কবি সুকান্তের মতো অকালে চলে গেছেন রাজশাহীর কবি ও গীতিকার রজনীকান্ত সেন। তিনি পঞ্চকবির অন্তর্ভুক্ত হলেও চর্চা নেই তার অমূল্য সাহিত্য কীর্তির। এমনকি তার শেষ স্মৃতি চিহ্ন রাজশাহীর বসত বাড়িটিও সংরক্ষণ করা হয়নি আজো। আবর্জনা-ময়লা ফেলে পুঁতে ফেলা হয়েছে এ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে। অথচ কবি নজরুল এ বাড়িটির সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে কবি রজনীকান্ত সেন’র প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘প্রাচীন যুগের স্বদেশী গানের স্রষ্টা, গীতিকার, সুরকার, আজো তুমি গানের মাঝে অমর হয়ে আছো, তোমাকে নমস্কার।’ ঘটনাটি ১৯২৮ সালের। অবশ্য রাজশাহীতে কবি নজরুলের ওই আগমনের ঘটনা এখন বিস্মৃতির পথে। আর রজনীকান্ত তো বহু আগেই হারিয়ে গেছেন রাজশাহীর স্মৃতিপট থেকে। এক সময় হওতো তাঁর বাড়িটাও ভেঙ্গে ফেলা হবে। সেখানে গড়ে উঠবে বিশাল অট্টালিকা। এভাবেই তিনি হারিয়ে যাবেন ইতিহাসের অতল গহবরে।
এই অমর কবি বসতবাড়ির গুরুত্ব ও মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর ‘স্বাধীনতার সুখ’ কবিতায় লিখেছিলেনণ্ড
বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,
কুড়ে ঘরে থাকি কর শিল্পের বড়াই,
কবিতাটির আমরা ভাবসম্প্রসারণ করেছি বহুবার। কিন্তু বেমালুম ভুলে গেছি এর রচয়িতা রজনীকান্ত সেন’কে। নেই কারো সামান্য উদ্যেগ তার বাড়ি রক্ষার। জীর্ণ বাড়িটির গায়ে জন্মেছে পরগাছা। চারিদিকে আবর্জনার স্তূপ। বাড়িটি এখন সোনালী ব্যাংকের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হলেও শহরের আবর্জনা জমতে জমতে উঁচু ঢিবিতে পরিণত হয়েছে তার বসতভিটা। আবার কারো কারো লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে এ বসতভিটার প্রতি। কিন্তু দেখবার কেউ নেই। রাজশাহীর সাহেববাজার বড় মসজিদের দক্ষিণে উঁচু ঢিবির ওপর চুনকামবিহীন অবহেলিত একতলা এ বাড়িতে বসেই কবি লিখেছেন ‘পরোপকার’ কবিতা। যা আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। হরহামেশা আমরা তা পড়েছি।ণ্ড
নদী কভু পান নাহি করে নিজ জল,
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল,
গাভী কভু নাহি করে নিজ দুগ্ধ পান,
কাষ্ঠ দগ্ধ হয়ে করে পরে অন্ন দান,
লিখেছেন অসংখ্য গান। যা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এদেশের স্বাধীনতাকামীদের শক্তি যুগিয়েছে। বিলেতের মিহি কাপড় বর্জনের জন্য তিনি লিখলেনণ্ড
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই ;
দীন দুঃখিনী মা যে তোদের, তার বেশী আর সাধ্য নাই।’
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকারী বাঙ্গালী দেশপ্রেমিকরা এই গানটি গেয়ে নতুন করে উৎসাহ পেতেন। গানটি সে সময় বাঙালী জাতির মাঝে ভীষণভাবে সমাদৃত হয়েছিল। তাই বাংলার আনাচে-কানাচে সবাই গাইতো তার গান। তাই কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর এ গানের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন এবং রাজশাহীতে এসে তাঁর স্মৃতিধন্য বাড়িটি পরিদর্শন করেছেন। ক্ষণজন্মা