• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

রবিবারের গল্প – আনন্দবাজার পত্রিকা

লাইব্রেরি » রবিবারের গল্প – আনন্দবাজার পত্রিকা
রবিবারের গল্প - আনন্দবাজার পত্রিকা

রবিবারের গল্প – আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় থেকে নির্বাচিত গল্পের সংকলন

প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৫

প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড

প্রচ্ছদ: সুনীল শীল

.

নিবেদন

দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয় পৃষ্ঠায় ছোটগল্প বরাবরই নিজস্ব মহিমায় উজ্জ্বল। সেই সম্ভার থেকে বেছে নিয়ে ‘আনন্দসঙ্গী’ শিরোনামে একটি গল্পসংকলন ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছিল। এ বার, ‘আনন্দসঙ্গী’র নতুন পর্বের সূচনায় প্রকাশিত এই সংকলনটিতে, লেখকদের বয়ঃক্রম অনুযায়ী, সাজিয়ে দেওয়া হল রবিবাসরীয়-র পাতা থেকে বেছে নেওয়া তেইশটি গল্প। গল্পের শেষে রবিবাসরীয় বিভাগে প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। বনফুল থেকে আবুল বাশার পর্যন্ত ছোটগল্পের আয়নায় ধরা পড়েছে এক বিপুল সময়কাল। গল্প-প্রকাশের তারিখের বিচারেও ব্যাপ্তিটি বিশাল— ১৯৩৯ থেকে ২০০৪। গল্পকারের দৃষ্টি বদলাচ্ছে, সময় বদলাচ্ছে, প্রকাশের ভাষা এবং ভঙ্গি বদলাচ্ছে, গল্প থেকে গল্পে যেতে যেতে এই খাতবদলের স্বাদগ্রহণ নিঃসন্দেহে এক আনন্দযাত্রা।

সংকলনটিকে সফল করে তোলার জন্য লেখকরা অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন। অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছেন প্রয়াত লেখকদের পরিবার-পরিজন তথা উত্তরাধিকারীরাও। সেই আন্তরিকতার ঋণ আন্তরিক ভাবে স্বীকার করি। কৃতজ্ঞতা জানাই তসলিমা নাসরিনকেও, তার মূল্যবান এবং সংবেদনশীল ভূমিকাটির জন্য।

সম্পাদক, আনন্দবাজার পত্রিকা

.

ভূমিকা – অল্পস্বল্প গল্প

মানুষের জন্ম থেকে আর যা কিছুই থাক বা না থাক, গল্প ছিল। মুখে মুখের গল্প ছিল। মানুষ গল্প বলত, গল্প শুনত। গল্প মানুষ প্রথম লিখতে শুরু করেছে পদ্যে, গদ্যে গল্প লেখার কথা যারাই সামান্য ভেবেছিল, তারাই তুড়িতে উড়িয়ে দিয়ে ভাবনাটি, বলেছিল, ‘কেন গদ্যে লিখব, যখন পদ্যেই বেশ লিখতে পারছি!’ যুক্তির কথা বটে, মঞ্জুকেশিনী মদিরাক্ষী ক্ষীণকটি নিতম্বিনী রূপশ্রেষ্ঠা পদ্যের মোহপাশ তুচ্ছ করে কে যাবে নিঝুম নিথর নিরলংকার গদ্যের নিরালোকে নিমজ্জিত হতে!

কাব্য এবং উপন্যাসের গায়ে গল্প ঢেলে দিল তার সর্বস্ব, নিজে সে পড়ে রইল পিছনে, পাঠকের দৃষ্টি থেকে দূরে, একা। গল্প কেবল শোনার জন্য রয়ে গেল, পড়ার জন্য নয়। পড়ার জন্য যখন শুরু হল, প্রথম প্রথম অদ্ভুত অলৌকিক বিষয়-আশয় নিয়েই সব লেখা হত। রূপকথা, ধর্মকথা, নীতিকথা, রীতিকথা ইত্যাদি নানা কথার জন্ম দিতে দিতে আঁতুড়ঘরের আঁধারে গল্পের প্রায় যায় যায় অবস্থা হত যদি না তড়িঘড়ি সে বেরিয়ে আসতে পারত আলোয়। গল্পের আলোয় ফেরা, আধুনিকতায় ফেরা, লৌকিকে, রক্তমাংসের জীবনে, রূঢ় অথবা অরূঢ় বাস্তবে ফেরা খুব বেশিদিন আগের নয়। গদ্যে গল্প লেখার, বিশেষ করে ছোটগল্প লেখার চল শুরু হয়েছে এই সে-দিন, ঊনবিংশ শতকে। আগে গল্পের অস্তিত্ব যে একেবারেই ছিল না তা ঠিক নয়, ছিল। ঠিক গল্প না হলেও এক ধরনের গল্পের মতো কিছু তো ছিলই। সাতশো পঞ্চান্ন খ্রিস্টাব্দে ‘অ্যাংলো-স্যাকসন ক্রনিকল’-এ লেখা হয়েছিল। ব্রিটেনে অ্যাংলো-স্যাকসনদের স্থায়ী বসবাসের ইতিহাস নিয়ে। ছোট ছোট স্মৃতিকথা, ঢংটা গল্পের। ক্রনিকল-এর কাছাকাছি সময়েই ভেনের‍্যাবল বিড লিখেছেন হিস্টোরিয়া এক্লেসিয়াসটিকা জেনটিস অ্যাংলোরম, এ-ও ইতিহাস, ইংরেজদের গির্জার ইতিহাস। এরপর দীর্ঘকাল গল্পের মতো কিছু আর দেখা যায়নি। তেরোশো সালের মাঝামাঝি কাব্য-গল্প ‘ক্যান্টারবেরি টেলস’ বেরল, জেফ্রি চসার-এর লেখা। প্রায় ওই সময়েই লেখা হয়েছে গিয়োর্দানো বোকাচিও-র ‘দেক্যামেরন’। এ সব রচনাকে গল্প বললেও এখন যে ধরনের গল্প আমরা পড়ি, তেমন গল্প নয়।

