০৬. আমার অবস্থান

০৬. আমার অবস্থান*

[*১৯৯২ সালের মে মাসে কীজ কলেজের (Caius College) শ্রোতাদের কাছে এই বক্তৃতাটি দেওয়া হয়েছিল।]

এই প্রবন্ধটি আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কি না সে বিষয়ে নয়। তার বদলে আমি আলোচনা। করব মহাবিশ্বকে কি করে বোঝা যায়। সে বিষয়ে আমার অগ্রসর হওয়ার পদ্ধতি : মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বের (grand unified theory) অর্থই বা কি, অবস্থানই বা কোথায়? মহান ঐক্যবদ্ধ তত্ত্বকে বলা যায় সর্ববিষয়ব্যাপী একটা তত্ত্ব। এক্ষেত্রে একটা সত্যিকারের সমস্যা রয়েছে। এই জাতীয় প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা এবং তর্ক করা উচিত দার্শনিকদের। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার আধুনিক বিকাশ সম্পর্কে অবহিত থাকার মতো যথেষ্ট গাণিতিক যোগ্যতা নেই। একটা উপজাতি আছে তার নাম বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাঁদের শিক্ষার মান আর একটু ভাল হওয়া উচিত। কিন্তু তাঁদের ভিতরে অনেকেই বিফলকাম পদার্থবিদ। তারা দেখলেন নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। তার বদলে তারা পদার্থবিদ্যা আর দর্শন নিয়ে লেখা শুরু করলেন। অপেক্ষাবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যার মতো এ শতাব্দীর প্রথম দিকে আবিষ্কৃত বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো নিয়ে তারা এখনও তর্ক করে চলেছেন। পদার্থবিদ্যার বর্তমান সীমান্তের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ নেই।

হয়ত দার্শনিকদের সম্পর্কে আমি একটু রূঢ়। কিন্তু তারাও আমার সঙ্গে খুব সহৃদয় ব্যবহার করেননি। আমার পদ্ধতিকে বলা হয়েছে অতি সরল (naive) এবং স্বল্পবুদ্ধিমনের প্রকাশ। আমার নানা বিশেষণ দেওয়া হয়েছে–সংজ্ঞাবাদী (nominal ist), যন্ত্রবাদী (instrumentalist), দৃষ্টবাদী (positivist), বাস্তববাদী (realist) এবং নানারকমবাদী। পদ্ধতিটা হল, কলঙ্ক আরোপ করে একটা মতকে খণ্ডক করা। যদি আমার মতবাদের উপরে একট মার্কা (Label) লাগিয়ে দিতে পারেন তাহলে ভুলটা কোথায় সেটা আর বলার প্রয়োজন হয় না। ঐ সমস্ত মতবাদের মারাত্মক ভুলগুলো নিশ্চিতভাবে সবারই জানা।

তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় যারা সত্যিকারের প্রগতিসাধন করেন, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের দার্শনিক এবং ঐতিহাসিকরা তাদের যে শ্রেণীতে ফেলেন, ঐ আবিষ্কারই বৈজ্ঞানিকরা কিন্তু সে সব শ্রেণীর কথা ভাবেন না। আমি নিশ্চিত আইনস্টাইন, হাইসেনবার্গ এবং ডিরাক এঁরা কখনোই নিজেরা বস্তুবাদী কিংবা যন্ত্রবাদী, তা নিয়ে মাথা ঘামাননি। তাঁদের চিন্তার বিষয় ছিল–তখনকার তত্ত্বগুলো পরস্পরের সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না। তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় অগ্রগতির ক্ষেত্রে যৌক্তিক সঙ্গতির অনুসন্ধান সবসময়ই পরীক্ষামূলক ফলের চাইতে বেশি গুরুত্ব লাভ করেছে। পর্যবেক্ষণ ফলের সঙ্গে অমিল হওয়ার জন্য অন্য দিক থেকে অতি সুন্দর, অতি চমৎকার অনেক তত্ত্ব পরিত্যক্ত হয়েছে কিন্তু শুধুমাত্র পরীক্ষালব্ধ ফলের ভিত্তিতে কোন গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব প্রস্তাবিত হয়েছে এরকম কোন ঘটনা আমি জানি না। সবসময়ই তত্ত্বই এসেছে প্রথম। সে তত্ত্বের প্রস্তাবনার অর্থ ছিল সুন্দর এবং সঙ্গতিপূর্ণ একটা প্রতিরূপ তৈরি করা। তত্ত্ব তারপর ভবিষ্যদ্বাণী করে। পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা পরীক্ষা করা যায়। পর্যবেক্ষণফলের সঙ্গে যদি ভবিষ্যদ্বাণীর ঐক্য হয় তাহলেও তত্ত্বটা প্রমাণিত হয় না। কিন্তু তত্ত্বটি আরও ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য বেঁচে থাকে। সে ভবিষ্যদ্বাণীগুলোও যাচাই করা হয় পর্যবেক্ষণ ফলের নিরিখে। পর্যবেক্ষণ ফল যদি ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে না মেলে তাহলে তত্ত্বটা পরিত্যাগ করা হয়।

