০৬. কৃষ্ণগহ্বর

৬. কৃষ্ণগহ্বর (Black Holes)

কৃষ্ণগহ্বর (Black Holes) শব্দটার উৎপত্তি হয়েছে খুবই সম্প্রতি। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে জন হুইলার John Wheeler) নামে একজন আমেরিকান বৈজ্ঞানিক এই শব্দটি সৃষ্টি করেছিলেন। এটা আসলে একটি ধারণার বিবরণের নক্সা (graphic description)। এ চিন্তাধারার বয়স অন্তত দুশ’ বছর। সে সময় আলোক সম্পর্কে দুটি তত্ত্ব প্রচলিত ছিল। তার ভিতরে একটি তত্ত্ব নিউটন সমর্থন করতেন। সে তত্ত্ব অনুসারে আলোক কণিকা দিয়ে গঠিত। অন্য তত্ত্ব অনুসারে আলোক তরঙ্গ দিয়ে গঠিত। এখন আমরা জানি আসলে দুটি তত্ত্বই নির্ভুল। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার তরঙ্গ কণিকার দ্বৈতোর ভিত্তিতে হআলোককে তরঙ্গ এবং কণিকা দুভাবেই বিচার করা যায়। আলোক তরঙ্গ দিয়ে গঠিত এই তত্ত্বের ভিত্তিতে মহাকর্ষ সাপেক্ষ আলোকের কি প্রতিক্রিয়া হবে সেটা স্পষ্ট ছিল না। কিন্তু আলোক যদি কণিকা দিয়ে গঠিত হয়, তা হলে আশা করা যেতে পারে কামানের গোলা, রকেট এবং গ্রহগুলোর দ্রুতি অসীম। সুতরাং, মহাকর্ষ তার গতি মন্থর করতে পারবে না। কিন্তু রোমার (Roemer) আবিষ্কার করলেন আলোকের দ্রুতির সীমা আছে। এর অর্থ আলোকের উপর মহাকর্ষের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিয়া থাকতে পারে।

এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে জন মিচেল (John Michell) নামে কেজি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডন (Don-অধ্যাপক) ১৮৮৩ সালে ফিলোজফিক্যাল ট্রানজ্যাকশনস্ অব্‌ দি রয়াল সোসাইটি, লন্ডন (Philosophical Transactions of the Royal Society of London) পত্রিকায় একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, একটি তারকার যদি যথেষ্ট ভর এবং ঘনত্ব থাকে তাহলে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে আলোক সেখান থেকে নির্গত হতে পারবে না। সেই তারকার পৃষ্ঠ থেকে নির্গত আলোক বেশি দূর যাওয়ার আগেই তারকাটির মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে পিছনে টেনে নিয়ে আসবে। এরকম বহুসংখ্যক তারকা থাকতে পারে এই ধরনের ইঙ্গিত মিচেল দিয়েছিলেন। যদিও সেগুলোর আলোক আমাদের কাছে পৌঁছাতে পারবে না বলে আমরা সেগুলোকে দেখতে পারব না তবুও সেগুলোর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ আমাদের বোধগম্য হবে। এই সমস্ত বস্তুপিণ্ডকেই আমরা এখন কৃষ্ণগহ্বর বলি। তার কারণ, সত্যিই সেগুলো কষ্ণগহ্বর অর্থাৎ স্থানে (space) কৃষ্ণ শূন্যতা। কয়েক বছর পর ফরাসী বৈজ্ঞানিক মার্কুইস্ দ্য লাপ্লাস (Marquis De Laplace) এই রকম ইঙ্গিত করেছিলেন। মনে হয় তাঁর এই ইঙ্গিত ছিল আপাতদৃষ্টিতে মিচেলের ইঙ্গিতের সঙ্গে সম্পর্কহীন। তাঁর বই সিস্টেম অব দি ওয়ার্ল্ড (System of the World) এর প্রথম এবং দ্বিতীয় সংস্করণে এই ইঙ্গিত ছিল কিন্তু আকর্ষণীয় ব্যাপার হল : পরবর্তী সংস্করণগুলো থেকে এ ইঙ্গিত তিনি বাদ দিয়েছিলেন। হয়ত ভেবেছিলেন এরকম চিন্তাধার একটা পাগলামি। (তাছাড়া, ঊনবিংশ শতাব্দীতে আলোকের কণিকাতত্ত্বের জনপ্রিয়তা চলে যায়, তখন মনে হয়েছিল তরঙ্গতত্ত্ব দিয়ে সব কিছুই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। তাছাড়া, তরঙ্গতত্ত্ব মেনে নিলে মহাকর্ষ কি করে আলোককে প্রভাবিত করবে সেটা কোনক্রমেই বোঝা যায় নি)।

আসলে নিউটনের মহাকর্ষীয় তত্ত্বে আলোককে যে কামানের গোলার মত মনে করা হয়েছে সেটা সত্যিই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তার কারণ আলোক স্থির দ্রুতি সম্পন্ন। (পৃথিবী থেকে ঊর্ধ্বদিকে একটি কামানের গোলা ছুঁড়লে মহাকর্ষের প্রভাবে তার গতি মন্থরতর হবে এবং একসময় সেটা থেমে যাবে আর নিচের দিকে পড়তে থাকবে। ফোটন কিন্তু স্থির দ্রুতিতে উপর দিকে যেতেই থাকবে। তাহলে নিউটনীয় মহাকর্ষ কি করে বেআলোককে প্রভাবিত করবে?) ১৯১৫ সালে আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ উপস্থাপনের আগে মহাকর্ষ কি করে আলোককে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে কোন সঙ্গতিপূর্ণ তত্ত্ব উপস্থাপিত হয় নি এবং তারও অনেক পরে অতিবৃহৎ ভরসম্পন্ন। তারকাগুলো সাপেক্ষ এই তত্ত্বের ফলশ্রুতি বোধগম্য হয়েছে।

কৃষ্ণগহ্বর কি করে তৈরি হয় সেটা বুঝতে হলে প্রথমে বোঝা দরকার একটি তারকার জীবনচক্র (life cycle)। যখন বৃহৎ পরিমাণ বায়ু (প্রধানত হাইড্রোজেন) নিজস্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাপে নিজের উপরেই চুপসে যেতে থাকে তখন একটি তারকা সৃষ্টি হয়। তারকাটি সঙ্কুচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর পরমাণুগুলোর ক্রমশ বেশি ঘন ঘন এবং বর্ধমান দ্রুতিতে পারস্পরিক সংঘর্ষ হতে থাকে, ফলে বায়ু উত্তপ্ত হয়। শেষ পর্যন্ত বায়ু এত উত্তপ্ত হয় যে, হাইড্রোজেন পরমাণুগুলো সংঘর্ষের পর পরস্পর থেকে দূরে ছিটকে না গিয়ে সংযুক্ত হয়ে হিলিয়ামে (Helium) পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়া একটি নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের মত। এর ফলে যে তাপ নির্গত হয় তার জন্যই তারকাটি আলোক বিকিরণ করে। এই বাড়তি উত্তাপ বায়ুর চাপও বাড়াতে থাকে। যখন বায়ুর চাপ এবং মহাকর্ষীয় আকর্ষণ সমান হয় তখন বায়ুর সঙ্কোচন বন্ধ হয়। ব্যাপারটা প্রায় একটি বেলুনের মত। বেলুনের ভিতরকার বায়ুর চাপ চেষ্টা করে সেটাকে ফোলাতে আর রবারের চাপ চেষ্টা করে বেলুনটাকে ক্ষুদ্রতর করতে। ফলে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়। পারমাণবিক পক্রিয়া থেকে উদ্ভূত তাপ এবং মহাকর্ষীয় আকর্ষণে ভারসাম্যের ফলে তারকাগুলো বহুকাল পর্যন্ত সুস্থিত (stable) থাকে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারকাটির হাইড্রোজেন এবং অন্যান্য পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়েও যাবে। একটি স্ববিরোধী ব্যাপার হল : শুরুতে তারকাটির জ্বালানি যত বেশি থাকে জ্বালানি ফুরিয়ে যায় তত তাড়াতাড়ি। এর কারণ, তারকাটির ভর যত বেশি হয় মহাকর্ষীয় আকর্ষণের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য তাকে তত বেশি উত্তপ্ত হয়। আর তারকাটি যত উত্তপ হবে তার জ্বালানিও তত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। আমাদে সূর্যের বোধ হয় আর পাঁচশো কোটি বছর কিম্বা তার কাছাকাছি সময় পর্যন্ত চলবার মত জ্বালানি আছে কিন্তু আরও ভরসম্পন্ন তারকাগুলো দশ কোটি বছরের মত অল্প সময়েই তাদের জ্বালানি শেষ করে দিতে পারে। এই কাল মহাবিশ্বের বয়সের চাইতে অনেক কম। একটি তারকার জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে সেটা শীতল হতে থাকে আর সঙ্কুচিত হতে থাকে। তখন সেটার কি হতে পারে সেটা বোঝা গিয়েছিল শুধুমাত্র উনিশশো কুড়ির দশকের শেষে।

১৯২৮ সালে সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখর (Subrahmanyan Chandrashekhar) নামে একজন ভারতীয় গ্র্যাজুয়েট ছাত্র কেম্ব্রিজে স্যার আর্থার এডিংটনের (Sir Arthur Addington) কাছে পড়বার জন্য ইংল্যান্ডে রওনা হন। তিনি ছিলেন ব্যাপক অপেক্ষবাদ সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। (কোন কোন কাহিনী অনুসারে ১৯২০ সালের প্রথম দিকে একজন সাংবাদিক এডিংটনকে বলেছিলেন– পৃথিবীতে ব্যাপক অপেক্ষবাদ বোঝেন মাত্র তিনজন। এডিংটন একটু থেমে উত্তর দিয়েছিলেন–“আমি ভাবতে চেষ্টা করছি তৃতীয় ব্যক্তিটি কে?”)। জাহাজে আসবার সময় চন্দ্রশেখর অঙ্ক কষে বার করেছিলেন– ব্যবহারের ফলে সমস্ত জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে নিজের মহাকর্ষের বিরুদ্ধে নিজেকে বহন করতে হলে একটি তারকার ভর কত হতে হবে। ভাবনাটি ছিল এইরকম: তারকাটি ক্ষুদ্র হয়ে গেলে পদার্থ কণিকাগুলো খুব কাছাকাছি এসে যায় সুতরাং পাউলির (Pauli) অপবর্জনতত্ত্ব (exclusion principle) অনুসারে তাদের অত্যন্ত বিভিন্ন গতিবেগ হওয়া আবশ্যিক। এজন্য তারা পরস্পর থেকে দূরে চলে যেতে থাকে, ফলে তারকাগুলোতে প্রসারণের চেষ্টা দেখা দেয় (tend to make the star expand)। ঠিক যেমন তারকাটির জীবনের শুরুতে মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করেছিল উত্তাপ, তেমনি মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং অপবর্জনতত্ত্বভিত্তিক (exclusion principle) বিকর্ষণের ভারসাম্য রক্ষিত হলেই তারকাটি তার নিজস্ব ব্যাসার্ধ অপরিবর্তিত রাখতে পারে।

কিন্তু চন্দ্রশেখর বুঝতে পেরেছিলেন অপবর্জনতত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণের একটি সীমা আছে। অপেক্ষবাদ তারকাটির ভিতরকার পদার্থ কণিকাগুলোর গতিবেগের পার্থক্যের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিয়েছে। সে সীমা হল আলোকের দ্রুতি (Speed of light)। এর অর্থ হল : তারকাটি যথেষ্ট গন হলে অপবর্জনতত্ত্বভিত্তি বিকর্ষণ মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাইতে কম হবে। চন্দ্রশেখর হিসেব করে দেখেছিলেন শীতল তারকার ভর আমাদের সূর্যের ভরের দেড় গুণের চাইতে বেশি হলে সে নিজের মহাকর্ষ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারবে না [এই ভর এখন চন্দ্রশেখরের সীমা (Chandrashekhar limit) নামে খ্যাত]। রুশ বৈজ্ঞানিক লেভ ডেভিডোভিচ ল্যান্ডো (Lev Devidovich Landau) প্রায় একই সময়ে একই ধরনের আবিষ্কার করেছিলেন।

উচ্চ ভরসম্পন্ন তারকাগুলোর অন্তিম দশা (ultimate fate) সম্পর্কে এই তত্ত্বের ফলশ্রুতি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। একটি তারকার ভর যদি চন্দ্রশেখর সীমার চাইতে কম হয় তাহলে এসটা সম্ভাব্য অন্তিম দশায় “শ্বেত বামন” (white dwarf) রূপে স্থিতিলাভ করতে পারে। এগুলোর ব্যাসার্ধ হয় কয়েক হাজার মাইল আর ঘনত্ব হয় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে কয়েক শ’ টন। নিজ পদার্থের ভিতরকার ইলেকট্রনগুলোর অন্তর্বর্তী অপবর্জনতত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণই একটি শ্বেত বামনকে রক্ষা করে (is supported)। বহু সংখ্যক এইরকম শ্বেত বামন তারকা আমরা পর্যবেক্ষণ করে থাকি। প্রথম যে কটি এই ধরনের তারকা আবিষ্কৃত হয়েছিল তার ভিতরে একটি সিরিয়াস (Sirius) নামক তারকাকে প্রদক্ষিণ করে। সিরিয়াস রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম তারকা।

ল্যান্ডো তারকার সম্ভাব্য আর একটি অন্তিম দশার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এগুলোর ভরের সীমা (limiting mass) সূর্যের এক কিম্বা দুই গুণের ভিতরে কিন্তু আকারে এরা শ্বেত বামনের চাইতেও ছোট। এই তারকাগুলোকেও রক্ষা করে অপবর্জনতত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণ কিন্তু এই বিকর্ষণ আন্ত নিউট্রন এবং প্রোটনের, তবে আন্ত ইলেকট্রনের নয়। সেজন্য এগুলোকে বলা হত নিউট্রন তারকা। এগুলোর ব্যাসার্ধ হয় মাত্র দশ মাইলের মত কিন্তু তাদের ঘনত্ব হয় প্রতি ঘন ইঞ্চিতে কোটি কোটি টন। এগুলো সম্পর্কে যখন প্রথম ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় তখন নিউট্রন তারকা পর্যবেক্ষণের কোন উপায় ছিল না। আসলে সেগুলো সনাক্ত করা হয়েছে অনেক পরে।

অন্যদিকে আবার যে সমস্ত তারকার ভর চন্দ্রশেখর সীমার চাইতে বেশি, জ্বালানি ফুরিয়ে গেলে সেগুলোকে বিরাট সমস্যায় পড়তে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে সেগুলোতে বিস্ফোরণ হয় আবার কোন কোন ক্ষেত্রে তারা নিজেদের ভর সীমার ভিতরে নিয়ে আসার মত যথেষ্ট পদার্থ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়। ফলে তারা মহাকর্ষের ক্রিয়ায় চুপসে যাওয়ার বিপর্যয় catastrophic gravitationl collapse) এড়াতে পারে। তারকাটি যত বড়ই হোক না কেন, এরকম যে সব সময়ই হবে সেটা বিশ্বাস করা বেশ শক্ত ছিল। তারকাটি কি করে জানবে যে তার ওজন কমাতে হবে? তাছাড়া প্রতিটি তারকাই যদি চুপসে যাওয়া এড়ানোর মত যথেষ্ট পরিমাণ ভর পরিত্যাগ করতে সক্ষমও হয় তাহলে শ্বেত বামন কিম্বা নিউট্রন তারকার সঙ্গে সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার মত অতিরিক্ত ভর যোগ করলে কি হবে? তাহলে কি সেটা চুপসে (Collapse) অসীম ঘনত্ব (infinite density) প্রাপ্ত হবে? এই ফলশ্রুতির সম্ভাবনাতে এডিংটন প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান (Shocked)। তিনি চন্দ্রশেখরের গবেষণার ফল বিশ্বাস করতে অস্বীকার করেন। এডিংটন ভেবেছিলেন, একটি তারকা চুপসে গিয়ে বিন্দুতে পরিণত হবে– এরকম ব্যাপার একেবারেই অসম্ভব। এটাই ছিল অধিকাংশ বৈজ্ঞানিকের মত। আইনস্টাইন নিজে একটা প্রবন্ধে দাবি করেছিলেন তারকা সঙ্কুচিত হয়ে শূন্য আয়তনে পৌঁছাবে না। অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের বিরুদ্ধতা, বিশেষ করে তার অতীতের শিক্ষক এবং তারকার গঠন সম্পর্কে অগ্রগণ্য পণ্ডিত এডিংটনের বিরুদ্ধতার ফলে চন্দ্রশেখর এই গবেষণার ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের (astronomy) অন্য ক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করেন। তাঁর গবেষণার একটি ক্ষেত্র ছিল তারকাগুচ্ছের গতি (motion of star clusters)। কিন্তু ১৯৮৩ সালে যখন তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তখন অন্তত অংশত সে পুরস্কার দেয়া হয়েছিল শীতল তারকার ভরের সীমা সম্পর্কীয় তার আগেকার গবেষণার জন্য।

চন্দ্রশেখর দেখিয়েছিলেন অপবর্জনতত্ত্ব চন্দ্রশেখর সীমার চাইতে বেশি ভরসম্পন্ন। তারকার চুপসে যাওয়া বন্ধ করতে পারে না। কিন্তু ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে সেই তারকার কি হবে সেটা বোঝার সমস্যা ১৯৩৯ সালে প্রথম সমাধান করেছিলেন রবার্ট ওপেনহাইমার (Robert Oppenheimer) নামে এক তরুণ আমেরিকান। কিন্তু তার গবেষণার ফলে মনে হয়েছিল তখনকার দিনে দূরবীক্ষণ যন্ত্রের পর্যবেক্ষণ করার মত কোন ফলশ্রুতি ঘটবে না। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এসে পড়ে এবং ওপেনহাইমার পরমাণু বোমা প্রকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েন। যুদ্ধের পর মহাকর্ষের ফলে চুপসে যাওয়ার সমস্যা প্রায় সবাই ভুলে যান। বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিকই তখন পরমাণু এবং কেন্দ্রকের (nucleus) মানের (scale) গবেষণায় জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬০ এর দশকে কিন্তু জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বৃহত্মানে মহাবিশ্বতত্ত্ব সম্বন্ধীয় সমস্যা নিয়ে ঔৎসুক্য দেখা দেয়। তার কারণ, আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা প্রয়োগের ফলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণের সংখ্যা এবং বিস্তৃতি খুব বৃদ্ধি পায়। ওপেনহাইমারের গবেষণা তখন পুনরাবিষ্কৃত হয় এবং কয়েকজনের দ্বারা আরও বিস্তৃতি লাভ করে।

ওপেনহাইমারের গবেষণা থেকে এখন আমরা যে চিত্র পাই সেটা অনেকটা এইরকম: তারকার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র স্থান-কালে আলোকরশ্মির গতিপথের পরিবর্তন করে। অর্থাৎ তারকাটি না থাকলে যে গতিপথ হওয়ার কথা ছিল তার তুলনায় অন্যরকম হয়। যে আলোক শঙ্কুগুলো (light cones) স্থান-কালে তাদের অগ্রভাগ থেকে নির্গত আলোকের গতিপথ নির্দেশ করে তারকার পৃষ্ঠের (surface) কাছাকাছি সেগুলো ভিতরদিকে সামান্য বেঁকে যায়। সূর্যগ্রহণের সময় দূরস্থিত তারকা থেকে নির্গত আলোকের বেঁকে যাওয়া থেকে এটা বোঝা যায়। তারকাটি যেমন সঙ্কুচিত হয় তার পৃষ্ঠের (surface) মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও তেমনি শক্তিশালী হতে থাকে এবং আলোক শঙ্কুগুলো ভিতরদিকে আরো বেশি বেঁকে যায়। এর ফলে আলোকের নির্গত হওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে এবং দূরস্থিত একজন পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে সে আলোক ক্ষীণতর এবং লোহিততর মনে হয়। শেষ পর্যন্ত তারকাটি যখন সঙ্কুচিত হয়ে একটি বিশেষ ক্রান্তিক ব্যাসার্ধ প্রাপ্ত হয় তখন পৃষ্ঠের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এমন শক্তিশালী হয় যে আলোক সঙ্কু ভিতরদিকে বেঁকে যায়। সে বক্রতা এত বেশি হয় যে আলোক আর সেখান থেকে নির্গত হতে পারে না (চিত্র : ৬.১)। অপেক্ষবাদ অনুসারে আলোকের চাইতে দ্রুতগামী কিছু হতে পারে না। সুতরাং আলোক যদি নির্গত হতে না পারে তাহলে অন্য কিছুও নির্গত হতে পারে না। মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সবকিছুকেই পিছন দিকে টেনে রাখে। সুতরাং একগুচ্ছ ঘটনা রইল : স্থান-কালের একটি অঞ্চল যেখান থেকে নির্গত হয়ে দূরস্থিত কোন পর্যবেক্ষকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়। এই অঞ্চলেরই আমরা নাম দিয়েছি কৃষ্ণগহ্বর। এর সীমানার নাম ঘটনাদিগন্ত (event horizon)। যে আলোক কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত হতে পারেনি সেই আলোকের গতিপথের সঙ্গে এই সীমানার সমাপতন (coin cide) ঘটে।

একটি তারকার চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর হওয়া পর্যবেক্ষণ করতে গেলে আপনি কি দেখবেন সেটা বুঝতে হলে মনে রাখতে হবে অপেক্ষবাদে কোন পরম কালের (absolute time) অস্তিত্ব নেই। প্রত্যেক পর্যবেক্ষকেরই কাল সম্পর্কে তার নিজস্ব মাপন রয়েছে। একটি তারকার উপর অবস্থিত একটি ব্যক্তিসাপেক্ষ কাল দূরে অবস্থিত অন্য একটি ব্যক্তিসাপেক্ষ কালের চাইতে পৃথক হবে। এর কারণ, তারকাটির মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র। অনুমান করা যাক একজন সাহসী মহাকাশচারী একটি তারকার পৃষ্ঠে রয়েছেন। তারকাটি চুপসে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষটিও চুপসে ভিতর দিকে চলে যাচ্ছে। তার মহাকাশযান তারকাটিকে প্রদক্ষিণ করছে আর সে নিজের ঘড়ি অনুসারে নিজের মহাকাশযানকে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে সঙ্কেত পাঠাচ্ছে। ধরা যাক তারকাটি কোন এক সময়ে ধরুন ১১টার সময় সঙ্কুচিত হতে হতে ক্রান্তিক ব্যাসার্ধ (critical radius) অতিক্রম করে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাবে। এই অবস্থায় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হয় যে কোন কিছুই সেখান থেকে নির্গত হতে পারে না। অতএব তার সঙ্কেতগুলোও আর মহাকাশযানে পৌঁছাবে না। এগারোটার কাছাকাছি সময়ে মহাকাশযান থেকে তার পর্যবেক্ষণকারী সঙ্গীরা দেখতে পাবে মহাকাশচারীর কাছ থেকে আসা ধারাবাহিক সঙ্কেতগুলোর অন্তর্বর্তী সময় ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু দশটা বেজে ঊনষাট মিনিট ঊনষাট সেকেন্ড পর্যন্ত এই ক্রিয়া হবে অতি অল্প। মহাকাশচারীর প্রেরিত দশটা ঊনষাট মিনিট আটান্ন সেকেন্ডের সঙ্কেত এবং তার নিজের ঘড়িতে যখন দশটা ঊনষাট মিনিট ঊনষাট সেকেন্ড হয়েছে তখনকার প্রেরিত সঙ্কেতের অন্তর্বর্তী সময় সামান্য দীর্ঘতর হবে। কিন্তু এগারোটার সঙ্কেতের জন্য তাকে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে হবে। মহাকাশযান থেকে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে মহাকাশচারীর ঘড়ির দশটা ঊনষাট মিনিট ঊনষাট সেকেন্ড এবং এগারোটার মধ্যবর্তী সময়ে তারকার পৃষ্ঠ থেকে প্রেরিত আলোকসঙ্কেত অসীমকালে বিস্তৃত। ধারাবাহিক তরঙ্গগুলোর আলোকও ক্রমশ বেশি লাল হবে এবং ক্ষীণতর হতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত তারকাটি এত ক্ষীণপ্রভ হবে যে সেটা আর মহাকশন থেকে দেখা যাবে না। অবশিষ্ট থাকবে শুধু স্থানে একটি কৃষ্ণগহ্বর। তারকাটি কিন্তু মহাকাশযানটির উপর একই রকম মহাকর্ষীয় বল প্রয়োগ করতে থাকবে এবং মহাকাশযানটিও কৃষ্ণগহ্বর প্রদক্ষিণ করতে থাকবে।

নিম্নলিখিত সমস্যার জন্য এই দৃশ্যপটও কিন্তু সম্পূর্ণ বাস্তবানুগ নয়। তারকা থেকে যত দূরে যাবেন মহাকর্ষও তত দুর্বল হবে। সুতরাং আমাদের সাহসী মহাকাশচারীর পায়ের উপরে মহাকর্ষীয় বল মাথার উপরকার মহাকর্ষীয় বলের চাইতে সব সময়েই বেশি হবে। বলের এই পার্থক্যের ফলে তারকাটি সঙ্কুচিত হয়ে যে ক্রান্তিক ব্যাসার্ধে (critical radius) ঘটনা দিগন্ত event horizon) সৃষ্টি হয়েছিল সে অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই আমাদের মহাকাশচারীকে হয় টেনে সেমাইয়ের মত লম্বা করে দেবে নয়ত ছিঁড়ে ফেলবে। আমাদের কিন্তু বিশ্বাস মহাবিশ্বের ছায়াপথগুলোর কেন্দ্রের মত বৃহত্তর বস্তু রয়েছে। সেগুলোও মহাকর্ষের ফলে চুপসে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে। এগুলোর উপরে কোন মহাকাশচারী থাকলে কৃষ্ণগহ্বর হওয়ার আগে সে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে না। ক্রান্তিক ব্যাসার্ধে পৌঁছানোর আগে তার কোন বিশেষ অনুভূতি হবে না। যে বিন্দু থেকে ফেরা যায় না সে বিন্দুও সে অতিক্রম করতে পারে কোনকিছু লক্ষ্য না করেই। তবে অঞ্চলটা যখন চুপসে যেতে থাকবে তখন কয়েক ঘণ্টার ভিতরেই পায়ের সঙ্গে মাথার মহাকর্ষীয় বলের পার্থক্য এত বেশি হবে যে, সে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।

১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৭০ সালের ভিতরে আমি এবং রজার পেনরোজ যে গবেষণা করেছিলাম তা থেকে দেখা গেছে অপেক্ষবাদ অনুসারে কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে অসীম ঘনত্ব এবং স্থান-কাল বক্রতার অনন্যতা (singularity) থাকতেই হবে। এটা অনেকটা কালের আরম্ভের সময়কার বৃহৎ বিস্ফোরণের big bang মত। শুধুমাত্র মহাকাশচারী আর যে বস্তুপিণ্ড চুপসে যাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে এ সময়টা হবে কালান্ত। এই অনন্যতায় (singularity) বিজ্ঞানের বিধি এবং আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ভেঙে পড়বে। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে অবস্থিত কোন পর্যবেক্ষকের ক্ষেত্রে এই ভবিষ্যদ্বাণী করার অক্ষমতায় কিছু এসে যায় না। তার কারণ কোন আলোক কিম্বা অন্য কোন সঙ্কেতই এই অনন্যতা থেকে তার কাছে পৌঁছাতে পারে না। এই উল্লেখযোগ্য তথ্যই রজার পেনরোজের (Roger Penrose) মহাজাগতিক প্রহরতা প্রকল্পের (cosmic cen sorship hypothesis) পথিকৃৎ। এ কথাই অন্যভাবে বলা যায় : “ঈশ্বর নিরাবরণ অনন্যতাকে ঘৃণার সঙ্গে পরিহার করেন।” অন্য কথায় বলা যায় : মহাকর্ষের জন্য চুপসে যাওয়ার মত অনন্যতা শুধুমাত্র কৃষ্ণগহ্বরের মত স্থানেই হয়। সেখানে ঘটনা দিগন্ত দিয়ে বাইরের দৃষ্টি থেকে ঘটনাগুলোকে সুষ্ঠুভাবে লুকিয়ে রাখা হয়। সঠিকভাবে বলতে গেলে বলা যায় এটাই স্বল্পবল মহাজাগতিক প্রহরতা (seak cosmic censorship) প্রকল্প বলে পরিচিত। যে সমস্ত পর্যবেক্ষক কৃষ্ণগহ্বরের বাইরে থাকেন এই অনন্যতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা ভেঙে পড়ার ফলশ্রুতি থেকে তাদের রক্ষা করে এই স্বল্পবল মহাজাগতিক প্রহরতা প্রকল্প। তবে যে হতভাগ্য মহাকাশচারী গহ্বরে পড়ে যায় সে বেচারার জন্য কিন্তু এ প্রকল্প কিছুই করে না।

ব্যাপক অপেক্ষবাদের সমীকরণগুলোর এমন কতকগুলো সমাধান আছে যেগুলো অনুসারে আমাদের মহাকাশচারীর নিরাবরণ অনন্যতা (naked singularity) দেখা সম্ভব। সে হয়ত অনন্যতায় ঠোক্কর খাওয়া এড়াতে সক্ষম হয়ে একটি সরু ছিদ্র (worm hole) দিয়ে ঢুকে মহাবিশ্বের অন্য অঞ্চলে বেরিয়ে আসতে পারে। এর ফলে স্থান-কালে পরিভ্রমণের একটা বিরাট সুযোগ হতে পারে কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মনে হয় এ সমাধানগুলো খুবই অস্থির হওয়া সম্ভব। সর্বনিম্ন গোলমাল, এমন কি একজন মহাকাশচারীর উপস্থিতি ও পরিস্থিতির এমন পরিবর্তন আনতে পারে যে, যখন পর্যন্ত ঠোক্কর খেয়ে তার কাল শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত হয়ত সে অনন্যতা দেখতেই পেল না। অন্য কথায়, অনন্যতা সব সময়েই থাকবে তার ভবিষ্যতে, অতীত নয়। মহাজাগতিক প্রহরতা প্রকল্পের শক্তিশালী রূপের (version) বক্তব্য বাস্তব সমাধানের ক্ষেত্রে অনন্যতাগুলো হয় সব সময়ই থাকবে সম্পূর্ণভাবে ভবিষ্যতে (যেমন মহাকর্ষীয় ক্রিয়ায় চুপসে যাওয়ার মত অনন্যতা) কিম্বা থাকবে সম্পূর্ণভাবে অতীতে (যেমন বৃহৎ বিস্ফোরণ)। খুবই আশা করা যায় প্রহরতা প্রকল্পের কোন কোন রূপ সত্য হবে, তার কারণ নিরাবরণ অনন্যতার সন্নিকটে অতীতে পরিভ্রমণ করা সম্ভব হতে পারে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী লেখকদের পক্ষে ব্যাপারটা খুবই ভাল কিন্তু কারো জীবনই নিরাপদ হবে না। যে কোন লোক অতীতে প্রবেশ করে আপনাকে গর্ভে ধারণ করার আগেই আপনার বাবা মাকে হত্যা করতে পারে!

ঘটনা দিগন্ত (event horizon) অর্থাৎ স্থান-কালের যে অঞ্চল থেকে পালিয়ে আসা সম্ভব নয় সেই অঞ্চলের সীমান্ত কৃষ্ণগহ্বরের চারপাশে একটা একমুখী one way) ঝিল্লির (membrane) মত কাজ করে। অসতর্ক মহাকাশচারীর মত কোন বস্তু ঘটনা দিগন্ত ভেদ করে কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হতে পারে কিন্তু ঘটনা দিগন্ত ভেদ করে কোন কিছুই কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না (মনে রাখবেন, যে আলোক কৃষ্ণগহ্বর থেকে পলায়ন করতে চাইছে স্থান-কালে সেই আলোকের গতিপথকেই বলে ঘটনা দিগন্ত এবং কোনও কিছুই আলোকের চাইতে দ্রুত পরিভ্রমণ করতে পারে না)। নরকের প্রবেশদ্বার সম্পর্কে কবি দান্তে বলেছিলেন, “যারা এখানে প্রবেশ করছে, তারা পরিত্যাগ করো সমস্ত আশা”। ঘটনা দিগন্ত সম্পর্কেও এরকম কথা বলা চলে। যে কোন লোক কিম্বা যে কোন বস্তু ঘটনা দিগন্ত ভেদ করে পড়লে অচিরে অসীম ঘনত্ব এবং কালান্তের অঞ্চলে পৌঁছে যাবে।

ব্যাপক অপেক্ষবাদের ভবিষ্যদ্বাণী হল : গুরুভার বস্তুপিণ্ড চলমান হলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সৃষ্টি করবে। এই তরঙ্গগুলো স্থানের বক্রতায় সৃষ্ট তরঙ্গ। এগুলো পরিভ্রমণ করে আলোকের দ্রুতিতে। এগুলো আলোক তরঙ্গের অনুরূপ। আলোক তরঙ্গগুলোও বিদ্যুৎ চুম্বকীয় ক্ষেত্রের তরঙ্গ তবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ সন্ধান করে সনাক্ত করা আরো কঠিন। আলোক তরঙ্গের মত এই তরঙ্গগুলোও যে সমস্ত বস্তুপিণ্ড থেকে নির্গত হয় সেগুলো থেকে শক্তি বহন করে দূরে নিয়ে যায়। সুতরাং আশা করা যায় ভারি বস্তুপিণ্ডসম্পন্ন একটি তন্ত্র শেষ পর্যন্ত স্থিরাবস্থা প্রাপ্ত হবে। তার কারণ, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্গত হওয়ার ফলে যে কোন গতির শক্তি দূরে পরিবাহিত হয়। (ব্যাপারটা অনেকটা একটি কর্ককে জলে ফেলার মত। প্রথমে কর্কটি খুব খানিকটা ওঠানামা করে কিন্তু ঢেউগুলো তার শক্তি বহন করে দূরে নিয়ে যায়, ফলে শেষ পর্যন্ত সেটা স্থিরাবস্থা প্রাপ্ত হয়। উদাহরণ : পৃথিবী নিজ কক্ষে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে চলমান হলে তা থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়। শক্তিক্ষয়ের ফলে পৃথিবীর কক্ষের পরিবর্তন হয়, সুতরাং ধীরে ধীরে পৃথিবীটা সূর্যের নিকটতর হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সূর্যের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়ে স্থিরাবস্থায় স্থিতিলাভ করে। সূর্য এবং পৃথিবীর ক্ষেত্রে শক্তিক্ষয়ের হার অত্যন্ত অল্প একটি ছোট ইলেকট্রিক হীটার জ্বালাতে যতটা শক্তি প্রয়োজন পায় ততটা। এর অর্থ হল, পৃথিবীর সঙ্গে সূর্যের সংঘর্ষ হতে প্রায় এক হাজার মিলিয়ন মিলিয়ান মিলিয়ান মিলিয়ন বছর লাগবে। সুতরাং আশু দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। পৃথিবীর কক্ষের পরিবর্তন এত ধীরে হয় যে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তবে PSR ১৯১৩ + ১৬ নামে তন্ত্রটি গত কয়েক বছর পরীক্ষা করে এই একই ক্রিয়া দেখা গেছে (PSR এর অর্থ Pulsar পালসার, এগুলো একটি বিশেষ ধরনের নিউট্রন তারকা। এ থেকে নিয়মিত বেতার তরঙ্গস্পন্দন পাওয়া যায়)। এই তন্ত্রে রয়েছে দুটি নিউট্রন তারকা। এরা পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ নির্গত হওয়ার দরুন এদের যে শক্তিক্ষয় হয় তার ফলে এরা পরস্পরকে প্রদক্ষিণ করে সর্পিল গতিতে (Spiral in) পরস্পরের নিকটতর হয়।

মহাকর্ষের ফলে একটি তারকার চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার সময় গতি অনেক দ্রুততর হবে, সুতরাং তাদের শক্তিক্ষয়ের হারও দ্রুততর হবে। সুতরাং এদের স্থিরাবস্থায় স্থিত হতে খুব বেশি সময় রাগবে না। এই অন্তিম অবস্থা দেখতে কি রকম হবে? অনুমান করা যেতে পারে যে সমস্ত উপাদান দিয়ে তারকাটি গঠিত হয়েছে সেগুলোর সমস্ত জটিল অবয়বের উপর এটা নির্ভর করবে। শুধুমাত্র তার ভর এবং ঘূর্ণনের হারই নয়, এটা নির্ভর করবে তারকাটির বিভিন্ন অংশের ঘনত্ব এবং তারকাটির অভ্যন্তরের বায়বীয় পদার্থগুলোর (gases) জটিল গতির উপর। যে সমস্ত বস্তুগুলো চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরগুলো হয়েছে, কৃষ্ণগহ্বরগুলোর নিজেদেরও যদি সেরকম নানা রূপ হয় তাহলে সেগুলো সম্পর্কে সাধারণ সম্ভব্য করা সত্যিই খুব কঠিন হতে পারে।

কিন্তু ১৯৬৭ সালে ওয়ার্নার ইজরায়েল (Werner Israel) নামে কানাডার একজন বৈজ্ঞানিক কৃষ্ণগহ্বর গবেষণায় বিপ্লব এনেছেন (দ্রলোকের জন্ম বার্লিনে, তিনি মানুষ হয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন আয়ার্ল্যান্ড থেকে)। ইজরায়েল দেখিয়েছেন ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে যে সমস্ত কৃষ্ণগহ্বর ঘূর্ণায়মান নয়, সেগুলোর গঠন অবশ্যই খুব সরল (simple)। সেগুলো নিখুঁতভাবে গোলীয়। তাদের আয়তন নির্ভর করে শুধুমাত্র তাদের ভরের উপর এবং যে কোন দুটি কৃষ্ণগহ্বরের ভর যদি এক হয় তাহলে রূপে তারা অভিন্ন। আসলে আইনস্টাইনের সমীকরণগুলোর একটি বিশেষ সমাধানের সাহায্যে এগুলোর বিবরণ দেয়া সম্ভব। এ সমাধানগুলো ১৯১৭ সাল থেকেই জানা। ব্যাপক অপেক্ষবাদ আবিষ্কারের স্বল্পকাল পরেই কার্ল সোয়ার্জচাইল্ড (Karl Schwarzschild) এই সমাধান আবিষ্কার করেন। প্রথমদিকে অনেকেরই, এমনকি ইজরায়েলের নিজেরও শক্তি ছিল : যেহেতু কৃষ্ণগহ্বরগুলোর নিখুঁত গোলীয় হতে হবে সুতরাং কৃষ্ণগহ্বর শুধুমাত্র নিখুঁত গোলীয় বস্তু চুপসে গিয়েই হতে পারে। কোন বাস্তব তারকা কখনোই নিখুঁত গোলীয় নয়। সুতরাং একটি তারকা শুধুমাত্র নিরাবরণ অনন্যতাই (naked singularity) গঠন করতে পারে।

কিন্তু ইজরায়েলের গবেষণাফলের অন্য একটি ব্যাখ্যাও ছিল। এই ব্যাখ্যা প্রস্তাব করেন রজার পেনরোজ (Roger Penrose) এবং বিশেষ করে জন হুইলার John Wheeler)। তাঁদের যুক্তি ছিল : একটি তারকার চুপসে যাওয়ার সঙ্গে গতির যে দ্রুতি জড়িত তার ফলে যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো নির্গত হবে সেগুলো ক্রমশই তারকাটিকে আরো বেশি বেশি গোলীয় (spherical) করে তুলবে এবং যখন স্থিরাবস্থা প্রাপ্ত হবে তখন ওটা হবে নিখুঁত ভাবে গোলীয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে যে কোন ঘূর্ণনবিহীন তারকা এবং অন্তর্বর্তী গঠন যাই হোক না কেন, ঘটনাটি এই রকমই দাঁড়াবে। এই কৃষ্ণগহ্বরের আয়তন নির্ভর করবে শুধুমাত্র তার ভরের উপর। পরবর্তী গণনা এই দৃষ্টিভঙ্গিই সমর্থন করেছে এবং খুবই তাড়াতাড়ি এই মত সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে।

ইজরায়েলের গবেষণাফল শুধুমাত্র ঘূর্ণনহীন বস্তুপিণ্ড থেকে সৃষ্ট কৃষ্ণগহ্বর নিয়েই বিচার করেছে। ১৯৬৩ সালে নিউজিল্যান্ডের রয় কের (Roy Kerr) ব্যাপক অপেক্ষবাদের কয়েকটি সমীকরণের সমাধান আবিষ্কার করেন। সেগুলো ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরের বিবরণ দিয়েছে। এই সমস্ত ‘কের’ কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণনের হার স্থির। তাদের আকার এবং অবয়ব নির্ভর করে শুধুমাত্র তাদের ভর এবং ঘূর্ণনের হারের উপর। ঘূর্ণনের হার যদি শূন্য হয় তাহলে কৃষ্ণগহ্বর হয় নিখুঁতভাবে গোল। এই সমাধান এবং সোয়ার্জচাইল্ড সমাধান অভিন্ন। ঘূর্ণন যদি শূন্য না হয় তাহলে কৃষ্ণগহ্বর নিজ বিষুবরেখা (equator) বরাবর স্ফীতি লাভ করে (ঠিক যেমন সূর্য এবং পৃথিবী তাদের নিজস্ব ঘূর্ণনের ফলে স্ফীতি লাভ করে) এবং ঘূর্ণন যত দ্রুত হবে স্ফীতিও তত বেশি হবে। সুতরাং ইজরায়েলের গবেষণাফল ঘূর্ণায়মান বস্তুপিণ্ডগুলোর ক্ষেত্রে বিচার করতে হলে অনুমান করতে হয় যে কোন ঘূর্ণায়মান বস্তুপিণ্ড চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি করলে শেষ পর্যন্ত কের (Kerr) সমাধানে বিবৃত স্থিরাবস্থায় স্থিত হবে।

১৯৭০ সালে ব্রান্ডন কার্টার (Brandon Carter) নামে আমার একজন সহকর্মী এবং গবেষক ছাত্র এই অনুমান প্রমাণ করার প্রথম পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি দেখিয়েছিলেন একটি ঘূর্ণায়মান স্থির কৃষ্ণগহ্বরের অক্ষ যদি ঘূর্ণায়মান লাটুর মত প্রতিসম (symmetrical) হয় তাহলে তার আকার এবং গঠন নির্ভর করবে শুধুমাত্র তার ভর এবং ঘূর্ণনের হারের উপর। তারপর ১৯৭১ সালে আমি প্রমাণ করলাম : যে কোন স্থির ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণগহ্বরের সত্যই ঐরকম একটি প্রতিসম অক্ষ (axis of sym metry) থাকবে। শেষে ১৯৭৩ সালে লন্ডনের কিংস কলেজের ডেভিড রবিনসন (David Robinson) আমার এবং কার্টারের (Carter) গবেষণাফল ব্যবহার করে দেখালেন অনুমানটা সঠিক ছিল। এরকম একটি কৃষ্ণগহ্বরকে সত্যিই কের সমাধানের অনুগামী হতে হবে। সুতরাং মহাকর্ষের ক্রিয়ায় চুপসে যাওয়ার ফলে কৃষ্ণগহ্বরটিকে এমন একটি অবস্থায় স্থিত হতে হবে যে অবস্থায় এটা ঘূর্ণায়মান হতে পারে কিন্তু স্পন্দনশীল (pulsating) হবে না। তাছাড়া এটার আয়তন এবং গঠন নির্ভর করবে শুধুমাত্র এর ভর এবং ঘূর্ণনের হারের উপর যে বস্তুপিণ্ড চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বরটি তৈরি হয়েছে তার প্রকৃতির (nature) উপর নয়। গবেষণাফলটি পরিচিত হয় এই প্রবচন দিয়ে একটি কৃষ্ণগহ্বরের কোন লোম নেই”। “লোম নেই” উপপাদ্যটির ব্যবহারিক গুরুতু বিরাট। কারণ এ উপপাদ্য কৃষ্ণগহ্বরগুলোর সম্ভাব্য রূপগুলোকে অতীত সীমিত করে। সুতরাং যে সমস্ত বস্তুপিণ্ডের ভিতর কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব সম্ভব সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিরূপ গঠন করে সেগুলোর ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে পর্যবেক্ষণফলের তুলনা করা যায়। এ তথ্যের অন্য অর্থ হল : যে বস্তুপিণ্ড চুপসে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হয়েছে, কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার সময় সেই বস্তুপিণ্ডটি সম্পর্কে অনেক সংবাদ নিশ্চয়ই হারিয়ে গিয়েছে। কারণ, পরবর্তীকালে আমাদের পক্ষে শুধুমাত্র সেটার ভর এবং ঘূর্ণনের হার মাপাই সম্ভব। পরের অধ্যায়ে এ তথ্যের গুরুত্ব বোঝা যাবে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বল্পসংখ্যক এমন কয়েকটি মাত্র ক্ষেত্র আছে যেখানে পর্যবেক্ষণ দ্বারা সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার আগেই বিস্তৃত গাণিতিক প্রতিরূপ (mathematical model) রূপে একটি তত্ত্ব (theory) বিকাশলাভ করেছে। কৃষ্ণগহ্বর তত্ত্ব সেগুলোর ভিতরে একটি। আসলে কৃষ্ণগহ্বর বিরোধীদের এটাই ছিল একটি প্রধান যুক্তি : যে বস্তুর একমাত্র সাক্ষ্য ব্যাপক অপেক্ষবাদ নামক একটি সন্দেহজনক তত্ত্বের ভিত্তিতে গণনা সে বস্তুতে কি করে বিশ্বাস করা যেতে পারে? কিন্তু ১৯৬৩ সালে মার্টেন স্মিডট (Maarten Schmidt) নামে ক্যালিফোর্নিয়ার পালোমার অবজারভেটরীর (Palomar Observatory) একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্বল্পপ্রভ (faint) তারকার মত একটি বস্তুর আলোকের লোহিত বিচ্যুতি (red shift) মাপেন। বিচ্যুতিটা ছিল ৩ সি ২৭৩ নামক বেতার তরঙ্গের উৎস অভিমুখে (অর্থাৎ কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতার উৎসের তৃতীয় তালিকার ২৭৩ নম্বর)। তিনি দেখলেন মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের ফলে বিচ্যুতির তুলনায় এ বিচ্যুতি অনেক বেশি। এটা মহাকর্ষীয় লোহিত বিচ্যুতি হলে বস্তুটি এত বৃহৎ এবং আমাদের এত নিকটে হত যে সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষের গোলমাল (disturb) সৃষ্টি করত। এর থেকে মনে হয়েছিল লোহিত বিচ্যুতির কারণ মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ। তার অর্থ বস্তুপিণ্ডটি বহু দূরে অবস্থিত। অত দূর থেকে দৃষ্টিগোচর হতে হলে বস্তুপিণ্ডটিকে খুবই উজ্জ্বল হতে হবে। অন্য কথায় তা থেকে বিরাট পরিমাণ শক্তি নির্গত হওয়া আবশ্যিক। এই বিরাট পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করার যে একমাত্র প্রক্রিয়া মানুষের মনে আসতে পারে সেটা হল : মহাকর্ষের ক্রিয়ায় শুধু একটি তারকার চুপসে যাওয়া (gravitational collapse) নয়, চুপসে যাওয়া একটি নীহারিকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সমস্তটা। এইরকম প্রায় তারকার মত কয়েকটি বস্তুপিণ্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলোর নাম কোয়াসার (quasistellar objects প্রায় তারকার মত বস্তু)। এগুলোর প্রত্যেকটিরই বৃহৎ পরিমাণ লোহিত বিচ্যুতি আছে। কিন্তু সেগুলো এত বেশি দূরে অবস্থিত যে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করে কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে সিদ্ধান্তমূলক প্রমাণ গ্রহণ করা খুবই শক্ত।

জোসেলিন বেল Jocelyn Bel) নামে কেম্ব্রিজের একজন গবেষক ছাত্রী ১৯৬৭ সালে আকাশে এমন কতকগুলো বস্তু আবিষ্কার করেন যা থেকে নিয়মিত বেতার তরঙ্গের স্পন্দন নির্গত হয়। এই ঘটনায় কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে উৎসাহ আরও বাড়ে। প্রথমে বেল এবং তার তত্ত্বাবধায়ক (supervisor) অ্যান্টনি হিউইস Antony Hesish) ভেবেছিলেন তারা হয়ত নীহারিকার ভিতরে অন্য একটি সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছেন। আমার মনে আছে যে সেমিনারে (seminar- শিক্ষাকেন্দ্রের আলোচনা সভা) তারা তাদের আবিষ্কার ঘোষণা করেছিলেন সেখানে আবিষ্কৃত প্রথম চারটি উৎসের নাম দিয়েছিলেন LGM 1-4, LGM এর অর্থ Little Green Men (ছোট সবুজ মানুষ)। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারা এই বস্তুগুলো সম্পর্কে অনেক কম রোমাঞ্চকর সিদ্ধান্তে আসনে। এগুলোর নাম দেয়া হয় পালসার (Pulsar–স্পন্দমান) এগুলো ছিল আসলে ঘূর্ণায়মান নিউট্রন তারকা। এগুলো থেকে নিয়মিত বেতার তরঙ্গের স্পন্দন (pulse) নির্গত হয়। এর কারণ চৌম্বক ক্ষেত্র এবং পরিবেষ্টনীর পদার্থের (surrounding) ভিতর জটিল পারস্পরিক ক্রিয়া। যারা স্পেস্ (space–স্থান) সম্পর্কে রোমাঞ্চকর উপন্যাস লেখেন তাদের কাছে এটি ছিল দুঃসংবাদ। কিন্তু আমাদের মত যে ক’জন স্বল্পসংখ্যক লোক সে সময় কৃষ্ণগহ্বরে বিশ্বাস করত তাদের কাছে এ সংবাদ ছিল অতীব আশাপ্রদ। নিউট্রন তারকার অস্তিত্ব সম্পর্কে এটাই ছিল প্রথম ইতিবাচক সাক্ষ্য। একটি নিউট্রন তারকার ব্যাসার্ধ হবে প্রায় দশ মাইল। সে ক্রান্তিক ব্যাসার্ধে একটি তারকা কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয় এই ব্যাসার্ধ ছিল তার চাইতে মাত্র কয়েক গুণ বেশি। একটি তারকা যদি চুপসে অত ক্ষুদ্রাকার হতে পারে তাহলে অন্য অনেক তারকাও যে চুপসে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হতে পারে এ রকম আশা করা অযৌক্তিক নয়।

সংজ্ঞা অনুসারে কৃষ্ণগহ্বর থেকে কোন আলোক নির্গত হয় না। তাহলে আমরা কৃষ্ণগহ্বর খুঁজে বার করার আশা করব কি করে? ব্যাপারটি প্রায় কয়লা গুদামে কালো বেড়াল খোঁজার মত। সৌভাগ্যক্রমে উপায় একটি আছে। ১৭৮৩ সালের জন্য মিচেলের John Michel) গবেষণাপত্র এ বিষয়ে পথ-প্রদর্শন করেছে (pioneering)। কৃষ্ণগহ্বর হলেও তারা নিকটবর্তী বস্তুগুলোর উপর মহাকর্ষীয় তর প্রয়োগ করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এমন বহু তন্ত্র (system) পর্যবেক্ষণ করেছেন যেখানে একটি তারকা অন্য একটি তারকাকে প্রদক্ষিণ করে। এর কারণ পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণ। এমন তন্ত্রও দেখা যায় যেখানে একটি তারকাই দৃশ্যমান। সে তারকাটি প্রদক্ষিণ করছে একটি অদৃশ্য সঙ্গীকে। সঙ্গীটি একটি কৃষ্ণগহ্বর এ রকম তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত করা যায় না। এটা এমন তারকা হতে পারে যেটা এত স্বল্পপ্রভ যে দেখা যায় না। কিন্তু এইরকম কিছু কিছু তন্ত্র শক্তিশালী এক্স-রের উৎস সিগনাস X-১ (Cygnus X-1, চিত্র : ৬.২) এইরকম একটি তন্ত্র। এর সবচাইতে ভাল ব্যাখ্যা হল : দৃশ্যমান তারকাটির উপরের স্তর থেকে পদার্থ উড়ে বেরিয়ে গিয়েছে (blown off)। অদৃশ্য সঙ্গীর দিকে পতনের সময় দৃশ্যমান তারকাটিতে একটি সর্পিল গতি (spiral motion) সৃষ্টি হয় (স্নানের টব থেকে জল বেরিয়ে যাওয়ার সময় যে রকম হয়, অনেকটা সেইরকম) এবং অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে তা থেকে এক্স-রে নির্গত হতে থাকে (চিত্র : ৬.৩)। এই প্রক্রিয়া হতে হলে অদৃশ্য বস্তুটিকে শ্বেত বামন (White dwarf) নিউট্রন তারকা কিম্বা কৃষ্ণগহ্বরের মত অত্যন্ত ক্ষুদ্র হতে পারে। দৃশ্যমান তারকাটির কক্ষ পর্যবেক্ষণ করে অদৃশ্য বস্তুটির সম্ভাব্য সর্বনিম্ন ভর নির্ধারণ করা যায়। সিগনাস এক্স-১ এর ক্ষেত্রে এই ভর সূর্যের ভরের ছয় গুণ। চন্দ্রশেখরের গবেষণাফল অনুসারে অদৃশ্য বস্তুটির শ্বেত বামন হওয়ার পক্ষে এই ভর অত্যধিক (too great)। নিউট্রন তারকা হওয়ার পক্ষেও এই ভর অত্যধিক (too large)। সুতরাং মনে হয় অবশ্যই এটা কৃষ্ণগহ্বর।

কৃষ্ণগহ্বর ছাড়াও সিগনার এক্স-১ ব্যাখ্যা করার মত অন্যান্য প্রতিরূপ আছে কিন্তু সেগুলোর সবকটিই কষ্টকল্পিত। কৃষ্ণগহ্বরই মনে হয় এই সমস্ত পর্যবেক্ষণের সত্যিকারের স্বাভাবিক ব্যাখ্যা। এ সত্ত্বেও ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কিপ থর্নের (Kip Thorne) সঙ্গে আমার একটি বাজি আছে। বাজির বিষয় : আসলে সিগনাস এক্স-১ এ কোন কৃষ্ণগহ্বর নেই। বাজিটা আমার কাছে একটি ইনস্যুরেন্স পলিসির মত। কৃষ্ণগহ্বরের উপর আমি অনেক গবেষণা করেছি। যদি দেখা যায় কৃষ্ণগহ্বর বলে কিছু নেই তাহলে আমার সমস্ত গবেষণাকর্মই নিষ্ফল হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমার সান্ত্বনা হবে বাজি জেতা। বাজি জিতলে আমি চার বছর প্রাইভেট আই (Private Eye) পত্রিকা পাব। আর যদি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্ব থাকে তাহলে কিপ এক বছর পেন্টহাউস (Penthouse) পত্রিকা পাবে। ১৯৭৫ সালে যখন আমরা বাজি ধরেছিরাম তখন আমরা প্রায় শতকরা আশিভাগ নিশ্চিত ছিলাম যে সিগনাস একটি কৃষ্ণগহ্বর। এখন আমরা প্রায় শতকরা পঁচানব্বই ভাগ নিশ্চিত কিন্তু বাজিটার নিষ্পত্তি হওয়া এখনও বাকি।

আমাদের নীহারিকার সিগনাল এক্স-১ এর মত একাধিক তন্ত্রে এবং আমাদের প্রতিবেশী মেগালেনিক ক্লাউড (Magellanic Cluds) নামক দুটি নীহারিকাতে কয়েকটি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য আমরা পেয়েছি। কিন্তু কৃষ্ণগহ্বরের সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেক বেশি। মহাবিশ্বের দীর্ঘ ইতিহাসে বহু তারকা নিশ্চয়ই তাদের পারমাণবিক জ্বালানি পুড়িয়ে শেষ করেছে এবং চুপসে যেতে বাধ্য হয়েছে। কৃষ্ণগহ্বরের সংখ্যা দৃশ্যমান তারকার চাইতে বেশিও হতে পারে। শুধুমাত্র আমাদের নীহারিকাতেই দৃশ্যমান তারকার সংখ্যা প্রায় দশ হাজার কোটি। এই বিরাট সংখ্যক কৃষ্ণগহ্বরজাত অতিরিক্ত মহাকর্ষী আকর্ষণ আমাদের নীহারিকার বাস্তব ঘূর্ণনের হার ব্যাখ্যা করতে পারে। দৃশ্যমান তারকার ভর এ ব্যাখ্যার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। আমাদের নীহারিকার কেন্দ্রে এর চাইতে অনেক বেশি বড় একটি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের কিছু সাক্ষ্য আমাদের আছে। সেই কৃষ্ণগহ্বরের ভর আমাদের সূর্যের ভরের চাইতে প্রায় এক লক্ষ গুণ বেশি। কোন তারকা কৃষ্ণগহ্বরের খুব কাছাকাছি এলে তার নিকটতর এবং দূরতর অংশে মহাকর্ষীয় আকর্ষণের পার্থক্যের জন্য তারকাটি ছিন্ন হয়ে যাবে। তাদের অবশিষ্টাংশ এবং অন্যান্য তারকা থেকে যে সমস্ত বায়বীয় পদার্থ নির্গত হয়েছে সবই গিয়ে পড়বে ঐ কৃষ্ণগহ্বরের দিকে। সিগনাস এক্স-১ এর ক্ষেত্রের মত এ ক্ষেত্রেও বায়বীয় পদার্থগুলো সর্পিল গতিতে ভিতরে ঢুকবে আর উত্তপ্ত হবে। তবে সে ক্ষেত্রে যতটা উত্তপ্ত হয়েছিল ততটা নয়। এটা এক্স-রে নির্গত হওয়ার মত উত্তপ্ত হবে না। কিন্তু আমাদের নীহারিকার কেন্দ্রে অত্যন্ত ঘন সন্নিবিষ্ট বেতার তরঙ্গ এবং অবলোহিত রশ্মির উৎসের ব্যাখ্যা এর ভিত্তিতে দেয়া যেতে পারে।

মনে হয় কোয়াসারগুলোর কেন্দ্রে এইরকম কিন্তু এর চাইতেও বড় কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে। সেগুলোর ভর আমাদের সূর্যের ভরের চাইতে প্রায় দশ কোটি গুণ বেশি। এই বস্তুগুলো থেকে যে বিশাল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তার উৎসের একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে ঐ বিশাল ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর পতনশীল পদার্থ। কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর পদার্থের সর্পিল গতি (spiral) কৃষ্ণগহ্বরটিকেও একই অভিমুখে ঘূর্ণায়মান করে, ফলে অনেকটা পৃথিবীরই মত চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। ভিতরে পতনশীল পদার্থ কৃষ্ণগহ্বরের নিকটে অতি উচ্চশক্তি সম্পন্ন কণিকা সৃষ্টি করবে। এর চৌম্বক ক্ষেত্র এত শক্তিশালী হবে যে এই কণিকাগুলোকে কেন্দ্রীভূত করে কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণনের অক্ষ বরাবর ফোয়ারার মত নিক্ষেপ করতে পারবে। অর্থাৎ নিক্ষেপ করবে কৃষ্ণগহ্বরের উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু অভিমুখে। কয়েকটি নীহারিকা এবং কোয়াসারে সত্যিই এরকম ফোয়ারা (jets) দেখা যায়।

সূর্যের চাইতে অনেক কম ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা বিচার করা যেতে পারে। মহাকর্ষের দরুন চুপসে যাওয়ার (gravitational collapse) ফলে এরকম কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হতে পারে না। কারণ এগুলোর ভর চন্দ্রশেখর ভর সীমার চাইতে কম। স্বল্প ভরসম্পন্ন এই কৃষ্ণগহ্বরগুলোর নিজস্ব পারমাণবিক জ্বালানি ফুরিয়ে গেলেও তারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে। শুধুমাত্র অত্যন্ত বৃহৎ বহিরাগত চাপের ফলে পদার্থ বিরাট ঘনত্ব সম্পন্ন হলেই স্বল্প ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা। অতিবৃহৎ হাইড্রোজেন বোমাতেও এরকম অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। পদার্থবিদ্যাবিদ জন হুইলার (John Wheeler) একবার হিসেব করে বলেছিলেন পৃথিবীর সমস্ত সাগরের সবটা ভারি জল দিয়ে যদি একটি হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করা যায় তাহলে তার কেন্দ্রে একটি কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হওয়ার মত চাপ সৃষ্টি হতে পারে। (অবশ্য সেটা পর্যবেক্ষণ করার মত কোন লোক অবশিষ্ট থাকবে না!) আরো একটি বাস্তব সম্ভাবনা হল : মহাবিশ্বের অতি আদিম অবস্থার প্রচণ্ড চাপ ও তাপে এই রকম স্বল্প ভরসম্পন্ন কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হয়ে থাকতে পারে। আদিম মহাবিশ্ব যদি নিখুঁত মসৃণ না থেকে থাকে এইমাত্র তাহলে কৃষ্ণগহ্বর গঠিত হওয়ার সম্ভাবনার অস্তিত্ব সম্ভব। তার কারণ শুধুমাত্র এমন একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল যদি থাকে, যেখানকার ঘনত্ব গড় ঘনত্বের চাইতে বেশি তাহলে চাপের ফলে সেখানে কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু আমরা জানি কিছু অসমাঙ্গতা ছিল, তাছাড়া বর্তমান যুগেও তারকা এবং নীহারিকা রূপে জমে না গিয়ে মহাবিশ্বের পদার্থ নিখুঁত সমরূপে বন্টিত থাকবে। তারকা এবং নীহারিকা গঠনের জন্য যে পরিমাণ অসমাঙ্গতা (irregularity) প্রয়োজন তার ফলে লক্ষণীয় সংখ্যায় “আদিম (pimordial)” কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি হতে পারত কিনা সেটা স্পষ্টতই নির্ভর করবে আদিম মহাবিশ্বের অবস্থার খুঁটিনাটির উপর। সুতরাং বর্তমানে কতকগুলো আদিম কৃষ্ণগহ্বর রয়েছে সেটা যদি নির্ধারণ করতে পারি তাহলে আমরা মহাকাশের প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারব। শুধুমাত্র অন্য দৃশ্যমান পদার্থের উপর এবং মহাবিশ্বে সম্প্রসারণের উপর মহাকর্ষীয় প্রভাবের সাহায্যের একশ’ কোটি টনের (একটি বড় পাহাড়ের ভরের সমান) বেশি ওজনের আদিম কৃষ্ণগহ্বরের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। যাই হোক, পরের অধ্যায়ে আমরা দেখব কৃষ্ণগহ্বরগুলো সত্যিই কৃষ্ণ নয়। তারা উত্তপ্ত বস্তুপিণ্ডের মত তাপদীপ্ত হয়। এগুলো যত ছোট হয় দীপ্তিও এদের তত বেশি হয়। সুতরাং তথ্যাটা স্ববিরোধী হলেও ক্ষুদ্রতর কৃষ্ণগহ্বরগুলোর সন্ধান পাওয়া হয়ত সহজতর হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *