1 of 3

০২২. প্লেন চলেছে ভোরের দিকে

প্লেন চলেছে ভোরের দিকে। আলোর দিকে। পূর্বাচলে। নিচে অন্ধকার পৃথিবী। আলো ঝলমল নোম ছেড়ে একটু আগেই আবার কালো আকাশে উঠে এল তারা। লন্ডন থেকে অনেক ইতালিয়ান উঠেছিল, রোমে তারা নেমে যাওয়ায় প্লেন এখন ফাঁকা। আইন সীটের হ্যান্ডরেস্ট তুলে দিয়ে অনেকে লম্বা হয়ে ঘুমোচ্ছ। কৃষ্ণজীবন কখনও প্লেনে ঘুমোতে পারে না। বছরে দু তিনবার সে বিদেশে যায়, সারা বছর দেশের এ-শহর ও-শহর উড়ে বেড়ায়, অজস্র মিটিং সেমিনার, কনফারেন্স উপলক্ষে। তবু প্লেনে ঘুমোতে গেলেই এখনও তার একটা গ্রাম্য ভয় এসে বাধা দেয়। প্লেন যদি হঠাৎ ক্র্যাশ করে। প্লেন ক্র্যাশ করলে জাগা বা ঘুমোনো দুটোই যে সমান তা কি কৃষ্ণজীবন জানে না? তার ভয়টা বড়ই অযৌক্তিক, তাই গ্রাম্য। এত ওপরে ওঠার তো কথা ছিল না তার। বোধহয় তাই আজ পতনের ভয়।

আর একটা গ্রাম্যতা আছে তার। প্লেনের উইন্ডাে সীটে বসবার লোভ। এই লোভে সে এয়ারপোর্টে চলে আসে খুব তাড়াতাড়ি। যদি জাম্বা জেট অনেক ওপর দিয়ে যায় এবং নিচে নিমেঘ আকাশ ও দিনের আলোতেও তেমন কিছু দেখা যায় না, শুধু রিলিফ ম্যাপের মতো ভূমিখণ্ড বা নিজীব সমুদ্র ছাড়া। তবু সে জানালার ধারে বসতে চায় এবং উদগ্র আগ্রহ নিয়ে বাইরে চেয়ে থাকে।

তার ভিতরে এখনও অনেক ছেলেমানুষী আছে, অনেক গ্রাম্যতা আছে, অপরিণামদৰ্শিতা আছে। বৃষ্টি দেখলে তার আজও ভিজতে ইচ্ছে করে। কোঁচড়ে মুড়ি নিয়ে খোসাসমেত শশা দিয়ে খেতে ইচ্ছে করে, মায়ের কাছে বসে শীতের সন্ধেয় আস্কে পিঠে বানানো দেখতে ইচ্ছে করে। নিজের ফ্ল্যাটে বা হোটেলের ঘরে যখন একা হয় তখন হঠাৎ হঠাৎ সে অর্থহীন আগডম বাগড়ম সব শব্দ দিয়ে বেসুরে গান বেঁধে গায় এবং নেচে ওঠে। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলার একটা বড় অভ্যাস তার অনেক দিনের। এইসব নিয়েই সে কৃষ্ণজীবন। সমাজের এক ভারিক্কী মানুষ, গুরুতর মানুষ। অবাক হয়ে সে মাঝে মাঝে ভাবে আমি কি করে এই সব হলাম?

তার ঘড়িতে এখনও লন্ডনের সময়। কিন্তু এই সময় অনুযায়ী মধ্যরাতেই দিল্লিতে ভোর হয়ে যাবে। ভোরের আর খুব বেশী দেরীও নেই। তারা চলেছে আলোর দিকে। ভোরের দিকে। এক উন্নত সভ্যতার সীমানা ছাড়িয়ে গরিব দেশের দিকে। দিল্লিগামী এই ফ্লাইটে সে আরও কয়েকবার এসেছে। মধ্য এশিয়ার ওপরেই ভোর হয়ে যায়। তখন এক ঊষর প্রস্তর আর রুক্ষ পাহাড়শ্রেণী দেখতে পায় সে। সবুজের লেশমাত্র নেই। পাথুরে নিরস সেই পর্বতমালার ভিতর দিয়ে একটি সর্পিল রেখার মতো একটিমাত্র পথ কোন দিগন্ত থেকে দিগন্তে চলে গেছে বাক খেয়ে খেয়ে, পাকসাট মেরে। সমস্ত পৃথিবীও কি ওই ঊষরতার পথে? এক অদ্ভুত আংকিক নিয়মে জনসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। খাদ্য, অক্সিজেন, উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বাসের স্থান, কর্ষণযোগ্য ভূমির সঙ্গে অনুপাত থাকছে না সেই জনসংখ্যার। মানুষের বসতি এগিয়ে গিয়ে গ্রাস করে নিচ্ছে চাষের জমি, জঙ্গল, জলাভূমি। মানুষের কাছে তার সন্তান কতই না আদরের, অথচ পৃথিবীর চোখে সে সন্তান মন্ত বালাই।

প্রকৃতি শোধ নেবে? নির্মম সব রোগ, মহামারী, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস দিয়ে হ্রাস করবে জনসংখ্যা? নাকি মানুষই মারবে মানুষকে বেড়ে যাবে গুপ্তহত্যা, উগ্রবাদ, দাঙ্গা, রাজনৈতিক খুন? মানুষ কি একদিন মানুষেরই মাংস খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে? নিজের তিনটি সন্তানকে কোন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে রেখে যাবে কৃষ্ণজীবন।

ঝিমুনি এসেছিল। অস্বস্তিতে হঠাৎ চটকা ভেঙে সোজা হয়ে বসল সে।

প্লেনে ডিনারটি আজ চমৎকার হয়েছিল। বারবার ঝিমুনি আসছে তার। ঝিমুনির মধ্যেই সে স্বপ্ন দেখছিল, পৃথিবীতে জনসংখ্যা কমানোর জন্য নিয়ম হয়েছে, কারও দুটির বেশী সন্তান হলে বাড়তি সন্তানদের কেড়ে নিয়ে মেরে ফেলা হবে। খবরটা শুনেই ইউনিভার্সিটি ফেলে বাড়িতে ছুটে এসেছে কৃষ্ণজীবন, গলা ফাটিয়ে ডাকছে, রিয়া! রিয়া! শীগগির দোলনকে লুকিয়ে ফেল! লুকিয়ে ফেল! ওরা কেড়ে নিতে আসছে। আদিগন্ত বিশাল এক ফ্ল্যাটে কোথা থেকে যেন আলুথালু রিয়া ছুটে আসছে আর পেঁচিয়ে বলছে, দোলনকে যে সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।

দুঃস্বপ্ন! চটকা ভেঙে গেল। একটু শিহরিত হল কৃষ্ণজীবন। অনেকদিন ধরেই একটি অপরাধবোধ কাজ করে তার মনের ভিতরে। তাদের তৃতীয় সন্তান দোলনকে পৃথিবীতে আনা তাদের উচিত হয়নি। পৃথিবীর জনসংখ্যার পক্ষে নিরপেক্ষ অংকের নিয়মে দোলন একটি বাড়তি মানুষ। বাহুল্য। এই একটি বাড়তি মানুষ থেকে জন্ম নেবে আরও কিছু বাড়তি মানুষ। না, দোলনকে আনা তাদের উচিত হয়নি। কিন্তু জন্মের পর কি দোলন ক্রমে তার নয়নের মণি হয়ে ওঠেনি। দোলনকে ছাড়া এই জীবনটার কথা কি ভাবতে পারে কৃষ্ণজীবন? সে মনে মনে শিউরে ওঠে আবার। কিন্তু এও নিৰ্মম সত্য, যে ভাবাবেগ নয়, পরিসংখ্যানই আজ সবচেয়ে সত্য কথা বলে। দোলন বাড়তি, দোলন বাহুল্য। দোলনের জন্যই সে পৃথিবীর কাছে অপরাধী। দোলনের জন্য সে লন্ডনের এক বিখ্যাত দোকান থেকে অনেক দাম দিয়ে নিয়ে এসেছে একটা মন্ত মেকানো সেট, ছবি আঁকার রং, পেনসিল, ভিউ মাস্টার। ভবিষ্যতের পৃথিবী দোলনকে এত আদর করবে কি?

প্লেনের মস্ত পেটের মধ্যে লাগেজ হ্যাচ-এ তার সুটকেসে আরও অনেকের জন্য অনেক কিছু আছে। রিয়া এবং ছেলেমেয়েদের জন্য। কিন্তু সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, এবার সে বিস্মৃতপ্রায় চারটি মানুষের জন্যও কিছু জিনিস কিনেছে। কেন কিনল, কেনার কথা কেন মনে এল, সেটাই সে বুঝতে পারছে না। সম্ভবত লন্ডনের ওয়েম্বলিতে একটা দোকানের মস্ত অখণ্ড কাচে লাগানো একটি গ্রাম্য ছবির পোস্টারই তার জন্য দায়ী। শাড়ি পরা একটি মেয়ে কলসী কাঁখে ঘোর বৃষ্টির মধ্যে আবছা একটা পিছল পথ বেয়ে আগাছার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পুকুরঘাটে নেমে যাচ্ছে। ভারী আবছায়া মায়াভরা ছবি। পিছন ফেরা বলে মেয়েটার মুখ দেখা যায় না। কিন্তু সন্দেহ নেই, ছবিটা গ্রাম বাংলার। অথচ ওয়েম্বলি হল গুজরাতি পাড়া, বাঙালি ব্যবসাদার নেই।

নিরামিষ ডিনার খাওয়াবে বলে তার বন্ধু, লন্ডনের এক স্কুলের অংকের শিক্ষক ভানুভাই তাকে নিয়ে গিয়েছিল গতকাল। সেখানে ফুটপাথে অজস্র জাপানী শাড়ি সস্তায় বিক্রি হচ্ছে। ওসব দিকে নজর দেওয়ার কথা নয় কৃষ্ণজীবনের। কিন্তু পোস্টারটা দেখে সে দাঁড়িয়ে গেল। মেয়েটার পায়ের চারধারে নির্ভুল কচুবন। সামনে তালের ডোঙায় বাধানো ঘাট। অজস্র বৃষ্টির জলধার। বিষ্টুপুর যেন উড়ে এল লন্ডনে। দুটো বোনের কথা ভীষণ মনে পড়ল, যারা জনও কখনও আসবে না বিদেশে, কখনও পরবে না জাপানী সামু সাটিন শাড়ি, অতীতের সব অপমানের ওপর কি বিস্মৃতি আজও পলির আস্তরণ ফেলে যায়নি? ওদের জন্য কখনও তো কিছু নিয়ে যায় না কৃষ্ণজীবন! সে সিদ্ধান্ত নেয় আচমকা, আবেগে।

শাড়িগুলো যেমন সুন্দর, তেমনি সস্তা। ওদের জন্য কিনলে কি রিয়া কিছু মনে করবে? তার ভয় শুধু রিয়াকে।

ভানুভাই তাড়না দিয়ে বলল, আরে লে লো ভাই কুছ মেহেঙ্গা তো নেহি।

না, মোটেই মেহেঙ্গা নয়। তিন পাউন্ড মানে দেদার সস্তা। আর কৃষ্ণজীবনের বিলে সদ্য অর্জিত প্রচুর বাড়তি পাউন্ড। তাদের কৌতূহল দেখে দোকানদারনি মাঝবয়সী গুজরাতি মহিলাও নেমে পড়লেন শাড়ি বাছতে। চমত্তার বিরল রঙের দুখানা শাড়ি মাত্র ছয় পাউন্ডে কিনে ফেলল কৃষ্ণজীবন। তারপরই হঠাৎ মনে পড়ল, রামজীবন আর বামাচরণের বউয়ের কথা। দুই বোনকে শুধু দিলে ভাল দেখাবে কি? সুতরাং আরও দুখানা কিনল সে। এখন দিল্পিগামী বিমানে ভোরের প্রত্যাশায় বসে পৃথিবীর দূষণজনিত দুশ্চিন্তার মতোই একটা মৃদু উদ্বেগ অনুভব করল সে। দেওয়াটা উচিত হচ্ছে কি? সংসারের নিয়ম এর কী ব্যাখ্যা করবে? কেমনভাবে নেবে রিয়া?

মনশ্চক্ষে সেই পোস্টারটা দেখতে পায় কৃষ্ণজীবন। দোকানদারনি বলতে পারেনি, ছবিটা কার আঁকা বা কোন প্রদেশের ছবি। কিন্তু মনটা ভারী স্নিগ্ধ হয়ে যায়। গাছপালা, বৃষ্টি, পুকুরঘাট আর সেই মেয়েটি। কী সুন্দর! যেন তার শৈশবের একটা জানালা খুলে গেল হঠাৎ।

একটা পোস্টারও কত কী করতে পারে।

আবার ঝিমুনি এল কৃষ্ণজীবনের।

হাই।

আরে অনু! কী খবর?

অনু তার সুন্দর ঠোঁটদুটি ভেঙে হাসির উৎস খুলে দিয়ে বলে, ভাল আর কই! ভালবাসা পেলে লোকে ভাল থাকে, তাই না? আমাকে তো কেউ ভালবাসে না!

তাই বুঝি? কেন তোমাকে কেউ ভালবাসে না? তুমি তো লাভেবল।

মোটেই না। আমার বাবা আর মায়ের সব ভালবাসা নিয়ে নেয় আমার দাদা আর দিদি। আমি বাড়িতে থাকি অরফ্যানের মতো।

অত সহজ নয়। মা আর বাবার ভালবাসা কি অত সহজে মাপা যায়? সে ভালবাসা তো শুধু আবেগ নয়, তাতে শাসন, নিয়ন্ত্রণ, দায়িত্ব, উদ্বেগ সব মিশে থাকে। ওটা বুঝতে একটু সময় লাগে।

তাই বুঝি? আমার কি বুদ্ধি নেই? আমি কি বুঝি না?

আমার বড় দুই ছেলেমেয়েও বোধহয় তোমার মতোই ভাবে। তারা বোধহয় ভাবে, আমি তাদের ভালবাসি না। সেটা তাদের বোঝার ভুল এবং কমিউনিকেশনের অভাব।

ইউ আব নট ক্যাপেল অফ লাভিং। সেইজন্যই তো আমি ফিলাডেলফিয়া চলে যাচ্ছি, সুমনের কাছে।

সুমন! সে কে বলো তো!

আপনি বুঝি আমার সব বয় ফ্রেন্ডকে চেনেন। সুমন সিং আমার বয়ফ্রেন্ড। দারুন স্মার্ট। ইন দি মেকিং অফ এ বিগ ডক্টর।

বয়ফ্রেন্ডের কাছে যাচ্ছো! তার সঙ্গেই থাকবে নাকি?

হোয়াই নট! উই উইল লিভ টুগেদার।

সে কী?

অনু কাঁধ দুটো ঝাঁকিয়ে বলে, সো হোয়াট! আমাদের সময়ে আমরা আদ্যিকালের সব নিয়ম আর ভ্যালুজ উড়িয়ে দেব। আমরা মানি না যে, ম্যারেজস আর মেড ইন হেভেন। লিভ টুগেদার করলে কত সুবিধে বলুন তো!

কৃষ্ণজীবন অনুর দিতে চেয়ে বলে, যদি গিয়ে দেখতে পাও যে, সুমনও আর একটা মেয়ের সঙ্গে বসবাস করছে?

অনু ফের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, সে হোয়াট? আমি তো আর জেলাস টাইপের নই। সুমন না চাইলে আমি আর একজন ফ্রেন্ডকে খুঁজে বের করে নেবো।

হতাশ মৃত কণ্ঠে কৃষ্ণজীবন বলে, তুমি এরকম কেন অনু? নর-নারীর সম্পর্কের মধ্যে কি কোনও রচনা নেই। কোনও নির্মাণ নেই?

অনু খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, আপনি ভীষণ ওল্ড টাইমার।

তা হবে।

হঠাৎ অনু তার দিকে ঝুঁকে মুখের পানে সকৌতুকে চেয়ে থেকে বলে, রাগ করলেন?

কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলে রাগ নয়। মনটা খারাপ লাগছে।

আচ্ছা, আপনি কেন নিজেকে বদলাতে পারেন না বলুন তো!

বদলাবো! কেন বলো তো!

আপনি ভীষণ সেকেলে, কুসংস্কারাচ্ছন্ন আর ইনস্টিটিউশন্যাল, তাই না?

তাই নাকি?

তাই-ইতো। নইলে কেন ম্যারেজটাকে এত ভ্যালুয়েবল মনে করেন?

ম্যারেজ থেকেই তো ফ্যামিলি, আর ফ্যামিলি থেকে ক্ল্যান। পরিবার হল মানুষের ভিড়। তার শিকড়। পরিবার না থাকলে মানুষ পরগাছার মতো হয়ে যায়, যাযাবরের মতো জীবনযাপন করে।

আপনার পরিবার কি আপনাকে শিকড় মেলতে দিয়েছে? তাহলে আপনি কেন আর গায়ের বাড়িতে যান না? আপনার নিজের পরিবারের সঙ্গে কেন আপনার মাখামাখি নেই।

কৃষ্ণজীবন মাথা নেড়ে বলে, তোমার দেখার মধ্যে একটু ভুল আছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু পরিবার মানুষকে কিছু একটা দেয়ই। সেটা হয়তো তার একটা পরিচয়, একটা পদবী, একটা ঠিকানা। আর এই আইডেন্টিটিই তাকে লক্ষ কোটি মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যেতে দেয় না।

আমি তো হারিয়েই যেতে চাই। কি হবে বাবা-মা-ভাই-বোন আঁকড়ে থেকে বলুন তো! আমার তো একদম ভাল লাগে না। বাবা-মায়েরা ভীষণ ন্যাগিং টাইপের হয়, ইচ্ছেমতো চলতে দেয় না, এটা বারণ করে, সেটা বারণ করে। আমাকে আমার মতো হতে দেয় না কিছুতেই।

তুমি কিরকম হতে চাও?

আমি আমার মতো হতে চাই। আমার ইচ্ছেমতো যা-খুশি হবো, যা-খুশি করব। কোনও প্রম্পটার চাই না। লাইফ ইজ নট এ গাইডেডর টুর।

কৃষ্ণজীবন সামান্য ঘামতে থাকে দুশ্চিন্তায়। অনুর দিকে চেয়ে থেকে বলে, তাই তুমি ফিলাডেলফিয়া চলে যাচ্ছো?

আবার ঠোঁটের মনোরম একটা ভঙ্গি করে অনু বলে, যেতাম না তো, যদি এখানে কেউ আমাকে ভালবাসত।

তুমি জানো না, তোমাকে কতটা ভালবাসেন তোমার মা আর বাবা।

ওরকম ভালবাসার কথা বলছি না। আই অ্যাম টকিং অ্যাবাউট রোমান্টিক লাভ।

ওঃ, মাই গড! রোমান্টিক লাভ! তার জন্য তো বয়স পড়ে আছে তোমার সামনে।

এইটেই তো ঠিক বয়স। আর বেশী বয়স হলে আমার মন যে হিসেবী হয়ে যাবে। ভাঙচুর করতে পারব না যে।

ভাঙচুর করতেই হবে?

করুণ মুখ করে অনু বলে, নইলে যে কেউ আমাকে ইস্পার্ট্যান্স দিচ্ছে না। টিন এজার বলে ভীষণ নেগালেক্ট করছে!

ওটা তোমার ভুল ধারণা। কেউ তোমাকে নেগলেক্ট করছে না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে মানুষ একটু বেশী সেন্টিমেন্টাল হয়, তাই সবাই নেগালেক্ট করছে বলে ভাবে।

অনু মাথা ঝামরে বলে, অন্তত একজন তো করছেই। আর তার জন্যই তো আমি সুমন সিং-এর কাছে চলে যাচ্ছি। রাগ করে।

কে নেগালেক্ট করছে তোমাকে?

আপনি।

আমি! বলে ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়ে কৃষ্ণজীবন, আমি তো কই তোমাকে নেগলেক্ট করি না। কত আড্ডা দিই তোমার সঙ্গে।

তাই বুঝি! আমি কিন্তু ঠিক টের পাই, আপনি আমাকে একদম পাত্তা দিতে চান না। ইউ আর ম্যারেড টু ইওর ওয়াইফ, ইউ আর ম্যারেড টু ইওর ওয়ার্ক, ইউ আর ম্যারেড টু ইওর ফ্যামিলি, আমার জন্য আপনার একটুও ভালবাসা নেই।

আচ্ছা বাবা আচ্ছা। কী করলে প্রমাণ হবে যে—বলে কৃষ্ণজীবন বাক্যটা সঙ্কোচবশে অসমাপ্ত রাখে।

অনু খিলখিল করে হাসে, আগে বলুন, আমার জন্য লন্ডন থেকে কী এনেছেন!

তোমার জন্য? ওঃ, তোমার জন্য … শাড়ি-হ্যাঁ একটা দারুণ শাড়ি!

দুর! শাড়ি আমি পরি নাকি?

তাহলে?

এক বাক্স চকোলেট আনলেন না কেন?

চকোলেট! বলে হাঃ হাঃ করে হাসতে চেষ্টা করল কৃষ্ণজীবন। কী ছেলেমানুষ! বালিকা বললেই হয়।

একটা এয়ারপকেটে জপ করে কিছুটা নেমে গেল প্লেন।

চটকা ভেঙে চোখ চাইল কৃষ্ণজীবন। না, লজ্জার কিছু নেই। স্বপ্ন স্বপ্নই। তবু নিচে উষর এক পাথুরে ভূখণ্ডের উপর ভোরের অপরূপ আলোর দিকে চেয়ে নিজের কাছে নিজেকেই লুকোতে ইচ্ছে করে কৃষ্ণজীবনের। অনুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার মধ্যে কোনও গোপন পাপ নেই তো মনে?

মন বড় বিচিত্র এক জিনিস। কিছুতেই তার টিকির নাগাল পাওয়া যায় না। মন কতভাবে যে নাকল করে বেড়ায় মানুষকে। নইলে সে কেন তার অবচেতন মনেও অনুর চিন্তা পোষণ করবে? কোনও মানে হয় এর?

গায়ের আর একটা জিনিস সঙ্গে করে এনেছে কৃষ্ণজীবন। খিদে। তার প্ৰেশার, ব্লাড সুগার, কোলেস্টোরেল নেই। সেজন্য বাঘের মতো খায়। তার খিদে প্ৰচণ্ড, ব্রেকফাস্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে গোটা ট্রে চোখের পলকে উড়িয়ে দিল।

দিল্লি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে সারাটা দিন পড়ে থাকতে হল কৃষ্ণজীবনকে। সে রিক্লাইনিং চেয়ারে পড়ে পড়ে ঘুমোলো। তারপর বিকেলে ধরল। কলকাতার প্লেন।

উইসকনসিন ইউনিৰ্ভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও গবেষণার চাকরির একটা প্ৰস্তাব তার কাছে এসেছে। মনস্থির করতে পারে না কৃষ্ণজীবন। সে গায়ের ছেলে। গরিব গ্রাম, গরিব দেশ। আমেরিকায় গেলে সে লোভনীয় চাকরি পাবে, থাকবে মহা আরামে। তার চেয়েও বড় কথা, তার কাজের পরিসর বেড়ে যাবে অনেক। খুব খুশি থাকবে রিয়া এবং তার তিন ছেলেমেয়ে। সবই ঠিক। তবু বিদেশে বসবাসের কথা ভাবলেই কেন যে তার ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে। এই নোংরা, গরিব, জনাকীর্ণ অকৃতজ্ঞ স্বদেশ কেন যে তাকে সম্মোহিত করে রেখেছে কে জানে! না, কোনওদিনই দীর্ঘ প্রবাস তার সহ্য হবে না।

চারটে শাড়ি নিয়ে রাতে রিয়া তার বিষ ওগরাল।

কেন ওদের শাড়ি দেবে? ওরা কি তোমাকে চেনে? দাদা বলে খাতির করে? ঝগড়ার সময় তো পারলে গলাধাক্কা দিয়েছিল।

কৃষ্ণজীবন ব্যথাহত মুখে বলল, সংসারে তো ভুল বোঝাবুঝি হয়। তা বলে সম্পর্ক তো মিথ্যে হয়ে যায় না।

ও সম্পর্ক কোনও সম্পর্কই নয়। চুকেবুকে গেছে, ওদের নিয়ে ফের মাতামাতি শুরু করলে পেয়ে বসবে।

আমি ওদের কখনও কিছু দিই না। কখনও না। সব লেনদেনই তো বন্ধ। এটা কি ভাল?

লেনদেনের কথা বলছে। তাহলে বলি, সম্পর্ক থাকে দেওয়া আর নেওয়ার মধ্যে। তুমি তো দিলে, ওরাও কিছু দিক। এই তো সেদিন বীণা হঠাৎ করে এসে হাজির। হাতে দু টাকার মিষ্টির বাক্সও তো ঘরে আনেনি ভাইপো-ভাইঝিদের জন্য!

অবাক হয়ে কৃষ্ণজীবন বলে, বীণা এসেছিল? ‘

তুমি লন্ডন যাওয়ার তিন চারদিন পর।

কী বলল?

কী আবার বলবে! বোধহয় দাদার সংসারটা একটু দেখে গেল, গিয়ে কৃটিকচালি করবে। বরটা তো একটা হাঁদা গঙ্গারাম।

কিছু বলেনি? কোনও দরকারের কথা?

না। হয়তো তোমাকে পেলে বলত।

কৃষ্ণজীবন একটা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে বলে, তোমাকে ভয় পায় ওরা। তাই কিছু বলেনি। হয়তো বিপদে পড়ে এসেছিল।

তার মানে তোমার মাথায় হাত বোলাতে। তোমার ওই বোনটি কিন্তু সোজা পাত্রী নয়। শুনতে পাই সে যাত্ৰা থিয়েটার করে বেড়ায়। চরিত্রের কোনও বালাই নেই। স্বামীটা তো মেনিমুখো। খুব সাবধোন কিন্তু। পেয়ে বসবে। একবার সাহায্য করলে বারবার করে যেতে হবে।

কৃষ্ণজীবন এখনও সংসারের সব প্যাঁচ বোঝে না। তবে সে বিমর্ষ বিবৰ্ণ মুখে বসে রইল। কথাটা মিথ্যে নয় যে, বীণাপানি যাত্রায় নেমেছে।

রিয়া গম্ভীর মুখ করে বলে, কিছু মনে কোরো না, তোমার যা স্ট্যাটাস, যা নাম, তাতে এইসব সাব স্ট্যান্ডার্ড লোকজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা ভীষণ বেমানান। কথাটা যতই খারাপ শোনাক, কিন্তু খুব সত্যি।

কৃষ্ণজীবন একটাও কথা বলতে পারল না। হার মেনে নিল। রিয়া শাড়ি চারখানা তুলে রাখল। তার নিজস্ব আলমারিতে। চিরকালের মতো।

রাতে ঘুম হল না। কৃষ্ণজীবনের। কেন যে খুব মনে পড়ছে ওদের কথা! তার ভাইবোন যদি নষ্ট হয়ে দিয়ে থাকে। তবে তা কার দোষ? ওরা যদি সাব স্ট্যান্ডার্ড থেকে গিয়ে থাকে। তবে তা কার দোষ? তার সঙ্গে যে ওদের যোজন যোজন তফাত হয়ে গেল সে কার দোষ? ছোট্ট বীণা তো তার হাত ধরে ধরে হাটতে শিখেছিল। সাইকেলের রডে পাখির মতো হ্যান্ডেল আঁকড়ে বসে থাকত আর তাকে নিয়ে নিয়ে পাড়ায় টহল দিত কৃষ্ণজীবন। ভাবলে কত কী মনে পড়ে! আর এক বোন সরো, তাকে কত কাল দেখেনি সে। রামজীবন, বামাচরণ, শিবচরণ এদের সবাই যে একদিন লতানে গাছের মতো উদ্বাহু হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে উঠে আসতে চেয়েছিল অন্ধকার থেকে আলোয়। অশিক্ষা, দারিদ্র্য, লাঞ্ছনা, আত্মাবমাননার হাত থেকে আকাশের ঈশ্বর নয়, দাদাকেই তারা বেশী নির্ভর করত।

এগারোতলার ছাদে নিশুত রাতে ভূতগ্ৰস্তের মতো উঠে আসে কৃষ্ণজীবন। আকাশে কালো ঘন মেঘ। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। তুমুল হাওয়া। ফাঁকা ছাদে আলসের ধারে দাঁড়িয়ে বিপুল শহরের অন্ধকার দিগন্তের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে থাকে সে। ভেজে। শীত করে।

উজানে যাবে কি নদী? আবার কি রচনা করা যাবে সব বিস্মৃত সম্পর্ক? নাকি ভুলে যাওয়া ভাল?

সে ঠিক বুঝতে পারে না। শুধু বুঝতে পারে, তার বুকের প্রকোষ্ঠে বড় গোপন একটা ব্যথা হয়। তার চোখে জল আসতে চায়। তার বুক ফাঁকা হয়ে যায় হাহাকারে।

অনেক রাত। বৃষ্টির তোড় বাড়ল সাজাতিক। হাওয়ায় প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণজীবনকে। তবু সে শান্ত ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির অজস্র চাবুক খেল সারা শরীরে। এ যেন তার প্রায়শ্চিত্ত। এ যেন তার নানা অপরাধের গুণাগার। এ যেন মাটি ভুলে গিয়ে বৃক্ষের অনুতাপ।

একসময়ে তার শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল শীতে। হাত পা অসাড়, কান বধির, চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে যাচ্ছিল প্ৰবল

উপর একসময় সিঁড়িতে শরীরের জল ছড়িয়ে ধীর পায়ে নিজের ফ্ল্যাটে নেমে এল সে। দরজা খুলল। গা মুছল। তারপর নিজস্ব স্টাডিতে বসে রইল চুপ করে। বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *