গল্পগ্রন্থ

প্যাঁসনের প্যাঁচে প্রফেসর

প্যাঁসনের প্যাঁচে প্রফেসর
[ দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য গোল্ডেন প্যাঁসনে ]

১৮৯৪ সাল। বিচার করে দেখতে গেলে আমার মনে হয়, ইয়ক্সলে ওল্ড প্লেসের উপসংহারের মতো কোনো কেসটিতেই এতগুলি অসাধারণ পয়েন্টের একত্র সমাবেশ ঘটেনি। এই কেসেই শোচনীয়ভাবে মৃত্যুবরণ করে তরুণ উইলোবি স্মিথ। শুধু তাই নয়, এরপর যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, তা থেকেই প্রকাশ পায় খুনের কারণ। সে-তথ্য যেমন বিচিত্র তেমনই কৌতূহলোদ্দীপক।

নভেম্বরের শেষাশেষি সেরাতে প্রচণ্ড ঝড়ের তাণ্ডবে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল আকাশ-বাতাস। সন্ধে থেকেই চুপচাপ বসে ছিলাম আমি আর হোমস। অক্সফোর্ড স্ট্রিটের প্রান্ত থেকে জল ছিটিয়ে পথ করে নিচ্ছিল একটি ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়ি।

বাতাসের গোঙানির মধ্যে থেকেই ভেসে এল খটাখট খটাখট অশ্বখুরধ্বনি এবং পাথুরে রাস্তার ওপর গড়ানো চাকার একটানা কর্কশ ঘড় ঘড় শব্দ। যে-গাড়িটা আমি দেখেছিলাম দূরে, সেইটাই এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের দরজায়।

তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সরকারি গোয়েন্দা স্ট্যানলি হপকিনস। চকচকে বর্ষাতি জ্বলজ্বল করতে লাগল বাতির আলোয়। ভিজে বর্ষাতিটা খুলে ফেলতে সাহায্য করলাম আমি। হোমস চুল্লি খুঁচিয়ে গনগনে করে তুলল আগুনটাকে।

তারপর বললে, মাই ডিয়ার হপকিনস, এবার জুতো-টুতো খুলে ফেলে পায়ের আঙুলগুলো গরম করে নাও। এই নাও একটা সিগার। এ-রকম রাতে ডাক্তারের একটা প্রেসক্রিপশন আছে–গরম জলের সঙ্গে লেবুর রস। খুবই কাজ দেয় ওষুধটা এ ধরনের আবহাওয়ায়। এই ঝড়-তুফান মাথায় করে যখন এসেছ, তখন কাজটা দরকারি না হয়ে যায় না, কি বল?

বাস্তবিকই তাই মি. হোমস। সারাবিকেলটা দম ফেলবার ফুরসত পাইনি। যেকোনো দৈনিকের শেষ সংস্করণে ইয়ক্সলে কেস সম্পর্কে কিছু দেখেছেন?

পঞ্চদশ শতাব্দীর পরের কিছুই আজ আমি দেখিনি।

খুব ছোটো খবর একটা মাত্র প্যারাগ্রাফ। তাও আগাগোড়াই ভুল–কাজেই চোখ এড়ায়নি আপনার। আমিও উঠেপড়ে লেগেছি এ-ব্যাপার নিয়ে, কাজে ফাঁক রাখিনি কোথাও। ঘটনাটা ঘটেছে কেন্টে, চ্যাথাম থেকে সাত মাইল দূরে আর রেল স্টেশন থেকে তিন মাইল ভেতরে একটা জায়গায়। সওয়া তিনটেতে টেলিগ্রাম পাই আমি। পাঁচটায় পৌঁছেই ইয়ক্সলে ওল্ড প্লেসে। সরেজমিন তদন্ত শেষ করে শেষ ট্রেন ধরে ফিরে আসি শেরিং ক্রসে। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে সিধে আসছি আপনার কাছে।

তার মানে, আমার বিশ্বাস, কেসটা সম্বন্ধে তোমার ধারণা এখনও পরিষ্কার হয়নি?

ব্যাপারটার ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি আমি। দেখেশুনে তো মনে হচ্ছে, এ ধরনের বিদকুটে জটিল কেস নিয়ে কোনোদিনই আমাকে মাথা ঘামাতে হয়নি। কিন্তু আশ্চর্য কী জানেন, প্রথমে কেসটাকে দারুণ সহজ মনে হয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম, এত সোজা ব্যাপারে কেউই ভুল করতে পারে না। মি. হোমস, মোটিভের নামগন্ধ নেই এ-কেসে। কিন্তু অনেক ভেবেও তো আমি দিশে পাচ্ছি না যে লোকটার ক্ষতি করবার চেষ্টাই-বা কেউ করবে কেন?

সিগারটা ধরিয়ে নিলে হোমস। তারপর, চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললে, ব্যাপারটা শোনাও দিকি।

জলের মতোই পরিষ্কার ঘটনাগুলো,বললে স্ট্যানলি হপকিনস। এখন শুধু জানতে চাই যে এসবের আসল মানেটা কী। গল্পটা যতদূর খাড়া করতে পেরেছি, তা এই। কয়েক বছর আগে পল্লি অঞ্চলের এই বাড়িটা কেনেন এক ভদ্রলোক। বাড়িটার নাম ইয়ক্সলে ওল্ড প্লেস। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছে। বাড়ি কেনার সময়ে তার নাম বলেন, প্রফেসর কোরাম। প্রফেসর কোরাম রুগ্ণ এবং চলাফেরার ক্ষমতা প্রায় নেই বললেই চলে। অর্ধেক সময় থাকেন শয্যায়। বাকি সময়টা হয় বাড়িময় পা টেনে টেনে লাঠি ঠুক টুক করে বেড়ান, আর না হয়, বাথ-চেয়ারে বসে হাওয়া খান বাড়ির সামনের জমিতে। চেয়ারটা ঠেলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বাগানের মালী। প্রতিবেশীদের কয়েকজন খুবই পছন্দ করত তাকে এবং কয়েকবার দেখাও করে গিয়েছিল তার সঙ্গে।মস্ত পণ্ডিত হিসেবে ও-অঞ্চলে তার খুব সুনামও আছে। ঘরকন্নার কাজ দেখাশুনা করার জন্যে সংসারে আছে মিসেস মার্কার আর সুসান টার্লটন নামে এক পরিচারিকা। উনি এখানে এসে পৌঁছানোর পর থেকেই এই দুজনে রয়েছে তার সঙ্গে। দুজনের স্বভাবচরিত্র অতি চমৎকার। পাণ্ডিত্যপূর্ণ একটা গ্রন্থ লিখেছেন প্রফেসর। তাই বছরখানেক আগে তার একজন সেক্রেটারির দরকার হয়। প্রথম দুজনকে নিয়ে সুবিধে করে উঠতে পারেননি প্রফেসর। কিন্তু তৃতীয় জন আসার পর যারপরনাই খুশি হলেন উনি। মি. উইলোবি স্মিথ বয়সে একদম তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে সিধে আসে প্রফেসরের চাকরিতে।কাজকর্ম দেখিয়েদু-দিনেই কর্মকর্তার মনোমতো হয়ে উঠল সে। সারাসকাল প্রফেসরের ডিকটেশন নেওয়াই তার কাজ। রেফারেন্স আর উদ্ধৃতির জন্যে কেতাব হাতড়াতেই কেটে যেত সন্ধেটা। পরের দিন সকালে দরকার হত এইসব তথ্য। ছেলেবেলায় আপিংহ্যামে থাকার সময়ে বা যৌবনে কেম্ব্রিজে পড়বার সময়ে কোনোদিনই কোনো সময়েই প্রফেসর কোরামের সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগেনি উইলোবি স্মিথের এবং তার বিরুদ্ধে তার কোনো বিদ্বেষও নেই। আমি তার সার্টিফিকেট ইত্যাদি কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলাম, প্রথম থেকেই ভদ্র শান্তশিষ্ট এবং কঠোর পরিশ্রমী ছাত্র হিসেবে সুনাম কিনেছে সে। কোনোরকম দুর্বলতা দেখা যায়নি তার চরিত্রে। কিন্তু এত গুণ থাকা সত্ত্বেও আজ সকালে এই ছেলেটিই মারা গেছে প্রফেসরের পড়ার ঘরে—মারা গেছে এমন পরিস্থিতির মধ্যে যে যার ফলে এ-মৃত্যুকে খুন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

গোঁ গোঁ করে গজরে উঠল বাতাস–ককিয়ে কেঁদে উঠল জানলায় জানলায়। আগুনের কাছে সরে বসলাম আমি আর হোমস। আর, একটির পর একটি পয়েন্ট তুলে ধরে ধীরেসুস্থে এই অতি আশ্চর্য কাহিনি বলে চলল তরুণ ইনস্পেকটর হপকিনস।

সারাইংলন্ড তন্নতন্ন করে তল্লাশ করলেও এর চাইতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বা বাইরের প্রভাব-বিমুক্ত বাড়ি আর পাবেন না আপনি। সারাহপ্তা কেটে গেলেও অতগুলি লোকের মধ্যে একজনও বাগানের ফটক পেরোয় না। প্রফেসর তো নিজের কাজেই ড়ুবে থাকেন এবং বাইরের জগৎ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আগ্রহ রাখেন না। প্রতিবেশীদের কারো সঙ্গে আলাপ ছিল না স্মিথ ছেলেটির। কাজেই, প্রফেসরের মতোই জীবনযাপন করতে হত তাকে। কোনোমতেই বাড়ির বাইরে আনা যেত না স্ত্রীলোক দুজনকে। মালীর নাম মর্টিমার। মর্টিমারই বাথ চেয়ার ঠেলে নিয়ে বেড়ায়। আগে আর্মিতে ছিল, এখন পেনশন ভোগ করছে। মর্টিমারের বয়স হয়েছে। ক্রিমিয়া তার মাতৃভূমি এবং স্বভাব চমৎকার। বাড়ির মধ্যে সে থাকে না; থাকে বাগানের একদম শেষে তিন ঘরওয়ালা একটা কটেজে। ইয়ক্সলে ওল্ড প্লেসের চৌহদ্দির মধ্যে মানুষ বলতে শুধু এই ক-জনকেই আপনি পাবেন। আরও একটা কথা। বাগানের গেট থেকে মাত্র এক-শো গজ দুরেই আছে লন্ডন থেকে চ্যাথাম যাওয়ার প্রধান সড়কটা। ছোটো হুড়কো দিয়ে আটকানো থাকে ফটকটা। কাজেই, যেকোনো বহিরাগতই ভেতরে আসতে পারে বিনা বাধায়।

এবার শুনুন সুসান টার্লটনের সাক্ষ্য। এ-ব্যাপারে নিশ্চিত কোনো খবর যদি দিতে কেউ পারে, তবে সে এই সুসান টার্লটন। ঘটনাটা ঘটে দুপুরের আগে, এগারোটা থেকে বারোটার মধ্যে। ওপরের তলায় সামনের শোবার ঘরে–কতকগুলো পর্দা টাঙানো নিয়ে ব্যস্ত ছিল সুসান। প্রফেসর কোরাম বিছানা ছেড়ে ওঠেননি তখনও। আবহাওয়া খারাপ থাকলে কচিৎ বারোটার আগে শয্যাত্যাগ করেন উনি। বাড়ির পেছনদিকে কতকগুলো কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল মিসেস মার্কার। উইলোবি স্মিথ ছিল তার শোবার ঘরে। শোবার ঘরটাই সে বসবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করত। সুসান যে-ঘরে ছিল, পড়ার ঘরটা ঠিক তার নীচেই। ঠিক সেই মুহূর্তে সুসান শুনতে পেল প্যাসেজ বরাবর গিয়ে নীচের পড়ার ঘরে নেমে গেল স্মিথ। স্মিথকে সে দেখেনি বটে, তবে ও-রকম চটপটে জোরালো পায়ে চলার শব্দ শুনে নাকি কিছুতেই ভুল হতে পারে না তার। পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দও সে শোনেনি। তবে মিনিটখানেক পরেই একটা ভয়াবহ। চিৎকার ভেসে আসে নীচের ঘর থেকে। ভাঙা-ভাঙা কর্কশ গলায় চিৎকার এমনই বিকট, অদ্ভুত আর অস্বাভাবিক যে চেঁচানিটা পুরুষের কি স্ত্রীলোকের, তা বোঝা মুশকিল। সঙ্গেসঙ্গে শোনা যায় ধপ করে একটা গুরুভার বস্তু পতনের শব্দ–সমস্ত বাড়ি কেঁপে ওঠে তাতে। তারপরেই, সব নিস্তব্ধ। মুহূর্তের জন্য ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সুসান। পরক্ষণেই, সাহস ফিরে আসে তার। এক দৌড়ে নেমে আসে সে নীচে। পড়ার ঘরের দরজা বন্ধ ছিল–সুসানই গিয়ে তা খোলে। ঘরের ভেতরে মেঝের ওপর পড়ে ছিল তরুণ মি. উইলোবি স্মিথের দেহ। প্রথমে সুসান আঘাতের কোনো চিহ্ন দেখতে পায়নি। কিন্তু দেহটা তুলতে গিয়েই সে দেখতে পায় ঘাড়ের নীচ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে দরদর করে। সামান্য একটু চোট লাগলেও ক্ষতস্থান খুবই গভীর এবং ওই এক আঘাতেই দু-টুকরো হয়ে গেছিল ক্যারোটিড ধমনী। যে হাতিয়ারে এ-আঘাতের সৃষ্টি, তা পড়ে ছিল তার পাশেই কার্পেটের ওপর। হাতিয়ারটা গালা সিলমোহর করার একটা ছোট্ট ছুরি। পুরোনো কায়দায় সাজানো লেখবার টেবিলে এ ধরনের ছুরি হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। ছুরির হাতলটা হাতির দাঁতের এবং ফলাটা বেশ শক্ত। প্রফেসরের নিজের টেবিলেই অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে এ-ছুরিটাও ছিল।

প্রথমে সুসান ভেবেছিল, স্মিথ বুঝি মারা গেছে। কিন্তু কাচের জলপাত্র ক্যারাফে থেকে জল নিয়ে কপালে ছিটিয়ে দিতেই মুহূর্তের জন্য চোখ খুললে ও। বিড়বিড় করে বললে, প্রফেসর–সেই মেয়েটা। সুসান তত দিব্যি করে বলতে রাজি আছে যে ঠিক এই শব্দ ক-টাই উচ্চারণ করেছিল স্মিথ। প্রাণপণে আরও কিছু বলার চেষ্টা করেছিল ও ডান হাতটা শূন্যেও তুলেছিল। তারপরেই, নিস্পন্দ হয়ে যায় তার প্রাণহীন দেহ।

ইতিমধ্যে মিসেস মার্কারও পৌঁছেছিল ঘরে। কিন্তু একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় ছেলেটির অন্তিম কথা আর শুনতে পায়নি। সুসানকে মৃতদেহের পাশে রেখে ও দৌড়ে যায় প্রফেসরের ঘরে। বিছানায় উঠে বসেছিলেন উনি। নিদারুণ আতঙ্ক আর উত্তেজনার অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছিল তার মুখে। রক্ত জমানো ওই চিৎকার শুনেই বোধ হয় তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেছিল যে, ভয়াবহ একটা কিছু ঘটেছে। মিসেস মার্কারের বেশ মনে আছে, তখনও রাত্রিবাস ছিল প্রফেসরের পরনে। বাস্তবিকই, মর্টিমারের সাহায্য ছাড়া তো পোশাক পরিবর্তন করা সম্ভবও নয় তাঁর পক্ষে। মর্টিমারের ওপর আদেশ ছিল দুপুর বারোটার সময়ে আসার। প্রফেসর বলছেন, দূর থেকে ভেসে আসে একটা চিৎকার। উনি শুনেছেন বটে কিন্তু তার বেশি আর কিছুই উনি জানেন না। স্মিথ ছেলেটির শেষ কথা ক-টিরও কোনো অর্থ উনি বলতে পারলেন না। তাঁর মতে প্রফেসর সেই মেয়েটা কথাটা আসলে নিছক প্রলাপ ছাড়া আর কিছুই নয়। ওর বিশ্বাস, দুনিয়ায় কোনো শত্রু নেই উইলোবি স্মিথের এবং হত্যার কোনো কারণ দর্শানোও সম্ভব নয় তার পক্ষে। প্রথমেই উনি মালী মর্টিমারকে পাঠিয়েছিলেন স্থানীয় পুলিশ ডেকে আনতে। একটু পরেই প্রধান কনস্টেবল খবর পাঠায় আমাকে। আমি না-যাওয়া পর্যন্ত কোনো জিনিসের নড়চড় হয়নি এবং কড়া হুকুম জারি করা ছিল যেন কেউ ফটক থেকে বাড়িতে আসার পথটার ওপর চলাফেরা না-করে। মি. শার্লক হোমস, আপনার থিয়োরি কাজে লাগার এই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। কিছুরই অভাব ছিল না অকুস্থানে।

কেবল মি. শার্লক হোমস ছাড়া। তিক্ত হেসে বললে আমার বন্ধুটি। যাক, অকুস্থানে পৌঁছে কাজকর্ম কীরকম করলে তাই এবার শোনা যাক।

মি হোমস, প্রথমেই আপনাকে নকশাটা দেখতে বলি। নকশাটা মোটামটি হলেও প্রফেসরের পড়ার ঘরের অবস্থান এবং এ-কেসের অন্যান্য পয়েন্টগুলো সম্বন্ধে সাধারণ ধারণা আপনি পাবেন এ থেকে। তাতে আমার তদন্তধারা বুঝতে সুবিধে হবে আপনার।

চার্টটা ভাজ খুলে মেলে ধরল হপকিনস। নকশাটার অবিকল প্রতিলিপি দিলাম নীচে। হোমসের হাঁটুর ওপর কাগজটা বিছিয়ে দিল হপকিনস। আমি উঠে গিয়ে হোমসের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগলাম ছকটা।

নকশাটা অবশ্য খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়। যে-পয়েন্টগুলো নিতান্ত প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে আমার কাছে, শুধু সেইগুলোই ধরে রেখেছি নকশাটায়। বাকি যা কিছু, তা নিজের চোখেই পরে দেখবেনখন। আচ্ছা, প্রথম থেকেই শুরু করা যাক। যদি ধরে নিই হত্যাকারী বাইরে থেকে এসেছিল বাড়ির মধ্যে, তাহলে প্রশ্ন উঠছে কীভাবে সে ঢুকল ভেতরে? সে বলতে আমি কিন্তু পুরুষ অথবা নারী উভয়কেই বোঝাচ্ছি। নিঃসন্দেহে সে ঢুকেছে পেছনকার দরজা আর বাগানের পথ দিয়ে। কেননা, এই দিক দিয়েই সোজাসুজি আসা যায় পড়ার ঘরে। অন্য কোনো পথ দিয়ে আসা মানে জটিলতা রীতিমতো বৃদ্ধি পাওয়া–কেননা সেক্ষেত্রে অনেক ঘুরে তবে তাকে আসতে হত। খুনিকে পালাতেও হয়েছে নিশ্চয় ওই পথ দিয়ে। কেননা, ঘর থেকে বেরোবার আর দুটি পথের একটি বন্ধ করেছিল সুসান সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময়ে। আর একটি পথ তো গেছে সিধে প্রফেসরের শোবার ঘরে। কাজে কাজেই সময় নষ্ট না-করে ক্ষণাৎ আমি বাগানের পথটা নিয়ে পড়লাম। সম্প্রতি বৃষ্টি হওয়ায় জলে প্যাঁচপেচে হয়ে ছিল পথটা। সুতরাং সেখানে পায়ের ছাপ থাকা খুবই স্বাভাবিক।

পরীক্ষাশেষে দেখলাম, খুব হুঁশিয়ার আর পাকা ক্রিমিনালের সঙ্গেই কাজে নামতে হয়েছে। আমায়। পথের ওপর কোনোরকম পায়ের ছাপের চিহ্নমাত্র দেখলাম না। রাস্তার ধারে ধারে ঘাসের বর্ডারের ওপর দিয়ে যে কেউ হেঁটে গেছে, সে-বিষয়ে অবশ্য কোনোরকম সংশয় আমার নেই। পাছে পায়ের ছাপ থেকে যায়, তাই তার এত সতর্কতা। সুস্পষ্ট ছাপ বা ওই জাতীয় কিছুই আমি পাইনি। না-পেলেও মাড়িয়ে যাওয়া ঘাসগুলোর অবস্থা দেখে বুঝেছিলাম কেউ-না-কেউ হেঁটে গেছে সেখান দিয়ে। সেই যে হত্যাকারী তা বুঝলাম এই কারণে যে, বৃষ্টি হয়েছে রাতে। আর সকালে মালী বা অন্য কেউ হেঁটে যায়নি ও-পথ দিয়ে।

এক সেকেন্ড, বলে হোমস। বাগানের ও-পথটা গেছে কোথায়?

বড়োরাস্তায়।

কত লম্বা এই পথটা?

শ-খানেক গজের মতো।

পথটা যেখানে ফটকের মাঝ দিয়ে গেছে, সেখানেই তো পায়ের ছাপ পেতে?

দুর্ভাগ্যবশত পথের ঠিক ওই জায়গাটাই বাঁধিয়ে রাখা হয়েছে টালি দিয়ে।

বড়োরাস্তায়?

না। জলে কাদায় জলাভূমি তৈরি হয়ে গেছে যেখানে।

কী বিপদ! আচ্ছা, ঘাসের ওপর ছাপটা দেখে কী মনে হল? লোকটা বাড়ির দিকে আসছিল, বাড়ির বাইরে যাচ্ছিল?

তা বলা মুশকিল। পরিষ্কার ছাপ কোথাও পাইনি।

বড়ো পা না ছোটো পা?

সে-পার্থক্য আপনিও ধরতে পারবেন না।

অধীরভাবে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল হোমস। তারপর থেকেই তো মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে আর হ্যারিকেনের মতো তুমুল ঝড় বইতে শুরু হয়েছে। পার্চমেন্টের ওই পাণ্ডুলিপির চাইতেও এখন কঠিন হবে ঘাসের ওপর পায়ের ছাপের প্রভেদ বার করা। যাক, কী আর করা যায়। তারপর, হপকিনস, তুমি যে কিছুই করতে পারনি, এ-সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর কী করলে শুনি?

আমার তো মনে হয়ে নিশ্চিতভাবে অনেক কিছুই আমি করেছি মি. হোমস। বাইরে থেকে কেউ অতি সাবধানে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছে, তা আমি জেনেছি। এরপর, করিডোরটা পরীক্ষা করলাম। নারকেল দড়ির মাদূর বিছানো সেখানে এবং কোনোরকম ছাপ তার ওপর পড়েনি। এখান থেকেই এসে পড়লাম ঘরে। অল্প কয়েকটি আসবাব দিয়ে সাজানো ঘর। প্রধান সামগ্রী হল একটা মস্তবড়ো খেলবার টেবিলের সঙ্গে লাগোয়া একটা বিউরো। বিউরোর দু-পাশে দু-সারি ড্রয়ার মাঝখানে একটা ছোট্ট কাবার্ড। ড্রয়ারগুলো খোলা ছিল বটে, কিন্তু তালাচাবি দেওয়া ছিল কাবার্ডে। দেখে মনে হল ড্রয়ারগুলো সবসময়েই খোলা থাকে ওইভাবে এবং মূল্যবান কাগজপত্র রাখা হয় না সেখানে। কাবার্ডের মধ্যে কতকগুলো দরকারি কাগজপত্র আছে বটে, তার এমন কোনো চিহ্ন দেখলাম না যা থেকে অনুমান করা যায় যে, কেউ কাবার্ডটা খোলার চেষ্টা করেছিল। প্রফেসরও জানালেন যে কিছুই চুরি যায়নি। কাজেই, চুরিচামারি যে একেবারেই হয়নি, এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত।

আচ্ছা, এবার আসা যাক ছেলেটির দেহ-প্রসঙ্গে। লাশটা পাওয়া গেছিল বিউরোর কাছেই, একটু বাঁ-দিকে চার্টে যেখানে দাগ দিয়েছি, ঠিক ওই জায়গায়। ছুরি-মারা হয়েছে ঘাড়ের ডান দিকে। এবং পেছন থেকে সামনের দিকে। কাজেই, সে যে নিজেই নিজেকে ছুরি মারেনি, সে-বিষয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ থাকছে না।

ছুরির ওপরে তো পড়েও যেতে পারে, বলল হোমস।

এগজ্যাক্টলি। এ-ধারণা আমার মাথাতেও এসেছিল। কিন্তু ছুরিটাকে পড়ে থাকতে দেখলাম দেহের কাছ থেকে বেশ কয়েকফুট দূরে। সুতরাং ও-ধারণা একেবারেই অসম্ভব। তারপরেও ধরুন, ছেলেটির অন্তিম কথাটা। এবং সবশেষে রয়েছে মৃত ব্যক্তির ডান হাতের মুঠিতে পাওয়া এই অত্যন্ত দরকারি প্রমাণটা।

পকেট থেকে একটা কাগজের ছোটো প্যাকেট বার করল স্ট্যানলি হপকিনস। প্যাকেটটা খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ল একটা সোনার পাসনে চশমা। কালো সিল্কের ছেড়া সুতোটা ঝুলছিল চশমার দু-পাশ থেকে। তারপর বললে, উইলোবি স্মিথের দৃষ্টিশক্তি বরাবরই খুব ভালো। কাজেই এ-জিনিসটি যে খুনির চোখ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সে-বিষয়ে কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না।

চশমাটা নিজের হাতে তুলে নিলে শার্লক হোমস। তারপর অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে তন্ময় হয়ে পরীক্ষা করতে লাগল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নাকের ওপর লাগিয়ে কিছু পড়ার চেষ্টা করল ও। তারপর উঠে গেল জানলার কাছে, কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাস্তার দিকে। ফিরে এসে বাতির নীচে জোরালো একটা আলোয় উলটেপালটে অতি সূক্ষ্মভাবে কী যেন দেখল। সবশেষে, নিঃশব্দে একচোট হেসে নিয়ে টেবিলে বসে পড়ে একটা কাগজে খসখস করে কয়েকটা লাইন লিখে টোকা মেরে কাগজটা এগিয়ে দিলে স্ট্যানলি হপকিনসের পানে।

বললে, তোমার জন্যে এর বেশি আর কিছু করতে পারছি না আমি। কাগজটা তোমার কাজে লাগতে পারে।

কাণ্ড দেখে তাজ্জব হয়ে গেছিল গোয়েন্দাপ্রবর। এখন কাগজটা তুলে নিয়ে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলে। এই কথাগুলো লেখা ছিল কাগজটায় :

অত্যন্ত মার্জিত স্বভাবের একজন স্ত্রীলোককে আমাদের প্রয়োজন। তার বেশভূষা ভদ্রমহিলার মততা, নাক অসাধারণ রকমের মোটা এবং নাকের দু-পাশের দুই চোখ খুবই ঘেঁষাঘেঁষি। তার কপাল কুঁচকোনো, চোখ কুঁচকে তাকানোর অভ্যাস আছে এবং সম্ভবত কাঁধ দুটোও গোল। দেখা যাচ্ছে গত কয়েক মাসের মধ্যে অন্ততপক্ষে দুবার চক্ষু-পরীক্ষকের কাছে তাকে যেতে হয়েছে। যেহেতু তার চশমার লেন্সের শক্তি খুবই বেশি এবং যেহেতু চক্ষু-পরীক্ষকের সংখ্যা খুব বেশি নেই, সুতরাং তাকে খুঁজে বার করা বিশেষ কঠিন হবে না।

হপকিনসের অবাক চাহনি দেখে মুচকে হেসে ওঠে হোমস। আমারও চোখে-মুখে নিশ্চয় প্রতিফলিত হয়ে উঠেছিল গোয়েন্দাপ্রবরের বিস্ময়।

আরে খুবই সোজা আমার অনুমান-সিদ্ধান্ত, বলে হোমস। চশমা ছাড়া এমন কোনো বস্তু নেই যা থেকে এত ভূরি ভূরি অথচ নিখুঁত সিদ্ধান্ত আদায় করা যায়। এমন কোনো বস্তুর নাম করাই কঠিন হবে তোমার পক্ষে। এ-চশমাটা তো দেখছি আরও অসাধারণ। প্যাঁসনেটা যে স্ত্রীলোকের তা বুঝেছি এর হালকা আর সূক্ষ্ম গড়ন দেখে এবং বিশেষ করে, মরবার আগে স্মিথের শেষ ক-টি শব্দ থেকে। তার স্বভাব মার্জিত কিনা এবং বেশভূষা ভদ্রোচিত কিনা, তা বুঝেছি সোনার চশমা দেখে। চশমাটা নিরেট সোনার এবং সুন্দরভাবে বাঁধানো। এমন রুচিসুন্দর প্যাঁসনে যিনি চোখে লাগান, তিনি যে অন্যান্য দিক দিয়ে অপরিচ্ছন্ন হবেন, তা কল্পনাতেও আনা যায় না। চশমাটা চোখে লাগালেই দেখবে, ক্লিপটা তোমার নাকের পক্ষে খুবই চওড়া। তার মানে এই ভদ্রমহিলার নাকটি গোড়ার দিকে খুবই মোটা। এ ধরনের নাক সাধারণত ছোটো আর পুরু হয়। কিন্তু এর অনেক ব্যতিক্রম আছে বলেই বর্ণনার এ-পয়েন্ট নিয়ে জোর দিইনি অথবা আমার অনুমানই যে নির্ভুল, এমন কথাও বলিনি। আমার নিজের মুখ সরু। কিন্তু তা সত্ত্বেও নাকের ওপর চশমা লাগালে কিছুতেই দুই চোখের তারাকে কাচ দুটোর মাঝামাঝি বা তার কাছাকাছি আনতে পারছি না। সুতরাং ভদ্রমহিলার চোখ দুটি যে নাকের একদম গা ঘেঁষে তা বুঝতে দেরি হল না। ওয়াটসন, প্যাঁসনেটা হাতে নিলেই বুঝবে, কাচ দুটো কনকেভ অর্থাৎ অবতল এবং তার পাওয়ারও অস্বাভাবিক রকমের বেশি। সারাজীবন ধরে যে ভদ্রমহিলার দৃষ্টি এতখানি সংকুচিত, তার দেহতেও যে এমন চাহনির বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কী! কপাল, চোখের পাতা আর কাঁধ–এই তিন জায়গাতেই দেখা যায় কুঁচকে তাকানোর এইসব চিহ্ন।

আমি বললাম, তোমার যুক্তিতর্ক সবই বুঝলাম। কিন্তু ভাই, একটা জিনিস তো বুঝলাম না। চক্ষু-পরীক্ষকের কাছে গত কয়েক মাসের মধ্যে ভদ্রমহিলাকে দুবার যেতে হয়েছে—এ-কথাটি কী করে আবিষ্কার করলে, তা তো বোধগম্য হল না।

চশমাটা তুলে নিলে হোমস।

বললে, হাত দিলেই বুঝবে ক্লিপের ওপর খুদে খুদে শোলার ফিতে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নাকের ওপর চাপ কমানোর উদ্দেশ্যে। একটা ফিতের রং জ্বলে গেছে। ব্যবহারের ফলে একটু ক্ষয়েও গেছে। অপরদিকটা আনকোরা। কাজেই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, একটা ফিতে পড়ে যাচ্ছে, একটা ফিতে পড়ে যাওয়ার পর নতুন করে লাগানো হয়েছে এই ফিতেটাকে। পুরোনো শোলাটাকে কিন্তু লাগানো হয়েছে মাস কয়েকের মধ্যেই। দুটো ফিতে দেখতে হুবহু একরকম। তাই বললাম, একই দোকানে দু-দুবার যেতে হয়েছে ভদ্রমহিলাকে।

শাবাশ! তাক লাগিয়ে দিলেন দেখছি! প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে হপকিনস। ভাবুন তো একবার সবকটা প্রমাণ হাতের মুঠোয় নিয়েও এত খবরের ছিটেফোঁটাও জানতে পারিনি আমি। অবশ্য আমার ইচ্ছে ছিল লন্ডন শহরের সবগুলো চোখের ডাক্তারখানায় একবার করে চুঁ মেরে আসি।

তা তো করবেই। ইতিমধ্যে কেসটা সম্পর্কে আমাদের আর কিছু বলার আছে তোমায়?

আর কিছুই নেই মি. হোমস। আমার তো মনে হয়, আমি যা জানি, আপনিও তা জানেন–হয়তো বেশি জানেন। গ্রামের পথে রেলস্টেশনে কোনো আগন্তুককে দেখা গেছিল কি না এ-সম্বন্ধে খোঁজ নিয়েছিলাম। কাউকে দেখা গেছে বলে কোনো খবর এখনও শুনিনি। খুনটার পেছনে কোনো রকমের উদ্দেশ্যের নামগন্ধ নেই এবং এই না-থাকাটাই বার বার ঘুলিয়ে দিচ্ছে আমার বুদ্ধিশুদ্ধি। যা হয় একটা মোটিভের ছায়াটুকু পর্যন্ত কেউ ধরে উঠতে পারল না?

আ! এদিক দিয়ে অবশ্য তোমায় সাহায্য করতে পারব না আমি। তুমি কি চাও আমরা কালকে আসি তোমার সঙ্গে?

চাওয়াটা যদি আমার পক্ষে অতিরিক্ত না হয়, মি. হোমস, তাহলে সত্যিই খুব খুশি হই আপনি এলে।

পরের দিন পৌঁছোলাম ইয়ক্সলে ওল্ড প্লেসে। বাগানের ফটকে দেখা হল একজন কনস্টেবলের সাথে।

কিছু খবর আছে, উইলসন?

না, স্যার, কিছুই নেই।

কোনো আগন্তুককে দেখা গেছে এ-অঞ্চলে?

না, স্যার, স্টেশনের কাছে প্রত্যেকেই জোর গলায় বলছে, গতকাল কোনো অচেনা লোকই আসেনি বা যায়নি ও-পথ দিয়ে।

সরাইখানা আর হোটেলগুলোয় খোঁজ নিয়েছিলে? হ্যাঁ, স্যার। তেমন কাউকে পাওয়া যায়নি।

এখান থেকে তো হেঁটেই যাওয়া যায় চ্যাথাম। যেকোনো লোকের পক্ষেই ওখানে থাকা বা সবার অগোচরে ট্রেনে চড়া সম্ভব। মি. হোমস এই সেই বাগানের পথ। আবার আমি বলছি, গতকাল কোনো চিহ্ন এখানে ছিল না।

দাগগুলো কোন দিকের ঘাসের ওপর দেখেছিলে?

এইদিকে, স্যার। ফুলের ঝোপ আর রাস্তার মাঝে এই সরু ঘাসের বর্ডারের ওপর। দাগগুলো এখন আর দেখতে পাচ্ছি না বটে, কিন্তু গতকাল বেশ পরিষ্কার ছিল চিহ্নগুলো।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, এখান দিয়ে কেউ-না-কেউ গেছে। ঘাসের বর্ডারের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল হোমস। খুবই হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলেছেন ভদ্রমহিলা। কেননা, বেসামাল হলেই পায়ের ছাপ থেকে যেত একদিকে রাস্তার ওপর। অপর দিকে পায়ের ছাপ আরও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠত ফুলের ঝোঁপের নরম মাটির ওপর।

হ্যাঁ, স্যার, মেয়েটির মাথা খুবই ঠান্ডা।

অভিসন্ধি-লুকোনো চকিত চাহনি ভেসে যেতে দেখলাম হোমসের ওপর দিয়ে।

ভদ্রমহিলা এই পথ দিয়ে এসেছেন বলছিলে, না?

হ্যাঁ, স্যার। আর কোনো পথ ছিল না।

ঘাসের এই বর্ডারটার ওপর দিয়ে?

নিশ্চয় তাই, মি. হোমস!

হুম! কাজটা খুবই অসাধারণ হে খুবই অসাধারণ। বেশ, বেশ, আমার তো মনে হয়, পথ দেখা সাঙ্গ হয়েছে। এবার চলো, এগিয়ে যাওয়া যাক। বাগানের এই ফটকটা সাধারণত খোলা হয়, তাই না? তাহলে গটগট করে ঢুকে পড়া মেয়েটিকে আর কিছুই করতে হয়নি দেখছি। খুন করার অভিপ্রায় তার মনে ছিল না। থাকলে উপযুক্ত হাতিয়ার নিয়েই আসতেন তিনি। লেখবার টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে নিতেন না নিশ্চয়। এই করিডোর দিয়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। নারকেল দড়ির মাদুরের ওপর কোনো ছাপই রেখে যাননি। তারপরই এসে পড়লেন পড়ার ঘরে। এখানে কতক্ষণ ছিলেন তিনি? তা ধরবার কোনো উপায় আমাদের নেই।

কয়েক মিনিটের বেশি নয়, স্যার। আপনাকে বলতে ভুলে গেছিলাম, ওই কাণ্ডের একটু আগেই ঘর পরিষ্কার করার জন্যে মিসেস মার্কার এসেছিল। মিনিট পনেরো ছিল সে এ-ঘরে।

বেশ, তাহলে খানিকটা দিশে পাওয়া যায়। ভদ্রমহিলা এ-ঘরে ঢুকে পড়লেন, তারপর করলেন কী? না, এগিয়ে গেলেন লেখবার টেবিলের কাছে। কী জন্যে? ড্রয়ারে রাখা কিছুর জন্যে নয়। তার নেওয়ার মতো যদি কিছু থাকে এ-ঘরে, তবে তা তালাচাবি দিয়ে রাখাই স্বাভাবিক। না হে, না, কাঠের ওই বিউরোটার মধ্যেই ছিল কিছু। হুররে! বিউবোর সামনের দিকে এ-আঁচড়টা কীসের হে? দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়ে ধরো তো, ওয়াটসন। এ-আঁচড়ের কথা তুমি আমায় আগে বলনি কেন হপকিনস?

যে-দাগ নিয়ে তার এত অভিনিবেশ, তা শুরু হয়েছে চাবির গর্তর ডান দিকে তামার পাতের ওপর। প্রায় ইঞ্চি চারেক লম্বা আঁচড়টা কাঠের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময়ে বার্নিশটাও তুলে ফেলেছে।

আমিও ওটা দেখেছি, মি. হোমস। কিন্তু চাবির গর্তের আশপাশে এ ধরনের আঁচড় তো হামেশাই দেখা যায়।

কিন্তু এ-দাগটা যে আনকোরা–একদম নতুন। দেখছ না, কাটার জায়গায় তামাটা কীরকম চকচক করছে। আঁচড়টা পুরোনো হলেও সমস্ত তামার পাতটার যা রং, আঁচড়টার রংও হত তাই। আমার লেন্সের মধ্যে দিয়ে দেখো। পরিখার দু-পাশে যেমন মাটি জমে থাকে উঁচু হয়ে, ঠিক তেমনি জমে আছে আঁচড়টার দু-পাশে। মিসেস মার্কার আছে নাকি?

ঘরে ঢুকল একজন বিষণ্ণ বদন বৃদ্ধা।

আজ সকালে এই বিউরোর ধুলো ঝেড়েছিলে তুমি?

হ্যাঁ, স্যার।

এই আঁচড়টা লক্ষ করেছিলে?

না, স্যার করিনি।

আমারও তাই বিশ্বাস, তুমি করনি। কেননা ধুলো ঝাড়ার পর বার্নিশের এই কুচোগুলো নিশ্চয় এখানে থাকত না। এ বিউবোর চাবি কার কাছে থাকে?

সাধারণ চাবি?

না, স্যার। চাব কোম্পানির চাবি।

বেশ, বেশ। মিসেস মার্কার তুমি এবার আসতে পার। একটু এগোতে পেরেছি আমরা। ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকলেন, বিউরোর কাছে এগিয়ে গেলেন, তারপর হয় খুলে ফেললেন কাবার্ডটা, অথবা খোলবার চেষ্টা করলেন। এই নিয়ে যখন ব্যস্ত উনি, ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল উইলোবি স্মিথ। তাড়াহুড়ো করে চাবিটা বার করতে গিয়ে পাল্লার খানিকটা আঁচড়ে ফেললেন চাবি দিয়ে। উইলোবি স্মিথ চেপে ধরল তাঁকে। মরিয়া হয়ে হাতের কাছে যা পেলেন, তাই তুলে নিলেন তিনি। দুর্ভাগ্যক্রমে, হাতে উঠে এল এই ছুরিটা এবং সঙ্গেসঙ্গে তাই দিয়ে আঘাত হানলেন তিনি স্মিথের ওপর উদ্দেশ্য ছিল কোনোমতে ওর কবল থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়া। মারাত্মক সে-আঘাত। পড়ে গেল স্মিথ। আর, সটকান দিলেন ভদ্রমহিলা। যা নিতে তার আগমন, যাবার সময়ে তা নিয়েও যেতে পারেন, নাও নিয়ে যেতে পারেন। সুসান আছে নাকি? আচ্ছা সুসান, চিৎকারটা শোনার পর ওই দরজা দিয়ে কারো পক্ষে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল কি?

না, স্যার। তা অসম্ভব! সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই প্যাসেজে তাহলে কাউকে-না-কাউকে দেখতে পেতাম আমি। তা ছাড়া, দরজাটা তো একেবারেই খোলেনি। খুললে শব্দ শুনতে পেতাম।

তাহলে পলায়ন-পথ সমস্যার মীমাংসা হয়ে গেল। যে-পথে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা, সেই পথেই প্রস্থান করেছিলেন তিনি। এ-সম্বন্ধে তাহলে আর কোনো সন্দেহ রইল না। আচ্ছা এই দ্বিতীয় প্যাসেজটা প্রফেসরের ঘরে গেছে, তাই না? এদিক দিয়ে বেরোবার পথ আছে নাকি?

না, স্যার।

আমরা বরং প্রফেসরের ঘরে গিয়ে আলাপ করে আসি তার সঙ্গে। আরে, আরে, হপকিনস! দারুণ দরকারি এই পয়েন্টটা। প্রফেসরের করিডোরেও দেখছি নারকেল দড়ির মাদূর বিছোনো।

কিন্তু স্যার, তাতে হয়েছে কী?

কেসটার সঙ্গে এ ব্যাপারে কোনো সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছ না? বেশ, বেশ, এর ওপর জোর দিতে চাই না আমি। নিঃসন্দেহে, আমারই ভুল। তবুও কিন্তু পয়েন্টটা খুবই ইঙ্গিতময়। চলে এসো

আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দাও প্রফেসরের সঙ্গে।

প্যাসেজ বরাবর এগিয়ে গেলাম আমরা। বাগানের পথের দিকে যে-প্যাসেজটা গেছে, তার যা দৈর্ঘ্য, এটারও তাই। করিডোরের প্রান্তে এক সারি সিঁড়ি উঠে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা দরজার সামনে। পথপ্রদর্শক হপকিনস টোকা দিলে দরজায়। তারপর আমাদের নিয়ে ঢুকল প্রফেসরের শোবার ঘরে।

ঘরটা বেজায় বড়ো। চারিদিকে অগণিত কেতাবের সারি। শেলফ উপচে বইয়ের পাহাড় জমে উঠেছে ঘরের কোণে কোণে এবং আলমারিগুলোর পায়ার কাছে মেঝের ওপর। বিছানাটা ঘরের ঠিক মাঝখানে। চারিদিকে বালিশ সাজিয়ে তার ওপর ভর দিয়ে বসে ছিলেন বাড়ির মালিক। এ-রকম ধরনের অসাধারণ চেহারার লোক আমি কদাচিৎ দেখেছি। হাড়সর্বস্ব রোগা মুখ, টিয়াপাখির মতো বাঁকানো নাক। গুচ্ছ গুচ্ছ ঝোঁপের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসা ভুরুর নীচে গভীর গহ্বরের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল একজোড়া কুচকুচে কালো চোখ। অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে আমাদের পানে তাকিয়ে ছিলেন প্রফেসর। ভদ্রলোকের চুল দাড়ি সবই ধবধবে সাদা। কিন্তু মুখের চারপাশের দাড়িতে হলদে রঙের ছোপ লেগেছিল অদ্ভুতভাবে! সাদা চুলের ঝোঁপের মধ্যে জ্বলছিল একটা সিগারেটের আগুন। বাসি তামাকের ধোঁয়ার দুর্গন্ধ ভাসছিল ঘরের বাতাসে। হোমসের পানে ভদ্রলোককে হাত বাড়িয়ে দিতে দেখলাম, নিকোটিনের হলদে রঙের ছোপ তার হাতেও লেগেছে।

ধূমপান করেন, মি. হোমস? বাছাই করা ইংলিশ বলেন প্রফেসর, কিন্তু উচ্চারণটা অদ্ভুত।

হোমস একটা সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে মসৃণ দৃষ্টি-শর নিক্ষেপ করে চলেছিল ঘরের সব কিছুর ওপর।

তামাক আর আমার কাজ, কিন্তু এখন শুধু তামাক, উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন বৃদ্ধ। খাসা ছেলেটি! আরে মশাই, আর কয়েক মাস ট্রেনিং দিলেই চমৎকার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে উঠতে পারত সে! কেসটা সম্বন্ধে আপনার কী মনে হয় মি. হোমস?

এখনও মনস্থির করে উঠতে পারিনি।

আমরা তো প্রত্যেকে এখনও অন্ধকারে রয়েছি। এ-অন্ধকারের মধ্যে যদি কিছু আলো নিক্ষেপ করতে পারেন, তাহলে বাস্তবিকই কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।

বৃদ্ধ প্রফেসরের কথা শুনতে শুনতে ঘরের একদিকে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত ক্রমাগত পায়চারি করছিল হোমস। লক্ষ করলাম, অসাধারণ দ্রুতবেগে ধূমপান করে চলেছে ও। দেখেই বোঝা যায়, আলেকজান্দ্রিয়ান সিগারেটের প্রতি গৃহস্বামীর অনুরাগে ভাগ বসাচ্ছে হোমস নিজেও।

বৃদ্ধ বললেন, এমনিতেই আমি রুগণ, স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল, তার ওপর আমার অ্যাসিস্ট্যান্টকেও সরিয়ে নেওয়া হল কাছ থেকে। কাজেই জানি না এত কাজ আমি সমাপ্ত করতে পারব কি না। আরে, মি. হোমস! আপনি তো দেখছি আমার চাইতেও তাড়াতাড়ি ধূমপান করেন।

মৃদু হাসল হোমস।

এ-বিষয়ে আমি বিজ্ঞ পরীক্ষক, বলতে বলতে সে আর একটি সিগারেট তুলে নিল বাক্স থেকে–এই তার চতুর্থ তার সদ্য-শেষ-হওয়া সিগারেটের অংশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে বললে, সুদীর্ঘ সওয়াল-জবাবের ঝামেলায় ফেলে আপনাকে আর বিব্রত করব না, প্রফেসর কোরাম। কেননা, আমি আগেই শুনেছি খুনের সময় আপনি শয্যায় ছিলেন এবং এ-সম্পর্কে কিছুই জানেন না। শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করব আপনাকে। বেচারা ছেলেটি মরবার সময় বলে গেছিল, প্রফেসর সেই মেয়েটা–এ-সম্বন্ধে আপনি কিছু ভেবেছেন কি?

মাথা নাড়লেন প্রফেসর।

বললেন, সুসান পল্লি-অঞ্চলের মেয়ে। এ-শ্রেণির মেয়েদের অবিশ্বাস্য রকমের নির্বুদ্ধিতার কথা তো আপনার জানা নয়। আমার মনে হয়, অন্তিম সময়ে বেচারা স্মিথ প্রলাপের ঘোরে বিড়বিড় করে অবোধ্য অস্পষ্ট কিছু বলে গেছে আর এই মেয়েটা তাকেই সাজিয়ে-গুছিয়ে

একটা অর্থহীন খবর তৈরি করে নিয়েছে।

বটে। ট্র্যাজেড়িটা সম্বন্ধে আপনার নিজের কোনো ব্যাখ্যা?

খুব সম্ভব দুর্ঘটনা। সম্ভবত শুধু নিজেদের মধ্যেই বলতে সাহস পাচ্ছি–আত্মহত্যা। অনেকরকম লুকোনো কষ্ট থাকে তো তরুণদের মনে, হৃদয়সম্পর্কিত অনেক ব্যাপার, কোনোদিনই সেসব আমরা জানতে পারিনি। খুনের চাইতে বরং এ-ধারণাটার খানিকটা মানে আছে।

কিন্তু প্যাঁসনে চশমাটা?

আ! নেহাতই ছাত্র আমি শুধু স্বপ্নই দেখি। বাস্তব জীবনের সমস্যা ব্যাখ্যা করার মতো যোগ্যতা আমার নেই। কিন্তু তবুও, মাই ফ্রেন্ড, আমরা জানি, ভালোবাসার পরিণতি মাঝে মাঝে বড়ো বিচিত্র আকার ধারণ করে। সে যাই হোক, আর একটা সিগারেট নিন। এ-জিনিস এ-রকম সমাদর পাচ্ছে দেখলেও আনন্দ। হাতপাখা, দস্তানা, চশমা–জীবনদীপ নিভিয়ে দেওয়ার সময়ে প্রতীক হিসেবে বা সম্পদ হিসেবে কে যে কোন জিনিসটা নিয়ে যাবে, তা কি কেউ বলতে পারে? এই ভদ্রলোক ঘাসের ওপর পায়ের ছাপের কথা বলছিলেন। কিন্তু যাই বলুন, ও-বিষয়ে ভুল হওয়াটাই খুব সহজ! আর ছুরিটা? পড়ে যাওয়ার সময়ে অনায়াসেই তা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে হতভাগা স্মিথ। খুব সম্ভব, ছেলেমানুষের মতো কথা বলছি আমি। কিন্তু আমার মতে নিজের হাতেই নিয়তির বিধান মেনে নিয়েছে উইলোবি স্মিথ।

থিয়োরিটা হোমসের মনে ধরেছে মনে হল। সিগারেটের পর সিগারেট ধ্বংস করে চিন্তামগ্ন মুখে তন্ময় হয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঘরের এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত পায়চারি করতে লাগল ও।

তারপর বললে, প্রফেসর কোরাম, বিউরোর মধ্যে কাবার্ডে কী ছিল বলুন তো?

চোরের উপকারে আসার মতো কিছু ছিল না। পারিবারিক কাগজপত্র, স্ত্রীর চিঠি, ইউনিভার্সিটির দেওয়া সম্মানপত্র, ডিপ্লোমার গাদা–এইসব। এই নিন চাবি। নিজেই দেখে আসুন।

চাবিটা তুলে নিয়ে মুহূর্তের জন্যে একবার দেখে নিলে হোমস। তারপরেই ফেরত দিয়ে দিলে প্রফেসরের হাতে।

না। বিউরো ঘেঁটে কিছু কাজ হবে বলে মনে হয় না আমার। আমি বরং বাগানে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ধীরেসুস্থে ভেবে দেখি সমস্ত ব্যাপারটা। আপনার ওই আত্মহত্যা-থিয়োরি নিয়ে কিছু বলা দরকার। অনেক উৎপাত করে গেলাম, ক্ষমা করবেন, প্রফেসর কোরাম। লাঞ্চের আগে আর বিরক্ত করব না আপনাকে। ঠিক দুটোর সময়ে আবার আসব আমি। ইতিমধ্যে যদি কিছু ঘটে তো রিপোর্ট দিয়ে যাব।

আশ্চর্যরকম অন্যমনস্ক দেখলাম হোমসকে। বেশ কিছুক্ষণ নীরবে আমরা পায়চারি করতে লাগলাম বাগানের পথের এ-মোড় থেকে ও-মোড় পর্যন্ত।

অবশেষে আমি শুধাই, সূত্র পেয়েছ নাকি?

তা নির্ভর করছে আমি যে-সিগারেটগুলো খেয়ে এলাম তার ওপর। এমনও হতে পারে যে আগাগোড়াই ভুল করছি আমি। ওই সিগারেটগুলোই আমায় তা দেখিয়ে দেবে।

বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠি আমি, মাই ডিয়ার হোমস, তুমি জানছ কী করে যে—

বেশ, বেশ, নিজের চোখেই দেখবে সব। না হলে, কোনো ক্ষতি নেই। চোখের ডাক্তারের কু তো হাতেই রয়েছে, ফিরে এসে তাই নিয়ে কাজ চালানো যাবেখন। কিন্তু সোজা পথ যখন দেখতে পেয়েছি, তখন তার সুযোগ আমি নেবই। এই যে মিসেস মার্কার! চলো হে, মিনিট পাঁচেক কথাবার্তা বলে খবরটবর কিছু জানা যাক ওর কাছ থেকে।

এর আগে আমি হয়তো বলে থাকতে পারি যে ইচ্ছে করলে, আশ্চর্য উপায়ে মেয়েদের চিত্ত জয় করতে পারত হোমস এবং অনায়াসে অতি অল্পসময়ের মধ্যে তাদের আস্থাভাজন হয়ে উঠত সে। এক্ষেত্রেও, পাঁচ মিনিট বললেও দেখলাম তার অর্ধেক সময়ের মধ্যে মিসেস মার্কারের বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠেছে ও এবং এমনভাবে গল্প করতে শুরু করে দিয়েছে যেন কত বছর ধরেই তার সঙ্গে পরিচয় হোমসের।

হ্যাঁ, মি. হোমস, আপনি যা বললেন, তা সত্যি। দারুণ সিগারেট খান উনি। সারাদিন তো বটেই। এমনকী কখনো কখনো রাত্রেও। একদিন সকালে ওঁর ঘরটা আমি দেখেছিলাম, স্যার। কী বলব, দেখলে পরে আপনার মনে হত যেন লন্ডনের কুয়াশা দেখছেন। বেচারি মি. স্মিথও সিগারেট খেতেন। তবে প্রফেসরের মতো একটা খারাপ স্মোকার ছিলেন না উনি। ওঁর স্বাস্থ্য–এত সিগারেট খেয়ে জানি না ওঁর স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে কি অবনতি হয়েছে।

আ! বলে হোমস। কিন্তু এতে খিদে নষ্ট হয়ে যায় যে।

তা হবে, আমি অবশ্য কিছু বুঝি না, স্যার।

আমার তো মনে হয়, খাওয়ার সময়ে নামমাত্র খান প্রফেসর, তাই নয় কি?

ঠিক নেই, কখনো বেশি, কখনো কম। ওঁর হয়েই বলছি আমি।

আমি বাজি ফেলে বলতে পারি, আজ সকালে ব্রেকফার্স্ট খাননি উনি! তা ছাড়া, যে পরিমাণে সিগারেট খেতে দেখলাম, ওর পরে লাঞ্চও ছোঁবেন না।

উঁহু, সবই ভুল বললেন, স্যার। আজ সকালেই তো আশ্চর্যরকমের বেশি ব্রেকফার্স্ট খেয়েছেন উনি। এ-রকম খাওয়া খেতে আগে তাঁকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। লাঞ্চের জন্যে একটা পুরো ডিশ ভরতি কাটলেটের অর্ডারও দিয়েছেন উনি। আমি তো নিজেই অবাক হয়ে গেছি ওঁর খাওয়া দেখে। গতকাল এ-ঘরে এসে মেঝের ওপর মি. স্মিথের দেহ দেখার পর থেকে খাবারের দিকে তাকাতেও পারছি না আমি। যাকগে, সবরকম মিশিয়েই তো এই সংসার। তাই বুঝি এত কাণ্ডের পরেও খিদে মরতে দেননি প্রফেসর।

সারাসকালটা বাগানে হাওয়া খেয়েই কাটিয়ে দিলাম। স্ট্যানলি হপকিনস গ্রামে গেছিল। আগের দিন সকালে চ্যাথাম রোডে একজন অজ্ঞাত স্ত্রীলোককে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে দেখেছিল–এমনি একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ায় খোঁজ করতে গেছিল ও। আর, আমার বন্ধুটিকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তার সমস্ত উৎসাহ উদ্দীপনাই এক ফুৎকারে মিলিয়ে গেছে শূন্যে। এ-রকমভাবে মনমরা হয়ে কোনো কেস নাড়াচাড়া করতে ওকে আমি দেখিনি। এমনকী হপকিনস এসে যখন খবর দিলে যে, হোমসের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় এমনি একজন চশমাপরা বা প্যাঁসনে চোখে স্ত্রীলোককে আগের দিন সকালে বাচ্চারা সত্যি সত্যিই দেখেছে চ্যাথাম রোডে তখনও তার মনে কোনোরকম নিবিড় আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে বলে মনে হল না। বরং তার অধিকতর মনোযোগ দেখা গেল সুসানের আনা খবরে। লাঞ্চের সময়ে সুসানই পরিবেশন করছিল আমাদের। নিজে থেকেই খবরটা দিল সে। গতকাল মি. স্মিথ বোধ হয় বেরিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্যে। খুন হওয়ার আধ ঘন্টাটাক আগে ফিরে আসে সে। এ-খবরের সঙ্গে আসল ঘটনার কী সম্পর্ক, তা আমি বুঝতে পারলাম না। কিন্তু বেশ বুঝলাম আগে থেকেই মস্তিকের মধ্যে গড়ে নেওয়া অসাধারণ ছকের মধ্যে এ-খবরটাকেও বেমালুম জোড়া লাগিয়ে দিলে হোমস। হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বাড়ির দিকে তাকালে ও জেন্টলমেন, দুটো বাজে। এবার ওপরে গিয়ে আমাদের প্রফেসর বন্ধুর সঙ্গে বসে এ-ব্যাপারটার ফয়সালা করে ফেলা যাক।

সবে লাঞ্চ শেষ করেছিলেন বৃদ্ধ প্রফেসর। খালি ডিশগুলো দেখেই বুঝলাম মিসেস মার্কার তার চমৎকার ক্ষুধা সম্পর্কে যে-মন্তব্য করেছিলেন তা সত্য। ধবধবে সাদা কেশর দুলিয়ে ঝকঝকে চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি আমাদের ওপর রাখতেই তাকে দেখে মনে হল যেন বাস্তবিকই কোনো ঐন্দ্রজালিকের মূর্তি দেখছি। চিরন্তন সিগারেটটা তখনও ধূমোদগিরণ করছিল তাঁর মুখে। পোশাক পরিবর্তন করে আগুনের পাশে হাতলওয়ালা একটা চেয়ারে বসে ছিলেন উনি।

তারপর, মি. হোমস, রহস্যের সমাধান করতে পারলেন? বলে পাশের টেবিলে রাখা সিগারেটের মস্ত বড়ো টিনটা এগিয়ে দিলেন হোমসের পানে। সঙ্গেসঙ্গে হাত বাড়িয়ে দিলে হোমস এবং হাতে ঠোকাঠুকি লেগে টেবিলের কিনারায় উলটে গেল বাক্সটা।মিনিটখানেককি দুয়েকের জন্য প্রত্যেকেই হামাগুড়ি দিতে লাগলাম কার্পেটের ওপর এবং ছড়ানো সিগারেটগুলো উদ্ধার করে আনতে লাগলাম অসম্ভব সব কোণ থেকে। উঠে দেখলাম চকচক করছে হোমসের দুই চোখ এবং রঙের ছোঁয়া লেগেছে গালে। একমাত্র সংকটকালেই উড়তে দেখেছি লড়াইয়ের এসব নিশানদিহি।

হ্যাঁ, বললে হোমস। এ-রহস্যের মর্মোদ্ঘাটন করেছি আমি।

সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আমি আর স্ট্যানলি হপকিনস। জিঘাংসা নিষ্ঠুর দাঁতখিচুনির মতোই একটা ছায়া দুলে উঠল বৃদ্ধ প্রফেসরের রুণ মুখের রেখায় রেখায়।

সত্যি! বাগানের মধ্যে নাকি?

না, এখানে।

এখানে! কখন?

এই মুহূর্তে।

নিশ্চয় তামাশা করছেন, মি. শার্লক হোমস। বলতে বাধ্য করলেন আমায় এতখানি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে এভাবে কথা বলা শোভা পায় না।

আমার যুক্তি-শৃঙ্খলের প্রতিটি অংশ আমি নিজে জোড়া লাগিয়েছি এবং প্রতিটি জোড় আমি পরখ করে দেখেছি। প্রফেসর কোরাম, আমার হিসেব নির্ভুল। আপনার মোটিভ কী, অথবা এই। অদ্ভুত ব্যাপারে কী কী চরিত্রে আপনি অভিনয় করেছেন, তা এখনও বলতে পারছি না আমি। খুব সম্ভব মিনিট কয়েকের মধ্যে আপনার মুখেই তা শুনতে পাব। ইতিমধ্যে অতীতের ঘটনাগুলোই জোড়াতালি দিয়ে খাড়া করছি আপনার সামনে এবং করছি আপনারই ভালোর জন্যে। সব শোনার পর ধরতে পারবেন কোন কোন তথ্যগুলো এখনও আমার দরকার।

গতকাল আপনার পড়ার ঘরে প্রবেশ করেছিলেন এক ভদ্রমহিলা। আপনার বিউরোতে রাখা বিশেষ কতকগুলো দলিল দস্তাবেজ হস্তগত করার অভিপ্রায় নিয়েই এসেছিলেন তিনি। সঙ্গে এনেছিলেন তার নিজের চাবি। আপনার চাবি পরীক্ষা করে দেখলাম বার্নিশের ওপর আঁচড় কাটার যে সামান্য বিবর্ণতা ফুটে ওঠা উচিত, আপনার চাবিতে তা নেই। কাজেই, এ-কাজে আপনি কোনো সাহায্য করেননি। প্রমাণ যা পাচ্ছি, দেখে বুঝছি উনি এসেছিলেন আপনার অজ্ঞাতসারে আপনার কোনো জিনিস সরিয়ে নিয়ে যেতে।

ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার মেঘ ছাড়লেন প্রফেসর।

বললেন, ভারি ইন্টারেস্টিং আর শিক্ষামূলক তো! আর কিছু বলার নেই আপনার? ভদ্রমহিলার অস্তিত্ব যখন আবিষ্কার করেছেন, তখন তিনি গেলেন কোথায়, তাও নিশ্চয় বলতে পারবেন?

চেষ্টা করব। প্রথমেই বলি আপনার সেক্রেটারি তাকে পাকড়াও করে। করতেই উনি তার কবলমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ছুরি মারেন তাকে। এ-বিপর্যয়কে একটা শোচনীয় দুর্ঘটনা ছাড়া আর কিছু বলতে রাজি নই আমি। কেননা, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-রকম মারাত্মক চোট দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে ছুরি চালাননি ভদ্রমহিলা। গুপ্তহত্যা যে করতে আসে, সে কখনো নিরস্ত্র হয়ে আসে না। খুনখারাপি দেখেই দারুণ আতঙ্কে অভিভূত হয়ে পড়েন উনি। ক্ষিপ্তের মতো এই শোচনীয় দৃশ্যস্থল ছেড়ে তিরবেগে বেরিয়ে যান বাইরে। দুর্ভাগ্যবশত ঝটাপটি করার সময়ে ওঁর পাঁসনেটা খোয়া যায়। দৃষ্টিশক্তি তার অতি ক্ষীণ এবং দূরের জিনিস একেবারেই দেখতে পান না বললেই চলে। কাজেই চশমা হারিয়ে সত্যি সত্যিই অসহায় হয়ে পড়েন ভদ্রমহিলা। করিডোর দিয়ে দৌড়োতে লাগলেন উনি। ভেবেছিলেন, এই পথ দিয়েই ঘরে ঢুকেছিলেন আসবার সময়ে। একইরকম দেখতে নারকেল দড়ির মাদূর বিছানো ছিল দুটো করিডোরেই। যখন বুঝলেন যে ভুলপথে এসেছেন, তখন খুবই দেরি হয়ে গেছে এবং পিছিয়ে যাওয়ার পথও বন্ধ। এ-রকম পরিস্থিতিতে কী করা উচিত তার? যে-পথে এসেছিলেন, সে-পথে যাওয়া সম্ভব ছিল না। যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। এগিয়ে যেতে হবে–যা-ই থাকুক সামনে। এগিয়ে গেলেন উনি! কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে একটা দরজা ঠেলে খুলে ফেলতেই এসে পড়লেন আপনার ঘরে।

হাঁ করে বিস্ফারিত চোখে বিহুলভাবে হোমসের পানে তাকিয়ে ছিলেন বৃদ্ধ প্রফেসর। বিস্ময় আর ভয় যেন পাশাপাশি কেটে বসে গেছিল তাঁর ভাবব্যঞ্জক মুখের রেখায়। হোমসের কথা ফুরোতেই জোর করে দুই কাঁধ ঝুঁকিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়লেন উনি।

চমৎকার মি. হোমস, আগাগোড়া সুন্দর বলে গেলেন। কিন্তু আপনার এই অতি আশ্চর্য থিয়োরিতে ছোট্ট একটা কাটা থেকে গেছে। আমি নিজে হাজির ছিলাম এ-ঘরে। সারাদিনের মধ্যে একবারও বাইরে যাইনি।

আমার তা অজানা নয়, প্রফেসর কোরাম।

তাই বুঝি আপনি বলতে চান যে বিছানায় শুয়ে থেকেও ঘরে একটা স্ত্রীলোক ঢুকেছিল কি , আমি জানতে পারিনি?

আমি কখনো তা বলিনি। আপনি জানতেন, তিনি ঘরে ঢুকেছেন। তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তাকে চিনতে পেরেছিলেন। তাকে গা-ঢাকা দিতে সাহায্য করেছিলেন।

আবার উচ্চ-গ্রামে অট্টহাস্য করে উঠলেন প্রফেসর। শয্যা ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠেছিলেন উনি। অঙ্গারের মতো জ্বলছিল তাঁর দু-চোখ।

আপনি উন্মাদ। চিৎকার করে ওঠেন তিনি, বিকৃতমস্তিস্ক লোকের মতো কথা বলছেন আপনি। আমি তাকে পালাতে সাহায্য করেছি? কোথায় তিনি?

ওইখানে, বলে ঘরের কোণে একটা উঁচু বুককেসের দিকে আঙুল তুলে দেখালে হোমস।

ভয়াবহ একটা আকুঞ্চন ভেসে গেল প্রফেসরের ভয়ংকর মুখের ওপর দিয়ে। দুই হাত শূন্যে ছুঁড়ে ধপ করে উনি বসে পড়লেন চেয়ারে। ঠিক সেই মুহূর্তে বোঁ করে একটা কবজার ওপর ঘুরে গেল বুককেসটা এবং তিরবেগে ঘরে ঢুকে পড়লেন একজন স্ত্রীলোক।

আপনি ঠিক বলেছেন। অদ্ভুত বিদেশি গলায় চিৎকার করে উঠলেন ভদ্রমহিলা। আপনি ঠিক বলেছেন! এই যে আমি।

ধুলোয় বাদামি হয়ে উঠেছিলেন উনি। গোপন-স্থানের দেওয়ালের মাকড়সার জালে আচ্ছন্ন হয়ে গেছিল আপাদমস্তক। কালিঝুলির ছাপ তার মুখেও লেগেছিল। কোনোমতেই সুশ্রী বলা চলে না তাকে। হোমস যে রকমটি বর্ণনা দিয়েছিল তার চেহারার, হুবহু সেসব বৈশিষ্ট্য দেখলাম তার দেহে-চোখে-মুখে। বাড়তির মধ্যে ছিল আরও একটি বৈশিষ্ট্য—দীর্ঘ আর জেদি থুতনি। খানিকটা স্বাভাবিক প্রায়-অন্ধতার জন্যে আর খানিকটা অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে আসার জন্যে চোখ মিটমিট করে আশেপাশে তাকাচ্ছিলেন উনি। দেখতে চেষ্টা করছিলেন, আমরা কে এবং কোথায় রয়েছি। এসব অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও কিন্তু একটা বনেদিয়ানার ছাপ ফুটে উঠেছিল ভদ্রমহিলার চেহারায়, উদ্ধত চিবুকের সাহসিকতায় আর উন্নত শিরে। দেখলেই সমবোধ জাগে। যেন বাধ্য করে শ্রদ্ধা আর প্রশংসা জানাতে। স্ট্যানলি হপকিনস তার বাহুর ওপর হাত রেখে বন্দি হিসেবে দাবি করল তাকে। কিন্তু আলতোভাবে ওকে সরিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা। এমন কর্তৃত্বব্যঞ্জক মর্যাদার সঙ্গে সরিয়ে দিলেন যে অবাধ্য হতে সাহস করল না হপকিনস। চেয়ারে এলিয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধ প্রফেসর। দারুণ আক্ষেপে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছিল, আকুঞ্চিত হয়ে উঠছিল তার মুখের প্রতিটি মাংসপেশি। উদবিগ্ন চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন উনি ভদ্রমহিলার পানে।

হ্যাঁ, স্যার, আমি আপনার বন্দি, বললেন ভদ্রমহিলা। ঘূপসির মধ্যে থেকে সব শুনেছি। আপনারা যা জেনেছেন, তা সত্য। সব স্বীকার করছি আমি। আমিই মেরে ফেলেছি যুবকটিকে। কিন্তু আপনাদের মধ্যে যিনি বললেন, এ-হত্যা নিছক দুর্ঘটনা, তাঁর ভুল হয়নি। আমি জানতামও না, যে-জিনিসটা বাগিয়ে ধরেছিলাম আমি তা একটা ছুরি, মরিয়া হয়ে টেবিলের উপর থেকে যা হয় একটা তুলে নিয়ে ছেলেটিকে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেয়েছিলাম আমি। যা বললাম, তা সত্যি।

হোমস বললে, ম্যাডাম, জানি আপনি সত্যি কথাই বলেছেন। আপনাকে কিন্তু মোটেই সুস্থ বলে মনে হচ্ছে না আমার।

বীভৎস হয়ে উঠেছিল ভদ্রমহিলার মুখের রং। মুখের কালো ধুলোর স্তরের চেয়েও ভয়াবহ

সে-বর্ণ। শয্যার একপাশে বসে পড়ে বলে চললেন উনি।

বেশিক্ষণ এখানে আমি থাকছি না। কিন্তু পুরো সত্যটা আপনাদের জানাতে চাই আমি। আমি এই লোকটার স্ত্রী। এ কিন্তু ইংরেজ নয়। রাশিয়ান। ওর নাম আমি বলব না।

এই প্রথম নড়ে উঠলেন বৃদ্ধ। ভগবান তোমার ভালো করবেন, আন। ভগবান তোমার ভালো করবেন!

দুই চোখে গভীর অবজ্ঞা নিয়ে প্রফেসরের পানে তাকালেন ভদ্রমহিলা।সারজিয়াস, তোমার এই জঘন্য ঘৃণিত জীবনটাকে কেন এমনভাবে আঁকড়ে ধরতে চাও বল তো? এ-জীবনে ক্ষতি করেছ অনেকের, কিন্তু ভালো করনি কারোরই–এমনকী তোমার নিজেরও নয়। যাই হোক, বিধাতার নির্ধারিত সময়ের আগে তোমার ওই অপলকা জীবনসূত্র ছিঁড়ে দেওয়ার কারণ হতে চাই না আমি। অভিশপ্ত এই বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর পর থেকে যথেষ্ট নির্যাতন গেছে আমার আত্মার ওপর। কিন্তু তবুও আমায় সব বলতে হবে, তা না হলে দেরি হয়ে যাবে খুবই।

জেন্টলমেন, আমি তো বললামই, এ-লোকটার স্ত্রী আমি। ওর বয়স তখনও পঞ্চাশ। আর আমি ছিলাম কুড়ি বছরের একটা মূখ মেয়ে। তখনই বিয়ে হয় আমাদের। রাশিয়ার একটা শহরে, একটা ইউনিভার্সিটিতে জায়গাটার নাম আমি বলব না।

ঈশ্বর তোমর মঙ্গল করুন, অ্যানা! আবার বিড়বিড় করে ওঠেন বৃদ্ধ।

আমরা ছিলাম সংস্কারক–বিপ্লবী–নিহিলিস্ট। ও ছিল, আমি ছিলাম, আরও অনেকে ছিল। তারপর একটা সময় এল যখন আমরা প্রত্যেকেই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম। একজন পুলিশ অফিসার খুন হয়েছিল। গ্রেপ্তার হল অনেকে। সাক্ষীসাবুদের দরকার হয়ে পড়ল। তখনই নিজের নিজের জীবন বাঁচানোর জন্যে এবং বিস্তর পুরস্কারের লোভে আমার স্বামী তার নিজের স্ত্রী এবং সঙ্গীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে। হ্যাঁ, ওরই স্বীকারোক্তির পর আমরা সবাই গ্রেপ্তার হলাম। কয়েকজন উঠল ফাঁসিকাঠের মঞ্চে, আর কয়েকজন গেল সাইবেরিয়ায়। শেষের দলে আমি ছিলাম। কিন্তু যাবজ্জীবন মেয়াদ ছিল না আমার। ননাংরা পথে পাওয়া সমস্ত অর্থ নিয়ে ইংলন্ডে চলে এল আমার স্বামী। সেই থেকেই পরম শান্তিতে এখানে আছে সে। ও অবশ্য ভালো করে জানে, যেদিন ব্রাদারহুড জানতে পারবে তার ঠিকানা, সেদিন থেকে সাতটা দিনও যাবে না ন্যায়বিচারের দণ্ড ওর শিরে নেমে আসতে।

কাঁপা হাত বাড়িয়ে কোনোমতে একটা সিগারেট তুলে নিলেন বৃদ্ধ। বললেন, আমি তোমার হাতের মুঠোয়, অ্যানা। আর, চিরকালই আমার ভালো বই খারাপ করনি তুমি।

এখনও কিন্তু ওর শয়তানির চূড়ান্ত দিকটা আপনাদের আমি বলিনি! অর্ডারের কমরেডদের মধ্যে একজন ছিল আমার প্রাণের বন্ধু! মহান, নিঃস্বার্থ আর প্রেমময় তার চরিত্র–এর কোনোটিই কিন্তু অ্যানার স্বামীর নেই। জোরজবরদস্তি জুলুমবাজিকে ঘৃণা করত সে, ভালোবাসত অহিংসাকে। অপরাধী ছিলাম আমরা প্রত্যেকেই অবশ্য যদি একে অপরাধ বলা যায় কিন্তু সে নয়। এ-পথ থেকে ফেরানোর জন্যে চিঠি লিখত সে আমায়। এই চিঠিগুলোেই বাঁচাতে পারত ওকে। আর পারত আমার ডায়েরিটা। তার প্রতি আমার মনোভাব, আমার আবেগ অনুভূতি প্রতিদিন লিখে রাখতাম এই ডায়েরিতে। আর লিখতাম আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মতামত। ডায়েরি আর চিঠির তাড়া–দুটোই খুঁজে বার করে নিজের কাছে রেখে দেয় আমার পতিদেবতা। শুধু রেখে দেওয়া নয়, একদম লুকিয়ে ফেলে এই দুটি জিনিস এবং আপ্রাণ চেষ্টা করে ওই যুবাপুরুষটির জীবনদীপ নিভিয়ে দিতে। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় সে। প্রাণে বেঁচে গেলেও মুক্তি পেল না অ্যালেক্সিস। তাকে পাঠানো হল সাইবেরিয়ায়। সেইখানেই এখনও, এই মুহূর্তে, সে কাজ করে চলেছে একটা নুনের খনিতে। ভাববা দিকি তার অবস্থাটা, শয়তান কোথাকার! এখন, এই মুহূর্তে–যার নাম উচ্চারণ করার যোগ্যতাও তোমার নেই, সেই অ্যালেক্সিস ক্রীতদাসের মতো গতর খাঁটিয়ে কোনোরকমে রয়েছে বেঁচে। আর তবুও কিনা তোমার জীবন আমার হাতের মুঠোয় থাকা সত্ত্বেও তোমায় রেহাই দিচ্ছি আমি!

সিগারেটে টান মেরে বললেন বৃদ্ধ, তুমি তো চিরকালই এমনই মহীয়সী, অ্যানা।

উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ভদ্রমহিলা! কিন্তু পরক্ষণেই যাতনাকরুণ ছোট্ট চিকার জেগে ওঠে ওর কণ্ঠে ধপ করে আবার বসে পড়েন শয্যায়।

বলেন, শেষ আমায় করতেই হবে। আমার মেয়াদ ফুরোলে উঠে পড়ে লাগলাম ডায়েরি আর চিঠিগুলো উদ্ধারের কাজে। রাশিয়ান গভর্নমেন্টের কাছে এ দুটো জিনিস পাঠালেই হল, তাহলেই খালাস পাবে আমার বন্ধুটি। আমার স্বামী যে ইংলন্ডে এসেছে, তা জানতাম। মাসের পর মাস তল্লাশি চালালাম–শেষকালে আবিষ্কার করলাম তার ঠিকানা। ডায়েরিটা যে এখনও তার কাছে আছে, তা জেনেছিলাম সাইবেরিয়াতে থাকার সময়ে ওর একটা চিঠি পেয়ে। ডায়েরির পাতা থেকে কয়েকটা অংশ তুলে তিরস্কার করে চিঠিটা লিখেছিল আমায়। কিন্তু প্রতিহিংসা নেওয়ার প্রবৃত্তি যার এতখানি, সে যে নিজে থেকেই সুড়সুড় করে কোনোদিনই ডায়েরিটা আমার হাতে তুলে দেবে না, তা আমি জানতাম। নিজেকেই তৎপর হয়ে সংগ্রহ করতে হবে তা। এই উদ্দেশ্যেই একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ প্রতিষ্ঠান থেকে একজন এজেন্টকে নিযুক্ত করেছিলাম এ-কাজের জন্যে। সেক্রেটারি হয়ে সে এল আমার স্বামীর বাড়িতে। সারজিয়াস, সে হল তোমার দ্বিতীয় সেক্রেটারি। খুব তাড়াতাড়ি কাজ ছেড়ে দিয়েছিল সে। কাগজপত্র যে-কাবার্ডে থাকে এ-খবর সে সংগ্রহ করলে এবং চাবিটারও একটা ছাপ এনে দিলে আমায়। এর বেশি এক পা-ও যেতে রাজি হল না সে। বাড়ির একটা নকশাও আমায় দিয়েছিল। আর বলেছিল, দুপুরের আগে সবসময়ে ফাঁকা থাকে পড়ার ঘরটা। সে সময়ে সেক্রেটারি ব্যস্ত থাকে ওপরে। তাই শেষ পর্যন্ত সাহসে বুক বেঁধে নিজেই এসেছিলাম কাগজগুলো উদ্ধার করতে। সফলও হয়েছি, কিন্তু হায়-রে, কী চরম মূল্যই দিতে হল তার প্রতিদানে!

কাগজগুলো সবে নিয়েছি, চাবি ঘুরিয়ে কাবার্ডটা বন্ধ করছি, এমন সময়ে ছেলেটি এসে চেপে ধরলে আমায়। সেদিন সকালেই তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। রাস্তায় তার সঙ্গে দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রফেসর কোরাম থাকেন কোথায়। তখন জানতাম না যে এ-বাড়িরই কর্মচারী সে।

এগজ্যাক্টলি! এগজ্যাক্টলি! বলে ওঠে হোমস। বাড়ি ফিরে এসে সেক্রেটারি প্রফেসর কোরামকে জানালে রাস্তায় দেখা স্ত্রীলোকটার কথা। তারপর, শেষ নিশ্বাস ফেলার সময়ে এই খবরটি পাঠাতে চেয়েছিল তাকে যে এই সেই মেয়েটি যে-মেয়েটির কথা, এইমাত্র সে আলোচনা করে এসেছে তার সঙ্গে।

আমাকে কথা বলতে দিন, আদেশের সুর ধ্বনিত হয়ে ওঠে ভদ্রমহিলার কণ্ঠে। যন্ত্রণায় কুঁচকে ওঠে তার মুখ।ও পড়ে যেতেই ঘর ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে পড়লাম আমি। ভুল দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম আমার স্বামীর ঘরে। ও চেয়েছিল আমাকে ধরিয়ে দিতে। কিন্তু আমি বুঝিয়ে দিলাম যে ও-কাজটি করতে যাওয়ার আগে তার মনে রাখা উচিত যে তারও জীবন আমার হাতে। আমাকে আইনের খপ্পরে দিলে, আমিও তাকে সঁপে দেব ব্রাদারহুডের কবলে। আমি যে শুধু আমার জীবনের জন্যেই বাঁচতে চেয়েছিলাম, তা নয়। আমি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চেয়েছিলাম। ও বুঝল, আমার যে কথা, সেই কাজ–বুঝল যে, ওর অদৃষ্টও নির্ভর করছে আমার অদৃষ্টের ওপর। শুধু এই কারণেই আমায় আড়াল করতে চেয়েছিল ও–আর কোনো কারণের জন্যে নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা লুকোনোর জায়গায় আমাকেও ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে। পুরোনো যুগের চিহ্ন এই ঘুপসি জায়গাটার হদিশ জানত শুধু সে নিজে। নিজের ঘরে খাবার আনিয়ে খেত ও। তাই, ওর খাবারের অংশ আমাকেও দিতে পেরেছিল ও। ঠিক ছিল যে পুলিশ বাড়ি ছেড়ে বিদায় হলে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দেব আমি এবং আর কোনোদিন ফিরে আসব না এ-অঞ্চলে। কিন্তু কেন জানি না আমাদের প্ল্যান ফাঁস হয়ে গেল আপনার কাছে। পোশাকের। ভেতর থেকে বুকের কাছে লুকোনো ছোটো একটা প্যাকেট টেনে বার করলেন ভদ্রমহিলা। বললেন, এই আমার শেষ কথা। এই প্যাকেটের বিনিময়ে মুক্তি পাবে অ্যালেক্সিস। ন্যায়বিচারের প্রতি আপনার শ্রদ্ধা আর অনুরাগের বিশ্বাসেই এ-জিনিস গচ্ছিত রাখলাম আপনার হাতে। নিন! রাশিয়ান এমব্যাসিতে আপনি পৌঁছে দেবেন এই প্যাকেটটা। আমার কর্তব্য শেষ হয়েছে আর

থামাও ওঁকে! চেঁচিয়ে উঠল হোমস। ঝড়ের মতো ঘরের মাঝ দিয়ে ছুটে গিয়ে ভদ্রমহিলার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলে ছোটো একটা শিশি।

বড়ো দেরি হয়ে গেছে! শয্যার ওপর লুটিয়ে পড়তে পড়তে বললেন উনি।বড়ো দেরি হয়ে গেছে! গোপন স্থান ছেড়ে বেরিয়ে আসার আগেই বিষ খেয়েছি আমি। মাথা ঘুরছে। চললাম! প্যাকেটটার কথা স্মরণে রাখবেন স্যার–এ-দায়িত্ব আপনার।

শহরে ফেরার পথে ট্রেনের মধ্যে বলল হোমস, খুবই সোজা কেসটা। কিন্তু কয়েক দিক দিয়ে বেশ শিক্ষামূলক। প্রথম থেকেই পুরোপুরিভাবে কেসটা নির্ভর করছিল ওই প্যাঁসনেটার ওপর। কপাল ভালো তাই মরার আগে চশমাটা ছিনিয়ে নিতে পেরেছিল স্মিথ। তা না হলে এ-রহস্যের মর্মোঘাটন কোনোদিন সম্ভব হত বলে মনে হয় না আমার। কাচ দুটোর শক্তি লক্ষ করেই বুঝেছিলাম, এ-চশমা যিনি ব্যবহার করেন, তাঁকে প্রায় অন্ধ বললেই চলে এবং চশমা-বিনা তিনি নিতান্তই অসহায়। তাই তুমি যখন আমাকে বিশ্বাস করতে বললে যে আততায়ী সরু একফালি ঘাসের ওপর দিয়ে গেছে অথচ একবারও ভুল পা ফেলেনি, তোমার মনে থাকতে পারে, তখন আমি বলেছিলাম কাজটা বাস্তবিকই বড়ো অসাধারণ। মনে মনে কিন্তু আমি নিশ্চিত জানতাম, এ-কাজ একেবারে অসম্ভব। তার আর একটা চশমা থাকলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কাজেই ভদ্রমহিলা যে বাড়ির মধ্যেই আছেন এমন একটা প্রকল্প বা hypothes।s বেশ গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য হলাম আমি। দুটো করিডোরে একই রকমের দেখতে নারিকেল দড়ির মাদূর পাতা দেখে বুঝলাম, পথ ভুল করা খুবই স্বাভাবিক তাঁর পক্ষে। সেক্ষেত্রে তিনি যে প্রফেসরের ঘরে ঢুকেছেন, তা আর না-বললেও চলে। তাই প্রথম থেকেই রীতিমতো সজাগ হয়ে রইলাম। আমার ধারণা যাতে সত্য প্রমাণিত হয়, এমনি কোনো কিছু যাতে চোখ না-এড়ায়, সতর্ক তীক্ষ্ণ্ণ চোখে চোখে দেখতে লাগলাম সব কিছু। তন্নতন্ন করে ঘরটাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম লুকোবার মতো কোনো জায়গা দেখার আশায়। কার্পেটটা একটানা পাতা এবং মেঝের সঙ্গে পেরেক দিয়ে আঁটা। তাই, মেঝের ওপর চোরা-দরজার সম্ভাবনা নাকচ করে দিলাম। বইগুলোর পেছনে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা থাকতে পারে। জানেন তো, সেকেলে লাইব্রেরিতে এ ধরনের কায়দা হামেশাই দেখা যায়। লক্ষ করলাম, মেঝের সর্বত্র পর্বতপ্রমাণ বই, কিন্তু একটা বুককেসের সামনেটা একদম ফাঁকা। গোপন-স্থানের দরজা হয়তো এইটাই। কিন্তু আমার সাহায্য হতে পারে, এমনি কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। তবে কার্পেটটার রং ম্যাটমেটে ধূসর বাদামি–এ-রকম রঙের কার্পেট পরীক্ষা করা খুব সহজ। তাই, অমন চিৎকার সিগারেটগুলোর অনেকগুলো শেষ করে ফেললাম অল্পক্ষণের মধ্যেই। আর ছাই ফেলতে লাগলাম সন্দেহজনক বুককেসটার সামনে সমস্ত জায়গাটার ওপর। কৌশলটা ভারি সহজ কিন্তু দারুণ কাজে লাগে। তারপর নীচে নেমে গেলাম। ওয়াটসন, তোমার সামনেই তো প্রমাণ করলাম, আমার ধারণা সত্য। প্রমাণ করলাম যে প্রফেসর কোরামের খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক, তাই নয় কি? তুমি অবশ্য আমার কথার এলোমেলো ধরন থেকে কিছুই বুঝে উঠতে পারনি। আবার গেলাম ওপরতলায়। সিগারেটের বাক্স উলটে দিয়ে খুব কাছ থেকে ভালো করে দেখে নিলাম মেঝের অবস্থাটা। সিগারেটের ছাইয়ের চিহ্ন থেকে বেশ পরিষ্কার বুঝলাম, আমাদের অবর্তমানে গোপন-স্থান থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা। ওহে হপকিনস, শেরিং ক্রস তো এসে গেল। কেসটার এ-রকম সার্থক সমাপ্তির জন্য অভিনন্দন জানাই তোমায়। নিশ্চয় এখন হেড কোয়ার্টারে চলেছ তুমি। ওয়াটসন, একটা গাড়ি নিয়ে চলো তুমি, আর আমি যাই রাশিয়ান এমব্যাসিতে।

———-

টীকা

প্যাঁসনের প্যাঁচে প্রফেসর : দি অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য গোল্ডেন প্যাঁসনে ইংলন্ডে স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনের জুলাই ১৯০৪ সংখ্যায় এবং আমেরিকায় কলিয়ার্স উইকলির ২৯ অক্টোবর ১৯০৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত।

বাথ চেয়ার : হুইল চেয়ার আনুমানিক ১৭৫০-এ বাথ শহরে এই ধরনের চেয়ার প্রথম নির্মাণ করেন জেমস হিথ। সেই সময়ে, বা পরেও, চাকা লাগানো এই চেয়ারের প্রচলিত নাম ছিল বাথ চেয়ার।

আলেকজান্দ্রিয়ান সিগারেট : মিশরীয়দের হুকায় ধুমপানের জন্য গুড় দিয়ে মিষ্টি করা বিশেষ জাতের তামাকে তৈরি সিগারেটের কথা বলা হয়ে থাকা সম্ভব।

বিপ্লবী–নিহিলিস্ট : দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য সিক্স নেপোলিয়নস গল্পের টীকা দ্রষ্টব্য। রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে ১৮৮১ সালে হত্যা করে নিহিলিস্টরা। তার ফল হিসেবে কয়েকশো নিহিলিস্টকে মৃত্যুদণ্ড বা নির্বাসন দেওয়া হয়।