১৩. মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ

১৩. মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ*

[* ১৯৯১ সালের জানুয়ারী মাসে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত ডারউইন বক্তৃতা।]

এই রচনার বিষয়বস্তু মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কিংবা বৈজ্ঞানিকেরা মাহবিশ্বের ভবিষ্যৎ কি হবে বলে ভাবেন। ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দেওয়া অবশ্যই খুব কঠিন কাজ, একবার ভেবেছিলাম আমার একটি বই লেখা উচিত–তার নাম গতকাল, আগামীকাল ও ভবিষ্যতের ইতিহাস। এই বইটি হওয়া উচিত ছিল ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কীয় ইতিহাস। প্রায় সবকটা ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু এই সমস্ত বিফলতা সত্ত্বেও বৈজ্ঞানিকেরা এখনও ভাবেন যে, তারা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন।

আগেরকার দিনে ভবিষ্যদ্বাণী করত দৈবজ্ঞ (oracles) কিংবা ডাইনি বুড়িরা। এরা প্রায়ই হত মহিলা। কোন ওষুধ খাইয়ে কিংবা আগ্নেয়গিরির ধোয়া শুকিয়ে এদের দশা ধরিয়ে দেওয়া হত (trance)। তাদের খ্যাপাটে কথার ব্যাখ্যা করতেন চারপাশের পুরোহিতরা। আসল কায়দা ছিল ব্যাখ্যায়। প্রাচীন গ্রীসে ডেলফির বিখ্যাত দৈবজ্ঞরা দুর্বোধ্যভাবে ঘুরিয়ে উত্তর দেওয়া কিংবা দ্ব্যর্থবোধক কথা বলার জন্য কুখ্যাত ছিল। স্পার্টানরা (Spartans) যখন জিজ্ঞাসা করল, পারসিকরা গ্রীস আক্রমণ করলে কি হবে? দৈবজ্ঞ উত্তর দিল : হয় স্পার্টা ধ্বংস হয়ে যাবে নয়ত তাদের রাজা নিহত হবে। আমার মনে হয় দৈবজ্ঞরা হিসাব করেছিল যদি এই ঘটনাগুলোর কোনটিই না ঘটে তাহলে স্পার্টানরা অ্যাপোলোর কাছে এতই কৃতজ্ঞ হবে যে, তাদের দৈবজ্ঞ যে ভুল করেছিল সেটি তারা অগ্রাহ্য করবে। আসলে থার্মোপলির গিরিপথ রক্ষা করতে গিয়ে রাজা নিহত হন। এই যুদ্ধে স্পার্টা বেঁচে গেল এবং পারসিকরাও শেষ পর্যন্ত হেরে গেল।

আরেকবার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী লিডিয়ার রাজা ক্রিসাস (Croesus) জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তিনি যদি পারস্য আক্রমণ করেন তাহলে কি হবে? উত্তরটি ছিল : এক বিরাট রাজত্বের পতন হবে। ক্রিসাস ভেবেছিলেন এর অর্থ পারসিক রাজত্ব। কিন্তু পতন হল তার নিজের রাজত্বের, তিনি শেষ হলেন চিতাতে। তাঁকে প্রায় জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছিল।

বর্তমান কালের ভবিষ্যৎ বক্তারা কাটবার জন্য নিজেদের গলা বাড়িয়ে দিতে আরও বেশি প্রস্তুত। তারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার নির্দিষ্ট ও নিশ্চিত তারিখ পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছেন। এসব ভবিষ্যদ্বাণীর শেয়ার বাজারের দর কমিয়ে দেওয়ার একটি প্রবণতা আছে। আমার কিন্তু মাথায় ঢোকে না পৃথিবী ধ্বংস হলে লোকে শেয়ার বেচতে চাইবে কেন? বোধহয় এর কোনটিই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারবে না বলে।

এ পর্যন্ত পৃথিবীর অন্তিম বলে যে কয়টি তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে তার প্রতিটি তারিখই ঘটনাবিহীন হয়ে কেটেছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ বক্তারা অনেক সময় এই আপাতদৃষ্ট বিফলতার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উদাহরণ : ‘সেভেনথ ডে অ্যাডভেন্টিস্টদের (Seventh Day Advantists একটি ক্রিস্টান সম্প্রদায়, অনুবাদক) প্রতিষ্ঠাতা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন দ্বিতীয় আগমন’ হবে ২১ মার্চ, ১৮৪৩ থেকে ২১ মার্চ, ১৮৪৪ এর ভিতরে। কিছুই যখন হল না তখন তারিখটি সংশোধন করে বলা হল ঘটনাটি ঘটবে ২২ অক্টোবর, ১৮৪৪। সেই তারিখে যখন কোন ঘটনা ঘটল না তখন একটি নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া হল। এই ব্যাখ্যা অনুসারে ১৮৪৪ ছিল দ্বিতীয় আগমনের’ শুরু। কিন্তু প্রথমে ‘বুক অফ লাইফে’র (Book of Life) নামগুলো গোনা প্রয়োজন, তারপরেই যাদের নাম নেই তাদের বিচারের দিন আসবে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে গুণতে দীর্ঘ সময় লাগছে।

বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণীগুলো অবশ্যই দৈবজ্ঞ কিংবা ভবিষ্যৎ বক্তার চাইতে বেশি বিশ্বাসযোগ্য নয়। আবহাওয়ার পূর্বাভাসের কথা চিন্তা করলেই এটি বোঝা যাবে। কিন্তু আমরা ভাবি কতগুলো পরিস্থিতিতে আমরা বিশ্বাসযোগ্য ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। বৃহৎ মানে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সেগুলোর ভিতর একটি।

গত তিনশ’ বছরে স্বাভাবিক অবস্থায় পদার্থকে শাসন করার বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো আমরা আবিষ্কার করেছি। অত্যন্ত চরম অবস্থায় পদার্থের নির্ভুল শাসনবিধি আমরা এখনও জানি না। মহাবিশ্ব কিভাবে শুরু হয়েছিল, সেটি বুঝবার জন্য এই বিধিগুলো গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্ব যদি পুনর্বার চুপসে গিয়ে উচ্চ ঘনত্বের অবস্থায় না পৌঁছায়, তাহলে ঐ বৈজ্ঞানিক বিধিগুলো মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ বিবর্তনকে প্রভাবিত করে না। আসলে এই উচ্চশক্তি বিষয়ক বিধিগুলো মহাবিশ্বকে কত অল্প প্রভাবিত করে, এটি তার একটি মাপন। যেহেতু কণিকাগুলোকে পরীক্ষা করার জন্য দৈত্যাকার কণিকাযন্ত্র তৈরি করতে আমাদের বিরাট অর্থ ব্যয় করতে হয়, সেজন্য এই মাপন প্রয়োজন।

যদি বা আমরা মহাবিশ্ব শাসনকারী প্রাসঙ্গিক বিধিগুলো জানি তবুও সুদূর ভবিষ্যৎ। সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো সামর্থ্য আমাদের নাও থাকতে পারে। তার কারণ, পদার্থবিদ্যার সমাধানগুলো একটি ধর্ম প্রদর্শন না হতে পারে। একটি তন্ত্রের কর্মপদ্ধতির প্রতিবারে অল্প পরিমাণ পরিবর্তন করুন। তন্ত্রটির পরবর্তী আচরণ শীঘ্রই হতে পারে সম্পূর্ণ পৃথক। উদাহরণ, আপনি যদি একটি রুলেটের (Roulett) চাকার (এরকম জুয়া খেলার চক্রবিশেষ) চক্ৰণে (spin) সামান্য পরিবর্তন করেন, তাহলে যে সংখ্যাটি উঠবে আপনি সেটারও পরিবর্তন করবেন। কোন সংখ্যাটি উঠবে, সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা। কার্যক্ষেত্রে অসম্ভব। তাহলে পদার্থবিদরা ক্যাসিনোতে (Casino) জুয়া খেলার আড্ডায় বিরাট অর্থ উপার্জন করতে পারতেন।

অস্থির এবং বিশৃঙখল তন্ত্রে সাধারণত একটি সময়ের মান থাকে। এই সময়ের ভিতরে প্রাথমিক অবস্থার একটি ক্ষুদ্র পরিবর্তন দ্বিগুণ বৃহৎ পরিবর্তনে পরিণত হয় । পৃথিবীর আবহাওয়ার ক্ষেত্রে এই সময়ের মান পাঁচ দিনের মতো। অর্থাৎ বায়ু পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করতে যে সময় নেয় সেই সময়। পাঁচ দিন পর্যন্ত আবহাওয়া সম্পর্কে মোটামুটি নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। কিন্তু তার চাইতে বেশিদিন সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হলে আবহাওয়ার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে নির্ভুল জ্ঞান প্রয়োজন এবং প্রয়োজন একটি অসম্ভব জটিল গণনা। শুধুমাত্র ঋতুভিত্তিক গড় প্রকাশ ছাড়া ছয় মাস পরের আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করার কোন উপায় নেই।

আমরা রসায়ন এবং জীববিদ্যার শাসনকারী মূলগত বিধিগুলো জানি। সুতরাং নীতিগতভাবে আমাদের মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে সেটি নির্ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের থাকা উচিত। কিন্তু মস্তিষ্কের শাসনকারী সমীকরণগুলোর আচারণ প্রায় নিশ্চিতভাবে বিশৃঙখল chaotic) অর্থাৎ প্রাথমিক অবস্থায় সামান্য পরিবর্তন একটি অত্যন্ত পৃথক ফলের পথিকৃৎ হতে পারে। সুতরাং কার্যক্ষেত্রে শাসনকারী সমীকরণগুলো জানি। বিজ্ঞান মানবসমাজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোন পূর্বাভাস দিতে পারে না– যদি এ সমাজের কোন ভবিষ্যৎ থেকে থাকে। বিপদটি হল আমাদের পরিবেশকে দূষিত করার কিংবা পরস্পরকে ধ্বংস করার ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই ক্ষমতা ব্যবহার করা সম্পর্কে আমাদের প্রজ্ঞা যত দ্রুত বাড়ছে তার চাইতে অনেক বেশি দ্রুত বাড়ছে আমাদের এই ধ্বংস করার ক্ষমতা।

আমাদের পৃথিবীতে যাই হোক না কেন, মহাবিশ্বের অবশিষ্টাংশ সে সম্পর্কে কোন গ্রাহ্য না করেই চলতে থাকবে। মনে হয় সূর্যের সর্বপার্শ্বে গ্রহগুলোর গতি শেষ পর্যন্ত বিশৃঙখল chaotic)। যদিও সে বিশৃঙ্খলার কালিক মাপ দীর্ঘ। এর অর্থ কালের অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে যে কোন ভবিষ্যদ্বাণীর ভ্রান্তি বৃদ্ধি পায়। একটি বিশেষ কালের পর এই গতি সম্পর্কে বিস্তৃত ভবিষ্যদ্বাণী করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি যে, দীর্ঘদিন পর্যন্ত শুক্র এবং পৃথিবী ঘনিষ্ঠভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হবে না কিন্তু অক্ষের সামান্য অস্থিরতার যোগ হতে হতে আজ থেকে একশ’ কোটি বছর পর দুটি গ্রহ ঐরকম মুখোমুখি হবে না–এ বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। সূর্য এবং নীহারিকার অন্যান্য তারকা আর স্থানীয় নীহারিকা গোষ্ঠীর অন্তর্বর্তী নীহারিকার গতিও বিশৃঙ্খল chaot ic)। আমরা পর্যবেক্ষণ করি অন্যান্য নীহারিকাগুলো আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসারণ করছে। তারা আমাদের কাছ থেকে যদ দূরে যায়, তাদের দূরাপসরণের গতিও তত বৃদ্ধি পায়। এর অর্থ মহাবিশ্ব আমাদের কাছাকাছি অঞ্চলে প্রসারমাণ। কালের অগ্রগতির সঙ্গে বিভিন্ন নীহারিকার মধ্যবর্তী দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ প্রসারণ মসৃণ, এ প্রসারণ বিশৃঙ্খলও নয়। এর সাক্ষ্য বাইরের স্থান থেকে আগত আমাদের পর্যবেক্ষণ করা মাইক্রোওয়েভ বিকিরণের পশ্চাৎপট। আপনার টেলিভিশন শূন্য চ্যালেন লক্ষ্য করে চালালেই এটি আপনি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন। আপনার টেলিভিশনের পর্দায় যে ফুটফুট চিহ্ন দেখতে পান তার একটি ক্ষুদ্র অংশের কারণ সৌরতন্ত্রের বাইরে থেকে আগত মাইক্রোওয়েভ। আপনি মাইক্রোওয়েভ আভেনে (oven) যে বিকিরণ পান, এ বিকিরণ সেইরকমই তবে অনেক বেশি দুর্বল। খাদ্যের উত্তাপকে এ বিকিরণ চরম শূন্য থেকে ২.৭ তাপমাত্রায় উঠাতে পারবে। সুতরাং আপনি যে পিজা (Pizza) সঙ্গে নিয়ে যান, সেটিকে এই বিকিরণ দিয়ে গরম করতে পারবেন। মনে হয়, এই বিকিরণ মহাবিশ্বের উত্তপ্ত আদিম স্তরের বিকিরণের অবশিষ্টাংশ। কিন্তু এর সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সবদিক থেকে আগত বিকিরণই মোটামুটি অভিন্ন। ‘কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড এক্সপ্লোরার স্যাটেলাইট’ (Cosmic Background Explorar Satelite মহাজাগতিক পশ্চাৎপট অনুসন্ধানের উপগ্রহ) এর এই সমস্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তৈরি একটি মানচিত্রে বিকিরণের বিভিন্ন তাপমাত্রা দেখা যাবে। এই তাপমাত্রাগুলো বিভিন্ন অভিমুখে বিভিন্ন। কিন্তু এই ভেদগুলো খুবই সামান্য। এক লক্ষ্যের শুধুমাত্র এক ভাগ। বিভিন্ন অভিমুখ থেকে আগত মাইক্রোওয়েভে কিছুটা পার্থক্য হওয় উচিত, কারণ মহাবিশ্ব সম্পূর্ণ মসৃণ নয়, তারকা, নীহারিকা এবং নীহারিকাপুঞ্জের মতো কিছু কিছু স্থানীয় অনিয়ম রয়েছে। কিন্তু এই মাইক্রোওয়েভ পশ্চাৎপটের ভেদ। (variation) যতটা সম্ভব ক্ষুদ্র এবং যে স্থানীয় অনিয়ম আমরা পর্যবেক্ষণ করি তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক লক্ষের ভিতরে ৯৯,৯৯৯ ভাগে মাইক্রোওয়েভ পশ্চাৎপট সমস্ত অভিমুখেই অভিন্ন।

প্রাচীনকালে লোকের বিশ্বাস ছিল পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত। সুতরাং পশ্চাৎপট সমস্ত অভিমুখেই অভিন্ন এ সংবাদে তারা আশ্চর্য হতেন না। কিন্তু কোপারনিকাসের সময় থেকে আমাদের পদের অবনতি হয়েছে। আমরা এখন দৃশ্যমান দশ হাজার বিলিয়ন নীহারিকার ভিতরে একটি জাতিরূপ (typical) নীহারিকার বাইরের কিনারায় অবস্থিত অত্যন্ত সাধারণ একটি তারকাকে প্রদক্ষিণ করে ভ্রাম্যমাণ একটি অপ্রধান গ্ৰহমাত্র। আমরা এখন এতই সামান্য যে মহাবিশ্বে কোন বিশেষ স্থান দাবি করতে পারি না। সেজন্য আমাদের অবশ্যই অনুমান করতে হবে, যে কোন নীহারিকার দিকে, যে কোন অভিমুখে পশ্চাৎপট অভিন্ন। এটি সম্ভব হতে পারে যদি শুধুমাত্র মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব এবং সম্প্রসারণের হার সর্বত্র অভিন্ন হয়। একটি বিরাট অঞ্চলে গড় ঘনত্বের কিংবা সম্প্রসারণের হারে যে কোন ভেদের ফলে মাইক্রোওয়েভ পশ্চাৎপট বিভিন্ন অভিমুখে বিভিন্ন হবে। এর অর্থ অতি বৃহৎ মানে মহাবিশ্বের আচরণ সরল কিন্তু বিশৃঙ্খল নয়। সুতরাং সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত এর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।

যেহেতু মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এত সুষম, সেজন্য এর বিবরণ একটি সংখ্যার বাগ্বিধিতে দেওয়া সম্ভব, সে সংখ্যাটি দুটি নীহারিকার অন্তর্বর্তী দূরত্ব। বর্তমানে এই দূরত্ব বদ্ধমান কিন্তু আশা করা যায় বিভিন্ন নীহারিকার পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এই প্রসারণের হার কমিয়ে দেবে। মহাবিশ্বের ঘনত্ব যদি একটি ক্রান্তিক মূল্যাঙ্কের চাইতে বেশি হয় তাহলে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ পরিণামে সম্প্রসারণকে থামিয়ে দেবে এবং মহাবিশ্ব আবার সঙ্কোচন শুরু করবে। মহাবিশ্ব একটি বৃহৎ সঙ্কোচনে চুপসে যাবে। বৃহৎ সঙ্কোচন হবে যাকে অনন্যতা বলে তাই। এটি একটি অসীম ঘনত্বের অবস্থা–এ অবস্থায় পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো ভেঙ্গে পড়ে। এর অর্থ বৃহৎ সঙ্কোচনের পর যদি কোন ঘটনা ঘটেও থাকত, তাহলেও সে সময়ে কি ঘটেছিল সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত না। কিন্তু ঘটনাগুলোর ভিতর কোন কার্যকারণ সম্পর্ক না থাকলে, একটি ঘটনা আর একটির পর ঘটেছিল এ কথা বলার কোন অর্থবহ উপায় থাকে না। এ কথাও বলা যেতে পারে, বৃহৎ সঙ্কোচনে আমাদের মহাবিশ্ব শেষ হয়ে গিয়েছিল এবং তারপর যদি কোন ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে সে ঘটনা অন্য একটি পৃথক মহাবিশ্বের ঘটনা। এটা অনেকটা পুনর্জন্মের মতো। পূর্বে মৃত একটি শিশু একটি নতুন একটি শিশু অভিন্ন এই দাবির কি অর্থ হতে পারে, যদি নতুন শিশুটির পূর্বজন্ম থেকে প্রাপ্ত কোন বৈশিষ্ট কিংবা স্মৃতি না থাকে? সহজেই বলা যেতে পারে ও একটি পৃথক ব্যক্তি।

মহাবিশ্বের গড় ঘনতু যদি ক্রান্তিক ঘনত্বের চাইতে অল্প হয় তাহলে মহাবিশ্ব আবার চুপসে যাবে না এবং চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। একটি বিশেষ কালের পর ঘনত্ব এত কম হবে যে প্রসারণ হ্রাস করার উপর মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কোন উল্লেখযোগ্য ক্রিয়া থাকবে না। নীহারিকাগুলো একটি স্থির দ্রুতিতে পরস্পর থেকে দূরে অপসারণ করতে থাকবে।

সুতরাং মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বিনিশ্চায়ক প্রশ্ন : গড় ঘনত্ব কত? যদি ক্রান্তিক ঘনত্বের চাইতে এ ঘনত্ব কম হয় তাহলে মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। কিন্তু যদি বেশি হয় তাহলে মহাবিশ্ব আবার চুপসে যাবে এবং বৃহৎ সঙ্কোচনে কাল নিজেই শেষ হয়ে যাবে। ধ্বংসের ভবিষ্যদ্বাণী করাতে দৈবজ্ঞের তুলনায় আমার একটি সুবিধা আছে। যদি এই হয় যে মহাবিশ্ব চুপসে যেতে চলেছে তাহলেও আমি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি আরও এক হাজার কোটি বছর পর্যন্ত মহাবিশ্বের প্রসারণ বন্ধ হবে না। আমার ভুল হয়েছে প্রমাণিত হওয়ার জন্য অতদিন আমি বেঁচে থাকব না।

পর্যবেক্ষণের সাহায্যে আমরা মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব হিসাব করার চেষ্টা করতে পারি। দৃশ্যমান তারকাগুলো যদি আমরা গণনা করি এবং তাদের ভরগুলো যোগ করি তাহলে আমরা ক্রান্তিক ঘনত্বের শতকরা এক ভাগের চাইতেও কম পাই। মহাবিশ্বে আমরা যে বায়বীয় পদার্থের মেঘ দেখতে পাই, সেগুলোর ভর যদি আমরা যোগ করি তাহলেও মোট যোগফল হয় প্রান্তিক মূল্যাঙ্কের শতকরা এক ভাগের চাইতেও কম। তবে আমরা জানি যাকে অদীপ্ত (dark) পদার্থ বলা হয় মহাবিশ্বে সে রকম পদার্থও নিশ্চয়ই কিছু আছে। আমরা সেগুলোকে প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারি না। এই অদীপ্ত পদার্থগুলো সম্পর্কে একটি সাক্ষ্য পাওয়া যায় সর্পিল নীহারিকাগুলো থেকে। এগুলো বিশাল প্যানকেকের * [*প্যানকেক–ধোসা, পাটিসাপটা, সরু চালকি ইত্যাদির মতো পিঠে] মতো গঠনের বায়বীয় পদার্থ এবং তারকার সগ্রহ। আমরা পর্যবেক্ষণ করি সেগুলো কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করে ঘূর্ণায়মান কিন্তু ঘূর্ণনের হার যথেষ্ট উচ্চ। আমরা যা পর্যবেক্ষণ করি যদি সেই তারকা এবং বায়বীয় পদার্থই থাকত তাহলে সেগুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছিটকে যেত। নিশ্চয়ই এমন কিছু অদৃশ্য ধরনের পদার্থ আছে, যার মহাকর্ষীয় আকর্ষণ ঘূর্ণায়মান নীহারিকাগুলোকে ধরে রাখার মতো যথেষ্ট বেশি।

অদীপ্ত পদার্থ সম্পর্কে আর একটি সাক্ষ্য পাওয়া যায় নীহারিকাপুঞ্জগুলো থেকে। আমরা পর্যবেক্ষণ করি নীহারিকাগুলো সমস্ত স্থানে সমভাবে বন্টিত নয়। তারা পুঞ্জে পুঞ্জে সংগৃহীত। কোন পুঞ্জে আছে কয়েকটি মাত্র নীহারিকা, আবার কোন পুঞ্জে নিযুত নিযুত নীহারিকা। সম্ভবত নীহারিকাগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে গোষ্ঠীবদ্ধ হয় বলে এই পুঞ্জগুলো গঠিত হয়। তবে এই পুঞ্জগুলোর ভিতরে একক নীহারকাগুলো কি দ্রুতিতে চলমান সেটা মাপা সম্ভব। আমরা দেখতে পাই, দ্রুতি এত বেশি যে কোন মহাকর্ষীয় আকর্ষণ দ্বারা সংযুক্ত না হলে তারা ভেঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে যেতে (fly apart)। যে ভর প্রয়োজন, সেটি সমস্ত নীহারিকার সংযুক্ত ভরের চাইতে অনেক বেশি। যদি আমরা ধরে নিই নীহারিকাগুলোকে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় একত্র ধরে রাখবার মতো ভর তাদের রয়েছে, তাদেরও এ তথ্য সত্য। এ থেকে মনে হয়–সেজন্য যে নীহারিকাগুলোকে আমরা দেখতে পাই, তার বাইরে নীহারিকাপুঞ্জের ভিতরে অতিরিক্ত অদীপ্ত (dark) পদার্থ রয়েছে।

যে সম্পর্কে নির্দিষ্ট নিশ্চিত সাক্ষাৎ আমরা পাই, সেই নীহারিকা এবং নীহারিকা গুঞ্জগুলোর ভিতরে যে অদীপ্ত পদার্থ বর্তমান, সে সম্পর্কে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য একটি অনুমান করা সম্ভব। কিন্তু এই হিসাবও মহাবিশ্বের আর একবার চুপসে যাওয়ার জন্য যে ক্রান্তিক ঘনত্বের প্রয়োজন তার শতকরা প্রায় দশ ভাগ মাত্র। সুতরাং কেউ যদি পর্যবেক্ষিত সাক্ষ্য দিয়ে চালিত হন, তাহলে তার ভবিষ্যদ্বাণী হবে মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকবে। আর কম বেশি পাঁচশ’ কোটি বছর পর সূর্যের পারমাণবিক জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে, তখন সেটি ফুলে, যাকে লোহিত দৈত্য বলা হয়, তাতে পরিণত হবে। যতদিন না এই সূর্যটি পৃথিবী এবং অন্যান্য নিকটবর্তী গ্রহগুলোকে গ্রাস করে, ততদিন এভাবেই থাকবে। তারপর সেটা কয়েক হাজার মাইল দৈর্ঘ্যের একটি শ্বেত বামন তারকারূপে স্থিতি লাভ করবে। সুতরাং আমি বিশ্বের অন্ত সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করছি, কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ বলা হয়নি। আমার মনে হয় না, এই ভবিষ্যদ্বাণীতে শেয়ার বাজারের দাম খুব বেশি কমবে। দিগন্তে আরও দুই-একটি তাৎক্ষণিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। যাই হোক না কেন, যতদিনে সূর্য বিস্ফোরিত হবে, ততদিনে আমরা আন্তঃতারকা ভ্রমণের প্রযুক্তি রপ্ত করে। ফেলব, অবশ্য তার আগে যদি আমরা নিজেদের ধ্বংস না করে ফেলি।

প্রায় এক হাজার কোটি বছর পরে মহাবিশ্বের অধিকাংশ তারকাই পুড়ে শেষ হয়ে যাবে। সূর্যের মতো ভরের তারকাগুলো হয় শ্বেত বামন নয়ত নিউট্রন তারকায় পরিণত হবে। নিউট্রন তারকাগুলো শ্বেত বামনের (white dwarf) চাইতে ক্ষুদ্র এবং ঘন। আরও বেশি ভরযুক্ত তারকাগুলো কৃষ্ণগহ্বর হতে পারে। সেগুলো আরও ক্ষুদ্র। সেগুলোর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে খুবই শক্তিশালী। কোন আলোক সেখান থেকে পলায়ন করতে পারে না। তবে, এই অবশিষ্ট্যাংশগুলো তখনও আমাদের নীহারিকার কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করতে থাকবে, প্রদক্ষিণ করবে প্রায় দশ কোটি বছরে একবার। অবশিষ্ট অংশগুলোর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে মুখোমুখি হওয়ার দরুন কয়েকটি নীহারিকা থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাবে। অবশিষ্ট অংশ কেন্দ্রে সর্বদিকে ঘনিষ্ঠতর কক্ষে সুস্থির হয়ে থাকবে এবং পরিণামে একত্রিত হয়ে নীহারিকার কেন্দ্রে একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বর সৃষ্টি করবে। নীহারিকা এবং নীহারিকাপুঞ্জের ভিতরকার অদীপ্ত পদার্থ যাই হোক না কেন, সেগুলোও ঐ অতি বিশাল কৃষ্ণগহ্বরগুলোর ভিতরে পতিত হবে বলে আশা করা যায়।

সুতরাং ধরে নেওয়া যেতে পারে, নীহারিকা এবং নীহারিকাপুঞ্জের ভিতরকার পদার্থগুলোর অধিকাংশকেই পরিণামে কৃষ্ণগহ্বরে গিয়ে শেষ হতে হবে। তবে কিছুদিন আগে আমি আবিষ্কার করেছি কৃষ্ণগহ্বরগুলোকে যত কৃষ্ণবর্ণ বলে প্রচার করা হয় গহ্বরগুলো তত কৃষ্ণ নয়। কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতি বলে, কণিকাগুলোর সুসংজ্ঞিত অবস্থান এবং সুসংজ্ঞিত দ্রুতি দুটিই যুগপৎ থাকতে পারে না। কণিকার অবস্থান যত নির্ভুলভাবে সুসংজ্ঞিত হবে তত কণিকার দ্রুতি সুসংজ্ঞিত হবে কম নির্ভুলভাবে। একটি কণিকা যদি কৃষ্ণগহ্বরে থাকে, তাহলে তার অবস্থান কষ্ণগহ্বরের ভিতরে সুসংজ্ঞিত। এর অর্থ তার দ্রুতি নির্ভুলভাবে সংজ্ঞিত করা যায় না। সেজন্য কণিকাটির দ্রুতি আলোকের দ্রুতির চাইতে বেশি হওয়া সম্ভব। এর ফলে কণিকাটি কৃষ্ণগহ্বর থেকে পলায়ন করতে পারবে। একটি নীহারিকার কেন্দ্রের বিশাল দৈত্যাকার কৃষ্ণগহ্বর দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বহু নিযুত মাইল হতে পারে, ফলে এর ভিতরকার কণিকার অবস্থানের একটি বিরাট অনিশ্চয়তা থাকবে। সেজন্য কণিকাটির দ্রুতির অনিশ্চয়তা হবে সামান্য। এর অর্থ কৃষ্ণগহ্বর থেকে পলায়ন করতে অনেক বেশি সময় লাগবে। কিন্তু পরিণামে কণিকাটি পলায়ন করবে। নীহারিকার কেন্দ্রে অবস্থিত একটি বৃহৎ কৃষ্ণগহ্বর উবে গিয়ে সম্পূর্ণ অদৃশ্য হতে ১০৯০ বছর লাগতে পারে অর্থাৎ একের পিঠে নব্বইটি শূন্য। এই কাল মহাবিশ্বের আধুনিক বয়সের চাইতে অনেক বেশি। মহাবিশ্বের বয়স ১০১০ বছর অর্থাৎ একের পিঠে দশটি শূন্য। তবুও মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতে থাকলে তার জন্য যথেষ্ট সময় থাকবে।

যে মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে, তার ভবিষ্যৎটি বড় একঘেয়ে। তবে মহাবিশ্ব যে চিরকাল প্রসারিত হতে থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মহাবিশ্বের পুনর্বার। চুপসে যাওয়ার জন্য যে ঘনত্ব প্রয়োজন তার প্রায় এক দশমাংশ সম্পর্কে আমাদের নির্দিষ্ট নিশ্চিত সাক্ষ্য রয়েছে, তবুও আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। এরকম অন্য ধরনের অদীপ্ত পদার্থ থাকতে পারে। সেই পদার্থগুলো মহাবিশ্বের গড় ঘনত্ব ক্রান্তিক ঘনত্বে নিয়ে যেতে পারে। কিংবা তার চাইতে বেশিও করে দিতে পারে। এই অতিরিক্ত অদীপ্ত পদার্থগুলোর অবস্থান হতে হবে নীহারিকাগুলো এবং নীহারিকাপুঞ্জগুলোর বাইরে। না হলে আমরা নীহারিকাগুলোর আবর্তনে কিংবা নীহারিকাপুঞ্জের গতিতে তার ক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারতাম।

আমরা কেন ভাবব, মহাবিশ্বের পরিণামে আবার চুপসে যাওয়ার মতো যথেষ্ট অদীপ্ত পদার্থ থাকতে পারে? যে পদার্থের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের নির্দিষ্ট নিশ্চিত সাক্ষ্য আছে, কেন আমরা তার উপরেই বিশ্বাস স্থাপন করব না? কারণটি হল, বর্তমানে ক্রান্তিক ঘনত্বের শুধুমাত্র দশ ভাগ থাকার জন্য প্রাথমিক ঘনত্ব এবং প্রসারণের হারের একটি অবিশ্বাস্য রকম সযত্ন নির্বাচন প্রয়োজন ছিল। যদি বৃহৎ বিস্ফোরণের এক সেকেন্ড পর মহাবিশ্বের ঘনত্ব দশ কোটি ভাগের এক ভাগ বেশি হত তাহলে মহাবিশ্ব দশ বছর বাদে আবার চুপসে যেত। আবার ঘনত্ব যদি একই পরিমাণে কম হত, তাহলে দশ বছরের কাছাকাছি বয়স হওয়ার পর থেকে মহাবিশ্ব মূলত শূন্য থাকত।

মহাবিশ্বে প্রাথমিক ঘনত্ব এত সযত্নে নির্বাচন করা হয়েছিল কিভাবে? মহাবিশ্বে নির্ভুল ক্রান্তিক ঘনত্ব থাকার হয়ত কোন কারণ আছে। দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মনে হয়। একটি হল তথাকথিত নরত্বীয় নীতি (anthropic principle), সেটি এক বাগ্বিধিতে প্রকাশ করা যায় : মহাবিশ্ব যে রকম আছে, সে রকম থাকার কারণ অন্যরকম হলে সেটি পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমরা এখানে উপস্থিত থাকতাম না। কল্পনটি হল : বিভিন্ন ঘনত্বসম্পন্ন বহু বিভিন্ন মহাবিশ্ব থাকতে পারত। শুধুমাত্র যেগুলো ক্রান্তিক ঘনত্বের খুবই কাছাকাছি সেগুলোরই তারকা এবং গ্রহ গঠন করার মতো দীর্ঘায়ু এবং যথেষ্ট পদার্থ সমন্বিত হওয়ার কথা। একমাত্র সেই সমস্ত বিশ্বেই বুদ্ধিমান জীবরা থাকতে পারে, যারা এই প্রশ্ন করবে–ঘনত্বটি কেন ক্রান্তিক ঘনত্বের এত কাছাকাছি? মহাবিশ্বের বর্তমান ঘনত্বের যদি এই ব্যাখ্যা হয়, তাহলে আমরা যা বুঝতে পেরেছি মহাবিশ্বে তার চাইতে বেশি পদার্থ আছে সেটি বিশ্বাস করার কোন যুক্তি নেই। ক্রান্তিক ঘনত্বের এক দশমাংশ থাকাই নীহারিকা এবং তারকা গঠিত হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

নরত্বীয় নীতি (anthropic principle) অনেকেই পছন্দ করেন না। তার কারণ এ নীতি আমাদের অস্তিত্বের উপর বড় বেশি গুরুত্ব আরোপ করে। সেজন্য ঘনত্ব কেন ক্রান্তিক ঘনত্বের এত নিকটে হবে তার সম্ভাব্য অন্য ব্যাখ্যা অনুসন্ধান করা হয়েছে। এই অনুসন্ধান মহাবিশ্বে অতিপ্রসারণ তত্ত্বের পথ দেখিয়েছে। কল্পনটি হল : ঠিক যেমন যে সমস্ত দেশে চরম মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, সেই সমস্ত দেশে কয়েক মাস পরপর মূল্যমান দ্বিগুণিত হয়। তবে মহাবিশ্বের অতিস্ফীতি (inflation) অনেক দ্রুত এবং আরও অনেক বেশি চরম হওয়ার কথা : এই স্ফীতির গুণক (factor) একটি অতি ক্ষুদ্র স্ফীতিতে অন্ততপক্ষে এক বিলিয়ান, বিলিয়ান, বিলিয়ান, এর ফলে মহাবিশ্ব নির্ভুল ক্রান্তিক ঘনত্বের এত নিকটে হত যে, সেটি বর্তমান কালেও ক্রান্তিক ঘনত্বের খুব কাছাকাছি থাকত। সুতরাং অতিস্ফীতি তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ক্রান্তিক ঘনত্বে নিয়ে আসবার মতো যথেষ্ট অদীপ্ত পদার্থ অবশ্যই থাকবে। এর অর্থ, পরিণামে মহাবিশ্ব হয়ত পুনর্বার সঙ্কুচিত হবে কিন্তু যে দেড় কোটি বছরের কাছাকাছি মহাবিশ্ব। প্রসারিত হচ্ছে তার চাইতে বেশি দীর্ঘকাল নয়।

অতিস্ফীতি তত্ত্ব যদি সঠিক হয়, তাহলে ঐ অতিরিক্ত অদীপ্ত (dark) পদার্থগুলো কি? মনে হয়, এগুলো হয়ত বিভিন্ন ধরনের সাধারণ পদার্থ, যে পদার্থ দিয়ে তারকা এবং গ্রহগুলো গঠিত তার চাইতে পৃথক। বৃহৎ বিস্ফোরণের প্রথম তিন মিনিটের ভিতরে মহাবিশ্বের উত্তপ্ত আদিম স্তরে যে নানারকম হাল্কা মৌলিক পদার্থগুলোর সৃষ্টি হত তার পরিমাণের একটি গণনা আমরা করতে পারি। এই হাল্কা মৌলিক পদার্থগুলোর light element) পরিমাণ নির্ভর করে মহাবিশ্বের স্বাভাবিক পদার্থের পরিমাণের উপর হাল্কা মৌলিক পদার্থগুলোর পরিমাণ আনুভূমিক অক্ষে রেখে লেখচিত্র (graph) করা যায়। যদি স্বাভাবিক পদার্থের মোট পরিমাণ এখনকার ক্রান্তিক পরিমাণের মাত্র এক দশমাংশ হয়, তাহলে পর্যবেক্ষণ করা প্রাচুর্যের সঙ্গে একটি উত্তম মতৈক্য পাওয়া যায়। হতে পারে এই গণনাগুলো ভুল। কিন্তু আমরা কয়েকিট মৌলিক পদার্থের ভিতরে এই বর্যবেক্ষণ করা প্রাচুর্য পাই–এ তথ্য মনকে খুবই প্রভাবিত করে।

যদি আমরা অদীপ্ত পদার্থের ক্রান্তিক ঘনত্ব পাই তাহলে সেগুলো কি হতে পারে সে বিষয়ে প্রথম প্রার্থী (candidate) হবে মহাবিশ্বের আদিম স্তর থেকে পড়ে থাকা অবশিষ্ট একটি সম্ভাবনা-মৌলকণা। অনেকগুলো প্রকল্পিত প্রার্থী (hypothetical candidates) আছে। সেগুলো এমন কণিকা যার অস্তিত্ব থাকতে পারে কিন্তু আমরা তাদের এখনও সঠিক শনাক্ত করতে পারিনি। তবে যে সম্পর্কে আমাদের সবচাইতে বেশি আশা সে কণিকা সম্পর্কে আমাদের ভাল সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে, সেটার নাম নিউট্রিনো। আগে ভাবা হত এর নিজের কোন ভর নেই কিন্তু আধুনিক পর্যবেক্ষণে অনুভাবন (suggestion) পাওয়া যায়, নিউট্রিনোর একটি ক্ষুদ্র ভর থাকতে পারে। এ তথ্য যদি সঠিক বলে প্রমাণিত হয় এবং দেখা যায় তার মূল্যাঙ্ক সঠিক, তাহলে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ক্রান্তিক ঘনত্বে নিয়ে আসবার মতো পর্যাপ্ত ভর নিউট্রিনো থেকে পাওয়া যাবে।

আর একটি সম্ভাবনা হতে পারে কৃষ্ণগহ্বর। আদিম মহাবিশ্ব, যাকে বলা হয় দশা রূপান্তর (phase transition), তার ভিতর দিয়ে গেছে। জলের জমে যাওয়া এবং ফোটা (boiling) দশা রূপান্তরের উদাহরণ। দশা রূপান্তরে প্রথম একটি জলের মতো সমরূপ মাধ্যমে অনিয়ম প্রকাশ পায়। জলের ক্ষেত্রে সেটি হতে পারে বরফের ঢেলা কিংবা বাষ্পের বুদ্বুদ। এই অসমাঙ্গতা (irregularities) চুপসে গিয়ে কৃষ্ণগহ্বর গঠন করতে পারে। কৃষ্ণগহ্বরগুলো খুবই ক্ষুদ্র হলে এতদিনে তারা উবে যেত। তার কারণ কণাবাদী বলবিদ্যার অনিশ্চয়তার নীতির ক্রিয়া। এ সম্পর্কে এর আগে বলা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো যদি কয়েক বিলিয়ন টনের বেশি হত (একটি পর্বতের ভর) তাহলে সেগুলো আজও পাওয়া যেত এবং সেগুলোকে সনাক্ত করা খুবই কঠিন হত।

মহাবিশ্বে সমরূপে বন্টিত অদীপ্ত পদার্থ সনাক্ত করার একমাত্র উপায় মহাবিশ্বের প্রসারণের উপরে তার ক্রিয়া নির্ধারণ। দূরস্থিত নীহারিকাগুলো যে দ্রুতিতে আমাদের কাছ থেকে অপসারণ করছে সেই দ্রুতি মেপে আমরা নির্ধারণ করতে পারি প্রসারণ কত দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ব্যাপারটি হল : এই নীহারিকাগুলোকে আমরা পর্যবেক্ষণ করছি সুদূর অতীতের অবস্থায় অর্থাৎ যখন আলো ঐ নীহারিকাগুলো ত্যাগ করে আমাদের দিকে আসতে শুরু করেছে তখনকার দিনের অবস্থা। আমরা নীহারিকাগুলোর আপাতদৃষ্ট উজ্জ্বলতা কিংবা পরিমাণগত মাপের (magnitude) পশ্চাৎপটে নীহারিকাগুলোর দ্রুতির একটি লেখচিত্র আঁকতে পারি–এটা আমাদের কাছ থেকে তাদের দূরত্বের মাপ। কিন্তু মুশকিল হল একটি নীহারিকার আপাতদৃষ্ট ঔজ্জ্বল্য আমাদের কাছ থেকে তাদের দূরত্বের উত্তম নির্দেশক নয়, তাছাড়া এমন সাক্ষ্য প্রমাণ আছে যে, কালের সঙ্গে তাদের ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তন হয়। যেহেতু উজ্জ্বলতার বিবর্তনের জন্য কতটা অনুমোদন করা উচিত সেটা আমরা জানি না সেজন্য হ্রাসের হার আমরা বলতে পারি না। পরিণামে চুপসে যাওয়ার মতো যথেষ্ট দ্রুত কিনা কিংবা চিরকাল এটি প্রসারিত হতেই থাকবে। যতদিন পর্যন্ত না আমরা নীহারিকাগুলোর দূরত্ব মাপার আরও ভার উপায় বের করতে পারব ততদিন পর্যন্ত আমাদের এ বিচার স্থগিত রাখতে হবে। তবে আমরা নিশ্চিত হতে পারি গতি শ্লথ হওয়ার হার এত দ্রুত নয় যে আগামী কয়েকশ’ কোটি বছরে মহাবিশ্ব চুপসে যাবে।

অনন্তকাল প্রসারণ কিংবা দশ হাজার কোটি বছরের কাছাকাছি পুনর্বার চুপষে যাওয়া খুব এটি উত্তেজিত হওয়ার মতো ভবিষ্যৎ নয়। ভবিষ্যৎকে আকর্ষণীয় করার মতো কোন উপায় কি আমাদের নেই? ভবিষ্যৎকে আকর্ষণীয় করার একটি নিশ্চিত উপায় আছে। সে উপায় একটি কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়া। কৃষ্ণগহ্বরটি বেশ বড় হতে হবে। তার ভর হতে হবে সূর্বের চাইতে দশ লক্ষ গুণেরও বেশি। আমাদের নীহারিকার কেন্দ্রে ঐ রকম বড় একটি কৃষ্ণগহ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আছে।

কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে কি ঘটে সে সম্পর্কে আমরা খুব নিশ্চিত নই। ব্যাপক অপেক্ষবাদের সমীকরণগুলোর এমন কতকগুলো সমাধান আছে যেগুলো কৃষ্ণগহ্বরে পতিত হয়ে অন্য কোথাও শ্বেতগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে আসা অনুমোদন করে। একটি শ্বেতগহ্বর একটি কৃষ্ণগহ্বর দিয়ে বেরিয়ে আসা অনুমোদন করে। একটি শ্বেতগহ্বর একটি কৃষ্ণগহ্বরের কালিক বিপরীত। এটি এমন একটি বস্তুপিণ্ড যা থেকে জিনিস বেরিয়ে আসতে পারে কিন্তু কোন জিনিস তার ভিতর পড়তে পারে না। শ্বেতগহ্বর মহাবিশ্বের অন্যপ্রান্তে অবস্থিত হতে পারে। মনে হয়, এর ফলে দ্রুত আন্তঃনীহারিকা। ভ্রমণের একটি সম্ভাবনা হতে পারে। মুশকিল হল, ভ্রমণটি অতিরিক্ত দ্রুত হতে পারে। কৃষ্ণগহ্বরের ভিতর দিয়ে শ্রবণ যদি সম্ভব হত তাহলে রওনা হওয়ার আগে ফিরে আসতে দেওয়ার বাধা কিছু থাকত বলে মনে হয় না। আপনি যদি আপনার মা-কে হত্যা করার মতো একটা কিছু করতে পারতেন তাহলে প্রথমত আপনার যাওয়াটা বন্ধ হত।

হয়ত আমাদের জীবন রক্ষার (এবং আমাদের মায়েদের জীবন রক্ষার) জন্য সৌভাগ্যক্রমে পদার্থবিদ্যার বিধিগুলো এরকম কালে ভ্রমণ অনুমোদন করে না। মনে হয় একটি কাল-নির্ঘণ্ট রক্ষার নিযুক্তক (Chronology Protection Agncy) আছে। তার কাজ অতীতে ভ্রমণ বন্ধ করে পৃথিবীকে ঐতিহাসিকদের জন্য নিরাপদ করা। যা হবে বলে মনে হয় সেটা হল অনিশ্চয়তার নীতির ক্রিয়ায় কেউ অতীতে ভ্রমণ করলে অত্যন্ত বেশি বিকিরণ হবে। এই বিকিরণ স্থান-কালকে এমনভাবে মুচড়ে বিকৃত করবে (warp) যে অতীতে যাওয়া সম্ভব হবে না। কিংবা স্থান-কালকে বৃহৎ বিস্ফোরণ কিংবা বৃহৎ সঙ্কোচনের মতো একটি অনন্যতায় এনে একেবারে শেষ করে দেবে। যাই হোক না কেন, আমাদের অতীতকে কিছু দুষ্ট লোক বিপদে ফেলতে পারবে না। আমি এবং আর কয়েকজনের গণনা থেকে কাল-নির্ঘণ্ট সুরক্ষা প্রকল্প সমর্থিত হয়। তবে, কালে ভ্রমণ যে সম্ভব নয় এবং কখনও সম্ভব হবে না, তার সবচাইতে ভাল সাক্ষ্য প্রমাণ; ভবিষ্যৎ থেকে দলে দলে ভ্রমণকারী আমাদের দিকে অভিযান করেননি।

সংক্ষিপ্তসার : বৈজ্ঞানিকরা বিশ্বাস করেন মহাবিশ্ব সুসংজ্ঞিত (well defince) বিধির দ্বারা শাসিত। এই বিধিগুলো নীতিগতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা অনুমোদন করে। এই বিধিগুলোর প্রদত্ত গতি অনেক সময় বিশৃঙ্খল। এর অর্থ প্রাথমিক অবস্থায় অতিক্ষুদ্র। পরিবর্তন পরবর্তী আচরণের পরিবর্তনের দ্রুত বৃদ্ধির পথিকৃৎ হতে পারে পরিবর্তন ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। সেজন্য কার্যক্ষেত্রে ভবিষ্যতে শুধুমাত্র খুব অল্পকাল বিষয়ে নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব। তবে খুব বৃহৎ মানে মহাবিশ্বের আচরণ সরলই মনে হয়, বিশৃঙখল নয়। সেজন্য মহাবিশ্ব চিরকাল প্রসারমাণ থাকবে, না পরিণামে আবার চুপসে যাবে সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেতে পারে। এটা নির্ভর করে মহাবিশ্বের বর্তমান ঘনত্বের উপর। আসলে যে ক্রান্তিক ঘনত্ব মহাবিশ্বের অনন্তকাল প্রসারিত হওয়া কিংবা আবার চুপসে যাওয়া নির্ধারণ করে সেই ঘনত্ব এবং বর্তমান ঘনত্ব খুবই সন্নিকট। যদি অতিস্ফীতি (inflation) তত্ত্ব সঠিক হয়, তাহলে মহাবিশ্বের অবস্থান ক্ষুরের ধারের উপর। সুতরাং দৈবজ্ঞ এবং ভবিষ্যৎ বক্তাদের দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যের অনুসরণ করে, আমি দুরকম কথা বলে নিজের ভবিষ্যদ্বাণীকে রক্ষা করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *