• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০২৪. কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ০২৪. কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া

কাউকে কোনও উপলক্ষে ফুল দেওয়া একদম পছন্দ নয়। আপার। একমাত্র পুজোর সময় ছাড়া। ঐ একটা ব্যাপারে তার দুর্বলতা আছে। তবে ঠাকুরপুজোয় ফুলও খুব বেশী দেওয়া উচিত বলে সে মনে করে না। সামাজিক অনুষ্ঠান বা শোকের সময় যে সব ফুল ও মালা দেওয়ার প্রথা আছে সেটা তার কাছে ফুলের অপমান বলে মনে হয়। তবু আজ। আপা এক গোছা রজনীগন্ধা নিয়ে অনীশদের বাড়িতে এল সকালে।

কাকাবাবু, আপনি তো খুব ভাল আছেন দেখতে পাচ্ছি। একদম যুবক দেখাচ্ছে আপনাকে!

মণীশ হেসে বলে, থাক, আর তোমাকে বানিয়ে বানিয়ে বলতে হবে না।

আপা এ বাড়িতে আলো-হাওয়ার মতো অবারিত আসে যায়। একখানা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে বলল, আমি মিথ্যে কথা বলতে পারি না যে!

মণীশ এ মেয়েটিকে খুব পছন্দ করে। মমতা মাখানো চোখে মেয়েটির রোগা মুখখানার দিকে চেয়ে বলল, মিথ্যে বলো না তা জানি। তবে ভুল দেখছো। কয়েকদিনেই তো আমার মনে হচ্ছে বুড়িয়ে গেছি।

একদম নয়। শুনুন, শরীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, মাছমাংস না খেলে এ রোগটা কম হয়। আপনি ননভেজ ছেড়ে আমার মতো পুরো ভেজ হয়ে যান।

মণীশ হাসল, সেটা পরে ভেবে দেখব। এখন ডাক্তার কড়া হুকুম দিয়েছে, রোজ একটা করে ছোট্ট মুগীর সুরুয়া খেতে হবে।

মুর্গীদের কপাল খারাপ!

আচ্ছা, তোমার হাতে ফুল কেন? কোথাও যাচ্ছ ফুল নিয়ে!

জিব কেটে আপা বলে, এ মা, এ তো আপনার জন্যই এনেছি। অভ্যাস নেই বলে দিতেই ভুলে গেছি। এই নিন।

মণীশ ফুলের গোছাটা নিয়ে একটু গন্ধ শোকার চেষ্টা করে বলে, এসব ভদ্রতা আবার করতে গেলে কেন? তুমি তো আমার মেয়ের মতোই। আচ্ছা, কলকাতার রজনীগন্ধায় গন্ধ থাকে না কেন বলো তো! রজনীগন্ধায় তো বেশ চড়া গন্ধ হওয়ার কথা।

বাসী ফুলে কি গন্ধ থাকে বলুন! কলকাতায় ঢুকলেই সব জিনিসের গন্ধ হারিয়ে যায়, গুণ হারিয়ে যায়, চরিত্র হারিয়ে

মণীশ খুব হাসল, বলল, তুমি রীতিমতো ফিলজফার হয়ে উঠছে দিনকে দিন। তোমার নতুন অ্যাডভেঞ্চার এখন কী হচ্ছে বলো তো!

আপা একটু কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, হল না তো। আমি এভারেস্ট এক্সপিডিশান যাওয়ার একটা প্রস্তাব পাঠিয়েছিলাম। ওরা জবাবই দিল না।

কারা?

একটা দেশী দল।

তুমি কখনও পাহাড়ে উঠেছো?

না তো! কিন্তু সুযোগ দিলে প্রথম বারেই ঠিক উঠে যেতাম।

উঃ, কী পাগল তুমি!

আমি সবসময়ে বড় কিছু করার কথা ভাবি। আমার মনে হয়, পৃথিবীর যে কোনও শক্ত কাজই আমি পেরে যাবো। কিন্তু বাড়ির আর সবাই কোথায়? কাকিম, অনীশ, অনু, ঝুমকি দিদি! এখন সকাল আটটা বাজছে। বাড়ি চুপচাপ কেন?

বুবকা বোধ হয়। সকালে জগিং করতে গেছে। ঝুমকির জুর। অনু একটু বেলা অবধি ঘুমায়। আর কাকিমাকে বোধহয় টয়লেট বা রান্নাঘরে পাওয়া যাবে।

বুবকা জগিং করছে শুনে খুশি লাগছে। ও আপনাকে এত ভালবাসে যে, আপনার অসুখের সময় ও একদম পাগলামতো হয়ে গিয়েছিল।

জানি। হি ইজ নট গ্রোয়িং টু অ্যাডাল্টহুড। একদম শিশুকাল থেকে আমার ন্যাওটা। আমি যদি হঠাৎ মারা-টারা যাই তাহলে যে ওর কী হবে!

আপনি ওকে কেন এত দখল করে আছেন কাকাবাবু? সেই জন্যই তো ও এত পলকা, টক করে ভেঙে যায়।

মণীশ এবার হাসল না। মাথাটা নেড়ে বলল, ঠিক বলেছো। ছেড়ে দিতে ইচ্ছেও করে, আবার ভয়ও পাই। সমাজটা কি রকম তা তো জানো। ড্রাগ, গার্লস, মদ, খারাপ লোক। তার ওপর পলিটিক্স আছে, গুণ্ডামি আছে, সন্ত্রাস আছে, অ্যাকসিডেন্ট আছে।

এবার আপা হাসে, ওইসব ভেবে ভেবেই বুঝি আপনার অসুখ হল! সমাজটা খারাপ বটে, কিন্তু আমাদের তো এর মধ্যেই ঝটপট দিয়ে, একটু সাফসুরত করে থাকতে হবে! নাকি!

তুমি খুব স্বাধীন, না?

আমাকে কে আটকে রাখবে বলুন! আমার বাবা সকাল থেকে রাত অবধি টাকা রোজগার করে। মার সারাদিন পুজোপাঠ। আমার দুটো দাদা ক্যারিয়ার নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। আমি একটু একা, তাই স্বাধীন। সারা দিন শহর চষে বেড়াই, অবশ্য যখন স্কুলটুল থাকে না।

অত ঘুরে বেড়াও তাহলে এত ভাল রেজাল্ট করো কী করে?

হয়ে যায়। আমি বেশী পড়িও না। যখন পড়ি তখন গল্পের বই-ই বেশী পড়ি।

তুমি যে আমার কাছে একটা বিস্ময়, সেটা জানো?

আপা হাসল, বন্ধুরা অনেকে ওকথা বলে। আসলে আমি তো ক্যারিয়ারের কথা ভেবে পড়ি না। পড়ি প্রাশন থেকে। তাই একবার পড়লেই সব বুঝে যাই।

তোমার মাথা তাহলে খুবই পরিষ্কার।

খুব মাথা নেড়ে। আপা বলে, মোটেই তা নয় কাকাবাবু। আমার মাথায় যে রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা। আমি সব সময়ে ভাবি। আর ঘুরি। ঘুরি। আর ভাবি।

এত ঘোরো কেন আপা?

আমি দেশটাকে বুঝবার চেষ্টা করি। এত দুঃখী মানুষ আর কোনও দেশে নেই। ভাতে দুঃখী, ভাবে দুঃখী, চিন্তায় দুঃখী, কল্পনায় দুঃখী, কাজে দুঃখী। আমি বুঝবার চেষ্টা করি।

তুমি দারুণ মেয়ে। একদিন কি তুমি দেশের প্রধানমন্ত্রী-টন্ত্রী হবে নাকি? হলে আমি অবাক হবো না কিন্তু।

দূর! প্রধানমন্ত্রী হয়ে কী হবে? মন্ত্রী-টন্ত্রীরা কি এসব লোকের কাছাকাছি আসতে পারে? তারা তো এসকর্ট নিয়ে ভি আই পি হয়ে ঘুরে বেড়ায়। প্রধানমন্ত্রী হলে আমি মরেই যাবো।

তাহলে কি মাদার টেরিজার মতো হতে চাও?

সবেগে মাথা নেড়ে। আপা বলে, মা টেরিজার কথা মনে হলেই আমি ভারি লজ্জা পাই।

মণীশ অবাক হয়ে বলে, লজ্জা পাও! কেন বলো তো?

লজ্জা পাবো না? মা টেরিজা একজন মেমসাহেব। কতদূর থেকে এসে তিনি কলকাতায় দুঃখী আতুরের সেবা করছেন, তাই না? সাহেবদের সঙ্গে আমরা কোন ব্যাপারেই পারি না। অলিম্পিকে পারি না, বিজ্ঞানে পারি না. শিল্পে পারি না, সভ্যতায় পারি না, কিন্তু সেবাটুকু তো পারতে পারতাম! তাই না কাকাবাবু? সেবা তো সহজ কাজ ছিল, তার জন্ম গায়ের জোর, কসরৎ বা মেধার দরকার হয় না। কিন্তু সেটাও একজন মেমসাহেবের কাছ থেকে শিখতে হচ্ছে কেন? আসলে শিখছিও না, মা টেরিজা নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, আর আমরা আমাদের মতো দিব্যি শুয়ে বসে আছি।

বিষণ্ণ মুখে মণীশ বলে, তুমি বোধ হয় ঠিকই বলছে আপা। এ দেশের জন্য কারও কিছু করার নেই।

ওটা কথা নয় কাকাবাবু। আসলে দেশটাকে বুঝে ওঠাই খুব শক্ত। কেউ তো সে কাজ করেনি; বুঝতে হলে গোটা দেশটা পায়ে হেঁটে ঘুরতে হবে। প্রত্যেক জায়গার লোকজনকে চিনতে হবে, শুনতে হবে অনেকের অনেক দুঃখ আর সমস্যার কথা। অনেক সময় লাগে, অনেক কষ্ট করতে হয়। কার মাথাব্যথা আছে বলুন!

মণীশ এই বাচ্চা মেয়েটার দিকে শ্রদ্ধাপুত চোখে চেয়ে থেকে বলে, এর চেয়ে অবাক-করা কথা আমি বহুকাল শুনিনি। তোমার মধ্যে দারুণ প্যাশন আছে আপা। তুমি বোধ হয় একটা কিছু করবে। খুব বড় কিছু। অল মাই গুড উইশেস।

আপা লাজুক হেসে বলে, কাকাবাবু, শুভেচ্ছা খুব ভাল। আরও ভাল কী জানেন?

কী বলো তো! আবার বোধ হয় তুমি চমকে দেবে আমাকে! মনে রেখো, আমার হার্ট কিন্তু জখম। এমন কিছু বোলো না যাতে হার্ট ডিগবাজি খায়।

আপা খুব হাসল। বলল, না, সেরকম কিছুই নয়। আমি বলতে চাই শুভেচ্ছার চেয়ে বেশী দরকার সহযোগিতা। কোঅপারেশন। আমার সঙ্গে একদিন পায়ে হেঁটে ঘুরবেন?

ও বাবাঃ! মরে যাবো যে!

আপা মাথা নেড়ে বলে, কিছু হবে না। প্রত্যেকটা মানুষই আলাদা আলাদা গল্প। যত জানবেন তত মজা। মিন্টো পার্কের কাছে দেখবেন যখন ট্র্যাফিকে গাড়ি থামে। তখন একটা লোক রেড ক্রসের কোটো ঝাকিয়ে পয়সা চায়। আর একটা লোকও এ কাজ করে চৌরঙ্গীর মোড়ে। আমি দুজনকেই পাকড়াও করেছিলাম। ওরা কেউ রেড ক্রসের লোক নয়। আসলে ওভাবেই ভিক্ষে করে। এ দেশে যার যা আছে বা নেই। সবাই সেই আছে বা নেইকে একটা ব্যাপারেই লগ্নি করতে চায়। সেটা হল ভিক্ষে। যার একটা হাত নেই সে সেই নেইটাকে ভিক্ষের কাজে লাগায়। ভিক্ষে করতে কে আমাদের শেখাচ্ছে জানেন? আমাদের সরকার। সরকার নিজেই পৃথিবীতে সবচেয়ে নির্লজ্জ ভিখিরি। এ দেশে। কত সম্পদ আছে, কোথায় কী পাওয়া যায়, আমাদের সত্যিকারের অভাব কতখানি তা কেউ খুঁজে দেখেনি আজ অবধি। খুঁজলে হয়তো দেখা যাবে, আমাদের দেশে রিসোর্সের অভাব নেই। শুধু খুঁজে দেখা হয়নি, এই যা।

মণীশ চোখ বুঝে কিছুক্ষণ ভোবল। তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, অথচ তোমার তো আঠেরোর বেশী বয়স নয়, তাই না। আপা?

আপা সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি একটু বেশী পাকা, না কাকাবাবু? আমার মাও সেই কথাই বলেন।

এ বয়সে এতটা ভার মাথায় নিয়েছে, তোমার সাহস তো সাজঘাতিক।

আমি আরও অনেক বেশী ভার নিতে চাই।

তুমিই বোধ হয় আমাদের ভাবী প্রধানমন্ত্রী!

ঠাট্টা করছেন কাকাবাবু?

না। আপা, ঠাট্টা করছি না। তুমি আমাকে সবসময়েই অবাক করে দাও। এইসব কথাগুলি তোমাকে কেউ শেখায়নি তো। আপা? তুমি কি নিজে ফিল করো?

খুব ফিল করি। কাকাবাবু। এত বেশী করি যে, আমার জীবনে একটুও শান্তি থাকে না। মাথা এত গরম হয়ে যায় যে, রাতে ঘুম আসতে চায় না।

মণীশ দুঃখিত মুখে বলল, তোমার তুলনায় আমার ছেলেমেয়েরা কত নাবালক আর নাবালিকা রয়ে গেছে।

আপা গম্ভীর মুখ করে বলে, আজকাল সব ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলারাই নিজেদের ছেলেমেয়েকে বোতলবন্দী করে রাখতে চায়। তাদের দোষও নেই। সমাজে নানারকম দূষণ বাড়ছে তো। কিন্তু মুশকিল হল, চারদিকে দূষণ বেড়ে গেলে তার কিছুটা ঘরের মধ্যেও ঢুকে পড়বেই। ঘরের পাশে বেড়াল মরে পড়ে থাকলে ঘরে পচা গন্ধ আসবে না? আবর্জনা জমে থাকলে মশা মাছি তো তার কিছুটা ঘরেও ছড়িয়ে দিয়ে যাবে। যাবে না, বলুন?

হ্যাঁ আপা।

আমাদের বাড়ির কাছেই একজন মাতাল থাকে। মদ খেলেই সে ভীষণ গালাগাল করে। কখনও একে, কখনও ওকে। আমাদেরও মাঝে মাঝে গালাগাল করেছে। আমরা নাকি তামিলনাড়ু থেকে এসে পশ্চিমবঙ্গকে লুটেপুটে খেয়ে নিচ্ছি। আমার মা আর বাবা ভয় পেয়ে ওদিককার জানালা বন্ধ রাখত। কিন্তু আমি বুঝলাম, ওটা কোনও প্রতিকার নয়। আমি সেই মাতালটার সঙ্গে আলাপ করে ফেললাম। সে বস্তির লোক, গরিব, চোর এবং রাগচটা। প্রথমটায় ভোব করতে চায়নি, সন্দেহ করেছিল। তার বউ, ছেলে আর মেয়েরাও একটু কেমন যেন অ্যাগ্রেসিভ টাইপের। তবু আমি লেগে রইলাম। এক মাস ধরে রোজ গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা করতাম, জিজ্ঞেস করতাম তারা কেমন আছে। একটু একটু করে ভাব হয়েই গেল। আমি লোকটার কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি, সে কেন সবাইকে গালাগাল করে। লোকটা জবাব দিতে পারেনি। তখন বুঝতে পারলাম, ওর রাগটা বিশেষ কারও ওপর নয়। ওর মনটাই বিগড়ে গেছে। মদ খেলেই ভিতরের নানারকম জমেথাকা বিষ গালাগাল হয়ে বেরিয়ে আসে। তখন আরাম পায়। খুব সহজ লোক, ওকে বুঝতে অসুবিধে হয় না। এখন সে আমার খুব বন্ধু।

তাকে মদ ছাড়াতে পেরেছো?

আপা মাথা নাড়ে, না কাকাবাবু। ওটা ছাড়া সোজা কথা নয়। চেষ্টা করছি। বিষ-মদে কত মানুষ মারা যায়। সে সব বলেছি। কিন্তু ওরা তো বিষকে ভয় পায় না, মরে যাওয়াকেও নয়। কিভাবে ছাড়াবো বলুন তো!

তা বটে।

তবে এখন আর গালাগাল দেয় না। ঘরে বসে মাতাল অবস্থায় গজগজ করে খানিকক্ষণ, তারপর ঘুমোয়।

তোমার মতো বুকের পাটা কম মানুষেরই আছে। আমার বাসার পাশেই তো বস্তি, কই আমার তো কখনও ওখানে ঢোকার ইচ্ছেই হয়নি।

ওটাই তো আমাদের মুশকিল। আমরা সব জায়গা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিই, প্রত্যাহার করে নিই। মনে ভাল ভাল ইচ্ছে থাকে, কিন্তু সেগুলো করি না।

তুমি কি আমাকে বকিছো?

না তো কাকাবাবু! ছিঃ, বকিবো কেন? আপনি দারুণ মানুষ একজন।

বকলেও দোষ নেই আপা। তুমি যে খুব নতুন কথা বলছে তা নয়, কিন্তু যেটা বড় কথা তা হল, তুমি যা বলো তা প্র্যাকটিসও করো। আমরা করি না।

আমি আপনাকে অনেকক্ষণ যন্ত্রণা করছি।

না না, আমার খুব সেলফ পিটি হচ্ছে ঠিকই, তবে তোমার কম্পানি খুব ভালও লাগছে। ডোরবেল বাজল নাকি? ওই বোধ হয় বুবকা এল!

বুবকাই। সাদা টি শার্ট, কালো শর্টস, পায়ে দৌড়োনোর জুতো। ঘর্মাক্ত, হাঁফাচ্ছে। ঘরে ঢুকেই মণীশের দিকে চেয়ে বলে, কেমন লাগছে। বাবা? আরে আপা! কখন এলে?

অনেকক্ষণ। বকে বকে কাকাবাবুর মাথা ধরিয়ে দিলুম।

অনীশ এসে সাবধানে তার বাবার বিছানায় একটু আলগোছে বসল। পাছে ধাপ করে বসলে খাটের ঝাঁকুনিতে হাৰ্টবিট বেড়ে যায়। মণীশের। তারা সবাই এখন অত্যধিক বাবা-সচেতন। মণীশের হাতটা নিজের সবল হাতে ধরে নাড়ীটা একটু বুঝবার চেষ্টা করল সে। তারপর বলল, মনে হয় সবই ঠিক আছে, না বাবা?

মণীশ ছেলের মুখের দিকে তৃষ্ণার্তা চোখে চেয়ে থেকে বলে, ঠিকই আছে। ভাবছিস কেন? আপা কত ফুল নিয়ে এসেছে দেখ, তোর মাকে বল সামনের ঘরে সাজিয়ে রাখতে।

ফুল! বলে অবাক হয়ে অনীশ আপার দিকে তাকায়, তুমি ফুল এনেছো নাকি? এ তো ভাবা যায় না।

আপা সামান্য লজ্জা পেয়ে বলে, ফুলটা আজ পাগলামি করে কিনে ফেললাম। কাকাবাবুকে একটু ইমপ্রেস করব বলে।

আমি খুব ইমপ্রেসড আপা। থ্যাংক ইউ।

কাকাবাবু, আপনার কি হাঁটাচলা বারণ?

মণীশ মুখটা একটু বিকৃত করে বলল, ডাক্তারদের কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না। বলেছে ফুল রেস্ট। তার মানে শুয়ে থাকা কিনা আমি জানি না। তবে আমার এইসব অফশুটরা আমাকে শুইয়েই রেখেছে। এমন কি পাশ ফিরতে অবধি দিচ্ছে না। সাতদিন এভাবে থাকলে আমাকে বোধ হয় পাগলাগারদে পাঠাতে হবে।

আপনার নিজের কেমন লাগছে?

খুব উইক, কিন্তু উঠতে বা একটু-আধটু চলাফেরা করতে কোনও অসুবিধে নেই।

তাহলে উঠে পড়ুন তো! চলুন ডাইনিং টেবিলে বসে একটু কালো কফি খাবেন।

বুবকা ভ্রূ কুঁচকে বলে, খুব ডাক্তার হয়েছো, না? মাথা-ফাতা ঘুরে গেলে কি হবে?

আপা একটা ছোট্ট ধমক দিয়ে বলে, চুপ করো তো! আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে মস্ত এক হার্ট স্পেশালিস্ট থাকেন। আমি প্রায়ই তাকে অ্যাসিস্ট করি। কত কিছু জানি, তুমি ধারণাও করতে পারবে না। রুগীকে রুগী বানিয়ে ফেলে রাখা মানে জানো? বিশেষ করে যারা হার্ট পেশেন্ট! একজরশান না করে যতদূর সম্ভব নরমাল রাখতে হয়। তোমরা কাকাবাবুকে জড়ভরত বানাতে চাও নাকি? আপনি উঠন তো কাকাবাবু।

মণীশের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে বলে, তোমার কাকিমারও একটু পারমিশান নিয়ে এসো। নইলে হয়তো রাগ করে কথা বন্ধ করে দেবে। বেশী শুয়ে থাকলে তো বেডসোরও হয়, না? কথাটা কাকিমাকে বোলো, যাও।

একটু বাদে যখন ডাইনিং টেবিলে তারা কফি ইত্যাদি নিয়ে বসল। তখন অপর্ণা বেজার মুখে বলল, আমার বাড়িতে এত অসুখবিসুখ যে কেন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একজনকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারলাম তো মেয়েটা জ্বরে পড়ল। বুকে সাজঘাতিক কনজেশন, জ্বর এখনও নামেনি। এত টেনশন যাচ্ছে।

তার কথাটাকে কেউ কোনও গুরুত্বই দিল না। হয়তো শুনতেই পেল না কেউ। অনু তার বাবার কানে কানে কী বলছে তার খুব হাসছে দুজনে। আপা আর অনীশ খুব নিবিষ্টভাবে ওদের পড়াশুনোর বিষয়ে কিছু বলছে। টেবিলে অপর্না আলাদা এবং একা। কিন্তু বরাবরই কি সে একা নয়? এ বাড়িতে তার তিন ছেলেমেয়ে আর ওদের বাবা যখন একসঙ্গে থাকে তখন অপর্ণা স্পষ্ট বুঝতে পারে, ওরা এক দলে। সে আলাদা। সে আউট অফ দি সার্কল। বর্জিত, অবহেলিত, উপেক্ষিত।

অথচ অপর্ণা কি প্ৰাণপাত করে দিচ্ছে না। সংসারের পিছনে? সে কি খরচ হয়ে যাচ্ছে না, ক্ষয় হচ্ছে না। এই তার আপনজনদের জন্য? ওরা কখনও কেউ কেন গুরুত্ব দেয় না। তাকে? রান্নাঘরের বাইরে কি তার কোনও ভূমিকা নেই?

সে চারজনের দিকেই চাইল। না, তাকে কেউ লক্ষ করছে না। পাত্তা দিচ্ছে না। সে খামোখা বসে আছে। এখানে। খুব হঠাৎ করে অভিমান হল অপর্ণার। নিঃশব্দে সে নিজের কাপটা নিয়ে রান্নাঘরে চলে এল।

হ্যাঁ, এইটেই তার সঠিক জায়গা। এখানেই তাকে মানায়। ভাবতে ভাবতে চোখে জল এল অপর্ণার। কত ভালবেসে সে বিয়ে করেছিল মণীশকে। কত ভালবাসার ভিতর দিয়েই না এল তাদের তিন সন্তান। টুক-টুক করে বড় করে তোলা ওই তিনজন কেন তার দিকে ফিরেও চায় না? মণীশই কি আজকাল আগের মতো গুরুত্ব দেয় তাকে? খুব ভাল হয় এখন যদি অপর্ণা মরে যায়। তাহলে ওরা হাড়ে হাড়ে বুঝবে অপর্ণা কে ছিল, কী ছিল ওদের সংসারে।

কেন যে তার মতো বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মহিলার আজকাল এত অভিমান হয়! কেন ষে সহজেই চোখে জল চলে আসে! অপর্ণা তার টলটলে জলভরা চোখে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে তেতো পৃথিবীটার দিকে চেয়ে রইল। উথলানো ডালের জল পড়ে গ্যাস নিবে যাচ্ছে, তবু গা করল না।

ক্ষীণকণ্ঠে একটা ডাক বাতাসে পাখির ডাকের মতো ভেসে এল, মা!

রান্নাঘরের পাশেই ঝুমকির ঘর।

ডাকটা শুনল অপর্ণা। নড়ল না। ডাকুক গে।

আবার ডাকটা এল, মা! ও মা!

অপর্ণা চোখ মুছে গম্ভীর মুখে দরজায় এসে দাঁড়ায়, কী বলছিস?

ঝুমকি একেই রোগা। অসুখে যেন বিছানায় মিশে গেছে। নিজের মাথাটা চেপে ধরে বলে, একটু কাছে এসে বসবে?

কেন?

এসো না। কাছে একটি বোসো। আমার কাছে কেউ কেন কখনও আসো না বলো তো!

কাকে চাই? অপর্ণ গম্ভীর গলাতে বলে।

তোমাকে।

অভিমানটা এবার ফেটে পড়ল জল-বেলুনের মতো, আমাকে! আমাকে আর তোমাদের কী দরকার? আমি তো এ বাড়ির কাজের লোকের চাইতে বেশী কিছু নয়।

ঝুমকি রোগা মুখে এবার হাসল, ঝগড়া হয়েছে বুঝি!

মোটেই ঝগড়া হয়নি। কী দরকার বলো, গ্যাসে রান্না চড়ানো।

গ্যাস নিবিয়ে দিয়ে এসো।

অত সময় নেই। বরং তোমার বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।

বাবা! বাবা কি উঠেছে?

বাইরের ঘরে বসে চা খাচ্ছে।

ঝুমকির মুখটা আলো হয়ে গেল, গুড নিউজ মা। তাহলে তোমার মুখ ওরকম ভার কেন?

মোটেই ভার নয়। কাজ আছে। তোমার বাবাকে ডাকছি।

বাবাকে আকণ্ঠ ভালবাসে ঝুমকি। বোধ হয় একবার ইচ্ছে হল, বাবাকে ডাকিয়ে আনার। কিন্তু ইচ্ছেটা সংবরণ করে বলে, না, বাবা নয়। তুমি এসো একটু।

বলছি না, রান্নাঘরে এখন আমি ভীষণ ব্যস্ত। ওই বোধ হয় ডালের জল পড়ে গ্যাস নিবে গেল। গ্যাসের গন্ধ আসছে।

রান্নাঘরে গিয়ে ছোট ঝামেলাটা সামলাতে সামলাতেই আরও দুবার ঝুমকির ডাক শোনা গেল। আর পারে না। অপর্ণ। সুমকির কাছে এসে কপালে হাত দিয়ে বলল, জ্বরটা কি আছে? আমার তো জল-হাত, বুঝতে পারছি না।

নেই মা। আজ সকালে ছেড়ে গেছে। তুমি বোসো একটু আমার কাছে।

গোমড়া মুখে অপর্ণ বিছানার একপাশে বসল।

তুমি কি কেঁদোছো মা? চোখ ছলছল করছে কেন?

কাঁদিনি।

কেঁদেছো। তোমাকে যে আমি ভীষণ চিনি।

লক্ষ করো নাকি? আমি যে একজন মানুষ এ সংসারের এক ধারে পড়ে আছি। এটা কি মনে থাকে?

মাথাটা অপর্ণার কোলের দিকে নামিয়ে দেওয়ার একটা চেষ্টা করে বলে, তুমি কি খুব অ্যাটেনশন চাও মা?

মোটেই সে কথা বলিনি। তোমরা ব্যস্ত মানুষ, আমার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় কোথায় তোমাদের?

ঝুমকি হাসল, কিন্তু এটা তো জানো, সবাইকে ছাপিয়ে কিন্তু তুমি, তোমাকে কখন দরকার জানো? যখন মন খারাপ লাগে, একা লাগে, যখন ভয় পাই, তখন সারা পৃথিবীতে এই একজনকেই সবার আগে মনে পড়ে। তা জানো? বাইরের মনোযোগটা বড় কথা হল বুঝি? তুমি যে আমাদের মন সত্তা সব জুড়ে আছো!

অপর্ণার বাঁ হাতখানা আপনা থেকেই ঝুমকির মাথায় বিলি কাটতে লাগল। আর চোখের বাঁধ ভেঙে জল পড়তে লাগল ফোঁটায় ফোঁটায়। তারপর ধারায়।

Category: পার্থিব - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০২৩. বনগাঁয়ের জমাটি অঞ্চলে নয়
পরবর্তী:
০২৫. খোঁচাখুঁচি করা হেমাঙ্গর একটা বদ অভ্যাস »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