অগ্নিনিরয় – কৌশিক মজুমদার
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০২৩
প্রচ্ছদ: কামিল দাস
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা: কৌশিক মজুমদার
অলংকরণ: গৌতম কর্মকার
কৃতজ্ঞতা
অরুন্ধতী মজুমদার, কামিল দাস, গৌতম কর্মকার জীবনানন্দ দাশ, প্রদীপ গড়াই, রণিতা চট্টোপাধ্যায়
.
এখানে পৃথিবী আর নেই
বলে তারা মানবকল্যাণেই
হিংসা-ক্লান্তির পানে
বিদায় নিয়েছে;
কল্যাণ-কল্যাণ; এই রাত্রির গভীরতম মানে।
কৃষ্ণাদশমীর রাতে: তোমাকে। জীবনানন্দ দাশ
.
কলিকাতা বুক এজেন্সী আফিস
বিজ্ঞাপন
• এই পুস্তকটি ম্যাসন সিরিজের তৃতীয় বা অন্তিম খণ্ড হিসেবে বিবেচিত হইবে।
• এই পুস্তকে ব্যবহৃত সকল স্থান, স্থানিক ইতিহাস, গুপ্ত সমিতি, গোপন চিহ্ন, চিকিৎসাবিদ্যা ও জাদুবিদ্যা সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্যসমূহ লেখকের জ্ঞানমতে সম্পূর্ণ সত্য।
• পুস্তকে বর্ণিত কিছু চরিত্র সম্পূর্ণ বাস্তব এবং কয়েকটি ঘটনা সরাসরি সমসাময়িক সংবাদপত্র হইতে আহৃত হইয়াছে। যে সকল জীবিত ব্যক্তিকে এই পুস্তকে চরিত্ররূপে ব্যবহার করা হইয়াছে, লেখক ব্যক্তিগতভাবে দূরভাষে তাঁহাদের অনুমতি লইয়াছেন; যদিচ তাঁহাদের সংলাপ ইত্যাদিতে কল্পনার আশ্রয় লওয়া হইয়াছে। ব্যক্তিগতভাবে লেখক তাঁহাদের নিকট ঋণী।
• মূল কাহিনি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
• কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ইহার সহিত বাস্তবের মিল পাইলে লেখক বা প্রকাশক দায়ী নহেন।
.
অন্তিমকথন
১৯ জুন, ২০১৮, চন্দননগর, রাত্রি ১১.১৫
দেবাশিস গুহর জবানি বহুদুর থেকে একটা অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে গলা বারবার ফিসফিস করে কী যেন বলে চলেছে। একবার। দুবার। বারবার। জ্ঞান ফিরতেই গলা জ্বালানো একটা টক অনুভূতি টাকরা, জিভ, মাড়িতে ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। বুঝতে পারছি আর বেশিক্ষণ এইভাবে থাকতে পারব না। চোখ খোলার চেষ্টা করলাম। চারিদিকে ক্লোরোফর্মের বোবা গন্ধ। কিছু বোঝার আগেই বাসু আমাকে কাবু করেছে। একটা কাপড় দিয়ে আমার দুই চোখ চেপে বাঁধা। সেই চাপে চোখের মণি দুটো টনটন করছে। চোখের পাতার কিছু অংশে ঘষা খেয়ে জ্বালা ভাব। চারদিকে নিকষ কালো অন্ধকার। একটু যদি বাঁধনটা হালকা করে দিত…… অনেকক্ষণ বাঁধা থাকায় আমার দুই হাতে, কাঁধে টনটনে ব্যথা। নাড়াতে পারছি না। একটু নড়লেই নাইলনের সরু দড়ি কেটে চামড়ার মধ্যে বসে যাচ্ছে।
পা দুটোও একইভাবে গোড়ালির কাছে বাঁধা। বুকের ভিতরটাতে প্রচণ্ড জোরে ধুকপুক করছে। গাড়ির ইঞ্জিনের মতো। যেন এখুনি ফেটে বেরিয়ে যাবে। খেয়াল করলাম আমার গোটা দেহে এক টুকরো সুতো অবধি নেই। বেতের চেয়ারের টুকরোটাকরা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা অংশ সরু সরু ছুঁচের মতো খোঁচা দিচ্ছে থাইয়ের কোনায়, কুঁচকির গোপন ফাঁকে। জোরে নিঃশ্বাস নিতে গেলাম। ভুল করলাম। ও জেনে গেল আমি জেগে গেছি। সঙ্গে সঙ্গে উরুর পাশে গরম লোহা বেঁধার মতো তীব্র যন্ত্রণা। তীক্ষ্ণ ধাতব এক ফলা ঢুকে যাচ্ছে মাংস চিরে।
সর্বনাশ! এ যে ক্লাসিক লিং-চি! চোখ বেঁধে একের পর এক আঘাতে শত্রুকে চিরে ফেলা। আমিই শিখিয়েছিলাম ওকে!
প্রবল ব্যথার মধ্যে ডুবে যেতে যেতেও আমার মাথা কাজ করছে। করছে স্বাভাবিকের থেকে অনেক দ্রুত। তবে না করলেই ভালো হত যেন। আমি চিৎকার করে বলতে চাইলাম, “লিবেরা অক্সিলিয়াম অ্যাডিউভেরেট টুবাল-কেন।” মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোল না। নিজের অস্পষ্ট গোঙানি শুনে নিজেই চমকে উঠলাম।
একে একে সব ছবির মতো ভেসে উঠছে। আজকের রাতের জন্যই এত আয়োজন। আজকেই এমন হতে হল! আর কয়েক ঘন্টা মাত্র। যদি ঈশ্বর বলে কেউ থেকে থাকেন, তাঁর কাছে ভিক্ষা করছিলাম অনন্ত থেকে কেড়ে নিয়ে আসা ঘড়ির পদচারণা। যদি এভাবেও কাটিয়ে দিতে পারি, তবে বিপদ কেটে যাবে আপাতত। মুছে যাবে গত চব্বিশ ঘণ্টার ইতিহাস। তারপর… তারপর সবকিছু আবার নতুনভাবে ভাবতে হবে। একেবারে শূন্য থেকে। যে লম্বা, প্রায় অভঙ্গুর বিশ্বাসের শিকল তৈরি করেছিলাম গত কয়েক বছরে, তার সবচেয়ে জরুরি জোড় আমার অজান্তেই দুর্বল হয়ে গেছে। আমি বুঝতেও পারিনি। নাকি এটাই ভূতের সবচেয়ে বড়ো শয়তানি! সেই অবস্থাতেই বারবার ভাবার চেষ্টা করলাম, কেন এমন হল? একেবারে অযাচিতভাবে যে অসামান্য সুযোগ ঈশ্বর আমার সামনে এনে দিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি নিজেই তা কেড়ে নিতে পারেন!
ঘরে অস্থির নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। একের পর এক বই, আলমারি থেকে টেনে নামানো হচ্ছে। ফেলা হচ্ছে মাটিতে। আমি বুঝতে পারছি। আমি জানি ও কী খুঁজছে। আমি জানি এমনিতে ও সেটা পাবে না। অত্যন্ত সংগোপনে আমি জায়গার জিনিস জায়গায় রেখে দিয়েছি। আমি নিশ্চিত, এই একবিংশ শতাব্দীতে আমি ছাড়া আর কারও পক্ষে ভূতের সন্ধান করা সম্ভব ছিল না। সত্যি বলতে আমিও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। আজ থেকে একশো বছর আগে যাঁরা ভূতকে বশ মানিয়েছিলেন, সংগত কারণেই তাঁরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাকে এক কাল্পনিক রূপকথার গল্প, এক আজগুবি ধারণা হিসেবে খাড়া করেছিলেন। আর আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে সেটা বিশ্বাস করেও গেছিলাম। বিশ্বাস করে যেতাম। যদি…
অতি ধীরে একটার পর একটা ছোটো ছোটো আঘাতে ছুরির ফলা ঢুকে যাচ্ছে আমার বুকে, পেটে, বাইসেপ বরাবর। আর তার সঙ্গে একটাই প্রশ্ন।
“কোথায়? কোথায়?”
আমি জানি এর শেষ কীভাবে হতে চলেছে। আবার আমারই মনের একটা অংশ তা বিশ্বাস করতে চাইছে না। এভাবে সবকিছু শেষ হতে পারে না। মাথাটা ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। চিন্তার শক্তি হারাচ্ছি। হয়তো তীব্র রাখার জন্যে। কিংবা অত্যধিক রক্তপাতের ফলে। রমণপাষ্টির খেলা শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যেতে চলেছে। সান্ত্বনা একটাই- আমার মৃত্যুর পরে পৃথিবীর এই আদিমতম রহস্যের সমাধানের নাগাল আর কেউ কোনও দিন পাবে না। শতাব্দীপ্রাচীন এই জ্ঞান আমার সঙ্গেই লোপ পাবে একেবারে। এর কথা আর কেউ জানে না।
জানবে না।
আচমকা তীব্র আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কোনও অজ্ঞাত কারণে আমার চোখের বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। চোখের শাঙ্কব কোশেরা এতক্ষণ নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়েছিল। আচমকা উজ্জ্বল এলইডি-র আলোতে মানিয়ে নিতে ওদেরও সমস্যা হচ্ছে। সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। সারা মুখ কালো কাপড়ে ঢাকা। আর ডান চোখ যে জায়গায় থাকা উচিত, মুখোশের সেখানে হলুদ সুতোতে সেলাই করা একটা চোখ। Omnes vIdentes oculum. কিন্তু আমি জানি ও আসলে কে। ওকে এই মুখোশ আমিই পরিয়েছিলাম। পরম যত্নে। যেমন করে এক স্নেহশীল বাবা শীতের রাতে পুত্রকে মাঙ্কি ক্যাপ পরিয়ে দেয়।
“কোথায়?”
আবার বলে উঠল সেই একই ঘড়ঘড়ে গলা। সে আমার থেকে যা জানতে চায়, তার সন্ধান ইহজগতে কেবল আমিই জানি। শুধু জানি না, ওকে সেটার সন্ধান দেওয়া ঠিক হবে কি না। অবশ্য না দিলে মুক্তির অন্য উপায়ও তো কিছু মাথায় আসছে না। যন্ত্রমানবের মতো বারবার সেই কণ্ঠ ক্রমাগত একই প্রশ্ন করে চলেছে আর প্রতিটি প্রশ্নের সঙ্গে আমার দেহের কিছু কিছু চামড়া মাংস উঠে আসছে ধারালো ছুরির ডগায়। ছুরির হাতলে ড্রাগনের মুখ খোদাই করা। গ্র্যান্ড হোটেলের কিউরিও শপ থেকে কিনেছিলাম।
আমার আত্মা অবশেষে আত্মসমর্পণ করল। আমি বুকশেলফের সেই ফলস তাকটার কথা বলে দিতে বাধ্য হলাম যেখানে একদিন, এত সন্তর্পণে বাক্সটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। বাক্স হাতে নিয়ে কালো মুখোশ খুলে ফেলল বাসু। খুব যত্ন নিয়ে দেখতে লাগল সেটাকে। যেন ছোটো ছেলে তার প্রিয় খেলনা পেয়েছে। এই মুখ, এই চোখ, এই অলীক ভাব আমার অনেকদিনের চেনা। তারপর সোজাআয়নার দিকে চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে। আমি অস্ফুটে ডাকার চেষ্টা করলাম, “বাসু… বাসুকি….”
সে সাড়া দিল না।
এবার তার দৃষ্টি গেল টেবিলের ওপরে লাল প্যাডের দিকে। দ্রুত হাতে পাতা উলটে কয়েক মুহূর্তে বার করে ফেলল অভীষ্ট পৃষ্ঠা। আর তখনই ওর হাতে খসে পড়ল চার ভাঁজ করে রাখা হলদে কাগজটা। আমার সব প্ল্যানের ব্লুপ্রিন্ট। আমি চিৎকার করে বাধা দিতে চাইলাম। পারলাম না। গলা শুকিয়ে কাঠ। আর মাত্র কয়েক মিনিট। চোখের সামনে ঘড়ির কাঁটা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরে চলছে। আমি মনে মনে হিসেব করে চলেছি। আর বড়োজোর আধঘন্টা… পঁচিশ মিনিট……কুড়ি। বাসু আমার চোখে চোখ রাখল। সে চোখে ঘৃণা, রাগ আর কষ্ট মিলেমিশে আছে। বাসু সব কিছু জেনে গেছে।
এই প্রথমবার আমি ভয় পেলাম।
বাসু কাগজটা পকেটে ঢোকাল। পকেট থেকে একটা ডট পেন নিয়ে কী যেন লিখতে লাগল তাতে। তারপর মেলে ধরল আমার চোখের সামনে। ব্যথায় চোখ বুজে আসছে, তবু অত কষ্টের মধ্যেও না তাকিয়ে পারলাম না। অবাক বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে দেখতে পেলাম, যেন আমাকে দেখানোর জন্যেই, আমার চোখের সামনে অবিকল আমার হাতের লেখা নকল করে বাসু লিখেছে-
তুর্বসু জানে।
তারপর ড্রাগনমুখো ছোরার ডগাটা ঘরের ধবধবে সাদা আলোতে ঝিকিয়ে উঠল শেষবারের মতো।
Leave a Reply