• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০৬৩. এরা মাটি ভাগ করতে চায়

এরা মাটি ভাগ করতে চায়, ভিটে ভাগ করতে চায়, বাড়ি ভাগ করতে চায়। ভাগাভাগির একটা হাওয়াই এখন বইছে পৃথিবী জুড়ে। দুনিয়াকে যে কত ভাবে, কত ভাগে ভাগ করতে চায় মানুষ! এভাবে কি ভাগ হয়? গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন কৃষ্ণজীবন তার দুটি ভাইপোকে নিয়ে ক্ষেতের ধারে ধারে মন্থর পায়ে হাঁটছে। শীতের বাতাস আর রোদে মাখামাখি আজকের এই সকাল তাকে কোন শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে আজ। সামনের ক্ষেতটুকু তাদের। আজ এর অনেক ভাগীদার। এই ক্ষেতটুকু আর ভিটেটুকু আঁকড়ে ধরে তার বাবাকে সে কঠিন বেঁচে থাকার লড়াই করতে দেখেছে। ঘাড়ে তখন অনেক পুষ্যি। দেশ ভাগের পর আত্মীয়স্বজন জ্ঞাতি কত মানুষ একে একে এসে তাদের আশ্রয় নিয়েছিল। একখানা বড় খোভড়া ঘরে তখন গাদাগাদি করে থাকা হত। ক্ষেত থেকে ছমাসের খোরাকির ধানও উঠত না। তার বাবা বিষ্ণুপদ বির ঘোরাঘুরি করে অনেক দূরের এক গায়ের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি জুটিয়ে নিয়েছিল। বেতন সজ্জাজনক। এই ক্ষেত আর ওই চাকরি যেন ফুটো নৌকোয় দরিয়া পাড়ি দেওয়া। অসুখ হলে ডাক্তার-বদ্যি ছিল না, ওষুধও না। টোটকা সম্বল। বিনা চিকিৎসায় কৃষ্ণজীবনের একটা ভাই আর দুটো বোন মারা যায়। আগ্রাসী দারিদ্রের সেই নগ্ন চেহারাটা বামাচরণ বা রামজীবন তেমন দেখেনি। ওরা তখন খুব ছোট।

একটা সজনে গাছের তলায় তিনজন দাঁড়াল পাশাপাশি।

পটল, এই ক্ষেত এখন কে চাষ করে জানিস?

জানি জ্যাঠা। বদরুদ্দিন চাচা।

সে ধানটান ঠিকমতো দেয়?

বেশী দেয় না।

বৰ্গা রেজিস্ট্রি হয়েছে কিনা জানিস?

না জ্যাঠা। ওসব বাবা জানে।

বহুকাল কৃষ্ণজীবন আর খবর রাখে না। এ জমি সে নিজে চাষ করেছে। তার বড় মায়া।

আয়, এখানে একটু বসি।

ঘাসের ওপর, সজনের ঝিরঝরে ছায়ায় বসল তিনজন। গোপাল কথা কইতে পারে না বটে, কিন্তু সে যে তার জ্যাঠাকে পছন্দ করে এটা সে নানাভাবে বুঝিয়ে দেয়। খুব ঘেঁষ হয়ে সে জ্যাঠার সঙ্গে লেগে বসে রইল। কৃষ্ণজীবনের বা ধারে পটল। আজকাল কৃষ্ণজীবন যখনই আসে এ দুটি তার সঙ্গে এঁটুলির মতো সেঁটে থাকে। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে একমাত্র দোলনই যা তার ন্যাটা, অন্য দুজন নয়।

গোপালকে এক হাত দিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে কৃষ্ণজীবন বলল, পটল, তুই কখনও লাঙল চালিয়েছিল।

না জ্যাঠা।

কেন চালাসনি। ইচ্ছে হয় না?

ক্ষেত তো বদরুদ্দিন চাচা চাষ করে।

সে করে, কিন্তু তোর ইচ্ছে হয় না?

পটল কি বলবে ভেবে পেল না।

কৃষ্ণজীবন মৃদু তদ্‌গত গলায় বলে, লাঙল চালালে কি হয় জানিস? মাটির ওপর মায়া হয়, ভালবাসা হয়। এই মাটির মধ্যে, চাষবাসের মধ্যেই আছে মানুষের প্রাণভোেমরা।

পটল একটু উত্তেজিত হল। জ্যাঠার সব কথাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সে বলল, সত্যি জ্যাঠা?

সত্যি।

তুমি নিজে চাষ করেছে, না জ্যাঠা?

হ্যাঁ। তোর মতো বয়সেই শুরু করেছিলাম। লাঙল চেপে রাখা খুব শক্ত। এবড়োধেবড়ো মাটিতে লাঙল যখন চলত, আমি লাঙলের মুঠ ধরে ঝুলে থাকতাম। কতবার পড়ে গেছি। হাতে ফোসকা পড়ত। তবে হাল ছাড়িনি। রোজ অভ্যাস করতে করতে দিব্যি পারতাম।

আমাদের যে হাল-বলদ নেই জ্যাঠা।

তখনও ছিল না। হাল বলদ ধার করে আনতে হত। সেও বড় কষ্ট। যার হাল বলদ সে তো আর আমার সুবিধেমতো দেবে না, তাই হাঁ করে তার দয়ার জন্য বসে থাকতে হত। অপমানও হতে হত খুব। তবে গায়ে মাখতাম না।

দাদু বলে, তোমার নাকি খুব রোখ ছিল।

কৃষ্ণজীবন একটু উদাস হাসি হাসল। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, রোখ ছিল, সাহস ছিল।

আমার সাহস নেই জ্যাঠা। আমি খুব ভীতু। নপাড়ার একটা ছেলে এই সেদিন আমাকে রথতলায় একা পেয়ে মেরে দিল। আমি কিছু করতেই পারিনি।

মারল কেন?

ওদের সঙ্গে পাড়ার ঝগড়া। একদিন গোপালকে সাইকেলে বসিয়ে আসছিলাম, একটা ছেলে এমন ঢিল মারল, আর একটু হলে আমার চোখ কানা হয়ে যেত। আর ঢ়িলটা গোপালের লাগলে মরেই যেত বোধ হয়। ইয়া বড় একটা পাথর।

নপাড়ার ছেলেরা বরাবরই একটু গুড়া।

তুমি কখনও মারপিট করেছে জ্যাঠা?

কৃষ্ণজীবন একটু হেসে বলল, সে অনেক করেছি। রিলিফ নিয়ে, ডোল নিয়ে, জমির দখল নিয়ে কত হাঙ্গামা হত তখন। গায়ের কয়েকটা খারাপ লোকও আমাদের পিছনে লেগেছিল। সে একটা বিশৃঙ্খলার সময়। তখন মার খেতাম, আবার উঠে মারতামও। নইলে দখল থাকত না। দখল রাখাটাই অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় কথা। দখল রাখতে মানুষ সব করতে পারে। এই যে জমিটুকু, বাড়িটুকু, এটুকু রাখতেই আমাদের প্রাণান্ত হওয়ার জোগাড়। তার মধ্যে আবার আমাদের ঘাড়ে বসে যারা খেত, সেইসব আত্মীয় আর জ্ঞাতিরাও এসবের ভাগ চাইতে শুরু করেছিল। সে খুব জটিল কাহিনী। আজ সেই জমি আর বাড়ি ভাগ হচ্ছে।

ভাগ হলে কী হবে জ্যাঠা?

কিছুই হবে না। বামাচরণ তো চাষ করবে না, তার ভাগের জমি বেচে দেবে। রামজীবনও বোধ হয় তাই করবে। সরস্বতী আর বীণাপাণি কি করবে কে জানে! বোধ হয় দাদাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ভাগ ছেড়ে দেবে। ওরা তো জানে না, এই সম্পত্তি আসলে একটা ইতিহাস। ওরা টাকাটাই চেনে।

পটল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার খুব ইচ্ছে করে, গোপালকে নিয়ে এ বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই।

পালাবি! কেন রে, পালাবি কেন?

আমার এখানে ভাল লাগে না, বড় ঝগড়া, অশান্তি।

তাই বলে পালাবি কেন? নিজের কাজ নিয়ে ড়ুবে থাকবি। দুনিয়াতে পালিয়ে যাওয়ার আর জায়গা নেই। পালাতে হলে নিজের মধ্যে পালাবি।

সেটা কেমন জ্যাঠা?

মানুষের পালানোর সবচেয়ে ভাল জায়গা হল তার মন। যদি সেখানে ঢুকে কপাট বন্ধ করে দিতে পারিস তা হলে আর কেউ তোর নাগাল পাবে না।

সত্যি জ্যাঠা?

খুব সত্যি। আমি যখন দিনের পর দিন খিদেয় কষ্ট পেতাম, তখন খিদে ভুলতেও মনের মধ্যে ড়ুবে যেতাম। খিদের কথাও আর মনে পড়ত না। এরকম কতদিন গেছে। মনটাই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। যে মনটাকে সই করে নিতে পারে তার মার নেই। চারদিকে যা খুশি হোক, তুই নিজের কাজ নিয়ে, নিজের ভাবনা নিয়ে থাক, দেখবি কিছুই তোকে ছুঁতে পারবে না।

তুমি কাছে থাকলে আমার খুব ভাল হয় জ্যাঠা।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, আমি কাছে থাকলে তোর সবসময়ে আমাকে নকল করতে ইচ্ছে হবে। সেটা ভাল না। আমি দূরে থাকি বলেই আমার ওপর তোর টানটাও আছে। আমার মতো হওয়ার ইচ্ছাটাও আছে। এরকমই ভাল। আর একটু বড় হ, তখন দেখতে পাবি, পৃথিবীতে নিজের মতো হয়ে ওঠাটাই সবচেয়ে বড় কথা।

পটল গম্ভীর হয়ে বসে জ্যাঠার কথাগুলি বুঝবার চেষ্টা করতে লাগল। আজকাল সে সব কিছু বুঝবার চেষ্টা করে।

তুই ইংরিজিতে কেমন?

গত পরীক্ষায় একটু ভাল পেয়েছি। তাও বেশী নয়। দাদুর কাছে পড়ছি বলে একটু ভাল হচ্ছে।

বাবা তাকে পড়ায় নাকি? খুব ভাল। বাবা তোর গোড়াটা বেঁধে দিতে পারবে। ইংরজি আর অঙ্কটা খুব দরকার। আর দরকার শক্ত মন। খুব কঠিন হবি, সাহসী হবি। হিংস্র নয়, কিন্তু সাহসী। বুঝেছিস।

তিনজন আরও কিছুক্ষণ বসে রইল সজনে গাছের নিচে। ঝিরঝরে ছায়া। শীতের বাতাস। কী ভাল চারদিকটা আজ।

তারপর ভাইপো দুটিকে নিয়ে উঠে পড়ল কৃষ্ণজীবন। আজই ভাগাভাগির কাগজপত্রে সই করে ফিরে যাবে সে। দুদিন বাদেই রওনা হবে আমস্টারডাম। অনেক কাজ বাকি।

বাড়ি ফিরে সে তার বাবার কাছে বসল একটু। একজন উকিল আসবার কথা। এখনও আসেনি।

বিষ্ণুপদ দাওয়ায় রোদে পিঠ দিয়ে বসে নিজের হাত দুখানার দিকে চেয়ে থেকে বলে, এ ভালই হল, কি বলিস বাবা?

অশান্তির চেয়ে তো ভাল।

আমিও তাই বলি। ভাগজোখ হয়ে গেলে যদি ভাব হয়।

আপনি কি তাই ভাবেন?

না বাবা, তা ভাবি না। আশা করি। একটা দুঃখ, তোর কোনও ভাগ থাকল না।

কি করব বাবা ভাগ দিয়ে? আমার তো লাগবে না।

তা জানি। কিন্তু আমার সম্পত্তিতে তোর একটু ভাগ থাকলে তোক আমার ছেলে বলে ভাবতে সুবিধে হয়।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, ও কি কথা বাবা, ছেলে বলে এমনিতে ভাবতে অসুবিধে কিসের?

তুই যে বড় ওপরে উঠে গেছিস বাবা, আমি যে তোকে আর নাগালে পাই না। নিজের ছেলে তো ঠিকই, কিন্তু ছেলে যখন বড় বেশী কৃতী হয়ে ওঠে তখন যেন ছেলে বলে মনে করতে ভরসা হয় না। যদি এক কাঠা জমিও নিজের নামে রাখতি তবে বুকটা ঠাণ্ডা হত। ভাবতাম, ও তো আমার ওয়ারিশ।

আপনি যে কত অভুত কথা ভাবেন বাবা!

ওটাই তো আমার মস্ত দোষ। অকাজের মাথায় কত উদ্ভট চিন্তাই যে আসে। কি করি জানিস। পটলের ভূগোল বইখানা খুলে ম্যাপ দেখি আর ভাবি, আমার কৃষ্ণজীবন এখন আমেরিকায় আছে। এই ইংলন্ডে আছে, এই অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছে। তোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও যেন চলে যাই ওসব জায়গায়। ভাবি, কৃষ্ণ তো আমার সত্তারই অংশ, আমিই তো কৃষ্ণজীবন হয়ে জন্মেছি। তাই না?

তাই তো বাবা।

বিষ্ণুপদ খুব হাসে আর মাথা নাড়ে। বলে, এইসব ভাবি আর কি!

বাবা, আপনার কি বিদেশ দেখতে ইচ্ছে করে?

বিষ্ণুপদ সভয়ে বলে, ও বাবা, না।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, আজকাল যাওয়া কিছু শক্ত নয়। আমি বোধ হয় বছরখানেকের জন্য আমেরিকায় যাবো। আপনি যদি যেতে চান সব ব্যবস্থা হবে।

বিষ্ণুপদ হাঁ করে চেয়ে থেকে বলে, তুই যে বলেছিস এটাই ঢের। আমার অত চাই না।

আজকাল সবাই যায়।

তারা যাক। আমার সইবে না।

কৃষ্ণজীবন চুপ করে রইল। তার বাবা বিষ্ণুপদর পক্ষে যে আমেরিকা যাওয়া ঘটে উঠবে না তা সেও জানে। অত সৌভাগ্য করে আসেনি তার বাবা। কিন্তু বিষ্ণুপদ কি দুৰ্ভাগা? তাও মনে হয় না কৃষ্ণজীবনের। বিষ্ণুপদ বরাবর নিজের দুর্ভাগ্যগুলিকে হাসিমুখে মেনে নিয়েছে। শান্ত সমাধিস্থ থেকেছে। মনের মধ্যে ড়ুব দেওয়ার কৌশল কি উত্তরাধিকার সূত্রে বিষ্ণুপদর কাছ থেকেই পায়নি কৃষ্ণজীবন।

বাবা, কয়েকদিন কলকাতায় গিয়ে থাকবেন।

বিষ্ণুপদ আবার খুব হাসল। বলল, আজকাল শরীরে নাড়া দিতে ইচ্ছে যায় না। মনে হয়, যত নাড়াচাড়া কম হয় ততই ভাল।

কেন বাবা?

কেমন যেন মনে হয়, শরীরেরও কিছু নালিশ আছে। ছুটি চাইছে। বায়ুপুরাণ পড়িসনি?

পড়িনি, কিন্তু আপনার কাছে শুনেছি।

বইখানা পড়িস। অনেক জ্ঞান হয়।

জ্ঞান তো সবই বই থেকেই হয় বাবা।

তা হয়। তবে বায়ুপুরাণ একখানা বেশ বই। অনেক লক্ষণ চিনিয়ে দেয়।

বাংলাদেশে নিজের গাঁয়ে একবার যাবেন।

কেন, সেখানে কী আছে?

দেশের গাঁ, পিতৃপুরুষের ভিটে দেখতে ইচ্ছে হয় না?

বিষ্ণুপদ হাসে আর মাথা নাড়ে, চোখে দেখে কি সুখ? বরং ভাবলে সুখ হয় একটু। সবই ভাবের জিনিস। নইলে কার মাটি, কার জমি, কার বসত? এগুলো কিছু না। দেশে কি খুব সুখে ছিলাম রে বাবা? খেয়েছি তো সেই কচু ঘেঁচু, বাস করেছি মাটির ভিটির ঘরে। তবু লোকের কেবল মনে হয় দেশে কত সুখে ছিলাম। ওটা হল ভাবের সুখ।

কৃষ্ণজীবন এই সত্যবাদিতায় মুগ্ধ হল। বাবার দিকে মায়াভরে চেয়ে থেকে বলল, বাবা, আপনি বড় ভাল বোঝেন।

বিষ্ণুপদ ঘন ঘন মাথা নাড়া দিয়ে বলে, কিছু না কিছু না। বুঝি কোথায়? এই শেষ বয়সে এসে যেন ফের হামা দিচ্ছি। এই দুনিয়াটা, আর এই আমি, কিছুতেই যেন এই দুইয়ে যোগটা খুঁজে পাই না।

আমিও পাই না বাবা। বোধ হয় কেউই পায় না।

বিষ্ণুপদ তার জ্যেষ্ঠ পুত্রটির দিকে উজ্জ্বল চোখে হাসিমুখ করে চেয়ে থেকে বলল, আমার কী তোকে দিই বল তো! জমি টমি কিছু নিলি না, ওয়ারিশ হলি না।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, ওগুলো তো বাইরের জিনিস বাবা। আপনার কাছ থেকেই তো সব পেয়েছি। আজই ভাবছিলাম, আপনি যেমন নিজের মনের মধ্যে ড়ুব দিয়ে বসে থাকেন, আমারও ঠিক অমনি স্বভাব। আপনার কাছ থেকে

অনেক পেয়েছি।

বিষ্ণুপদ খুশি হয়ে মাথা নাড়ে খুব। বলে, তা অবশ্য ঠিক। স্ত্রীকে জায়া বলে, তার কারণ স্ত্রীর ভিতর দিয়েই তো পুরুষ আবার জন্মায় তার সন্তান হয়। এ তত্ত্বটা বড় ভাল, ভাবলে একটা বলভরসা হয়।

তাই তো বাবা।

তোর কথা ভেবে খুব তাজ্জব হয়ে যাই মাঝে মাঝে। তোর মাকেও বলি, এই আমরা যেমন, তুই ঠিক সেরকম তো নোস। আমি ভাবি কি, আমার মতো মোটাবুদ্ধি মানুষের ছেলে হয়ে তোর এত বুদ্ধি কেমন করে হল?

কৃষ্ণজীবন খুব হাসল। বলল, বাবা আপনার মোটাবুদ্ধি কে বলে? দেশের গায়ে লেখাপড়ার চাড় ছিল না, চর্চা ছিল না, আপনার তেমন উৎসাহ ছিল না। নইলে হয়তো দেখা যেত আপনি মস্ত মেধারই মানুষ। গায়ে গঞ্জে কত মেধা তো অনুশীলনেরই অভাবে নষ্ট হয়ে যায়।

তা বটে। বলে বিষ্ণুপদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, কিন্তু কিছু টের পাইনি কখনও। সারাজীবন একটা কাজই করেছি। ভেবেছি। মেলা ভেবেছি। সবই হাবিজাবি। আর তেমন কিছু করিনি। অবিন্যস্ত চিন্তা। মনে হয় গুছিয়ে ভাবতে পারলে, ভাবনার পরম্পরা ঠিক থাকলেও মানুষ ভেবেই কত কী করতে পারে।

কৃষ্ণজীবন হাসতে হাসতে বলল, এই যে বলছিলেন আপনার মোটাবুদ্ধি! মোটাবুদ্ধির মগজ থেকে কি এসব কথা বেলোয়?

শোন, আমার তো বিশেষ কিছু নেই। একটা মাদুলি আছে। আমার মাদুলি। তোর ঠাকুমা কোথা থেকে এনে পরিয়েছিল আমায়। কোনও কাজ হয়েছিল কি না জানি না। তবে অনেকদিন আমার হাতে বাঁধা ছিল। এই বছরখানেক হল তাগা ছিঁড়ে যাওয়ায় আর পরিনি। আমার খুব ইচ্ছে হয়, ওটা তোকে দিই।

মাদুলি দিয়ে কী করব বাবা?

বিষ্ণুপদ সলজ্জভাবে মাথা নেড়ে বলে, কিছু করবি না, তোর কাছে রাখবি। এইটেই তোকে দিলাম ওয়ারিশ হিসেবে।

কেন বাবা?

মাদুলি সামান্য জিনিস, ওর সঙ্গে স্বার্থ বা লোভের সম্পর্ক নেই। একটা কিছু দেওয়াও হল, পাঁচজনের চোখ টাটাল না, নিবি কৃষ্ণ।

কৃষ্ণজীবন দুটি হাত পেতে বলল, দিন বাবা। তাই দিন।

বিষ্ণুপদ উঠে ঘরে গেল। বাক্স খুলে একটা কৌটো বের করে আনল। কৌটোর ভিতর থেকে কালপ্রাচীন মাদুলিটি বেরোলো। মাদুলির তাম্রাভ বর্ণ কালচে হয়ে গেছে, ঘেঁড়া তাগাটা তেলচিটে।

অপ্রতিভ বিষ্ণুপদ দ্বিধান্বিত করতলে মাদুলিটা নিয়ে বলল, এটাই। নিবি বাবা? ঘেন্না করবে না তো!

কৃষ্ণজীবনের চোখে জল এল। মাথা নেড়ে বলল, না বাবা। ঘেন্না কেন করবে?

বড় নোংরা হয়ে আছে। পুরোনো তো?

ওইরকমই থাক বাবা। এতে একজন সৎ মানুষের স্পর্শ আছে। দিন।

বিষ্ণুপদ মাদুলিটা তার হাতে দিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল, মনে মনে ভাবছিলাম, তোকে কী দিই! কাল রাতে হঠাৎ স্বপ্ন দেখলাম, তোক এই মাদুলিটা দিচ্ছি। স্বপ্নের তো মাথামুণ্ডু থাকে না। তবু ভাবলাম, তা হলে দেওয়াই ভাল।

মাদুলিটা পকেটে রেখে কৃষ্ণজীবন বলল, এটা কি পরতে হবে বাবা?

বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, না না। পরতে হবে না। তোর বাড়িতে রেখে দিস কোথাও। ওর কোনও ক্রিয়া নেই। শুধু একটা চিহ্ন।

দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ।

বিষ্ণুপদ হঠাৎ বলল, হ্যাঁ রে, ইনঅ্যানিমেট যা সব আছে, সেগুলো কি সত্যিই ইনঅ্যানিমেট? তুই তো অনেক জানিস, তোর কি মনে হয়?

কৃষ্ণজীবন একটু অবাক হয়ে বলে, ইনঅ্যানিমেট তো জড়বস্তু।

বিষ্ণুপদ খুব লজ্জার হাসি হেসে শিশুর মতোই বলে, কি জানিস, যখন ছোট ছিলাম তখন কিন্তু মনে হত, সব জড়বস্তুই যেন জীয়ন্ত। প্রাণ কি না জানি না, কিন্তু আমাদের সবই ওরা দেখে, বুঝতে পারে, টের পায়। এখনও ঠিক সেরকম মনে হয়।

কৃষ্ণজীবন মৃদু হেসে বলে, তাতে দোষ কি বাবা? সেরকম হতেও পারে। বিজ্ঞান দিয়ে আমরা আর কতটুকু জানতে পেরেছি।

তোর ওরকম মনে হয় না, না? না বাবা।

ওই যে মাদুলিটা নিলি, কত আদর করে নিলি, ওটা তো ইনঅ্যানিমেট। তাই না? আমার কেন যে মনে হয়, এই মাদুলিটার মধ্যে আমার একটু তরঙ্গ, একটু স্পন্দন রয়ে গেল। জড় বটে, কিন্তু তবু যেন পুরোপুরি জড় নয়।

কৃষ্ণজীবন স্মিত মুখে চুপ করে রইল।

বিষ্ণুপদ বলল, কত কী মনে হয়। গরুটা, কুকুরটা, ছাগলটা, গাছটা সব কিছুকেই যেন মনে হয়, মানুষের মতোই। হয়তো তেমন বুদ্ধি নেই, ক্রিয়া নেই, তবু যেন সবই মানুষ। সবই আমাদেরই ভিন্নরূপ।

এরকম হলে তো ভালই বাবা।

বিষ্ণুপদ খুশি হল। খুব হাসল। দুলে দুলে।

উকিল এল একটু বেলায়। বামাচরণই নিয়ে এল। রামজীবন, বামাচরণ, বিষ্ণুপদ আর কৃষ্ণজীবন মিলে একটা ভাগাভাগির বৈঠক বসল। ঝগড়া-কাজিয়া হল না। শান্তভাবে একটা মুসাবিদা করা হল। নিজের ভাগের সম্পত্তি দানপত্ৰ করে দিল কৃষ্ণজীবন। সবই কাঁচা চুক্তি। পরে আদালত থেকে পাকা হয়ে আসবে। সাক্ষী সাবুদও জুটে গেল কয়েকজন।

বিকেলে অবসন্ন মনে ফেরার ট্রেন ধরল কৃষ্ণজীবন। একা। বড়ই কঁকা ট্রেন। এই একাকিত্ব কৃষ্ণজীবনের আশৈশব সঙ্গী। বাইরে বন্ধুবান্ধব ছিল, আত্মীয়স্বজন ছিল, তবু সকলের মাঝখানে থেকেও কৃষ্ণজীবন মনে মনে ছিল একা, সঙ্গীহীন। বরাবর। বিয়ের পরও। আজ অবধি সেই একাকিত্ব কখনও ঘোচেনি তার। কিন্তু ঘুচবেই বা কেন? সে তত এই একাকিত্বকে আদ্যন্ত উপভোগ করে।

ঠিক একাও নয়। সে যখন একা হয় তখন গোটা বিশ্বজগৎ নিয়ে তার প্রিয় চিন্তা এক রূপকথার জগৎকে উন্মোচিত করে দেয়। সীমাহীনতা, সময়হীনতা পরিব্যাপ্ত হয়ে যে চরাচর, তার রূপ ও অরূপ, তার আলো ও অন্ধকার ভরে রাখে তার মাথা।

একা প্ৰায়ান্ধকার ট্রেনের কামরায় জানালার পাশে বসে সে আজ উপভোগ করছিল এই একাকিত্বকে। বিশাল বিশ্বজগতের কথা যখনই সে ভাবতে শুরু করে তখনই তুচ্ছ হয়ে যায় তার সব প্রিয়জন, তার চাকরি, সাফল্য, প্রতিষ্ঠা। এক দিশাহীন অতল অন্ধকারে আচ্ছন্ন অসীম আর মহাকাল যার শুরু নেই, শেষও নেই—তাকে এসে সন্মােহিত করে দেয়।

পকেট থেকে আনমনে বাবার দেওয়া মাদুলিটা বের করল সে। চেয়ে রইল। কেন বাবা মাদুটিা তাকে দিল তা অন্যে হয়তো বুঝবে না। কিন্তু সে বোঝে। সে বুঝেছে। বাবা এই সামান্য মাদুলিটি হয়ে তার সঙ্গে লেগে থাকতে চায়। বিষ্ণুপদ এর বেশী আর কিছুই চায়নি তার কাছে।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৬২. একটা নদী কত কী করতে পারে
পরবর্তী:
০৬৪. নিরঞ্জনবাবুর কাছে বসে থাকলে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