২১
দাদুর কাছে পটল শুনেছে, পুলিন ডাক্তার সব বিদ্যেই জানে। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, কবরেজি, এমন কি চাঁদসী অবধি। অথচ পুলিন ডাক্তারের একটাও পাশ করা নেই। ধরা পড়লে ডাক্তারদাদুর জেল-জরিমানা সবই হতে পারে।
দুই বুড়ো মানুষে কথা হচ্ছিল একদিন, তখন পটল শুনেছে। ডাক্তারদাদু বড়াই করে বলল, আমি থাকলে বিষ্ণুপুর শীতলাতলা কবে ওলাবিবির গরাস হয়ে যেত তা জানো? ম্যালেরিয়া, মা শীতলার দয়া, সান্নিপাতিক, সন্ন্যাস মানুষের কোন রোগ-ভোগ সামাল দিইনি বলো। পাশ-করা ডাক্তার তখন কোথায় ছিল সব! আমি অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথি আলাদা করে ধরি না বাপু, রোগে পড়লে যার যা সয় দিই। গাঁ গঞ্জে সব রকমই লাগে। অনেকের অ্যালোপ্যাথি ওষুধ কেনার পয়সা থাকে না, অনেকের সহ্য হয় না, অনেকে আবার কবরেজির ভক্ত। সব বন্দোবস্ত রাখতে হয়েছিল সেইজন্যই।
পটল বিদ্যের ব্যাপারটা বোঝে না। তবে ডাক্তার দাদুকে তার বেশ লাগে। মজার মানুষ। বাইরের দিকে পাকা একখানা ঘরে ডিসপেনসারি। চারটে বড় বড় আলমারি ভর্তি ওষুধ। মদন কম্পাউন্ডার লোকটিও ভাল। সন্ধেবেলায় বটতলায় হারুর সাইকেলের দোকানে বসে গাঁজা খায় বটে, কিন্তু এমনিতে ভারি হাসিখুশি। কাউকে চটায় না, ঝগড়া করে না। ডিসপেনসারিতে নানা লোক আসে। রুগী তেমন কেউ না এলেও, গল্প করতে মেলা লোক আসে। বুড়ো মানুষই বেশী। তাদের কেউ কেউ ডাক্তার দাদুকে দিয়ে ব্লাড প্রেশার মাপিয়ে নেয়, কেউ বুকটা একটু এমনিই পরীক্ষা করিয়ে নেয়। বাদবাকি সময় গল্প হয়।
পটল মাঝে মাঝে গোপালকে নিয়ে এসে বসে থাকে এক ধারটায়, কাঠের বেঞ্চে। ডাক্তারদাদু অনেকদিন আগেই বলে দিয়েছে, ও হল জন্মের রোগ। ও কি সারে রে!
কত অসুখের তো কত ওষুধ বেরিয়ে গেছে দাদু। পেনিসিলিন, আরও সব কী যেন!
দুনিয়ায় কত বোবা-কালা আছে জানিস? ওষুধ থাকলে কবে সবাই ভাল হয়ে যেত।
তাহলে গোপালের কী হবে?
কি আর হবে! বোবা-কালাদেরও ব্যবস্থা আছে। ডিফ অ্যান্ড ডাম্বদের ইস্কুল আছে, লেখাপড়া শিখতে পারে।
হোমিওপ্যাথিতে তো কত মরো-মরো মানুষও বেঁচে ওঠে। নেই ওরকম কোনও ওষুধ?
থাকলে কি বসে থাকতুম রে! মানুষকে ভগবান অনেক বিদ্যে দিয়েছেন বটে, কিন্তু সবটুকু তো আর দেননি। মানুষ যে ভগবান নয়, এটা যাতে সর্বদা মনে রাখে, সেইজন্যই দেননি।
কথাটা পটলের বিশ্বাস হয় না। ডাক্তারদাদুকে ছেড়ে মাঝে মাঝে মদন কম্পাউন্ডারের কাছেও ব্যাপারটা বলেছে, দাও না একটা ওষুধ মদনকাকা। গোপালের জন্য একটা ওষুধ ঠিক পাওয়া যাবে। ভাল করে খুঁজে দেখ।
মদন অবশ্য সরাসরি না করে দেয় না। এক-আধটা পুরিয়া দিয়ে বলে, দেখ খাইয়ে। ঠাকুরের নাম করে খাওয়াস। শাস্ত্রে বলেছে, মূকং করোতি বাচালং। দেখ কী হয়।
হয়নি। গোপাল এখনও কানে শোনে না। কথাও বলে না।
বটতলায় আগে বুধবারে হাট বসত। হাটেই গাঁয়ের মানুষ হপ্তার বাজার করে রাখত। আজকাল আর সেই দুঃখ নেই। বটতলায় পাকা বাজার বসে গেছে। তবে বুধবারের হাট এখনও হয়। মেলা ব্যাপারী আসে। তাদের মধ্যে এক জড়িবুটিওলাও আছে। নানারকম হাড়গোড়, তেল, ভস্ম, গুঁড়ো, পাথর সব থাকে তার কাছে। ভিড়ও হয়। তার কাছ থেকেও ওষুধ নিয়েছিল পটল। একটা গাছের শেকড় মধু দিয়ে বেটে খাওয়াতে হয়েছিল। কাজ হয়নি।
কিসে কাজ হবে, পটল তা নিয়ে আকাশ-পাতাল ভাবে। আকাশে এরোপ্লেন ওড়ে, চাঁদে মানুষ যায়, অ্যাটম বোমা, টেলিফোন কত কী তৈরি করেছে মানুষ, আর গোপালকে কথা কওয়াতে পারবে না? সে একবার তার বড় জ্যাঠাকে চিঠিতে লিখেছিল, আপনি তো বিলেত আমেরিকা যান। গোপালের জন্য ওষুধ এনে দেবেন? সে চিঠির জবাবে জ্যাঠামশাই লিখেছিল, এর কোনও চিকিৎসা নেই। তবে তুমি বড় হয়ে এটা নিয়ে গবেষণা কোরো। মানুষ চেষ্টা করলে সব পারে।
সাধু-সন্ন্যাসীরা হয়তো পারে। কিন্তু জটাজুটওলা লোক দেখলেই পটল ভয় খায়। তান্ত্রিক শুনলেই তার বুক হিম হয়ে যায়। গোপালের জন্য আজও সে কোনও সাধুকে ধরতে পারেন। তবে জলপড়া, চরণামৃত খাইয়েছে অনেক।
গোপাল যদি কথা বলতে পারত তাহলে তাকে দাদা বলে ডাকত। দুই ভাইয়ে কত প্রাণের কথা হত। সে যখন কথা বলে তখন গোপাল একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। চেয়ে থাকলে গোপাল খানিকটা তার কথা বুঝতেও পারে। পেনসিল, বই, এক গেলাস জল, মাদুর, ঘটি এসব আনতে বললে ঠিক এনে দেয়। কিন্তু না তাকালে বুঝতে পারে না।
পটল মনে মনে ঠিক করে রেখেছে বড় হয়ে সে ডাক্তার হবে। ডাক্তার হওয়া শক্ত। পড়াশুনো খুব কঠিন। তার আগে স্কুলের শেষ পরীক্ষায় খুব ভাল ফল হওয়া চাই। তাই সে আজকাল খুব কষে পড়ে। কিন্তু পড়ার ঝোঁকটা বজায় রাখতে পারে না। দুদিন খুব পড়ল তো চারদিন আর রোখটা রইল না।
ডাক্তারদাদু যে পাশ করা ডাক্তার নয়, তা সে জানে। তবু আজ বৃষ্টি-ভেজা সকালে ভাইকে নিয়ে সে এসে বসেছে ডিসপেনসারিতে। ডাক্তারদাদু একবার চোখ তুলে তাকে দেখে বলল, কী ব্যাপার রে? তোর দাদুর কিছু হল নাকি আবার!
না, দাদু ঠিক আছে। তবে মায়ের বড় দাঁতের ব্যথা হচ্ছে।
কিরকম ব্যথা? নড়ছে নাকি?
তা জানি না, ব্যথা হচ্ছে খুব।
ব্যথার ওষুধ খাইয়ে চাপা দিয়ে রাখ। পরে দাঁতের ডাক্তার দেখিয়ে নিস। পেয়ারা পাতা সেদ্ধ করা জলে মুখ ধুতে বলিস।
ভেজা গায়ে পটল আর গোপাল বেঞ্চে বসে থাকে। ডাক্তারদাদু একটা মোটা বই পড়তে থাকে। মদন তার টুলে চুপ করে বসে থাকে। আজ আড্ডার লোক নেই, রুগী নেই।
ডাক্তার দাদু, একটা কথা বলব?
কি কথা?
ডাক্তার হতে গেলে কী করতে হয়?
কপাল লাগে। কপাল ছাড়া হয় না। আমার দু-দুটো দামড়াকে কত তৈরি করলুম, তা দুটোই ধ্যাড়াল।
খুব পড়তে হয়, না?
না পড়লে কি হয়! পড়াই তো আসল জিনিস। পড়তে হয়, বুঝতে হয়, মাথা খাটাতে হয়। শরীরের মধ্যে কি সোজা যন্ত্রপাতি রে!
একটু দমে যায় পটল। তার তো তেমন মাথা নেই, সে কি পারবে অত শক্ত জিনিস শিখতে? কিন্তু বোবা-কালা ভাইটার মায়ায় মাখানো করুণ মুখখানার দিকে চাইলে তার বুকে একটা জোর এসে পড়ে। তখন মনে হয়, গোপালের জন্যই তাকে ডাক্তার হতে হবে।
ডাক্তারদাদুর বাড়িতে বোধহয় ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে। খুব গন্ধ আসছে। পাশে-বসা গোপাল একটু আনচান করে। তারপর দাদার দিকে মুখ তুলে তাকায়। পটল তার মুখখানার দিকে চেয়েই বুঝতে পারে, ওর খাওয়ার লোভ হয়েছে। তার ভাইটা একটু লোভী। খেতে ভালবাসে। কিন্তু চুরি করে খায় না, না দিলে খায় না। লোভ হলে শুধু পটলকে এসে ঝাঁকুনি দেয়।
পটল উঠে পড়ল। বাইরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। তবে তারা দুজনেই ভিজে ঝুব্বুস হয়ে আছে, আর ভিজলেও ক্ষতি নেই।
কোথায় চললি রে বৃষ্টি-বাদলায়? মায়ের জন্য ওষুধ নিলি না?
দাও।
চারটে ট্যাবলেটের একটা রাংতার পাতা দিল মদনকাকা।
ডাক্তার দাদু বলল, তোদের ইলেকট্রিক লাইন এসেছে নাকি? পরশু দিন যেন তার টানতে দেখলাম।
হ্যাঁ। আর দু’চারদিনের মধ্যেই এসে যাবে।
হুঁঃ! খামোখা পয়সা জলে দিচ্ছে রামজীবন। আমার বাড়িতে তো কবে থেকে আছে, তা হপ্তায় জ্বলে ক’দিন? ভরসা তো সেই হ্যারিকেন লণ্ঠন। আদি সনাতন জিনিস। তা শখ হয়েছে যখন লাগিয়ে নে। রামজীবনের পয়সাটা যে কোত্থেকে আসছে!
আজকাল পটল বড়দের অনেক কথার ভিতরকার অর্থ বুঝতে পারে। আগে পারত না। তার বাবা রামজীবনের যে বাজারে কিছু বদনাম আছে তা সে খুব টের পায়। কিন্তু বাবা বলেই যে, সে গাল পাড়বে, এমন নয়। আসলে বাবাকেও তার বিশেষ পছন্দ হয় না। তার বাবা রামজীবন স্মাগলিং বা চুরি-ডাকাতি গোছরই কিছু করে বলে, সে আবছা শুনেছে। বটতলায় রামজীবনের যে আড্ডা আছে, সেখানে খুব খারাপ খারাপ লোকের জমায়েত হয়। তবে বাবার ওপর তার রাগের কারণ সেসব নয়। রাগ হয়, কারণ মাঝে মাঝে মাতাল হয়ে এসে রামজীবন গোপালকে বড্ড মারে। মারার কোনও কারণই নেই। গোপাল কিছু দুষ্টুমি করে না, দোষঘাট করে না।
বৃষ্টিতে গোপালকে নিয়ে বেরোতেই সামনে ইস্কুলের মাঠে একটা বাজ পড়ল যেন! নীল চোখ-ধাঁধানো আলো দেখেই কুঁকড়ে গিয়েছিল পটল। শব্দটা এত জোরে হল যেন কেউ ঠাস করে গালে থাপ্পড় মারল। আর তারপরই কান দুটোয় যেন তালা লেগে গেল একেবারে।
গোপাল হাঁ করে চেয়ে ছিল পটলের দিকে। অত বড় বাজের শব্দটা ও শুনতেও পায়নি। সবাই বলে, কানে শুনতে পায় না বলেই গোপাল কথা বলতে পারে না। কানটা যদি ভাল হয়ে যায় তাহলেই কথাও কইতে পারবে।
আজ বাজ ঠাকুর ক্ষেপে আছে মনে হয়। বটতলার দিকে একটা আর ঘোষপাড়ার দিকে দুটো বাজ বাতাসে যেন আগুন ধরিয়ে দিল। ভয় হচ্ছে। এত বাজ তো কখনও পড়ে না! আকাশটা যেন আরও কালচে হয়ে এল। বাতাস বইছে রাবণরাজার মতো অট্টহাসি হেসে। বৃষ্টিতে তলোয়ারের ধার। কাদা-মাখা রাস্তায় গোপালকে নিয়ে ছুটতে থাকে পটল।
বাড়ি অবধি যেতে পারল না তারা। বৃষ্টি এত জোরে নামল, আর এত বাতাস যে পথঘাট সব গুলিয়ে গেল। বাজ পড়ছে খুব।
ইস্কুলবাড়ির পাকা দাওয়ায় উঠে পড়ল পটল। গোপাল খুব ঘেঁষ হয়ে দাঁড়ালো তার গায়ের সঙ্গে। ভয় পেলে পটলের সঙ্গে লেপটে থাকে গোপাল।
আজ রবিবার। ইস্কুল বন্ধ। চারদিকটা খাঁ খাঁ করছে। টানা লম্বা দুটো টিনের চালের ঘর নিয়ে ইস্কুল। একটা পাকা দোতলা বাড়ি উঠছিল, সেটার একতলার ছাদ ঢালাই হয়নি, তার আগেই টাকার জন্য কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। চার-পাঁচ বছর ধরে বন্ধ হয়ে আছে, মাঝখানে গাছ উঠেছে, দেয়ালগুলোয় শ্যাওলা।
ইস্কুলবাড়ির দরজা জানালা সব ভাঙা, বেশীর ভাগেরই পাল্লা নেই। তারা দুজনে একটা ঘরে ঢুকে দেখল, একটা ছাগল তার দুটো বাচ্চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভিতরে। মেঝেয় ছাগলের নাদি। বৃষ্টির ঝাপটায় বেঞ্চগুলো সব ভেজা। পাগলা বাতাসে জানালার দু-তিনটে পাল্লা ঠকাস করে বন্ধ হচ্ছে, ফের মচাক করে খুলে যাচ্ছে।
পটল এই ইস্কুলেই পড়ে। এই ইস্কুল থেকে যারা পাশ করে গেছে তাদের মধ্যে একমাত্র বড় জ্যাঠামশাই ছাড়া আর কেউ বড় মানুষ হয়নি। সে কি পারবে ডাক্তার হতে? তবে বড় জ্যাঠামশাইয়ের কথা ভাবলে তার খুব অহংকার হয়। জ্যাঠামশাই ইস্কুলের শেষ পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করায়, ইস্কুল একদিন বন্ধ দিয়েছিল।
ব্ল্যাকবোর্ডে একটা আধখাওয়া অঙ্ক জ্বলজ্বল করছে। মোছা হয়নি। অঙ্কটার দিকে চেয়ে থাকে পটল। বড় ক্লাসের অঙ্ক। সে কিছুই বুঝতে পারে না। এখনও এই ইস্কুলেই তাকে অনেক ধাপ পেরোতে হবে। কত কী জানতে হবে, শিখতে হবে। তারপর পাশ করেও আবার নতুন করে অনেক পড়াশুনো। পড়াশুনোর কথা ভাবতে ভাবতে তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। মাথাটা ঝিমঝিম করে।
বেলা অনেক হয়েছে। গোপাল নানারকম ঘোঁৎ ঘাঁৎ শব্দ করছে। তার খিদে পেয়েছে। খিদে পেলে অমন করে।
টিনের চালে একটা সুপুরির ডোঙা ভেঙে পড়ল। ছাগলটা ম্যা করে মিহি সুরে ডাকল। হঠাৎ তখন ইস্কুলবাড়ির ভূতের কথা মনে পড়ল পটলের। সবাই জানে। ভূতটা হল কমল ঘোষের। এই ইস্কুল তাঁরই তৈরি করা। মরার পরও মায়া ছাড়তে পারেননি বলে ছুটির দিনে নির্জন দুপুরে আর গভীর রাতে নাকি ঘুরে ঘুরে ক্লাসগুলো দেখেন। অনেকেই দেখেছে।
পটল আর দাঁড়াল না। গোপালকে টানতে টানতে বৃষ্টির মধ্যেই ফের বেরিয়ে পড়ল।
ঘোষপাড়ার রাস্তায় পড়ে একবার ফিরে তাকাল পটল। বৃষ্টিতে আবছা ইস্কুলবাড়ির বারান্দায় কি কমল ঘোষ দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ করছে তাদের? গোপালকে টানতে টানতে আরও জোরে দৌড়োতে থাকে পটল। ঘোষপাড়ার পুকুরে দুটো ছেলে গামছা দিয়ে মাছ ধরছে। অনেকক্ষণ বাদে মানুষ দেখে বুকে ফের সাহস ফিরে এল।
বাড়ির মধ্যে একমাত্র দাদুরই কোনও কাজ নেই। মানুষ বুড়ো হলে তাকে আর লেখাপড়া করতে হয় না, ডাক্তার বা মাস্টার হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না, চুপচাপ বসে থাকতে হয়। দাদুকে দেখে তাই মনে হয় পটলের। কি করে যে দাদু শুধু বসে থাকে, তা ভেবে পায় না পটল। সে তো দু মিনিট চুপ করে থাকতে পারে না, কী যেন কুটকুট করে কামড়ায় তাকে, তাড়িয়ে বেড়ায়।
আজ সারাদিন বৃষ্টি হচ্ছে। বাজ পড়ছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হতে চলল, বৃষ্টির থামবার লক্ষণ নেই। উঠোন, বাগান, মাঠঘাট সব একাকার হয়ে গেল জলে। আজ আর কোথাও বেরোনোর নেই পটলের। সারা দুপুর বই কোলে করে বসে থেকেছে পটল। পড়েনি একটা লাইনও। ভেবেছে। বড় হয়ে সে কত বড় ধন্বন্তরী ডাক্তার হবে, জ্যাঠামশাইয়ের মতো কেমন দুনিয়া চষে বেড়াবে, সেইসব ভেবে ভেবেই মাথাটা ভার হয়েছে খুব। বিকেলে একটু ফুটবল খেললে হত। কিন্তু ফিরিঙ্গির মাঠে আজ একহাঁটু জল। ফুটবল নামেইনি। আকাশ আরও ঘোরালো হয়েছে। এ বৃষ্টি সহজে ছাড়বার নয়।
ঘরময় জল। নানা ফুটোফাটা দিয়ে জল পড়ে। ব্যাঙ, পোকামাকড়, সাপখোপ অবধি ঢুকে পড়তে থাকে ঘরের মধ্যে। দেয়ালে বড় বড় কেঁচো বেয়ে বেড়ায়। ঘরের মধ্যে বড় হাঁফ ধরে যায় পটলের।
দুপুরের ঘুম থেকে উঠে দাদু দাওয়ায় বসেছে। গায়ে মোটা একখানা কাঁথা জড়ানো। চেয়ে আছে সুমুখের দিকে। কী যে দেখার আছে, তা বুঝতে পারে না পটল।
নিজেদের ঘরের দাওয়া থেকে দাদুর দাওয়ার তফাত তিন হাতের বেশী হবে না। পটল সেটা লাফ মেরে ডিঙিয়ে গেল।
ও দাদু।
দাদু গম্ভীর মুখখানা তার দিকে ফিরিয়ে বলে, কি রে? ইস্কুলে যাসনি?
আজ, রোববার না!
রোববার বুঝি!
দাদু ওইরকম। বার মাস কিছু খেয়াল থাকে না।
কি করছ বসে বসে?
এই বসে আছি। কি আর করব?
তোমার বসে থাকতে ভাল লাগে?
খারাপ লাগে না। শরীর নেড়ে কিছু তো করার নেই আমার। মনটা সচল রাখতে চেষ্টা করি।
মা যে বলে, অত বসে থাকলে বাত হয়।
তা হয় হয়তো। এখন ডঙ্কা বেজে গেছে, বাতকে আর ভয় কি?
ডঙ্কা বেজে গেছে কেন?
চলে যাওয়ার লগ্ন এসে গেছে রে ভাই।
তুমি কি মরে যাবে দাদু?
তা আর বলতে! পা বাড়িয়ে আছি।
মরে কোথায় যাবে?
বিষ্ণুপদ একটু হাসল, মানুষের বিদ্যেতে এত কিছু আছে, অথচ এ প্রশ্নটার জবাব নেই রে ভাই।
কোথায় সে যায়। নাকি কিছুই থাকে না। কে জানে!
তুমি কমল ঘোষকে দেখেছো?
কোন কমল ঘোষ?
আমাদের ইস্কুলের হেড মাস্টার ছিল না?
ওঃ, সেই কমল ঘোষ! চিনবো না মানে? এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় এসে, সে-ই তো প্রথম ইস্কুল খোলার জন্য আদাজল খেয়ে লাগল। কত দৌড়-ঝাঁপ ধরা-করা করে, গাঁটগচ্ছা দিয়ে তাতে ইস্কুল খুলে একটা কাজের মতো কাজ করল। নইলে চার পাঁচ মাইল ঠেঙিয়ে এ গাঁয়ের ছেলেদের ইস্কুলে যেতে হত। প্রথম দিকে তো প্রায় ভিক্ষে করে ইস্কুল চালাতে হত, মাস্টারমশাইরা মাইনে-টাইনে যৎসামান্য পেত। খুব দুরবস্থা গেছে। তবে কমল ঘোষ ছাড়েনি, দমেওনি। আমার সঙ্গে তেমন বনিবনা হয়নি অবশ্য। আমার বিদ্যে বেশী নয় বলে ইস্কুলে চাকরি দিল না। আমি ভিন গাঁয়ে মাস্টারি করতে যেতাম।
কমল ঘোষ মরার পর তার ভূত দেখনি?
ভূত! না দাদা, সেরকম কিছু তো দেখিনি।
কমল ঘোষ এখন তো ভূত হয়ে ইস্কুলে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সবাই জানে।
বিষ্ণুপদ একটু হাসল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তাহলেও তো একটা সমাধান হয় রে!
কিসের সমাধান দাদু?
ভূত হয়েও যদি থাকা যায়, তো, সেটাও তো মস্ত কথা। থাকাটাই তো আসল কথা, ভূত হয়েই হোক, মানুষ হয়েই হোক।
তুমি কখনও ভূত দেখনি দাদু?
বিষ্ণুপদ একটু বিব্রত হয়ে বলে, লোকে তো দেখে বলে শুনেছি। আছে বোধহয়!
তুমি কখনও দেখনি?
বিষ্ণুপদ একটু চুপ করে থেকে বলে, ভূত কি না জানি না, তবে একবার একটা কাণ্ড হয়েছিল।
বলবে! বলে উজ্জ্বল মুখে দাদুর কাছ ঘেঁষে বসল পটল।
তখন এ জায়গায় আমরা সবে এসেছি। চালচুলোর কোনও ঠিক নেই। যে যেখানে পারছে ঘর বেঁধে মাথা গোঁজার জায়গা করছে। দাঙ্গা হাঙ্গামাও হচ্ছে, ঝগড়া কাজিয়াও হচ্ছে, সরকারী লোক, পুলিশও আসছে, চোর ডাকাত আড়কাঠিরও অভাব নেই। সে একটা অরাজক অবস্থা। বনগাঁ ক্যাম্প থেকে আমাদের এখানকার ঠিকানা দিয়েছিল সরকারী লোকেরাই। সেই অশান্তির মধ্যে অতি কষ্টে একখানা ঘর খাড়া করে আমরা আট দশটি প্রাণী কোনওরকমে আছি। হাতের টাকা ফুরিয়ে আসছে। মা একখানা করে গয়না খুলে দেয়, আমি বা বাবা গিয়ে সেটা বেচে টাকা নিয়ে আসি, তবে দুটো ভাত জোটে। এক বছর খুব কষ্ট গেছে। মায়ের বিছেহার বেচে কিছু চাষের জমি কিনে বাবা চাষবাস শুরু করে দিল। কিন্তু বুড়ো বয়সে ধাক্কাটা সইল না। রোগে পড়ল। আমিও চাষ করতাম, কিন্তু সেইসময়ে মাস্টারির চাকরিটা পেয়ে যাই। জমিটা ভাগে বন্দোবস্ত করে চাকরিটা নিয়ে নিলাম। যাই হোক, বাঁধা একটা রোজগার তো। মাস গেলে ষাট সত্তরটা টাকা তো হাতে আসবে। একেবারে নির্জলা উপোস তো নয়! ইস্কুলটা দূরে। তখনও সাইকেল কেনা হয়নি। হেঁটেই যেতে আসতে হত। তখন শীতকাল। মাঘ মাসই হবে। প্রচণ্ড শীত পড়ত তখন এদিকটায়। মেলা গাছপালা ছিল তো! এত ঘন বসতিও হয়নি তখন। ইস্কুলের শেষ ক্লাস নিয়ে যখন ফিরতাম তখন অন্ধকার হয়ে যেত। জংলা রাস্তা, ফাঁকা মাঠঘাট দিয়ে একা ফিরতে একটু গা ছম্ ছম্ করত। হাঁক মারলে শোনার লোক নেই। একদিন সন্ধেবেলা ফিরছি। সেদিন কুয়াশাও হয়েছে খুব। রঘুনাথপুরের দহ বাঁয়ে রেখে বিষ্টুপুরের দিকে আসছি। সামনে একট জংলা জায়গা ছিল, আঁশফলের জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে সরু পথ। একেবারে নিশুত রাতের মতো নিঃঝুম। শুধু ঝিঁঝি ডাকছে।
পটল আর একটু ঘেঁষে বসল।
বিষ্ণুপদ দূর অতীতের দিকে ধূসর চোখে চেয়ে থেকে ধরা গলায় বলে, জঙ্গলটার মাঝ বরাবর এসেছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম খুব কাছ থেকে কে যেন বলে উঠল, বিষ্ণুপদ, একটু তাড়াতাড়ি যা বাবা। আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। গলাটা খুব চেনা। আমার বাবার গলা। কিন্তু বাবা এখানে এই জঙ্গলে আসবে কি করে? তার তো বিছানা ছেড়ে ওঠারই সামর্থ্য নেই। আমি চারদিকে চেয়ে দেখলাম, কোথাও কেউ নেই। চাপ অন্ধকার আর কুয়াশায় সব ঢাকা। বললুম, কে? কে আপনি? কেউ জবাব দিল না। শুধু একটা পেঁচা ডেকে উঠল আর হুড়ুস করে একটা বাদুড় উড়ে গেল আকাশে। গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল আমার। কথাটা স্পষ্ট শুনেছি। ভুল নেই। কিছুক্ষণ হাত পা সব কাঠ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ মনে হল, গলাটা বাবারই। হয়তো বাবা আর নেই। মনে হতেই প্রায় ছুটতে শুরু করলাম। মাইলটাক পথ পার হয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কান্নার রোল শুনতে পেলাম। এসে দেখি, বাবা আর নেই।
তারপর কী করলে?
বিষ্ণুপদ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, কী আর করব! যা সবাই করে, তাই করলাম সব। তবে ওই একবারই একটা ঘটনা ঘটেছিল। তাই মনে হয়, মরে গিয়েও মানুষের কিছু থাকে। সবটা শেষ হয় না। কিছু একটা থেকে যায়।
সেটাই কি ভূত দাদু?
তা হতেও পারে। তবে আমার আর কতটুকু জানা আছে বল ভাই! কত কী আছে চারদিকে। টের পাই, কিন্তু ধরতে পারি না।