সাহিত্য-সংসারে কাব্য, উপন্যাস, নাটক প্রবন্ধ যদি অশীতিপর বৃদ্ধা হয়, ছোটগল্প নিতান্তই কিশোরী। কিশোরী কিন্তু কিছুতেই রূপসী রাজেন্দ্ৰনন্দিনীর মতো অহম্পূর্বিকা গ্রীবা বাঁকিয়ে জয় করতে পারছে না জগৎ। ছোটগল্পের পাঠক নেই– এমন কথা বলা হচ্ছে। বিদেশের প্রকাশকরা তো বলেন, দেশের প্রকাশকরাও বলতে শুরু করেছেন। হাতে গোনা কিছু গল্পকারের গল্প ছাড়া গল্প নাকি একদমই চলছে না। আসলে জগতের সর্বত্র প্রায় একই অবস্থা। ছড়া, কবিতা, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, নিবন্ধ নানা জিনিস চলবে, কিন্তু ছোটগল্প চলবে না। না চলার হয়ত একশো একটা কারণ আছে। অল্পতে অনেকের আশ মেটে না। চাই চাই বাড়ছে, ধারাবাহিক বাড়ছে, সিরিয়াল জমছে, লম্বা হচ্ছে লেজ, হবে না কেন—বকবক আর জোড়াতালির যুগ যখন। সত্যি কথা বলতে কী, ছোটগল্প কোথাও কখনও খুব একটা জনপ্রিয় ছিল না। আরব্যরজনীর গল্পের কথা আলাদা। এ দেশে ও-দেশে দু’একজন গল্পকার তরতর করে তারকা হয়ে গেছেন, ছোটগল্পের জন্য এটি প্লাস পয়েন্ট হতে পারে, কিন্তু মাইনাসের ঝুলির সঙ্গে পাল্লা দিলে ও প্লাস বড় নিঃস্ব। এক সময় এডগার অ্যালেন পো-র উচ্ছ্বাস পশ্চিমি পাঠকদের উৎসাহী করেছিল ছোটগল্পের দিকে। পো বলেছিলেন ‘ছোটগল্প হচ্ছে গদ্যের সর্বোত্তম রূপ, এবং এতে সবচেয়ে বেশি সুযোগ থাকে গদ্যের ওপর দখল দেখানোর। ইট ইজ, অফ কোর্স, অ্যা ফার ফাইনার ফিল্ড দ্যান দ্য এসে। ইট হ্যাজ ইভেন পয়েন্টস অফ সুপিরিয়রিটি ওভার দ্য পোয়েম।’ এ সব কেবল বলেই তিনি বসে থাকেননি, বড়সড় বিপ্লব করে সাহিত্যের ভিতে আধুনিক ছোটগল্পের শেকড় পর্যন্ত ঢুকিয়ে ছেড়েছিলেন। এটা ঠিক যে, দু’শো বছর ধরে নানা কায়দায় ছোটগল্প লেখার ধরন নিয়ে আন্তন চেকভ, জেমস জয়েস, ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ড, ফ্রানৎজ কাফকা, ডরোথি পারকার, টমাস হার্ডি, সেরুড এনডারসন, রেমন্ড কার্ভার, মপাসাঁ, আরনেস্ট হেমিংওয়ের মতো অনেক পশ্চিমি লেখক কাজ করেছেন। ছোটগল্পকে অনেক বড় জায়গায় এনে তাঁরা দাঁড় করিয়েছেন, তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু এখন, যে যাই বলুক, ছোটগল্প এবং কবিতার কিন্তু করুণ দশা দেখি পুবের চেয়ে বেশি পশ্চিমে। ছোটগল্প মরে যাচ্ছে— এমন দুঃসংবাদ হু হু করে চারদিক থেকেই আসে। শুনে মন খারাপ হয়ে যায়, যেন বৃক্ষগুলোর শরীর থেকে খসে পড়ছে সমস্ত সবুজ। গল্পের আদর কোথাও যদি সামান্যও টিকে থাকে এখনও, জগতের অলক্ষ্যে হলেও, আমার ধারণা, বাংলাতেই টিকে আছে। তা নয়তো কী! পৃথিবীর কটা দৈনিকে ফি সপ্তাহে ছোটগল্প ছাপা হয়! কটা সাপ্তাহিকে গল্প? কটা দেশে গল্পের কবিতার এমন অসংখ্য ছোট পত্রিকা বেরোয়! বাংলা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার নানান কারণ থাকতে পারে, গৌরব করার কারণ কিন্তু মোটেও কম নয়।

অনেক প্রবন্ধের বই পড়ে শেষ করেছি, অনেক কাব্য অনেক উপন্যাস পড়েছি, সবচেয়ে বেশি যে বইটি আমার ভাল লাগে, যে বইয়ের সবকটি পৃষ্ঠার সবকটি কাহিনি আমার অন্তরে, সে বইটির নাম ‘গল্পগুচ্ছ’। রবীন্দ্রনাথ লেখেননি এমন কিছু নেই। কিন্তু টানে আমাকে তাঁর গল্পগুলোই। এক একটি গল্প এক একটি বিশাল উপন্যাসের চেয়েও বড়। হৃদয়ে রয়ে যায়। বাংলায় ছোটগল্প রবীন্দ্রনাথের আগেও লেখা হয়েছে, কিন্তু হৃদয়ে রয়ে যাবার মতো করে হয়নি। রবীন্দ্রনাথই দিতে পেরেছেন এতে প্রাণ। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন দীনতা, পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্ব, দুঃখ সুখের সূক্ষ্ম অনুভব, প্রাকৃতিক-মনস্তাত্ত্বিক জীবনকে বড় কাছ থেকে দেখে তিনি লিখেছেন। তিনি প্রবেশ করেছিলেন জীবনের অন্তঃপুরে, যেখানে মেলে অনন্ত ঐশ্বর্য। ওই ঐশ্বর্য মুঠো মুঠো তুলে নিয়েছিলেন তিনি, নিয়েছিলেন বলেই আজও তাঁর গল্পের চরিত্রগুলো দেখি আমার চারপাশেই বাস করে, বিচরণ করে। কোনও কোনও চরিত্রকে মনে হয় চিনি আমি, খুব গভীর করে চিনি, বড় আপন এ, মনে হয় এ বুঝি আমিই।

এই সংকলনে রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তাঁর পরের প্রজন্মের প্রতিভা নতুন বিষয়, বৈচিত্র, নতুন রূপ-গুণ, নতুন শিল্প-শৈলী নিয়ে প্রচণ্ড রকম উপস্থিত। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়তই বিবর্তন ঘটছে, যার কিছুই হয়তো খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না, শিল্প সাহিত্যের বিবর্তন এক জীবনে খুব একটা ঠাহর করা যায় না, কিন্তু সাহিত্যের শাখায় ফুটে থাকা সবচেয়ে নতুন কুঁড়িটির, ছোটগল্পটির বিবর্তন স্পষ্ট চোখে পড়ছে। কান পেতে রাখলেই শোনা যাচ্ছে নতুন দিনের পায়ের আওয়াজ। চোখ খুলেই দেখছি নতুন প্রাণের স্পন্দন। হাওয়ায় হাওয়ায় নতুন হাওয়ার ঘ্রাণ। গল্পের আঙ্গিক পালটে যাচ্ছে, মনোভঙ্গি ভিন্ন, বিষয়বস্তু এখনকার। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হওয়া গল্প থেকে বাছাই করা কিছু গল্প নিয়ে এই সংকলনটি, উনিশশো ঊনচল্লিশ সাল থেকে দু’ হাজার চার পর্যন্ত প্রায় ছ’ যুগ দীর্ঘ একটি জীবনের সময়। কম নয়। অল্প কিছু গল্প কিন্তু একই সঙ্গে এটি একটি সময়ের দলিল। কী করে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে দেখার চোখ, সেটিই দেখার। বদলে যাচ্ছে, কিন্তু একটি জায়গায় খুব মিল আছে। গল্পের শেষে মানবতার জয়ই ঘোষণা করেছেন সকলে, নিঃস্বার্থ নির্ভুল নির্বিঘ্ন জীবনই হয় কাম্য। সন্তোষকুমার ঘোষের লেখা স্নায়ু’ গল্পে মিঃ দাশ ক্রমে ক্রমে ধনমানবশখ্যাতির লোভে পড়ে সহমর্মিতা প্রশস্তচিত্ততা ইত্যাদি গুণগুলো হারিয়ে ফেলতে থাকে। তার জগতে মানুষের মন টাকার মাপে পরিমিত। স্ত্রীর প্রতি তার অন্যায় আচরণ, অকারণে অফিসের কর্মচারী নিশীথের চাকরি খেয়ে ফেলা— সবই তাকে একসময় অনুশোচনায় ভোগাতে থাকে। ধনতন্ত্রের খপ্পরে পড়া মিঃ দাশ বাহির এবং ভিতরের সংঘাতের মাঝখানে কিছুকাল দাঁড়িয়ে থেকে শেষপর্যন্ত তার অনুশোচনাকে দুর্বলতা বলে উড়িয়ে দিয়ে যে-পথে যাবার সে-পথেই, সেই মসৃণ পথেই চলে যায়। এই গল্পের বাষট্টি বছর পর সুচিত্রা ভট্টাচার্যের গল্পে একই জিনিস পাচ্ছি, বাজারসর্বস্বতা মানুষকে কুটিল কঠোর করে তুলছে, যশখ্যাতির তীব্র আকাঙক্ষা মানবতাকে ছিঁড়ে টুকরো করছে, রক্তাক্ত করছে। কেবল এই দু’জনের গল্পে নয়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের বিষয় অনেকটা একই। গল্পগুলোয় পুঁজিবাদের পাতা ফাঁদে পা পিছলে পড়া ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে, আছে রক্ষণশীলতা আর প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের বিনাশ, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ঘরগেরস্থালির একঘেয়েমি, নীচতা স্বার্থপরতা অনুদারতার সঙ্গে আপস, আছে অসহায় অস্তিত্বের অস্থিরতা, আছে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মানবিক বোধ।

কোনও নিয়ম আমি মনে করি না থাকা উচিত ছোটগল্প লেখার, যার যেমন করে গল্প লিখতে ইচ্ছে করে তেমন করেই লিখবে। যে পড়বে সে-ই বিচার করবে গল্পটি তাকে কোনও আকাশ দিচ্ছে কি না ভাবনার। গল্পটি তাকে এক বিন্দু স্পর্শ করতে পারছে কি না, পারলেও সে কেমন স্পর্শ। কী করে গল্প কবিতা লিখতে হয়— পশ্চিমের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তা শেখানো হয়। ক্রিয়েটিভ রাইটিং বলে একটি গোটা বিষয়ই তাদের আছে। রীতিমতো শিখে পড়ে মানুষ কলম হাতে নেয়। গঠনপ্রক্রিয়া আর আঙ্গিক হয়তো শেখার প্রয়োজন আছে, কিন্তু আসল যে জিনিসটি, উপলব্ধিটি, সেটি শেখার জিনিস নয়। সেটি ভিতর থেকে আসে। সেটি যদি না আসে, বানিয়ে বেশি দিন কেউ বেশি দূর যেতে পারে না। মিথ্যের মুখোশ এক দিন আপনাতেই খুলে পড়ে।

ছোটগল্পের কী কী উপাদান থাকে বা থাকতে হবে তা পণ্ডিতেরা বলে দিয়েছেন—‘এক নম্বর, অপার-বিস্তৃত রহস্য-জটিল আধুনিক জীবন-ভূমি, যার প্রতি মুহূর্তে, প্রতি বিন্দুতে, জমে আছে অতলান্ত রহস্য-গভীরতা। তার যে-কোনও একটি বিন্দুর গহনে তলিয়ে পূর্ণ জীবনের একটি অখণ্ড ছায়ারূপকে প্রত্যক্ষ করা। দুই, শিল্পী ব্যক্তির ঘন-নিবিড় অনুভব-তন্ময়তা— চলমান জীবন সম্পর্কে তাঁর ধ্যানিজনোচিত আত্মস্থতা। সেই সুস্থির চেতনার মুকুরে জীবনের যে-কোনও মুহূর্ত যেন পূর্ণ জীবনের ছায়া ফেলে। তিন, চাই রচনার ব্যঞ্জনাধর্মিতা। যেন একটি জীবনের বিশেষ মুহূর্তের অবস্থান, অভিঘাত বা আবেগ সর্ব-দেশ-কালের জীবনভূমিতে উৎক্ৰমণ করে।’ খুব গভীর কথা। খুব কঠিন নিয়ম। এ রকম নিয়ম মাথার ওপর রেখে গল্প লেখা সোজা কথা নয়। আমি নিয়ম না-মানার দলে। গঠনপ্রক্রিয়া, আঙ্গিক ইত্যাদি কোনও শেখা বিদ্যে থেকে যে প্রয়োগ করতে হবে তা আমি মনে করি না। আমি তো যেমন ইচ্ছের মানুষ। বিষয়ও, যা খুশি তা হতে পারে। ব্যক্তিগত ভাবে মনস্তত্ত্বের জটিলতায় আমার আগ্রহ বেশি। এই গুচ্ছে এটি বেশ চমৎকার এসেছে আশাপূর্ণা দেবীর গল্পে। ‘চাবি’ গল্পের প্রধান চরিত্র কৃষ্ণা চিঠির বাক্সের চাবি নিয়েই ভাবছিল বেশি, স্বামীর মৃত্যু নিয়ে নয়। অবিশ্বাস তাকে এমনই অধিকার করে ফেলে যে মৃত্যুর মতো ভয়াবহ বীভৎসতাও তাকে এতটুকু স্পর্শ করতে পারে না। মন এমনই আশ্চর্য রকম জটিল, এমনই সূক্ষ্ম রহস্যতন্তুতে গাঁথা, এত ব্যাপ্তি এর, এত আকাশ এটি, যে, রক্তমাংসের শরীর, সে শরীর জীবিত কিংবা মৃত, এত অকিঞ্চিৎকর, যে, অনায়াসে অতিক্রম করে যেতে পারে। জটিলতা আরও মেলে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘হাওয়া-বদল’ আর মতি নন্দীর ‘পাষাণভার’-এ। দু’টোই ষাটের দশকের মাঝামাঝির গল্প। রাজনৈতিক সচেতনতা, শিল্প সাহিত্যের বোধ সবই তখন নিঃসন্দেহে শীর্ষে। ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো সময় ভাল মন্দে দোল খায়। সে-দিনের সেই শীর্ষের সেই চূড়ান্ত সম্ভাবনা মৃত নক্ষত্রের মতো চুপসে যেতে যেতে শুষে নিচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনা, শুভবুদ্ধি। আজও মানুষ দোল খাচ্ছে স্বপ্নের ভাঙাগড়ায়।

জটিলতায় হাজার রকম জিনিস থাকে। ঈর্ষা থাকে। মনে ঈর্ষা আছে, তাই গল্পেও আছে। নরেন্দ্রনাথ মিত্রর ‘আলমারি’ নায়ক পরিতোষ ঈর্ষায় পোড়ে। পরিতোষের স্ত্রী সুপ্রীতির একটি আলমারির দরকার ছিল। আলমারিটি পরিতোষ কিনে দেবে, কিন্তু তার আগেই একটি আলমারি সুপ্রীতি উপহার পেয়ে যায় নির্মলের কাছ থেকে। এই উপহার পাওয়ার ব্যাপারটি পরিতোষের সয় না। আলমারিটির অস্তিত্ব সে ভুলতে পারে না। নির্মলের আন্তরিকতা তার অন্তর ছিঁড়ে খায়। কারওর আলমারির দরকার। কারওর দরকার বসবার ঘর। রমাপদ চৌধুরীর ‘বসবার ঘর’ গল্পটি জাগতিক চাই চাই-এর বিরুদ্ধে চমৎকার প্রতিবাদ। গল্পকারের হাতে যদি জাদু থাকে তবে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনাও চিরস্মরণীয় হয়ে যেতে পারে। ছোট্ট একটি গল্প, দাঁড়িয়ে যেতে পারে অসাধারণ শিল্পে। এমন অনেক গল্প আছে, পড়ার পর যে মানুষ আমি সে মানুষই থেকে যাই। আমি বদলে যাই না, গল্পের কিছু নিয়ে আমি ভাবি না বা আমাকে ভাবতে হয় না। এমন গল্প পড়া না-পড়া আমার কাছে একই কথা। বনফুল আর বাণী বসুর গল্প দু’টো, মড়া নিয়ে হোক বা কাঠমিস্ত্রি নিয়ে হোক, ভাবায়।

গল্পগুলোর সময়কালে ইংরেজ শাসন, মন্বন্তর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, নকশাল আন্দোলন, পাকিস্তানের যুদ্ধ, অযোধ্যা, গুজরাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। কিন্তু কোনও গল্পেই এ সবের প্রসঙ্গ নেই, কেবল সুবোধ ঘোষের গল্পে আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাম্যবাদে বিশ্বাসী ইস্কুল মাস্টার ধ্রুবেশ সমাজ সংসার তুচ্ছ করে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে চলে যায়। উনিশশো বিয়াল্লিশ সালে যুদ্ধকালীন সময়ে গল্পটি লিখেছেন সুবোধ ঘোষ। মানুষকে রাজনীতিতে উৎসাহী করার জন্য, জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাহিত্যিকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সকল দেশে সকল কালেই ছিল। ওদিকে একই বছরে, উনিশশো বিয়াল্লিশ সালেই পল এলুয়ারের কবিতা ‘লিবার্তে জেক্রি ত নম, স্বাধীনতা আমি তোমার নাম লিখি…’ কপি করে করে বিলি করা হচ্ছে পরাধীন ফরাসি দেশে। যারাই পড়ছে, রক্তে তাদের বান ডাকছে, মাটির সঙ্গে শপথ করে এক একজন হয়ে উঠছে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা।

সমকালীন রাজনৈতিক অনাচারের গল্প লিখেছেন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। মানুষের মঙ্গল করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটে জিতে রাজনীতির নেতানেত্রীবৃন্দ মানুষকে দিব্যি শোষণ করছে। স্বৈরাচারী শাসনে মানুষের অধিকার যে-ভাবে পদদলিত হয়, একই ভাবে হয় পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে। লেখকের কোনও দায়বদ্ধতা থাকতেই হবে এমন কোনও শর্ত নেই, কিন্তু দারিদ্র দুর্ভিক্ষ দুর্যোগ দুরবস্থার যুগে দুর্ভোগ পোহানো বাঙালির জন্য লেখককে দায়বদ্ধ হতেই হয়। সত্য এবং সুন্দরের স্বপ্ন দেখতেই হয়। আমাদের গল্পকাররা যদি মানুষ হন, তবে মানুষের কথাই তাঁরা বলবেন। প্রতিটি মানুষের জীবন একটি করে গল্প। একুশ কোটি বাঙালির একুশ কোটি গল্প আছে। এখনও একুশ কোটি গল্প আমাদের গল্পকাররা লিখে উঠতে পারেননি। তাঁরা লিখছেন, লিখবেন। আমরা পড়ছি, আমরা পড়ব। চোখের সামনে। আমরা জীবন দেখছি বটে, কিন্তু একজন শিল্পীর চোখ দিয়ে যখন দেখি, সেই দেখাটি অন্য রকম, সেই দেখাটি দেখার চেয়েও বেশি দেখা, সেই দেখাতে মমতা অনেক বেশি।

তেইশটি গল্পের মধ্যে মাত্র চারটি নারীর। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সর্বত্র পুরুষের আধিপত্য, সাহিত্যজগৎটিও দখল করে বসে আছে পুরুষ-লেখক। নারী-লেখকদের স্থান খুব কম। চারজন নারী-লেখকের মধ্যে এক নবনীতা দেব সেনই লিখেছেন নারীকে দাবিয়ে রাখার পুরুষতান্ত্রিক যড়যন্ত্রের কাহিনি। সলাজনয়নীর স্বামীর বাড়িতে ধেড়ে ধেড়ে স্টিলের ট্রাঙ্ক আর কাঠের প্যাঁটরা ছিল, কোনও বাক্স ছিল না। স্বামীর ব্যবহারে রাগ করে সলাজনয়নী এই যাচ্ছি এই গেলুম বলেও কোনওদিন বাপের বাড়ি সত্যিকার চলে যেতে পারেনি, হাতি চড়ে ডুলি চড়ে পেরোতে হয় বাপের বাড়ির পথ। ও পথে ধুমসো ভারী তোরঙ্গ মাথায় নিয়ে যাওয়া যায় না, এক কাপড়েও ভিখিরির মতো খালি হাতে বাপের বাড়িতে ওঠা ভাল দেখায় না। স্বামীর সঙ্গে পঞ্চাশ বছর সংসার করার পর সলাজনয়নী একটি সুটকেস পায়, তার ছেলে চন্দনই তাকে দেয়। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হল তো সুটকেসে কাপড় চোপড় ভরে সে বাপের বাড়ি চলে গেল। সংসারের কাজকম্ম রান্নাবান্নায় ব্যাঘাত হচ্ছে বলে স্বামী তখন বিষম অসন্তুষ্ট। আরও বেশি অসন্তুষ্ট সলাজনয়নীর স্পর্ধা দেখে। অসন্তোষ প্রকাশ করতে যতই স্বামী কথায় কথায় ডিভোর্সের কথা তোলে, ততই স্ত্রী ঘাবড়ে না গিয়ে দিব্যি ডিভোর্সের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই শক্তি বা সাহস সলাজনয়নী ওই সুটকেসটি থেকেই পায়, যে সুটকেসটিতে নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে সে যখন খুশি চলে যেতে পারে। সংসারে দীর্ঘ বছর পরিশ্রম করেও কিছুই নিজের হয় না, কিছুই নিজের না হলেও ওই সুটকেসটি তার নিজের। ওটি নিয়ে যে চলে যাওয়া, জন্মের মতো চলে যাওয়া না হলেও তো যাওয়া, যেমনই হোক সে যাওয়া—সলাজনয়নীকে পৃথক একটি অস্তিত্ব দেয়, অহংকার দেয়, আত্মসম্মানের বোধটুকু দেয়। ছোট্ট একটি সুটকেস, এটিই হয়ে ওঠে সলাজনয়নীর বিস্তৃত আকাশ, স্বাধীনতার আর এক নাম। কিন্তু নারীর স্বাধীনতা পুরুষের সইবে কেন! সলাজনয়নীর স্বামী একটি চিঠি লেখে চন্দনের কাছে, লাল কালিতে দাগ দিয়ে অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে জানিয়ে দেয়, ছেলে যেন অতি অবশ্যই সুটকেলটি ফেরত নিয়ে যায়, যেন এই আদেশটি কোনও মতেই নড়চড় না হয়। এবং পুনশ্চ দিয়ে আরও একটি বাক্য লেখে সলাজনয়নীর স্বামী, সুবিধে হলে ছোট দেখে লোহার একটি আলমারি যেন চন্দন কিনে দেয় তার মাকে। এমনই তো জীবন নারীর। গণ্ডির বাইরে বেরতে গেলেই পায়ে শেকল পরানো হয়। স্বাধীনতার উড়াল চাইলে ডানা কেটে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। চোখ ফুটলেই চোখ অন্ধ করা হয়, মুখ খুললেই মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া হয়। অধিকারের বোধ জাগলেই তাকে বোধহীন স্তব্ধতার বিষ-জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। নারীবাদী লেখক ভার্জিনিয়া উলফ নারীর নিজের জন্য নিজের একটি ঘরের প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। সেই থেকে দিন পেরোচ্ছে, শ পেরিয়ে সহস্র, পাঁচ দশ করে পনেরো পঁচিশ, এখনও পেরোচ্ছে, কিন্তু নিজের ঘর বলতে যা বোঝায় তা পাওয়া হয়নি নারীর। পাওয়া হয়নি এখনও সত্যিকার স্বাধীনতার স্বাদ, সত্তার স্বাতন্ত্র্য, সম্পূর্ণতা। এখনও নারী মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ পায় না। এখনও তারা দাসী। এখনও বস্তু, ভোগের বস্তু। নারীর বঞ্চনা লাঞ্ছনার গল্প নারী-লেখকদের কলমে খুব না এলেও এসেছে সমরেশ বসুর ‘ঠাট্টা’য়। সমরেশ বসু শক্তিমান লেখক বলেই এবং নিজে তিনি পুরুষ বলেই চমৎকার তুলে আনতে পেরেছেন পুরুষের ভেতরের ভয়ংকর কুৎসিত পুরুষটিকে। মেয়েরা যখন বাসর জাগতে বসেছে আসর জাঁকিয়ে, শিবেন বাজি ধরেছে, যে-মেয়ে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে তিন টান দিতে পারবে, তাকে দেওয়া হবে দশ টাকা। দশ টাকা বেড়ে পরে কুড়ি টাকা হয়। হলেও ছিছি আর থুতুর ভয়ে কোনও মেয়েই সিগারেট স্পর্শ করতে সাহস পায় না। কোন মেয়ে চায় লোকের চোখে মন্দ হতে। কিন্তু মায়া চায়। মায়ার অভাবের সংসারে কুড়ি টাকা অনেক টাকা। মায়া যখন সিগারেটে টান দিল, মানে পুরুষতান্ত্রিক রক্ষণশীল সমাজ মেয়েদের যা করা উচিত নয় বলে ফতোয়া দিয়েছে, তা করল, মাছের গন্ধ পাওয়া চতুর বেড়ালের হাসি তখন শিবেনের গোঁফের ফাঁকে। শিবেন সবে বিয়ে করেছে, সুন্দরী একটি বউ আছে পাশে, তাতে কী! সমাজের নিয়মনীতি না মানা, রক্তচোখের শাসানিকে পরোয়া না করা, নষ্ট-মেয়ে আখ্যা পাওয়ার ভয়কে তুচ্ছ করা মেয়েরা একটু অন্য রকম, এই অন্য রকম মেয়েদের, শিবেন এবং বাকি মেয়েরা খুব সহজে ভেবে নেয়, যে, হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়। শিবেন এবং শিবেনের মতো পুরুষেরা এই অন্যরকম মেয়েদের ছলে বলে কৌশলে ভোগ করতে চায়, এবং এর মজাই, তারা মনে করে, আলাদা। যে মেয়েরা, মেয়ে হয়েও, মন্দ লোক শিবেনকে মন্দ না বলে মায়াকে মন্দ বলেছে, সেই মেয়েরা শিবেনের চেয়ে কিছু কম পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক তারা, নিজের ঘাড়ের ঘায়ের ওপর তারা পাহাড়ের মতো ভারী পুরুষতন্ত্রকে বইছে, কেবল বইছে না এটিকে মাথা উঁচু করে সবলে সকৌতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে সবরকম সাহায্য করছে। এদের এবং এদের পূর্বনারীদের মস্তিষ্কের অণুতে অণুতে সহস্র বছর ধরে প্রবেশ করানো হয়েছে এই শিক্ষা, যে, পুরুষ উপরে, নারী নীচে। পুরুষ খানিক বেশি-মানুষ, নারী খানিক কম-মানুষ, পুরুষ সুপিরিয়র, নারী ইনফিরিয়র। নারী হচ্ছে, পুরুষের সম্পত্তি, পুরুষ যা কিছুই আদেশ করবে, নতমস্তকে নারীর তা পালন করা কর্তব্য। সমরেশ বসু শিবেনকে দিয়ে বাসরঘরের ঠাট্টাটি করালেন বটে, এই ঠাট্টার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সংসারে নারীর মূল্যহীনতা।

সংসারে নারীকে যে মূল্য দেওয়া হয় বলে দাবি করা হয়, সেই মূল্য নারীকে ততক্ষণই দেওয়া হয়, যতক্ষণ সে পুরুষেরই তৈরি নিয়ম মেনে পুরুষের সাধ-আহ্লাদ কামনা-বাসনা মেটাতে পারে, যতক্ষণ সে নিজের ত্যাগ বিতরণ করে পুরুষকে ভোগী করতে পারে, নিজেকে নিঃস্ব করে পুরুষকে অধীশ্বর করতে পারে, নিজে সর্বংসহা হয়ে পুরুষকে সর্বভুক করতে পারে। নারীর এই মূল্যটি বা তাকে অর্পণ করা এই শ্রদ্ধাটি সবসময়ই শর্তাধীন। এই শ্রদ্ধা নারীর প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নয়, এই শ্রদ্ধা মায়ের চিরন্তনী রূপের প্রতি শ্রদ্ধা, এই শ্রদ্ধা নারীকে পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে অর্জন করতে হয়, কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে এই শ্রদ্ধার্জন সম্ভব নয়। তলিয়ে দেখলেই দেখি শ্রদ্ধা ও সম্মানের একফোঁটাও আসলে নারীর জন্য নয়, পুরোটাই পুত্রের জন্য, পুরুষের জন্য। পুত্রকে বা পুরুষকে ধারণ করে লালন করে মানুষ করে পুরুষের মতো পুরুষ করে নারীর নিজের জীবনকে সার্থক করতে হয়। নারীর নিজের কোনও আলাদা জীবন নেই, মানুষ হিসেবে নারীর নিজের জীবনের কোনও মূল্য পিতৃতন্ত্রের এই পচা পুরনো সমাজে নেই।

সুবোধ ঘোষ তাঁর ‘কর্ণফুলির ডাক’ গল্পটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তাণ্ডব ধ্রুবেশকে, একটি ছাপোষা মধ্যবিত্ত পুরুষকে ধীরে ধীরে কী করে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন এবং সক্রিয় করে তুলল তার গল্প বলেছেন। গল্প বলতে গেলে ধ্রুবেশের স্ত্রী রমার কথা চায়ের সঙ্গে একমুঠো চানাচুরের মতো এসে যায়। রমার জন্য রাজনীতি নয়, রমাকে রাজনীতি নিয়ে ভাবা মানায় না, ও বড় জটিল জিনিস, বুদ্ধির বস্তু। রমার জন্য তাই, রমাকে যা মানায়, তা-ই রাখা। গোটা একটি সংসার। চার দেওয়াল। বাসন কোসন। কাচ্চা বাচ্চা। সুবোধ ঘোষ অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে বলেন, ‘ঘর নিয়ে পড়েছে রমা— সোনার খাঁচা গড়ার আনন্দে সে বিভোর।’ অথবা ‘ধ্রুবেশকে সে ভালবাসে নিজের চেয়ে অনেক বেশি।’ অথবা ‘দিনরাত শুধু খাটতে ইচ্ছে করে (রমার)। সংসারের জন্য বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে নিজেকে।’ রমাই হচ্ছে আমাদের সতীসাধ্বী, গর্ভধারিণী, মাতৃরূপিণী পতিব্রতা কুলবধূর প্রতীক। সোনা বা রুপো বা কাঁসা বা পিতল বা লোহার খাঁচায় বন্দি লক্ষকোটি নারীর মতোই রমা, রমা বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা নয়। রমার মতো নারীই গল্পগুলোয় মেলে।

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের নারী অভাবে শরীর বিক্রি করতে যায়! স্বামী সন্তানের জন্য ভাত জোটাতে তার অবশেষে এ ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। এতে স্বামীটির সায় থাকে। স্বামী চোর হতে চাইছে না, কারণ, চৌর্যবৃত্তিতে, সে মনে করছে, যে, মান যাবে তার। কিন্তু স্ত্রীর শরীরটি, যেহেতু শরীরই সম্পদ মেয়ের, এবং বিবাহিত মেয়ের শরীরটি স্বামীর সম্পত্তি, এটি খাটিয়ে ঘরে পয়সা আনা, যদি স্বামী রাজি হয়, দোষের নয়। বিয়ে করলে, স্বামী হাজরার মনে হয়, যে, এক জন মানুষের আর এক জন মানুষের ওপর দখল হয়। আসলে এক জনটি এবং আর এক জনটি কে বা কারা তা আমরা বেশ ভাল বুঝতে পারি। দাম্পত্যে এই দখল তো কখনও পরস্পরের ওপর হয় না। দখল শুধু পুরুষেরই হয়, নারীর ওপর হয়। হাজরাকে খেয়ে পরে বাঁচতে হবে, স্ত্রীর সতীত্ব রক্ষার চেয়ে মহান কাজ এটি। ‘রক্ষণশীল মধ্যবিত্তদেরই শুধু শরীর নিয়ে শুচিতা। পেটে খিদে থাকলে কেউ মান সম্মান নিয়ে ভাবে না, শরীর নিয়ে কারওর সতীপনা করারও দরকার হয় না’— এ সব যুক্তিতে অনেক পাঠকই হয়তো প্রমীলার পক্ষ নেবেন, যে প্রমীলা নিজের শরীরকে মাংসের মতো বিক্রি করছে হাটে কেবল স্বামী সন্তানকে তুষ্ট করার জন্য। পুরুষের জন্য এ নারীর চিরাচরিত ত্যাগ, কিন্তু প্রথার বাইরের ত্যাগ। প্রথার বাইরের ত্যাগ বলেই চমক আছে এ ত্যাগে। আসলে কিন্তু ত্যাগ ত্যাগই, চমক থাক বা না থাক। পুরুষের পৌরুষ রক্ষা করতে নারী নিজেকে কখনও আবৃত করে, কখনও অনাবৃত করে। কখনও ঘোমটা পরে, কখনও খেমটা নাচে। কখনও সে মা, কখনও সে বেশ্যা।

দিব্যেন্দু পালিতের গল্পটিতেও দেখি নারীর ত্যাগ। ত্যাগ শেষে স্বামীর সহানুভূতি এবং সাহচর্য পেয়ে নারী ধন্য হচ্ছে, সুখে কাঁদছে। লেখক বলছেন, ‘রথীনের সংসার কুড়ি বছরে অনেক কাড়াকাড়ি করেছে ওর কাছে—শরীর, স্বাস্থ্য, সময়, সোনাদানা, হয়তো বা মনও।’ দেবী মুখ বুজে সবই দিয়েছে নিজের যা ছিল। সব দেওয়ার পর অবশিষ্টটুকু নিয়ে সে ফের দাঁড়িয়ে থাকে, আরও দিতে, আবারও দিতে। মুখ বুজে। এমন মেয়েই তো সংসারে প্রয়োজন, এ রকম আত্মত্যাগের মাধ্যমেই নারী মহিমান্বিত হয়ে ওঠে—মূলত পুরুষ-লেখকদের গল্পের শেষে প্রচ্ছন্ন বা অপ্রছন্ন বাণীটি এই-ই থাকে। নারী চরিত্রগুলো এখানে নেপথ্যে, পুরুষকে প্রেম দিচ্ছে, প্রেরণা দিচ্ছে, স্বস্তি দিচ্ছে, সুখ দিচ্ছে, আরাম-আয়েশ যত প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি দিচ্ছে। নিজের জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে। এইসব নারীকে বড় যত্নে বড় মায়ায় বড় ভালবাসায় এঁকেছেন লেখকরা। কিন্তু দু’হাজার চার সাল অবধি একজন লেখকও লেখেননি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র নিয়ে বেঁচে থাকা কোনও স্বনির্ভর নারীর কথা, নষ্ট সমাজের শৃঙ্খল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা কোনও সাহসী মেয়ের গল্প।

সকালে ঘুম থেকে উঠে এক রাতের মধ্যেই নিজের পোকা হয়ে যাওয়া দেখেছিল কাফকার নায়ক। সমরেশ মজুমদার তাঁর নায়ক মুকুন্দকে পোকা না বানালেও তার চামড়া মোটা করে দিয়েছেন। এই কাণ্ড করতে সময় নিয়েছেন তিনি তিন দিন। সমরেশের মোটা চামড়ার এই গল্পটি হিতোপদেশে জর্জরিত। সংসার ও সংশয়ের নখর মুকুন্দকে আঁচড়ে কামড়ে অসহায় করে তুলছে, হীনম্মন্যতায় ভুগতে ভুগতে শেষ অবধি সে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে। স্নায়ু কাজ করছে না, শিরা উপশিরাও করছে না। ছুরিতে কাটলেও মুকুন্দর গা থেকে রক্ত বেরোয় না। যত বড় দর্শনই থাক না কেন এ সবের গভীরে, একটু আধটু দৃষ্টি যেটুকু পড়ে নারীর ওপর, তাতেই দাঁতকপাটি মেলে বেরিয়ে পড়ে নারীর প্রতি চরম ঘৃণা। মুকুন্দর মনে পড়ে, ‘একমাত্র দুষ্ট চরিত্রের মহিলারাই প্রৌঢ়া বয়সে যুবতী থাকেন।’ এ কেবল গল্পের মুকুন্দর নয়, বাস্তবের অসংখ্য অগুনতি মুকুন্দর এমনই বিশ্বাস। নারীকে যৌনসামগ্রী জ্ঞান করলেও জীবন নিয়ে বড় বড় দর্শন আওড়িয়ে খুব সহজেই বড় বড় দার্শনিক বনে যেতে পারেন পুরুষেরা, কেউ এতে এ যাবৎ আপত্তি করেনি, আপত্তি করে না।

এ দিকে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পে দেখছি দাম্পত্যের আর এক রূপ, ইউলিসিসি সংশয়। সুজয় তার বউয়ের পাশে শুয়ে থেকে থেকে কেবলই ভাবে, যুবতী বউটি মনের ভেতর রেখে দিয়েছে বড় এক পদ্মদিঘি, পাড়ে পাড়ে তখন কেউ বুঝি হেঁটে বেড়ায়। স্ত্রীকে যেহেতু নিজের সম্পত্তি ভাবা হয়, তাই দিবানিশি সম্পত্তির মালিক সংশয়ের সমুদ্রে সাঁতার কাটে, এই বুঝি সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে, কেউ দখল বসাতে চাইছে, এই বুঝি এক শরীর জমির ওপর গোপনে কেউ লাঙ্গল চালিয়ে গেল। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর গল্পের পুরুষচরিত্র যে কোনও পুরুষের মতোই প্রেমিকাকে অন্য পুরুষের সঙ্গে বসে থাকতে দেখেই মন্তব্য করে ফেলে, বিচ, হোর। প্রেমিকাকে পশুপতির সঙ্গে শুতে দেখেনি, একটি রেস্তোরাঁয় বসে কথা বলতে দেখেছে মাত্র। এটুকুতেই নীলাদ্রির এই মন্তব্য। নীলাদ্রি ঈর্ষা থেকে বলে এ কথা, তার এ কথায় পাঠকের ভ্রূ কিন্তু সামান্যও কুঞ্চিত হবে না। কারণ এই অশালীন মন্তব্য কোনও অজানা অন্ধকার থেকে টুপ করে অকস্মাৎ পড়েনি। এই মন্তব্য ঘরে বাইরে রাস্তা ঘাটে সর্বত্র সশব্দে, নিঃশব্দে উচ্চারিত হচ্ছেই। ঠিক একই রকম ঘটনায় কোনও প্রেমিকা কিন্তু ঈর্ষা থেকে এ রকম কোনও মন্তব্য তার প্রেমিক সম্পর্কে করবে না, বরং প্রেমিকা বাড়ি গিয়ে বালিশে মাথা লুকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদবে অথবা ঈর্ষান্বিত প্রেমিকের মতো প্রেমিকের পাশে বসা মেয়েটিকেই গালি দেবে বিচ আর হোর বলে। বোধোদয় হওয়া মেয়েদের ঐক্য ভেঙে দেওয়া এবং মেয়েদের পিছনে মেয়েদের লেলিয়ে দেওয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ষড়যন্ত্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সার্থক। মহাসমারোহে এই ষড়যন্ত্রটি এখনও ধোঁকা দিয়ে চলছে মানুষকে, এমনকী যারা প্রগতিশীল বলে নিজেদের দাবি করে, তাদেরকেও।

আবুল বাশারের গল্পে এক বুড়ো হঠাৎ ঘোষণা করে দিল তাঁর স্ত্রীর শরীর থেকে দুর্গন্ধ বেরচ্ছে, বাসি হয়ে যাওয়া মাংসের গন্ধ স্ত্রীর শরীরে, তাই তিনি তাঁকে ডিভোর্স দেবেন। নিজের বয়স নব্বই হলেও স্ত্রীর বয়স যেহেতু বেড়েছে, লোল হয়েছে, তাই সুগন্ধ চলে গেছে, স্ত্রীর মাংস তাই বাসি। বঙ্কিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বুড়ো বলেন যে যৌবনে কুক্কুরীও সুন্দর। যৌবন গত হলেই মেয়েরা বাসি হয়ে যায়, পচে যায়, ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে যায়। পুরুষ-লেখকরা এই ভয়ঙ্কর পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই পুরুষ, তাঁদেরও ‘ভাল এবং মন্দ নারী’র প্রচলিত সংজ্ঞতা জানা আছে, এবং এতে গভীর বিশ্বাসও আছে, তাই দেখি সতীসাধ্বী সহৃদয় সহিষ্ণু নারীকে তাঁরা বড় শ্রদ্ধায় সংসারে ঠাঁই দেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবনের গল্পে সেটিই তো প্রস্ফুটিত এবং প্রকটিত।

১৭৮৯ সালে ঘটে যাওয়া ‘মহান’ ফরাসি বিপ্লব ছিল শোষকের বিরুদ্ধে এবং শোষিতের পক্ষে। এত বড় বিপ্লব এত কিছু ঘুচিয়েছে, লিঙ্গভিত্তিক শোষণ ঘোচায়নি। বিখ্যাত ডিক্লারেশন অব দ্য রাইটস অব ম্যান— যেখানে ‘ম্যান’-এর অর্থ কেবল পুরুষ — লেখা হয়ে গেল। এত বড় বিপ্লব সমাজের উঁচুতলা নিচুতলা ভেঙে সমান করে দিল, গোঁড়ামির আগাগোড়া বদলে দিল, গুঁড়ো করে দিল হাজার বছরের মেনে চলা নিয়ম কিন্তু এই বিপ্লব আসলে ছিল পুরুষের অধিকারের জন্য বিপ্লব। নারীর অধিকারের কথা এক বারও উচ্চারিত হয়নি। হয়নি, কারণ নারীকে মানুষ বলে গণ্য করা হয়নি। এই এত বড় বিপ্লব নারীকে সামান্য ভোটের অধিকারও দেয়নি। নারীর যন্ত্রণা চোখে পড়ে না বড় বড় বিপ্লবীদের, বড় বড় সমাজবিদদের, বড় বড় গল্পকারদেরও।

তসলিমা নাসরিন
কলকাতা, ১ জানুয়ারি, ২০০৫

Book Content

মড়াটা – বনফুল
হাওয়া-বদল – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত
চাবি – আশাপূর্ণা দেবী
কর্ণফুলির ডাক – সুবোধ ঘোষ
সন্দেশ – জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী
আলমারি – নরেন্দ্রনাথ মিত্র
স্নায়ু – সন্তোষ কুমার ঘোষ
খিল – বিমল কর
বসবার ঘর – রমাপদ চৌধুরী
ঠাট্টা – সমরেশ বসু
একটা পিস্তল ও ডুমুর গাছ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
পাষাণভার – মতি নন্দী
অন্নপূর্ণা – শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
শোণিতে সুমধুর সজ্জা – অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
সাঁকো – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
আমেরিকা – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
স্পেশাল অফিসার – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
সুটকেস – নবনীতা দেবসেন
ঝালমুড়ি – দিব্যেন্দু পালিত
অবস্থান – বাণী বসু
টাটকা বরফের মাছ – সমরেশ মজুমদার
আমার এখন সময় নেই – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
আমি আমার মতো নই – আবুল বাশার
বইয়ের ধরন: গল্পগ্রন্থ / গল্পের বই
ভাসানবাড়ি - সায়ক আমান

ভাসানবাড়ি – সায়ক আমান

প্রেত-প্রেয়সী

প্রেত-প্রেয়সী – অদ্রীশ বর্ধন

খোঁয়ারি (গল্পগ্রন্থ) - আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

খোঁয়ারি – আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

অলকনন্দা - নারায়ণ সান্যাল

অলকনন্দা – নারায়ণ সান্যাল

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑

Login
Accessing this book requires a login. Please enter your credentials below!

Continue with Google
Lost Your Password?
egb-logo
Register
Don't have an account? Register one!
Register an Account

Continue with Google

Registration confirmation will be emailed to you.