খিল – বিমল কর

খিল – বিমল কর

যার আসার কথা তার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না স্টেশনে। তার বদলে ইন্টার ক্লাস কম্পার্টমেন্ট থেকে ও নেমে এল। নেমে আসতেই মুখোমুখি দেখা। মাধবী চৌধুরী।

চেন-বাঁধা ফক্সটেরিয়ারটা আলগা পেয়ে সুধাংশুর ত্রিসীমানা ছাড়িয়ে ছুট। ঠোঁটের সিগারেট ঝুলতে থাকল ঠোঁটেই।

চোখে চোখ রেখে সুধাংশু বললে অবাক হয়ে, ‘তুমি!’

—তাই তো, তুমি এখানে! মাধবী বিস্ময় প্রকাশ করলে।

কুলি এসে সুটকেশ আর হোল্ডঅল নামিয়ে নিয়েছে মাধবীর।

হাঁটতে শুরু করলে দুজনেই প্লাটফর্ম দিয়ে। সুধাংশু ডাকছিল উচ্চস্বরে—জিমি, জিমি। কাম অন—জিমি।

ফক্সটেরিয়ার প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে ছুঁই-না-ছুঁই করে পাশে পাশে চলছিল।

ওদের মধ্যে আর কোনও কথা হয়নি। সেই তুমিতেই থেমে আছে।

প্লাটফর্মের বাইরে এসে সুধাংশু এগিয়ে গেল তার গাড়ির দিকে। হরিতকী গাছের ছায়ায় সুধাংশুর টু-সিটার দাঁড়িয়ে।

কুলিটাও গাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছিল সুধাংশুর পিছন পিছন।

মাধবী ডাকলে, এই কুলি!

কুলি সে-ডাক শুনতে পেল না। শুনতে পেল সুধাংশু। শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে ক’পা দূরে মাধবী দাঁড়িয়ে পড়েছে।

পা বাড়াবে কি বাড়াবে-না একটু বুঝি ভেবে সুধাংশু এগিয়ে এসে মাধবীর কাছে দাঁড়াল। হেসে বললে, ‘ওর আর দোষ কী। ও ভেবেছে আমি তোমায় অ্যাটেন্ড করতে এসেছিলাম। মোটরে মাল তুলছে।’

—জ্বালাতন! ডাকো তো ওকে। মাধবীর চোখে বিরক্তি ফুটল।

—ডাকব কেন। তুলেছে যখন ভালই করেছে। কোথায় যাবে তুমি বলো, নামিয়ে দিয়ে যাব।

—যাবার কোনও ঠিকানা নেই। এক রাতের মতন মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে নিতে হবে।

—সে কী!

—আমি অবশ্য ভেবে এসেছিলাম এখানে মেয়ে-ইস্কুলের টিচারদের আস্তানায়—

মাধবীর কথা শেষ হয়নি, একটা সাইকেল-রিকশা ওদের কাছে এসে থামল, আর রিকশা থেকে নামতে নামতে এক ভদ্রলোক সুধাংশুর দিকে তাকিয়ে বিগলিত হাসি হেসে নমস্কার জানালে করজোড়ে, স্যার—আপনি।

সুধাংশু ঠোঁটের কোণে একটু হাসি টেনে একটা হাতের ক’টি আঙুল কপালের কাছাকাছি এনে মাথা হেলাল, ভাল তো!

—আজ্ঞে হ্যাঁ। ভদ্রলোক যেন কৃতার্থ বোধ করলেন। রিকশাওয়ালাকে পয়সা হিসেব করে দিতে দিতে কয়েক বার তাকালেন সুধাংশু আর মাধবীর দিকে।

দাঁড়িয়ে থেকে দু’জনাই অস্বস্তি বোধ করছিল, বেশ বোঝা গেল।

—এসো। সুধাংশু বললে।

মাধবী ভাবলে, টিচারদের কোয়ার্টার্সেই তাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে সুধাংশু।

গাড়িতে পাশাপাশি ওরা। একটা মোড় ঘুরে গাছের ছায়ায় ছায়ায় পিচের যে রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে —সুধাংশু সেই রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

—তুমি কি মেয়ে-স্কুলের টিচারির ইন্টারভ্যু দিতে এসেছ? মাথা নাড়ল মাধবী।

—কালকেই ত ইন্টারভ্যু! সুধাংশু আবার বললে।

—তুমি দেখছি সব খবরই রাখো।

—রাখতে হয়। হাসল সুধাংশু, কিন্তু এ চাকরি তো তোমার হবে না।

—কেন? লোক নেওয়া আগেই হয়ে গিয়েছে নাকি?

—না।

—তবে প্রাইভেটে কোনও ক্যান্ডিডেট—

—না, না, নট দ্যাট। আমি-ই অ্যাপ্রুভ করব না।

মাধবীর কাছে হেঁয়ালি ঠেকছিল সুধাংশুর কথাবার্তা।

সেকেন্ড গিয়ারে গাড়ি তুলে সুধাংশু বললে, ‘রিকশা থেকে যে ভদ্রলোক নামলেন তখন—উনিই বলরামবাবু, স্কুলের সেক্রেটারি। অতি সজ্জন ব্যক্তি। আজই স্কুলের কমিটি-মেম্বারদের বাড়ি বয়ে গিয়ে খবরটা জানিয়ে দেবেন, স্কুলের প্রেসিডেন্ট একটি সুন্দরী মহিলাকে কলকাতা থেকে আনিয়েছেন স্কুলের হেড মিসট্রেসের পদে বরণ করে নেবার জন্যে। স্বচক্ষে স্টেশনে তিনি দেখে এসেছেন সে দৃশ্য।’ সুধাংশু হঠাৎ একটা ব্রেক কষল। হাসল আপন খেয়ালেই। তারপর বললে, ‘আমি এখন ব্যাচিলার। বলরামবাবুরা সে জন্যে বড়ই উদ্বিগ্ন থাকেন। কিন্তু নেহাতই মুন্সেফির জোরে— প্রেসিডেন্ট কি না, তাই একটু মুশকিল।

মাধবী হঠাৎ অত্যন্ত অসহায় বোধ করলে।

অসহায় এবং বিরক্ত-ও।

—কী আশ্চর্য, আমি ত জানতাম না তোমার সঙ্গে এভাবে দেখা হতে পারে!

—আমিও জানতাম না।

—তোমার শেল্টার আমি চাইনি!

—আমিও তোমায় শেল্টার দিতে আসিনি। কিন্তু এখন দিচ্ছি।

মাধবী চুপ।

—তুমি কি আগের স্কুলে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছ?

—না।

—তবে দুশ্চিন্তা নেই। এখানে চাকরি করলে তোমায় নিয়ে আড়ালে কথা হবে। আমিও বাদ যাব না। আমাদের এই হঠাৎ দেখা হওয়াটাই অভিশাপ হল তোমার পক্ষে।

মাধবী আশা ভরসা ছেড়েই দিয়েছিল। অনেক ক’টা টাকা যাতায়াতে অযথাই খরচ হয়ে গল, তাই মনটা খচ খচ করছিল। চাকরি পেলেও সুধাংশু যে স্কুলের প্রেসিডেন্ট, সেখানে মাধবীও থাকত না।

সুধাংশুর শেষ কথাটা কানে যেতে মাধবী মুখ ফিরিয়ে দেখল তাকে। ওদের দু’জনে হঠাৎ দেখা হওয়াটা যে মাধবীর পক্ষে অভিশাপ বিশেষ, এ সত্য অনেক দিন আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল তার। কাজেই কথাটা নতুন নয়। তবে নতুন করে আবার শোনা গেল।

—ডাউন ট্রেনে আমি ফিরে যাই তবে। কখন ট্রেন? শুধাল মাধবী।

—সন্ধ্যেবেলায়।

—সারাদিন আর গাড়ি নেই!

—ছিল, খুব ভোরে, প্রায় শেষ রাতেই বলা চলে।

আবার চুপ দু’জনেই। সুধাংশুর শার্টের কলার হাওয়ায় উড়ছে। মাধবীর চুলগুলোও মুখে কপালে উড়ে পড়ছে। জড়িয়ে যাচ্ছে চশমায়।

—কোথায় যাচ্ছি? মাধৰী সামনের দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললে।

—আমার বাংলোয়। সুধাংশু আর একটা মোড় ঘুরে স্পিড কমিয়ে আনলে মোটরের।

টেবিলে খেতে বসেছে দু’জনে। স্নান সেরে, হাল্কা সবুজ রঙের শাড়িটি পরেছে মাধবী। চুলগুলো সদ্য-ভিজে, এলো হয়ে পিঠে ছড়িয়ে রয়েছে। মুখে সামান্য একটু পাউডারের ছিটে।

সুধাংশুর পরনে পা-জামা, গায়ে হাফ-হাতা শার্ট।

ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। মাথার ওপর ফ্যানটাও ঘুরছে ধীরে। দরজায় খস ঝুলছে, শার্সি আধ-ভেজানো।

বেশ একটা ছায়াচ্ছন্ন স্নিগ্ধতা।

—ক’বছরে বেশ রোগা হয়ে গিয়েছ তুমি। সুধাংশু চামচে করে মুখে ভাত তুলতে তুলতে বললে।

—তুমি বেশ মোটা হয়েছ। মাধবী চোখ না তুলেই হাসল।

—অ্যালকোহলিক ফ্যাট নয়।

—আমি কি তাই বলেছি! এবার চোখ তুলল মাধবী, ‘ভাল আছ, ভাল থাকছ, খাচ্ছো, মনে সুখ আছে।’

—সুখ আছে, তবে চিত্তে শান্তি নেই। হাসল সুধাংশু।

মাধবীর মুখ দিয়ে বেফাঁস বেরিয়ে গেল, ‘একটা বিয়ে করে ফেলো।’

—ভাবছি করব। ঠিক করেই ফেলেছি। আজই একটি পাত্রী আসার কথা ছিল।

—বাবা, বাড়ি বয়ে এসে কন্যাপক্ষ কন্যা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে! মাধবী ঠোঁট ওল্টায়।

—কন্যাপক্ষ বলতে কন্যাই শুধু। তিনি একাই আসছিলেন। তাঁকে আনতেই স্টেশনে গিয়েছিলাম।

মাধবীর চামচ থেকে মাছের টুকরোটা প্লেটে পড়ে গেল। চোখ তুলতেই দেখে সুধাংশু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

চোখ নামিয়ে নিল মাধবী। আশ্চর্য একটা অস্বস্তিতে সঙ্কুচিত হয়ে উঠল ও। চুপ করে থাকায় আবহাওয়াটা যেন আরও অস্বস্তিকর হয়ে উঠতে লাগল।

—তবে তো তুমি হতাশ হলে।

মাধবী কোনও রকমে আবহাওয়া তরল করতে লঘু কণ্ঠে বললে।

—একরকম তাই-ই। তবে লাভ তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।

—আমার কিন্তু লোকসান। মাধবী এবার শব্দ করে হাসল। আবহাওয়াটা আরও তরল করতে চায় ও।

একটু পরে মাধবীই বললে, ‘যিনি আসছিলেন তিনি বুঝি তোমার পূর্বপরিচিতা?’

—হ্যাঁ।

সন্ধ্যের ডাউন ট্রেনে ফেরার জন্যে মাধবীর তাড়া ছিল হয়তো। কিন্তু দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল বেচারি। সারারাত্রি ট্রেন জার্নি করে এসেছে। মনে যথেষ্ট উদ্বেগও বুঝি ছিল। ঘুম হয়নি হয়তো রাত্রে। সুধাংশুর বাংলোর ঠাণ্ডা নিরিবিলি ঘরে নরম বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে কাদা।

ঘুম ভাঙল যখন তখন বিকেল শেষ। গোধূলির আলোও শিশুগাছের পাতায় ফিকে হয়ে এসেছে।

তবু তাড়াতাড়ি করে কাপড় ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। সুধাংশু গাড়ি বের করলে গ্যারেজ থেকে। স্টার্ট দিয়ে বললে, আর মাত্র দশ মিনিট। পারবে কি গাড়ি ধরতে!

—তোমার দয়া হলেই পারব।

সুধাংশু সাধ্যমত স্পিড তুলেছিল গাড়িতে। কিন্তু মাঝপথে গিয়ে অচল হল টু-সিটার। পেট্রল ফুরিয়েছে। তাড়াতাড়িতে বেরুবার সময় ট্যাঙ্কটা ভর্তি করে নেয়নি সুধাংশু। ভুলে গিয়েছিল একেবারেই।

মাধবী রাস্তায় নেমে এসেছিল। কপালে বিরক্তি ফুটিয়ে বললে, ‘এখন কী করি!’

—চল হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরি। বাংলোয় গিয়ে পেট্রল সমেত লোক পাঠাব, গাড়ি নিয়ে যাবে।

আশ্চর্য! মাধবী ভ্রূকুঞ্চিত করলে, ‘তোমার গাফিলতির জন্যে এত দুর্ভোগ। এখন রাত কাটাতে হবে।’

—উপায় কী! সুধাংশু ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুছতে মুছতে বললে।

রাত্রে খাবার টেবিলে বসে ওরা এমন সব কথাবার্তা শুরু করলে যার সঙ্গে নিজেরা কোনও ভাবেই যুক্ত নয়। দু’জনেই কেমন যেন সচেতন, কোনও রকমের ব্যক্তিগত কথা যেন কোনও ভাবেই না উঠে পড়ে। সুধাংশু হয়তো বললে, ‘এখানে মাংসটা সব সময় এভেলেবল্‌। মাছ বড় একটা পাওয়াই যায় না।’

—তোমার রান্নাবান্না বেশ ভালই করে দেখছি।

—হ্যাঁ, লোকটাকে বিস্তর তোষামোদ করে রেখেছি।

কিংবা কথা ওঠে এখানে বর্ষাকালে ব্যাঙরা যখন ডাকে তখন তার শব্দ কী। লোভনীয়, অথবা আশ্বিন মাসের সকাল কী সুন্দর এখানে। মাধবী কথাপ্রসঙ্গে দু’চারজন বন্ধুর খবর দেয়। কে বিয়ে করেছে, কে মরেছে, কে স্কলারশিপ নিয়ে বিলেত গেল।

খাওয়া শেষ হলে আরও একটু গল্প। তারপর সুধাংশু বললে, কালকে ভোরের ট্রেনেই যাচ্ছো তাহলে!’

—নিশ্চয়ই।

—আরলি মর্নিং-এ ট্রেন—পাঁচটা সাতে।

—আমি তৈরি থাকব। তুমি অনুগ্রহ করে উঠলেই বাঁচি।

এখন মাধবীকে অন্যরকম দেখাচ্ছিল। রুক্ষতা যদিও বা একটু থেকে থাকে চোখে কিন্তু সে-রুক্ষতা ওর সৌন্দর্য হরণ করেনি। বরং একটু বুঝি দীপ্তই মনে হচ্ছে। গায়ের শাড়িটা আবার পাল্টেছে মাধবী।

এবার পরনে ঘন নীল শাড়ি। প্রান্তে সরু জরির পাড়। ব্লাউজটা সাদা। হাতে একটি লতার কাজ। খোঁপাটা এলো করে বাঁধা। ঘাড়ে ভেঙে পড়েছে। পাতা সমেত দুটি বেল কুঁড়ি ওর চুলে।

সুধাংশু মাধবীর এ রূপ লক্ষ করছিল কি-না স্পষ্ট তা বোঝা গেল না।

টেবিল থেকে উঠে শোবার ঘরে এসে বললে, ‘এইটে তোমার। পাশেই আমি থাকলাম।’ সুধাংশু একটু তাকাল এদিক ওদিক, তারপর বললে, ওদিকের সব দরজাই বন্ধ। এইটেই খোলা। আমি পাশেই থাকলাম। খিল বন্ধ করে দিয়ো।

মাধবী কথা বললে না। সুধাংশুই দরজাটা টেনে দিলে।

মাঝ রাত বুঝি তখন। মাধবীর একটু বুঝি তন্দ্রা এসেছিল। বুকটা ধুক ধুক করে উঠল। পাশের ঘরে কীসের যেন শব্দ উঠল খুট খুট। ঘর অন্ধকার। মাধবী সেই অন্ধকারেই দরজার দিকে তাকাল তীক্ষ্ণ চোখে। অনেকক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে থাকল। এই বুঝি—! না কেউ নয়।

সুধাংশুর গালে মশারির একটা অংশ হাওয়ায় ফুলে এসে ঠেকতেই চমকে উঠেছিল ও। কাঠ হয়ে শুয়ে থাকল চোখ বুজে। স্পর্শটা কি গভীর হবে! অনেক— অনেকক্ষণ কেটে গেল। মনে হল না আর কোনও স্পর্শ পাওয়া সম্ভব। তবে যা ভেবেছিল ও তা না।

—মাধবী। সুধাংশু ডাকল দরজায় দাঁড়িয়ে।

—উঠেছি। ঘরের ভেতর থেকে জবাব এল মাধবীর সঙ্গে সঙ্গেই। বাতি জ্বলে উঠল। দরজা খুলে গেল। কোনও শব্দ শোনা গেল না।

সাড়ে চারটে বাজে। মাধবীর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাতে তাকাতে বললে সুধাংশু, মুখ ধুয়ে নাও—আমি একটু চা করে নিচ্ছি।

চা খেতে বসে বার বার হাই তুলছিল মাধবী।

সুধাংশু বললে, রাত্রে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি বুঝি।

—হ্যাঁ, জেগেই ছিলাম।

—ভয়ে নাকি? সুধাংশু হাসল।

—ভ-য়! মাধবী চোখ ভরে তাকাল সুধাংশুর মুখে। সুধাংশুও তাকিয়ে আছে।

—খিল তো তোমার ঘরে ছিলই! সুধাংশু হঠাৎ কেমন যেন একটু আড়ষ্ট হয়ে বললে।

—খিল! মাধবী স্পষ্ট কণ্ঠে বললে, ‘খিল তো খোলাই ছিল।’

সুধাংশু চুপ। চোখ নিচু করলে। তাকাল দেওয়ালে। দরজার দিকে। দরজাটার ওপাশে খিল ছিল না। সারারাত খোলাই ছিল।

—আমিও জেগেছিলুম সারারাত। আস্তে আস্তে বললে সুধাংশু, এ ঘরের এপাশেও খিল ছিল না।’

দু’জনাই চুপ। ফক্সটেরিয়ারটা এত সকালেও উঠে ডাক দিয়েছে।

ট্রেনের টাইম হয়ে গেছে। হঠাৎ বললে সুধাংশু।

—চলো। মাধবী উঠে পড়ল।

মোটরে উঠে দু’জনেই চুপ। দু’জনেই ভাবছিল খিল তো সারারাত খোলাই ছিল। তবে কেন?

ওরা জানত না, আজ জানল ট্রেন যখন স্টেশনে এসে গেছে এবং মাধবী উঠেছে কম্পার্টমেন্টে তখনই জানল ভেতরের খিল এতদিনে ভাল করেই লাগানো হয়ে গেছে ওদের দু’জনারই—এবং যে কোনও অছিলায় কাছে এলেও পাশাপাশি ঘরে রাত কাটালেও কেউ এসে মাঝরাতে ডাকবে না কানে কানে।

তা সত্ত্বেও সুধাংশু বাংলোয় ফিরে এসে ঘরটা ভাল করে নজর করে দেখেছে এবং সেই সাদা কাঠের খিলও।

মাধবীর কোনও চিহ্ন কোথাও যদি এক তিল পড়ে থাকত তা হলেও বুঝি ভাবা চলত মাধবী এসেছিল। কিন্তু কিছু নেই—এক বিন্দু ধুলো, একটু ভাঁজ, মাথার একটি চুলও না।

সত্যিই কি মাধবী এসেছিল? সুধাংশু ভাবল। অথবা অন্য কেউ। কিংবা কেউই নয় হয়তো।

২৬.০৯.১৯৫৪

লেখক পরিচিতি

বিমল কর : ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে টাকির কাছে এক গ্রামে জন্ম। ১৯৫২ সালে দেশ পত্রিকায় প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’। ‘ছোটগল্প— নতুন রীতি’ আন্দোলনের প্রবক্তা। কাচঘর, বালিকা বধূ, আঙুরলতা, খড়কুটো প্রভৃতি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। ১৯৬৭ এবং ১৯৯২ সালে আনন্দ পুরস্কার। ১৯৭৫-এ অকাদেমি পুরস্কার। মৃত্যু ২৬ অগস্ট ২০০৩।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *