শুধু দুটি কথা আমার মনের মধ্যে ক্ষণ জেগে থাকে।
একটি উপনিষদের বাণী :
আকাশ আনন্দপূর্ণ না রহিত যদি
জড়তার নাগপাশে দেহ মন হইত নিশ্চল।
কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ
যদেষ আকাশো আনন্দে ন স্যাৎ।
আমার প্রথম আনন্দের দিনে হঠাৎ এটি আমার মনের ভিতরে এসেছিল—বহু বৎসর অদর্শনের পর প্রিয়জন আচমকা এসে আবির্ভূত হলে যে রকম হয়। তাকে কোথায় বসাব, কী দিয়ে আদর করব কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি নি। এই যে আকাশ বাতাস, সে আনন্দে পরিপূর্ণ না থাকলে, কে একটি মাত্র নিশ্বাস নিতে পারত এর থেকে?
সেই রাত্রে আমি আমাদের বাসরঘরে যাই। শব্নম যেদিন চলে যায়, সেদিন কেন জানি নে তার কুরান—শরীফখানা টেবিলের উপর রেখে গিয়েছিল।
প্রত্যাদেশের সন্ধানে অনেকেই কুরান খুলে যেখানে খুশি সেখানে পড়ে। আমার কোনও প্রত্যাদেশের প্রয়োজন নেই। আমি এমনি খুলেছিলুম।
‘ওয়া লাওয়া ফদ্লুল্লাহি আলাইকুম ও রহ্মমতহু ফী দ্দুনিয়া ওয়াল আখিরা—’
‘ভূলোক দ্যুলোক যদি তাঁর দাক্ষিণ্য ও করুণায় পরিপূর্ণ না থাকত তবে—’ তবে? সর্বকালের মানুষ সর্ব বিভীষিকা দেখেছে। তার নির্যাস মানুষের—অসম্পূর্ণতা তখন রুন্দ্রের বহ্নি (গজব) আহ্বান করে আনত, সৃষ্টি লোপ পেত।
মনে পড়ল, ছেলেবেলাকার কথা। দাদারা ইস্কুলে, আমার সে বয়স হয় নি। দুপুর বেলা মা আমাকে চওড়া লালপেড়ে ধুতি, তাঁরই হাতেবোনা লেসের হাতাওয়ালা কুর্তা, আর জরির টুপি পরিয়ে সামনে বসিয়ে কুরান পড়ত। এই জ্যোতি অনুচ্ছেদটিই মার বিশেষ প্রিয় ছিল—বহু বহু বিশ্বাসীর তাই। আমার স্মরণে ছিল শুধু দুটি শব্দ ‘ফদল’ আর ‘রহমৎ’—উচ্ছ্বসিত দাক্ষিণ্য ও করুণা। তখন শব্দ দুটির অর্থ বা অন্য কোন কিছু বুঝি নি। আজও কি সম্পূর্ণ বুঝেছি?
আরও সহজে বলি।
বয়স তখন দশ কি বারো। চটি বাংলা বইয়ে গল্পটি পড়েছিলুম। বড় হয়ে এ গল্পটি আর কোথাও চোখে পড়ে নি।
এক ইংরেজকে বন্দী করে নিয়ে যায় বেদুইন দল। দলপতি খানদানী শেখ তার মেয়ের উপর ভার দেন বন্দীকে খাওয়াবার।
ভাষাহীন প্রণয় হয় দুজনাতে। তাই শেষটায় বল্লভের বন্দীদশা আর সে সাইতে পারল না। শব্নমের লায়লী তো ওই দেশেরই মেয়ে। একদিন পিতা যখন পণ্যবাহিনী আক্রমণ করতে বেরিয়েছেন তখন সে খাদ্য আর তেজী আরবী ঘোড়া এনে বল্লভের দিকে তাকালে। দুজনার পলানো অসম্ভব। যদি ধরা পড়ে তবে দুহিতাহরণকারীকে প্রাণ দিয়ে তার শোধ দিতে হবে—এই একটিমাত্র আশঙ্কা ছিল বলে সে সঙ্গ নিয়ে দয়িতের প্রাণ বিপন্ন করতে চায় নি। যাবার সময় ইংরেজ শুধু দুটি শব্দ বলে গিয়েছিল— ‘টম’ আর ‘লণ্ডন’।
এক মাস পরে দলপতির অনুচরগণ খবর আনল, ইংরেজ বন্দরে পৌঁছতে পেরে জাহাজ ধরেছে।
সরলা কুমারী চেষ্টা করেছিল তাকে ভোলবার—বহুদিন ধরে—পারে নি।
পালিয়ে গেছে সমুদ্রপারে। সেখানে প্রতি জাহাজের প্রত্যেককে বলে ‘টম’—লণ্ডন, ‘টম’—লণ্ডন।
এক কাপ্তেনের দয়া হল। এ—বন্দর ও বন্দর করে করে তাকে লণ্ডনে নামিয়ে দিল। ইতিমধ্যে মেয়েটি ওই দুটি শব্দ ছাড়া আর এক বর্ণ ইংরেজী শেখে নি—সে কাউকে সঙ্গ দিত না। ওর দিকে কেউ তাকালে কিংবা প্রশ্ন শুধালে ম্লান হাসি হেসে বলত, ‘টম’—‘লণ্ডন’।
সেই বিশাল লণ্ডনের জনসমুদ্র। তার মাঝখান দিয়ে চলছে একাকিনী বেদুইন—তরুণী। মুখে শুধু টম—লণ্ডন। কত শত টম আছে লণ্ডনে, কে জানে, কত কোণে, কিংবা অন্যত্র, কিংবা ফের বিদেশে চলে গিয়েছে আমাদের টম।
হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে আসছে টম৷ চোখাচোখি হল। দুজনা ছুটে গিয়ে একে অন্যকে আলিঙ্গন করলে সেই সদর রাস্তার বুকের উপর। ঠিক তেমনি একদিন আসবে না শব্নম? সে কি আমাকে বলে যায় নি, ‘বাড়িতে থেকে। আমি ফিরব।’
।। তামাম্ ন্ শুদ্।।
কামরুল আহসান
“তামাম্ ন্ শুদ্” শব্দটির অর্থ জানা আছে কিন্তু কোন ভাষা তা জানা নেই। যদি দয়া করে জানান উপকৃত হবো।
Bangla Library
ফারসি।
Nur Hosain Majidi
تمام نشد
تمام আরবী ও نشد ফার্সী শব্দ (نه ও شد)। আধুনিক ফার্সী উচ্চারণ “তামম্ নাশোদ্” (তামম্ = তা+ম্+অ+ম্)। অর্থ “শেষ হলো না।”