎ ও যদি এখন বেরয় কেউ জানতে পারবে না।
বাইরের ঘরে এসে টেবলে রাখা ছোট্ট এল ই ডি ঘড়িটা দেখল তাতার। ভোর পৌনে চারটে বাজে। এখন গরমকাল তাই আর-একটু পরেই আলো ফুটে যাবে।
ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল।
ওদের বাড়ির ছোট একটা ঘরে সকলের জামাকাপড় থাকে। তাতার নিঃশব্দে সেখানে গেল। তারপর সাঁতারের উপযোগী পোশাক পরে তার উপর একটা ট্র্যাকসুট চাপিয়ে নিল। আজ এই ভোরে ছোট গাঙের কাছে যেখানে বিলটা ঘুরে গিয়েছে সেখানে যাবে। তারপর জলে নেমে দেখবে সত্যি ঝাঁঝরি আছে কি না!
সাইকেলটা বের করে আলতো করে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল তাতার। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠে মাধুদা। তার মধ্যেই ঠিক ফিরে আসবে ও।
এখানে রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে গিয়েছে। সোজা গেলে ছোট গাঙের পাড়ে যাওয়া যায় আর ডানদিকে বাঁক নিলে বিলের দিকে। তাতার সাইকেলটা ডানদিকে ঘোরাল।
বিলের পাড়ে বড় গাছটার নীচে সাইকেলটা রেখে ধীরে-ধীরে জলের দিকে এগোল তাতার। এখানেই মা জলে নেমেছিলেন? তারপর আর কোনওদিন উঠে আসেননি!
ও জানে এভাবে এমন সময়ে এখানে আসাটা ঠিক নয়। বিশেষ করে ছোট গাঙের দিকটার যখন বদনাম আছে। কিন্তু তাতার এটাও জানে একবার আলো ফুটে গেলে আর কেউ ওকে এখানে আসতে দেবে না। আসলে কেউ তো ওকে বুঝতেই পারে না। মায়ের জন্য ওর বুকের ভিতরটা যে কেমন করে সেটা যদি কেউ জানত! ও ছোট থেকে শুনে আসছে ওর এই জলের দিকের টানটা নাকি ওর মায়ের থেকে পাওয়া। তাই জলে নামলেই একমাত্র ওর মনে হয় মায়ের সঙ্গে একটা যোগ তৈরি হল!
বিলের পাড়ে গিয়ে একটু থমকে দাঁড়াল তাতার। আবছা আলোয় দেখল জলের উপরে নানা জায়গায় বাঁশ পোঁতা আর তাতে জাল বাঁধা রয়েছে! মানে মাছ ধরার সময় এসে গিয়েছে।
এই বিলের সঙ্গে ছোট গাঙের একটা যোগ আছে। তাই প্রচুর মাছ হয় এই বিলে। এখানকার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তাই বিলের এদিকটার ইজারা দেওয়া হয় মাছ ধরার জন্য। চারুর বাবা নাকি প্রতিবার ইজারাটা নেন।
সাবধানে, জাল এড়িয়ে জলে নামল তাতার। জলটা একটু ঠান্ডা।
জল কেটে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল তাতার। হঠাৎ পাশের থেকে কেমন একটা ঝটপটানি শুনল ও। চকিতে শব্দের দিকে ঘুরল তাতার। থমকে বোঝার চেষ্টা করল আওয়াজটা কোন দিক থেকে আসছে!
আবার শব্দটা হল। কেমন একটা ছটফটানির শব্দ! তাতার বুঝল, সামনে মিটারদশেক দূরের থেকে শব্দটা আসছে। চারদিকে জাল পাতা রয়েছে। এমনিতেই জালে মাছ পড়লে মাছেরা লাফায়। কিন্তু সেই শব্দ তো এত জোরে আর এমন করে হয় না। বড় কিছু আটকে পড়লেই এমন শব্দ হয়। ব্যাপারটা দেখতে হবে। আবছা অন্ধকারে চোখ সয়ে গিয়েছে এখন। তাতার তাই দেখতে পাচ্ছে মোটামুটি।
বেশ কয়েকটা বড় জালের মধ্যে একটা জাল প্রচণ্ড জোরে নড়ছে। আর সেখান থেকেই ছপছপ শব্দটা হচ্ছে! তাতার গোলাকার জালগুলোর ফাঁক দিয়ে এগোল সামনে। দূরত্ব কমে আসতে লাগল ক্রমশ!
তাতার কাছে যেতেই আচমকা জালটা একদম স্থির হয়ে গেল! কী হল ব্যাপারটা! শব্দটা থামল কেন! এই তো জালটা! কী আছে এর ভিতরে?
আরও একটু কাছে এগোতে গেল তাতার, ঠিক তখনই জালটা প্রচণ্ড কেঁপে উঠল আর জালের একটা পাশে ছিঁড়ে সেখান থেকে একটা হাত ছিটকে বেরিয়ে এল বাইরে।
ভীষণ চমকে উঠে পিছনে ছিটকে গেল তাতার! এটা কী? জালের মধ্যে মানুষ ধরা পড়েছে নাকি?
কয়েক মুহূর্তের জন্য ঘাবড়ে গেলেও তাতার সামলাল নিজেকে। তারপর ভাল করে দেখল। আর সঙ্গে-সঙ্গে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল ওর।
তাতার দেখল জালের ভিতর থেকে মানুষের মতো দেখতে একটা মুখ তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকে। একটা হাত নেড়ে যেন ডাকছে ওকে। কিন্তু হাতটা মানুষের মতো হয়েও ঠিক মানুষের মতো নয়। প্রত্যেকটা আঙুল একে অপরের সঙ্গে হাঁসের পায়ের মতো পাতলা চামড়া দিয়ে যুক্ত! আর মানুষটার চোখ দুটো গোলাকার ও বড়-বড়। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, মানুষটার নাভি পর্যন্ত স্বাভাবিক মানুষের মতো হলেও নাভির নীচে থেকে গোটাটাই একটা বড় মাছের লেজের মতো!
নিজের বাড়ির ব্যালকনিতে বসে দূরবিনটা চোখে লাগিয়ে ভাল করে তাকালেন একজন। দূরবিনটায় নাইট ভিশন আছে। অন্ধকারে দেখা যায়। লোকটি দেখলেন তাতার একটা জালের সামনে থমকে রয়েছে আর জাল থেকে অদ্ভুত একটা হাত বেরিয়ে রয়েছে বাইরে।
দূরবিনটা চোখ থেকে নামিয়ে লোকটি চোয়াল শক্ত করলেন। তবে কি তিনি যা ভাবছেন এটা সেই প্রাণী!
দূরবিনটা আবার চোখে লাগিয়ে ভাল করে তাকালেন লোকটি।
তাতার জানতেও পারল না ঠিক ওই সময়ে দূর থেকে ওকে দূরবিন দিয়ে লক্ষ করছেন সান্টাদাদু!
১২
কলকাতা থেকে এই মুকুটপুর প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূর। ট্রেনে করে আসতে বেশ কিছুটা সময় লাগে।
এই মুকুটপুরে যে কোনও হোটেল পাওয়া যাবে না সেটাই স্বাভাবিক। তাই কলকাতা থেকেই বন্দোবস্ত করে এসেছে আদেশ।
ওর বাবার এক পরিচিত মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করেন। তাঁর মাধ্যমে এখানে একটা গেস্টহাউজ বুক করেছে আদেশ।
টিভির সেই খবরটা শোনার পর সব বন্দোবস্ত করে আসতে তিন-চারদিন সময় লেগে গিয়েছে আদেশের। আসলে শুধু বন্দোবস্তই নয়, আর-একটা কারণেও দেরি হয়েছে।
গোটা ব্যাপারটা ববকে বলেছিল আদেশ। সব শুনে বব একটু সময় চুপ করে বসে ছিল। তারপর বলেছিল, “আদেশ, আমার সোর্স বলেছে আমাদের পাকিস্তানের সাদার্ন রিজিয়নে যেতে হবে। ওখানের নেটিভরা নানান রকম মারমেড সাইটিংয়ের ব্যাপারে বলছে।”
আদেশ বলেছিল, “সে তো না হয় যাব বব। কিন্তু তার আগে আমাদের ঘরের কাছে যেটা আছে, সেটা একবার নক করব না?”
“আদেশ,” বব বিরক্ত হয়েছিল কিছুটা, “তুমি কী বলছ! টিভির খবরে কে একজন কী বলল সেই শুনে সেখানে যেতে হবে! কত লোক তো বলেছে ইয়েতি দেখেছে তারা! ভিনগ্রহের প্রাণীরা তাদের অ্যাবডাক্ট করে নিয়ে গিয়েছে। লকনেস মনস্টারকে তারা চোখে দেখেছে, সেই সব কিছুকে বিশ্বাস করতে হবে?”
আদেশ শক্ত গলায় বলেছিল, “বব, আমি কিন্তু ওখানে যাবই। তোমার না যেতে হয় যেয়ো না। কিন্তু আমার গাট ফিলিং বলছে এটা ওয়াইল্ড গুজ় চেজ় নয়। তাই আমি তো যাচ্ছি। প্লাস জিওগ্রাফিক্যালিও জায়গাটা ঠিক ভাবে প্লেসড। আমি ইন্টারনেট সার্চ করে দেখেছি। গঙ্গার মোহনার কাছে একটা খাঁড়ির ধারে এই মুকুটপুর অবস্থিত। তাই আমি বাবাকে বলছি গেস্টহাউজ়ের বন্দোবস্ত করতে। বুঝেছ?”
বব যে ইচ্ছের বিরুদ্ধে এই মুকুটপুরে এসেছে সেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
গেস্টহাউজ়ে একটা বড় ডবল রুম নিয়েছে ওরা। ঘরটায় দুটো আলাদা-আলাদা বিছানা। আদেশ যখন ঘর থেকে বেরিয়ে দেখেছে বব নিজের বিছানায় বসে ল্যাপটপ নিয়ে কী সব খুটখাট করছে।
গেস্টহাউজ়ের মেন গেটের কাছেই বকুকে দেখল আদেশ। বকু ছেলেটা এখানেই থাকে। ফাইফরমাস খাটে। আদেশদের ব্যাগও ওই বয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঘরে। তখন বকু বলেছিল কিছু দরকার হলে আদেশ যেন ওকে বলে।
“এই বকু,” আদেশ হাত তুলে ডাকল।
বকু দৌড়ে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। রোগা-পাতলা চেহারা বকুর। এক মাথা কোঁকড়া চুল। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত হল ওর চোখ। হালকা ছাই রঙা চোখ দুটো যেন সব সময় ঘুরছে!
আদেশ পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে বকুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার একটা খবর চাই। দিতে পারবি?”
বকু টাকাটা নিয়ে পকেটে ঢুকিয়ে হাসল, “একটা কেন দাদা, দশটাও পারব।”
“তোর মনে আছে কিছুদিন আগে এখানে ওই নদীর দিকে ইটভাঁটায় একটা ডাকাতি হয়েছিল?”
“হ্যাঁ, মনে আছে। এই তো নটু সামন্তর খোলা। একটা মার্ডারও তো হয়েছিল।”
“ঠিক,” হাসল আদেশ, “সেখানে যখন সাংবাদিকরা নিউজ করছিল তখন একটা লোক, মানে রোগা, সোয়েটার পরা আচমকা চলে এসেছিল ক্যামেরার সামনে। লোকটা মানে, দেখে মনে হচ্ছিল খুব একটা সুস্থ নয়। গরমে ও সোয়েটার পরা। খয়েরি সোয়েটার। মানে, তোকে কি বোঝাতে পারছি আমি?”
বকু হাসল। মাথা নাড়ল, বলল, “খুব পারছেন। অমন রত্ন একটিই আছে মুকুটপুরে।”
“কী নাম লোকটার?” আদেশ অধৈর্য হল সামান্য।
বকু বলল, “রক্তিম গাঙ্গুলি নাম লোকটার। তবে সবাই ডারউইন বলে ডাকে।”
“অ্যাঁ, ডারউইন!” আদেশ অবাক হল, “তা, ওকে এখন কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারিস?”
“ডারউইনকে?” বকুকে এবার একটু চিন্তিত দেখাল, “এই সেরেছে, ও কোথায় কখন থাকে সেটা কি ও নিজেই জানে? তবে বিকেলের দিকটায় স্টেশনের কাছে বেবি টিফিন বলে একটা দোকান আছে সেখানে ওকে পাওয়া যায় মাঝে-মাঝে! খাবার চাইতে আসে। তবে রোজ আসে না কিন্তু।”
আদেশ আর কথা বাড়াল না। থ্যাঙ্কস বলে বেরিয়ে এল গেটের বাইরে।
গেস্টহাউজের সামনে থেকেই রিকশা পেয়ে গেল ও। সেটায় উঠে বলল স্টেশনের কাছে বেবি টিফিন নামে দোকানটায় যেতে।
গেস্টহাউজ়় থেকে দোকানে যেতে মিনিটদশেক সময় লাগল আদেশের। দোকানটা একদম রাস্তার উপরে। শিঙাড়া, প্যাটিস, বার্গার ইত্যাদির দোকান এটা। বিকেল বলে ভিড়ও বেশ।
আদেশ রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দোকানের একপাশে দাঁড়াল। ভিড়টা কমলে এগোবে।
মিনিটপনেরো অপেক্ষা করার পর ভিড়টা পাতলা হল দোকানের সামনে থেকে। আদেশ এগিয়ে গেল এবার। বলল, “আমায় ছ’টা শিঙাড়া দেবেন দাদা।”
দোকানের লোকটা যন্ত্রের মতো ঠোঙায় শিঙাড়া ভরে এগিয়ে দিয়ে দামটা বলল।
আদেশ টাকাটা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজ এখানে ডারউইন এসেছিল?”
দোকানের লোকটা এবার থমকাল একটু। অবাক হয়ে তাকাল আদেশের দিকে।
আদেশ আবার বলল, “মানে ওই রক্তিম গাঙ্গুলি আর কী!”
লোকটা বিরক্ত হল যেন, “ডারউইন যে রক্তিম গাঙ্গুলি সেটা আমি জানি। না, ও আজ আসেনি। আপনার কী দরকার। ওর সঙ্গে?”
আদেশ কথা বাড়াল না। ছোট করে বলল, “সে আছে।”
দোকানদার লোকটা ঠোঁট ওলটাল, “এতদিনে এই প্রথম দেখলাম কেউ ডারউইনকে খুঁজছে!”
আদেশ হাল ছাড়ল না। আশপাশের দোকানেও খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু কেউই সঠিক ভাবে বলতে পারল না কিছু।
প্রায় দেড়ঘণ্টা ধরে খুঁজেও ডারউইনের টিকিও পেল না আদেশ। বরং সবাই ওর দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল এমন একজন মানুষকে খুঁজছে বলে!
সন্ধের অন্ধকারে ক্লান্ত হয়ে ফেরার রিকশা ধরল আদেশ। আজ কিছু হল না।
মনের ভেতরে একটা কাঁটার মতো লাগছে আদেশের! তবে কি ববই ঠিক!
“এই যে। ব্যাপারটা কী?”
রিকশা থেকে নামতেই সামনের বড় শিরীষ গাছের আড়াল থেকে আচমকা একটা লোক এসে আদেশের পথ আটকে দাঁড়াল।
আদেশ ঘাবড়ে গেল একটু। তারপর সামলে নিয়ে দেখল একটা বেঁটে, রোগা লোক। গায়ে ঘন রঙের সোয়েটার! মাথার সামনের চারটে চুল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে!
আদেশের বুকে জল এল যেন। সারা বিকেলের পরিশ্রম যেন সফল হল! কারণ এই অন্ধকারেও ও বলে দিতে পারে লোকটার পরে থাকা ওই সোয়েটারের রং গাঢ় খয়েরি!
১৩
সন্ধের মুখে গামাদের বাড়ির সামনে সাইকেলটা থামাল তাতার।
গামাদের বাড়িতে মাঝে-মাঝে আসে ও। তাই জানে এমন সময় গামাকে ওদের বাড়ি থেকে বেরতে দেবে না। কিন্তু আজ দিনটা অন্য রকম।
আসলে গামার থেকেই ও জেনেছিল যে, আজ ওর বাবা আর মা কলকাতা যাবেন ডাক্তার দেখাতে। তাই বাড়িতে গামা আর ওর ঠাকুরমা আছেন!
সাইকেলটা রাস্তার পাশে রেখে তাতার এগোল। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়িটা বেশ বড়। পোক্ত লোহার গেট পেরিয়েই দেখা যায় সুন্দর করে সাজানো একটা বাগান রয়েছে। এই বাগানের মাঝখান দিয়ে ছোট নুড়ির রাস্তা মূল বাড়িটার দিকে গিয়েছে।
তাতার জানে গামার ঘরটা বাড়ির পিছনের দিকে।
গামার ঘরের একটা দেওয়াল ঘষাকাচের। তাতার দেখল, সেখানে আলো জ্বলছে! অর্থাৎ গামা ঘরেই রয়েছে।
তাতার এগিয়ে গিয়ে কাচের গায়ে টোকা দিল।
“কে?” গামার গলা শুনেই ও বুঝল আচমকা এমন টোকার শব্দে ছেলেটা ঘাবড়ে গিয়েছে একটু।
তাতার চাপা গলায় বলল, “আমি তাতার, জানলাটা খোল।”
খুট করে শব্দ হল একটা। গামা কাচের দেওয়ালের মধ্যের একটা চৌকো অংশ খুলে দিল। তারপর ওকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “এ কী রে! তুই এখানে? মেন দরজা দিয়ে আসছিস না কেন?”
তাতার বলল, “ওখান দিয়ে এলে কি ঠাকুরমা এখন তোকে আমার সঙ্গে বেরতে দেবেন?”
“মানে? তোর সঙ্গে কোথায় বেরব?”
তাতার চোয়াল শক্ত করল। এই হচ্ছে গামার সমস্যা। সব সময় সব কিছুতে ভয়!
ও বলল, “তুই পুলিশ না কুইজ় মাস্টার? আমার সঙ্গে যেতে বলছি, যাবি। অত কথার কী আছে? চল বলছি।”
গামা থমকাল একটু। একবার পিছন ফিরে দেখল ঘরে কেউ ঢুকেছে কি না! তারপর বলল, “কিন্তু সাইকেলটা তো বাড়ির সামনের দিকে রাখা! ওখান থেকে তো…”
“আমি তোকে ডাবল ক্যারি করব। আধঘণ্টার কাজ! আমি আবার এসে তোকে দিয়ে যাব। ফালতু ভয় পাস না!”
পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল গামা। তাতার এই আবছায়া আলোতেও দেখল ভারী কাচের আড়ালে গামার চোখ দুটো পিটপিট করছে টেনশনে।
“চল,” তাতার বলল, “আর দেরি করলে হবে না!”
সাইকেলের সামনে গামা উঠে বসল। তাতার সাইকেলটা চালিয়ে দিয়ে বলল, “তোকে আজ এমন একটা জিনিস দেখাব না যে, চোখ চশমাসুদ্ধ কপালে উঠবে তোর!”
গামা জিজ্ঞেস করল, “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমায়? আর সামনে এই পলিথিনের প্যাকেটে এটা কী ঝুলিয়েছিস?”
তাতার দ্রুত প্যাডেল করতে-করতে বলল, “এটায় খাবার আছে। মুরগির মাংস।”
“কী ব্যাপার বল তো?” গামা ছটফট করে উঠল অস্থিরতায়।
“আহ, চুপ করে বস না,” তার ধমক দিল ওকে, “আমরা পিরবাবার বিলের দিকে যাচ্ছি।”
“অ্যাঁ? ওখানে? এখন? ওরে বাবা!” গামা কাঁপা গলায় বলল, “তোকে ওখানে যেতে সবাই বারণ করেছে না? জায়গাটা ভাল নয় জানিস না?”
“চুপ কর গামা,” তাতার কড়া গলায় বলল, “শোন, যা তোকে দেখাব না লাইফটাইম এক্সপিরিয়েন্স! বুঝেছিস? চুপ করে থাক।”
সাইকেলটা বড় গাছের তলায় রাখল তাতার। তারপর প্লাস্টিকের ব্যাগটা হাতে নিয়ে গামাকে বলল, “আয়।”
গামা তাতারের জামাটা টেনে ধরল পিছন থেকে, “এই, কেসটা কী বল তো? জলের কাছে যাব কেন?”
“আয় না,” তাতার ওকে টেনে নিয়ে গেল বিলের পাড়ে। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “এবার দেখবি।”
তাতার প্লাস্টিকের প্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল কাঁচা মুরগির মাংস। তারপর হাঁটু গেড়ে বিলের পাড়ে বসে আর-এক হাত দিয়ে আলতো করে জলের উপর চাপড় মারতে লাগল।
গামা ওর পাশে বসে ফিসফিসে গলায় বলল, “কী করছিস?”
তাতার কিছু বলতে গেল, কিন্তু পারল না। কারণ গামা আচমকা ভয়ে আর উত্তেজনায় খামচে ধরল ওর কাঁধ। তারপর মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল, “এ-এটা কী?”
জলের গভীরে একটা হালকা নীল আলো দেখা যাচ্ছে! আর আলোটা একটু-একটু করে ভেসে উঠছে উপরের দিকে। যেন একটা লম্বা মাছের পিঠ বরাবর কেউ ছোট-ছোট এলইডি লাইট ফিট করে দিয়েছে এমন সার দেওয়া নীল আলো ভেসে উঠছে ক্রমশ!
আস্তে-আস্তে আলোটা উঠে এল জলের উপরে। গামার হাতটা ভয়ে আরও শক্ত করে চেপে বসল তাতারের কাঁধে।
তাতার বলল, “ছাড় আমায়। আর ভাল করে দেখ।”
ওই আবছা নীল আলোয় গামা ভাল করে দেখল। জলের তলায় মাছের মতো লাগলেও আসলে কিন্তু মাছ নয়। প্রাণীটার কোমর থেকে উপরের দিকটা মানুষের মতো আর নীচের অংশটা মাছের মতো! তবে পুরোটাও ঠিক মানুষের মতো নয়! যেমন মাথায় চুল নেই। আর কানের জায়গাতেও কেমন যেন মাছের ফুলকোর মতো! গামার গলা শুকিয়ে গিয়েছে।
তাতার হাতের মাংসটা ছুড়ে দিল জলের দিকে। আর প্রাণীটা টপ করে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল সেটা। হাতটাও কেমন যেন অদ্ভুত। প্রতিটা আঙুল পাশেরটার সঙ্গে পাতলা চামড়া দিয়ে আটকানো!
প্রাণীটা মাংসের টুকরোটায় কামড় বসাল এবার। তারপর অদ্ভুত একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে। অনেকটা শিস আর কাচের গুলি টিনের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়লে যেমন শব্দ হয় তার মিশেল যেন! তারপর আবার টুপ করে ডুবে গেল জলের তলায়। নীল আলোর বিন্দুগুলো মিলিয়ে গেল জলের অন্ধকারে!
“এটা কী?” গামা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল।
“মারমেড!” তাতার ঘাসের উপর বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা।
“না, মারমেড নয়,” আচমকা পাশের অন্ধকার ফুঁড়ে ওদের সামনে এসে হাজির হলেন একজন মানুষ!
এবার তাতারও ঘাবড়ে গেল। চমকে উঠে দেখল পুরো কালো পোশাক পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে সান্টাদাদু!
“সান্টা…” গামা কথা শেষ করতে পারল না।
“ওটা মারমেড নয়।”
তাতার বলল, “কিন্তু হাফ মাছ, হাফ মানুষ মানে মারমেড তো!”
জন হাঁটু গেড়ে বসলেন ওদের পাশে। তারপর বললেন, “মারমেড হল ফেমিনিন জেন্ডার। আর এটা পুরুষ। একে বলে মারম্যান!”
“আ— আপনি জানলেন কেমন করে?” গামার গলা এখনও কাঁপছে!
জন বললেন, “বহুবছর ধরে আমি এইখানে আছি। আগে জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলাম। সারা পৃথিবী ঘুরেছি! জলের রহস্য আমি জানি কিছুটা। আর এইখানে বোট নিয়ে ঘুরতে-ঘুরতে বেশ কয়েকবছর আগে প্রথম দেখতে পাই এদের। না, স্পষ্ট দেখিনি। দেখেছিলাম একঝলক। কিন্তু তারপর থেকেই আমার এদের নিয়ে কৌতূহলের শুরু। তারপর আচমকা দেখলাম গঙ্গায় ডলফিন বেড়ে গেল। মানে গত দশবছরে এত ডলফিন আর কখনও এদিকে আসেনি! আর…”
“ডলফিন বাড়লে কী হয়?” তাতার জিজ্ঞেস করল।
“মারমেড আর মারম্যানরা সাধারণত সমুদ্রেই থাকে। একজোট হয়ে ঘোরে। মাঝে-মাঝে দূরেও পাড়ি দেয়। তবে তাতে নিজেরা সাঁতার কাটে না খুব একটা। বড়-বড় তিমিকে ধরে তাদের সঙ্গে ভেসে যায়। এতে ওদের এনার্জি বাঁচে। মানে সাইকেল চালাতে–চালাতে যেমন কেউ-কেউ লরি বা ম্যাটাডোর ধরে নেয় না, তেমন! তবে নিজেদের অঞ্চলে ওরা ঘুরে বেড়ায় ডলফিনদের সঙ্গে! ডলফিনদের সঙ্গে ওদের ভাবের আদান-প্রদানও হয়। তাই আমার মনে হয়েছিল এবার এদিকে যদি মারমেড বা মারম্যানদের দেখা যায়! আর হলও তাই। এই বিলটার সঙ্গে যোগ আছে গঙ্গার। আমি নিশ্চিত এই মারম্যানটি দলছুট হয়ে চলে এসেছে এখানে। তবে এটা অ্যাডাল্ট মারম্যান নয়, এটা বাচ্চা। তাই হয়তো ঠিক পথ চিনে ফেরত যেতে পারছে না!”
গামা বলল, “এটাকে ধরা যায় না?”
তাতার বলল, “একদম না। ধরবি কেন রে? ধরলেই তো ওকে আটকে রাখবে। কাটাঁছেড়া করবে। সেটা কি ভাল হবে? শুনলি না ও ছোট? বাবা-মায়ের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে! তোকে কেউ ধরলে তোর ভাল লাগবে?”
জন হাসলেন, “ব্রাভো। তবে ওদের ধরা সহজ নয়। জলের অনেক তলায় থাকে ওরা। আর আমি তো ওয়াচ রাখছি। আমি দেখেছি তোমার সামনে ছাড়া ও আর কারও সামনে আসে না।”
“তাই?” গামা অবাক হয়ে তাকাল তাতারের দিকে, “কেন রে, তুই খাবার দিস বলে?”
তাতার বলল, “খাবার? ধুর। বিলে কম মাছ আছে? আমি ক’দিন ধরে এটা-ওটা দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করে দেখলাম ও মুরগির মাংসটা ভাল খায়। তাই নিয়ে আসি। কিন্তু সেজন্য মোটেই নয়।”
“তবে? তবে কীসের জন্য?”
তাতার জলের দিকে তাকাল আবার। তারপর আবছা গলায় বলল, “কে জানে! হয়তো ওকে জাল থেকে বাঁচিয়েছিলাম বলে! হয়তো আমায় বন্ধু ভাবে! হয়তো… জানি না! সব কিছুর কারণ কি সত্যি জানা যায়, বল!”
বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বিলের পাড়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল চারু। বাজার থেকে তাতার আর গামাকে এতটা ফলো করে এসেছে ও। এই সন্ধের সময় দু’জনকে এদিকে আসতে দেখেই সন্দেহ হয়েছিল ওর। মনে হয়েছিল কিছু একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে! তাই পিছু নিয়েছিল ওদের।
কিন্তু কী ঘটল এটা? দূর থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছে না চারু। শুধু দেখল ওরা দু’জন জলের পাশে গেল। আর তারপর জলের ভিতর কেমন যেন একটা নীল আলো ফুটে উঠল! কীসের আলো ওটা? কে রয়েছে জলের তলায়? সান্টাবুড়োই বা কী করছে ওদের সঙ্গে?
চারু আবছা অন্ধকারে তাকিয়ে রইল বিলের দিকে। কী আছে ওখানে? আর তার সঙ্গে তাতার আর গামার সম্পর্কটাই বা কী? তবে যাই থাক সেটা যে তাতাররা লুকোতে চায় তা স্পষ্ট!
চারু চোয়াল শক্ত করল। তাতার ওকে কী বলেছিল সেটা এখনও মনে আছে। কিন্তু আজ তাতারেরও গোপনীয় জিনিসের খোঁজ পেয়েছে ও। এবার তাতারকে চারু বোঝাবে মাঝগ্রীষ্মে কী করে মাঘমাস আসে!
১৪
“তুমি একটা পাগলের কথা বিশ্বাস করলে শেষপর্যন্ত!” বব বিরক্ত মুখে তাকাল আদেশের দিকে, “তিনদিন হয়ে গেল ওই বিলে চক্কর লাগাচ্ছি! কিছু পেলে? যত্তসব! আরে বাবা মারমেড কি অতই সস্তা নাকি যে খাল, বিল, পুকুরের মাছের মতো দেখা যাবে!”
আদেশ উত্তর না দিয়ে চুপ করে শুয়ে রইল কিছুক্ষণ। আসলে বব যা বলছে তা কিছুটা হলেও সত্যি! খাল, বিল, পুকুরের মাছের মতো যে মারমেড উঠবে না সেটা ও জানে। কিন্তু সত্যি বলতে কী এই তিনদিনে যতবারই ও বিলের পাশে গিয়েছে ততবারই ওর একটা গাট ফিলিং হয়েছে যে, এই জলের ভিতরে কেউ একটা রয়েছে! কেন ওর এমন মনে হয়েছে সেটা ও জানে না। কিন্তু হয়েছে! আসলে পৃথিবীর সমস্ত ডিসকভারিগুলোতেই এই ‘মনে হচ্ছে’ ব্যাপারটা খুব কাজ করে! সে গ্যালিলিও থেকে আইনস্টাইন, সবারই গাট ফিলিং ছিল যে, তাঁরা যা খুঁজছেন তা তাঁরা ঠিক পাবেন!
ডারউইন লোকটাকে সবাই পাগল বলে। আর হয়তো সেটা সত্যিও, কিন্তু লোকটা যা বলেছে সবটা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না! বিশেষ করে ওর দেওয়া ডিটেলগুলো।
তবে সেদিন গেস্টহাউজ়ের সামনে ডারউইনকে অমন আচমকা দেখে প্রথমে বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিল আদেশ।
আদেশ বলেছিল, “তুমি ডারউইন?”
ডারউইন মাথা চুলকে ভেবেছিল একটু। তারপর বলেছিল, “‘অরিজিন অব স্পিশিজ়’ না লিখলেও আমি ডারউইনই! তুমি আমার খোঁজ করছিলে কেন? লকনেস মনস্টারের বায়োলজি না ইয়েতির নেস্টিং হ্যাবিট? কী চাও?”
আদেশ সময় নষ্ট করেনি! বলেছিল, “তোমার জলের দানোর কথা শুনতে চাই!”
“জলের দানো?” ডারউইন থমকে গিয়েছিল একটু। ভুরু কুঁচকে ভাল করে তাকিয়েছিল আদেশের দিকে। তারপর বলেছিল, “এই জন্য তুমি আমায় সারা বিকেল খুঁজেছ!”
“হ্যাঁ,” আদেশ বলেছিল, “জলের দানো কি সত্যি আছে?”
“আছে। আমি নিজে দেখেছি! ছোট গাঙের দিকে বিলে আছে,” ডারউইনের চোখমুখ কেমন যেন টালুমালু হয়ে গিয়েছিল, “আমি বলি কেউ মানতেই চায় না! কিন্তু বিকেলে আমি দেখলাম। জলের উপর ভেসে উঠল। অর্ধেক মাছের মতো! মানে মারমেডের মতো দানোটা!”
“মতো কেন? মারমেড নয় কেন?” আদেশ অবাক হয়েছিল!
ডারউইন আবার বলেছিল, “মারমেড তো দেখতে খুব সুন্দর হয়! কিন্তু এটা কেমন যেন! মাথায় চুল নেই। খয়েরি ছোপ-ছোপ শরীর। বড় প্যাঁচার মতো চোখ, মাছের কানকোর মতো কান আর…”
“আর?” আদেশ তাকিয়েছিল ডারউইনের দিকে।
“আর কেমন শব্দ করে মুখ দিয়ে!”
“তুমি ক’বার দেখেছ ওকে?” আদেশ জিজ্ঞেস করেছিল।
“আমি? আমি তো একবার দেখেছি! তারপর আর দেখি না। কিন্তু আমি জানি ওটা দানো! জলের দানো!”
“কী হল? তুমি কী ভাবছ?” বব নিজের বিছানা থেকে উঠে এসে বসল আদেশের বিছানায়।
আদেশ বলল, “ভাবছি উপর-উপর দেখে কিছু বোঝা যাবে না। জলে নামতে হবে।”
“তো নামছ না কেন?”
“কারণ, যে জায়গায় সাইটিংটা হয়েছে সেখানে মাছ ধরার জাল ফেলা থাকে। আমি খবর নিয়েছি যে, রমেন হাজরা বলে একজনের ইজারা নেওয়া আছে বিলের ওইদিকটার।”
“তো?” বব অবাক হল, “আমরা নামতেই পারি! আমি আজই বলে দিচ্ছি, চেন্নাই থেকে প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট নিয়ে তিনজন কালকেই ফ্লাই করে চলে আসবে। দেন উই উইল সার্চ দ্য ওয়াটার!”
“দাড়াও, আমি আগে রমেন হাজরার সঙ্গে কথা বলি। মাছের জাল একটা বাধা। আমাদের জলে নামায় যদি সেগুলোয় ছিঁড়ে যায় তবে ঝামেলা হতে পারে। আর…” আদেশ বিছানা থেকে উঠে পায়চারি করতে শুরু করল, “বব, আমি কিন্তু ফোটোই তুলতে চাই। মানে স্টিল আর মুভি দুটোই। আর চাই ওর গায়ে একটা ট্র্যাকার লাগিয়ে দিতে! ব্যস আর কিছু করতে চাই না আপাতত।”
“সে কী! শুধু ফোটো তুলবে? পাগল! আরে, যদি সত্যি মারমেড থেকে থাকে, আমরা ওটা ক্যাপচার করব! ফোটো তুললে আবার লোকজন বলবে ওটা ফেক, ওটা মর্ফ করা। কিন্তু ইফ উই প্রেজেন্ট দ্য রিয়েল থিং তবে সেন্সেশনটা কেমন হবে বোঝো!” বব উত্তেজিত হয়ে হাতে হাত ঘষল!
“না, একদমই নয়”, আদেশ কড়া গলায় বলল, “আমরা সেন্সেশন তৈরি করতে চাই না। জাস্ট ট্রুথটাকে রিভিল করতে চাই।”
বব বিরক্ত হল, “অত সাধুগিরি করতে হবে না তোমায়। ওদের বায়োলজি জানতে হবে তো! আর টিস্যু স্যাম্পেল নিয়ে দেখতে হবে না? কীভাবে ওরা এল সেটা জানলে মানুষের অরিজিন সম্বন্ধে আরও ভাল করে বোঝা যাবে।”
আদেশ তাকাল ববের দিকে, “আগে মিথটা ভাঙুক। প্লাস আমি চাই ওর গায়ে একটা জি পি এস ট্র্যাকার লাগিয়ে দিতে। যাতে ও যখন আবার সমুদ্রে ফিরে যাবে ওর কমিউনিটিকে আমরা ট্রেস করতে পারব। আর তারপর যদি আমরা ওদের সঙ্গে র্যাপো গড়ে তুলতে পারি…”
“পাগল নাকি? এত যদির উপর বেস করে কেউ থাকে?” বব মুখ বেঁকাল।
“এই জন্যই তো আজ আমাদের এই দশা!” আদেশ বলল, “অত লোভ করতে নেই। গ্রেটার গুডটা দ্যাখো। আমরা যদি ওদের গোটা কমিউনিটিকে ট্র্যাক করতে পারি, তবে ভাবতে পারছ কী হবে?”
বব হাসল। বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। আগে তুমি কথা তো বলো ওই হাজরার সঙ্গে। পরে উই উইল সেটল থিংস।”
“পরে নয়। যা বললাম সেটা যেন মনে থাকে!” আদেশ সরাসরি তাকাল ববের দিকে।
বব কিছু বলল না। শুধু এলোমেলো চুলগুলো দু’হাত দিয়ে ঠিক করতে-করতে হাসল।
১৫
কমলা পুস্তকালয়ে চারটে বইয়ের অর্ডার দেওয়া ছিল সোমেনের। কিন্তু অফিস থাকায় নিজে যেতে পারেননি। তাই তাতারকে বলেছিলেন বিকেলে গিয়ে নিয়ে আসতে।
চারটে বই ক্যারিয়ারে আটকে দোকানের সামনে থেকে সাইকেলটা ঘোরাল তাতার। গামা আগেই সাইকেল ঘুরিয়ে রাস্তার অন্যদিকে অপেক্ষা করছিল।
সিটে উঠে গামার দিকে তাকিয়ে তাতার বলল, “চল।”
ফেরার পথে আর স্টেশন রোডটা ধরল না ওরা। বরং পাড়ার ভিতর দিয়ে একটু ঘুরে ফিরবে ঠিক করল।
এদিকটা নির্জন।
গামা বলল, “আজ সন্ধেবেলাতেও যাবি?”
“হাঁ যাব তো?”
“কিন্তু, একটা কথা বলি? তুই যে এই মারম্যানের সঙ্গে জলে নেমে সাঁতার কাটিস এটা কিন্তু ঠিক করিস না। মানে যদি তোর কিছু হয়ে যায়?”
“কিচ্ছু হবে না,” তাতার হাসল, “ও আমার বন্ধু তো!”
কথাটা শেষ করতে পারল না তাতার। তার আগেই ওর নাম ধরে কেউ একটা ডাকল। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে পাশে তাকাল ও।
ডানদিকে একটা গলি চলে গেছে। সেখান থেকে ওদের দিকে হাত তুলে দাঁড়াতে বলছে চারু!
তাতারের ভুরু কুঁচকে গেল। আজ আবার কী চায় ছেলেটা!
চারু ওর সাইকেলটা এনে দাঁড় করাল ওদের সামনে। তারপর বলল, “কীরে কালা নাকি? শুনতে পাস না?”
তাতার শক্ত গলায় বলল, “না শুনলে দাঁড়ালাম কেন? কী দরকার তোর?”
চারু ভণিতা করল না একটুও। বলল, “আমি দেখেছি!”
“কী?”
“তোদের। ছোট গাঙের দিকে পিরবাবার বিলে তোরা সন্ধেবেলা কী করিস?”
তাতার থমকাল একটু। এই সেরেছে! এই ব্যাটা জানে তবে! কিন্তু এই আশ্চর্য হওয়াটা মুখে প্রকাশ করল না ও। স্বাভাবিক গলায় বলল, “কী বলতে চাস তুই?”
চারু বলল, “আমাকেও দেখাতে হবে ওই নীল আলোর প্রাণীটাকে।”
“নীল আলো?” তাতার অবাক হওয়ার ভান করল, “নেশা করছিস নাকি আজকাল?”
চারু বলল, “কথা ঘুরিয়ে লাভ হবে না। আমি জানি। তুই, গামা আর সান্টাবুড়ো। তোরা তিনজনে যাস ওখানে। আমি বেশ ক’দিন ওয়াচ করেছি!”
গামা এবার মুখ খুলল, “তো?”
“তো মানে? আমায় দেখাবি। নয়তো বাবাকে বলে দেব। সবাইকে বলে দেব,” চারু কোমরে হাত দিল।
“যা বল গিয়ে,” তাতার মাথা নাড়াল, “কেউ তোকে বিশ্বাস করবে না। ভাববে তুই ডারউইন টু!”
“দেখবি তবে? বাবাকে বলে ওই প্রাণীটাকে ধরে চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেব,” চারু তীক্ষ্ণ গলায় বলল।
“শোন,” তাতার আচমকা সাইকেল থেকে নেমে এসে দাঁড়াল চারুর সামনে। তারপর কেটে-কেটে বলল, “তুই যাকে ধরার কথা বলছিস সে আমার বন্ধু। ওর গায়ে যদি হাত পড়ে না তোকে আমি ছাড়ব না চারু। আমার নাম কিন্তু এমনি তাতার নয়। ইতিহাস খুলে দেখিস তাতারদস্যুরা কতটা ভয়ংকর ছিল!”
১৬
রমেন হাজরার বাড়িটা বিশাল বড়!
বাড়ির মূল ফটকের বাইরে রিকশাটা ছেড়ে দিল আদেশ।
লোহার দরজা। পাশে দু’জন দরোয়ান রয়েছে।
গেটের কাছে গিয়ে আদেশ নিজের কার্ডটা বের করে একজন দরোয়ানকে দিয়ে বলল, “আমরা একবার রমেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
দরোয়ানটি একবার আদেশকে দেখল। তারপর দেখল ববকে। আর সঙ্গে-সঙ্গে দরোয়ানটির মুখের ভাব বদলে গেল। মনে-মনে হাসল আদেশ। এখনও এদেশের বহু মানুষের সাদা চামড়া দেখলে সম্ভ্রম বেড়ে যায়!
দরোয়ানটি ওদের গেটের ভিতরে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির দিকে চলে গেল।
বব আদেশের দিকে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, “আমি চেন্নাইয়ে ফোন করে দিয়েছি। ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ওরা চলে আসবে। কিন্তু ওদের সব অ্যারেঞ্জ করে আসতে পরশু হয়ে যাবে। আর আমি বলেছি কলকাতা থেকে একটা মোটরবোট জোগাড় করতে।”
“মোটরবোট!” অবাক হয়ে তাকাল আদেশ।
বব বলল, “হ্যাঁ, মোটরবোট। যদি ওর গায়ে কোনও ট্র্যাকার লাগাও, তবে ওকে ফলো করতে হবে তো! অন্তত প্রাথমিক ভাবে তো ওর পিছনে যেতেই হবে! তুমি নিশ্চয়ই ট্র্যাকার লাগিয়ে ওকে ওই বিলেই রেখে দেবে না! নদীতে ছাড়বে তো ধরে নিয়ে গিয়ে। তাই না?”
আদেশ কিছু বলার আগেই দরোয়ানটি ফিরে এল। বলল, “আপনারা ভিতরে যান স্যার। সোজা যাবেন। ওখানে মোতিবাবু রয়েছেন। উনি আপনাদের নিয়ে যাবেন।”
দু’পাশের ছোট-বড় গাছের মধ্যে দিয়ে পথটা বেঁকে গিয়েছে বাড়ির দিকে। সময়টা বিকেল হলেও দু’পাশের গাছের জন্য পথটা ছায়াময় হয়ে রয়েছে। আর গরমটাও তেমন নেই।
এই পথ ধরে কিছুটা এগিয়ে মূল বাড়িটাকে এবার দেখতে পেল আদেশ। হলুদ রঙের বাড়িটা রোদের নীচে যেন স্ফিংসের মতো বসে রয়েছে!
গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়ানো ধুতি-পাঞ্জাবি পরা লোকটা যে মোতিবাবু সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না আদেশের।
ওদের দেখে মোতিবাবু নিজেই এগিয়ে এলেন, “আসুন-আসুন। স্যার বৈঠকখানাতেই আছেন।”
বাড়ির বাইরেটার মতো ভিতরটাও চোখধাঁধানো! মার্বেলের গোলাপি-সবুজ মেঝে। মেহগনি কাঠের আসবাব। কাটগ্লাসের ঝাড়বাতি! দেখেই বোঝা যায় আজকের জিনিস নয়!
আদেশরা মোতিবাবুর পিছন পিছন ড্রয়িংরুমের দিকে গেল।
ড্রয়িংরুমটাই কলকাতায় আদেশদের বাড়ির গোটা দোতলাটার সমান। এত বিশাল ঘরের মধ্যে রমেন হাজরাকে যেন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে। কারণ রমেন হাজরার হাইট বড়জোর পাঁচফট!
ওদের দেখে রমেন উঠে দাঁড়ালেন, “আসুন। বসুন প্লিজ়।”
নরম সোফায় প্রায় ডুবে গেল আদেশ।
রমেন বললেন, “আপনার কার্ডটা দেখলাম। কিন্তু আমার সঙ্গে আপনাদের কী দরকার সেটা তো… মানে…”
আদেশ বলল, “আসলে আমরা এই অঞ্চলের ওয়াটার বডিজ় নিয়ে রিসার্চ করছি। মানে,যদি কোনও আননোন কোয়ানটিটি কিছু থেকে থাকে আর কী!”
“আননোন কোয়ানটিটি মানে?” রমেন আগ্রহী হয়ে এগিয়ে বসলেন।
“দেখুন, এখনও পৃথিবীর প্রচুর রহস্য অজানা রয়েছে। আমরা তেমনই একটা নতুন জলচর প্রাণীর খবর শুনে এসে এখানকার খাল-বিলগুলো একটু পরীক্ষা করতে চাইছি! তাই আপনার হেল্প লাগবে!”
“এখানকার কোনও নির্দিষ্ট ওয়াটারবডির কথা আপনারা বলতে চাইছেন? নাকি যত রয়েছে তার সবটাতেই দেখবেন?”
“না,” আদেশ একবার ববকে দেখল। তারপর বলল, “ওই পিরবাবার বিলটা!”
“পিরবাবার বিল!” রমেন আবার পিছিয়ে বসলেন, “তা দেখুন না তার জন্য আমার সঙ্গে দেখা করা কেন?”
“কারণ বিলের তো দুটো ভাগ। একটা ভাগ শহরের দিকে। আর অন্যটা ছোট গাঙের দিকে। দুটো ভাগের মাঝখানে জাল দিয়ে ভাগ করা। তাই না?”
রমেন সামান্য অবাক হলেন, “হ্যাঁ, ঠিক তাই। আসলে ছোট গাঙের দিকে বিলের যে অংশ, সেটা আমি ইজারা নিয়েছি মাছ ধরব বলে। তাই ওই জাল দিয়ে সেই অংশটাকে অন্য অংশের চেয়ে আলাদা করে রাখি। ছোট গাঙের দিক থেকে বিলে জল ঢোকে। তারপর মাছ ধরার মরশুম এলে সেই জল ঢোকার সোর্সটাতেও আমি বড় ঝাঁঝরি লাগিয়ে দিই। যাতে ছোট মাছ ঢুকলেও তেমন বড় রাক্ষুসে কোনও মাছ ঢুকে না পড়ে। পরে আবার কাজ হয়ে গেলে, মানে শরতের শেষে, ঝাঁঝরিটা খুলে রাখি।”
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার বব বলল, “দ্যাট এক্সপ্লেন্স এভরিথিং! ও ভিতরে ঢুকে পড়লেও ওই বড় ঝাঁঝরির জন্য বেরতে পারেনি!”
“মানে?” রমেনবাবু আবার ঝুঁকে বসলেন।
আদেশ বিরক্ত হল। ববের এই কথাটা না বললেই চলছিল না!
ও বলল, “মানে আমরা ওই মাছ ধরার দিকটা একবার দেখতে চাই। মানে যন্ত্রপাতি নিয়ে জলে নেমে পরীক্ষা করতে চাই।”
“আপনারা কী ভাবছেন? মাছ ছাড়াও অন্য কিছু ঢুকে পড়েছে ওখানে? দাঁড়ান-দাঁড়ান,” রমেন এবার উঠে দাঁড়ালেন, “কিছুদিন আগে একটা জাল পুরো কাটা ছিল! মানে এটা খুবই আনইউজুয়াল। মোতিবাবু বলছিলেন যে, জেলেরা বলছে তারা গোটা জালই বিছিয়েছিল, কিন্তু কীভাবে কে জানে জালটা পুরো ফালা হয়ে গিয়েছিল!”
আদেশ বলল, “আমরা চাইছিলাম যদি আপনি ওইদিকে জলে নামার অনুমতি দেন! জালটা যদি দু’দিনের জন্য সরিয়ে দেন।”
বব আবার বলল, “মানে আমরা আপনাকে শুধু-শুধু করতে বলছি না। উই ক্যান পে ফর ইওর লসেস। আমরা…”
রমেন হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ববকে। তারপর বললেন, “টাকার কথা হচ্ছে না। আমি টাকার কথা ভাবি না। আপনাদের কথা শুনে আমার কৌতূহল হচ্ছে। ঠিক আছে। আমি বন্দোবস্ত করছি। আমার একদিন টাইম লাগবে। মানে আজকের দিনটা। কাল বিকেল থেকে আপনারা কাজে লাগতে পারেন। শুধু…”
“শুধু?” আদেশ তাকাল রমেনবাবুর দিকে।
“শুধু তেমন কিছু যদি পান আমাকে দেখাবেন। আর আমার নামটাও যেন থাকে এই ব্যাপারে। মানে, আমি যে আপনাদের সহযোগিতা করছি সেটা যেন উল্লেখ থাকে! কেমন?”
কথা শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়াল আদেশরা।
মোতিবাবু ওদের এই গাড়িবারান্দায় অপেক্ষা করতে বলে ড্রাইভারকে ডাকতে গিয়েছেন। ওদের পৌঁছে দেবেন।
আদেশ বলল, “বব, ফস করে তুমি ওই কথাটা না বললেও পারতে। ভদ্রলোক যদি পাঁচকান করেন কথাটা!”
বব বলল, “আরে করবেন না। উনি এটুকু বোঝেন। তবে জলের মধ্যে…” কথাটা শেষ করতে পারল না বব। আচমকা একটা গলা পেল আদেশ, “আছে, জলের মধ্যে কিছু একটা আছেই।”
আদেশ চট করে পিছনে ফিরল। আর অবাক হয়ে দেখল একটা ছেলে! রোগা, ছোটখাট চেহারা। কখন যেন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে! আর বেশ ভালই ইংরিজিতে কথা বলছে!
“কী বলছ তুমি?” আদেশ ঝুঁকে পড়ল।
ছেলেটা বলল, “আমি দেখেছি নিজে। তাতার আর গামা যায় সন্ধেবেলা। সঙ্গে সান্টাবুড়োও থাকে!”
“সান্টা!” বব ভুরু কোঁচকাল। তারপর আদেশকে চাপাগলাম বলল, “এখানে ম্যাক্সিমাম লোকজনের মাথার স্কু-ই কি ঢিলে নাকি?”
আদেশ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল, “কী বলছ তুমি? তোমার কী নাম?”
“আমি চারু। আপনারা আমার বাবার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলেন। আমি জানি ইভসড্রপ করা খারাপ। কিন্তু তাও কথাগুলো কানে এসেছে আমার! আমি দেখেছি নিজে। ছোট গাঙের ওদিকে সন্ধের মুখে তাতার আর গামা যায়। সান্টাবুড়োও আসে। ওরা তিনজনে মিলে জলের কাছে বসে। জলে খাবার ছুড়ে দেয়। আর জলের তলার থেকে কী যেন একটা ভেসে ওঠে! তার গায়ে নীল রঙের আলো জ্বলে। এলইডি লাইটের মতো আলো! তাতার তো কয়েকবার জলে নেমেছে ওই প্রাণীটার সঙ্গে!”
আদেশ চট করে তাকাল ববের দিকে। দেখল উত্তেজনায় ববের মুখটা লাল হয়ে গিয়েছে!
আদেশ বলল, “তুমি আমাদের দেখাতে পারবে?”
“আজ তো পারব না! আজ সন্ধেবেলা পড়া আছে। স্যার পড়াতে আসবেন। কামাই করলে খুব বকেন। তবে কাল সন্ধেবেলা পারব,” চারু আমতা-আমতা করে বলল।
“ঠিক আছে, কাল সন্ধেবেলাই সই!” আদেশ এবার ববকে বলল, “তোমার লোকদের যে করেই হোক কালকের মধ্যে আসতে বলো। পরশু করলে হবে না।”
চারু বলল, “ঠিক আছে তবে, কাল সন্ধেবেলা আমি নিয়ে যাব আপনাদের। ওই সময়টায় তাতাররা আসে। ওকে দেখলেই শুধু প্রাণীটা বেরয় জল থেকে। তখন আমি ওটা দেখিয়ে দেব দূর থেকে! আপনারা ধরবেন ওটাকে। হুঁ, আমায় বলে কিনা নাক গলাতে হবে না, তা হলে নাকি নাক কেটে দেবে! ওটা নাকি ওদের বন্ধু! ঠিক আছে এবার দেখব কার নাক থাকে আর কারটা কাটা যায়!”
গাড়িবারান্দার পাশের মোটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে বড়-বড় চোখ করে সবটা শুনল রুপু! এসব কী শুনছে ও! এই লোকগুলোকে কী বলল চারু! আর লোকগুলোই বা কী করবে? তাতারকে জব্দ করতে এই বাইরের লোকগুলোকে পিরবাবার বিলের জলের তলার কোন প্রাণীকে দেখিয়ে দেবে চারু? ওই জলের তলায় সত্যি কে আছে?
১৭
জুলু আজ বাড়িতেই আছে। নিজের ঘরে বসে কম্পিউটারে খুটখাট করছে কিছু।
জুলু বাড়ি থাকলে এই সন্ধের মুখটায় পিরবাবার বিলে যেতে পারে না তাতার।
আজকাল ওই মারম্যানকে না দেখলে কেমন যেন লাগে তাতারের। এই ক’দিনেই কেমন যেন একটা সখ্য তৈরি হয়ে গিয়েছে ওর সঙ্গে। তাই মারম্যানের একটা নামও দিয়েছে তাতার। মাসাই!
“মাসাই!” নামটা শুনে খুব অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিল গামা, “হঠাৎ এমন নাম দিলি কেন?”
তাতার বলেছিল, “আমার দাদা জুল, আমি তাতার আর ও মাসাই! তিনটেই ওয়ারিয়র ট্রাইব। উই ফাইট টু লিভ অ্যান্ড উই লিভ টু ফাইট!”
“মাসাই আবার কী ফাইট করল?” গামা ভারী চশমার ওপার থেকে জুলজুল করে তাকিয়েছিল ওর দিকে।
“এই এলিয়েন পরিস্থিতিতে টিকে থাকাই তো আসল লড়াই রে। ওরও তো বাবা-মা রয়েছে। কিন্তু দ্যাখ, কতদিন এখানে আটকে আছে! আমি তো ওর সঙ্গে জলে নামি, তাই জানি ওর লেজের একটা দিক ভেঙেও গিয়েছে। ঠিকমতো সাঁতার কাটতেও পারে না! তাও হি ইজ় সারভাইভিং। এটা ফাইট নয়তো কী?”
“কীরে বসে-বসে কী করছিস? খাবারটা দিয়েছি, খাবি না?” মাধুদার কথায় মুখ তুলে তাকাল তাতার।
তাতারের বিরক্ত লাগল। কেউ যদি ওকে একটুও শান্তিতে থাকতে দেয়! সোমেনের এখন ‘বি’ শিফ্ট ডিউটি চলছে! মানে দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত অফিস। তাতার ভেবেছিল এই সুযোগে সন্ধেবেলাগুলোয় মাসাইয়ের সঙ্গে কাটাবে! কিন্তু তার কি উপায় আছে? মাধুদা যেন দম না ফুরোনো এক ঘড়ি! সারাক্ষণ ওর পিছনে টিকটিক করেই চলেছে।
তাতার প্লেটটা টেনে নিল। তারপর বলল, “তুমি যাও। আমি খেয়ে প্লেটটা রেখে আসব!”
খাওয়া শেষ করে প্লেটটা রেখে এসে ঘরে ঢুকল তাতার।
জুলু স্ক্রিনের থেকে মুখ না সরিয়েই বলল, “তুই নাকি আজকাল রোজ সন্ধেবেলা বেরোস! কোথায় যাস? পিরবাবার বিলে?”
তাতার বলল, “কেন?”
জুলু এবার মুখ ফিরিয়ে তাকাল ওর দিকে, “প্রশ্নের উত্তর কি আর-একটা প্রশ্ন হয়? আজকাল খুব অবাধ্য হয়ে গিয়েছিস তুই! বল, কেন সন্ধেবেলা বেরোস? বাবা জানলে কী হবে ভেবেছিস?”
তাতার সময় নিল একটু। তারপর বলল, “দাদা একটা কথা বলি? তোদের কি মনে হয় যে, আমিও মায়ের মতো জলে ডুবে যাব? আমি কত ভাল সাঁতার কাটি জানিস না?”
জুলু থমকাল একটু। তারপর উঠে এসে বসল ওর পাশে। বলল, “মাও খুব ভাল সাঁতার কাটতেন। ন্যাশনালে সিলভার ছিল মায়ের। কিন্তু তাও পায়ে ঝাঁঝরি আটকে… শোন, জীবনে কোনও কিছুতেই ওভার কনফিডেন্ট হওয়া ভাল নয়। বাবা এমনিতেই টেনশনে থাকেন। অত বড় একটা অয়েল ডিপোজ়িটের মেন্টেনেন্স কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। তার উপর এখন খাঁড়ির মুখে জাহাজ লেগেছে। তেল নামছে। বাবা আরও স্ট্রেসড হয়ে আছেন। তুই কিছু উলটোপালটা করিস না।”
“উলটোপালটা মানে? আর তোকে কে বলল আমি সন্ধেবেলা বেরোই?”
জুলু হাসল, “শোন, আমরা কিন্তু আগে মুকুটপুরেই থাকতাম। এখানে আমার বন্ধুবান্ধবও তো রয়েছে কিছু। তোকে প্রায় সবাই চেনে এখানে। তাই কী করছিস সেটা আমি জানতে পারব না?”
তাতার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ বাইরের ঘরে গামার গলা পেল। ও শুনল গামা জিজ্ঞেস করছে, “মাধুদা, তাতার নেই?”
গামার কথা বলার ধরনে কিছু একটা ছিল যে, শুধু তাতারই নয় জুলুও বেরিয়ে এল ঘর থেকে। আর বেরিয়েই অবাক হয়ে গেল ওরা। দেখল গামা আজ একা আসেনি। ওর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে রুপু!
“তোরা?” তাতার এগিয়ে গেল।
“হ্যা,” ঠোট চাটল গামা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, বেশ ঘাবড়ে আছে ও। গামা বলল, “একটা ঘটনা ঘটেছে। তবে…”
“কী তবে?” তাতার গামার কাঁধ ধরে বলল, “ন্যাকামো করছিস কেন? বল না।”
জুলু আর মাধুদার দিকে তাকাল গামা।
জুলু বলল, “আমার সামনেই বল। আমি কোথাও যাব না। তোরা কি কোনও কাণ্ড ঘটিয়েছিস?”
“না, মানে…” গামা তাও দ্বিধা করতে লাগল।
“আমি বলছি,” রুপু আর সময় নষ্ট করল না, “গতকাল বিকেলে আমাদের বাড়িতে দু’জন লোক এসেছিল বাবার কাছে। ওরা পিরবাবার বিল মানে, যেদিকটায় মাছ ধরা হয়, সেখানে কিছু একটা করবে। মানে কোনও একটা প্রাণীকে ধরবে!”
“কী?” তাতার নিজের অজান্তেই চিৎকার করে উঠল।
রুপু বলল, “চারু ওদের হেল্প করবে। বিলের জলে নাকি নীল রঙের আলো জ্বলে! আজ সন্ধেবেলা ও ওই দুটো লোককে নিয়ে বিলের কাছে যাবে। আমি এটুকুই শুনেছি।”
তাতার বিরক্ত হয়ে বলল, “গতকাল বিকেলে শুনেছ আর এখন এসে বলছ! এতক্ষণ পরে!”
রুপু বলল, “আমি ঠিক বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস। আর মাও বাড়ি থেকে বেরতে দেয়নি। প্লাস জান তো আমায় বাড়িতে মোবাইল ফোন ধরতেই দেন না বাবা-মা! তারপর আজ বিকেলে চারু নিজের থেকেই আমায় বলল যে, তাতার আর গামার দফারফা করবে! বলল, আর মাঘ মাসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। তাতারকে আজই উচিত শিক্ষা দেবে!”
“তাই?” তাতার চোয়াল শক্ত করে তাকাল রুপুর দিকে। তারপর জুলুর দিকে তাকিয়ে বলল, “দাদা, তোর মোবাইলটা দিবি একটু? খুব দরকার।”
জুলু বলল, “কী হয়েছে তাতার? চারু এসব বলছে কেন? আর বিলের জলে নীল রঙের আলো মানে? কোন প্রাণীর কথা বলছে?”
“দে না ফোনটা,” তাতার চিৎকার করে উঠে জুলুর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিল মোবাইলটা। তারপর দ্রুত একটা নম্বর ডায়াল করে কানে লাগাল।
জুলু তাকাল গামার দিকে। ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী করেছিস তোরা? কী সর্বনাশ করেছিস? বিলের জলে কী আছে?”
গামা থতমত খেয়ে অস্ফূটে বলল, “মানে, মা-মাসাই!”
“মাসাই?” জুলু অবাক হয়ে তাকাল তাতারের দিকে।
তাতার সেসব পাত্তা দিল না। প্রথমবার রিংয়ে ওদিকে কেউ ফোন তোলেননি। ও আবার রিং করতে গেল।
জুলু এবার হাত চেপে ধরল ওর, “কী হল বল। বল কী হয়েছে?”
তাতার হাতটা ছাড়িয়ে বলল, “আমায় কলটা করতে দে। না হলে খুব বিপদ হয়ে যাবে মাসাইয়ের।”
তাতার আবার কল করল। চারবার রিং হওয়ার পরে এবার ফোনটা ধরা হল ওদিক থেকে।
তাতার উত্তেজিত গলায় বলল, “মাসাই ইজ় ইন ডেঞ্জার। প্লিজ় হেল্প আস। আমরা যাচ্ছি বিলে। আপনিও আসুন জনদাদু। প্লিজ় আসুন।”
কথাটা শেষ করে ফোনটা কোনও মতে জুলুর হাতে ফেরত দিয়ে তাতার দৌড়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। আর ওদের পিছন- পিছন গামা আর রুপুও বেরিয়ে গেল!
জুলু বুঝতে পারল না কী করবে! কিছুক্ষণের জন্য কেউ যেন ওর দুটো পা সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে দিল মেঝের সঙ্গে! মেন গেটের আওয়াজ শুনে ওর সংবিৎ ফিরল। তাতার বেরিয়ে গেল! কোথায় গেল ও? জনদাদুই বা কে? কী হতে চলেছে সামনে?
জুলু আর অপেক্ষা করল না। ও চট করে দেওয়ালে ঝোলানো ওর সাইকেলের চাবিটা নিল। তারপর দৌড়ে গেল বারান্দার দিকে। শুধু যেতে-যেতে মাধুদাকে বলল, “আমি যদি কুড়িমিনিটের মধ্যে না ফিরি তবেই বাবাকে ফোন করবে। কেমন?”
মাধুদা ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথায় যাচ্ছিস আবার?”
জুলু চোয়াল শক্ত করে বলল, “হতে পারে তাতার দুষ্টু, অবাধ্য। কিন্তু তাও আমার ভাই তো। ওর কোনও বিপদ আমি হতে দিতে পারি মাধুদা?”
১৮
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা চারটে লোককে আবার দেখল আদেশ। লোকগুলো সবাই বিদেশি। সবাই ছ’ফুটের উপর লম্বা আর রাগবি প্লেয়ারদের মতো চেহারা। মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় সোজা পথে জীবন দেখতে এরা খুব একটা অভ্যস্ত নয়।
লোকগুলো ববের ডাকে এসেছে।
বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকল আদেশ। গোটা পরিবেশটা ওর কেন কে জানে ভাল লাগছে না একদম!
বব ওর দিকে পিছন ফিরে ঝুঁকে পড়ে বিছানায় রাখা নিজের ব্যাগটা ঘাঁটছিল। আদেশের ঘরে ঢোকার শব্দে পিছন ফিরে তাকাল।
“কী করছ?” আদেশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “বেরতে হবে তো!”
বব হেসে এবার ঘুরে দাঁড়াল।
আঁতকে উঠল আদেশ, “এ কী! তোমার হাতে পিস্তল কেন?”
বব বলল, “তো হাতে কি ফুলের বোকে থাকবে নাকি? আমরা কি সঠিক ভাবে জানি কোন প্রাণী ধরতে যাচ্ছি! সেটা যদি ফেরাশাস হয়! আমার হাতে তো শুধু পিস্তল আছে, আমার লোকেদের কাছে আরও বড় জিনিস রয়েছে!”
আদেশ চোয়াল শক্ত করে এগিয়ে গেল ববের দিকে। বলল, “বব, আমি কিন্তু প্রথম থেকেই বলছি আমরা জাস্ট ফোটো নেব। মারমেড থাকলে তাকে ধরব না। নেচারের কোনও কিছুকেই কিন্তু আমরা নিজের ইচ্ছেমতো বন্দি করতে পারি না। মনে রেখো মানুষের এই ব্যবহারের জন্যই কিন্তু একদিন মারমেডরা মানুষের থেকে দূরে সরে গিয়ে লুকিয়েছিল সমুদ্রের গভীরে!”
“মানে?” বব অবাক হল একটু।
আদেশ বলল, “মিশরে কিছু স্যান্ডস্টোন কেভ পাওয়া গিয়েছে। প্রায় তিরিশহাজার বছরের পুরনো সেই গুহাগুলো। আগে এখানে জল ছিল, এখন সরে গিয়েছে বহু দূর। তবু সেইসব জলাশয়ে পাশের মানুষগুলোর স্মৃতি রয়ে গেছে আজও। গুহার দেওয়ালে তাদের ছবিতে সেইসব মানুষ লিখে গিয়েছে এক অদ্ভুত ইতিহাস! সেখানের দেওয়ালে, লেজওয়ালা মানুষরা হাতে বর্শা নিয়ে জলে সাঁতার কেটে মাছ ধরছে, এমন ছবি আঁকা রয়েছে। মানুষও তখন মাছ ধরত। তাই বলা যায় সেসময় ভ্যালুয়েবল ফুড সোর্স ছিল এই মাছ! সেটা নিয়েই সম্ভবত মানুষ আর এই জল-মানুষদের মধ্যে রাইভালরি ছিল। বলা হয়, সেই মাছের দখলদারি নিয়ে যুদ্ধে মানুষরা এই মারমেডদের মেরে সরিয়ে দেয়। এসবই সেই গুহাচিত্রে ধরা রয়েছে। বোধ হয় সেই থেকেই একটা জলজ্যান্ত স্পিশিজ় মিথে পরিণত হয়ে গিয়েছে! কে জানে আমরা সেই অত হাজারবছর আগে ওদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি নাকি উই ড্রোভ দেম ইন্টু হাইডিং! তাই বলছি, যদি সত্যি মারমেড থাকে তবে আবার এমনটা কোরো না।”
“আমি যা করার করব,” বব পিস্তলটা শোল্ডার হোলস্টারে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল, “ছেলেটা তো এল না! বাচ্চা ছেলে, আসবে কি শেষ পর্যন্ত? আমাদের কিন্তু সব রেডি। এমনকী, ছোট গাঙে বোটও এনে রাখা হয়েছে।”
বাইরে দরজায় এবার একটা টোকার শব্দ হল। আদেশ এগিয়ে গিয়ে খুলে দিল দরজাটা। সেই ছেলেটা! চারু!
“এসো।”
“আমি আসছি একমিনিটের মধ্যে। বাইরে ওদের দু’-একটা কথা বলার আছে। তোমরা কথা বলে নাও,” বব বেরিয়ে গেল বাইরে।
চারু ভয়ে-ভয়ে চারদিকটা দেখল একবার।
আদেশ হাসল, বলল, “বাড়িতে বলে এসেছ?”
চারু মাথা নাড়ল, “না, মানে… তবে কোনও প্রবলেম নেই। রাত ন’টার মধ্যে বাড়ি ঢুকলেই হবে।”
আদেশ বলল, “একটা কথার উত্তর দেবে?”
“বলুন।”
আদেশ বলল, “এটা কি তুমি কোনও রিভেঞ্জ নিতে করছ?”
“মানে?” চারু কেমন যেন একটু নড়ে গেল।
“মানে,” আদেশ বসল সামনে, “মানে সেদিন বললে না, কার নাক থাকবে কি না!”
চারু কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিল।
আদেশ বলল, “আমি কিন্তু ওই প্রাণীটার ক্ষতি করতে যাচ্ছি না চারু, শুধু ফোটো তুলতে যাচ্ছি। ওদের নাক বা কান কাটার কথা মাথায় এনো না। জানবে কারও ক্ষতি করে কিন্তু নিজের জীবনের উন্নতি হয় না!”
বব ঘরে ঢুকল আবার। তারপর বলল, “চলো। আমরা রেডি। লেটস গো অ্যান্ড ফাইন্ড আউট দ্য ট্রুথ।”
আদেশ উঠল। মনটা ভাল লাগছে না। কু ডাক ডাকছে। বারবার মনে হচ্ছে সামনে বিস্তর গন্ডগোল অপেক্ষা করে রয়েছে ওর জন্য!
১৯
আজ আকাশটা কেমন যেন লাল হয়ে আছে! দমচাপা, গুমটভাব ছড়িয়ে রয়েছে চারিদিকে।
তাতার আরও জোরে সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাল। মাথার ভিতর একটা রাগ দপ দপ করছে! চারুটা এত শয়তান! বাইরের লোকদের জানিয়ে দিল ব্যাপারটা!
“তাতার সামলে। অন্ধকারে দেখে চলো!” পিছন থেকে রুপু চিৎকার করে উঠল।
তাতার কিন্তু সাইকেলের গতি কমাল না। বরং আরও জোরে প্যাডেল ঘোরাল। যে করেই হোক মাসাইকে বাঁচাতে হবে। কে জানে জনদাদু এতক্ষণে বিলের পাড়ে চলে এসেছেন কি না!
ছোট গাঙের রাস্তার থেকে ডানদিকে বাঁক নিল তাতার। পিছনে সাইকেলের শব্দ শুনে বুঝল বাকিরাও রয়েছে।
“তাতার। দাঁড়া, এই তাতার।”
আচমকা জুলুর গলাটা শুনে একটু চমকে উঠল তাতার! নিমেষের জন্য পিছনে তাকাল আর সঙ্গে-সঙ্গে হাতলটা নড়ে গেল ওর! সাইকেলটা অন্ধকার রাস্তায় একটা পাথরে লেগে লাফিয়ে উঠল। তাতার নিমেষের মধ্যে ভেসে উঠল সামনে। তারপর ছিটকে পড়ল রাস্তায়!
আবছা অন্ধকারটা যেন ব্যথার চোটে তালগোল পাকিয়ে গেল আরও! একটা তীব্র যন্ত্রণা বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে। তাতারের মনে হল ডানপা আর হাতটা বোধ হয় ভেঙেই গিয়েছে!
জুলু সাইকেল থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসল ওর সামনে, “তাতার, কী হয়েছে? কোথায় লেগেছে? তুই কী করছিস?”
তাতার সামান্য সময় নিল। হাত-পা নেড়ে দেখল, না, কিছু হয়নি! শুধু কেটে গিয়েছে কয়েকটা জায়গায়। চিনচিন করছে! ও উঠে দাঁড়াল সোজা হয়ে। বলল, “দাদাভাই, আমি সব বলব। কিন্তু এখন নয়। প্লিজ় মাসাইকে… মাসাইকে ওরা…”
তাতার সাইকেলটা তুলল মাটি থেকে। কিন্তু দেখল সাইকেলের মাডগার্ড তুবড়ে গিয়েছে। চেনটাও ছিঁড়ে ঝুলছে! ও সময় নষ্ট না করে জুলুকে বলল, “প্লিজ় আমায় ক্যারি কর। প্লিজ়।”
তাতারের গলায় এমন কিছু ছিল যে, জুলু আর সময় নষ্ট করল না। গামা আর রুপুর দিকে তাকাল একবার। তারপর তাতারকে বলল, “বোস।”
বিলের ধারে পৌঁছে সাইকেল থেকে নামল তাতার। পায়ে লাগছে, কিন্তু সেটা খুব একটা গ্রাহ্য করল না ও। আবছা অন্ধকারে জনদাদুর অবয়বটা দেখা যাচ্ছে!
ওদের দেখে এগিয়ে এলেন জন। তাতার দেখল জনের পিঠে একটা লম্বা রোল করা জিনিস ঝোলানো!
জন বললেন, “আরে, তুমি এসে গিয়েছ? মাসাইয়ের কী হয়েছে?”
“মাসাই? সেটা কে?” জুলু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
তাতার পাত্তা না দিয়ে বলল, “বাইরে থেকে লোক এসেছে জনদাদু। ওরা মাসাইকে ধরে নিয়ে যাবে। মাসাইকে এখান থেকে সরাতে হবে আমাদের। বাঁচাতে হবে!”
“আরে মাসাইটা কে?” জুলু এবার চেঁচিয়ে উঠল।
“একজন মারম্যান। মানে যাকে সবাই জেনারালি মারমেড বলে থাকে। মানে জলপরি!” জনদাদু সংক্ষেপে বললেন।
“জলপরি? মার…” জুলু কথা শেষ না করেই মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “পাগল হয়েছেন আপনারা? ওরা না হয় বয়সে ছোট! তা বলে আপনিও? এই সায়েন্সের যুগে এসব কী বলছেন?”
জন তাকালেন জুলুর দিকে, “ট্রুথ ইজ় স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন মাই বয়!”
“কিন্তু…”
জুলুকে কথাটা শেষ করতে দিল না তাতার। ও বলল, “জনদাদু আমি তো আজ মাংস আনিনি। মাসাইকে ডাকব কী করে?”
জন একটা প্যাকেট থেকে মাংসের বড় টুকরো বের করে বললেন, “আমি এনেছি।”
তাতার দ্রুত মাংসটা নিল। তারপর জলের পাড়ে গিয়ে বসল হাঁটু গেড়ে। আলতো করে তাল ঠোকার মতো কয়েকবার মারল জলের উপর, তারপর ডাকল, “মাসাই, মাসাই।”
আচমকা জলের তলায় আলোড়ন হল একটা। তারপর সেই নীল আলো জ্বলে উঠল। ম্যারম্যান ধীরে-ধীরে ভেসে উঠল জলের উপরে! তাতার জুলুর দিকে তাকাল। জুলু পাথরের মতো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না!
তাতার অস্ফুটে বলল, “এই মাসাই!”
মাসাই ভেসে উঠে অদ্ভুত একটা শব্দ করল মুখ দিয়ে। তারপর হাত বাড়াল তাতারের দিকে। আর ঠিক তখনই ‘ছপ’ করে শব্দ হল একটা।
তাতার অবাক হয়ে দেখল জন একটা শক্ত নাইলনের ফোল্ডিং জাল ছুড়ে মেরেছেন মাসাইয়ের দিকে! ও কিছু বলার আগেই জন জালের শেষ প্রান্তের দড়িটা ধরে প্রচণ্ড টান মারলেন। আর সেই টানের চোটে মাসাই জলের ভিতর থেকে ছিটকে এসে পড়ল বিলের পাড়ে! তাতার বুঝল জনের পিঠে এতক্ষণ কী ঝোলানো ছিল!
তাতার কী বলবে বুঝতে পারল না। জন এটা কী করছেন? মাসাইকে এমন করে জালে বন্দি করলেন কেন?
গামা আর রুপু ভয়ে সরে গিয়েছে দূরে। জুলুও সামনে এগোচ্ছে না! তাতার দেখল জালে বন্দি হয়ে মাসাই প্রচণ্ড ছটফট করার সঙ্গে জান্তব চিৎকারও করছে! আর ওর গায়ের সেই নীল রং বদলে গিয়েছে লাল রঙে। যেন গায়ের চামড়া ভেদ করে জ্বলন্ত অঙ্গার ফুটে উঠেছে। আর সেই লাল আভায় জনের মুখের দিকে তাকাল তাতার। দেখল ফরসা বৃদ্ধের দুটো চোখ যেন জ্বলছে ধিকধিক করে!
২০
অন্ধকারে একটা গাড়ির টেল লাইটের ছোট্ট লাল আলোটা দেখা যাচ্ছে! গাড়িটা বেশ দ্রুত যাচ্ছে। এবড়োখেবড়ো মাঠের উপর দিয়ে লাফাতে-লাফাতে চলেছে গাড়িটা।
“যাহ!” মাথার চুলগুলোকে খামচে ধরল বব, “একটুর জন্য বেরিয়ে গেল!”
আদেশ বুঝল কথাটা সত্যি! ওরা যে এখানে আসছে সেটা কোনও ভাবে কেউ জেনে ফেলেছে! আর তার ফলে ওই প্রাণীটাকে জল থেকে তুলে নিয়েছে!
বব হাতের জোরালো আলোটাকে বিলের পাড়ে ফেলল। মাটিতে ভিজে দাগ। ও বলল, “এই দেখ পুল মার্ক! কেউ টেনে নিয়ে গিয়েছে। আর এই গাড়ির চাকার দাগ!”
আদেশ কী করবে বুঝতে পারল না। ও পাশে দাঁড়ানো চারুর দিকে তাকাল।
বব আবার বলল, “ওয়েল জাস্ট ডোন্ট স্ট্যান্ড হিয়ার। চলো, লেটস ফলো দেম।”
আদেশ দেখল ববের কথা শোনামাত্র ওর সঙ্গীরা লাফিয়ে উঠল বড় জিপটায়। আদেশও এগোল। লোকগুলোর হাবভাব একদম ভাল লাগছে না ওর! কী যে সর্বনাশ হতে পারে তার একটা আঁচ করতে পারছে। ও নিজে ইচ্ছে করলেই সরে যেতে পারে এসবের থেকে কিন্তু তা হলে সেটা তো পালানো হয়ে যাবে। ও ববকে কিছুতেই ভুলভাল কাজ করতে দেবে না। সত্যি যদি মারমেড থেকে থাকে ববকে ও কিছুতেই সেটাকে মারতে বা বন্দি করতে দেবে না।
আদেশ লাফিয়ে উঠল জিপে। তারপর চারুকে বলল, “তোমার এই পর্যন্তই কাজ ছিল। আর নয়। তুমি ফিরে যাও।”
সামনের গাড়িটার টেল লাইট আরও ছোট হয়ে এসেছে। দূর থেকে আরও দূরে সরে যাচ্ছে গাড়িটা। বব আর অপেক্ষা না করে ওদের জিপটাকে স্টার্ট করতে বলল।
জিপটা লাফিয়ে উঠে তির বেগে ছুটতে লাগল সামনের দিকে। অসমান মাঠের উপর দিয়ে ড্রপ খেতে-খেতে এগোচ্ছে গাড়িটা।
বব বলল, “পালিয়ে যাবে কোথায়? বড়জোর ছোট গাঙে!”
আদেশ বলল, “তুমি কী করতে চাও?”
বব হাসল। তারপর পিস্তলটা শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করে হাতে নিয়ে বলল, “যত দূর যা করতে হয় আমি করব।”
জিপটা এগোচ্ছে। দূরের গাড়িটাও বোধ হয় বুঝতে পেরেছে পিছনে কেউ আসছে তাড়া করে। তারাও গতি বাড়িয়ে দিয়েছে।
আদেশ জানে সামনেই ছোট গাঙ। হয়তো প্রাণীটাকে নিয়ে ওরা জলে ছেড়ে দেবে! কিন্তু এখন তো ভাটার সময়। জল নেমে গিয়েছে! তা হলে কি ওরা বড় গঙ্গায় যাবে?
বব বলল, “আমার মোটরবোট রেডি। ওরা প্রাণীটাকে শিওর ছোট গাঙে ছাড়বে না। ওরা জানে আমরা পিছনে আছি, তাই সেই রিস্ক নেবে না। কারণ তা হলে তো জাল ফেলে আমরা এখান থেকেই ধরে নেব মারমেডটাকে!”
আদেশ বলল, “বোকার মতো কিছু করবে না বব। ওই গাড়িতে কিন্তু বাচ্চা ছেলে আছে একটা!”
বব হাসল। তারপর বলল, “যে এমন একটা ব্যাপারে নিজেকে ইনভলভ করে সে আর যাই হোক বাচ্চা নয়। শোনো আদেশ, আমি অনেক টাকা আর আমার জীবনের একটা বড় সময় ইনভেস্ট করেছি এর পিছনে। ভেবো না অত সহজে আমি ছেড়ে দেব। সো ডোন্ট ট্রাই টু স্টপ মি! বুঝেছ?”
আজ সারাদিন খুব খাটুনি যাচ্ছে। গঙ্গায় দাঁড়িয়ে থাকা জাহাজ থেকে স্টিমারে করে তেল এনে ভরা হচ্ছে রিজ়ারভয়্যারে।
তবে আর চিন্তা নেই। কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। শেষ লটের তেল ভরে দিয়ে স্টিমার ফিরে গিয়েছে। এই গোটা কাজটা সোমেনকে দাঁড়িয়ে থেকে করাতে হয়। আসলে তেল ট্রান্সফার পাইপলাইনে সামান্য লিক থাকলেই তেল গিয়ে পড়বে ছোট গাঙে! আর এই ছোট গাঙের জলের স্রোতটা এমন যে, একবার যদি এই পাড়ে তেল লিক করে জলে পড়ে তবে নিমেষে সেটা ওই পাড় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়! তাই সবদিক ভাল করে নজর রাখতে হয়।
সোমেন রিজ়ারভয়্যারের জ়োন থেকে বেরিয়ে মোবাইলটা অন করলেন এবার। আসলে ওই জ়োনে থাকাকালীন মোবাইল সুইচ অফ করে রাখতে হয়!
ফোনটা অন হওয়ামাত্র পিংপিং শব্দে বেশ কিছু মেসেজ এসে ঢুকল। আর সোমেন অবাক হয়ে দেখলেন তার মধ্যে প্রায় কুড়িটা মিসড কল অ্যালার্ট এসেছে বাড়ির নম্বর থেকে!
বাড়ি থেকে এত ফোন কেন? সোমেন ঘাবড়ে গেলেন একটু! তাতারটা আবার কিছু করল নাকি?
সোমেন দ্রুত বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করে ফোনটা কানে লাগালেন। দু’বার রিং হতেই ওপাশ থেকে ফোনটা ধরল মাধুদা।
“হ্যালো, আরে আমি তো পাগল হয়ে উঠেছি!” মাধুদার গলাটা খুবই আতঙ্কিত শোনাল।
“কী হয়েছে মাধুদা?”
মাধুদা কিছু বলার আগেই পাশের থেকে কেউ একটা কেড়ে নিল ফোনটা, তারপর একটা নরম-গরম স্বর শোনা গেল, “আমি রুপু বলছি কাকু। তাতার আর গামার খুব বিপদ! তোমাকে ফোন করে কেউ পাচ্ছিল না। ওরা ছোট গাঙে সান্টাদাদুর সঙ্গে গিয়েছে মারম্যানটাকে নিয়ে। ওদের তাড়া করেছে একটা গুন্ডার দল।”
“কী?” সোমেন বুঝতে পারলেন না, “কী বলছ এসব? মারম্যান? গুন্ডা? তাতার বাড়িতে নেই? তাড়া করেছে মানে?”
“কাকু প্লিজ়!” রুপু উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠল, “তাতারের খুব বিপদ। আমায় ও মিনিটদুয়েক আগে ফোন করেছিল সান্টাদাদুর মোবাইল থেকে। তোমায় ফোন করে পাচ্ছে না। ওরা ছোট গাঙ দিয়ে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে মোটরবোট করে! পিছনে গুন্ডা লেগেছে। প্লিজ় তুমি কিছু করো।”
সোমেনের হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল প্রায়! তাতার মোটরবোটে করে গঙ্গার দিকে যাচ্ছে! পিছনে গুন্ডা লেগেছে! কেন? কী হয়েছে?
সোমেন আর সময় নষ্ট করলেন না। মনে-মনে হিসেব করে নিলেন ছোট গাঙ থেকে গঙ্গায় যেতে হলে এই অয়েল ডিপোর সামনে দিয়েই যেতে হবে। তবে দূরত্ব বেশ অনেকটা। মোটরবোটে করে আসতে মিনিটদশেক তো লাগবেই!
সোমেন আর দেরি না করে দৌড়ে গেলেন ওয়াচ টাওয়ারের দিকে।
তেল খুব দামি আর গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী। আর এই অঞ্চলটাও যথেষ্ট উপদ্রুত! তাই এই গোটা জায়গাটাকে সবসময় সিকিউরিটি দিয়ে ঘিরে রাখতে হয়। ছোট গাঙের ধার বরাবর যে পাঁচিল রয়েছে সেখানে চারটে বড় ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে।
সোমেন দৌড়ে গিয়ে একটা টাওয়ারে উঠলেন। এখানে বড় নাইট-ভিশন বাইনোকুলার লাগানো রয়েছে।
এখন যতীন আর মনোজ বলে দুটো ছেলে এই চার নম্বর ওয়াচ টাওয়ারে গার্ড দিচ্ছে। কোনওদিন এমন হন্তদন্ত অবস্থায় সোমেনকে ওরা দেখেনি।
মনোজ বলল, “স্যার কী হয়েছে?”
সোমেন বললেন, “খুব বিপদ! সরো।”
সোমেন মনোজকে প্রায় ঠেলে সরিয়ে দূরবিনটায় চোখ রাখলেন। নাইট-ভিশন দূরবিনে ভিতর থেকে সবটাই সবুজ লাগে! ছোট গাঙের এদিকটা একদম সোজা। বহু দূর দেখা যায়। সোমেন দেখলেন সত্যি একটা মোটরবোট এগিয়ে আসছে এদিকে। আর তার বেশ অনেকটা পিছনে আর-একটা মোটরবোট! ঠিক যেমন ওই রুপু বলে মেয়েটা বলেছিল।
মোটরবোটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাতার, জুলু আর গামা! আর পিছনে বয়স্ক একজন মানুষ! লোকটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাতারদের? আর পিছনে আর-একটা বোটই বা তাড়া করছে কেন?
এবার সোমেন পিছনের বোটটাকে দেখার চেষ্টা করলেন। তবে দূরত্বটা বেশি। ঠিক স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সোমেন ভাল করে দেখার চেষ্টা করলেন। আর ঠিক তখনই ওই দূরের বোট থেকে একটা আলোর ঝলকানি এল! কী ওটা! সোমেন ভয়ে, বিস্ময়ে শুনলেন ছোট গাঙের দিক থেকে এবার ভেসে এল একটা হালকা শব্দ!
গুলির শব্দ! পিছনের বোটটা থেকে তাতারদের বোটের দিকে গুলি করা হচ্ছে! কারা করছে? গুন্ডারা?
২১
“বব!” আদেশ চিৎকার করে উঠল, “কী করছ কী তুমি?”
বব বলল, “বেশ করছি। আমার জিনিস নিয়ে পালাচ্ছে আমি ছেড়ে দেব?”
“তোমার জিনিস?” আদেশ কি অবাক হয়ে গেল?
বব ওর দিকে তাকাল। হাওয়ায় ববের বড় চুলগুলো উড়ছে খুব। গ্রিক পুরানের মেডুসার মতো লাগছে ববকে! মনে হচ্ছে মাথাভর্তি অসংখ্য সাপ যেন কিলবিল করছে!
বব বলল, “তুমি সরে যাও আদেশ। ডোন্ট ট্রাই টু স্টপ মি। না হলে…”
আদেশ চোয়াল শক্ত করল, “না হলে কী?”
“আমায় ওই বোটটাকে ধরতেই হবে,” বব চিৎকার করল এবার, “স্পিড বাড়াও।”
একজন উত্তর দিল, “সামনের বোটটা হাই পাওয়ারড স্যার। আমরা হয়তো…”
“মানে?” বব হিংস্র ভাবে তাকাল লোকটার দিকে। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আই উইল গান ইট ডাউন।”
বব হাতের পিস্তলটা ফেলে বোটের উপর রাখা টেলিস্কোপিক রাইফেল তুলল এবার।
“কী করছ বব?” আদেশ রাইফেলের নলটা ধরে টান মারল একটা।
“তবে রে…” বব রাগে পাগল হয়ে গেল যেন। রাইফেলটাকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল আদেশের হাত থেকে তারপর ঘুরিয়ে বাঁট দিয়ে মারল আদেশের মাথায়।
‘থপ’ করে ভোঁতা শব্দ হল একটা। আদেশের মনে হল মাথার ভিতর যেন বোমা ফাটল! ও ঘুরে পড়ে গেল বোটের মেঝেয়। দু’জন এসে দ্রুত চেপে ধরল ওকে। তার ভীত দৃষ্টিতে আদেশ দেখল বব রাইফেলটা তুলে চোখ রাখল তার টেলিস্কোপে!
২২
পরপর দু’বার বন্দুকের আওয়াজ পেল তাতার। আর সঙ্গে-সঙ্গে গামাকে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে পড়ল ও। জুলুও বসে পড়েছে গুলির শব্দ পেয়ে।
জন বললেন, “মাথা তুলবে না। আমি স্পিড বাড়াচ্ছি আরও।”
গামা কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, “আমি কি মরে যাব তাতার?”
তাতার বলল, “তোকে তখনই বলেছিলাম আসিস না। রুপুর সঙ্গে ফিরে যা।”
অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো আবার পরপর মনে পড়ল তাতারের। ওহ, কী ভয়ংকর দিন আজ!
বিলের পাড়ে জন যখন মাসাইকে আচমকা জালবন্দি করে তুলে আনলেন তাতার তো ঘাবড়েই গিয়েছিল প্রথমে। মাসাইয়ের গায়ের থেকে বেরনো লাল আলোয় জনকে কেমন অদ্ভুত লাগছিল। ভয় লেগেছিল তাতারের। ভেবেছিল জনও কি তবে খারাপ লোকগুলোর সঙ্গী?
কিন্তু তারপরেই ভুল ভেঙেছিল। জন জালবন্দি অবস্থাতেই মাসাইকে দু’হাতে পাঁজাকোলা করে তুলেছিলেন। তারপর নিজের বড় গাড়িটার দিকে যেতে-যেতে বলেছিলেন, “কাম অন। আমাদের পালাতে হবে। ওকে বাঁচাতে হবে!”
ব্যাপারটা তখন বুঝেছিল তাতার। বুঝেছিল, জন এটা ঠিক কাজই করেছেন। মাসাই তো আর মানুষ নয় যে ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জল থেকে তুলবে ওরা! যদি ওকে এমন করে জলবন্দি না করতেন জন, তবে তো মাসাইকে ধরাই যেত না! জলের গভীরে ঢুকে বসে থাকত ও। আর ওই গুন্ডাগুলো জলে। নেমে…
না, আর ভাবতে পারছে না তাতার। ও পাশে তাকাল। জালের মধ্যে গুটিয়ে শুয়ে আছে মাসাই! মারম্যান! সত্যি এমন একটা মিথিক্যাল প্রাণী ওর সামনে!
তাতার দেখল মাসাই তাকিয়ে রয়েছে ওর দিকেই। আবছা অন্ধকারেও মাসাইয়ের করুণ চোখদুটো বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না তাতারের। মাসাই যেন নিস্তেজ হয়ে পড়েছে! এখান থেকে বেরতে পারবে না সেটা বুঝতে পারছে। শরীরে কোনও আলোও জ্বলছে না!
তাতার হাত বাড়াল। তারপর জালের উপর দিয়েই মাসাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মাসাই যেন গুটিয়ে গেল একটু। মুখ থেকে অস্ফুটে শব্দ করল।
তাতার বলল, “ভয় নেই। আমরা তোমায় তোমার আসল জায়গায় নিয়ে যাব। ভয় পেয়ো না।”
জন এক হাতে স্টিয়ারিং হুইলটা ধরে অন্য হাতে মোবাইলটা বাড়িয়ে বললেন, “কল ইওর ফাদার। আস্ক ফর হেল্প। এরা তো গুলি করছে!”
জুলু ফোনটা নিল, “আমি কথা বলছি।”
“না,” তাতার ফোনটা কেড়ে নিল জুলুর থেকে। বলল, “আমি যা বলার বলব। আমি শুরু করেছি এটা। আমিই শেষ করব।”
তাতার মনকে শক্ত করল। বাবার ফোন তো বন্ধ ছিল। ঠিক আছে, আবার ট্রাই করা যাক।
সোমেনের নম্বরটা ডায়াল করে স্পিকারে দিল তাতার। আর এবার একবার রিং হতেই ফোনটা ধরলেন সোমেন।
“হ্যালো,” সোমেনের গলায় উদ্বেগ!
“বাবা!” আচমকা তাতারের গলা ভারী হয়ে এল। চোখে জল চলে এল।
সোমেন বললেন, “আমি তোদের দেখতে পাচ্ছি। একটা ফোন এসেছিল বাড়ি থেকে। তুই মাথা নামিয়ে রাখ। ওরা গুলি করছে!”
বাবা ওদের দেখতে পাচ্ছেন! তাতার অবাক হল। ও বলল, “বাবা ওরা আমাদের…”
“ধরতে পারবে না। আমি দেখছি যাতে ওরা আর তোদের পিছনে না যেতে পারে।”
“আয়াম সরি বাবা। কিন্তু মাসাইকে বাঁচাতে এটা করতেই হত। তাও আয়াম সরি!”
সোমেন যেন এবার সময় নিলেন একটু। তারপর বললেন, “ঠিক আছে। আমি জানি না কী চলছে। তবে যখন কাউকে হেল্প করছিস তখন ইট্স ফাইন। আমি ওই পিছনের বোটের গুন্ডাগুলোকে মজা দেখাচ্ছি!”
ফোনটা কেটে তাতার তাকাল গামার দিকে।
গামা বলল, “আমি শুনেছি সব। কাকু কী করবেন রে? উনি তো দূরে আছেন!”
জুলু বলল, “সত্যি! বাবা দূর থেকে কী করবেন? পুলিশে খবর দিলে তারাও তো এসে এই মারম্যা… মানে মাসাইকে ধরে নিয়ে যাবে! তবে?”
তাতার তাকাল মাসাইয়ের দিকে তারপর জুলুকে বলল, “বাবা ঠিক কিছু করবেন। দাদাভাই, আই বিলিভ ইন হিম। মাধুদার কথা ভুলে গিয়েছিস? মাধুদা বলে না বাবার মতো দস্যি ছেলে মাধুদা কোনওদিন দেখেনি! আই হোপ সেই দস্যি ছেলেটা এখনও কোথাও বাবার ভিতরে বেঁচে রয়েছে!”
২৩
সোমেন ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে ওয়াচ টাওয়ার থেকে দ্রুত নেমে এলেন নীচে।
সন্ধে, রাতের দিকে এগোচ্ছে ক্রমশ। চারিদিক বেশ শুনশান। শেষ স্টিমারটাও তেল নামিয়ে চলে গিয়েছে। অয়েল পাম্পগুলোর শব্দ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঝিঁঝিঁর ডাক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরও!
আবার আবছা ভাবে যেন গুলির শব্দ শোনা গেল। একবার দ্রুত টাওয়ারের দিকে তাকালেন সোমেন। টাওয়ারের রক্ষীরা সব দেখলেও কিছু করবে না। অয়েল ডিপোয় যতক্ষণ না কিছু হবে ওরা ততক্ষণ পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ওদের এমনই নির্দেশ দেওয়া আছে। শুধু সোমেনের অনুরোধে ওরা লোকাল থানায় ফোন করেছে। তবে তারা কখন আসবে কে জানে!
সোমেন ছুটলেন। বিরাট বড় ডিপোর যেদিকে ছোট গাঙ সেদিকে একটা জেটি করা আছে। সেখান থেকেই তেলটা ভরা হয়।
জেটির নীচে দিয়ে ড্রেনের পাইপলাইন গিয়েছে। সেই পাইপ দিয়ে ডিপোর নোংরা জল গিয়ে পড়ে ছোট গাঙে। এখনও জল পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সোমেন ঠিক করলেন এই ব্যাপারটাকে কাজে লাগাতে হবে।
পাশেই একটা পুশকার্ট পড়ে রয়েছে।
সোমেন দ্রুত চারটে ছোট ব্যারেল তেল তুললেন ওই কার্টে। তারপর দেওয়ালে টাঙানো একটা পুলাস্কি তুলে নিলেন।
পুলাস্কি এক ধরনের যন্ত্র। বড় হাতলের মাথায় একটা ‘হেড’ লাগানো থাকে। আর এই হেডটির একটা দিক কুঠারের মতো আর আর-একটা দিক ছোট কোদালের মতো।
সোমেন কার্ট ঠেলে দ্রুত জেটির দিকে গেলেন। এদিকে এখন আলো নেভানো রয়েছে। শুধু লাল হয়ে থাকা গুমোট আকাশের থেকে ছড়িয়ে পড়া আবছা আলোয় সব কিছুই কেমন যেন লোডশেডিংয়ের শহরের মতো লাগছে!
আবার একবার ছোট গাঙের দিকে তাকালেন সোমেন। দুটো মোটরবোট আরও দ্রুত এগিয়ে আসছে। সোমেন চোয়াল শক্ত করে প্রস্তুত হলেন। দুটো বোটের মধ্যে তিনশোমিটারের মতো দূরত্ব। মানে যে কাজটা সোমেন করতে চান, সেটায় খুব কম সময় পাবেন!
পুলাস্কি দিয়ে দ্রুত চারটে ছোট ব্যারেলের মুখ খুলে দিলেন সোমেন। ওই আসছে প্রথম বোটটা। সোমেন মনে-মনে গুনতে শুরু করলেন, “দশ, নয়, আট, সাত…”
ঠিক চার গোনার সময় তাতারদের বোটটা জেটির সামনে দিয়ে হুস করে বেরিয়ে গেল। সোমেন এগিয়ে গেলেন। এটাই সময়।
জেটির নীচের পাইপ দিয়ে হুড়হুড় করে বাজে জল বেরচ্ছে ছোট গাঙে! সোমেন দ্রুত চারটে ব্যারেল এক-এক করে উপুড় করে দিলেন সেই জলের স্রোতের মুখে। জলের চেয়ে তেল হালকা। তাই সোমেন জানেন এই তেলটা জলের উপর ভেসে তোড়ের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে গোটা গাঙের জলে। চারটে ব্যারেল উপুড় করে সোমেন পকেট থেকে দেশলাই বের করলেন। আর একশোমিটার দূরে পরের বোটটা। আর সময় নেই। সোমেন দেশলাইট জ্বালিয়ে ছুড়ে দিলেন জলে! দেশলাইটা ঘুরে গিয়ে পড়ল জলের উপর ভেসে থাকা তেলে। আর সোমেন দেখলেন নীল আগুনের শিখা সাপের মতো এঁকেবেঁকে ছুটে গেল জলের উপর দিয়ে। তারপর মুহুর্তের মধ্যে ছোট গাঙের এ মাথা থেকে ও মাথা জ্বলে উঠল দাউ দাউ করে।
“ও গড!” জন আচমকা চিৎকার করে উঠলেন।
তাতার ভয় পেয়ে গেল! ও রিফ্লেক্সে উঠে দাঁড়াল এবার। ওর সঙ্গে উঠে দাঁড়াল জুলু আর গামাও। আর দাঁড়িয়েই হতভম্ব হয়ে গেল একদম! এটা কী!
তাতার দেখল অন্ধকার রাতের বুকে যেন নরক নেমে এসেছে। ছোট গাঙের এমাথা থেকে ওমাথা জ্বলছে দাউদাউ করে! একতলা বাড়ির সমান উঁচু আগুনের পাঁচিল যেন দাঁড়িয়ে আছে জলের উপর! ওরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জন বোট থামালেন না। এগিয়ে নিয়ে গেলেন আরও সামনে, বড় গঙ্গার দিকে।
আবছা হলুদ আলোয় জুলু তাকাল তাতারের দিকে।
তাতার সেই আগুনের পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা! বাবা ঠিক আটকে দিলেন ওই শয়তানগুলোকে!”
আদেশ দেখল ওকে চেপে রাখা দুটো লোক সামনের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। আর চারিদিক অদ্ভুত একটা হলুদ আলোয় ভরে গেল নিমেষে। কী হল ব্যাপারটা!
আদেশ এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে-সঙ্গে ভয়ের একটা হিমস্রোত বয়ে গেল ওর শিরদাঁড়া দিয়ে! সামনে এটা কী? আগুনের পাঁচিল!
বব চিৎকার করে উঠল ভয়ে। যে স্টিয়ারিং ধরে ছিল সে প্রাণপণে বোটের মুখ ঘোরাতে চাইল। কিন্তু বোটটা আগুনের এত কাছে চলে এসেছে যে উপায় নেই।
আদেশ নিমেষে স্থির করে নিল কর্তব্য! দেখল বোটটা প্রচণ্ড গতিতে ছিটকে যাচ্ছে ওই আগুনের দিকে। ও শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে লাফ দিল বোটের থেকে।
নিমেষে জলের মধ্যে ছিটকে পড়ে তলিয়ে গেল আদেশ। চারদিকে জল। তাও জলের উপরের হলুদ আভাটা দেখা যাচ্ছে! একটু সময় নিল আদেশ। তারপর ধীরে-ধীরে ভেসে উঠল উপরে। দেখল পাশের পাড়ে ধাক্কা লেগে চুরমার হয়ে গিয়েছে বোটটা। আর তার ভাঙা, জ্বলন্ত অংশ চারিদিকে ছড়িয়ে রয়েছে! মাথা ঘুরিয়ে ভাল করে দেখল আদেশ। ওই তো বব আর বাকিরা! জলের মধ্যে ভাসছে সবাই। হাত-পা ছুড়ছে!
আদেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোভ! ববের লোভ শেষ করে দিল সব কিছু!
ও আর সামনে গেল না। বরং পিছন ফিরে ধীরে-ধীরে সাঁতার দিয়ে এগোল এই পাড়ের দিকে! ববের থেকে যতটা পারা যায় দূরে সরে যেতে হবে ওকে। ববের লোভের থেকে যতটা সম্ভব দূরে পালাতে হবে! তারপর আবার অন্য কোনওদিন, অন্য কোনও সময়ে নিজের মতো করে খুঁজে নিতে হবে ওর লক্ষ্য!
তবে সে সবের আগে ও নিজের থেকেই যাবে পুলিশের কাছে। অনিচ্ছায় হলেও একটা অন্যায় কাজে জড়িয়ে গিয়েছে ও। তাই পুলিশের কাছে যাওয়াটা ওর কর্তব্য।
২৪
চারিদিক শান্ত হয়ে আছে! রাতের লাল আকাশ যেন উপুড় হয়ে আছে মোহনায়! এখানে নদী এসে মিশেছে সাগরে।
সেই ছোট গাঙের থেকে সোজা এই মোহনায় এসে বোট থামিয়েছেন জন!
তাতার বলল, “জনদাদু, এবার তো মাসাইকে ছাড়ার সময় হল!”
“হ্যাঁ তাতার তা তো হলই!” জন হাসলেন।
জুলু বলল, “কিন্তু ওর তো ডানদিকের লেজের কাছটা ভেঙে গিয়েছে! ও যাবে কী করে?”
জন বললেন, “তুমি সেটা নিয়ে ভেবো না। এত হাজার-হাজার বছর ওরা জলের তলায় রয়েছে। দে নো দেয়ার মেডিসিন ওয়েল। তবে আমার চিন্তা অন্য। এখানে এমন নিরালা জলে ওকে ছেড়ে দিলে ও কি খুঁজে পাবে ওর নিজের দলকে?”
তাতার বলল, “ওকে আগে জাল থেকে বের তো করি!”
জুলু আর তাতার এগোল জালের দিকে। ওদের দেখে মাসাই বড়-বড় চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল কেবল। তাতার হাঁটু গেড়ে বসে প্রথমে মাসাইয়ের মাথায় হাত বোলাল একটু। তারপর জালটা টেনে ফাঁক করল।
“এসো,” তাতার হাত বাড়াল সামনে।
সামান্য সময় নিল মাসাই। তারপর ধীরে-ধীরে তাতারের বাড়ানো হাতটা ধরল। তাতার টানল মাসাইকে, মাসাইও শরীর ঘষটে এগোতে গেল।
এবার জন আর জুলু এগিয়ে এসে মাসাইকে ধরে তুলল। মাসাই এবার আর ছটফট করল না একটুও। বরং আশপাশে জল দেখে কেমন যেন থমকে গেল।
তাতার আলতো করে মাসাইয়ের হাতটা ধরল। তারপর জলের দিকে ইঙ্গিত করল!
মাসাই চুপ করে তাকিয়ে রইল প্রথমে। তারপর হঠাৎ মুখটা উঁচু করে ‘উও উও’ শব্দে চিৎকার করে উঠল।
তাতার বুঝতে পারল না কী হচ্ছে! তারপরেই আচমকা সামনের জলে আলোড়ন দেখা গেল। আর ওরা অবাক হয়ে দেখল প্রায় দশটা ডলফিন লাফিয়ে উঠল একসঙ্গে!
জন বললেন, “ডলফিন আর মারমেড মানে, মারম্যানদের সম্পর্ক কয়েকহাজার বছরের। এদের রিলেশনটা সিমবায়োটিক!”
ডলফিনদের দেখে মাসাই চঞ্চল হয়ে উঠল। একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকাল তাতারের দিকে। যেন অনুমতি চাইছে যাওয়ার! তাতার কী বলবে বুঝতে পারল না। এক অজানা কষ্টে আচমকা বুকের ভিতরটা কেমন যেন নরম হয়ে এল ওর। মনে হল, মাসাই চলে যাবে!
মাসাই এবার হাত বাড়াল তাতারের দিকে। তাতার হাতটা ধরল ওর। তারপর শান্ত গলায় বলল, “এসো।”
মাসাই তাও তাতারের হাতটা ধরে রইল আরও একটু সময়। তারপর হাতটা ছেড়ে তাকাল তাতারের দিকে। আর মুখ দিয়ে অস্ফুটে শব্দ করে ছিটকে লাফিয়ে পড়ল জলে। ডলফিনগুলো নিমেষে ঘিরে ধরল ওকে! মাসাই বোটের সবার দিকে তাকিয়ে হাত তুলল! তারপর টুপ করে ডুব দিল জলে!
আর সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল একটু দূরে নীল আলোর অজস্র বিন্দু জ্বলে উঠল একসঙ্গে! তারপর সেগুলো এগিয়ে গেল সামনের অন্ধকার জলের ভিতরে।
তাতাররা সবাই তাকিয়ে রইল সেই দিকে। বুঝল জলের গভীরে এতক্ষণ মারম্যান আর মারমেডরা অপেক্ষা করছিল মাসাইয়ের জন্য!
ওরা দেখল, মাসাইয়ের আলোর পাশে ধীরে-ধীরে জড়ো হতে লাগল জলের তলার সেই সব নীল আলোর বিন্দুগুলো! কিছুক্ষণ আলোগুলো জ্বলে রইল জলের তলায়, তারপর আচমকা সব নিভে গেল একসঙ্গে। আবার গোটা জলটা আগের মতো নিকষ অন্ধকার হয়ে গেল! তাতার বুঝল মাসাই ওর পরিবারের কাছে ফিরে গেল অবশেষে!
জন হাত রাখলেন তাতারের কাঁধে। বললেন, “ডোন্ট ক্রাই৷”
ও কাঁদছে! তাতার চোখে হাত দিল! আরে, সত্যি তো! ওর চোখে জল!
তাতার হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখটা মুছে বলল, “জনদাদু আমি বাড়ি যাব। বাবার কাছে যাব।”
২৫
সাইকেলটা বড় গাছের নীচে স্ট্যান্ড করিয়ে বিলের দিকে তাকাল তাতার। আজ ওর সঙ্গে আর কেউ নেই। দু’দিন আগের ঘটনার শক যেন কেউ কাটিয়ে উঠতে পারেনি এখনও!
বোটে করে সেই জেটির কাছে ফেরার সময় তার দেখেছিল আগুন নিভে গিয়েছে। কিন্তু চারিদিক পুলিশে পুলিশ! দমকলের লোকজনও এসেছে!
বোটটাকে জনদাদু পাড়ে আনার পর তাতার দৌড়ে গিয়েছিল সোমেনের দিকে। সোমেন বসে ছিলেন মাথা নিচু করে। ‘মুকুটপর অয়েল স্টোরেজ’-এর জেনারেল ম্যানেজার দাঁড়িয়ে ছিলেন পাশে। তাতার বুঝতে পারছিল সোমেন সমস্যায় পড়বেন! স্বাভাবিক!
তবে পুলিশদের তৎপরতা ছিল ছোট গাঙের অন্যদিকে! সেদিকে ভেঙে পড়েছিল আর-একটা বোট! তাতার বুঝতে পারছিল এটাই সেই তাড়া করে আসা বোটটা! পুলিশ ঘিরে রেখেছিল ভাঙা বোটটাকে। সেখান থেকে দুটো অ্যাসল্ট রাইফেল আর-একটা টেলিস্কোপিক রাইফেল পেয়েছিল পুলিশ। আর ধরা পড়েছিল কয়েকজন লোক। এখন জানা গিয়েছে তাদের মধ্যে একজন সাংবাদিক আর বাকিরা নাকি দাগি অপরাধী! তা ছাড়া আর-একজনও নাকি ছিল। আদেশ তার নাম। কলকাতায় তার বাড়ি। সে গতকাল সকালে নিজেই গিয়ে ধরা দিয়েছে পুলিশের কাছে।
সোমেনকে পুলিশ এসে কনগ্র্যাচুলেট করেছিল এই লোকগুলোকে ধরতে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু অফিস থেকে সোমেনকে ‘শো কজ়’ করা হয়েছে! বলা হয়েছে কেন সোমেন এমন করে চার ব্যারেল তেল নষ্ট করলেন তার কারণ দেখাতে। আর শুধু তাই নয়, তেলের রিজ়ার্ভের কাছে কেন আগুন লাগাবার রিস্ক নিলেন সোমেন, সেটাও বলতে হবে! না হলে চারমাসের সাসপেনশন হবে ওঁর!
তাতার শুনেছে আজ সকালে সোমেন মাধুদাকে বলছেন, “আমার চাকরি নিয়ে চিন্তা করি না মাধুদা। তাতারদের দিকে গুলি ছুড়ছিল ওরা। সেখানে আমাকে তো ওদের থামাতেই হত!”
গতকাল বিকেলে তাতারের কাছে চারুকে নিয়ে এসেছিল রুপু। ছেলেটার মুখ চুন হয়ে ছিল একদম।
রুপু বলেছিল, “এই নাও তোমার কালপ্রিট! ওর জন্যই এসব হয়েছে।”
তাতারের কিন্তু কেন কে জানে রাগ হচ্ছিল না একটুও। চারুর মুখটা দেখেই বুঝতে পারছিল ছেলেটা অনুশোচনায় ভুগছে।
চারু এগিয়ে এসেছিল তাতারের দিকে। তারপর বলেছিল, “আমি রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তাতার। তাই… কিন্তু এতটা হবে বুঝতে পারিনি রে! তুই আমায় ক্ষমা করে দে। আর যা শাস্তি দিতে চাস, দে!”
তাতার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “নিজে যখন ভুল বুঝেছিস তখন আর আমার কিছু বলার নেই। শুধু এটুকু মাথায় রাখিস, নিজের জেদ পূর্ণ করার জন্য কারও ক্ষতি করিস না।”
চারু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। না দেখা গেলেও তাতার বুঝতে পারছিল চারু কাঁদছে!
আকাশের দিকে তাকাল তাতার। মনটা ভাল নেই। আজ জলও টানছে না ওকে! শুধু মনে হচ্ছে ছোট গাঙের এই দিকটাতেই তো মাসাই থাকত। এই দিকটাতেই তো জলে নেমে ও সাঁতার কাটত মাসাইয়ের সঙ্গে! ওর মনে হল, এই বিলের জল ওর মাকে নিয়েছে। তারপর ওর বন্ধুকেও হারাল এই জলে! এই জল কি শুধু ওর থেকে নিয়েই নেবে! ফেরত কি দেবে না কিছু!
তাতার বীরে-ধীরে এগিয়ে গেল বিলের পাড়ের দিকে। ছোট-ছোট। ঝোপে ঢেকে আছে পাড়টা। রঙিন ফুলে ভরে আছে চারিদিক।
আচমকা সরসর শব্দ হল একটা! বাদামি লম্বা মতো কিছু দ্রুত চলে গেল ওর পা ঘেঁষে! সাপ! তার পিছোতে গিয়ে পড়ে গেল! ঝোপের উপর। দেখল সাপটা যেদিকে গেল সেদিকে একটা খাকি রঙের বেজিও দৌড়ে গেল দ্রুত!
ও! খুব বেঁচে গিয়েছে! তাতার মাটিতে ভর দিয়ে উঠতে গেল আর ঠিক তখনই কী যেন লাগল ওর হাতে! দ্রুত ঘুরে বসল তাতার। ঝোপের ভিতর এটা কী?
তাতার দেখল ঝোপের ভিতর পদ্মপাতার মোড়ক রাখা আছে একটা। কী এটা? ও হাতে নিল পাতার মোড়কটা। তারপর খুলল ধীরে-ধীরে।
মেঘলা বিকেলের নরম আলোয় তাতার দেখল মোড়কের ভিতর পানপাতার আকারের লকেট একটা। কার এটা? দীর্ঘদিন জলের তলায় থাকার ফলে লকেটটার সারা গায়ে শ্যাওলা! ও ঘষে-ঘষে শ্যাওলা পরিষ্কার করল সময় নিয়ে। তারপর হাতের চাপে কুট করে খুলে ফেলল লকেটটা! আর খুলেই স্থির হয়ে গেল তাতার। কে রেখে গিয়েছে এটাকে জলের তলা থেকে তুলে এনে? এমন সুন্দর মোড়ক করে কে রেখে গিয়েছে?
তাতার জানে এটা মাসাই রেখে গিয়েছে! তাতারের চোখে জল এল। ও ঝাপসা চোখে দেখল, লকেটের ভিতরে প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া একটা ফোটো। আর সেই ফোটোর ভিতরে তাতার আর জুলুকে জড়িয়ে ধরে হাসছেন মা!
Leave a Reply