দোকানটায় ঢুকতে একটু লজ্জা করছে হেমাঙ্গর। প্রায় রোজই সন্ধের দিকে এসে হানা দিচ্ছে, একটা জিনিসই রোজ খুঁটিয়ে দেখছে এবং রোজই নানা নতুন প্রশ্ন করছে জিনিসটা সম্বন্ধে— এতে ওরা বিরক্ত হচ্ছে কি?
অবশ্য কোনও দোকানদারই হেমাঙ্গর ওপর বিরক্ত হয় না। যারা মোটামুটি ভাল দোকানদার তারা লোকের মুখ দেখেই অভ্যন্তরকে বুঝে নিতে পারে। এ দোকানটায় দত্ত বলে যে লোকটি আছে তার সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়ে গেছে তার। ধৈর্যশীল দত্ত রোজ তাকে মাইক্রোওয়েভ সম্পর্কে জ্ঞানদান করে। ছাত্রের মতো শেখে হেমাঙ্গ। আর জিনিসটাকে অত্যন্ত পরীক্ষামূলক চোখে দেখে। পরশু দত্ত একটা লাইভ ডেমনস্ট্রেশন দিয়ে দেখিয়েছে, মাইক্রোওয়েভে বাস্তবিকই ছ’মিনিটে ভাত রান্না হয়। এবং তার ফ্যান গালবার দরকার হয় না। চাল আগে থেকে ভিজিয়ে রাখতে হয়। জলটা মেপে দিলে ফ্যান শুষে ভাত ঝরঝরে হয়ে যায়। ঠাণ্ডা চায়ের কাপটি মাইক্রোওয়েভে রাখলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে চা আগুন-গরম হয়ে যায় এবং চায়ের স্বাদগন্ধে কোনও অশুভ বদল ঘটে না। মিয়ানো মুড়ি বা ন্যাতানো বিস্কুট ফের নতুন মুড়ি আর টাটকা বিস্কুট হয়ে ওঠে। ফ্রিজের ঠাণ্ডা জিনিস কয়েক সেকেন্ডে হয়ে যায় পাইপিং হট। সবচেয়ে অদ্ভুত হল, মাইক্রোওয়েভে জিনিসটাই গরম হয়, কিন্তু পাত্রটি নয়। যত দেখছে তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে হেমাঙ্গ। যত মুগ্ধ হচ্ছে ততই লজ্জিত হয়ে পড়ছে ভিতরে ভিতরে। এই সব জিনিস—অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি বা ভোগ্যপণ্যের ছলাকলায় সে যে কেন এত সহজে বশ মানে তা সে ভাল বুঝতে পারে না। মদ মেয়েমানুষ মারিজুয়ানা কি এর চেয়ে বেশী বিপজ্জনক?
খুবই কুন্ঠিত পায়ে, প্রায় নববধূর মতো সে প্রকাণ্ড দোকানঘরটায় ঢুকল। দিব্যি স্প্রিংএর দরজা। ভিতরটা ঠাণ্ডা এবং শব্দহীন। থরে থরে শুধু জিনিস আর জিনিস। যথেষ্ট খদ্দেরের ভিড়।
দত্তই তাকে প্রথম দেখল। বোধহয় শিকারীর চোখে অপেক্ষা করছিল তারই জন্য। দত্তর অভিজ্ঞ চোখ হেমাঙ্গর নির্মোক এবং প্রতিরোধ ভেদ করে দেখতে পাচ্ছে, ভিতরে ভিতরে হেমাঙ্গ ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। হার মেনে নিচ্ছে। দুমাস আগে এই দত্তই তাকে ওয়াশিং মেশিনটা গছিয়েছিল, ঠিক একইভাবে। ধীরে ধীরে। অপেক্ষা করে করে। সুতো ছেড়ে ছেড়ে। আপনজনের মতে, বাল্যবন্ধুর মতো ব্যবহার করে করে। আর ওয়াশিং মেশিনটাও নীরবে নিবেদন করেছিল তার হৃদয়, যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং…
আরে, আসুন স্যার। গুড ইভনিং।
ওই দুর্দান্ত স্মার্ট লোকটা আসলে মাকড়সা। তার চারদিকে এই সব অত্যাধুনিক জিনিসপত্রের মায়াজাল পাতা। আর হেমাঙ্গ নিয়তি-নির্দিষ্ট সেই পতঙ্গ। নইলে স্বক্ষেত্রে হেমাঙ্গ কিছু কম স্মার্ট নয়। নিজস্ব ক্ষেত্রে সেও তো লোককে হিপনোটাইজ করে। তবু এইসব ভোগ্যপণ্যের কাছাকাছি এসে যে কেমন যেন এলিয়ে পড়ে। কেমন যেন আনস্মার্ট, লজ্জাতুর, আত্মবিশ্বাসহীন লাগে নিজেকে।
জিনিস কিনতে সে ভীষণ ভালবাসে। অথচ খামোখা যে এত জিনিস কিনে ঘরে জঞ্জাল বাড়ানো উচিত নয় এটাও সে ভালই জানে। জিনিস কেনা নিয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে তাকে যথেষ্ট ভর্ৎসনা সহ্য করতে হচ্ছে। মনের এই দ্বান্দ্বিক প্রতিক্রিয়া—টু বি অর নট টু বি—তাকে কাহিল করে ফেলছে কি? তাই দত্তের মুখখামুখি সে গোবেচারার মতো দাঁড়িয়ে আছে আজও।
দত্ত সামান্য উঁচু গলায় ডাকল, গৌরী, প্লীজ মিস্টার চট্টরাজকে একটু অ্যাটেন্ড করো।
সাইনবোর্ডের মতো মিষ্টি মেকানিক্যাল হাসি মুখে ঝুলিয়ে গৌরী এল, আসুন স্যার। মাইক্রোওয়েভ তো!
ওই আর কি। বলে হেমাঙ্গর মনে হল, কথাটার আদ্যন্ত কোনও মানেই হয় না। সে ভিতরে ভিতরে এত লজ্জিত ও কুন্ঠিত হয়ে পড়েছে যে, ভেবেচিন্তে সাজিয়ে-গুছিয়ে কিছু বলছে না।
ডিসপ্লে সারকেলে চূড়ান্ত পোজ নিয়ে চারখানা মাইক্রোওয়েভ তাকে একযোগে কটাক্ষে বিদ্ধ করল।
গৌরী-নাম্নী মেয়েটি বলল, আপনি কিন্তু স্যার এটাই পছন্দ করে রেখেছেন। দিস ওয়ান ইজ দ্য বেস্ট। ফুল্লি অটোমেটিক, ব্রাউনিং করা যায়, টাইমার আছে।
এ সবই হেমাঙ্গর মুখস্থ। সে সোফায় বসে গৌরীর মুখের দিকে সম্মোহিতের মত চেয়ে থেকে অন্যমনস্ক হাতে ব্রিফকেস খুলে চেকবই বের করল।
কত যেন একজাক্ট ফিগারটা?
উনিশ হাজার একশো…
সম্পূর্ণ আনমনা হাত চেকের ওপর অংকটা লিখল এবং সই করল, তারপর সেটা ছিঁড়ে মেয়েটার হাতে দিল। সবটাই করল তার হাত। সে নয় যেন।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, আপনার সঙ্গে কি গাড়ি আছে?
আছে।
গাড়িতেই তুলে দেবো তো! নাকি কাল হোম ডেলিভারিতে পাঠিয়ে দেবো?
না না, গাড়িতে তুলে দিন।
ভারী একটা স্বস্তিবোধ করে হেমাঙ্গ। যেন কিছুদিন ধরে একটা টেনশন ও টানাপোড়েন চলছিল মনে মনে। এই ট্রানজাকশনটা হয়ে যাওয়ার পর সে হালকাবোধ করছে। ব্রিফকেসটা বন্ধ করল তার দুটি হাত। হাতই, সে নয়।
ভ্রূ কুঁচকে সে ব্রিফকেসটার দিকে একটু চেয়ে থাকে। সিঙ্গাপুর থেকে কিনেছিল। আসল গুক্কি। এই ব্রিফকেসটাও তাকে ঠিক এরকমই টেনশনে ফেলে দিয়েছিল। কেনার পর শান্তি।
দত্ত এগিয়ে এল।
হয়ে গেল স্যার?
রুমালে ঘর্মাক্ত মুখ মুছে হেমাঙ্গ বলে, শুনেছি মাইক্রোওয়েভে খুব কমপ্লেন হয়। এদের সার্ভিস ভাল তো।
এ গ্রেড। তাছাড়া আমরা তো আছিই। কিছু হলে আমাদের কাছে কমপ্লেন করবেন, উই উইল সি টু ইট।
হেমাঙ্গ জানে, তার মাইক্রোওয়েভে বিশেষ কমপ্লেন হবে না। প্রথম প্রথম কয়েকদিন শখ করে ব্যবহার করবে বটে, তারপর পড়ে থাকবে। যেমন তার অন্যান্য জিনিস রয়েছে পড়ে। মোটর ড্রিভ্ন ক্যামেরা, ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, দুটো ফ্রিজ, দুটো টিভি, দুটো ভি সি আর, এগারোটা ব্রিফকেস, আরও কত কী!
বাড়িটা পাওয়া গিয়েছিল খুব বরাতজোরে। তাদের অনেক বাড়ি কলকাতায়। বেশীরভাগ বাড়িতেই বহু পুরনোকালের ভাড়াটেরা পনেরো বিশ ত্রিশ চল্লিশ টাকা ভাড়ায় বসে আছে। কাউকেই নড়ানো সম্ভব নয়।
আচমকা এই একখানা বাড়ি থেকে এক বহু পুরনো ভাড়াটে চলে গেল। হেমাঙ্গ তার বাবাকে গিয়ে বলল, বাড়িটা আমায় দেবেন? আমি থাকব।
তার মানে? আলাদা হতে চাও নাকি?
না। তবে একটু হাত-পা খেলিয়ে থাকব।
কেন এই এত বড় বাড়িটায় তোমার হাত-পা খেলানোর জায়গার অভাব হচ্ছে নাকি?
কথাটা ঠিক। তাদের বিশাল দুই মহলা বাড়িতে জায়গার অভাব নেই। হেমাঙ্গরা ছয় ভাই, চারজনই বিয়ে করেছে। প্রত্যেকেরই একাধিক কাচ্চাবাচ্চা। তবু জায়গার সমস্যা নেই। সামনের দিকের বাড়িটায় হেমাঙ্গ তিনখানা ঘর নিয়ে যথেষ্ট হাত-পা খেলিয়েই থাকে। তবে অসুবিধে একটাই, বাড়িতে তার অভিভাবকের সংখ্যা বড্ড বেশি। পাঁচ ভাই-ই তার বড়। তাছাড়া বাবা, বাবার ওপরে বিরানব্বই বছর বয়সী দাদু, বিধবা এক পিসি, এক ব্যাচেলর কাকা, মা, এক বিধবা কাকীমা, খুড়তুতো এক দাদা, তার নিজের এক অবিবাহিতা দিদি— সবাই তার অভিভাবক। ফলে প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হয়ে ওঠা তার কপালে হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু কথাটা তো বাবাকে বলা যায় না। সে খুবই বিনয়ের সঙ্গে বলল, বাড়িটা ফাঁকা ফেলে রাখা ঠিক হবে না। আজকাল বাড়ি ফাঁকা রাখলে জোর করে তোক ঢুকে পড়ছে।
হেমাঙ্গর বাবা দুর্গানাথ খুবই অবাক হয়ে বললেন, এ খবর আবার কোথায় পেলে? এটা কি মগের মুল্লুক বলে তোমার ধারণা?
দুর্গানাথ যে খুব কড়া ধাতের লোক তা নয়। বরং রঙ্গরসিকতার দিকেই তাঁর পক্ষপাত এবং স্বভাবে খানিকটা শিথিলতাও আছে। আবার অন্যদিকে অতিকায় ক্ষুরধার বুদ্ধি ও প্রবল পরিশ্রমী। তিন পুরুষের একটি ব্যবসাকে প্রায় একা হাতে ধরে রেখেছেন এবং ফলাও করে তুলেছেন। পশ্চিমবঙ্গের কারখানাগুলিতে শ্রমিক-অশান্তির যে প্রাবল্য রয়েছে, ধর্মঘট-ধীরে চলো-লকআউট ইত্যাদি দুর্গানাথের প্লাগ তৈরির কারখানায় নেই। কোনও অশান্তি নেই তাদের সার্জিক্যাল গুডসের দুটি এবং ওষুধের একটি দোকানেও। সবই নিখুঁতভাবে চলছে। সামান্য অশান্তি দেখা দিলেই দুর্গানাথ সেটিকে গোড়াতেই মেরে দেন। খুব জোরালো যুক্তি ছাড়া দুর্গানাথকে কব্জা করা অসম্ভব। হেমাঙ্গ রণে ভঙ্গ দিল। জোরালো যুক্তি তার ছিল না, শুধু একা স্বাধীনভাবে থাকার একটা প্রবল ইচ্ছা ছিল মাত্র।
গড়চা বাই লেনের বাড়িটার মালিক যে তারাই এটা হেমাঙ্গরা ভুলেই গিয়েছিল একরকম। ভাড়াটে তোলার নিস্ফল চেষ্টা তারা কোনওদিন কোনও বাড়ির জন্যই করেনি। কিন্তু এই বাড়িটার ভাড়াটে মহিমবাবু একদম একা হয়ে গেলেন হঠাৎ। ছেলেমেয়ে দুজনেই অস্ট্রেলিয়ায়, হঠাৎ তাঁর স্ত্রী-বিয়োগ ঘটল। একা বাড়িতে থাকতে পারছিলেন না। তখন ছেলে এসে স্থায়ীভাবে বাবাকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে গেল। তাঁদের যথেষ্ট টাকা, বাড়িটা নিয়ে তারা কোনও ঘোঁট পাকাতে চায়নি।
কিন্তু মুশকিল হল, বাড়ি খালি হওয়ার পর নানা নোক আসছে ভাড়া নেওয়ার জন্য। দুর্গানাথ বিরক্ত হচ্ছেন। আসছে দালাল, রাজনীতির লোক, লোকাল মস্তান। একখানা আস্ত দোতলা বাড়ি খালি পড়ে থাকা সমীচীনও নয়। কলকাতায় যখন এত স্থানাভাব।
দুর্গানাথ একদিন হেমাঙ্গকে ডেকে বললেন, তুমি না গড়ার বাড়িটায় থাকতে চেয়েছিলে?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তোমার মতলবখানা কী?
হেমাঙ্গ একটু আশার আলো দেখতে পেয়ে বলল, আজ্ঞে আমার একটু নিরিবিলিতে থাকার শখ।
এ বাড়িতে কি সবাই তোমাকে উত্যক্ত করে?
না, তা কেন? আসলে এখানে ঠিক প্রাইভেসি নেই তো। লোকজন আসছে যাচ্ছে।
গড়চার বাড়িটা আমার আর ভাড়া দেওয়ার ইচ্ছে নেই। খালিও ফেলে রাখা যাচ্ছে না। তুমি সেখানে গিয়ে থাকতে পার। তবে একটা শর্ত আছে।
শর্ত! শর্ত কিসের?
তুমি এখনও ব্যাচেলর। তোমার পক্ষে একা থাকা বিপজ্জনক। তুমি বরং চট করে বিয়েটা সেরে ফেল, তারপর বউ নিয়ে ও বাড়িতে গিয়ে থাক।
আতঙ্কিত হেমাঙ্গ বলল, আমার ও বাড়িতে যাওয়ার আর কোনও ইচ্ছে নেই বাবা। আমি এখানেই বেশ আছি।
দুর্গানাথ ছেলের অবস্থা দেখে হাসলেন, বিয়ের কথায় ভয় পেয়ে গেলে দেখছি।
আজ্ঞে আমি ওনাদের খুবই ভয় পাই।
শুনেছি মহিলাদের সম্পর্কে তোমার একটু অ্যালার্জি আছে। নারীর প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা এবং তাঁদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখা খুবই ভাল। কিন্তু আতঙ্ক থাকা ভাল নয়। তোমার এই স্বভাবের জন্য তোমার মা-ও কিছু চিন্তিত। থাকগে, তা হলে বিয়েটা করতে চাইছ না?
আজ্ঞে না।
গড়চার বাড়িটা বেশ বড়ই। ওপর নিচে বোধহয় সাত-আটটা ঘর। এতগুলি ঘর নিয়ে একাই থাকবে?
যে আজ্ঞে! একা থাকা আমার খুবই প্রিয়।
দুর্গানাথ একটু হেসে বললেন, গড়চার গলির মধ্যে বাড়ি বলে তোমার বিবাহিত দাদারা কেউই ও বাড়িতে যেতে চাইছেন না। তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ফ্ল্যাটও ফাঁকা পড়ে আছে। বাধ্য হয়ে এখন তোমাকেই পাঠাতে হবে দেখছি। তা ওখানেই রান্নাবান্না হবে, নাকি এ বাড়িতে এসে খেয়ে যাবে! সকালের চা ইত্যাদি করে দেওয়ারও তো লোক চাই।
আজ্ঞে লোক রাখলে একা থাকার ব্যাপারটা নষ্ট হয়ে যায়। রান্না আমি নিজেই করে নেবো।
বলো কি? রান্না নিজে করে নেবে!
চেষ্টা করলে পারব।
পুরূষে মানুষ রাঁধে এ তো কস্মিনকালেও শুনিনি।
হেমাঙ্গ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, বাবা, দুনিয়ার যত বড় বড় হোটেলের ওস্তাদ রাঁধুনীরা সবাই পুরুষ।
দুর্গানাথ একটু হোঁচট খেয়ে গেলেন এ কথায়। বললেন, তা বটে। খেয়াল ছিল না। মহাভারতের ভীমসেনও মস্ত রাঁধুনী ছিলেন। কিন্তু তুমি কি পারবে? সবাই সব কিছু পারে না। তোমার মা শুনলে তো মূর্ছা যাবেন। ভাল করে ভেবে দেখ।
আমি ভাল করে ভেবে দেখেছি। একা থাকব এবং নিজের সব কাজ নিজেই করে নেবো।
ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসনমাজা এসবও করবে নাকি?
ওসবের জন্য একজন ঠিকে নোক রাখলেই হবে।
তার দরকার নেই। বুড়ো দারোয়ান ফটিক আউট হাউসে থাকে। ও সব করে দেবেখন।
হেমাঙ্গ অবাক হয়ে বলে, ও বাড়িতে দারোয়ানও আছে নাকি?
ছিল না। বাড়ি খালি হয়ে যাওয়ার পর ফটিককে কারখানা থেকে ওখানে বদলি করেছি। পাহারা রাখলে বিপদ। ফটিক বিশ্বাসী লোক, সে তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না। ফটকের পাশে একটা কুঠুরিমততা আছে। একা মানুষ, সেখানেই:দিব্যি থাকে। তোমার হঠাৎ একা থাকার বাই যে কেন উঠল কে জানে! শুনেছি তুমি কিছুটা বায়ুগ্রস্ত, সত্যি নাকি?
আপনাকে কে বলেছে?
তোমাকে যারা অহর্নিশ লক্ষ করে তাদেরই এরকম ধারণা।
হেমাঙ্গ সামান্য অভিমানী গলায় বলল, আমাকে অহর্নিশ লক্ষ করাটা কি সকলের উচিত?
সেইজন্যই তো আমি একা থাকতে চাই।
তোমাকে লক্ষ করা হয় লক্ষ করার মতো কিছু আচরণের জন্যই। সেইসব আচরণ যদি একা থাকলে বেড়ে যায়?
আমি কি অ্যাবনরমাল বলে আপনার ধারণা?
দুর্গানাথ ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলেন, আরে না না। অল্পবিস্তর অ্যাবনরমাল আমরা সকলেই। বাড়াবাড়ি না করলেই হল। আমি তো অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ, তাই সন্তানরা কে কেমন হল তা লক্ষও করি না, মাথাও তেমন ঘামাই না। এ ব্যাপারে যাবতীয় চিন্তা থেকে তোমাদের মা, কাকা আর দাদু আমাকে অনেকদিন আগেই রেহাই দিয়েছেন। তাই তোমরা আমার কাছে কিছুটা অচেনা রয়ে গেছ। সেইজন্যই কথাগুলো বলতে হল। আর একটা কথা, ও বাড়িতে যাওয়ার ব্যাপারে তোমার মা আর কাকার মতামত নেওয়াটাও দরকার।
হেমাঙ্গ জানে, সেটাই শক্ত কাজ। খুবই শক্ত।
মা শুনেই বলল, ওসব চিন্তা মাথা থেকে তাড়া। কিছুতেই তোকে আমি একা থাকতে দেব না। পাগল নাকি?
হেমাঙ্গকে আবার পিছোতে হল। হতাশ এবং ব্যর্থ। সে প্রাপ্তবয়স্ক, উপার্জনশীল এবং যোগ্যতাসম্পন্ন একজন মানুষ হওয়া সত্ত্বেও এ বাড়িতে তার প্রতি নাবালকের মতোই আচরণ করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে মা। মায়ের কাছ থেকে সে কখনোই পূর্ণবয়স্ক মানুষের মর্যাদা আদায় করতে পারেনি।
মানুষের জীবনে নানা ধরনের দুঃখ থাকে। হেমাঙ্গর জীবনে এইটেই ছিল সাংঘাতিক দুঃখ। মাথার ওপর এতগুলো অভিভাবকের ভার সে আর বহন করতে পারছিল না। নিজেকে তার মনে হত ইটচাপা ঘাস। বিবর্ণ, খবঁটে, ভবিষ্যৎ-হীন।
হঠাৎ হেমাঙ্গর ভাগ্যাকাশে পূর্ণচন্দ্রের উদয় হল। কিছুদিন বাদে খবর এল গড়চা বাই লেনের বাড়িটার একজন দাবীদার উঠেছে। লোকটা বলছে, তার কাকা মহিমবাবু বাড়িটা আদৌ ছাড়েননি, বরং তাকেই থাকতে দিয়ে গেছেন। বাড়ির ভিতরে তার কাকার ব্যবহৃত জিনিসপত্রও কিছু আছে।
কথাটা মিথ্যে নয়। বাস্তবিকই মহিমবাবুর খাট আলমারি চেয়ার টেবিল ইত্যাদি কিছু জিনিস তাড়াতাড়িতে বিলিব্যবস্থা করা যায়নি বলে ফেলেই গেছেন তিনি। দুর্গানাথকে বলে গেছেন, ওগুলোর একটা গতি যেন তিনিই করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, লোকটি সত্যিই মহিমবাবুর ভাইপো। সে পাড়ার লোক এবং একজন পাকা উকিলের সহায়তায় বাড়ি দখলের জন্য নানা হুজ্জত শুরু করে দিল। তালা ভেঙে ঢোকার চেষ্টাও হল একটা। পুলিশ এল, কিন্তু কেমন যেন গা-ছাড়া ভাব তাদের।
দুর্গানাথ বিপদ বুঝে একটা পারিবারিক মিটিং ডেকে বললেন, বাড়ির পজেশন নেওয়াটাই আইনের বড় কথা। অবিলম্বে বাড়িতে লোক ঢোকানো দরকার। হেমাঙ্গ যখন স্বেচ্ছায় ওখানে থাকতে চাইছে তখন ওকেই পাঠাননা হোক।
মা অবশ্য বেঁকে বসল, হাঙ্গামার মধ্যে ছেলেকে পাঠাননা কেন? ও কি ভেসে এসেছে? যদি ওকে মারে?
বিস্তর বিতর্কের পর শেষ অবধি হেমাঙ্গই জয়টিকা পরল। পরদিন বাক্স-বিছানা নিয়ে গিয়ে সে গড়চা বাই লেনের বাড়ির দখল পত্তন করল। সঙ্গে পাড়ার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। বন্ধুরা অবশ্য সাময়িকভাবে সঙ্গ দিতে গিয়েছিল।
মহিমবাবুর ভাইপো কিছু তিড়িংবিড়িং করেছিল বটে, কিন্তু ডাহা একটা মিথ্যে দাবী নিয়ে বেশিদূর এগোতে পারল না। দিন সাতেক বাদে সে নিরস্ত হল।
সেই থেকে হেমাঙ্গ এক সুখী ও একা মানুষ। দোতলায় চারখানা শশাওয়ার ও একখানা বড় বসবার ঘর নিয়ে বিশাল ফ্ল্যাটে সে থাকে। একতলাটা কিছুদিন ফাঁকা থাকার পর তার সেজদা গৌরাঙ্গ সেখানে একটা সাউন্ড রেকর্ডিং স্টুডিও করে। সেটা চলল না। এরপর টিভি সিরিয়ালের সেট হিসেবে সেটা ভাড়া দেওয়া হয় কিছুদিন। তারপর বিয়েবাড়ি হিসেবে ভাড়া দেওয়া হতে থাকে। অবশেষে ওটা এখন তাদের গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। হেমাঙ্গ এখন নিশ্চিন্ত। সে এখন নিরঙ্কুশ একা।
একা বটে, কিন্তু উৎপাতহীন নয়। তার পৈতৃক বড় বাড়িটা বিডন স্ট্রিটে হলেও, তার সেজদি নীলা বন্ডেল রোড এবং পিসতুতে দিদি চারুশীলা গোলপার্কে থাকে। তারা সময় অসময়ে এসে হাজির হয় এবং যথেষ্ট হামলা মাচিয়ে যায়। প্রথম প্রথম বিডন স্ট্রিট থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে মা বা ছোড়দি চলে আসত। আজকাল সেটা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু এই দুই দিদির খবরদারি বন্ধ হয়নি। হেমাঙ্গর প্রত্যেকটা শ্বাসপ্রশ্বাস অবধি এরা দুজন বিডন স্ট্রিটে ফোন করে জানিয়ে দেয়।
এই যে তার ফিয়াট গাড়ির ডিকিতে মাইক্রোওয়েভের বাক্সটি নিয়ে সে বাড়ি ফিরছে এটা দু’একদিনের মধ্যেই রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ফি রোব্বার সে বিডন স্ট্রিটে মাকে দেখতে যায়। আর তখন কৃতকর্মের জন্য তাকে শতেক গঞ্জনা শুনতে হয় নানাজনের কাছে। মাইক্রোওয়েভ তাকে যথেষ্ট বেগ দেবে।
হেমাঙ্গ কি বোঝে না যে এত জিনিসপত্র কোনও কাজের নয়? অবুঝ হেমাঙ্গর ভিতরে একজন যুক্তিবাদী হেমাঙ্গও বাস করে। যুক্তিবাদী হেমাঙ্গ ভালই জানে, এই সব জিনিসপত্র কেনা মানে দূর্লভ অর্থশক্তির অপপ্রয়োগ মাত্র। অবুঝ হেমাঙ্গ বলে, আরে, আয়ু তত দুদিনের। যা ইচ্ছে যায় তা করে নেওয়াই ভাল।
ডিকি থেকে বাক্সটা ওপরে তুলে দিল ফটিক। ফটিক একটি বেশ লোক। হেমাঙ্গর সব কথাতেই সে সায় দেয় এবং যথেষ্ট খাতির করে। ফটিকের বয়স ষাটের ওপর এবং হেমাঙ্গর বয়স ত্রিশের নিচে হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক আছে।
বাক্স খুলে জিনিসটা বের করে রান্নাঘরের তাকে রেখে প্লাগ লাগিয়ে হেমাঙ্গ বলল, জিনিসটা দেখেছ ফটিকদা?
ফটিক সবিস্ময়ে চেয়ে থেকে বলে, রান্নাঘরে টিভি দিয়ে কি হবে দাদাবাবু?
এটা টিভি নয়। মাইক্রোওয়েভ। এতে রান্নাবান্না হয়। বসে দেখ।
ফটিক উবু হয়ে বসল। তার চোখের সামনে চোখের পলকে ফ্রিজের ঠাণ্ডা খাবার গরম করে ফেলল হেমাঙ্গ। পাঁপর সেঁকল। বিনা জলে আলু সেদ্ধ করল।
দেখলে?
ই রে বাবা! এ তো দেখছি অশৈলী কাণ্ডকারখানা! ধোঁয়া নেই, শব্দ নেই, তা হলে কী হল কাণ্ডখানা!
মাইক্রোওয়েভ হল পৃথিবীর নতুন বিস্ময়। আলট্রা মডার্ন জিনিস।
তাই তো দেখছি।
ফটিকের জিনিস এত কম যে সেটাও হেমাঙ্গর কাছে বিস্ময়। ফটিকের সম্বল মাত্র একটা তোলা উনুন, একখানা কড়াই, একটি হাঁড়ি আর থালা। একটা ঘটি, একটা বালতি, একখানা মগ ও একটা গামছা আছে তার। আছে দুটি লুঙ্গি, দুখানা ধুতি আর দু-তিনটে জামা। আবার বলতে একটা ছোট্ট চৌকি। এ সবই খুব খুঁটিয়ে লক্ষ করেছে হেমাঙ্গ। ফটিকের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে তার। ফটিকের অতি ছোটো ঘরটায় গিয়ে মাঝে মাঝে বসে হেমাঙ্গ। চারদিকে চেয়ে ফটিকের একাবোকা সংসার দেখে। এরকমভাবেও মানুষের তো চলে যায় বেশ!