কবি রজনীকান্ত সেন ১৮৬৫ সালের ২৬ জুলাই মাসে সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী কলেজে অধ্যয়নকালে তার সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়। রাজশাহীর বাড়িতে শুরু হয় ওকালতি এবং সাহিত্যকর্ম। কিন্তু যশ-খ্যাতির ঊষালগ্নে তিনি আক্রান্ত হন কালব্যধি ক্যান্সারে এবং মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে কোলকাতায় পরলোকগমন করেন। আগামী রবিবার তাঁর জন্মবার্ষিকী। কিন্তু প্রতি বছরের মতো হয়তো এবারো নীরবে-নিভৃতে পার হয়ে যাবে তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবর্ার্ষিকী। কবির স্মৃতিধন্য রাজশাহী তো দূরের কথা, হয়তো দেশ জুড়ে কোথাও হবে না কোন আলোচনা সভা।
কোলকাতার ‘সাপ্তাহিক সওগাত’ পত্রিকায় ১৯২৮ সালের ২৮ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত রিপোর্ট সূত্রে জানা গেছে, কবি নজরুল ১৯২৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এলে ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়’র সাথে সাক্ষাৎ করে রজনীকান্ত সেনের বাড়ি দেখতে আসেন। তখন তাঁর বাড়িটির সামনে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে তাঁকে নমস্কার জানান।
ক্ষণজন্মা রজনীকান্তের জীবনের সাথে বিদ্রোহী কাজী নজরুলের জীবনের এক বিস্ময়কর মিল পাওয়া যায়। উভয় ছিলেন ক্ষণজন্মা কবি। মেধা বিকশিত হওয়ার প্রাক্কালে স্বল্প বয়সে নির্বাক হয়ে যান। তারা দু’জনই যে কোন পরিবেশে চটজলদি গান-কবিতা লিখতে পারতেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীকারের আন্দোলনে উভয়ের ছিল প্রত্যক্ষ ভূমিকা। আবার দু’জনের জীবদ্দশায় সন্তানের অকাল মৃত্যু ঘটে।
রজনীকান্তের জন্ম, শিক্ষা জীবন ও সাহিত্যকর্ম রাজশাহী এসোসিয়েসন কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজশাহী প্রতিভা’ সূত্রে জানা যায়, কবি রজনীকান্তের পূর্ব পুরুষদের আদি নিবাস ছিল ময়মনসিংহ জেলার (তৎকালীন) টাঙ্গাইল মহকুমার সহদেবপুর গ্রামে। কবির প্রপিতামহ যোগীরাম সেন তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী করুণাময়ী সহদেবপুর গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে ভ্রাতা শ্যামকিশোর সেনের বাড়িতে। তাঁরই গর্ভে জন্ম হয় গোলকনাথ সেনে’র। ইনি রজনীকান্তের পিতামহ। গোলকনাথ সেন পৈত্রিক বাড়ি সহদেবপুরে না গিয়ে মাতুলালয়ে অতিকষ্টে পালিত হন। পরে সহদেবপুর গ্রামের অন্নপূর্ণা দেবীর সাথে বিয়ে হয়। এরই দুই সন্তানণ্ড রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন ও পিতৃব্য গোবিন্দনাথ সেন। তারা ভীষণ দৈনতার মাঝে লেখাপড়া করে রাজশাহীতে ওকালতি শুরু করেন। রজনীকান্তের পিতা গুরুপ্রসাদ সেন পরে সাবজজ হন। সংস্কৃতি, পারসী ও ইংরেজী ভাষায় পন্ডিত ছিলেন গুরুপ্রসাদ সেন। তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং স্বাস্থ্য ভঙ্গের কারণে সময়ের পূর্বেই পেনশন গ্রহণ করলেন। এছাড়া রাজশাহীর ইন্দ্রনাথ কাঁইয়ার কুঠিতে গচ্ছিত তাঁর বিপুল পরিমাণ অর্থও বেহাত হয়ে গেল কুঠির দেওলিয়া হয়ে পড়ার কারণে। ফলে এই সচ্ছল পরিবার অকস্মাৎ আর্থিক দৈনতায় অকূল পাথরে ভাসতে লাগলো। পারিবারিক এই বিপর্যয়ের মুখে কবি রজনীকান্ত সেন’র শিক্ষা জীবনের সূত্রপাত হয়। কবি যখন বি.এ ক্লাসের ছাত্র সে সময় তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটে।
পিতার তৃতীয় সন্তান রজনীকান্ত সেন শৈশব থেকেই সঙ্গীত, আবৃতি ও রসরসিকতার অভিনয়ে ছিলেন পারদর্শী। অসাধারণ স্মৃতিধর রজনীকান্ত ১৮৮৩ সালে কুচবিহার জেন কিন্স স্কুল থেকে বৃত্তিসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন। পড়াশোনায় মেধাবী হলেও গানের পাগল রজনীকান্ত নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ‘‘আমি গান গেয়ে নেচে হেসে পাস করেছি।’’ ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ.এ পাস করেন। ১৮৮৯ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৯১ সালে ওই কলেজ থেকে তিনি বি.এল পাস করেন। ওকালতি পাস করেই তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করে পরিবারের হাল ধরেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই তার লক্ষ্মীর পুনরাবির্ভাব ঘটে। তৎকালীন স্কুল বিভাগের ডিপুটি ইন্সপেক্টর ও মানিকগঞ্জের বাসিন্দা তারকানাথ সেনের কন্যা হিরন্ময়ী দেবীর সঙ্গে রজনীকান্ত সেন’র বিয়ে হয়।
বি.এল পরীক্ষা দেবার আগে থেকেই তাঁর কবিতা ও গান রাজশাহীর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজশাহীর সুরেশ চন্দ্র সাহা’র মাসিক “উৎসাহ” পত্রিকায় রজনীকান্তের পর পর কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়। যদিও তিনি কলেজ জীবন থেকেই কবিতা ও সঙ্গীত রচনা শুরু করেন। ওকালতি পেশায় গেলেও গানের নেশা, কবিতা ও রসব্যঙ্গ কাব্য লেখা তাঁর নেশা হয়ে দাঁড়ালো। তাঁর ভাষায়,‘‘ আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু ব্যবসায় করিতে পারি নাই। ঃশিশুকাল হইতে সাহিত্য ভাল বাসিতাম ণ্ড আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল।”
রাজশাহীতে এ সময় ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র সাথে রজনীকান্তের সখ্যতা গড়ে উঠে। আবগারি বিভাগের পরিদর্শকরূপে কবি ও নাট্যকার ডি.এল রায় রাজশাহীতে আসলে তিনি তার সাথেও পরিচিত হন। ভারতবর্ষ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং সকলে মিলে একটি সাহিত্য গোষ্ঠী গড়ে তোলেন। সে সময় উক্ত চারজন সঙ্গীত ও সাহিত্য রসিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রাজশাহীতে সব সময় উৎসব অনুষ্ঠান লেগেই থাকতো। বিশেষত রজনীকান্তের স্বভাবসুলভ সঙ্গীতকুশলতা ও রসরসিকতা রাজশাহীর সভা-সমিতির অতি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল।
জলধর সেন লিখেছেন, ‘‘এক রবিবারে রাজশাহীর লাইব্রেরীতে কিসের যেন একটি সভা হইবার কথা ছিল। রজনী বেলা প্রায় তিনটার সময় অক্ষয়ের বাসায় আসিল। অক্ষয় বলিল, ‘রজনী ভায়া খালি হাতে সভায় যাইবে। একটা গান বাঁধিয়া লও না।’ রজনী যে গান গাইতে, বাঁধিতে পারিত, তাহা আমি জানিতাম না। আমি জানিতাম, সে গান গাইতেই পারে। আমি বলিলাম, এক ঘন্টা পরে সভা হইবে, এখন কি আর গান বাঁধিবার সময় আছে ?’ অক্ষয় বলিল, রজনী একটু বসিলেই গান বাঁধিতে পারে।’ রজনী অক্ষয়কে বড় ভক্তি করিত। সে তখন একখানা চেয়ার টানিয়া অল্পক্ষণের জন্য চুপ করিয়া বসিয়া থাকিল। তাহার পরেই কাগজ টানিয়া লইয়া একটা গান লিখিয়া ফেলিল। আমি তো অবাক! গানটা চাহিয়া লইয়া পড়িয়া দেখি, অতি সুন্দর হইয়াছে।” গানটি এখন সর্বজন পরিচিতণ্ড “তব চরণ-নিম্নে উৎসবময়ী শ্যাম ধরণী সরসা।’’ এমনই মেধাবান ছিলেন রজনীকান্ত। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে গান লিখে ও সেই গানে সুর দিয়ে গান গেয়ে আসর মাত করার জুড়ি ছিল না তার। অবশ্য পরবর্তীতে কাজী নজরুলের মধ্যেও একই রকমের মেধা পাওয়া যায়। কবি নজরুল হয়তো সেই কারণে রজনীকান্তকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন এবং তিনি তাঁর বসতবাড়ি দেখতে রাজশাহী আসেন।
বাস্তবে রজনীকান্ত সেন উকিল হলেও আইন ব্যবসায় মনোযোগ না দিয়ে সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়েই মেতে থাকতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি কুমার শরৎকুমারকে লেখা এ চিঠিতে বলেছেন, “কুমার, আমি আইন ব্যবসায়ী, কিন্তু আমি ব্যবসায় করিতে পারি নাই। কোন দুর্লঙ্ঘ্য অদৃষ্ট আমাকে ঐ ব্যবসার সহিত বাঁধিয়া দিয়াছিল; কিন্তু আমার চিত্ত উহাতে প্রবেশ লাভ করিতে পারে নাই। আমি শিশুকাল হইতে সাহিত্য ভালবাসিতাম, কবিতার পূজা করিতাম, কল্পনার আরাধনা করিতাম, আমার চিত্ত তাই লইয়াই জীবিত ছিল। সুতরাং আইনের ব্যবসায় আমাকে সাময়িক উদরান্ন দিয়াছে, কিন্তু সঞ্চয়ের জন্য অর্থ দেয় নাই।”
১৯০২ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘‘বাণী”-কাব্য অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়’র সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এটি মূলত গানের বই। দ্বিতীয় গ্রন্থ ‘‘কল্যাণী’’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। এটিও ছোট-বড় গানের সংকলন। কবির তৃতীয় গ্রন্থ “অমৃত” নীতিকবিতা প্রকাশিত হয় ১৯১০ সালে। আটচল্লিশটি কবিতা এতে সংকলিত হয়েছে। পরোপকার কবিতাটি এই গ্রন্থে রয়েছে। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী দেশাত্মবোধের জোয়ার সৃষ্টি হলে বিদেশী পণ্য বর্জনের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলন গড়ে উঠে। কবি রজনীকান্ত এই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিদেশী মিহি কাপড়ের পরিবর্তে বাঙালীর জন্য দেশীয় কলে মোটা কাপড় তৈরী শুরু হলো। আর রজনীকান্ত সেন দেশীয় পণ্যকে জনগণ চিত্তে স্থান করে দিতে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করে গাইলেন তাঁর বিখ্যাত গানণ্ড
‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়
মাথায় তুলে নেরে ভাই ;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের
তার বেশী আর সাধ্য নাই।’’
আরও গাইলেনণ্ড
‘ভিক্ষার চালে কাজ নাই, সে বড় অপমান,
মোটা হোক, সে সোনা মোদের মায়ের ক্ষেতের ধান।’’
মুহূর্তেই রজনীকান্তের নাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লো। কবির এই গান বাঙালীর ঘরে ঘরে সবার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগলো। বাংলার বিখ্যাত মনীষীরা অকুণ্ঠচিত্তে রজনীকান্তের দেশাত্মবোধের মহিমা বর্ণনা করে পত্র-পত্রিকায় তাদের মন্তব্য প্রকাশ করলেন।
রাজশাহীতে অবস্থানকালে কবির তৃতীয় পুত্র ভুপেন্দ্রনাথ কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। পরের বছর কবি আবার শোকে পড়লেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি ভাঙ্গাবাড়িতে অবস্থানকালে কবির প্রথম কন্যা শতদলবাসিনী এবং দ্বিতীয় পুত্র জ্ঞানেন্দ্র রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। জ্ঞানেন্দ্র সুস্থ হয়ে উঠলেও কন্যা শতদলবাসিনী মারা যায়। কবি রজনীকান্ত পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে লিখেছেনণ্ড
‘আমি অকৃতী অধম বলেও তো
কিছু কম করে মোরে দাওনি।
যা’ দিয়েছ তার অযোগ্য ভাবিয়া
কেড়েও তো কিছু নাও নি।’
কিন্তু বিধির কি নির্মম পরিহাস কবি যখন সারা বাংলাসহ রাজশাহীতে গৌরবের শিখরে আসীন তখনই তিনি আক্রান্ত হলেন কালব্যাধি ক্যান্সারে। তবুও তিনি থেমে যাননি। ব্যাধি অগ্রাহ্য করে গান লিখেছেন ও গান গেয়েছেন সভা-সমিতিতে। তাঁর নিজ হাতে লেখা ডাইরীতে তিনি বলেছেন, ‘‘হঠাৎ হাসতে হাসতে গলায় ঘা হল। তাই নিয়ে রঙ্গপুরে গিয়ে তিনদিন গান করতে হল, তারপর থেকে এই দশা।”
শেষ পর্যন্ত রুগ্ন অবস্থায় কবিকে কলকাতা, কাশীতে চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু কোন ফল না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোগাক্রান্ত কবি রজনীকান্তকে দেখে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে লিখেছিলেন, “প্রীতিপূর্বক নমস্কারপূর্বক নিবেদন, সেদিন আপনার রোগশয্যার পাশে বসিয়া মানবাত্মার একটি জ্যোতির্ময় প্রকাশ দেখিয়া আসিয়াছি। ঃ.শরীর হার মানিয়াছে, কিন্তু চিত্তকে পরাভূত করিতে পারে নাইণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আরাম ও আশা ধূলিসাৎ হইয়াছে, কিন্তু ভূমার প্রতি ভক্তি ও বিশ্বাসকে ম্লান করিতে পারে নাই।ঃ আপনি যে গানটি পাঠাইয়াছেন, তাহা শিরোধার্য করিয়া লইলাম।”
কবি রোগাশয্যায় মেডিকেলে থেকেও বহু গীতি কবিতা লিখেছেন। রোগ শয্যায় তিনি পুত্র শচীনের বিবাহ সম্পন্ন করেন। তাঁর মহাপ্রয়াণের পর আরো পাঁচটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯১০ সালে “আনন্দময়ী”। এটি আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতের সংকলন। ওই বছরই প্রকাশিত হয় “বিশ্রাম” ও “অভয়া” (কাব্য)। “সদ্ভাব কুসুম” (নীতি কবিতা) ১৯১৩ সালে এবং “শেষ দান” (কাব্য) প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। শেষ দান কাব্যটি কবির জীবনের শেষ কাব্য। এই কাব্যের কবিতাগুলো কবি হাসপাতালের রোগ শয্যায় নির্বাক জীবনে লেখেন।
মোহাম্মদ জুলফিকার
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক, জুলাই ২৪, ২০০৯
ভালো লাগলো, তবে শেষের দিকটা খুবই মর্মাহত । এমনটা আশা করছিলাম না ।
ভালো লাগলো, তবে শেষের দিকটা খুবই মর্মাহত । এমনটা আশা করিনি ।