কিংবা বলা যায় ঐ রকমই হওয়ার কথা। যে তত্ত্বের পিছনে অনেক সময় এবং শ্রম ব্যয় করা হয়েছে, কার্যক্ষেত্রে মানুষ সে তত্ত্ব পরিত্যাগ করতে চায় না। পর্যবেক্ষণফলের নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন করে তারা শুরু করে। তাতে না হলে তারা তত্ত্বের একটা সাময়িক পরিবর্তন করতে চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত তত্ত্বটা হয়ে দাঁড়ায় একটা বিশ্রী নড়বড়ে প্রাসাদ। তারপর কেউ একটা নতুন তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। সে তত্ত্বে পর্যবেক্ষণ ফলের গোলমেলে ব্যাপারগুলো সুন্দর এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করা হয়। এর একটা উদাহরণ ১৮৮৭ সালের মিচেলসন-মালিং (Michelson-Morley) পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় দেখা গেল আলোর উৎস কিংবা পর্যবেক্ষক যেভাবেই চলমান হোক না কেন আলোর দ্রুতি সবসময় একই থাকে। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়েছিল। কেউ যদি আলোকের উৎসের অভিমুখে গমন করতে থাকে তাহলে আলো যেদিকে চলমান সেদিকে যে চলছে তার তুলনায় প্রথম লোকটির মনে হবে আলোর দ্রুতি বেশি। কিন্তু পরীক্ষায় দেখা গেল দুজন পর্যবেক্ষকই মাপনে দেখবেন আলোর গতি নির্ভুলভাবে অভিন্ন। তার পরের আঠারো বছর হেনরিক লোরেঞ্জ (Hendric Lorentz) এবং জর্জ ফিটজারাল্ড (George Fitzgerald) স্থান এবং কাল সম্পর্কে সবার গৃহীত ধারণার ভিত্তিতে পরীক্ষা ফলকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন। তারা কতগুলো তদর্থক (adhoc) স্বীকৃতি উপস্থিত করলেন। যেমন, তাঁরা প্রস্তাব করলেন বস্তুপিণ্ডগুলো যখন অধিক দ্রুতিতে চলমান হয় তখন তাদের দৈর্ঘ্য হ্রস্বতর হয়ে যায়–এই প্রস্তাব। পদার্থবিদ্যার কাঠামোটাই কুশ্রী এবং গোলমেলে হয়ে দাঁড়াল। তারপর আইনস্টাইন উপস্থিত করলেন অনেক বেশি আকর্ষণীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গি। এতে বলা হল কাল সম্পূর্ণ স্বনির্ভর এবং বিচ্ছিন্ন নয়, তার বদলে তিনি স্থানের সমন্বয়কারী একটা চারমাত্রিক বস্তু তৈরি করেন, তার নাম দিলেন স্থান-কাল। আইনস্টাইন তত্ত্বের দুটি অংশের সঙ্গতিপূর্ণ সমন্বয়ে যতটা উৎসাহী ছিলেন, পরীক্ষার ফলগুলো তাঁকে এই চিন্তাধারার ব্যাপারে ততটা উৎসাহিত করেনি। দুটি অংশের একটা হল যে বিধিগুলো বৈদ্যুতিক এবং চুম্বকক্ষেত্রগুলো শাসন করে এবং আরেকটা হল যে বিধিগুলো বিভিন্ন বস্তুগুলোর গতি শাসন করে।

আমার মনে হয় না, ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন কিংবা আর কেউ অপেক্ষবাদ অতটা সরল এবং সুন্দর–সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। এই তত্ত্ব স্থান-কাল সম্পর্কে আমাদের চিন্তাধারায় সম্পূর্ণ একটা বিপ্লব এনে দেয়। বিজ্ঞানের দর্শনে বাস্তববাদী হওয়া কতটা কঠিন, অপেক্ষবাদ আবিষ্কার তার একটা উদাহরণ। কারণ আমরা যাকে বাস্তব বলি সেটা নির্ভর করে কোন্ তত্ত্ব আমরা সমর্থন করি তার উপর।

আমি নিশ্চিত যে, লোরেঞ্জ আর ফিটজারাল্ড নিজেদের বাস্তববাদী মনে করতেন। তারা আলোকের দ্রুতি সম্পৰ্কীয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষাকে নিউটনের পরম (absolute) কাল এবং পরম স্থানের বাগ্বিধিতে ব্যাখ্যা করেছেন। মনে হয়েছিল স্থান এবং কাল সম্পর্কে এই ধারণাগুলো সাধারণ বুদ্ধি এবং বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়। তবুও আজকাল যারা অপেক্ষবাদে বিশ্বাস করেন (যদিও তারা জনতার অতি ক্ষুদ্র এবং সংখ্যালঘু অংশ হওয়ার ফলে আমি উদ্বিগ্ন হই) তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম। স্থান এবং কাল সম্পর্কেও মূলগত ধারণা সম্বন্ধে আধুনিক বোধ আমাদের জনসাধারণকে জানানো উচিত।

আমরা যাকে বাস্তব বলি সেটা নির্ভর করে আমরা যাকে তত্ত্ব বলি তার উপরে, তাহলে আমরা বাস্তবতাকে কি করে দর্শনের ভিত্তি করব? আমি বলব সামনে একটা মহাবিশ্ব রয়েছে এবং সেটা অপেক্ষা করছে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করার জন্য এবং তাকে বোঝার জন্য এই অর্থে আমি একজন বাস্তববাদী। আত্মজ্ঞানবাদীদের (Solipsist) মত সব বস্তুই আমাদের কল্পনার সৃষ্টি। আমার ধারণা এরকম কল্পনে শুধুমাত্র সময় নষ্ট করাই হয়। এই ভিত্তিতে কেউই কাজ করে না। মহাবিশ্বের বাস্তবতা কি, তত্ত্ব ছাড়া সেটা আমরা বুঝতে পারি না। সেজন্য আমার মত–পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব পর্যবেক্ষণফলের বর্ণনা দেওয়ার জন্য একটা গাণিতিক প্রতিরূপ মাত্র। অনেকে এজন্য আমাকে স্বল্পবুদ্ধি কিংবা অর্বাচীন বলেন। একটা তত্ত্ব যদি গঠনে সুন্দর হয়, যদি বহু পর্যবেক্ষণ ফল ব্যাখ্যা করতে পারে এবং নতুন নতুন পর্যবেক্ষণ ফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে তাহলে আমরা বলি তত্ত্বটা উত্তম। এর বাইরে তত্ত্বটা বাস্তবানুগ কিনা সে প্রশ্ন করার অর্থ হয় না। তার কারণ তত্ত্বনিরপেক্ষ বাস্তবতা কি আমরা জানি না। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসম্পর্কীয় এই দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আমাকে যন্ত্রবাদী কিংবা দৃষ্টবাদী (positivist) বলা হতে পারে, এ কথা আমি আগে বলেছি। আমাকে দুরকমই বলা হয়েছে। যিনি আমাকে দৃষ্টবাদী বলেছিলেন, তিনি তার সঙ্গে এ কথাও যোগ করেছিলেন যে, দুষ্ট আজকাল অচল, এ কথা সবার জানা। কলঙ্ক আরোপ করে যুক্তি খণ্ডন করার এটা আরেকটা উদাহরণ। ব্যাপারটা সেকেলে হতে পারে, কারণ এটা ছিল অতীতের বৌদ্ধিক খেয়াল। কিন্তু যারা মহাবিশ্বের বিবরণ দান করার জন্য নতুন পদ্ধতি খুঁজছেন তাদের পক্ষে আমি দৃষ্টবাদের যে বিবরণ দিয়েছি সেটা গ্রহণ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বাস্তবতার নামে আপিল করে কোন লাভ নেই, কারণ বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের কোন অন্য নিরপেক্ষ প্রতিরূপ নেই।

আমার মতে একটা অন্য নিরপেক্ষ বাস্তবতা সম্পর্কে অব্যক্ত বিশ্বাসই বিজ্ঞানের দর্শনের পক্ষে কণাবাদী বলবিদ্যা এবং অনিশ্চয়তাবাদ নিয়ে অসুবিধার কারণ। শ্রয়েডিংগার এর বেড়াল নামে একটা বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক চিন্তন পরীক্ষার গল্প রয়েছে। একটা বন্ধ বাক্সে একটা বেড়ালকে পুরে দেওয়া হল। বেড়ালটার দিকে একটা বন্দুক তাক করে আছে। যদি কোন তেজস্ক্রিয় কেন্দ্ৰক (radio active nucleus) ক্ষয়প্রাপ্ত হয় (decays) তাহলে বন্দুকটা থেকে গুলি বেরোবে। এরকম হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঞ্চাশ ভাগ। (আজকালকার দিনে এরকম প্রস্তাব করতে কেউ সাহস করবেন না। এমন কি শুদ্ধ-চিন্তন-পরীক্ষার উপরও নয়। কিন্তু শ্রয়েডিংগারের সময় জন্তুদের মুক্তির কথা কেউ শোনেননি।)

বাক্সটা কেউ খুললে বেড়ালটাকে হয় জীবিত নয় মৃত দখবেন। কিন্তু এ বাক্সটি খুলবার আগে বেড়ালটার কণাবাদী অবস্থান হতে মৃত বেড়ালের অবস্থা এবং জীবিত বেড়ালের অবস্থার একটা মিশ্রণ। অনেক বিজ্ঞানের দার্শনিকের এ ব্যাপারটা মেনে নেওয়া কষ্ট। তাদের বক্তব্য বেড়ালটা অর্ধেক গুলি খাওয়া এবং অর্ধেক গুলি না খাওয়া হতে পারে না। ঠিক যেমন একজন মহিলা অর্ধেক গর্ভবতী হতে পারেন না। তাঁদের অসুবিধা হল বাস্তবতা সম্পর্কে তাদের ধারণার ভিতরে নিহিত রয়েছে চিরায়ত চিন্তাধারা। সেই চিন্তনে একটা বস্তুপিণ্ডের একটাই নির্দিষ্ট নিশ্চিত ইতিহাস রয়েছে। কণাবাদী বলবিদ্যার মূল বক্তব্যই হল বাস্তবতা সম্পর্কে তার দৃষ্টি অন্যরকম। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে একটা বস্তুপিণ্ডের একটামাত্র ইতিহাসই নেই, আছে সম্ভাব্য সর্বপ্রকার ইতিহাস। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিশেষ একটামাত্র ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা এবং সামান্য পৃথক কোন ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা পরস্পরকে বাতিল করে দেবে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ইতিহাস থাকার সম্ভাবনা পরস্পরের শক্তি বৃদ্ধি করে। একটা বস্তুপিণ্ডের ইতিহাসে আমরা পর্যবেক্ষণ করি শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে (reinforced) এরকম আরেকটা ইতিহাস।

শ্রয়েডিংগারের বেড়ালের ক্ষেত্রে রয়েছে দুটি ইতিহাস–যাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছে। একটা ইতিহাসে বেড়ালটিকে গুলি করা হয়েছে, অন্যটিতে সে বেঁচে আছে। কণাবাদী বলবিদ্যায় দুটি সম্ভাবনার অস্তিত্ব একত্র থাকতে পারে কিন্তু কোন কোন দার্শনিক প্যাঁচে পড়ে যান, কারণ তাদের অন্তর্নিহিত অনুমান হল বেড়ালের একটা ইতিহাসই থাকতে পারে।

আমাদের পদার্থবিদ্যা সম্পকীয় তত্ত্বের বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের কল্পন নির্ধারণ করার আর একটা উদাহরণ কালের ধর্ম। কালের প্রবাহ অন্য কোন ঘটনা নিরপেক্ষ এবং চিরন্তন, এ তথ্যকে আগে ভাবা হত স্বতঃপ্রতীয়মান। কিন্তু অপেক্ষবাদ স্থান এবং কালকে সংযুক্ত করে ঘোষণা করল মহাবিশ্বের পদার্থ এবং শক্তি, স্থান এবং কাল দুটিকেই বিকৃত করে দিতে পারে। কালের ধর্ম সম্পর্কে আমাদের অনুভূতি আগে ছিল এ ধর্ম মহাবিশ্ব নিরপেক্ষ কিন্তু সে ধারণা পরিবর্তিত হয়েছে। এখন মনে করা হয় মহাবিশ্ব কালের ধর্মের রূপ দান করে। তখন এরকম চিন্তন সম্ভব হল যে, অতীতে একটা বিশেষ বিন্দুর পূর্বে কালের সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়। অতীতে গমন করল এমন একটা অনতিক্রমনীয় বাধা অর্থাৎ অনন্যতার (Singularity) মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা। সে বাধা অতিক্রম করা সম্ভব নয়। তাই যদি হয় তাহলে বৃহৎ বিস্ফোরণ কি করে হল কিংবা সে বিস্ফোরণ কে ঘটাল সে প্রশ্ন করার কোন অর্থ হয় না। সৃষ্টি কিংবা কারণ সম্পর্কে আলোচনায় এ অনুমান নিহিত তাকে যে, বৃহৎ বিস্ফোরণের অনন্যতার আগেও একটা কালের অস্তিত্ব ছিল। পঁচিশ বছর হল আমরা জানি আইনস্টাইনের ব্যাপক অপেক্ষবাদ অনুসারে পনের হাজার কোটি বছর আগে একটা অনন্যতায় কাল শুরু হয়েছিল। কিন্তু দার্শনিকরা এখনো এই চিন্তনের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেননি। এখনো তাদের চিন্তা কণাবাদী বলবিদ্যার ভিত্তি নিয়ে। সে ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে পঁয়ষট্টি বছর আগে। পদার্থবিদ্যার সীমান্ত যে এগিয়ে চলেছে এটা তারা বোঝেন না।

আরও মন্দ হল কাল্পনিক কালের গাণিতিক কল্পন। এই কল্পনে আমি আর জিম হার্টল Jim Hartle) প্রস্তাব করেছিলাম মহাবিশ্বের হয়ত কোন শুরু কিংবা শেষ নেই। কাল্পনিক কাল সম্পর্কে বলার জন্য একজন বিজ্ঞানের দার্শনিক আমাকে বর্বরভাবে আক্রমণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন-কাল্পনিক কালের মতো একটি গাণিতিক চাতুরির বাস্তব মহাবিশ্বের সঙ্গে কি সম্পর্ক থাকতে পারে? আমার মনে হয় গাণিতিক প্রযুক্তিতে ব্যবহৃত কথা। বাস্তব আর কাল্পনিকের সঙ্গে সাধারণ দৈনন্দিন ভাষায় ব্যবহৃত বিষয়ের এটা একটা উদাহরণ। তত্ত্ব কিংবা ব্যাখ্যা করার মতো কোন প্রতিরূপ (model) না থাকলে আমরা কি করে জানব কোনটা বাস্তব? মহাবিশ্বকে বুঝবার সমস্যা বোঝানোর চেষ্টায় আমি অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যা থেকে উদাহরণ ব্যবহার করেছি। আপনি যদি অপেক্ষবাদ এবং কণাবাদী বলবিদ্যা না বুঝতে পারেন তাহলেও কিছু এসে যায় না। এমন কি তত্ত্বগুলো ভুল হলেও কিছু আসে যায় না। আশা করি আমি দেখতে পেরেছি, তত্ত্বকে একটা প্রতিরূপ হিসেবে ব্যবহার করা যায় এরকম কোন দৃষ্টবাদী (positivist) পদ্ধতি, অন্ততপক্ষে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদের পক্ষে মহাবিশ্বকে বুঝবার একমাত্র উপায়। আমি আশা করি, মহাবিশ্বের সবকিছুর বিবরণ দেওয়া যায় এরকম একটা সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিরূপ আমরা আবিষ্কার করতে পারব। তা যদি আমরা করি তাহলে সেটা হবে মানবজাতির একটা সত্যিকারের জয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *